দিব্যজ্যোতি মজুমদার
সে অনেককাল আগের কথা। এক বনে দুই বন্ধু ছিল। তাদের একজন শুয়োর আর অন্যজন ছিল কচ্ছপ। দুজনের খুব মনের মিল। কেউ কারও কাছে কোন কথা লুকিয়ে রাখতে পারে না। সব কথাই দুজনে দুজনের কাছে মন খুলে বলত।
এমনি করে দিন যায়। একদিন কচ্ছপ মন ভারি করে শুয়োরের কাছে গেল। তার মুখখানা শুখনো দেখে শুয়োর কেমন মুষড়ে গেল। আমতা আমতা করে সে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার ভাই কচ্ছপ? তোমার শরীর-মন ভালো নেই বুঝি?
কচ্ছপ দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে আধবোজা চোখে বলল, আমি একেবারে ভেঙে পড়েছি ভাই। ছেলে-বউকে খাওয়ানোর মতো সামান্য পয়সাও হাতে নেই। কি যে করি?
‘এই ব্যাপার? বলেই শুয়োর ঠোঁটের ফাঁকে একটু হেসে নিয়ে আবার বলল, কিছু ভেবো না। কয়েকদিন আগে আমি কিছু টাকা পেয়েছি। এখন খরচ করার মতো কিছু নেই। তাই তুমি সেটা নিয়ে নাও ভাই, তোমার উপকার হবে।
কচ্ছপ কিন্তু আরও দীর্ঘনিশ্বাঃস ছেড়ে দুঃখের সঙ্গে বলল, তোমার হয়ত ওই টাকাটার দরকার নেই এখন। কিন্তু কালই হতে পারে।
কি যে তুমি বল ভাই। বিপদের সময় বন্ধুকে যদি সাহায্য করতে না পারলাম, তবে আর বন্ধুত্ব কিসের? তুমি আমার বিপদেও এইভাবেই সাহায্য করবে। কি, করবে না? শুয়োর বলল।
এ অবশ্য তুমি ঠিকই বলেছ বন্ধু। কচ্ছপ মাথা ঝাঁকাল।
`আমি আর তোমায় দেরি করে দেব না,’বলেই শুয়ের তার শোবার ঘরে চলে গেল। ঘরের কোণায় এক গোপন গর্ত থেকে সে কিছু টাকা বের করে গুনল। অর্ধেকটা নিয়ে বাকি অর্ধেকটা গর্তে রেখে গর্তের মুখ বন্ধ করে ফিরে এল কচ্ছপের কাছে।
এই নাও ভাই কচ্ছপ। টাকাগুলো সে তুলে দিল কচ্ছপের হাতে। কয়েক ফোঁটা চোখের জল ফেলে কচ্ছপ বলল, তোমায় ধন্যবাদ! তুমি যে আমার কি উপকার করলে।
ভুলে যাও ওসব কথা। আমি তোমায় সাহায্য করতে পেরেই আনন্দিত।
এ টাকা আমি তোমায় পনেরো দিনের মধ্যেই ফেরত দেব। আর যদি খুব দেরি হয় তবে একুশ দিন। তুমি কিন্তু কিছু মনে করো না ভাই।
তাড়াতাড়ির কোন দরকার নেই। যখন তোমার সুবিধে হবে তখন দিও। তোমায় আমি বিশ্বাস করি, তুমি যে আমার বন্ধু।
শুয়োরভাই, তোমার নজর খুব উঁচু। তুমি বড়ই দয়ালু। তোমার মতন এত ভালো মন আমি আর কোথাও দেখিনি। ধরা গলায় একথা বলে কচ্ছপ বিদায় নিল।
এদিকে টাকা নিয়ে যাওয়ার পর কচ্ছপের আর দেখা নেই। সে এ পথে আর হাঁটেই না। একমাস যায়, দুমাস যায়। কিন্তু কচ্ছপের কাছ থেকে কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। সে এখন শুয়োরকে পারতপক্ষে এড়িয়ে চলতে চায়।
একদিন একটা কাজে শুয়োর গিয়েছে দূরে। ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেল। ক্লান্ত পায়ে সে যখন বাড়িতে ঢুকছে, তখন বউ তাকে দেখে প্রায় কেঁদেই ফেলল। তাকে দেখে শুয়োরের যেন কেমন মনে হল।
হস্তদন্ত হয়ে সে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?
‘ওগো আমাদের সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। এবার সে ঝরঝর করে কেঁদেই ফেলল। কোন কথা না বলে শুয়োরের বউ সোজা তাকে ঘরের কোণে সেই গর্তের কাছে নিয়ে গেল যেখানে শুয়োর টাকাগুলো রেখেছিল।
আমাদের টাকাগুলো সব চুরি হয়ে গিয়েছে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে বলল।
‘চুরি গেছে। অবাক হয়ে গেল শুয়োর। আর কোন কথা বেরুল না তার মুখ থেকে। কেননা, সে ভেবেছিল সে ছাড়া আর কেউ ও গর্তের খবর জানে না।
আমাদের সব টাকা চুরি হয়ে গেল।’
‘আমাদের টাকা মানে।’
‘হ্যাঁ, গো, আমাদের দুজনের টাকা। আমি মাঝে মাঝেই এর মধ্যে সামান্য করে টাকা রাখতাম। তোমার আসার আগে আমি গুনতে গেলাম কেমন জমছে আমাদের টাকা। গিয়ে দেখি অর্ধেকটা চুরি হয়ে গিয়েছে। তুমি নিশ্চয়ই চোরকে ধরতে পারবে।
‘ও, অর্ধেকটা, তাই বল! আমার তো হয়ে এসেছিল তোমার কথা শুনে। ওটা চুরি হয়নি বউ ; শুয়োর নিঃশ্বাস ফেলে বলল।
‘তাহলে, টাকাগুলো কি হল? শুয়োরের বউ চিৎকার করে উঠল।
রেগে গিয়ে শুয়োর বলল, শোন, টাকা আমার, আর তাই আমার যা ইচ্ছে তাই করব। তোমার নাক গলাতে হবে না।
আমার টাকার অংশও তুমি নিয়েছ। তাই আমার জানার অধিকার আছে। কাকে তুমি টাকা দিয়েছ?
‘আমি কাউকেই টাকা দিই নি। শুধু এক বন্ধুকে তার বিপদে সাহায্য করেছি। সে খুব সৎ লোক, শিগগিরই টাকা ফেরৎ দেবে। শুয়োর বেশ জোরের সঙ্গে বলে উঠল।
তুমি ও টাকা আর ফেরৎ পাবে না। ঝাঁঝের সঙ্গে বলল বউ।
‘আমি টাকা ফেরৎ পাবই। বন্ধু কচ্ছপ কখনও আমাকে ফাঁকি দেবে না।
‘হুঃ, তোমার হাতে যখন ফেরৎ-দেওয়া টাকা আমি দেখব, তখনই শুধু বিশ্বাস করব। তার আগে নয়।
বেশ। শিগগির তুমি তা দেখতে পাবে। সেই শিগগির-ই তোমার কবে হবে শুনি? শুয়োরের চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে বউ জিজ্ঞেস করল।
‘এরই মধ্যে একদিন।’
‘ও একটা কথা।’ হঠাৎ কিছু মনে পড়েছে এইভাবে শুয়োরের বউ বলল, আচ্ছা, তুমি কতদিন আগে তোমার বন্ধুকে টাকা ধার দিয়েছ বলতো।
মানে, এই– তো কযেকদিন আগে। শুয়োর সত্যি কথাটা ভয়ে বলতে পারল না।
কিন্তু অত সহজে ভুলবার পাত্রী শুয়োরের বউ নয়। সে বলে বসল, ‘তোমার বন্ধু কচ্ছপকে তো আমি দুমাস আগে একবার এধারে দেখেছিলাম। তারপরে আর তো সে এমুখো হয়নি।
‘বাইরে তার সঙ্গে আমার প্রায়ই দেখা হয়। তার এখন সময়টা খুব ভালো যাচ্ছে না। নইলে – থেমে গেল শুয়োর তার বউয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে।
‘তাই বুঝি? বউ চোখ ঘুরিয়ে বলল।
শুয়োর গেল ক্ষেপে, আচ্ছা মুশকিল, ব্যাপারখানা কি বলতো?
‘আমি কালকে বাজারে গিয়ে কচ্ছপের বউকে দেখতে পেয়েছি। সে জলের মতো টাকা খরচ করছে। এটা কিনছে, ওটা কিনছে, সেটা কিনছে?
এবার সত্যি সত্যি শুয়োরের অবাক হওয়ার পালা।
‘তাই বুঝি? কচ্ছপ তাহলে টাকা পেয়েছে। সে যদি টাকা পেয়ে থাকে, নিশ্চয়ই আমাকে টাকা দিয়ে যাবে। তার কাছে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। সেই ঠিকসময়ে আমার কাছে আসবে টাকা ফেরৎ দিতে।
কিন্তু অবাক হল শুয়োর। সেইদিন কিংবা তার পরের দিনও কচ্ছপ এল না। তৃতীয় দিনে শুয়োর বেশ ঘাবড়ে গেল। সে ঠিক করল আজই সে কচ্ছপের সঙ্গে দেখা করবে। এই ভেবে সে রওনা দিল কচ্ছপের বাড়িমুখো।
এদিকে দূর থেকেই গাছের ফাঁক দিয়ে কচ্ছপ দেখতে পেল, দ্রুতপায়ে শুয়োর আসছে তারই বাড়ির দিকে। সবই বুঝল সে। বউকে ডেকে তাই বলল, শুয়োরবেটা এই ধারেই আসছে। আমি ওর সঙ্গে মোটেই দেখা করতে চাই না।
‘ওটা তুমি আমার ওপরেই ছেড়ে দাও। দেখ না, কি করি।’ কচ্ছপের বউ বলে উঠল।
অল্পক্ষণের মধ্যেই কচ্ছপের বউ ফিরিয়ে দিল শুয়োরকে। শুয়োর বাড়ি ফিরে এসে তার বউকে কোন কথাই বলল না।
দুদিন পরে আবার এল শুয়োর। এবারও সে শুনল কচ্ছপ বাড়িতে নেই, বাইরে গিয়েছে জরুরি কাজে। তার কেমন সন্দেহ হল, কচ্ছপের বউ বোধহয় সত্যি কথা বলছে না।
আচ্ছা, কখন এলে কচ্ছপের দেখা মিলবে? মনের সন্দেহ চেপে রেখে শুয়োর জিজ্ঞেস করল।
‘সেটা বলা খুবই মুশকিল। সে ইচ্ছেমতো যাওয়া-আসা করে আজকাল।
‘আপনি কি তাকে বলেছিলেন যে, আমি সেদিন তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম?
‘হ্যা, তাকে আমি বলেছিলাম আপনার আসবার কথা। আপনার সঙ্গে দেখা না হওয়াতে তিনি খুব দুঃখ করলেন। আপনি যদি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন, তবে তার দেখা পেতে পারেন। এরই মধ্যে তিনি এসে পড়বেন মনে হচ্ছে,’ কচ্ছপের বউ গাছের ফাঁক দিয়ে দূরে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল যেন এখনি কচ্ছপ এসে পড়বে।
এটাও কিন্তু তার মিথ্যে কথা। আশায় ভর করে শুয়োর জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আমি কখন তাকে পেতে পারি?
‘আমি ঠিক বলতে পারি না। তিনি আজকাল যখন-তখন আসেন আর বাইরে বেরিয়ে যান যে সঠিক করে কিছু বলা কঠিন।
শুয়োর সেখান থেকে ধীরে ধীরে চলে এল। পথে হাঁটতে হাঁটতে সে ভাবতে লাগল, কচ্ছপ ঠিক যেন বন্ধুর মতো ব্যবহার করছে না। সে বাড়িতে গিয়ে এবার বউকে বলল, দেখ, আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে, আমার টাকাটা হয়তো আমি আর ফেরৎ পাব না।
‘কিন্তু ওটা যে আমাদের টাকা?
‘কচ্ছপের এই ব্যবহার আমি ভাবতেই পারিনি। সে আমার এত বন্ধু।’
‘যে আদৌ বন্ধু নয়, তাকে যদি হারাতে চাও তাহলে সমান্য টাকা ধার দিলেই যথেষ্ট। সে আর তোমার ঘরমুখো হবে না।’
তুমি ঠিকই বলেছ বউ। তোমার কথাই ফলল। তুমি প্রথমেই আমাকে একথা বলেছিলে। আমি তখন বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আমি টাকা ফেরৎ আনবই, নইলে আমার নাম শুয়োর-ই না।
‘আমি তোমার কথা শুনে খুবই খুশি হলাম। তুমি যত তাড়াতাড়ি একাজ করবে, ততই মঙ্গল। শুয়োরের বউ ঘরের কাজে মন দিল।
সেদিন ভাগ্য ভালো। হঠাৎ দেখা হয়ে গেল কচ্ছপের সঙ্গে।
‘তুমি কেমন আছ ভাই কচ্ছপ?’ শুয়োর মনের রাগ চেপে রেখে বাইরে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল।
‘খুব ভালো ভাই, খুব ভালো। কিন্তু আজকাল বড্ড ব্যস্ত আমি। বাড়িতে একেবারে থাকতে পারি না ভাই। বউ বলেছিল, তুমি কয়েকবার গিয়েছ আমার সঙ্গে দেখা করতে।
‘কয়েকবার নয়, মাত্র দুবার। শুয়োর উত্তর দিল।
কচ্ছপ বলল, আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু এত ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম যে আর যেতেই পারি নি। হ্যাঁ, একটা কথা। সেই সামান্য ব্যাপারটা আমি একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম।
শুয়োর মাথা নাড়ল, হাসল। তারপর বলল, আমি বড় ঝামেলায় পড়েছি। আমার বউও ব্যাপারটা জেনে ফেলেছে। আর তুমি তো জানই মেয়েরা কি ধরনের হয়।
যাকগে ঘাবড়িয়ো না ভাই। আমি সব ব্যবস্থা করছি। আচ্ছা, তুমি কাল সন্ধের সময় আসতে পারবে? কোন অসুবিধা হবে না তো?
‘না না অসুবিধার কি আছে? আমি নিশ্চয়ই আসব।’
‘খুব ভালো হল। আমি সব ব্যবস্থা করে রাখব।’ মিষ্টি সুরে কচ্ছপ বলে ওঠে।
শুয়োর আনন্দে অন্য সবকিছু ভুলে গেল। বাড়ি গিয়ে সে বউকে সব জানাল।
‘আমি যদি তুমি হতাম, তাহলে আরও আগে তার কাছে যেতাম টাকা আদায় করতে। সমস্ত কিছু শুনে শুয়োরের বউ উত্তর দিল।
যাইহোক, সন্ধে লাগার আগেই শুয়োর বাড়ি থেকে রওনা দিল। তাকে আসতে দেখে কচ্ছপের বউ দৌড়ে গিয়ে স্বামীকে খবর দিল। অল্পক্ষণের জন্য কচ্ছপ কি যেন ভাবল, ঘরের চারিদিকে চেয়ে দেখল, তারপর তাদের শোবার ঘরের মধ্যে যে ঝুড়িটা ছিল তার দিকে আঙুল দেখিয়ে সে বলল, আমি ওর মধ্যে লুকোচ্ছি।
‘কেন?’
‘এখন খুলে বলার সময় নেই। শুধু সে চলে যাওয়া পর্যন্ত তুমি তার সঙ্গে কথা বলতে থাকো। কিন্তু কখনও যেন সে বুঝতে না পারে, তুমি তাকে তাড়াতে চাইছ। মনে থাকবে তো?’
‘আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করব। খুব খুশি না হয়েই বউ জবাব দিল।’
‘তোমাকে করতেই হবে।’ এই আদেশ দিয়ে কচ্ছপ ঝুড়ির মধ্যে ঢুকে বলল, ‘আমাকে ঠিক করে কাপড়-চোপড় দিয়ে ঢেকে দাও।
কচ্ছপের বউ তাকে এমনভাবে ঢেকে দিল যাতে সে নিঃশ্বাসটুকু শুধু নিতে পারে। একটু পরেই শুয়োরের দরজা নাড়ার আওয়াজ পাওয়া গেল।
আদর করে বউ তাকে ঘরে ডেকে আনল। ‘আপনি ভালো আছেন তো?’ সে শুয়োরকে জিজ্ঞেস করল।
‘ভালোই। কচ্ছপ বাড়ি আছে তো?’ শুয়োর জিজ্ঞেস করল। কিছু মনে করবেন না, আমি একটু আগেই চলে এসেছি।
‘আপনি কি কিছুক্ষণ বসবেন না?’ খুব বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করল কচ্ছপের বউ।
‘হ্যা, বসব।’
তারা দুজন এবার বসল। শুয়োর চেষ্টা করতে লাগল যাতে কচ্ছপের বউ কথাবার্তা বলে, কিন্তু কচ্ছপের বউ কোন কথাই বলছে না। আরও কিছুক্ষণ পরে শুয়োর অস্থির হয়ে পড়ল।
‘কালকে আপনার স্বামীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সে আমাকে আজ সন্ধেবেলা আসতে বলেছিল।’
আমাকে সে এসব কোন কথাই বলে নি। পরিষ্কারভাবে বৃঢ় গলায় কচ্ছপের বউ একথা জানাল।
এই ধরনের উত্তর কিন্তু শুয়োরের মোটেই ভালো লাগল না।
‘ওঃ! শুয়োর বলে উঠল, ‘কচ্ছপ কি এই গায়ের বাইরে কোন কাজে গিয়েছে?’
‘তা আমি কি করে জানব?
‘শ্রীমতী কচ্ছপ আপনি ঠিক কথা বলছেন না। আমার তাই মনে হচ্ছে।
‘আমি। আঁৎকে উঠল কচ্ছপ-গৃহিণী।’
‘আপনার স্বামী কি ভেতরেই আছেন?’ শুয়োরের জিজ্ঞাসায় কচ্ছপের বউ মুখে কেমন শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
‘আপনি আমাকে কোন কথা বলবেন না জানি, তাহলে, আমিই নিজে দেখি কোথায় কচ্ছপ। রেগে ঘোঁৎ ঘোৎ করে উঠল শুয়োর।
সে উঠে শোবার ঘরের দিকে যাওয়ার জন্য এগিয়ে গেল। কিন্তু দরজার কাছে তার পথ আটকে দাঁড়াল শ্রীমতী কচ্ছপ।
‘আপনি ভেতরে যেতে পারবেন না।’
‘সে কোথাও লুকিয়ে নেই। সে বাইরে গিয়েছে কাজে।
‘আপনি কি আমায় কচি ছেলে পেয়েছেন যে, যা বলবেন তাই বিশ্বাস করব? যদি আপনি সত্যি কথাই বলছেন তাহলে আমাকে ভেতরে যেতে দিতে আপনার এত আপত্তি কেন?
‘আমাকে না মেরে আপনি ঘরে যেতে পারবেন না। তীক্ষস্বরে কচ্ছপের বউ জানাল’।
শুয়োরের তখন ধৈর্যের সীমা পার হয়ে গিয়েছে। রাগে কাপতে কাঁপতে সে বলল, ‘আমি এক-দুই-তিন গুনব, এর মধ্যে আপনি যদি পথ থেকে সরে না যান তবে যা ঘটবে তার জন্য আপনাকেই পস্তাতে হবে।
ঠিক আছে, আপনার যা ইচ্ছে আপনি করতে পারেন। শান্তভাবে জবাব দিল কচ্ছপের বউ।
‘এক-দুই-তিন। আপনি আমার পথ ছাড়বেন?’
কচ্ছপের বউ সেইভাবেই দাড়িয়ে রইল, শুয়োর ছুটে এসে মারল প্রচণ্ড এক গুতো। কিন্তু ঠিক সময়ে হঠাৎ ফট করে সরে গেল কচ্ছপের বউ আর সোজা ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল শুয়োর। হাওয়ার বেগে। ঢুকেই সে গুতো খেল সেই ঝুড়িটার সঙ্গে। রাগে সে ঝুড়িটাকে তুলে ঘরের বাইরে এনে টেনে ফেলে দিল দূরে। তারপর আবার ঢুকল শোবার ঘরে। সে পই পই করে সবদিক খুঁজল, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না।
যখন সে বাইরে বেরিয়ে এল, তখন যা-নয়-তাই বলে কচ্ছপের বউ তাকে বকতে লাগল। সেও ক্ষেপে ছিল, গলা চড়িয়ে সেও দিল গালাগালি। দুজনের মধ্যে রীতিমত ঝগড়া বেধে গেল।
এদিকে দুজনের মধ্যে যখন প্রচণ্ড বচসা হচ্ছে, তখন কচ্ছপ ঝুড়ি থেকে গুটি গুটি বের হয়ে বাড়ির দিকে এল।
এখানে সব হচ্ছেটা কি? গোলমালকে ছাড়িয়ে সে চিৎকার করে উঠল। হঠাৎ তাদের ঝগড়া গেল থেমে। তারপর কচ্ছপের বউ সব ঘটনা কচ্ছপকে খুলে বলল। আর সমস্ত দোষ চাপাল নিরীহ শুয়োরের ওপর।
‘তোমার কিছু বলার আছে শুয়োর?’ কচ্ছপ জিজ্ঞেস করল।
‘আমি খুব দুঃখিত, আমি আমার ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছিলাম। খুব বিনীতভাবে শুয়োর জানাল ‘
আশ্চর্য! আমি ভাবতে পারিনি বন্ধু, তুমি এই ব্যবহার করবে। আমি ভাবতাম তুমি আমার প্রাণের বন্ধু। বাঃ! ওঃ ভাই, আজকে আমি জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাতটি পেলাম। দুঃখের ভান করল কচ্ছপ।
‘আমায় ভাই তুমি ক্ষমা করো। উপহাস করে রেগে কচ্ছপের বউ বলল, ‘জানেন, আপনি আমার ঝুড়ি ভেঙে ফেলেছেন?’ তারপর স্বামীর দিকে চেয়ে বলল, সেই যে আমার শিল-পাটা, তুমি তো জান, তাতে আমি পেয়াজ টমাটো আর লঙ্কা বাটতাম। ভেঙে ফেলেছে। তোমার বন্ধু শুয়োর ঝুড়ির সঙ্গে ওটাও বাইরে ফেলে দিয়েছে।
‘তাই নাকি শুয়োর ভাই?’
‘আমি একই সঙ্গে বোধহয় ও দুটোকে ফেলে দিয়েছি। এই বলে শুয়োর বাইরে গিয়ে ঝুড়িটা নিয়ে এল কিন্তু শিল-পাটা কোথাও দেখতে পেল না।
‘আমার বউ-এর শিল-পাটা কোথায়? ওটা তো আমি দেখতে পেলাম না। আচ্ছা, আমি আবার খুঁজে আসছি। এবারও খালি হাতে ফিরে এল শুয়োর। যতক্ষণ না তুমি ওই শিল-পাটা খুঁজে পাচ্ছ, ততক্ষণ তোমার টাকা কিছুতেই শোধ করব না আমি, তা বলে রাখছি কিন্তু। এতক্ষণে কচ্ছপ তার রূপ প্রকাশ করল।
‘বেশ আমি ওটা খুঁজছি। দেখো শুয়োর, আমার সঙ্গে চালাকি করতে এসো না। আমি আমার বউ-এর সেই শিল-পাটা চাই, অন্য কোনটা আনলে চলবে না। এ আমি তোমায় স্পষ্টই বলে দিচ্ছি।’
ওপরে-নীচে আশে-পাশে সব জায়গায় বন্ধু শুয়োর সেই হারিয়ে-যাওয়া শিলপাটাটি খুঁজল, কিন্তু কোথাও সেটা সে পেল না। কেননা, শিল-পাটাটি ছিল ঝুড়ির মধ্যে লুকিয়ে থাকা কচ্ছপ নিজেই।
তাই আজও শুয়োরকে নাক দিয়ে মাটি খুঁড়তে দেখা যায়। সেইদিন থেকে মাটি খুঁড়ে সে শ্রীমতী কচ্ছপের শিল-পাটা খুঁজছে। আজও সে খুঁজেই চলেছে, এখনও পায়নি। যেমন ফেরৎ পায়নি সেই টাকা অকৃতজ্ঞ কচ্ছপের কাছ থেকে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন