নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পূর্ব-মুহূর্তে কৌরব এবং পাণ্ডবদের সৈন্যবাহিনীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রবল-পরাক্রান্ত অর্জুন কীভাবে চোখের জল ফেলেছিলেন—তা আমরা সবাই জানি। আমরা আর একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে এই করুণ অশ্রুবিন্দুপাতের অনেকগুলি কণিকাই অধিকার করেছেন অর্জুনের শ্বশুর এবং শ্যালকেরা। জামাই-বাবাজিদের ওপর কলিযুগের গুরুস্থানীয় শ্বশুর-শাশুড়িদের প্রভাব নিয়ে আর আমরা আলোচনা করতে চাই না কেননা এ চিত্র এখনও যেমন সে যুগেও তেমনই; বিশেষত রবীন্দ্রনাথের বউঠাকুরাণীর হাটে ”রমাই মুখভঙ্গি করিয়া কহিল, ”অসারং খলু সংসারং সারং শ্বশুর মন্দিরম’। কথাটা মিথ্যে নহে। শ্বশুরমন্দিরের সকলই সার—আহারটা, সমাদরটা, দুধের সরটি পাওয়া যায়, মাছের মুড়োটি পাওয়া যায়, সকলই সার পদার্থ, কেবল সর্বাপেক্ষা অসার ওই স্ত্রীটা।”
পরাশর মুনি তো মনের মতো করে আমাদের অভিশাপ দিলেন যে কলিকালে নাকি ‘শ্যালক এবং যাদের স্ত্রী অতিশয় সুন্দরী তারাই শুধু বন্ধু হবে’। এই ঋষিবাক্যের সত্যতা অথবা পক্ষপাতিত্ব যাচাই করতে হলে, চলে যেতে হবে একেবারে সেই ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রেই। অর্জুনের বিষাদযোগ তখনও আরম্ভ হয়নি। দু-পক্ষের সৈন্যসমাবেশ দেখে দুর্যোধন কেবলই এসেছেন দ্রোণের কাছে, আচার্য অস্ত্রগুরু বলে কথা। বললেন—দেখুন, পাণ্ডবদের মহতী সৈন্যবাহিনী কেমন দলে উপদলে, সামনে পেছনে ব্যূহরচনা করে সাজানো হয়েছে। আর এই ব্যূহরচনা কে করেছে জানেন? সে হল আপনার বুদ্ধিমান শিষ্য দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন।
দুর্যোধনের এই বক্তব্যের মধ্যে কোনো প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত আছে কিনা জানি না, তবে পাণ্ডব-পক্ষের পঞ্চভ্রাতার শৌর্য-বীর্য বিশ্লেষণ করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় ঠিকই। যুদ্ধবিগ্রহের ব্যাপারে নকুল-সহদেবকে আমরা ছেলেমানুষ মনে করি। মাত্রাতিরিক্ত ধর্মবুদ্ধির জন্য যুধিষ্ঠিরকেও না হয় বাদ দেওয়া যায়। কিন্তু ভীম—তাঁকেও না হয় ছেড়ে দিলাম। নিজের লৌহ-কঠিন হাত-দুটির ওপরেই তাঁর এত বেশি আস্থা ছিল যে ওসব ব্যূহ-টুহ সাজানোর বিলাসিতা তাঁর ছিল না—এ খবর আমরা পেয়েছি ভাসের পঞ্চরাত্র নাটকে। কাজেই অবধারিতভাবে যে ধীরোদাত্ত নায়কটির কথা মনে আসে তিনি হলেন অর্জুন। কিন্তু তিনি থাকতেও কুরুক্ষেত্রের মতো সাংঘাতিক যুদ্ধে ব্যূহরচনার সমস্ত ভার দেওয়া হয়েছে—দ্রৌপদীর ভাই ধৃষ্টদ্যুম্নকে। যে দুরূহ সৌভাগ্যবলে ধৃষ্টদ্যুম্নকে এত বড় পদাধিকার দেওয়া হয়েছিল—তার কারণ নিশ্চয়ই যুদ্ধবিদ্যায় তাঁর অসামান্য পারদর্শিতা নয়, তা যদি হত—তাহলে আগেই তার প্রমাণ কিছু মিলতই। তার থেকে সহজে স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে—একটি নয়, দুটি নয় পাঁচ ভাইয়ের একটিমাত্র শালা—তাঁর ওপরে নির্ভরতা না থাকলে অন্তঃপুরে অগ্রাধিকার পাওয়া মুশকিল।
আসল কথা বউদের মন পেতে হলে শালাবাবুদের মন পেতেই হবে। সেক্ষেত্রে জামাইবাবুর মই বেয়ে শালাবাবুরা হঠাৎ করেই কখনো হর্তা-কর্তা হয়ে বসেন, কখনো বা অপকর্মও করে বসেন কিছু। জামাইবাবুর মানসিক গতি এবং শালাবাবুর পদোন্নতি—এইসব কিছুরই ‘সোনিক রিমোট কন্ট্রোল’ চালান একটি মহিলা যিনি প্রথমজনের স্ত্রী, অপরজনের ভগিনী। এই পদ্ধতির সঠিক মহা-ভারতীয় প্রয়োগ পাওয়া যায় বিরাটপর্বে। মহারাজ বিরাটের শালার নাম কীচক—সেই সুবাদেই সে রাজ্যের সেনাপতি। কিন্তু নিরামিষ সেনাপতিত্বে মন ভরে না, কাজেই সে প্রেম নিবেদন করে বসল পঞ্চস্বামি-গর্বিতা দ্রৌপদীর কাছে। তার প্রেম নিবেদনের ভাষাটি এমনই চড়া সুরে বাঁধা যে সেখানে কীচকের ভাবাবেশের থেকেও বড় হয়ে উঠেছে তার বলদর্পিতা—অহংকৃতি। সে তার নিয়োগকর্তা বিরাটের ধার ধারে না, দ্রৌপদীকে বলল—সুন্দরী, আমি এই সমস্ত রাজ্যের অধীশ্বর এবং আমার সমকক্ষ ব্যক্তি আর একটিও নেই। আমাকে ভজনা করলে এই সমস্ত রাজ্য আমি তোমাকেই দেব। মহারাজ বিরাটের মূলচ্ছেদী এই প্রেম, যাতে নির্জনে পরিপাক লাভ করে—তার জন্য সুরা আহরণের ছলে কীচকের বাড়িতে দ্রৌপদীকে পাঠিয়ে, সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে বিরাটমহিষী সুদেষ্ণা! দ্রৌপদী প্রকাশ্য রাজসভায় বিরাটের কাছে জানিয়েছিলেন তাঁর শ্যালকের দুরভিসন্ধির কথা। কিন্তু তার জন্য উলটে কীচকের পদাঘাত সহ্য করতে হয়েছিল দ্রৌপদীকেই—শালাবাবুর প্রতাপে সন্ত্রস্ত রাজা, সেদিন এর কোনো বিচার তো করেনইনি, বরঞ্চ চোখ বুজে বসেছিলেন। এমনকী কীচকের মৃত্যুর পর কীচকের ভাইরা যখন দ্রৌপদীকে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নিল, মহাভারত সেখানে টিপ্পনী করেছে—উপকীচকদের বলবিক্রম জেনে রাজা নির্দ্বিধায় তাদের মত মেনে নিলেন। বিরাটরাজ্যে তাঁর শালাদের প্রতাপ কীরকম ছিল তা বোঝা যাবে বাণভট্টের একটি উপমায়—বিরাটনগরী ইব কীচকশতাবৃতা—যেন বিরাটের রাজধানী, যেখানে ছিল একশো কীচকেরা। অর্থাৎ বিরাটের রাজধানীর সঙ্গে কীচকদের নাম এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে যে তাদের নাম না করলে যেন বিরাটের রাজধানীকে চেনাই যায় না।
গীতাশাস্ত্রে পাঁচ ভাইয়ের এক শালার অহেতুক ক্ষমতা তথা বিরাটপর্বে কীচকদের অপকীর্তি আমাদের স্মৃতিশাস্ত্রকারেরা বিলক্ষণ জানতেন। তবুও তাঁরা নির্দেশ দিলেন—শ্রাদ্ধের সময় গীতা এবং বিরাটপর্ব পাঠ করার। ‘আকাশস্থ নিরালম্ব’ অবস্থায় সূক্ষ্মদেহে যে প্রেতপুরুষ এই গীতা বা বিরাটপর্ব শ্রবণ করবেন, পরজন্ম সত্য হলে, আমাদের ধারণা, সেই প্রেতপুরুষ আবার দেহধারণ করে শ্যালকদের বশীভূত হবেনই।
শ্যালক চরিত্রের যে সর্বগ্রাসিতার উদাহরণ আমরা মহাভারতের বিরাটপর্বে পেয়েছি, তাই চলে এসেছে এতকাল ধরে। এই বৈশিষ্ট্য এমনই যে কবিগুরুর কবিদৃষ্টিতেও এর ছায়া পড়েছে। তাঁর ‘রাজা ও রানী’তে জালন্ধরের স্ত্রীবিলাসী রাজা বিক্রমদেবের ললিত-বিক্রমের সুযোগ নিয়ে—
রানীর কুটুম্ব যত বিদেশী কাশ্মীরী
দেশ জুড়ে বসিয়াছে। রাজার প্রতাপ
ভাগ করে লইয়াছে খণ্ড খণ্ড করি,
বিষ্ণুচক্রে ছিন্ন মৃত সতীদেহ সম।
যদি বলা যায় এরা রানীর আপন ভাই কিংবা রাজার আপন শালা কুমারসেন নয়, তবু কিন্তু রানী আর দেবদত্তের সংলাপটি মনে রাখার মতো। রানী বললেন—বিদেশী! কে তারা? তবে, আমার আত্মীয়?
দেবদত্ত—রানীর আত্মীয় তারা প্রজার মাতুল,
যেমন মাতুল কংস, মামা কালনেমি।
প্রজার মাতুলদের রাজার শালা হিসেবে বেশি করে চিনিয়ে দিতে হবে কি?
মনে রাখা দরকার আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেও শ্বশুর-শ্যালকদের বাড়িতে ঘনঘন যাতায়াত, মামাবাড়িতে থাকা—এসব খুব স্নিগ্ধদৃষ্টিতে দেখা হত না। কিন্তু সেই হাজার হাজার বছর আগেও দশরথের পুত্র ভরত প্রায় মামাবাড়িতেই মানুষ, এমনকি রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেক পর্বেও তিনি অনুপস্থিত। কৈকেয়ীকে প্ররোচিত করার সময় মন্থরা একটি সত্যভাষণ করে বলেছে—তুমি এমনই বুদ্ধিহীনা যে ভরতকে বাল্যকাল থেকেই মামাবাড়িতে রেখে দিয়েছ—’বাল এব তু মাতুল্যং ভরতো নায়িতস্ত্বয়া’। এই নজির কি বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা কৈকেয়ীর ভ্রাতৃমহিমায় না রাজার স্বমহিমায়। মহাভারতের যুদ্ধঘটনায় যদি ধৃতরাষ্ট্রের শ্যালক শকুনির নাম করি, তাহলে পক্ষপাতের প্রশ্ন আসতে পারে কিন্তু সে দোষ আমরা কাটিয়ে উঠব যদি একজনের নাম করি—তিনি হলেন অর্জুনের শ্যালক—’বেলাভ তাম্রফলক’ খুব ছোট্ট করে যাঁর উপাধি দিয়েছে ‘মহাভারত-সূত্রধারঃ,/গোপিশত-কেলিকারঃ।’ বাস্তবিকই মহাভারতের ছোট-বড় সমস্ত ঘটনায় এই শালা না থাকলে পাণ্ডবেরা কিছুই করতে পারতেন না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইনি আবার একাধারে দ্রৌপদীর ‘বয়ফ্রেন্ড’ও বটে। কেননা ভীমের পরাক্রম এবং অর্জুনের গাণ্ডীবকে ধিক্কার দিয়ে, দ্রৌপদী যাঁর ওপরে সমস্ত আস্থা রেখে বলেছেন—’আমি তোমার প্রিয়সখী’—তিনি হলেন কৃষ্ণ। মহাভারতের বিচিত্র ঘটনায় একথা প্রমাণিত যে পাণ্ডবদের সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়াও দ্রৌপদীর সঙ্গে কৃষ্ণের ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের নির্মল সম্পর্ক ছিল। অন্তত এই নিরিখে ”যাহাদের স্ত্রী সুন্দরী তাহারাই বন্ধু হইবে”—পরাশরের এই কথাটুকুর কিঞ্চিৎ আধুনিকীকরণ প্রয়োজন। চতুর্বেদী পরাশর মুনির কাছে বেদের উল্লেখ করা ধৃষ্টতা হবে কিনা জানি না, তবে—নিষ্কাশিত সোমরস দুধের সঙ্গে মিশিয়ে যখন কলসীর মধ্যে ভরা হচ্ছে, তখন প্রতর্দন ঋষির মনে এল একটি উপমা। তিনি বললেন—কোনো ব্যক্তি যেমন তার বন্ধুর প্রণয়িনীর দিকে ধাবিত হয়—’সখ্যু ন জামিম’, তেমনই সোমরসের ধারা প্রবেশ করছে কলসের ভেতর। এই উপমাটি জগৎ এবং জীবন থেকেই নেওয়া; তাছাড়া এই ছোট্ট উদ্ধৃতিটুকু তুলে ধরার কারণ এই নয় যে, আমরা কলির জীবেরা এমনতরই বটে কিংবা এইসব মহৎকর্মে আমরা কাউকে উদ্বুদ্ধ করতে চাই—এ শুধু বৃদ্ধ পরাশরকে একবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে, সুন্দরী স্ত্রীর অধিকারীকে বেছে বেছে বন্ধুত্বে বরণ করা—এটি সেযুগে যত স্বাভাবিক, এযুগে তত নয়।
আমাদের মূল বিষয় শ্যালকদের কথায়ই ফিরে আসি আবার। রামায়ণ-মহাভারতের সেইসব অসামান্য শ্যালকদের কথা বাদ দিলেও সাধারণ জীবনেও শ্যালকদের ছাড়া চলে না, যেমনটি চলত না সেদিনও। আমাদের জানতে বাকি নেই—সেই মনু-মহারাজের কালে শালা ছাড়া বিয়ে ছিল ভীষণ অলক্ষুণে। কালিদাসের কুমারসম্ভবে হিমালয়ের বর্ণনা, পার্বতীর রূপ বর্ণনা, রতি-বিলাপ—আরও কত কীই না আছে। সেখানে একটি মাত্র শ্লোকে শুধু বলা হল—হিমালয়ের মৈনাক নামে একটি পুত্র হল। অমনি টীকাকারেরা কোমর বেঁধে লেগে গেলেন আপাতত অপ্রাসঙ্গিক এই ছোট্ট শ্লোকটির সঙ্গতি খুঁজে বার করার জন্য। শেষপর্যন্ত জানা গেল—ভাই ছাড়া মেয়ে নাকি লক্ষ্মীমন্ত হয় না, তাই পার্বতীর সৌভাগ্য সূচনার জন্যই নাকি এই শ্লোকের প্রসঙ্গ। তর্কশাস্ত্রের অমোঘ নিয়মে শিবের সৌভাগ্যটিও কি স্বতঃসিদ্ধ নয়? ভাই ছাড়া কনে যদি অলক্ষুণে হয়, শালা ছাড়া জামাইবাবুও তেমনই অলক্ষুণে। দুনিয়ার জামাইদের সেক্ষেত্রে নিজেদের অস্তিত্ব এবং সৌভাগ্য বজায় রাখার জন্যই শালা নামক প্রজাতির সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করা প্রয়োজন। পরাশর মুনির কথা শুনে, গৃহস্থ শিবদের অকল্যাণ ডেকে আনা—মনুই বরদাস্ত করেননি, এযুগে নানা অনাচারের মধ্যে শালাহীন বিবাহ সেখানে নতুন অনাচারের সৃষ্টি করবে না তো?
শ্যালকদের সঙ্গে জামাইবাবুদের গোপন সম্পর্ক শুরু হয়ে যায় সেই কুশণ্ডিকার সময় থেকেই। পুরোহিত-দর্পণ খুললে দেখা যাবে কিংবা পিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নানা কর্ম-বৈচিত্র্যের মধ্যে একটা সময় আসবে যখন নববধূকে সামনে দাঁড় করিয়ে সলজ্জ ভুজবেষ্টনে বরকে হাতে নিতে হবে একটি কুলো। ‘অশ্মাভিক্রমণ’ শেষ করে, মানে নববধূকে সংসারধর্মে প্রস্তর-কঠিন সহ্যশক্তির উপদেশ দিয়ে বর যখন ঝুরঝুর করে খই ফেলছেন আগুনের ওপর, তখন কুলোর মধ্যে যিনি চারটি-চারটি করে খইয়ের জোগান দেবেন—নিয়মমতো তিনি কিন্তু বরের শালা, অন্তত পুরোহিত-দর্পণ মতে তাই। শ্যালক-সমক্ষে তারই দেওয়া খইসুদ্ধ কুলোর বাতাস বরের মনে কী যে রাসায়নিক ক্রিয়া করে বসে, সারাজীবন ধরে বরের আপন পিতা-মাতা শত বাৎসল্য-রস বিতরণ করেও সেই ক্রিয়ালোপ করতে পারেন না। ‘অশ্মেব ত্বং স্থিরা ভব’ কিংবা ‘লাজহোমে বিনিয়োগঃ’—ইত্যাদি নানা মন্ত্রঃপূত বিবাহ-হোমের ধূমাকুলিত দৃষ্টির মধ্যে শালার (আইন-মতে ভাই) প্রতি সেই যে মায়া সৃষ্টি হল, মায়াপারের মানুষ পরাশর মুনি তার বুঝবেন কি!
সমস্ত রসিকতা রেখে তটস্থ হয়ে বিচার করলে দেখা যাবে শ্যালকেরা সত্য ঐতিহাসিক চরিত্র। ভারতবর্ষের ইতিহাসে শ্যালকেরা বারবার ফিরে এসেছে অতুলনীয় ক্ষমতায়। অবশ্য সে ইতিহাস কলিযুগেরই—তবে সে কলি দ্বাপরের অব্যবহিত পরের কলি, কেননা বিষ্ণুপুরাণ মতে মগধবংশীয় নন্দের সময় থেকেই কলির আরম্ভ। যাঁর কথা আমরা বলতে চাই সেই প্রথম চন্দ্রগুপ্ত আর নন্দের থেকে কতদূরে, অর্থাৎ তখনও তার গা থেকে দ্বাপরের গন্ধ যায়নি। সেই প্রথম চন্দ্রগুপ্ত যিনি এতবড় ‘রাজাধিরাজ’ উপাধি ধারণ করতে পেরেছিলেন—সে কেবল তাঁর লিচ্ছবি শ্যালকদের জোরে। জামাইবাবুর মই বেয়ে যেমন শালারা বীরাসনে বসেন তেমনই প্রতাপশালী শ্যালকের সূত্র ধরে কখনও বা প্রতিষ্ঠা লাভ করেন জামাতৃবর্গ। এ ব্যাপারে প্রথম চন্দ্রগুপ্তও তত বড় দৃষ্টান্ত নন, যতখানি হলেন মৌখরীরা। মৌখরীয় অবন্তীবর্মার পুত্র গ্রহবর্মা প্রধানত বিখ্যাত হয়েছেন হর্ষবর্ধনকে শালা পেয়ে। মহাভারতে এইরকম উদাহরণ হল জয়দ্রথ, যিনি একশো ভাইয়ের এক বোন দুঃশলাকে বিবাহ করে দুর্যোধনের দৌলতে পরাক্রান্ত হয়েছিলেন। তবু, তবুও বলব এ উদাহরণ বেশি নয়। রাজনীতিতে শালা জামাইবাবুকে ধরে ক্ষমতাসীন হবেন, না—জামাইবাবু শালাকে ধরে শীর্ষস্থানে আসবেন, তার মধ্যেও রাজনীতি আছে। মহামান্য আকবর শাহের রাজপুত শ্যালকেরা একে অন্যের হাত শক্ত করেছে; কিন্তু যেরকমটি আমরা দেখছি বিরাটরাজার ক্ষেত্রে অর্থাৎ মানুষের স্ত্রৈণতায় শালাবাবুর পদাধিকার—এইটিই বোধহয় চিরন্তন সত্য। ইতিহাসে এর উদাহরণ জাহাঙ্গীর। তাঁর শ্যালকের কথা বেশি করে বলতে চাই না কারণ সে সময় রাজ্যশাসন করতেন তাঁর বেগম নূরজাহান। তীক্ষ্নবুদ্ধি এই অন্তঃপুরচারিণীর দৌলতে তাঁর ভাই আসফ খাঁ এমন স্থান অধিকার করেছিলেন যে শেষ পর্যন্ত তাঁর ভগিনী নূরজাহানের কথাও তিনি অস্বীকার করেন। পরবর্তীকালে আরজুমন্দ বানু, মানে তাঁর মেয়ে মমতাজকে শাহজাহানের কাছে পাত্রস্থ করার সুবাদে মোগল সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রিত্বই অধিকার করেছিলেন তিনি উপাধি পেয়েছিলেন—’ইয়ামিন-উদ-দৌলা’—সম্রাট তথা সাম্রাজ্যের ডান হাত।
জামাইবাবুর দৌলতে যতবড় পদই এঁরা লাভ করুন না কে, বাস্তবিক রাজার শালা হওয়ার মূল্য এরা ততখানি বোঝেনি, যা বুঝেছিল বাংলার রাজা লক্ষ্মণসেনের শালা কুমারদত্ত এবং চারুদত্ত। সেক-শুভোদয়ার তৃতীয় পরিচ্ছেদে দেখি—কুমারদত্ত মাধবী নামে এক কূল-ললনার সর্বনাশ করেছে। তার অত্যাচারের পরিণতি হিসেবে মাধবীর স্বামী বরণ করেছে মৃত্যুকে। কুমারদত্তকে সবাই যখন ধরে নিয়ে গেল রাজমন্ত্রীর কাছে, বিচক্ষণ মন্ত্রী তখন বললেন—আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব করব। কিন্তু মনে রেখ এ হল রাজার শালা—’কিঞ্চ রাজশ্যালকো’সৌ। পুনরপি রাজপত্নী বল্লভা’—তার ওপর রাজপত্নী বল্লভার ভাই—কাজেই আমি নিজে এর শাস্তি বিধান করতে পারব না। চতুর্দশ পরিচ্ছেদে আবার দেখি—লক্ষ্মণসেন গঙ্গায় স্নান করে স্তোত্র পাঠ করছেন। এমন সময় এক অচণ্ডীদাসী রজকিনী কাপড় সামলাবার অছিলায় তার উত্তমাঙ্গ প্রদর্শন করতে লাগল। অস্থান-বিলাসী রাজাও তাকে এক গ্রাম্য উক্তি করে বসলেন। পাশে ছিল রাজার আর এক শ্যালক চারুদত্ত। সে ভাবল—এই উক্তি তাকে উদ্দেশ করেই। ব্যাস, নালিশ হল দিদি বল্লভার কাছে। প্রথমে রাণীর কান্নাকাটি, তারপর উপযুক্ত ব্যবস্থা। প্রকাশ্য রাজসভায় সেদিন লক্ষ্মণসেনকে মুখ নীচু করে বসে থাকতে হয়েছিল।
শ্যালকদের এই ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা কোনোকালেই তাদের নিজস্ব বিদ্যাবুদ্ধির ওপর নির্ভর করত না, পরোক্ষভাবে রাজার স্ত্রৈণতাই ছিল এর জন্য দায়ী। পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক শালাবাবুরা—ভালো মন্দ, নামি-অনামি যাঁরাই আছেন—তাঁরা সবাই তাঁদের ভগিনীকে কেন্দ্র করেই উচ্চ পদাধিকার লাভ করেছেন। তাঁদের ক্ষমতার নীতিহীন বৈশিষ্ট্যটুকু নিয়েই বোধহয় পরিণতি লাভ করেছে রসশাস্ত্রের ‘শকার’ চরিত্রটি। ‘শকার’ মানেও রাজার শালা—তবে এ রাজার পরিণীতা বধূর ভাই নয়, এ হল অবৈধ প্রেমের সম্বন্ধী। এদের রসের মাত্রাটাও তাই যেমন একটু বেশি, পরিমিতি-বোধও তাই তেমন একটু কম। শকার শব্দটি নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ প্রচুর। সর্বশেষে মতবাদটি হল—বাণভট্টের লেখা ‘পরকলত্র-কামুক শকপতি’ এই বাক্যপ্রমাণে ‘শক’ শব্দটি নিন্দনীয় অর্থে রূঢ় হয়ে যায়। সেই নিরিখে শব্দটি নাকি শকাকার থেকে শকার—এইভাবে এসেছে। যাহোক শব্দচিত্র নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই, আসল কথা, এ হল শালা এবং অবৈধ শালা। কালিদাসের অভিজ্ঞান-শকুন্তলে এ অবতীর্ণ হয়েছে ‘শ্যাল’ নামেই। রাজার নাম লেখা আংটি উদ্ধারের প্রসঙ্গে এর আবির্ভাব, তবে সম্পর্কের গৌরবে এও কিন্তু নগর-কোটাল এবং সুযোগ পেলেই মদের দোকানে হুল্লোড় জমাতে ভালোবাসে। শালা-চরিত্রের অসামান্য ছবিটি ফুটে উঠেছে শূদ্রকের নিপুণ অঙ্গুলি চালনায় তাঁর মৃচ্ছকটিক নাটকে। এ শালা কথা বলে ‘শ-শ’ করে। অন্ধকার রাজপথে সাঙ্গোপাঙ্গে বেরিয়ে পড়েছে গণিকা বসন্তসেনার উপাসনায়, প্রেমের মর্ম বোঝে না, আগুনে মাংসখণ্ড ঝলসানোর মতো এর হৃদয় শুধু জ্বলে কামনায়—অঙ্গার-রাশি-পতিতমিব মাংসখণ্ডন। মূর্খ, মদমত্ত, নিষ্ঠুর—কিন্তু রাজবল্লভ এবং সেই সুবাদেই শেষপর্যন্ত বসন্তসেনার নিগ্রহ করতে বাধে না তার।
রসশাস্ত্রের এই শালার মধ্যে নতুন করে পাওয়ার কিছু নেই, এদের পূর্বসূরিকে আমরা পেয়েছি ইতিহাস-পুরাণেই। মহাভারতের শালা আর ইতিহাসের শালা, কালিদাসের শালা আর শূদ্রকের শালা—এ যেন পৌরাণিক মহিমার সঙ্গে ঐতিহাসিক সত্যের মধুর মিলনে রসশাস্ত্রের একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার জন্ম। পরাশর মুনির ভূমা-দৃষ্টিতে আধুনিক যুবকদের যে জায়গায় দুর্বলতা ধরা পড়েছে, সেই শ্যালকদের বৈশিষ্ট্য কিন্তু তত সামগ্রিক নয়, তাঁরা কেউ চলেন পৌরাণিক মতে, কেউ ঐতিহাসিক, কেউ বা রসশাস্ত্রের মতে। কিন্তু যে ভাবেই হোক, যাঁরা ছিলেন, তাঁরাই আছেন।
কলিযুগের ওপর ঈর্ষাবুদ্ধিতে পরাশর মুনি বলেছেন, আমরা বশীভূত হব শ্বশুর-শাশুড়ি-শালার। কিন্তু যাদের কথা বলেননি—তাঁরা হলেন শ্যালিকা। বাস্তবিক তখনকার দিনে রথী-মহারথীরা বিয়েও করতেন বেশ বুদ্ধি করে, একেবারে—’তুই রবি একেশ্বরী একলা আমি রইব পাশে’। কাউকে দেখবেন না—’অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী, তারা মন্দোদরী তথা’—যার কথাই বলি না কেন, কারও কোনো বোন নেই। রামচন্দ্র—যিনি আর একটু হলেই—আপন এবং খুড়তুতো তিন-তিনটি শালী-সুখ ভোগ করতেন, তাঁকেও বঞ্চিত হতে হল নিজের ভাইদের জন্য। শালিকা-সুখে বঞ্চিত সত্য-ত্রেতা-দ্বাপরের এই সমাজ ঋষির স্মৃতিপটে এমনই কোনো দুঃখ জাগিয়েছিল যে পরাশর একবারও এদের নাম পর্যন্ত করেননি তাঁর ‘কলিধর্মনিরূপণে’। কাজেই—
”তাঁহার কালের স্বাদগন্ধ আমি তো পাই মৃদুমন্দ,/আমার কালের কণামাত্র পাননি মহাকবি।”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন