একখানি গো-এষণা

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

অনেক কাল পরে, অবশেষে এই বুড়ো বয়সের পরিণতি দেখে সম্পাদকমশাই আমাকে সঠিক চিনতে পেরেছেন—তিনি আমাকে গোরু নিয়ে একটি রচনা লিখতে বলেছেন। আমি পরম পুলকিত বোধ করছি এই কারণে যে, আমার ছোটবেলায় সরল রচনাশিক্ষার বইটিতেও গোরুর রচনাটি ছিল প্রথমে এবং আমার পরীক্ষার সময়ে গোরুর রচনাই লিখতে বলা হয়েছিল। প্রত্যেক রচনা লেখকই যেমন ভাবে যে, সর্বশ্রেষ্ঠ রচনাটি সেই লিখেছে, আমিও তেমনই মুগ্ধতায় কিছুকাল কাটিয়ে দেওয়ার পর দেখলাম—আমি রচনা-লেখায় দশে তিন পেয়েছি। সেকালের দিনে খাতা দেখানোর কোনো নিয়ম ছিল না, কিন্তু ক্লাসে বসে আমার কম নম্বর পাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে মাস্টারমশাই সকলের সামনে আমার সম্বন্ধে তাঁর সার্বিক সিদ্ধান্ত জানিয়ে বললেন—তুই একটি গোরু।

পরের দিন থেকে সেই আমাদের শ্রেণিকক্ষে আমার নামই হয়ে গেল গোরু। আমার ক্লাসের বন্ধুরা আমাকে অনেকেই গোরু বলে ডাকত এবং তখনকার দিনে পিতা-মাতারাও আমাদের মধ্যে কোনো আত্মসচেতনতা তৈরি করতে পারেননি বা সে চেষ্টা কোনো দিনই করেননি বলে গোরু-সম্বোধন কোনো পৃথক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেনি আমার মনে। আমাকে গোরু বলে ডাকলে আমি সাড়াও দিতাম সঙ্গে সঙ্গে। আমার নিজস্ব নামটাও এমন খটমট ছিল যে, আমার সেই রচনা-স্যার পর্যন্ত আমাকে ‘নিরিসিংহ’ বলে ডাকতেন। কিন্তু সেদিনের সেই রচনা—সংবেদনের পর ছাত্রদের মধ্যে যখন আমার গোরু নামটি বেশ চলছে এবং ইতোমধ্যে রচনা-বিরচনের ক্ষেত্রে আমি যখন আরও দুই-তিন বার আমার ভয়ংকরি প্রতিভার পরিচয় দিয়ে সংখ্যামানে আরও নীচুস্তরে পৌঁছোচ্ছি, তখন মাস্টারমশাই একদিন টেবিলের সামনে ডেকে এনে বললেন—দ্যাখ! নিরিসিংহ না কী সিংহ! তোর নাম তো গোরুই হয়ে গেছে। কাল থেকে তুই আমার ক্লাসে আর ‘ইয়েস স্যর’, ‘প্রেজেন্ট স্যর’ কিংবা ‘উপস্থিত’ বলবি না, তোর নাম ডাকলেই তুই বলবি ‘হাম্বা’, তাতেই আমি বুঝে নেব।

পরের দিন শনিবার ক্লাসের বাংলা টিচার রামবাবু যখন রোলকল করে আমার দিকে তাকালেন এবং আমিও যখন চকিতে ‘হাম্বা’ বলার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন আমার মৌহূর্তিক সংকোচ এবং বিলম্বের সুযোগ নিয়ে অন্য একটি ফাজিল ছেলে বলে দিল ‘হাম্বা’। ব্যাস, সমস্ত ক্লাসের মধ্যে হাসির রোল উঠল। ক্লাসের পড়াশুনো আরম্ভ হওয়ার আগেই ‘আমায় নিয়ে’ এইরকম ‘রসের খেলা’টা এতটাই সহজ এক বিমলানন্দ দান করেছিল, যাতে আমার পৃথক করে কষ্ট পাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। আজকের এই অদ্ভুত বিচিত্র মানুষের আত্মহত্যাপ্রবণ যুগে এবং তার চেয়েও বেশি শত শত প্রকৃত-মূর্খ, অতিরিক্ত আত্মসচেতন এবং অধিকার-সর্বস্ব অভিভাবক বাবা-মায়ের মানসিক বিকারের নিরিখে সেই মাস্টারমশাই রামবাবু আজকে যে কী পরিমাণ নিগৃহীত হতেন, সেটা ভাবলে পরে তাঁর সেই পান-খাওয়া হাস্যমুখর মুখখানি আরও বেশি করে মনে পড়ে।

আমায় নিয়ে এই যে গোরু-কাণ্ড চলেছিল, এর বিন্দু-বিসর্গ আমার বাড়ির লোকেরা কেউ জানতেন না। আর যদি বা জানতেনও, তাহলেও সেটা নিয়ে এক মিনিটও তাঁরা আলোচনা করতেন না, সেটা আমি জানি; কেননা একটা ছাত্রকে ক্লাসে কে গোরু বলছে না বলছে, সেটা নিয়ে ক্লাস ফাইভের একটি ছেলের অহেতুক গুরুত্ব তৈরি করতেন না তাঁরা। এ বিষয়ে প্রমাণও পেয়েছি হাতেনাতে। আমার স্কুলের এক বন্ধু বিকেলবেলায় খেলার জন্য বাড়িতে ডাকতে এসেছিল। দরজা খুলতেই সামনে আমার দাদাকে দেখে সে বলেছিল—গোরু আছে বাড়িতে? আমার দাদার ক্ষণিক ভ্রান্তি তৈরি হতেই, আমার স্কুল এবং স্কুলের বন্ধু এবং তৎকালীন সময়ের সরলতার কথা ঝটিতি খেয়াল করে অসাধারণ রিফ্লেকস দেখিয়ে তিনি বললেন—অ, গোরু! গোরু আছে বাড়িতে। বলেই তিনি চেঁচিয়ে ডাকতে আরম্ভ করলেন—গোরু! অ গোরু! তোর বন্ধু আইছে, হিগগির আয়। হ্যাঁ যাও, চরতে যাও, কিন্তু ঘাস খাইয়া সন্ধ্যা ছয়ডার মধ্যে গোয়ালে ঢুগবা।

এই ঘটনার চার-পাঁচদিন পরে আমার সেই দাদা একদিন জিজ্ঞাসা করলেন—তা হ্যাঁ রে! ক্লাসে তরে গোরু ডাকে ক্যান? কী করছস। আমি বললাম—ওই গোরুর রচনায় দশে তিন পাইছি, তাই রামবাবু আমার নাম দিছে গোরু। আমার দাদা বললেন—ঠিকোই তো করছে। ল্যাখাপড়া ঠিক মতো কর, রচনায় দশে পাঁচ পাইলেই যথেষ্ট। আমার স্কুলের রামবাবু লোকটি খারাপ ছিলেন না, আমাকে গোরু বলে ডাকলেও আমাকে ভালোও বাসতেন যথেষ্ট। ফলে পুনরায় একটি ক্লাসে তিনি প্রসঙ্গত আমার গোরুর রচনা নিয়ে কথা বলতে আরম্ভ করলেন। অন্যান্য ছাত্রদের উদ্দেশে তিনি বললেন—ও রচনায় তিন পেয়েছে বলে বেশি শোর করিস না। এই রচনাটাই পরীক্ষার খাতা ছাড়া অন্য জায়গায় লিখলে ও অনেক নম্বর পেত।

এই কথাটায় ক্লাস ফাইভের মতো একটা নিম্ন শ্রেণিতেও বেশ একটা প্রতিক্রিয়া হল এবং আপনারা তো জানেনই যে, প্রত্যেক ক্লাসেই একটি সর্ববিদ্যাবিশারদ ‘ফার্স্ট বয়’ থাকে—যার মনে সদা চিন্তা, তার প্রথমত্ব না হারিয়ে যায়। সেই ‘ফার্স্ট বয়’ কিন্তু রামবাবুকে বলেই ফেলল—কেন, কী আছে ওই রচনার মধ্যে, যা অন্য জায়গায় লিখলে অনেক নম্বর পেত! রামবাবু বললেন—তোদের প্রত্যেকের লেখায় রচনা লেখার সঠিক প্রক্রিয়াটা তোরা বোঝাতে পেরেছিস—যেমন, গোরুর আকৃতি, প্রয়োজনীয়তা, উপকার, এমনকি তার গলকম্বলের কথাটাও বিশেষ করে লিখেছিস। কিন্তু এই গোরুটা রচনার এই পদ্ধতিটাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফেই লিখল—গোরুর মন আছে, গোরু মন বোঝে।

এই কথাটা উচ্চারিত হতেই হাসির রোল উঠল ক্লাসে। সবাই আবার গোরু-গোরু বলে চেঁচাচ্ছে এবং সেই উত্তাল ক্লাসের মধ্যে সেই অকালপক্ব ‘ফার্স্ট বয়’ আমাকে বিশুদ্ধভাবে বলল—তার মানে তোমারও মনে আছে বল? হা হা হা! মাস্টারমশাই ক্লাস থামিয়ে বললেন—দ্যাখ। ও পূর্ববঙ্গ থেকে সদ্য এসেছে এই এক বছর আগে। ওদের বাড়িতেই দুটো গোরু ছিল। সেই গোরু দুটোর সঙ্গে ও চলাফেরা করেছে—সন্ধ্যাবেলায় মাঠ থেকে ওরই পিছন পিছন ফিরে আসত, কোনোদিন ওকে গুঁতোয়নি। একবার মাঠে চরতে চরতে লোকের ধানখেতে ঢুকে পড়েছিল বলে অন্য লোকেরা ওদের একটা গোরুকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সন্ধেরাত্রির পর গোরু খুঁজতে খুঁজতে যখন ‘কালী কালী’ বলে তোদের এই বন্ধু চেঁচিয়ে ফিরছিল, তখন কিন্তু একটা ভিতরবাড়ির উঠোন থেকে কালী নামক গোরুটি অস্পষ্ট করুণ স্বরে সাড়া দিয়েছিল, আর তোদের এই বন্ধু যখন গাঁ ছেড়ে কলকাতায় আসে, তখন নাকি সেই পোষা গোরুটার চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। তোর বন্ধু তাই লিখেছে—গোরুর মন আছে।

রামবাবু আমার গোরুর রচনা শুনিয়ে বললেন—কিন্তু পরীক্ষার খাতায় এই রচনা চলবে না। সেখানে গোরুর চারটে পা, দুটি শিং, একটি লেজ, একটি গলকম্বলের বিবরণটাই লাগবে, এমনকি গোরুর চামড়াটাও যে কত কাজে লাগে, সেটা লিখলেও একটা নম্বর বেশি আসবে। কিন্তু গোরুর মনের কথা যদি লিখতে যাস, তাহলে সেটা ইস্কুলের ম্যাগাজিনে লিখিস, তাতে নম্বর পাবি না বটে, কিন্তু হেডমাস্টারমশাই খুশি হবেন।

আমার ক্লাসের ছেলেরা এই বক্তব্যের কী বুঝল জানি না, এমনকি আমিও যে খুব বেশি কিছু বুঝলাম তা নয়। কিন্তু সেই আমার গোরুর রচনা লেখা শুরু। পরবর্তীকালে যখন গবেষণার জগতে প্রবেশ করেছি, তখন দেখলাম—ভারতবর্ষের মানুষ, ভারতবর্ষের প্রকৃতি, এমনকি ভারতবর্ষের ভাষার সঙ্গে গোরু এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, জগৎ এবং জীবনের ক্ষেত্রে গোরুই আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী হয়ে উঠেছে। প্রাচীন সংস্কৃত ভাষায় এবং প্রাচীন সংস্কৃতি এবং সাহিত্যক্ষেত্রে গোরু বা ‘গো’-শব্দটি এত বিশদ এবং বিচিত্রভাবে উল্লিখিত, সেখানে গো কথাটার বিচিত্র অর্থ নিয়েই একটা অসামান্য গবেষণা-পত্র আমি তৈরি করে দিতে পারি এবং সেখানে গোরু খাওয়া বা না-খাওয়ার কথাটা নিতান্তই ঐকাংশিক একটা আলোচনার জন্ম দেয়।

আমি প্রথম আশ্চর্য হয়েছিলাম সংস্কৃত ভাষায় গো-শব্দের অর্থব্যাপ্তি দেখে। পৃথিবীর ইতিহাস এবং প্রাচীনতম সাহিত্যে গোরু অর্থাৎ ‘গো’ ভারতীয় কৃষ্টির মধ্যে এমনভাবে প্রবেশ করেছিল যে, অন্য কোনো প্রাণী—বাঘ, সিংহ কিংবা হাতি যেখানে বিশ্বসাহিত্যে বহুল বন্দিত, সেখানে বেদ-উপনিষদ-মহাভারতে গো বা গোরুর উল্লেখ যত বার হয়েছে ততটা অন্য কোনো প্রাণী নয়। সবচেয়ে বড় কথা—আর্য জীবনের সঙ্গে গো-শব্দটি এমন সাংস্কৃতিক সম্বন্ধ তৈরি করেছে, এবং গো শব্দটি ব্যবহার আমরাই এত বিচিত্রভাবে করেছি, যে আমরা বুঝতেও পারি না—সেই শব্দও নিতান্তই গণ্য।

গবেষণার জগতে আসামাত্রই প্রথম আবিষ্কার করলাম যে, ‘গো’-শব্দের অর্থ ‘বাক’ অর্থাৎ বাগদেবী সরস্বতী। গবেষণা মানে বিদ্যা এবং জ্ঞান খুঁজে বেড়াচ্ছি। অন্বেষণ এবং নিরন্তর অন্বেষণই যেখানে গবেষণার তাৎপর্য, সেখানে কিন্তু গোরু-খোঁজার মতো স্থূল মর্মটুকুও রয়ে গেছে। গোরু চরতে গিয়ে গোরু হারালে সেই গোরু খুঁজে আনতে যে ধৈর্য লাগে, সেই ধৈর্যের মর্ম বুঝি গবেষণার মধ্যেও আছে। সেইজন্য গো-এষণা, গবেষণা, অর্থাৎ সরস্বতী-খোঁজা।

আর্য সমাজের গোরুর প্রিয়ত্ব এতটাই ছিল যে, গো শব্দের একটা অর্থ এই পৃথিবী। আমরা মহাভারত-পুরাণে পৃথিবীকে বার বার গোরূপে দেখতে পেয়েছি। ওই যে সেই যখন-যখনই ধর্মের গ্লানি আর অধর্মের অভ্যুদয়ের প্রশ্ন এসেছে, তখন পৌরাণিকের চোখে পৃথিবী অশ্রুমুখী গোরুর রূপ ধারণ করে ভগবান বিষ্ণুর কাছে প্রার্থনা জানিয়েছেন—ধরায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য—গৌভূত্বাশ্রুমুখী খিন্না ক্রন্দন্তী করুণং বিভো। পৃথিবীকে এইভাবে গোরুর প্রতীকে দেখার মধ্যে প্রাচীনদের মনের গভীরে গোরুর নিরীহতা, সহিষ্ণুতা এবং বিনা প্রতিবাদে মালিকের অত্যাচার সইবার প্রত্যক্ষ বৃত্তিগুলিই কাজ করেছে। আবার খুব বড় বড় রাজারা যখন নতুন নতুন নীতি আবিষ্কার করে এই পৃথিবীকে বহুল কর্ষণযোগ্য করে তুলেছেন, নব-নব শস্যের উৎপাদন ত্বরান্বিত করেছেন, পৃথিবীর আকর দ্রব্য লোহা, তামা ব্যবহারযোগ্য করে তুলেছেন, তখনও গোরুর উপমা দিয়ে বলা হয়েছে—অমুক রাজা পৃথিবী দোহন করেছেন এবং এখানে অবধারিত ভাবেই পৃথিবীর পর্যায় শব্দ হিসেবে গো-শব্দটাই সরাসরি ব্যবহার করা হয়েছে—দুদোহ গাং স যজ্ঞায়—এ কথা আছে কালিদাসের রঘুবংশে এবং পুরাণগুলিতে। পৃথিবীর সঙ্গে গো এমনই এক অভিন্ন পর্যায় তৈরি করেছে, যাতে অনেকগুলি গোরুর অধিকারী মানুষ যেমন গোপতি, তেমনই এই পৃথিবীর অধীশ্বর রাজারও অন্য নাম হল গোপতি। পণ্ডিত R.S. Sharma তো গোটা একটা অধ্যায় লিখে ফেললেন—From Gopati to Bhupati:Changing positions of a king.

গোরু ছেড়ে যদি বৃষ-তে আসেন তখনও দেখা যাবে যে, সমাজ এবং সামাজিক ব্যবহারে প্রাণী হিসেবে বৃষের মর্যাদাই কিন্তু ভারতীয় ধর্ম এবং দর্শনের ক্ষেত্রে বৃষকে চরম আধ্যাত্মিকতার প্রতীক করে তুলেছে। খোদ মহাভারতে বৃষ মানে হল ধর্ম, বৃষ মানে জ্ঞান—বৃষো হি ভগবান ধর্মঃ। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে শিবের বাহন ষাঁড়কে নিয়ে যত তামাশাই করা হোক—যেমন ভারতচন্দ্রে—বুড়া গরু লড়া দাঁত ভাঙা গাছ গাড়ু—কিন্তু মহাভারত-পুরাণে বৃষ জ্ঞান এবং ধর্মের প্রতীক। বৃষবাহন শিব আসলে জ্ঞানবাহন শিব—শিবের কাছেই নিত্যানিত্য, সত্যাসত্য, ধর্মাধর্মের বিবেক জ্ঞান বা পার্থক্য করার জ্ঞান শিখতে হবে বলে শাস্ত্রীয় প্রবাদই এইরকম—জ্ঞানঞ্চ শঙ্করাদ ইচ্ছেৎ। একটি পুরাণে কৃষ্ণ ভগবান নিজেকে জ্ঞানের মহিমায় প্রকট করে শিবের প্রসঙ্গ তুলে বলেছেন—আমিই বৃষরূপে শিবকে বহন করি—ততো’হং বৃষরূপেণ বহামি তেন তং প্রিয়ম।

পণ্ডিতজনেরা বৃষকে ঋকবেদের পটভূমিকায় সূর্যের প্রতীক হিসেবে দেখেছেন এবং ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলিতে সূর্যের সমস্ত রশ্মি গো-প্রতীকে চিহ্নিত। তবে বৃষের এই সূর্যস্বরূপতা মিশরের Nemur-এ Mnevis নামের কৃষ্ণরূপী সূর্যের সঙ্গে তুলনীয় এবং প্রতি ঘণ্টায় সেই বৃষের রোমগুলি বর্ণান্তর গ্রহণ করে। আমাদের দেশে অবশ্য গো-শব্দের অর্থ সূর্যও বটে, চন্দ্রও বটে, আবার সূর্যচন্দ্রের রশ্মিও বটে। ভাগবত পুরাণে রাসলীলার আরম্ভে সন্ধ্যাকালীন বনের মাঝে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণ দেখেছিলেন কোমল-স্নিগ্ধ চন্দ্রকিরণে রাঙা হয়ে গেছে বনরাজি, সেখানে চন্দ্রকিরণের প্রতিশব্দ কিন্তু গো—’বনঞ্চ তৎকোমল গোভী রঞ্জিতম’ এবং এখন মধুর সংকেত দেখেই সমস্ত রমণী-গোপীকুলের উদ্দেশে বাঁশির আহ্বান-সুর ধ্বনিত করেছিলেন কৃষ্ণ। ‘এই তো তোমার আলোক-ধেনু সূর্য-তারা দলে দলে’।

আমরা সত্যি আর গো-বৃষের শব্দতন্ত্রে স্থিত হতে চাই না; তাতে গোচর, গোত্র, গোধূলি থেকে গোপাল-গোবিন্দ পর্যন্ত পদপদার্থ বিশ্লেষণ করতে হবে আমাকে এবং তাতে আমার মতো গোমুগ্ধ ব্যক্তির মুখরতা বাড়বে বই নয়। আপাতত এটা জানানো খুবই সঙ্গত হবে যে, প্রাচীন ভারতীয় আর্যসমাজে যারা প্রথম পর্যায়ে একেবারেই যাযাবর-বৃত্তি ছিলেন, তাঁদের প্রধান আজীব্য এবং উপজীব্য ছিল গোরু। গৃহপালনের জন্য এই নিরীহ জীবটি সব দিক থেকে এতই বেশি গ্রহণযোগ্য ছিল যে, গোরুর সৃষ্টি নিয়ে মহাভারত-পুরাণে কাহিনি তৈরি হয়েছে।

মহাভারতে বলা হয়েছে যে, সৃষ্টির আদিতে ব্রহ্মার আদেশে দক্ষ প্রজাপতি মানুষ সৃষ্টি করতে লাগলেন। কিন্তু সেই সৃষ্ট মানুষের জীবনধারণের উপায় অথবা তাদের জন্য পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা তখনও হয়নি। ফলে মানুষেরা কীভাবে জীবন ধারণ করবে, এই বৃত্তিকামনায় মানুষেরা কান্নাকাটি আরম্ভ করল—প্রজাতান্যেব ভূতানি প্রাক্রোশন বৃত্তিকাঙ্ক্ষয়া।

এইরকম একটা কান্নাকাটির কথা যতই এখানে লেখা থাক এই কাহিনির প্রথমারম্ভে দেখা যাচ্ছে যে, দক্ষ প্রজাপতি নাকি প্রাণীদের হিতকামনায় তাঁদের বৃত্তির কথাটাই আগে ভেবেছেন। অর্থাৎ কিনা, জন্মানোর পর মানুষের কীভাবে জীবনযাত্রা চলবে না চলবে, তাদের খাওয়াদাওয়া কী হবে না-হবে—এসব নাকি দক্ষ প্রজাপতি আগেভাগেই চিন্তা করছেন—অসৃজৎ বৃত্তিমেবাগ্রে প্রজানাং হিতকাম্যয়া। মানুষের বৃত্তি কী হবে—এই কথা ভেবে মানুষের প্রাণধারণের উপযোগী কোনো কিছু একটা সৃষ্টি করবেন বলে দক্ষ প্রজাপতি অমৃত পান করলেন। অমৃতপানের পর দক্ষের উদ্গার থেকে অপূর্ব এক সুগন্ধের সৃষ্টি হল। সেই সুগন্ধ থেকেই জন্ম নিলেন গোমাতা সুরভি—দদর্শোদ্গারসংবৃত্তাং সুরভিং মুখজাং সুতাম! এই সুরভি থেকেই জন্ম হল শত শত কপিলা গাভীদের—যারা একাধারে ‘লোকমাতৃকাঃ’ কেননা গোদুগ্ধের মাধ্যমে তারা মানুষের পালন পোষণ করে। আর তাদের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল—তারাই মানুষের জীবিকা উপার্জনের প্রধান উপায় হয়ে উঠল—সুবর্ণবর্ণাঃ কপিলাঃ প্রজানাং বৃত্তিধেনবঃ।

গোরুর দুধের পুষ্টি আর গোরুর মাধ্যমেই জীবিকা—এই দুটিই প্রাচীনদের কাছে গোরুকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেনি, তাকে জীবনীশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। ভারতীয় কৃষ্টি এবং ধর্মভাবনার সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ ঋগবেদ থেকে একথা প্রমাণ করা যাবে যে, গোরু এবং ষাঁড় খুব সহজে মানুষকে প্রত্যক্ষ খাদ্য দিয়েছে দুধ এবং মাংসের প্রত্যক্ষ সরবরাহ ঘটিয়ে—অর্থাৎ গোরুর দুধ এবং বৃষের মাংস। খাদ্যের পরে প্রশ্ন আসে জীবিকা—সেই জীবিকার প্রধান আজীব্য ছিল পশু, আরও পরিষ্কার শব্দে এই পশু অবশ্যই গোরু।

আশ্চর্য লাগবে শুনতে—ওই যে মহাভারত একটা শব্দ উচ্চারণ করল—’বৃত্তিধেনু’ অর্থাৎ জীবিকার জন্য ধেনু—এই ধেনুর অর্থ কিন্তু সবৎসা গাভী অর্থাৎ প্রজনন শক্তিসম্পন্ন গাভীই ব্যবসার কাজে লাগত, বন্ধ্যা গাভী নয়। হয়তো বা বন্ধ্যা গাভী ব্যবসায়ের উপযুক্ত ছিল না বলেই বৃষ ছাড়া একমাত্র বন্ধ্যা গাভীই যজ্ঞের বলি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বন্ধ্যা গাভীর পারিভাষিক নাম ছিল ‘বসা’। অন্যদিকে ওই যে বৃত্তি-শব্দটা, তার প্রতিশব্দ ছিল ‘বার্তা’—বেদ-পরবর্তী যুগে বার্তা বলতে সব সময়েই ব্যবসা বুঝিয়েছে এবং বার্তা শব্দের প্রধান অর্থ ছিল—কৃষি-গোরক্ষা-বাণিজ্য। গোরক্ষা বলতে গোপ্রজনন থেকে গোপালন এবং অবশেষে বিনিময়ের মাধ্যমে অন্য বস্তুর সংগ্রহ পর্যন্তই বোঝাত। লক্ষণীয়, ভগবদগীতাতেও যখন ‘গোরক্ষা’ শব্দটিকে মাঝখানে রেখে বৈশ্য জনজাতির স্বভাবজ কর্মের কথা বলে—কৃষি-গোরক্ষা-বাণিজ্যং বৈশ্যং কর্ম স্বভাবজম—তখনই বোঝা যায় গোরুকে কেন্দ্র করেই একদিকে কৃষির বিস্তার অন্যদিকে বাণিজ্যেরও বিস্তার। এটা একটু বুঝিয়ে বলতে হবে বটে।

আমার মনে আছে, আমি যখন যৌবনাবধি মঠে-মন্দিরে, বৈষ্ণবীয় আখরায় কীর্তন শুনতে যেতাম এবং গাইতামও দোয়ারকি হিসেবে তখন এক গৃহস্থবাড়িতে একজন আবিষ্ট মনে গান ধরেছেন—

হরি বলবো আর মদনমোহন হেরিবো গো।

আমরা এইরূপে ব্রজের পথে চলিবো গো।।

সেদিন এই ব্রজের পথ আমার কাছে এক আকুল মায়া পথের মতো লেগেছিল। ব্রজের পথ বলতে মনে এসেছিল সেই সবুজ বনভূমির মধ্যে-মধ্যে পায়ে চলার ধূলিধূসর সেই সব পথ যেখান দিয়ে গোরু চরাতে যেতেন রাখাল কৃষ্ণ আর ওদিকে মা যশোমতীর সতর্কবাণী—আমারও শপথি লাগে/না যাইয়ো ধেনু আগে/পরাণেরও পরাণ নীলমণি। আমার মনে আসে সেইসব পথ, যেখানে কৃষ্ণের বাঁশি শুনে ব্রজকুলরমণীরা সব ‘কেহ কাহুক পথ না হেরি’ অন্যা রমণী কোন পথে যাচ্ছে, সেটা না দেখে শুধু নিজের রাস্তা ধরে কৃষ্ণের কাছে পৌঁছেছেন।

আর সেই পথের মোক্ষম দার্শনিকতা চৈতন্যপার্ষদ রূপ গোস্বামীর তাত্ত্বিকতায়—ধূলায় ধূসর নন্দকিশোর গোরু চরিয়ে ফিরছেন, তখন গাভীগুলির পদাহত ধূলিতে গোধূলি লগ্ন তৈরি হয় এবং সেই ধূলিতে একদিকে যেমন রাখালরাজাকে দেখতে আসা ব্রজকুলরমণীদের প্রেমনত চোখগুলি বুজে গেল, তেমনই বন্ধ হয়ে গেল বেদ-বেদান্তের ব্রহ্মময়ী শ্রুতির পথও। কেননা কৃষ্ণপ্রেমের পথে বেদ-বেদান্তের অদ্বৈতবাণী চলে না—ব্রজভূমিতে যুগলের মধুরতা—রাই-কানুর দ্বৈতশাসন, যেখানে কৃষ্ণ একবার ব্রজপুরের বাইরে এলে মাথুর বিরহে গোপিনী বলবেন—একবার ব্রজে চল ব্রজেশ্বর দু-এক দিনের মতো।

(যদি বলো) ব্রজে যেতে চলতে চরণ ধূলায় ধূসর হবে।

(তবে) ব্রজগোপীর নয়ন-জলে চরণ পাখলিবে।।

এই তো ছিল আমার ব্রজের ধারণা, ব্রজভূমি মানেই বৃন্দাবনের কুঞ্জে কুঞ্জে যুগল-পদের বিহরণ। কিন্তু সমস্যা হল—বিদ্যা মানুষের আবেগ নষ্ট করে দেয়, পড়াশুনো মানুষের আবেগ নষ্ট করে দেয়, পড়াশুনো মানুষের স্বপ্নকবিতার বুনন ভেঙে দেয়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র পড়াটাই কাল হল আমার, বিপদ বাধাল মহাভারত-হরিবংশও খানিক। দেখলাম—সেকালের দিনে রাজাদের অর্থনৈতিক উপার্জনের একটা বড় উৎস ছিল ব্রজভূমি। আর ব্রজভূমি মানে কোনো বৃন্দাবন নয়, ব্রজ মানে হল এমন একটা জায়গা, যেখানে গোপালন, গোচারণটাই প্রধান হলেও ব্রজভূমি হল গোপ্রজনন কেন্দ্র। পরবর্তী সময়ে ব্রজভূমির কার্য-পরিধি গোরু ছাড়াও অন্য পশুর মধ্যে প্রসারিত হয়েছে। আমরা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে দেখতে পাচ্ছি—একজন রাজার কর গ্রহণের যে সাতটি উৎস আছে—দুর্গ, রাষ্ট্র, খনি, বন ইত্যাদি তার মধ্যে ‘ব্রজ’ একটি এবং এই ‘ব্রজ’ নামক পারিভাষিক শব্দটির সংজ্ঞা হল—যেখানে গোরু-মোষ, উট-ঘোড়া ইত্যাদির ক্রয়বিক্রয় থেকে আরম্ভ করে দুধ-দই-মাখন, এমনকি ভেড়ার লোম পর্যন্ত রাজার আয়-ব্যয়ের নিদান তৈরি হয়।

কিন্তু ব্রজের এই অর্থব্যাপ্তি, যেখানে অন্য পশুদেরও স্থান হয়েছে রাষ্ট্রের বাণিজ্যিক উপাদানের মধ্যে—ব্রজ শব্দের এই বিশদ অর্থ তৈরি হয়েছে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রব্যবস্থা পূর্ণতা পাওয়ার পর চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীতে। কিন্তু তার আগে, বিশেষত বৈদিক কালে, রাজারা যখন পররাজ্য জয়ের সঙ্গে রাজসূয়-অশ্বমেধের মতো যজ্ঞগুলিকে সমমাত্রায় দেখছেন, তখন কিন্তু ব্রজ বলতে শুধুমাত্র গোরুদের চারণ-পালন-প্রজননের জন্য নির্দিষ্ট একটি ভূমিখণ্ডই বোঝাত। হয়তো সেটা ছোট্ট একটি গ্রাম, কিন্তু সেই গ্রামটা যদি ব্রজের সংখ্যা বহন করে তাহলে তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতাও কিছু ছিল। ঋগবেদের একটি মন্ত্রে দেখা যাবে যে, গ্রামশাসনের প্রসঙ্গে গ্রামের মধ্যে যে ছোট্ট ছোট্ট গৃহস্থঘর, তাদের নাম ছিল কুল। গ্রামশাসনের ক্ষেত্রে কুলপতির একটা ভূমিকা ছিল এবং তার পারিভাষিক নাম ছিল ‘কুলপা’। ঋগবেদে এ বার ‘কুলপা’ এবং ‘ব্রজপতি’ শব্দ দুটিকে একত্রে এনে বলা হল—কুলপতিরা ব্রজপতির চারদিকেই ঘোরাফেরা করেন—কুলপা ন ব্রজপতিং চরন্তম। এই যে ব্রজপতি, তিনি অবধারিতভাবে গোরুদের পালন-পোষণের সঙ্গে জড়িত এবং সেখানে রাষ্ট্রের ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িত আছে।

একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, সে কালের প্রত্যেক রাজার রাজ্যের মধ্যে একটি প্রত্যন্ত জায়গায় একটি ব্রজভূমি থাকত, যেখানে তাঁদের গোপ্রজননকেন্দ্র থেকে গোপালন, গোচারণ সবই চলত। এই ব্রজভূমির অধিকর্তার একটা রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ক্ষমতাও ছিল। এখনই এই সামান্য অনুমানটুকু করার সময়—কেননা মথুরারাজ কংসের অত্যাচারে নিগৃহীত বসুদেব মথুরার রাজধানী থেকে কংস-রাজার ব্রজভূমি গোকুলেই কিন্তু শিশুকৃষ্ণকে রেখে এসেছিলেন এবং এখানে ব্রজপতি কৃষ্ণের পালকপিতা নন্দ কিন্তু কংস রাজার কাছে ব্রজভূমির ‘রেভিনিউ কলেকশন’ জমা করতেন রাজকর হিসেবে তার প্রমাণ হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণে একাধিকবার পাওয়া যাবে। আবার ব্রজভূমির গোপিনীরা যমুনা পার হয়ে দুধ-দই মাখন বিক্রি করতে যাচ্ছেন এবং নাগর কৃষ্ণ সেখানে কংস রাজার প্রতিনিধি সেজে ব্রজরমণীদের কাছ থেকে কর আদায় করার ছলে তোলা আদায় করছেন এবং তোলার পরিবর্ত হিসেবে গোপরমণীদের শারীরিক সংস্পর্শের দাবি জানাচ্ছেন—এই ঘটনাগুলি ব্রজভূমিতে গোরু এবং গো-জাত নানান গব্য বস্তুর ব্যবসায়িক মাত্রা প্রমাণ করে দেয়।

ঋগবেদের মধ্যে যাজ্ঞিক ক্রিয়ার ফল হিসেবে দেবতাদের কাছে বহু বহু গাভী প্রার্থনা করে যত আহুতি দেওয়া হচ্ছে, তার কোনো শেষ নেই। ধর্মকার্যের এই স্থান ছাড়াও বেদের কালেই গোরু একেবারে পূর্ণ ব্যবসায়িক সম্পদ হিসেবে গণ্য হয়েছে এবং এই গো-সম্পদ বা গোধন পাওয়ার জন্য চুরি থেকে বড় যুদ্ধ পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে। বিশেষত গোরু পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করাটা ঋগবেদের কালেই এত সহজ এবং প্রসিদ্ধ ছিল যে, একজন শক্তিমান রাজা যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন মানেই তাঁর প্রথম প্রয়োজন—কতগুলি গোরু তো আগে পাই, তারপর অন্য কিছু—স সত্ত্বভিঃ প্রথমো গোষু গচ্ছতি। অন্য একটি ঋকমন্ত্রে দুই ধনাঢ্য এবং উদ্যোগী পুরুষকে গোরু পাওয়ার জন্য পরস্পর বিরুদ্ধাচরণ করতে দেখা যাচ্ছে। সেখানে মঘবান ইন্দ্র শক্তিমত্তর ব্যক্তিটিকে বন্ধু হিসেবে দেখছেন এবং তাকে গোসমূহ প্রদান করছেন—গব্যং সৃজতে সত্ত্বভির্ধুনিঃ। গোরুর জন্য যুদ্ধ, গোধন লাভের জন্য রাজায় রাজায় শত্রুতা, কিংবা শুধুমাত্র গোরু পাওয়ার জন্য বিনা কারণে বলবত্তর রাজার আক্রমণ—এই উদাহরণ কিন্তু সবচেয়ে ভালো আছে মহাভারতে।

পাণ্ডবেরা যখন বিরাট রাজার রাজগৃহে অজ্ঞাতবাস করছেন এবং সেই অজ্ঞাতবাসের কাল অবশিষ্ট প্রায়, তখন দুর্যোধনের তরফ থেকে প্রচুর অন্বেষণ চলল পাণ্ডবদের খুঁজে বার করার। গুপ্তচরেরা যখন কিছুতেই তাঁদের খুঁজে পাচ্ছে না, তখন হঠাৎই একদিন কৌরবদের কাছে খবর এল যে, বিরাট রাজার মহাবীর সেনাপতি কীচক মারা গেছেন। ত্রিগর্ত দেশের রাজা সুশর্মা এই খবরটা কৌরব দুর্যোধন এবং কর্ণের কাছে দিয়ে প্রস্তাব করলেন বিরাট রাজার মৎস্যদেশ আক্রমণ করতে, কেননা ত্রিগর্তরাজ সুশর্মার ব্যক্তিগত আক্রোশ আছে বিরাট রাজার ওপর। কিন্তু সুশর্মার না হয় বিরাট রাজার সঙ্গে শত্রুতা আছে, কিন্তু এখানে কৌরবদের কোনো প্রয়োজন ছিল বিরাট রাজ্য আক্রমণ করার! সুশর্মা কৌরবদের বন্ধু, অতএব ছুতোর অভাব হল না।

সুশর্মাই দুর্যোধন-কর্ণকে বললেন—ত্রিগর্ত এবং কুরুদেশ একসঙ্গে যৌথ আক্রমণ চালাক বিরাটের ওপর। আমরা জোর করে ওদের রাজধানী আক্রমণ করে ওদের রাজ্যটাকে ভাগ করে নিতে পারি অথবা ওদের সম্পদসূচক হাজার হাজার গোরু আমরা হরণ করে নিতে পারি—

অথবা গোসহস্রাণি শুভানি চ বহুনি চ।

বিবিধানি হরিষ্যামঃ প্রতিপীড্য পুরং বলাৎ।।

আমরা শুধু এই আক্রমণের বৈকল্পিক সমাধানটার ওপর জোর দিতে চাই। রাজধানী আক্রমণ করে রাজ্য এবং তার ধনসম্পদ ভাগ করে নেওয়া অথবা হাজার হাজার গোরু বিরাটের গোশালা থেকে বার করে আনা—গাস্তস্য অপহরামাশু সহ সর্বেঃ সুসংহতাঃ। এই দুয়ের মধ্যে কর্ণ কিন্তু বিরাট রাজার গোধন হরণ করাটাই বেশি উপযুক্ত মনে করলেন এবং দেখা গেল এই প্রস্তাবে ভীষ্ম-দ্রোণরাও কোনো বাধা দিলেন না এবং তা দিলেন না এই কারণেই যে, হীনবল রাজাকে আক্রমণ করে গোধন হরণ করাটা সেকালের পররাষ্ট্র নীতির অঙ্গ ছিল এবং সেটা রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটাত।

সৈন্য-সামন্তদের যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বলে দুর্যোধন মৎস্যদেশ আক্রমণের স্ট্র্যাটিজি ঘোষণা করলেন। বললেন—ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা আগের দিন গিয়ে বিরাটের গোশালার আধিকারিক গোপজনদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে। তারপর তাদের পরাভূত করে বিরাটের গোশালা থেকে গোরুগুলিকে বার করে আনবেন সুশর্মা এবং তাঁর সৈন্যবাহিনী। কৌরবরা সসৈন্যে যাবেন সুশর্মার পিছন পিছন এবং সুশর্মার প্রথম আক্রমণের পরেই দুই ভাগে পৃথক-সংস্থিত কৌরববাহিনীর এক ভাগ বিরাট রাজ্য থেকে সুশর্মার হরণ করা গোরুগুলিকে সংরক্ষিত করে কুরু রাজ্যের দিকে নিয়ে যাবে। আর এক পৃথক বাহিনী প্রস্তুত থাকবে যুদ্ধের জন্য—

গবাং শতসহস্রাণি শ্রীমন্তি গুণবন্তি চ।

বয়মপ্যপুগৃহ্নীমো দ্বিধা কৃত্বা বরূথিনীম।।

যেমন ঠিক হল, ঠিক সেইভাবেই কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমীর দিনে সুশর্মা বিরাট রাজ্য আক্রমণ করলেন। আর ঠিক তার পরের দিনেই কৌরবরা একত্রিত হলেন সুশর্মার পিছনে। ঘটনাচক্র এমনই যে, কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিটাই ছিল পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাস শেষ হওয়ার পরের দিন। ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা যখন বিরাট রাজার গোশালার আধিকারিকদের আক্রমণ করে ছত্রভঙ্গ করে দিলেন, সেদিন এক গোপালক ছুটে গিয়ে রাজসভায় উপস্থিত হয়ে জানাল—মহারাজ! সর্বনাশ হয়ে গেছে। ত্রিগর্ত দেশের সৈন্য-সামন্তরা আমাদের ওপর আক্রমণ করেছে এবং আপনার গোশালা থেকে শত শত গোরু বার করে নিয়ে গেছে—গবাং শত-সহস্রাণি ত্রিগর্তাঃ কালয়ন্তিতে। আপনি দেখুন মহারাজ! আপনার এই মহার্ঘ্য পশুসম্পদ যেন নষ্ট না হয়—মা নেশুঃ পশবস্তব।

এই সামান্য কথোপকথনের মধ্যে যেটা পরিষ্কার সেটা হল—মৎস্যরাজ বিরাটের গোসম্পদ সম্পদ হিসেবেই বিখ্যাত হল—বিরাট রাজার পশুসম্পদ এবং কৃষিসম্পদে পুষ্ট রাজ্যকে—দুর্যোধন বলেছেন পশুধান্যসমাকুলম। মহারাজ বিরাট কিন্তু এই গোধন-হারকের বিরুদ্ধে ভাই-বেরাদর-পুত্রকে নিয়ে নিজে গেছেন যুদ্ধে এবং সঙ্গে নিয়ে গেছেন যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল এবং সহদেবকেও। এই বিরাট আয়োজনটা কিন্তু গোরুগুলিকে শুধু উদ্ধার করে আনার জন্য এবং তাতে অর্থনৈতিক সম্পদ হিসেবে গোরুর মর্যাদা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? আর বিরাট-রাজার গোশালাটি যে আসলে ব্রজভূমির মৌখিক রূপ এবং সেটা যে তাঁর রাষ্ট্রজীবিকার অন্যতম অঙ্গ—সেটা বোঝা যায় তাঁর যুদ্ধের প্রস্তুতি দেখে এবং বোঝা যায় এই গোসম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তাঁর পূর্ব প্রচেষ্টা দেখে।

এখানে আপনাদের স্মরণ করিয়ে দেব শুধু সহদেবের কথা। অজ্ঞাতবাসের সময় পাণ্ডব-কনিষ্ঠ সহদেব যখন বিরাট রাজার কাছে এসে বসতি-ভিক্ষা করলেন, তখন তিনি বিরাট-রাজার সামনে এসে বলেছিলেন—আমি আগে পাণ্ডবদের রাজবাড়িতে কাজ করতাম। কিন্তু তাঁরা যে বনবাসের ঝামেলায় কোথায় চলে গেছেন জানি না। কিন্তু আমি তো সাধারণ কোনো জায়গায় কাজও করতে পারব না, তাই আপনার কাছে জীবিকার জন্য এসেছি। বিরাট জিজ্ঞাসা করলেন—কী ধরনের শিল্পকাজ জানো—কঞ্চাপি শিল্পং তব বিদ্যতে কৃতম—কোথায় তোমার ‘এক্সপারটাইজ’।

সহদেব বললেন—দেখুন মহারাজ! পাণ্ডবজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির তাঁর রাষ্ট্রে আট লক্ষ গোরুর একটা সম্পদ তৈরি করেছিলেন এবং এই সংরক্ষিত সংখ্যা-স্থিতির মধ্যে শত শত গোরু সেখানে কেনাও হত বলে গোরুর সংখ্যা আরও বেশি দাঁড়াবে—তস্যাষ্টশতসাহস্রা গবাং বর্গাঃ শতং শতম। এগুলির সঙ্গে প্রজননক্ষম বৃষ ছিল দশ হাজার এবং বলদ ছিল অন্তত কুড়ি হাজার—অপরে দশসাহস্রা দ্বিস্তাবন্তস্তথা পরে। এই সমস্ত গো-বৃষদের শুভাশুভ লক্ষণ আমার জানা ছিল বলেই আমাকে তিনি আধিকারিকের কাজ দিয়েছিলেন। আমার নাম ছিল ‘তন্তিপাল’।

সহদেব এইটুকু বলেই ছাড়লেন না, ফলে একজন উন্নতিশীল রাজার রাষ্ট্রজীবিকা হিসেবে ব্রজভূমিতে গোসম্পদ কীভাবে রক্ষিত এবং বিবর্ধিত হত, তা সহদেবের মুখে তাঁর এক্সপারটাইজে’র বিবরণ শুনলেই বোঝা যায়। সহদেব বললেন—যে কোনো গোরুর ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান আমি জানি; একটা ব্রজভূমির দশ যোজন পর্যন্ত যে সমস্ত গোরুরা চলে বেড়ায় সেগুলির প্রত্যেকটির দুর্লক্ষণ-সুলক্ষণ আমি জানি। আমার এই সমস্ত গুণ সেই মহাত্মা যুধিষ্ঠিরের জানা ছিল এবং তিনি এইসব গুণের জন্যই আমাকে পছন্দ করতেন। সবচেয়ে বড়ো কথা—গোসম্পদ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আমার বিদ্যার শিল্প-সার্থকতা তো এইখানেই যে, কীভাবে গোরুদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, তাদের যাতে কোনো রোগ না হয়—এইগুলিই তো—এগুলি সব আমার জানা আছে—এতানি শিল্পানি ময়ি স্থিতানি। আর গোপ্রজননক্ষম বৃষগুলির কথাই বা বাদ যায় কেন? উৎকৃষ্টলক্ষণ বৃষের ব্যাপার আমার এতটাই জানা আছে যে, সে সব বৃষের মূত্রগন্ধ শুঁকেও একটি বন্ধ্যা গাভী প্রসব করে ফেলবে—যেষাং মূত্রম উপাঘ্রায় অপি বন্ধ্যা প্রসূয়তে।

সহদেবের কথা শুনে বিরাট বললেন—আমার গাভীগুলির বিশেষত্ব অনুসারে নানান বর্গ আছে। এক-একটি যূথে এক-এক লক্ষ পশু আছে। তাদের জন্য আমার গোশালা আছে আলাদা আলাদা—শতং সহস্রানি সমাহিতানি/বর্গস্য বর্গস্য বিনিশ্চিতানি। বিরাট সমস্ত গোপালক আধিকারিক সহ সবগুলি গোশালা অর্থাৎ তাঁর ব্রজভূমির দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন সহদেবের হাতে।

সহদেবের কথাটা তুললাম এটা বোঝানোর জন্য যে, একটা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য কীভাবে গোসম্পদ তৈরি করা হত রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমার মধ্যেই এবং অন্য রাষ্ট্র থেকে এই গোধন হরণ করাটা অন্যতর পররাষ্ট্রের সার্বক্ষণিক ভাবনার মধ্যে কতটা থাকত এবং সেটা স্বরাষ্ট্রের অর্থপুষ্টির জন্যই। বিশেষত পররাষ্ট্র থেকে এই গোধন হরণ করার কাজটা যে কত নিপুণভাবে এবং কতটা ‘স্ট্র্যাটিজিক’ ভাবনা নিয়ে করা হত, সেটা দুর্যোধনের গোধন হরণের পরিকল্পনা থেকেই বোঝা যায়। ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা বিরাটের গোশালা থেকে গোরুগুলি বার করে আনার পর সম্মুখ যুদ্ধে বিরাটকে পরাস্ত করে অস্ত্রহীন অবস্থায় রথে তুলে নিয়েছিলেন, এই অবস্থায় অজ্ঞাতবাসের ছদ্মবেশী ভীম গিয়ে বিরাটকে মুক্ত করে সুশর্মাকেই তুলে নিয়ে এলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে।

একটা ‘সেক্টরে’ বিরাটরাজের যুদ্ধজয় হল বটে, কিন্তু তিনি জানতেন না যে, তাঁর লালিত-সংরক্ষিত গোসম্পদ হরণের জন্য আরও বড়ো পরিকল্পনা তৈরি হয়েই আছে। বিরাট যখন সুশর্মার সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য রাজধানী থেকে বেরিয়ে গেছেন, তখনই আর একটা ‘সেক্টরে’ আক্রমণ ঘটে গেল বিরাটের রাজ্যে। সেখানেও একইভাবে গোশালা থেকে গোরু তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হল গোপালকদের ছত্রভঙ্গ করে—ঘোষান বিদ্রাব্য তরসা গোধনং জহ্রুরঞ্জসা। কৌরবরা সংখ্যায় অনেক, সৈন্য-সেনাও তাঁদের অনেক। ফলে তাঁরা বিরাটের বিভিন্ন বর্গের গোশালা থেকে ষাট হাজার গোরু বার করে নিয়ে গোরুগুলির চারপাশে চক্রাকারে রথ সাজিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে গোরুগুলিকে হরণ করে নিয়ে যেতে লাগলেন—মহতা রথবংশেন পরিবার্য্য সমন্ততঃ।

চারদিকে বিদ্রাবিত গাভীর হাম্বারব আর সেনাদের দ্বারা প্রহৃত গোপালকদের আর্তনাদ, অবশেষে গবাধ্যক্ষ দ্রুতগামী রথে চড়ে রাজধানীতে এল এবং বিরাটের বালক পুত্রের কাছে বহুকালার্জিত গোধন রক্ষা করার আর্জি জানাল—তদ বিজেতুং সমুত্তিষ্ঠ গোধনং রাষ্ট্রবর্ধন। এর পরের ইতিহাস সকলের জানা। বৃহন্নলাবেশী অর্জুন কুমার উত্তরকে সারথি করে যুদ্ধে এসেছিলেন। অর্জুনের মুখোমুখি হওয়ার আগেই ভীষ্ম এক-চতুর্থাংশ সৈন্য সহ দুর্যোধনকে হস্তিনাপুরের দিকে প্রস্থান করিয়ে দিয়েছেন এবং তা এইজন্য যাতে বিরাটের গোশালা থেকে অপহৃত গোরুগুলিকে অন্তত হস্তিনাপুরে পাঠানো যায়। ভীষ্ম অর্জুনের বিরুদ্ধে সেনাব্যূহ তৈরি করার আগেই দুর্যোধনের দায়িত্বে গোরুগুলিকে রওনা করে দিলেন হস্তিনার দিকে—ভীষ্মঃ প্রস্থাপ্য রাজানং গোধনং তদনন্তরম।

কিন্তু অপহৃত গোধন বাঁচানো এবং গোরুর সঙ্গে দুর্যোধনকে বাঁচানোর এই বুদ্ধিটা কোনো কাজে লাগল না। সবাই ভেবেছিলেন যে, সামনে এত রথী-মহারথী দেখে অর্জুন সব ভুলে গিয়ে সম্মুখস্থ সকলকে আক্রমণ করবেন, সেটা কিন্তু হল না। অর্জুন এসেই প্রথমে গোরুগুলিকে দেখতে না পেয়ে এবং সেই সঙ্গে দুর্যোধনকেও দেখতে না পেয়ে কুমার উত্তরকে বললেন—আমি রাজা দুর্যোধনকে তো দেখতে পাচ্ছি না, আমি নিশ্চিত তিনি অপহৃত গোরুগুলিকে নিয়ে দক্ষিণের পথ ধরেছেন এবং এইভাবে তিনি নিজেকেও বাঁচানোর চেষ্টা করছেন—রাজানং নাত্র পশ্যামি… দক্ষিণং মার্গমাস্থায়… গা সমাদায় গচ্ছতি। অর্জুন নির্দেশ দিলেন উত্তর-সারথিকে—সামনের সবাইকে ছেড়ে তুমি দুর্যোধনের কাছে চল। যুদ্ধ জিনিসটা কখনওই নিরামিষ হয় না, আমার যেটা লোভের জিনিস, সেটা হল—আগে গোরুগুলিকে ফিরিয়ে আনা। সেই কাজটা সবার আগে করতে হবে।

অর্জুনের রথের গতি এবং লক্ষ দেখে কৌরব সেনাপতিরাও বুঝতে পারলেন, কী হতে চলেছে। অর্জুন দুর্যোধনের সৈন্যবাহিনীকে সম্পূর্ণ ছত্রভঙ্গ করে দিলেন বাণাঘাতে। তারপর গোরুগুলির কাছে গিয়ে এমন শব্দ করতে আরম্ভ করলেন যে, গোরুগুলি লেজ কাঁপিয়ে হাম্বা হাম্বা করতে করতে দক্ষিণ দিক ধরে বিরাট-রাজার গোশালার পথ ধরল—

ঊর্ধ্বং পুচ্ছং বিধুন্বানা রেভমাণাঃ সমন্ততঃ।

গাবঃ প্রতিন্যবর্তন্ত দিশমাস্থায় দক্ষিণম।।

আমরা মহাভারতের এই গোগ্রহণ এবং গোনিবর্তনের কাহিনিটা শোনালাম এই জন্য যে, বৈদিক কাল থেকে মহাভারতের কাল পর্যন্ত গোরু অর্থনৈতিক সম্পত্তি হিসেবে একটি রাষ্ট্রের কাছে কতটা মূল্যবান ছিল সেটা এই গোধন-লাভের জন্য পারস্পরিক যুদ্ধচেষ্টা থেকেই প্রমাণিত হয়। বেদের কালে এই গোধন লাভের চেষ্টাটা অনেক ‘ক্রুড’ আকারে ছিল। একজন ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠী—প্রত্যেকে চেষ্টা করছে—কীভাবে নিজের আর্থিক অবস্থান সুস্থিত করা করা যায় গোধন লাভের মাধ্যমে অর্থাৎ গোরুর সংখ্যা বাড়ানোর মাধ্যমে। ঋগবেদে এমন কোনো মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি নেই অর্থাৎ যে ঋষিরা মন্ত্র রচনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে এমন কেউ নেই যিনি দেবতার কাছে বহুল সংখ্যক গাভী চাননি। গোষ্ঠীপতি, রাজা বা নেতা গোছের যাঁরাই প্রশাসন চালাতেন, তাঁদের যাতে অনেক গোরু থাকে সেই প্রার্থনাও ঋষিদের মুখ থেকেই বেরিয়েছে। আর এই প্রসঙ্গে ঋষিরা ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ এমনকি যজ্ঞ-ব্যবহার্য সোমের কাছেও প্রার্থনা জানিয়েছেন যাতে শত্রুর গোশালা রিক্ত করে গোরুগুলি যেন হয় নিজের কাছে, নয়তো যজমান রাজার কাছে চলে আসে। আর এইসব ক্ষেত্রে গোশালা অর্থে ‘ব্রজ’ শব্দটিই ঋগবেদে ব্যবহার হয়েছে। বলা হয়েছে—হে ইন্দ্র! তুমি গাভীর নিবাসস্থান ব্রজভূমির দরজা খুলে দাও আমাদের কাছে, আমাদের ধন দান করো তুমি—গবামপব্রজং বৃধি কৃণুষ্ব রাধো অদ্রিবঃ। আবার এই যে, কৌরব-ত্রিগর্তরা বিরাটের গোধন অপহরণ করলেন আবার ইন্দ্রপুত্র অর্জুন সেই গোরুদের ফিরিয়ে নিয়ে এলেন, এর একটা বৈদিক অনুরূপ আছে, বল নামক সেই অসুরের মধ্যে যিনি দেবতাদের গাভী অপহরণ করে কোনো এক গহ্বরে গোপন করে রেখেছিলেন, আর ইন্দ্র সসৈন্যে সেই গহ্বর বেষ্টন করে সেই গহ্বর থেকে গাভী বার করে এনেছিলেন—ত্বং বলস্য গোমতো অপাবরদ রিবো বিলম।

গোরু যে সেকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জীবিকা ছিল, এমনকি তা যে বাণিজ্যিক বিনিময়েরও বস্তু ছিল, সেটার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণও বোধহয় ঋগবেদেই পাওয়া যায়। এখানে কোনো একজন মানুষ হয়তো বা কোনো মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিই হবেন, তিনি কোনোভাবে যাজ্ঞিক ভাবনা-সম্মত একটি ইন্দ্রমূর্তি বানিয়েছিলেন, কিন্তু তারপর তিনি সেই মূর্তিটি বিক্রয় করার চেষ্টা করছেন দশটি সবৎসা গাভী বা ধেনুর বিনিময়ে। বিনিময়ের মূল্যটাই এখানে খানিক বেশি, নাকি বৈদিক দেবচক্রের বিখ্যাত দেবতা ইন্দ্রের মূর্তি বলেই দশ দশটা ধেনু লাগছে মূল্য হিসেবে, নাকি গোরুর প্রজনন এবং বৃদ্ধি যথেষ্ট থাকায় দশটা গোরু মূল্য হিসেবে এমন কিছু নয়, এই তর্ক চলতেই পারে, কিন্তু আশ্চর্যের খবর এটাই যে, দেবতার মূর্তি বিক্রয় করার বিনিময় মাধ্যমও গোরুই। ঋষি বলছেন—দশটি ধেনুর বিনিময়ে কে আমার কাছ থেকে এই ইন্দ্রমূর্তি কিনবে—ক ইমং দশভির্মমেন্দ্রং ক্রীণাতি ধেনুভিঃ। এই ইন্দ্রের উপাসনা-আরাধনার শেষে ইন্দ্র যখন সেই ক্রেতার শত্রুদের বধ করবেন, তখন না হয় আবার তিনি এটা ফেরত দেবেন—অথৈনং মে পুনর্দদৎ।

তার মানে, এটা কেনাবেচার ওপরে চলে গেছে। দশটা গোরু নিয়ে ইন্দ্রমূর্তি ফেরত দেবে। এটা তো রীতিমতো ভাড়া দেওয়ার ঘটনা এবং এটা বাণিজ্যের আরও বিবর্তিত পর্যায়, কিন্তু সেটাও গোরুর বিনিময়েই সম্পন্ন হচ্ছে।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গোরুর এই সার্বিক ব্যবহার এবং গুরুত্ব কিন্তু আরও একটা সত্য প্রকাশিত করে। সেটা হল—শুধু অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক নয়, কেননা সেকালের বৈশ্য-কর্ম যেটা—কৃষি-গোরক্ষা-বাণিজ্যম বৈশ্যং কর্ম স্বভাবজম—সেখানে গোরক্ষণের মাধ্যমে কৃষি এবং বাণিজ্য দুটোই হত—ফলে অর্থনৈতিক জায়গাটা পূর্ণ গোময় হয়ে ওঠার ফলে গার্হস্থের জায়গাটাও কিন্তু সার্বিকভাবে গোতান্ত্রিক হয়ে উঠেছিল। এটা মনে রাখতে হবে যে, গোরুর দুধের অনন্ত প্রশংসা এবং তার উপযোগিতার ব্যাপারটা যেমন বৈদিক হোম-যজ্ঞে গোদুগ্ধের বিশদ ব্যবহার থেকে প্রমাণ হয়, তেমনই খাদ্য হিসেবে গোমাংসের প্রচলনও যাগ-যজ্ঞের যজনযাজনের মধ্যে দিয়েই আর্যসমাজে গোরুর যে বহুল উপকারিতা লক্ষ করা গেছে, সেখানে এই মাংসভক্ষণের সুবিধাটাও কিন্তু অন্যতম উপকারিতা হিসেবেই গণ্য হয়েছে।

সাধারণ মানুষ যে একটা গোরুকে ভাগে ভাগে কেটে তারপর রান্না করে খেত, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ঋগবেদে ব্যবহৃত একটি উপমায়। বলা হচ্ছে—হে অগ্নি! তুমি কি দেবতাদের মধ্যে কারও ওপর রাগ করেছ। আমি জানি না বলেই জিজ্ঞাসা করছি এ কথা। মানুষ যেমন খড়্গ দিয়ে একটা গোরুকে ভাগে ভাগে কাটে, তেমনই তুমি আহার্য দ্রব্য পর্বে পর্বে, ভাগে ভাগে কেটে নাও—পর্বশশ্চকর্ত গামিবাসিঃ। ইংরেজিতে যাকে আমরা slaughter house বলি, বৈদিক কালে সেই জায়গার নাম ছিল ‘বিশসন-স্থান’, যদিও বেদ লিখেছে শুধুই শসন। বলা হয়েছে—পৃথিবীর যে জায়গাটায় গোহত্যা করার পর গোরুগুলি পড়ে থাকে, হে ইন্দ্র ! তোমার অস্ত্রে নিহত হয়ে সেইভাবে তোমার শত্রুরাও শুয়ে পড়ুক—মিত্রক্রুবো যচ্ছসনে ন গাবঃ/পৃথিবা আপৃগমুয়া শয়ন্তে।

দুটো মন্ত্রের মধ্যেই পরিষ্কার গো-শব্দেরই উল্লেখ হয়েছে এবং একটি মন্ত্রে একটি সাধারণ গোকর্তনের জায়গা বা বিশসন-স্থানের খবর পাওয়া যাচ্ছে আর একটিতে ‘বিশসন’-এর মতো যাজ্ঞিক শব্দ ব্যবহার না করে একেবারে ‘কাটা’র (কর্তন/চকর্ত) মতো কথ্য পদ ব্যবহার করা হল। কিন্তু আর একটি মন্ত্রে—যেখানে সমস্ত গাভীর অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক গুরুত্ব নির্ধারণ করা হচ্ছে, সেখানে ভরদ্বাজ ঋষির মুখ থেকে এই করুণাঘন উক্তিও শুনতে পাচ্ছি যে, গোরুগুলি এত পুষ্টি দেয় বলেই তস্কর যেন সেই গোরু চুরি না করে, শক্তিমান লোকেদের বলবান সামরিক অশ্বগুলির সামনে পড়ে গোরুগুলি যেন অপহৃত হওয়ার জায়গায় না পৌঁছোয়, আর যজ্ঞে যে পশুবলির ব্যবস্থা থাকে, সেখানে যেন এই গোরুগুলিকে বলি না হতে হয়—ন সংস্কৃতত্রমুপ যন্তি তা অভি।

কালীঘাটে ছাগবলির আগে সেই ছাগলটিকে স্নান করিয়ে মাথায় সিঁদুর লাগিয়ে, গলায় মালা দিয়ে তাকে সংস্কার করা হয়। পূর্বোক্ত ঋকমন্ত্রে ভরদ্বাজ ঋষির আশা—গোরুকে যেন সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্যে গিয়ে বলি না হতে হয়, কেননা গোরু অশেষ পুষ্টিসাধক এবং দেশে দেশে যে গাভীকে ব্যবহার করা হবে সেখানে তার দুধ এবং অন্যান্য গব্য বস্তু দই, ঘি ইত্যাদি—এগুলোর প্রয়োজনীয়তাই প্রধান হয়ে উঠুক এবং তার জন্য সবার আগে এটাই বড়ো প্রয়োজন যে, গোরুর সঙ্গে গোপালনকারী মানুষটির যেন বিচ্ছেদ না ঘটে—

ন তা নশনিত ন দভাতি তস্করো/নাসামমিত্রো ব্যথিরা দধর্ষতি।

দেবাংশ যাভির্যজতে দদাতিচ/জ্যোগিত্তাভিঃ সচতে গোপতিঃ সহ।

এই মন্ত্রের ইতিবাচক প্রার্থনা এবং তার পরের মন্ত্রেই গোরুকে যাতে সংস্কৃত অবস্থায় বলি পর্যন্ত না যেতে হয়—এই প্রার্থনা থেকেই কিন্তু এটাও ইতিবাচকভাবে প্রমাণ হয় যে, একটা সময় দুগ্ধবতী গাভীও যজ্ঞবলি হিসেবে ব্যবহৃত হত, কিন্তু সেই কাজটা যেন বহু প্রয়োজনীয় গাভীকে দিয়ে করা না হয়, তার জন্য প্রার্থনা করেছেন ভরদ্বাজ।

সার্থকভাবে আধুনিক গো-গবেষণা থেকে প্রমাণ হয় যে, একেবারে বৈদিক কালেই যজ্ঞবলি হিসেবে দুগ্ধবতী গাভীর ব্যবহার থেকে বেশ খানিকটা সরে এসেছেন যাজ্ঞিকেরা। হয়তো এই প্রার্থনা থেকেই ঋগবেদে দুগ্ধবতী গাভী সম্বন্ধে আশ্চর্য এক বিশেষণাত্মক বিশেষ্য-শব্দ তৈরি হয়েছে, যেটা প্রায় সংজ্ঞাবাচক এবং এই শব্দটি হল ‘অঘ্ন্যা’ অর্থাৎ গোরু কখনওই মারা যাবে না, মারা উচিত নয়। গোরু শব্দের পর্যায়বাচক এই অঘ্ন্যা বা পুংলিঙ্গে পশুর বিশেষণ হিসেবে ‘অঘ্ন্য’ শব্দটি অন্তত ষোল বার ব্যবহৃত হয়েছে ঋগবেদে। ঋগবেদের বিশেষ একটি মন্ত্রের মধ্যে কথাটা এমনভাবেই এসেছে, যেখানে অবশ্যই গোরুর দুধের গুরুত্বটা ধরা পড়ে এবং এই শব্দের প্রায়োগিক বৈশিষ্ট্য মন্ত্রসূত্রের মধ্যে একটা প্রাতিভাসিক মায়াও প্রতিষ্ঠিত হয়।

বাস্তবেও এটা আমি দেখেছি যে গোরুর মতো এমন একটা নির্বুদ্ধি, নিরীহ এবং একাধারে এমন এক বৃহৎ প্রাণীকে মেরে ফেলতে মায়াই লাগার কথা। আমরা যখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে এ দেশে এসেছিলাম, তখন আমাদের গোরুটি এক হাজি সাহেবের কাছে দিয়ে আসা হয়েছিল, হাজি সাহেব আমার পিতৃবন্ধু ছিলেন এবং কথা দিয়েছিলেন যে, দুধের প্রয়োজনটাই তাঁর বেশি, তিনি যত্নে রাখবেন গোরুটিকে। কিন্তু এই হাত-বদল হওয়া গোরুটিও কিন্তু আমাদের চলে আসাটা বুঝতে পারছিল, সেই পোষা গোরুর চোখে জল পড়তে দেখে আমার মা কেঁদে ফেলেছিলেন। হাজি-সাহেব কিন্তু কথা রেখেছিলেন।

ঋগবেদে যেখানে দুগ্ধবতী গাভী মাত্রেই তাকে ‘অঘ্ন্য’ বলা হচ্ছে, সেখানে যেন এই পারিবারিক মায়া আছে। একটি পোষা গোরু—সেকালের ঋষিরা তাঁদের প্রাত্যহিক অগ্নিহোত্র যাগ করার জন্য এবং অবশ্যই পারিবারিক পুষ্টির জন্য অনেকেই গোরু পুষতেন। আর বশিষ্ঠ মুনির শতেচ্ছাপূরক কামধেনুটি তো এতই বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল যে, সেটা পাওয়ার জন্য বিশ্বামিত্র মুনি যুদ্ধ করেছেন বশিষ্ঠের সঙ্গে। পারিবারিক দুগ্ধপুষ্টির জন্য পাণ্ডব-কৌরবের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন, কিন্তু একটা গোরুও তিনি পাননি। কেননা যার গোরু থাকত, সে গোরুকে তার সম্পদ হিসেবে গণ্য করত। সবার ওপরে আছেন আমাদের গিরিরাজ গোবর্ধন—গোবর্ধন শব্দটাই তো গোরু বাড়ানোর ইঙ্গিত দেয়, কিন্তু এত যে গোরক্ষা-গোবর্ধন, তা সবার মূলে আছে দুধের পুষ্টি, তাতেই গোরুর এই পর্যায়বাচক শব্দ তৈরি হয়েছে—গোরুকে কখনো মারা উচিত নয় বলেই তার নাম ‘অঘ্ন্য’। ঋগবেদের মন্ত্রে প্রার্থনা করা হচ্ছে—হে হত্যার অযোগ্য অহননীয়া গাভী! তুমি শোভন শস্য-তৃণাদি ভক্ষণ কর এবং প্রভূত দুগ্ধবতী হও। তাহলে আমরাও প্রভূত ধনবান হব। সর্বকাল ধরে তৃণ ভক্ষণ কর এবং সর্বত্র গমন করে নির্মল জল পান কর—

সূয়বমাদ ভগবতী হি ভূয়া অথো বয়ং ভগবন্তো স্যাম।

অদ্ধি তৃণম অঘ্ন্যে বিশ্বদানীং পিব

শুদ্ধমুদকমাচরন্তী।।

দুগ্ধবতী গাভী কখনও হত্যার যোগ্য নয়—এমন ঘোষণা সমস্ত বেদ-ব্রাহ্মণে বার বার উচ্চারিত হলেও বৈদিক কালের মানুষ এমনকি ঋষি-ব্রাহ্মণেরাও গোরু খেতেন না এমন নয়। প্রাচীন ব্রাহ্মণগ্রন্থে অর্থাৎ শতপথ ব্রাহ্মণের মতো সুপ্রাচীন ব্রাহ্মণগ্রন্থে যজমান—যিনি যজ্ঞ করবেন—সেই যজমানকে যজ্ঞশালায় প্রবেশ করানো হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ঋত্বিক যাজ্ঞিকেরা আচার ঘোষণা আরম্ভ করলেন—এ যেন গোরু কিংবা ষাঁড়ের মাংস না খায়, কেননা গোরু এবং ষাঁড় এই পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রেখেছে। দেবতারা অন্যান্য সমস্ত প্রাণীর প্রাণশক্তি গোরু এবং ষাঁড়ের মধ্যে দিয়েছেন। অতএব এই দুটি প্রাণী খেয়ো না—তস্মাদ ধেন্বনডুহয়ো নাশ্লীয়াৎ। খেলে মহাপাপ হবে।

এক অনুচ্ছেদ ধরে গোমাংস-বৃষমাংস ভক্ষণ সম্বন্ধে পাপ উচ্চারণের পর হঠাৎ এক বিখ্যাত ঋষির কণ্ঠস্বর শোনা গেল। তিনি বেদ-উপনিষদ, ব্রাহ্মণ-পুরাণের সোচ্চার ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য। তিনি গোরু-ষাঁড়ের নিষেধ শব্দ উড়িয়ে দিয়ে বললেন—সে তোমরা যাই বল বাপু! আমি কিন্তু এ সব মাংস খাই এবং অবশ্যই খাই যদি রান্না করার পর সে মাংসটা বেশ তুলতুলে নরম হয়—তদু হোবাচ যাজ্ঞবল্ক্যো অশ্মাম্যেবাহম অমংসলং চেদ্ভবতি।

যাজ্ঞবল্ক্যের এই সোচ্ছ্বাস ঘোষণা থেকে বোঝা যায় গো-বৃষের মাংস খাওয়াটা যাজ্ঞবল্ক্যের অনেক কালের অভ্যাস এবং এখন এই মাংসগুলির ওপর নিষেধাজ্ঞা নামছে, কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্য সে কথায় আমল দিতে রাজি নন।

বস্তুত বৈদিক কালে গোমাংস ভক্ষণ চালু ছিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু সে মাংসের একটা বিশেষত্ব আছে। ঋগবেদের মধ্যে যতবার গোমাংস ভক্ষণের উল্লেখ আছে, সেখানে বৃষ মাংসের কথাটা খুব স্পষ্ট এবং বহুলভাবে আসে, আর গাভীর ক্ষেত্রে বন্ধ্যা গাভীই কিন্তু দেবাহুতির কাজে লেগেছে। বন্ধ্যা গাভীর পারিভাষিক নাম ছিল বসা। একটি ঋকমন্ত্রে অগ্নির বিশেষণ দেওয়া হয়েছে—উক্ষান্ন, বসান্ন। অর্থাৎ অগ্নি বৃষমিশ্রিত অন্নগ্রহণ করেন এবং বন্ধ্যা গাভীর মাংস মিশ্রিত অন্ন ভোজন করেন, এই দুই প্রকার মাংসের পরেই অবশ্য খানিক সোমরসেরও ব্যবস্থা আছে—উক্ষান্নায় বসান্নায় সোমপৃষ্ঠায় বেধসে। উক্ষ মানে ষাঁড়।

অন্য একটি মন্ত্রে ইন্দ্রের প্রশংসা আছে। যেখানে যেন ইন্দ্রের বন্ধুস্থানীয় একজন, যাঁর নাম বৃষাকপি, ইন্দ্রাণী তাঁকে খুব একটা পছন্দ করেন না বটে, কিন্তু তিনি ইন্দ্রাণীর উদ্দেশে বলছেন—তোমার বৃষদের ইন্দ্র ভক্ষণ করুন, তোমার এই অতি চমৎকার হোমদ্রব্য ইন্দ্র ভক্ষণ করুন। কথাটা শুনে ইন্দ্র নিজেই বৃষভক্ষণের ব্যাপারে উৎসাহিত হয়ে ইন্দ্রাণীকে বললেন—দ্যাখো, একটা-দুটোয় হবে না, অন্তত পনেরো-বিশটা—উক্ষ্নো হি মে পঞ্চদশ সাকং পচন্তি বিংশতিম—আমার জন্য অন্তত পনেরো বিশটা ষাঁড় রান্না করে দাও, আমি খেয়েদেয়ে একটু মোটা হই আর আমার পেটে দু’পাশটাও যেন ভরে যায়।

দেবরাজ এবং বেদের সবচেয়ে বড়ো যোদ্ধা ইন্দ্রের জন্য পনেরো-বিশটা ষাঁড় কী-ভাবে রান্না হত, তার বিবরণে যাচ্ছি না, কিন্তু তিনি যে এই উক্ষান্নের গন্ধে আমোদিত হতেন, তার প্রমাণ বেদের মধ্যে যথেষ্টই আছে। শুধু তাই নয় ইন্দ্র যেহেতু প্রধানত যুদ্ধনেতা এবং যৌনতার ক্ষেত্রেও প্রায় অধিপুরুষ নায়কের মতো তাই গোমাংসের চেয়ে বৃষমাংসই তাঁর পছন্দ ছিল বেশি এবং ঋষিরা নিজেরাই সে মাংস রান্না করে উপহার দিতেন ইন্দ্রকে, আর সেটাও সোমরসের সঙ্গে—অমা তে তুভ্যং বৃষভং পচানি। গোমাংস বা বৃষমাংস খাবার ব্যাপারে আর্যভাষাভাষী প্রাচীনদের এই উদার এবং ঔদরিক ঘোষণা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। যে জাতির কৃষিভিত্তি তেমন ছিল না এবং প্রধানত যাঁরা পশুপালবৃত্তি নিয়ে যাযাবরদের মতোই জীবনধারণ করতেন সেই আর্যরা নিজেদের ইন্দো-ইয়োরোপিয়ান ভাষার অবশেষের সঙ্গে ইন্দো-ইয়োরোপিয়ান খাদ্যাভ্যাসটুকুও সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। ফলত সেখানে পশুধনের সঙ্গে পশুমাংস, বিশেষত আর্যরা বহু দূর ঠান্ডার দেশ থেকে এসেই ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিলেন। প্রথম যেখানে এসে বসতি তৈরি করেছিলেন সেই সপ্তসিন্ধুর দেশটাও ঠান্ডা। খাদ্যাভ্যাস যেহেতু দেশ, কাল, জলবায়ুর ওপরে অনেকটাই নির্ভর করে, তাই গোমাংস, বৃষমাংস ভক্ষণের ব্যাপারটাও খুব সহজভাবে এসেছে ব্রাহ্মণ্য জীবনের মধ্যে। আবার যাজ্ঞিকেরা বৃষমাংস রান্না করে দেবতাদের লোভ দেখাচ্ছেন এই জন্যই—কেননা, যজ্ঞের অবশেষ প্রসাদের ওপর তাঁদেরও লোভ আছে। ঋষি বলছেন ইন্দ্রকে—তোমার জন্য পুরোহিতদের নিয়ে স্থূলকায় একটি বৃষ পাক করেছি। আর পনেরোটি তিথির প্রত্যেকটিতে সোমরসও বানিয়েছি তোমার জন্য।

এই মন্ত্রে বৃষপাকের ব্যাপারে টীকাকার সায়নাচার্যকে লিখতে হয়েছে যে, কোন কোন দেবতার উদ্দেশে বৃষ-শরীরের কোন কোন অংশ আহুতি দেওয়া হবে, আর তিনি যেটা লেখেননি, অথচ অন্যেরা অন্য জায়গায় যেটা লিখেছেন, সেটা হল যজ্ঞের ঋত্বিক-পুরোহিতরা ক্রমান্বয়ে যজ্ঞীয় পশুর কোন ভাগ কেন পান মর্যাদার অনুক্রমে। এবং এটা কোনো টীকা-ভাষ্য নয়, ঐতরেয় ব্রাহ্মণের মতো প্রাচীন ব্রাহ্মণ-গ্রন্থে ঋত্বিক-পুরোহিতদের এই অনুক্রম পরিষ্কারভাবে বলা আছে। বৈদিক যজ্ঞভাবনায় বড় বড় যজ্ঞের সময় বিশেষ করে পশুযাগ, সোমযাগে চারটি পৃথক বেদের চারজন প্রধান পুরোহিতের সহায়তার জন্য স্তরে স্তরে আরও অনেক পুরোহিত থাকতেন তাঁদের প্রত্যেককে যজ্ঞাবশেষ মাংস দেওয়ার জন্য ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ঘোষণা করে বলেছে—এবার পশুর বিভাগে বলছি শোনো—জিহ্বাসহ হনুদ্বয় প্রস্তোতার, শ্যেনাকৃতি বক্ষোভাগ সামবেদীয় প্রধান ঋত্বিক উদগাতার ভাগ, দক্ষিণ শ্রোণি ঋগবেদের প্রধান ঋত্বিক হোতার ভাগ, আর বাম শ্রোণি অথর্ববেদের প্রধান ঋত্বিক ব্রহ্মার, কাঁধ-সহ দক্ষিণ পাশটা পুরো অধ্বর্যুর অর্থাৎ যজুর্বেদীয় প্রধান ঋত্বিকের ভাগ। এইভাবে অন্তত ছত্রিশটা ভাগ সকলের মধ্যে ভাগ করা হত এবং সেটা বৃষই হোক, কমবয়সি ষাঁড় উক্ষই হোক, অথবা অশ্ব কিংবা মেষ-ছাগ।

গোমাংসই হোক কিংবা বৃষমাংস, তার আর এক প্রায়োগিক জায়গা ছিল মধুপর্ক। একালে মধুপর্ক দধি, দুগ্ধ, ঘৃত, মধু আর শর্করায় পর্যবসিত হয়েছে, অর্থাৎ গো-র বদলে গব্য, গোরুর প্রোডাক্ট। কিন্তু সেকালের মধুপর্কে বসার আসন, পা ধোবার জল, ফলমূলের অর্ঘ্য, আচমনের জল আর একটি গোরু—এই ছিল উপাদান—মধুপর্কো গৌঃ। পুরো গোরু যদি না-ই দিতেন, গোমাংস কিছু লাগতই কেননা আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রে আছে—নমাংসো মধুপর্ক ভবতি। পরবর্তী সময়ে যখন গোহত্যার ব্যাপারে সমাজ খানিক সংবেদনশীল হয়েছে, তখন মহাভারতে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখেছি যে, তখন একটি গোরু অতিথিকে মধুপর্ক হিসেবে দেওয়া হচ্ছে বটে—গাঞ্চ ন্যবেদয়ৎ—কিন্তু অতিথি ঋষি ওঁ স্বস্তি বলে গোরুটিকে গ্রহণ করে সেই গোরুটিকে আবার রজ্জুমুক্ত করে দিচ্ছেন। অর্থাৎ পূর্বের প্রথাটুকু প্রতীকী-ভাবে মানা হচ্ছে বটে, কিন্তু গোবধের ঘটনাটা গোরক্ষণের দিকে এগোচ্ছে।

একই কথা পাণিনি ব্যাকরণের ‘গোঘ্ন’ শব্দটি সম্বন্ধেও খাটে। ‘গোঘ্ন’ মানে যে গো হত্যা করে, কিন্তু ব্যাকরণের নিয়মে গোঘ্ন মানে যার জন্য গোরু কাটা হয়। অর্থাৎ গোঘ্ন মানে অতিথি। অতিথি বাড়িতে আসলে তাঁর আতিথেয়তার জন্য গোরু কাটা হত বলে অতিথির নামই হয়ে গেল গোঘ্ন। কিন্তু পরবর্তীকালে এই অতিথিও আর এতটা মাংসরসিক থাকেননি। সমাজে বুদ্ধদেবের আন্দোলন গড়ে উঠেছে পশুহত্যার বিরুদ্ধে, ব্রাহ্মণরা বৌদ্ধ মতকে ‘অ্যাসিমিলেট’ করেছেন যজ্ঞে পশুহত্যার বিকল্প ঘনিয়ে এনে। বৈদিক কালেই কিন্তু এই বিকল্প তৈরি হয়ে গিয়েছিল—ষাঁড় না হলে বড়ো একটা ছাগল হলেও হবে—মহোক্ষং বা মহাজং বা। কাজেই বৈদিকতা মেনে যাগযজ্ঞ করে খানিক বৃষমাংসের প্রসাদও যেমন একেবারে অবৈধ নয়, তেমনই ছাগল তো গোরুকে টেক্কা দিয়ে সমস্ত ভারতবর্ষের জাতীয় খাদ্য হয়ে উঠেছে—বিকল্প আপনার হাতে—মহোক্ষং বা মহাজং বা।

উক্ষ বা বৃষ, অথবা অজাশ্বই হোক, বলতে বাধা নেই—পরিপূর্ণ বৈদিক কালে যে বিরাট যাগ-যজ্ঞের আড়ম্বর তৈরি হয়েছিল, সেখানে যজ্ঞে পশুবধ করে তার মাংস দেবোদ্দেশে আহুতি দেওয়াটাও অন্যতম আড়ম্বর হিসেবে গণ্য হত। এই পশুর মধ্যে অন্যতম ছিল গোরু। আর ষাঁড় তো বার বার উচ্চারিত হয়েছে যজ্ঞীয় পশু হিসেবে। ঋগবেদের একটা ঘটনায় দেখা যাচ্ছে যে, ইন্দ্রের এক পুত্র, তাঁর নাম বসুক্র একটি যজ্ঞ করেছেন, সেখানে অন্যান্য দেবতার সঙ্গে দেবরাজ ইন্দ্রেরও আসার কথা ছিল, কিন্তু তিনি আসেননি। এই অবস্থায় বসুক্রের স্ত্রী একটু দুঃখ করেই বলছেন—

সমস্ত প্রভুসম্মিত দেবতারাই এই যজ্ঞে এলেন কিন্তু আমার শ্বশুরমশাই ইন্দ্র এলেন না। যদি আসতেন তিনি, তাহলে ঘিয়ে ভাজা যবের ছাতু খেতে পেতেন। সোমরসও পান করতে পারতেন—জক্ষীয়াদ ধানা উত সোমং পপীয়াৎ। (ইন্দ্রের পুত্রবধূ এখনও আশা ছাড়েননি, তিনি শ্বশুরের উদ্দেশে বলছেন—) পাথরের উপর ছেঁচে যাঁরা সোমরস তৈরি করেন, সেই সোমরস তুমি পান কর, তারা অনেক ষাঁড়ের মাংস রান্না করেছেন, তুমি তা ভোজন কর—পচন্তি ত্বে বৃষভাঁ অৎসি তেযাৎ পৃক্ষেন যন্মঘবন হুয়মানঃ—আহুতি চলছে, তুমি এস। ভোজন কর। আমাদের ধারণা, ইন্দ্র কিংবা অগ্নি বেদের খুব জবরদস্ত দেবতা বলেই গোরুর চেয়ে ষাঁড়ের মাংস বেশি পছন্দ করতেন। অগ্নির একটা বিশেষণই হল—উক্ষান্ন—উক্ষ মানে বাচ্চা ষাঁড়—ষাঁড়ের পক্ব মাংস সহ ভাত কিংবা ভাজা যবের ছাতু—উক্ষান্ন।

অনেক দৃষ্টান্ত আরও দেওয়া যায়, কিন্তু সেটার থেকেও বড়ো প্রয়োজন এটাই বলা—ষাঁড়ের মাংস খাওয়াটা জনপ্রিয় ছিল বেশি, সেখানে গোরু খাওয়ার চল থাকলেও গোরুর দুধের মূল্য এবং পুষ্টি বেশ তাড়াতাড়িই বুঝতে পারেন প্রাচীন বৈদিকেরা, ফলে গোবধের জন্য বন্ধ্যা গাভীর ব্যবস্থাটা একটা ‘পয়েন্টার।’ বৈদিক পরবর্তী যুগে গোদুগ্ধের বহুল উপকারিতা স্মরণ করেই কিন্তু যজ্ঞে গোবধ নিবারিত হতে থাকে। মহাভারতে রন্তিদেবের যজ্ঞে বহুল গোবধের কথা সগর্বে স্মরণ করা হলেও মহাভারতেই শুধু জীবনধারণের প্রয়াসে শুধু একটি গোরু পাওয়ার জন্য অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন, তবু একটা গোরু তাঁকে কেউ দেয়নি। তার মানে কি গোরু কমে আসছিল! নাকি গোহত্যা বন্ধের পিছনে নাস্তিক অহিংসবাদী বুদ্ধের বৌদ্ধিক আক্রমণও একটা কারণ। খোদ সংস্কৃত শাস্ত্রগুলির মধ্যে—এবং তা মহাভারত থেকে আরম্ভ করে পুরাণগুলির মধ্যে গোহত্যার বিরুদ্ধে দাবি উঠেছিল। লোকে কিন্তু প্রশ্ন তুলেছে—তাহলে বেদে-ব্রাহ্মণ গ্রন্থে যে এত গোবধ বা বৃষ মাংস ভোজনের ছড়াছড়ি, তার কী গতি হবে, বেদই তো সমস্ত শাস্ত্রীয় ধর্মের মূল নিদান, তাহলে? বেদো খিলধর্মমূলম।

ওঁদের উত্তর সাজাতে হয়েছে। বলতে হয়েছে—সে তখন যা হয়েছে, হয়েছে, এখন কলিকাল, এখন গোমাংস ভক্ষণ কলিবর্জ্যের মধ্যে পড়ে। আর বৈদিক ঋষিরা অনেক শক্তিমান, তাঁদের যজ্ঞে যে পশুই বধ্য হোক, আর মেধ্য হোক, যজ্ঞে পশুবধের নিয়ম ঠিক ছিল এবং যজ্ঞে পশুবধ করলে তাকে বধ বলে না—যস্মাৎ যজ্ঞে বধো’ অবধঃ। বেদ-পুরাণ মিলিয়ে আমাদের বক্তব্য হল—গোরু খাবেন কি না সেটা ব্যক্তিগত ‘চয়েস’ এবং হজমশক্তিটাই সেখানে বেশি জরুরি। আমরা তো আর ইন্দ্র নই। অতএব গোরু খাওয়াটা যেমন প্রগতিশীলতার কোনো মাপকাঠি নয়, তেমনই গোবধ যাঁরা করছেন, অথবা যাঁরা গোরু খাচ্ছেন, তাঁদের কোনো অশাস্ত্রীয় চিহ্নে চিহ্নিত করাটাও একেবারে ঠিক নয়। ‘শং নো’স্তু দ্বিপদে শং নো’স্তু চতুষ্পদে—দ্বিপদ এবং চতুষ্পদ দু’জনেরই মঙ্গল হোক।

সকল অধ্যায়

১. নবপত্রিকা
২. দুর্গাপূজা : মার্কণ্ডেয় চণ্ডী এবং কৃত্তিবাসী রামায়ণ
৩. সোমরস
৪. সাপ-লুডোর উৎস সন্ধানে
৫. একখানি গো-এষণা
৬. মহাপুরাণে কুম্ভ
৭. ন সো রমণ ন হাম রমণী
৮. সংকেতস্থান
৯. প্রাচীনকালের আধুনিকা
১০. পৌরাণিক নট-নটী
১১. শকুন্তলার উৎস সন্ধানে
১২. কেশবন্ধ যুগে যুগে
১৩. ফুলডোরে বাঁধ ঝুলনা
১৪. বিবাহ : শিকার এবং শিকারি
১৫. দাম্পত্য-কলহে চৈব
১৬. শালাবাবু
১৭. অপত্য
১৮. চরৈবেতি
১৯. সেই তুমি মূর্তিতে দিবে কি ধরা!
২০. নিয়তি
২১. শ্রুতিতে-স্মৃতিতে নাস্তিকতা
২২. বনচর—শবর-ব্যাধ
২৩. হিন্দু বিবেকানন্দ
২৪. সংস্কৃত সমাজের আড়কাটীরা
২৫. বাঙালির চোখে সেকালের উত্তর ভারতীয়রা
২৬. উত্তর ভারতের চোখে সেকালের বাঙালি
২৭. বাঙালির চোখে, উত্তর ভারতীয়ের চোখ
২৮. ঘোর-কলি
২৯. তোমার কালের স্বাদগন্ধ
৩০. পৌরাণিক আড্ডাখানা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন