নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
পরাশর উবাচ—কলিকালে অষ্টম, নবম এবং দশম বর্ষ বয়স্ক পুরুষের সহবাসেই পঞ্চম, ষষ্ঠ এবং সপ্তম বর্ষীয়া বালিকারাই সন্তানবতী হইবে।
প্রথম শ্রেণিতে পড়া একটি মেয়ে এবং তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া একটি ছেলের মধ্যে মহর্ষি পরাশর যে সম্ভাবনা দেখতে পেরেছেন তা সফল করতে হল প্রচণ্ড বৈজ্ঞানিক উন্নতি প্রয়োজন যা একেবারে ঘোরতম কলিতে, ভারতবর্ষে না হলেও, কলির নিজের রাজ্য আমেরিকাতে সম্ভব হতে পারে।
পরাশর মুনির মতো আরও অনেকেই কলিযুগের সম্বন্ধে এরকম অনেক ভবিষ্যৎবাণী করেছেন, তবে প্রাচীনত্বের বিচারে পরাশর মুনির মতের মূল্য অন্যরকম নিশ্চয়ই। উল্লিখিত শ্লোকটি দেখে অনেকেই হয়তো মনে করবেন—ঋষিরা এইরকম উদ্ভট কথাই বলেছেন বেশি। আসলে কিন্তু তাঁদের অনেক কথা খেটেও গেছে। তবে যেগুলো খেটেছে সেগুলো বেশিরভাগই নদী-নালা কিংবা জীবজন্তু বিষয়ক। নদীনালা শুকিয়ে যাওয়া, কিংবা গোরুর পক্ষে ছাগলের মতো অল্প দুধ দেওয়া, প্রজানুরঞ্জনের নামে তথাকথিত রাজাদের প্রজা শোষণ কিংবা সাধুসন্তের ভণ্ডামি—এগুলোর মধ্যে কালের প্রভাব পড়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু নদী আর গোরুর দৃষ্টান্তে উৎসাহিত হয়ে আমাদের গুরুস্থানীয় ব্যক্তিরা মনে করেন—মানুষের ব্যাপারটাও মিলে গেছে, অন্তত সেই রকমই বিশ্বাস করতে ভালোবাসেন। ঋষিদের সম্বন্ধে আমাদের গুরুস্থানীয়দের যত শ্রদ্ধাই থাক না কেন, এমনকী আমাদেরও যে শ্রদ্ধা নেই তাও নয়, কিন্তু কলিকালের চিত্রটি তাঁদের ত্রিকালদর্শিতায় এমনই নিষ্ঠুর, এমনই নির্মম হয়ে উঠেছে যে পাঁচ বছরের মেয়েকে পর্যন্ত গর্ভধারণ করতে হয়েছে। পরাশর-মুনির সূত্র ধরে আমাদের মনু-মহারাজ আবার আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। তিনি বললেন—চব্বিশ বছরের একটি নায়ক ছেলে বিয়ে করবে একটি আট বছরের মেয়েকে। অভিমত পাত্র পেলে ছ বছরের মেয়েকেও বিয়ে দেওয়া যায়। মুকুলিকা, মানে দেহ-মনে সব অর্থেই মুকুলিকা বালিকা বধূর মধ্যে একটি চব্বিশ বছরের যুবক যে কি আবেদন খুঁজে পাবেন, তা ভাবতে ভয় হয়। সেকালে শাস্ত্রকর্তা তথা কলিযুগের ভাগ্যবিধাতা ঋষিদের কিন্তু সোনার দিন ছিল—সোনার দিন মানে সুখের দিন। প্রেমে পড়ে বা না পড়ে একশো বছর যার সঙ্গে কাটাতে হবে—জীবৈমঃ শরদঃ শতম—তাকে বেশ উচ্চাবচ দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে নিয়েছেন তাঁরা। অর্থাৎ মনু-মহারাজের বিধানমতো তাঁরা নিজেরা যে কচি-খুকিদের বিয়ে করে ঘরে তুলতেন—তা মোটেই নয়। শতপথ ব্রাহ্মণ তো একেবারেই ইতস্তত না করে সোজাসুজি বলে ফেলল—মেয়েদের প্রশংসা করার মতো চেহারা হল—পৃথুশ্রোণি, ক্ষীণমধ্যা এবং উত্তমাঙ্গ পীনোন্নত। এ চেহারা আমাদের চেনা। প্রত্যঙ্গ-বন্ধুর এই বিবরণ আমাদের মনেও আছে, কিন্তু বিসংবাদ তো তাই নিয়ে নয়, বিসংবাদ আচরণ নিয়ে। ত্রিকালজ্ঞ ঋষির দৃষ্টিতে কলিকালে মেয়েমাত্রই স্বেচ্ছাচারিণী, দুঃশীলা—”স্ত্রীগণ সাধারণতঃ স্বেচ্ছাচারিণী হইবে” এবং ”ধর্মানুরূপ-বিবাহ থাকিবে না—বিবাহা ন কলৌ ধর্ম্যাঃ।” অর্থাৎ আবার সেই অসবর্ণ বিয়ে—আমরা অসবর্ণ বিয়ে নিয়ে কোনো কথাই বলতে চাই না কারণ এর ঐতিহ্য এত পুরোনো এবং উদাহরণ এতই বেশি যে ঋষিরা নিজেদের মধ্যে একটু আত্মস্থ হলেই আমাদের এই কলি-কলুষ দৃষ্টিপাতের প্রয়োজন থাকবে না মোটেই। কিন্তু স্বেচ্ছাচারিতা—স্বেচ্ছাচারিতার ফলে অসবর্ণ বিয়ে হত—একথা বললে মানা যেত তবু, কিন্তু তা নয়, মেয়েরা নাকি স্বভাবতই স্বেচ্ছাচারিণী। আজকের দিনে যে সব মেয়েরা একটু অনিয়ন্ত্রিতভাবে ঘোরাফেরা করে কিংবা যাদের মনে একটু কোমল-মধুর আবেশ হয়েছে—সন্দেহ নেই, মহর্ষি পরাশরের ‘ক্রোধ গিয়ে পড়েছে তাদের ওপরেই। অবশ্য ভাগ্যিস পরাশর মুনি আমাদের এই কলিকালে জন্মাননি। সেই দ্বাপরযুগে যমুনা পার হবার সময় নৌকার ওপর সত্যবতীর অতুল রূপ দেখে তাঁর যে অবস্থা হয়েছিল, মহাভারত তার বর্ণনা দিতে গিয়ে যে সব শব্দ ব্যবহার করেছে—সেগুলোর সোজাসুজি অর্থ করলে দেখা যাবে যে মহর্ষির মাথা একেবারে ঘুরে গিয়েছিল। না জানি আজকের এই নরম কলিতে মহর্ষিকে যদি সন্ধ্যাবেলায় গড়িয়াহাটের মোর পার হতে হত, তাহলে আধুনিক সাজে সজ্জিতা, ত্বরিতগতি কোনো পৌরললনার অপাঙ্গ-ইঙ্গিতে, প্রথম দফায় তিনি খড়ম পিছলে পড়ে যেতেন, দ্বিতীয় দফায় বিষ্ণুপুরাণের ‘কলি-ধর্ম-নিরূপণ’—অধ্যায়টি ছিঁড়ে নিয়ে কালিদাসের শিবের মতো বলতেন—অবনতাঙ্গি, তবাস্মি দাসঃ। অবশ্য আধুনিক স্বেচ্ছাচারিণীরা মহর্ষিকে কতদূর সহ্য করতেন তাই নিয়ে একটা সন্দেহ করা চলে, কারণ এরা তো তপস্যার প্রভাব জানে না, আর অভিশাপের ভয়ও নেই। মহাভারতে দেখেছি—সত্যবতী নাকি মুনির বাচিক তাড়নায় পিতার অনুমতি নেবার সময় পর্যন্ত পাননি। শেষ পর্যন্ত মৎস্য-গন্ধের খোলস ছেড়ে যোজন-গন্ধা সত্যবতী মুনির প্রভাবে তাৎক্ষণিক গর্ভমোচন করে মুক্তি পেলেন বটে, কিন্তু আমাদের সর্বকালের অভিভাবক মনু মহারাজ পড়লেন মহাফাঁপরে। তিনি বলেছিলেন—”যে ব্রাহ্মণ শূদ্রার অধর-রস পান করিয়াছে এবং শয্যায় তাহার নিঃশ্বাস গায়ে লইয়াছে এবং তাহাতে সন্তান উৎপাদন করিয়াছে, তাহার ঐ কর্মের নিষ্কৃতি, অর্থাৎ প্রায়শ্চিত্তেরও বিধান নাই।” অর্থাৎ তার হয়ে গেল। মনু অবশ্য মুনি-ঋষিদের চির-তৃষ্ণার্ত অবস্থা বুঝে সমগ্র ব্রাহ্মণ-জাতিকেই কিছু সুবিধে দিয়ে বলেছেন যে, ব্রাহ্মণেরা প্রথমে একটি সবর্ণা ব্রাহ্মণী কন্যা বিয়ে করে নেবেন,’ পরে কামবশত যদি আবার বিয়ে করার ইচ্ছে হয় তবে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র সবই চলবে। ব্যাস-পিতামহ পরাশর মুনিকে কোনো ব্রাহ্মণীর কাছে পূর্বাহ্নেই পাত্রীস্থ করেছিলেন কিনা জানি না। তবে কলস্বনা যমুনার ওপর কুজঝটিকার মধ্যে নৌকাবিলাসের সময় মৎস্যগন্ধার আতপ্ত-নিঃশ্বাস যদি মহামুনির গায়ে লেগে থাকে, তথাচ ব্যাসদেবের জন্ম প্রমাণে তিনি কি এখন স্বর্গে নৌকাবিহার করছেন?
আমাদের মতো কলির জীবদের কিন্তু মনুর শেষোক্ত বিধানটি বেশ পছন্দ হয়েছিল, কিন্তু মুশকিল হল আমরা যদি ব্রাহ্মণী বর্তমানেও ‘আবার মোরে পাগল করে দিবে কে’?—এইরকম একটা শুভ-সূচনা করি তাহলে আদালত আর বন্দিশালা তো আছেই, নিদেনপক্ষে সেই পুরোনো ব্রাহ্মণীর কাছেও কি ফেরা যাবে আবার? ভাবতে পারেন, আমরা নিজেদের স্বেচ্ছাচারিতা সমর্থনের জন্য ঋষিদের স্বৈরবিহার স্মরণ করছি, কিন্তু তাঁদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তাঁরা নিজেরাই আছেন। ভাগবত পুরাণ বললেন—দেখ বাবা পরীক্ষিৎ, তোমরা নিজেরা এসব করতে যেও না। শিব ছাড়া কেউ বিষপান করলে তার যা হাল হবে, এই সব স্বৈরবিহার করতে গেলে সাধারণ মানুষেরও সেই হাল হবে। তা ছাড়া তেজীয়ান পুরুষেরা আগুনের মতো সব কিছুই হজম করে ফেলেন—কাজেই তাঁদের চারিত্রিক ত্রুটিগুলো ধরা চলবে না—তেজীয়সাং ন দোষায়। আমরাও ভাবলাম তাই হবে, না হলে জেলের মেয়ের জালে ধরা পড়লেন পরাশর মুনি, নিয়োগ প্রথায় পরক্ষেত্রে দু-চারটি সন্তান উৎপাদন করলেন পরাশর-পুত্র ব্যাস, আর তস্য পুত্র শুকদেব তাদের সমর্থন করে বললেন—তেজীয়সাং ন দোষায়—এখন বিবাহ-ধর্মে আমরা যাই কোথায়?
এতো গেল বিয়ে-থার কথা আর স্বেচ্ছাচারিতা—সেও তো পুরুষের চিরায়ত। পরাশর মুনি নিজের দৃষ্টাতে পুরুষদের ক্ষমা করে দিয়ে স্বেচ্ছাচারিতার সমস্ত দায় চাপিয়ে গেছেন কলিযুগের মেয়েদের ওপর। কিন্তু সরল, সাদাসিধে বৈদিক-ঋষিরা, যাঁরা পরাশর-মনু, এঁদেরও অনেক আগের যুগের লোক—তাঁরা নির্মল হাস্যে মেয়েদের মৃদুল-গমনের ছন্দটি করে বলত দরদিয়ার মতো ধরে রেখেছেন বৈদিক ছন্দে।
‘যুবতী মেয়ের পেছন পেছন যেমন যুবকেরা ঘোরাফেরা করে’—এই ধরনের উপমা যে ঋগবেদে কতবার আছে তার ঠিক নেই। আর সেই অনুসৃতা যুবতীর মনে রাগ হতে পারে, অপমানও হতে পারে, কিন্তু আত্মতৃপ্তি—সেও কি কিছুই নেই? যে সমাজের যুবকদের মনে এত গান, সেখানে যুবতীদের মনেও কি গুনগুন ছিল না কোনো—সমান্তরাল? দশাঙ্গুলির নিষ্পেষণে সংশোধিত হচ্ছে সোমরস—সেখানে উপমাটি হল—দশটি যুবতী একই সঙ্গে যেমন একটি যুবককে আহ্বান করে। বিশ্বামিত্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে নদীগুলো, মেয়েরা যেমন পুরুষদের দিকে প্রচলিত হয়—আসঙ্গলিপ্সায়। এই ঋক মন্ত্রে আমরা কি মেয়েদের স্বেচ্ছাচারিণী বলব, না স্বাভাবিক দুই হাতে তালির প্রবাদটি মেনে নেব। আর একটি শব্দ আছে ‘সমন।’ শব্দটি নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিবাদ আছে প্রচুর, তবু সাধারণ অর্থে এটি এক ধরনের উৎসব—যে উৎসবে মেয়েদের আশাপূরণের ইঙ্গিত আছেই। মহামতি পিশেলের মতে ‘সমন’ একটি জনপ্রিয়, সার্বজনীন উৎসব যেখানে মেয়েরা আসত মনের মানুষ খুঁজতে, কবিরা যেত স্বরচিত কবিতা পাঠ করে যশ কুড়োতে। আর ধনুর্বেদীরা আসত লক্ষ্যভেধ করে পুরস্কার জিততে। এই উৎসবের মেয়াদ থাকত সারারাত। বায়ুর গতির দ্রুততা বোঝাতে ঋষি উপমা দিলেন ‘সমনং ন ঘোষাঃ অর্থাৎ যে দ্রুততায় মেয়েরা সমনে যোগ দিতে আসে। মেয়েদের এইসব অভিসারে তাদের মায়েদের মদতও কম ছিল না—তাঁরা মোহন সাজে সাজিয়ে দিতেন অভিসারিকাদের। যাতে তারা অভিমত যুবককে আকর্ষণ করতে পারে।
আহা আমাদের যুগে যদি এমন একটি উৎসব থাকত, তাহলে আমাদের মেয়েরা রীতিমতো গান করে বলত—
তুমি উৎসব কর সারারাত
তব বিজয়শঙ্খ বাজিয়ে
মোরে কেড়ে লও তুমি ধরি
হাত নব রক্তবসনে সাজায়ে।
অবশ্য দুঃখ করে লাভ নেই—সত্যযুগের ঐতিহ্য—ছিটেফোঁটা এখনও যেটুকু পড়ে আছে—আমরা তাই সামলাতে পারছি না, তবে তোমার বসন্ত দিন এবং আমার বসন্ত দিনে ভেদ নেই কিছু—তাই একে আমরা স্বেচ্ছাচারিতা বলি না, বলি না দুঃশীলতাও।
যত যাই রসিকতা করি না কেন, ভারী বদরাগী মানুষ ছিলেন এই পরাশর মুনি। কিচ্ছু ভাবলেন না, বুঝলেন না এখনকার কোনও সমস্যা, সোজা রায় দিয়ে দিলেন—কলিকালে নাকি ”স্ত্রীগণ উভয়-হস্ত মস্তক চুলকাইতে চুলকাইতে অনায়াসে স্বামীর বাক্য অবহেলা করিবে।” একথার অর্থ নিশ্চয়ই স্ত্রীরা স্বামীর মাথায় চড়ে বসে এবং উলটোদিক দিয়ে বউ-এর কথায় স্বামীরা কান ধরে ওঠবোস করে। ব্যক্তিগত বিচারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এইরকম একটি অসুস্থ সম্পর্ক আমরা কখনও কামনা করি না, কিন্তু এই ধরনের দুঃখজনক ঘটনা যদি কোথায় বটে থাকে তার জন্যও প্রথমে দোষ দিতে হবে প্রজাপতি ঋষিকে, যিনি সম্রাজ্ঞী শ্বশুরে ভব, সম্রাজ্ঞী শ্বশ্রাং ভব—ইত্যাদি ‘বিবাহমন্ত্রে নববধূকে সবার মাথায় চড়িয়ে দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত সত্য-ত্রেতা-দ্বাপর যুগে অনেক রথী-মহারথী আছেন, যাঁরা স্ত্রীর অত্যন্ত বশীভূত। ভাবুন তো দশ হাজার বছরের বুড়ো রাজা দশরথ যখন রামচন্দ্রের অভিষেক নিয়ে বারংবার অনুরোধ করছেন মেজোরানী কৈকেয়ীকে, তখন তাঁকে দু-হাতে মাথা চুলকাতেও হয়নি, সোজা ঘরের দরজা বন্ধ করে রাগ দেখাতেই সুফল ফলেছে। আমরা স্থানবিশেষে ভীম, অর্জুন এমনকী যুধিষ্ঠিরের পর্যন্ত সাময়িক দুর্বলতার কথা জানি কিন্তু বলব না। বরঞ্চ বলব পরাশর মুনি এ ব্যাপারে আমাদের কাছে হেরে গেছেন। তাঁর অবশ্য লজ্জা পাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তিনি বিনা দ্বিধায় বললেন—”এ বিষয়ে চিরকালের একটি গান আছে। গানটি হল—জগতে স্ত্রীর বশীভূত হইয়া যাহারা মৃত হইয়াছে বা উৎপন্ন হইবে তাহাদিগের মধ্যে শৈব্যাপতি জ্যামঘই শ্রেষ্ঠ।” জ্যামঘ কিন্তু যে সে লোক নন। যদুবংশীয় কৃষ্ণের ঊর্ধ্বতন পুরুষ, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি অপুত্রক। এ সত্ত্বেও তৎকালীন রীতি অনুসারে পুত্র কামনায় দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে সাহসী হলেন না—কারণ অনতিক্রমণীয়া শৈব্যা। একদিন হল কি, এক যুদ্ধজয়ের শেষে সবাই যখন পালিয়ে গেছে, তখন জ্যামঘ দেখতে পেলেন এক সুন্দরী রমণীকে। তাকে বিয়ে করার জন্য রথে চাপিয়ে নিয়ে এলেন বটে রাজধানীতে, কিন্তু শৈব্যার অনুমতি ছাড়া বিয়ে করবেন কী করে? এদিকে শৈব্যা রাজার বামপার্শ্ববর্তিনী নবীনাকে দেখে রেগে বললেন—ব্যাপার কী? পাশে এটি কে? ভয়ের চোটে রাজা বললেন—এ আমার পুত্রবধূ হবে। শৈব্যা বললেন—আমার তো ছেলে নেই। তোমারও অন্য কোনো স্ত্রী নেই, তবে তোমার কোন ধরনের ছেলের সঙ্গে এর বিয়ে হবে? রাজা শেষপর্যন্ত অবস্থা সামাল দেবার জন্য বললেন—ভবিষ্যতে তোমার যে পুত্র হবে তার জন্যই এই বধূ নির্বাচন। এত বুদ্ধিহীন কথা শুনে শৈব্যার মতো সাংঘাতিক মহিলাও হেসে ফেললেন। যা হোক অনুকূল গ্রহলগ্নে শৈব্যার বিদর্ভ নামে এক পুত্র হল। এবং মজার ব্যাপার, সেই পুত্রের সঙ্গে তার দ্বিগুণ-বয়সি সেই মেয়ের বিয়েও হল। তার মানে পরাশর মুনির কালে এসবও চলত, মানে মেয়ের বয়স বেশি হলেও বিয়ের অসুবিধে ছিল না। মুনি অবশ্য বয়সের ব্যাপারটা পুরো চেপে গেছেন; নিছক কলিযুগের অনুসন্ধিৎসায় সে ব্যাপারটি ধরে ফেলেছি আমরা। বেশি বয়সের মেয়ের সঙ্গে বিয়ের রেওয়াজ তখন যে ভালোই ছিল তার প্রমাণ মিলবে কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্নের সঙ্গে মায়াবতীর বিবাহে। মায়াবতী তো রীতিমতো তার স্বামীকে সূতিকা পর্যায় থেকে মানুষই করেছিলেন। পরে তার সঙ্গেই প্রদ্যুম্নের বিয়ে হল।
আগেই বলেছি জ্যামঘ যদু-বংশীয়, কাজেই তাঁর অধস্তন চরম এবং পরম পুরুষ কৃষ্ণের কথাই বা বাদ যায় কেন। কৃষ্ণ স্বভাবতই একটু ললিত গুণের মানুষ বলে বৃন্দাবন অঞ্চলে পরিচিত, কিন্তু দ্বারকায় নাকি তিনি একটু স্বামী-সুলভ মেজাজেই থাকতেন, এমনকি কিঞ্চিৎ পরিহাস করলেও নাকি রুক্মিণী ইত্যাদি স্ত্রীদের মনে ভয় ধরে যেত। ভাগবত পুরাণের প্রমাণে এ কথা আমাদের জানিয়েছে চৈতন্য চরিতামৃত—”কৃষ্ণ যবে রুক্মিণীকে কৈল পরিহাস। কৃষ্ণ ছাড়িবেন জানি রুক্মিণীর হৈল ত্রাস।।” এ হেন কৃষ্ণ নন্দন-কাননে সত্যভামার সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে দেখতে পেলেন পারিজাত-পুষ্প। সত্যভামা বললেন—কৃষ্ণ, তুমিই না বল রুক্মিণী, জাম্ববতী—এদের কেউই আমার তেমন প্রেয়সী নয়, যেমনটি তুমি। এ কথা যদি নিছক চাটুবাক্য না হয় তাহলে এই পারিজাত বৃক্ষ তুলে নিয়ে যেতেই হবে দ্বারকায়, আর সেই ফুল খোঁপায় গুঁজে আমি সতীনদের মনে জ্বালা ধরিয়ে দেব। শেষপর্যন্ত সত্যভামার কথা ফেলতে না পেরে দেবরাজের সঙ্গে এক বিরাট যুদ্ধ লাগিয়ে দিলেন কৃষ্ণ। অন্যদিকে ইন্দ্রেরও বলিহারি যাই। তিনিও শচীর কথায় ওঠ-বোস করেন, ক্রোধান্বিত হয়ে চলে গেলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। অলঙ্ঘ্য নিয়মে যুদ্ধের ফল কৃষ্ণের স্বপক্ষে গেল। অবশেষে দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে রসরাজ কৃষ্ণের যখন বোঝাপড়া হয়ে গেল তখন কিন্তু বিগলিত হয়ে আসল কথাটি স্বমুখেই ফাঁস করেছেন কৃষ্ণ, বলেছেন এত সব যুদ্ধ-বিগ্রহ—তার কারণ স্ত্রীর বচন—সত্যা-বচন-কারণাৎ। সত্যভামার আদরের নাম—সত্যা।
স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মনুষ্যলীলার স্বাদ গন্ধে স্ত্রীর চুলে ফুল গোঁজার জন্য যে লীলা করেছেন সেই লীলায় আমরা লীলায়িত হলেই পরাশর মুনির মুখ ভারী হয়ে যায়, বাস্তবিক সত্যভামার মতো মানিনী স্ত্রী থাকলে আমাদের অনেকেই ‘মিটে যাবে এক প্রেমে জীবনের সর্বপ্রেম-তৃষা।’ আমাদের কালের স্ত্রীরা না হয় ‘মস্তক চুলকাইতে চুলকাইতে’ অনেক কিছু করেন, সে কালে যে স্বামীর মাথাই চুলকে দিয়েছে স্ত্রীরা। আমাদের মনে হয় মহর্ষি বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন যে আমরা এইসব যুক্তিজাল বিস্তার করতে পারি, বিশেষত উপদেশ অপেক্ষা উদাহরণের জোর বেশি, কাজেই মুনি এবার তাঁর শেষ অস্ত্র ছেড়ে আমাদের সম্মানে আঘাত দিলেন, ‘মৈত্রেয়, কলিকালে শ্বশুর ও শাশুড়িই মনুষ্যগণের প্রধান গুরু হইবে এবং শ্যালক ও যাহাদের স্ত্রী অতিশয় সুন্দরী, তাহারাই বন্ধু হইবে।”
নব বিবাহিত যুবকদের পিতা-মাতারা এই ঋষিবাক্যের খবর রাখেন কিনা জানি না, তবে এ কথাগুলো তাঁরা ঋষির মতো করেই বলেন। আর সত্যি এইসব উপসর্গ আজকাল বড় বেশি দেখা যাচ্ছে, বিশেষত যে-কোনো ছেলেই এখন ছেলে হিসেবে যতটা ভালো, জামাই হিসেবে তার থেকে অনেক বেশি ভালো। তবে এও ঐতিহ্য। ঐতিহ্য বলে দেবে এর বীজ ছিল সে কালেই। দর্শনের সার গীতার মধ্যে কৌরব পাণ্ডবদের সৈন্যবাহিনীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে যেখানে অর্জুনের হাত থেকে গাণ্ডীব খসে পড়ে যাচ্ছে, মুখ শুকিয়ে আসছে, যাদের দেখে অর্জুনের মনে হচ্ছে—আমি মরে গেলেও এদের মারতে পারব না, সেখানে আচার্য, পিতৃস্থানীয় এবং পুত্রদের সঙ্গে গদগদভাবে শ্বশুর এবং শালাদের নামও উচ্চারণ করেছেন অর্জুন—মাতুলাঃ শ্বশুরাঃ পৌত্রাঃ শ্যালাঃ সম্বন্ধিনস্তথা। তবে এ ব্যাপারে অর্জুনকে খুব দোষী করে লাভ নেই কেননা পাণ্ডব এবং কৌরবদের প্রপিতামহ থেকে আরম্ভ করে অনেকের মধ্যেই শ্বশুর-শ্যালক সম্বন্ধে বেশ দুর্বলতা দেখা যাবে। প্রপিতামহ শান্তনুর কথাই বলি। নায়িকা ঘুরে ফিরে আবার সেই সত্যবতী। স্থান আবার সেই যমুনা, তবে এবার নদীবক্ষে নয়, নদীতীরে। ভোজরাজ তাঁর ‘শৃঙ্গারপ্রকাশে’ সত্যবতীকে ফেলেছেন ‘পুনর্ভূ’ নায়িকাশ্রেণির মধ্যে। ‘পুনর্ভূ’ মানে যার দুবার বিয়ে হয়েছে। ভোজরাজের মতে সত্যবতী পুনর্ভূ বটে তবে অক্ষতা অর্থাৎ পরাশর মুনির ব্যাপারটা তিনি ইচ্ছে করেই ভুলে গেছেন। যাক সে কথা। এই সত্যবতী তাঁর পূর্ব-নায়কের প্রসাদী গন্ধে মাতিয়ে রেখেছিলেন যমুনার তীর। মোহিত হলেন শান্তনু। ভীষ্মের মতো দেবকল্প পুত্র থাকতেও বিয়ের কথা বলার জন্য চলে গেলেন কন্যার পিতার কাছে। দাসরাজার শর্ত ছিল সত্যবতীর পুত্রই হবে ভবিষ্যতের রাজা—ভীষ্ম নয়। মহা ফাঁপরে পড়লেন শান্তনু। কিন্তু ভীষ্ম? তিনি তো কম পুরুষ নন, যৌবন বয়সে যাকে পিতার বিবাহ দেখতে হয় তাকে তৈরি হতে হয় শিশুকাল থেকেই। শান্তনুর মলিন মুখখানি দেখে ঠিক ধরে ফেললেন তাঁর মানসিক অবস্থা। শান্তনু তখন তো-তো করে যা বললেন তার অভিনব শৈলীটি জানা থাকলে আজকের দিনের অনেকের পক্ষে দ্বিতীয়বার বিয়ে করা সম্ভব।
শ্বশুরের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অর্ধাঙ্গিনীর নাম না করলে তিনি দুঃখিত হবেন, তাই শাশুড়ির কথাও কিছু বলতে হয়। তবে তাঁর নিয়ন্ত্রণক্ষমতা নিয়ে গল্প ফেঁদে বসলে অন্যায় হবে, কেননা স্বয়ং মনু মহারাজ তাঁকে গুরুপত্নীর মতো সম্মান করতে বলেছেন। কতকগুলো পুরাণেও আছে সেকথা। তা ছাড়া শ্বশুরের মতো শাশুড়ির নিয়ন্ত্রণ তত সোজাসুজি নয়, তার উপদেশ আসে তাঁর কন্যার সূত্র ধরে, এবং তা কাজ করে নরম বিষের মতো। তারপর যা হয়—রাজা করিতেছে রাজ্যশাসন, তাহারে শাসিছে রানী। পরাশর মুনি যা-ই বলুন, অন্তত রানীর উপরেও নির্ভর না করলে যুগধর্মে তথা ঐতিহ্যে পতিত হবে কলির জীবেরা। সেইজন্যেই এত কথা। নইলে আমরা তো তাঁরাই।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন