নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
ফুটপাতে এইখানে যার শোয়ার কথা ছিল, সে দেশে গেছে, বিহারে। তার জায়গার দখল রাখতে যে রিকশাওয়ালা আজকে এখানে শুলো, তাকে রাত একটার সময় এক মদ্যপ গাড়ি এসে পিষে দিয়ে গেল। লোকে বলল—যার মরবার কথা ছিল, সে বেঁচে গেল—রাখে হরি মারে কে! আর যে লোকটা কোনো দিন গঙ্গার ধারের ওই বটতলা ছাড়া শুতো না, সে ব্যাটা গঙ্গার আশ্রয় ছেড়ে একদিনের শহুরে আমোদ করতে এল আর বেঘোরে মরল। কপাল! কপালের নাম গোপাল।
এই সামান্য কথ্যের মধ্যে দুটি কথা খেয়াল করার মতো। প্রথম কথা একটা মানুষ দৈবক্রমে বেঁচেছে এবং তার বাঁচার পিছনে ভগবান শ্রীহরির গূঢ় অবদান আছে বলে মনে করা হচ্ছে অর্থাৎ বেঁচে থাকার এই আকস্মিকতাটুকু এখানে শ্রীহরির প্রতি নিবেদিত হল। অন্যদিকে যে লোকটি মারা গেল এবং যার মারা যাবার কোনো পরম্পরাগত যুক্তি ছিল না, অথচ আজ মরণ যেন তাকে ডেকে নিয়ে এল মারার জন্য, সেটা নিতান্তই কপাল এবং সে কপালও এখানে গোপালের সঙ্গে একাত্মকভাবে চিহ্নিত। অর্থাৎ কি না বাঁচা-মরা দুই ক্ষেত্রেই আমাদের কপালটুকু যেন ভগবানের ওপর নির্ভর করছে।
এখানে যুক্তিবাদীর মন কিন্তু তদন্তকারী পুলিশের মতোই কপালের পূর্বানুসন্ধানে ব্যস্ত থাকে অর্থাৎ যার মৃত্যু হল, তার কাপালিক মৃত্যুর চেয়েও বড়ো হয়ে ওঠে—যে গাড়িটি এসেছিল, সেটা কত মাইল স্পিডে এসেছিল, গাড়ির চালক মদ্যপান করেছিল কি না, কোথাকার গাড়ি, কার গাড়ি ইত্যাদি। অর্থাৎ যত তদন্ত সব কিন্তু বেঁচে থাকা আততায়ীকে নিয়ে। কিন্তু যে অদ্ভুত আকস্মিকতায় লোকটি মরল, সেখানে সমস্ত তদন্ত কিন্তু ততোধিক একটা ‘যদি’-র ঘটনাশৃঙ্খলে পূর্বাবদ্ধ। অর্থাৎ যদি মৃত লোকটির দেশওয়ালি বন্ধু দেশে না যেত, সে দেশে গেলেও যদি এই লোকটি শুতে না আসত এখানে, যদি বা শুয়েইছে, তাহলে দু-হাত সরে যদি শুতো, আর যদি ঘাতক গাড়ির মালিক মদ না খেয়ে চালাত—এই এত সব ‘যদি’ যদি রাত গভীরের সেই ভয়ংকরী আকস্মিকতাকে আটকাতে পারত, তাহলেও বৈরাগী দার্শনিক বলতেন—লিখিতমপি ললাটে প্রোজ্ঝিতুং কঃ সমর্থঃ। অর্থাৎ ললাটে যা লেখা হয়েছে, তা কেউ আটকাতে পারবে না।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে যাবে যে, ললাটে কেউ লেখে নাকি? লিখলে কোন সেই বিধাতা পুরুষ, যিনি সকলের অলক্ষ্যে বসে প্রতি মানুষের ললাটে নিতান্ত অলক্ষ্য লেখাগুলি লিখছেন? এত কি সময় আছে তাঁর? অলৌকিক বিশ্বাসেও যেন বিশ্বাস হতে চায় না এ কথা। অথচ এইরকম একটা অপমৃত্যুর ব্যাখ্যা নেই কোনো। আর সেই ব্যাখ্যাটা যদি নিতান্ত বৈজ্ঞানিক হয়, তাহলে সেটা ব্যক্ত করা খুব সোজা এবং তা হবে অনেকটাই সেই জাপানি কবিতার মতো—নদীর জল, ব্যাঙের লাফ আর সামান্য জল ছিটকানোর মতো—অর্থাৎ লোকটা যেখানে শুয়েছিল, গাড়িটি দিক ভুল করে, অতি বেগে তার উপরে এসে পড়ায় এই মৃত্যু ঘটেছে এবং মৃত্যু আটকানোর একমাত্র উপায় ছিল একটাই—লোকটার ওখানে না শোয়া এবং গাড়িটির গতিভ্রষ্ট না হওয়া। কিন্তু এই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় তাঁদের কোনো সান্ত্বনা নেই, যাঁরা খুব শাস্ত্রীয় ভাবেই এমন অসম্ভবনাময় ‘যদি’র কথা শুনেছেন। সেই বিখ্যাত শ্লোকটি এখানে এক প্রমাণের মতো হয়ে ওঠে। শ্লোক বলেছিল—যা অনিবার্য, এমন সব ঘটনা যা নিবারণ করা যায় না—সেই অনিবার্য এবং অবশ্যম্ভাবী ঘটনার যদি কোনো প্রতিকার মানুষের হাতে থাকত, তাহলে নিষধ-দেশের রাজা নল, অযোধ্যার রঘুপতি রামচন্দ্র এবং মহাভারতের যুধিষ্ঠির সারাজীবন ধরে অত কষ্ট পেতেন না—তদা দুঃখৈর্ন লিপ্যেরন নল-রাম-যুধিষ্ঠিরাঃ। নিয়তি নল-যুধিষ্ঠিরের মতো মার্জিত রাজাদের পাশাখেলার আসরে টেনে নিয়ে গেছে, নিয়তিই রামচন্দ্রের মতো স্থিতধী পুরুষকে সোনার হরিণের পিছনে দৌড়োতে প্ররোচিত করেছে।
নিয়তি কি তাহলে এই বিরাট চলমানতার মধ্যে সেই অনুঘটক ধ্রুব-বিন্দু, যা যুধিষ্ঠির-রামচন্দ্রের মতো মানুষেরও বুদ্ধির বিকার ঘটিয়ে দিতে পারে; নাকি নিয়তি সেই অদ্ভুত, আকস্মিক, অজ্ঞাত অভিভাবক যাঁর কোনো মতিস্থির নেই—কখন কী করবেন বলে। আসলে নিয়তি কোনো গড্ডল প্রবাহ নয়, যা প্রতিদিন একইরকম ভাবে ঘটবে। যেহেতু এখানে কোনো পূর্বনিয়ন্ত্রণ থাকে না, তাই সেই আকস্মিকতা এড়ানোর জন্য পূর্ব কোনো পরিকল্পনাও তৈরি করতে পারা যায় না। ফলত ‘নিয়তিঃ কেন বাধ্যতে’—এমন কেউ নেই যে নিয়তিকে আটকাতে পারে। আর আটকানো ব্যাপারটা নেহাৎই অসাধ্য বলেই মানুষ কিন্তু এখানে পূর্বজন্মের পাপ-পুণ্য, কর্মফল থেকে আরম্ভ করে অভিশাপ, তিরস্কার, বর, বরাভয়, পুণ্য ইত্যাদি অব্যাখ্যেয় নানারকম অতর্কিত সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করে—যেগুলি নিয়তির আকস্মিকতাকে খানিকটা সহনীয় করে তোলে বটে, কিন্তু হঠাৎ নেমে আসা নিয়তির ব্যাখাটি মোটেই সহনীয় হয় না।
আসলে নিয়তি বস্তুটা ঠিক ভাগ্য, কপাল, ভবিতব্য কিংবা বিধির বিধান বলে মেনে নেওয়া যায় না। এই যে সেদিন একটা নির্মীয়মান ‘ব্রিজ’ ভেঙে পড়ল এতগুলি লোকের মাথায়—লোকগুলির দোষ হল এই যে, তারা বিনা ভাবনায় সেতুর তলা দিয়ে যাচ্ছিল। অন্য দিনেও তারা সেখান দিয়ে আসা-যাওয়া করেছে। কিন্তু সেদিন সেই মুহূর্তটা কতটা প্রতিকূল ছিল, যাতে কতগুলি নিরীহ মানুষ মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করলেন মুহূর্তের মধ্যে। ন্যায়শাস্ত্রে বিদ্বান নৈয়ায়িক যাঁরা, যাঁরা তর্কযুক্তিতে সর্বত্রই সংশয় প্রকাশ করেন বলে অনেকেই তাঁদের ‘হৈতুক’ বা ‘হেতুবাদী’ বলেন, সেই নৈয়ায়িকরাও কিন্তু এইরকম আকস্মিক মৃত্যুর হেতু নির্ধারণের খুব স্পষ্ট কথা বলেননি।
প্রাচীন ন্যায়শাস্ত্রের মূর্ধণ্য পুরুষ উদয়নাচার্য তাঁর ন্যায়কুসুমাঞ্জলি গ্রন্থে কদাচিৎ কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পিছনেও একটা হেতু আছে বলেই তিনি মনে করেন। তাঁর মতে কার্যমাত্রেই তার কারণ থাকবে, কেননা কার্যমাত্রেই সেটা সাপেক্ষ, অর্থাৎ কোনো কিছুকে সেটি অপেক্ষা করে। উদয়নের মতে কার্য যে কারণসাপেক্ষ, সেটা সিদ্ধ হয় কাদাচিৎকত্বের মাধ্যমে। যা কোনো কালে থাকে এবং কোনো কালে থাকে না তাকে বলে ‘কাদাচিৎক’—কদাচিৎ থেকে কথাটা এসেছে। যে কোনো কার্যই কার্যোৎপত্তির আগে পর্যন্ত থাকে না, কিন্তু উৎপত্তির পর থাকে, অতএব সেটা কাদাচিৎক। কার্যের উৎপত্তি-ঘটনাটাই যেহেতু কাদাচিৎক, অতএব তার হেতুটাও কাদাচিৎকে হতেই হবে। এইভাবে বললে এটাই দাঁড়াবে যে, একটি কার্য যেমন সহেতুক, সেই কার্যের হেতুটাও তেমনই সহেতুক এবং সেই হেতুর হেতুও সহেতুক। এইভাবে চললে তর্কের ক্ষেত্রে অনাবস্থা দোষ হয়, ইংরেজিতে যাকে বলে অ্যাড ইনফিনিটাম।
অনাবস্থা দোষ কাটানোর জন্য কার্যকারণের সহেতুক প্রবাহের মধ্যে একটি হেতুকে অহেতুক বলে ধরা হয় এবং সে ক্ষেত্রে প্রথম কার্যটাকেই অহেতুক স্বীকার করা উচিত। তার উত্তরেই উদয়ন বলেছেন যে, কার্যকারণ প্রবাহ অনাদি, সমস্ত কার্য যেহেতু এক রকম নয়, অতএব তার হেতুও বিচিত্র। আবার বিভিন্ন ব্যক্তির ভোগ্যবস্তু একরকম হতে পারে, কিন্তু সুখভোগ বা দুঃখভোগ প্রত্যেকটি ব্যক্তিরই ভিন্ন ভিন্ন। একই বস্তু একের সুখের কারণ হতে পারে, কিন্তু অন্য জনের পক্ষে সেটা দুঃখের কারণও হতে পারে। ফলত প্রত্যেকটি ব্যক্তির অদৃষ্ট তার নিজের নিজের ভোগের কারণ—সেটা সুখভোগই হোক অথবা দুঃখভোগ।
উদয়ন যা বলেছেন, তাতে কিন্তু শুধু একটা মাত্র কারণকে নির্দেশ করা যায় না আকস্মিক কোনো বিপদের জন্য, অথবা কোনো সুখভোগ্য বস্তুর জন্য। নৈয়ায়িকরা এখানে ঈশ্বর, ঈশ্বরের জ্ঞান থেকে আরম্ভ করে কাল অদৃষ্ট, ধর্ম, ব্যক্তি এমন অন্তত আট রকম নিমিত্তের কথা বলেছেন, যা একটি কার্যের অব্যবহিত পূর্বে কাদাচিৎক হেতু হিসেবে থাকে। কিন্তু তাঁরা কোনোভাবেই এটা মানবেন না যে কোনো হেতু ছাড়াই অকস্মাৎ একটা ঘটনা ঘটে গেল। আকস্মিকতার কথাটা চার্বাকদের মতো।
আমরা ন্যায়শাস্ত্রের কথা উল্লেখ করে আকস্মিক দুর্ঘটনার কথাটা জটিল করে ফেলতে পেরেছি বটে, কিন্তু ন্যায়মতে চললেও ব্যাপারটার হেতুকল্প এমনও হতে পারে যে, অতগুলো লোকের মাথার উপর যে জোড়াসাঁকোর নির্মীয়মাণ সেতুটি ভেঙে পড়ল, তার পিছনে সেতুর ভেঙে পড়াটাই কাদাচিৎক হেতু, আর সেতুটা ভাঙল কেন তার কারণ একেবারেই পৃথক, যদিও কার্যকারণ প্রবাহে সেই হেতুর সঙ্গে অপরাপর হেতুগুলিও অনুপূর্বিতায় মানুষের অবশেষ মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
একটা কথা কিন্তু মানতেই হবে যে, এখনো এই ঘোর টেকনোলজির যুগে যেখানে বিজ্ঞান সব সময় আমাদের হেতুবাদিতা শিক্ষা দিচ্ছে, সেখানে এখনও গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে হাজার হাজার দৈবজ্ঞ বসে আছেন, যাঁদের কাছে শতেক মানুষ আছেন ভবিষ্য দৈবের উপশম ঘটাতে। অথবা ভবিষ্যতে কী ঘটবে, সেটা আগে থেকে জানতে। আশ্চর্যের কথা হল—ভারতবর্ষ দেবতায় বিশ্বাস করে, দৈবেও বিশ্বাস করে, কিন্তু তাই বলে দৈবই সব, দৈবই সব ঘটিয়ে দিচ্ছে—এমনটা বিশ্বাস করে না ভারতবর্ষের মানুষ। বরঞ্চ দেখেছি, আপন অহংকার এবং অপসিদ্ধান্তে যখন সব কিছু শেষ হতে বসেছে, তখনই দৈবকে স্বীকার করেছে মানুষ। কিন্তু তাতে এটাই প্রমাণ হয় যে, ভারতবর্ষ যত বড়ো ‘ধর্মক্ষেত্র’ হোক না কেন, জীবনের শেষ নেমে না আসা পর্যন্ত সে ‘কুরুক্ষেত্রে’ই বিশ্বাস করে।
লক্ষণীয়, যাকে আমরা নিয়তি কিংবা দৈব বলছি তার অনেকগুলি পর্যায়-শব্দ আছে মহাভারত-পুরাণে এবং সংস্কৃত সাহিত্যে—যেমন ভাগ্য, অদৃষ্ট, ভবিতব্য, দিষ্ট, কাল, বিধি, বিধির বিধান, বিধিলিপি, ভাগধেয়, কর্ম, ললাট-লিখিত, ভাবী, যদৃচ্ছা, অচিন্ত্য এবং ঈশ্বর। এই শব্দগুলির প্রত্যেকটির মধ্যে একের সঙ্গে অপরের কিছু আন্তর পার্থক্য আছে, আবার এগুলির প্রত্যেকটির মধ্যেই মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া এবং ঘটিতব্য বিষয়ের একটা অনির্দেশ্য উপাদান আছে, যেটাকে মানুষ কার্যকারণ-সূত্রে মেলাতে পারে না এবং সেই জায়গাগুলোতেই যেন অগত্যা উপরোক্ত কোনো একটি শব্দের আশ্রয় তথা আক্ষেপ শুনতে হয়। সবচেয়ে বড়ো কথা, এই শব্দগুলির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝে নিলে দেখা যাবে যে, একের সঙ্গে অপরের গূঢ়, সূক্ষ্ম পার্থক্যও আছে যথেষ্ট, কোথাও কোথাও এক-একটি শব্দ অতি ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে নিজস্ব গভীরতাও হারিয়ে ফেলেছে।
আমরা নিয়তির ক্ষেত্রে প্রায় সব সময়ই ভালো-মন্দ কর্ম এবং কর্মফলের প্রসঙ্গ উত্থাপন করি এবং সেটাই বোধহয় নিয়তির বিশ্লেষণে সবচেয়ে বড়ো তর্কযুক্তির পরিসর। অর্থাৎ কিনা কার্যোৎপত্তির সময়ে আমরা যেমন অনাদি কার্যকারণের প্রবাহ স্বীকার করি, নিয়তির ক্ষেত্রে কর্ম বা কর্মফলের যুক্তিটা অনেকটাই কার্যকারণের রূপান্তরিত চেহারা। কিন্তু কর্মের দার্শনিক যৌক্তিকতা যখন তৈরি হয়নি, তখন কিন্তু সেই সব শব্দই আমাদের নিয়তির ব্যাখ্যায় কাজে লেগেছে যেখানে না-বুঝে-ওঠা অলৌকিকতার আভাস তৈরি হয়েছে—সেখানে বিধি, বিধান, অদৃষ্ট, দিষ্ট, বিধিলিপি, ভাগ্য তথা ভাগধেয় এবং নিয়তির মতো শব্দগুলি একাকার হয়ে যায়।
যে মহাকবি লিখেছিলেন ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান’, তিনিও এটা বুঝেছিলেন যে, মনুষ্যচেষ্টার বাইরেও এমন এক অব্যাখ্যেয় শক্তি আছে, যার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেক সময় ভুলও করি আমরা। বিধি, বিধান কিংবা নিয়তির ব্যাখ্যায় একটা সুশৃঙ্খল নীতি-নিয়ম থাকে কখনো। যেমন বিধি, নিয়তি কিংবা বিধির বাঁধন কিন্তু এটাও যে গোলাপ ফুলে গন্ধ থাকবে, কিংবা জলে শীতলতা থাকবে; একইভাবে এটাও কিন্তু নিয়তি যে, কোনো মতেই যা ব্যাখ্যাযোগ্য নয়—এমন দুর্ঘটনাকে জন্মান্তরীণ কর্মসংস্কারের মধ্যে ফেলাটা একদিকে পাপ-পুণ্যভোগের ব্যাপারে যেমন আমাদের নিজস্ব ব্যক্তিভূমি তৈরি করে, তেমনই দুর্ঘটনার অনিবার্যতার মধ্যে কোথায় যেন একটা অলৌকিকতার আভাসও তৈরি করে।
মহাভারত-রামায়ণ বা পুরাণগুলিতে অদৃষ্ট, নিয়তি বা বিধির বিধান জন্মান্তরবাদের সঙ্গে একান্তভাবে সংশ্লিষ্ট। বিশেষত দুঃখের সান্ত্বনায় মানুষ কর্মফল, দৈব, জন্মান্তর এবং কালকে এমনভাবেই ব্যবহার করে, যাতে দুর্ঘটনার যেমন হেতু তৈরি হয়, তেমনই সান্ত্বনা এবং দুঃখপ্রশমনেরও হেতু তৈরি হয়। মহাভারতে বলা হয়েছে—মানুষ জীবনের যে অবস্থায় যে ধরনের যে পরিমাণ কাজ করে, পরজন্মে সে যদি মানুষ হয়েই জন্মায়, তাহলে সেই অবস্থায় সেইরকম এবং সেই পরিমাণই ফল পায়—যস্যাং যস্যাম অবস্থায়াং যৎ যৎ কর্ম করোতি যঃ। মহাভারতের অণীমাণ্ডব্যের উপাখ্যানে কর্মফলের একটা যথাযথ উদাহরণ আছে। ঋষি মাণ্ডব্য তপোবনে তপস্যা করছিলেন মৌনী হয়ে। এই সময় কতগুলি চোর রাজপুরুষের তাড়া খেয়ে মুনির আশ্রমে ঢুকে বামাল-সমেত এখানে-ওখানে লুকিয়ে রইল। এ দিকে রাজরক্ষীরাও আনুমানিক সন্দেহে মাণ্ডব্য মুনির আশ্রমে ঢুকে মুনিকে চোরদের নিয়ে প্রশ্ন করল। মৌনব্রতী মুনির কাছে কোনো উত্তর না পেয়ে তারা নিজেরাই এদিক-ওদিক খোঁজাখুঁজি করে বামাল-সমেত চোরদের ধরেও ফেলল। কিন্তু চোরদের ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় রাজপুরুষেরা মুনিকেও সন্দেহবশে রাজার কাছে ধরে নিয়ে গেল।
রাজা কোনো বাছ-বিচার না করে সবাইকেই শূলে চড়ানোর আদেশ দিলেন। সব চোরদের সঙ্গে মাণ্ডব্য মুনিকেও শূলে চড়িয়ে দিল রাজরক্ষী পুরুষেরা। আশ্চর্য হল, চোরেরা সকলেই এই শাস্তিতে মারা পড়ল বটে কিন্তু মাণ্ডব্য মুনি মারা গেলেন না। উপরন্তু তাঁকে দেখা গেল তিনি সেই শূল-গাঁথা অবস্থাতেই তপস্যায় মৌনী হয়ে আছেন বেশ কিছুদিন। রক্ষীরা অবাক হয়ে রাজাকে খবর দিলে রাজা নিজে গিয়ে মুনির কাছে ক্ষমা চাইলেন এবং তৎক্ষণাৎ তাঁকে শূল থেকে নামাতে বললেন। রাজার আদেশ সহজে পালন করা গেল না, কেননা মুনির শরীরে গেঁথে যাওয়া শূল পুরোপুরি বার করে নিতে হলে তাঁর প্রাণ যাবে। অতএব রক্ষীরা মুনির দেহপ্রবিষ্ট শূলের বহিরাংশ কোনো মতে কেটে নিল, কিন্তু সেই শূলের অগ্রভাগ—যার পারিভাষিক নাম ‘অণী’—সেই অণী তাঁর শরীরের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েই রইল। মাণ্ডব্য মুনি কাউকে কোনো দোষারোপ না করে শূলাগ্রভাগ অণীটিকে দেহে ধারণ করেই নানা তীর্থে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। তাঁর নাম হয়ে গেল অণীমাণ্ডব্য।
তপস্যার প্রভাবে মাণ্ডব্য মুনি যখন স্বর্গলোকে স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করতে পারেন, তখন তিনি একদিন সময় বুঝে উপস্থিত হলেন ধর্মরাজের কাছে। তিনি ভগবান ধর্মকে প্রায় তিরস্কারের ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করলেন—আমি আমার অজ্ঞাতে কী এমন দুষ্কর্ম করেছি, যাতে এই শূলাগ্রভাগ দেহে নিয়ে অনন্ত যন্ত্রণায় ঘুরে বেড়াচ্ছি সর্বত্র। ধর্ম কালবিলম্ব না করে মাণ্ডব্য মুনিকে তাঁর পূর্বজন্মের এক বিচিত্র কৌতুকের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন—আপনি কোনো সময়ে ফড়িং জাতীয় কতগুলি পতঙ্গিকার পুচ্ছদেশে নলখাগড়ার শিষ প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিলেন, সেই জন্যই আজকে এইভাবে শূলাগ্রভাগ দেহে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে আপনাকে। ধর্মরাজ একটু জ্ঞানও দিলেন সঙ্গে বললেন—শুনুন ঋষি! অল্প একটু দান করলেও তার ফল যেমন বহুগুণ হয়, তেমনই সামান্য পাপ করলেও তার ফল অনেকগুণ বেশি হয়।
বলা বাহুল্য, শেষের কথাটি জ্ঞানবাণীই বটে, হয়তো বা ফড়িংয়ের মতো পতঙ্গিকার পুচ্ছদেশে যে ‘ইষিকা’ প্রবেশ করানো হয়েছিল, সেই কষ্টটা মানুষের পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয় বলেই মনুষ্যদেহে শূল প্রবেশনের কষ্টটা একইভাবে তুলনীয় হলেও মানুষ সেটা বেশি কষ্টকর ভাবে বলেই ধর্মরাজ পাপের ফলের মধ্যে গুণিতকের প্রশ্ন তুলেছেন। বাস্তবে কিন্তু যেমন কর্ম তেমন ফলের কথাই নির্দেশ করেছে মহাভারত। অর্থাৎ যিনি পতঙ্গিকার পুচ্ছদেশে ইষিকা প্রবেশ করিয়েছেন, তাঁরই গুহ্যদেশে শূল প্রবেশ করাচ্ছেন রাজরক্ষী পুরুষেরা—যস্যাং যস্যামবস্থায়াং যৎ যৎ কর্ম করোতি যঃ।
আমরা আবারও ‘ফ্রিডম অব উইল’-এর কথা তুলছি। বলতে চাইছি, যে ভাবেই আপনারা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করুন না কেন—সেখানে জন্মান্তরীণ কর্ম মন্দ-ভালো যাই করুক না মানুষ, সেই কর্মের ফলও সে মন্দ-ভালো যাই পাক, সে সবটাই তার নিজের ‘প্রোরোগেটিভ’, এখানে ভগবানের কোনো হাত নেই, এখানে তিনি সাক্ষী-চৈতন্যের মতো আছেন, তাঁর অধিকার নেই কোনো জীবসমূহের কর্মকাণ্ডে হাত দেওয়ার বা অনুপ্রবেশ করার। এদিক থেকে ভারতবর্ষীয় জীবের স্বাধীনতা বা ‘ফ্রিডম অব উইল’ আক্ষরিক অর্থেই অনেক বেশি, অর্থাৎ পাপ-পুণ্যের কর্ম-সাধনে ঈশ্বরের কোনো ভূমিকা নেই। কথাটা বেশ পরিষ্কার করে ঘোষণাও করে দেওয়া হয়েছে ভগবদগীতায় এবং সে ঘোষণা করেছেন ভগবৎ-প্রমাণ মানুষটি, যিনি গীতার প্রবক্তা।
আমি এক ছেলেহারা মায়ের বিলাপ শুনেছিলাম, এক মধ্যবয়সী রমণীর করুণ আর্তি শুনেছিলাম—তাঁর স্বামীর শবদেহ গ্রামে ফেরার পর—তাঁদের আকুল আর্তি শব্দের মধ্যে বার বার ভগবানের উদ্দেশে চরম তিরস্কার উচ্চারিত হয়েছে, এমনও তাঁরা প্রতিজ্ঞা করেছেন যে, আর কোনো দিন তাঁরা ঠাকুরের সিংহাসন স্পর্শ করবেন না, বরঞ্চ জলে ভাসিয়ে দেবেন ভগবানের বিগ্রহ। আমাদের গীতার দার্শনিক সেই ভগবৎপ্রমাণ মানুষটি, যিনি আমাদের কালের রাখালও বটে, তিনি তাঁর সমস্ত আলোক ধেনুগুলিকে চড়াতে দিয়েছেন পূর্ণ স্বাধীনতায় এবং নিজে কোথায় বসে যে বেণু বাজাচ্ছেন, তাও জানি না, সেই তিনি কিন্তু বহুকাল আগেই হাত তুলে দিয়েছেন মানুষের ব্যাপারে। তিনি পূর্ণ ঈশ্বরাবেশে ঘোষণা করে বলেছেন—দ্যাখো অর্জুন! মানুষ কী করবে আর কী করবে না, মানুষের এই কর্তৃত্ব কিন্তু ভগবান তৈরি করে দেন না, কিংবা সে কাজ-অকাজ যাই করুক তার কর্মের ফলটাই বা কী হবে—সেই কর্ম আর কর্মফলের সংযোগ ঘটানোতেও তাঁর কোনো ভূমিকা নেই—ন কর্তৃত্বং ন কর্মাণি লোকস্য সৃজতি প্রভুঃ।
আমার ছোটবেলার সাধারণ জ্ঞানই এটা আমার মনে হয়েছিল যে, সত্যিই তো, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই কোটি কোটি লোক, তারা কখন, কোথায় কী করছে, এইসব হিসেব যদি ভগবানকে রাখতে হয়, তাহলে পরম ঈশ্বরকে বড়ো বেশি বাণিজ্যিক ব্যবহারজীবী হয়ে উঠতে হয়। যা ভেবেছি ঠিক তাই, তিনি এত এত লোকের ‘প্রাইভেসি’র মধ্যে প্রবেশ করেন না, মানুষ যদি পাপ করে তবে সে পাপের দায় তাঁর নয়, আর যদি পুণ্য করে তবে সে পুণ্যের দায়ও তাঁর নয়—নাদত্তে কস্যচিৎ পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভুঃ। মানুষ পাপ-পুণ্য যাই করুক, ভালো-মন্দ কাজের ফলও সে যাই পাক, সেখানে কাজ করে অনাদি-অনন্ত প্রবাহে নেমে আসা মানুষের স্বভাব—স্বভাবস্তু প্রবর্ততে। স্বভাব-প্রেরিত মনুষ্য-কর্ম কীভাবে কর্মফলের সঙ্গে যুক্ত হয়, সে কথা বলতে গিয়ে মহাভারত বলছে—সমস্ত ধেনুর মধ্যেও গোবৎস যেমন ঠিক আপন জননীকে চিনে নিয়ে তার অনুসরণ করে, জন্মান্তরের কর্মফলও পরের পরের জন্মে কর্মানুষ্ঠাতা মানুষকে অনুসরণ করে—যথা ধেনু সহস্রেষু বৎসো বিন্দতি মাতরম।
এই কর্ম এবং কর্মফলকেই প্রাচীনেরা কখনো অদৃষ্ট, কখনো দৈব, কখনো নিয়তি, কখনো বা ভবিতব্য নামে অভিহিত করেছেন—সৌভাগ্যম উপভোগশ্চ ভবিতব্যেন লভ্যতে। কিন্তু মানুষের জীবনে আকস্মিক যে সব দুঃখ-শোক অথবা সুখ-ঐশ্বর্য নেমে আসে, সেই দুঃখ-সুখকে কার্যকারণ সূত্রে অনেক সময়েই ব্যাখ্যা করা যায় না বলেই সেই ভবিতব্য বা নিয়তিকে জন্মান্তরীণ পাপ-পুণ্যের কর্মফল বলে ব্যাখ্যা করলেই সবচেয়ে বেশি সমীচীন লাগে। অন্যদিকে সেই জন্মান্তরীণ পাপ-পুণ্য চোখে দেখা যায় না বলেই দুর্ঘটনা ঘটলে তার কর্তৃত্ব ঈশ্বরের ওপর চাপিয়ে দেওয়াটাও বেশ যুক্তিসঙ্গত হয়ে ওঠে। মহাভারতের দ্রৌপদী বনবাসের কষ্ট সইতে না পেরে ঠিক এই কথাগুলিই বলেছিলেন যুধিষ্ঠিরকে এবং তা বলেছিলেন সেই ধাতা-বিধাতার উদ্দেশে নমস্কার জানিয়ে—যে ধাতা এবং বিধাতাকে আমরা নিয়তি বা ভবিতব্যের পর্যায় শব্দ বলে উল্লেখ করেছি।
দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন—দণ্ডবৎ করি সেই ধাতা আর বিধাতাকে! তাঁরাই তো এই কর্ম আর কর্মফলের মোহচক্র তৈরি করে দিয়েছেন। ভালো কাজ, ধর্মের কাজ করলে তো ভালো ফলই হওয়ার কথা। কিন্তু আমি তো চোখের সামনে দেখছি—ধর্ম, কোমলতা, ক্ষমা, সারল্য এ সব গুণ থাকলে মানুষ কখনোই ঐশ্বর্য-সম্পদ লাভ করে না, দয়া দেখিয়ে তো কখনোই নয়—পুরুষঃ শ্রিয়মাপ্রোতি ন ঘৃণিত্বেন কর্হিচিৎ। দ্রৌপদী নানা ধর্মের উদাহরণ দিয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন—তুমি কিংবা তোমার ভাইরা কোনো দিনই এমন কাজ করনি যা ধর্ম নয়, কেননা ধর্মকে তোমরা জীবনের থেকেও বড়ো মনে কর—ধর্মাৎ প্রিয়তরং কিঞ্চিদপি চেজ্জীবিতাদিহ। আমি শুনেছি—যে রাজা ধর্মকে রক্ষা করে চলেন, সেই ধর্ম নাকি রাজাকেও রক্ষা করে—কিন্তু এ আমার বড়োদের কাছে শোনা কথা। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, ধর্ম অন্তত তোমাকে রক্ষা করেনি এবং এখনও করে না—ইতি মে শ্রুতম আর্যাণাং ত্বান্তু মন্যে ন রক্ষতি।
দ্রৌপদী কিন্তু ধর্ম বা পুণ্যের কর্মফল সম্বন্ধে সন্দিহান নন, তিনি অধর্মেরও বিষম ফল দেখতে পাচ্ছেন। অর্থাৎ চিরন্তন যে বিশ্বাস সেটাই তিনি বলছেন—ধর্ম বা পুণ্যকর্ম করলে ভালো বংশে জন্ম হবে, ঐশ্বর্য-বীরত্ব লাভ হবে, অমানুষী সৌন্দর্য, সৌভাগ্য এবং উপভোগ লাভ হবে, শরীর হবে রোগমুক্ত—
কুলে জন্ম তথা বীর্য্যমারোগ্যং রূপমেব চ।
সৌভাগ্যমুপভোগশ্চ ভবিতব্যেন লভ্যতে।।
এই মত কিন্তু দ্রৌপদী তাঁর আপন অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারছেন না। অন্যদিকে তিনি বলছেন যুধিষ্ঠিরকে—আমার এই বিপন্নতার জন্য যেমন আমি বিধাতাকে দোষ দিচ্ছি, তেমনই দুর্যোধনের সম্পন্নতার জন্যও আমি বিধাতাকেই দোষ দিচ্ছি, কেননা তাঁর চোখটাই বাঁকা—বিষমং যো’নুপশ্যতি। তা নইলে দ্যাখো, তোমার ভালো কাজের ফল একেবারেই খারাপ পাচ্ছ, আর দুর্যোধনের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো, সে সব ধর্মের বাঁধ ভেঙে দিয়েছে, তার স্বভাব ক্রূর এবং সে লোভে আকুল সব সময়, অথচ বিধাতা তাঁকে অপার সম্পত্তি দিয়ে কী মজা পাচ্ছেন, সেটা তর্কযুক্তিতে বুঝতে পারি না—ধৃতরাষ্ট্রে শ্রিয়ং দত্ত্বা ধাতা কিং ফলমশ্নুতে? এই বিষম বিপরীত অবস্থা দেখে দ্রৌপদী সাক্ষেপে বলেছেন—এমনটা যদি মানতেই হয় যে, প্রাক্তন কর্ম কর্তাকেই অনুসরণ করে অর্থাৎ পূর্বজন্মের প্রারব্ধ কর্ম যদি পরজন্মে কর্মফল হিসেবে পরিণত হয়, এমনটাও যদি মানতে হয়, তবে সেই পাপকর্মে স্বয়ং ঈশ্বরও লিপ্ত আছেন নিশ্চয়—কর্মণা তেন পাপেন লিপ্যতে নূনমীশ্বরঃ।
দ্রৌপদী নিজস্ব একটা ‘থিওরি’ তৈরি করেছেন। তিনি মনে করেন, শুভাশুভ কর্মের মাধ্যমে আপন ভাগ্য তৈরির ব্যাপারে ঈশ্বরের একটা খেলা আছে। তাঁর মতে, কর্ম করার ব্যাপারে মানুষের স্বাধীনতা কোথায়? সুতোয় বাঁধা পাখির মতো কর্মবদ্ধ প্রাণীদের কোনো স্বাধীনতা নেই, তারা সব ঈশ্বরের অধীন; সুতরাং নাকে দড়ি-বাঁধা ষাঁড়-বলদের মতো কিংবা ভূমিচ্যুত গাছ যদি মাটি ছেড়ে স্রোতের টানে ভেসে যায়, তেমনই বিধাতার অধীনে থেকে তাঁরই নিয়ন্ত্রণেই মানুষ শুভাশুভ কর্ম করে, স্বাধীনভাবে মানুষের কিছু করারই ক্ষমতা নেই—ধাতুরেবং বশং যান্তি সর্বভূতানি ভারত। ঈশ্বর সর্বভূতে বিরাজ করছেন, অতএব তিনিই মানুষকে পাপে কিংবা পুণ্যের কর্মে প্রবৃত্ত করছেন—আর্যকর্মণি যুজ্ঞানঃ পাপে বা পুনরীশ্বরঃ।
লক্ষণীয়, দ্রৌপদীর এই কথাগুলি নিয়তিবাদ বিষয়ে ভারতীয় দার্শনিক প্রতিপত্তিগুলির সঙ্গে তেমন মেলে না এবং তিনি যে আচরিত দর্শনের বিরোধেই কথা বলছেন, সেটা তিনি জানেনও বোধহয়। দ্রৌপদীর কথাগুলি তুলনীয় হয়ে উঠছে সেই বিখ্যাত প্রবাদ-শ্লোকের সঙ্গে—যা মহাভারতে আছে বলে অনেক গবেষকেরও ভ্রান্তি হয়। আমার নিজেরও এই ভ্রান্তি ছিল, মৌখিক পরম্পরায় চলে আসা সেই শ্লোকটি নাকি মহাভারতের প্রধান প্রতিনায়ক দুর্যোধনের উক্তি। শ্লোকের মধ্যে শব্দসন্নিবেশের মাধুর্য এবং তীক্ষ্নতা এখানে এতটাই যে, আমাদের বিশ্বাস হয়েছিল যে, শ্লোকোক্ত কথাগুলি দুর্যোধনেরই উক্তি হবে বোধহয় এবং এই উক্তি তিনি করেছিলেন জননী গান্ধারী অথবা পিতা ধৃতরাষ্ট্রের মুখে তিরস্কার শোনার পর—যদিও আবার বলছি—এই অসামান্য শ্লোকটি আমরা মহাভারতে পাইনি।
গান্ধারীর মুখে তিরস্কার শুনে দুর্যোধন বলেছিলেন—আমি ধর্ম জানি, কিন্তু সেই ধর্মে আমার অন্তত কোনো প্রবৃত্তি নেই। এমনকি কোনটা অধর্ম সেটাও আমি জানি, কিন্তু সেই অধর্ম থেকে নিবৃত্ত হওয়ার ক্ষমতা বা মানসিক শক্তিও আমার নেই—জানামি ধর্মং ন চ মে প্রবৃত্তিঃ/ জানাম্যধর্মং ন চ মে নিবৃত্তিঃ। এর পরেই পুরোপুরি এক সাধকের মতো দুর্যোধন বলছেন—সমস্ত ইন্দ্রিয়ের অধীশ্বর ভগবান হৃষিকেশ আমার হৃদয়ে বসে যে পথে আমায় চালাচ্ছেন, যে ভাবে আমায় নির্দেশ দিচ্ছেন, সেই পথে, সেই ভাবেই আমি কাজ করছি—ত্বয়া হৃষিকেশ হৃদিস্থিতেন/যথা নিযুক্তো’স্মি তথা করোমি।
এই শ্লোকের প্রধান মর্মের সঙ্গে দ্রৌপদীর বক্তব্যের কোনো তফাত নেই। যদিও পূর্বোক্ত শ্লোকটির মধ্যে তো এমন ইঙ্গিত আছে যে, আমার যদি চুরি-ডাকাতি, ধর্ষণ-মারণ ঘটাতে ইচ্ছে করে তাহলেও আমি বলতে পারি যে, হৃদমাঝারে বসে ঠাকুর যেমনটি প্রবৃত্তি দিচ্ছেন, যে কর্মে তিনি প্রবৃত্ত করছেন, আমি তেমনটিই করে যাচ্ছি—যথা নিযুক্তো’স্মি তথা করোমি। এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্রৌপদীর বক্তব্যের তফাত নেই কোনো। তিনি বলেছেন—কাঠের পুতুল যেমন সূত্রধার নর্তকের সূত্র চালনায় হাত-পা নাড়ায়, তেমনই জগতের সমস্ত প্রাণীই ঈশ্বরচালিত হয়ে নানা রকম কর্ম করতে থাকে—যথা দারুময়ী যোষা… তথা রাজন্নিমাঃ প্রজাঃ। মানুষ যে ভালো-মন্দ পুণ্য-পাপের কাজ করছে, তা করছে ঈশ্বরের মায়ায় বশীভূত হয়ে এবং সেটাকে দেখতে এমনই লাগে যেন ঈশ্বরই সেই পাপ অথবা কল্যাণের কাজটা করছেন—ঈশ্বরো বিদধাতীহ কল্যাণং যচ্চ পাপকম।
দ্রৌপদী তাঁর বিশ্বাস ব্যাখ্যা করার জন্য বেশ দার্শনিক ভাবে বলেছেন—প্রাণীদের এই শরীর নামক ক্ষেত্রটাই ভালো-মন্দ কাজ করার হেতু এবং সেটাই ঈশ্বরের প্রকাশ হওয়ার জায়গা, ফলত সেই শরীরে বসেই তিনি জীবদের দিয়ে শুভাশুভ কর্মগুলি করান, যেগুলি তাদের নিয়তি বা ভবিতব্য হিসেবে ভবিষ্যতে আসে। তবে অখিল প্রাণী কুলের এই শুভাশুভ কর্মপ্রবৃত্তির মধ্যে দ্রৌপদী বোধহয় সোজাসুজি ঈশ্বরের হাত দেখছেন না, এর মধ্যে তিনি ঈশ্বরী মায়ার অবতারণা করছেন, যে মায়ায় মোহিত হয়ে জীব শুভাশুভ কর্মের মাধ্যমে নিজের নিয়তি সৃষ্টি করে। মায়া যেহেতু ঈশ্বরের অধীন তাঁর এক বহিরঙ্গা শক্তি, তাই তার নিয়ন্ত্রক ঈশ্বরকে সম্বোধন করেই দ্রৌপদী বলছেন—ঈশ্বরের এই মায়ার প্রভাব এমনই যে তিনি সেই মায়ায় মোহিত করেই প্রাণীদের দিয়ে অন্য প্রাণীর বধ ঘটাচ্ছেন—যো হন্তি ভূতৈর্ভূতানি মোহয়িত্বা আত্মমায়য়া। অবশেষে জাগতিক মানুষের এই শুভাশুভ-কর্মপ্রসূত নিয়তিকে দ্রৌপদী প্রায় কবিজনোচিত সরসতায় ঈশ্বরের খেলা হিসেবে দেখার চেষ্টা করেছেন এবং সে ভাবনাটা প্রায় নজরুলের বিশ্বময়ী ভাবনা—খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আপন মনে। আর দ্রৌপদী বলছেন—একটি বাচ্চা ছেলে যেমন খেলার জিনিস নিয়ে খেলা করে, তেমনই ঈশ্বরও তাঁর ইচ্ছানুসারে নানা সংযোগ-বিয়োগ ঘটিয়ে, একের সম্পত্তি অন্যের বিপত্তি ঘটিয়ে মানুষকে নিয়ে খেলা করছেন—ক্রীড়তে ভগবান ভূতৈ বালঃ ক্রীড়নকৈরিব।
দ্রৌপদীর সম্পূর্ণ বক্তব্যকে আমরা দু-ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি। এক তো দার্শনিক দৃষ্টিতে যেখানে প্রচলিত মতবাদের বিরুদ্ধে গিয়ে দ্রৌপদী ঈশ্বরকেই দায়ী করেছেন মানুষকে দুঃখকষ্টের নিয়তি ভোগ করানোর জন্য। তা না হলে এমনটা সাভিমানেও তিনি বলতেন না যে, মা-বাবা যেমন তাঁদের সন্তানদের স্নেহদৃষ্টিতে দেখেন ঈশ্বরের সেই স্নেহদয়া নেই মানুষের ওপর। তাঁদের তিনি রোষদৃষ্টিতেই দেখেন সব সময়—ন মাতৃপিতৃবৎ রাজন ধাতা ভূতেষু বর্ততে। অনেক অন্যায়-পাপ করা সত্ত্বেও দুর্যোধনের সম্পন্নতা দেখে দ্রৌপদীর বিশ্বাস হয় যে, মানুষকে পাপ করানোর ব্যাপারে ঈশ্বরের হাত আছে। নিয়তি বা কর্মফল ভোগের ক্ষেত্রে দ্রৌপদীর এই মত ভারতীয় কর্মবাদ এবং জন্মান্তরের প্রারব্ধ কর্মবাদের বিরুদ্ধে যায় বলেই দ্রৌপদীর মতকে বহুল যুক্তিপূর্ণ এবং তীক্ষ্ন বলে মন্তব্য করার সঙ্গে সঙ্গে এই মতের মধ্যে নাস্তিকতার আভাস আছে বলেও যুধিষ্ঠির সাবধান করেছেন দ্রৌপদীকে—উক্তং তচশ্রুতমম্মাভি র্নাস্তিক্যন্তু প্রভাষসে।
আমরা কিন্তু দ্বিতীয় বুদ্ধিতে এটাও ভাবি যে, ঈশ্বরের প্রতি দ্রৌপদীর এই সাভিমান দোষারোপের মধ্যে অদ্ভুত এক আত্মনিবেদনও আছে ঈশ্বরের প্রতি, তাতে সমাজের বিষম প্রকৃতিগুলি, যেখানে অন্যায় করেও মানুষ ঐশ্বর্য লাভ করছে, আবার পুণ্য-ধর্মের কাজ করেও যুধিষ্ঠিরের মতো মানুষ বনবাস-দুঃখ লাভ করছেন। এইরকম জায়গায়—আমরা কেউ কিছু করতে পারি না, ভালো-মন্দ যা ঘটছে সব ঈশ্বরই করাচ্ছেন, মানুষ এবং প্রাণীজগৎ সেই বিরাট নটের সুতোয় বাঁধা কাষ্ঠপুত্তলিকা মাত্র—এইভাবে যদি ভাবা যায় তাহলে সেটা কিন্তু পরম এক আত্মনিবেদনের কথা। এই নিখিল বিশ্বভুবনের সকল প্রাণীদের নানা কীর্তিকলাপ দেখে তিনি মজা পাচ্ছেন, শিশুর খেলার মতো তিনি আমোদ পাচ্ছেন সকলের উথাল-পাথাল চেষ্টা দেখে—এইভাবে ভাবনা করলে দ্রৌপদীর বক্তব্য কিন্তু এই মর্মেও ব্যাখ্যাত হতে পারে যে, ‘আমায় ভিখারি সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি হেরিছ’।
আর সত্যিই তো, এইভাবে যদি মানুষ ভাবতে পারে যে, কপালে যা আছে, তা তো ঘটবেই, যা পাবার পাবো যা পাবার নয় পাবো না। দেবতা, দানব-মানব, মুনি-ঋষি, তাঁরাও তো কত সময় কষ্ট পান, সেখানে যদি এইভাবেই ভাবা যায় যে, এমন মানুষও তো অনেক আছে, যাদের আপাত কোনো দোষ দেখা যায় না এবং তারা ভালো কাজই করছে, অনেক পরোপকারও করছে, তারাও তো অনেকে যথেষ্টই কষ্ট পায়, দুঃখ ভোগ করে—সেখানে এমনটাও তো ভাবা যায় যে,
মান্ধাতারই আমল থেকে
চলে আসছে এমনি রকম…
তোমারি কি এমন ভাগ্য
বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম।
অতএব সুখ-দুঃখের নিয়তি যা ঘটবে, তা সহজভাবে গ্রহণ করাটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। দ্রৌপদী তেমনই এক আভাসে জাগতিক বিষম নিয়তিকে ঈশ্বরী মায়ার কাজ বলে চিহ্নিত করেছেন এবং ওই একই আভাসে নিতান্ত নিশ্চিন্ততায় ভগবানই সব করাচ্ছেন এই সান্ত্বনা-সুখের জন্য ভগবানকে দায়ী করাটাও বুদ্ধির কাজই বটে, কেননা ভগবদ গীতাতেও তো সেই দার্শনিক স্বীকারোক্তি ভেসে এসেছে ভগবানের মুখ থেকেই—আমি সমস্ত প্রাণীকে আমার মায়াযন্ত্রে স্থাপন করে ঘুরিয়ে চলেছি সব সময়—ভ্রাময়ন সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়াপি মায়য়া। অতএব কষ্টকর ভাগ্য, দুর্গতিকে খুব যান্ত্রিকভাবে গ্রহণ করেই অযান্ত্রিক মনের মধ্যে তার বিচার করতে হয়—দুঃখের বিপরীতে সুখের মতোই এক আকস্মিক সংক্রান্তি হিসেবে—ঠিক যেমনটা সেই দৈত্যরাজ নমুচি বলেছিলেন দেবরাজ ইন্দ্রকে।
দোর্দণ্ডপ্রতাপ নমুচি দৈত্য স্বর্গরাজ্য দখল করে সমস্ত দেবতাদের ঘরছাড়া করে দিয়েছিলেন। তার পর কালের নির্বন্ধে, নিয়তির পরিহাসে তাঁরও পতন ঘটল একদিন। কিন্তু নমুচি একেবারেই ভেঙে পড়লেন না। তাঁর রাজলক্ষ্মী নেই, তবু অক্ষোভ্য শান্ত সাগরের মতো বসে আছেন তিনি। এই অবস্থায় দেবরাজ ইন্দ্র, যিনি ক-দিন আগেও নমুচির ভয়ে গিরিগুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, তিনি বেশ তির্যক সুরে নমুচিকে বললেন—সব তো গেছে তোমার, স্বর্গের ঐশ্বর্য থেকে তুমি চ্যুত, রাজলক্ষ্মী অন্যত্র বিচরণ করছেন, তুমি শত্রুর বশীভূত, এমন অবস্থায় কষ্ট হচ্ছে না তোমার? নমুচি দৈত্য অসামান্য দার্শনিকতায় উত্তর দিয়ে বললেন—দুঃখ-কষ্ট পেয়ে শোক-বিলাপ করে তো এমন হবে না যে, আমি আমার চাওয়ার জিনিসটা পেয়ে যাব। তা ছাড়া শোক করলে শরীরটাও যেমন শুকোবে, তেমনই আনন্দ পাবে শত্রুরাও। তা ছাড়া আমার একান্ত দুঃখ-কষ্টের নিয়তি ভোগ করার ব্যাপারে কোনো সহায়তাও থাকবে না, কাজেই যা ফিরে পাবো না, তার জন্য শোক করে অন্যকে সুখ দিয়ে লাভ কী—অমিত্রাশ্চ প্রহৃষ্যন্তি নাস্তি শোকে সহায়তা।
নমুচিও কিন্তু একটা জায়গায় দুর্যোধনের ওপর আরোপিত সেই বক্তব্য—’তিনি যেমন চালান তেমনি চলি’, অথবা বিধাতার প্রতি দ্রৌপদীর সেই সমাক্ষেপ—শুভাশুভ কর্ম সব তিনি করাচ্ছেন, জীব-মানুষের নিয়তি সৃষ্টি করছেন তিনিই—এই বক্তব্যই যেন বলছেন—এ জগতের শাসনকর্তা একজনই, দ্বিতীয় কোনো শাসক নেই—একঃ শাস্তা ন দ্বিতীয়ো’স্তি শাস্তা। জল যেমন নীচের দিকেই যায়, তেমনই মানুষও সেই শাসকের দ্বারা চালিত হয়ে যা করার তাই করে। অতএব তিনি যেমন চালাচ্ছেন, তেমনি আমি চলছি যথা নিযুক্তো’স্মি তথা ভবামি। নমুচি বলছেন—জগতের উৎপত্তি বিনাশের তত্ত্ব আমি জানি, এমনকী সংসারের মায়া থেকে মুক্তির তত্ত্বও আমার ভালোই জানা আছে, কিন্তু তাই বলে সেই মুক্তির জন্য আমি যে খুব ভাবছি, তা মোটেই নয়। বরঞ্চ নগর প্রান্তে যে সব কাননঘেরা বাড়ি, সেই দিকে দৃষ্টি দিয়ে যেমনটি তিনি চালাচ্ছেন সেই ভাবে বয়ে চলেছি—আশাসু হর্ম্যাসু হৃদাসু কুর্বন/যথা নিযুক্তো’স্মি তথা বহামি।
এইভাবে ‘যথা-নিযুক্ত’ চলার মধ্যে অদ্ভুত এক আত্মনিবেদন আছে সে কথা স্বীকার করে নিতেই হবে এবং তাতে শুভলাভের জন্য শুভ কর্ম করার তাগিদটুকুও কিন্তু থেকেই যায়। অর্থাৎ কিনা এমন নয় এটা যে, তিনি যেমন চালাচ্ছেন, আমি তেমনটাই চলছি। মানে—আমি যেমনটা চলছি, তার মধ্যে যেন তাঁর চালনার স্পর্শ আছে, যেন আমার চলার কোনো ক্ষমতাই নেই, তিনি চালাচ্ছেন বলেই যেন আমি চলতে পারছি—অনেকটা ‘আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী, যেমন চালাও তেমনি চলি’র মতো; অথবা বৈষ্ণবীয় ভাবে—
একেলা ঈশ্বর কৃষ্ণ আর সব ভৃত্য।
যারে যৈছে নাচায় সে তৈছে করে নৃত্য।।
বেশ বোঝা যায় যে, কর্মবাদ, জন্মান্তরবাদ এবং অদৃষ্ট কার্যকারণবাদ স্বীকার করার পরেও ভারতবর্ষীয় নিয়তির যুক্তিভাবনার আরও এক ধূসর পরিসর আছে, যেটা আত্মনিবেদনের জায়গা—যেখানে আপন কর্ম, অকর্ম এমনকী কুকর্মও ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করে মানুষ। এই রকম একটা বিশ্বাসের সুবিধে এই যে, মানুষ যখন নিজের ইচ্ছামতোকৃতকর্মকেও ঈশ্বরারোপিত ভেবে কর্ম করে, তখন কিন্তু তেমন সমস্যায় না পড়লে শুভ সৌভাগ্যের কারণেই সে খুব খারাপ কাজ করে না। আর আমাদের ঈশ্বরও তেমনই কৃপাময়, তিনি নিজেই খুব ভালো জানেন যে, জীবের কর্ম করার ব্যাপারে তাঁর কোনো ভূমিকা নেই, তাঁর কোনো কর্তৃত্বও নেই এখানে—ন কর্তৃত্বং ন কর্মাণি লোকস্য সৃজতি প্রভুঃ—তবু কিন্তু কৌষিতকী ব্রাহ্মণোপনিষদে এইরকম একটা অসামান্য কথা শোনা যাবে যে, যাঁকে তিনি এই সামান্য লৌকিক জগৎ থেকে উন্নত করার ইচ্ছে করেন, তাঁকে দিয়ে তিনি ভালো কাজ করান—এষ হ্যেবৈনং সাধু কর্ম কারয়তি, তং যমেভ্যো লোকেভ্য উন্নিনীষতে।
এ কথা শুনলে মনে হবে যেন মানুষের কর্ম-নিয়তি সৃষ্টিতে ঈশ্বরের কর্তৃত্ব আছে! আসলে তা নয় কিন্তু। ভালো কাজ বা শুভ কর্মই অন্যতর শুভ কর্মের জন্ম দেয়, তা থেকেই মনে হয় যেন ঈশ্বরই তাঁকে দিয়ে শুভ কর্ম করাচ্ছেন। আসলে শুভাশুভ কর্মের নিয়তি মানুষ নিজেই সৃষ্টি করে, সেখানে ঈশ্বরে কর্ম অর্পণ করার সুবিধে এটাই যে, জীবনে দুর্দৈব নেমে আসলে মানুষ সেটাকে ঈশ্বরদত্ত শাস্তি ভেবে সইতে পারার শক্তি পায়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন