০৬. আমার গৌরব, আমি স্বেচ্ছাচারী

তসলিমা নাসরিন

আকাশ ভাঙা বৃষ্টি আর বজ্রপাত। এর মধ্যেই সেদিন বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। কী, বৃষ্টিতে ভিজবো।

কেন ভিজবে?

ইচ্ছে করেছে।

ইচ্ছে?

হ্যাঁ ইচ্ছে।

লোকে কী ভাববে বলো!

কী ভাববে?

ভাববে মাথা খারাপ।

ভাবুক।

বৃষ্টিতে ভিজলে অসুখ করবে তো!

কী অসুখ?

সর্দি জ্বর।

করুক।

এই বয়সে এসব মানায় না।

কোন বয়সে এসব মানায়?

ষোলো সতেরো বছর বয়স হলে ঠিক হতো।

অনেকের চোখে তাও ঠিক নয়। কে বানিয়েছে কোন বয়সে কী করা উচিত কী উচিত নয়, তার লিস্ট?

সোসাইটি।

সোসাইটির জন্য আমরা, নাকি আমাদের জন্য সোসাইটি? মানুষই নিয়ম তৈরি করে। মানুষই নিয়ম ভাঙে। কোনও নিয়মই দীর্ঘকাল বিরাজ করে না।

আমাদের কথোপকথন এরপর আরও অনেক এগিয়ে শেষে স্বেচ্ছাচারে গিয়ে থেমেছে। স্বেচ্ছাচার শব্দের অর্থ যদি নিজের খেয়ালখুশিতে করা কাজ (সংসদ বাংলা অভিধান) হয় তবে অবশ্যই আমি স্বেচ্ছাচারী। একশ ভাগ। এ আমার জীবন। আমি সিদ্ধান্ত নেব আমার জীবনে আমি কী করবো না করবো। অন্যে কেন নেবে? জীবন যার যার তার তার। নিজের জীবনে কার কী করার ইচ্ছে, তা মানুষের নিজেরই জানা উচিত। যার এখনও নিজস্ব ইচ্ছে গড়ে ওঠেনি, তাকে আমি প্রাপ্তবয়স্ক বলি না। যে এখনও নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী চলে না বা চলতে ভয় পায়, তাকে আমি সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষও মনে করি না।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কারও যদি ইচ্ছে করে কাউকে খুন করতে, তবে? কারও যদি ইচ্ছে করে কাউকে ধর্ষণ করতে, তবে? আমার ব্যক্তিগত মত, যে স্বেচ্ছাচার অন্যের ক্ষতি করে, সেই স্বেচ্ছাচারে আমি বিশ্বাসী নই। এখন ক্ষতিরও রকম ফের আছে। কেউ যদি বলে ‘তুমি ওই ধর্মের নিন্দা করতে পারো না, কারণ তোমার নিন্দা আমার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে,’ তবে?

কারো শরীরে আঘাত দেওয়ার অর্থ যদি অন্যের ক্ষতি করা হয়ে থাকে, তবে মনে আঘাত দেওয়ার অর্থ কেন অন্যের ক্ষতি করা হবে না! এ ক্ষেত্রে আমার মত হচ্ছে যে মানুষের মনে নানা রকম কুসংস্কার এবং অজ্ঞানতা বাসা বেঁধে থাকে, এসব দূর করা উচিত। দূর করার দায়িত্ব সচেতন মানুষের। এখন আরেকটি প্রশ্ন উঠতে পারে, আমি কেন নিজেকে সচেতন মনে করছি, এবং একজন মৌলবাদীকে করছি না? করছি না, এর পেছনে কিন্তু আমার একশ যুক্তি আছে। মৌলবাদীও তার নিজের যুক্তি খাড়া করতে পারে। কিন্তু যে বিচারবুদ্ধি আমার আছে, যে মূল্যবোধ আমার গড়ে উঠেছে, তাতে আমি মৌলবাদীদের যুক্তিকে অবৈত্তানিক এবং অযৌক্তিক বলে খণ্ডন করে নিজের মতে স্থির থাকতে পারি। আমি জ্ঞানত কারও শরীরে আঘাত করি না। কোনও সৎ মানুষের আর্থিক ক্ষতির কারণ হই না। আমার স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে আমি কোনও অনুতাপ করি না। আজ অবধি অনুতাপ করতে হয় নি। সমাজের অনেক টাবু আমি ভেঙেছি। লোকে বলেছে স্বেচ্ছাচার, আমি বলেছি স্বাধীনতা। আমার বিবেকের কাছে আমি পরিষ্কার। আমি যা করছি, আমার দৃষ্টিতে কোনও অন্যায় করছি না। নিজের কাছে সৎ থাকা, নিজের কাছে নিরপরাধ থাকার মূল্য অনেক।

যখন কিশোরী ছিলাম, পায়ে পায়ে নিষেধাত্তা। ঘরবার হবি না। খেলাধুলা করবি না। সিনেমা থিয়েটারে যাবি না। ছাদে উঠবি না। গাছে চড়বি না। কোনও ছেলে ছোকরার দিকে তাকাবি না। কারও সঙ্গে প্রেম করবি না। আমি কিন্তু সবই করেছি। করেছি, কারণ আমার ইচ্ছে হয়েছে করতে। নিষেধ ছিল বলে যে ইচ্ছে হয়েছে তা নয়। বাবা তো আমাকে আরও অনেক কিছুই নিষেধ করতেন, যেমন পুকুরে নাববি না, আমি পুকুরে নাবিনি, কারণ আমি সাঁতার জানি না, আর এ কারণে আমার আশত্তা হত সাঁতার না জেনে পুকুরে নামলে আনন্দ তো হবেই না বরং অসাবধানে ডুবে মরতে পারি। বাবা বলতেন, ছাদের রেলিংএ চড়বি না। আমি চড়িনি। কারণ আমার মনে হতো রেলিং যেহেতু সরু ছিল, পা পিছলে নিচে পড়লেই সব্বনাশ। যে কোনও কাজ করতে গিয়ে অন্য কেউ কী বললো না বললো তা না দেখে বরং নিজে কী বলছি, নিজে কী যুক্তি দিচ্ছি সেটি দেখি। নিজের ইচ্ছের সামনে আমি অত্যন্ত সততা নিয়ে দাঁড়াই। মেয়েদের পক্ষে, যাদের ইচ্ছের দাম এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কখনও দেয় না, নিজের ইচ্ছেকে প্রতিষ্ঠিত করা সহজ নয়। কিন্তু আমি কোনও কারণ দেখিনি প্রতিষ্ঠিত না করার। নিজের কাছে নিজের ভীতু, হেরে যাওয়া, নত মস্তক, নতজানু রূপ আমার সইবে না আমি জানি।

আমার লড়াই সত্যের জন্য, সাম্যের জন্য, সুন্দরের জন্য। এই লড়াই করতে গেলে স্বেচ্ছাচারী আমাকে হতেই হবে। না হয়ে এই লড়াই করা যায় না। ব্যক্তিগত জীবনেও মাথা উঁচু করে থাকতে চাইলে স্বেচ্ছাচারী হতে হবে। অন্যের ইচ্ছেয় যদি চলি, তবে তো আমি পরনির্ভর। অন্যের দেওয়া বুদ্ধিতে, চিন্তায় যদি চলি, তবে মানসিক ভাবে আমি নিশ্চয়ই পঙ্গু। অন্যের দেওয়া করুণায় আমার যদি জীবন যাপন করতে হয়, তবে আমি আর যাই হোক, স্বনির্ভর নই। স্বেচ্ছাচারের আনন্দ সেখানে নেই। মুক্ত চিন্তা নেই, মুক্তবুদ্ধি নেই, কেবলই যন্ত্রের মতো চালিত হবো। ভাবলে আমার শ্বাসকষ্ট হয়। এরকম দুঃসহ জীবন থাকার চেয়ে না থাকা ভালো।

পুরুষেরা চিরকালই স্বেচ্ছাচার করে আসছে। সমাজটা তাদেরই অধীনে। স্বেচ্ছাচার দরকার নারীর। নারীর ইচ্ছের ঘরে নারীকে যে তালা দিতে হয়, তালা দিয়ে এই সমাজে তথাকথিত ভালো মেয়ে, লক্ষ্মী মেয়ে, বুদ্ধি-আছে মেয়ে, ভদ্র মেয়ে, নম্র মেয়ে সাজতে হয় — সেই তালার চাবি নারী এখন তার আঁচল থেকে বার করুক। তালা খুলে নিজের ইচ্ছেগুলোকে পাখির মতো উড়িয়ে দিক আকাশ জুড়ে। নারী স্বেচ্ছাচারী হোক সর্বত্র। না হলে তারা বুঝবে না স্বাধীনতা মানে কী। না হলে তারা দেখবে না জীবনের সৌন্দর্য।

স্বাধীনতা মানে কী, জানি আমি। স্বাধীনতার প্রয়োজন আমি অনুভব করি প্রতিটি মুহূর্তে। আমি একা থাকি, কী দোকা থাকি, কী হাজার মানুষের ভিড়ে থাকি, আমার স্বাধীনতা আমি কাউকে দান করি না বা কোথাও হারিয়ে ফেলি না। স্বাধীনতা এবং অধিকারের কথা লিখি আমি, যা লিখি তা বিশ্বাস করি। যা বিশ্বাস করি, তা যাপন করি। মানসিকভাবে আমি সবল, অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর, এবং নৈতিকভাবে স্বাধীন মানুষ। এটা পুরুষের সয় না। পুরুষেরা নারীর এত ক্ষমতা পছন্দ করে না। তারা নারীকে হাতের মুঠোয় নিয়ে, পায়ের তলায় নিয়ে পিষতে চায়। পিষতে না দিলে নারী ভালো নয়। পিষতে না দিলে নারী মন্দ। পিষতে না দিলে নারী স্বেচ্ছাচারী। অনেকে মনে করে স্বেচ্ছাচারী মানে বুঝি যে কোনও পুরুষের সঙ্গে যখন তখন শুয়ে পড়া, যৌন সম্পর্ক করা। স্বেচ্ছাচার মানে একেবারেই তা নয়। পুরুষের সঙ্গে না শোয়াটাকে আমি স্বেচ্ছাচার বলে মনে করি। পুরুষের সঙ্গে নারী যেন শোয়, পুরুষ ডাকলেই নারী যেন যেখানেই থাকুক, দৌড়ে চলে যায় তার কাছে, সাধারণত এরকমই নিয়ম। নারী যদি তার ইচ্ছে না হলে না শোয়, সেই নারী নিশ্চয়ই তবে স্বেচ্ছাচারী। এই স্বেচ্ছাচারী নারীকে পুরুষেরা পছন্দ করবে কেন! পুরুষের সুখভোগের জন্য, পুরুষের দেহের মনের তৃপ্তির জন্য, তার বিকৃতি, তার বিলাস মেটাতে নিজেকে যে নারী বিলিয়ে না দেয়, তাকে শুধু স্বেচ্ছাচারী বলে নয়, বেশ্যা বলেও অপমান করার জন্য পুরুষ প্রস্তুত।

আমার যা ইচ্ছে হয় আমি তাই করি। কারও ধ্বংস ঘটিয়ে করি না কিছু। স্বেচ্ছাচারী বলে জীবনের অর্থ এবং মূল্য দুটোই আমি ভালো অনুধাবণ করতে পারি। স্বেচ্ছাচারী না হলে, অন্যের ইচ্ছের যূপকাষ্ঠে বলি হলে, আমার বোঝার সাধ্য ছিল না আমি কে, আমি কেন। মানুষ যদি নিজেকেই চিনতে না পারলো, চিনবে তবে কাকে! আজ যদি স্বেচ্ছাচারী না হতাম আমি, হয়তো এই লেখাটি, যে লেখাটি লিখছি, তার একটি বাক্যও আমি লিখতে পারতাম না।

সকল অধ্যায়

১. ০১. পুরুষের বেলায় ‘অধিকার’, নারীর বেলায় ‘দায়িত্ব’
২. ০২. বাঙালি পুরুষ
৩. ০৩. নারী শরীর
৪. ০৪. সুন্দরী
৫. ০৫. আমি কান পেতে রই
৬. ০৬. আমার গৌরব, আমি স্বেচ্ছাচারী
৭. ০৭. বাঙালি নারীর সেকাল একাল
৮. ০৮. আমার প্রেমিকেরা
৯. ০৯. রেখে ঢেকে আর নয়
১০. ১০. অসভ্যতা
১১. ১১. মঙ্গল কামনা
১২. ১২. এতদিনে সভ্য আইন
১৩. ১৩. মহাশ্বেতা, মেধা, মমতা— মহাজগতের মহামানবীরা
১৪. ১৪. অসম্ভব তেজ ও দৃঢ়তা
১৫. ১৫. মেয়েদের রাগ হোক, ক্রোধ হোক
১৬. ১৬. এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষ—নারীর সমস্যার এ কি কোনও সমাধান?
১৭. ১৭. মাথায় প্রবলেম না থাকলে সব নারীরই নারীবাদী হওয়ার কথা
১৮. ১৮. শেষ পর্যন্ত হেরে যেতে হল
১৯. ১৯. কামড়ে খামচে মেয়েদের ‘আদর’ করছে পুরুষেরা
২০. ২০. সোনার বাংলার সোনার নারীরা শোনো: ঘনিয়ে আসছে ঘোর দুর্দিন
২১. ২১. মেয়েরা ছেলে হয়ে যাক, মেয়ে বলে কিছু আর না থাকুক কোথাও
২২. ২২. ডিভোর্স হয় না বলেই ব্যভিচার বাড়ে
২৩. ২৩. মেয়েরা কেন তাদের অত্যাচারী ব্যভিচারী স্বামীদের ডিভোর্স করছে না?
২৪. ২৪. আর কতকাল নারী কোলে কাঁখে রেখে অমানুষ করবে পুরুষজাতকে?
২৫. ২৫. পুরুষ কি আদৌ নারীর প্রেম পাবার যোগ্য?
২৬. ২৬. সমকামীদের গর্তে লুকিয়ে রেখে প্রগতিশীল হওয়া অসম্ভব
২৭. ২৭. আমার মায়ের আমার বোনের কষ্টে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি…
২৮. ২৮. সানেরার মতো মেয়ে চাই। আছে?
২৯. ২৯. ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬৪ দিন পুরুষদিবস, ১ দিন নারীদিবস
৩০. ৩০. দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি
৩১. ৩১. নারী = শরীর
৩২. ৩২. ভারতবর্ষে বেঁচে থাকবে শুধু পুরুষরাই
৩৩. ৩৩. কট্টরপন্থীদের কোনও দোষ নেই
৩৪. ৩৪. জনগণের নিরাপত্তার ব্যবস্থা হলেই নারী নিরাপত্তা পাবে
৩৫. ৩৫. মেয়েরা যেন না মেনে নেয় অপমান
৩৬. ৩৬. কবে হবে মেয়েরা নিজেই নিজের পরিচয়?
৩৭. ৩৭. কে দোষী? পুরুষ না পুরুষতন্ত্র?
৩৮. ৩৮. বধূ নির্যাতন আইনের প্রয়োগে মেয়েরা কেন দ্বিধাগ্রস্ত?
৩৯. ৩৯. যদি এর পেছনে রাজনীতি না থাকতো?
৪০. ৪০. আত্মঘাতী নারী!
৪১. ৪১. পুরুষের স্ত্রী বা প্রেমিকা হওয়া ছাড়া মেয়েদের আর কোনও ভূমিকা নেই
৪২. ৪২. মানুষ আর মানুষ নেই
৪৩. ৪৩. নামে অনেক কিছু আসে যায়
৪৪. ৪৪. লিঙ্গ-নিরপেক্ষ বাংলা ভাষার প্রয়োজন
৪৫. ৪৫. শাঁখা সিঁদুরের গল্প
৪৬. ৪৬. ধর্ম থাকবে, নারীর অধিকারও থাকবে, এটা হয় না

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন