২৭. আমার মায়ের আমার বোনের কষ্টে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি…

তসলিমা নাসরিন

আমাকে একটি ভাষা শিখিয়েছিল আমার মা, মার নিজের ভাষা। ভাষাটি শিখতে শিখতে ডাঙর হয়েছি, শিখতে শিখতে মানুষ। ভাষাটি ছিল বলে কথা বলেছিলাম, ক্ষিধেতেষ্টার কথা, ইচ্ছের কথা, ইচ্ছেগুলোর কথা। মুখ ফুটে বলেছিলাম, ‘আমার প্রাপ্যটুকু চাই।’ ভাষাটি ছিল বলে গান গেয়েছিলাম, প্রতিবাদ লিখেছিলাম দেওয়ালে, ব্যক্তিগত কাগজে। ব্যক্তিগত কিছুই আর ব্যক্তিগত থাকেনি, আগুন হয়ে ছড়িয়েছিল সারা দেশে। ভাষাটি আমাকে দিন দিন কী আশ্চর্য রকম শক্তিময়ী করে তুলেছিল, আমি আর সেই সাত চড়ে রা না করা আমি ছিলাম না। রেললাইনের ঘুমটি ঘরে ঘুরে বেড়ানো, বিকেল জুড়ে গোল্লাছুটের আমি ছিলাম না। বাড়ির ছাদে বসে একা একা রাতের তারা গোনার আমি ছিলাম না। আমি তখন হাজার মানুষের ভিড়ে হাঁটছি, আমি তখন বিভেদগুলো ভাঙছি, আমি তখন অ.ন্তি বিষবৃক্ষ উপড়ে তুলছি। আমি তখন কেবল আমার নয়, সহস্র কোটির প্রাপ্যের কথা চিৎকার করে বলছি। শুনে এমনই রাগ ওদের, গলা চেপে ধরেছিল আমার, ভাষা কেড়ে নেবে।
হাত থেকে কলম কেড়ে নিল, ভাষা কেড়ে নেবে। বই পোড়ানোর উৎসব করলো শহরে নগরে, গঞ্জ গে্রামে। ভাষা কেড়ে নেবে। আমাকে পোড়ালো, পুড়ে আমি অত্তার হইনি, ইস্পাত হয়েছি। যে শক্তি আমাকে দিয়েছিল আমার মা, ওরা কেড়ে নেবে। কেউ কি নিতে পারে কারও ভেতর গভীর করে যদি কিছু থাকে, তা? কেউ কি পারে ওভাবে দু হাতে নখে দাঁতে ছিঁড়ে নিতে কিছু! ভালোবাসা পারে নিতে? ভাষা? ভাষা তো রক্তে থাকে, রক্ত থেকে কেউ কি ঠুকরে নিতে পারে ভাষার কণিকা?

নির্বাসন দণ্ড হল আমার। আর কেউ নয়, কোনও স্বজন নয়, বন্ধু নয়, ভাষাটি রইল কেবল সঙ্গে, একা একা আমরা দুজন। ভিনদেশে ভিনভাষীদের ভিড়ে আমরা দুজন, দুজনে নিভৃতে নিরালায় হৃদয়ে হৃদয়ে বাক্য বিনিময় করি। সারারাত না ঘুমিয়ে করি। ভিন-ভাষার শক্ত শক্ত মুষ্ঠিতে আঘাত পেতে আমার ভাষাটিকে দিই না, ভিন-ভাষার লোমশ লোমশ পায়ের তলে পিষ্ট হতে আমার ভাষাটিকে দিই না, নিরীহ নির্জন ভাষাটিকে আগলে রাখি, দেখে দেখে রাখি। ভালোবেসে রাখি। চোখের জলে ভাষার গায়ের ধুলোকালি ধুয়ে রাখি। মায়ের মতো রাখি, বোনের মত ভাইয়ের মতো রাখি। ভাষাটি রইল নির্বাসনে দীর্ঘ এক যুগ। ভাষাটি রইল বরফে তুষারে, অন্ধকারে দীর্ঘ এক যুগ। ভাষাটি রইল আমার উচ্চারণে নয়, শ্রবণে নয়, হৃদয়ে এক যুগ। চতুর্দিকের হই চই থেকে এক কোণে একা একা আমার মতোই এক যুগ।

ভাষাটি ক্তমে ক্তমে অসুস্থ হয় তীব্র শীতে, ভাষাটি জমে যেতে থাকে ঠাত্তা বরফে। বাঁচাতে থাকি তাকে বুকের উত্তাপ দিয়ে দিয়ে, শত্রু শিবিরে বসে শুশ্রুষা করি তার। সে আমার আত্মীয় তখন, বন্ধু তখন। সে আমার মা। কত কত বছর চলে গেল, কত কেউ চলে গেল, আপন কত কেউ, যেতে যেতে সীমানা পেরোনো, চোখের আড়াল। কোনওদিন আর ফিরে না আসা দূরত্বে এক এক করে মানুষগুলো চলে গেল। আমিই পড়ে আছি একা, সব হারিয়ে ফুরিয়ে নিঃস্ব। সঙ্গে কেউ নেই, কিছু নেই, শুধু ভাষাটি। ভাষাটি আছে বলে চলে যাওয়া মানুষগুলোর সঙ্গে মনে মনে কথা বলতে পারি। ভাষাটি আছে বলে চারদিক খা খা করার, একলা-লাগার দুচারটে গদ্যপদ্য লিখতে পারি। খুব দুঃখকষ্টের দিনে ভাষার বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে পারি। ভাষাটি আছে বলেই কেউ আছে।

কিন্তু ভাষাটি তো যে করেই হোক লোকালয় চায়, দেশ চায়, উষ্ণতা চায়, উচ্চারণ চায়। ভাষাটির জন্য আমি সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে আজ এখানে। ভাষাটিকে বাঁচাতে। আমার ভাষাকে।
ভাষা আজ সূর্যের মুখ দেখছে, আজ সে সূর্যমুখী।
ভাষা আজ মাঠে ময়দানে বিকেলের রোত্রুরে খেলছে, সে সুখী।
ভাষার শরীর থেকে স্যাঁতসেঁতে শ্যাওলা দূর হচ্ছে, সে সাঁতার কাটছে গত্তায়, বঙ্গোপসাগরে।

আমি আর আমার ভাষা, দীর্ঘ দীর্ঘ বছরের বিদেশ বিভুঁইএর ক্লান্তিকর পরাধীনতা সরিয়ে এইখানে, দেশে, দেশের পশ্চিম প্রান্তে, নিশ্চিন্তে। আমি আর আমার ভাষা আজ ঘরে, নিজঘরে, নিরাপদ আশ্রয়ে। আমি যখন আমার ভাষাকে উচ্চারণ করি, আমার মাকে উচ্চারণ করি। আমি যখন আমার ভাষাকে ভালোবাসি, আমার মাকে ভালোবাসি আমি। মা নেই, কেউ কেউ বলে মা নাকি কবে কোথায় আকাশের কোনও একটি তারা হয়ে গেছে।

মা নেই, আমাকে মায়ের মতো দেখে দেখে রাখছে আমার মায়ের ভাষা, যে ভাষায় মা আমাকে ভালোবাসার কথা বলতো, যে ভাষায় মা আমার জন্য কাঁদত, যে ভাষায় মা আমাকে তার কোলে ফিরে আসতে বলতো। ভাষাটিকে আমি খুব নিবিড় করে আলিঙ্গন করি, মনে মনে বলি, মা তুমি। ভাষাটির শরীরে আমি আমার মায়ের সুগন্ধ পাই। মার বিষয় আশয় কিছু ছিল না, সামান্য যা ছিল সব পচে ধ্বসে গেছে, কেবল ভাষাটিই আছে, প্রতিদিন জীবন্ত, প্রাণময়।

মাকে আমি উচ্চারণ করি, মাকে আমি উচ্চারণ করছি। আমি উচ্চারণ করছি তোমাকে আমার ভাষা, তোমাকে উচ্চারণ করতে চাই, যতদিন শ্বাস নেব। তোমাকে ভালোবাসব, যতদিন বাঁচব। তোমার কাছেই বারবার ফিরে আসবো। আমি তো চিরকালের নিরাশ্রয়, ভাষা তুমি আমাকে দেখে দেখে রেখো। মানুষের মার খেয়ে, ঘৃণা পেয়ে যখন নুয়ে পড়ব, ভাষা তুমি সাহস দিও ভাষা তুমি শক্তি দিও, মা যেমন শক্তি দিত।

প্রতিবাদ আমি লিখছি, পাথরগুলো সরাচ্ছি পথ থেকে, পথগুলো পথ হোক। আমাদের প্রাপ্য তো খল-পুরুষেরা লুটেপুটে খেল, আমরা নারীরা আজ বোবা, ভাষাহীন। যতবারই কথা বলতে চাই, ততবারই মুখ চেপে ধরে ওরা। গলায় গরল ঢেলে দেয়। যতবারই কথা বলতে চাই, ততবারই ঠোঁটে সেলাই, জিভে কাঁটা। আমরা নারীরা আজ কীকরে কাকে জানাবো যে আমরা ভালো নেই! হাজার বছর ধরে পিঠে কালসিটে, চোখ নির্ঘুম, হাজার বছর ধরে আমরা ভাষাহীন। নারীর কজ্ঞে এবার ভাষা উঠে আসুক, স্ফূলিঙ্গ হোক সে, আগুনের মতো ছড়িয়ে যাক সবখানে, নারীরা পুড়ে পুড়ে ইস্পাত হোক। নারী শক্তিময়ী হোক।

ভাষা তুমি মা,
ভাষা তুমি আমি,
ভাষা তুমি বোন।
নারী আজ উচ্চারণ করছে ভাষা, নারী আজ উচ্চারণ করছে প্রতিবাদ। নারী আজ কজ্ঞে নিচ্ছে তীক্ষ্ণ তীব্র ভাষা, নারী আজ উচ্চারণ করছে নারীর জন্য নারীর ভালোবাসা।
আমি এবং আমার ভাষা আজ খোলামেলা ঘুরে বেড়াচ্ছি, আমাদের স্বাধীনতার পায়ে কেউ শেকল পরাতে এসো না, আমাদের মুক্তকণ্ঠকে কেউ চেপে ধরতে এসো না, আমাদের ভালোবাসার বুকে কেউ ছুরি বসাতে এসো না।
ক্ষমতা তুমি দূরে সরে থাকো,
ক্ষমতা তুমি পাথর ছুড়ো না,
ক্ষমতা তুমি পথরোধ করো না,
ক্ষমতা তুমি ভালোবাসতে শেখো,
ক্ষমতা পারোতো মানুষ হও,
ক্ষমতা তুমি মানুষ হও, মানবিক হও।

আমাকে থাকতে দাও আমার মতো, নির্বিবাদে, ভাষায়ভালোবাসায়। আমাকে থাকতে দাও আমার মায়ের কাছে, আমার মায়ের চোখের জল ধুয়ে দেবে আমার গায়ের ধুলোকালি। আমার মায়ের কোলটি থাকবে আমার জন্য, ওই কোলে সুখে কিংবা দুঃখে আমি ফিরবো, মা তো চিরকালই ডাকতেন আমাকে, তাঁর কোলে।

সকল অধ্যায়

১. ০১. পুরুষের বেলায় ‘অধিকার’, নারীর বেলায় ‘দায়িত্ব’
২. ০২. বাঙালি পুরুষ
৩. ০৩. নারী শরীর
৪. ০৪. সুন্দরী
৫. ০৫. আমি কান পেতে রই
৬. ০৬. আমার গৌরব, আমি স্বেচ্ছাচারী
৭. ০৭. বাঙালি নারীর সেকাল একাল
৮. ০৮. আমার প্রেমিকেরা
৯. ০৯. রেখে ঢেকে আর নয়
১০. ১০. অসভ্যতা
১১. ১১. মঙ্গল কামনা
১২. ১২. এতদিনে সভ্য আইন
১৩. ১৩. মহাশ্বেতা, মেধা, মমতা— মহাজগতের মহামানবীরা
১৪. ১৪. অসম্ভব তেজ ও দৃঢ়তা
১৫. ১৫. মেয়েদের রাগ হোক, ক্রোধ হোক
১৬. ১৬. এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষ—নারীর সমস্যার এ কি কোনও সমাধান?
১৭. ১৭. মাথায় প্রবলেম না থাকলে সব নারীরই নারীবাদী হওয়ার কথা
১৮. ১৮. শেষ পর্যন্ত হেরে যেতে হল
১৯. ১৯. কামড়ে খামচে মেয়েদের ‘আদর’ করছে পুরুষেরা
২০. ২০. সোনার বাংলার সোনার নারীরা শোনো: ঘনিয়ে আসছে ঘোর দুর্দিন
২১. ২১. মেয়েরা ছেলে হয়ে যাক, মেয়ে বলে কিছু আর না থাকুক কোথাও
২২. ২২. ডিভোর্স হয় না বলেই ব্যভিচার বাড়ে
২৩. ২৩. মেয়েরা কেন তাদের অত্যাচারী ব্যভিচারী স্বামীদের ডিভোর্স করছে না?
২৪. ২৪. আর কতকাল নারী কোলে কাঁখে রেখে অমানুষ করবে পুরুষজাতকে?
২৫. ২৫. পুরুষ কি আদৌ নারীর প্রেম পাবার যোগ্য?
২৬. ২৬. সমকামীদের গর্তে লুকিয়ে রেখে প্রগতিশীল হওয়া অসম্ভব
২৭. ২৭. আমার মায়ের আমার বোনের কষ্টে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি…
২৮. ২৮. সানেরার মতো মেয়ে চাই। আছে?
২৯. ২৯. ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬৪ দিন পুরুষদিবস, ১ দিন নারীদিবস
৩০. ৩০. দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি
৩১. ৩১. নারী = শরীর
৩২. ৩২. ভারতবর্ষে বেঁচে থাকবে শুধু পুরুষরাই
৩৩. ৩৩. কট্টরপন্থীদের কোনও দোষ নেই
৩৪. ৩৪. জনগণের নিরাপত্তার ব্যবস্থা হলেই নারী নিরাপত্তা পাবে
৩৫. ৩৫. মেয়েরা যেন না মেনে নেয় অপমান
৩৬. ৩৬. কবে হবে মেয়েরা নিজেই নিজের পরিচয়?
৩৭. ৩৭. কে দোষী? পুরুষ না পুরুষতন্ত্র?
৩৮. ৩৮. বধূ নির্যাতন আইনের প্রয়োগে মেয়েরা কেন দ্বিধাগ্রস্ত?
৩৯. ৩৯. যদি এর পেছনে রাজনীতি না থাকতো?
৪০. ৪০. আত্মঘাতী নারী!
৪১. ৪১. পুরুষের স্ত্রী বা প্রেমিকা হওয়া ছাড়া মেয়েদের আর কোনও ভূমিকা নেই
৪২. ৪২. মানুষ আর মানুষ নেই
৪৩. ৪৩. নামে অনেক কিছু আসে যায়
৪৪. ৪৪. লিঙ্গ-নিরপেক্ষ বাংলা ভাষার প্রয়োজন
৪৫. ৪৫. শাঁখা সিঁদুরের গল্প
৪৬. ৪৬. ধর্ম থাকবে, নারীর অধিকারও থাকবে, এটা হয় না

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন