৩৪. জনগণের নিরাপত্তার ব্যবস্থা হলেই নারী নিরাপত্তা পাবে

তসলিমা নাসরিন

কেরালা আর কর্ণাটক রাজ্যদুটোতে মেয়েদের অবস্থা ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে ভালো। এই ভালো-রাজ্য কর্ণাটকে হঠাৎ কিছুদিন আগে ৪৬ বছরের পুরোনো একটি আইন (দোকান এবং বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৬১) প্রয়োগ করা হল। আইনটি হল, ‘মেয়েরা রাত আটটার পর কোথাও কাজ করতে পারবে না, অর্থাৎ রাঙ্গিভাগে তাদের কাজ নিষিদ্ধ। আইন অমান্য করলে শাস্তি, ছ মাসের কারাদণ্ড এবং নগদ দশ হাজার টাকা।’ হঠাৎ যেন ভারতবর্ষে ঝড়ের মতো নেমে এলো এক টুকরো মধ্যযুগ।

আসলেই কি নেমে এলো? মধ্যযুগ কি বিরাজ করছে না প্রকাশ্যে অনেক অঞ্চলেই, এবং গোপনে গোপনে প্রায় সর্বত্র? মানসিকতার কি উত্তরণ ঘটেছে যথেষ্ট? রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক আখ্যা দেওয়া হচ্ছে, চমৎকার চমৎকার আইনের প্রণয়নও হচ্ছে, সংখ্যালঘুর জন্য না হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠর জন্য সমানাধিকারের ব্যবস্থা হচ্ছে, গৃহ নিগ্রহের বিরুদ্ধেও আধুনিক একটি আইন আনা হল, জাতপাতের বিরুদ্ধে তো কঠোর কঠিন আইন আছেই, পণপ্রথার বিরুদ্ধেও। তাতে কী? সমাজে জাতপ্রথা নেই? পণ দেওয়া নেওয়া হরদম চলছে না? শিকার হচ্ছে না মেয়েরা প্রতিদিন,এই প্রথার, এই ভারতবর্ষে? বধূহত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, নারীপাচার, বেশ্যাপ্রথা সবই সতীদাহের আগুনের মতো দাউ দাউ করে জ্বলছে, জানান দিচ্ছে তারা আছে। তারা আইন মানে না।

এই মধ্যযুগের মধ্যেই মেয়েরা অনেকে শিক্ষা আর স্বনির্ভরতার আধুনিকতার দিকে যখন এগোচ্ছে তখন পুরোনো নথিপজ্ঞের গা থেকে ধুলো ঝেড়ে কর্ণাটকের সরকার আইন বের করেন খুঁজে, মেয়েদের পায়ে শেকল পরাতে চান। মেয়েদের ওপর রাতে রাতে আক্রমণ বাড়ছে, সুতরাং মেয়েদের ঘরবন্দি করো। ‘মাথা ব্যথা হচ্ছে, সুতরাং মাথা কেটে ফেলো’র মতো সমাধান। দিনের বেলায় যদি আক্রমণ হয় তাহলে তো দিনের বেলাতেও ঘরের বাইরে বেরোনো মেয়েদের বন্ধ হবে। মেয়েদের ওপর আক্রমণ কখন না হয়? রাতে হয়, দিনে হয় না? দিন রাতের কোনও ভাগেই নিরাপদ নয় মেয়েদের জীবন। কেন নয়, সে কারণটি খুঁজে বের করা উচিত কর্ণাটক সরকারের। সমস্যার মূল কারণটিকে নির্মূল করা হলে সমস্যা নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

যদিও নারীবাদীদের চাপে রাতের চাকরিতে মেয়েদের নিষিদ্ধ করার বিষয়টি এখন স্থগিত রেখেছেন কর্নাটক সরকার, কিন্তু চাকরিরত মেয়েদের ওপর নিষেধাত্তা আরোপের একটি চেষ্টা অন্তত হয়েছিল, তা ভুলে গেলে চলবে না। আজ কর্নাটকের মতো রাজ্যে নিজেদের নিরাপত্তা ঘরে বন্দি হয়ে থেকে যদি মেয়েদের দিতে হয়, তবে অন্য অনগ্রসর রাজ্যগুলোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যেতে বাধ্য এই নিয়ম। মেয়েদের জন্য সবচেয়ে ভালো, ঘর থেকে না বের হওয়াই। তাহলে ভীষণ নিরাপত্তার মধ্যে মেয়েরা রইল। আর, বাইরে যদি বেরোতেই হয়, নিরাপত্তার চরমতম ব্যবস্থাটিই গ্রহণ করা উচিত। চলমান কারাগার, যার আরেক নাম বোরখা, ব্যবহার করতে হবে যেন মন্দ লোকের নজর না পড়ে। অন্ধকারের দিকে চিরকাল মানুষ এভাবেই হেঁটেছে। অন্ধকার চিরকাল মানুষকে এভাবেই গ্রাস করে নিয়েছে।

মানুষ তো আলোর দিকেও যায়। মনকে আলোকিত করার কিছুই কি নেই এই ভারতবর্ষে? মায়াবতীর বিজয় হচ্ছে একদিকে, ঘর থেকে বেরিয়ে আসা মেয়ে, দিন রাঙ্গির পরিশ্রম করে সাফল্য পাওয়া মেয়ে, আর অন্যদিকে চলছে মেয়েদের পঙ্গু বানাবার, পরাজিত আর পরনির্ভর বানাবার পাঁয়তারা।

ভারতবর্ষে বিজ্ঞান এবং ধর্মের যেমন সহাবস্থান চলে, নারীর জয় এবং পরাজয়েরও তেমন। আলো আর অন্ধকার পরস্পরকে উষ্ণ আলিঙ্গন করে আছে দেখলে বড় আশংকা হয়। যদি অন্ধকারের হাঁ মুখে ঢুকে যায় সব আলো, সব জয়, সব বিজ্ঞান, সব যুক্তি, সব মুক্তি, সব সমতা, সব মানবতা, তবে? অন্ধকারের শিক্ত কম নয়।

নারীকে রক্ষা করার জন্য, নারীর সম্ভ্রম বা ইজ্জত বাঁচানোর জন্য আলাদা কোনও আইনের কোনও প্রয়োজন নেই। নারী নাগরিক রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার সকল নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা। রাষ্ট্র যদি তার সব নাগরিককে বা জনগণকে নিরাপত্তা দেয়, তবে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজনীয় সব নিরাপত্তা নারী পেয়ে যাবে। রাষ্ট্র কি তা করে? যদি করতোই তবে সরকার অনুমোদিত বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার ইত্যাদি আইনি বৈষম্যের শিকার নারীকে হতে হত না, যদি করতোই তবে দিনে কেন, রাতেও নারী নিশ্চিন্তে রাস্তাঘাটে কর্মক্ষেত্রে চলাফেরা করতে পারতো, কোনও নিগ্রহের শিকার তাকে হতে হত না। যদি করতোই, তবে ঘরে ঘরে নারী শান্তিতে স্বস্তিতে বাস করতে পারতো।

নারীর নিরাপত্তা কোথাও নেই! নিরাপত্তার জন্য নানা আইনের প্রণয়ন হয়েছে, কোথাও কোথাও সেসব প্রয়োগও হচ্ছে। কিন্তু সত্যিকার নিরাপত্তা নারীর জুটছে না। একা আইন দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা যায় না। পুরুষ যদি এখন নারীকে আক্রমণ না করে, তবে সে আইনের ভয়ে। কিন্তু পুরুষ যেদিন থেকে নারীকে আক্রমণ করবে না, কারণ নারীকে সে মানুষ হিসেবে সম্মান করবে, সেদিন সমস্যার সত্যিকার সমাধান হবে। তার আগে নয়। শ্রদ্ধা ও সম্মান ভেতর থেকে আসে। ভেতর থেকে না এলে বাইরে থেকে আরোপ করে কৃঙ্গিম উপায়ে যে শিল্প বা সংস্কৃতিই নির্মাণ করা হোক না কেন, তুড়িতে ভেঙে পড়ে সব।

আইনের ভয় আজ থাকে, কাল থাকে না। ভয় দিনে দিনে দূর হয় লোকের। দূর্নীতিগ্রস্ত সমাজে ভয় বলে শেষ অবধি কারও কিছুই থাকে না। বুক ফুলিয়ে সন্ত্রাস চালিয়ে যেতে পারে যে কেউ। আইনের ভয় দেখিয়ে নারী নির্যাতন বন্ধ করা যায় না, যাবে না। একমাত্র উপায় নির্যাতন বন্ধ করার, পুরুষের মানসিকতা বদলানোর। নারীকে দুর্বল ভাবার, যৌনবস্তু ভাবার, খেলনা ভাবার, দাসী ভাবার, মনোরঞ্জনের জিনিস ভাবার, উৎপাদনের যন্ত্র ভাবার মানসিকতা না বদলালে কোনওদিনই নারী তার নিরাপত্তা এ সমাজে পেতে পারে না।

প্রশ্ন হল পুরুষের এই মানসিকতা তৈরি করছে কারা? তৈরি করছে রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সমাজ ব্যবস্থা, আইনি ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা। প্রতিটি ব্যবস্থাই পুরুষতান্ত্রিক, পুরুষকেন্দ্রিক। এক মায়াবতী দিয়ে রাজনৈতিক জগতে চমক ফেলা যায়, কিন্তু সমাজ পরিবর্তন করা যায় না। সমাজে আরও অনেক মেধার প্রয়োজন, আরও মায়াবতীর প্রয়োজন। আরও আরও রুখে ওঠা মানুষের প্রয়োজন। সমতার জন্য আরও আরও লড়াইএর প্রয়োজন।

নারীর প্রতি শ্রদ্ধা কি নারীরই আছে! হিসেব করলে দেখা যায়, নেই। কারণটি হল নারী নিচুশ্রেণীর জীব — এ কথা বাচ্চা বয়স থেকে সবাইকে শেখানো হয়, নারী পুরুষ উভয়কেই। উভয়ের মস্তিষ্কেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয় এই বিদ্যে। নিচুশ্রেণীর জীবকে শ্রদ্ধা বা সম্মান করা খুব দুরূহ ব্যাপার। তাই নারীবিরোধী অপরাধ বন্ধ হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই কোথাও।

নারীকে মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা ও সম্মান যেদিন নারী ও পুরুষ উভয়ে করতে শিখবে, সেদিন নারীবিরোধী কোনও কার্যকলাপ, নারীবিরোধী কোনও আইন, কোনও কুসংস্কার এই সমাজে টিকে থাকতে পারবে না। তখন নারীর নিরাপত্তার জন্য ঘন ঘন আইন প্রণয়ণেরও প্রয়োজন হবে না। শ্রদ্ধা করলে কেউ নারীকে ধর্ষণ করে না, কেউ নারীপাচার করে না, সম্মান করলে কেউ নারীকে বেশ্যাবৃঙ্গিতে ঠেলে দেয় না, তাকে আগুনে পোড়ায় না।

আইন কি কম আছে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে? ক’জন নির্যাতনকারী শাস্তি পায়? ক’জন নারী এ সমাজে সত্যিকার অর্থে নিরাপত্তা পায়? রোগের চিকিৎসা না করে রোগের উপসর্গের চিকিৎসা করা হচ্ছে। রোগ কী করে সারবে তবে!

রাত আটটার পর পুরুষরা যদি অসভ্য, অভব্য, অগণতান্ত্রিক, অমানুষ হয়ে ওঠে, তবে সেই পুরুষদের শাস্তি দেবার ব্যবস্থা হোক, মেয়েদের কেন শাস্তি দেওয়া হবে! মেয়েরা যদি রাঙ্গিভাগে কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়, তবে তারা চাকরির সুবিধে থেকে বঙ্গিত হবে। এক ক্ষতি ঠেকাতে গিয়ে আরও একটি বিরাট ক্ষতির আয়োজন ছাড়া এ কী আর কিছু! আর, এ কথাও সকলের জেনে রাখা প্রয়োজন, যে পুরুষ রাত আটটার পর বদমাইশি করতে পারে, সে দিন দুপুরেও অবলীলায় তা পারে। যে বদমাইশি করে না, সে রাত গভীর হলেও করে না।

বদমাইশি আলো আর অন্ধকারের ওপর নির্ভর করে না। করে মানসিকতার ওপর। মানসিকতা নির্ভর করে সুশিক্ষার ওপর। সুশিক্ষা নির্ভর করে শিক্ষা-ব্যবস্থার ওপর। শিক্ষা-ব্যবস্থা নির্ভর করে রাজনীতির ওপর। পুরুষতন্ত্রের আর বৈষম্যের রাজনীতির জয়জয়কার এখন। সমতায় বিশ্বাসী নারী-পুরুষ যতদিন না বৈষম্যের মূলোৎপাটন করছে, যতদিন ব্যবস্থাগুলোর আমূল পরিবর্তন না হচ্ছে, ততদিন নারীকে ইঁদুরের মতো বেঁচে থাকতে হবে। বিপদ দেখলে গর্তে লুকিয়ে পড়তে হবে। ইঁদুরের গর্তেই কি ইঁদুরের নিরাপত্তা আদৌ আছে! নিরীহ ইঁদুরের যেমন নেই, নারীরও নেই।

সকল অধ্যায়

১. ০১. পুরুষের বেলায় ‘অধিকার’, নারীর বেলায় ‘দায়িত্ব’
২. ০২. বাঙালি পুরুষ
৩. ০৩. নারী শরীর
৪. ০৪. সুন্দরী
৫. ০৫. আমি কান পেতে রই
৬. ০৬. আমার গৌরব, আমি স্বেচ্ছাচারী
৭. ০৭. বাঙালি নারীর সেকাল একাল
৮. ০৮. আমার প্রেমিকেরা
৯. ০৯. রেখে ঢেকে আর নয়
১০. ১০. অসভ্যতা
১১. ১১. মঙ্গল কামনা
১২. ১২. এতদিনে সভ্য আইন
১৩. ১৩. মহাশ্বেতা, মেধা, মমতা— মহাজগতের মহামানবীরা
১৪. ১৪. অসম্ভব তেজ ও দৃঢ়তা
১৫. ১৫. মেয়েদের রাগ হোক, ক্রোধ হোক
১৬. ১৬. এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষ—নারীর সমস্যার এ কি কোনও সমাধান?
১৭. ১৭. মাথায় প্রবলেম না থাকলে সব নারীরই নারীবাদী হওয়ার কথা
১৮. ১৮. শেষ পর্যন্ত হেরে যেতে হল
১৯. ১৯. কামড়ে খামচে মেয়েদের ‘আদর’ করছে পুরুষেরা
২০. ২০. সোনার বাংলার সোনার নারীরা শোনো: ঘনিয়ে আসছে ঘোর দুর্দিন
২১. ২১. মেয়েরা ছেলে হয়ে যাক, মেয়ে বলে কিছু আর না থাকুক কোথাও
২২. ২২. ডিভোর্স হয় না বলেই ব্যভিচার বাড়ে
২৩. ২৩. মেয়েরা কেন তাদের অত্যাচারী ব্যভিচারী স্বামীদের ডিভোর্স করছে না?
২৪. ২৪. আর কতকাল নারী কোলে কাঁখে রেখে অমানুষ করবে পুরুষজাতকে?
২৫. ২৫. পুরুষ কি আদৌ নারীর প্রেম পাবার যোগ্য?
২৬. ২৬. সমকামীদের গর্তে লুকিয়ে রেখে প্রগতিশীল হওয়া অসম্ভব
২৭. ২৭. আমার মায়ের আমার বোনের কষ্টে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি…
২৮. ২৮. সানেরার মতো মেয়ে চাই। আছে?
২৯. ২৯. ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬৪ দিন পুরুষদিবস, ১ দিন নারীদিবস
৩০. ৩০. দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি
৩১. ৩১. নারী = শরীর
৩২. ৩২. ভারতবর্ষে বেঁচে থাকবে শুধু পুরুষরাই
৩৩. ৩৩. কট্টরপন্থীদের কোনও দোষ নেই
৩৪. ৩৪. জনগণের নিরাপত্তার ব্যবস্থা হলেই নারী নিরাপত্তা পাবে
৩৫. ৩৫. মেয়েরা যেন না মেনে নেয় অপমান
৩৬. ৩৬. কবে হবে মেয়েরা নিজেই নিজের পরিচয়?
৩৭. ৩৭. কে দোষী? পুরুষ না পুরুষতন্ত্র?
৩৮. ৩৮. বধূ নির্যাতন আইনের প্রয়োগে মেয়েরা কেন দ্বিধাগ্রস্ত?
৩৯. ৩৯. যদি এর পেছনে রাজনীতি না থাকতো?
৪০. ৪০. আত্মঘাতী নারী!
৪১. ৪১. পুরুষের স্ত্রী বা প্রেমিকা হওয়া ছাড়া মেয়েদের আর কোনও ভূমিকা নেই
৪২. ৪২. মানুষ আর মানুষ নেই
৪৩. ৪৩. নামে অনেক কিছু আসে যায়
৪৪. ৪৪. লিঙ্গ-নিরপেক্ষ বাংলা ভাষার প্রয়োজন
৪৫. ৪৫. শাঁখা সিঁদুরের গল্প
৪৬. ৪৬. ধর্ম থাকবে, নারীর অধিকারও থাকবে, এটা হয় না

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন