১০. অসভ্যতা

তসলিমা নাসরিন

কদিন পর পর আজগুবি আর উদ্ভট সব কাণ্ড ঘটায় মুসলমান উগ্রপন্থীরা । সকলে হাঁ হয়ে দেখে এসব। বোমা মেরে এটা সেটা উড়িয়ে দেওয়া, ত্রাস সৃষ্টি করা — এসব তো আছেই, এসব হয়তো যে কোনও সন্ত্রাসী দলই করে বা করতে পারে, ধর্ম তাদের যা-ই হোক না কেন। কিন্তু কদিন পর পরই মেয়েদের নিয়ে ‘ছেলেখেলা’ খেলে পুরো ভারতবাসীকে চমকে দেওয়ার কাজ ওরাই করছে। দেখে মনে হয় একরকম দায়িত্বই ওরা নিয়েছে এ-কাজের। আমি বলতে চাইছি না অমুসলমান মেয়েদের নিয়ে ‘ছেলেখেলা’ হয় না, বলছি না যে তারা অফুরন্ত স্বাধীনতা ভোগ করছে। মোটেও তা নয়। ভারতবর্ষের মেয়েরা সর্বত্রই কম বেশি দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি। তবে অমুসলমান মেয়েদের ওপর যে অসভ্যতা চলে, সেসব অসভ্যতার একটা সীমা আছে। কিন্তু মুসলমান মেয়ের ওপর অসভ্যতা প্রায়ই সীমা ছাড়িয়ে যায়। মেয়েরা যে কেবলই পুরুষের যৌনইচ্ছে মেটাবার খেলনা, কেবলই যে পুরুষের সুখভোগের বস্তু, কেবলই যে পুরুষের দাসী বা ক্রীতদাসী — তা এত তীব্র করে অন্য কেউ বোঝায় না, যত বোঝায় মুসলমান পুরুষেরা। শ্বশুর ধর্ষণ করেছে। ধর্ষণ পুরুষমাত্রই হয় মনে মনে নয় শরীরে শরীরে করে — পুরুষাঙ্গে তাদের মুসলমানি বা খৎনা নামের ঘটনা ঘটুক বা না ঘটুক। কিন্তু তাই বলে ধর্ষককে স্বামী বলে মানতে হবে! এরকম ফতোয়া জগতের সেরা অসভ্যরাও কোনওকালে দিয়েছে বলে শুনিনি। মুসলমান-মৌলবাদীদের অসভ্যতার অবশ্য দেশকালপাত্র ভেদ নেই। ধর্ষক-শ্বশুর স্বামী বনে যাবে, নিজের স্বামী বনে যাবে নিজের ছেলে – এসব কি লোক হাসানো ছাড়া আর কিছু? যদি ঠাকুরদা ধর্ষক হয় তিন বছরের শিশুর? তবে কি শিশুটিকে হতে হবে ঠাকুরদার স্ত্রী? শিশুটির বাবা হবে শিশুটির ছেলে? শিশুটির মাকে হতে হবে শিশুটির পুত্রবধূ? এই তো মনে হচ্ছে ওদের বিচার!

এসব শুনলে গা হাত পা ঠাত্তা হয়ে আসে। গুড়িয়াকে নিয়েও ‘ছেলেখেলা’ চলেছিল। ‘এই স্বামীর সঙ্গে বাস করা চলবে না, ওই স্বামীর সঙ্গে বাস কর।’ গুড়িয়ার ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনও মূল্য কেউ দেয়নি। তা দেবে কেন! মেয়েরা তো মাংসপিণ্ড ছাড়া কিছু নয়, মেয়েদের তো ‘মস্তিস্ক নেই, মগজ নেই, মাথা নেই’। তাদের আবার ইচ্ছে কী, অনিচ্ছে কী! ইমরানার বেলাতেও তাই। ইমরানার ইচ্ছে অনিচ্ছের ধার ধারার জন্য কেউ বসে নেই কোথাও। তাকে ধর্ষক-শ্বশুরের অবাধ কামের, পত্তায়েতের অশ্লীল অন্যায়ের আর মুসলিম ল বোর্ডের অবিশ্বাস্য অসভ্যতার শিকার হতে হয়। ধর্মতন্ত্রে এবং পুরুষতন্ত্রে বুঁদ হয়ে তাকে নিয়ে ‘ছেলেখেলা’ খেলেই চলেছে মানুষ। ‘ছেলেখেলা’ না বলে একে এখন ‘পুরুষখেলা’ই বলা ভালো। ছেলেখেলা এত ভয়ঙ্কর হয় না, যত ভয়ঙ্কর হয় ‘পুরুষখেলা’। ‘ছেলেখেলা’য় উদ্দেশ্য এত কুৎসিত থাকে না, যত কুৎসিত থাকে পুরুষখেলায়। পুরুষ যখন খেলে, নারীকে চিরকালই পায়ের তলায় পিষে মারতে পারার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য খেলে। ‘আজ খেলে জিতে গেলাম, হিপ হিপ হুররে’ – অমন ‘ছেলেখেলা’ হয়তো তারা ছেলেবয়সে খেলতো, পুরুষবয়সে আর খেলে না। পুরুষবয়সে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ করে। চিরকালই খেলতে পারার বন্দোবস্ত। নিজেদের চিরস্থায়ী আরামের আমোদের আয়েশের বন্দোবস্ত। পুরুষের হাতের মুঠোয় ধর্ম, হাতের মুঠোয় সমাজ, হাতের মুঠোয় রাজনীতি অর্থনীতি। এগুলো যেন সহজে পুরুষের মুঠোবন্দি হয়, তার জন্য নারী কম ত্যাগ, কম তিতিক্ষা এ যাবৎ করেনি। নারী যদি নিজেকে নিঃস্ব ক’রে পুরুষকে শক্তিমান, শৌর্যবান না করে, তবে সে আর নারী কিসে! এই বিশ্বাসে ভর করে পুরুষের সংত্তা মেনে চমৎকার আদর্শ নারী হয়ে উঠেছে নারীকুল। এই নিঃস্ব রিক্ত নারীকে কথায় কথায় পুরুষেরা গুঁতো দিলে, লাথি দিলে, চেপে মারলে, টিপে মারলে, মুচড়ে মারলে, পুড়িয়ে মারলে, পুঁতে মারলে, ডুবিয়ে মারলে, কুপিয়ে মারলে কার কী বলার আছে? কিচ্ছু বলার নেই কারওর।

‘ইমরানা তো আমাদের নয়, তাদের।’ সুতরাং ‘তারা’ যা ইচ্ছে করে, তাই করবে ইমরানাকে। এমন কথা অমুসলমানদের অনেকেই উঠতে বসতে বলছে। প্রশ্ন হল, এই তারাটা কারা? তারাটা নাকি মুসলমানরা। এর মানে হচ্ছে ইমরানা মুসলমানদের, সুতরাং মুসলমানি বিধিব্যবস্থার শিকার তাকে হতেই হবে। মুসলমান না হয়ে সে হিন্দু বা খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ বা জৈন বা ইহুদি বা নাস্তিক হলে তাকে শিকার হতে হত না। ভারতে ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্ধ ভিন্ন ভিন্ন ধর্মভিত্তিক আইন। এসব আইনের সংস্কার হয়েছে আজ অনেককাল। যেমন, হিন্দু পুরুষের বহুবিবাহ নিষিদ্ধ, হিন্দু নারী সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে আর বঙ্গিত নয়। কিন্তু মুসলমানদের মাথার ওপর সপ্তম শতাব্দীর আইন, যেমন ছিল তেমনই আছে, সংস্কারের কিছুই হয়নি এতকাল, আর ভারতবর্ষের সব মুসলমানকে মাথা পেতে বরণ করতে হচ্ছে এই পচা পুরোনো আইন, এই আইন তারা পছন্দ করুক বা না করুক। প্রতিবেশী মুসলিম দেশগুলোয় কিন্তু শরিয়তি আইনের প্রচুর সংস্কার হয়েছে, ওখানে পুরুষেরা ‘তালাক তালাক তালাক’ উচ্চারণ করলেই তালাক হয় না, ওখানে পুরুষের একসঙ্গে চার স্ত্রী রাখার খায়েশ হলেই তা পূরণ হয় না। ইসলামি রাষ্ট্রেও শরিয়তি আইনের সংস্কার হচ্ছে। সংস্কারের বালাই নেই কেবল ভারতেই। আজ ইমরানাকে ইসলামি আইনের কবল থেকে বাঁচতে দেওয়ানি বা ফৌজদারি আইনের আশ্রয় নিতে হয়। ইসলামি আইনে বা শরিয়তি আইনে ধর্ষক শ্বশুরের শাস্তি নেই। শাস্তি তো নেই-ই, বরং উপঢৌকনের ব্যবস্থা আছে। ধর্ষিতাকে উপঢৌকন হিসেবে ধর্ষকের লিঙ্গে নিবেদন করা হয়। ধর্ষক যেন দিবানিশি নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায় ধর্ষণ করে যেতে পারে ধর্ষিতাকে। ভারতীয় আইনে ইমরানারা বিচার পায় ঠিকই, কিন্তু ধর্মীয় আইনেই আবার অবিচার জোটে। এক আইনে মেয়েদের বাঁচানো হয়, আরেক আইনে মারা হয়। কিন্তু, সভ্য আইনের পাশাপাশি অসভ্য আইন বহাল রাখার যুক্তি কী? সমতার পেছনে অসাম্যকে লেলিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য কী? পরস্পরবিরোধী দুটো আইনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য দোলনা দুলিয়ে কারও কি আদৌ কোনও লাভ হচ্ছে? লাভ হয়তো কিছু বদ পুরুষের হচ্ছে, মেয়েদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে মজা করে মজা দেখার লাভ। কিন্তু ক্ষতি তো হচ্ছে তাবৎ মেয়েদের! অর্ধেক জনসংখ্যার। অযুত সম্ভাবনার। তার চেয়ে একটি আইনই থাকুক, যে আইনে অপরাধীর শাস্তি হয় আর নিরপরাধী মুক্তি পায়! না, এটিতে অনেকের আপত্রি। আপত্রি কিছু জঙ্গি সন্ত্রাসী মুসলমানের আর লোকনীতির (পলিটিজ্ঞের) লোকের। ‘মুসলমানরা যেহেতু চাইছে শরিয়তি আইন — তা তাদের দিতে হবে।’ কেন চাইছে, কী শিক্ষা থেকে চাইছে, কী বিদ্যা থেকে চাইছে, এই আইন কারও কোনও ক্ষতি করছে কী না তা খতিয়ে দেখার কেউ নেই। এই আইন কি শিক্ষিত বিবেকবান মুসলমানরা চাইছে? এই আইন কি মুসলমানরা চাইতো যদি তারা বিজ্ঞান-শিক্ষায় সত্যিকার শিক্ষিত হত? ‘মুসলিম পারিবারিক ও উত্তরাধিকার আইন’ মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করছে কি না, নারীর সমানাধিকারকে মানছে কী না, গণতন্ত্রের সব শর্ত পূরণ করছে কি না – তা দেখছেটা কে শুনি? কে দেখছে যে ধর্মীয় আইনের প্রথম এবং প্রধান এবং একমাত্র ভিকটিম হচ্ছে মেয়েরা। মেয়েরা এবং মেয়েরাই।

‘তারা আলাদা আমরা আলাদা।’ ‘মুসলমানরা যদি নিজেরাই নিজেদের কবর খুঁড়তে চায়, তাতে আমাদের কী! আমরা বাঁচলেই তো হলো।’ এরকম কাণ্ডজ্ঞানহীন বাক্য বুদ্ধিজীবীরাও উচ্চারণ করেন। তবে মুসলমানরা না বাঁচলে তাঁরাও যে বাঁচবেন না, এ কথা বারবারই তাঁরা ভুলে যান। বাঁচতে হলে একসঙ্গেই সবাইকে বাঁচতে হয়। মুসলমানরা শক্ত শক্ত কোদাল শাবল নিয়ে নিজেদের কবর সত্যি সত্যি খুঁড়ছে। যারা খুঁড়ছে তাদের খুব কম সংখ্যক জানে যে তারা খুঁড়ছে। বোধবুদ্ধিহীন বাকিরা জানে যে এ তাদের বেহেস্তে যাবার সুড়ঙ্গপথ। সবচেয়ে আফশোসের ব্যাপার এই, যে, এই বেঁচে যাওয়া আমরা জানি না যে ওটা আমাদেরও সুড়ঙ্গপথ, তবে বেহেস্তে যাবার নয়, নরকে যাবার। কোদাল শাবল নিয়ে আজ নিজেদের কবর যারা খুঁড়ছে, তারা কিন্তু সবসময় নিজেদের কবরই খুঁড়বে না, অন্যদের কবরও খুঁড়বে। কবরে পা পিছলে পড়বে যাদের ৪৯ জন্য কবর নয়, যারা সেইফসাইডে, তারাও। মাটি তো এক। না কি? আসলে এক দেশের, এক রাষ্ট্রের মানুষের মধ্যে আলাদা আলাদা কানুন চালু করলে মানুষ চিরকাল আলাদাই থেকে যায়। সেগ্রেগেটেড। বিচ্ছিন্ন। তারা কিছুতেই একাত্ম হতে পারে না। সৌহার্দের বন্ধন সৃষ্টি হয় না। যতদিন না আমাদের আর তাদের একত্রবাস হচ্ছে, ততদিন তাদেরকে অচেনা গ্রহের অচেনা জীব বলেই আমাদের মনে হবে। না হওয়ার কোনও কারণ নেই। মূল জনস্রোত থেকে পিছিয়ে পড়া কোনও সংখ্যালঘুর জন্য মুক্তচিন্তায় পারদর্শি হওয়া দুঃসহ। আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগতে তারা বাধ্য হয়। ভুগতে ভুগতে একদিন ধর্মকেই আঁকড়ে ধরে নিজের পরিচয় হিসেবে। ধীরে ধীরে তারা ধর্মবাদী হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে অসহিষ্ণু অচেতন মৌলবাদী।

বিজেপি বলছে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কথা। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলে যাদের খ্যাতি আছে, তারা রাগ করেছে শুনে। বিজেপির বিরুদ্ধশিবির বলেই তাদের উল্টোকথা বলতে হবে, স্বরচিত এই নিয়ম মেনে বলছে তারা – ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি মানি না’। এটি মানার দু হাজার কারণ থাকলেও বলছে মানি না। না মানার কী কী কারণ? একটিই কারণ। বিজেপি মানছে। বিজেপি মানছে বলে অন্য দলের তা মানা যাবে না। বিজেপি যদি বলে সূর্য পূর্বদিকে ওঠে, তাহলে কি বিরুদ্ধশিবিরকে বলতে হবে যে সূর্য পূর্বদিকে ওঠে না, ওঠে পশ্চিমদিকে? অনেকে মনে করে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি মানে মুসলমানদের বুঝি ‘হিন্দু আইন’ মানতে হবে। হিন্দু আইনের কথা এখানে হচ্ছে না, অন্য কোনও ধর্মভিত্তিক কোনও আইনের কথাও হচ্ছে না, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বলতে যা বোঝায় তা হল সমানাধিকারের ভিত্তিতে রচিত বিধি, যে বিধিতে ধর্মের ধ-ও নেই, নারী ও পুরুষের সমান অধিকার যে বিধি নিশ্চিত করে। একটি সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য এই ধর্মগন্ধহীন নিষ্কলুষ বিধি নিতান্তই অপরিহার্য। মানবাধিকারের সুবিধে কিছু মানুষকে দেওয়ার, এবং কিছু মানুষকে সেই সুবিধে থেকে বঙ্গিত করার আইন বহাল থাকে যে রাষ্ট্রে, সেই রাষ্ট্রকে আর যাই বলা যাক, গণতান্ত্রিক বলা যায় না। যে কোনও ধর্মীয় আইনই যে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, এবং নারীর অধিকারের পরিপন্থী তা যে কোনও সুস্থ মানুষেরই বোঝার কথা।

ইমরানাকে যতদিন ‘তাদের মেয়ে’ হিসেবে দেখা হবে, যতদিন ‘আমাদের মেয়ে’ হিসেবে হবে না, যতদিন সে ভারতের মেয়ে না হবে, ততদিন ইমরানাদের দিকে আঙুল তুলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় দেখবে এবং দেখাবে। ইমরানার দুর্ভোগকে কখনও তারা নিজেদের দুর্ভোগ বলে অনুভব করবে না। অনুভব করবে না বলেই তারা রা-শব্দ করবে না, বা চিল্লিয়ে প্রতিবাদ করবে না। ‘মুসলিম-বিরোধী’ দুর্নাম কামাতে হয় কী না এই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকবে। বর্বরতাকে মেনে নিলেই অসাম্প্রদায়িক বা সেকুলার হিসেবে দিব্যি ‘নাম’ হয়। সহজে নাম হওয়ার এটি একটি পন্থা বটে। চোখ কান নাক মাথা বুঁজে থেকে ‘নাম’ করে নেওয়া। নাম না হয় হল, কিন্তু দেশটির কী হয়? দেশের প্রায় পনেরো কোটি মানুষ যদি অন্ধকারে পড়ে থাকে, যদি অশিক্ষা কুশিক্ষা অন্ধত্ব আর দারিদ্র ছাড়া আর কিছু তাদের সামনে না থাকে! তাদের মধ্যে তো খুব স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে ঠগ জোচ্চোর বদমাশ ধর্ষক সন্ত্রাসী খুনী এবং আরও হরেক রকম উপদ্রব। দূরদর্শী আছে কেউ? কোনও লোকনীতিক? ইমরানাদের বাঁচাবার জন্য না হলেও অন্তত দেশটিকে বাঁচাবার জন্য ধর্মীয় শিক্ষার পরিবর্তে ধর্মমুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করা, শরিয়তি আইনের পরিবর্তে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রণয়ন করা, অন্ধকারের পরিবর্তে আলো ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা যতদিন না লোকনীতিকরা অনুধাবন করতে পারছেন ততদিন ভারতের ভবিষ্যত নিয়ে ভয় দূর হওয়ার নয়। কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়ন দিয়ে দেশকে সভ্য করা যায় না। গেলে সৌদি আরবে মানবাধিকার, নারীর অধিকার আর গণতন্ত্র বিরাজ করতে পারতো।

ভারতে কিন্তু জনহিতকর কাজের অভাব নেই। ‘একে বাঁচাও ওকে রক্ষা করো’ আন্দোলন লেগেই আছে বছরভর। নানা রকম আইনও আছে নানা জিনিস রক্ষা করার। কিন্তু চরম দুর্দশা থেকে লাঞ্ছনা থেকে অপমান থেকে মৃত্যু থেকে মুসলমান মেয়েদের রক্ষা করার কোনও আন্দোলন বা কোনও আইন এই ভারতবর্ষে নেই। আট কোটি মুসলমান মেয়ের চেয়ে একটি কৃষ্ণসার হরিণের মূল্য এ দেশে বেশি। কৃষ্ণসার হরিণকে বাঁচাবার আইন আছে, আট কোটি মেয়েকে বাঁচাবার কোনও আইন নেই।

একটি শিশু যখন জন্ম নেয়, তার কোনও ধর্ম থাকে না। তাকে বাবা মার ধর্মভুক্ত হতে বাধ্য করা হয়। বুদ্ধি হবার পর তার কোনও অধিকার থাকে না নিজের জন্য কোনও ধর্ম অথবা ধর্মহীনতাকে পছন্দ করার। শাহবানু, ইমরানা, লতিফুন্নেসা, গুড়িয়ারা কি মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়ে দোষ করেছে? কেন তাদের রাষ্ট্র তাদের নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করবে, কেন তারা বঙ্গিত হবে গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকার, সমানাধিকার, বাক স্বাধীনতা, এবং প্রাপ্য নিরাপত্তা থেকে? কী অপরাধ তাদের? আজ শিকলে, বোরখায়, আধাঁরে, পাঁকে বন্দি এইসব মেয়ে। লক্ষ কোটি মেয়ে। এরা ‘তারা’ নয়, এরা ‘আমরা’, এরা স্বাতী, সরস্বতী, এরা দ্রৌপদি, এরা পার্বতী, এরা শ্বেতা, মহাশ্বেতা। এক মেয়ে যখন বন্দি, আমি বিশ্বাস করি তখন সব মেয়েই বন্দি। মেয়েদের বন্দি করা হচ্ছে এই সমাজে, এই দেশে, আর এই দেশেরই এই সমাজেরই মানুষ হয়ে নিজেদের মুক্ত ভাবে যে মেয়েরা, ধিক তাদের। কোনও মেয়েই মুক্ত নয়, যখন সব মেয়ে মুক্ত নয়। এই বোধটি আর কবে মেয়েদের মনে উদয় হবে! অবশ্য উদয় হলেই বা করার কী আছে? মেয়েরা তো ছোট বড় মাঝারি নানান রকম খাঁচায় বন্দি। কারই বা কী করার আছে কঠিন কঠোর পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে! চিৎকার করা যায়। চিৎকার করে কিছু হোক বা না হোক, চিৎকার তো অন্তত হয়। এটিই মেয়েরা যদি সবাই মিলে করতে পারতো! নিজেদেরকে অযথা সুখী এবং স্বাধীন মনে না করে। নিরাপদে এবং নিরুপদ্রবে আছে বলে ভুল না করে!

ভারত আজ উদাহরণ হতে পারতো সত্যিকার গণতন্ত্রের। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো ধীরে ধীরে ভারতের উদাহরণ মেনে গণতান্ত্রিক হতে পারতো আরও। শুধু প্রতিবেশীই বা বলি কেন, মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মরাষ্ট্রগুলোও শিক্ষা নিতে পারতো। আজ এত বড় একটি রাষ্ট্র ভারত, ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক শক্তি ও অতুল সম্ভাবনা, দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে । এই ভারত দায় নিতে পারতো সভ্যতার। দায় যদি বড়রা না নেয়, তবে নেবে কে?

আসছে নভেম্বরে কলকাতা শহরে হতে চলেছে ধর্মমুক্ত মানববাদী মজ্ঞের কনভেনশন। কনভেনশনে ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চাই’ বলে দাবি উঠবে। এই মজ্ঞের সকলের জন্ম মুসলিম পরিবারে। গিয়াসউত্তিন, সুলতানা ওয়াজেদা, মোজাফফর হোসেন, সুলেখা বেগম, জাহানারা খাতুন, ফাতেমা রহমান, গোলাম ইয়াজদানি, মহব্বত হোসেন এরকম অনেকে। সরকার কি কিছু জঙ্গিকে মুসলমানের প্রতিনিধি না ভেবে এই শিক্ষিত সচেতন বিবেকবান যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক, মানববাদে এবং মানবাধিকারে, গণতন্ত্রে এবং সেকুলারিজমে বিশ্বাসী মানুষদের মুসলমানের প্রতিনিধি ভাবতে পারেন না? পারলে চিত্র বদলে যায়। একটি বৈষম্যহীন আগামির স্বপ্ন আমরা দেখতে পারি। মজ্ঞের আরও দাবি ‘মানবাধিকার, নারীর অধিকার, ধর্মমুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা, ধর্মীয় সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ’—এসব প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগও নির্বিঘ্নে নেওয়া যেতে পারে।

খুব বেশি তো দাবি নয়, অতি সামান্যই দাবি, সামান্য একটু সভ্য হওয়ার দাবি। রাষ্ট্রকে, আইনকে, সমাজকে সামান্য সভ্য করার দাবি। দাবিটি তো অযৌক্তিক নয়। দাবিটি তো ন্যায্য। এই দাবিকে যারা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চায়, তারা কি সত্যিই বৈষম্যহীন বিদ্বেষহীন সমাজ চায়? তারা কি আদৌ দেশের এতটুকু ভালো চায়?

সকল অধ্যায়

১. ০১. পুরুষের বেলায় ‘অধিকার’, নারীর বেলায় ‘দায়িত্ব’
২. ০২. বাঙালি পুরুষ
৩. ০৩. নারী শরীর
৪. ০৪. সুন্দরী
৫. ০৫. আমি কান পেতে রই
৬. ০৬. আমার গৌরব, আমি স্বেচ্ছাচারী
৭. ০৭. বাঙালি নারীর সেকাল একাল
৮. ০৮. আমার প্রেমিকেরা
৯. ০৯. রেখে ঢেকে আর নয়
১০. ১০. অসভ্যতা
১১. ১১. মঙ্গল কামনা
১২. ১২. এতদিনে সভ্য আইন
১৩. ১৩. মহাশ্বেতা, মেধা, মমতা— মহাজগতের মহামানবীরা
১৪. ১৪. অসম্ভব তেজ ও দৃঢ়তা
১৫. ১৫. মেয়েদের রাগ হোক, ক্রোধ হোক
১৬. ১৬. এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষ—নারীর সমস্যার এ কি কোনও সমাধান?
১৭. ১৭. মাথায় প্রবলেম না থাকলে সব নারীরই নারীবাদী হওয়ার কথা
১৮. ১৮. শেষ পর্যন্ত হেরে যেতে হল
১৯. ১৯. কামড়ে খামচে মেয়েদের ‘আদর’ করছে পুরুষেরা
২০. ২০. সোনার বাংলার সোনার নারীরা শোনো: ঘনিয়ে আসছে ঘোর দুর্দিন
২১. ২১. মেয়েরা ছেলে হয়ে যাক, মেয়ে বলে কিছু আর না থাকুক কোথাও
২২. ২২. ডিভোর্স হয় না বলেই ব্যভিচার বাড়ে
২৩. ২৩. মেয়েরা কেন তাদের অত্যাচারী ব্যভিচারী স্বামীদের ডিভোর্স করছে না?
২৪. ২৪. আর কতকাল নারী কোলে কাঁখে রেখে অমানুষ করবে পুরুষজাতকে?
২৫. ২৫. পুরুষ কি আদৌ নারীর প্রেম পাবার যোগ্য?
২৬. ২৬. সমকামীদের গর্তে লুকিয়ে রেখে প্রগতিশীল হওয়া অসম্ভব
২৭. ২৭. আমার মায়ের আমার বোনের কষ্টে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি…
২৮. ২৮. সানেরার মতো মেয়ে চাই। আছে?
২৯. ২৯. ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬৪ দিন পুরুষদিবস, ১ দিন নারীদিবস
৩০. ৩০. দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি
৩১. ৩১. নারী = শরীর
৩২. ৩২. ভারতবর্ষে বেঁচে থাকবে শুধু পুরুষরাই
৩৩. ৩৩. কট্টরপন্থীদের কোনও দোষ নেই
৩৪. ৩৪. জনগণের নিরাপত্তার ব্যবস্থা হলেই নারী নিরাপত্তা পাবে
৩৫. ৩৫. মেয়েরা যেন না মেনে নেয় অপমান
৩৬. ৩৬. কবে হবে মেয়েরা নিজেই নিজের পরিচয়?
৩৭. ৩৭. কে দোষী? পুরুষ না পুরুষতন্ত্র?
৩৮. ৩৮. বধূ নির্যাতন আইনের প্রয়োগে মেয়েরা কেন দ্বিধাগ্রস্ত?
৩৯. ৩৯. যদি এর পেছনে রাজনীতি না থাকতো?
৪০. ৪০. আত্মঘাতী নারী!
৪১. ৪১. পুরুষের স্ত্রী বা প্রেমিকা হওয়া ছাড়া মেয়েদের আর কোনও ভূমিকা নেই
৪২. ৪২. মানুষ আর মানুষ নেই
৪৩. ৪৩. নামে অনেক কিছু আসে যায়
৪৪. ৪৪. লিঙ্গ-নিরপেক্ষ বাংলা ভাষার প্রয়োজন
৪৫. ৪৫. শাঁখা সিঁদুরের গল্প
৪৬. ৪৬. ধর্ম থাকবে, নারীর অধিকারও থাকবে, এটা হয় না

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন