কাজী আনোয়ার হোসেন
সাবধান, ডিউক! – আর. এম. লিটন
গ্লাসের সঙ্গে বোতলের ঠোকাঠুকির শব্দ। চিয়ার্সের টুং-টাং। চাপা গুঞ্জন, ফিসফাস। কোমল আলোয় সরব চারদিক।
সন্ধে নামার পরপরই বিশাল মেইন রুমে ক্লাবটির সদস্য ও অতিথিদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। গুচ্ছ বেঁধে আলাপচারিতায় মুখর কয়েকটি গ্রুপ। কেউ নিঃসঙ্গ বসে আছে কারও অপেক্ষায়, চুমুক দিচ্ছে ড্রিঙ্কসের গ্লাসে, দৃষ্টি নিবদ্ধ মোবাইলের স্ক্রিনে। কেউবা হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে স্মোকিং যোনে, নিকোটিনের নেশায় পেয়েছে। উপস্থিত সবাই তাদের আধুনিক পোশাকে, সাজে ঝলমল করছে। তরুণ-তরুণী যেমন আছে, তেমনি পঞ্চাশ-ষাটোর্ধ্ব নারী-পুরুষও কম নেই। ওয়েটার বা ওয়েট্রেসদের ড্রিক্স আর ফিঙ্গার ফুডের ট্রে হাতে ছুটোছুটি চলছে, কিন্তু কারও গায়ে সামান্যতম টোকাও লাগছে না। তবে নিচু স্টেজের ওপর আলোটা সামান্য বেশি, সেখানে ক্লাসিকাল সঙ্গীত বাজিয়ে চলেছে একদল যন্ত্রশিল্পী, মূল শিল্পী সেতার হাতে একজন নারী-ছিপছিপে গড়নের ওপর ক্রিম কালারের শাড়ি আধুনিক স্টাইলে জড়ানো, একপাশের কাঁধ উন্মুক্ত। কান, গলা আর চুলে গহনার পরিমিত ব্যবহার তার সৌন্দর্যকে দিয়েছে আভিজাত্য। সবচেয়ে বড় কথা, তার সুললিত কণ্ঠে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের পরিবেশনা ‘ক্লাবের পরিবেশটাকে নিয়ে গিয়েছে এক অন্য উচ্চতায়। যদিও রাত যত গভীর হবে, এই স্টেজও পরিণত হবে ট্যাঙ্গো, জ্যাজ, ওয়াজ কিংবা ডিজে মিউজিকের উদ্দাম নৃত্যাঙ্গনে।
কঠিন নিয়ম-কানুনের বেড়াজালে ঢাকায় পাঁচ বছর আগে চালু হওয়া এলিট শ্রেণীর মানুষদের ক্লাব এটি। এখানে বিলিয়ন ডলারের বিজনেস ডিল যেমন হয়, তেমনি চলে ক্লাসিকাল, রক, ফিউশন কিংবা ইণ্ডিয়ান, অ্যারাবিয়ান মিউজিকের সঙ্গে আড্ডা, ক্যাসিনো এবং পানীয় গ্রহণের মচ্ছব। আশ্চর্য হলেও সত্যি, এখানে বুউজ বা হার্ড ড্রিঙ্কস ছাড়া অন্য কোন নেশাদ্রব্যের অনুমোদন নেই। ভুল করেও কেউ যদি অন্য ধরনের মাদক বহন বা আদান-প্রদান করে, সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করে দেয়া হয় তার সদস্যপদ। এমনকী রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর কোন ব্যক্তির পারমিশন থাকলেও ক্লাবের বাইরে বারের কোন পানীয় বহন করার অনুমতি নেই এদের। এসব নিয়ে ছোটখাট ঝামেলায় দেশের ভেতরে অনেক বড় বড় ক্লাব বন্ধ হয়ে গেছে। তাই সকল সদস্য এবং তাদের অতিথিরা সাবধানে থাকে, কারণ তাদের জন্য লাভের পারদটা অনেক উঁচুতে।
তাই বলে কি এখানে যৌনতা, অনাচার, ব্ল্যাকমেইল, ঘুষ বা অন্য কোন অপরাধ চলে না?
নিশ্চয়ই চলে। তবে এজন্য আমাদের ক্যামোফ্লেজ সরিয়ে ভেতরের জগৎটা দেখতে হবে। এখানে দ্বিতীয় আরেকটা লেয়ার আছে, যেটি সময়মত প্রকাশিত হবে। আপাতত ফোকাস করা যাক গভীর মনোযোগে উচ্চাঙ্গের সুর শুনতে থাকা যুবকটির ওপর। যদিও খেয়াল করলে বোঝা যাবে সে কিছুটা অন্যমনস্ক আর বিরক্ত। সময় তার কাছে মহামূল্যবান। একজনের জন্য অপেক্ষা করছে, কিন্তু অ্যাপয়েন্টমেন্টের ক্ষণ অতিক্রান্ত। নতুন একটা কাজের কথা চলছে, তাতে আছে প্রচুর টাকার পারিশ্রমিক। কাজ বলতে যেটা বোঝায়, তা হলো মার্ডার বা খুন করা। এই পেশায় যুবক একজন কিংবদন্তী, যদিও বদনাম একটাই—অর্ধেক পেমেন্ট অ্যাডভান্স নিয়েও সে কাজটা না-ও করতে পারে, তার যেমন মর্জি। এটা মেনেই ক্লায়েন্টরা তাকে খোঁজে, কারণ কাজটা যদি সে করে, তা হলে সাফল্যের সম্ভাবনা শতভাগ! আর যদি না করে দেয়, তো ক্লায়েন্টদের আইনের কাছে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনাও শূন্য।
আরও কিছুক্ষণ দেখে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে চারপাশে চোখ বোলাল যুবক। ভাবছে-যারা খুনের ‘সুপারি’ দেয়, তারা যদি সময়মত উপস্থিত না হয়, এর একটি কারণ হতে পারে যে নিজেই বিপদে পড়েছে সে। সেক্ষেত্রে ওর নিজেরও মিটিঙের জায়গায় বেশিক্ষণ থাকা সমীচীন নয়। শত্রুপক্ষ কিংবা আইন-দুটোই ওঁৎ পেতে থাকতে পারে বাইরে।
শেষবারের মত রিস্টওয়াচ দেখে হাই চেয়ারটা থেকে নেমে পড়ল যুবক। দু’তিনটা মেয়ে গ্লাস ভরে নিতে বার কাউন্টারে এসে কাছ ঘেঁষে ঘুরে গেল, চোখে মায়াবিনীর আহ্বান। কিন্তু কোন আগ্রহ দেখাল না ও। হোস্ট হিসেবে ক্লায়েন্টের পরিচয় দিয়ে বিল মিটিয়ে শেষ হওয়া ড্রিঙ্কসের গ্লাসটা কাউন্টার টপে রেখে ঘুরে দাঁড়াতেই মুখোমুখি হয়ে গেল আপাদমস্তক কালো স্যুট পরা এক লোকের। চোখে কালো গ্লাস, কানে ইয়ারপিস। ক্লাব সিকিউরিটি।
বাধা পেয়ে কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠল ও, ‘সরে দাঁড়াও!’
ওর ইংরেজি কথার উত্তর ইংরেজিতেই ভদ্র সুরে দিল সিকিউরিটির লোকটা, ‘আমাদের একজন সম্মানিত অতিথি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।’
লোকটার ইঙ্গিত দেখে তার মাথার ওপর দিয়ে দূরে তাকাল যুবক। সিলিং থেকে ডিজাইন করা বিশাল এক গ্লাস- প্যানেল ঢালু হয়ে নিচের দেয়ালে এসে মিলেছে। আর প্যানেলটা ওয়ানওয়ে অর্থাৎ ওপাশ থেকে নিচের ফ্লোর দেখতে পাচ্ছে একদল লোক হতে পারে সে ক্লাব প্রেসিডেন্ট, ভিভিআইপি অথবা সিকিউরিটি স্টাফ। ওটা আলাদা কোন এক জগৎ। তারমানে, ওপাশের ব্যক্তিরা ক্লাবের নিচের এই অংশে কখনও পা ফেলে না। সুতরাং ধরে নেয়া যায় এই নতুন ‘সম্মানিত অতিথি’ ওর ক্লায়েন্ট নয়।
মাথা নাড়ল যুবক, পাশ কাটিয়ে যেতে উদ্যত হলো। ‘আমি আগ্রহী নই।
পাশে সরে গিয়ে আবার পথ আটকাল কালো চশমা। ‘উপায় নেই। ওপরের নির্দেশ।’
লোকটার ব্যারিকেডের মত করে ধরা ডানহাতটা এক ঝটকায় নামিয়ে দিল রাগান্বিত যুবক। চিবিয়ে চিবিয়ে মুখ খারাপ করে বলল, ‘ফাক অফ!’ তারপর আর এক সেকেণ্ড না দাঁড়িয়ে হনহন করে এগিয়ে গেল একটি ডোরের দিকে।
‘আটকাব, স্যর?’ কানের ইয়ারপিস আলতো ছুঁয়ে জানতে চাইল কালো চশমা।
ওপর থেকে নির্দেশ এল: ‘আজ নয়।’
ক্লাবের বাইরে বেরিয়ে এসে সিগারেট ধরাল যুবক, সেই সঙ্গে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। ক্লাবের ডোরম্যান আর পার্কিং এরিয়ার গার্ড ছাড়া রাস্তায় কেউ নেই। গার্ডকে এগিয়ে আসতে দেখে হাত নেড়ে নিরুৎসাহিত করল যুবক, কারণ প্রয়োজনের সময় হুট করে এখান থেকে বের হওয়া যাবে না বলে ইচ্ছে করেই এই ভিড়ের মধ্যে রাখেনি ওর গাড়িটা। গুলশানে অনেক রাত পর্যন্ত বিভিন্ন রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে রাখা যায়। ওর নিজের গাড়িতে পৌঁছাতে হলে পার হতে হবে দুটো গলি। শার্টের আস্তিন গোটাতে গোটাতে সাধারণ পথচারীর মতই হাঁটতে শুরু করল সে।
টয়োটা প্রিমিয়ো গাড়িটার কাছে পৌঁছানোর আগেই তাদেরকে দেখতে পেল। নির্জন রাস্তায় তিনজন তারা। ওর গাড়ির কাছাকাছিই নিয়েছে পজিশন। কিঞ্চিৎ অন্ধকারে এক তরুণ আর তরুণী। মেয়েটা কাঁধখোলা টপস পরেছে, সেটার প্রান্ত থেকে কোমরের জিন্স শর্টসের দূরত্ব বেশ অনেকখানি। তার কাঁধ ধরে ছেলেটি একবার নিজের শরীরের কাছে টানছে, আবার দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। মজার খেলা পেয়েছে যেন। মেয়েটির ক্ষীণ কণ্ঠের ‘স্টপ’ কথাটা কয়েকবার শুনতে পেল যুবক। তৃতীয়জন দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা গাড়ির বনেটের ওপাশে, যেন এই দলের কেউ নয়। দলটার দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ না করে প্রিমিয়োর ড্রাইভিং সিটের ডোর আনলক করতে গেল ও। আর তখনই ওকে উদ্দেশ্য করে কিছুটা মাতলামি জড়ানো সুরে বলে উঠল মেয়েটা, ‘হেই, মিস্টার! ক্যান ইউ হেল্প মি? ইউ ণ্ডড, ম্যান!’
মাত্র চার-পাঁচ গজ দূরত্ব অথচ যেন শুনতেই পায়নি যুবক, পা ঢোকাতে যাচ্ছে গাড়ির ভেতরে। এবার নেশাগ্রস্ত ভারী এক পুরুষকণ্ঠ শোনা গেল। ‘কী ব্যাপার, হিরো? নায়িকাকে সেইভ করবে না? না করলে কিন্তু জরিমানা দিতে হবে। হাহ্ হাহ্ হাহ্!’
কণ্ঠস্বরের মালিকের দিকে এক পলক তাকাল যুবক। একই সঙ্গে অনুভব করল পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে চতুর্থজন, যাকে আগে দেখেনি। স্বাভাবিকভাবে ঘাড়টা ঘোরাল ও। ওর মুখের তিন ইঞ্চি দূরে লম্বা সরু ফলার এক ছুরি ধরে রেখেছে বাইশ বা তেইশ বছরের ক্ষীণ স্বাস্থ্যের এক তরুণ। মৃদু কাঁপছে হাতের ছুরি। হুমকি দেয়ার জন্য কিছু বলতে যাবে তরুণ, এমন সময় যেন ম্যাজিক ঘটে গেল। লক্ষ করল তার হাতে আর ছুরিটা নেই, ওটা এখন ‘শিকারের হাতে! আর ছুরির ফলা ঠেকে আছে তার নিজেরই গলায়!
মেয়েটাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল দলপতি। রাগী কণ্ঠে বলল, ‘ভুল করছিস, হারামি কুত্তা! যেতে দে ওকে, নইলে খারাবি আছে তোর কপালে!’
কিন্তু কথা শেষ করেই তাজা রক্ত দেখে হতভম্ব হয়ে গেল সে।
তিরতির করে কাঁপছে দুর্বল স্বাস্থ্যের তরুণ। আর ছুরির ফলার খোঁচায় রক্তের ক্ষীণ একটা ধারা তার গলা থেকে নেমে ভিজিয়ে দিচ্ছে পরনের হালকা নীল টি-শার্ট। যে-কোন সময়ে ভয়ে হিসও করে দিতে পারে তরুণ।
এবার গাড়ির আড়াল থেকে এল তৃতীয়জন, হাতে উদ্যত পিস্তল। এত কাছ থেকে তার গুলি মিস হবার চান্স নেই বললেই চলে। তবে সেই সুযোগ পাওয়ার আগেই আহত পশুর মত আর্তনাদ করে উঠল সে। বিদ্যুদ্বেগে ছুটে আসা লম্বা ছুরির চিকন ফলাটা সম্পূর্ণ ভেদ করেছে তার পিস্তলধরা হাতের বাইসেপ। বাহুর দু’দিকের দুই ক্ষত দিয়ে টপ্-টপ্ করে পড়ছে রক্ত। হুড়মুড় করে পড়ে গেল সে রাস্তার ওপরে। গলা ছেড়ে চেঁচাচ্ছে যন্ত্রণায়। ওদিকে গালে প্রচণ্ড এক চড় খেয়ে ভূমিশয্যা নিয়েছে ক্ষীণদেহী তরুণ। মেয়েটাকে বাদ দিলে রইল বাকি একজন। পরিস্থিতি উল্টে গেছে দেখে চুপসে গেছে তারা। দু’হাত সারেণ্ডারের ভঙ্গিতে তুলে ধরে বলল লোকটা, ‘হয়েছে, হয়েছে, মিস্টার! তোমার প্রতি আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। তুমি যেতে পারো!’
এবার মেয়েটা নাগিনীর মত ফোঁস করে উঠে বলল, ‘না- না, তা কেন? আমরা কার কাছে হেনস্থা হলাম, সেটা তো জানতে চাইবে আমাদের বড় ভাই। তখন মস্তানি ছুটিয়ে দেবে এর। সত্যি সত্যি সাহস থাকলে কুকুরটা বলুক না ওর নাম কী!’
পুরো ঘটনাটা ঘটতে পনেরো সেকেণ্ড লাগেনি। কেউ মারাও যায়নি। মনে মনে স্বস্তির শ্বাস ফেলল যুবক। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল নিষ্ঠুর এক চিলতে হাসি। বলল, ‘তোদের বড় ভাইকে বলবি, আমার নাম ডিউক। তাকে বলবি, অন্তত ফোন করে হলেও যেন মাফ চেয়ে নেয় তোদের ভাই!’
মতিঝিল, ঢাকা।
বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের অফিসের কেউ কখনও চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর সোহেল আহমেদকে এমন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে দেখেনি, আজ যেমনটি দেখল। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছে সে, একটু পিছিয়ে পড়লে যেন পৃথিবীর ধ্বংস অনিবার্য!
মা মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিল মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের সেক্রেটারি ইলোরা। তাকেও জিজ্ঞেস করার প্রটোকলে না গিয়ে সরাসরি বসের অফিস-কামরার দরজায় নক করেই ঢুকে পড়ল সোহেল আহমেদ। হতভম্ব হয়ে গেল ইলোরা-কী হলো এটা?
ফুসফুসের সমস্যাটা আবার বেড়েছে। পাইপটা ধরাবেন কি ধরাবেন না, এই সিদ্ধান্ত রাহাত খান নেয়ার আগেই ঝড়ের বেগে কামরায় প্রবেশ করেছে তাঁর চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর।
‘কী ব্যাপার, সোহেল? বড় কোন ইস্যু?’ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি। তা
হাঁপাচ্ছে সোহেল। ‘রানার খোঁজ পাওয়া গেছে, স্যর! সেন্ট মেরি আইল্যাণ্ড থেকে উধাও হওয়ার পর গত আট মাস তো আমরা হন্যে হয়ে খুঁজলাম ওকে, অবশেষে নিজেই ফিরে এসেছে ও। এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন থেকে এইমাত্র আমাদের সোর্স খবর দিল।’
‘তুমি শান্ত হয়ে বোসো,’ ধীরকণ্ঠে বললেন রাহাত খান। যদিও আনন্দে ফুলে উঠছে তাঁর বুক। ইচ্ছে করছে সোহেলকেই জড়িয়ে ধরে সুখবরটা উদ্যাপন করতে। কতদিন ধরে ছেলেটাকে দেখেন না, সত্যিই এতদিন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল বুকটা। এমআরনাইন বেঁচে আছে!
নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে হাতের পাইপ ধরিয়েই ফেললেন রাহাত খান। ঘন ঘন টান দিলেন ধোঁয়া তৈরির জন্য। তাঁর আবেগের আলোড়নটুকু বুঝতে দিতে চান না সোহেলকে। ‘এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে রানা কোথায় যাবে সেটা দেখার জন্য কাউকে অ্যাসাইন করেছ? তোমার কী মনে হয়, অফিসে আসবে ও, না বাসায় যাবে?’
‘স্যর, কোথায় বসে, কোথায় খায়, কোথায় ফোন করে, সব আপডেট পাব। মনে হচ্ছে অফিসে আসার সম্ভাবনাই বেশি, আর আমার ভয় এখানেই।
‘কেন? কোন বিপদের আশঙ্কা করছ?’
‘রানা বলেই সাবধান হতে চাইছি, স্যর। অফিসে এসেই আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইবে, তখন আপনি থাকবেন পুরোপুরি অরক্ষিত।’
সোহেলের ভয় অমূলক নয়। আট মাস মাসুদ রানার কোন খোঁজ ছিল না। ভারত মহাসাগরের ছোট্ট এক দ্বীপ লা অ্যানযো থেকে সেন্ট মেরি আইল্যাণ্ডে ফেরার পথে মোসাদের এক আততায়ীকে প্রতিহত করে রানা। কিন্তু সেন্ট মেরির জেটিতে ভেড়ার আগেই বিস্ফোরিত হয় ওদের ইয়ট জলকুমারী। প্রাতিষ্ঠানিক প্রটোকল সেরে কয়েকঘণ্টা লেগে যায় ডুবুরি নামাতে, যে-কারণে বোটে কারও মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। রানার হুট করে এভাবে মরে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। বেশিরভাগ স্পাই দুর্ঘটনাতেই মারা যায়, তবুও সহকর্মীদের অগাধ বিশ্বাস ও ভালবাসার টানে ওর অনুসন্ধানে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে বিসিআই এজেন্ট আর রানা এজেন্সির ছেলেরা। এমনকী জায়োনিস্ট ইন্টেলিজেন্সগুলোর ভেতরে লুকিয়ে থাকা সোর্সদেরও কাজে লাগান রাহাত খান। মনে আশা: যদি মোসাদের কোন গোপন আস্তানায় রানার বন্দি থাকার খবর মেলে! সেই আস্তানা আকাশ-পাতাল যেখানেই থাকুক, ওদের প্রিয় বন্ধু আর সহকর্মীকে ঠিকই উদ্ধার করে আনবে সোহেল এবং তাঁর অন্য ছেলেরা। কিন্তু না, আশার আলো নিভে যায় অচিরেই।
পুরো বিসিআই জুড়ে এতদিন বিরাজ করছিল এক শোক- শোক ভাব, আজ যখন হঠাৎ বিনা নোটিশে রানার ফেরার খবর পাওয়া গেছে, সবাই আবার প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একই সঙ্গে খারাপ আশঙ্কা করাও বুদ্ধিমানের কাজই হবে। হতে পারে রানা এই আট মাস মোসাদের কারাবন্দি ছিল, ওকে আবারও ব্রেইনওয়াশ করে বিসিআই বা দেশের কোন ক্ষতি করার জন্য ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। নাহলে, এতগুলো মাস চলে গেল, একবারও যোগাযোগ করতে পারল না ওর মত দায়িত্বশীল এক এজেণ্ট?
কিংবা প্লেনে ওঠার আগেও তো ইনফর্ম করতে পারত অফিসে বা রানা এজেন্সির নিকটস্থ শাখায়!
সোহেলের কথায় সায় দিলেন রাহাত খান। যদিও মনটা আনচান করছে তাঁর, রানাকে হঠাৎ করেই খুব ইচ্ছে করছে দেখতে!
‘তোমার কোন প্ল্যান আছে?’
পিঠ সোজা করে বসল সোহেল। বেশ সিরিয়াস কণ্ঠ ওর। ‘আছে, স্যর। রানা যদি স্বাভাবিক মস্তিষ্কে থাকে, তবে ও প্রটোকল বুঝবে। আমিই ওকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এক সপ্তাহ সময় নেব। এর মধ্যে টেক টিম আর সিকিউরিটি মিলে আপনার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে। তারপর আপনাদের সামনা-সামনি দেখা হলেও চিন্তা নেই।
বুক খাঁ-খাঁ করে উঠল মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের।
চচ এক সপ্তাহ! ছেলেটা তাঁর কাছাকাছি এসে ফিরে যাবে
আর তিনি এক সপ্তাহ অপেক্ষা করবেন, এটা কীভাবে সম্ভব?
তবুও শক্ত হতে হবে, সোহেলের পরিস্থিতি পর্যালোচনার উপর পূর্ণ আস্থা আছে তাঁর।
সোহেল বলে চলেছে, ‘আর যদি ওর এখনকার আচরণে সামান্যতম অস্বাভাবিকতা দেখি, তো অ্যারেস্ট করা ছাড়া আমি আর কোন পথ দেখি না। এমনটি হতে হলে আপনার অনুমতি দরকার হবে, স্যর।’
হঠাৎ প্রিয় পাইপের স্বাদ বিস্বাদ ঠেকল রাহাত খানের কাছে। সরিয়ে রাখলেন ওটা। ‘তুমি যা ভাল বোঝো, করো। আমি শুধু এক সপ্তাহ পর রানাকে আমার সামনে বহাল তবিয়তে দেখতে চাই।
ট্যাক্সি-ক্যাব থেকে মতিঝিলের সাত তলা অফিস ভবনের সামনে নামল মাসুদ রানা। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি চলে এসেছে। ভাড়া মেটানোর ফাঁকে একবার নজর বুলিয়ে দেখে নিল ওকে ফলো করে আসা গাড়িটাকে একটা এসইউভি, স্বাভাবিক গতিতে ওর বাহনটাকে পার করে সামনের মোড়ের দিকে চলে গেল।
মুচকি হাসল রানা। পুরো এক বছর পর দেশে ফিরেছে ও। আশপাশের সব দৃশ্য ঠিক যেন আগের মতই আছে। গ্রাউণ্ড ফ্লোরে ঢুকে মেইন লিফট দুটো পেছনে ফেলে বেশ অনেকটা সামনে এগিয়ে ডানদিকে মোড় নিল ও। এদিকটাতে কেউ আসে না। ভুল করে চলে এলেও দেখবে পরিত্যক্ত জং ধরা এক লিফট মুখ গোমড়া করে পড়ে আছে। ডানহাতের তালু ওটার পাশের দেয়ালের গায়ের ভাঙাচোরা অ্যাকসেস কন্ট্রোল ডিভাইসের সামনে নিতেই জং ধরা দরজার গায়ে দেখা গেল চার ইঞ্চির বর্গাকার একটা চকচকে স্ক্রিন। সেখানে ভার্চুয়াল কিবোর্ডে নিজের পাঁচ ডিজিটের পিন নম্বর চাপতেই খুলে গেল দরজাটা। অবশ্য এটা আসলে লিফট নয়, বরং স্ক্যানার। আরোহীর আপাদমস্তক ডিজিটালি পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে কিছুক্ষণ, যাতে কোন ক্ষতিকারক বস্তু বহন করলে ধরা পড়ে। দ্রুত ভেতরে ঢুকে পড়তেই লেগে গেল দরজা। ভেতরটা ঝকঝকে, তকতকে।
রানার আচরণে কোন জড়তা নেই। জানে, ইতোমধ্যে ওর ওপর কাজ শুরু করে দিয়েছে অদৃশ্য স্ক্যানারটা। যদিও ব্রিফকেসের ফস্ কম্পার্টমেন্টে প্রিয় ওয়ালথার পিপিকে ছাড়া আর কোন আগ্নেয়াস্ত্র নেই ওর কাছে। এ-ও জানে, ওর প্রতিটি পদক্ষেপ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সিসিটিভিতে দেখছে সোহেলসহ সিকিউরিটির লোকজন। অতএব, সাবধান! ভুল কোন আচরণ এখনই করা যাবে না!
স্ক্যানিং শেষ হতে উল্টোদিকে আরেকটা দরজা নিজ থেকেই খুলে গেল। রানা বেরিয়ে এল ফাঁকা এবং রেস্ট্রিক্টেড এক বেইসমেন্ট এরিয়ায়। এখানে আরেকটা লিফটে চেপে উঠে এল ছয় তলায়। ওর অফিসটা এই ফ্লোরেই।
লিফটের দরজা খুলে যেতে করিডোরে পা রাখল মাসুদ রানা। আর তারপরই আঁতকে উঠল। পুরো করিডোরে যেন চলে এসেছে বিসিআই! সোহেল, ইলোরা, রাশেদ, সলিল, জাহেদ, নীলা, টেক টিমের সদস্যরা, সিকিউরিটি চিফসহ সব্বাই। কিন্তু সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিই নেই-ওর বস্ রাহাত খান। সোহানা বা রূপাকেও দেখা যাচ্ছে না। নিশ্চয়ই কোন মিশন নিয়ে ব্যস্ত ওরা। বাদবাকি সবার শুভেচ্ছা আর আন্তরিকতায় সিক্ত হলো রানা। অনেকেই কাছে এসে জড়িয়ে ধরল ওকে, চোখে অশ্রু। মানুষগুলো যে কী প্রচণ্ডরকম মিস করেছে তাদের প্রিয় মানুষটাকে, এটা উপলব্ধি করে মনে মনে বলে উঠল রানা- ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক।’
সবশেষে সোহেল এগিয়ে এল, তারপর গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরল প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে। ভেজা কণ্ঠে বলল, ‘কোন্ চুলায় পড়ে ছিলি রে এতদিন, রানা?’
আবেগে কণ্ঠ বুজে এলেও নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করল রানা। কৌতুকের ছলে বলল, ‘দুলাভাইকে খুব মিস করেছিস, না রে? এখন ছাড় তো দেখি, এমনিতেই শুকিয়ে গিয়েছি, তুই আরেকটু চাপ দিলে মট্ করে ভেঙে যাব!’
ওকে আলিঙ্গনমুক্ত করে দু’হাত দূরে সরে গেল সোহেল। ভাল করে খেয়াল করল, সত্যিই অনেক রোগা হয়ে গেছে রানা। লম্বা হয়ে কাঁধ ছুঁই-ছুঁই করছে ওর চুলগুলো, তাতে চেহারাটা লম্বাটে দেখাচ্ছে।
সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষ করে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সোহেলের সঙ্গে নিজের অফিস-কামরায় ঢুকল রানা। সবকিছু পরিচ্ছন্ন দেখে অবাক হলো না। ও বেঁচে নেই, এ-কথা কেউই অন্তর থেকে মেনে নেয়নি। রিভলভিং চেয়ারটাতে গা এলিয়ে বসে সোহেলকে বলল, ‘বস্ কেমন আছে রে? বুড়ো আমাকে মনে রেখেছে তো? নাকি পত্রিকায় আমার অবিচুয়ারি পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে?’
বন্ধুর মন্তব্য শুনে খানিকটা আহত হয়েছে সোহেল। নরম সুরে বলল, ‘আমাদের সবার মাঝে উনিই তোকে সবচেয়ে বেশি মিস করেছেন। বস্ প্রকাশ করেন না, কিন্তু আমি জানি। আর আমিই ওঁকে নিষেধ করেছি তোর সঙ্গে এখনই দেখা করতে। বন্ধু-সহকর্মী হিসেবে আমরা প্রটোকল ভাঙতে পারি, কিন্তু তাঁকে সেটা করতে দিতে পারি না। তুই কোন খবর না দিয়ে আচমকা এসে হাজির, এ-পরিস্থিতিতে নিয়ম মেনে আমাদের সিকিউরিটি টিম তোকে কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করবে। শারীরিক ও মানসিক ইভালুয়েশন হবে, তারপর বসের সঙ্গে দেখা করতে পারবি। এর ব্যত্যয় ঘটালে ডিফেন্স মিনিস্ট্রির কাছে তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে। আশা করি, তুই কিছু মনে করবি না এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবি। কী বলিস, করবি তো?’
বন্ধু সোহেলের কথাগুলো কেমন যেন শেলের মত বুকে বিধল রানার। মাত্র বছরখানেকের অনুপস্থিতির কারণে কেমন অচেনা হয়ে গেছে ও এখানে। কিছুক্ষণ আগে করিডোরে সহকর্মীদের আন্তরিক রিসেপশন যেন বেমালুম ভুলে গেল। বুকে জায়গা করে নিল একরাশ অভিমান। ওরা তো তবে ঠিকই বলেছিল! মানুষের মূল্য কখন যে কমে যায়, কে তা বলতে পারে!
দীর্ঘ কয়েক সেকেণ্ড ফাঁকা দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সোহেলের মুখে, যেন অনেক দূরে চলে গেছে ওর মন। তারপর বলল, ‘নিশ্চয়ই। যা খুশি কর, নিজেকে তোদের হাতেই ছেড়ে দিলাম।’
.
পরদিন থেকেই শুরু হলো ক্লান্তিকর, টানা ফিজিকাল ইভালুয়েশন। ইন্টারনাল অর্গান টেস্টে শরীরের ভেতরে কোন বায়োলজিকাল অ্যানামোলি ধরা পড়েনি। এরপর জিম, সুইমিং, শুটিং। শরীরে এতদিনে কী পরিমাণ মরচে ধরেছে, এসব করতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেল মাসুদ রানা। বেশিক্ষণ দৌড়াতে পারে না, সুইমিং করতে গিয়ে এক শ’ মিটার পুলে দুই ল্যাপস পুরো করতেই যেন জান বেরিয়ে যায়। শুধু শুটিঙে দেখা গেল টার্গেটের খানিকটা কাছাকাছি যেতে পারছে। তবে আরও প্র্যাকটিস চালিয়ে যেতে হবে রেঞ্জে। এভাবেই চলল টানা তিন দিন। যে অবসাদ খুব দ্রুত পেয়ে বসছিল ওকে, আস্তে আস্তে কমে আসতে লাগল তা।
চা মাঝখানে একদিন বিরতি। ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের সঙ্গে গলফ কোর্সে খেলা, ক্লাবে জমজমাট আড্ডা, ডিনার-এভাবেই শেষ হলো দিনটা। এরই মধ্যে ফোনে সোহানা ও রূপার সঙ্গেও কথা হয়েছে। শুভেচ্ছা বিনিময় আর হাসি-ঠাট্টা শেষে জানিয়ে দিয়েছে শীঘ্রিই দেশে ফিরবে ওরা। তখন সামনা-সামনি আড্ডা হবে। ওরা তো আর জানে না যে, মাসুদ রানার সঙ্গে অচিরেই দেখা হচ্ছে না!
মাসুদ রানাকে অ্যারেস্ট করা হয়নি। যদিও নজরবন্দি অবস্থার মধ্যে রাখা হয়েছে। তাই নির্ধারিত কিছু জায়গা ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়ার উপায় নেই, আবার তেমন সময়ও পায় না। অফিস থেকে বাসায় ফোন করে রাঙার মাকে জানানো হয়েছে ওর সুস্থ থাকার কথা, যেন আর দুশ্চিন্তা না করে। রানা মনে মনে ভেবেছে, ওর বেঁচে ফেরার সংবাদ পেয়ে দিনভর মাতৃতুল্য মানুষটার মাজার থেকে মাজারে মানত পূরণে ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেছে নিশ্চয়ই।
চতুর্থ দিন শুরু হলো ওর মানসিক ইভালুয়েশন। মাঝারি আকৃতির কামরায় একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার। কোন ওয়ানওয়ে মিরর নেই, সাধারণত ইন্টারোগেশন রুমে যেমনটি থাকে। তবু রানা জানে, গোপন ক্যামেরায় অডিয়ো-ভিডিয়ো লাইভ ফিড এবং রেকর্ড দুটোই করা হবে। গভীর মনোযোগে লক্ষ্য করা হবে ওর প্রতিটি কথাবার্তা ও আচরণ। স্ক্রিনের সামনে থাকবে বিসিআই-এর চিফ সাইকিয়াট্রিস্ট এবং সোহেল আহমেদ। মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানও থাকতে পারেন।
কামরার ভেতরে ওর মুখোমুখি চেয়ারে বসা মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক। তিনি ইভালুয়েশন টিমের একজন সদস্য, পরনে সাদা ল্যাব অ্যাপ্রন। এটা পরার কী যৌক্তিকতা থাকতে পারে তা রানার বোধগম্য নয়। তবে পরিবেশটাকে ভারী বা সিরিয়াস করার এটা একটা প্রচেষ্টা হতে পারে। শুরু হলো ছোট ছোট বোর্ডে আঁকা বিভিন্ন সাইন বা বিমূর্ত ছবি দিয়ে। ওগুলো দেখে তাৎক্ষণিকভাবে মনে যে চিন্তা বা শব্দটা আসে, সেটাই জানাতে হবে ওর। উত্তর কিংবা বিরতি থেকে মানসিক অবস্থার উপসংহার টানা হবে বিশেষজ্ঞের প্রতিবেদনে।
সাঙ্কেতিক প্রতিকৃতির পরীক্ষা শেষে এল প্রশ্নোত্তর পর্ব। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সবাই কিছু প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য, ওর মুখ থেকেই। প্রথমেই সরল একটা প্রশ্ন: ‘দীর্ঘ আট মাস কোথায় ছিলেন?’
এই এক প্রশ্নের উত্তরে যুক্ত হতে পারে সকল প্রশ্নের জবাব, যদি রানা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে। কিন্তু ওর উত্তরও হলো সংক্ষিপ্ত: ‘সিসিলি, আল্টামোর্টে।’
এত টু দ্য পয়েন্ট জবাব আশা করেননি প্রশ্নকর্তা। তাই খুকখুক করে একটু কেশে আবার জানতে চাইলেন, ‘ভারত মহাসাগর থেকে ছয় হাজার কিলোমিটার দূরের এক ছোট্ট দ্বীপে কীভাবে গেলেন, কী করছিলেন, একটু বিস্তারিত বলবেন কি, মি. রানা?’
‘আমার জানা নেই। আমি আমাদের ইয়ট জলকুমারীর ডেকে ছিলাম। রেলিং ঘেঁষে কোন একটা কাজ করছিলাম দড়িদড়া নিয়ে। তারপর হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল বোট। আমি ছিটকে গিয়ে পড়লাম পানিতে। তারপর আর কিছু মনে নেই। এব্যাপারে সঠিক তথ্য দিয়ে আপনাদেরকে সাহায্য করতে পারেন স্থানীয় পাদ্রী এবং ডাক্তার মি. অ্যাঞ্জেলো। ডাক্তার আমাকে বলেছিলেন, কনভেণ্ট নানদের একটা গ্রুপ আমাকে ওঁর কেয়ারে রেখে যান।’
হালকা চুলে ছাওয়া মাথাটা একটু চুলকে নিলেন সাইকিয়াট্রিস্ট। বললেন, ‘জলকুমারীর ঘটনাটা থেকে আপনার ডাক্তার অ্যাঞ্জেলোর কেয়ারে আসা পর্যন্ত সময়কালটা বলতে পারবেন? মানে, কনভেন্ট নানদের কাছে কতদিন ছিলেন সেটা কি মনে আছে?’
চেহারায় কোন অস্থিরতা ফুটতে দিল না রানা। যদিও সাদা রঙের এই ঘরটাতে ওর আর একটুও থাকতে ইচ্ছে করছে না। সম্ভব হলে ছুটে বেরিয়ে যেত। কী যেন একটা দৃশ্য ধরা দিতে চাইছে মনের পর্দায়। কিন্তু তা না করে বাড়িয়ে দিচ্ছে মাথার যন্ত্রণা। বমি করতে পারলে ভাল লাগত। তবুও শান্ত ভঙ্গিতেই বলল, ‘ইতালীয় নানদের গ্রুপটা সোমালিয়াতে একটা হিউম্যানিটারিয়ান মিশনে ছিল, সেখান থেকে সিসিলিতে ফিরে আসে জাহাজে করে। আহত এবং অজ্ঞাত হিসেবে ওঁদের দলে আমাকে নিয়ে থাকতে পারেন। এই অধ্যায়টা আমার কাছে টোটালি ব্ল্যাঙ্ক। সময় সম্পর্কেও ধারণা নেই। ডা. অ্যাঞ্জেলোর হিসেবে চার মাস ছিলাম আমি তাঁর কাছে।’
এরপর আরও কিছুক্ষণ চলল এলোমেলো ইন্টারোগেশন। এই প্রশ্নগুলোর সময় রানার মেজাজ-মর্জি, চোখ-মুখ-ঠোঁট- হাতের নড়াচড়া, কণ্ঠের ওঠা-নামা, হাসি, ভুরু কোঁচকানো- এসবই নোট করা হয়েছে বিহেভেরিয়াল অ্যাসেসমেন্টের জন্য।
অবশেষে একসময় থামল কষ্টকর জিজ্ঞাসাবাদ। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল রানা। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, ‘দু’ঘণ্টা বিরতির পর আবার আরেকটা টিম বসবে আপনার সঙ্গে, মি. রানা। ততক্ষণ খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে নিন।’
মনে মনে গুঙিয়ে উঠল মাসুদ রানা।
আবারও!
একই প্রশ্ন বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে করবে লোকগুলো, ওর উত্তর আর আচরণের মধ্যে খুঁজবে সঙ্গতি-অসঙ্গতি, সেই সঙ্গে চলবে ফ্যাক্টস্ চেক। মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিল ও, ‘আর একটা দিন দাঁতে দাঁত চেপে থাক, ব্যাটা! আর তারপর তো শেষ হবে তোর মিশন!’
আজ সকাল থেকেই বিসিআই অফিসে উত্তেজনার পারদ চলে গেছে চরমে। মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে এমআরনাইন-এর। সমস্ত প্রস্তুতি নেয়া শেষ। সবচেয়ে বেশি টেনশনে আছে চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর সোহেল আহমেদ। ওর পক্ষে যতটুকু নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব, সেটা করেছে। টেক আর সিকিউরিটি টিম দু’দলই তৈরি। মাসুদ রানার ইভালুয়েশন ঠিকঠাক মতই হয়েছে। সাইকিয়াট্রিস্টের রিপোর্ট মোটামুটি ভাল। অবশ্য আরও অবজার্ভেশনের পক্ষে তারা। ধীরে ধীরে নিজেকে ফিরে পাচ্ছে রানা, এটা ভাল লক্ষণ। কিন্তু সোহেলকে ভোগাচ্ছে রানার ব্যাকস্টোরিটা। ওরা চেক করে দেখেছে, আল্টামোর্টের ড. অ্যাঞ্জেলোর কেয়ারে থাকা কিংবা কনভেন্ট নানদের ঘটনাটা সত্যি হলেও নানদের ওই গ্রুপ কোন অ্যামনেশিয়ার রোগী বা আহত ব্যক্তিকে নিজেদের জাহাজে তুলে নিয়েছে, এমন কোন তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি। তাছাড়া, অজ্ঞাত একজন ব্যক্তিকে নিয়ে তারা সিসিলির কাস্টম্স পার হলো কীভাবে? তা-ও গোপনে! ঈশ্বরের একনিষ্ঠ সেবকেরা আইনবিরোধী কাজ করবে? এটাই খোঁচাচ্ছে সোহেলকে। কোথাও বড় কোন ফাঁকি আছে, কিন্তু ওর হাতে এমন যথেষ্ট তথ্য নেই, সেটা চ্যালেঞ্জ করা যাবে।
আবার অবাক বিষয় হচ্ছে, আল্টামোর্টের পুলিশ রীতিমত মাসুদ রানার ভক্ত। রানা অ্যামনেশিয়া থেকে ধীরে ধীরে রিকভার করার পর নিজের পরিচয় জানায় ডাক্তারকে। তিনি জানান পুলিশকে। পুলিশ মেইনল্যাণ্ডে খোঁজখবর করে নিশ্চিত হয়, একমাত্র সূত্র পালের্মোর রানা এজেন্সির শাখা থেকে। পরে ওখানকার শাখাপ্রধান আরমানের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে রানার। ঢাকার অফিসে কিছু না জানানোর সিদ্ধান্ত ছিল রানারই। আর সেটা সোহেলকে নিশ্চিত করেছে আরমান। একদিক দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল এটা। তখনও শারীরিকভাবে দুর্বল রানা যে-কোন সময়ে আবারও আক্রান্ত হতে পারত। সুতরাং, গোপনীয়তার দরকার ছিল। এর মধ্যেই কয়েকটা কেসে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে আর তথ্য শেয়ার করেছে রানা; আর তাতে ওর সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছে স্থানীয় পুলিশের।
এখন, এই মুহূর্তে স্ক্রিনের সামনে বসে আছে সোহেল। মনিটরে দেখছে লিফটে উঠছে মাসুদ রানা। ছয় তলায় নেমে সিঁড়ি বেয়ে গিয়ে ঢুকবে সাত তলায় বসের অফিসে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে।
স্ক্যানার বলছে, ওয়ালখার পিপিকে বহন করছে এমআরনাইন। বিসিআই-এর হাইলি প্রিভিলেজড এজেন্টদের একজন ও, যারা অফিসের ভেতরে স্মল আর্মস বহন করতে পারে। যেহেতু ও সন্দেহভাজন বা অ্যারেস্টেড নয়, সুতরাং অন্য এজেন্টদের মত ওকেও পিস্তল সঙ্গে রাখতে দিতে হবে। সোহেল চায়নি, কিন্তু বস্ এমআরনাইন-এর মনে কোন হীনম্মন্যতা কাজ করুক, এটা চাননি। ও নিজেও রানার সঙ্গে কামরার ভেতরে থাকতে চেয়েছিল, বস্ এককথায় নাকচ করে দিয়েছেন। দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন, ‘তোমার যা প্রস্তুতি নেয়ার, সেটা নিয়েছ, সোহেল। নাউ, লেট হিম কাম টু মি।’
এখন ভালয় ভালয় প্রথম পর্ব শেষ হলেই বাঁচোয়া।
রানা, ভাই আমার, কোন ঝামেলা পাকাসনে দয়া করে। মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়াও বাদ দিচ্ছে না সোহেল।
ছয় তলায় লিফট থেকে নেমে বিশাল ওঅর্কস্পেসটা পার হচ্ছে মাসুদ রানা। প্রায় প্রতিটি ডেস্ক থেকে সরাসরি বা আড়চোখে ওকে দেখছে সহকর্মীরা। জায়গাটা পেরিয়ে সিঁড়ি রেয়ে সাত তলায় উঠে এল রানা। সামনেই ইলোরার অফিস। হাসিমুখে ওকে স্বাগত জানাল বসের সেক্রেটারি।
‘ভেতরে যেতে পারো, রানা। স্যর তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।’
মৃদু হাসল রানা। ‘ধন্যবাদ, ইলোরা। এটা আমার জন্য একটা গোল্ডেন মোমেন্ট।’
মাথা নাড়ল ইলোরা। ‘আমি জানি। তোমরা দু’জনেই আজকের জন্য অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করেছ। সো, গেট ইন, প্রিয়!’
‘বি আ ডিয়ার, ইলোরা। বস্ না ডাকলে কাউকে ঢুকতে দিয়ো না ভেতরে।’
দরজায় নক করে ঢুকে পড়ল রানা বসের কামরায়। অবাক হলো না যে, আজ ঘামছে না ওর হাতের তালু, গলাও শুকায়নি। শুধু একটু নার্ভাস লাগছে, ওয়ালথারটা যথাসময়ে কাজ করলেই হয়!
রাহাত খান চিরচেনা ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন জানালার সামনে, হাতে সেই বিখ্যাত পাইপ। যখন ঘুরে দাঁড়ালেন, চকিতে স্নেহের একটা ছায়া দেখা গেল তাঁর চোখেমুখে। এরপর আবার ফিরে এল স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য। কিন্তু গভীর কণ্ঠস্বরে আবেগটুকু লুকানো কঠিন হলো: ‘কেমন আছ, রানা?’
একটু কি কেঁপে গেল গলার স্বর?
রানা কি বুঝতে পারছে কী অধীর আগ্রহে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরতে চাইছেন তিনি?
নিজেকে সামলে নিলেন রাহাত খান। ‘বসো, রানা। তারপর, বলো কী বলবে। ওদেরকে যা বলোনি, সেটা দিয়েই শুরু করো।’
বুড়ো এখনও কত শার্প। ঠিকই ধরে ফেলেছে!
অবশ্য এমন ধারালো না হলে বাঘা বাঘা প্রতিপক্ষকে বুদ্ধির লড়াইয়ে ঘায়েল করতে পারতেন না তিনি।
‘আপনার শরীরটা বোধহয় ভাল যাচ্ছে না, স্যর?’
নিজের চেয়ারে বসে পড়লেন রাহাত খান। রানাকে হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিলেন সামনের চেয়ার। ‘আমি ঠিকই আছি। তা তুমি কেমন বোধ করছ? আমরা যখন সবকিছু গুছিয়ে এনেছি, এমন সময় তোমার সঙ্গে যা ঘটল, সেটা সবার কল্পনার বাইরে ছিল। তোমাকে খুঁজে পেতে যথেষ্ট দক্ষতা আমরা দেখাতে পারিনি, এজন্য আমি সত্যিই দুঃখিত।’
বুড়ো বলে কী! পাশের কামরা থেকে হেডফোনে ওদের কথোপকথন শুনছে সোহেল। রাহাত খানের দুঃখ প্রকাশ চমকে দিয়েছে ওকে।
চেয়ারে বসে মৃদু হাসল রানা। ‘আপনি ঠিকই ধরেছেন, স্যর। বিসিআই খুঁজে না পেলেও ওরা কিন্তু ঠিকই আমাকে নতুন জীবন দান করেছে। হ্যাঁ, মোসাদের কথাই বলছি। চিকিৎসা, সেবা-যত্ন করা, বলতে পারেন দারুণ খাতির- আপ্যায়ন করেছে। নইলে অমন এক ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের পর আমার বেঁচে থাকারই তো কথা নয়! আমার সঙ্গী রডরিক তো মারাই গেল। উঁচু থেকে ছিটকে পানিতে পড়ার সময় মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছি, যেটা মাঝে-মধ্যে এখনও বাড়ে। কয়েকমাস কিছুই মনে ছিল না। এমনকী নামটাও নয়। মোসাদের সেই দয়ালু ডিটিএমটাই আমাকে শত্রুপক্ষের লোক জেনেও প্রাণে বাঁচিয়েছে, পরিচয় জানিয়েছে। ওদের সযত্ন সেবায় আমার স্মৃতি ফিরতে শুরু করে। এর মধ্যেই বিশ্বরাজনীতির মুখোশ খুলে দিচ্ছিল ওরা আমাকে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে। আশ্চর্য, ওদের আমরা অত্যাচারী ভাবি, অথচ ওরাই ভিকটিম, স্যর! ফেরাউনের শোষণ থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের হলোকাস্ট ওদেরকে পৌঁছে দিয়েছিল ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আরব-বিশ্ব দিয়ে ঘেরা ইসরাইলের অবশ্যই অধিকার আছে নিজেকে ডিফেও করার। আর কে না জানে, যুদ্ধের সময় এক-আধটু লাগামহীন হত্যাকাণ্ড তো সব পক্ষই করে!’
একটানা কথা বলে থামল রানা। হেডফোনে শুনে সোহেলের চোখ বিস্ফারিত। মোসাদের এক নম্বর শত্রু এসব কথা কীভাবে বলছে! মনে হচ্ছে মার্কিন সিনেট মিটিঙে জায়োনিযমের পক্ষে বক্তৃতা দিয়ে চলেছে কোন কট্টরপন্থী সিনেটর। এক্ষুণি ছুটে কামরায় ঢুকতে ইচ্ছে করছে সোহেলের। মনে হচ্ছে বসের সামনে সমূহ বিপদ! কিন্তু কী মনে হতে থমকে গেল।
ওদিকে রাহাত খান ভেতরে ভেতরে চমকে গেলেও বাইরে থেকে তাঁর বিচলিত ভাব বোঝা গেল না। ছেলেটার ওপর দিয়ে গত আট মাস কী মানসিক অত্যাচার চালিয়ে গেছে মোসাদ, সেটা বোঝার চেষ্টা করে শিউরে উঠলেন তিনি। শান্ত স্বরেই বললেন, ‘তাহলে ইসরাইলি সামরিক শক্তির সমস্ত কর্মকাণ্ড তোমার কাছে যৌক্তিক মনে হচ্ছে, কারণ ওরা তোমার প্রাণ বাঁচিয়ে দিয়েছে? ওদের পাতা বোমাতেই কিন্তু তুমি গুরুতর আহত হয়েছিলে।’
রানার কণ্ঠস্বর আরেকটু জোরালো হলো। ‘হ্যাঁ, তখন আমাকে শত্রুজ্ঞান করত, অপমানের মৃত্যু দিতে চাইত। কিন্তু পরে ভুল বুঝতে পেরে আমাকে সেবা-যত্ন করে নিজেদের সৎ উদ্দেশ্য প্রমাণ করেছে ওরা। আসলে ওরা শান্তি চায়, আরব- বিশ্ব যেন মিত্রশক্তিতে পরিণত হয়, সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে ইসরাইল। আর ওদের ভিশনকে আমি সমর্থন করি।’
চেয়ারে একটু নড়েচড়ে বসে হাতের পাইপে টান দিলেন রাহাত খান। তবে ওটা থেকে এখন আর কোন ধোঁয়া বের হচ্ছে না। পাইপ নিভে গেছে সেদিকে খেয়াল নেই। নরম সুরে বললেন, ‘তাহলে ফিরে এলে কেন, রানা? ওদের শান্তির পক্ষে কাজ করবে যখন, তখন ওখানেই তো থেকে যেতে পারতে।’
ভুরু কোঁচকাল মাসুদ রানা। কিছু একটা মস্তিষ্কে ধরা দিতে চাইছে। কিন্তু ধরতে পারছে না। ধীরে ধীরে পিঠ সোজা করে বসে বলতে লাগল রানা, ‘আমি ফিরেছি, কারণ তেলআবিবের বাইরে থেকে শান্তির স্বপক্ষে কাজ করাটা আমার জন্য বেশি সহজ। ওরা আমাকে শান্তিবিরোধী কিছু লোকের তালিকা দিয়েছে, যাদের কূট-পরিকল্পনার কারণে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে ইসরাইলের। এদেরকে সবার আগে দুনিয়া থেকে সরাতে হবে, আর তালিকার প্রথম নামটাই আপনার…’ বসা থেকে চট্ করে উঠে দাঁড়াল রানা, ঝটকা দিয়ে হোলস্টার থেকে বের করে এনেছে ওয়ালথার পিপিকে।
হতভম্ব আর বিমূঢ় রাহাত খানকে কথা বলার কোন সুযোগ না দিয়েই পরপর তিনবার ট্রিগার চাপল রানা। বসের বুকের বাঁ পাশে ক্ষতস্থান থেকে গলগল করে বেরিয়ে এল রক্ত। একবার কেঁপে উঠেই থেমে গেলেন বিসিআই কর্ণধার। হাত থেকে মেঝের কার্পেটে পড়ে গেছে প্রিয় পাইপটা।
দৃশ্যটা দেখে এবার নিজেই ধাক্কা খেল রানা। এটা কী করল ও? এ-ও কি সম্ভব? কী করে পারল বাবার মত…
হঠাৎ চোখের সামনে একগাদা আকৃতি ফুটতে দেখল রানা। পুরনো টিভিতে চ্যানেল ধরতে গেলে দৃশ্য যেমন বেঁকেচুরে যেত, সেরকমই কিছু ভাসছে মাথার মধ্যে। তারপর শুরু হলো প্রচণ্ড মাথা-ব্যথা। ও যখনই নিজের মধ্যে প্রতিরোধ গড়তে যায়, তখনই চলে আসে ব্যথাটা। হড়হড় করে শুরু করল বমি। ওটার দমক শেষ হতে বড় করে একটা শ্বাস নেবার চেষ্টা করল, তারপর জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল ফ্লোরে। জ্ঞান হারানোর আগে যদি খেয়াল করার মত অবস্থা থাকত ওর, তা হলে দেখতে পেত: ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে ওর চারপাশের সবকিছু। রাহাত খানের মৃত শরীর, পাইপ, চেয়ার-সবকিছু বিলীন হয়ে গেল শূন্যে!
.
রিক্লাইনার চেয়ারে আধশোয়া প্রাণপ্রিয় এজেন্টকে ছটফট করতে দেখে ওয়ানওয়ে মিররের ওপাশ থেকে ভীষণ বিচলিত বোধ করছেন রাহাত খান। তা দেখে তাঁর কাঁধে একটা হাত রাখলেন বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট ও বন্ধু প্রফেসর শমসের। দেখতে পাচ্ছেন রানাকে একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে কসরৎ করছে একজন ডাক্তার। অন্য একজন ওর চোখের ওপর থেকে খুলে নিল বিশেষভাবে তৈরি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হেডসেট।
সোহেল আহমেদকে কাছেই দেখতে পেয়ে ওর পিঠ চাপড়ে দিলেন প্রফেসর। দেবেনই তো, কারণ বুদ্ধিটা তো ওরই। বাইরের জগতে অগমেন্টেড রিয়েলিটি প্রযুক্তি এখনও অবধি ‘শৈশব’ পর্যায়ে থাকলেও বিসিআই-এর টেক ডিটিএম এক্ষেত্রে আশ্চর্য আর অভূতপূর্ব ‘তারুণ্য’ ঘটিয়ে ফেলেছে। সোহেল প্রথমে টেক ডিটিএমকে চ্যালেঞ্জ দেয়, যেন কৃত্রিম বাস্তবতার মধ্যে ফেলে রানার ভেতরের দমে থাকা পরিকল্পনাটাকে বের করে আনা যায়। ওখানে থাকে এমন এক রিয়েলিটি, যেখানে রানা ভাববে সবকিছু বাস্তবে ঘটছে। আধো ঘুম আধো জাগরণে ও বুঝবেই না বাস্তবতা- পরাবাস্তবতার ফারাক। কিন্তু জেনেশুনে এ-ফাঁদে পা দেবে কেন এমআরনাইন? এই সমস্যা দূর করেন প্রফেসর শমসের তাঁর সম্মোহন বিদ্যার মাধ্যমে। তার আগে এক সিটিঙে রানাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সম্মোহিত হতে রাজি করান তিনি।
সোহেলের কাঁধে আরেকবার স্নেহের মৃদু একটা চাপড় দিয়ে বন্ধু রাহাতের দিকে তাকালেন প্রফেসর। ‘তুমি কিছু সোনার টুকরো ছেলে পেয়েছ, খান। এভাবে যে একটা প্ল্যান একযিকিউট করা যায়, তা আমার চিন্তার অতীত ছিল। সিনেমাকেও হার মানায়। আর রানার কথা কী বলব, হি হ্যায আ ভেরি স্ট্রং মাইও। আমি এমনটা আগে কখনও দেখিনি। অবচেতন মনে যতই ঘৃণা ঢুকিয়ে দিয়ে থাকুক ওরা, সচেতন অবস্থায় কখনও ও তোমাকে গুলি করবে না। অস্থিরতা, খিঁচুনি, বমি করা-এগুলো ওর চরম অন্তর্দ্বন্দ্বেরই প্রতিক্রিয়া।
‘কংগ্রাচুলেশন্স, মাই বয়!’ নিজের খোলস থেকে বেরিয়ে সোহেলের মাথায় হাত বোলালেন রাহাত খান। স্যরের আদরের হাত নিজের মাথায় দেখে লজ্জা আর আবেগে শরীরটা যেন গুটিয়ে গেল সোহেলের। ‘রানাকে স্যাংচুয়ারিতে নেয়ার ব্যবস্থা করো, কিছুদিন ওখানেই থাকুক সেবা-যত্ন আর মেডিটেশনে। তবে এই ঘরের বাইরের কেউ যেন কিছু না জানে।’
এতক্ষণ ওঁদের সঙ্গে ঘরেই ছিলেন সিকিউরিটি চিফ কর্নেল জামিল। এবার মুখ খুললেন, ‘কিন্তু, স্যর, এটা তো অ্যাটেম্প্টেড মার্ডার আর ট্রিন, হোক না ডিজিটাল কিছু। কোর্ট মার্শাল…’
তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন রাহাত খান। ‘রানা এখনও কোন অপরাধ করেনি, করলে আমরা করেছি ওকে নিয়ে। কিছুক্ষণ আগে যা ঘটল, তা আসলে ঘটেইনি! তাছাড়া, ও অসুস্থ, ওর এখন সুচিকিৎসা আর প্রচুর বিশ্রাম দরকার।’
পিছিয়ে গেলেন কর্নেল জামিল। ‘ইউ আর রাইট, স্যর। আই এগ্রি।
ঘাড় ঘুরিয়ে বন্ধুর দিকে তাকালেন রাহাত খান। ‘তোমার আরও সাহায্য প্রয়োজন পড়বে ওর, প্রফেসর। এই মুহূর্তে কোন সাজেশন দিতে চাও?’
মাথা নাড়লেন প্রফেসর। ‘ওর জন্য সবসময় আমাকে পাশে পাবে। আর পরামর্শ যদি চাও তো বলব, ওকে কিন্তু বসিয়ে রাখলে হবে না, খান। অলস মস্তিষ্ক ভয়ঙ্কর জিনিস। তাই দু’এক সপ্তাহ রেস্টের পর, যে কাজটা রানা ভাল পারে সেই কাজেই ওকে ব্যস্ত রাখতে হবে। যদিও ওকে তুমি ফিল্ডে পাঠাতে পারবে না। সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতে হবে। পারবে ওর জন্য এমন কিছুর ব্যবস্থা করে দিতে?
হঠাৎ তাঁর চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের চোখেমুখে কীসের যেন খেলা দেখতে পেলেন রাহাত খান। তিনি বুঝতে পারলেন সোহেলের মাথায় আবারও চট্ করে কিছু উদয় হয়েছে। উৎসাহ দিলেন তিনি, ‘বলে ফেলো, সোহেল।’
‘ডিউক, স্যর। রানাকে ডিউক হিসেবে রাস্তায় ছেড়ে দিই। প্র্যাকটিসে থাকলে নিজের শক্তি আর দক্ষতা দুটোই ফিরে পাবে। সবচেয়ে বড় কথা, চব্বিশ ঘণ্টা ওকে আমরা চোখে চোখে রাখতে পারব। কোন বিপদ ঘনিয়ে এলে আমরাই ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে সাহায্য করব। আর ডিউক যখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে, তখন ওকে আমরা ইউনিট-এক্স সিণ্ডিকেটের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেব। আপনি তো জানেন, স্যর, পুলিশ ওদের ধরতে কেমন হিমশিম খাচ্ছে। আণ্ডারগ্রাউণ্ডে ডিউকের সাহায্যে আমরা ওদের ওপরে চরম আঘাত হানতে পারব।’
কিছুক্ষণের জন্য গভীর ভাবনায় ডুবে গেলেন রাহাত খান। তারপর মুখ তুলে বললেন, ‘ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া, সোহেল। তবে ধীরেসুস্থে। ইউনিট-এক্সকে নিশ্চিহ্ন করার যথেষ্ট সময় পাব আমরা। এর মধ্যে ডিউক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে রানাকে। ততদিন আমাদেরকে ওর ছায়া হয়ে থাকতে হবে। সো, ইনিশিয়েট দ্য প্রোগ্রাম, লেট ডিউক বি বর্ন এগেইন!’
‘আমার একমাত্র মেয়েটাকে ওরা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে, ডিউক। আপনার সাহায্য ছাড়া ওকে ফিরে পাবার কোন উপায় নেই। আমি আপনাকে ব্ল্যাঙ্ক চেক দিতেও রাজি আছি।’
টকটকে লাল আর অনিদ্রায় ভারী চোখ নিয়ে কথাগুলো বললেন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী টাকার কুমীর জনাব আদনান সিরাজ। অনেক কষ্টে লোকজন ধরাধরি করে পেয়েছেন ডিউকের খোঁজ। গুরুত্বহীন মানুষ বলে মনে করে তাঁর কাজ নেবে কি না যুবক, এখন এই ভয়ে আছেন। তিনি নিজেও দুধে ধোয়া তুলসী পাতা নন, সম্পদের পাহাড় টিকিয়ে রাখতে তাঁকেও বহু পাপ কাজ করতে হয়। একদল মস্তান যদি তাঁর মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যেত, তো ওদের দফারফা করে দিতেন তিনি। কিন্তু একজন পাওয়ারফুল মন্ত্রীর পুত্র যেহেতু ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে ড্রাগস, সেক্স আর অ্যাডভেঞ্চারের লোভ দেখিয়ে, সেহেতু তাঁর পক্ষে কিছু করা হয়ে উঠেছে রীতিমত অসম্ভব। কিন্তু অজ্ঞাত এবং বুদ্ধিমান একজন ক্রিমিনাল হয়তো সহজেই লম্পট যুবকের খপ্পর থেকে তাঁর মেয়েটাকে বের করে আনতে পারবে।
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সামনের লোকটাকে মাপছে ডিউক। ভাল ক্লায়েন্ট তাতে সন্দেহ নেই, কাজটাও খুব জটিল কিছু নয়। সমস্যা হচ্ছে শুধু একটাই, হারামি যুবক আবার নামকরা মন্ত্রীর ছেলে!
‘আপনি আসলে কী চান, মি. সিরাজ? এরকম এক চুক্তি করতে চাইছেন পাবলিক প্লেসে, আপনার নাম প্রকাশ পেলে তো মহাবিপদে পড়বেন।
‘নোবডি কেয়ার্স,’ বললেন আদনান সিরাজ। ‘এইরকম ক্লাব সব সুখের সমুদ্র, সবাই আনন্দ-বিনোদনে হাবুডুবু খেতে আসে, দুঃখ ভুলতে আসে। অন্যের দুঃখে কান পাতার ফুরসৎ নেই কারও।’
‘ইউ আর সো রং,’ মনে মনে বলল ডিউক। যাদের অ পাতার দরকার, তারা ঠিকই তা করে।
‘আমার যে মোবাইল নাম্বার দেয়া আছে, ওটায় একবারই কল দেয়ার সুযোগ পাবেন। সময় নিয়ে ভাবুন, তারপর আমাকে জানাবেন কী রেযাল্ট চান। আমিও তখন জানিয়ে দেব কত টাকা কীভাবে পাঠাতে হবে। মনে রাখবেন, মুড না এলে কাজ আমি না-ও করতে পারি। সেক্ষেত্রে আপনার অর্ধেক টাকা কিন্তু পানিতে যাবে।’
কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াল ডিউক। আদনান সিরাজও দাঁড়ালেন, একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন হ্যাণ্ডশেক করার জন্য। নিচু গলায় বললেন, ‘অনেকেই বলেন আপনার ভেতরে রবিন হুডের আত্মা বাস করে। আমার অল্পবয়সী মেয়েটাকে আপনি বাঁচাবেন বলেই আমি বিশ্বাস করি…’
ভদ্রলোকের বাড়িয়ে দেয়া হাত এড়িয়ে গিয়ে পাশ কাটিয়ে এগোল ডিউক। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল অবজ্ঞা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু একযিট ডোরের কাছে যাবার আগেই আবার ওকে আটকাল সেই কালো চশমা পরা সিকিউরিটি অফিসার। আচ্ছা, এরকম কোমল আলোয় গাঢ় রঙের চশমা পরে দেখতে অসুবিধা হয় না লোকটার?-ভাবল ডিউক।
এবার স্যুটের সামনের দিকটা সামান্য সরিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রটা দেখাল লোকটা। তারপর পকেটে হাত ঢোকাল…
মুচকি হাসল ডিউক। ‘বুঝলে, ভায়া, নিজের মর্জিমত চলে ডিউক। তোমার বসকে আরও ক’দিন অপেক্ষা করতে হবে। চাইলে সিরিয়াল নিতে পারো। আর যদি এতসব এলিট মানুষের ভিড়ে গোলাগুলির ইচ্ছে থাকে, তবে চলো, শুরু করা যাক!’
পকেট থেকে একটা মোবাইল বের করে আনল কালো চশমা। স্ক্রিনটা ওর চোখের সামনে ধরল সে। তাতে একটা মেসেজ শো করছে: ‘প্লিয! আপনি আফসোস করবেন না।
একটু চিন্তা করল ডিউক। এই মেসেজ পাবার পরেও প্রত্যাখ্যান করলে ওকে হয়তো এই ক্লাবেই অবাঞ্ছিত ঘোষণা করবে কর্তৃপক্ষ। এমনটি হলে বিজনেসের জন্য খারাপ। তাই মেসেজের ভাষাটা ওকে সন্তুষ্ট করেছে এমন ভাব দেখিয়ে বলল ও, ‘ঠিক আছে, চলো দেখি, কী আছে তোমার কর্তার মনে।’
ক্লাবের মেইন হলরুম থেকে বেরিয়ে পেছনদিকে এল ওরা। ওদিকটাতে ব্যারিকেড দেয়া এক অংশে সশস্ত্র দু’জন স্বাস্থ্যবান গার্ড দায়িত্বরত। কালো চশমাকে দেখে সসম্মানে ব্যারিকেড তুলে দিল তারা। তবে ডিউককে থামাল বডি সার্চ করবে বলে। কোন হ্যাণ্ডগান বহন করছে না ও, তবে সুইস আর্মি নাইফ আছে। ওটাকে কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে ফেরত দিল গার্ড। এরপর বিনা বাধায় লিফটে উঠল ডিউক আর কালো চশমা। ওপরের তলায় উঠে বেরিয়ে এল লিফট থেকে।
নিচের শশব্যস্ত জগৎ থেকে এই জায়গা একেবারেই আলাদা। দশ সেকেণ্ড স্থির দাঁড়িয়ে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল ডিউক। আলো ঝলমলে উজ্জ্বল পরিবেশে বিশাল ফ্লোরের মেঝেতে গোড়ালি ডোবা পুরু কার্পেট, ক্রিম কালারের সুদৃশ্য সোফা, সেখানে বসে আড্ডা দিচ্ছে কয়েকজন দেশি-বিদেশি নারী-পুরুষ। আফ্রিকান ব্ল্যাকউডের তৈরি চওড়া সারফেসের চকচকে পালিশ করা বার কাউন্টার, দেয়ালে তাকে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন ব্র্যাণ্ডের পানীয়ভর্তি বোতল। কাউন্টারে সাদা স্যুট পরা হালকা-পাতলা কিন্তু বেশ লম্বা এক বিদেশির সঙ্গে বাংলাদেশি এক সুন্দরীর হাসি-ঠাট্টা চলছে। মেয়েটা যে সেলেব্রিটি সেটা একনজর দেখেই বুঝল ডিউক। সময়-অসময়ে ঢাকার পথে পথে পোস্টারে এই চাঁদমুখ কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার ওয়ালে প্রায়ই দেখা যায় স্বল্পবসনা এই মেয়েকে।
ফ্লোরে ওর উপস্থিতি টের পেয়ে থেমে গেল সবার আলাপ। ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে সবাই। তবে সেলেব্রিটি ঘুরে গেল ওর দিকে পিঠ দিয়ে। অচেনা আর লোকাল কাউকে হয়তো পাত্তা দেয়ার ইচ্ছে নেই। সাদা স্যুট পরা লম্বা ভদ্রলোক সহাস্যে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এল কাছে। ‘দ্য গ্রেট ডিউক অভ ঢাকা, ওয়েলকাম, স্যর। আমার নাম গিলেরমো মোজি। এই ক্লাবের একজন সামান্য পৃষ্ঠপোষক। আপনি আসায় আমি খুবই সম্মানিত বোধ করছি।
… হাসিখুশি ইটালিয়ানের হাতটা ধরে একটু ঝাঁকাল ডিউক। ধন্যবাদের ধারেকাছেও গেল না ও। রসকহীন কণ্ঠে বলল, ‘আমার পরিচয় তো জানাই আছে। অহেতুক সময় নষ্ট করি না। আপনার মনে যা-ই থাকুক, মূল্যটা যেন সঠিক হয়।’
‘ওরে, বাব্বা, সো সিরিয়াস,’ হাসতে হাসতে বলল গিলেরমো। ‘তারমানে আমাদের সঙ্গে বসে একটু গলা ভেজাবেন না, সুন্দরীদের সঙ্গে খুনসুটি করবেন না? এসব চমৎকার মানুষের সঙ্গে একবার কার্ড পেটাবেন না? বুঝেছি, আপনাকেই আমার দরকার।’
বিদেশি হোস্টের কথায় কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সিঙ্গেল এক সোফা অন্য গেস্টদের সামনে থেকে একটানে খানিকটা দূরে সরিয়ে এনে বসে পড়ল ডিউক। পায়ের ওপরে তুলে দিল পা। ওর আচরণে স্পষ্ট অবজ্ঞা প্রকাশ পাচ্ছে সবার প্রতি। ব্যাপারটা বেশ অপমানজনক। সবসময় সম্মান পেতে অভ্যস্ত এরা। অথচ দুই পয়সার এক মস্তান তাদের সামনে এমন ভাব দেখাচ্ছে, যেন এই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট সে! অবশ্য ‘ওর আচরণে কিঞ্চিৎ কৌতূহল জাগল সেলেব্রিটি মেয়েটার মনে। বুঝতে পারছে, নতুন যুবকের কোন আগ্রহ নেই তার প্রতি। জীবনে তো কম পুরুষের মুখোমুখি হয়নি, তাকে পাওয়ার জন্য লোভী পুরুষগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়, অথচ এরকম ব্যতিক্রমী পুরুষমানুষ এই প্রথম দেখল সে। নিজ থেকেই দুটো গ্লাসে উইস্কি ঢেলে লম্বা সরু পা ফেলে লাস্যময়ী ভঙ্গিতে এগিয়ে গিয়ে একটা অফার করল অতিথিকে। তার উন্মুক্ত ফর্সা মসৃণ ত্বকের ঔজ্জ্বল্যে চকচক করে উঠল উপস্থিত পুরুষদের চোখগুলো, একজন ছাড়া। আর মেয়েদের দৃষ্টিতে স্পষ্ট ঈর্ষা।
তির্যকভাবে চোখ তুলে মেয়েটাকে দেখল ডিউক। তার মৃদু হাসিমাখা ঠোঁটে, মেকি কোন আহ্বান নেই, আছে স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা। গ্লাসটা হাতে নিয়ে নড করল ডিউক, ধন্যবাদ দিয়ে শব্দ খরচ করল না।
মাথা ঘুরিয়ে সরাসরি তাকাল গিলেরমোর দিকে। ‘শ্যাল উই?’
শোবিয জগতের রানীর রূপলাবণ্যও ডিউককে কুপোকাত করল না দেখে আরও খুশি হলো ইটালিয়ান। ‘মাই গড, ইউ আর রিয়েলি আ প্রফেশনাল! লেট’স গেট টু দ্য পয়েন্ট দেন। কথা আমরা বলব, তবে এখানে নয়, প্রাইভেট লোকেশনে। তার আগে আপনাকে একটা ছোট্ট পরীক্ষা দিতে মনে। আমার জানতে হবে, যে ডিউককে আমরা আসলে খুঁ আপনি সে-ই কিনা।
ড্রিঙ্কের গ্লাসটা সোফার হাতলে রাখল ডিউক। ওটা পড়ে যাবে কিনা কেয়ার করল না। ‘আমি জানতাম এখানে খামোকাই সময় নষ্ট করছি। ডিউক কারও কাছে পরীক্ষা দেয় না, আর কারও ওপর নির্ভরও করে না।’
‘আরে, বাবা, শান্ত হোন তো,’ যেন ঢাকার এই কুখ্যাত মস্তানের আঁতে ঘা দেয়নি, এমন হালকা সুরে কথা বলে উঠল গিলেরমো। মুখটা হাসি-হাসি। ‘ছোট্ট এক গেইম খেলব, যেটা আপনিও এনজয় করবেন। অল ওঅর্ক অ্যাণ্ড নো প্লে, মেইকস ডিউক আ ডাল বয়! সুতরাং, এটাকে খেলা হিসেবে নিলে ভাল করবেন। জিতলে পুরস্কার, দামি দামি কন্ট্রাক্ট পাবেন, আর সঙ্গে আমাদের শোবিয কুইন মিস শিবাকে। যদি হেরে যান, সসম্মানে বিদায় জানাব। মনে কোন খেদ রাখব না। কি, রাজি? আপনার কিংবদন্তী হয়ে ওঠার কীর্তির কথাও তো আর কম শুনলাম না। পনেরো গজ দূর থেকে ছুরি ছুঁড়ে মাথার চুল বা আস্ত পেন্সিল দু’ভাগ করে দিতে পারেন, ফাস্ট ড্র আর নির্ভুল লক্ষ্যভেদে দুর্দান্ত, খালি হাতে পিটিয়ে চার-পাঁচজনকে শুইয়ে দিতে পারেন ইত্যাদি। এখন বলেন তো, নিজের চোখে অন্তত একটা ডেমো না দেখে বিশ্বাস করি কীভাবে?’
উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়েছিল ডিউক, ইটালিয়ানের শেষ কথাটা চ্যালেঞ্জের মতই ঠেকল ওর কাছে। ক্রুর এক হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে। ‘ঠিক আছে, ডামি হয়ে দাঁড়ান তবে, ফার্স্ট হ্যাণ্ড অভিজ্ঞতা পেয়ে যাবেন।
দ্রুত দু’পাশে মাথা নাড়ল গিলেরমো। ‘আরে, না, আমি না! দর্শক হয়েই থাকতে চাই। কিন্তু আমাদের বিউটি কুইন, এগিয়ে গিয়ে সেলেব্রিটি শিবা সুস্মিতার দু’হাত ধরল সে, প্রায় ঠেলে নিয়ে চলল কামরার অপর প্রান্তে। ‘ও হবে আপনার ডামি। জিতলে আজ রাতের পুরস্কার হিসেবে ওকে পাবেন, আর হারলে মানে গুলিটা ওর গায়ে লেগে গেলে বেচারির কপাল খুবই খারাপ বলব। আর যদি টার্গেট মিস করেন, তবে আপনাকে আবার অন্য কোথাও কাজে লাগানো যাবে।’
দেশের প্রথম সারির সিনেমার নায়িকা কোন প্রতিবাদ ছাড়াই তার গডফাদারের ইচ্ছায় টার্গেট হচ্ছে দেখে অবাক হয়েছে ডিউক। ভাবল, এটা কি ড্রাগের প্রভাব? নাকি কোথাও বাঁধা পড়ে আছে? হাবভাবে মনে হচ্ছে, এর আগেও এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে মেয়েটার।
গিলেরমোর ডাকে আবার ফিরে এসেছে কালো চশমা। তবে একজন নয়, এবার দুই কালো চশমা। দেখতে একই রকম। ব্যাটারা যমজ নাকি? দু’জনের হাতেই সাইলেন্সার দেয়া ব্রাউনিং পিস্তল। একজনের বামহাতে একটা ট্রে, সিল্কের চকচকে কাপড়ের ওপরে শুয়ে আছে ওয়ালথারের নতুন মডেলের পিস্তল: পিডিপি। চার ইঞ্চির স্টিল ব্যারেল, নাইন মি.মি. কার্ট্রিজ। শুটিং অপশন আছে: সেমিঅটো, সিঙ্গেল অ্যাকশন আর স্ট্রাইকার-ফায়ার্ড। স্মল আর্মস হিসেবে বেশ সুদর্শন, বিশ গজ দূর থেকেও জাদু দেখাতে পারবে দক্ষ হাতে পড়লে।
ট্রে-টা ওর সামনে উঁচু করে ধরতেই পিস্তল ডানহাতে তুলে নিল ডিউক। ওটার ওজন ওর কাছে দু’পাউণ্ডের কিছু বেশি হবে মনে হলো। ম্যাগাযিনটা বোধহয় খালি। চেক করল, একটাই বুলেট চেম্বারে।
উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী হতে যাচ্ছে, এই আনন্দে ঘরের অতিথিরা সবাই পছন্দমত ভিউয়িং অ্যাঙ্গেল বেছে নিয়ে বসে পড়ল। হোস্ট গিলেরমো মোজি ছোটখাট একটা বক্তৃতা দিল সবার উদ্দেশে। এরকম এক ইভেন্ট আয়োজন করতে পেরে রীতিমত গর্বিত বোধ করছে সে। উৎসাহ দিয়ে বলল হাই স্টেকে বাজি ধরতে, তারপর ডিউকের কাছে এসে বলল, ‘স্ট্রাইকিং ডিস্ট্যান্স ষাট গজ, টার্গেটও স্থির। আপনার জন্য এটা কোন ব্যাপারই না।’ এবার দুই কালো চশমাকে দেখিয়ে বলল, ‘মিট ডি সিলভা ব্রাদার্স ফ্রম শ্রীলঙ্কা, টুইনস। কিছু মনে করবেন না, ওরা দুটো গান তাক করে রাখবে আপনার দিকে, যদি আপনার মাথায় শেষ মুহূর্তে একটা বুলেট দিয়েই কোন পাগলামি চাপে, তাই আর কী!’
বিশাল ফ্লোরের শেষপ্রান্তে শিবা সুস্মিতা পিঠ সোজা করে বসে আছে খাড়া ব্যাকরেস্টের চেয়ারে। তার কাছে গিয়ে ঝুঁকে আলতো করে ঠোঁটে চুমো খেল গিলেরমো। ‘ভয় পাচ্ছ, ডার্লিং? শুধু ভাবতে থাকো, বেঁচে গেলে কী পুরস্কারই না পাবে!’ হাসিমুখে এক চোখ টিপে ডিউকের দিকে ইঙ্গিত করে দেখাল সে। শিবার থুতনিটা আলতো করে নেড়ে আদর করে দিল, তারপর এক হাতে ধরা কার্লসবার্গ জ্যাকবসেন বিয়ারের বোতলটা তার মাথার ওপরে সেট করল। ‘একদম নড়বে না। অনেক দামি বিয়ার, পড়ে গেলে নষ্ট হবে। গতবারের শাস্তির কথা মনে আছে তো?’
ওয়ালথারের এই মডেলটা আগে ব্যবহার করেনি ডিউক। অবশ্য জানে এটার ইকুইভ্যালেন্ট হচ্ছে গ্লক ১৭, যেটা বেশ কয়েকবার শুটআউটে ওর কাজে লেগেছে চমৎকারভাবে। পনেরো রাউণ্ডের ম্যাগাযিন খালি থাকায় অনেক হালকা হয়ে গেছে অস্ত্রটা। ট্রিগারে আঙুল রেখে প্রেশার বোঝার চেষ্টা করল ও। এইম করল শিবা সুস্মিতার মাথায় রাখা বিয়ারের বোতলটার ওপরে। নাইন মি.মি. বুলেট দিয়ে আউটডোরে এক শ’ গজ দূরেও টার্গেটে গুলি করেছে ডিউক, কিন্তু সেই টার্গেট ছিল প্রমাণ সাইজের। আর এখানে ষাট গজ দূরের ছোট্ট বোতলটা বরাবর পিস্তল তুলে ধরলে হয়তো ওটাকে চোখে ভাল করেই দেখা যাবে না। আরেকটা ভয় হচ্ছে রিকয়েল নিয়ে। এখানে দূরত্বের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রিসিশন বা নির্ভুল লক্ষ্যে গুলি পৌঁছানো। এজন্য অপটিক মাউন্টিং কাজে লাগবে অবশ্য। যদিও ডানহাতের তালু আর বাঁ হাতের আঙুল ব্যবহার করে রিকয়েলটা যদি সঠিকভাবে গ্রিপ ধরা হাতের দিকে প্রবাহিত করতে না পারে, তাহলে ওয়ালথারের নল ঝাঁকি খাবে বেশি, ফলে এক ইঞ্চির ব্যবধান হলেই টার্গেটধারীর মৃত্যু অথবা কাঁচের টুকরোর আঘাতে সে মারাত্মকভাবে আহত হবে।
পিনপতন নীরবতা সুবিশাল রুমে। সবাই নিঃশ্বাস ফেলতেও যেন ভুলে গেছে। মডেলদের মত ঋজু পিঠে এখনও স্থির বসে আছে শিবা, মাথায় টার্গেট। এত দূর থেকে তার চেহারায় আতঙ্কের ভাব বোঝা যাচ্ছে না, তবে মসৃণ গ্রীবায় ঘাম চকচক করতে দেখল ডিউক।
ডানহাতে ওয়ালথার পিডিপিটা ধরে ট্রিগারে আঙুল রাখল ডিউক। বামহাতের তর্জনী দিয়ে ট্রিগার গার্ডের ওপরের অংশ চেপে ধরল, যাতে আঙুলের মাথা থাকে পিস্তলের নলের সমান্তরালে। রিকয়েল সামলানোর পুরনো কৌশল। সামান্য পা ফাঁক করে শুটারের স্ট্যাণ্ডার্ড পোচারে দাঁড়াল ও। এবার গুলি করবে।
খুক খুক করে কেশে বাধা দিল গিলেরমো। শিবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সরি, ডার্লিং, ওয়ান সেক্,’ তারপর ডিউকের দিকে তাকিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত জানাল, ‘শুধু এক হাতে অস্ত্রটা ব্যবহার করতে হবে, ডিউক।’
গুঞ্জন উঠল অতিথির মাঝে, বাজির পরিমাণ বাড়াবে না কমাবে এই নিয়ে কথা চলছে বোধহয়। ওদিকে শিবার গলা বেয়ে দরদর করে ঝরছে ঘাম। ভিজে গেছে সাদা টপসের সামনের অংশ। সেঁটে আছে বুকের সঙ্গে। তার অসহায়ত্বে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। রক্তের গন্ধ পাওয়া হাঙরের মত অস্থির হয়ে উঠেছে অভিজাতদের এই দলটি। ভাবল ডিউক, তখন ওর ক্লায়েন্ট আদনান সিরাজ কী যেন বলছিল? সুখের সমুদ্র!
পিস্তলের গা থেকে বামহাত সরিয়ে নিল ও। শরীর একটু কোনাকুনি করে দাঁড়াল। লম্বা করে দিল ডানহাত। অপটিক মাউন্টিঙের ভেতর দিয়ে টার্গেটের দিকে নিবদ্ধ করল দৃষ্টি। একদম ভুলে গেছে শিবার উপস্থিতি, এখন চোখ জুড়ে আছে বিয়ারের বোতল।
নিস্তব্ধতার ভেতরে হঠাৎ করে যেন বোমা ফাটল। বুম্ করে আগুন ঝরাল ওয়ালথার পিডিপি। হঠাৎ শব্দে যেন কানে তালা লেগে গেল। তবে সাউণ্ডপ্রুফ হওয়ায় হলরুমের বাইরে যায়নি পিস্তলের গর্জন। অদৃশ্য হয়ে গেছে বোতলটা, এক ফোঁটা তরল কিংবা সামান্য কাঁচের টুকরো পড়েনি শিবার গায়ে। সম্পূর্ণ অক্ষত সে।
এক সেকেণ্ডের স্থবিরতা। তারপর নড়ে উঠল সবাই। বাজিতে যারা জিতেছে, উল্লাস করতে লাগল তারা, টিপ্পনী কাটছে প্রতিপক্ষকে। এক ডি সিলভা এসে ওয়ালথার নিয়ে গেল শুটারের হাত থেকে। গিলেরমো ছুটল বোতলের খোঁজে। শিবার ডানপাশে দু’গজ দূরে গলগল করে দামি পুরু কার্পেটের ওপর হালকা সোনালী তরল ঢেলে দিচ্ছে মাথা কাটা কার্লসবার্গ জ্যাকবসেন।
বোতলটা সোজা করে হাতে নিল ইটালিয়ান। ‘ইউ আর আ জেইম, ডিউক! যদিও একটু সফট্। ধরে নিয়েছিলাম আমাদের হোয়াইট কুইনের সারা শরীরে বিয়ারের স্প্ল্যাশ দেখতে পাব। কিন্তু আপনি যা দেখালেন, তা সত্যিই অবিশ্বাস্য!’
কাছে এসে নিজে থেকেই ডিউকের হাত নিয়ে হ্যাণ্ডশেক করল সে। তারপর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, ‘ওয়েলকাম টু দি ইউনিট-এক্স, ডিউক!’
গিলেরমোর প্রাইভেট অফিসে এক ঘণ্টা ধরে চলল আলোচনা। ডিউক বুঝল, এটা শুধু এলিট ক্লাব নয়, বরং আড়ালে চলে ইউনিট-এক্স নামক এক সিণ্ডিকেটের রিক্রুটমেন্ট প্রসেস। নানান মানুষ আসে এই ক্লাবে, কেউ দুর্বল, কেউ দুঃসাহসিক। তবে সবাই ধনী এবং প্রত্যেকের কোন না কোন মহলে লিঙ্ক আছে। এদের মধ্য থেকেই ব্যাকগ্রাউণ্ড যাচাই করে নেয়া হয় সদস্য। তারপর যার যার ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী কাউকে নারীঘটিত বা আর্থিক কেলেঙ্কারীতে ফাঁসিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে, লোভীদের ঘুষ দিয়ে কিংবা শক্তিমানদের অহমে ঘা দিয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজে জড়িয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। মোটকথা, এক ছাদের তলে এত সম্ভাবনাময় এজেন্ট আর কোথায় পাবে ইউনিট-এক্স?
গিলেরমো মোজি যেহেতু রিক্রুটিং বস্, তার ওপর আরও বড় সব মাথা আছে নিঃসন্দেহে। তারমানে, দেশি-বিদেশি চক্র একসঙ্গে মিলেই গড়ে তুলেছে এই সিণ্ডিকেট। আর ডিউকের মত শার্প ও স্কিল্ড অথচ ক্রিমিনাল মাইণ্ডেড যুবকদের তো তাদের চাই-ই চাই।
গিলেরমো তার মত করে সিণ্ডিকেটটা সম্বন্ধে যতটুকু রেখে-ঢেকে জানানোর, জানাল ডিউককে।
‘এখানে আমি একটা সমস্যা দেখছি,’ বলল ডিউক, ‘আমি স্বাধীনভাবে কাজ করতে অভ্যস্ত। আবার মুড না এলে কোন কাজ করি না। আপনারা আমার কাছে আনুগত্য চাইবেন। কিন্তু আমি শুধু আমার নিজেরই অনুগত। সুতরাং, আপনাদের কন্ট্রাক্ট গ্রহণ করতে পারছি না।’ দৃঢ় কণ্ঠে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করেছে ডিউক।
‘বুঝতে পারছি আপনাকে কোন লোভ বা ভয় দেখিয়ে দলে টানা যাবে না।’ মুখের হাসি মুছে গেছে ইটালিয়ানের। নরম সুরে বলল, ‘কিন্তু ইউনিট-এক্স তো অত সহজে ছাড়বে না। আমাদের প্রত্যাখ্যান করার ফল কিন্তু হবে ভয়াবহ, তা কি বুঝতে পারছেন?’
‘আমার শর্ত একটাই। আমি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কেস বাই কেসে কাজ করব। অর্থাৎ, কোন কাজ আমার পছন্দ না হলে সেটা রিফিউজ করার স্বাধীনতা আমার থাকতে হবে। তাছাড়া, আমার স্বতন্ত্র ক্লায়েন্টদের কাজ পছন্দ হলেও আমি তা হাতে নেব।’
‘ওকে, ডিউক, আমি সুপিরিয়রদের সঙ্গে কথা বলব। আপডেট না আসা পর্যন্ত ঢাকাতেই থাকবেন, প্লিয। আশা করি আমরা ভাল বন্ধু হতে পারব। তবে তার আগে চলুন, ডিনার সেরে নেয়া যাক, অতিথিরা অপেক্ষা করে আছেন।’
ডিনারে সাত কোর্সের ইটালিয়ান কুইযিন উপভোগের পর বিদায় নিল ডিউক। ওর সঙ্গে জুড়ে গেল শিবা সুস্মিতা। ঘামে ভেজা সাদা পোশাকটা স্নান শেষে পাল্টে নিয়েছে। এখন পরনে সাদা-কালোর মিশ্রণে হাঁটু পর্যন্ত এক চমৎকার গাউন। দেহের বাঁক আর উচ্চতাগুলো প্রকাশ্য। মাখনের মত মসৃণ খোলা কাঁধ।
মনে মনে স্বীকার করল ডিউক, মেয়েটা সত্যিই খুব সুন্দরী। গাড়িতে ওর পাশের সিটে বসল সে। আচরণে কোন জড়তা নেই। মাথায় বোতল নিয়ে ঠায় বসে থাকা আতঙ্কিত মানুষটার সঙ্গে কোন মিলই নেই।
‘তোমাকে কোথায় নামিয়ে দিতে হবে, বলো।’
আলাদা হওয়ার কথা শুনে কলকল করে উঠল শিবা। ‘মাথা খারাপ, হাড়গিলেটা (গিলেরমো) কী বলল শোনোনি? আজ তোমার সঙ্গেই আমাকে থাকতে হবে। নইলে খবর আছে। আজকের জন্য আমি তোমার উপহার আর তুমি আমার পুরস্কার। সো, গো এনিহোয়্যার ইউ লাইক টু।’
গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে শিবার বকবকানি শুনতে লাগল ডিউক, কিন্তু চোখজোড়া ঠিকই খেয়াল রাখছে পেছনে। একটা এসইউভি ফলো করছে ওর প্রিমিয়োকে। খুব কাছে আসছে না, তাই ভেতরের কাউকে ভাল করেও দেখা যাচ্ছে না। গভীর রাতের রাস্তা প্রায় নির্জন, অনুসরণ করতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
‘ঠিক আছে, গিলেরমোকে ভয় পেয়ে থাকলে আমার বাসায় আজ রাতে থাকতে পারো। কিন্তু আজই শেষ। দ্বিতীয় সুযোগ খুঁজবে না কখনও।’
মুক্তার মত সাদা দাঁত বের করে হাসল লাস্যময়ী নায়িকা। আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলল, ‘সে পরে দেখা যাবে কে কাকে খোঁজে!’
ডিউক তার মগবাজারের বাসা বহু আগেই ছেড়ে দিয়েছে। এখন এলিট শ্রেণীর গুণ্ডা হিসাবে থাকে গুলশান- সাতরাস্তা-হাতিরঝিল কাভার করে এমন এক এরিয়ায়, যাতে পালিয়ে যেতে হলে অনেকগুলো একযিট পাওয়া যায়। এবং ওর এই বুদ্ধি আগেও বহুবার কাজে এসেছে।
হাতের রেখার মত চেনা রাস্তাগুলোতে ঘুরে ঘুরে ঠিকই এসইউভিটা খসিয়ে দিল ডিউক। তারপর চলে এল ওর ফ্ল্যাটে। চার তলায় উঠে আসতে গিয়ে কারও সঙ্গে দেখা হলো না, শুধু দারোয়ান ছাড়া। ব্যাটা রাত এগারোটার পর কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেয় না। কিন্তু ডিউককে ‘না’ করে কার ঘাড়ে ক’টা মাথা! বাড়িওয়ালাও মুখ বুজে থাকেন। নামকরা এক গুপ্তাকে বাসা ভাড়া দেয়ার কোন ইচ্ছে ছিল না তাঁর, কিন্তু পুলিশকে বলেও লাভ হয়নি। উল্টো তাঁকেই চোখমুখ বন্ধ করে রাখতে বলা হয়েছে।
চার তলাতে অন্য ফ্লোরগুলোর মত দুটো করে ইউনিট। পেছনেরটা ডিউক ভাড়া নিয়েছে, তারপর নিজের মত করে কিছু মডিফিকেশন করে নিয়েছে। হঠাৎ শত্রু হামলা করলে যেন আপার হ্যাণ্ড ওরই থাকে। সামনের ইউনিট ভাড়া নিয়েছে ওর পরিচিত সরকারি অফিসার, কিন্তু লিঙ্কটা গোপনই আছে। সুতরাং চাইলেও কারও পক্ষে পাশের কামরা থেকে স্পাইং করা সম্ভব নয়।
দু’হাজার স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট বেশ সাজানো-গোছানো। ঘুরে-ফিরে সব দেখে আফসোস করল শিবা, ‘ইশ্, জায়গার কী অপচয়! তোমার কোন সঙ্গিনী নেই ভাবাই যায় না। অবশ্য তুমি যেরকম কাঠখোট্টা! হি-হি-হি।’
একসঙ্গেই ঢুকল ওরা মেইন বেডরুমে। শিবাকে বলল ডিউক, ‘তুমি ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে পড়ো। দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ো। এসি অন করা আছে। আর আমি পাশের বেডরুমে আছি, ভয় নেই।’
কপট অভিমানে গাল ফোলাল শিবা। ‘ও, মা, কী কথা ছিল আর কী হচ্ছে এসব! জীবন বাজি রেখেছি, আমাকে আমার পুরস্কার দাও, আমার সঙ্গে থাকো, প্লিয!’ বলতে বলতে হুট করে কাছে এসে ওর গলা জড়িয়ে ধরল।
নিজের বুকে শিবার কোমল বুকের উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে অজান্তেই শিহরিত হলো ডিউক, কিন্তু সামলে নিল নিজেকে। প্রায় জোর করে মেয়েটার হাত ছোটাল নিজের গলা থেকে তারপর শরীরটা ঘুরিয়ে দিয়ে বাথরুমের দিকে ঠেলে দিল। ‘গো, ফ্রেশেন আপ। দু’জনের ওপর দিয়েই প্রচণ্ড ধকল গিয়েছে। ভাল একটা ঘুম দরকার। উপহার বা পুরস্কার এগুলো পরে দেখা যাবে।’
চোখেমুখে হতাশা ফুটিয়ে দরজা বন্ধ করতে এগিয়ে এল শিবা। মুখে বলল, ‘আমাকে তোমার অ্যাট্রাকটিভ মনে হয় না, না?’
‘তা নয়, তুমি ঠিক আমার টাইপ নও।’
‘কী! তা হলে তোমার কেমন মেয়ে পছন্দ? বিবাহিত নাকি বিধবা?’
ফুঁসে ওঠা সুন্দরী রমণীর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দরজা ভিড়িয়ে চলে গেল ডিউক, মুখে মৃদু হাসি। পাশের বেডরুমে ঢুকেই আবার সিরিয়াস হয়ে গেল ডিউক। ঘর অন্ধকার রেখেই জানালার পর্দা সরিয়ে নিচে তাকাল। আবার ঠোঁটের কোণে ফিরল হাসিটা। রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়িটা আর সিগারেট ফুঁকতে থাকা দু’জনকে দেখে অনায়াসে সাদা পোশাকে পুলিশের লোক বলে চিনতে পারল ও। যতদূর চোখ যায় এপাশ-ওপাশ দেখে নিল। যেহেতু পুলিশের গাড়ি আছে, অন্য কেউ এই বিল্ডিঙের দিকে চোখ রাখলেও এদিকে আসবে না।
আপাতত ওর ফ্ল্যাট নিরাপদ। জানে, ওর জন্য এসবি-র লোকগুলো আসেনি।
পরিচিত তিনটা টোকার শব্দ শুনে ড্রেসিং টেবিলটার সামনে এসে দাঁড়াল। পুরো কাঠামোটা ধরে বামপাশে ঘুরিয়ে দিল। ফল্স দেয়ালের গায়ে বসানো টেবিলটা। পেছনের অংশ উন্মুক্ত হতে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল পাশের ফ্ল্যাটের সেই সরকারি অফিসার।
ডিউক প্রতিবারের মত আশা করছিল ওর দিকে শান্তভাবে আসবে সেই অফিসার। তারপর যথারীতি আপডেট চাইবে। কিন্তু ওকে চমকে দিয়ে কেউ যেন ছুঁড়ে মারল তাকে ওর গায়ের ওপরে। মৃত অফিসারের শরীরের আচমকা ধাক্কায় মেঝেতে তাল হারিয়ে পড়ে গেল অপ্রস্তুত ডিউক। তবে মুহূর্তেই গড়িয়ে সরে গেল এক পাশে। উঠে বসল সোজা হয়ে। হাতে উঠে এসেছে সুইস আর্মি নাইফ। তেমন ভয়ঙ্কর কিছু না হলেও অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করাই যায়। কিন্তু প্রতিপক্ষের হাতে সাইলেন্সার্ড ব্রাউনিং হাই-পাওয়ার পিস্তল! লম্বা নল ভীতিকর ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। অবশ্য মালিককে আরও ভয়ঙ্কর লাগছে। কালো চশমা, ডি সিলভা! তার সামনে পিস্তলের মুখে রেখেছে এক মেয়েকে
তার পেছনদিকে উঁকি দিয়ে দেখল ডিউক। ‘তোমার ভাইকে সঙ্গে আনোনি?’
‘খুব মজা পাচ্ছ বোধহয় ধরা খেয়ে? এই সরকারি টিকটিকির সঙ্গে এত খাতির কীসের?’
শত্রুর চোখ দেখতে না পারলে তার প্রতিক্রিয়া আগাম বোঝা মুশকিল। যদিও কালক্ষেপণ করতে কথাবার্তা চালিয়ে যাবার বিকল্প নেই। ‘টিকটিকি বলছ কাকে, মিয়া? এ তো আমার প্রেমিকা, হাযবেও বাসায় না থাকলে এই গোপন দেয়াল সরিয়ে আমার কাছে আসে। হাযবেণ্ড ব্যাটা ট্রেনিঙে ঢাকার বাইরে গেলে আমার জন্য ওর ব্যাকুলতা দেখার পর আমিই এটা তৈরি করে দিয়েছি।’
মেঝেতে ডিউকের কথিত প্রেমিকা নড়েচড়ে উঠল। তাকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিল ও। ‘তুমি ঠিক আছ তো, ডার্লিং?’
মাথা নাড়ল সরকারি অফিসারের বউ। ভয় পাওয়া কাঁপা- কাঁপা কণ্ঠে বলল, ‘সরি, ডিউক, শেষ পর্যন্ত ধরাই খেয়ে গেলাম। এখন কী হবে আমার? আমার স্বামী তো জানলে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে!’
ওদের ‘নাটক’ দেখে বিরক্ত ডি সিলভা। ‘তুমি বলতে চাইছ, এই মেয়ে পুলিশের নয়? তুমি পুলিশের ইনফর্মার নও? নিচে যে সাদা পোশাকের পুলিশের লোক দেখলাম, ওরা এর লোক নয়? আজ বসের সঙ্গে যে আলোচনা হলো তোমার, সেগুলো জানতে আসেনি এই মেয়ে? সবচেয়ে বড় কথা, পাশের ঘরে নায়িকা রেখে তুমি এই ঘরে আরেকজনের বউয়ের সঙ্গে শুতে এসেছ?’
ধরা পড়ে যাওয়া ভঙ্গিতে হাসল ডিউক। ‘জানি তোমার বিশ্বাস হবে না, কিন্তু আমার রুচিই এমন, বলো কী-ই বা করতে পারি! হাজার হোক, প্রেমিকা,’ বলে আড়চোখে তাকাল মেয়েটার দিকে। বাপ রে, এ যেন আরেক অগ্নিকন্যা!
সেফটি ক্যাচ অন করে ফেলেছিল, আবার অফ করল ডি সিলভা। ‘তাহলে বলো, এসইউভিটা তোমাকে ফলো করছিল কেন? পুলিশ কেন নিচে? তোমাকে প্রথমদিন ক্লাবে দেখার পর থেকেই আমার সন্দেহ হয়েছে, তাই একটুও বিশ্বাস করিনি। বস্ বলে দিয়েছেন, সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেলে যেন গুলি করি মারার জন্য। তো আগে তোমার প্রেমিকাকে দিয়েই শুরু করি, কী বলো?’
ডিউকের মনে হলো স্লো মোশনে ওর পাশে বসা মেয়েটার দিকে অস্ত্রের মুখ ঘুরে যাচ্ছে ডি সিলভার। একই সঙ্গে দু’জনের শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। সরাসরি ঝাঁপ দিল ব্রাউনিঙের ওপর। পিস্তল তখনও কারও গায়ে তাক করা হয়ে ওঠেনি, এমন সময় ওদের নড়তে দেখেই ট্রিগারে চাপ দিল ডি সিলভা। কিন্তু ভুল করে বসেছে সেমিঅটোতে না রেখে, সিঙ্গেল শটে বাটন রেখে। প্রতিবার তাকে এখন ট্রিগার চাপতে হবে। প্রথম গুলি বিছানায় লাগল, দ্বিতীয় গুলি ফুটো করল ডিউক-প্রেমিকার কোমরের জামার পাশের অংশ। একটু হলে ফুটো হত মেয়েটার পেট। তৃতীয়বার ট্রিগার চাপার আগেই ডিউকের হাতের সুইস আর্মি নাইফের করাতের মত ফলা চিরে দিল ডি সিলভার পিস্তলধরা হাতের কব্জির শিরা। ওদিকে প্রেমিকা ততক্ষণে জোরাল এক রাইট হুক বসিয়ে দিয়েছে কালো চশমার থুতনির নিচে। সঙ্গে ডান পা-ও সেঁধিয়ে দিয়েছে লোকটার দুই উরুর মধ্যিখানে। থ্যাচ করে শোনা গেল একটা শব্দ!
কেঁউ করে উঠে ভাঁজ হয়ে গেল ডি সিলভা। অন্য কেউ হলে কুপোকাত হয়ে যেত। কিন্তু সে অন্য ধাতুতে গড়া যোদ্ধা। প্রচণ্ড ব্যথা উপেক্ষা করেই বামহাতে চালান দিল ব্রাউনিং হাই-পাওয়ার। এই হাতেও টার্গেট মিস হবে না। খেয়াল নেই গলগল করে রক্ত পড়ছে ডানহাতের কব্জি থেকে। বামহাত তুলেই গুলি চালাল, কিন্তু দুরন্ত মেয়েটা আবারও ঝাঁপিয়ে পড়ে ঝট্ করে তার কব্জি ধরে হাত নিচে নামিয়ে দিল। দুটো বুলেট হজম করল কার্পেট আর মেঝে। ডিউকও একই সঙ্গে বিরাশি সিক্কা ঘুষি হাঁকাল খুনির সোলার প্লেক্সাস বরাবর। সজোরে ছিটকে পেছনে গিয়ে পড়ল ডি সিলভা। পড়েই একটা গড়ান দিয়ে উঠে বসল হাঁটু ভাঁজ করে। পিস্তল তখনও ছাড়েনি হাত থেকে, তাক করল নল ওদের দিকে।
স্থির হয়ে গেল ডিউক আর ওর কথিত প্রেমিকা। নিষ্ঠুর হাসি ফুটল কালো চশমার মুখে। ডানহাতের চেটো দিয়ে মুছল মুখের রক্ত আর লালা। আর তারপর হঠাৎই খেয়াল হলো পাল্টে গেছে কিছু একটা। বড় বেশি হালকা লাগছে পিস্তল। ঝট করে মেয়েটার দিকে চোখ গেল তার। হ্যাঁ, ওই তো, ম্যাগাযিন ছেমড়ির হাতেই! লড়াইয়ের ফাঁকে কখন যেন খুলে নিয়েছে! কিন্তু চেম্বারে একটা বুলেট তো রয়ে গেছে! তারমানে, যে-কোন একজনকে নিয়ে মরতে পারবে সিলভা। একবার মেয়েটার দিকে, আরেকবার ডিউকের দিকে তাক করল পিস্তলটা। দু’জনেই সতর্ক, যে-কোন মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে নিরাপদ ডিরেকশনে, সেটা যাকেই গুলি করুক না কেন সে!
কে বেশি ক্ষতিকর ইউনিট-এক্সের জন্য? মেয়েটা, না ডিউক? ডিউকই তো! সিদ্ধান্ত নিল সিলভা। এবার কুৎসিত নল তাক করল ঢাকার কুখ্যাত গুণ্ডার দিকে। মেয়েটাকে পরে খালি হাতে মারার চেষ্টা করে দেখবে। কিন্তু এ কী, মেয়েটা এমন পাগলামি করছে কেন?
ডিউকের দিকে ব্রাউনিং ঘুরে যেতেই ঝুঁকি নেয়ার জন্য মনস্থির করেছে সরকারি অফিসারের বউ। হতাশায় ভেঙে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বিছানার প্রান্তে ধপ্ করে বসে পড়ল। তারপর ঊরুর কাছে ট্রাউজারের সেলাইয়ের দু’পাশ ধরে টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলল কাপড়। ফর্সা ও পেলব উরু স্পষ্ট দেখা গেল। জাদুমন্ত্রের মত তার হাতে চলে এসেছে .২২ ক্যালিবারের খুদে ম্যাগনাম রিভলভার। উরুর ভেতরের দিকে লুকানো ছিল অস্ত্রটা।
মাত্র তিন সেকেণ্ডের ঘটনা। ডি সিলভা চমকে গিয়ে চট করে ডিউকের দিক থেকে সরিয়ে ব্রাউনিং তাক করল আশ্চর্য মেয়েটার ওপরে। কিন্তু বিধিবাম। কোথায় গুলি? তার পিস্তল ব্রাউনিং হাই-পাওয়ার, এতে আছে ম্যাগাযিন সেফটি। অর্থাৎ, ম্যাগাযিন সরিয়ে ফেলে চেম্বারের একমাত্র বুলেটটা যদি কেউ খরচ করতে চায়, তখন ম্যাগাযিন সেফটি অপশন সেটাকে অটোলক করে দেয়, চেম্বারের গুলিটা জায়গামত থেকে যায়, বের আর হয় না। পৃথিবীর খুব কম হ্যাণ্ডগানেই এই ফিচারটা রাখা হয়েছে, আর এই তথ্য ভুলে গিয়েছিল ডি সিলভা!
বসা থেকে উঠে দাঁড়াল সুন্দরী তরুণী, কী এক ভয়াবহ কাঠিন্য ওর চোখেমুখে। হাতের তালুতে লুকানোর মত পিচ্চি অস্ত্রটা সিঙ্গেল শট, ধীরেসুস্থে এগিয়ে গিয়ে ডি সিলভার মাথায় তাক করল, তারপর কোন দ্বিধা ছাড়াই টিপে দিল ট্রিগার। ভবলীলা সাঙ্গ হলো কালো চশমা পরা লঙ্কান হিটম্যানের।
অবাক হয়ে ‘প্রেমিকাকে’ অ্যাকশনে দেখল ডিউক প্রশংসা ঝরল ওর মুখ থেকে, ‘কী দস্যি মেয়ে, বাবা! একেবারে মহিলা জেমস বণ্ড! আমার প্রেয়সী যে এমন ভয়ঙ্কর সেটা তো আগে জানা ছিল না…
‘থামো!’ মুখ ঝামটে উঠল বিসিআই-এর অগ্নিকন্যা এজেন্ট রূপা। হাতের খুদে ম্যাগনাম রিলোড করে তাক করল ডিউকের দিকে। ‘প্রেয়সী না ছাই, আমার এসব হবার মত যোগ্যতা তোর আছে নাকি রে, শালা!’
‘আমার নেই, তবে এই ব্যাটা তুভাক্কুকারুর কিন্তু ছিল, তোমাদের মানাত ভাল,’ হাসতে হাসতে বলল ডিউকরূপী মাসুদ রানা।
‘চুপ, শালা! মস্করা করবি না!’ হাসছে রূপাও। জানে, সিংহলী ভাষার তুভাক্কুকারুর মানে গানম্যান। ডি সিলভাকে ইঙ্গিত করেছে রানা।
ইশ, আজ কতদিন পর দু’জনের দেখা সেটা ভাবছে রূপা। নরম সুরে বলেই ফেলল, ‘আমরা তোমাকে অনেক মিস করেছি, রানা।’
‘আমি জানি, রূপা। এখন পুরোপুরি সুস্থ আমি। আশা করি আগের মতই আবার কোন দুঃসাহসিক মিশনে যাবার সুযোগ হবে আমাদের। তা তুমি ধরা পড়লে কীভাবে? আমি তো ধরে নিয়েছিলাম আজও আলতাফই আসবে।’
নিজের ওপরে খানিকটা ক্ষুব্ধ রূপা। ‘আগেই অপেক্ষা করছিল, হয়তো আলতাফ সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছিল। যেহেতু অনেকদিন ধরেই তোমাকে দলে টানার চেষ্টা করে চলেছে। আমাকে আশা করেনি, তাই প্রথমেই গুলি চালিয়ে মেরে ফেলেনি লোকটা। ইন্টারোগেট করছিল। আমিও ভাবলাম কৌশলে এখানে এনে যদি ওকে সামলানোর একটা সুযোগ পাওয়া যায়।’
‘কৌশলটা কাজে দিয়েছে নিঃসন্দেহে। আচ্ছা, শোনো, নিচের পুলিশ কি তুমি বা অফিস বসিয়েছে?’
মৃদু হাসল রূপা। ‘পুলিশ নয়, আমাদের দলের কয়েকজন।’
ঠিক তখনই ওদের হঠাৎ চমকে দিয়ে জোরে জোরে দরজা পিটানোর শব্দ হলো আর সেই সঙ্গে চিৎকার। ‘ডিউক, ডিউক, প্লিয, দরজা খোলো, বাঁচাও আমাকে! আমার ভীষণ ভয় লাগছে! ডিউক, ডিউক!’
চিৎকার থামছে না।
কানে হাত চেপে ধরে হাসছে রূপা। ‘ওই যে তোমার আসল প্রেমিকা। জলদি বাঁচাও ওকে, নইলে পুলিশ ওপরে উঠে আসবে এক্ষুণি!’
কিল মারার ভঙ্গি করল রানা, তারপর নিজেও হেসে ফেলল। ‘কিন্তু এর তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে। ভোর হবার আগেই ডেডবডি সরিয়ে ফেলা দরকার।’
কানে আঙুল দিয়ে দ্রুত ওকে দরজার দিকে ঠেলে দিল রূপা। ‘ক্লিনিং ক্রু খবর দিচ্ছি। এদিকটা সামলে নেব, তুমি তোমার নায়িকা সামলাও
হঠাৎ রূপাকে কাছে টানল রানা, কপালে একটা আলতো চুমো খেয়ে ছেড়ে দিল। আর দাঁড়াল না, দরজা খুলে সামান্য ফাঁক করে বেরিয়ে গেল বাইরে।
পেছন থেকে দরজাটা লাগিয়ে দিল রূপা। রানার গায়ের পুরুষালী গন্ধ এখনও ছুঁয়ে আছে ওকে। বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে মোবাইলটা বের করল বিসিআই অফিসে ফোন দেবে বলে।
ওদিকে শিবা সুস্মিতাকে সঙ্গে নিয়ে মেইন বেডরুমে ঢুকল রানা। পেছনে দরজা লক করে দিল। ওর গায়ে ঘাম দেখে ভুরু কোঁচকাল শিবা। ‘এক্সারসাইজ করছিলে নাকি এত রাতে?’
‘হুঁ, শরীরটা তো ফিট রাখতে হবে, যে-ধরনের কাজ করে বেড়াই। এবার লক্ষ্মী মেয়ের মত বিছানায় যাও, আমি স্নানটা সেরে নিই।’
দশ মিনিট শাওয়ারে দাঁড়িয়ে ভিজল মাসুদ রানা। শরীরের সমস্ত ক্লেদ, ক্লান্তি দূর হয়ে নির্ভার হয়ে গেল যেন। মাত্র তোয়ালে দিয়ে গা মুছতে যাবে, আবার ‘ডিউক’ চিৎকার কানে যেতেই দ্রুত কোমরে তোয়ালে পেঁচিয়ে বাথরুম থেকে ছুটে বেরোল ও। দেখল বিছানার ওপর বালিশে মাথা সামান্য কাত করে শুয়ে আছে শিবা, হাসছে ওকে বোকা বানিয়ে দিতে পেরে। বুকের কাছটায় পরনের রোব কিঞ্চিৎ ফাঁকা হয়ে আছে। আবেদনময়ীর ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকল সে রানার পেটানো শরীরের দিকে। ভেজা গা থেকে তখনও গড়িয়ে নামছে পানি। নিজেকে আজ রাতে বঞ্চিত করার মানে হয় না, ভাবছে ডিউক।
এসময় রানার পেছনে ধুপ্ করে একটা শব্দ হলো। পাশের কামরায় বিসিআই-এর ক্লিনার পৌঁছে গেছে?
ওকে আর ভাবার সুযোগ না দিয়ে বিছানা থেকে রীতিমত উড়ে এসে ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল শিবা। ‘সত্যিই ভয় পাচ্ছি আমি, ডিউক। তোমার ওই গুলি করার মুহূর্তটির পর আমি ক্ষণে ক্ষণে কানে শুনতে পাচ্ছি শব্দটা। এই একটু আগেও যেন হলো। আমি কিছুতেই আর এখন একা থাকতে পারব না। প্লিয, আমাকে এসব ভুলিয়ে দাও, ডিউক!’
হঠাৎ হঠাৎ কিছু শব্দ হয়তো আরও হবে, ভাবছে রানা। তাই মেয়েটাকে ব্যস্ত রাখাই ভাল। খানিক ঝুঁকে পাঁজাকোলা করে শিবাকে বুকে তুলে নিল ও, বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেও উঠে পড়ল খাটে। বিড়বিড় করে বলল, ‘দেখি এই মহাবিদ্যাটা কতটুকু মনে আছে!’
প্রচুর সময় আর বেশ যত্ন নিয়ে শিবার ভয় দূর করে দিতে লাগল ডিউক ওরফে মাসুদ রানা!
বহুক্ষণ পর থেমে গেল নায়িকার শীৎকারের সব শব্দ।
ওদিকে ক্লিনিং ক্রু আর রূপা মনে হয় কাজ শেষ করে চলে গেছে। ঘুম আসছে না ওদের কারও। ওর রোমশ বুকে মাথা রেখে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেলছে শিবা। তার মাথার চুলে হাত বোলাল রানা। নিচু গলায় জানতে চাইল, ‘ভয়টা কি কেটেছে, শিবা?’
উত্তরে ওকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা। ‘ভয়? না, তা নেই। কিন্তু তোমাকে আরও চাই!’
গভীর রাতে আবারও ব্যস্ত হয়ে উঠল ওরা দু’জন দু’জনকে নিয়ে।
(মাসুদ রানা সিরিজের বই বিষ নিঃশ্বাস থেকে অনুপ্রাণিত)
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন