কাজী আনোয়ার হোসেন
কুহক জাল – আর. এম. লিটন
কীভাবে যে কী হয়ে গেল!
রানিয়ার হাতের ছুরিটা থেকে রক্ত পড়ছে মেঝেতে। অবশ হয়ে গেছে ওর দেহ। ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে, চারপাশে শুধু লাল আর লাল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় রানিয়ার বিশ্বাস হচ্ছে না, চোখের সামনে তড়পাচ্ছে রক্তমাখা একটা শরীর। শেষ কয়েক ঝাঁকি দিয়ে হঠাৎ স্থির হয়ে গেল দেহটা। এই একটু আগেও জীবিত ছিল মানুষটা, গল্প করছিল, দুষ্টুমি করছিল। আর এখন সে মৃত!
একটা লাশের দিকে চেয়ে আছে মনে হতেই সংবিৎ ফিরল রানিয়ার। মুঠোয় ধরা ছুরিটা চোখের সামনে তুলে দেখে ঝট করে রেখে দিল পাশের ডাইনিং টেবিলের ওপর। পিছিয়ে গেল কয়েক পা, রক্তের স্রোত বয়ে এসে ছুঁতে চাইছে ওকে। ভয়ে-আতঙ্কে একমুহূর্তও আর দাঁড়াতে চাইল না পাদুটো। ছুটে পালাল বাইরের দিকে। ফুসফুস চেপে আসছে, বাতাস চাই, ঠাণ্ডা বাতাস!
একদৌড়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসতেই সন্ধ্যার শীতল বাতাস চোখেমুখে বুলিয়ে দিল শান্তির পরশ। কিন্তু ওর মনে তো শান্তি নেই। আবার ছুটল রানিয়া, অঝোরে ঝরছে চোখের জল।
অস্ফুটে বলল মেয়েটা, ‘সরি, বাবা, আই অ্যাম সো সরি!’
শিবা সুস্মিতার ভার্চুয়াল ডায়েরি থেকে:
রাত বাজে সাড়ে এগারো। আকাশে মস্ত এক আলোকিত চাঁদ, জোছনায় ভিজিয়ে দিচ্ছে চরাচর। বারান্দার পর্দাটা টেনে দিতে গিয়ে চোখ পড়ল আরও একবার, ফেরার পথে গাড়িতে বসে অনেকক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখেছি ওকে। এখন মনে হচ্ছে আমাকে অনুসরণ করে এসে অসহায় প্রেমিকের মত উঁকি দিচ্ছে বারান্দার ওপার থেকে। ‘তোমার কোন সুযোগ নেই, গো!’ মজা করে বললাম দুষ্ট চাঁদটাকে।
ক্লান্তি পৌঁছেছে চরমে। সকাল থেকে রাত অবধি শুধু শুটিং আর শুটিং। এই তো মাত্র ফিরলাম দুটো চ্যানেলের অনুষ্ঠান শেষ করে। কাল আবার একই রুটিন। বছরের সবক’টা দিন এরকম যয় না কিন্তু। এক সপ্তাহ হলো আমার নতুন সিনেমা মুক্তি পেয়েছে এবং পেয়েই ব্লকবাস্টার হবার পথে। দর্শকরা এত ভালভাবে গ্রহণ করেছে ছবিটা যে, প্রতিটা শো হাউসফুল যাচ্ছে সিনেমা হলগুলোতে। আর তাতেই পত্রপত্রিকা, টিভি চ্যানেল, অনলাইন চ্যানেলসহ মিডিয়ার সবগুলো প্রতিষ্ঠানই টিআরপি বাড়াতে নানারকম প্রোগ্রাম হোস্ট করছে। এতে করে আমিসহ অন্যান্য কলাকুশলীদেরও ব্যস্ততা বেড়ে গেছে কয়েক গুণ।
সবচেয়ে আনন্দের বিষয়, ছবিতে একটা আইটেম সং আছে, যেটা গেয়েছি, লিপসিং করেছি ও নেচেছি আমিই। এই গান এত পপুলার হয়েছে যে, ইউটিউবে ভিউ এরই মধ্যে কোটি ছাড়িয়ে গেছে। হাটে-মাঠে-ঘাটে সবার মুখে মুখে শ্রুতিমধুর গানটা। ফলে আমিই এখন সবচেয়ে বেশি ফোকাসে আছি। এত ব্যস্ততা সত্ত্বেও বেশ উপভোগ করছি খ্যাতির এই অপ্রত্যাশিত বিড়ম্বনাটুকু।
জামা-কাপড় ছেড়ে শাওয়ার নিতে বাথরুমে ঢুকলাম। ক্লান্ত শরীর একটু পর চাঙ্গা হয়ে যাবে। আমার জীবনে একজন একান্ত মানুষ আছে, ওই মানুষটির পরামর্শে ঠাণ্ডা এবং গরম জলে এমনভাবে স্নান করি যে, শরীরটা ফুরফুরে হয়ে যায়। শাওয়ারের জল তীরের মত গায়ে এসে পড়তেই শিউরে উঠল শরীরটা, তারপরই শান্তির এক আবেশ ছড়িয়ে দিল। চোখ বন্ধ করে জলের স্পর্শ উপভোগ করতে করতেই মনে পড়ল আমার মনের মানুষটার কথা।
ডিউক। নামটা উচ্চারণ করলেও একটা শিহরন জাগে দেহমনে। আমার এই পাগলা ভালবাসার কথা ডিউক কিন্তু জানে না। জীবনে অনেক পুরুষের সান্নিধ্যে এসেছি, বন্ধুত্ব করেছি, তবে সেসবই প্রয়োজনে; আজকের যে অবস্থানে আছি আমি সেটা মজবুত করার জন্যে। কিন্তু ওর কথা আলাদা। পুরুষমানুষকে তো আর চিনতে বাকি নেই, সবাই নারীদেহের লোভে কাতর। ভালবাসা জিনিসটা যে বলে-কয়ে আসে না, বরং হয়ে যায়, ওকে দেখেই প্রথম উপলব্ধি করি। আমার মনের গভীরের এই অনুভূতি ওকে কখনও জানাইনি, কারণ বুঝে গেছি ডিউক আমার মতই নিঃসঙ্গ একজন মানুষ, যাকে কখনও বাঁধনে জড়ানো যায় না। জড়াতে গেলেই ছিঁড়ে যাবে বাঁধন।
তাই আমার কোন আফসোস নেই। মানুষটার সঙ্গ যতদিনই পাই, সেটাই লাভ। মিডিয়ার অতিপ্রচারণায় সকলেই জানে আমি পুরুষ ছাড়া থাকতে পারি না, কিছুদিন পরপরই বদলানোর স্বভাব। আমি গায়ে মাখি না, খ্যাতির স্বার্থে কিছু কুখ্যাতি তো জুটবেই! সাধারণ মানুষ যেটা জানে না, তা হলো আমাকে বিয়ে করা পুরুষগুলোর সঙ্গে আমি নায়িকা না হয়ে যখন সাধারণ একজন বউ হতে চাই, তখনই ওরা আমার কাছে ধরা খেয়ে যায় অন্য কোন নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে। সারাদিন বাইরে নায়িকা হয়ে থাকি বলে ঘরে ফিরেও তাই থাকব? সুতরাং, ডিভোর্স ছাড়া পথ থাকে না। এটাও ঠিক, আমি নিঃসঙ্গ হলেও একা থাকতে পারি না। কাউকে পরম আদরে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছেটা উজ্জীবিতই থাকে।
ছোটবেলা থেকেই আমি ছেলেঘেঁষা। মেয়েরা যে বয়সে পড়লে বাড়ির ত্রি-সীমানার বাইরে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, তার …আগপর্যন্ত আমি ছেলেদের সঙ্গে কুস্তি লড়েছি, বাজি ধরে সাঁতার কেটেছি এবং জিতেছি, কাবাড়ি পর্যন্ত খেলেছি। অনেক ছেলের চেয়েও আমার গায়ের শক্তি বেশি ছিল। কিন্তু যৌবনের শুরুতে গৃহবন্দি হয়ে টিভিতে সিনেমা দেখতে দেখতে হঠাৎ করেই নায়িকা হবার স্বপ্ন জন্ম নিল আমার মনে। খুব ভাল নাচতাম, নাগিন ডান্স এবং অন্যান্য নাচ। যত কঠিন স্টেপিংই হোক, এক বা দুইবার দেখেই হুবহু নকল করতে পারতাম। আমার গায়ের রঙ ফর্সা এবং মুখচ্ছবিও সুন্দর, কিন্তু গ্রামীণ ছাপটা স্পষ্ট ছিল, সহজ বাংলায় যাকে বলে ‘গেঁয়ো’। গ্রামের এক বড় ভাই ঢাকাই সিনেমার – প্রোডাকশন্স টিমে কাজ করত, একদিন আমি তার চোখে পড়ে যাই, দেখে সে মুগ্ধ হয় আমার সৌন্দর্যে এবং আমার স্বপ্নটাকে সিরিয়াসলি নেয়ার অভিনয় করে। দুনিয়ার সবকিছু তখন আমার কাছে তুচ্ছ, তাই একদিন ওই লোকটাকে বিয়ে করে পালিয়ে গেলাম গ্রাম ছেড়ে। বিয়েটা গোপনই থাকল, নইলে কাজ পেতে সমস্যা হবে যে!
এরপর পাঁচ বছর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সুযোগ পেলাম মূল নায়িকা হবার। প্রযোজকের আবদার, তাকে বিয়ে করতে হবে, তবে গোপনে। কারণ বউ-বাচ্চা আছে তার। মেইন লিডে অভিনয় করার সুযোগ তো ফেলে দিতে পারি না, এরকম অফার ভাগ্যে আর জুটবে কি না সন্দেহ। তাই বিনা বাক্যব্যয়ে রাজি হলাম। আগের স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে -গিয়েছিল, এবার আবার বিয়ে। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কয়েকটা সিনেমা সুপারহিট হওয়ায় আমিও শিল্পীদের ‘এ লিস্টে’ উঠে গেলাম। শুরু হলো নামকরা সব ব্যবসায়ী, ক্রিকেটার ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সখ্যের সময়।
ওরা যে কত ‘ভাল মানুষ’ তা তো আমরা সকলেই জানি। অপব্যবহার করে করে আমার জীবন অতিষ্ঠ করে দিল সমাজের এই সম্মানিত আর ক্ষমতাবান অমানুষেরা। তারপরও আমি পিছিয়ে যাইনি, হাসিমুখে দাঁড়িয়েছি এসে লাইম লাইটে, কারণ এই জগৎ আমিই বেছে নিয়েছি। যাই হোক, এমনই এক খারাপ সময়ে আমি এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করে ফেলি, কিছুটা মাতাল ছিলাম সে-রাতে। ফলাফল, মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে কোর্ট-কাচারি দৌড়াদৌড়ি। একেবারে জেরবার অবস্থা! এই টানাহেঁচড়ায় যখন ভীষণ ক্লান্ত অনুভব করছি, একদিন আমার এক পুলিশ ‘বন্ধু’ এল একটা প্রস্তাব নিয়ে। ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে যেহেতু আমার যাতায়াত আছে, এলিট ক্লাবসহ, ওই ক্লাবেরই এক বিদেশি পৃষ্ঠপোষক গিলেরমো মোজির সঙ্গে মিশতে হবে, তার অনুগত হতে হবে। ধারণা করা হচ্ছে সে ভয়ঙ্কর এক অপরাধী সংগঠন ইউনিট-এক্সের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু কোন প্রমাণ নেই পুলিশের হাতে। তাই গিলেরমোর সঙ্গে মিশে ওদের সংগঠনের যে-কোন তথ্য পেলে সেসব জানাতে হবে ডিবি পুলিশকে। পারব তো?
পারব না মানে! অপরাধীর অপবাদ মাথায় নিয়ে রোজ রোজ কোর্ট-কাচারি ছোটার চাইতে এই গোয়েন্দাগিরির প্রস্তাব যথেষ্ট লোভনীয় বলে মনে হলো আমার কাছে। একমুহূর্তের সিদ্ধান্তে অপরাধী থেকে বনে গেলাম আমি আইনের সেবক। সব মামলা ক্লোড়। এক মাসের মধ্যেই আবিষ্কার করলাম আণ্ডারকাভার ইনফর্মার হিসেবে আমি বেশ দক্ষ। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইনফর্মেশন দিতে পেরেছি ডিবিকে। আবার অনেক কিছুই জানাইনি, অহেতুক নিজেকে তো বিপদে পড়তে দিতে পারি না!
মজা পেয়ে গেলাম গোয়েন্দাগিরির কাজে। সারাক্ষণ এক অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করে, কিন্তু তাতে ভয় না পেয়ে বরং উপভোগ করি। শুধু হাড়গিলেটার (গিলেরমো) শুটিং প্র্যাকটিস ছাড়া। ওই সময় প্রতিবার আমার মৃত্যুভয় কাজ করে, মনে হয় লোকটা আমার ব্যাপারে সব জেনে গেছে, তাই শেষ করে দেবে গুলি মেরে। এই আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দেয়, যখন দেখি সাদা পোশাকে দু’জন ডিবি অফিসার আমাকে অনুসরণ করে। কী এক বিরক্তিকর যন্ত্রণা! বোকাগুলো বোঝে না, ওদের উপস্থিতি ইউনিট-এক্সের লোকজনের চোখে পড়তে পারে। নাকি ওরা টের পেয়ে গেছে, অনেক তথ্য আমি গোপন করে ফেলি!
তারপর একদিন দেখলাম সেই মানুষটাকে।
ডিউক!
ঢাকার কুখ্যাত এক এলিট মস্তান এবং কন্ট্রাক্ট কিলার। ইউনিট-এক্স ওকে অ্যাসেট মনে করে নিজেদের দলে ভিড়াতে চায়। আরেকজন লোভী পুরুষের খপ্পরে পড়ে নিজের জীবনে জটিলতা আর বাড়াতে চাইনি। কিন্তু প্রথমে আমাকে লক্ষ্য না করা (যেটা আমি অসম্ভব মনে করতাম) এবং যখন তাকাল, তখন ওর প্রশংসাসূচক অথচ নির্লোভ দৃষ্টির ভাষা আমাকে অবাক আর অবশ করে দিল। এই প্রথম কোন পুরুষের দৃষ্টিতে কামনা দেখিনি, বদলে দেখেছি সৌন্দর্যের মুগ্ধতা। প্রেমে পড়ে গেলাম আমি ওর। যে-কেউ ভাববে, আমি বেহায়ার মত আচরণ করেছি ডিউকের সঙ্গে। কিন্তু ওকে পাবার জন্যে অতটুকু বেহায়াপনার দরকার ছিল। পরে যখন বুঝতে পেরেছি, ও কাছে টানে সবাইকে, কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না, তখন আর নিজের মনটাকে ওর কাছে মেলে ধরিনি। যতদিন ও আমাকে জড়িয়ে রাখবে, সেটাই আমার জীবনের, আমার প্রেমের সার্থকতা।
একরাতে আমার সবকথা বললাম ডিউককে, ভালবাসার কথা বাদ দিয়ে অবশ্য। এমনিতে ও বেশি কথা বলে না, সেদিনও মুখে কিছু বলেনি, শুধু শক্ত করে ওর বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। এরপর ঘটল অভূতপূর্ব ঘটনা। সাদা পোশাকের দুই পুলিশ উধাও হয়ে গেল, আর কখনও ওদেরকে আমার ছায়া মাড়াতে দেখিনি। ডিউক কি ওদের মেরে ফেলেছে? কিন্তু সেক্ষেত্রে তো ওদের ডিপার্টমেন্টে হুলস্থুল লেগে যেত। আরও দলবল জুটে যেত আমার পেছনে। অন্তত জিজ্ঞাসাবাদ তো করত!
কিন্তু, না, কেউ আমাকে বিরক্ত করেনি, তথ্যও চায়নি কোন। আমি নিজেই যেচে পড়ে ডিউককে জানিয়ে দিই সব হঠাৎ একবার মনে হয়েছিল, আচ্ছা, ডিউক আইনের লোক নয় তো? আণ্ডারকাভার এজেন্ট কিংবা স্পাই! তারপর চিন্তা- ভাবনার লাগাম টেনে ধরেছি-ও যাই হোক, কেয়ার করি না। অহেতুক কৌতূহল দেখাতে গিয়ে ওকে অকালে হারাতে চাই না!
শাওয়ারের নিচে চোখ বন্ধ করে দাঁড়ালে কত শত কল্পনাই না মাথায় ঘুরপাক খায়। নবটা ঘুরিয়ে জলের ধারা বন্ধ করে বিদেশি তোয়ালে দিয়ে গা মুছলাম, তারপর শাওয়ার-ক্যাপটা মাথা থেকে খুলে রোব গায়ে দিয়ে বেরিয়ে এলাম বাথরুম থেকে। সেই মুহূর্তে রিংটোন বেজে উঠল মোবাইল ফোনে। অপরিচিত নাম্বার। ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে পরিচয় দিল পুলিশ বলে, ইন্সপেক্টর তোয়াব খান। মনে হচ্ছিল বুকের ভেতর থেকে হৃৎপিণ্ডটা আমার লাফিয়ে বেরিয়ে আসবে। ভয় পেয়ে গেলাম ভীষণ। যদিও অফিসারের কণ্ঠ মোলায়েম।
‘ম্যাডাম, অসময়ে ফোন দেয়ার জন্যে দুঃখিত। আপনার কি ডিউক নামের কারও সঙ্গে পরিচয় আছে?’
প্রথমে স্বীকার করতে সাহস হলো না, তারপর ভয়টাকে তুচ্ছজ্ঞান করে বলেই ফেললাম, চিনি ওকে। বন্ধু হয়।
‘কেন যে আপনাদের মত শিল্পী মানুষেরা এসব আজেবাজে লোকের বন্ধু হয়, তা বুঝি না। যাই হোক, ডিউকের বিধ্বস্ত টয়োটা প্রিমিয়ো গাড়ি উদ্ধার করেছি আমরা। ভয়ঙ্কর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে ঘণ্টাখানেক আগে সেগুনবাগিচা রোডে, লাশ চেনা যায় না। আপনাকে একটু কষ্ট করে মর্গে আসতে হবে আগামীকাল, সনাক্ত করার জন্যে। ওই লোকের পরিচিত এমন কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না, সবগুলো তো ক্রিমিনাল, অপরাধ করে আর গর্তে লুকায়…’
ইন্সপেক্টর তোয়াব খানের কোন কথাই আর কানে ঢুকল না আমার, কখন লাইন কেটে গেছে বলতে পারব না। আমার ডিউক আর নেই-এ-কথা কিছুতেই মনকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না। কান্না আমার অপছন্দের জিনিস, দুঃখগুলোকেও আমি হাসি দিয়ে উড়িয়ে দিই। অথচ আমিই কি না এখন অঝোরে কাঁদছি। ওর দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া মৃতদেহ আমি দেখতে পারব না কিছুতেই, অত কষ্ট আমার সহ্য হবে না।
এবার আমার অন্য মোবাইলে একটা ছোট্ট করে রিংটোন বাজল, চোখ মুছতে মুছতে হাতে নিলাম ওটা। একটা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ। ডিউক পাঠিয়েছে এইমাত্র! ও লিখেছে: ‘আমি আপনার একজন ভক্ত। আপনার নতুন গানের ভিডিয়ো কবে রিলিজ পাবে?’
এই কোড আমার জানা আছে। এর মানে হলো, আমার কাছে অত্যন্ত সেনসিটিভ যে ভিডিয়ো ডিউক গচ্ছিত রেখেছিল, সেটা এখনই সেও করে দিতে হবে। আজ কারও সর্বনাশ হতে যাচ্ছে। ডিউক যাকে শিকার করে তার আর রক্ষে নেই!
কান্না রেখে মুখভরে হাসলাম আমি। ডিউক আমাকে খুব বিশ্বাস করে, জানে ওর দেয়া যে-কোন নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।
বড় রহস্যময় একজন পুরুষকে ভালবেসেছি আমি!
নিরাপদ দূরত্বে চারজন গানম্যান। দু’জনের হাতে রেমিংটন ৮৭০ মডেলের পাম্প-অ্যাকশন শটগান, অন্য দু’জনের কাছে গ্লক ১৭ হ্যাণ্ডগান। সবক’টার নল তাক করা আছে ডিউকের মাথার দিকে। একটাই যথেষ্ট ছিল, চার চারটে আগ্নেয়াস্ত্ৰ একটিমাত্র ফিল্ম টার্গেটের খুলিতে গুলি করতে প্রস্তুত- এমনটা বড্ড বেশি ফিল্মি দেখায়। কিন্তু কী আর করা, বাংলা সিনেমার ‘তোকে আমি দেখে নেব’ টাইপ ভিলেনের মত পায়ের ওপর পা তুলে সিংহাসনসদৃশ আসনে বসে থাকা বস্ লোকটার নির্দেশ অমান্য করে, সাধ্যি কোন্ চ্যালার! চুল স্থায়ীভাবে সুন্দর করার এতরকম পদ্ধতি থাকা সত্ত্বেও মাথার ওপরে বেঢপ এক উইগ এঁটে রেখেছে লোকটা। বিচিত্র রঙের পাথরের আঙটিভরা আঙুলগুলো দিয়ে হাঁটুর ওপরে ডুগডুগি বাজাচ্ছে, আর ঠাণ্ডা চোখে মাপছে তার সামনেই হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখা ঢাকার এক ‘পাতি মস্তান’ ডিউককে।
অনেক কষ্টে নিজের অপরাধের সাম্রাজ্যটাকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে বাসেত ভাই। আর হঠাৎ কোথাকার এই মস্তান হুট করে এসে তার লোকজনকে মেরে-ধরে বলে কি না ‘বাসেত ভাই’ যেন ফোন করে হলেও এর কাছে মাফ চায়! আবার তার কিছু পেডলারকে অনুসরণও করে। কত্ত বড় বুকের পাটা! যৌবনে কারওয়ান বাজারে চা বিক্রি করা বাসেত মোক্ষম সময়ে উপযুক্ত কিছু লোকের সান্নিধ্যে এসে নিজের ভেতরের নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে সহজেই পেয়ে যায় ওপরে ওঠার সিঁড়ি। গত সাত-আট বছরে তার যে নামডাক ছড়িয়েছে, এর পেছনে কত মানুষের রক্তঝরা ‘অবদান’ আছে, তা কি এই ডিউক শালার ব্যাটা জানে?
‘কী রে, মামু, মুখ বন্ধ ক্যান? আমি মাফ চামু, না তুই?’
মুচকি হেসে বলল ডিউক, ‘চারটা ভয়ঙ্কর অস্ত্রের মুখে মাফ চাইতে বলছ, ভয়ে তো আমারই সেটা করার কথা। কিন্তু এতে আবার ডিউকের মান-সম্মান থাকে না। এটা আমার বিজনেসের জন্যেও খারাপ। তারচেয়ে, যা করার করে ফেলো। হয় মরে যাই, নয় তো সসম্মানে বিদায় নিই। বল এখন তোমার কোর্টে, বাসেত!’
ডিউকের কথায় প্রচ্ছন্ন শাসানি আছে মনে করে ঝট্ করে এক পা আগে বাড়ল এক শটগানধারী, ওর প্রায় কানের কাছে এসে শব্দ করে শেল লোড করল।
‘আরে, দাঁড়া, এত জলদি শ্যাষ করা লাগব না,’ এক হাত তুলে চ্যালাকে নিরস্ত করল বাসেত ভাই। যদিও এই অচেনা যুবকের মুখে ‘ভাই’ সম্বোধনটা না শুনে খেপে আছে সে, তবুও শান্ত থাকার চেষ্টা করল। ‘এই রহম অবস্থায় বহুত লোক হাগামুতা শুরু কইরা দেয়, তুই করস ফাইজলামি। তোর পিছনে কোন জাউরা আছে, বল্ তো? মন্ত্রী, পুলিশের বড়কর্তা নাকি অন্য এলাকার গডফাদার? আমার লোকেগো পেছনে ঘুরঘুর করতাছস ক্যান? খালি একবার ক কার হুকুমে!’
তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হাসিটা ধরে রাখল ডিউক, সেই সঙ্গে মাথার ভেতরে চলছে হিসাব-নিকাশ। ঢাকার সর্বোত্তরের এই এলাকাটায় এখনও মানুষের লাশ গুম করে ফেলা যায় অনায়াসে। এমনই এক নির্জন অংশে এই বাড়িটা। ওর চোখ বেঁধে নিয়ে আসেনি চ্যালারা, তার মানে জীবিত ফেরার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আসার পথে খেয়াল করেছে আশপাশের কিছু বিল্ডিং এখনও আণ্ডার কন্সট্রাকশন। এই দালানটার পাঁচতলায় নিয়ে আসা হয়েছে ওকে। দামি আর বিলাসবহুল আসবাবে সুসজ্জিত ড্রইং রুম, একপাশের দেয়াল পুরু কাঁচের। এই ঘরে উপস্থিত সশস্ত্র চারজনের মধ্যে একজনকেই বেশি বিপজ্জনক মনে হচ্ছে, যে বসের ইশারা পাওয়ার পরের সেকেণ্ডের মধ্যে গুলি করে বসবে। বাকি তিনজনের মুখে হালকা ঘাম জমেছে, বোধহয় কিছুটা নার্ভাস, গোলাগুলি শুরু হলে ট্রিগার চাপতে সময় নেবে। তার মানে এরা কেউই ট্রেনিংপ্রাপ্ত নয়। ধরে নেয়া যায়, গডফাদার বাসেত ভাইয়ের কাছেও লুকানো কোন অস্ত্র আছে। মনে মনে টার্গেট ঠিক করে ফেলল ডিউক। ওকে সার্চ করে পাওয়া একমাত্র অস্ত্র সুইস নাইফটা বাসেত ভাইয়ের হাতে। ভাঁজ করা একটা ফলা বের করে চোখের সামনে নাড়ছে। সুযোগমত টার্গেটকে কাবু করে বাকিদের সঙ্গে গোলাগুলির একটা ঝুঁকি নিতে হবে ডিউককে, অবশ্য তার দরকার না-ও হতে পারে। যদি…
‘কথা কস না ক্যান, হোগার পোলা? এই লাইনে আমরা সকলেই মরণরে কম ভয় পাই, তাই ঠুস কইরা গুলি ভইরা দিমু মনে কইরা ফূর্তিতে আছস, কিন্তু টরচার করলে আবার বাপ-বাপ কইরা ফটফট করবি। কথা ক, নাইলে তর চাকু দিয়াই তর শরীলের সব একটা একটা কইরা কাটুম, চুদির ভাই।’ ডিউকের নীরবতা ক্রমশ রাগ, চড়াচ্ছে গডফাদারের।
আরও হুমকি-ধমকি দিতে যাচ্ছিল বাসেত ভাই, এমন সময় টুংটুং শব্দে বেজে উঠল তার আইফোন। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ এসেছে। হাঁ করা মুখ বন্ধ করে ফোনের স্ক্রিনে তাকাল সে, তারপর ঝট্ করে সোজা হয়ে বসল। ঝড়ের বেগে ফোন আনলক করে অ্যাপটা খুলল, স্ক্রল করে কী যেন দেখছে। ঘরের উজ্জ্বল আলোয় তার মুখটা রক্তশূন্য হতে দেখল তার সাগরেদরা আর বন্দি ডিউক।
অনেকক্ষণ পর মোবাইলের পর্দা থেকে দৃষ্টি সরাল বাসেত ভাই। চেহারায় রক্ত ফিরে আসছে আবার। ডিউককে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘এসব দেখায়া জানে বাইচা যাবি, ভাবছস? কার নম্বর এইটা? কে পাঠাইছে? বল, শুয়ারের বাচ্চা!’
মাথার পেছনে দু’হাত বেঁধে বসে থাকা ডিউক অসহায় ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল। ‘বাসেত, তুমি কী বলছ আমার কোন ধারণাই নেই। এখন কথা বাড়িয়ে কী লাভ? তারচেয়ে হয় মারো কিংবা ছাড়ো।’ মুখের কথায় ও ভাবভঙ্গিতে ব্লাফ দিলেও মনে মনে শিবা সুস্মিতাকে ধন্যবাদ দিল একদম সঠিক মুহূর্তে বাসেতের মোবাইলে মেসেজ পাঠানোর জন্যে। এলিট ক্লাবের প্রাইভেট ফ্লোরে পরিচিত হবার পর থেকেই মেয়েটা ডিউককে সাহায্য করতে সর্বদা এক পায়ে খাড়া হয়ে থাকে।
সুইস নাইফ হাতে ঝট্ করে উঠে দাঁড়াল বাসেত ভাই, জানে এখন আর সে ডিউককে খুন করতে পারবে না। তার হাত বাঁধা পড়ে গেছে। কিন্তু মনের সুখ মিটিয়ে পেটাতে তো পারবে! পাঁচ গুণ্ডার সঙ্গে কিছুতেই একা পেরে উঠবে না এই ছোকরা মস্তান। এর গ্রুপের অন্য মস্তানরা যদি ঝামেলা করে, সে পরে দেখা যাবে। ‘অই, অস্ত্র ফালা, শক্ত কইরা ধর তরা এই শালারে!’
ডিউক বুঝে গেছে, ওকে জানে মারার পরিকল্পনা বাদ দিয়েছে গডফাদার। তার লোকেরা এমুহূর্তে আগ্নেয়াস্ত্র হাতছাড়া করতে ইতস্তত করছে। রাগের মাথায় ছুরিটা নিয়ে কয়েক কদম এগিয়ে এল বাসেত ভাই, ধরেই নিয়েছে সে বন্দির কাছে পৌঁছানোর আগেই তার চারজন গুণ্ডা ওকে ধরে ফেলবে।
কিন্তু তা নয়, বিদ্যুৎ খেলে গেল ডিউকের শরীরে। বাসেত ভাই আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের পক্ষে ইহজনমে ওর ফাইটিং স্কিলের একভাগ ট্রেনিং পাওয়াও সম্ভব নয়। তাই অনায়াসেই গুণ্ডাসর্দারের কাছ থেকে নিজের সুইস নাইফটা কেড়ে নিল ডিউক। খচাখচ দুটো স্ট্যাব করল লোকটার পেটে। বিকট আর্তনাদ করে পেট চেপে বসে পড়ল সে। এখনি মরবে না। এবার তার সাগরেদদের পালা। চারজনই অস্ত্র ত্যাগ করেছে, একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়বে ওর ওপরে। একটুও দয়া দেখাল না ডিউক। পরবর্তী কয়েক মিনিট মৌমাছির মত উড়ে বেড়াল ঘরময়, মনের সুখে পেটাতে শুরু করল চার ষণ্ডাকে। তারপর ক্ষান্ত হলো তাদেরকে মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে।
এরপর আহত গডফাদারের কাছে গিয়ে রক্তাক্ত ফলার ছুরিটা হাতে নিল ও, ঘষে ঘষে মুছল তার দামি পোশাকে। ফলা এবার তার গলায় ঠেকাতেই কেঁপে উঠল বাসেত ভাই। প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরে উঠে বলল, ‘সোরি, ডিউক। এমনটা আর হইব না। আ-আমি পুলিশের হাতে ধরা খাইতে চাই না। আমারে বাঁচাও, পিলিয!’
‘বুঝতে পেরেছি, তুমি হাসপাতালে না গিয়ে নিজের মেডিকেল স্টাফদের ডাকতে চাইছ।’ হাত থেকে ছিটকে পড়া মোবাইল ফোন মেঝে থেকে তুলে বাসেত ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিল ডিউক, তারপর মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘ভেবো না তোমার লোকজন বীরত্বের সঙ্গে আমাকে এখানে ধরে নিয়ে এসেছে। ডিউককে আটক করা ওদের মত ছিচকে সন্ত্রাসীদের কম্মো নয়। আসলে আমি নিজেই ধরা দিয়েছি, কারণ তোমার একটা সাহায্য আমার দরকার। এমপি সালেক রহমানের ছেলে জিসান রেমানের সঙ্গে আমার একটা সাক্ষাৎ করিয়ে দেবে তুমি। আমি জানি, সে তোমার ড্রাগস বিজনেসের একজন স্টেইকহোল্ডার।
ফ্যাল ফ্যাল করে চোখ মেলে ওকে দেখছে বাসেত ভাই। একটু আগে তার চারপাশে যে ঝড় বয়ে গেছে, তার সঙ্গে সে মোটেও পরিচিত নয়। কাঁপা-কাঁপা যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে বলল, ‘কী বলতেছ আমি বুঝতে পারতেছি না, ওই নামের কাউরে আমি চিনিই না।’
হতাশ একটা ভঙ্গি করল ডিউক, মোবাইলটা কেড়ে নিল বাসেত ভাইয়ের হাত থেকে। ‘আমার জন্যে ওই লোকের সঙ্গে দেখা করার হাজারটা পথ খোলা, বাসেত। কিন্তু তোমার অন্য কোন পথ নেই। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তোমার মৃত্যু হবে, যদি সময়মত চিকিৎসা না করা হয়। আর কোনভাবে বেঁচে গেলেও হোয়াটসঅ্যাপের ওই অডিয়ো-ভিডিয়ো কন্টেন্ট কিন্তু ঠিকই পৌঁছে যাবে পুলিশের কাছে। সুতরাং, তোমার পরবর্তী শব্দগুলো সাবধানে বেছে নিয়ো।’
বাপেরও ওপরে বাপ থাকে। ক্ষমতা আর কানেকশনের জোরে বাসেত ভাই চুটিয়ে পরকীয়া প্রেম করছিল পুলিশেরই ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার স্ত্রীর সঙ্গে। তাদের দু’জনের কিছু ছবি আর ভিডিয়ো হোয়াটসঅ্যাপে পেয়েই মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। এই কন্টেন্ট ভাইরাল হলে তার গডফাদারগিরি তো শেষই, দেশ ছেড়েও পালাতে হবে। এখন থেকে ডিউককে সমঝে না চলে বাসেত ভাইয়ের আর কোন উপায় নেই!
পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে মাথা নাড়ল গডফাদার। ‘ঠিক আছে, আ-আমি ব্যবস্থা করুম, এখন আমারে বাঁচতে দেও, ভাই!’
মোবাইলটা তার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল ডিউক। ‘মনে রেখ, তোমার রাজ্যে তুমিই রাজা। আমার কাজ আমাকে নির্বিঘ্নে করতে দিলেই ভাল, নইলে কী পরিণতি হবে সেটা নিশ্চয়ই ভালভাবেই আঁচ করতে পারছ এখন।’
আহত ক্রিমিনাল সর্দারকে তার নিজস্ব মেডিকেল টিমকে ফোন করার সুযোগ দিয়ে অকুস্থল থেকে বের হয়ে গেল ডিউক, দ্রুত ছাড়তে হবে এই এলাকা।
কিন্তু যে গলির ভেতরে রেখে গেছে ওর প্রিমিয়ো গাড়ি, সে জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে। বাসেতের ছেলেরা অথবা কোন পেশাদার গাড়িচোর লোপাট করে দিয়েছে ওর গাড়িটা!
গলি থেকে বেরিয়ে হনহন করে হেঁটে চলল ডিউক পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে উবারের একটা গাড়ি ডেকে ফিরে চলল নিজের ফ্ল্যাটের উদ্দেশে। খাট্টা হয়ে গেছে ওর মেজাজ। নিজেকে বলল, বাসেত যেহেতু তার ছেলেদের দিয়ে ওকে তার আস্তানায় নিয়ে গেছে, কাজেই নতুন গাড়ি কিনে দেয়ার দায়িত্বও ড্রাগের কারবারী বাসেতের। এর একটু এদিক-ওদিক হলে খবর আছে তার।
এসব জায়গা সুখের সমুদ্র। সবাই আনন্দ-বিনোদনে গা ভাসাতে আসে, কারও দুঃখ শেয়ার করতে নয়।
গুলশানের এলিট ক্লাবে বসে এই কথাগুলোই বলেছিল ওর বর্তমান ক্লায়েন্ট আদনান সিরাজ, যাঁর একমাত্র মেয়ে রানিয়া এখন রয়েছে এক পথভ্রষ্ট এমপি-পুত্রের কব্জায়, যার নাম জিসান রেমান। পিতার নাম অনুযায়ী তারও নামের শেষটা রহমান হওয়ার কথা, কিন্তু আজকাল নাম সংক্ষিপ্ত ও পশ্চিমীকরণ চলছে, তাই রহমান হয়ে গেছে রেমান। এই জিসান রেমানকে ফলো করতে গিয়েই আদনান সিরাজের কথা মনে পড়ে গেল ডিউকের। ওই ক্লাবটা থেকেই তবে শুরু করা যাক।
একমাত্র সন্তানকে জীবিত অবস্থাতেই হারিয়ে ফেলা একজন বাবার জন্যে খুবই বেদনাদায়ক, এটা ভালভাবেই উপলব্ধি করে বর্তমানে মস্তান ডিউকের পরিচয়ে অপরাধজগতে বিচরণকারী বিসিআই-রত্ন মাসুদ রানা। রানা এজেন্সির ক্লায়েন্ট হলে হয়তো কেসটা নিয়েই নিত। তখন ওপরমহলের কিছু সুতো টেনে এমপি মহোদয়ের সঙ্গে ব্যাপারটা মীমাংসা করা যেত খুনখারাপি এড়িয়ে গিয়ে। কিন্তু এটা ডিউকের কেস যে কি না মায়াদয়াহীন এক গুণ্ডা, টাকার বিনিময়ে ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করতে পারে।
মাসুদ রানা ওর জীবনে বহু মানুষকে খুন করেছে, তা সত্য। কিন্তু তারা সবাই হিংস্র অমানুষ ছিল। পেশার খাতিরে, দেশ ও মানবতার প্রয়োজনে কিংবা আত্মরক্ষার তাগিদে খুনগুলো করতে হয়েছে ওকে। কিন্তু ডিউক রূপে যখন ঢাকার বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন নিজের ওজন বজায় রাখতে হলেও এধরনের অপ্রিয় কিছু কাজ ওকে হাতে নিতে হয়, নইলে ওর নাম ছড়াবে না, ইউনিট এক্স-এর মত দেশবিরোধী সিণ্ডিকেট আর আণ্ডারগ্রাউণ্ডের গোপন ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশনগুলোও ডিউককে খুঁজবে না। ফলে সহজে তাদের নির্মূলও করা যাবে না। তাই কিছু কাজ হাতে নিতেই হয় ‘কুখ্যাতি’ ছড়ানোর স্বার্থে। তবে সুবিধা একটাই, অপেক্ষাকৃত নিরীহ কাউকে মারার সুপারি পেলে ডিউক ওটা এড়িয়ে যায়, অর্ধেক পেমেন্টও মেরে দেয়। কার সাহস আছে ওকে কিছু বলে। এই বদনাম তো ওর অনেক আগে থেকেই!
কয়েক দিন চিন্তা-ভাবনা করে আদনান সিরাজকে সাহায্য করবে বলে মনস্থির করেছে রানা অর্থাৎ ডিউক। উদ্ধার করে আনবে তাঁর মেয়েকে। তবে দুটো অপশন দিয়েছে সিরাজকে। প্রথমটাতে, এমপি-পুত্র জিসান রেমানের মৃত্যু। মেয়ের সঙ্গে যেসব নিকৃষ্ট আচরণ করা হয়েছে তার শাস্তি হিসেবে এটাই চান আদনান সিরাজ। এতে যদি তাঁর মেয়ে রানিয়া পুরোপুরি মুক্ত হতে পারে, তবে তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেবেন সুচিকিৎসা ও উচ্চশিক্ষার জন্যে। এ-কাজে ডিউককে ব্ল্যাঙ্ক চেক দিতেও আপত্তি নেই তাঁর।
প্রথম অপশনে রানা আরও বলেছিল, জিসান খুন হলে ব্যাপক তোলপাড় হবে। আইন ও মিডিয়া দুটোই হন্যে হয়ে খুঁজবে অপরাধীকে, এতে দীর্ঘদিনের জন্যে বিদেশেও পালিয়ে থাকতে হতে পারে ডিউককে। আইন আদনান সিরাজ পর্যন্তও পৌঁছে যেতে পারে, যদিও নিজের কাজে কোন খুঁত রাখে না ও। ওদিকে দুই নম্বর অপশন হচ্ছে কোনভাবে শিকারকে যদি কোন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে বিপদে ফেলা যায়, সেক্ষেত্রে অনেক সময় তারা নতি স্বীকার করে নেয় বাধ্য হয়ে। এ-কাজে সময়টা একটু বেশি লাগে এ-ই যা। এখন পুরো বিষয়টা আদনান সিরাজের বেছে নেয়ার ওপরে নির্ভর করে। অপশন এ অথবা বি।
তাঁর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় বসে থাকেনি অবশ্য রানা, ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছিল সার্ভেইল্যান্স। এলিট ক্লাব থেকেই কয়েকদিন হলো অনুসরণ করছে রেমানকে। ছেলেটার ডেইলি রুটিন এখন ওর মুখস্থ। ব্যবসা, বন্ধুবান্ধব, নারী’ ও নেশায় মত্ত ভোগবিলাসের জীবন তার, সারা সপ্তাহ অফিস শেষে ঘুরতে থাকে সে বিভিন্ন ক্লাবে আর হোটেলে। ছেলেবন্ধুদের সংখ্যা অপরিবর্তিত থাকলেও মেয়েবন্ধুর সংখ্যা বাড়ে-কমে। চেহারাও বদলে যায়, যখন ব্যবসায়ী বন্ধু বা ক্লায়েন্টরা সঙ্গে থাকে। তবে এদের মধ্যে রানিয়া নেই। বেশিরভাগ সময় মেয়েটা রেমানের ফ্ল্যাটেই থাকে, হয়তো নেশায় ডুবে। মাঝেমধ্যে বেরোয়, শপিং-টপিং করে। সপ্তাহে অন্তত একবার পার্টি হয় সেই ফ্ল্যাটে। সাউণ্ডপ্রুফ ব্যবস্থা থাকায় হইহুল্লোড়র শব্দ খুব একটা বাইরে আসে না। তবে অজানা-অচেনাদের আনাগোনায় প্রতিবেশী ফ্ল্যাটবাসীরা কেউ তেমন অভিযোগও করে না। তাতে যে ফল আসবে না, বরং ক্ষতি হবে, এটা সবাই বুঝে গেছে।
জিসান রেমানকে বন্ধুবান্ধব ছাড়া আরও ঘিরে থাকে তিন শক্তপোক্ত বডিগার্ড, অস্ত্র হাতে। লাইসেন্স আছে নিশ্চয়ই। তবুও ডিউক দেখেছে, রেমানকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া বেশ সহজ, অন্তত ওর জন্যে। আর তাই ছেলেটাকে একটা সুযোগ দেবে বলে ঠিক করেছে ও। সামনা-সামনি কথা বলতে হবে। খোঁজখবর নিয়ে জেনেছে, জিসান বাসেত ভাই নামের এক মাদক ব্যবসায়ী গডফাদারের বেশ ঘনিষ্ঠ এবং এক্সক্লুসিভ ক্লায়েন্ট। সেই সঙ্গে ব্যবসার সহযোগী হিসেবে আপার ক্লাসে সে-ই সমস্ত ড্রাগস সাপ্লাই দেয় বিভিন্ন ইভেন্টে। এলিট ক্লাবে জিসান যদিও মদ ছাড়া আর কিছু নেয় না ক্লাবের কঠিন সব রুলসের কারণে, তবে নিজের ফ্ল্যাটগুলোতে কিংবা কোন ফাঁকা রিসোর্টে নেশাদ্রব্যের কোন বাছবিচার থাকে না। কথা বলতে হলে জিসানকে সোবার থাকতে হবে, মাতালকে কিছু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তো লাভ নেই! আর তাই রানা ঠিক করেছে, তার ড্রাগ সাপ্লাইয়ার বন্ধু বাসেত ভাইয়ের মাধ্যমে মিটিংটা ফিক্স করতে হবে।
সিদ্ধান্তটা নিয়ে পরদিন থেকেই বাসেত গ্রুপের ড্রাগ পেডলারদের অনুসরণ করা শুরু করে ও। ছদ্মবেশটা বেশ সহজ ছিল- হেলমেট পরা উবার রাইড সার্ভিসের রাইডার। এ-কাজে ওর সঙ্গী পুরনো ক্লাসিক মডেলের সুজুকি জিএন১২৫ ক্রুজার মোটরবাইক। দু’ শ’ তেতাল্লিশ পাউণ্ড ওজনের এই বাইকটা খুব যে স্পিড তুলতে পারে এমন নয়, ঘণ্টায় মাত্র ১০০ কি.মি.। কিন্তু যে-কোন ধরনের রাস্তায় স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারে আর রাইডিংও খুব আরামদায়ক। আবার রেট্রো লুকটা প্রবল বলে লোকজন তেমন নজর দেয় না। মাসুদ রানার নিজস্ব বাইকশালায় বিভিন্ন ব্র্যাণ্ড এবং মডেলের ভিনটেজ ও আধুনিক মোটরবাইকের অভাব নেই, তারই মধ্য থেকে পছন্দ করে এই সুজুকিটা চালাচ্ছে। তবে বের করার আগে নিজের হাতে গ্রিজিং করে নিয়েছিল স্মুথ রানের জন্যে। ও, হ্যাঁ, দেশে ওর অনুপস্থিতির সময়ে মোটর- সংগ্রহশালা দেখাশোনা করে ইঞ্জিনিয়ার সেতু।
এদিকে রাইড শেয়ারিঙের সুবিধা হচ্ছে, ঢাকার রাস্তায় যত্রতত্র দাঁড়ানো যায়, হেলমেট পরা থাকলেও কেউ সন্দেহ করে না বা দ্বিতীয়বার তাকায় না। ফলটা ভালই এল, তিন দিনের মাথায় এক পেডলারকে অনুসরণ করতে গিয়ে তার সাপ্লাইয়ারের খোঁজ পেল আর সেই লোকের সূত্র ধরে পৌঁছে গিয়েছিল ওদেরই এক ওয়্যারহাউসে। এবং এরপর প্ল্যান মোতাবেক ইচ্ছে করেই ধরা খেয়েছে বাসেত বাহিনীর হাতে।
.
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই গডফাদারের বিপজ্জনক এলাকা ছেড়ে দূরে সরে এল রানা। ক’দিন অদৃশ্য থেকে আবার নক করতে হবে বাসেতকে, ততদিনে লোকটা একটু সুস্থ হোক। ছুরির আঘাত যদিও অত মারাত্মক নয়, সেরে উঠতে বেশি সময় নেবে না।
শার্টের ভেতরের পকেটে মোবাইলটা ভাইব্রেট করতেই ওটা বের করে কানে তুলল মাসুদ রানা। শাপলা ব্র্যাণ্ডের ডিভাইস। দেশীয় ব্র্যাণ্ড হিসেবে এরই মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে নিজস্ব প্রযুক্তিতে স্থানীয় ফ্যাক্টরিতে তৈরি এই মোবাইল ফোন। তবে খালি চোখে অন্য দশজন ব্যবহারকারীর শাপলা মোবাইলের সঙ্গে তেমন কোন পার্থক্য দেখা না গেলেও আসলে ওর ফোন একেবারেই কাস্টম ফিচারসমৃদ্ধ। বিসিআই-এর টেক টিম ওটার ইন্টারফেস ঠিক রেখে নতুনভাবে তৈরি করেছে অপারেটিং সিস্টেম। যেটা আসলে আইফোনের মতই সিকিওর্ড। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন সব অপশন যা সাধারণ ফোনে নেই। যেমন: এর আইএমইআই নাম্বার আনট্রেসেবল্। আছে সিম ফিঙের ব্যবস্থা। অর্থাৎ, ভিন্ন ভিন্ন নাম্বার দেখা যাবে প্রতিটি কলে। তবে সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে জিপিএস এনকোডার। ছোট্ট একটা চিপ, কলের অপরপ্রান্তের ব্যক্তিটিকে সবসময় কলারের ভুল লোকেশন দেখাবে, যদি সে ট্রেস করতে চায়। টেক টিমের এই আবিষ্কারের ফলে বিসিআই এজেন্টদের মৃত্যুহার অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। তারাও নিরাপদে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারে ট্র্যাকিঙের ভয় ছাড়াই।
এই মুহূর্তে স্ক্রিনে ফুটে উঠেছে আদনান সিরাজের ফোনের নাম্বার। ডিউকের কল যখন রিসিভ করবেন তিনি, তখন ভিন্ন নাম্বার দেখবেন, এটাই সিম স্পুফিঙের সুবিধা। মানুষটা হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুত বলে উঠল রানা, ‘কারও নাম নেবার দরকার নেই। মন খুলে গল্পও করতে হবে না। শুধু সিদ্ধান্ত নিন। অপশন এ অর অপশন বি।’
ওপাশ থেকে ভারী কণ্ঠস্বর শুনতে পেল ও। ‘আই ওয়ান্ট হোয়াট’স বেস্ট ফর মাই চাইল্ড। আই’ল লেট ইউ ডিসাইড। আই হ্যাভ ফেইথ ইন ইউ,’ বলেই কল কেটে দিলেন আদনান সিরাজ, শেষের দিকে তিনি কি কেঁদে ফেললেন?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রানা। সেই চিরাচরিত গল্প। প্রেম করে বিয়ে দুই পেশাজীবী নরনারীর। অর্থবিত্তের মোহে আর সময়ের ফেরে দু’জনেই বহির্মুখী। একমাত্র কন্যা শিশু বেড়ে ওঠে আয়া-বুয়া আর ড্রাইভারদের সান্নিধ্যে। স্বামী-স্ত্রীর দূরত্ব এতই বেড়ে যায়, একসময় অবধারিতভাবেই ঘনিষ্ঠ কলিগের প্রশংসায় সিক্ত স্ত্রী ডিভোর্স দিয়ে বিয়ে করেন অজানা সুখের আশায়। মেয়েকেও সঙ্গে নিতে চান, কিন্তু পিতার জেদ আর অহঙ্কার অপত্যস্নেহের রূপ ধরে সামনে আসে, বিপুল অর্থের খরচে আইনের মারপ্যাচে শিশুটি পিতার কাছেই থেকে যায়।
পিতৃত্বের দৌড় এটুকুই। আরও সম্পদ আর ক্ষমতা চাই। এটাই তাঁর জীবনের সার্থকতা। ওদিকে নামীদামি স্কুলে পড়েও মেয়েটা হয়ে ওঠে জেদি, অসামাজিক ও নিঃসঙ্গ। ছোট্ট মনে কখনও আত্মহত্যার মত চিন্তারও যে উদ্রেক হয়নি, তা-ও বলা যাবে না। এইচ.এস.সি. পাশ করার পর কন্যা যখন নিজেকে ম্যাচিউর্ড ভাবতে শুরু করে, তখনই নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি নিজেই নিয়ে নেয়। অভিভাবকরূপী বুয়ার অবাধ্য হওয়া, বাবাকে এড়িয়ে চলা, যখন খুশি বাড়ির বাইরে যাওয়া, পড়াশোনায় আলসেমি আর অনির্ধারিত লক্ষ্য নিয়েই চলতে থাকে একাকী জীবন। তারপর কোন এক ভুল মুহূর্তে ভুল সঙ্গীর আহ্বানে নাগালে আসে ড্রাগস। কালক্রমে পরিচয় হয় জিসান রেমানের মত আলফা মেইলের সঙ্গে। মাত্র সতেরো বছর বয়সে তার কাছেই কুমারিত্ব হারায় রানিয়া সিরাজ, জিসান হয়ে ওঠে ওর মুক্তিদাতা স্বপ্নপুরুষ। অপহরণকারীর প্রেমে মজে যায় অপহৃতা। সাইকোলজির টার্মে যাকে বলে: স্টকহোম সিনড্রোম।
একমাত্র মেয়ের জীবন এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, এই সময় পিতৃস্নেহ পুনরুজ্জীবিত হয়েছে আদনান সিরাজের ভেতরে। যে-কোন মূল্যে মেয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চান, রানিয়া তাঁকে ঘৃণা করুক আর না-ই করুক।
রানিয়ার এই স্টকহোম সিনড্রোম নিয়েই চিন্তিত রানা। জিসানের মৃত্যু হলে ধাক্কাটা সে না-ও সামলে নিতে পারে, ফলাফল আত্মহত্যা। আর জীবিত জিসান ওকে যদি চিরদিনের জন্য ত্যাগ করে, তা হলেও আরেকরকম ধাক্কা খাবে মেয়েটা। জীবনের একমাত্র আশ্রয় ভাবা পুরুষটিও যখন পরিত্যাগ করবে, তখনও রানিয়া আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে। জিসান যদি ওকে যত্ন আর ভালবাসায় নিজের কাছে রাখত, তবে রানা নিজেই আদনান সিরাজের বিরোধিতা করত। কিন্তু জিসান নিজেও রানিয়াকে নরকের মধ্যেই রেখেছে, নেশার ঘোরে সেটা বুঝতে পারছে না ও। আর তাই, রানিয়াকে উদ্ধার করবে বলেই সঙ্কল্প করেছে রানা। কীভাবে, এখনও জানে না। আগের কাজ আগে। জিসানের সঙ্গে বসতে হবে ওকে।
মাদকের গডফাদার বাসেতকে নিজের কোন মোবাইল নম্বর দিয়ে আসেনি ও। তাই দু’দিন পর নিজেই ফোন দিল। ওর কন্ঠ শুনে মনে হলো কেঁপে উঠল বাসেত। মিনমিন করে বলল, ‘আমি নিজেই তোমারে আইজ কল দিতাম, ডিউক। অনেক কষ্টে জিসান রেমানরে রাজি করাইসি। সে দেখা করব। তবে তার দেওয়া ঠিকানায়। ডায়াবলো রেসটুরেনটা চিনো? ওইখানে। আগামী কাইল রাত একটায় যাইতে বলসে, একলা,’ একটানা বলে থামল সে।
‘গুড জব, বাসেত, ধন্যবাদ।’
ওকে ধন্যবাদ দিতে শুনে একটু হকচকিয়ে গেল বাসেত। আদব-কায়দা জানে, শিক্ষিত্ মস্তান! একটা কথা মনে পড়তেই বলে উঠল, ‘আমি কিন্তু থাকতে পারুম না কাইল, আইজ রাইতেই ঢাকার বাইরে,’ এটুকু বলেই থেমে গেল সে, কারণ তার কথা শুরু হবার আগেই লাইন কেটে দিয়েছে ডিউক।
জিসানের ডিয়ারো রেস্তোরাঁ অ্যাও বারটা শ্যামলীর রিং রোডে। রাত একটায় রাস্তা প্রায় নির্জন, বারের সামনের রাস্তা প্রায়ান্ধকার। বেশকিছু গাছপালা আছে এখানে-সেখানে, স্ট্রিটলাইট দু’তিনটে নষ্ট থাকায় অন্ধকার জমে আছে বেশ। বরাবরের মতই নিজের জিএন১২৫ মোটরবাইকটাকে অন্য গলিতে রেখে ডিয়ারোতে ঢুকল রানা। গেটের মুখে দাঁড়ানো ইউনিফর্ম পরা পেশিবহুল বাউন্সার নিঃশব্দে ওকে ভেতরে প্রবেশ করতে দিল। বেশ প্রশস্ত ফ্লোর, অবশ্য বেশিরভাগ চেয়ার-টেবিল গুছিয়ে ফেলা হয়েছে, তাই হয়তো জায়গাটা বেশি বড় লাগছে। কামরার অপর প্রান্তে জিসানের এক বডিগার্ড কাউন্টারের ওপাশে বারটেণ্ডারের ভূমিকায়, কাউন্টারের নিচেই কোথাও শটগান আছে ধারণা করল ও।
ডানপাশে তাকাতেই দেখতে পেল জিসানকে। একমাত্র পাতা টেবিলে পা তুলে দিয়ে আরাম করে চেয়ারে বসে আছে সে। টেবিলের ওপরে উইস্কির বোতল আর গ্লাস। একদৃষ্টিতে ডিউককে দেখছে আর মাপছে যুবক। আর যাই হোক, ছ’ফুট দীর্ঘ মুখভর্তি চাপদাড়িওয়ালা কোন সুদর্শন যুবককে আশা করেনি রানা। গড়পড়তা বাঙালি পুরুষের চেয়ে একটু বেশিই লম্বা জিসান। তবে চেহারায় চাপা একটা নিষ্ঠুরতাও লক্ষণীয়।
মাপা, দীর্ঘ পা ফেলে জিসানের টেবিলের সামনে চলে এল রানা। ম্যাজিশিয়ানের মত হুট করে ওর পাশে উদয় হলো দ্বিতীয় বডিগার্ড, দক্ষ হাতে সার্চ করল ওর সারাশরীর 1 যথারীতি শুধু সুইস নাইফটাই পাওয়া গেল। নিজের পকেটে চালান করে দিতে যাচ্ছিল লোকটা, কিন্তু ইশারা পেতেই নাইফটা বসের হাতে দিয়ে দিল। তারপর একটা চেয়ার টেনে দিল অতিথির বসার জন্যে।
জিসান রেমানের মুখোমুখি বসতে গিয়ে চট্ করে চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে নিল মাসুদ রানা। আর কেউ নেই ওরা তিনজন ছাড়া। তৃতীয় বডিগার্ডটা কোথায়?
প্রথম মুখ খুলল জিসানই। ‘আমার বন্ধু বাসেতকে ভালই ভয় দেখিয়ে দিয়েছ তুমি। আহত শরীর নিয়েই ঢাকার বাইরে ভাগছে আজ রাতে। হা-হা-হা! তোমার কথা আগে শুনিনি কেন? কে তুমি, ডিউক? আমার কাছে কী?’
এমপি- -পুত্রের চোখ থেকে দৃষ্টি সরাল না রানা, যতক্ষণ না যুবকের চোখের পাতা কেঁপে উঠতে দেখল। তারপর বলল, ‘তোমার কোনরকম ক্ষতি করার ইচ্ছে আমার নেই। আমার ধারণা ভায়োলেন্স দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। মিউচুয়ালি মিটিয়ে ফেলাই ভাল। তাই সোজাসুজিই বলছি: তুমি রানিয়া সিরাজকে ছেড়ে দেবে, বিনা শর্তে এবং সসম্মানে, আজীবনের জন্যে।’
‘ওয়াও,’ বলে হাততালি দেয়া শুরু করল জিসান রেমান, হাসছে। ‘ডিউক তা হলে ভাড়াটে গুণ্ডা! নাকি কিলার? এই সুইস নাইফটা দিয়ে মানুষ খুন করো? কীভাবে? রগ কেটে দাও নাকি? রগ-কাটা কিলার, হা-হা-হা!’
সুইস নাইফের একটা ফলা বের করে চোখের সামনে নাচাল সে, তারপর হঠাৎ ওর দিকে হাতটা বাড়িয়ে খোঁচা দেয়ার ভঙ্গি করল। রানা একচুলও নড়ে ওঠেনি দেখে প্রশংসা ঝরল কণ্ঠে, ‘বাহ্, কঠিন নার্ভ তোমার, আই গিভ ইউ দ্যাট! বাট, ডিউক, আমি দুঃখিত। রানিয়া আমার জীবন। বাবা সিরাজের লেলিয়ে দেয়া গুণ্ডার ভয়ে আমি ওকে ছেড়ে দেব, এটা কীভাবে সম্ভব, বল তো?’
জিসানের বিদ্রূপে মোটেও বিচলিত দেখাল না রানাকে। শান্ত কণ্ঠেই বলল, ‘রানিয়া যদি তোমার জীবনই হয়, তা হলে ওকে নরকে রেখেছ কেন?’
‘বিকজ, মাই ফ্রেণ্ড,’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল জিসান, দু’হাতের তর্জনী খাড়া করে মাথার দু’পাশে সাজাল অনেকটা শিঙের মত করে, তারপর নাটকীয় ভঙ্গিতে কণ্ঠ কর্কশ করে বলল, ‘আই অ্যাম দ্য ডেভিল! হা-হা-হা!’
তার ভারী, মাতলামিভরা কণ্ঠের হাসির সঙ্গে তাল মেলাল দুই বডিগার্ড। খুব মজা পেয়ে সতর্কতায় ঢিল পড়ে গেছে। আচমকা নড়ে উঠল রানা, ওর শক্তিশালী হাতের ধাক্কায় উড়ে গিয়ে টেবিলের অপর দিকটা বাড়ি খেল জিসানের উরুতে। হঠাৎ আক্রমণে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়ে গুঙিয়ে উঠল সে। নিজের অজান্তেই শরীরের ওপরের অংশ ঝুঁকে এল টেবিলের ওপর। আর সে মুহূর্তে দেরি না করে তার হাত থেকে সুইস নাইফটা কেড়ে নিল রানা। ফলা জিসানই খুলে রেখেছিল, সেটাই ঠেকাল তার ঘাড়ের জুগুলার ভেইনে। অন্যহাতে টেবিলটপে চেপে ধরল মাথাটা।
মাত্র পাঁচ সেকেণ্ডে ঘটে গেল ভয়ঙ্কর ঘটনাটা। ওর বিদ্যুদ্গতি হতভম্ব করে দিয়েছিল বডিগার্ডদের, সেটা কাটিয়ে উঠে দ্রুত শটগান তাক করল দু’জনেই রানার দিকে। কিন্তু এর মধ্যেই হেরে গেছে তারা। কারণ তাদের বস্ এখন ডিউকের কব্জায়। বাসেত ভাই আগেই সাবধান দিয়েছিল, সেটা আমলে নেয়নি বলে আফসোস করে মনে মনে। কে জানত, নিরস্ত্র এক লোক এমন জাদু দেখাবে!
‘আমি রগ কাটি না, ধড় কাটি, জিসানের মাথাটা. টেবিলে চেপে ধরে কঠোর স্বরে বলল রানা। ‘অস্ত্র ফেলো!’ ওর ধমকে চমক কাটল বডিগার্ডদ্বয়ের। কিন্তু বসের নির্দেশ ছাড়া অস্ত্র ফেলবে কেন? আবার শট নিতে গেলে বসেরও মারা যাবার ভয় থাকে। তাদের সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা করে দিতেই যেন খেঁকিয়ে উঠল জিসান, ‘অ্যাঁই, তোরা বন্দুক ফেল, এর কথামত কাজ কর!’
এবার দেরি না করে ঝটপট মেঝেতে হাতের আগ্নেয়াস্ত্র নামিয়ে রাখল ওরা, তারপর রানার নির্দেশ মেনে দূরের দেয়ালের সামনে গিয়ে পেছন ফিরে পা ফাঁক করে দাঁড়াল। দু’জোড়া হাত মাথার ওপরে উঁচু করে দেয়ালের ওপরে রাখা। তাদের নিরস্ত্র করে এবার জিসানকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দিল ও। ইশারা করল বসতে। মুখের ফর্সা চামড়া লাল হয়ে আছে একযোগে রক্ত ছুটে আসায়, অপমানে থরথর করে কাঁপছে যেন জিসানের শরীর।
নিজেও চেয়ার টেনে বসল রানা, এমনভাবে যেন বডিগার্ড আর জিসান, দু’দিকেই নজর থাকে। কথা ও-ই শুরু করল। ‘চলো, আবার নতুন করে আলোচনা শুরু করা যাক। আমি কী চাই সেটা জানো, বিনিময়ে তুমি যা চাইতে পারো তা বলো। দেখি, আমরা ট্রেড করতে পারি কি না।’
ওর ঠাণ্ডা নিষ্কম্প স্বর শুনে একটু নড়েচড়ে বসল জিসান, নিজের ব্যক্তিত্ব ফিরে পেতে চেষ্টা করছে, যা কিছুক্ষণ আগে চুরমার করে দিয়েছে সামনে বসা এই দুর্ধর্ষ মস্তান। পরনের দামি জ্যাকেটের কলার ঠিকঠাক করতে করতে বলল, ‘ঢাকার ঠিক বাইরে আদনান সিরাজের পাঁচ শ’ একর নিষ্কণ্টক জমি আছে। আগের মালিকপক্ষ ব্যাঙ্করাপ্ট হওয়ায় নিলামে তোলা হয়, আমাদেরই কেনার কথা ছিল, কিন্তু বাবা সিরাজ জিতে যায় কোন এক কৌশল করে। এখন আমি ওটা পুরোটা চাই, বিনামূল্যে। তারপর রানিয়া চলে যেতে পারে, বাধা দেব না।’
কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে লোভী এমপি-পুত্রের দিকে তাকিয়ে রইল মাসুদ রানা। ‘দ্যাট’স সামথিং টু স্টার্ট। আমি তোমার প্রস্তাব জানাব তাঁকে। কিন্তু ততদিন রানিয়াকে কোন নোংরামিতে ব্যবহার করতে পারবে না। ওর মাথার একটা চুল বাঁকা হলেও এই নেগোশিয়েশন থেমে যাবে। তারপর তুমি মরবে। কী, রাজি?
উঠে দাঁড়াল আবার জিসান রেমান, এবার টেবিলের কাছ থেকে দূরে সরে গেল। ডানহাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘ডিল ইয অন।’
তার সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করার কোন উৎসাহ দেখা গেল না রানার মধ্যে। ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়িয়ে ঘুরতে যাবে, মুখোমুখি হয়ে গেল তৃতীয় বডিগার্ডের। পেটের ওপর স্পর্শ পেল পিস্তলের ঠাণ্ডা নলের। ভয়ঙ্কর দৃষ্টি ষণ্ডার চোখে, বসের ইশারা পাওয়ামাত্র গুলি করে দেবে। তার থ্যাবড়া নাকটা রানার কপাল থেকে খুব বেশি দূরে নয়, অনেক কষ্টে ওই নাক ভচকে দেবার লোভ থেকে নিজেকে সামলাল ও। পরিবর্তে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল জিসানের দিকে। ‘কোটা তোমার জন্যে লাভজনক? পাঁচ শ’ একর জমি, না আমার লাশ?’
অপমানের শোধ নেয়ার লোভটা সংবরণ করল জিসান, মাথা নাড়ল বডিগার্ডের উদ্দেশে। ‘অন্য কোনদিন, রকি। আজ যেতে দাও ওকে।’
মুচকি হেসে একটা তর্জনী তাক করল রানা তার দিকে, বলল, ‘খাঁটি ব্যবসায়ী তুমি। খামোকাই প্রেমিক সাজার ভান করো, ওসব তোমাকে মানায় না!’
মন ভাল নেই রানিয়ার। বেশ কিছুদিন জিসানের দেখা পাচ্ছে না, মানুষটা কি ওকে ভুলে গেল? নাকি ওর ওপর থেকে সমস্ত আগ্রহ আর ভালবাসা চলে গিয়েছে? তা-ই বা কী করে হয়? ও তো কোনদিন জিসানের অবাধ্য হয়নি, যা কিছু করতে বলেছে সেটা ভাল হোক বা নোংরামি, সব হাসিমুখে বিনাবাক্যব্যয়ে পালন করেছে। বিনিময়ে যা চেয়েছে তাই ওকে দিয়েছে মানুষটা। ড্রাগস, টাকা, বন্ধুত্ব আর স্বপ্ন।
হ্যাঁ, জিসান রেমানকে অনেক ভালবাসে রানিয়া সিরাজ। শৈশবের এক পর্যায় থেকে অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল ওর পুরো জীবন, জিসান সেখানে একরাশ আলো এনে দিয়েছে, শিখিয়েছে আবার নতুন করে বাঁচা যায়। এখন সে-ই ওর অভিভাবক, ওর ভবিষ্যৎ। আর কাউকেই পরোয়া করে না ও, কোন কিছু প্রত্যাশাও করে না জীবনে। এটা ঠিক, ব্রোকেন ফ্যামিলির কারণে অবহেলিত হয়ে একা একা বড় হওয়ায় পৃথিবীর কোন কিছুর প্রতিই তেমন আকর্ষণ জন্মেনি ওর। এমন কোন ড্রাগস নেই যা ওর ছোট্ট জীবনে ট্রাই করেনি, এমন কোন সেক্সুয়াল নোংরামিও নেই যা ওকে করতে বাধ্য করায়নি জিসান। কিন্তু সবকিছুই রানিয়ার কাছে অপ্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। যদিও সবাই ওকে ‘জাঙ্কি’-ই মনে করে, তবে ওর কাছে গোটা জীবনটাই যেন এক টাইম পাস ম্যাটার। জামা পরতে হয় তাই পরা, নেশা করতে হয় তাই করা।
বর্তমানে ওর একমাত্র আকর্ষণ আর ভরসার মানুষ জিসান। ওই মানুষটার জন্যে বুকের ভেতরে এত ভালবাসা কীভাবে তৈরি হলো বলতে পারবে না রানিয়া। শুধু অনুভব করে গভীরভাবে ভালবাসে। কোনক্রমেই এই অমূল্য ধন হারাতে চায় না ও। তাই জিসানের সঙ্গে ঘন ঘন দেখা হওয়াটা জরুরি। আগে সপ্তাহে কয়েক দিন তার দেখা পেত, এখানে-ওখানে বেড়াতে বা ক্লাব-পার্টিতে যেত। কিন্তু দু’সপ্তাহ ধরে অনিয়মিত জিসান, মাত্র একবার এসেছিল। এদিকে মোবাইলে কল বা মেসেজ দিয়ে রাখলেও কাজ হয় না। নিজে থেকে সে যোগাযোগ না করলে তাকে পায় কার সাধ্যি। নাহ্, এভাবে একাকী এই ফ্ল্যাটে পড়ে থাকা যাবে না, জিসানের ছায়া হয়ে থাকতে হবে।
বিশাল স্ক্রিনের টিভিতে মুভি চলছিল, আর সোফায় শুয়ে ধূমপান করতে করতে এসব ভাবছিল রানিয়া সিরাজ। সিদ্ধান্ত নিতে পেরে মনের ভেতরে শান্তি পেল। জিসানের প্রায় সব ডেরাই চেনে, ঢুঁ মারবে সবগুলোতে একটা একটা করে। সোফা থেকে উঠে বসে সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে চেপে নেভাল ও। টিভি বন্ধ করে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। সময় নিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে কুসুম গরম পানিতে গোসলটা সারল, তারপর ওয়ারড্রোব। আচ্ছা, আজ কি বাইরে ঠাণ্ডাটা বেশি নাকি? হুডিটাই পরা যাক তা হলে।
অনেকদিন পর শান্ত আর খুশি মনে ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল রানিয়া ওর স্বপ্নসখার খোঁজে।
প্রথম দুই লোকেশনে গিয়ে কাউকে পাওয়া গেল না। তৃতীয় লোকেশন মোহাম্মদপুরে, তাজমহল রোডে। উবার ভাড়া করে পুরনো ধাঁচের ডুপ্লেক্স বাড়িটার ঠিকানায় এসে নামল রানিয়া। ওকে দেখে সিকিউরিটি গার্ড দ্রুত সালাম দিল, তারপর খুলে দিল লোহার গেট। ভেতরে ঢুকলেই হাতের ডানে গার্ড হাউস। সোজা এগোলে পোর্চ।
‘তোমার বস্ ভেতরে আছে?’ উত্তেজনা নিয়ে জানতে চাইল রানিয়া।
চওড়া, রহস্যময় এক দেঁতো হাসি দিল গার্ড। ‘জী, আছেন তো।’
প্রায় ছুটে গিয়ে বাসার প্রবেশ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল চাপল ও। ভেতর থেকে পায়ের আওয়াজ এদিকেই আসছে। বুকের রক্ত ছলকে উঠল ওর, মনে হলো হৃৎপিণ্ডটা ফেটে যাবে উত্তেজনায়। খুলে গেল দরজা। বাথরোব পরে দরজা মেলে সামনেই দাঁড়িয়ে আছে… কে!
‘কী রে, শালীর বেটি, হঠাৎ কোত্থেকে এসে পড়লি টুপ করে?’
হাস্যোজ্জ্বল মুখটা এতদিন পর দেখতে পেয়ে বিস্মিত রানিয়া। ‘স্যামি, তুই! দেশে আসলি কবে?’
দেড়মাস আগে ইউ.এস.এ. চলে গিয়েছিল স্যামি ওরফে সামীর হায়দার। কোন খোঁজখবর ছিল না। এখানে তাকে আবার দেখতে পাবে ভাবতেই পারেনি রানিয়া। এবার বুঝল সিকিউরিটি গার্ডের মুখ ভরা হাসির রহস্য। ব্যাটা অনেক কিছুই জানে ওদের সম্পর্কে।
‘আমি আজই এসেছি রে। জিসানটা এমনভাবে ডাকল না, না এসে পারলাম না।’
স্যামির কিছুটা মেয়েলি ঢঙে কথা বলার অভ্যেসটা এখনও রয়ে গেছে, অবশ্য এগুলো বিদেশে কোন সমস্যা নয়। কিন্তু দেশের মানুষ এখনও একটু অন্যরকম। জিসান স্যামি-রানিয়া ওরা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, মাস দেড়েক আগে জিসানেরই এক বিজনেস পার্টনার স্যামিকে ‘হিজ মাস্টার্স বিচ’ বলায় প্রচণ্ড অভিমান করে চলে যায় সে দেশ ছেড়ে। আজ ফিরে এসেছে, তার মানে জিসান নিয়মিতই যোগাযোগ রেখেছে তার সঙ্গে। অথচ রানিয়া কিছুই জানে না। তা হলে কি ওর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে জিসানের কাছে? ওর প্রিয় মানুষটা কি এখন প্রকাশ্যে স্যামিকে নিয়ে থাকতে শুরু করবে? রাখঢাকের সময় শেষ?
জিসান তো বলেছিল, তার সঙ্গে স্যামির সম্পর্কটা একদম গোপন রাখতে হবে, কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও না জানতে পারে, বিনিময়ে যা চাইবে তাই পাবে ও। রানিয়াকে সে খুব ভালবাসে সত্যি, কিন্তু স্যামিকেও তার দরকার। রানিয়া তখন আপত্তি করেনি; স্বামী বা বয়ফ্রেণ্ড নয়, বরং জিসানকে একজন বিশ্বস্ত বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবেই দরকার ছিল ওর।
রানিয়ার হাত ধরে টেনে নিয়ে লিভিং রুমের সোফায় বসাল স্যামি। একহাতে তার ব্র্যাণ্ডির গ্লাস, অপর হাত রানিয়ার গালে-ঘাড়ে বুলাল। তারপর তর্জনী দিয়ে নিচের ঠোঁট স্পর্শ করল, চোখ নেড়ে বলল, ‘অনেক মিস করেছি রে তোদেরকে। আয় না, জিসান আসার আগে আমরা একটু মজা করি।’
ওদের মধ্যে ত্রিমুখী যে জটিল সম্পর্ক, তাতে এধরনের কর্মকাণ্ড নতুন কিছু নয়। এলএসডি’র নেশার ঘোরে উপভোগও করেছে সেসব। কিন্তু এমুহূর্তে বলতে পারবে না কেন, শিহরিত হওয়ার বদলে গা-টা ঘিনঘিন করে উঠল রানিয়ার। চোয়াল শক্ত করল ও, সবকিছুর আগে জিসানকে কৈফিয়ত দিতে হবে কেন সে তাচ্ছিল্য দেখাচ্ছে ওর প্রতি। এত সহজে ছাড়বে না ও!
‘স্বপ্নের একটি বাড়ি তৈরি করছে সবাই মাটি, পাথর, কাঠ এবং ধার করা টাকা থেকে। বৃষ্টি-বন্যাতে মাটি-পাথর ভেসে গৈছে, উইপোকারা কাঠ কুরে কুরে খাচ্ছে। এখন বাকি শুধু ঋণ…’ ড্রিঙ্কসের গ্লাস হাতে ভরাট কণ্ঠে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করছেন আদনান সিরাজ। এখনও মাতাল হননি যদিও, তবে উপলব্ধির ডালপালা মেলে ধরতে উন্মুখ তাঁর মন।
‘বুঝলেন, ডিউক, একই কলেজে পড়তাম আমরা। প্রেম হয়ে গেল, বিয়েও করে ফেললাম পরিবারের অমতে। দু’জনেই চাকরিজীবী তখন, আমাদের জীবন আলোকিত করে এল রানিয়া। ওর উজ্জ্বলতম ভবিষ্যৎ গড়ব বলে টাকা রোজগারের নেশায় পেয়ে বসল। চাকরি ছেড়ে ধরলাম ব্যবসা। অর্থবিত্ত, গাড়ি, বাড়ি সবই হলো একদিন, কিন্তু সংসারটা আর হলো না। দুনিয়ার সবকিছুর ওপর ইন্টারেস্ট বেড়ে গেল, শুধু স্ত্রী ছাড়া। ও যেদিন রানিয়াকে নিয়ে চলে যেতে চাইল, এমন ইগো পেয়ে বসল আমাকে যে, মেয়ের জন্যে কোনটা সঠিক সেটা বিবেচনা না করেই আইনের মারপ্যাঁচ খেললাম। মা’র কাছ থেকে ছোট্ট রানিয়াকে আলাদা করে দিলাম। ইগো দমিত হবার পর সংসারের প্রতি আর কোন আগ্রহ রইল না। মেয়ে কার কাছে কেমন করে বড় হচ্ছে কেয়ারই করিনি। অঢেল টাকা তো দিচ্ছি! আজ মেয়েটার জন্যে যে ভালবাসা আর কষ্ট অনুভব করছি, সেই সময় এটা করলে আমাদের তিনজনের জীবন অন্যরকম সুন্দর হত। আমি একটা নির্বোধ ছাড়া আর কিছু নই!’
ছাতের রেলিঙে হেলান দিয়ে আদনান সিরাজের আত্মোপলব্ধি শুনছিল রানা, নিজে কোন মন্তব্য করল না। যা ঘটে গেছে তা নিয়ে চর্চা করে কী লাভ! বরং নিজেকে বর্তমানে শুধরে নিয়ে ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের চেষ্টা করাই শ্রেয়।
আদনান সিরাজের এই বাগান-বাড়ি ঢাকার অদূরে পূর্বাচল এলাকা ছাড়িয়ে অনেকটা ভেতরে, আশপাশ বেশ নির্জন। ব্যবসায়িক পার্টনার আর সুন্দরী নারীদের নিয়ে আমোদ-ফূর্তি করার জন্যে উপযুক্ত জায়গা। ভদ্রলোকের ভাষ্যমতে, এই বাংলোর মালিক যে তিনি, এটা তাঁর বডিগার্ডরা ছাড়া অন্য কেউ জানে না। তাই জিসান রেমানের পাঁচ শ’ একর জমি দাবির প্রস্তাবটা নিয়ে ডিউক যখন আলাপ করতে চাইল, তিনি এ-বাড়িতেই আসতে অনুরোধ জানালেন।
নিজের গ্লাসে আরেকবার উইস্কি ঢাললেন আদনান, তারপর আঙুলের ফাঁকে পুড়তে থাকা সিগারেটে একটা টান দিলেন বুক ভরে। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘ওই জমিটা দিয়ে দিলে আমার তেমন কিছু আসবে-যাবে না। এত সহজে আমার রানিয়াকে ফিরে পেতে পারি, এটা কখনও আমার ভাবনাতেই আসেনি, যেহেতু এমপি সালেক রহমানের সঙ্গে আমার সম্পর্ক তেমন সুবিধার নয়।’
‘গুড,’ এবার মন্তব্য করল রানা। প্রাসঙ্গিক আলোচনা শুরু হওয়ায় স্বস্তিবোধ করছে। ‘তবে জিসানের মনে কী আছে এখনও সেটা পরিষ্কার নয়। রানিয়াকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত জমির কাগজপত্র তার হাতে দেয়া যাবে না। অবশ্য আপনি উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে দলিলপত্র তৈরি করতে থাকুন, যাতে আমরা দ্রুত মুভ করতে পারি।’
ওর কথায় সায় দিলেন আদনান। ‘তোমার প্রতি আমি অনেক…’ বাক্যটা শেষ করার আগেই তার মোবাইল ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনের দিকে চেয়ে ভুরু কোঁচকালেন তিনি। কলটা রিসিভ করে ওপ্রান্তের কথা শুনলেন এবং মুহূর্তের মধ্যে সাদা হয়ে গেল তাঁর মুখ। ঝট্ করে উঠে পড়লেন চেয়ার ছেড়ে। ফোনটা পকেটে পুরেই রানার দিকে তাকালেন, কাঁপা কাঁপা স্বরে বললেন, ‘রানিয়া বাসায় ফিরেছে, এক্ষুণি চাইছে আমাকে। আপনি আজ এখানেই থেকে যান, জায়গাটা নিরাপদ। আমি গিয়ে সব জেনে আপনাকে আপডেট দেব।’ রানার জবাবের অপেক্ষায় আর দাঁড়ালেন না তিনি, ঝড়ের বেগে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন।
ছাতের প্রান্তে দাঁড়িয়ে বডিগার্ডসহ দ্রুতবেগে আদনান সিরাজের গাড়িটা মেইন গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখল রানা। ভাবছে, খারাপ কিছু ঘটেনি তো?
ওদিকে গাড়িতে বসে প্রচণ্ড উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠায় ঘামতে শুরু করেছেন আদনান। যে মেয়ে ঝগড়া ছাড়া কোনদিন তাঁর সঙ্গে ঠিকমত কথাও বালনি, এমনকী সম্বোধন পর্যন্ত করেনি, সব কথা যার শেষ হত ‘আই হেইট ইউ’ দিয়ে, সেই মেয়ে কি না এতদিন পর বাড়িতে এসে কাঁদতে কাঁদতে জানতে চাইছে: ‘বাবা কোথায়? বাবাকে আমার এক্ষুণি দরকার!’
দ্রুত বাসায় ফেরার তাড়া অনুভব করছেন তিনি, কিন্তু রাস্তা যেন ফুরোচ্ছেই না, আরও দূরে সরে যাচ্ছে যেন। অবশেষে স্নায়ু বিদীর্ণ হবার মুহূর্তে এসে বাসার গেট দেখতে পেলেন। ড্রাইভারকে ধমক দিয়ে ঘন ঘন হর্ন বাজাতে বলতে লাগলেন।
গাড়ি থামতে যা দেরি, লাফিয়ে নেমে দৌড়ে বাসার ভেতরে ছুটলেন আদনান। বিশাল ডাইনিং স্পেসের একটা চেয়ারে গুটিসুটি মেরে বসে আছে রানিয়া, পরনের হুডি পুলওভারে ছোপ ছোপ লাল দাগ। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাতৃস্নেহ দেয়া প্রবীণা বুয়া। অজানা বিপদের আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠল আদনানের।
তাঁর পায়ের শব্দে কান্নাভেজা মুখ তুলে তাকাল রানিয়া, তারপর স্প্রিঙের মত লাফ দিয়ে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাবার বুকে। কাঁদতে কাঁদতে হড়বড় করে কী সব যে বলছে মেয়েটা কিছুই বুঝলেন না আদনান। তবে নিজে চুপ থাকলেন, পরম মমতায় ওকে জড়িয়ে ধরে রাখলেন বুকের মধ্যে।
বেশ অনেকক্ষণ পর থামল রানিয়ার কান্নার দমক। ওকে আলতো করে ধরে নিয়ে চেয়ারটাতে বসালেন আদনান, তারপর মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে রানিয়ার হাতদুটো নিজের হাতে নিলেন। খেয়াল করলেন মেয়ের মত তাঁর চোখ বেয়েও অবাধে কান্না ঝরছে। বলতে চাইলেন, কী হয়েছে তোর? জামায় এত লাল দাগ কীভাবে এল? কিন্তু আবেগ ধরে রাখতে না পেরে বলে উঠলেন, ‘কেমন আছিস তুই, মা!’
বাবার কণ্ঠে প্রচণ্ড স্নেহময় এই ডাক শুনে আবারও ভেঙে পড়ল রানিয়া। পিতা-কন্যার অঝোর অশ্রুবর্ষণে এক অদ্ভুত সুন্দর আবেগময় পরিবেশ তৈরি হলো। এবার একটু পরই নিজেকে সামলে নিতে পারল রানিয়া। ভাঙা ভাঙা স্বরে বলল, ‘আ-আই হ্যাভ কমিটেড আ মার্ডার, বাবা। জিসানের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু স্যামিকে খুন করে ফেলেছি। রেপ করতে চাইছিল ও আমাকে। জিসান তো আর কোনদিন আমাকে ক্ষমা করবে না, বাবা!’
অবিশ্বাস নিয়ে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আদনান সিরাজ। চোখের সামনে ভেসে উঠল চিৎকারে হাসপাতাল কাঁপিয়ে তোলা সদ্য ভূমিষ্ঠ মেয়েটা তাঁর কোলে এসেই শান্ত হয়ে পড়ার দৃশ্য। সেই মেয়ে মাত্র ক’দিনেই এত বড় হয়ে গেল? এখন আবার হত্যাকাণ্ডও ঘটিয়ে ফেলেছে! ওর কথা কি বিশ্বাস করা যায়? স্যামিকে চেনেন না তিনি, শুধু নামটা জানতেন। কিন্তু খোঁজ নিয়ে আগেই জেনেছেন, ওরা তিনজন যেখানে যায় একসঙ্গেই যায়, মানে যেত। সেই এতদিনের সঙ্গীকে হঠাৎ খুন করে ফেলল রানিয়া? নেশার ঘোরে? নাকি ছেলেটার আসলেই বদ মতলব ছিল? জিসানের সঙ্গে রানিয়া থাকত বলে কি ঈর্ষান্বিত ছিল স্যামি?
রেপ এমন এক বিষয় যা নিয়ে আদনান তাঁর মেয়েকে একটা প্রশ্নও করবেন না বলে ঠিক করলেন। রেপের অ্যাটেম্প্ট নেয়া হয়েছে এবং আত্মরক্ষার্থে রানিয়া খুন করেছে আক্রমণকারীকে। এভাবেই আবেদন করা হবে কোর্টে।
কোর্ট! আদালত! থানা-পুলিশ! সালেক রহমান! জিসান রেমান! এসব কিছুই ড্রাগ অ্যাডিক্ট রানিয়ার জন্যে ভয়ঙ্কর শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। সময়মত ড্রাগস নিতে পারেনি বা নিতে স্যামি বাধা দেয়ায় তাকে রানিয়া খুন করেছে, এটাই প্রমাণ করবে আদালতে রহমান গং! কিন্তু তা হতে দেয়া যায় না। এতদিন পর মেয়েকে কাছে পেয়ে কিছুতেই হারাতে পারবেন না আদনান। যে করেই হোক ওকে রক্ষা করতে হবে এই জটিল জাল থেকে। এখন একমাত্র ভরসা ডিউক!
মোবাইল বের করে ডিউককে কল দিতে গেলেন তিনি, অন্য হাতে রিমোট চেপে টিভিটা অন করলেন ড্রইং রুমের। কোন চ্যানেলেই খুনের নিউজটা নেই, তার মানে মিডিয়া এবং পুলিশ এখনও কিছু জানে না।
ডিউক ধরল না ফোন। ভীষণ আতঙ্কিত বোধ করলেন আদনান। চিনচিন করে উঠল বুকের বাঁ পাশ, মনে হলো হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে এক্ষুণি। এমন সময় বারান্দার দিকের থাই-ডোরটা একপাশে খুলে গেল, ঘরে ঢুকল পরিচিত মুখটা। কী বলে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দেবেন ভাষা খুঁজে পেলেন না তিনি। এ তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি!
‘সরি, টেরেসটা ব্যবহার করতে হলো, চাইনি কেউ দেখুক এই বাড়িতে ঢুকছি,’ বলতে বলতে কামরার সবটা একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিল ডিউক ওরফে মাসুদ রানা, তারপর রানিয়াকে দেখল কিছুক্ষণ। বুয়ার বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে, হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। এবার আদনানের মুখোমুখি হয়ে বলল, ‘খারাপ কিছু ঘটেছে আশঙ্কা করে আপনার একটু পরেই বেরিয়ে পড়ি আমি। এবার খুলে বলুন তো সব।’
রানিয়ার কাছে শোনা পুরো ঘটনাটাই ওকে খুলে বললেন আদনান। বেশ কয়েক দিন দেখা না হওয়ায় জিসানের খোঁজে কয়েকটা আস্তানায় ঢুঁ মারে রানিয়া। মোহাম্মদপুরের একটা ডুপ্লেক্স বাড়িতে স্যামির সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। পুরনো বন্ধু, দীর্ঘদিন দেখা নেই, তাই স্যামি অনুরোধ করে কিছুক্ষণ ‘হ্যাংআউট’ করার। ছেলেটা নিজেও অল্পস্বল্প নেশা করে, গল্প করার এক পর্যায়ে রানিয়াকে স্পর্শ করে বসে স্যামি। এরপর দু’জনের কথা কাটাকাটি আর ধস্তাধস্তির মধ্যে রাগের বশে স্যামির গায়ে কিচেন নাইফ চালায় রানিয়া। কিন্তু কোথায় আঘাত করেছে বলতে পারছে না। অনেক রক্ত দেখে ভয় পেয়ে যায়, পালিয়ে আসে ওখান থেকে। তার আগে, রানিয়াকে দেখে নিয়ত খারাপ হয়েছিল বলেই হয়তো একমাত্র সিকিউরিটি গার্ডকে বাড়ির বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিল স্যামি। রানিয়া ছুটে বের হয়ে আসার সময় কাউকে দেখতে পায়নি, অবশ্য ভাল করে খেয়াল করার মত মানসিক অবস্থাও ওর ছিল না।
‘আর মার্ডার উইপন?’ জানতে চাইল রানা। তবে আদনান সিরাজকে ভুরু উঁচু করতে দেখে সংশোধন করে বলল, ‘মানে কিচেন নাইফটা কোথায়?’
মাথা নাড়লেন আদনান হতাশ ভঙ্গিতে, মলিন কণ্ঠে বললেন, ‘ওটা ওখানেই ফেলে এসেছে। ওর এই অবস্থায় এতটা আশা করা ঠিক হবে না যে, নাইফটা লুকিয়ে ফেলবে বা সঙ্গে করে নিয়ে আসবে।’
‘জানি। তবুও নিশ্চিত হওয়ার দরকার ছিল।’
ভাবার জন্যে একটু সময় নিল রানা, তারপর বলল, ‘আর এক সেকেণ্ডও নষ্ট না করে আমরা যেখান থেকে এলাম, রানিয়াকে এবং এই মহিলাকে সেই বাড়িটাতে পাঠিয়ে দিন। ওটা যদি সত্যিই আপনাদের কারও নামে রেজিস্টার্ড না হয়ে থাকে, যেমনটি আপনি বলেছিলেন, তবে আপাতত ওরা নিরাপদে থাকবে। আপনার বডিগার্ডরা ছাড়া বাইরের আর কাউকে অ্যালাউ করবেন না। আর হ্যাঁ, কারও সঙ্গেই ফোন রাখা যাবে না। ওটা সঙ্গে থাকলেই কেউ না কেউ চালু রাখবে, ব্যবহার করতে চাইবে। বিশেষ করে আপনার মেয়ে যেন কারও সঙ্গে কথা বলার সুযোগ না পায়। আপনিও সতর্ক থাকবেন, জিসান খবরটা পাওয়ামাত্র রানিয়াকে খুঁজবে এবং আপনাকেও। কিছুই না জানার অভিনয় করবেন, মেয়ের খোঁজ চাইবেন, ওকে? এবার ওদের বেরিয়ে পড়তে বলুন, কুইক!’
ওর কণ্ঠে তাগাদার সুর। এক কাপড়েই রানিয়া আর বুয়াকে নিয়ে গাড়ির দিকে এগোলেন আদনান। মেয়েকে ধরে পেছনের সিটে বসালেন, এখনও ঘুম ঘুম আবেশে আছে ও। বুয়া বসল পাশে ওকে ধরে। এক বডিগার্ড উঠে বসল ড্রাইভারের পাশের সিটে, অপর দু’জন পেছনের গাড়িতে তৈরি। গাড়ির দরজা বন্ধ করে ড্রাইভারকে ইশারায় স্টার্ট দিয়ে চলে যেতে বললেন আদনান। দুটো গাড়িই মেইন গেট পেরিয়ে বের হয়ে যেতে ডিউকের দিকে ফিরলেন তিনি। ‘আপনি কী করবেন, ডিউক?’
ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে সহজ ভঙ্গিতে বলল রানা, ‘ডেডবডিটা দেখতে যাব।’
সন্ধ্যার পর ওর সুজুকিটা এক মোটরবাইক মেকানিকের কাছে মেইনটেন্যান্সের জন্যে দিয়ে হাঁটতে বেরোল রানা। ঢাকার শীত তেমন জোরালো নয়, তাই বেশিরভাগ সময় আস্তিন গোটানো শার্ট পরে ও। তবে আজ একটা বিশেষ কারণে জ্যাকেট পরেছে হুডিসহ। হয়তো কিছু টুলস বহন করতে হবে ওকে।
ওঅর্কশপটা থেকে আধমাইল হাঁটতে হলো ওকে তাজমহল রোডে পৌঁছাতে। আদনান সিরাজের কাছ থেকে আগেই ঠিকানা নিয়ে নিয়েছে। বাড়িটাকে ঘিরে প্রথমে একটা চক্কর লাগাল, বুঝল মেইন গেট দিয়ে ঢোকা যাবে না, দেয়াল টপকে ঢুকতে হবে। এমপি-পুত্র জিসান আত্মবিশ্বাসী, সিকিউরিটি ক্যামেরা ছাড়া তেমন জোরদার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। একজন মাত্র সিকিউরিটি গার্ড।
এই পথেও বেশকিছু গাছপালা আছে। ওগুলোর একটাতে চড়ে বাউণ্ডারি টপকানো অনেকটা সহজ হয়ে গেল। ক্যামেরায় ওকে ঠিকই দেখা যাবে, যদিও হুডি পরা বলে মুখটা স্পষ্ট হবে না। ভাগ্য ভাল, বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ফেস রিকগনিশন ডেটাবেইস নেই। তবুও ক্যামেরাগুলোর কথা মাথায় রাখতে হবে।
ভেতরের ঘরে প্রবেশও করল রানা পেছনের দরজা দিয়ে। স্বস্তির ব্যাপার, ঘরে কোন ক্যামেরা নেই এবং ঘরের আলো জ্বলছে। এজন্যেই পরে ফিরে আসা বোকা সিকিউরিটি গার্ডটা ভেতরে আসেনি চেক করে দেখতে। যদি আসত, এতক্ষণে পুলিশ ও সাংবাদিক গিজগিজ করত এখানে। কিন্তু লোকটাকে মেইন গেটে শীতের সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে দেখে এসেছে ও।
পুরো ঘর তীক্ষ্ণ চোখে স্ক্যান করল মাসুদ রানা। রক্ত, রক্ত আর রক্ত। দেয়ালে, মেঝেতে, সাইড’ কেবিনেটে, ডাইনিং টেবিলে, রক্তের ছড়াছড়ি। লাশটা পড়ে আছে টেবিলের কাছেই, তার তিন ফিট দূরে টেবিলের ওপর রক্তে মাখামাখি ছুরি। মনে হচ্ছে কোন হিংস্র সিরিয়াল কিলারের কাণ্ড। অথবা কোন ড্রাগ অ্যাডিক্টের! রানিয়ার কোন চান্স নেই বাঁচার। সহজ পুলিশ কেস। শাস্তি যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদণ্ড।
এবার, সহজ এই কেসটাকে খানিক জটিল করে ফেলা যাক দেখি! মেঝের রক্ত এড়িয়ে খানিকটা দূর থেকেই স্যামির লাশের দিকে ঝুঁকল রানা। গলার কাটা দাগটা স্পষ্ট, প্রথমে ওখানেই পৌঁচ দিয়েছে রানিয়া, তারপর হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মত এলোপাতাড়ি আঘাত করেছে। আহা, যৌবনের কী অপচয়। সম্ভাবনাময় একটা জীবন, নেশা আর বিকৃত খামখেয়ালিপনায় ধ্বংস হয়ে গেল, মৃত যুবকটার জন্যে আফসোস হলো ওর।
ওখান থেকে সরে এসে কিচেনে গিয়ে ঢুকল, একটু খুঁজতেই একটা ওয়াল কেবিনেটের ড্রয়ারে পেয়ে গেল যিপ ব্যাগের বক্সগুলো-বিভিন্ন সাইজের আছে। প্রতিটা বক্সে শ’খানেকের মত পাতলা প্লাস্টিক ব্যাগ থাকে। মাপমত একটা নিয়ে আবার জায়গামত রেখে দিল যেভাবে ছিল। আশা করা যায় ওগুলো কেউ গুনে রাখেনি। ভেতরে ঠেলে দিল ড্রয়ার। আঙুলের ছাপ নিয়ে ভয় নেই, গ্লাভ্স পরে আছে।
কিচেন থেকে বেরিয়ে এ-ঘর ও-ঘর চট্ করে ঘুরে এল রানা, যদি রানিয়া অসাবধানে কিছু ফেলে রেখে যায়। এরপর আবার অকুস্থলে ফিরে টেবিল থেকে রক্তমাখা মাঝারি আকৃতির কিচেন নাইফটা সাবধানে যিপ ব্যাগে ভরে মুখটা আটকে দিল। জ্যাকেটের ভেতরে কাস্টমাইয করা গভীর এক পকেটে ছুরিসমেত যিপ ব্যাগটা ঢুকিয়ে রাখল। আরেকটা কাজ বাকি। পেছনদিক দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে বাড়ির ভেতরের দেয়াল ধরে মেইন গেটে এল ও। সিকিউরিটি গার্ড এখনও শীতে জবুথুবু, কখনও কিছু ঘটে না বলে অসতর্ক। গা গরম রাখার জন্যেই বোধহয় মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের ওপর অনেকখানি ঝুঁকে আছে। হয়তো ইউটিউবে বলিউডের কোন মাসালা ডান্স দেখছে। পেছনে থেকে অনায়াসেই তাকে কাবু করল ও, তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে বসাল অজ্ঞান শরীরটা। ব্যাটা ঘুমাক কিছুক্ষণ। তারপর বাইরের গেস্টদের দেখার জন্যে যে জানালা আছে, সেটার পাল্লা বন্ধ করে দিল। বাইরে থেকে এখন হঠাৎ কোন ভিজিটরের উঁকি মারার সম্ভাবনা নেই। অজ্ঞান লোকটার হাত থেকে মোবাইলটা ছাড়িয়ে নিয়ে ডেস্কের ওপর রাখতে গিয়ে হঠাৎ জমে গেল ও।
স্ক্রিনে গোপনে ধারণ করা এক ভিডিয়ো চলছে, কলাকুশলীরা অবশ্যই জানে না এটার অস্তিত্ব সম্পর্কে, জানলে এই গার্ড জীবিত থাকত না। ফুটেজের শিল্পীরা হলো জিসান আর তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু স্যামি, যার লাশটা কয়েক গজ দূরেই রক্তে ডুবে আছে। ওরা দু’জন যে অপ্রাকৃতিক কার্যকলাপে মত্ত সেটা প্রকাশ পেলে জিসান তো বটেই, এমপি সালেক রহমানও আত্মহত্যা করতে পারেন! বাংলাদেশের সমাজে এটা চরমভাবে অগ্রহণযোগ্য।
অ্যাপ ব্যবহার করে ভিডিয়োটা নিজের মোবাইল ফোনে কপি করে নিল রানা। পরে লেভারেজ হিসেবে কাজে আসতে পারে। তারপর সিকিউরিটি ক্যামেরা চেক করতে শুরু করল। খুব সিম্পল সিস্টেম। জনপ্রিয় চাইনিজ একটা ব্র্যাণ্ডের ডিভিআরে সর্বমোট আটটা ক্যামেরা চলছে। পেরিমিটারের দুটো ক্যামেরাতে ওর সিল্যুয়েট দেখা গেল, তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে রানিয়ার আগমন এবং প্রস্থানের রেকর্ডিংটা। মেয়েটা ফেঁসে যাবে অনায়াসে। এখন এই রেকর্ডিং নিয়ে টেম্পারিং করার সময় ও সুযোগ কোনটাই নেই। সবগুলো কেবল ডিটাচ করে পুরো ডিভিআর মেশিনটাই নিয়ে নিল। মাত্র বারো ইঞ্চি সাইজ, জ্যাকেটের আড়ালে সহজেই লুকানো গেল।
পকেট থেকে একটা ফেস মাস্ক বের করে পরল ও, হুডিটা মাথা এখনও ঢেকে রেখেছে। এবার মাপমত কয়েকটা চড় মারল গার্ডের গালে, জাগাতে চাইছে। গাল লাল হয়ে গেল, কিন্তু ব্যাটার জাগার কোন লক্ষণই নেই। খেয়াল করল ডেস্কের ওপর রাখা সেভেনআপের পুরনো এক বোতল, এখন পানি খাওয়ার কাজে লাগে। শীত কাল যেহেতু, পানিও ঠাণ্ডা হয়ে আছে। বোতলের মুখ খুলে সরাসরি গার্ডের মুখে পানি ঢালতে শুরু করল রানা। বুক ভিজে যাওয়ার আগেই ধড়মড় করে উঠে বসল লোকটা। ওকে দেখেই আতঙ্কে চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেছে। তার মুখ চেপে ধরে চিৎকার করতে মানা করল ও, নইলে…
মোবাইলের ভিডিয়োটা নিজের চোখের সামনে চলতে দেখে হার্টের বিট মিস করল গার্ড। বিশ্বাস করতে পারছে না যে, ভিডিয়োটা নিয়ে কারও কাছে হাতেনাতে ধরা খেয়ে গেছে!
তার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিল রানা, কিছুটা ধাতস্থ হবার সুযোগ দিয়ে বলল, ‘আমাকে বা মেয়েটাকে আসতে- যেতে দেখোনি তুমি। বাড়ির ভেতরে গিয়ে যা-ই দেখবে, সঙ্গে সঙ্গে জিসানকে ফোন করে জানাবে। সে-ই পুলিশকে সামলাবে। আমাদের বিষয়ে যদি একটা শব্দ উচ্চারণ করো, তা হলে এই ভিডিয়ো জিসানের কাছে পাঠাব আমি। আমার কাছে কপি আছে। ক্লিয়ার? জ্ঞান ফেরার পর তোমার সঙ্গে আমার দেখা বা কথা হয়নি, তুমি তোমার আক্রমণকারীকে দেখোনি। বুঝতে পারলে মাথা নাড়াও।’
ভয়ে গার্ডের মুখ দিয়ে কথা বেরোল না। চিঁ চিঁ করে সায় দিল রানার কথায়। এই শীতের মধ্যেও ঘাম জমেছে কপালে, বেয়ে এসে পড়ল চোখের পাতায়। দ্রুত দু’হাতে চোখ মুছেই আক্রমণকারীকে দেখতে চাইল, কিন্তু ঘরে কেউ নেই। একেবারেই একা সে। দুঃস্বপ্ন দেখেনি সেটা বুঝল ডিভিআরটা গায়েব হয়ে যাওয়ায়। ক্যাম-মনিটরও অন্ধ হয়ে গেছে। নিজের বুক ভেজা পানিতে। কী মনে হতেই ঝট্ করে উঠে দাঁড়াল সে, তাড়াতাড়ি ছুট লাগাল বাড়ির ভেতরদিকে 1 গেট খুলে ঢুকেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। রক্তের সমুদ্রে স্যামির লাশটা দেখে মাথা চক্কর দিয়ে উঠল তার। ভাবল, আমি আজ শেষ!
.
পুলিশ ভ্যানে বসে আছে সিরিউরিটি গার্ড, ব্যথা পাওয়া ঘাড়টা ডলছে। নাম তার বারেক মিয়া। পাঁচ বছর ধরে মালিকের লবণ খাচ্ছে, তাই বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেনি। ওই আগন্তুকের কথামত জিসান বসকেই আগে কল দেয় সে, কাছাকাছিই ছিল জিসান, স্যামির সঙ্গে সেলিব্রেট করবে ভেবে দামি ওয়াইন নিয়ে এ-বাড়ির দিকেই আসছিল। তাই দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেল সে। যে উত্তেজনা আর ব্যাকুলতা নিয়ে ছুটে এসেছিল, তা প্রবল কষ্ট, হতাশা, ব্যর্থতা এবং শেষমেশ ঘৃণায় রূপ নিল। তার জীবনের একটা অপূরণীয় ক্ষতি করে ফেলেছে রানিয়া আর বাবা সিরাজ। ওই রঙবাজ ডিউকও জড়িত থাকতে পারে। কী যেন বলেছিল সে? আমি রগ কাটি না, ধড় কাটি!
প্রিয়তম বন্ধুর লাশ ছুঁয়ে, প্রতিজ্ঞা করল জিসান রেমান, কাউকে বাঁচিয়ে রাখবে না!
বিশ্বস্ত গার্ড বারেক মিয়া কিছুই লুকায়নি। রানিয়ার আগমন, স্যামির সঙ্গে বাড়ির ভেতরে যাওয়া, তাকে গ্রোসারি আনতে পাঠানো (এটা শুনে জিসানের ভীষণ রাগও হয়েছে, নিরাপত্তাকর্মীকে কেউ মুদি দোকানে পাঠায়? আবার বলে দেয়, সিগারেট এনে নিজের কাছেই রাখিস, আমি চেয়ে নেব, বাসার ভেতর ঢুকবি না।), হুডি পরা আগন্তুকের আগমন ও মারধর, মিথ্যা বলার জন্যে শাসানি, ক্যামেরার রেকর্ডিং বক্স নিয়ে যাওয়া—কোন কিছুই বাদ দেয়নি।
সব শুনে জিসান বলেছে, থাক, তুই ভয় পাইস না। তোকে আমি চিনি, বেঈমানি করবি না। এখন আমি পুলিশ ডাকব, বাবাকেও জানাব। পুলিশ তোকে সন্দেহের চোখে দেখবে, অনেক প্রশ্ন করবে। তুই শুধু আমি যা শিখিয়ে দিব, তাই বলবি। রানিয়া বা ওই কিলারের কথা কিচ্ছু বলবি না! আমি নিজে ওই দুইটারে জন্মের শাস্তি দিব!’
এখন প্রিজন ভ্যানে বসে অনেকটা স্বস্তিতে আছে বারেক মিয়া। প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠেছে। ভ্যানের বাইরে, সারাবাড়িতে পুলিশ আর মিডিয়ার লোক গিজগিজ করছে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মৃত্যুতে কেঁদে কেঁদে সাংবাদিকদের কাছে স্টেটমেন্ট দিচ্ছে জিসান রেমান। তাকে ধরে শোকাহত এমপি বাবা সালেক রহমান সান্ত্বনা দিচ্ছেন, সেই সঙ্গে খুনির উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছেন।
এই মিডিয়ার লোকদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যেই পুলিশ বারেক মিয়াকে ভ্যানের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে তেমন কোন জিজ্ঞাসাবাদ না করেই। হুট করে বেফাঁস কিছু বলে ভাইরাল না হয়ে যায় পরে! এখন তার আছে অনেক সময়, জিসানের শিখিয়ে দেয়া কথাগুলো মনে মনে গুছিয়ে নিতে লাগল সে।
কিছুদিন পর আরও অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনার ভিড়ে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার গতি যখন কিছুটা ধীর লয় হলো, তখনি প্রত্যাশিত ফোনটা পেলেন আদনান সিরাজ।
‘রানিয়ার খোঁজ চাই, সিরাজ, আর ওই ডিউকের, যাকে দিয়ে কাণ্ডটা ঘটিয়েছিস তুই!’
আদনানের কানে যেন বোমার মত বিস্ফোরিত হলো জিসানের কথাটা, সেই সঙ্গে অকথ্য গালাগাল চলল কিছুক্ষণ।
একতরফা চিল্লাফাল্লা করে জিসান একটু শান্ত হলে আদনান বললেন, ‘আমি নিউজে দেখেছি দুঃসংবাদটা। ওটার জন্যে তুমি আমাকে দায়ী করছ? এত সহজ একটা ডিল হতে যাচ্ছিল আমাদের মধ্যে, এরপর তুমি বিশ্বাস করো এমন বোকামি করব আমি? দেখো, জিসান, তোমার মনের অবস্থা বিবেচনা করে ফোন দিইনি এই ক’দিন। আমিও জানতে চাই আমার মেয়ে কোথায়। কোথায় ওকে আটকে রেখেছ? এখনও সময় আছে, বাবা, রানিয়াকে ফেরত দিয়ে জমির দলিল নিয়ে যাও।’
আবারও রাগে ফেটে পড়ল জিসান রেমান। ‘শালার পুত, আমারে অ্যাকটিং শিখাও? তোমার অ্যাকটিং আমি পুটকি দিয়া ভইরা দিমু। ডিউক যেখানেই থাকুক, পাঠাইস ওরে, নতুন ডিল হবে!’
কল কেটে যাবার পর পকেট থেকে অন্য আরেকটা মোবাইল বের করলেন আদনান। এটা ডিউকের দেয়া, কী সব সিকিউরিটি ফিচার নাকি সেট করা। এতসব অত্যাধুনিক ইকুইপমেণ্ট ছেলেটা কোথায় পায় কে জানে! আফসোস হয় তাঁর এই ভেবে যে, মেয়েটার জন্যে এরকম একজন বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী যুবককে জামাই হিসেবে পেলে তাঁর আর কোন দুশ্চিন্তা থাকত না। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি।
দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে জিসানের কথাগুলো জানাবেন বলে ডিউককে কল করলেন আদনান।
পরদিন গুলশানে রহমান গ্রুপের মালিকানাধীন চারতারকা হোটেল ডেভন-এ অ্যাপয়েন্টমেন্ট রক্ষা করতে হাজির হলো মাসুদ রানা। রিসেপশনে বলা ছিল, একজন সিনিয়র এক্সিকিউটিভ নিজে ওকে এসকর্ট করে বেইসমেন্টে নিয়ে এল লিফটে চেপে। এরই মধ্যে ও খেয়াল করেছে, স্টাফরা ছাড়া দেশি কেউ নেই। গেস্ট যাকেই দেখতে পেল, সবাই বিদেশি। এক্সিকিউটিভকে প্রশ্ন করে জানতে পারল যে, এখানে বিদেশি ছাড়া অন্য কোন বোর্ডার বা গেস্ট অ্যালাউ করা হয় না। শুধু স্টাফ, মালিকের পরিবারের সদস্য আর নারী এসকর্টরা এই নিয়মের বাইরে।
বেইসমেন্টের চওড়া, আলোকিত প্যাসেজ ধরে হেঁটে গিয়ে বিশাল সাইজের এক দরজার সামনে দাঁড়াল ওরা। হোটেল স্টাফ দরজা ঠেলে খুলল নিঃশব্দে, রানাকে প্রবেশ করতে দিয়ে পরে নিজেও ঢুকল। জায়গাটা দেখে অবাক হলো রানা। টার্কিশ হাম্মামের মত বিশাল স্পেস, মাঝখানে বড়সড় একটা সুইমিং পুল, পাথর দিয়ে বাথটাবের মত করে ডিজাইন করা হয়েছে, বাষ্প উঠছে পানি থেকে। সুইমিং পুল থেকে উঠলেই গেস্টদের জন্যে দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে শ্বেত পাথরে তৈরি প্রশস্ত বসার জায়গা, চাইলে কেউ শুয়েও পড়তে পারে। তবে, ধারণা করল রানা, এটা জিসান রেমানের প্রাইভেট পুল। সুইমিং পুলে এমুহূর্তে জিসানকেই দেখা যাচ্ছে, সঙ্গে এক বিদেশিনী, পরনের ছোট্ট বিকিনি রমণীয় প্রাইভেট পার্টস ঢেকে রেখেছে। মনে মনে হাসল ও, বেচারা জিসানকে এখনও স্ট্রেইট পুরুষের অভিনয় করে যেতে হচ্ছে। নাকি ছেলেটা বাইসেক্সুয়াল?
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ রানাকে রেখে বেরিয়ে গেছে। নিজের বাঁ দিকে একজন বডিগার্ড দেখতে পেল ও, মনোযোগ হাতের ম্যাগাজিনে, যদিও সন্দেহ আছে। এখন থেকে প্রতিটা সেকেণ্ড তার সমস্ত ইন্দ্রিয় ফলো করবে ওকে। বসের ইঙ্গিত পেলেই কোমরের পেছন থেকে হয়তো হাতে উঠে আসবে অগ্নিঝরা পিস্তল।
রানাকে দেখে হাত নাড়ল জিসান, ইশারা করল কাপড়- চোপড় ছেড়ে পুলে নেমে পড়ার। অনেকটা কর্তৃত্বের ভঙ্গিতে। তাকে পাত্তা দিল না রানা, শ্বেত পাথরের আসনটাতে বসে পড়ল। এবার সুন্দরী সঙ্গিনীকে ইশারা করল জিসান। প্রায় নগ্ন শরীরে হিল্লোল তুলে সাবলীল ভঙ্গিতে পুল থেকে উঠে পড়ল মেয়েটা, বিশাল ঘরটার দূর প্রান্তে গিয়ে একটা ফ্লোর টাওয়েল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল উপুড় হয়ে।
সেখান থেকে চোখ ফিরিয়ে সুইমিং পুলের কিনারে এসে উঠে দাঁড়াল জিসান, বেশ সুঠাম দেহ তার। পাশে রাখা নিচু একটা টেবিল থেকে হাত বাড়িয়ে টাওয়েলটা নিয়ে কোমরে জড়াল সে, তারপর রানার পাশে এসে বসল।
কিছুক্ষণ নীরবতা। স্নায়ুর জোর পরীক্ষায় হারতে রাজি নয় রানা, তাই টু শব্দও করল না। ব্যক্তিত্বের পরীক্ষায় দ্বিতীয়বার হারল জিসান, তবে চেহারায় সেটা বুঝতে না দিয়ে শান্ত স্বরেই বলল, ‘কেন ওকে খুন করলে, ডিউক? ওর সঙ্গে তো তোমার কোন শত্রুতা ছিল না। বাবা সিরাজ টাকা দিল আর তুমি স্যামির গলা কেটে দিলে?’
আদনান সিরাজকে ব্যঙ্গ করে বাবা সিরাজ বলছে জিসান। সেদিকে ভুরুক্ষেপ না করে চেহারায় একটু কাঠিন্য আনল মাসুদ রানা। ‘ডোন্ট বি আ ফুল, জিসান। আমি প্রফেশনাল। একজন প্রফেশনাল হিটম্যান কখনও ওভাবে খুন করবে না। আমাদের পছন্দের জায়গা হচ্ছে স্টারনামের ফাঁকফোকর, যাতে একবারেই হৃৎপিণ্ড স্পর্শ করা যায়, রক্তপাতও কম হয়। গলায় বা মাথায় ছুরি বা গুলি চালানো মানে হচ্ছে রক্ত আর ঘিলু ছিটানো। পরনের পোশাক নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। আমি নিউজে দেখেছি ক্রাইম সিনটা কেমন ছিল। ওটা একেবারেই কারও ইমপালসিভ রিয়্যাকশন অথবা সিরিয়াল কিল…’
‘অথবা কোন ড্রাগ অ্যাডিক্টের আক্রোশ!’ ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল জিসান। ওর চোখেমুখে কী যেন খুঁজছে। ভাবলেশহীন থাকল রানা। ‘রানিয়া খুনটা করতে পারে?’
‘সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সেক্ষেত্রে ওকেই জিজ্ঞেস করছ না কেন? তোমার কাছেই তো থাকে।’
খানিকটা দ্বিধান্বিত দেখা গেল জিসানকে, কিছু একটা বলবে কি বলবে না, সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তারপর বলেই ফেলল, ‘রানিয়া আমার কাছে নেই। পালিয়ে গেছে ও!’
‘হোয়াট!’ ডিউকের প্রতিক্রিয়া হলো দেখার মত, এমনকী জিসানও চমকে গেল। বডিগার্ড আর শ্বেতসুন্দরী দু’জনেই এদিকে তাকাল, কিছুটা অবাক। কোনদিন কাউকে বসের সামনে এভাবে শাউট করতে দেখেনি
‘এখানে খামোকা সময় নষ্ট করছি আমি। তোমার কাছে আমাদের যা দরকার, তা আর নেই। সুতরাং, আওয়ার ডিল ইয অফ। উই’ল নট মিট এগেইন।’
রেগেমেগে চলে যাবার জন্যে দাঁড়িয়ে পড়ল রানা। ওর অভিনয় নিশ্চয়ই নিখুঁত, কারণ ততক্ষণে দু’হাত শূন্যে তুলে ওকে শান্ত করার জন্যে দাঁড়িয়ে পড়েছে জিসানও। অর্থাৎ, আপাতত মেনে নিয়েছে ডিউক স্যামি হত্যায় জড়িত নয়। অন্য একটা চিন্তাও তার মাথায় খেলে গেল।
‘একটা শেষ তো কী হয়েছে, নতুন আরেকটা ডিল হতে পারে। আফটার অল, ব্যবসায়ী মানুষ আমরা।’
জিসানের নতুন করে কী বলার আছে শোনার জন্যে রসল আবার রানা। ‘ইট’স বেটার ওয়ার্থ ইট।’
‘তার আগে তোমাকে একটা গল্প বলি, শোনো। স্কুলে স্যামির সঙ্গে আমার মেলামেশা দেখে সহপাঠীরা খুব খেপাত, সিনিয়র স্টুডেন্টরাও বাদ যেত না। প্রায়ই মেয়েলি একটা গালি ব্যবহার করত ওকে উদ্দেশ্য করে। আমার রাগ হলেও কিছু বলতাম না, কারণ স্যামি পানি ঘোলা করতে চাইত না। একদিন ওকে রাস্তায় একা পেয়ে চরম বুলিইং করে কয়েকটা ছেলে। সেইবার প্রথম ওকে আত্মহত্যার চেষ্টা করতে দেখি। টয়লেট-ক্লিনিং লিকুয়িড খেয়ে সুইসাইড অ্যাটেম্প্ট। রাগে- ক্ষোভে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি, জানতাম না কারা ছিল ওই ছেলেগুলো। স্কুলের না বাইরের, স্যামির বলার মত অবস্থা ছিল না। ডাক্তাররা যখন হাসপাতালে ওকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে, আমি তখন মুখচেনা কিছু ক্লাসমেটকে খুঁজে বের করি যারা প্রায়ই ওকে বুলি করত। ছেলেগুলো স্বীকার করতে চায়নি কে বা কারা স্যামিকে হেনস্থা করেছে। তাই আমি দু’তিনজনকে ছুরি দিয়ে স্ট্যাব করি, এর মধ্যে একজন মরে যায়। আইনি ঝামেলা শেষে পরবর্তী সময়ে বাবা আমাদের দুই বন্ধুকেই বিদেশে পাঠিয়ে দেন পড়াশোনাটা শেষ করার জন্যে। যাই হোক, পয়েন্ট অভ দ্য স্টোরি কী, জানো?’
চুপচাপ শুনছিল রানা, কোন মন্তব্য করল না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বুলিইং সাধারণ এক প্রকট সমস্যা। কিন্তু এই ব্যাপারটা যাঁদের দায়িত্ব তাঁরা কেউই অ্যাড্রেস করেন না, ফলে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কোমলমতি শিশুরা। ওদের জন্যে রানা সমব্যথী, তাই জিসানের কথার পিঠে চুপ করেই থাকল। সে-ই বলুক।
‘পয়েন্টটা হলো, স্যামির ওপর একটা টোকাও আমি সহ্য করিনি কখনও। মূল অপরাধীকে যদি না পাই, সমস্যা নেই, যাদের সন্দেহ হয় তাদেরকেই শেষ করে দিই আমি। আমার যে বিজনেস পার্টনারের কারণে স্যামি দেশ ত্যাগ করেছিল, তাকেও আমি গায়েন করে দিয়েছি। আমার যেসব বান্ধবী স্যামিকে আমার মতই গুরুত্ব দেয়নি, ওদেরও শাস্তি পেতে হয়েছে। যাই হোক, এখন আমার সন্দেহ রানিয়া আর বাবা সিরাজের প্রতি। ওরা তোমার অজান্তেই অন্য কোন খুনিকে হায়ার করে থাকতে পারে, যে রানিয়াকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। এবং স্যামিকে হত্যা করে মার্ডার উইপন ও ভিডিয়ো ফুটেজের মত এভিডেন্সও সরিয়ে ফেলেছে। তোমার কী মনে হয়, ডিউক?’
কিছুটা চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রানা। ‘হুম, তেমনটি হওয়া অস্বাভাবিক নয়, অতীতে বেশ কয়েকজন ক্লায়েন্ট আমাকে ডাবলক্রস করেছে, আর আদনান সিরাজও দুধে ধোয়া তুলসী পাতা নয়।
উৎফুল্ল দেখাল জিসানকে। নিচু গলায় বলল, ‘এই তো বুঝতে পারছ। এবার কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার পালা। রানিয়াকে আমি নিজেই খুঁজে নেব, তোমার সঙ্গে আমার নতুন ডিলটা হলো: তুমি বাবা সিরাজকে খুন করবে। বিশ লাখ টাকা পাবে।’
ভেতরে ভেতরে চমকে গেলেও চেহারা নির্লিপ্ত রাখল রানা। ‘তাকে খুন করা তোমার লোকদের জন্যে ওয়ান-টুর ব্যাপার। এত টাকার কন্ট্রাক্ট আমাকে কেন দেবে?’
ডানহাতের তর্জনী আর মধ্যমা একসঙ্গে তুলল জিসান। ‘দুটো কারণে। এক, সে খুন হলে আমার বাবা বা আমার প্রতি কেউ যেন আঙুল না তোলে; দুই, আমাদের ফার্স্ট ডিলটা অফ হয়ে যাওয়ায় বাবা সিরাজ আর তোমাকে বাকি অর্ধেক টাকা দেবে না। তাই আমার এই সেকেণ্ড অফারটা তোমার জন্যে কমপেনসেশন। তা ছাড়া, ওই যে বললাম, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। তার কিলার দিয়ে তাকেই খুন করানোর মাঝে মধুর প্রতিশোধের একটা ব্যাপার আছে, তাই না!’
‘যদি আমি তোমার এই অফারটা না নিই? আমি কাকে ক্লায়েন্ট হিসেবে গ্রহণ করব বা করব না, এটা কিন্তু সম্পূর্ণ আমার এখতিয়ার। ক্লায়েন্টের চয়েস নয়।’
ডিউক কি খেলাচ্ছে তাকে? মুখটা শক্ত করল জিসান। ‘সেটা তুমিই ঠিক করবে নিশ্চয়ই। সেক্ষেত্রে আমার নিজেকেই ব্যাপারটা দেখতে হবে। তবে কি জানো, তোমাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে, অনেক দামি দামি ক্লায়েন্ট পেতে আমার পক্ষে থাকলে। এখন যদি তুমি ওয়াকআউট করো, আমি তোমাকেও সন্দেহ করা শুরু করব।’
‘বি কেয়ারফুল, জিসান। ইউ ডোন্ট ওয়ান্ট টু গো দেয়ার, ট্রাস্ট মি,’ শীতল কণ্ঠ রানার, শেষ করল এই বলে, ‘পঞ্চাশ লাখ। কাজের আগে পঁচিশ, পরে পঁচিশ। একটা অফশোর অ্যাকাউন্টে পাঠাবে।’
ওয়ালেট থেকে একটা কার্ড বের করে জিসানকে দিল রানা। কার্ডে শুধু ওর বিদেশি অ্যাকাউন্ট নাম্বারটা লেখা। ওকে রীতিমত প্রস্তুত দেখে অবাক হলো এমপি-পুত্র, সে যে এমন প্রস্তাব দেবে মানুষটা যেন জানত!
‘জাস্ট একটা কৌতূহল,’ কার্ডটা উল্টেপাল্টে দেখে মুচকি হেসে বলল জিসান, ‘এই নাম্বার দিয়ে কি তোমাকে ট্রেস করা যাবে?’
রানাও পাল্টা রহস্যময় হাসি দিল। ‘চেষ্টা করে দেখতে পারো। ওখান থেকে টাকা মুহূর্তে অন্য এক অ্যাকাউন্টে ফরোয়ার্ড হয়ে যাবে, যেটার খবর তোমার বা কারোরই জানা নেই।’
ফেয়ার এনাফ। এই উপলক্ষে এসো একটু গলা ভেজানো যাক,’ চোখ টিপল জিসান। ‘চাইলে এনজয়ও করতে পারো, ভাল জিনিস!’ বিদেশিনী সুন্দরীর দিকে ইঙ্গিত করছে সে।
‘যতক্ষণ সময় আছে এনজয় করে নে, ব্যাটা,’ মনে মনে বলল রানা। মুখে বলল, ‘এনজয় ইয়োর টাইম ওয়াইলি অ্যাণ্ড লেট মি ড্র মাই জব।’
হা-হা করে হাসল জিসান, তারপর চুটকি বাজাল। চট্ করে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়াল সেই মেয়েটা। ওয়াল- কেবিনেট থেকে স্যামসোনাইটের একটা ব্যাগ বের করল, ভেতরে ল্যাপটপ। কাছে এসে জিসানের হাত থেকে কার্ডটা নিল, ইতিমধ্যে বুকে পেঁচিয়ে নিয়েছে একটা টাওয়েল। চালুই ছিল ল্যাপটপ, দ্রুত নির্দিষ্ট সাইটে লগ-ইন করে ডিউকের অ্যাকাউন্ট নাম্বার পাঞ্চ করে পঁচিশ লাখ টাকার সমপরিমাণ ইউ.এস. ডলার ট্রান্সফার করে দিল।
প্রসন্নচিত্তে হাম্মামখানা থেকে বিদায় নিল রানা। এবার আদনান সিরাজের একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
.
রানাও দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল, আর অমনি কাকতালীয়ভাবে হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিয়োটা রিসিভ করল জিসান। টেক্সট মেসেজও আছে, কিন্তু ভিডিয়োটা প্লে করেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠল সে। তার আর স্যামির অন্তরঙ্গ মুহূর্তের রেকর্ডিং, গোপনে ধারণ করা ফুল এইচডি ফুটেজে পরিষ্কার চেনা যাচ্ছে দু’জনকেই!
জিসানের মনে হলো হৃৎপিণ্ডটা তার খাঁচা থেকে বেরিয়ে যাবে। মাথার ভেতরটাও প্রচণ্ডরকম উত্তপ্ত হয়ে উঠল। নাক দিয়ে বেরোচ্ছে গরম ধোঁয়া। একই দিনে দ্বিতীয়বার চমকাল বডিগার্ড আর বিদেশিনী। বসের সঙ্গে আজ ঘটছেটা কী?
ওদের দিকে ভুরুক্ষেপ না করে ভাবছে জিসান রেমান। এই ফুটেজ অনলাইনে লিক হলে সারাদেশের পত্র-পত্রিকায়, টিভিতে ইনস্ট্যান্ট নিউজ হবে, তার আর এমপি বাবার তো বটেই, পরিবারের কারও মান-সম্মান থাকবে না। বাবাকে সংসদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে, তাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। নইলে পড়বে মানুষের রোষানলে। সবচেয়ে বড় কথা, স্যামির মার্ডার কেসের প্রধান সন্দেহভাজন আসামীর তালিকায় চলে আসবে তার নাম!
ভিডিয়ো লিঙ্কের নিচের মেসেজটা এবার পড়ল জিসান। বলা হয়েছে, রানিয়া সিরাজকে খোঁজার চেষ্টা করলে কিংবা কোন ক্ষতি করার অ্যাটেম্প্ট নিলে এই ভিডিয়ো ভাইরাল করে দেয়া হবে। সেণ্ডার তার নাম লেখেনি, নাম্বারটাও অচেনা। জিসানের সরকারি প্রশাসনিক স্তরে যেসব কন্ট্যাক্ট আছে, তাদের ব্যবহার করে নাম্বারটা হয়তো ট্রেস করা যাবে, কিন্তু ব্যাপারটা সময়সাপেক্ষ হতে পারে। একই সঙ্গে রানিয়াকে দ্রুত খুঁজে বের করতে হবে। ওকে জিম্মি করেই এই ভিডিয়োর সোর্সকে পাওয়া যাবে। এখন প্রচুর লোক দরকার হবে তার, বাবার সাহায্য নেবে নাকি? নাহ্, আপাতত থাক। তার ডানহাত রকিকে লাগিয়ে দিতে হবে কাজে। এদিকে ডিউক তো চলে গেল আদনান সিরাজকে খুন করতে, থামাবে ওকে? না, থাক। এক্ষুণি হয়তো খুনটা হবে না, যেহেতু ডিউক প্ল্যানিং ছাড়া কোন কাজ করে না। আর খুন হলেও সমস্যা নেই, আপদ তাড়াতাড়ি বিদায় হলেই ভাল।
তবে ডিউকও আছে তার সন্দেহের তালিকায়। আপাতত এই ভিডিয়ো লিকিঙের ঝড়টা সামাল দিই, তারপর ওই মস্তানের ব্যবস্থা হবে। নিজের সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট হয়ে রকিকে ফোনকল দিল জিসান, দাঁতে দাঁত চেপে ভাবছে: বাবা সিরাজ, ডিউককে খেপিয়ে দিয়েছি, এবার তোমার খেল খতম!
কিন্তু রকির ফোনে তো কল ঢুকছে না, ব্যাপার কী? আবার সেণ্ড কী-তে ট্যাপ করতে যাবে, এমন সময় পাল্টা রিংটোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে নামটা দেখে খুশিতে দাঁত বেরিয়ে গেল জিসানের। রানিয়া কল দিয়েছে!
রানার প্ল্যান খুব সিম্পল। প্রথমত, নায়িকা শিবা সুস্মিতা একটা ফেইক নাম্বার দিয়ে জিসানকে হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিয়ো আর মেসেজ পাঠাবে, আর তাতে উত্তেজিত হয়ে সে নিজের লোকদের মাঠে নামাবে রানিয়ার খোঁজে। সিম ট্র্যাকিঙের চেষ্টা হতে পারে কিন্তু শিবাকে দেয়া ডিউকের শাপলা ব্র্যাণ্ডের বিশেষ ফোনটাতে জিপিএস এনকোডার চিপ থাকায় লোকেশন ভুলভাল দেখাবে। সুতরাং, ওকে স্বেচ্ছায় সাহায্য করতে রাজি হওয়ায় শিবার বিপদের ভয় নেই।
দ্বিতীয় পদক্ষেপ, জিসানের আঙুলের ছাপ জোগাড় করা। লোকটার নিশ্চয়ই শত শত অনুচর নেই, বিশ-ত্রিশজনও যদি থাকে, সবাই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে এখনি ছড়িয়ে পড়বে সারা ঢাকায়। অর্থাৎ, জিসানের বেশিরভাগ ডেরা আজ খালি থাকবে অথবা মিনিমাম পাহারা থাকবে। এই সুযোগে রানার ঠিক করা এক ঘাঘু চোর চুরি করতে যাবে, গত রাতে জিসান যে আস্তানায় ছিল, সেখানে। তার কাছে একটা ইউভি, আরেকটা ইনফ্রারেড মিনি টর্চ থাকবে, যেটা দিয়ে সম্ভাব্য সবরকম সারফেসে-গ্লাস, মেটাল, প্লাস্টিক, কাগজ ইত্যাদি- আঙুলের ছাপ সনাক্ত করা যাবে। ঝানু চোর বুঝে নেবে বাড়ির মালিক কোথায় কোথায় খালি হাতে স্পর্শ করতে পারে, সেই সঙ্গে নিজের ইচ্ছেমত লুটপাট করবে, যাতে ঘটনা অথেনটিক চুরি বলেই মনে হয়।
তৃতীয় পদক্ষেপ, এভিডেন্স রোপণ করা। চুরি করে সংগ্রহ করা আঙুলের ছাপ কৌশলে বসাবে সেই মার্ডার উইপন বা কিচেন নাইফের বাটে, যাতে মনে হয় জিসানই ওটা ব্যবহার করে স্যামিকে খুন করেছে। খুব ভালমত ফরেনসিক টেস্ট করা হলে হয়তো ফাঁকিবাজিটা ধরা পড়বে, কিন্তু ব্যাটা ক’দিন জেলের ভাত তো খাবে। সেই সুযোগে রানিয়া সিরাজ দেশের বাইরে চলে যেতে পারবে। যদিও রানা চাইলে ওই নোংরা ফুটেজ সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারে, কিন্তু মন সায় দিচ্ছে না। একেবারে বাধ্য না হলে এটা করবে না ও। লাস্ট রিসোর্ট।
পুলিশের ইনভেস্টিগেটরদের জন্যে জল ঘোলা করতে আরও কিছু রোপণ করার মত পেলে ভাল হত। হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মত মাথায় এল রানিয়ার পরা হুডিটার কথা। স্যামিকে অ্যাক্সিডেন্টালি মার্ডার করার আগে ওদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়েছিল। ছেলেটার কয়েকটা চুল-টুল ছিঁড়ে হুডি পুলওভারে আটকে যায়নি তো? একটা-দুটো হলেও চলবে। ওর মনে আছে, ওই রক্ত লাগা হুডি পরা অবস্থাতেই সেদিন রাতে গোপন ঠিকানায় মেয়েটাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ওয়াশ করে ফেলেনি তো? কথাটা মনে হতেই দ্রুত আদনান সিরাজকে ফোন দিল ও বার্নার ফোনে, যাতে কল ট্যাপড় না হয়। হুডির কথা জিজ্ঞেস করতেই হাঁ হয়ে গেলেন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত আদনান। রানিয়াকে পাহারারত কোন গার্ডের কাছে এখন ফোন-টোন নেই, তাই এ-ক’দিন যোগাযোগও নেই। তবে হ্যাঁ, বুয়ার কাছে একটা পুরনো মডেলের নোকিয়া বাটন ফোন আছে, কল দিয়ে দেখবেন নাকি বুয়া ধরে কি না? কিন্তু লাভ হলো না, ডিউকের কল কেটে মহিলার ফোনে কল দিয়ে কোন সাড়া পেলেন না। অপারেটরের রেকর্ডেড ভয়েস বলছে মোবাইলটা বন্ধ।
কলব্যাক করে রানাকে তথ্যটা জানিয়ে দিলেন আদনান। জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন তা হলে কী করা যায়?’
রানা জানাল, কিছুই করতে হবে না। যতটুকু প্রস্তুতি নিয়েছে, সেটা যথেষ্ট। এবার তিনি যেন বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যান আজ রাতের জন্যে। লোকজনের মাঝে থাকলে ভাল হয়, অ্যালিবাই শক্ত হবে। আজ রাতে যা-ই ঘটুক, কেউ আদনান সিরাজের দিকে আঙুল তুলবে না।
ওদিকে রকি তার দলবল নিয়ে রওনা হয়ে গিয়েছে রানিয়ার ঠিকানায়। রীতিমত যুদ্ধের প্রস্তুতি তাদের। জানে, আদনান সিরাজের গার্ডরা বিনা যুদ্ধে মেয়েটাকে শত্রুর হাতে তুলে দেবে না। সবক’টার লাশের ওপর দিয়ে ওকে ছিনিয়ে আনতে হবে বসের জন্যে।
রানিয়ার কল পেয়ে আনন্দ আর ধরে না জিসানের। অজ্ঞাত কারও পাঠানো ফুটেজটা দেখার পর একবার মনে হচ্ছিল আত্মহত্যা করবে কি না, এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে দেহ-মন তার হালকা হয়ে গেছে। মেয়েটাকে হাতের মুঠোয় পেলে সব টেনশন শেষ, রকি কোন কাজে ব্যর্থ হয় না। আবার ডিউকও ব্যর্থ হয় না। বাপ-বেটি আর ব্ল্যাকমেইলার, আজকে রাতের মধ্যেই সব শহীদ হয়ে যাবে!
মনে মনে হাসছে জিসান রেমান।
কী যেন বলছিল রানিয়া?
‘প্লিয, ডার্লিং, বোঝার চেষ্টা করো, খুনটা আমি ইচ্ছে করে করিনি। হঠাৎ কী হয়ে গেল আমি জানি না। তোমার অগ্নিমূর্তি কল্পনা করে আমি পালিয়ে এসেছি। কিন্তু এখানে বাবা আমাকে বন্দি করে রেখেছে। আমি আর নিতে পারছি না, জিসান! তুমিই আমার জান, তুমিই আমার জীবন, এখানে আমি আর একমুহূর্ত থাকতে চাই না। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও, প্লিয। যদি তুমি আমাকে নিতে আসো, আমি ভাবব তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ।’
এক নাগাড়ে দ্রুত কথাগুলো বলে থেমেছিল রানিয়া। উৎফুল্লের হাসি চেপে জিসান বলেছিল, ‘কী যে বলো, রানিয়া। তুমি তো আমার রানি, রানি! তুমি না করলে স্যামিকে আমিই খুন করতাম। বড্ড বেড়ে গিয়েছিল, আমাকে ছেড়ে অন্য পুরুষের সঙ্গে… যাই হোক, তুমি ওকে শাস্তি দিয়ে বরং আমার উপকারই করলে। শোনো, আমি নিজেই তোমাকে নিতে আসব, ঠিকানাটা দাও।’
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না রানিয়া। এত জটিল সমস্যার এত সহজ সমাধান হয়ে গেছে! ওর প্রিয়তম পুরুষ ওকে মাফ করে দিয়েছে, এত সুখ আর আনন্দ কোথায় রাখবে সে! উচ্ছ্বসিত ছোট বাচ্চার মত লাফিয়ে উঠছিল রানিয়া, ফিসফিসিয়ে বলেছিল, ‘আই লাভ ইউ, জিসান। টেক মি ব্যাক টু ইউ অ্যাণ্ড টেক মাই লাইফ!’
তার তিন সঙ্গীকে নিয়ে আদনান সিরাজের গোপন বাংলোর সন্নিকটে উপস্থিত হলো রকি। জায়গাটা জংলামত, সারি সারি গাছ আর ঝোপের আড়াল নিয়ে পৌঁছাতে অসুবিধে হয়নি। গাড়িটা রেখে এসেছে এক কি.মি. দূরে, ড্রাইভার আছে ওটার পাহারায়। রকি জানে আদনানের চার-পাঁচজন গার্ড সার্বক্ষণিক নজর রাখবে বাড়িটার ওপরে। তবে তারা ডিটেক্ট করতে পারল তিনজনকে। একজন কিছুক্ষণ পর পর সীমানা ঘিরে চক্কর দিচ্ছে, একজন ছাদ থেকে খেয়াল রাখছে, তৃতীয় গার্ড বাড়ির ভেতরে। তবে একবার টেরেসে এসে ধূমপান করে গেছে সে।
ধারালো কমব্যাট নাইফটা ব্যবহার করে নিঃশব্দে সীমানা ঘেঁষে ভ্রমণরত গার্ডের গলা ফাঁক করে দিল রকি। তার গায়ে অমানুষিক শক্তি, লড়তেই পারেনি সদ্যমৃত লোকটা। রকির তিন সঙ্গী বাংলোর পেছন দিয়ে দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকল। বাউণ্ডারি ওয়ালের ওপরে চোখা কাঁচের টুকরো ফিক্স করা আছে। এরা মোটা কম্বল এনেছিল সঙ্গে, ওটা ব্যবহার করে দেয়াল টপকানো গেলেও গায়ে এবং নিতম্বে কিছু তীক্ষ্ণ খোঁচা খেতে হয়েছে। যদিও ব্যথাটা সহ্য করে নেয়ার মত।
তাদের মধ্যে দু’জন ছাদে চলে গেল দ্বিতীয় গার্ডের ব্যবস্থা করতে। অপর যুবক মেইন গেট ভেতর থেকে খুলে দিল, যাতে সহজে প্রবেশ করতে পারে রকি। এরপর দু’জন মিলে ছুটল তারা মেইন ভিলার দিকে।
প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে খুনি দু’জন উঠে এল ছাদে, কিন্তু নিঃশব্দে আসার পরেও আভাস পেয়ে গেছে দ্বিতীয় গার্ড। তার সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলের গুলি ঢুকে রকির ষণ্ডাদের একজনের গলার অন্যপাশ দিয়ে বেরোল। স্পট ডেড। বাজে একটা গালি দিয়ে নিজের শরীর উল্টোদিকে ছুঁড়ে দিল তার সঙ্গী। এরই ফাঁকে দেখেছে কোথায় লুকিয়ে গুলি করছে গার্ড।
ছাদ বড় হলেও আড়াল বলতে পানির ট্যাঙ্ক। সেটার ওপর ভরসা না করে কার্নিশের ধারে ঝুঁকে পড়া গাছটা বেয়ে নেমে যাবার চেষ্টা করবে ভাবল গার্ড, কিন্তু গাছের ডাল স্পর্শ করার আগেই পিঠে দুটো গুলি খেয়ে বাঁকা হয়ে গেল সে, তারপর ধুপ্ করে গিয়ে পড়ল নিচের মাটিতে। মারা গেছে পড়ার আগেই। সন্তুষ্ট চিত্তে ছাদের দখল নিল রকির সঙ্গী।
বাড়ির ভেতরে দোতলার করিডোরে ছিল তিন নম্বর গার্ড। মাত্র টয়লেট থেকে বেরিয়ে এসেছে সে। প্যান্টের যিপার ফেঁসে যাওয়ায় ওটা লাগানোর চেষ্টা করছে। কাঁধে ঝুলছে বারো গেজের শটগান। বেচারা রকিকে নিচে দেখতে পেল ঠিকই, কিন্তু যিপার আর শটগানের মাঝে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা বোঝার আগেই রকির নিখুঁত নিশানায় উড়ে গেল তার মগজ। সাইলেন্সার লাগানো গ্লক পিস্তল, তাই শুধু মাথা ফাটার ‘ফট’ একটা শব্দ হলো।
পুরো বাড়ি এখন ক্লিন। শুধু বাকি মহিলা দু’জন। ওপরের বেডরুমেই হয়তো পাওয়া যাবে ওদের। বসের নির্দেশ পরিষ্কার: ভোর পর্যন্ত সময় আছে। এর মধ্যেই সবক’জনকে মেরে ফেলতে হবে এবং এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে ডেডবডি না পাওয়া যায়। এমনকী বাদ যাবে না রানিয়াও। ওকেও মারতে হবে, তবে যন্ত্রণা দিয়ে। এই শাস্তি দেয়া হবে, কারণ জিসান বসের কাছ থেকে তার প্রেমিক স্যামিকে কেড়ে নিয়েছে বেয়াড়া মেয়েটা।
রকির শরীরটা গণ্ডারের মত পেশিবহুল। এই শক্ত শরীরটা দিয়ে কোমল নারীদেহ পিষে ফেলার মত অভিজ্ঞতা তার প্রচুর আছে। তার চাপে ছোটখাট রানিয়ার শরীরের হাড়গোড় ফেটে, ভেঙে এত টুকরো হবে যে, ওই ব্যথা হজম করার মত সহ্যশক্তি রানিয়ার হবে না!
মৃদু টোকা দিল রকি মাস্টার বেডরুমের দরজায়। বুয়ার কণ্ঠ শোনা গেল। তারপর খুট শব্দ হলো, দরজা খুলেই আতঙ্কে মুখে হাত চাপা দিল রানিয়ার মাতৃপ্রতিম বুয়া। আগে বেড়ে তার ছোট্ট মাথাটা মট করে ঘুরিয়ে দিতে মাত্র এক সেকেণ্ড লাগল রকির। শব্দ করে মেঝেতে পড়ল বুয়ার নিথর দেহ। সেই শব্দেই ঘুম ভেঙে গেল রানিয়ার। রকিকে চেনে ও, তাকে দেখেই খুশি হয়ে গেল। কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে রইল দরজার দিকে, চকচক করছে চোখজোড়া, এই বুঝি জিসান ঢুকল।
কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে দরজার বোল্ট টেনে ভেতর থেকে লক করে দিল রকি। তার কালো তেল চকচকে মুখে নিষ্ঠুর এক হাসি, চোখে আজন্মের লোভ। রানিয়া বুঝল, জিসান ওকে ত্যাগ করেছে, মিথ্যে বলেছে ফোনে। স্যামির মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পাঠিয়ে দিয়েছে রকি নামের এই মৃত্যুদানবকে। অনেক কষ্ট দিয়ে মারবে সে, আর এই ব্যবস্থা রানিয়া নিজেই করে দিয়েছে জিসানকে ফোন করে। ফোনের কথা মনে পড়তে আবার মনটা তিক্ত হয়ে গেল ওর। ওটা বুয়ার হ্যাণ্ডব্যাগে ছিল, সবাই যেখানে মোবাইল রেখে এসেছিল, তখন বুয়ার অজান্তেই ওদের সঙ্গে চলে এসেছিল যন্ত্রটা। কিন্তু চার্জার আনেনি, ফলে লুকিয়ে জিসানের সঙ্গে কথা বলার পর পরই ফুরিয়ে গিয়েছিল পুরনো মডেলের মোবাইলের চার্জ। দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে। রকিকে এগিয়ে আসতে দেখে চোখ ফেটে জল এল রানিয়ার। অস্ফুটে বলল, ‘বাবা, আমাকে বাঁচাও!’
রানার এভিডেন্স রোপণের কাজটা শেষ হয়েছে। জিসান এবার ভালমত ফেঁসে যাবে। এখন থেকে ঠিক দু’ঘণ্টা পর পুলিশ অজ্ঞাত এক চোরের ফোন কল পাবে। সে জানাবে আজ সন্ধ্যার পর একটা খালি বাসায় চুরি করতে গিয়ে ক্লজিটের ভেতরে লুকানো প্লাস্টিকের ব্যাগে মুড়িয়ে রাখা একটা রক্তাক্ত ছুরি দেখতে পেয়েছে। পুলিশের কোন কেসে জিনিসটা কাজে লাগতে পারে মনে করে অনেক ভেবে-চিন্তে কল দিয়েছে। পুলিশ চাইলে চুরির মালামাল সে ফেরত দিতে পারে, এমনকী তাদের সোর্স হিসেবেও কাজ করতে পারে। কিন্তু কোন মার্ডার কেসের ঝামেলায় জড়াতে রাজি নয় সে!
খাস ঢাকাইয়া এই চোরের নাম হচ্ছে সরকার বাবু। গিলটি মিয়ার ঝানু ও বিশ্বস্ত সাগরেদদের মধ্যে অন্যতম। তার আসল নাম সুবোধ সরকার আর ডাক নাম বাবু। কিন্তু চুরির লাইনে ‘বিখ্যাত’ হয়ে যাওয়ায় সুবোধটা বাদ পড়ে গেছে, সরকার বাবু হয়ে গেছে। প্রাক্তন ওস্তাদের মত লিকলিকে শরীরের ছোটখাট মানুষ সে, চুরির ঘটনা নিখুঁতভাবে ঘটিয়েছে। মিনি বারের কাবার্ডে জিসানের নিজের দামি গ্লাসটা সহজেই আলাদা করে চিনতে পেরেছিল। ইউভি লাইটে বুড়ো আঙুলের ছাপের অস্তিত্ব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল।
মাল ডেলিভারি পাবার পর বিসিআই-এর টেক টিমের কাছ থেকে শেখা কৌশলে জিসানের আঙুলের ছাপ অ্যাডহেসিভ টেপের সাহায্যে মার্ডার উইপন বা কিচেন নাইফটার হাতলে প্লেস করল রানা, নিজের কাজে মোটামুটি সন্তুষ্ট। এরপর নাইফটা নিজে গিয়ে রেখে দিল জিসানের জনশূন্য বাসাটায় ক্লজিটের ভেতরে ঝোলানো এক ওভারকোটের পকেটে। পুরো ব্যাপারটা পুলিশের তদন্তকারী অফিসারদের কিছুদিন ব্যতিব্যস্ত করে রাখবে।
শেষ কাজটুকু সেরে জিসান রেমানের শান্তিনগরের সেই পুরনো বাসা থেকে দেয়াল টপকে বেরিয়ে এল মাসুদ রানা। এবার চলেছে মেইন রোডের দিকে। ওর সুজুকি জিএন১২৫ বাইকটা পার্ক করা যেখানে। তবে সরাসরি না গিয়ে কয়েকটা লেন ঘুরল শুধু দেখার জন্যে যে পিছনে ফেউ আছে কি না। আনমনে শিস দিচ্ছে: হ্যায় আপনা দিল তো আওয়ারা! ভবঘুরে মনটা আমার!
একটা ফার্মেসির বাইরে ভবঘুরের মতই দাঁড়িয়ে আছে ওর বাইক, আরও দু’চারজন অ্যাপ রাইডার আছে আশপাশে। স্টার্ট দিতে গিয়ে হঠাৎ কেন যেন মনটা খচ খচ করে উঠল। পই পই করে বলার পরেও একটা মোবাইল রানিয়াদের সঙ্গে ঠিকই চলে গেছে আদনান সিরাজের সেই গোপন বাংলোতে। এই ব্যাপারটা নিয়ে ভদ্রলোক বয়সে মুরুব্বী হওয়া সত্ত্বেও তাকে বেশ বকাঝকা করেছে ও। তার ওপর আজ সন্ধ্যায় বন্ধ পাওয়া গিয়েছে ফোনটা। কোন বিপদের আশঙ্কা আছে? ওই ঠিকানার সঙ্গে আদনান সিরাজকে এত দ্রুত রিলেট করা মুশকিল হবে জিসানের পক্ষে। জায়গাটা বেশি দূরেও নয়, পূর্বাচল পার হয়েই।. একবার ঢুঁ মেরে আসবে নাকি? বিপদ না হলেও হুডিটা অন্তত একবার চেক করা যাবে।
বাইক নিয়ে চৌরাস্তা পার হয়ে বেইলি রোডে ঢুকে স্কুলটার দিকে মোড় নিতে গিয়ে নিশ্চিত হলো রানা, ফলো করা হচ্ছে ওকে। ওটা একটা সেডান-টয়োটা অ্যাভালন। ড্রাইভার দক্ষ হলে হালকা ট্রাফিকে ওর সুজুকি সুবিধা করতে পারবে না। জ্যাম লেগে গেলেও সমস্যা, গলি-টলি দিয়ে ছুটে ফাঁকি দেয়া কষ্টকর হবে। ঢাকা শহরের জ্যাম বলে কথা! দুর্ভাগ্য নাকি সৌভাগ্য, আজ রাতে রাস্তা অনেকটা ফাঁকাই বলা চলে। এখন দেখা যাক টয়োটার আরোহীদের উদ্দেশ্য কী। চাইলে ওর বাইকটাকে ধাক্কা দিতে পারে, তারপর গায়ের ওপর দিয়ে চলে যেতে পারে, অথবা ওকে আটক করে নিয়ে যেতে পারে। এই বিপদটা সহজ। কিন্তু যদি পুরোটা পথ অনুসরণ করে, তা হলে মুশকিল। কারণ রানা যেখানে যেতে চাইছে, সেখানে আর কাউকে পথসঙ্গী করা যাবে না!
বেইলি রোড থেকে মগবাজার রোড ধরে এগিয়ে শহীদ তাজউদ্দীন সড়কে পড়ল সুজুকি। পিছনে আঠার মত লেগে আছে টয়োটা। সম্ভবত ওর গন্তব্য পর্যন্ত ট্র্যাক করবে। কারা এরা? জিসানের লোক? নাকি ইউনিট-এক্স অথবা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের লোক, যারা ডিউকের আসল পরিচয় জানে না? যেই হোক, সরি, ফোক্স, টা-টা বাই-বাই!
মুহূর্তে বাইকের গতি বাড়াল রানা, মগবাজার রেলগেট ক্রসিঙের সিগন্যাল পড়ার আগেই পেরিয়ে গেল বাইকটা। দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি, ক্রসিং বার-টা যখন নিচে নামছে, সেই সময় ঝড়ের বেগে লাইন পেরিয়ে এল টয়োটা অ্যাভালন। ওর সুজুকি পান্থপথ-তেজগাঁও লিঙ্করোড অর্থাৎ কারওয়ান বাজার অভিমুখে বাঁক নিয়েছে, টয়োটাও তা-ই, মাত্র কয়েক গজ দূরে। কারওয়ান বাজার ফ্লাইওভার পেরিয়ে ডানদিকে ঘুরে গেছে যে রাস্তাটা, সেদিকে সামান্য স্পিড কমিয়ে বাইক ঘুরিয়ে নিল রানা, তারপর ছুটল উল্টোপথে এফডিসি রোড ধরে। স্পিড না কমিয়েই বাঁক ঘুরল টয়োটা, রাস্তার সঙ্গে চাকার ঘর্ষণে গা শিউরানো শব্দ হলো। হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও ক্রসিং থেকে ইতিউতি তাকাল ট্রাফিক পুলিশ, শব্দের উৎস খুঁজছে।
ড্রাইভার বেশ দক্ষ, মেনে নিল রানা। তবে বেশিক্ষণ খেলা যাবে না। ওর মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে, যদিও রিস্কি। ঠিকমত কাজটা করতে না পারলে কপালে খারাবি আছে। রাস্তার মাঝখানের ডিভাইডারের ওপরটা উঁচু লোহার গ্রিল দিয়ে আটকানো, সেই হাতিরঝিল মোড় পর্যন্ত। উৎসাহী পথিকদের যত্রতত্র রাস্তা-পারাপার থেকে নিরস্ত রাখাই উদ্দেশ্য। কিন্তু বাংলাদেশের পথিকেরা ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা ভালবাসে, তাই কেউ বা কারা গ্রিলের এক জায়গায় লোহার লম্বা বারগুলো ভেঙে সরিয়ে ফেলেছে, শুধু ওপরের আড়াআড়ি ধাতব অংশটা রয়ে গেছে। তিন-চার ফিট উচ্চতার সেই ফোকরে ওর নিচু বাইকটা হয়তো ঢুকে যাবে, আরোহী ঢুকবে কি না সন্দেহ।
কিন্তু এছাড়া উপায় নেই, ফেউ খসাতে হলে ওকে এক মিনিটের জন্যে হলেও একা হতে হবে। নিজেকে বাইকের পিঠে প্রায় শুইয়ে ফেলল রানা। মুভেবল লুকিং মিরর দুটোই যতটা সম্ভব নিচু করে দিল, তারপর ফাঁকা গ্রিলটা কাছে আসতেই তীব্র গতিতে ছুটল সেটা লক্ষ্য করে। ভাগ্য ভাল এদিকের ডিভাইডারটা ভেঙে ঢালু হয়ে রাস্তায় মিশেছে। তাই সুজুকিকে জাম্প করাতে হলো না। ওটার স্লিম বড়ি অনায়াসে ওকে নিয়ে ফোকরটা পার হয়ে অপরপ্রান্তে চলে এল চোখের পলকে। গ্রিলের তলার বার না থাকায় বাড়তি সুবিধা পেয়েছে, নইলে গতির ফলে হঠাৎ পিঠে ঘষা লাগলেও মেরুদণ্ড ভেঙে যেত। স্পিড তুলে ছোটার আগে পিঠ সামান্য উঁচু করল রানা, উল্টোদিকের রাস্তায় টয়োটাকে দেখে আরোহীদের উদ্দেশে হাত নেড়ে টা-টা জানাল। বেচারাদের এখন হাতিরঝিল মোড় পর্যন্ত সোজা গিয়ে ইউ-টার্ন নিয়ে ফিরে আসতে হবে। এরই মধ্যে ট্রেন চলে যাবার পর মোড় থেকে একঝাঁক গাড়ি ঢুকে গেছে এদিকের রাস্তায়। টয়োটার কমপক্ষে মিনিট দু’তিন লাগবে ওকে ধরে ফেলতে। রানার সুজুকি ততক্ষণে পগার পার।
পাঁচ মিনিট পর কারওয়ান বাজার চৌরাস্তায় এসে দ্বিধায় পড়ল টয়োটা অ্যাভালনের ড্রাইভার-কোন্দিকে গেল বাইকটা? ফার্মগেট, পান্থপথ, হাতিরপুল, শাহবাগ?
ফার্মগেট থেকে মহাখালি হয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলেছে মাসুদ রানা। উদ্দেশ্য হোটেল র্যাডিসন ব্লু’র সামনে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে ৩০০ ফিট ধরে পূর্বাচলে ঢোকা। তারপর গন্তব্য আদনান সিরাজের অজ্ঞাত মালিকানার বাংলো বাড়ি। মনে মনে প্রার্থনা করছে রানিয়া যেন নিরাপদে থাকে।
লোকেশন থেকে এক কি.মি. দূরে থাকতে বাইকটাকে ত্যাগ করল রানা। তবে ওর জানা নেই, সমান্তরালে অন্য এক বড় জংলামত জায়গার পাশে রকির ড্রাইভার ভ্যান নিয়ে অপেক্ষা করছে দলের সদস্যদের ফিরে আসার। তবে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি সে, মনের সুখে সিগারেটে টান দিচ্ছে আর গান ধরেছে: কেন পিরিতি বাড়াইলা রে, বন্ধু, ছাইড়া যাইবা যদি।
নিশুতি রাতে তার এই সুরেলা কণ্ঠ রানাকে সাবধান করে দিল। গান শোনার মেজাজে নেই ও, তাই ছুরির ঠাণ্ডা ব্লেডটা গায়কের ঘাড়ের পেছনে ছোঁয়াল। গান থামিয়ে কেঁপে উঠল ড্রাইভার।
‘গান তুমি ভালই গাও, কিন্তু সমস্যা হলো আমার মুড আর টাইম একদমই নেই। তাই চট করে বলে ফেলো দেখি, ওখানে ক’জন গিয়েছে? প্ল্যান কী ওদের?’
মুখ খোলার ইচ্ছে নেই লোকটার, পরে নিজে বিপদে পড়তে চায় না। কিন্তু ঘাড়ের পেছনে ছুরির খোঁচাটা জোরাল হলো। সেই সঙ্গে ভেজা কিছু পিঠ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। ওটা ঘাম না রক্ত তা নিয়ে গবেষণা করাটা বোকামি। আগন্তুককে পুরোপুরি সিরিয়াস মনে হচ্ছে। আপাতত মুখ খোলাই বাঁচার একমাত্র উপায়।
‘রকিসহ চারজন গিয়েছে। কাউকে বাঁচিয়ে রাখবে না, একেবারে শেষ করে দিয়ে আসবে। আ… আমি কোন কিলার না, বস্, জাস্ট ড্রাইভার।’
‘কিন্তু তোমরা ঠিকানা পেলে কীভাবে?’
‘ও, আচ্ছা, রকি আসার পথে বলাবলি করছিল, মেয়েটা নাকি বকে ফোন দিয়েছিল। মাফ চেয়ে বসের কাছে ফিরতে চায়। কিন্তু, বস্ আর ওকে চায় না।’
বাকিটা বুঝে নিল রানা। ওর মনের খচখচানিটাই সত্যি হলো শেষে। গায়ককে সার্চ করে কোন অস্ত্র পেল না। তার মোবাইলটা নিয়ে নিল। দেখল যে চারজন ওখানে গিয়েছে, তাদের নাম্বারগুলো সেভ করা আছে কি না। তারপর আচ্ছামত ড্রাইভারের মুখ-হাত বাঁধল। এবং গাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে হাঁটিয়ে নিয়ে এসে তার দুই পা-ও বাঁধল ভাল করে। আপাতত ঝামেলা পাকাতে পারবে না ড্রাইভার।
ওখান থেকে দ্রুত পদক্ষেপে বাংলোর কাছাকাছি চলে এল রানা। নিচ থেকেই দেখতে পেল মূল দালানের ছাদের কোণে সিগারেটের আলো। কয়েক সেকেণ্ড পরেই সরে গেল অবশ্য। টহল দিচ্ছে। চারজনের একজন মেইন গেটের কাছে থাকার সম্ভাবনা বেশি। বাউণ্ডারি ওয়ালে কোন ওয়ার্নিং ট্রিগার থাকলেও সেটা নিশ্চয়ই অকেজো করেছে রকির দলবল। সীমানা ঘেঁষে রওনা দিতেই পায়ের ধাক্কা লাগল একটা কিছুতে। আদনানের এক বডিগার্ডের মৃতদেহ। রানা নিশ্চিত এরা কেউ বেঁচে নেই। রানিয়া কি আছে? না থাকলে জিসানের কপালে দুঃখ আছে।
জ্যাকেটের পকেট থেকে প্রিয় ওয়ালথারটা বের করল রানা। ওটার নাকে লাগিয়ে নিল সাইলেন্সার, তারপর দেয়াল টপকাল অনায়াসে। কারণ রকিদের কম্বলগুলো এখনও সরানো হয়নি দেয়ালের ওপর থেকে। ওপারে নেমেই গাছের আড়ালে অপেক্ষা করল ছাদের ওপর থেকে সিগারেটের আলো আরেকবার সরে যাবার। এবার মৃদু খসখস শব্দ করল, যাতে মেইন গেটে দাঁড়ানো খুনি শুনে এদিকে চেক করতে আসে। আত্মবিশ্বাসী লোকটা কাউকে ডাক না দিয়ে একাই এগিয়ে এল। তার মানে কি ওরা সংখ্যায় কমে গিয়েছে নাকি?
রানা যেখানে একটু আগে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে এসে কিছু দেখার জন্য মাটির দিকে ঝুঁকল লোকটা। গাছের আড়াল থেকে শুধু হাতটা বের করে তার মাথায়, সাইলেন্সার তাক করল রানা, টিপে দিল ট্রিগার। মৃতদেহটা মাটিতে পড়ার আগেই ধরে ফেলল, তারপর চওড়া একটা ফ্লাওয়ার বেডের ওপাশে শুইয়ে দিল।
রকিকে বাদ দিলে আরও দু’জন আছে। এই বাড়িতে আগেও পদধূলি পড়েছে ডিউকরূপী মাসুদ রানার। তাই জানে সিঁড়ি না ভেঙে কীভাবে ছাদে ওঠা যায়। এর জন্যে ওকে এবার টারজান টারজান খেলতে হবে একটু। আদনানের গার্ডটা প্রাণ বাঁচাতে যে গাছের সাহায্যে ছাদ থেকে নিচে নামতে চেয়েছিল, সেই গাছ বেয়েই ছাদের কার্নিশে উঠল রানা। গার্ডের মৃতদেহ নিচে দেখে এসেছে, প্রায় ডেবে গেছে নরম মাটিতে।
সিগারেট ফোঁকা খুনিটার অবস্থান দেখার জন্যে ছাদের প্যারাপেট থেকে সামান্য মাথা উঁচু করল ও। ওর বাঁ দিকের কার্নিশ ধরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে লোকটা, খুঁজছে মেইন গেট পাহারারত সঙ্গীকে। হাতের পিস্তলটা তার সতর্কভঙ্গিতে ধরা, হয়তো বুঝে ফেলেছে বিপদ আছে আশপাশেই।
প্যারাপেটের আড়ালে থেকেই পকেট থেকে ড্রাইভারের মোবাইলটা বের করল রানা। রকির নাম্বারটা বাদ দিয়ে ‘ইনি মিনি মাইনি মো’ করে তিনটা নাম্বারের একটা বেছে নিয়ে ফোন দিল, তারপর নিজেই চমকে উঠল।
সিগারেটওয়ালার মোবাইল বাজেনি, বাজছে তার থেকে কয়েক গজ দূরে পড়ে থাকা আরেকটা ডেডবডির কাছ থেকে। সিমেন্টের তৈরি এক বেঞ্চের ওপাশে লাশটা পড়ে আছে বলে আগে দেখতে পায়নি ও। তার মানে ওটা রকির দ্বিতীয় চ্যালা, আগেই আদনানের কোন গার্ডের হাতে মরেছে।
চমকে গিয়েছে সিগারেটওয়ালাও। দ্রুত দৌড়ে গেল সে রিংটোন লক্ষ্য করে। হয়তো রকি বা নিখোঁজ সঙ্গী কল করেছে। কিন্তু মোবাইলটা হাতে নেবার আগেই চোখের কোণে খেয়াল করল কিছু একটা ছুটে আসছে এদিকে। ঝট্ করে ফিরে পিস্তল তাক করেই গুলি চালাল সে।
রানা প্যারাপেট পেরিয়ে ছাদে উঠেই সামনে একটা টব পেয়ে গেছে, ওটাই ছুঁড়ে দিয়েছে লাশের দিকে ঝুঁকে বসা লোকটার দিকে। রিফ্লেক্সবশত টবটার দিকেই গুলি চালিয়েছে সিগারেটওয়ালা। রানার জন্যে সহজ টার্গেট হয়ে পড়ল সে। বুকে আর মাথায় দুটো গুলি নিয়ে পরপারে যাত্রা করল।
এবার রইল শুধু রকি। সিঁড়ি ভেঙে সন্তর্পণে নিচে নেমে এল রানা। বড় কামরাটার দিকে এগিয়ে গেল বারান্দা ধরে। কামরার বিশাল ভারী দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। খোলার চেষ্টা করলে বা ধাক্কা দিলে সাবধান হয়ে যাবে রকি। রানিয়া আর ওর বুয়াকে মেরেও ফেলতে পারে সে। তার মত ষণ্ডাকে বাগে পেতে হলে অতর্কিতে হামলা করতে হবে, চমকে দিয়ে। দরজার গায়ে কান পাতল রানা। মেয়েলি কণ্ঠে কাকুতি-মিনতি করছে কেউ। রানিয়ার কণ্ঠ শোনেনি আগে ও, তবুও আশা করল এই গলা যেন ওরই হয়। স্বস্তির একটা অনুভূতি নিয়ে আবার ছাদে উঠে এল রানা। একদিকে বামন দেয়াল নেই, বরং ঢালু হয়ে ছাদের অংশ বড় কামরাটার টেরেসের দিকে ঝুঁকে গেছে। শেষ প্রান্ত থেকে মেঝের দূরত্ব সাত ফিটের মত হবে। ওখান থেকে লাফ দিলে সামান্য হলেও শব্দ হবে আর তাতে সতর্ক হয়ে যাবে রকি।
একটু ভেবে ঢালু অংশে সাবধানে নামল রানা। শুয়ে পড়ে এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে নিচের দিকে ঠেলছে নিজেকে। তাড়াহুড়ো করছে না, শব্দ এড়ানো এবং হঠাৎ পিছলে যাওয়া ঠেকানোতেই ওর যত মনোযোগ। অবশেষে ধৈর্যের পরীক্ষায় পাশ করে ঢালু ছাদের প্রান্তে পৌঁছাল। এবার পকেট থেকে রকির মৃত অনুচরের মোবাইলটা বের করল ও, তারপর রিং দিল রকির ফোনে। ঠিক দুই সেকেণ্ড পর লাফিয়ে নামল টেরেসের মেঝেতে। ওর পা পড়ার সঙ্গে মিল রেখে একই সময়ে বেজে উঠল রকির মোবাইল। রিংটোনের মিউজিকটা শুনে হাসল রানা, নায়িকা শিবা সুস্মিতার নতুন সিনেমার আইটেম সং ওটা, তুমুল জনপ্রিয় আজকাল। মনে মনে দুঃখবোধ করল ও, বেচারি শিবা আজ রাতে ওর এক ভক্তকে হারাতে যাচ্ছে!
ফোনটা বাজতেই ওটা কানে তুলে ‘হ্যালো’ বলতে গেল রকি, কিন্তুকল কেটে দিয়েছে রানা। এবার সুইচ-অফও করে দিল, যাতে রকি কলব্যাক করলে বেজে না ওঠে।
টেরেসটা পাশে চওড়া হলেও সামনের দিকে মাত্র আড়াই কি তিন ফিট। কামরায় ঢোকার কাঁচের স্লাইডিং থাই ডোর ফুটখানেক খোলা, মাঝে মধ্যে পর্দার একটা প্রান্ত সেই ফাঁকা অংশ দিয়ে বাইরে বেরোতে চাইছে, যেন ভেতরে যা-ই ঘটছে সেই ঘটনার সাক্ষী হতে চাইছে না।
তার পাল্টা কল কেউ ধরছে না বলে ভয়ঙ্কর বাজে এক গালি দিয়ে ধুপ্ করে মোবাইলটা কোথাও রাখল রকি, তারপর এগিয়ে গেল বিছানায় শুইয়ে বেঁধে রাখা রানিয়ার দিকে। অসহায় মেয়েটার নিম্নাঙ্গে কোন কাপড় নেই, অথচ মুখের ভেতরে একদলা কাপড় ঠেসে দেয়া।
রকির পিছনে, পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল রানা। লম্বা করা হাতে ওয়ালথার পিপিকে। রকির পিঠ দিয়ে ঢুকে হৃৎপিণ্ড ফুটো করবে বুলেট, এটাই ছিল প্ল্যান। কিন্তু চোখের কোণে কিছু একটা দেখেই দ্রুত ঘুরে গেল যুবক। গুলিটা বুকের বদলে তার বাইসেপের মাংসে আঁচড় কেটে বেরিয়ে গেল। একটুও গোঙাল না সে ব্যথায়, যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে হাতে প্যাঁচানো কোমরের বেল্টটা বিদ্যুৎবেগে চালাল। দ্বিতীয় গুলি ছোঁড়ার আগেই বেল্টের লেজের দিকটা ছোবল মারল রানার হাতে। ঝট্ করে ওয়ালথারটা উড়ে চলে গেল ঘরের এক কোণে। চাবুকের মত সপাং দংশনে হাতের চামড়া উঠে গেল ওর, একই সঙ্গে অমানুষিক যন্ত্রণা। সেটা ভুলে থাকার চেষ্টা করে হাতটা ঝাড়া দিল রানা কয়েকবার, হাতাহাতি লড়াইয়ের মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ওকে নিরস্ত্র দেখে বেল্ট হাত থেকে ফেলে দিল রকি। খালি গায়ে কিলবিল করছে পেশিগুলো, আস্ত এক গণ্ডার যেন। পিষে ফেলবে এবার সে সস্তা মস্তানটাকে। কয়েক দিন ধরে সুযোগ খুঁজছে, এবার বাগে পাওয়া গেছে। শালা, বসের সঙ্গে পাঙ্গা! প্রতিপক্ষকে কষ্ট দেবার আনন্দে তর সইল না তার, ছুটে গেল ভীমের মত ঘর কাঁপিয়ে। তাকে আসতে দেখে ম্যাটাডরের মত একপাশে সরে গেল রানা, লাথি মারল গোড়ালি বরাবর। ঠিকমত লাগলে হাড় সরে যেত, কিন্তু লাগল ঘষা। ব্রেক কষে নিজেকে সামলে নিল গণ্ডার। বামহাতে রদ্দা চালাল রানার ঘাড় বরাবর। মাথা নিচু করে আঘাতটা এড়াল রানা। বক্সিঙের ভঙ্গিতে কয়েকটা ঘুষি মারল প্রতিপক্ষের সোলার প্লেক্সাস বরাবর। এই ঘুষিতে দম বন্ধ হয়ে সটান মাটিতে শুয়ে পড়ার কথা, কিন্তু দিব্যি দাঁড়িয়ে রইল রকি, হাসছে। এবার খপ্ করে ধরল সে রানার ঘুষিটা, এক ঝটকায় নিজের দিকে টান দিয়েই ওর পুরো শরীর শূন্যে তুলে ফেলল, তারপর ছুঁড়ে মারল টেরেসের থাই-ডোরের গ্লাসের ওপরে।
কিন্তু সরাসরি কাঁচে ধাক্কা না খেয়ে মেঝেতে পড়ল রানা, ওর হাতের মুঠোয় ধরা খেয়ে ফড়ফড় করে ওপরের বার থেকে ছিঁড়ে নেমে এল সুদৃশ্য ভারী কার্টেন। প্রচণ্ড ব্যথা পেলেও দ্রুত উঠে দাঁড়াল ও। এই গণ্ডারের সামনে বেশিক্ষণ পড়ে থাকা যাবে না। হাড়গোড় সব গুঁড়ো করে ছাড়বে।
আবার মুখোমুখি হলো দুই ভয়ঙ্কর যোদ্ধা। পরস্পরকে আঘাত করে চলেছে ওরা, কিন্তু রানার বেশিরভাগ আঘাত তেমন ক্ষতি করতে পারছে না রকির। ওদিকে তার আঘাতগুলোতে জান বেরিয়ে যাবার অবস্থা হচ্ছে রানার। এরই মধ্যে এক চোখ ফুলে উঠেছে, ঠোঁট কেটে দরদর করে ঝরছে রক্ত। ঠিক এসময় এল রকির ডেথ রো, ওটা জায়গামত লাগলে সারাজীবনের জন্যে বোধহয় চিৎপটাং হয়েই থাকত ও, কিন্তু তার আগেই রিডিং ডেস্কের ওপরে রাখা ফুটখানেক লম্বা কাঁচের তৈরি ভারী ফ্লাওয়ার ভাসটা তুলে নিল ডানহাতে। পুরু কাঁচের তলাটা দিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত করল রকির ছুটে আসা মুঠির ওপর। মট্ করে ফ্যালাঞ্জেস বা আঙুলের বেইসের হাড়গুলো ভাঙার শব্দটা মধুর শোনাল রানার কানে। জান্তব একটা ঘোঁৎ শব্দ করে উঠল দানব, ওটাই তার ব্যথার আর্তনাদ। কাঁচের ভাস আবার সদ্ব্যবহার করতে চাইল রানা, কিন্তু পিছিয়ে গেছে প্রতিপক্ষ।
চরম ব্যথা পেয়ে ওকে পেটানোর সাধ মিটে গেছে রকির, ত্যাঁদড় মস্তানটাকে দ্রুত খতম করার জন্যে নিজের পিস্তলটা তুলে নিল বেডসাইড টেবিলের ওপর থেকে। শিকারের মগজ ছিটকানো দেখাটা উপভোগ করে সে, তাই পিস্তলের নল তাক করল রানার মাথায়, টিপে দিল ট্রিগার।
কিন্তু ভুল স্পটে দাঁড়িয়ে ছিল সে। তার পিছনে বিছানায় শোয়া রানিয়ার হাতদুটোই শুধু বাঁধা, পাজোড়া মুক্ত। নিজেকে মুচড়ে বিছানার কিনারায় চলে এসে শরীরের সমস্ত শক্তি আর মনের ঘৃণা এক করে লাথি চালাল রানিয়া রকির কোমরে। গুলি করার ঠিক আগমুহূর্তে হঠাৎ লাথি খেয়ে সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে গেল রকি। বেরিয়ে যাওয়া বুলেটটা রানার মাথায় না লেগে লাগল কাঁধের ওপরের মাংসে। বুলেটের ধাক্কায় পিছিয়ে গেল ওর শরীর, মনে হলো কাঁধে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা ভারী কার্টেনটা তুলে নিল। ওদিকে রাগের মাথায় পিস্তলের বাঁট দিয়ে রানিয়ার মাথায় বাড়ি মারতে যাচ্ছে রকি। মস্তানটাকে পড়ে যেতে দেখে নিয়েছে আগেই।
ভারী কার্টেনটা রকির মাথার ওপরে ছড়িয়ে দিয়ে তাকে ঢেকে ফেলল রানা, একই সঙ্গে ঝাপটা দিয়ে ফেলে দিল তার হাতের আগ্নেয়াস্ত্র। এরপর ইচ্ছেমত দিতে শুরু করল কিল-ঘুষি-লাথি। কার্টেনের ‘জাল’ থেকে বের হওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে নাচানাচি করছে গণ্ডার। এবার রানা মারল মোক্ষম মার। যেখানে মারলে হারকিউলিসও বাবাকে ডাকবে, সেখানে মারল লাথিটা-দুই উরুর ফাঁকে। তবে ব্যাটা কঠিন লোক, বাপকে না ডেকে ককিয়ে উঠে বসে পড়ল মেঝেতে।
নিজের ওয়ালথার ঘরের কোণ থেকে উদ্ধার করল রানা। চেম্বারে বুলেট লোড করাই ছিল, এখনও আছে। ফিরে চেয়ে দেখল উঠে দাঁড়িয়েছে রকি, ওকে খুন করার অদম্য ইচ্ছায় থরথর করে কাঁপছে সে। অবাক হলো ও লোকটার স্ট্যামিনা দেখে। একটা হাত উঁচিয়ে বলল, ‘দাঁড়াও, রকি, মরার আগে তোমার বসের পরিণতিটা দেখে যাবে না?’
প্রশ্নবোধক চাউনি দিল বুনো ক্ষ্যাপা লোকটা। তার পাশের দেয়ালে ফিট করা টিভি স্ক্রিনের দিকে ইঙ্গিত করল রানা। টিভিটা চালুই আছে, কিন্তু ভলিউম অনেক কমানো, তাই নিউজ রিডার কী বলছে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। তবে নিচে স্ক্রল করে যে ব্রেকিং নিউজ যাচ্ছে তা পরিষ্কার পড়া গেল।
‘বন্ধুকে খুনের দায়ে ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার সাংসদ সালেক রহমানের পুত্র জিসান রেমান। তার এক বাসা থেকে হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও আলামত উদ্ধার।’
স্কুলের ওপরে একই ভিডিয়োতে বারবার দেখা যাচ্ছে হাতকড়া পরা জিসান পুলিশের গাড়িতে উঠছে। ইনসেটে বিষণ্ণ এমপি সাহেব টিভি সাংবাদিকদের কিছু বলছেন। টিভি থেকে চোখ ফিরিয়ে হিংস্র একটা ভঙ্গি করল রকি। ‘এসব করে তুই পার পেয়ে যাবি? কয়টা গুলি করবি? তোকে নিয়েই মরব আজ!’
কথা মুখে নিয়েই মত্ত হাতির গতিতে তেড়ে এল সে। করতে গিয়েও করল না রানা। এক্সপ্রেস ট্রেন তার গন্তব্যে পৌঁছাক। ও শুধু শরীর ঘুরিয়ে সরে গেল শেষ মুহূর্তে, তারপর গুলি করল টেরেসের গ্লাসডোরের গায়ে। প্রচণ্ড গতি নিয়ে ছুটন্ত রকির পেশিবহুল বিশাল দেহ সামনে কোন বাধা না পাওয়ায় অতিক্রম করে গেল টেরেসের সামনের মাত্র তিন ফিট দূরত্ব। তারপর রওনা দিল নিচের দিকে। মাথাটা নিচের দিকে থাকায় আগে সেটাই ল্যাণ্ড করল, তারপর বাঁকা হয়ে গিয়ে মট্ করে ভেঙে গেল ঘাড়। বাকি শরীর একমুহূর্ত শূন্যে স্থির থেকে শব্দ করে পড়ল মাটিতে।
কার্টেনটা মেঝে থেকে তুলে রানিয়ার শরীরের নিরাবরণ অংশটুকু ঢেকে দিল রানা, তারপর ওর হাতের বাঁধনটা খুলে দিতেই উঠে বসে চট করে ওকে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা। থরথর করে কাঁপছে আর অঝোরে কাঁদছে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল রানা, ‘থ্যাঙ্ক ইউ ফর সেভিং মাই লাইফ। ডিউক তোমার কাছে আজীবন ঋণী থাকবে।’
এবার মুখ তুলল রানিয়া। অবাক হয়ে তাকাল। এক সমব্যথী মায়াবী দৃষ্টি দেখতে পেল উদ্ধারকারীর চোখে। এই চোখ মিথ্যে কথা বলে না।
‘তুমিই তা হলে সেই ডিউক, বাবা যার ওপরে ভরসা করে ছিল? আমি ভাবিইনি তুমি বা কেউ আসবে। এত খারাপভাবে মরব, মনে হচ্ছিল এটাই আমার শাস্তি। তুমি এসেছ বলে এখন মনে হচ্ছে আবার একটা সুযোগ দেয়া হলো আমাকে। এই জীবনে আর কোনদিন ভুল করব না আমি, দেখো।
‘গুড গার্ল,’ বলে রানিয়ার থুতনি নেড়ে দিল রানা। ওকে জামাকাপড় পরে নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার সুযোগ দিতে কামরার বাইরে করিডোরে চলে এল। দরজার পাশেই বুয়ার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে দুঃখ পেল মনে মনে। আরও একটু আগে আসতে পারলে হয়তো বাঁচানো যেত মহিলাকে। হঠাৎ খেয়াল করল, কাঁধ এবং হাতের ব্যথাটা বেড়ে গেছে। জ্যাকেট আর শার্ট ভিজে গেছে রক্তে। ক্ষতটা ড্রেসিং করা দরকার। এবার চট্ করে চলে যেতে হবে ওকে এই জায়গা ছেড়ে। আদনান সিরাজকে ফোন করে সুখবর দিয়ে বলল বিশ্বস্ত লোকজন নিয়ে দ্রুত চলে আসার জন্যে। অনেক আগাছা জমে গেছে, সব পরিষ্কার করতে হবে।
ফোন রাখতে গিয়ে শুনতে পেল আদনান কাঁদছেন, কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললেন, ‘আমি আসা পর্যন্ত তুমি কি থাকবে ওখানে? তোমার ব্ল্যাঙ্ক চেকটা?’
‘না, আপনাদের আসার আগেই আমি বিদায় হব। অন্য কেউ হলে আমি এই কেসে চার্জ করতাম না। কিন্তু আপনার অঢেল সম্পদ, তাই আপনি পাঁচ কোটি টাকার একটা চেক কাটবেন, আর ওই টাকার পুরোটা খরচ করবেন একটা ভাল রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার তৈরি এবং ম্যানেজমেন্টে। পরবর্তী সময়ে আরও ফাণ্ড দরকার হলে আমাকে খুঁজবেন, ব্যাকআপ পেয়ে যাবেন।’
চোখ মুছলেন আদনান সিরাজ। ‘সেটা আর বলতে হবে না, বাবা, ডিউক। একটা মানবিক সেবার উপযোগী রিহ্যাব সেন্টার চালানো আমার জন্যে কোন সমস্যাই নয়। আমার মেয়ের মত অন্যদের সন্তানরাও সুচিকিৎসা পাবে, কথা দিচ্ছি আমি। একটা কথা, বাবা, আই নো ইউ আর আ গুড সৌল, মাই বয়। সো, থ্যাঙ্ক ইউ! ‘
ডিউকের যা বলা উচিত এখন, শীতল কণ্ঠে তাই বলল রানা, ‘আপনি ভুল ভেবেছেন। ভুলে যাবেন না আমার পেশা কী। কালকে কেউ আপনার বিরুদ্ধেও আমাকে সুপারি দিতে পারে। সুতরাং আমার মত কাউকেই সহজে আপন ভাববেন না। আপনি তাড়াতাড়ি রওনা দিন, আমাকে যেতে হবে।’ ফোন কেটে দিল রানা।
আর দুটো কাজ বাকি।
এক, এবার জিসানকে শাস্তি দেয়ার পালা, রানিয়াকে মারতে একদল খুনি পাঠিয়ে ব্যাটা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তাই তার আর স্যামির অন্তরঙ্গ ভিডিয়ো প্রকাশ করে দেবে রানা। ব্ল্যাকমেইল কিংবা কাউকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসাবার ব্যাপারটা এমনকী ডিউকের স্ট্যাণ্ডার্ডেও খুব ঘৃণ্য কাজ। কিন্তু ও বাধ্য হচ্ছে সেটা করতে। জিসানের অহঙ্কারপূর্ণ আচরণ আর নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে যে, সে কত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। বাবার ক্ষমতা ব্যবহার করে আজ পর্যন্ত অনেক মানুষের ক্ষতি করেছে অবলীলায়, হত্যা করতেও কখনও পিছ-পা হয়নি। তাই দ্রুত তাকে আটক করে রানিয়াকে নিরাপদ কোথাও সরিয়ে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। পরবর্তী সময়ে পুলিশ বাহিনীর ভেতরে রানা এজেন্সির কানেকশন ব্যবহার করে জিসানের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণাদি প্রকাশ করে দেবে ও।
আর দ্বিতীয় কাজ, কান মুচড়ে ড্রাগের কারবারী বাসেতের কাছ থেকে নিজের জন্যে আদায় করে নেবে ডিউক নতুন একটা টয়োটা প্রিমিয়ো গাড়ি। পরে তার ড্রাগ ব্যবসার বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করে লোকটাকে তুলে দেবে পুলিশের হাতে।
শিবাকে মেসেঞ্জারে আগে থেকে ঠিক করা একটা কোডেড মেসেজ পাঠিয়ে দিল ডিউক হিসেবে: ‘ম্যাডাম, আমি আপনার একজন ভক্ত। আপনার নতুন গানের ভিডিয়ো কবে রিলিফ পাবে?’
আর দশজনের কাছে যেমনই হোক, শিবা সুস্মিতা ডিউকের জন্যে লক্ষ্মী এক মেয়ে। এমনিতে অনেক কথা বলে, চুপচাপ কমই থাকে, কিন্তু নিজের মনের একান্ত অনুভূতি মেলে ধরতে চায় না। অথচ ডিউকের কথায় জীবন দিয়ে দিতেও রাজি সে।
রানা বুঝে গেছে, রহস্যময় পুরুষ ডিউককে ভালবেসে ফেলেছে বোকা মেয়েটা, অথচ সাবধান থাকা উচিত তার!
সমাপ্ত
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন