মরণছোবল – আর. এম. লিটন

কাজী আনোয়ার হোসেন

মরণছোবল – আর. এম. লিটন

এক

কড়া রোদ চোখেমুখে লাগতেই ঘুম ভেঙে চোখের পাতা সামান্য খুলে ঘরের চারপাশে তাকাল মাসুদ রানা।

এই ঘরে বোধহয় এখন ও ছাড়া আর কেউ নেই। হোটেল মি-কাসা’র চোদ্দ তলার স্যুইটে একপাশের পুরু কাঁচের দেয়ালের পর্দা সরানো। রাতের আলোক-ঝলমলে রূপসী শহর দেখার পর পর্দা আর টেনে দেয়া হয়নি। কিন্তু সেটা করল কে? রানা নিজে কাজটা করেনি। ওর ডানহাত ঝট্ করে অভ্যাসবশত চলে গেল বালিশের নিচে। প্রিয় ওয়ালথারের ঠাণ্ডা স্পর্শ একটু যেন স্বস্তি এনে দিল। কিন্তু মাথার ভেতরটা এত ভারী হয়ে আছে কেন? অতিরিক্ত মাল টেনেছিল নাকি? কিন্তু মাতাল হওয়ার মত মদ্যপান কখনও করে না রানা। কালরাতের ক্লাবের ঘটনাটা আবছাভাবে খেলে গেল স্মৃতিতে। এলিস নামের ফ্রেঞ্চ মেয়েটার সঙ্গে অল্পতেই ভাব জমে গিয়েছিল। ড্রিংকস, ডান্স আর টুকটাক চুমো- স্পর্শের পর আরও কিছুটা এগোত, কিন্তু বাদ সাধল এলিসের বয়ফ্রেণ্ড। রানার জানা ছিল না মেয়েটা অলরেডি এনগেজ্‌ড্। এধরনের সম্পর্ক ওর নীতিবিরুদ্ধ। তাই কোন ঝুটঝামেলা ছাড়াই সরে পড়তে চাইল। কিন্তু বয়ফ্রেণ্ড তো রেগে কাঁই, সঙ্গে ছিল অতি উৎসাহী কিছু মারমুখো বন্ধুবান্ধব—সইল না তাদের। বাধ্য হয়ে জড়িয়ে গেল রানা বার-রুম ফাইটে। এলোপাতাড়ি লড়াইয়ের মাঝখানে ওর সাহায্যে এগিয়ে এল সুনয়না কিমি, জুজিৎসুতে দক্ষ জাপানি এক যুবতী।

কিন্তু কে আসলে এই কিমি?

দু’চোখ ডলে ঘুমঘুম ভাব কাটানোর চেষ্টা করে বিছানায় উঠে বসল রানা। তাকাল মেঝের দিকে। আর সঙ্গে সঙ্গে নিজের পরনের কাপড়-চোপড় ছাড়াও মেয়েদের অন্তর্বাস আর একজোড়া হালকা পেস্টকালারের হাই-হিল পড়ে আছে দেখে সতর্কতার একটা ঢেউ বয়ে গেল ওর স্নায়ুজুড়ে। ঘাড় ঘোরাতে শুরু করল বাঁ পাশে, মনের পর্দায় চকিতে দেখতে পেল বালিশের ওপর ছড়ানো একরাশ মসৃণ কালো চুল। কিন্তু না, সাদা বালিশ দক্ষিণ মেরুর দ্যুতি ছড়াচ্ছে। তবে তার ঠিক নিচেই কালো কিছুর আভাস, চাদরের মাথার দিকটা দিয়ে ঢাকা। সজাগ ও সতর্ক রানা হাত বাড়াল, আস্তে করে চাদরের প্রান্ত ধরে কয়েক ইঞ্চি নিচে নামাল। তাতে বেরিয়ে পড়ল ছোট করে ছাঁটা কালো চুল, মাখনের মত মসৃণ চকচকে কপাল, আধবোজা চোখ, গোলাপী ঠোঁট আর পেলব চিবুক। হ্যাঁ, এ-ই তো সেই কিমি!

নাকের সামনে হাত নিয়ে দেখল রানা।

না, মেয়েটা আর শ্বাস নিচ্ছে না। আর নেবেও না কোনদিন। ওটা একটা ডেডবডি!

স্মার্ট ওয়াচে সময় দেখল রানা। সকাল এখন পৌনে সাতটা। এধরনের পরিস্থিতিতে ঘাবড়ে যাবার অভ্যাস রানার নেই। সুতরাং এবার কী করতে হবে সেটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে আবার গত রাতের কথা মনে করতে চাইল ও।

কিমির সাহায্য নিয়ে এলিসের বয়ফ্রেণ্ড ও তার বন্ধুদের ভালই পিটিয়ে দিয়েছিল। তারপর পরস্পরের মৃদু জখমের পরিচর্যা, হালকা ডিনার এবং রানার হোটেল মি-কাসা’র চোদ্দ তলার বেডরুম। তার আগে অবশ্য কিমির চোখ এড়িয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করতে ভোলেনি ও। ঢাকার বুড়োর নতুন নির্দেশ: প্রয়োজনে/অপ্রয়োজনে যে-কোন মেয়ের সঙ্গে মেলামেশা করার আগে (না করাটাই নাকি অতি-উত্তম!) প্রত্যেক এজেন্টকে ওই নারীর ছবি নিকটস্থ বিসিআই কন্ট্যাক্ট বা হ্যাণ্ডলারকে পাঠাতে হবে।

মাসুদ রানাও এখন এ-নিয়ম মেনে চলে। গোপনে কিমির ছবি চলে গিয়েছিল বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কন্ট্যাক্টের কাছে। কিছুক্ষণের মধ্যে কনফার্মেশন আসে যে, কিমি নিরাপদ। শখ বা আত্মরক্ষার্থে জুজিৎসুর ট্রেনিং নিয়েছে।

সুতরাং প্রেমপর্ব শেষ হওয়ার পর রানা শাওয়ার নিতে বাথরুমে ঢুকে গিয়েছিল, বের হয়ে দেখে শ্যাম্পেনের নতুন এক বোতল খুলেছে কিমি। চুমুক দিতে দিতে গল্প করছিল ওরা। তারপর আর কিছু মনে নেই।

অতিরিক্ত শারীরিক ক্লান্তিতে ঘুম এসে গিয়েছিল?

নাকি শ্যাম্পেনের বোতলে কিছু ছিল?

ওটা কি ক্লোরাল হাইড্রেট?

এসবে কিমি জড়িত, নাকি নির্দোষ ভিক্টিম?

রানার পুরনো কোন শত্রু ওকে খুন করতে চেয়েছে? তা হলে জ্ঞান হারানো রানাকে না মেরে কিমিকে মারল কেন?

এসবই দুই সেকেণ্ডের ভাবনা। কিমি কীভাবে মারা গেল সেটা বোঝার জন্যে চাদর আরেকটু নিচে নামাল। মেয়েটার বুকের ঠিক ওপরে বাঁ পাশে ছোট্ট এক ক্ষতচিহ্ন। যা কিছুই ইনজেক্ট করা হয়ে থাকুক, তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয়েছে ঘুমের মধ্যেই। রক্তে বোধকরি কোন ট্রেস থাকবে না কেমিকেলটার।

এখন ডেডবডির ব্যবস্থা করতে হলে রানা এজেন্সির ছেলেদের সাহায্য লাগবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজন পড়বে পোস্টমর্টেম রিপোর্টের। কিমির মৃত্যু বৃথা যেতে দেয়া যায় না। যেহেতু ওর সঙ্গেই ছিল নিরীহ মেয়েটা, খুনির একটা ব্যবস্থা করা ওর দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। তার ওপর তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে হবে। খুন হওয়ার আগপর্যন্ত যে-কোন সম্পর্কই সহজ। কিন্তু খুন হয়ে গেলে সবদিক সামলানো সত্যিই কঠিন, যদি সততার সঙ্গে করতে চায়।

বিছানা থেকে নেমে দ্রুত পোশাক পরে নিল মাসুদ রানা। তবে রানা এজেন্সিতে ফোন করার আগে জানা দরকার কেউ ফ্রন্ট ডোর দিয়ে লকপিক করে ভেতরে ঢুকেছিল কি না। রাতে দরজার পিপ হোলে ছোট্ট একটা স্পাইক্যাম সেট করে রেখেছিল রানা। ওটা স্ট্যাণ্ডার্ড সিকিউরিটি প্রসিজার। মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে ক্যাম-এর ফুটেজ দেখার জন্যে অ্যাপটা ওপেন করল ও, সঙ্গে সঙ্গে ধক্ করে উঠল বুকটা।

কলিং বেলটা বেজে উঠেছে!

ও তো রুম সার্ভিস ডাকেনি, তা হলে এল কে?

অ্যাপের স্ক্রিনে দেখতে পেল এক লোক। হোটেল স্টাফের পোশাক পরা, মাথায় ক্যাপ, নিচের দিকে নামানো। হোটেল স্টাফদের ক্যাপ পরাটা স্বাভাবিক? অস্বাভাবিকও তো নয়! লোকটার হাতে প্রেস করা স্যুট দেখা যাচ্ছে, আড়ালে পিস্তল নেই তো?

দরজার নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ‘কে?’ জানতে চাইল রানা, সঙ্গে সঙ্গে বদল করল জায়গা। ওপাশ থেকে ওর কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে ছুটে আসা হঠাৎ গুলির শিকার হতে রাজি নয়।

ওপাশ থেকে খসখসে এক কণ্ঠ বলল, ‘ডিনারে প্রেম আর প্রাতরাশে মৃত্যু, আমাদের জীবনটা তো এমনই, স্যর, কী বলেন? ‘

হার্টের একটা বিট মিস করল মাসুদ রানা। এই কণ্ঠ ওর চেনা। সর্বনাশ, ইণ্ডিয়ান সিক্রেট সার্ভিস!

দুই

নীল নয়না। নীলাদ্রী। নীলিমা। কত নামে তাকে ডাকতে ইচ্ছে করছে খালেদ আমানের। মনে হচ্ছে সবকিছু ভুলে দু’হাত ছড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার বুকে। কিন্তু না। মেডিটেরেনিয়ান সি’র কোল ঘেঁষে ড্রাইভ করতে করতে প্রবল আকাঙ্ক্ষাটা দমন করল সে। সাগরের চোখ জুড়ানো সুনীল জলরাশি যতই মুগ্ধ করুক, হাতের কাজটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভোলা যাবে না, এর সঙ্গে অনেক অনেক মানুষের জীবন-মৃত্যু জড়িত। যার জন্যে কোন মোবাইল ফোনও বয়ে বেড়াচ্ছে না খালেদ। যতটা সম্ভব ট্র্যাকিং এড়িয়ে যেতে হবে। একটা ‘বার্নার’ ফোন ছিল সঙ্গে, কিন্তু একবার ব্যবহার করেই ফেলে দিয়েছে ওটা। সাবধানের মার নেই!

তবে হাতের এই কাজটা শেষ করতে পারলে জীবনে একটা সুযোগ নেবে। অনেক দিনের শখ তার নীলাঞ্জনা কোন মেয়ের সঙ্গে রিলেশনশিপে যাবে। এখন তো ইচ্ছেটা আরও দ্বিগুণ হয়ে গেল, যে করেই হোক, সেই প্রেমিকাকে নিয়ে এই শহরেই আসবে সে ছুটি নিয়ে!

মন ভাল করার মত বিচিত্র সব ভাবনায় কেমন করে যেন সময় কেটে গেল, ছোট্ট এক পাহাড়ি শহরে পৌঁছে গিয়েছে খালেদ আমান। রাস্তার ধারে একটা পাব-এর সামনে গাড়িটা পার্ক করল। একটা পাবলিক ল্যাণ্ড ফোন দরকার।

সুন্দর সুন্দর কল্পনার দৃশ্য সরে গিয়ে মাথায় আবার ভিড় করল রাজ্যের আশঙ্কা। পাবের ফোনটা পেছনদিকে, একটু নির্জনে। ভালই হলো, আশপাশে কেউ নেই দেখে ফোনের রিসিভারটা তুলে ডায়াল করতে শুরু করল। আগেই পাব মালিকের অনুমতি নিয়ে নিয়েছে।

অপরপ্রান্তে শুধু রিসিভ করার জন্যে একটা ক্লিক_ শোনা গেল, কেউ পাল্টা কথা বলবে না। খালেদ শুধু বলল, ‘এমডি ইজ রেডি ফর ডেলিভারি। স্টেশন আননোন। ইউজুয়াল রদেভুঁ। সেও এমআরনাইন ওনলি।’

তারপর লাইন কেটে দিয়ে বের হয়ে এল। এত নির্জন পাহাড়ি অঞ্চলে বিপদের আশঙ্কা হঠাৎই নেই বলে মনে হলো। আরাম করে এক কাপ কফি খাওয়া যেতেই পারে। কফির অর্ডার দিয়ে পাবের উল্টোদিকের রাস্তায় এসে দাঁড়াল খালেদ। এখান থেকেই ঝপ করে নিচে নেমে গেছে পাহাড়ের গা, নিচে দেখা যাচ্ছে যে দুর্গম পথে গাড়ি চালিয়ে ওপরে এসেছে সে। এখনও দুটো গাড়ি উঠছে দেখা যাচ্ছে, এদিক দিয়েই হয়তো যাবে।

পাহাড়ি অঞ্চলে এটা খুবই স্বাভাবিক দৃশ্য। মাঝে মাঝে দু’চারটে গাড়ি পাশ কাটিয়ে যাবে। কিন্তু তারপরও সকতাবোধটা ফিরে এল খালেদের মধ্যে। কতক্ষণ লাগবে গাড়িদুটোর ওই দূরত্ব অতিক্রম করতে? বড়জোর দশ মিনিট। সে নিজে লুকিয়ে পড়ে সম্ভাব্য শত্রুগাড়ি এড়াতে পারে, কিন্তু তার নিজের গাড়িটা তো উন্মুক্ত জায়গা, আর লুকানোর মত তেমন জায়গাও নেই!

এমন সময় খিলখিল হাসির শব্দে ঘাড় ফেরাল খালেদ। স্থানীয় তিন তরুণী ওপরের রাস্তা ধরে পাবের দিকেই আসছে। তাকে দেখতে পেয়ে তিনজনই ক্ষণিকের জন্যে থমকাল, তারপর আবার কলকাকলিতে মুখর হয়ে এগোতে লাগল।

রাস্তা পার হয়ে পাবে ফিরল খালেদ। কফির দাম মিটিয়ে ওয়ানটাইম কাপটা হাতে নিয়ে গাড়ির কাছে আসতেই পড়ে গেল মেয়ে তিনটার সামনে। নো ওয়ে! ডানদিকের মেয়েটার চোখে চোখ পড়তেই শ্বাসরোধ হলো যেন খালেদের। এত সুন্দর নীল চোখ, যেন পুরো ভূমধ্যসাগর জায়গা করে নিয়েছে ওই নীল আঁখিপাতে। তারপর, ওই দৃষ্টিটাকে আরও প্রসারিত হতে দেখে বুঝল, তার সময় শেষ।

মেডিটেরেনিয়ানের সৌন্দর্য মাথায় নিয়েই মারা গেল খালেদ আমান। স্টিলেটোটা তার ঘাড়ের পেছন থেকে ঢুকে কণ্ঠার হাড় ভেদ করে বেরিয়ে এল, ফলাফল তাৎক্ষণিক মৃত্যু। প্রকৃতি হয়তো নিশ্চিত, খালেদ শুনতে পায়নি নীল নয়নার বুকচেরা চিৎকারটা।

অনেক ভরসা করে এমআরনাইনকে আসার জন্যে মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছিল খালেদ, কিন্তু তার জানার কথা নয়-বিষাক্ত সাপ, এরই মধ্যে ফণা তুলেছে, ছোবল মারবে যে-কোন মুহূর্তে।

এবার মাসুদ রানার মরবার পালা!

তিন

বিসিআই এজেণ্ট খালেদ আমানের হত্যাকাণ্ডের অল্প কয়েক দিন পরেই আরেকটি মৃত্যু মঞ্চস্থ হলো হোটেল মি-কাসা’র চোদ্দ তলার লাক্সারি স্যুইটে। আরেক তুখোড় এজেন্ট, বিসিআই-এর প্রাণ মেজর মাসুদ রানার শোবার ঘরে! কিছুক্ষণের মধ্যে হয়তো আরও একটি খুনের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।

স্যুইটের লিভিং রুমে দাঁড়িয়ে আছে বিসিআই রত্ন মাসুদ রানা। ওর কয়েক হাত সামনেই দাঁড়ানো ইণ্ডিয়ান সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্ট বিজয় ভদ্র। একহাতের স্যুটটা রাখল সে সোফার হাতলে। অপর হাতে সতর্ক ভঙ্গিতে ধরা সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলটা।

মাসুদ রানাকে নিরস্ত্র দেখে কিছুটা বিস্ময় খেলে গেল বিজয় ভদ্রের চোখেমুখে, কিন্তু সামলে নিল। গুরুতুল্য মাসুদ রানাকে আগে বুঝে নিতে চাইছে সে। কে জানে, তাঁর আস্তিন থেকে হঠাৎ করেই হয়তো ভোজবাজির মত বেরিয়ে আসবে কোন অস্ত্র!

চেহারায় বন্ধুবৎসল হাসি ফুটিয়ে পিস্তলের সেফটি ক্যাচ অন করল বিজয়, তারপর সেটা কোমরে গুঁজে নিয়ে সারেণ্ডারের ভঙ্গিতে হাতদুটো ওপরে তুলে বলল, ‘এবার তা হলে আমাদের কাজটা এগিয়ে নেয়া যাক, স্যর, কী বলেন?’

এতক্ষণ রানাও মেপে দেখছিল বিজয়কে। এর সম্পর্কে যতটুকু মনে পড়ল ওর এখন, সেটা হচ্ছে: বিজয় ভদ্র শুধু একজন দক্ষ ও নির্দয় এজেণ্টই নয়, ক্রাইম সিন মপ-আপ করাতেও ওস্তাদ লোক। অর্থাৎ সে একজন ‘ক্লিনার’-ও বটে। এবং এ-ও রানা বুঝল, অতিরিক্ত বিনয় আর ‘কী বলেন’ বলা এ-দুটো তার মুদ্রাদোষ।

‘তার আগে, বিজয়, আমাকে বলো তুমি এখানে কেন?’

বিগলিত হাসি উপহার দিল বিজয়। ‘কী বলেন, স্যর! আপনাকে সাহায্য করাই তো এই মিশনে আমাদের কাজ কিন্তু আপনি হঠাৎ দু’দিন আগে হোটেল বদলে ফেলায় আমার লোকেরা আপনাকে হারিয়ে ফেলে। বহুত ঘাম ঝরাতে হয়েছে খুঁজে পেতে। গতকাল যদি না পেতাম, তবে আমার চাকরি আর প্রাণ কোনটাই রক্ষা করা সম্ভব হতো না।’

‘ফেউ আমার একদম পছন্দ নয়,’ মন্তব্য করল রানা। কিন্তু মনে মনে মাথা চুলকাচ্ছে, মিশনটা কী ছিল ওর? কিছুই তো মনে পড়ছে না রে, বাপ!

একসঙ্গে কাজ করে থাকলে আইএসএস-কে ফাঁকি দিয়েছিল কেন তবে?

যতদূর ভাবতে পারছে, গতকাল রাতের ক্লাবের ঘটনা, এলিস কিংবা কিমির সঙ্গে পরিচয়-এসবই নিছক কাকতালীয় ব্যাপার। সাজানো কিছু বা বিশেষ মিশন নয়। কিন্তু বেডরুমের বিছানায় শান্তভঙ্গিতে শুয়ে থাকা এক নারীর মৃতদেহ বলছে ভিন্ন কথা। ড্রাগের প্রভাবে ওর কি তবে পার্শিয়াল মেমোরি ব্ল্যাকআউট হয়েছে?

এটা কি সম্ভব যে কিছু মনে থাকবে, আর কিছু থাকবে না?

নতুন ধরনের কোন কেমিকেল, যেটার সম্পর্কে এখনও ঢাকা থেকে ওকে ব্রিফ করা হয়নি?

নিজের অবস্থা বুঝতে না দিয়ে রানা জিজ্ঞেস করল, ‘এখন পর্যন্ত এই মিশনে তোমাদের অগ্রগতির একটা ধারণা দাও, বিজয়।’

‘কী বলেন, স্যর,’ সোফায় বসে পায়ের ওপর পা তুলতে গিয়ে জিভ কাটল বিজয়, তারপর পাদুটো সোজা রেখেই বসল। ‘আপনাকে ছায়ার মত অনুসরণ করা; বিপদ হলে প্রটেকশন দেয়াই ছিল আমাদের তিনজনের প্রধান কাজ। আপনি বায়ার-এর সঙ্গে মিট করবেন, তারপর জিনিসটা আমাদের হাতে তুলে দেবেন। মিশন অ্যাকমপ্লিশ্ড্। যে যার ঠিকানায় ফিরে যাব। কিন্তু বায়ার তো দেখা দেয়ইনি, উল্টো ওই জাপানি নারী গুপ্তঘাতকের পাল্লায় পড়লেন আপনি!’

একটা হাত তুলে বিজয় ভদ্রকে বাধা দিল মাসুদ রানা। ‘এই মেয়েটা গুপ্তঘাতক বুঝলে কীভাবে? ওর প্রোফাইল দেখেছ?’ রানার মনে আছে, দূতাবাসের কন্ট্যাক্ট কিমিকে নিরাপদ বলেছিল। তার মানে কি বিসিআই-এর ডেটাবেইস আপটুডেট নয়?

‘প্রথমে বুঝতেই পারিনি, স্যর। কিন্তু কী বলেন, দু’দিন আগে আপনাকে হারিয়ে ফেলে কুত্তাপাগলের মত…’ আধহাত জিভ কেটে ক্ষমাপ্রার্থনা করল বিজয়। ‘মানে, আপনাকে এলোমেলোভাবে বিভিন্ন জায়গায় খুঁজি আমরা তিনভাগে ভাগ হয়ে। কিন্তু বায়ারের সঙ্গে দেখা করার সময় এবং স্থানটা যেহেতু আমার জানা ছিল, তাই গতকাল ওখানেই আপনাকে পাই এক ফ্রেঞ্চ মেয়ের সঙ্গে। কিন্তু মাঝখানের দুদিন একেবারে লাপাত্তা ছিলেন!’

একটু থামল বিজয়, আবার বিনয়ী হেসে শুরু করল, ‘সত্যি বলতে কি, স্যর, আমরা ভেবে পাচ্ছিলাম না কীভাবে মেয়েগুলো আপনার সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছিল। এক্কেবারে জেমস বণ্ডের ক্লাসিক মুভিগুলোর মত। যদিও আমাদের ইন্টেল ছিল যে, বায়ার একজন পুরুষ। যা-ই হোক, আপনার ওই বার- ফাইট দেখে আমরা শেষমুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি, বাধ্য না হলে অংশ নিতাম না। নিজেদেরকে এক্সপো করতে চাইনি আর কী। কিন্তু মেয়েটা জড়িয়ে গিয়ে আমাদের সুবিধাই করে দিয়েছিল, কী বলেন?

‘এদিকে আমাদের অনেকটা সময় ব্যয় হলো ওই মেয়েদুটোর ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে। যা জানলাম, তা আঁতকে ওঠার মত! ফ্রেঞ্চ মেয়েটা সাধারণ হলেও জাপানি কিমি মাসুকো ভয়ঙ্কর। এই লাইনে নতুন, তাই খুব বেশি লোক তাকে চিনত না। নিজের এলাকায় নিরীহ একজন স্কুলশিক্ষক, ফিজিকাল ট্রেইনার। আর আণ্ডারগ্রাউণ্ডে এক ডেডলি অ্যাসাসিন, কী বলেন! মারপিটের প্রতি অদ্ভুত আকর্ষণ তার, তাই এলাকার সাধারণ গুণ্ডারা সমঝে চলত তাকে। গোপন মিশনের ছোটখাট ক্ষতগুলো লুকানোর জন্যে এই মারামারির বদঅভ্যাসটা মন্দ নয়, কী বলেন, স্যর?’

আবার একটু দম নেবার জন্যে, থামল বিজয় ভদ্র। মাসুদ রানা এখনও তাকে মাপছে, মনের ভেতরে নাড়াচাড়া করছে তার দেয়া তথ্যগুলো। কিন্তু কূল-কিনারা পাচ্ছে না মোটেও। ভদ্র ভদ্রতার সঙ্গে সত্যি কথা বলছে বলেই তো মনে হচ্ছে! যত শুনছে, তত অসহায় বোধ করছে রানা।

আবারও শুরু হলো। ‘কিন্তু কী বলব, স্যর! এতসব খোঁজখবর করতে গিয়ে আমার যে লোকটাকে ক্লাবে রেখে গিয়েছি আপনাকে ফলো করে ঠিকানা জেনে আসবে বলে, সে আবারও আপনাকে হারিয়ে ফেলল। আর আপনিও চলে এলেন কিমি মাসুকোর ফাঁদে ধরা দিয়ে। যেহেতু বায়ার বলেছিল আপনাকে ছাড়া অন্য কারও কাছে অতিমূল্যবান জিনিসটা হ্যাণ্ডওভার করবে না, সুতরাং আমাদের প্রাইমারি অবজেক্টিভ যে-কোন মূল্যে আপনার জীবন রক্ষা করা। ভয়ঙ্কর আতঙ্কে কেটেছে আমার সারাটা রাত-এই বুঝি মাসুকো আপনাকে খেয়ে ফেলে; না, মানে…’ কানে হাত ছুঁইয়ে বিড়বিড় করল সে। ‘মেরে ফেলে আর কী! কিন্তু একটু আগে দরজার ওপাশ থেকে আপনার কণ্ঠ শুনে বুঝলাম: দ্য গ্রেট মাসুদ রানা স্যর ইয স্টিল ব্রিদিং অ্যাণ্ড হি কিল্ড দ্য হাট্রেস! এই হলো, স্যর, আমার সাইডের গল্প, কী বলেন?’

কথা শুনতে শুনতে চিন্তিত মনে হাতের মোবাইলটাতে ক্যাম-অ্যাপটা দেখছিল রানা। ও নিজে যদি কিমিকে না মেরে থাকে, তবে জ্ঞান হারানোর পর কেউ কামরায় ঢুকে থাকতে পারে। হয়তো কিমি জীবিত ছিল, তার কোন সঙ্গী ছিল, যাকে সে বিশ্বাস করত, ঘুমন্ত রানাকে খুন করার সিদ্ধান্তে দু’জনের বনিবনা না হওয়ায় সঙ্গীটি হয়তো কিমিকে হত্যা করে পালিয়ে গেছে। বেশি ভাবতে গিয়ে যে কিমির প্রতি মনে একটা সফট্ কর্নার তৈরি হচ্ছে, সেটাও অস্বীকার করতে পারছে না রানা। তবে মনের অনুভূতি পক্ষ নিলেও দেশের স্বার্থ আর পেশাগত দায়িত্বের কাছে তা গৌণ। কিন্তু অরক্ষিত রানাকে খুন না করে খুনির প্রস্থান সত্যিই খুব রহস্যজনক। অবশ্য, যদি না…

ভাবনাটা মাথায় আসতেই একটা আশার আলো দেখতে পেল রানা। তবে ক্যামেরার ফুটেজে তেমন কিছু পেল না। আততায়ী খুব সাবধান, রাত তিনটার দিকে কামরায় নিচু হয়ে ঢুকেছে পিকলকার। ফলে শর্ট ভিউয়িং অ্যাঙ্গেলের ক্যামেরায় ধরা পড়েনি। শুধু দরজা খুলেছে আর লাগিয়ে নিয়েছে। পরে একই কায়দায় কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। এরপর যে হোটেলেই গিয়ে উঠুক, লিভিং রুমেও একটা স্পাইক্যাম ফিট করতে হবে, নিজেকে সাজেশন দিয়ে রাখল রানা।

ওদিকে চুপচাপ বসে ভাবনায় বুঁদ মাসুদ রানাকে দেখছে বিজয় ভদ্র। এতক্ষণ ধরে যা কিছু বলেছে, তা হজম করার জন্যে সময় দিচ্ছে ওস্তাদকে। তার হাতে প্রচুর সময় আছে, এই কামরায় ঢুকেছে মাত্র পনেরো মিনিট পার হয়েছে। এখন যে কাজে হাত দিতে যাচ্ছে, তাতে রানাকে পাশে পাওয়াটা খুব জরুরি। আর তা ছাড়া, যে-কোন কাজ ধীরে ধীরে রসিয়ে রসিয়ে সম্পূর্ণ করতে ভালবাসে ভদ্র। গান সে গাইতে পারে না, এমনকী বাথরুমে সুর ভাঁজতেও তার লজ্জা লাগে। তবে হরবোলা সে, মৃদু শব্দে পাখির বিচিত্র সুর বা গান করতে ভালবাসে একমনে। এখনও অপেক্ষা করতে করতে মৃদু শব্দে শিস দিচ্ছে।

অবশ্য তার সেই কুহু সুর মাসুদ রানার মনোযোগ কাড়তে পারল না। বরং সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিজয়কে ইশারা করে বেডরুমের দিকে চলল ও। কোমরে গোঁজা পিস্তল একবার স্পর্শ করে যেন শক্তি সঞ্চয় করল বিজয় ভদ্র, তারপর রানাকে অনুসরণ করল, মুখে এখনও ঝুলছে বিনয়ের হাসিটা। ওস্তাদ বিশ্বাস করেছে তাকে, এবার স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করবে সে!

চার

উজ্জ্বল রোদে ভেসে যাচ্ছে কামরা। কিমি মাসুকোর ডেডবডির সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা আফসোস, কিছুটা বিস্ময়মাখা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বিজয় ভদ্র। স্বর্গের অপ্সরার রূপলাবণ্য নিয়ে শুয়ে আছে মেয়েটা। তবে এই ঘুম আর ভাঙবে না। জীবন আর সৌন্দর্যের কী মর্মান্তিক অপচয়!

হঠাৎ শরীরটা আড়ষ্ট হয়ে যাওয়ার অনুভূতি হলো তার। পিছনে কারও অস্বস্তিকর উপস্থিতি। সেই সঙ্গে ঠাণ্ডা একটা পরিচিত স্পর্শ। কণ্ঠভরা একরাশ হাহাকার নিয়ে বলে উঠল ভদ্র, ‘কী বলেন, স্যর! আপনি কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না?’

ওয়ালখার পিপিকের নলটা একবিন্দু না সরিয়ে অনেকটা কৌতুকের সুরে বলল রানা, ‘বিশ্বাসটা আরও গভীর হবে, যদি দু’জনেই নিরস্ত্র থাকি। তোমার পিস্তলটা এক্ষুণি আনলোড করে নাও।’

এই লোকের সামনে থাকা আর পিছনে থাকা—দুটোই সমান ভয়ঙ্কর। আগেই রানার বিরুদ্ধে কোনরকম অ্যাকশনে যায়নি বলে নিজেকে মনে মনে ধন্যবাদ দিল বিজয়। রসো, হাতে এখনও সময় আছে।

অতি সাবধানে কোমরে গোঁজা অস্ত্রটা বের করে আনল সে। চেম্বারের বুলেট আর ম্যাগাজিন ইজেক্ট করল। মাসুদ রানাও ওর ওয়ালথারটাকে একইভাবে নিষ্ক্রিয় করে নিল।

‘ওকে নিয়ে তোমার প্ল্যানটা কী, এবার সেটা বলো।’

রানার প্রশ্নে সচল হলো বিজয়। মৃতদেহটা ইঙ্গিত করে বলল, ‘একটা লাগেজে ভরে নিতে হবে ওটা। কীভাবে সেটা আমার ওপরে ছেড়ে দিন, স্যর। আপনাকে কিছুই করতে হবে না, কী বলেন? কাজ শেষ হলে একটা কল দেব, আমার লোকেরা এসে লাগেজটা নিয়ে যাবে। তারপর মাসুকো হাওয়া হয়ে যাবে ওস্তাদ মাসুদের জীবন থেকে ‘

‘এনি রিস্ক ফ্যাক্টর?’ জানতে চাইল রানা।

আবার হাসিতে যেন গলে পড়ল বিজয়। ‘কী বলেন, স্যর, আপনি লজ্জা দিলেন আমাকে। বহু বচ্ছরের অভিজ্ঞতা আমার এই লাইনে। লাশ হাওয়া করার সবচেয়ে ভাল বুদ্ধি, ছাইয়ে পরিণত করা। ওই যে কথায় আছে না: ফ্রম অ্যাশেস টু অ্যাশেস, সেরকমই আর কী। মাটিতে পানিতে আস্ত অবস্থায় যাই ঢুকাবেন, ‘ওপরে উঠে আসবেই’ একদিন না একদিন। তাই আমি এগুলোর গতি করি ক্রেমেটোরিয়ামে। আঠারো শ’ ডিগ্রি ফারেনহাইটে পাঁচ ঘণ্টা পোড়ালে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। আমরা তখন পাব কিছুটা ভারী আর কর্কশ ছাই। ওটুকু পরে জায়গামত নিয়ে পানিতে ছড়িয়ে দিলেই আর কোন সূত্র বা চিহ্ন থাকে না। ভাববেন না, এসব সম্পূর্ণ আমার দায়িত্ব। আপনি একদম হাত-পা ঝাড়া! তবে তার আগে একটা কাজ করা লাগবে, স্যর। আপনার অনুমতি চাই, কী বলেন?’

প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল মাসুদ রানা। বুঝতে চাইছে, কী খেলছে এই চালু লোকটির মাথায়।

বিজয় বলে চলল, ‘আমি নিশ্চিত না, জাস্ট একটা হাঞ্চ। ধরুন, বায়ারকে আগেই সাবড়ে দিয়েছিল মাসুকো, তারপর প্যাকেজ নিজের দখলে নিয়ে নেয়। সেক্ষেত্রে ওটা তার সঙ্গেই ছিল, মানে এখনও থাকতে পারে। কী বলেন, স্যর?’

মাথা নাড়ল রানা। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘একটা সম্ভাবনা। কিন্তু, বিজয়, জিনিসটা নিয়ে পালিয়ে না গিয়ে সে আমার কাছে এল কেন? আর কী পাওয়ার ছিল ওর?’

‘বুঝলেন না, স্যর, লুয এণ্ড। যারাই মাসুকোকে আপনার পিছনে লাগিয়েছিল, বায়ারের সঙ্গে আপনার কোনরকমের সেটা জানে তারা। তাই পাল্টা

রিলেশন আছে, ইনভেস্টিগেশন এড়াতে আপনাকেও…

‘মানলাম তোমার যুক্তি,’ বলল রানা। ‘রদেভু মিস করার পর এখনও পর্যন্ত বায়ার আর যোগাযোগ করেনি, তার কোন বিপদ হয়ে থাকতে পারে।’ মিথ্যে বলছে রানা, বায়ার সংক্রান্ত কোন তথ্যই ওর মনে পড়ছে না। এবং সেটা বিজয়কে বুঝতে দিতে চাইছে না। তবে এটাও সত্যি, কেউ ফোন করেনি ওকে!

‘তবে কি জানো,’ আবার বলল রানা, ‘আমি হলে জিনিসটা কখনোই সঙ্গে নিয়ে ঘুরতাম না। কোথাও নিরাপদে রেখে পরবর্তী কাজে হাত দিতাম।

‘কী বলেন, স্যর,’ হাত কচলে বলল বিজয়, ‘তবু যদি একটা সুযোগ পেতাম! কথা দিচ্ছি, স্যর, ডেডবডি হলেও ওকে সম্মানের সঙ্গে নাড়াচাড়া করব।’

কপালে চোখ তুলল রানা। ‘কী করতে চাও তুমি?’

মুখটা কাঁচুমাচু করে বিজয় বলল, ‘মাসুকোর হ্যাণ্ডব্যাগে জিনিসটা থাকবে না বলেই মনে করি। তাই ওর শরীরে খুঁজব। এব্যাপারেও আমি একজন এক্সপার্ট, স্যর। কোন মিউটিলেশন হবে না, নিশ্চিত থাকুন। আপনি শুধু অনুমতি দিলে…’

এরপর যে প্রশ্নটা রানা করতে চাইছে, সেটা খুবই রিস্কি। বিজয় বুঝে যেতে পারে ওর মেমোরি ব্ল্যাকআউটের কথা। কিন্তু না করেও পারছে না, দেখাই যাক না আইএসএস ক্লিনারের প্রতিক্রিয়া কী হয়!

প্রথমেই মাথা নেড়ে অনুমতি দিল রানা। তাতে দেরি না করে দ্রুত হাতে ল্যাটেক্স গ্লাভস পরে নিল বিজয় ভদ্র, তারপর লাশের গায়ের চাদরের ওপর দিয়েই মাসুকোর দু’পা দু’দিকে ছড়িয়ে নিল। মাথা থেকে পা পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজবে।

তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে যথাসম্ভব হালকা সুরেই জিজ্ঞেস করল রানা, ‘আমরা ঠিক কী খুঁজছি? আই ক্যান হেল্প।’

প্রশ্নটা শুনে একটু থমকে গেল বিজয়? নাকি রানা ভুল দেখেছে? কোনরকম প্রতিক্রিয়া ছাড়াই উত্তর দিল লোকটা। ‘এমডি, স্যর। মাইক্রোডট। দ্যাট ভেরি ওন্ড ক্র্যাপ!’

মাইক্রোডট! হঠাৎ করেই ছোট্ট রঙিন একটা জিনিস, তাতে গোল গোল দাগ-রানার স্মৃতিতে এক ঝলক উঁকি দিয়েই হারিয়ে যেতে বসল। সেটাকে মনে মনে হাত বাড়িয়ে আটকানোর চেষ্টা করল ও, কিন্তু পারল না।

এই মাইক্রোডটের সঙ্গে নিশ্চয়ই ওর মেমোরি ব্ল্যাকআউটের একটা সম্পর্ক আছে!

কিমির মুখটা হাঁ করিয়ে আঙুল ঢুকিয়ে দাঁত আর মাড়ির ওপর পরীক্ষা চালাচ্ছিল বিজয়। রানা তাকে বলল, ‘ওর হ্যাণ্ডব্যাগ কিংবা পার্সেও জিনিসটা লুকানো থাকতে পারে, ‘ বলতে বলতে নিজেই কিমির ব্যাগ উপুড় করে ভেতরের জিনিস বিছানার ওপর ঝেড়ে ফেলল রানা।

সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে দেখল বিজয়। ‘প্লিয, স্যর, ওদিকটা আপনি সামলান তবে, কী বলেন?’ তারপর আবার ফিরে গেল কাজে, শিস বাজিয়ে সুর তুলছে কোন অজানা পাখির গান।

একটি মেয়ের ব্যাগে স্বাভাবিক যা কিছু থাকতে পারে, সেসব কিছুর মাঝে রানার দৃষ্টি আকর্ষণ করল একটা কন্ট্যাক্ট লেন্সের বক্স, দুই সেট ফল্‌স্ নেইল, টো আলাদা বক্সে। লেন্সের বক্সটা খুলে একজোড়া লেন্স পাওয়া গেল, নেড়েচেড়ে সন্দেহজনক কিছু দেখল না। তবে ফল্‌স্ নেইলের বক্সজোড়া সন্দেহের উদ্রেক করল। কিছু নেইল বা নখের ওপর ছোট ছোট বিন্দুর মত গ্লিটার করা ডিজাইন ছিল, ওগুলো তুলে ফেলা হয়েছে। তার মানে এগুলোর ওপর আগেই কারও হাত পড়েছে।

দ্বিতীয় ফস্ নেইলের সেটটাতে চোখ আটকে গেল রানার। লিডটা খুলে হাতে নিল একটা, রঙিন কিন্তু সারফেসটা মসৃণ। ওপর-নিচ থেকে আরও ভাল করে আরেকটু চেক করতেই ওর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল মৃদু হাসি।

বিজয়কে কিছু বলতে যাবে, এমন সময় ওর মনোযোগ দাবি করল তার নিচু সুরে বাজানো শিস। এখানে আসার পর থেকেই দেখছে একটু পর পরই লোকটা এধরনের বিচিত্র সুর তুলছে। কিন্তু অন্য ভাবনায় মন ব্যস্ত থাকায় পাত্তা দেয়নি। কিন্তু এবার না দিয়ে পারল না। কারণ এই শিস ওর পরিচিত।

রানা পাখি বিশেষজ্ঞ নয়, কিন্তু কখনও কখনও বিরল কিছু প্রজাতির পাখির গান বা সুর শোনার সৌভাগ্য হয়েছে, বিশেষ করে ওর ঢাকার এক পাখি-বিশারদ বন্ধুর বাসায়। এমনই একটি বিরল পাখি সং থ্রাশ, যা সাধারণত ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অংশ জুড়ে পাওয়া যায়। বন্ধুটি তার বাসায় রানাকে দেখিয়েছিল কমলা-নীল পালকের এক সং থ্রাশ প্রজাতি, যা সে সংগ্রহ করেছিল বান্দরবানের হিল ট্র্যাক্টস থেকে। পাখিটার কন্ঠের সুর সত্যিই ভারি মিষ্টি।

কাজের মাঝখানে পাখি নিয়ে ভাবছে বলে অবাকই হলো রানা, কিন্তু বিজয় হুবহু সুরটা তুলতে পেরেছে! ভাল লাগছে বলেই বোধহয় রানার মাথায় হুট করে একটা বাংলা কবিতার লাইন ঢুকে গেল। পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল…। দপ্ করে ওর মাথার ভেতরে যেন এক শ’টা উজ্জ্বল বা একসঙ্গে জ্বলে উঠল। আঁধার কালো সব মুছে গিয়ে শুধু আলো আর আলো!

‘লিভ হার অ্যালোন, বিজয়!’

রানার কণ্ঠে কিছু একটা ছিল। কাজ এবং শিস দুটোই থামাতে বাধ্য হলো বিজয় ভদ্র। ঘাড় ফেরাতে দেখল ওস্তাদের হাতে আবার শোভা পাচ্ছে ওয়ালথারটা। কী বদলে গেছে বুঝতে পারছে না বিজয়। ‘কী বলেন, স্যর! আমার অপরাধটা আবার কী হলো?’

‘তোমার অপরাধ তুমি আইএসএস এজেন্ট নও, আমার সহযোগী তো নও-ই। তুমি হলে মোসাদ এজেন্ট!’

‘স্-স্যর! এটা সত্যি না, আপনি ইল ইনফর্মড। এতক্ষণ তো… আচ্ছা!’ হাঁ হয়ে গেছে বিজয়, ‘অসম্ভব, কীভাবে!’

বিছানায় বসে আয়েশ করে পায়ের ওপর পা তুলল রানা, পিস্তলটা এখনও তাক করে আছে হরবোলার দিকে। ‘এই তো বুঝতে পেরেছ। প্রথম কৃতিত্ব আমার বসের বন্ধু এক পাগলা প্রফেসরের, ‘দ্বিতীয় কৃতিত্ব অবশ্যই তোমার। তবে সেটা ব্যাখ্যা না করাই ভাল। এই ধরনের অ্যাটেমপ্ট আগেও নিয়েছিল মোসাদ। আচ্ছা, বলো তো, তুমি ডাবল এজেন্ট নাকি পুরোপুরি মোসাদের হয়ে কাজ করছ? তোমার বস্ জানেন?’

নার্ভাসনেসটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করল বিজয় ভদ্র। প্ল্যানটা কোথায় বরবাদ হয়ে গেল, বুঝতে পারছে না। কিন্তু এখন তো আর কিছু লুকানোর উপায় নেই। এদিকে আসল জিনিসটাই তো এখনও খুঁজে পাওয়া গেল না।

তার দুশ্চিন্তা যেন পড়তে পারল মাসুদ রানা। একটু মুচকি হেসে বলল, ‘ও, হ্যাঁ, মাইক্রোডট। ওটা এখন আমার কাছে।’

পাঁচ

ঢাকা, মতিঝিল। বিসিআই হেডকোয়ার্টার। রাত প্রায় তিনটা।

ছ’তলায় মাসুদ রানার নিজের অফিস কামরা। কিন্তু সেখানে না থেমে সরাসরি সাত তলায় এসে লিফট থেকে নামল রানা। জরুরি তলব। গাড়ি পাঠিয়ে রীতিমত ‘কিডন্যাপ’ করে আনা হয়েছে ওকে গুলশানের এক ক্লাব থেকে।

সাত তলার বিশাল ফ্লোরে ভীষণ কর্মযজ্ঞ চলছে। সবাই ব্যস্ত যার যার কম্পিউটার কনসোলের সামনে। কেউ বা ল্যাপটপ, আইপ্যাড, ফাইলপত্র নিয়ে এদিক-সেদিক ছুটছে। বোঝার উপায় নেই, ঘণ্টাখানেক পর দিগন্তে ফুটে উঠবে ভোরের রেখা।

দীর্ঘ এক বছর পর দেশে ফিরেছে মাসুদ রানা। আর আজই হাজির হতে হয়েছে অফিসে। নতুন করে ইন্টেরিয়র করায় সুন্দর হয়েছে ফ্লোর বিন্যাসটা, সবকিছু কেমন নতুন আর ঝকঝকে লাগছে।

মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের কামরায় ঢোকার আগেই তাঁর সেক্রেটারি ইলোরার ডেস্ক। তারও চোখজোড়া কম্পিউটার স্ক্রিনে নিবদ্ধ। রানা ঢুকতেই অবশ্য মুখটা সামান্য ঘোরাল ইলোরা। ‘যাক, পৌঁছালে তা হলে?’

‘ঘটনা কী, বুড়ো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধটাও ঠিকমত লাগতে দেবে না, না কি?’ সহাস্যে বলল রানা। বাকি সোলজাররা কোথায়, পাজিগুলো নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে বুঝি?’

ইলোরাও ওর কথায় হেসে ফেলল। ‘ভেতরে গেলেই টের পাবে! তা কেমন আছ, রানা? অনেক দিন পর তোমাকে দেখে ভাল লাগছে।’

চোখটা পেছনের ফ্লোরে ইঙ্গিত করে রানা বলল, ‘তোমরাও বেশ আছ দেখতে পাচ্ছি। আমিও এতক্ষণ সময়টা ভাল কাটাচ্ছিলাম আড্ডা দিয়ে। কিন্তু যা শুরু করলে তোমরা! যাই হোক, তুমি কিন্তু আগের চেয়ে আরও অনেক সুন্দর হয়ে গেছ। একটা ডেট দেবে নাকি?’

‘হুম, দাঁড়াও, সোহানাদিকে বলছি, ওঁকে ছাড়া আজকাল, আমাদের দিকেও নজর পড়ছে তোমার!’ কপট অভিযোগ ইলোরার স্বরে। এমন সময় রানাকে চমকে দিয়ে মাথার ওপর থেকে ভেসে এল জলদগম্ভীর কণ্ঠ, ‘ফ্লার্টিং পরে হবে, জরুরি কথা আছে, ভেতরে এসো, রানা।

মাথাটা সামান্য পেছনে নিয়ে ঠিক ওপরেই ফলস্ সিলিঙে ফিট করা পি.এ. সিস্টেমের স্পিকারটা দেখতে পেল রানা। নতুন সংযোজন। আশপাশে অন্য কেউ বসের কথাটা শুনে ফেলেছে কি না, একবার দেখে নিল ও। তারপর দরজা ঠেলে সাবধানে ঢুকে পড়ল বুড়োর কামরায়। চোখের কোণ দিয়ে খেয়াল করলেও কিছু বলা হলো না, পেছনে মুখ চেপেও হাসি থামাতে পারছে না ইলোরা!

আগের চেয়ে বেশ শুকিয়ে গেছেন রাহাত খান। ফলে আরও লম্বা দেখাচ্ছে তাঁকে। অনেক দিন পর স্যুট ছাড়া তাঁকে দেখল রানা। নীল শার্টে আরও ধারালো মনে হচ্ছে ব্যক্তিত্বটা, তবে চেহারায় চিন্তার ছাপ।

‘তুমি ঘুমাও কখন, রানা? দু’দিনের জন্যে মাত্র দেশে এসেছ, এর মধ্যেই রাতবিরেতে ক্লাবে ছোটাছুটি।’

এমনিতেই বুকের ভেতর ধুকপুকানি চলছে, হাতের তালু ভিজে যাচ্ছে ঘামে, কিছু বলতে গিয়ে গলা আটকে গেল রানার। বলতে চাইল, আজ সন্ধ্যায় তো ল্যাণ্ড করলাম, স্যর, ভেবেছি আগামীকাল সকালে অফিসে আসব, তাই রাতে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে একটু হাই-হ্যালো করতে ক্লাবে যাওয়া।

কিন্তু বলতে পারল না কিছুই। বরং মিনমিন করে বলল, ‘আপনি কেমন আছেন, স্যর?’

‘এই বয়সে যেমন থাকা যায়,’ বলে টেবিলের ওপর থেকে পাইপটা নিতে গিয়েও হাত ফিরিয়ে নিলেন। ফুসফুসের একটা সমস্যা দেখা দেয়ায় ইদানীং ধূমপান অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। ‘তোমার রানা এজেন্সির খবর কী? ছেলেরা ভাল করছে?’

‘জী, স্যর। ওদের পারফর্মেন্স খুব ভাল। সুনাম ছড়াচ্ছে।’

‘হুম, ভালই হলো, ওরা তোমার ব্যস্ততা কমিয়ে দিয়েছে। এদিকে তুমিও ট্রেয়ার হান্টিঙে বেশ সময় দিতে পারছ।’

স্বাভাবিক সুরেই বলেছেন রাহাত খান। কিন্তু আঁতকে উঠল রানা। বুড়ো বলে কী! কিছু বলার ভাষা হারিয়ে নীরবে খোঁচাটা হজম করল ও। শব্দ হবে ভেবে রাগের চোটে দাঁত কিড়মিড় করল না।

ওর মনের অবস্থা টের পেয়েই বোধহয় সরাসরি কাজের প্রসঙ্গ তুললেন রাহাত খান। ‘তুমি খালেদ আমানকে তো চিনতে, তা-ই না?’

হাঁফ ছেড়ে বাঁচল রানা। মাথা নেড়ে বলল, ‘লণ্ডনে দেখা হয়েছিল গতবছর, সোহেলও সঙ্গে ছিল। রানা এজেন্সির একটা কাজে বেশ সাহায্য করেছিল সেসময়। খুব বুদ্ধিমান আর চঞ্চল টাইপের ছেলে। হঠাৎ ওর কথা, স্যর?’

‘হি ওঅয আ প্রমিযিং ব্রাইট এজেন্ট। খালেদ মারা গিয়েছে গতকাল। স্পেনে। পেছন থেকে স্ট্যাব করে হত্যা করা হয়েছে।’ পাইপটা আবারও এড়িয়ে গিয়ে একটা ফাইল নিয়ে দৃষ্টি নিচু করলেন রাহাত খান। রানা বুঝল বসের কষ্টটা। ওর নিজেরও খারাপ লাগছে। খালেদের দুষ্টুমিভরা হাস্যোজ্জ্বল মুখটা মনের পর্দায় ভেসে উঠল।

‘ওর অ্যাসাইনমেন্টটা কী ছিল, স্যর।’

হাতের ফাইল একপাশে সরিয়ে রাখলেন রাহাত খান। আবেগ সামলে নিয়েছেন। ‘বর্তমান সময়ের গ্লোবাল পলিটিক্স আর যুদ্ধ পরিস্থিতি তো দেখতেই পাচ্ছ। একপক্ষ আরেকপক্ষের দুর্বলতা খুঁজে চলেছে। আর সেটা পেলেই শুরু হচ্ছে হামলা। আমরা যারা যুদ্ধ চাই না, তাদেরও দু’পক্ষের মধ্যে সামরিক সক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে দিন-রাত কাজ করতে হচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতেই খালেদ আমান গত সপ্তাহে এক মোসাদ এজেন্টকে ধাওয়া করে মেডিটেরেনিয়ান অঞ্চলে। ওর কাছে ইন্টেল ছিল, মোসাদ এজেন্টের কাছে আছে এক বা একাধিক মাইক্রোডট, সবগুলোতে ইরানের বড় বড় পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর গোপন নকশা। যে-কোন ইনস্টলেশনের কিছু দুর্বলতা থেকেই যায়। আমাদের বিশ্বাস এই গোপন নকশাগুলোতে সেই পয়েন্টগুলোই চিহ্নিত আছে, যা প্রতিপক্ষের স্যাবোটাজকে কোন মিসাইল লঞ্চ না করেও সফল করে তুলতে পারে। এগুলো ইসরাইল হাতে পেলে মধ্যপ্রাচ্যে প্যালেস্টাইনের পক্ষে আওয়াজ তোলার মত আর কোন শক্তিশালী মিত্র থাকবে না। জর্ডান, সৌদি কিংবা মিশরের যুদ্ধবিরোধী অবস্থান সমর্থনযোগ্য, কিন্তু একই কারণে ইসরাইল তাদেরকে মিত্র ভাবে। ইরানের সাহায্য ছাড়া হিজবুল্লাহ বা হামাসের অবস্থা হবে খোলা ময়দানে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকার মত। ওরা হবে সহজ ও দুর্বল টার্গেট।

‘যতক্ষণ শক্তির ভারসাম্য রক্ষার সুযোগ আছে, আমরা সেটা হতে দিতে পারি না, রানা। তাই বিপদ আর নির্দেশের গুরুত্ব বুঝে মোসাদ এজেন্টকে ক্যাপচার করে খালেদ। তারপর মাইক্রোডট হাতে পেয়ে বিসিআই-এ পাঠায় কোডেড মেসেজ।’

এবার বোধহয় আর থাকতে পারলেন না, পাইপটা শেষ পর্যন্ত ধরালেন রাহাত খান। ‘অন্য কোন এজেন্টকে আমি সেটা ইন্টারসেপ্ট করতে পাঠাতাম, কিন্তু খালেদ তোমার কোডনেম উল্লেখ করেই মেসেজটা পাঠিয়ে দিয়েছে।

কথা শেষ করে ছোট্ট এক টুকরো কাগজ রানার দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি। রানা খেয়াল করল তাঁর কপালের একপাশের রগটা কেমন লাফিয়ে উঠছে। ‘স্টেশন আননোন বলতে খালেদ কী বুঝিয়েছে, আমি বা. সোহেল ধরতে পারিনি। ও হয়তো নিশ্চিত ছিল তুমিই বুঝবে।’

মেসেজটা দু’বার পড়ল রানা, তারপর কাগজটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি বুঝতে পেরেছি, স্যর। এক বছরও হয়নি, জাপানি এক নারী অ্যাসাসিন কিমি মাসুকোর সঙ্গে ঝামেলা লেগে যায় স্থানীয় এক ইয়াকুয়া বসের। কিমির ছিল চার বছরের এক মেয়ে। ওকে গোপনে অন্য কোথাও নিরাপদেই রেখেছিল মেয়েটা। কিন্তু ইয়াকুয়া ঠিকই খোঁজ পেয়ে যায় আর বাচ্চাটাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যায় অজ্ঞাত জায়গায়।

‘সেই সময় আহত কিমি পরিচয় গোপন করে সাহায্য চায় রানা এজেন্সির। বাচ্চাটার সন্ধান আমি খুঁজে বের করে ফেলি ঠিকই, কিন্তু এমআই-সিক্সের এক কাজে সাহায্য করা জরুরি ছিল বলে তখন সোহেলকে অনুরোধ করি। ও-ই খালেদকে মিশনটা দেয় কিমির মেয়েটাকে উদ্ধার করার আর ইয়াকুয়া বসকে শায়েস্তা করার। খালেদ সাফল্যের সঙ্গে কাজটা শেষ করেছিল। আর কিমি মাসুকোও আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থেকে যায়।’

তর্জনী দিয়ে ডান ভুরুর ওপরটা একটু চুলকালেন রাহাত খান, তারপর বললেন, ‘তার মানে, খালেদ মাসুকোর মাধ্যমে মাইক্রোডট পাঠাচ্ছে। এবং সেটা একমাত্র তুমিই ইন্টারসেপ্ট করতে পারবে, কারণ রদেভু একমাত্র তোমাদের দু’জনেরই জানা আছে। খালেদ সত্যিই ব্রিলিয়ান্ট ছিল। এখন মাসুকো মেয়েটা ওর বিশ্বাসের মর্যাদা দিলেই হয়।’

মাথা দুলিয়ে সায় দিল রানা। ‘আমিও সেটার ওপর ভরসা করছি, স্যর। তা হলে, দেরি না করে রওনা হয়ে যাই,’ বলে উঠে দাঁড়াল রানা।

আরেকটা ফাইল হাতে তুলে নিলেন রাহাত খান। অর্থাৎ ‘তুমি এখন যেতে পারো’। তবে বোধহয় প্রথমবারের মত এবার মুখ তুলেই বললেন, ‘খালেদ শতভাগ সাবধানেই ছিল বলে আমার বিশ্বাস। তুমি তার থেকেও সাবধানে থেকো। মোসাদ খুবই ভয়ঙ্কর, রানা। মাইক্রোডটটা যে-কোন মূল্যে ওদের চাই!’

‘আমি সতর্ক থাকব, স্যর,’ বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রানা। মৃত খালেদের আস্থা, বসের ভরসা আর বুকভরা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বসের ঘর থেকে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে এল।

ছয়

হোটেল মি-কাসা’র চোদ্দ তলায় মঞ্চস্থ হতে চলেছে দুই দেশের দুই দুর্ধর্ষ এজেন্টের দ্বৈরথের শেষাঙ্ক।

দু’হাত মাথার ওপরে তুলে খুব সাবধানে কিমি মাসুকোর ডেডবডির কাছ থেকে সরে গেল বিজয় ভদ্র। খসে গেছে বিনয়ের মুখোশ। তবে মুখে ধরে রেখেছে চতুর এক হাসি।

‘মারার আগে কৌতূহলটা তো মিটিয়ে দাও, রানা। তোমাকে সম্মোহনের প্ল্যান ছিল নিখুঁত। ইতোমধ্যে অনেক ইমপ্রুভ করেছি আমরা এই প্রজেক্টে। কিন্তু কীভাবে কী হলো? হোয়াট গেইভ আস আপ?’

তর্জনী ঠোঁটের ওপরে ধরল রানা। ‘এই সিক্রেট তো ফাঁস করা যাবে না, ভাই। তবে বোকার মত কিছু না করলে এক্ষুণি তোমাকে মরতে হবে না। হাজার হোক, বন্ধুপ্রতিম দেশের মানুষ তুমি, ওদের রত্ন ওদেরকেই ফেরত দেবার ইচ্ছে রাখি। আইএসএস সিদ্ধান্ত নেবে তোমাকে নিয়ে তারা কী করবে।’

রানাকে অবাক করে হা-হা করে হেসে উঠল বিজয়। ‘বিরাট ভুল করবে। আমি ওদের কাছে মহামূল্যবান।

‘তা-ই? কিন্তু, মহাশয়, আমি তো দেখছি তোমার ভয়ঙ্কর বিপদ। আইএসএস তোমাকে ছেড়ে দিলেও মোসাদ ভুলেও ছাড়বে না। শুরু থেকেই মাইক্রোডট খুইয়ে একের পর এক ভুল করছ। একটু মন দিয়ে শোনো আমি কী বলি, ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে।’

অবাধ্য ছাত্রকে উপদেশ দিচ্ছে এমন সুরে কথা বলছে রানা। ‘প্রথম ভুল করেছ খালেদকে হত্যা করে। তোমার কুরিয়ারের খুনের প্রতিশোধ নিয়েছ ঠিকই, কিন্তু নিজেদেরকে এক্সপোয করে দিয়ে। অবশ্য তোমাদের পেগাসাস ভাল কাজ দেখিয়েছে মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করে। ফলে তোমরা জেনে যাও ঢাকা থেকে কে আসছে। আমিও বোকার মতই তোমাদের ফাঁদে পা দিই। সম্মোহনের মাধ্যমে আমাকে সাজেশন দিয়ে নিজেদের বন্ধু বানালে। অপেক্ষায় থাকলে, যাতে ডেলিভারি-পার্সন দেখা দিলে মাইক্রোডট আমি তোমার হাতে তুলে দিই। তারপর তোমরা আমাদের দু’জনকেই মেরে ফেলতে। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে এলিস মেয়েটা আর তার, বয়ফ্রেণ্ড ঝামেলা করতেই তোমরা হকচকিয়ে যাও। কেউ একজন পুলিশ ডাকে আর পুলিশের গাড়ি দেখে তোমরা সরে যাও নিরাপদ দূরত্বে। তার আগেই অবশ্য কিমি তোমার লোকদের ফাঁকি দিয়ে আমাকে নিয়ে সটকে পড়ে।

একটু বিরতি দিয়ে বিজয়ের প্রতিক্রিয়া দেখল রানা। ‘হ্যাণ্ডস-আপ’ ভঙ্গিটা প্রায় শিথিল হয়ে এসেছে ইসরাইলি এজেন্টের, রানা পিস্তল নাড়তেই আবার সোজা ওপরে হাত তুলল সে।

‘খুব বেশিক্ষণ অবশ্য লুকিয়ে থাকতে পারিনি। তোমাদের নেটওঅর্ক ঠিকই খুঁজে বের করে, হোটেল মি- কাসা’য় আমরা আছি। রুম সার্ভিসকে হাত করে শ্যাম্পেনে ক্লোরাল হাইড্রেট মিশিয়ে দিলে। আমরা জ্ঞান হারালে গভীর রাতে আমাদের রুমে ঢুকে প্রথমেই হত্যা করলে কিমিকে। কারণ, তোমরা জানতে জাগ্রত কিমি কমব্যাটে ভয়ঙ্কর। আর আমি তো ব্রেইনওয়াড় হয়ে তোমার ‘স্যর’ হয়ে বসে আছি! এরপর ওর হ্যাণ্ডব্যাগসহ সবকিছু খুঁজেও মাইক্রোডট পেলে না। ফল্‌স্‌ নেইলের ওপর আঁচড়ের দাগ দেখেই সেটা বুঝতে পেরেছি। যাই হোক, না পেয়ে ভাবলে সকালে মাসুদ রানার সহযোগী বা বন্ধু সেজে এসে সাহায্য চাইবে এবং আবার খুঁজবে। কিন্তু এখানে আমি যেটা বুঝিনি সেটা হলো: সারারাত তোমার হাতে সময় ছিল, তা হলে না খোঁজাখুঁজি করেই চলে গেলে কেন?’

মনোযোগ দিয়েই রানার কথা শুনছে বিজয় ভদ্র। অস্থির হওয়া তার স্বভাবে নেই। কীভাবে কী হলো, সেটা নিয়ে এখন আফসোস করে কোন লাভ নেই। এবার তক্কে তক্কে থাকতে হবে। একটু পর কোন না কোন সুযোগ আসবেই।

রানার প্রশ্ন শুনে বলল ভদ্র, ‘আমার রিপোর্টিং আওয়ার ঘনিয়ে এসেছিল। গাড়িতে ছিল স্যাটেলাইট ফোন। বারবার ওপর-নিচে ওঠানামা করতে চাইনি। তাতে কারও না কারও চোখে পড়ে যেতাম। তুমি যেহেতু ‘আমাদেরই লোক’ ছিলে, ভাবলাম একসঙ্গে খুঁজলেই ভাল।

‘তারপর আমার কী হতো? সেই ‘ফ্রম অ্যাশেস টু অ্যাশেস’?’ মোসাদের হাতে ওর শেষ পরিণতিটা জানতে চাইছে রানা।

বিজয়ের মুখে ফুটে উঠল বিদ্রূপের মুচকি হাসি। ‘তোমার কোন ধারণাই নেই, রানা, মোসাদ তোমাকে নিয়ে কী করতে চায়! খুন করা তো সহজ, কয়জন আততায়ীকে ঠেকাবে? কিন্তু ওরা তোমাকে উন্মাদ বানাতে চায়, প্রচণ্ড অপমান করতে চায়, যাতে তুমি, তোমার বস, কলিগ, দেশ সবার মাথা লজ্জায় নিচু হয়ে যায়। কিমির মত একজন আণ্ডারগ্রাউণ্ড অ্যাসাসিনেটরের সঙ্গে তোমার ‘প্রেম, প্রতারণা, অবৈধ সন্তান, গোপন তথ্য চালাচালি এবং সবশেষে বনিবনা না হওয়ায় মার্ডার’-এসবই বারবার ফলাও করে ছাপা হবে সারা দুনিয়ার প্রিন্ট মিডিয়ায়। বাংলাদেশি হিরো স্পাই আর জাপানি ভাড়াটে কিলারের গোপন সম্পর্ক! খুবই মুখরোচক একটা স্ক্যাণ্ডাল হবে ওটা!’

কথাগুলো বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে তৃপ্তির সঙ্গে বলেছে বিজয়। এখনও যেন ভাবছে সামনে বড় কোন সুযোগ আসবে। মাইক্রোডট হারানোর দুঃখ মোসাদ ভুলে যাবে, যদি তাদের এই প্ল্যান কার্যকর করা যায়।

এদিকে প্রচণ্ড বিতৃষ্ণা নিয়ে বিজয় ভদ্রের চোখে চেয়ে আছে মাসুদ রানা। যেন এক্ষুণি গুলি করে দেবে। পরিবর্তে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি নিজেই তো এখন কট, কীভাবে তোমার প্ল্যান এক্‌ িকিউট করবে?’

হাসল বিজয়। ডানহাত সামান্য ঝাঁকি দিতেই ম্যাজিকের মত শার্টের আস্তিন ছেড়ে তার তালুতে উঠে এল স্টিলেটো I সবক’টা দাঁত বেরিয়ে পড়েছে তার। ‘আমার হাতেও তুরুপের তাস আছে, রানা। তোমার ওয়ালথার গর্জে উঠবে ঠিকই, কিন্তু তোমাকে আটক করার পরেই পিস্তলের ম্যাগাযিন খুলে ওটার ভেতরে আমরা রেখেছি ব্ল্যাঙ্ক কার্ট্রিজ। সুতরাং, খালি হাতে তুমি কিছুই করতে পারবে না। আর ছুরি হাতে আমার জুড়ি নেই। আই অ্যাম আ গড!’

লোকটা এত চালাকি করবে সেটা ভাবেনি রানা। আবার খুব যে অবাক হয়েছে, তা-ও নয়। বিজয় অত্যন্ত দক্ষ আর প্রশিক্ষিত একজন খুনি। কিন্তু ওর পিস্তলের ম্যাগাযিনে আসলেই ব্ল্যাঙ্ক গুলির খোসা আছে কি না, সেটা পরীক্ষা করতে বিজয়ের পেছনের দেয়ালে গুলি করল রানা। বিরতি না দিয়ে পর পর তিনবার গর্জে উঠল ওয়ালথার। আসলেই ব্ল্যাঙ্ক কার্ট্রিজ। শব্দ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দেয়ালের কোন ক্ষতি হয়নি।

ভুরু নাচিয়ে হাসছে বিজয়। ‘এবার তা হলে? তুমি নিরস্ত্র আর আমি সশস্ত্র। কী বলেন, স্যর! হা হা…’

তাকে ভিলেনমার্কা তৃপ্তির হাসি শেষ করতে দিল না রানা, তার আগেই বিসিআই-এর আর্মারিতে মডিফাই করা ওর প্রিয় ওয়ালথার পিপিকের গায়ে একটা গোপন সিলেক্টর সুইচ টিপে দিয়েই সজোরে ছুঁড়ে মারল মোসাদ এজেন্টের কপাল বরাবর।

বিজয়ের রিফ্লেক্স চমৎকার। দ্রুত হাতের ঝাপটায় উড়ন্ত পিস্তল মুখের সামনে থেকে সরিয়ে দিল সে। তবে ব্যথাটা পেল হাতের তালুর উল্টোদিকে। রানা প্রস্তুত ছিল, এক ঝটকায় আগে বেড়ে লাথি চালাল বিজয়ের হাঁটু বরাবর। উদ্দেশ্য, নিচের দিকে ঝুঁকলেই শত্রুর কণ্ঠা বরাবর একটা ডেথ ব্লো। কিন্তু বিজয় আরও ফাস্ট। চোখের পলকে হাঁটু সামলে উরু দিয়ে ঠেকিয়ে দিল রানার লাথি। সেই সঙ্গে চালাল ছুরি। রানার পায়ের কাফ মাসলে লম্বা একটা আঁচড় কাটল স্টিলেটো।

ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে জ্বলতে শুরু করেছে জায়গাটা, ঝট করে পিছিয়ে এল রানা। ভাল করেই জানে, এবার আক্রমণ শানাবে বিজয়। হিংস্র হাসিতে ভরে উঠেছে তার মুখ। সময় নষ্ট না করে সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। বিশেষ ভঙ্গিতে উঁচু করে ধরেছে স্টিলেটো। আক্রমণে যেতে সে প্রস্তুত। এবার রানা তার স্টিলেটো খপ্ করে পাকড়ে ধরার আগেই দক্ষতার সঙ্গে ওর হাত এড়িয়ে গেল বিজয়। রানার বাহুতে ছুরির আঘাতে তৈরি হলো গভীর এক ক্ষত।

পরবর্তী দশ মিনিট বেশকিছু কাটাকুটির ক্ষতের মালিক হলো রানা। তবে কঠিন কিছু ঘুষি লাগাতে পেরেছে বলে বিজয়ের বাম চোখের নিচের ফোলা নীল অংশ আর ফাটা ঠোঁট থেকে এখন ঝর ঝর করে ঝরছে রক্ত। যদিও বদলায়নি রানার টার্গেট-যেভাবেই হোক ওর হাতে পেতে হবে স্টিলেটো।

সুযোগ হঠাৎ করেই এল। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে হাত লম্বা করে ওর ঘাড়ের নরম অংশে স্টিলেটো গেঁথে দেয়ার সুযোগ পেল বিজয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে এসে ক্রাভ মাগা’র কৌশলে ডান পায়ের লাথি চালাল রানা। তাতে আরেকটু হলে প্রচণ্ড ধারালো ছুরি আমূল ওর উরুতে গেঁথে দিত মোসাদ এজেন্ট। অবশ্য রানার লাথি ঠিকভাবেই লেগেছে তার বাহুমূলের নিচে। ভদ্র যদিও ধরে রেখেছে ছুরি, কিন্তু কয়েক মুহূর্ত আর হাত ওপরে তুলতে পারল না। আর এই সুযোগে আবার এগিয়ে গিয়ে শত্রুর প্রায় বিবশ হাত কনুইয়ের নিচে খামচে ধরে, অন্য হাতে মাপা ঘুষি চালাল রানা লোকটার কব্জির ওপরে। কার্পেটের ওপরে থপ শব্দে পড়ল ছরি। ওটাকে পা দিয়ে ঠেলে দিয়ে সময় নষ্ট না করেই জুজিৎসুর প্যাচে বিজয়কে কঠিন এক আছাড় দিল রানা।

অবশ্য আছাড় খেয়েও এক গড়ান দিয়ে উঠে পড়ল বিজয়। এখন তার হাতে রানার ছুঁড়ে মারা ওয়ালথার পিপিকে। লোকটা দেরি করেনি ওটা মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিতে। ভোজবাজির মত তার হাতে একটা ম্যাগাযিনও দেখা গেল। কয়েক পা পিছিয়ে দ্রুত পিস্তলে ম্যাগাযিন লোড করল সে। রানা ধরে নিল, এবারের ম্যাগাযিনে সত্যিকারের গুলি থাকবে। চেম্বারেও ঢুকবে আসল বুলেট। এদিকে ওর নিজের হাতে এখন আছে বিজয়ের স্টিলেটো।

‘দ্য গেইম হ্যায চেড়, রানা। তুমি আক্রমণ করতে পারো, কিন্তু সেক্ষেত্রে নিজের পিস্তলের গুলিতেই মরবে। আর যদি আমার কথামত চলো, তো সুযোগ পাবে আরও কিছুক্ষণ বাঁচার। চয়েস ইয ইওস।’

শান্ত রানা সিদ্ধান্ত নিল, হাতের স্টিলেটো ফেলে নির্দেশ মেনে নেবে। ওর কাজ ও করেছে, এখন আশা করছে বিসিআই-এর টেক এক্সপার্টরা তাদের কাজ ঠিকঠাক মত করতে পেরেছে।

বিজয়ের মুখে আবার ফিরে এল ভিলেনমার্কা হাসি। ‘মরার জন্যে দুটো অপশন আছে তোমার কাছে। এক: মাইক্রোডট আমার হাতে দাও। সেক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক মৃত্যু উপহার পাবে। আর দুই: মাইক্রোডট না দিলে বিছানায় গিয়ে বসো কিমির পাশে। তা হলে মোসাদকে আমি খুশি করব তোমার মান-সম্মানে কালিমা লেপে।

বিজয় জানে মাইক্রোডট প্রাণ থাকতে দেবে না রানা। বরং অসম্মানের মৃত্যুই বেছে নেবে। তাই ওকে বিছানার ওপর বসতে দেখে অবাক হলো না সে। বরং তাতে তার মনে বেড়ে গেল রানার প্রতি সম্মান। আফসোস করে বলল ভদ্র, ‘অন্য কোন পরিস্থিতিতে আমরা বোধহয় হতাম খুব ভাল বন্ধু, রানা। কিন্তু এই দুনিয়া তো স্রেফ স্বার্থের।’

রানা ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘থাক, দুঃখ কোরো না। যা করতে চাও, সেটা দ্রুত শেষ করো। আমার কোন আফসোস নেই। একদিন এভাবে আমাকে যেতেই হতো।’

‘ওকে, বস্।’ কাঁধ ঝাঁকাল বিজয় ভদ্র। কয়েক ফিট দূর থেকে পিস্তল অ্যালাইন করল রানার কণ্ঠা আর চিবুকের দিকে, যাতে মনে হয় জাপানি প্রেমিকাকে হত্যার পর অপরাধবোধে আত্মহনন করেছে বিসিআই এজেন্ট। এখনও গ্লাভ্স্‌ পরে আছে দু’হাতে পিস্তল চালানোয় দক্ষ মোসাদ এজেন্ট। মনে মনে বলল, এই কামরা ত্যাগ করার আগে কুড়িয়ে নিতে হবে নিজের আগ্নেয়াস্ত্র আর ম্যাগাযিন। সব সেটআপ সন্তোষজনক দেখে সাফল্যের হাসি হাসল বিজয় ভদ্র, তারপর টিপে দিল ট্রিগার।

মাসুদ রানা স্থির হয়ে বসে আছে বিছানায়, বীরের হাসি এখনও ম্লান হয়নি। চিবুকের নিচ দিয়ে ঢুকে গুলিটা মগজ ভেদ করে বেরিয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু তেমনটা ঘটল না।

তাজ্জব হয়ে বিজয় দেখল, কী যেন গুবলেট হয়ে গেছে!

রানা আবারও ঝাঁপিয়ে পড়বে এই আশঙ্কায় রিফ্লেক্স বশে আরও তিনবার ট্রিগারে চাপ দিল সে।

কিন্তু যে-ই কে সে-ই!

নিজের পিস্তল আগেই কেন তুলে নেয়নি, মনে মনে আফসোস করল বিজয় ভদ্র। অবশ্য তার সেই আফসোসটা আর দীর্ঘ হতে পারল না-সেলফ ডেস্ট্রাকটিং মেকানিযম চালু হওয়ায় ওর হাতেই বিস্ফোরিত হলো ওয়ালথার পিপিকে। সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে গেল তার কব্জি। কন্ট্রোল্ড চার্জের আঘাতে এক বিঘৎ মত জায়গার মাংস বিচ্ছিন্ন হয়ে বেরিয়ে এল রক্তমাখা সাদা হাড়। প্রচণ্ড শক আর বিস্ময়ে যেন পাথর হয়ে গেল বিজয় ভদ্র। যখন ব্যথাটা টের পেল, তখন অমানুষিক এক বিকট চিৎকার দেয়ার জন্যে মুখ হাঁ করতে গেল, কিন্তু তার আগেই থুতনির ওপর ফ্লাইং কিক চালিয়ে তাকে মেঝেতে ফেলে দিল রানা। মাত্র এক সেকেণ্ডে জ্ঞান হারিয়ে বসেছে বিজয় ভদ্র।

ওয়ালথারের সিলেক্টর সুইচ ঠিকমতই কাজ করেছে বলে মনে মনে বিসিআই টেক টিমকে ধন্যবাদ দিল মাসুদ রানা। এবার অদৃশ্য হবার পালা। মাইক্রোডট ঢাকায় পৌঁছানোরও ব্যবস্থা করতে হবে। ও, হ্যাঁ, বুদ্ধি করে নিজের ফস্ নেইলের মসৃণ সারফেসে অ্যান্টি-থে মাইক্রোডট স্প্রে ব্যবহার করে আসলটা লুকিয়ে রেখেছিল কিমি মাসুকো। মাইক্রোডট একাধিক হতে পারে, তাই ফস্ নেইলের পুরো বক্সটাই নিয়ে যাবে ও।

সময় সম্পর্কে সচেতন মানুষ রানা। বিজয়ের লোকেরা ওপরে উঠে আসার আগেই সব গুছিয়ে নেবে। স্মার্ট ওয়াচ ব্যবহার করে দ্রুত কোডেড মেসেজ পাঠাল ওর সিগন্যালের জন্যে অপেক্ষমাণ বিসিআই টিমের লিডারকে। মেসেজখানা অনেকটা এমন: বড় এক মাছ ধরেছি তোদের জন্যে। ওটা এখনও জ্যান্ত। ভালমত রান্না করে খেতে হবে। এবার এসে তোর দুলাভাইকে রেহাই দে, প্রিয় শ্যালক। আর, হ্যাঁ, খুব দামি সিগারেটের একটা প্যাকেট রেখে গেলাম তোর পুরস্কার হিসেবে। ভেতরে একটাই স্টিক দেখে মন খারাপ করিস না কিন্তু, জানিসই তো-স্মোকিং কিস্!

পরিশিষ্ট

একই দিন।

মোখলেসের ভাগ্নে রতন খুবই বিরক্ত রাঙার মা’র ওপরে। মামার মৃত্যুর পর সে-ই দেখাশোনা করে রানা স্যরের বাসার সমস্ত কাজ আর খেয়াল রাখে রাঙার মা’র। জরুরি এক কাজে আজই জমি-জমা সংশ্লিষ্ট সমস্যায় পড়ে গ্রামের বাড়ি যেতে হবে তাকে। আর সেই জন্যে রানা স্যরের অফিস থেকে ছুটিও নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠেই কান্নাকাটি শুরু করেছে বুড়ি। মিরপুর মাজারে নিয়ে যেতে হবে তক্ষুণি। কী এক দুঃস্বপ্ন দেখেছে, স্যরের কী নাকি হয়েছে।

আরে, স্বপ্ন তো বাপু স্বপ্নই!

আজকাল কি এসব কেউ বিশ্বাস করে?

কিন্তু বুড়ির চূড়ান্ত আবদার, নিয়ে যেতেই হবে, নইলে অকথ্য গালিগালাজের চোটে মানসম্মান শেষ!

রতন অনেক বুঝিয়ে বলে দেখেছে, আর তো কয়েকটা দিন, স্যর প্রতি মাসে দু’মাসে একবার করে মোবাইলে অনলাইন ভিডিয়ো কল দেন, ওদের দু’জনেরই খোঁজখবর নেন, দুনিয়ার যে প্রান্তেই থাকুন। আগামী কলের সময় কাছে চলে এসেছে, আর দুটো দিন অপেক্ষা করো না, তা না! বুড়ির আজকেই মাজারে যেতে হবে!

গজগজ করতে করতে পায়চারি করছিল রতন। রাঙার মা ঘর থেকে বেরিয়েই আচমকা পড়ে গেল মাথা ঘুরিয়ে। বয়স হলেও এমনিতে বুড়ি বেশ শক্তপোক্ত। রতন দ্রুত ছুটে গিয়ে তাকে ধরতেই চমকে গেল, রাঙার মা’র সারা গা পুড়ছে জ্বরে। রতন একবার বলতে চাইল, আজ থাক, যেয়ে কাজ নাই। কিন্তু রাঙার মা সেটা আঁচ করে হুট করে উঠে পড়ল। নাহ্, একে আজ কিছুতেই মাজার থেকে দূরে রাখা যাবে না। কঠিন সব মানত করে বুড়ি! আরও যন্ত্রণার ব্যাপার, স্যর যদি এই সপ্তাহে কলটা না করেন, তা হলে ঢাকা শহরের সব মাজারে ঘুরে বেড়াবে বুড়ি তাকে নিয়ে।

রাঙার মা’র কষ্টটা অবশ্য রতন কেন, কেউ বুঝবে না। কাউকে বোঝাতেও পারবে না সে। আব্বা (রানা) তার কাছে আসলে কী, সেটা পৃথিবীর কেউ জানে না। সবসময় নামাজ পড়ে, মানত করে, মাজারে যায়, যাতে আব্বাকে সহি সালামতে রাখেন আল্লাহ্তায়ালা। আজ মনটা তার বেশ অস্থির। স্বপ্নে দেখেছে, আব্বা আর নেই! তার লাশটাও কেউ খুঁজে পাচ্ছে না!

(মাসুদ রানা সিরিজের ক্লাসিক কাহিনী আমিই রানা থেকে অনুপ্রাণিত)

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন