কাজী আনোয়ার হোসেন
জলকুমারী – আর. এম. লিটন
প্রথমে একটা চোখ খুলল মাসুদ রানা। এখনও ঘুম লেগে আছে সেখানে। অনেক কষ্টে দ্বিতীয় চোখটাও মেলল। ইচ্ছে করছে প্রাণভরে আরও ঘুমাতে। কিন্তু একবার গভীর ঘুম ভেঙে গেলে সহজে আর আসে না। তবে শরীরে একটা আলসেমি থাকে, বিশেষ করে যখন কোন অ্যাসাইনমেন্টের টেনশন থাকে না।
বেশ প্রশস্ত একটা ঘরে আরামদায়ক কিং সাইজ বিছানায় ও একা। এসি নেই, তবে ফ্যান আছে, সেটাও বন্ধ। ওগুলোর অবশ্য দরকারও নেই। পায়ের দিকের দেয়ালজোড়া বিশাল জানালা দিয়ে ফুরফুরে স্নিগ্ধ বাতাস বয়ে যাচ্ছে ঘরময়, খেলা করছে জানালার পাতলা সাদা পর্দাটা নিয়ে
পঁচিশ একরের ছায়া সুনিবিড় শান্তির জায়গা। শুরুতে ছিল রানার নিজ হাতে তৈরি চারটে কামরা। এই ক’বছরে তিনগুণ বেড়েছে সংখ্যাটা। চওড়া বারান্দা, বাগান আর লতা- ঝোপের তিনদিকের বাউণ্ডারি ওয়াল। আম গাছ দিয়ে ঘেরা বাড়িটি থেকে দেয়ালবিহীন অংশটা দিয়ে সাদা সৈকত দেখতে পাওয়া যায়, তারপরই সুনীল সাগর, শোনা যায় তার উদাত্ত আহ্বান।
মাসুদ রানার বিসিআই ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে নিজের কেনা এই জায়গাটা এখন আর বাড়ি নেই, হয়ে গেছে শান্তিময় রিসোর্ট। বিদেশিদের প্রোপার্টিজ মালিকানায় রাখার আইন এখন অকার্যকর সেন্ট মেরি দ্বীপে, যদিও অনেক আগেই এই জায়গাটা নামমাত্র দামে বিক্রি করে দিয়েছিল রডরিকের পরিবারের কাছে। সেই সঙ্গে রানার প্রিয় বোট আসল জলকুমারীর আদলে তৈরি করা দ্বিতীয় জলকুমারীকেও। আসলে আইন মেনে সামান্য বিনিময় হলেও বাস্তবে এটা ছিল ওর তরফ থেকে উপহার। ভালবেসে এখনও কামরাটা ওর জন্যই রেখে দেয়া হয়েছে। রানা, রডরিক আর ল্যাম্পনির স্মৃতিস্বরূপ বেশ কিছু ফটোগ্রাফ ফ্রেম করে টাঙানো আছে দেয়ালে। আছে কিছু ডেস্কের ওপরে।
শুরুতে রডরিকের বউ চালালেও এখন এর দেখাশোনা করে রডরিকের বোন তারাজি। ভীষণ অমায়িক ও বন্ধুবৎসল এই কালো ভদ্রমহিলা নিজের ভাইয়ের থেকে কোন অংশে কম ভালবাসে না রানাকে। তার কাছেই শুনেছে, জলকুমারীতে করে ট্যুরিস্টদেরকে কাছের বিভিন্ন দ্বীপে বেড়াতে নিয়ে যায় রডরিকের ছেলে, বেশ ভাল আয় হয় বোট ভাড়া থেকে। সেই সঙ্গে মৌসুম এলে মাছ ধরা তো চলেই।
তারাজির গুণে বেশ ভাল চলছে রিসোর্ট। দেশ-বিদেশ থেকে এই দ্বীপে বেড়াতে আসা ট্যুরিস্টরা ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে রুম বুকিং দেয়, অনলাইন বুকিং সুবিধাও আছে। তবে বছরের এই সময়টায় হঠাৎ একগাদা পর্যটক ভিড় করার সম্ভাবনা কম। তাই আরামেই সময় কাটবে আশা করছে রানা।
সেন্ট মেরি আইল্যাণ্ড শেষবার যেমনটি দেখে গিয়েছিল ও, এখন তারচেয়ে অনেক আধুনিক হয়ে গেছে। পুব আফ্রিকার খুদে একটি দ্বীপরাষ্ট্রে শতভাগ মানুষ শিক্ষিত, সংখ্যায় এক লাখেরও কম। নারকেল, অ্যালকোহল, মাছ রপ্তানি আর ট্যুরিজমের কারণে অর্থনৈতিকভাবে বেশ এগিয়ে গিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, উন্নত জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ের পরেও দ্বীপবাসীদের সাদাসিধে জীবনযাত্রা আর চারিত্রিক সারল্য একটুও কমে যায়নি।
বিছানা থেকে নেমে আড়মোড়া ভাঙল মাসুদ রানা, ত্রিশবার বুকডন দিয়ে শরীরের জড়তাটা কাটিয়ে নিল। হঠাৎ দেয়ালে টাঙানো রডরিক ও ল্যাম্পনির সঙ্গে ওর ছবিটাতে চোখ যেতেই পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল। গতকাল এখানে এসে সময় নষ্ট করেনি, তারাজির সঙ্গে বিকেলটা গল্প করে কাটিয়ে সন্ধ্যার দিকে তার বাইকটা চালিয়ে লর্ড নেলসনে চলে গেছে রানা। লর্ড নেলসন হলো হারবারের কাছে ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া অফিসার্স ক্লাব। এই বার-টা এখন চালায় জিলেট ল্যাম্পনির চাচাত ভাই জিম ল্যাম্পনি তারাজির কাছে শুনেছে এখনও বিয়ে করেনি সে, চাচাত ভাই জিলেটের মতই নারী-পাগল। আর মেয়েরাও ঘুরঘুর করে তার আশপাশে!
ওকে দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠল জিম ল্যাম্পনি। ‘রানা, বস্, এত বছর পর মনে পড়ল আমাদের কথা!’
তার আলিঙ্গন থেকে কোনমতে নিজেকে ছাড়াল রানা, লিকলিকে শরীরে জিম ল্যাম্পনির অনেক জোর। ‘আরে, দাঁড়াও, একটু দম নিতে দাও! তা ভালই তো জমিয়ে দিয়েছ জায়গাটা! শুনলাম সন্ধ্যার পর থেকে তোমার বার-টাই নাকি সবচেয়ে বেশি জমজমাট থাকে।’
কাঁধ ঝাঁকাল জিম ল্যাম্পনি। ‘সবই ঈশ্বরের দয়া। তবে আফসোস কী জানো, আমার সবচেয়ে বড় খদ্দের যারা হতে পারত, সেই জিলেট আর রডরিকই আর নেই। ওদেরকে আর তোমাকে ছাড়া আমার জীবনটা বড়ই নীরস!’
রানা জানে, চাচাত ভাই জিলেট আর রডরিকের কথা বলছে জিম ল্যাম্পনি। একসময়ে রানা ছিল তাদের বস্ আর কর্মচারী অথচ বন্ধু। একটা টেবিল দখল করে বিয়ারের পর বিয়ার খেতে খেতে মধ্যরাত পর্যন্ত গল্প ও অতীত স্মৃতিরোমন্থনে মেতে উঠল রানা আর জিম ল্যাম্পনি। মেয়েগুলো আজ জিমের কাছে ঘেঁষতে পারেনি, দূর দূর করে তাদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছে সে। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে সেই সময়ের অনেক পরিচিত মুখের দেখা পেয়েছে রানা, আবার অনেকেই চলে গেছে পৃথিবী ছেড়ে। যেমন, রামাদীন। তার ছোট ভাই এখন রামাদীন ট্রাভেলস চালায়। সকলের আন্তরিক ব্যবহারে মনে হচ্ছিল এই দ্বীপ ছেড়ে কখনও যায়ইনি ও। হঠাৎ করে একবার রানার মনে হলো ল্যাম্পনিকে জিজ্ঞেস করে রাফেলার কথা যে, কখনও ওর খোঁজে এসেছিল কি না মেয়েটা। তারপর কী মনে করে প্রসঙ্গটা আর তুলল না রানা। বিদায় নেবার সময় ওকে নিঃসঙ্গ মনে করে এক কৃষ্ণসুন্দরীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল জিম ল্যাম্পনি, কিন্তু হাই-হ্যালো ছাড়া তেমন কোন সাড়া মিলল না ওর কাছ থেকে। মেয়েটার সৌন্দর্যের প্রশংসা করে সসম্মানে পিছু হটে গেল রানা।
এখন, এই স্নিগ্ধ সকালে, উন্মুক্ত বিশাল জানালাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও। চুপচাপ শুনছে সমুদ্রের গর্জন। খুব শান্তি লাগছে। মনে পড়ে গেল শেষ অ্যাসাইনমেন্টটার কথা, ওকে আবার ফাঁদে ফেলে ব্রেইনওয়াশ করেছিল ইসরাইলি ইন্টেলিজেন্স সংস্থা মোসাদ, উদ্দেশ্য ছিল ওর মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার গোপন নকশা হাতিয়ে নেয়ার। কিন্তু মেমোরি রিট্রিভিং কোড ইনিশিয়েট হওয়ায় আবারও স্মৃতি ফিরে পায় রানা। তারপর বানচাল করে দেয় মোসাদের বিধ্বংসী পরিকল্পনা। সেনসিটিভ নকশাগুলো লুকানো আছে এমন একসেট মাইক্রোডট উদ্ধারের পর সেগুলো গোপনে মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের কাছে পৌঁছাবার ব্যবস্থা করে ও। তারপর বুড়ো কী কলকাঠি নেড়েছিলেন জানা নেই ওর, তবে ইরান-ইসরাইল দু’দেশই যুদ্ধংদেহী অবস্থান থেকে সরে এসেছিল।
যখন কোন মিশন সফল হয়, এরচেয়ে আনন্দের কিছু হতে পারে না। বিশ্বে শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশ যে বলিষ্ঠ ভূমিকা নেয়, সেসবের অনেক কিছুই পৃথিবীর মানুষ জানতে পারে না। দেশের এরকম মহতী ভূমিকার পেছনে সামান্য হলেও ওর মত এজেন্টরা যে অবদান রাখতে পারে, তাতেই রানা কৃতজ্ঞ। মাতৃভূমির জন্যে কিছু করতে পারলে বেশ গর্ব অনুভব করে।
এদিকে, আপাতত নতুন টার্গেট পেয়েছে মোসাদ। যে- কোন মূল্যে মাসুদ রানার কল্লা চাই! তাই ঢাকার পরিষ্কার নির্দেশ: ‘পৃথিবীর যে-কোন প্রান্তে লুকিয়ে পড়ো কিছুদিনের জন্যে। কোনভাবেই কোন ঝামেলায় জড়ানো যাবে না। এমনকী অন্যের বিপদ-আপদ দেখলে সেখান থেকেও সরে থাকতে হবে। মেইনটেইন অ্যাবসোলিউট লো প্রোফাইল!’
সেই নির্দেশ মেনেই রানা এখন ভারত মহাসাগরের ছোট্ট এই দ্বীপ সেন্ট মেরিতে। মাঝখানে অবশ্য ছদ্মপরিচয়ে নাইরোবি যেতে হয়েছিল বাংলাদেশি এক বেসরকারি কার্গোবাহী জাহাজ ও সেটার ক্রুদের সোমালি জলদস্যুদের হাত থেকে উদ্ধারের জন্যে। কমাণ্ডো টিম তৈরি ছিল, কিন্তু হঠাৎ জাহাজ কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা বন্দি অফিসার ও ক্রুদের জীবন নিয়ে কোন ঝুঁকি নেবে না। জলদস্যুদের দাবি মেটানো হবে।
রানার কাছেও লো প্রোফাইল ভাঙার কোন নির্দেশ আসেনি। তাই নাইরোবি থেকে মোম্বাসায় চলে আসে ও, সেখান থেকে ফেরিতে করে সেন্ট মেরি দ্বীপ। গতকাল তো এসে পৌঁছাল মাত্র, কিন্তু রডরিকের ছেলে কিংবা জলকুমারী, এখনও পর্যন্ত কারোরই দেখা পায়নি ও।
গোসল-শেভ সেরে বেরিয়ে পড়ল রেস্তোরাঁর উদ্দেশে। নাস্তা খাওয়া দরকার। খিদেয় পেট চোঁ-চোঁ করছে। অল্প কয়েকজন ট্যুরিস্ট দেখতে পেল রানা, তারাও মাত্র এসেছে ব্রেকফাস্ট সারতে। একনজর বুলিয়ে সবাইকে মোটামুটি মেপে নিল ও। সন্দেহজনক তেমন কিছু চোখে পড়ল না। তারাজি ওকে দেখে সহাস্যে এগিয়ে এল, ‘গুড মর্নিং, মিস্ট্রি ম্যান! ঘুম কেমন হয়েছে?’
রানাও পাল্টা হাসি উপহার দিল। ‘গুড মর্নিং, সিস্। একেবারে সতেজ অনুভব করছি, এক ঘুমেই সব ক্লান্তি দূর।’
‘ওকে। ব্রেকফাস্ট সেরে নাও তাড়াতাড়ি, তোমার জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে।’
ভুরু উঁচু করল রানা। ‘জলকুমারী ফিরেছে বুঝি!’
কপট হতাশার ভঙ্গি করল তারাজি। ‘নাহ্, তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়া মুশকিলই বটে!’ রানার জন্যে তৈরি স্পেশাল নাস্তাটা টেবিলে রাখল ভদ্রমহিলা। একটা চোখ টিপে বলল, ‘তবে এইবার ঘটনাটা অন্যরকম হতে চলেছে।’
দু’জনে মিলে খুনসুটি করতে করতে দ্রুত নাস্তা সেরে নিল রানা, এরপর কফির মগটা যেই তুলতে যাবে, একটা ছায়া পড়ল ওর সামনে। ঘাড়টা ঘোরাতে শুরু করল ও, সেই সঙ্গে বিস্ফারিত হচ্ছে ওর অবাক চোখ।
মানুষটা বিশালদেহী। চকচকে খয়েরি রঙের পরিষ্কার করে কামানো মাথা। চোখদুটোর সাদা জমিন একটু বেশিই সাদা। মোটা কালো ঠোঁটে আত্মীয়সুলভ হাসি, যেন বহুদিন পর খুঁজে পেয়েছে হারিয়ে যাওয়া কোন আপনজনকে।
রডরিক!
মন্ত্রাহতের মত উঠে দাঁড়াল রানা। রডরিক এগিয়ে এসে ওর হাতটা ধরল। পরিষ্কার তাকে বলতে শুনল রানা, ‘আজও তোমাকে আমার ছোট ভাইয়ের মত ভালবাসি, রানা। আই লাভ ইউ, ম্যান!’
এই ছিল এই নেই। ওটা হঠাৎ ভোজবাজির মত উধাও হয়ে গেছে। গগল্সটা ঠিক করে চারপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর বোলাল মাসুদ রানা, জানে ওটা আশপাশেই আছে।
হ্যাঁ, ওই তো! লেগুনের তলা থেকে উঠে আসছে, যেন বিশাল একখানা চাদর ভাসছে। এক ডানা থেকে আরেক ডানার দূরত্ব হবে ছয় ফিটের মত, আর মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত দশ ফিট। স্টিংরেটার লেজ থেকে সাবধান, নিজেকে সতর্ক করল রানা। টিভিতে-সিনেমায় যতই নিরীহ দেখাক প্রাণীটাকে, এর কাঁটাওয়ালা লেজটা মারাত্মক বিষাক্ত, গায়ে আঘাত লাগলে মৃত্যু নিশ্চিত। একসময় ইংরেজ ভূস্বামী কিংবা আরব শেখদের পছন্দের চাবুক তৈরি হত এই স্টিংরের লেজ দিয়েই, ‘অবাধ্য’ প্রজা বা দাস কিংবা স্ত্রীদের শায়েস্তা করার কাজে ব্যবহারের জন্যে। বর্তমানে এসব মাছ শিকার নিষিদ্ধ করা হলেও অনেক ধনী লোকই বেআইনিভাবে এর লেজ সংগ্রহের চেষ্টা করে। সেটা কি আসলে নির্দোষ স্যুভেনিয়র?
আপাতত ফিন নেড়ে নিরাপদ দূরত্বে সাঁতার কেটে ওপর থেকে অনুসরণ করে চলেছে রানা, দেখতে চায় কোথায় গিয়ে থামে বা লুকায় মাছটা। সাঁতরে যেতে যেতে মাঝেমধ্যেই পানিতে লেজ ঝাপটাচ্ছে স্টিংরে। নিরাপত্তার জন্যে হাতে ধরা হারপুন গানটার ওপর মুঠো শক্ত করল রানা। রিফটা ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে আসছে, কোরাল আর সামুদ্রিক ঝোপে ছেয়ে আছে জায়গাটা, রিফের রঙিন মাছগুলো উজ্জ্বল সোনালি আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে। ঢেউ তুলে দুলতে থাকা আগাছাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে মুঠি-সাইজের টাইগার কড়ি বা শামুকগুলো চকচক করছে। অপূর্ব সুন্দর এই লেপার্ড বা টাইগার শামুক, রিফের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।
এই জগৎটা ওর খুব পরিচিত। কত রোমাঞ্চকর আর প্রেমময় সময় কেটেছে রাফেলা বার্ডের সঙ্গে। কোন এক অদ্ভুত কারণে মেয়েটির আসল নামটা আর জানা হয়নি। চাইলে ওর পক্ষে রাফেলাকে পরে খুঁজে বের করা সম্ভব ছিল, তবে হয়তো অবচেতন মনে বাঁধনে জড়ানোর আশঙ্কা ছিল বলেই আর চেষ্টাও করেনি। হয়তো পরবর্তী সময়ে রেবেকা বা সোহানার সঙ্গে ওর ভাগ্যটা জুড়ে যাবে বলেই সেই সময় ওদের আর মিলন হয়ে ওঠেনি।
রিফের ওপর দিয়ে ঘুরে এসে তীরের দিকে রওনা দিল স্টিংরে, তারপর হঠাৎ থমকে গেল, ভাবছে বড় মাছটা (রানা) এখনও আক্রমণ করছে না কেন? শুধু শুধু পেছনে ঘুরে মরছে। মহাঝামেলা তো দেখছি! কিন্তু না, ব্যাটা সরে যাচ্ছে, আক্রমণের কোন ইচ্ছা নেই বলেই মনে হচ্ছে। নিশ্চিত হয়ে বালির ওপর নেমে এল সে, দু’ডানা ছড়িয়ে দিয়ে স্থির হলো। রঙ বদলে মিশে গেল বালির সঙ্গে, এখন আর বোঝার উপায় নেই তার অস্তিত্ব, ভাল করে খেয়াল না করলে।
সারফেসে মাথা তুলল রানা, গগল্সটা খুলে জমে থাকা পানি ফেলে দিল। বালিতে পা দিতেই দেখল ওর দিকে হেঁটে আসছে দীর্ঘকায়, স্বাস্থ্যবান একজন মানুষ, সূর্যের আলোয় চকচক করছে খয়েরি রঙের কামানো মাথাটা।
রডরিকের ছেলে রডরিক জুনিয়র দেখতে ঠিক বাপের হুবহু কপি হয়ে উঠেছে। এজন্যেই সেদিন প্রথমদর্শনে চমকে উঠেছিল রানা। কল্পনায় যেন রডরিকের বলা কথাটাই শুনতে পাচ্ছিল। এরই মধ্যে বাপের মত ছেলের সঙ্গেও খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ওর। গত তিন মাস ধরে সেন্ট মেরির আশপাশের দ্বীপ আর কোরাল রিফ চষে বেরিয়েছে দু’জন। কখনও ট্যুরিস্টদের সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন আইল্যাণ্ড হপিং। অবশ্যই জলকুমারীতে করেই। ধবধবে ফর্সা গায়ে রোদ মেখে যখন সাগরের বুকে চকচক করতে করতে ছোটে জলকুমারী, সে এক দুর্দান্ত দৃশ্য। মনে হয় অপার আনন্দে নেচে বেড়াচ্ছে রূপকথার কোন সাগরকন্যা।
জলকুমারীর কথা যখন উঠলই, তখন যমজটির কথা না বললেই নয়। হ্যাঁ, জলকুমারী একটা নয়, দুটো। এটাই ছিল রানার জন্যে ‘ব্যাক টু ব্যাক’ সারপ্রাইজ। প্রথম জলকুমারী আসলটার মত করেই তৈরি, মাছ ধরা কিংবা সাধারণ ট্যুরিস্টদের নিয়ে বেড়ানোর জন্যে কাছাকাছি দ্বীপগুলোতে ঢু মারা ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয়। আর জলকুমারী ২.০ কাজে লাগে দূরবর্তী দ্বীপ বা লেগুন ভেঞ্চারে। কিছু ধনী রোমাঞ্চপ্রিয় ট্যুরিস্ট আছে, যারা দূর-দূরান্তে যেতে বা সাগরে রাত কাটাতে প্রচুর অর্থ খরচ করে। তাদের জন্যেই দ্বিতীয় জলকুমারী-বাহাত্তর ফুটের এক ছোটখাট লাক্সারি ইয়ট। ডুয়াল ভলভো পেণ্টা ইঞ্জিন সর্বোচ্চ গতি তুলতে পারে ত্রিশ নট, যদিও ক্রুজিং স্পিড চব্বিশ নট। ফ্লাইং ব্রিজের নিচে দুটো ডেক, ওখানে দুটো ভিআইপি আর একটি ক্রু কেবিন, তিন বাথরুম আর গ্যালি। সেই সঙ্গে সোফাসেট ও বার কাউন্টার নিয়ে নরম কার্পেটে ঢাকা সুসজ্জিত লাউঞ্জ বা স্যালন তো আছেই। স্যালনের পরেই দ্বিতীয় হেম্ মানে জলকুমারীর অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক কনসোল। রডরিক (রানা এখন রডরিকের ছেলেকেও একই নামে ডাকে, তাকেও বলে দিয়েছে ওকে যেন ‘রানা’ বলেই সম্বোধন করে) যখন ওকে প্রথম দেখাল জলকুমারী ২.০-কে, রানা অভিভূত না হয়ে পারেনি। ওর উপহার দেয়া সম্পদ যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে নিজেদের জীবনযাত্রা উন্নত করে নিয়েছে প্রয়াত রডরিকের বোন ও ছেলে। বৃদ্ধি করেছে আরও সম্পদ ও সম্পত্তি।
এই মুহূর্তে, সেন্ট মেরি দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তের স্বচ্ছ নীল জলের এই লেগুনটা থেকে রানাকে খালি হাতে উঠে আসতে দেখে সহানুভূতির হাসি দিল রডরিক। ‘আজও কিছু পেলে না ‘বুঝি?’
‘হুম, নিচের দুনিয়াটা এত সুন্দর যে, মাছ শিকার করতে গিয়ে নিজেকে মহাপাপী মনে হচ্ছিল,’ কাঁধটা সামান্য ঝাঁকিয়ে বলল রানা।
‘যাক, দুঃখ কোরো না। সুখবর আছে, আবার অ্যাডভেঞ্চারে যেতে হবে। রামাদীনের ভাই খবর দিয়েছে, ওর ট্রাভেল এজেন্সিতে ট্যুরিস্টদের বেশ আনাগোনা চলছে এখন। দামি এক ক্লায়েন্ট পাওয়া গেছে।
এই সপ্তাহে মাথায় অন্য পরিকল্পনা থাকলেও অ্যাডভেঞ্চারের কথায় নেচে উঠল রানার রক্ত। তিন মাস ধরে দেশের সঙ্গে যোগাযোগ নেই বললেই চলে ওর। সেন্ট মেরি থেকে মেসেজ পাঠাতে গেলে ফাঁস হয়ে যেতে পারে ওর পরিচয়, তাই নাইরোবিতে গিয়ে ওখান থেকে গোপনে ঢাকায় যোগাযোগ করবে ভেবেছিল। অবশ্য যেহেতু রেডিমেড ক্লায়েন্ট পাওয়া যাচ্ছে, তাই আপাতত মনে মনে নাইরোবি যাবার ইচ্ছেটা মুলতবি রাখল রানা।
‘বছরের এই সময় দামি ক্লায়েন্ট?’
‘হ্যাঁ,’ বলল ‘রডরিক, ‘আমেরিকার এক প্রাইভেট কোম্পানির ক্রুজ শিপ কেনিয়া যাচ্ছিল চারশো যাত্রী নিয়ে। কিন্তু ওখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়ায় মার্কিন এম্বেসি যেতে নিষেধ করে ইয়ট কোম্পানিকে। বিপাকে পড়ে শিপটা এখন সেন্ট মেরিতে। মিডিয়াতে গতকাল থেকেই এটা নিয়ে নিউজ চলছে একের পর এক। এই জাহাজেরই এক ধনী যাত্রী রবার্ট আর্ভিং, মিলেনিয়াম ফাউণ্ডেশনের ওউনার, তার স্ত্রীসহ লা অ্যানযো দ্বীপ ঘুরেফিরে দেখতে চাচ্ছে ওদিকে কী নাকি এক দুর্লভ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। তাদের প্রথম পছন্দ লাক্সারি বোট, সঙ্গে ভাল ডাইভার। তাই সে আমাদের জলকুমারীকেই রেকমেণ্ড করেছে।
‘লা অ্যানযো দ্বীপটা যেন কোথায়?’
‘এখান থেকে অনেকটা দূর, আফ্রিকান উপকূল ছাড়িয়ে। গত চার-পাঁচ বছরে আমার ওদিকটা যাওয়া হয়নি, যতদূর মনে পড়ে, পাখির ডিম ছাড়া আর কোন কিছু ওখানে পাওয়া যায় বলে মনে হয় না!’
‘তাই বুঝি?’ আনমনে কী যেন ভাবছে রানা। এসবই স্বাভাবিক ঘটনা, তবুও মস্তিষ্কের কোথাও যেন বেজে উঠেছে বিপদের সতর্কঘণ্টা। আবার হয়তো আসছে অপ্রত্যাশিত কোন ঝড়!
মেজাজ বিগড়ে আছে রবার্ট আর্ভিঙের। মাত্র বাহাত্তরফুটি এই ফালতু বোটটা নাকি এই দ্বীপের সবচেয়ে বড় আর দ্রুতগামী, অথচ আমেরিকাতে তার নিজের বোটটাই দেড়শোফুটি একটা ইয়ট। আর এদেরটার নামটাও কী অদ্ভুত-জলকুমারী। আরে, এটা আবার কোন্ বিদঘুটে ভাষার শব্দ? এত এত পশ্চিমা ট্যুরিস্ট এখানে আসে বেড়াতে, একটা ইংরেজি নাম রাখা যেত না?
তবে বব (রবার্ট) সাহেবের মেজাজ খারাপের প্রধান কারণ, সে কেনিয়া পৌঁছে এবার সাফারিটা করতে পারল না। মরার টেরোরিস্টগুলো আর ঝামেলা পাকানোর সময় পেল না! জাহাজ কোম্পানিকে বকতে বকতে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তখনই আবার তার ফাউণ্ডেশন থেকে ফোন এসেছে: স্যর কি ভারত মহাসাগরের আফ্রিকান উপকূলের লা অ্যানযো দ্বীপটা থেকে ঘুরে আসতে পারবেন? বিরল প্রজাতির একটা মাছ আছে, যা শুধু ওখানেই পাওয়া যায়। ওটা পেলে আমাদের মেরিন ল্যাবের একটা মূল্যবান কালেকশন হবে। তা ছাড়া, ভাল কোন বোট মিলে গেলে দু’দিনের একটা চমৎকার জার্নিও হবে আপনার!
নিজের হাতে গড়া ফাউণ্ডেশনের জন্যে লাভজনক হবে ভেবেই সেই দূরের দ্বীপ ভ্রমণে রাজি হয়েছে রবার্ট আর্ভিং, ভেবেছিল বড় একটা লাক্সারি বোট নিয়ে আরাম করেই কাজটা করবে। কিন্তু জলকুমারীকে দেখে হতাশ হলো সে।
জেটিতে তাকে আর তার স্ত্রীকে সাদরে গ্রহণ করা হলো, রডরিক সসম্মানে সঙ্গের লাগেজগুলোসহ কেবিনে পৌঁছে দিল। একটা লাগেজ একটু বেশিই ভারি দেখে অবাক হলো সে। আবার খেয়াল করল, মিসেস আর্ভিং গভীর আগ্রহে পর্যবেক্ষণ করছে জলকুমারীকে।
নিজেদের কেবিনে মালপত্র রেখে লাউঞ্জে বেরিয়ে এল স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই। বোটের ভেতরের পুরোটা এয়ার কণ্ডিশনড় দেখে বেশ খুশি। বাইরে যা গরম! পুরু কার্পেটে পা ডুবিয়ে আরামদায়ক সোফায় বসল তারা। যেদিক দিয়ে রোদ আসছে, সেদিকের কাঁচের পুরোটা দেয়াল ভেনেসিয়ান ব্লাইও দিয়ে ঢাকা থাকলেও অপর দিকের ব্লাইণ্ড সরানো, দেখা যাচ্ছে সাগরের একটা পাশ, রোদ পড়ে স্বর্ণের মত চিকচিক করছে তার সুনীল সারফেস। অদ্ভুত সুন্দর! কিন্তু মিস্টার অ্যাণ্ড মিসেস আর্ভিং অসমবয়সী স্বামী-স্ত্রী বলেই বোধহয় তাদের আচরণে তেমন কোন উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে না। তবে তাদের চোখেমুখে ভাল লাগার একটা প্রকাশ দৃশ্যমান। সোফার উল্টোদিকের রুপালি কাঠের প্যানেল করা শেলফ থেকে ড্রিঙ্কসের বোতল আর গ্লাস নামিয়ে অতিথিদেরকে সার্ভ করল রডরিক।
এসময় কামরায় ঢুকল মাসুদ রানা। ফ্লাইং ব্রিজ থেকেই যাত্রীদেরকে উঠতে দেখেছে ও। ‘স্বাগতম আপনাদের। আশা করি আমাদের সঙ্গে সময়টা উপভোগ করবেন আপনারা।’
বসে থেকেই রানার বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরে হ্যাণ্ডশেক করল রবার্ট, ভদ্রতা করে ওঠার কোন লক্ষণ নেই। অত্যন্ত সুদর্শন অভিজাত চেহারা লোকটার, মাথাভর্তি কাঁচাপাকা চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো, চেহারায় কর্তৃত্বের ভাব। বয়স ষাটের গোড়ায়।
অন্যদিকে মিসেস রবার্ট রীতিমত তরুণী, বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। লাবণ্যময় ত্বক অত ফর্সা না হলেও দেখতে খুবই আকর্ষণীয়া, মায়াময় মুখচ্ছবি। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রানার সঙ্গে হাত মেলাল সে। ‘আমি মীরা, মানে মিসেস আর্ভিং, আপনিই কি ক্যাপ্টেন, মিস্টার…’
মীরার চোখে কি খানিকটা ভয় খেলে যেতে দেখল রানা নিজের নাম বলার সময়? ‘সরি, না। রডরিক হচ্ছে ক্যাপ্টেন। আমি আপনাদের ডাইভার, মাসুদ রানা। বন্ধুদের কাছে শুধু ‘রানা’।
বন্ধু হবার কোন ইচ্ছে নেই ‘এটা বোঝাতেই যেন নড়েচড়ে উঠল রবার্ট। ‘মি. মেসুদ, ডাইভিং আপনার পেশা বুঝি?’ ভরাট কণ্ঠ তার, যেন কাউকে ধমক দিচ্ছে।
‘না। তবে শখ বলতে পারেন।’
‘যেটাই হোক, আপনি আমার কাজে এলেই আমি খুশি। আমি রবার্ট আর্ভিং, ব্রিটিশ হলেও থাকি শিকাগোতে। ও, হ্যাঁ, স্যর রবার্টও বলতে পারেন, ক’দিন পর রাজার কাছ থেকে নাইট উপাধি পেতে যাচ্ছি কি না।’
লোকটার অভদ্র আচরণে অবাক না হয়ে পারল না রানা, এখনও ঔপনিবেশিক আমলের ভাবসাব নিয়ে আছে। মীরাকেও খানিকটা বিব্রত মনে হলো। রডরিক নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সব দেখছে। রানা বলল, ‘আমরা বরং সেই দিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করি, কেমন? আপাতত মি. রবার্টই যথার্থ।’
ধূসর নীল চোখদুটো আটকাল ওর ওপর, ক্ষীণ বিরতি দিয়ে ঠোঁটজোড়া দু’পাশে প্রসারিত হলো, ওটা তার হাসি। ‘হিউমার, অ্যাঁ? আপনার সঙ্গে আমার জমবে ভাল, মি. মেসুদ। আপনাকে এ-দেশি মনে হচ্ছে না, যদিও রঙটা কালোই।
কোনদিক থেকে এবার আক্রমণটা আসে, সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা করে রানা বলল, ‘আমি বাংলাদেশি।’
তাচ্ছিল্যের সুরে রবার্ট বলল, ‘ও, আপনি তা হলে বাংলাদেশি! একবার গিয়েছিলাম ওখানে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। শুনেছিলাম বিনিয়োগ নাকি বেশ লাভজনক। কিন্তু যেদিন গেলাম, সেদিন পলিটিকাল স্ট্রাইক চলছিল, আর চললও টানা অনেক দিন। তখনই মনে হয়েছে বাংলাদেশ একটা নির্বোধের দেশ, নিজেদের মধ্যেই সহিংসতা করে মরে বোকা মানুষগুলো।’
রানা আর রডরিকের চোখাচোখি হলো। দু’জনেই সিদ্ধান্ত নিল লোকটাকে না ঘাঁটানোর। কিন্তু রবার্ট ছাড়বার পাত্র নয়। স্থানীয় মদ ‘রাই’-এর একটা বোতলের মুখ খুলে ঘ্রাণ নিতে গেল, সঙ্গে সঙ্গে ভীষণভাবে কুঁচকে উঠল তার মুখ। ‘এটা কী!’
রডরিক দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বোতলটা নিয়ে নিল ছুঁড়ে ফেলার সম্ভাবনা দেখামাত্রই। হড়বড় করে বলল, ‘আপনার পছন্দ হবে না, মি. আর্ভিং। এটা আমাদের জনপ্রিয় লোকাল মদ।’
চক্ষু যেন ছানাবড়া অহঙ্কারী লোকটার। ‘মাই গড, এটা এখানকার সেরা পানীয়! এত বাজে!’
মৃদু হেসে বলল রানা, ‘এটাই এখানে আমাদের প্রথম পছন্দ। দারুণ জিনিস, বাজার পেলে বিখ্যাত হতে সময় নিত না।’
দু’পাশে মাথা নাড়ল রবার্ট। ‘আপনি মানুষটা উৎকৃষ্ট রুচির বলে মনে হচ্ছে না, মি. মেসুদ। মদ তৈরিতে ইংরেজদের জুড়ি মেলা ভার। উইস্কি, আহ্, সেরা সেরা।’
খোঁচা খেয়ে পাল্টা খোঁচা দিতে দেরি করল না রানা। হালকাভাবে বলল, ‘আমি যতদূর জানি, স্কটরা নিজেদের ইংরেজ বলে মনে করে না।’
এক নিমিষে চেহারাটা টকটকে লাল হয়ে উঠল হবু ব্রিটিশ নাইটের। ‘আপনি একটু বেশিই জানেন, মি. রানা। আপনার পেশা কী, ইতিহাসবিদ?’
‘সিভিল সার্ভেন্ট,’ সরল জবাব রানার।
আবার তাচ্ছিল্যের হাসিটা ফিরে এল রবার্টের মুখে। ‘বেশ, বেশ, সিভিল সার্ভেন্ট। এধরনের লোকদেরই আমার আশপাশে দেখতে বেশি ভাল লাগে। আফটার অল, সত্যিকারের দাসত্ব কী জিনিস, সেটা কিন্তু ইংরেজরাই আপনাদেরকে শিখিয়েছে। যেমন ধরুন, এই সেন্ট মেরি আইল্যাণ্ড আমাদের কলোনি ছিল তিনশো বছর, মি. রডরিকের পূর্বপুরুষরা তো তাদেরই গোলামী করত!’
রানা এবং রডরিক দু’জনেরই মুঠো পাকিয়ে গেল। ঠাট্টাচ্ছলে কথা কাটাকাটি এক জিনিস, কিন্তু রেসিযম একেবারেই মেনে নেয়া যায় না।
চুপচাপ ওদের বাকযুদ্ধ দেখছিল মীরা। ওদের দু’জনের প্রতিক্রিয়া স্বামী খেয়াল না করলেও সে করেছে। চোখ দিয়ে রানার প্রতি অনুনয় করল, যাতে ব্যাপারটা আর না এগোয়। নিজে পরিস্থিতিটা হালকা করার জন্যে বলল, ‘এনি ড্রিঙ্কস, জেন্টলমেন?’
স্বামীপ্রবর এগিয়ে এসে স্ত্রীর কাঁধে হাত রাখল। গম্ভীর স্বরে বলল, ‘আমার কথার মাঝখানে কথা বলার অভ্যাসটা আর গেল না তোমার, হানি!’
তার স্বরের প্রচ্ছন্ন হুমকিতে একটু কি শিউরে উঠল মেয়েটা?
নরম কণ্ঠে বলে উঠল মেয়েটা, ‘দুঃখিত, বব, ভুলে গিয়েছিলাম। আর হবে না এমনটা।’
এবার রডরিক অস্বস্তি কাটিয়ে বলে উঠল, ‘যাই, বোট ছাড়তে হবে এখন। অনেকটা দূর যাওয়া লাগবে।’
‘আরে, দাঁড়াও, দাঁড়াও, আমিও তোমার সঙ্গে ব্রিজে যাচ্ছি। কী যেন নাম তোমার? ও, হ্যাঁ, রডরিক। ভাল নাম, আমার পুরনো চাকরটার কথা মনে পড়ে গেল। আর, মি. মেসুদ, আপনি এবার একটু সিভিল সার্ভেন্টগিরি দেখান দেখি, আমার বউকে ড্রিস তৈরি করতে সাহায্য করুন।
রডরিকের পিছু পিছু বেরিয়ে যাচ্ছিল রবার্ট, হঠাৎ থেমে ঘাড় ঘুরিয়ে রানার দিকে তাকিয়ে হাসল। ‘ভাল কথা, উল্টোপাল্টা ভাবনা মাথায় আনবেন না কিন্তু। মিসেস রবার্ট মিস্টার রবার্টকে অনেক ভালবাসেন! তা-ই না, হানি?’
রানা বিরক্তি নিয়ে কপাল কুঁচকাল আর ভীষণ বিব্রত দেখাল মীরাকে, তবুও স্বামীকে না চটাতে খানিকটা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
লোকটা চলে যেতে লাউঞ্জে ওরা দু’জন একা হয়ে গেল। ঘরের গুমোট পরিবেশটাও স্বস্তিদায়ক হয়ে উঠল।
হাঁফ ছাড়ল রানা। ‘সতেরোশো শতাব্দীর কোন ঐতিহ্য হিসেবে জাদুঘরের শোভা বর্ধন করবে তোমার স্বামী!’
ওর বলার সুরে এমন কিছু ছিল যে, ফিক্ করে হেসে ফেলল মীরা। তার স্বতঃস্ফূর্ত হাসিটা চমৎকার লাগল রানার।
‘নাহ্, মানুষটা অত খারাপ না, রানা। একটু কৌতুকপ্রবণ, তাই খোঁচা দিয়ে কথা বলে। তুমি ওর কথা ধোরো না, প্লিজ।’
‘আমার কথা ভাবছি না,’ ওপরের দিকে ইঙ্গিত করল রানা। ‘ভাবছি, রডরিকের কী হাল করছে সে।’
আবারও মন খুলে হেসে উঠল মীরা। যেন বহুদিন এভাবে হাসার সুযোগ পায়নি।
‘যদি কিছু মনে না করো, কৌতূহল বোধ করছি, এমন মানুষটার সঙ্গে তোমার ভাগ্য জুড়ল কীভাবে?’
‘সে এক লম্বা গল্প। অত সময় তোমার হবে না।’
‘কয়েকটা দিন তো আছি এই বোটে। বলার সুযোগ পেতেও পারো।’
‘যত সুযোগই আসুক, আমার স্বামী অত সময় তোমাকে- আমাকে কিছুতেই দেবে না।
‘তুমি তো দেখি আমার শোনার আগ্রহটা আরও তীব্র করে দিলে! আচ্ছা, আবার নতুন করে পরিচিত হয়ে শুরু করা যাক তা হলে। আমি রানা, বাংলাদেশি। বাবা-মা’র অঢেল সম্পদ, তাই পরিব্রাজকের জীবন। আপাতত দ্বীপ-দ্বীপান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। তুমি?’
ওর বাড়ানো হাতটা ধরল মীরা, স্পর্শটা ভালমত অনুভব করে বেশ সময় নিয়ে হ্যাণ্ডশেক করল। ‘আমি মীরা কোলিন, মা অ্যারাবিয়ান হলেও বাবা ছিলেন ইংরেজ, সেই সূত্রে ব্রিটিশ। মিসেস আর্ভিং হয়েছি দু’বছর হবে। ঘটনাটা স্বপ্নের মত মনে হয়, এখনও মাঝেমধ্যে নিজের শরীরে চিমটি কাটি জানো! ও আমাকে অনেক ভালবাসে, দামি সব উপহার কিনে দেয়। ইংল্যাণ্ডের হাই-সোসাইটিতে ওর খুব নামডাক, সেসব জায়গায় রাজকীয় সম্মান পেতে বেশ ভাল লাগে।’
মেয়েটার উচ্ছ্বসিত কথাবার্তা শুনে রানা মন্তব্য করল, ‘তাই তো হবার কথা, ভদ্রলোক নিজেও সেটা প্রাপ্য বলে মনে করেন, তা-ই না?’ যদিও মনে মনে মিসেসের কথাগুলো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে ওর।
‘ঠিক তা-ই। ওর মধ্যে আসলে একজন রাজা বাস করে। ও বলে, কেউ যদি অনেক চেষ্টা ও পরিশ্রম করে কোন গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালে ওঠে, তবে সে-গাছের সেরা ফলটা ভোগ করার অধিকার তারই। …এই দেখ, আমি কীভাবে কথা বলছি তোমার সঙ্গে, মনে হচ্ছে কত দিনের চেনাজানা!’
মৃদু হাসল রানা। ‘কিছু কিছু মানুষের সম্পর্ক এভাবেই গভীর হয়।’ কথাটা বলে নিজের গালে নিজেই চড় মারল ও, অবশ্য মনে মনে। মীরা কি একটু লজ্জা পেল, নাকি বিব্রত?
কথা বলতে বলতে দু’জনে মিলে উইস্কি আর রাইয়ের গ্লাস-ট্রে ও বোতল তুলে নিল রানা ও মীরা। ওকে ব্রিজে যেতে বলে নিজে স্যুট বদলে হালকা কিছু পরবে বলে বেডরুমে ফিরে গেল মেয়েটা।
ডেকে এসে দেখতে পেল রানা, ধীরে ধীরে সেন্ট মেরির সবুজ সীমানা দূরে সরে যাচ্ছে। এরই মধ্যে খোলা সাগরে বেরিয়ে এসেছে জলকুমারী, স্পিড দশ নট।
‘ওয়েল, মি. মেসুদ, কেমন বুঝছেন?’
পিছন থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত কণ্ঠটা ভেসে আসতে ফিরে তাকাল ও।
‘আমার বউটাকে কোথায় রেখে এলেন? আহ্, এই ড্রিঙ্কসের ট্রে-টা আপনি আবার আনতে গেলেন কেন, ওর ঘাড়ে না ফেলে আসবেন? বউরা তো এসব কাজের জন্যেই, কী বলেন? চলুন, বোটটা ঘুরেফিরে দেখান তো আমাকে, রডরিক এটাকে একা ভালই সামলাচ্ছে দেখলাম।’
বিরক্ত বোধ করছিল রানা লোকটার কথা আর আচরণ দেখে, যেন সে-ই এই বোটের মালিক। ‘মিসেস আর্ভিং পোশাক পাল্টে ওপরে আসবেন। চলুন, আমরা শুরু করি।’
এক ইঞ্চি জায়গাও কোথাও ডিজাইনে নষ্ট হয়নি, প্রয়োজনীয় সবকিছুই ঠিকঠাক আছে। সারা বোট ঘুরে মনে মনে প্রশংসা করলেও সেটা ভাষায় প্রকাশ করল না রবার্ট, ট্যুর শেষে নিজেদের কামরার সামনে এসে একবার টোকা দিয়েই ভেতরে ঢুকে পড়ল। রানা দরজার বাইরেই থাকল, তবে খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পেল মীরাকে ভ্যানিটি ডেস্কের সামনে।
‘কী ব্যাপার, হানি?’ মনে হলো চিবিয়ে চিবিয়ে বলছে রবার্ট, ‘কাপড় পাল্টাতে এত সময় নিচ্ছ? মি. মেসুদের জন্যে বেশি বেশি মেকআপ করছ নাকি?’
দূর থেকে রানার দিকে চোখ পড়তে সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করল মীরা। নিচু গলায় বলল, ‘দুঃখিত, বব। যিপ-টা আটকে গিয়েছিল বলে একটু দেরি হয়ে গেল।’ ওদের দু’জনকে দ্রুত পাশ কাটিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে ওপরের ডেকের দিকে চলল মেয়েটা। রানাও পিছু নেবে, তার আগে বিছানার ওপরে রাখা জিনিসটার ওপরে চোখ পড়ল ওর। ওটা একটা হান্টার, স্টিংরের লেজের তৈরি!
এগিয়ে গিয়ে সামনে থেকে ওটা দেখল রানা। কাঁটাগুলোর ওপর আঙুল বোলাতে গিয়ে শিউরে উঠল একবার। ‘এই নিষিদ্ধ জিনিস কোথায় পেলেন আপনি? গতকালও জীবন্ত একটার পিছনে ছুটেছি আমি।’
শূন্যে হাত নাড়ল রবার্ট। ‘দূর, এটা কোন ব্যাপার হলো? বাহরাইন থেকে কিনেছি। শুনেছি শেখ সাহেবরা বউদের ওপর নিয়মিত নাকি এটা ব্যবহার করে। আমারও মাঝেমধ্যে করতে হয় অবশ্য।’
নির্লজ্জ লোকটার কথা শুনে বিরক্ত হয়ে বলল রানা, ‘জানেন, সেণ্ট মেরিতেও এটা বহন করা দণ্ডনীয় অপরাধ?’
হাসল রবার্ট। ‘টাকাওয়ালাদের জন্যে নয়, মি. মেসুদ। আমার জন্যে তো নয়ই!’
বেশিক্ষণ এই লোকের সামনে থাকা যেমন বিব্রতকর, তেমনি অপমানজনক। তাই ব্রিজে রডরিককে সাহায্য করার কথা বলে দ্রুত ডেকে উঠে এল ও। বোটের কোর্স সেট করে আপনমনে শিস দিচ্ছে রডরিক, হাতে রাইয়ের বোতল। বাকী, রানা, কেমন বুঝলে? বুড়োটা হারামি। সারাক্ষণ লোকজনকে অপমান করে বেড়াচ্ছে, নিজের বউকেও ছাড় দিচ্ছে না। অথচ ভাগ্য কত ভাল, এত সুন্দরী একটা মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেয়ে গেছে।
‘হুম, সুন্দরী এবং দুঃখী,’ মন্তব্য করল রানা।
কৌতূহল জিনিসটা রডরিকের চরিত্রে নেই, তবুও কথার পিঠে জানতে চাইল, ‘কী রকম?’
‘মেয়েটা জালবন্দি হয়ে গেছে। কতগুলো স্বপ্ন ধরতে গিয়ে কখন যে জালে জড়িয়ে পড়েছে, বুঝতে পারেনি। এখন মুক্তির পথ খুঁজছে।’
চোখ ছোট করল রডরিক। ‘খুব কাব্য করে বললে। তা তোমার মাথায় আবার হিরো হবার বাসনা জাগছে নাকি! হা- হা-হা। অবশ্য তুমি তো হিরোদের চেয়েও বেশি কিছু।’
দু’পাশে মাথা নেড়ে রডরিককে আশ্বস্ত করল রানা। ‘না হে, অন্যকিছু ভাবার অবকাশ নেই। আপাতত কাজ আর অ্যাডভেঞ্চার!’
ইঞ্জিনবন্ধ জলকুমারী মৃদু দুলছে ঢেউয়ের দোলায়। লাঞ্চ আওয়ারে সবাই জড় হলো ডাইনিং লাউঞ্জে। দু’পাশের ব্লাইও গুটিয়ে নেয়ায় পুরো কাঁচের জানালা জুড়ে শান্ত সাগরের অপূর্ব দৃশ্য।
সুস্বাদু খাবার আর পানীয় গেলার ফাঁকে বকবক করে চলেছে রবার্ট আর্ভিং। সবই তার ‘সম্পদ, ক্ষমতা আর সাম্রাজ্য’ সম্পর্কিত। ‘জানেন তো, অনেকেই বলে ব্যবসায়ীরা নাকি ভ্রমণের মজা নিতে পারে না। তবে আমি কিন্তু সেণ্ট পার্সেন্ট মজা নিই। পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো আমার শখ, সঙ্গে সবসময় থাকে গাড়ি, নারী, শিল্প, সাহিত্য আর বিজ্ঞান। একটা উদাহরণ দিই। প্যারিসে একবার এক উঠতি মডেল কন্যাকে বেশ মনে ধরল, কিছুতেই আমার ডাকে সাড়া দেবে না। ফ্যাশন হাউসগুলোতে তার চাহিদা তৈরি হচ্ছিল, সুন্দরী প্রতিযোগিতায় জিতে গেলে তাকে আর পায় কে, দাম- দম্ভ দুটোই বেড়ে যাবে। অবশ্য, সে তো জানত না আমি কী। কিছু কলকাঠি নাড়তেই মেয়েটার কন্ট্রাক্টগুলো ক্যান্সেল হওয়া শুরু করল। তারপর খোঁজ নিয়ে যখন জানল আমিই এর পেছনে, তখন দেরি করেনি আমার পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে। এখনও প্যারিসে গেলে সে আমাকে নিরাশ করে না। হা-হা-হা!’
নিজের চরিত্রের দোষ-ত্রুটি তৃপ্তি নিয়ে বর্ণনা করছে রবার্ট। বিতৃষ্ণা নিয়ে শুনতে শুনতে মীরার দিকে তাকাল রানা। চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। স্বামীর এসব কুকীর্তি সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নিশ্চয়ই। গোসল সেরে একটা স্লিভলেস ফ্রক পরেছে সে, মুখে তেমন মেকআপ ছাড়াই কমনীয় দেখাচ্ছে চেহারাটা। বুকের কাছে ভি-কাট জামার প্রান্ত থেকে উঁকি দিচ্ছে রমণীয় কোমলতা। পাকা এক পাপীর সামনে রাখা নিষ্পাপ এক শ্বেত গোলাপ যেন।
রানা মনে মনে বাজি ধরল, স্বামীর নির্দেশেই ফ্রকটা পরেছে মীরা। সাজগোজ করা মেয়েদের একটি স্বাভাবিক সহজাত অভ্যাস। কিন্তু বউকে সাজতে দেয়নি রবার্ট, যাতে সাজটা রানার জন্যে না হয়। আবার লো-কাট ড্রেস পরতে বলেছে, যাতে তার নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য লোভী করে তোলে উপস্থিত পরপুরুষদের। লোকটা যেন বলতে চায়, দেখো, দুনিয়ার ভাল সব ভোগবিলাসের সবই আমার করতলে!
মি. আর্ভিঙের মনস্তত্ত্ব খুব জটিল ধরনের, মনে মনে স্বীকার করল রানা। ওদিকে ব্যাটা তখনও বলে চলেছে, ‘আমার ধন-সম্পদের মোটা একটা অংশ প্রতিবছর সরকারের ট্রেজারিতে চলে যায়, তাই ভাবলাম, ওই বিপুল অর্থ বাঁচানোর জন্যে একটা চ্যারিটি ফাউণ্ডেশন খোলা যাক -শিশুদের, বুড়োদের অথবা বিজ্ঞানের জন্যে। শেষেরটাই বেছে নিলাম, কারণ অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ আছে। যেসব দেশে ঘুরতে যাই, স্থানীয় দুর্লভ স্পেসিমেন সংগ্রহের চেষ্টা করি। দেখুন না, গতকাল মাত্র এসেছি সেন্ট মেরিতে, এরই মধ্যে জোগাড় হয়ে গেছে ব্ল্যাক প্যারট, বিরাট সাইজের কচ্ছপ, লেপার্ড কড়ির বড়সড় মজুদ ইত্যাদি। মি. মেসুদ, একবার আপনাদের বান্দরবানের বৌদ্ধদের এক ধর্মীয় উপাসনার গুহা থেকেও সংগ্রহ করেছিলাম গ্রেটার হিমালয়ান লিফনোজ ব্যাট। এই নতুন প্রজাতির বাদুড়ের অস্তিত্বের বিষয়ে আপনাদের বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর এখনও অজ্ঞ, এব্যাপারে আমি নিশ্চিত।’
‘ব্যাপারটা চুরির মত হয়ে গেল না, মি. রবার্ট? বেআইনি কাজ করে বেড়াচ্ছেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই,’ তির্যক কণ্ঠেই বলে ফেলল রানা।
একটু গম্ভীর হলো রবার্ট। ‘টাকা আর ক্ষমতা যার, আইনও তার। আপনার কি মনে হয়, সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সহায়তা ছাড়া এসব সংগ্রহ করা সম্ভব? সততা এখন একটি প্রাগৈতিহাসিক ভ্যালুজ, মি. মেসুদ!’
এতক্ষণ নিঃশব্দে খাওয়া-দাওয়া উপভোগ করছিল রডরিক। বিদেশিদের বেশিরভাগ আলোচনাই তার সরল জীবনে অর্থহীন বকবকানি ছাড়া আর কিছুই নয়। তবুও নিজের উপস্থিতি জানান দিতেই বোধ হয় প্রশ্নটা করল, ‘এই দুর্লভ স্পেসিমেনগুলো সেন্ট মেরি থেকে কীভাবে জোগালেন? দুর্নীতি জিনিসটা আমাদের এখানে নেই বললেই চলে।’
মুচকি হাসল রবার্ট। ‘আরও সহজে। আপনাদের মেয়র অফিসে আমার ফাউণ্ডেশনের নামে বড় অঙ্কের টাকা ডোনেট করতেই কাজ হয়ে গেল। ওটা দুর্নীতি ছিল না, বলতে পারেন বিনিময়। পিওর বিজনেস!’
লাঞ্চ শেষে একটা গ্লাসে অল্প একটু ভদকা নিল রানা। এরপর জানতে চাইল, ‘এই রেয়ার ফিশের ব্যাপারটা কী? যেটা খুঁজতে আমাদের সাহায্য প্রয়োজন হচ্ছে?’
‘বছর দশেক আগে এক মেরিন বিজ্ঞানী বন্ধু লা অ্যানযো দ্বীপে এই মাছের দেখা পেয়েছিল। তবে ধরার সুযোগ পায়নি। কিন্তু তার দৃঢ় বিশ্বাস, এটা সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতির মাছ। যেটা পশ্চিম ভারত মহাসাগর ছাড়া অন্য কোথাও মিলবে না। বন্ধুটি ওটার নাম দিয়েছে, অ্যাকুয়া মেইডেন। কাকতালীয়ভাবে আপনাদের বোটের নামের সঙ্গে মিলে গেছে।’
‘জলকুমারী, মনে মনে ভাবল রানা। যখন ব্রিজে ছিল তারা দু’জন, নিশ্চয়ই রডরিকের কাছ থেকেই এই নামের ইংরেজিটা জেনে নিয়েছিল রবার্ট।
বড় একটা ঢেঁকুর তুলে চেয়ারে হেলান দিল রবার্ট। ‘ওটা স্কুইরেল প্রজাতির মাছের মতই। গোলাপী-নীল-কমলা বর্ণের মিশ্রণ। ছয় ইঞ্চি সাইজের শরীর। তবে বিপজ্জনক ডরসাল ফিনে রয়েছে কালো স্ট্রাইপ। দারুণ সুন্দর এই মাছটা ধরতে এসেছি দুনিয়ার আরেক প্রান্তে, বিজ্ঞানের সেবায়। অথচ জানেন, ট্যাক্স-অফিসের লোভী কুকুরগুলো আমার ফাউণ্ডেশনটা বন্ধ করে দিতে চাইছে!’
‘ওয়েল, দ্যাটস আ নিউজ!’ মনে মনে বলল রানা। ‘কেউ না কেউ তোমার বেআইনি কাজকর্মে ঠিকই নজর রেখেছে!’ এটা মাথায় আসতেই ওর মনে পড়ল রাহাত খানের সতর্কবাণী: কোনভাবেই নিউজ হওয়ার মত কোন ঘটনায় জড়ানো যাবে না। মেইনটেইন স্ট্রিক্ট লো প্রোফাইল।
ব্যক্তিগত বিতৃষ্ণা একপাশে সরিয়ে রেখে পুরোপুরি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল রানা। কিন্তু ওদের সবাইকে চমকে দিয়ে মুখ ফস্কে বলে উঠল মীরা, ‘লোকগুলো বলছিল, তুমি নাকি বিজ্ঞানের জন্যে কিছু করছ না, নিজের লাভের লোভে…’
মুহূর্তে লাল টকটকে হয়ে উঠল রবার্টের ফর্সা চেহারা। ‘হানি, কতবার বলেছি, মনে নেই, আমার কথার মাঝখানে নাক গলাবে না? বুঝেছি, আজ রাতেই তোমার সঙ্গে ওটার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দিতে হবে!’
ভয়ে চোখমুখ শুকিয়ে গেল মীরার, কাতর কণ্ঠে বলল, ‘না, বব। প্লিজ, না!’
রবার্ট যে স্টিংরের লেজের তৈরি চাবুকের কথা বলছে, এতে কোন সন্দেহ নেই রানার। একেবারে বোবা হয়ে গেল ও। ওদের সামনেই স্ত্রীর জন্যে চরম শাস্তি ঘোষণা করেছে পাষণ্ড স্বামী!
পরদিন।
লা অ্যানযো দ্বীপের কাছাকাছি নোঙর ফেলেছে জলকুমারী। দ্বীপটা আর দুই-দশটা কোরাল দ্বীপের মতই, বড় বেশি নির্জন আর প্রাকৃতিক বলেই কোন জেটি নেই। মৃত কোরালভূমি নিচু ঝোপঝাড়ে ঢাকা, বিশ একরের মত সাদা বালিময় সৈকত, পঞ্চাশ ফুটের মত অগভীর লেগুন। কোন জনমানুষের পা পড়ে না এখানে। ছোট্ট মোটর-র্যাফটে চড়ে মূল দ্বীপে পা রাখল ওরা তিনজন। মীরা আসেনি। রবার্ট বলেছে তার মাথা-ব্যথা। কিন্তু রানা জানে আসল কারণটা, যদিও সেটা ভুলে থাকার চেষ্টা করছে।
ফ্লাইং ফিশগুলো হঠাৎ হঠাৎ লাফিয়ে উঠছে নীল সাগরের বুকে। বাদামি-সাদা আর সবুজ মাছের ঝাঁক দাপাদাপি করছে সারফেসের ঠিক নিচেই। আহ্, আবার চারদিকের কোলাহল পিছনে ফেলে ডুব দিতে যাচ্ছে রানা। রবার্ট আর্ভিঙের কাছ থেকে বেশ কিছুটা সময় দূরে থাকতে পারবে বলে মনে স্বস্তি বোধ করছে ও।
অচেনা আগন্তুকদের আগমন টের পেয়ে জানা-অজানা হরেকরকম পাখি ডানা ঝাপটে উড়াল দিল ঝাঁকে ঝাঁকে। দ্বীপে নামতেই বিষ্ঠার কড়া দুর্গন্ধ নাকে বাড়ি মারল। সৈকতের চকচকে সাদা বালিতে সূর্যের আলো পড়ে চোখে এসে লাগছে ওদের। কোথাও কোন ছায়া নেই। অস্থায়ী তাঁবু তৈরির আগে সানগ্লাসই ভরসা।
তাঁবুটা মোটামুটি ছায়া দেয়ার মত হতেই সেখানে গিয়ে ধপ্ করে বসে পড়ল রবার্ট। সিগার ধরাল। লোকটার সঙ্গে কোন কথায় না গিয়ে রানা ও রডরিক মাস্ক এবং হারপুন নিয়ে বেরিয়ে পড়ল, জানে আগে রিফটা ঘিরে একটা চক্কর কেটে কী করতে হবে ওদের।
পৃথিবীর যে সাগরই হোক না কেন, তার নিচের জগৎটা সত্যিই বিস্ময়কর। সবকিছু অদ্ভুত রঙিন, আলো-আঁধারির বিচিত্র ছোঁয়ায় বাঙ্ময়। নির্দিষ্ট কিছুতে মনোযোগ দেয়া মুশকিল। মুহূর্তে নতুন কিছু মনোযোগ কেড়ে নেয়। ওরা যে চার রঙের বর্ণিল এক মাছ খুঁজছে, মাঝেমধ্যেই সেটা ভুলে যাচ্ছে রানা। রবার্ট ওদেরকে বলে দিয়েছে, ‘মাছটার অবস্থান নিশ্চিত হলে শুধু একটা চিৎকার করে জানাবেন, বাকিটা আমি দেখব। ওটাকে ধরার চমৎকার একটা কৌশল জানা আছে আমার।’
চোখদুটোকে বিশ্রাম দেয়ার জন্যে থামল রানা। পানির সারফেস এত শান্ত, ওর ইচ্ছে হচ্ছে শুধু মুখ ডুবিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে। এসব ভাবতে গিয়ে অমনোযোগী রানা একটা সী-এগ (সী-আর্চিন) ভেঙে ফেলল হারপুনের গুঁতোয়, সঙ্গে সঙ্গে একঝাঁক ছোট মাছ সী-এগের কাঁটাওয়ালা পিঠের ফাঁকে ফাঁকে ছুটে গেল নরম মাংসের আশায়। এগুলোর ভিড়ে অ্যাকুয়া-মেইডেন নেই। ব্যাপারটা অদ্ভুত নয়- মাছটাকে খুঁজে বের করবে ওরা, আর বিখ্যাত হবে রবার্ট আর্ভিং আর তার ফাউণ্ডেশন? ওটার দেখা পেলে আগে তাড়িয়ে দেবে ওরা, তারপর অহঙ্কারী লোকটাকে বলবে: দেখা মেলেনি মাছটার।
আনমনে হাসল রানা। চুক্তি যেহেতু হয়েছে, কাজটা না করে উপায় নেই। কোন ঝামেলায় জড়ানো যাবে না। তবে মীরা কি ঝামেলায় ফেলতে পারে? গত রাতে সন্দেহ নেই রবার্ট তাকে চাবুক-পেটা করেছে। সেই আঘাতে হয়তো জ্বর চলে এসেছে মেয়েটার। নাকি লজ্জায়-অপমানে বের হয়নি আজ? কোন একদিন কি মেয়েটা শোধ নেবে? অত্যাচারিত হবার কোন এক মুহূর্তে হয়তো তার হাতে থাকবে ছুরি কিংবা পিস্তল। কিন্তু সেটা চালাতে পারবে সে মোক্ষম কোন সময়ে? না, এসব হবে না তাকে দিয়ে। মীরা নরম স্বভাবের আর স্বপ্নবিলাসী মেয়ে। রবার্ট দেখেশুনেই তাকে বাছাই করেছে, যাতে সারাজীবন নিজের বিকৃতি, রাগ, অপমানের জ্বালা মেটাতে পারে বউয়ের ওপর। স্বামীর নির্যাতন ক্রীতদাসী বানিয়ে ফেলেছে মীরাকে।
অথচ সে শিক্ষিতা। অন্য সাধারণ মেয়ের তুলনায় পৃথিবীকে ভাল করে বোঝে। পশ্চিমা আদালতে আইনের আশ্রয় নিলে সুবিচার পাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর, সেটা কি তাকে বুঝিয়ে বলবে রানা? সেক্ষেত্রে কী বলবে ও? ‘মীরা, তুমি যদি তোমার স্বামীকে খুন করতে চাও, তো করে ফেলো, আমি তোমার সঙ্গেই আছি?’
পাগল নাকি! স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার, তারাই ভাল বুঝুক। কী দরকার ওর নিজের নাকটা লম্বা করে ঝামেলায় জড়িয়ে যাওয়ার? তবে হ্যাঁ, মেয়েটা সবসময় ভয় আর উদ্বেগের মধ্যে বাস করে, আর এটাই বারবার পীড়া দিচ্ছে রানাকে।
অনেকটা পথ সাঁতার কেটে এসেছে, এবার ওপরে মাথা তুলল রানা। ওর একশো গজ দূরে রডরিক। তার মানে রিফটা ইতিমধ্যে একবার চক্কর দিয়েছে দু’জনেই, কিন্তু বর্ণনার সঙ্গে মেলে এমন কোন স্কুইরেল জাতীয় মাছের দেখা পায়নি। সৈকতে উঠে এসে বালিতে শুয়ে পড়ল ওরা। ওদের দেখতে পেয়ে তাঁবুর বাইরে এল রবার্ট। ‘এলে তোমরা? এদিকে মাছিগুলো আমাকে ভীষণ জ্বালাচ্ছে, ভারি বাজে একটা দ্বীপ। কোন অগ্রগতি হলো?’
জবাব দিল রডরিক, ‘তেমন কিছু দেখলাম না। সবুজ শামুকের বড় একটা কলোনি দেখলাম, সঙ্গে নীলরঙা একটা প্যারট-ফিশ, ত্রিশ পাউণ্ড ওজন তো হবেই। কিন্তু মারলাম না, আশপাশে দুটো লেপার্ড শার্ককে ঘুরোঘুরি করতে দেখলাম তো, তাই। এরপর আরও অগভীর পানিতে নামব আমরা। ঠিকই পেয়ে যাব এবার, যদি ওটা থাকে। তবে তার আগে পেটে কিছু খাবার না দিলেই নয়।’
‘ঠিক আছে, তোমরা খেয়ে নাও, আমি ততক্ষণে একটু লেগুনের তলাটা নেড়েচেড়ে আসি। ওদের থেকে একটা মাস্ক আর হারপুন নিয়ে স্বচ্ছ হাঁটু-পানিতে নেমেই এখানে- ওখানে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখতে লাগল রবার্ট।
তাঁবুর ছায়ায় বসে চিকেন সালাদ আর বিয়ার দিয়ে লাঞ্চ সারছে ওরা, অদূর থেকে লোকটাকে দেখছে খেতে খেতে। রডরিক বলল, ‘ব্যাটা ঠিকই বলেছে। কাঁকড়া আর পাখির বিষ্ঠা ছাড়া এই দ্বীপে আর কিছুই নেই।
হঠাৎ খেয়াল করল রানা, রবার্ট ঘন ঘন হাত নেড়ে ডাকছে ওদেরকে। ‘নিশ্চয়ই বুররাকটা অ্যাকুয়া-মেইডেনকে খুঁজে পেয়েছে, নয়তো কোন গিটার-ফিশকে মাড়িয়ে – দিয়েছে!’ হাতে মাস্কটা নিয়ে ছুটে গেল ও।
রিফের কোমর-পানিতে দাঁড়ানো রবার্টের কাছাকাছি পৌঁছাল রানা। মাস্ক পরে নিয়ে সারফেসের নিচে মাথা নামাল। কোরালের গায়ে সামুদ্রিক ঘাসের বিছানা, ডজনখানেক ছোট মাছ এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা গর্ত থেকে তীক্ষ্ণ দাঁতসহ একটা সবুজ মাথা উঁকি দিল, সোনালি চোখ সাবধানে খেয়াল রাখছে ওর দিকে মোরে ঈল। মজা পেল রানা এটা দেখে যে, ঈলটার দাঁতের সারি থেকে খুব বেশি দূরে নয় রবার্টের লোমশ পাদুটো। হারপুনের চোখা মাথাটা দিয়ে হালকা খোঁচা দিয়ে একটু উৎসাহ দিতে চাইল রানা, কিন্তু ভয় পেয়ে ঘুরেই গর্তে গিয়ে লুকাল মোরে ঈল।
ওটার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি বোলাল রানা। এমন সময় গোলাপী-নীলের একটা ঝলক যেন কুয়াশার চাদর ঠেলে বেরিয়ে এল, এগোচ্ছে ওর দিকেই। গাঢ় নীল চোখে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল ওকে, এমনভাবে ঘুরছে যেন মডেলিং করছে ক্যাটওয়াকে। এবার হুট করে সোৎসাহে ছুটে গেল পাথরের নিচে অ্যালজির একটা আস্তরণ দেখে। তারপর, যেন এইমাত্র পারফর্মেন্স শেষ হলো, দুলতে দুলতে রঙ্গমঞ্চ ত্যাগ করে কুয়াশার আড়ালে আবার ফিরে গেল অ্যাকুয়া মেইডেন!
পানির ওপরে মাথা তুলে মাস্ক সরিয়ে বলল রানা, ‘হুম, এটাই। আমরা বরং শান্তভাবে এখান থেকে সরে পড়ি, ভয় না পেলে এই জায়গা ছেড়ে সহজে যাবে না। রিফের মাছ পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে সাধারণত অন্য কোথাও যায় না।’
রবার্ট আর্ভিংও তার মাস্ক খুলেছে, উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘মাই গড, ওটা আমিই খুঁজে পেয়েছি!’ তবে কোন আলোড়ন না তুলে চুপচাপ রানার পিছু নিয়ে সৈকতে ফিরে এল। রডরিককে সামনে পেয়েই বলতে লাগল, ‘তোমরা এক্সপার্টরা তো সকাল-দুপুর এক করে কিছুই করতে পারলে না, আর আমার ওটাকে খুঁজে পেতে পনেরো মিনিটও লাগেনি! কী দারুণ, কী দারুণ!’
রডরিক তার ক্লায়েন্টের সাফল্যে খুশি। ‘বেশ ভাল হলো তো, মি. রবার্ট। তা হলে এখন মাছটাকে ধরবেন কী উপায়ে?’
হেসে চোখ টিপল রবার্ট। ‘উপায়টা আমার জানা আছে। এক কেমিস্ট বন্ধু দিয়েছিল। ডেরিস নামের লেবুজাতীয় এক উদ্ভিদের মূল থেকে তৈরি কেমিকাল। ওটা ফুলকা আছে শুধু তেমন মাছেরই ক্ষতি করে, দম বন্ধ হয়ে মারা যায় ওরা। মানুষের কোন ক্ষতি নেই এতে।’
তাঁবুতে রাখা বড়সড় একটা ব্যাগ থেকে দুটো একফুটি ক্যান বের করে ওদের দেখাল রবার্ট। হাঁ হয়ে গেল রডরিক। চমকে গিয়ে বলল, ‘এই জিনিস আপনি আনলেন কী করে!’ তক্ষুণি তার মনে পড়ে গেল লাগেজগুলো গেস্ট কেবিনে তোলার সময় একটা বেশ ভারী মনে হয়েছিল। আরও মজুদ আছে নাকি? সর্বনাশ!
‘কিন্তু এই জিনিস তো বেআইনি নয়, সুতরাং ব্যবহারে কোন বাধা নেই,’ জোর দিয়ে বলল রবার্ট।
রানাও জানে, সহজে মাছ ধরার জন্যে আদিকাল থেকেই এই প্রাকৃতিক বিষ ব্যবহার করছে মানুষ। বিষয়টা অনেকটা ফসলের খেতে কীটনাশক দেয়ার মত। পেস্টিসাইড হিসেবে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও মাছ মারার জন্যে নয়। বিশেষ করে গবেষণার্থে নতুন প্রজাতির মাছ সংগ্রহে এটা কার্যকর, জীবন্ত ধরার প্রয়োজন পড়ে না। তা ছাড়া পানিতে বেশি সময় কার্যক্ষম থাকে না বলে ততটা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হয় না। সুতরাং, আইনত রবার্টকে বাধা দেয়ার উপায় নেই। কিন্তু একটা মাছ ধরতে গিয়ে একশোটা মারবে এখন সে।
মানুষ প্রতিদিন লাখে লাখে মাছ মারছে। তাই অহেতুক তর্কে না জড়িয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ওখান থেকে সরে এল রানা। চলল সাইটের দিকে। ডুব দিতেই দেখতে পেল স্কুইরেলটা ফিরে এসেছে। এবার সাহস করে ওর কাছাকাছি সাঁতরে এল, মাস্কের ওপাশ থেকে তাকাল ওর চোখে। এমনভাবে ঘুরে গেল যেন বিরক্ত হয়েছে অতিথির আগমনে। কিছুক্ষণ খেলা করল পাথরগুলোর ফাঁকে ফাঁকে, তারপর হুট করে আবার হারিয়ে গেল কুয়াশার পর্দার আড়ালে। অস্থিরচিত্ত কিশোরীর মতই আচরণ তার!
অকস্মাৎ সাগরের নিচের জগৎটা হয়ে উঠল জীবন্ত। সেই মোরে ঈলটা নিজের বাসা থেকে মাথা বের করল, একটা খুদে অক্টোপাস রঙ পাল্টে নিজের উপস্থিতি জানান দিল, তারপর সন্তর্পণে এগোতে লাগল বালির ওপর দিয়ে। নীল, হলুদ বর্ণের কিছু মাছ পাথরের নিচ থেকে এগিয়ে এল ওর দিকে, দুয়েকটা রানার পায়ের বুড়ো আঙুলে ঠোকর দিতে শুরু করেছে। স্পর্শটা নিঃসন্দেহে আরামদায়ক। তবে ওর তো কাজ আছে, তাই একটা সী-এগ ভেঙে দিল, সঙ্গে সঙ্গে লোভনীয় খাবারের টানে ওদিকে ছুটে গেল মাছের দল।
পানির ওপর মাথা তুলল রানা, ওর ডানদিকে গজ বিশেক দূরে রবার্ট, হাতে কেমিকাল-ক্যান।
‘মাছটা এলে আমি বুড়ো আঙুল তুলব পানির ওপরে, তারপর আপনি ওটা ঢালবেন, তার আগে নয়,’ বলল রানা।
‘বোমার সাইটে আপনিই দাঁড়িয়ে আছেন,’ হাসতে হাসতে বলল রবার্ট, পরিবেশটাকে হালকা করতে চাইছে।
আবার ডুব দিল রানা। তখনি দেখতে পেল কুয়াশা থেকে বেরিয়ে আসছে রঙিন এক অবয়ব। দ্রুত সাঁতার কেটে কাছে চলে এল ওটা, ওকে যেন বলতে চাইছে, ‘আমার জগতে তোমাকে মেনে নিলাম!’
সামান্য নিচে স্থির হয়ে সরাসরি ওর দিকে চেয়ে রইল ওটা। মাস্কের ভেতর থেকেই বিড়বিড় করল রানা, ‘যা ভাগ, বেটি, পালা এখান থেকে!’ বলেই হাতের হারপুনটা দিয়ে গুঁতো মারার ভঙ্গি করল। কুয়াশার আড়ালে ছুটে পালাল অ্যাকুয়া-মেইডেন। মুখ ডুবিয়ে রেখেই বামহাতের বুড়ো আঙুল ওপরে তুলে সিগনাল দিল ও। মাছটাকে পালিয়ে যেতে দেয়া কি উচিত হলো?
কেমিকালে টইটম্বুর ক্যানটা পানিতে কাত করল রবার্ট। গাঢ় বাদামি তেলতেলে জিনিসটা কলের পানির ধারার মত পড়তে লাগল। বাতাস রিফের দিকে বইছে বলে দ্রুত বিষটাও ছড়িয়ে পড়ছে। ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে রানা। ক্যানের শেষ বিন্দুটা পর্যন্ত নিঃশেষ হতে দেখল। মুহূর্তের মধ্যে লেগুনের নীল পানি হয়ে উঠল কাদা রঙের। ওদিকে সৈকতে দাঁড়িয়ে এসব দেখছে আর রাগে ফুঁসছে রডরিক। অসহায় সঙ্গীর দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আবার মাস্ক পরে নিয়ে তলিয়ে গেল রানা।
সারফেসের নিচের পানি এখনও যথেষ্ট স্বচ্ছ। রানা দেখতে পেল, বিষ ঢেলে ছোট্ট শান্ত জগৎটা মুহূর্তেই অশান্ত করে দিয়েছে ওরা। দলবেঁধে ঘুরতে থাকা খুদে মাছগুলো হঠাৎ করেই পাতার মত ভাসতে ভাসতে নেমে গেল মেঝের দিকে। আর নড়ছে না। মোরে ঈলটা গর্ত থেকে মুখ বের করে ‘দম নেয়ার’ চেষ্টা করল, তারপর স্থির হয়ে গেল। মুখটা হাঁ রয়ে গেছে। আরও কিছু মাছের দল উদ্ভ্রান্তের মত দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করল, তারপর কাত হয়ে শুয়ে পড়ল মৃত্যুর কোলে। শিশু অক্টোপাস কোরাল আঁকড়ে ধরে ছটফট করতে করতে মারা গেল। বেশ বড়সড় একটা লাশের স্তূপ তৈরি হলো লেগুনতলে। মনে মনে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল রানা, রডরিককে এই দৃশ্য দেখতে হচ্ছে না। জায়গাটাকে যেন স্রেফ নরক বানিয়ে ফেলেছে একটার পর একটা মর্মান্তিক মৃত্যু। কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত মাছগুলো সারফেসে ভেসে উঠবে
পাশেই কারও উপস্থিতি টের পেয়ে উঠে দাঁড়াল রানা।
রবার্ট ওর কাঁধে টোকা দিয়ে গম্ভীর স্বরে জানতে চাইল, ‘আমার মাছটা কোথায়?’
‘সম্ভবত কেমিকালটা অত নিচে নামার আগেই চলে গিয়েছে। অপেক্ষা করে দেখি, আবারও ফিরতে পারে,’ বলল রানা।
সন্দেহের চোখে ওকে দেখল রবার্ট। ‘নাকি ভাগিয়ে দিয়েছেন আপনি?’
একটু তেতে উঠল রানা। কণ্ঠে ঝাঁঝ এনে বলল, ‘মাইও ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ, মি. রবার্ট! আপনার সৌভাগ্য যে আমরা দু’জন আপনাকে সাহায্য করছি। নিচে তাকিয়ে দেখুন, কী ম্যাসাকার করে বসেছেন।’
হা-হা করে হেসে উঠল রবার্ট। ‘ওটা না পাওয়া পর্যন্ত আরও মারব। লেগুনের সব মাছ মেরে ফেলব দরকার হলে। আপনি একটা সেন্টিমেন্টাল রাবিশ, মি. মেসুদ। ওগুলো শুধুই মাছ, ওদের মৃত্যুতে কিছুই এসে যায় না! আপনার সঙ্গে কোন শত্রুতা নেই আমার। মাছটা ধরে দিন, এই বিষ আর ব্যবহার করব না। ওয়াদা করছি, কৃতজ্ঞ থাকব। না হলে…
অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকাল রানা। কী যেন ভেবে নিয়ে বলল, ‘আপনি অনুগ্রহ করে এখান থেকে চলে যান। তাঁবুতে গিয়ে অপেক্ষা করুন। রডরিক! একটা জার নিয়ে এসো তো।
হতভম্ব দেখাল রবার্টকে। বিড়বিড় করে বলল, ‘মাছ কি উনি খালি হাতে ধরবেন নাকি? এত সহজ!’
এটা আদৌ সহজ নয়। রানার একমাত্র ভরসা ওই ছোট্ট স্কুইরেলটার বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ। ছোট হলেও মাছটার মধ্যে নির্ভীক ও রাজসিক একটা ব্যাপার আছে।
নিচের জগৎটা এখন সুনসান। তবে বিষের রাসায়নিক প্রভাব কমে এসেছে বা নেই-ই হয়তো, পরিবেশটাও নিরাপদ বলেই মনে হচ্ছে। নইলে ওর বন্ধু অ্যাকুয়া মেইডেন মুখোমুখি এসে দাঁড়াত না! জীবন বাঁচিয়ে দিয়েছে বলে কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছে? হঠাৎ গোলাপী একটা আভা পেছনে রেখে আগের মতই দ্রুত সটকে পড়ল স্কুইরেলটা। কয়েক সেকেণ্ড পরেই অবশ্য ফিরে এল। ওর নিচে কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করল, তারপর মুহূর্তেই এগিয়ে এসে ওর পেটে একটা মৃদু ঠোকর দিয়েই সরে গেল। অনুভূতিটা হলো আদর করে চিমটি কাটার মত। ভাগ্যিস লেজের তীক্ষ্ণ কাঁটা দিয়ে গুঁতো দেয়নি!
মোনাজাতের ভঙ্গিতে হাতের তালুজোড়া বেঁধে কিছুটা নিচের দিকে ধরল রানা। ছুটে এসে ওর আঙুলের ডগায় মুখ বোলাল স্কুইরেল, একটু থেমে বুঝে নিল এই বিশাল বন্ধুটাকে বিশ্বাস করা যায় কি না, এরপর হাতের তালুতে উঠে এল। ফাঁদ কি না নিশ্চিত হবার জন্যে দু’তিনবার ছুটে বেরিয়ে গেল সে, তারপর ফিরল আবার, রাজকীয়ভাবে সাঁতার কাটতে লাগল আগে-পিছে পায়চারির ভঙ্গিতে। অনেক খেলা হয়েছে, এবার ফেরা দরকার। ধীরেসুস্থে খেলার স্থানটা ত্যাগ করতে গেল সে…
মনের ভেতরে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে অপেক্ষা করছিল রানা, শেষ মুহূর্তে ঝেড়ে ফেলল সব, হাতের তালুদুটো পরস্পরের সঙ্গে চেপে ধরল। মাঝখানে আটকা পড়ল রঙিন জলচরী। বন্দিনী কোনরকম অস্থিরতা দেখাল না, হয়তো ভাবছে দৈত্যবন্ধুর এটা নতুন কোন খেলা!
তার সারফেসে মাথা তুলল রানা, হাতদুটো তখনও পানির নিচে রেখেছে। দেখতে পেয়ে খানিকটা দূরে দাঁড়ানো রডরিক পানিভর্তি জার হাতে ছুটে এল। ওটার খোলা মুখ দিয়ে মাছটাকে ভেতরে ছেড়ে দিল রানা। ছপ্ করে স্বল্প পানিতে পড়েই ঘুরে গেল স্কুইরেলের মাথা, ওকে খুঁজছে। ডান-বাঁয়ে করে রডরিকের পিছনে আড়াল নিল ও, কিন্তু মাছটাও সঙ্গে সঙ্গে সরে গিয়ে খোঁজার চেষ্টা করে চলেছে। তার চোখে কি আহত দৃষ্টি দেখতে পেল রানা? ভীষণ খারাপ লাগতে শুরু করল ওর। ওই দৃষ্টিটা যেন বলতে চাইছে ওকে, কেন প্রতারণা করলে, বন্ধু!
মাসুদ রানার অনিচ্ছাকৃত প্রবঞ্চনায় বন্দি হলো অ্যাকুয়া- মেইডেন বা জলকুমারী।
জারের ভেতরে মাছটাকে দেখে আনন্দে শিশুর মত কিছুক্ষণ লাফাল রবার্ট। ‘আপনি তো ইতিহাস গড়ে ফেললেন, মেসুদ!’ আনন্দের চোটে ‘মিস্টার’ বাদ পড়ে গেছে খেয়াল করল না সে, বা কেয়ার করল না। সম্ভবত জীবনে প্রথম কারও প্রশংসা করছে মন খুলে।
পারিবারিক বন্ধুর গর্বে বুক আধহাত ফুলে গেল রডরিকের, ধবধবে সাদা সবগুলো দাঁত বেরিয়ে এসেছে সরল হাসিতে। ‘বলেছিলাম না, মি. আর্ভিং, রানা সেন্ট মেরিয়ানদের তুলনায়ও ভাল মাছশিকারি?’
হঠাৎ কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই জারের ভেতরে তরল বিষটা ঢেলে দিল রবার্ট। তার হাত থেকে জারটা ছিনিয়ে নেয়ার জন্যে দ্রুত হাত বাড়াতে চাইল রডরিক, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। সরাসরি এত পরিমাণ পয়জনের আক্রমণে কয়েকবার ছটফট করেই মারা গেল জলকুমারী।
হাউমাউ করে উঠল রডরিক, ‘এটা আপনি কী করলেন? মেরে ফেললেন এত সুন্দর একটা…’ গলা ধরে এল তার।
হাসল রবার্ট। সেই তাচ্ছিল্যের হাসি। ‘গবেষণার জন্যে জীবন্ত মাছ আমার দরকার নেই। এমন ভাব করছ, যেন পরিবারের কেউ খুন হয়েছে। রিল্যাক্স, ইট’স ওনলি আ ফিশ!’
কাঁদো কাঁদো চোখে রানার দিকে তাকাল রডরিক।
চোখমুখ কঠিন দেখাচ্ছে রানার, মেরে বসবে নাকি রবার্টকে?
কিন্তু না, মুহূর্তে শান্ত আর উদাস হয়ে গেল রানা। রবার্টের মত লোককে উপযুক্ত শিক্ষা দেয়া কোন ব্যাপার নয়, কিন্তু ঢাকার নির্দেশ অমান্য করে আপাতত কিছু করার ইচ্ছে ওর নেই। বস্ এবং কলিগরা যথেষ্ট খাটাখাটনি করছে মোসাদের বিরুদ্ধে ওর অবস্থানকে নিরাপদ করার জন্য, ওদের কষ্টটাকে সম্মান করতেই হবে। আবার একদিক দিয়ে ভালই হলো, জলকুমারীর আহত দৃষ্টিটা আর ওকে সহ্য করতে হবে না।
বোটে ফিরে এসে সন্ধ্যা পর্যন্ত কেবিনেই কাটাল রানা। ঘণ্টা তিনেকের জন্যে ব্রিজ সামলাচ্ছে রডরিক, জলকুমারীকে চালিয়ে মনটা ব্যস্ত থাকুক তার। রাতের ডিউটি করবে রানা। ইতিমধ্যে রওনা দিয়েছে বোট সেন্ট মেরির উদ্দেশে।
ডিনার টেবিলে সবাইকেই পেল রানা। মীরাকে চব্বিশ ঘণ্টা পর দেখল ও, কাঁটা চামচ চালাচ্ছে খাবারে। কালো এক ইভনিং গাউন পরে আছে, বুকের কাছে ওটা চেপে থাকায় অনেকটাই দৃশ্যমান তার রমণীয় সৌন্দর্য। তিক্তমনে ভাবল ও, আবার সেই রবার্টীয় ইগো। উপস্থিত পুরুষদের দেখিয়ে বলা: দেখো, লোভী হও, কিন্তু হাত বাড়াবে না। এটা আমার সম্পত্তি!’
যদিও রানাকে দেখেই মুখ উজ্জ্বল হলো রবার্টের। ‘আসুন, হিরো, আজকের ডিনার কিন্তু আপনারই সম্মানে!’
কিছু না বলে চেয়ারে বসল রানা। উচ্ছল রবার্ট বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী একটা দিন গেল আজ! তুমি যদি দেখতে, হানি! মেসুদের হিরোইক এফোর্ট ছিল দুর্দান্ত। কেনিয়ায় না গিয়ে ভালই হয়েছে। এখানে এসেই বরং আমার মিশন সফল। ট্যাক্স-অফিসও আর ঝামেলা করবে না। নাইটহুডই বা ঠেকায় কে? এই হতচ্ছাড়া দ্বীপদেশ ছেড়ে দু’দিনের মধ্যেই সভ্য জগতে ফিরে যাব, কী বলো, হানি? প্যারিস কেমন হবে?’
খেপে যাবে স্বামী, তাই সংক্ষেপে সাড়া দিল মীরা, ‘হ্যাঁ, প্যারিসই ভাল।
ম্যাকারেল ফিশ, ক্যাভিয়ার আর শ্যাম্পেন ডিনারের মেনু। এই মাঝসাগরে ব্যাটা ক্যাভিয়ারও জোগাড় করে ফেলেছে। নিশ্চয়ই ব্যাগে করে নিয়ে এসেছে
‘মেসুদ, শ্যাম্পেন চলবে তো? পিঙ্ক শ্যাম্পেন, অনেক দামি কিন্তু! যাই হোক, ঠিক করেছি, প্যারিসে পৌঁছেই একটা সংবাদ সম্মেলন ডাকব আমি, যাতে ভাল একটা কাভারেজ পাই বিশ্বমিডিয়ায়। বলা যায় না, এত বছর পর খুঁজে পাওয়া দুর্লভ অ্যাকুয়া-মেইডেনের নাম আমার নামেও রাখা হতে পারে! আমার বিরুদ্ধে লাগা ট্যাক্স-অফিসের লোভী লোকগুলোর মুখে শোকের ছায়া নেমে আসবে, কী বলো, হানি?’
বাধ্য স্ত্রীর মত সাড়া দিল মীরা। ‘অবশ্যই, বব।’
রডরিক আজ আগের চেয়েও চুপচাপ। জলকুমারীর ইঞ্জিন বন্ধ করে এসে ডিনারে যোগ দিয়েছে। ডিনারের পর ইচ্ছেমত উইস্কি খেল, যেন মাতাল হতে চায়। গোল, শক্ত মাথাটা কাঁধের ওপর এপাশ-ওপাশ দুলছে। রবার্টও প্রবল ৬ৎসাহে বারবার রডরিকের গ্লাসটা ভরে দিচ্ছে, যেন এটাই তার কৃতজ্ঞতা জানানোর তরিকা। ব্যাপারটা সন্দেহজনক লাগলেও কিছু বলল না রানা। ওকে চুপচাপ দেখেই বোধহয় লোকটা ফিরে এল তার চিরাচরিত স্বভাবে। এতক্ষণ রানার প্রশংসাই করছিল, এবার আক্রমণের শিকার হিসেবে ধরে নিল।
‘বাঙালিরা, বুঝলেন, নিকৃষ্ট একটা জাতি। অলস, স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক। আমরা, ইংরেজরা তিনশো বছরেও ওদের সভ্য করে তুলতে পারিনি। চেষ্টা করিনি, তা নয়। কিন্তু আন্দোলন-ফান্দোলন করে তিতিবিরক্ত করে ফেলেছিল, শেষে বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে ত্যাগ করলাম ওদের, ছাড়লাম ভারতবর্ষ। কী পেলি তোরা শেষে টুকরো টুকরো জমি ছাড়া? এতবছরেও নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারলি না। অথচ আমাদের বশ্য হয়ে থাকলে এতদিনে উন্নতির সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যেতি। এই জন্যেই তৃতীয় বিশ্বের লোকজন এখনও নির্বোধই রয়ে গেল! কী বলেন, মেসুদ, ঠিক বলিনি?’
রানা জানে, ওর বেশিরভাগ আধুনিক ইংরেজ বন্ধুরা রবার্টের থেকে ভিন্নমত পোষণ করে। তবুও জবাব দেবার খাতিরেই বলল, ‘ইংরেজদের সেই কলোনিয়াল শক্তি কিন্তু এখন আর নেই। বর্তমান বিশ্বে মহাশক্তি মূলত তিনটি: আমেরিকা, রাশা আর চিন। ইংল্যাণ্ড আশপাশেও নেই। আপনার কথা শুনে আমার এক বন্ধুর একটা মজার মন্তব্য মনে পড়ে গেল।’
চোখ গরম করে ওর দিকে তাকাল রবার্ট। ‘কী সেটা, বলুন তো দেখি।’
মুচকি হাসল রানা। ‘সে আমাকে বলেছিল- সব নয়, কিছু ইংরেজ আছে যারা ঔপনিবেশিক আমলের ক্ষমতার দম্ভ ভুলতে পারে না। এরা আসলে অতীতচারী, পুরনো স্মৃতি আঁকড়ে ধরে থেকে মানসিক রোগী হয়ে গেছে।’
ওর খোঁচা মারা কথা শুনে লাল টকটকে হয়ে উঠল রবার্টের সাদা মুখ। সশব্দ হাসি শুনে ‘কেলে ভূত’ রডরিকের দিকে কটমট করে তাকাল। তারপর স্ত্রীর দিকে ফিরে বলল, ‘তুমি মনে হয় মেসুদের সঙ্গে একমত, তা-ই না, হানি? একবার তুমিও কী যেন বলেছিলে ইংরেজদের স্বভাব-চরিত্র নিয়ে?’
ত্রস্তা হরিণীর মত দেখাল মীরাকে, আবারও তার দিকেই তীর ছুঁড়ছে স্বামী। তাড়াতাড়ি করে বলে উঠল, ‘নাহ্, বব, আমি সেরকম কিছুই মিন করিনি, পত্রিকার কমিকস পাতা নিয়ে সামান্য একটা মন্তব্য ছিল ওটা। তা ছাড়া, আমার মনে হয় মি. রানাও সিরিয়াসলি বলেননি কথাটা।
উইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে রানা বলল, ‘সম্ভবত তা-ই। মি. রবার্ট যেমনটি বাঙালিদের নিয়ে বললেন, আমিও সেরকমই বলেছি।
খুকখুক করে একটু কেশে নিল রবার্ট, তারপর লাল দৃষ্টিবাণ ছুঁড়ে বলল, ‘সম্ভবত তা-ই হবে। তবে আমি মনে রাখব কথাটা, ভালভাবেই।’
উইস্কির বোতলটা প্রায় খালি, অবশিষ্টটুকু গ্লাসে নিয়ে গলায় ঢালল সে, তারপর তাকাল রডরিকের দিকে, জড়ানো কণ্ঠে বলে উঠল, ‘প্রথম যখন সেন্ট মেরিকে ম্যাপে দেখলাম মনে হয়েছিল পাখির একফোঁটা বিষ্ঠা, হাতের উল্টোপিঠ। ঘষাও দিয়েছিলাম মুছে ফেলার জন্যে। কিন্তু দেখো ভাগ এখানেই আমাকে আসতে হলো। ধুর; এরকম জায়গায় কে৬ সারাজীবন থাকে? তুমি নিশ্চয়ই গেঁয়ো না, কালোরা তো এখন পশ্চিমা দেশগুলোতে ভালই করছে! তুমিও চলে যাও, মাছ ধরা আর ট্যুরিস্ট চরানো কোন ভদ্র পেশা হলো? অবশ্য পশ্চিমে গিয়ে এরকম গণ্ডায় গণ্ডায় বাচ্চা পয়দা করতে পারবে না। শুনেছি, তোমাদের এখানে নাকি একজনই শত শিশুর জন্ম দেয়, যাতে এই যুগেও দাস ব্যবসার মত ফ্যামিলিকে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কথা কি সত্যি নাকি, রডরিক?’
যথেষ্ট শুনেছে। রাগে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। টলতে টলতে ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে গেল রডরিক। তার অবস্থা বেগতিক দেখে রানাও উঠে পড়ল, পৌঁছে দেবে তাকে কেবিনে। রাতে জলকুমারীকে ও একাই স্টিয়ারিং করবে। ভুসভুস করে উইস্কির গন্ধ ছড়িয়ে রডরিক বলল, ‘রানা, তুমি না থাকলে আজ ব্যাটাকে আমি খুন করতাম! এখন বুঝতে পারছি আমার বাবা কেন তোমাকে এত ভালবাসত। তোমার সঙ্গ বন্ধুদের ভেতরের ভাল মানুষটাকে জাগিয়ে তোলে। আই লাভ ইউ, টু, ম্যান! আই লাভ ইউ, টু…
রডরিককে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ব্রিজে কন্ট্রোল রুমে চলে এল রানা। বোটের সম্ভবত একমাত্র জাগ্রত প্রাণী ও। স্বামী- স্ত্রী দু’জনও তাদের কেবিনে চলে গিয়েছে। অত্যাধুনিক কনসোলের রিডিংগুলো চেক করল রানা। না, কোথাও কোন সমস্যা নেই। জলকুমারী মসৃণভাবে চলছে। বিশাল সাগরে বোটটা ছোট্ট একটা ডট, মস্ত আকাশ যেন তার ওপরে ঝুঁকে এসেছে প্রচণ্ড কৌতূহল নিয়ে।
ঝট করে পেছনদিকে চাইল রানা। একটা শব্দ শুনেছে। একটা মূর্তি ঢুকল কন্ট্রোল রুমে। মেয়েটার পরনে নাইট গাউন। হাতদুটো বুকের কাছে বাধা, যেন শীত কাটাতে চাইছে।
ত’বাব্বা, বাইরে কী ঠাণ্ডা। কিন্তু কী করব বলো, ঘুম আসছিল না। এসির বাতাসও সহ্য হচ্ছিল না। তাই ভাবলাম তোমাকে সঙ্গ দিই। ভুল করেছি, রানা?
মীরার কণ্ঠে কি খানিকটা মাদকতা? নাকি বাইরের ঠাণ্ডা বাতাস লেগে ভারী হয়ে গেছে স্বর? সতর্ক হবার প্রয়োজন অনুভব করল রানা। ‘কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ফিরে যাও, নইলে তোমার স্বামী খেপে যাবে না-দেখতে পেয়ে।’
ওর কাছ ঘেঁষে এসে দাঁড়াল মীরা, যতটা কাছে এলে মৃদু কাঁপতে থাকা একজন নারীকে জড়িয়ে ধরে উষ্ণতা দেয়া যায়। সংযম, রানা, সংযম। নিজেকে আচ্ছামত শাসাল ও।
‘তুমি না আমার গল্প শুনতে চেয়েছিলে, রানা?’ মীরার কণ্ঠে ব্যাকুলতা। ‘এখন মনে হচ্ছে, তোমাকে বলতে পারলে খুব ভাল লাগবে আমার। বুকের ভেতরটা হালকা হবে।’
‘আগে বুঝিনি কীসের মধ্যে আছ তুমি। মন হালকা করতে চাইলে বলতে পারো। দাঁড়াও, তার আগে দু’কাপ কফি তৈরি করে নিই।’
নিজেই কফিটা বানাবে বলে ঘনিষ্ঠ দূরত্ব থেকে সরে গেল মীরা। স্বস্তির নিঃশ্বাসটা গোপনে ছাড়ল রানা।
কফি নিয়ে এসেই কথা বলতে শুরু করল মেয়েটা। জানাল, ব্রিটিশ এম্বেসিতে চাকরি করত তার বাবা। সেখানে এক পার্টিতে রবার্টের সঙ্গে পরিচয়। ছোটবেলায় মাকে হারানোয় বাবার সান্নিধ্যেই সময়টা কেটেছে বেশি। তাই নিজের অজান্তেই মাঝবয়সী পুরুষদের প্রতি আবেগ জন্মাত তার। রবার্টের সঙ্গে পরিচয় দ্রুতই পরিণয়ে রূপ নেয়। সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়ে আনন্দ আর জৌলুসের মধ্যে ভালই কাটছিল জীবন। কিন্তু যত দিন যাচ্ছিল, স্ত্রী হিসেবে স্বামীর গোপন বিষয়গুলো ততই জেনে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে প্রতিবাদও করত, বিশেষ করে অন্য নারীঘটিত বিষয়ে। ডিভোর্সের ভয়ও দেখিয়েছিল। কিন্তু যখন একটা মেয়ে হলো তাদের, বাঁধা পড়ে গেল সে। মেয়েকে সুইস এক বোর্ডিং হাউসে রেখেছে রবার্ট, বলে দিয়েছে সাফ সাফ: মেয়ের ভাল চাহলে যেন কখনও তাকে ছেড়ে যাবার চিন্তাও না করে।
চোখ তুলে সরাসরি রানার দিকে তাকাল মীরা। গভীর কালো মণির চারপাশের সাদা অংশটা আকাশজোড়া নক্ষত্রের আলোয় চিকচিক করছে, দৃষ্টি ভেজা। লিপস্টিকবিহীন ঠোঁট সামান্য ফাঁক হয়ে আছে আমন্ত্রণের ভঙ্গিতে। ধক করে উঠল মাসুদ রানার বুকটা, কণ্ঠতালু শুকিয়ে কাঠ। ইন্দ্রিয়গুলো সাড়া দিতে চাইছে!
গাউনের ওপরের আলগা অংশটা খুলে সিটের ওপরে রাখল মীরা। বামহাতে ডান কাঁধের স্ট্র্যাপটা হালকাভাবে টেনে নামাল। একইভাবে অপর কাঁধেরটাও সরিয়ে জামাটা ঝপাৎ করে মেঝেতে পড়ে যেতে দিল। তারপর রানার দিকে পিঠ দিয়ে ঘুরে গেল। তার পিঠ-নিতম্ব জুড়ে নির্যাতনের অসংখ্য কাটাকুটি চিহ্ন। কতগুলো আঘাত একেবারে তাজা, গত রাতের।
আধ খাওয়া কফির কাপটা কনসোলের পাশে রেখে মেঝে থেকে গাউনটা তুলে মীরার খোলা পিঠটা নিচ পর্যন্ত ঢেকে দিল রানা, মৃদুস্বরে বলল, ‘পরে নাও। সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখো।’
প্রস্তুত ছিল না ও, শরীরটা ঘুরিয়েই ওর বাহুবন্ধনে নিজেকে সেঁধিয়ে দিল মেয়েটা, আঁকড়ে ধরল ওর চওড়া পিঠ। তৃষ্ণার্ত ঠোঁট দিয়ে খুঁজে নিতে চাইল পৌরুষদীপ্ত ঠোঁট।
কিন্তু নিজেকে সামলে নিল মাসুদ রানা। মেয়েটার দুঃখভরা কাহিনী শুনতে শুনতে খুব মায়া হচ্ছিল মীরা আর তার মেয়ের জন্যে। সেই মায়ার প্রতি সম্মান দেখিয়েই পিছিয়ে এল ও।
‘শোনো: ‘মেঘ ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়’। সেই আদিকাল থেকে পথ হারানো মানুষকে পথের সন্ধান দিচ্ছে ওই আকাশ। দুঃখ যত বড়ই হোক, দৃষ্টি মেলে মন খুলে আকাশ, নক্ষত্র দেখবে, মন শান্ত হয়ে যাবে তখন। সেই অনন্তের সামনে আমরা অতি তুচ্ছ।’
প্রত্যাখ্যান নয়, রানার চোখে তার প্রতি সম্মান দেখে অভিভূত হলো মীরা। দ্রুত হাতে নিজেকে গুছিয়ে নিল। অনেকটা ফিসফিস করে বলল, ‘ধন্যবাদ, রানা। বাঁচালে আমায়।’
হালকা করে মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘এবার ঘুমোতে যাও।’
ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল মীরা। ‘কিছুক্ষণ যদি এখানে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখি, কিছু মনে করবে তুমি?’
‘না’ বলার মত কোন কারণ খুঁজে পেল না রানা। হেম্-এর আরামদায়ক সিটে বসে পাশের সিটে মীরাকে বসার ইঙ্গিত করল ও। এগিয়ে এসে বসল সে। একটা সুইচ চেপে দিতেই তার সিটের ব্যাকরেস্ট বেশ খানিকটা পেছনদিকে হেলে পড়ল। আরেকটা সুইচ চাপতে মাথার ওপরে সিলিঙের অংশটা স্লাইড করে সরে গেল। এবার রানা নিজের সিটের ব্যাকরেস্টও একইভাবে শুইয়ে নিল। এখন কাঁচের সিলিঙের এপাশ থেকে দৃষ্টিজুড়ে শুধুই বিশাল বিস্তৃত তারাজ্বলা আকাশ। অনন্ত নক্ষত্রবীথি। অপার বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল মীরা, অস্ফুটে বলে উঠল, ‘এমেইযিং, আনবিলিভেবল!’
অতিথিদের এধরনের মুগ্ধতা রানার জন্যে নতুন কিছু নয়। চুপচাপ উপভোগ করছে মেয়েটার চোখের মোহাবিষ্ট দৃষ্টিটা।
‘কী বিশাল লাগছে আকাশটাকে! জানো, ছোটবেলায় আকাশটাকে মনে হত বিরাট এক কালো চাদর আর তারাগুলোকে মনে হত সেই চাদরের ফুটো দিয়ে আসা আলো,’ বলেই হেসে ফেলল মীরা। ‘অদ্ভুত সব চিন্তা ঘুরত আমাদের ছোট্ট মাথায়!’
রানাও পাল্টা হাসল। ‘ঠিক বলেছ। বড় হলে ছোটবেলার মজা নীরস হয়ে যায়।’
‘তুমি আমাকে আজ এক অনন্য সৌন্দর্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলে, আমি বোধহয় তোমার প্রেমেই পড়ে গেছি, রানা। তবে দুর্ভাগ্যটা আমারই…’
কিন্তু রানা মোটেও প্রেম অনুভব করছে না। চোখজোড়া অনেক কষ্টে মেলেও রাখতে পারছে না, জন্মের ঘুম চলে আসছে যেন। কালো একটা পর্দা নেমে আসছে দৃষ্টির সামনে। কিছু কি ছিল কফিতে?
গভীর ঘুমে লুটিয়ে পড়ার আগে একটাই শব্দ রানার মাথায় ঘুরছিল: মোসাদ!
ভোরের আলো ফুটি ফুটি করছে। অসীম ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছে সে, জানে তার সামনে ঘুমন্ত হারামি বিদেশি এজেন্টটা কিছুক্ষণের মধ্যেই জাগবে, সেই ইঞ্জেকশনটা দিয়েছে খানিক আগেই।
একটু কি নড়ে উঠল লোকটা? সতর্ক হবার প্রয়োজন বোধ করল না সে, কারণ জেগে উঠলেও একটা আঙুলও নাড়াতে পারবে না মাসুদ রানা।
ঘুম ভেঙে প্রত্যাশিত বাঁধনটা দেখে অবাক হলো না রানা, আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে রেখেছে ওকে সিটের সঙ্গে। একটু ঝাঁকিয়ে মাথাটা পরিষ্কার করার চেষ্টা চালাল, শুধু মাথাটাই নড়ল। পুরো শরীর গেঁথে আছে সিটের মধ্যে। বেশি নাড়াচাড়া করলে বাঁধন আরও এঁটে যাবে, তাই স্থির থাকার চেষ্টা করল ও। মোসাদ এজেন্ট মীরা কোলিন সামনেই বসে আছে, হাতে শোভা পাচ্ছে গ্লক জি-থার্টিথ্রি মডেলের এক পিস্তল। সেই নিষ্পাপ সারল্য উবে গেছে মুখ থেকে, এখন সেখানে নিষ্ঠুর এক চিলতে লেডি ভিলেনমার্কা হাসি। পিঠ পর্যন্ত চুলগুলো এখন পনিটেইল। গাউনের ওপরে একটা লেদার জ্যাকেট, ফলে পিস্তল হাতে দারুণ মানিয়ে গেছে। রানা কৌতুক করে ভাবল, আচ্ছা, সিনেমার ভিলেনগুলো শেষ দৃশ্যে এজন্যই বোধহয় লেদারের জ্যাকেট পরে, যাতে ‘কূল’ একটা ভাব আসে!
‘ওয়েল, ওয়েল, দ্য গ্রেট মাসুদ রানা। বিসিআই এজেন্ট। ঘুম ভাঙল তা হলে?’ বিদ্রূপের হাসি মীরার কণ্ঠে।
যতটা সম্ভব চারপাশে চোখ ঘোরানোর চেষ্টা করল রানা। মন খারাপ হলো ওর স্মার্ট ওয়াচটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে দেখে। এখন সেটা মেঝেতে পড়ে আছে। বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে লুকোনো দুটো ক্যামেরাই নষ্ট করে ফেলেছে মীরা। চালু মেয়ে!
সরাসরি তার চোখে চেয়ে মুখ খুলল রানা, ‘এবার আমাকে চরম অপমানজনক মৃত্যু দেয়ার জন্যে কী প্লট সাজালে তোমরা, বলো তো? দাঁড়াও, দাঁড়াও, আমিই খানিকটা বলি। লোভ, ঘৃণা আর প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে রবার্ট আর্ভিংকে খুন করেছি আমি, আর স্বামীকে বাঁচাতে আর আত্মরক্ষার্থে আমাকে ও রডরিককে খুন করেছ তুমি। তারপর এটাই ফলাও করে ওঅর্ল্ড মিডিয়ায় মুখরোচক স্ক্যাণ্ডাল হিসেবে প্রচার হবে। স্ত্রী ও নিজের সম্মান বাঁচাতে বিজ্ঞানসেবক, প্রকৃতিপ্রেমিক একজন ব্রিটিশ ব্যবসায়ীর করুণ মৃত্যুবরণ। কী, ঠিক বলেছি?’
হি-হি করে খুব একচোট হেসে নিল মীরা। ‘তোমার হিউমার স্পট-অন! ঘটনা অনেকটা সেরকমই। তবে রডরিক জীবিত থাকবে, একজন সাক্ষী লাগবে না বুঝি? সে এখনও মড়ার মত ঘুমাচ্ছে, জেগে উঠে দেখবে মিসেস আর্ভিং স্বামীর মৃত্যুশোকে হাউমাউ করে কাঁদছে আর প্রিয় বন্ধু মাসুদ রানা ক্ষণিকের রোষে মিস্টার রবার্টকে খুন করে নিজেই খুন হয়ে গেছে। অনেকটা সেরকম সম্পর্কই তো ছিল তোমার ববের সঙ্গে।’
‘মানছি, তোমার অভিনয় দক্ষতা গ্যাল গ্যাদতকেও হার মানায়। সিনেমায় নামলে পারতে!’ প্রশংসা ঝরল রানার কণ্ঠে। ‘কিন্তু ফরেনসিক রিপোর্টে রবার্ট আর আমার মৃত্যুর মাঝখানে সময়ের ব্যবধান দেখা দেবে, সেটা ব্যালেন্স করবে কীভাবে? ধরেই নিচ্ছি, আমার এখানে আসার আগেই তুমি রবার্টকে খুন করে এসেছ। কীভাবে মারলে?’
প্রথমে তর্জনী, তারপর মধ্যমা আঙুল দেখাল মীরা, মুখে বলল, ‘একটা একটা করে, রানা। একটা একটা করে। দুর্ভাগ্যজনক তবে বলতেই হচ্ছে, তোমার মৃতদেহটা পাওয়া যাবে না। কোথায় কোন্ শার্কের পেটে খুঁজবে তোমায় লোকে? কিন্তু তোমার রক্তের দাগ থাকবে বোটে, কী যেন, ওহ্, হ্যাঁ, জলকুমারীর সারা অঙ্গে।’ হি-হি-হি। ‘কর্তৃপক্ষের মনে হবে, গুলি খেয়ে আহত হয়ে নিচের ডেকে পালাতে গিয়ে রেলিঙের সরু পথটা দিয়ে তাড়াহুড়ো করে যাওয়ার সময় পড়ে গিয়েছ সাগরে। কী চমৎকার, না? আর ববের মৃত্যু? এত নিষ্ঠুরভাবে ওকে মেরেছ তুমি, ছয় ইঞ্চির অ্যাকুয়া-মেইডেনকে ঘুমন্ত মি. রবার্টের হাঁ করা মুখে ঠেসে দিয়েছ। লেজের শক্ত কাঁটাটা বেচারার দু’গাল এফোঁড়- ওফোঁড় করে দিয়েছে। মাছটার মতই দম আটকে মারা গিয়েছে আমার স্বামী। এটাই তো চেয়েছিলে তুমি, রানা!’
তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে রইল মাসুদ রানা ধুরন্ধর মোসাদ এজেন্টের দিকে। গলায় বিস্ময় নিয়েই বলল, ‘আমি জানি, জায়োনিস্টরা খুব মেধাবী হয়। কিন্তু আমাকে খুন করার পেছনে তোমরা যে পরিমাণ ব্রেইন খাটাচ্ছ, তার সিকিভাগও যদি বিশ্বশান্তির পেছনে ব্যয় করতে, মধ্যপ্রাচ্যের চেহারাটাই পাল্টে যেত।’
এবার মীরাকে রাগতে দেখল ও। ‘শাটআপ, ইউ বাস্টার্ড! আমার দেশটাকে অনেক ভুগিয়েছ তুমি। এটুকু শাস্তিও তোমার জন্যে খুব কমই হয়ে যাচ্ছে।’
‘আচ্ছা, আমাকে মেরে ফেলার আগে একটা কৌতূহল তো মেটাতে পারো, নাকি?’ জানে বেশি সময় নেই, তবুও যতটুকু পারে সময় আদায় করে নিতে চাইছে রানা। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ-এটা রানার মটো! ‘তোমার অভিনয় দক্ষতা দিয়ে আমাকে তো কাবুই করে ফেলেছ, কিন্তু রবার্টের সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা? সেটাও কি অভিনয়? আর তোমার মেয়ে?’
ঘৃণায় জ্বলে উঠতে দেখল ও মীরার চোখজোড়া। ‘লোকটা একটা নপুংসক। তেলআবিব যখন বলল এর সঙ্গেই সংসার বেঁধে মোসাদের জন্যে ডিপ কাভার স্পাইং করে যেতে হবে, সেটা না মেনে উপায় ছিল না দেশের স্বার্থে। ববের মাধ্যমে এতসব হাই-প্রোফাইল লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হত, সবাই এক একটা ইনফর্মেশনের খনি। বব নিজেই তার অক্ষমতা ঢাকার জন্যে পরকীয়ার গল্প বানাত আর আমাকে পেটাত। মুখ বুজে থাকতে থাকতে একসময় মার খাওয়াটা উপভোগ করতে শুরু করি। যতই আতঙ্কিত হবার ভান করতাম, সে ততই উত্তেজিত হত। সবসময় তার ক্রীতদাসীর মত থাকার অভিনয় করেছি, এতে অন্যদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা কখনও টের পায়নি সে। আমার মিশনগুলোও সফল হচ্ছে একের পর এক। ইদানীং অবশ্য একঘেয়ে লাগছিল কিছু, বড়কর্তাদের অনুরোধ করেছিলাম তেলআবিবে ডেকে নিতে। সে সূত্রেই এবার মোসাদ জানাল, সুযোগ এপেছে, সব খতম করে দাও!’
একটু থেমে দম নিল মীরা। রানাকে বোকা বানাতে পেরে তৃপ্তিতে সারামুখে ছড়িয়ে গেছে হাসিটা। আবারও বলতে শুরু করল, ‘আর আমার মেয়ের ব্যাপারটা? সরি, রানা। ওটা ক্রিস্টোফার নোলানের ‘টেনেট’ মুভির প্লট থেকে কপি করেছি।’ হি-হি-হি। ‘ভেবেছি এতবড় স্পাই তুমি, তোমার সঙ্গে শুয়ে আমার রেকর্ডটা আরেকটু সমৃদ্ধ করি। ওসব বললে তোমার হয়তো মন গলবে। কিন্তু নাহ্, মানতেই হবে, তুমি একটা কঠিন বান্দা।’
এক গাল হাসল রানা। ‘তোমার প্রশংসা শুনে ভাল লাগছে, মীরা। এই ভূমিকায় তোমাকে আমারও ভাল লাগছে না, ইউ আর বেটার দ্যান দিস! তাই বলি, এসো, শত্রুতা ভুলে সব মিটমাট করে নিই। তুমি তোমার পথে চলে যাও, আমি আমার পথে। তোমার প্রতি আমার কোন বিরাগ নেই।’
‘আবারও সরি, রানা। কিন্তু আমার রয়ে গেছে রাগ। কয়েকমাস আগেই তুমি আমার এক কলিগকে বন্দি করেছ, যার বেঁচে থাকার কারণে ইসরাইলের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। তা ছাড়া, তোমার মিষ্টি মিষ্টি কথার ফাঁদে পা দিলে বিশ্বাসঘাতকের ভয়ঙ্কর মৃত্যু দেবে আমাকে মোসাদ। তার চেয়ে,’ সিটের ওপরে সোজা হয়ে বসল মীরা, গ্লকের চেম্বারে একটা বুলেট ভরে অফ করল সেফটি, ‘এমুহূর্তেই মরণ হোক তোমার। বিদায়, রানা!
নিঃশব্দ ভোরে গুলির বিকট শব্দে কেঁপে উঠল যেন বিশ্বচরাচর। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে টার্গেট প্র্যাকটিস করলে তরমুজ যেভাবে বিস্ফোরিত হয়, সেভাবেই বিস্ফোরিত হলো মাথাটা। অবাক ব্যাপার, ঘাড়টার ওপরে মাথার দুই- তৃতীয়াংশ তখনও রয়ে গেছে, উড়ে গেছে খুলির একটা পাশ। ছিটকে গেছে মগজ দিগ্বিদিক, মাসুদ রানার গায়েই পড়ল বেশ কিছুটা।
সৌভাগ্য বোধহয় একেই বলে। আজকেও মাসুদ রানার মৃত্যু লেখা ছিল না ভাগ্যে। আংশিক খণ্ডিত মাথাটা নিয়ে এখনও বসে আছে মোসাদ এজেণ্ট মীরা কোলিনের লাশটা। পিছন থেকে উঁকি দিল খয়েরি চকচকে একটা মাথা, নিচের ডেক থেকে ছোট্ট সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল ব্রিজে। হাতে ধরে রেখেছে লিভার-অ্যাকশন শটগানটা।
‘যাক, তোমার আসার সময় হলো তা হলে? আমি তো স্বর্গের পথে একটা পা বাড়িয়েই দিয়েছিলাম, বাধা দিলে কেন?’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কৌতুক করল বন্দি রানা।
সাদা দাঁত বের করে লাজুক হাসি হাসল রডরিক, দ্রুত হাতে খুলে দিতে লাগল ওর হাত-পায়ের বাঁধন। ‘মাফ করো, রানা। তুমি এতগুলো বেনজিড্রিন খাইয়ে এলে, আমার তো চোখ বন্ধ হবারই কথা না। কিন্তু তারপরও সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ তলিয়ে গিয়েছিলাম। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, সময়মত জাগিয়ে দিয়েছেন বলে! তা, তুমি কীভাবে বুঝলে এই মেয়েটাই শত্রু?’
‘বুঝিনি আগে। তাই তো কফির ফাঁদে পড়েছি। অপেক্ষা করেছি রবার্টের জন্যে। যেভাবে আদর করে সে তোমাকে মাতাল করতে চেয়েছিল, তাই ধরেই নিয়েছি, সেন্ট মেরিতে ফেরার আগেই একটা সুযোগ নেবে আমার শত্রু। আস্ত একটা জাহাজ ফিরে যেতে বলেছে আমেরিকান এম্বেসি, মনটা তখনই কামড় দিয়েছিল। এজন্যেই ড্রাগ দিয়ে তোমার ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করেছি, যাতে বিপদে পড়লে ব্যাকআপ হিসেবে কাজ করতে পারো তুমি। সুতরাং, ধন্যবাদ, রডরিক, আমার প্রাণ বাঁচালে বলে।’
‘আরে, আমি আর কী, দুর্দান্ত প্ল্যানটা তো তোমারই ছিল। আমি তো ঘুঁটি মাত্র! আর একটু হলেই দিয়েছিলাম সব কেঁচে! অবশ্য স্বর্গের অপ্সরাদের তোমার সঙ্গ থেকে বঞ্চিত করলাম বলে ভালই লাগছে।’
গলা ছেড়ে হেসে উঠল দুই বন্ধু। হাসি থামতেই রডরিক বলল, ‘আমার বাবা ভাগ্যবান ছিল তোমার মত বন্ধু পেয়ে, যে কি না নিজেকে নিশ্চিন্তে বিপদের মুখে ছেড়ে দিতে পারে বন্ধুর ওপর ভরসা করে। বাবার মতই আমিও তোমাকে ভালবাসি, রানা।’
‘আসল সত্যটা বের করার জন্যে মাঝেমধ্যে ফাঁদে পা না দিয়ে উপায় থাকে না, রডরিক। যাকগে, একে অপরের পিঠ চাপড়ানোর উৎসব আমরা পরে পালন করব। এখন চলো, এসব কিছুর একটা ব্যবস্থা করা যাক। জেটিতে ভিড়লেই তো পুলিশের খপ্পরে!’
‘ও, হ্যাঁ, তাই তো! কী করবে বলে ভাবছ? পুলিশ ধরলে তো আমাদের সব শেষ হয়ে যাবে।’ রডরিকের চোখে আশঙ্কার মেঘ।
মুচকি হাসল রানা। ‘সব এই ‘শার্লক হোমসের’ ওপর ছেড়ে দাও, রডরিক। ভুলে গেলে, আমাদের একজন সাক্ষী আছে এই জলকুমারীতে?’
চোখ বিস্ফারিত করল তরুণ আইল্যাণ্ডার। ‘তার মানে, তোমার সঙ্গে খুনি মেয়েটার সব কথাবার্তা রেকর্ড হয়ে গেছে? কিন্তু ক্যামেরা তো দেখছি ভাঙা।
মৃদু নড করে রানা জলকুমারীর কম্পিউটার কনসোলের দিকে এগিয়ে গেল। রেকর্ডিং সফটওয়্যারটা ক্লোজ করল। বলল, ‘ভিডিয়ো নেই, তবে অডিয়ো আছে। যদিও পুরো ক্লিপ ওদের সঙ্গে শেয়ার করা যাবে না। প্রয়োজন মত একটু এডিট করে নিতে হবে। চলো, কাজে নামি। দেখি, শত্রুদের চেয়ে আমরা ক্রাইম সিন তৈরিতে আরেকটু নিখুঁত হতে পারি কি না!’
(মাসুদ রানা সিরিজের জনপ্রিয় বই আই লাভ ইউ, ম্যান এবং একটি বিদেশি গল্পের কিছুটা ছায়া অবলম্বনে রচিত)
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন