মেঘচোর

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

পুরন্দর চৌধুরী চোখ থেকে কালো চশমাটা খুলে ফেলে বললেন, অসীমা, এবার আমি তোমাকে এমন একটা দৃশ্য দেখাবো, যা তোমার আগে পৃথিবীতে কেউ কখনো দেখেনি। এরকম দৃশ্য কেউ কল্পনাও করেনি।

ছোট একটা রকেট আকাশের এক জায়গায় গোল হয়ে পাক খাচ্ছে। কমপিউটারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কমপিউটারই রকেটটাকে ঘোরাচ্ছে।

দুটি মাত্র আসন। পাশাপাশি বসে আছেন পুরন্দর ও অসীমা। পুরন্দরের মুখখানা ফর্সা ও একেবারে গোল প্রায় চাঁদের মতন, তাঁর চোখের মণি দুটো নীল, তাঁর বয়েস পঞ্চাশের কাছাকাছি। বৃষ্টি—বিজ্ঞানী হিসেবে সারা পৃথিবীতে তাঁর নাম। সাহারা মরুভূমিতে তিনি এক মাসে একশো ইঞ্চি বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড করেছেন। এ জন্য তাঁর প্রশংসা যত হয়েছে, নিন্দেও হয়েছে প্রায় ততটাই।

মেঘ থেকে ইচ্ছে মতন বৃষ্টিপাত ঘটানো এখন আর কিছু ব্যাপার নয়! কিন্তু তিনি অন্য দেশ থেকে মেঘ তাড়িয়ে এনে সাহারায় বৃষ্টি ঝরিয়েছেন। সেই দেশে এবার বৃষ্টি কম হবে। একে মেঘ—চুরি বলা যায়। রাষ্ট্রসঙ্ঘে অনেকগুলি দেশ দাবী তুলেছে যে মেঘ—চুরি আইন করে বদলানো দরকার।

অসীমার বয়েস সাতাশ। আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করে। পুরন্দর চৌধুরী বোস্টন শহরে একটি আবহাওয়া বিষয়ে আলোচনায় যোগ দিতে এসেছিলেন। সেখানে অসীমার সঙ্গে তাঁর হঠাৎ আলাপ হয়। অসীমা নিজেই পুরন্দর চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ করতে এসেছিল।

সেই আলোচনা সভায় কারপভ নামে একজন বৈজ্ঞানিক পুরন্দরকে মেঘচোর বলে গালাগাল দেওয়ায় তিনি এমন উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন যে চিৎকার করে কিছু বলতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যান।

যখন তিনি চোখ মেললেন, তখন তিনি দেখলেন তাঁর মাথার কাছে বসে আছে এই সুন্দরী মেয়েটি। সে তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

এই দুনিয়ায় পুরন্দর চৌধুরীর আত্মীয়—স্বজন কেউ নেই। তিনি বিয়েও করেননি। বিদেশে একটি অচেনা বাঙালি মেয়েকে তাঁর সেবা করতে দেখে তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কে?

অসীমা বলেছিল, আপনি আমায় চিনতে পারবেন না, কিন্তু আমি আপনার ছোট ভাইয়ের মেয়ে।

পুরন্দর প্রথমে বিশ্বাস করেননি। তাঁর একটি ভাই ছিল ঠিকই, কিন্তু সে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে পঁচিশ বছর আগে! সেই ভাইয়ের নাম ছিল দিকবিজয়।

অসীমা বলেছিল, আমার বাবা নিরুদ্দেশ হয়ে যাননি, তিনি দেশ ছেড়ে ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত আলাস্কায় এসে সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন। বিয়ে করেছিলেন একটি এক্সিমো মেয়েকে। তিনিই আমার মা। আমার বাবার বাঁ চোখের ভুরুর ওপর একটা কাটা দাগ ছিল, খুব ছোটবেলায় আপনিই তাঁকে একবার স্কেল দিয়ে ওইখানে মেরেছিলেন, তাই না? আমার বাবা কিন্তু আপনাকে খুব ভালবাসতেন, মৃত্যুর আগেও আপনার কথা বলেছিলেন।

বিদেশে এসে এমনভাবে একজন রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়কে খুঁজে পেয়ে পুরন্দর চৌধুরী দারুণ খুশি হয়ে উঠেছিলেন। তারপর তিনি আর অসীমাকে ছাড়তে চাননি। তাঁর নিজস্ব রকেটে তিনি অসীমাকে নিয়ে বহু জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর আবহাওয়ার নানারকম রহস্য দেখাচ্ছেন।

ঘুরতে ঘুরতে এখন ওঁরা এসেছেন আলাস্কার আকাশে। অসীমা তার বাবা—মায়ের সঙ্গে যেখানে থাকতো, সে জায়গায়টাও দেখা হয়ে গেছে। সেখানে অবশ্য এক্সিমোদের ইগলুর বদলে এখন বড় বড় এয়ারকন্ডিশানড বাড়ি উঠেছে। পুরন্দর চৌধুরী বললেন, নীচের দিকে তাকিয়ে দেখো, ওটা কী দেখছো বলতে পারো?

অসীমা বললো, দেখতে পাচ্ছি একটা সোনালী রঙের পাহাড়। চূড়ার বরফের ওপর রোদ পড়েছে বলে সত্যিই সোনার মতন ঝকঝক করছে।

—ওই পাহাড়টার নাম জানো?

অসীম ইতিহাসের ছাত্রী হলেও ভূগোলও বেশ ভালোই জানে। সে বললো, আমি আলাস্কার এত দূরে কখনো আসিনি বটে, তবে এই পাহাড়টার নাম মাউন্ট চেম্বারলিন। তার পাশেই যে কুয়াশায় ঢাকা হ্রদ, তার নাম লেক শ্রেভার।

পুরন্দর খুশি হয়ে বললেন, বাঃ! এবার তোমাকে আমি যা দেখাবো, তা কিন্তু তুমি কাউকে বলতে পারবে না। সারা পৃথিবীতে দারুণ হই—চই হবে এই নিয়ে, কিন্তু মুখ খুলতে পারবে না। ব্যাটা কারপভ কী রকম জব্দ হয় এবার দেখো।

অসীমা মৃদুভাবে বললো, বৈজ্ঞানিকদের উচিত নয় কিন্তু একজন আর একজনকে জব্দ করা।

—বোকাদের বুঝিয়ে দেওয়া দরকার, তাদের জ্ঞান কতটুকু! আমাকে মেঘ—চোর বলে, এত সাহস? আমি অন্যায়টা কী করেছি? সাইবেরিয়া থেকে মেঘ এনেছি সাহারায়। সাইবেরিয়ায় অত বরফ, সেখানে বৃষ্টি না হলে ক্ষতি কী আছে?

অসীমা বললো, কিন্তু একবার এরকম শুরু করলে, তারপর যদি যে—কোনো দেশ অন্য দেশে মেঘ চুরি করতে শুরু করে? মনে করুন, ইন্ডিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের ঝগড়া হলো, তখন আপনি পাকিস্তান থেকে সব মেঘ উড়িয়ে নিয়ে চলে এলেন। তখন সে দেশের মানুষের কী অবস্থা হবে?

আমি পৃথিবীর মানুষকে আর একটা জিনিস শিখিয়ে দিয়ে যাবো। যাতে ও রকম মেঘ চুরি হলেও কোন ক্ষতি হবে না। যাক গে, সে কথা পরে। তুমি তো ইতিহাসের ছাত্রী, পৃথিবীতে শেষ তুষার—যুগ কবে এসেছিল জানো?

—এটা ঠিক ইতিহাসের বিষয় নয়, প্রাগৈতিহাসিক ব্যাপার। তবু আমি এটা জানি। শেষ হিমযুগ হয়েছিল তেরো হাজার বছর আগে।

—ঠিক বলেছো। এই লেক শ্রেভার তৈরি হয়েছিল সেই সময়ে। মাউন্ট চেম্বারলিনের বরফ—গলা জল এই লেকে এসে জমে। আবার এই জল বাষ্প হয়ে উড়ে গিয়ে মাউন্ট চেম্বারলিনের চূড়ায় গিয়ে আবার বরফ হয়ে যায়। এই সাইকেল চলছে।

—যেমন সমুদ্রের জল মেঘ হয়ে উড়ে যায়। আবার মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়ে সমুদ্র ভরাট হয়।

—ওটা তো ইস্কুলের ছেলেমেয়েদের মতন হলো। আসল বৃষ্টির হিসেবটা তোমাকে সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিচ্ছি। সারা বছরে পৃথিবী থেকে কত জল বাষ্প হয়ে মেঘে উড়ে যায় জান? পঁচানব্বই হাজার কিউবিক মাইল। তার মধ্যে আশী হাজার কিউবিক মাইলই যায় সমুদ্র থেকে। আবার ঠিক আশি হাজার কিউবিক মাইলই বৃষ্টি হয়ে সমুদ্রে ফিরে আসে। আর মাত্র পনেরো হাজার কিউবিক মাইল বৃষ্টি নিয়ে পৃথিবীর এত মানুষ, জীবজন্তু, গাছপালা সব বেঁচে আছে। প্রকৃতির হল এটাই নিখুঁত হিসেব। কিন্তু এবার মানুষের সংখ্যা দিন—দিন বেড়ে যাচ্ছে। সুতরাং মানুষের জন্য বেশি বৃষ্টি দরকার।

—আপনি এখানে আমাকে কী দেখাবেন বলেছিলেন?

—হ্যাঁ। এই যে নীচে দেখছো লেক শ্রেভার, এখানে একটা মজার ব্যাপার ঘটছে। এখানে যতখানি জল বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে, ঠিক ততখানি বৃষ্টি হয়ে ফিরে আসছে না। কিছুটা কম ফিরে আসছে। অর্থাৎ হ্রদটা একটু—একটু করে শুকোচ্ছে। আমি হিসেব করে দেখেছি। এই হ্রদটা পুরোপুরি শুকোতে আরও দশ হাজার বছর লাগবে।

—আপনি কী করে জানলেন? ঠিক দশ হাজার বছর লাগবে?

—অঙ্কের হিসেবে! তুমি পৃথিবীর যে—কোন পাহাড়, নদী, পুকুর, খাল—বিলের কাছে আমায় নিয়ে যাও, আমি অঙ্ক কষে বলে দেবো, সেখান থেকে কত জল বাষ্প হচ্ছে আর কত জল বৃষ্টি হয়ে ফিরে আসছে। এই অঙ্ক আমার থেকে ভালো আর কেউ জানে না। কারপভও কিছুটা জানে, তবে আমার চেয়ে কম।

—আমি তো ইতিহাস পড়ি, অঙ্ক আমার মাথায় বিশেষ ঢোকে না।

—ইতিহাসেও তো অঙ্কে লাগে। অবশ্য সাধারণ যোগ—বিয়োগ। আচ্ছা ইতিহাসের ছাত্রী, তুমি আটলান্টিস নামে লুপ্ত সভ্যতার কথা জানো? সেটা কোথায় ছিল বলো তো?

—এটাও কিন্তু ইতিহাসের বিষয় নয়। আটলান্টিসের ব্যাপারটা গ্রীক লেখকদের জল্পনা—কল্পনা। অনেক জায়গায় খোঁজাখুঁজি হয়েছে, এখনো কোথাও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি ঠিকঠাক।

—আমি যদি বলি এই লেক শ্রেভারের তলাতেই চাপা পড়ে আছে?

—সেটা দশ হাজাব বছর পরে জানা যাবে!

পুরন্দর চৌধুরী হা—হা করে হেসে উঠলেন। ছোট্ট একটা মশলার কৌটো খুলে একটা লবঙ্গ খেয়ে বললেন, তুমি একটা নেবে নাকি?

অসীমাও একটা লবঙ্গ নিল।

পুরন্দর চৌধুরী বললেন, তুমি আর আমি কেউই তো দশ হাজার বছর বাঁচবো না! ততদিন পৃথিবীতে মানুষই থাকবে কিনা সন্দেহ! দশ হাজার বছর তো দূরের কথা, আমি দশ বছরও অপেক্ষা করতে রাজি নই!

অসীমা চোখ বড় বড় করে বললো, তা হলে কি আপনি এই লেকটা খুঁজে দেখতে চান? এর তো প্রায় সবটাই বরফে ঢাকা!

পুরন্দর মাথা নেড়ে বললেন, খোঁড়াখুঁড়ি তো তোমাদের কাজ! আমি জল নিয়ে কারবার করি। জল কি খুঁড়তে হয়? এই যে এত বড় একটা লেক পড়ে আছে এখানে, এটা অপ্রয়োজনীয়, তা না? কোনো মানুষ এখানে আসে না। দশ হাজার বছর ধরে লেকটা নিজে নিজে শুকোতোই, অত দিন অপেক্ষা না করে এখনই এটাকে শুকিয়ে ফেললে কেমন হয়?

—এত বড় লেকটা শুকোবেন কি করে? সেই জল ফেলবেন কোথায়?

—মেঘ করে ছড়িয়ে দেবো! সেই কারপভের দেশে পাঠিয়ে দেবো। ও খুব মেঘ—মেঘ বলে চ্যাঁচামেচি করছিল যে!

—এই বিশাল হ্রদের জল যদি মেঘ হয়ে যায়, সেই মেঘ থেকে অন্য জায়গায় বৃষ্টি হবে। একসঙ্গে হঠাৎ বৃষ্টি বেড়ে গেলে পৃথিবীর দারুণ কোন ক্ষতি হয়ে যাবে না!

—কী আর হবে! সাইবেরিয়ায় বড় জোর এক ইঞ্চি বেশি বরফ জমবে!

অসীমা হেসে ফেলে বললো, আপনি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন। এতবড় লেক কী শুকিয়ে ফেলা যায়? পুরন্দর বললেন, বড় বড় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার যখন প্রথম হয়, তখন সবাই অবিশ্বাস করে। তোমাকে আর একটি ছোট্ট ঘটনা বলি। ঘটনাটা ছোট কিন্তু তার ফলটা হয়েছিল বিরাট। দশ লক্ষ বছরেরও কিছু বেশি আগে, এই পৃথিবীর উত্তাপ মাঝে মাঝে কমে বাড়ে। মাঝে মাঝে এই ধরো—দশ—পনেরো হাজার বছর পরে পরে। আমি যে—বারের কথা বলছি, সেবার পৃথিবীর উত্তাপ কমেছিল মাত্র তিন থেকে চার ডিগ্রি ফারেনহাইট। সেন্টিগ্রেটের হিসেবে খুব বেশি হলে দুই পয়েন্ট দুই। অতি সামান্য, তাতেই গোটা উত্তর আমেরিকাটা বরফে ঢেকে গিয়েছিল। কোথাও কোথাও বরফ জমে গিয়েছিল এক হাজার ফিট উঁচু। তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না? এটা কিন্তু প্রমাণিত সত্য!

অসীমা বললেন, আপনার কথা অবিশ্বাস করবো কেন? আমি ভাবছিলুম, আপনি আমাকে ছেলেমানুষ ভেবে ঠাট্টা করছেন!

না, এসব ঠাট্টার ব্যাপার নয়। এবার বুঝলে তো পৃথিবীর উত্তাপ একটুখানি কমে গেলেই কী কাণ্ড হয়? সেইরকম পৃথিবীর উত্তাপ যদি খানিকটা বাড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলেই সব বরফ গলতে শুরু করবে। আগে এই তাপ কমা—বাড়াটা সূর্যের ওপর নির্ভর করতো। এখন মানুষই তা পারে। যেসব পাগলগুলি অ্যাটম বোমা, হাইড্রোজেন বোমা জমিয়ে রেখেছে, সেগুলো যদি একসঙ্গে ফাটাতে শুরু করে তা হলে পৃথিবীর সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাবে!

সেকথা জানি! এত বড় লেকটাকে বাষ্প করে দেবার জন্য আপনিও একটা অ্যাটম বোমা ফাটাবেন নাকি। আমি ওসব বোমা—টোমায় বিশ্বাস করি না! আমি পুরন্দর চৌধুরী, আমার আবিষ্কার সব সময় মৌলিক। আলাস্কার এই চেম্বারলিন পাহাড়ের কাছে জনমনুষ্য নেই। এখানেহ হবে আমার আবিষ্কারেব পরীক্ষা। শুধু তুমি থাকবে তার সাক্ষী। তুমি আমার ভাইয়ের মেয়ে, তাই তোমাকে এই মহান দৃশ্য দেখার সুযোগও দিচ্ছি। দশ হাজার বছর পরে যে হ্রদটা শুকিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেটাকে আমি নিশ্চিহ্ন করে দেবো পাঁচ মিনিটে।

সত্যিই কী তা সম্ভব!

এক্ষুণি দেখতে পাবে!

এতবড় লেকটার জল বাষ্প হয়ে গেলে যে বিরাট মেঘ হবে, তার ধাক্কায় আমাদের রকেট টিকতে পারবে? আমারা মেঘলোকের অনেক উঁচুতে উঠে যাবো! মেঘ আর কতটা উঠতে পারে!

তারপর এতবড় মেঘকে আপনি সাইবেরিয়ায় পাঠাবেন?

সবট নাও পাঠাতে পারি, কিছু কিছু বিক্রিও করতে পারি। যে—সব দেশে বৃষ্টি কম, তাদের কয়েক টুকরো দেওয়া যেতে পারে।

ততদিন আপনি এই মেঘ জমিয়ে রাখবেন কোথায়?

উড়িয়ে নিয়ে বেড়াবো? এক দেশ থেকে আরেক দেশে উড়িয়ে যাবো। যে—কোন দেশের ওপর দিয়েই মেঘ উড়ে যাওয়া তো বে—আইনি নয়।

কিন্তু এই মেঘের সঙ্গে অন্য দেশের মেঘ উড়ে যেতে পারে না!

তা পারে অবশ্য! জানো অসীমা, এত বড় একটা জল—ভরা মেঘ যদি আমাদের অধিকারে থাকে, তা হলে সেই মেঘখানাকে উড়িয়ে আমরা পৃথিবীর সব মেঘ একসঙ্গে জুড়ে নিতে পারি! তখন কোথায় কখন বৃষ্টি হবে, তা আমি ঠিক করছি। আমি হবো আকাশের দেবতা ইন্দ্র। আমার নাম পুরন্দর, তার মানে জানো তো? যে—ক’জন বৈজ্ঞানিক আমার সঙ্গে শত্রুতা করেছে, আমার নামে নিন্দে রটিয়েছে, তাদের দেশে আমি ইচ্ছে করলে এক ফোঁটাও বৃষ্টি না দিতে পারি! বিশেষ করে ওই কারপভকে আমি একবার শিক্ষা দিতে চাই!

অসীমা হঠাৎ মুখ নিচু করে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো।

পুরন্দর একটু রেগে নিয়ে বললেন, এখনো বুঝি তোমার সন্দেহ হচ্ছে!

অসীমা বললেন, না, তা নয়। আপনি পঁচানব্বই হাজার কিউবিক মাইল লম্বা এক বিশাল মেঘ নিয়ে আকাশে ফেরিওয়ালার মতন ঘুরছেন, আর সব কটা দেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করছেন, বৃষ্টি নেবে? বৃষ্টি নেবে? এটা ভাবতেই কী রকম মজা লাগছে!

পুরন্দর বললেন, তুমি ঠিকই বলছো। এটা মজারই ব্যাপার। আমি সত্যি সত্যি অবশ্য সেরকম কিছু করবো না। আমি তো মেঘের ব্যবসাদার নই। মানুষের ক্ষতি করতেও চাই না। শুধ ওই কারপভ আমাকে মেঘচোর বলেছে, ওর দেশে আমি এই প্রকাণ্ড মেঘটা পাঠিয়ে দিয়ে বলবো, এই নাও ধার শোধ! সাইবেরিয়ায় কয়েক ইঞ্চি বরফ বেড়ে যাবে!

অসীমা বললেন, কি সাইবেরিয়ায় যাবার আগেই যদি এই মেঘ কোথাও ভেঙে পড়ে! কোনো দেশকে ভাসিয়ে দেয়?

পুরন্দর বললেন, সে রকম একটু ঝুঁকি নিতেই হয়। অবশ আমার যতদূর ধারণা, আমি মেঘটাকে ঠিক চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবো!

মনে করুন, সাইবেরিয়ার দিকে না গিয়ে এই মেঘটা আপনার দেশ কলকাতার আকাশের ওপর ভেঙে পড়লো, তা হলে সেই শহরের অবস্থা কী হবে?

এরকম জলভরা টলমলে মেঘ হঠাৎ ভেঙে কলকাতার অর্ধেক বাড়ি ভেঙে পড়লে গুঁড়ো হয়ে যাবে। কিন্তু সেরকম অবস্থা আমি হতেই দেবো না। মেঘটা এদিক—ওদিক গেলেই আমি পাঠিয়ে দেবো কোন নির্জন জায়গায়!

এবারে তিনি নিচু হয়ে তাঁর বসবার জায়গার তলা থেকে একটি ফাইবার গ্লাসের বাক্স বার করলেন। সেই বাক্সের মধ্যে ফুটবলের সাইজের একটি ধাতুর বল।

সেই বলটা হাতে নিয়ে তিনি বললেন—এটা দেখছো, অসীমা। এটা আমার নিজের তৈরি। মার্কারির সঙ্গে আরও এগারোটি ধাতু মিশিয়ে তৈরি হয়েছে এই নতুন অ্যালয়। এর গুণ হচ্ছে জলের ছোঁয়া লাগলেই এটা গরম হতে শুরু করে। তারপর উত্তাপ এমন বাড়বে যে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। দ্যাখো, হাত দিয়ে দ্যাখো, বাতাসে যে জলকণা আছে, তাতেই এটা গরম হতে শুরু করেছে। সেইজন্যই একটা এয়ারটাইট অবস্থায় রাখতে হয়।

অসীমা হাত দিয়ে দেখল, সত্যিই বলটা বেশ গরম।

পুরন্দর বললেন, আমার হিসেব অনুযায়ী জলের মধ্যে মেশবাব পর পাঁচ মিনিটেই এর উত্তাপ এত বাড়বে যে গোটা লেকটারই বরফ গলে গিয়ে বাষ্প হয়ে যাবে! তারপর আমরা দেখবো ওর তলায় আটলান্টিস আছে কিনা! দু’রকম আবিষ্কারই হবে, কী বলো!

অসীমা জিজ্ঞেস করলো, আমরা মেঘলোকের ওপরে ওঠে গেলে মেঘের তলায় কী আছে, তা দেখবো কী করে?

—দেখতে পেলে তো হলো।

—আপনার এই গোল ধাতুটা কি একবার গরম হয়েই নষ্ট হয়ে যাবে?

—না, না, না, এর ধ্বংস নেই। এটা যতবার ইচ্ছে ব্যবহার করা যাবে। সব জল শুকিয়ে গেলেই এটা আস্তে আস্তে আবার ঠাণ্ডা হতে শুরু করবে। এইবার তা হলে শুরু হোক!

অসীমা তার কোটের পকেট থেকে একটা ছোট্ট রিভলভার বার করে বললো, পুরন্দর চৌধুরী, ওই বলটাকে আপনি আবার ওই এয়ারটাইট বাক্সে ঢোকান। এবার আমাদের ফিরে যেতে হবে!

দারুণ অবাক হয়ে চোখ কপালে তুলে পুরন্দর বললেন, এ কী অসীমা? তুমি ওটা তুলে আমাকে ভয় দেখাচ্ছো কেন?

অসীমা বললো, আপনার দিকে অস্ত্র তুলতে হয়েছে বলে আমরা দুঃখিত। কিন্তু না হলে আপনি আমার কথা শুনতেন না। প্রকৃতিকে ধ্বংস করা একটা অপরাধ। আলাস্কার একটি লেক শুকিয়ে সাইবেরিয়ার এত বড় একটা মেঘ পাঠালে প্রকৃতিতে মহা বিপর্যয় শুরু হয়ে যাবে! ডক্টর কারপভের ওপর রাগ করে আপনি পৃথিবীর ক্ষতি করতে চাইছেন!

পুরন্দর এক ধমক দিয়ে বললেন, বোকা মেয়ে! ওটা সরিয়ে রাখো! পাঁচ মিনিটে এত বড় একটা মেঘ সৃষ্টি করার রেকর্ড করবো আমি। তার সঙ্গে তোমার নামটাও থাকবে আমার ভাইঝি হিসেবে।

—আমি আপনার ভাইঝি নই! আমি কারপভের মেয়ে।

—অ্যাঁ?

—হ্যাঁ, আমার মা বাঙালি মেয়ে।

—তুমি আমাকে মিথ্যে কথা বলেছিলে? তুমি একটা স্পাই।

—ঠিক মিথ্যে বলিনি। আমার বাবা আপনাকে বড় ভাইয়ের মতন শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু তিনি বলেন, আপনি এক দেশের মেঘ অন্য দেশে নিয়ে গিয়ে পাগলামি করছেন। সমুদ্র থেকে খাল কেটে সাহারায় জল আনা ইচ্ছে, অন্য দেশের মেঘ আনার দরকার নেই!

—তুমি, তুমি আমার এমন একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার নষ্ট করে নিতে চাও? তুমি আমার ওপর গুলি চালাও, আমাকে মেরে ফেলো, তবু এই গোলাটা আমি হ্রদে ফেলবোই। আমি মরে গেলেও পৃথিবীর লোক জানবে যে পুরন্দর চৌধুরী কত বড় বৈজ্ঞানিক ছিল।

অসীমা একবার বাইরের দিকটা দেকে নিয়ে পুরন্দরের দিকে স্থিরভাবে চেয়ে রইলো।

পুরন্দর রকেটের একটা অংশ খুলতে যেতেই অসীমা বললো, ওটা খুলবেন না। তা হলে আমরা গুঁড়ো হয়ে যাবো!

—আমি এটা বাইরে ছুঁড়বোই!

—ছুঁড়ুন তা হলে। কিন্তু জানলা—টানলা খুলবেন না। এই সকেটের মধ্যে ফেলুন, নীচের পর পর কয়েকটা ভালব খুলে গিয়ে এটাকে বাইরে বার করে দেবে!

—তার মানে? তুমি কী বলছো? জানলা খুলবো না কেন?

—ডক্টর পুরন্দর চৌধুরী আপনি আবহাওয়া বিজ্ঞনী। আমি কিন্তু শুধু ইতিহাসের ছাত্রী নই। কমপিউটারেই আমার বিশেষ আগ্রহ। আগে থেকে প্রোগ্রাম করে রেখেছিলাম। কমপিউটার এখন রকেটটাকে বায়ুমণ্ডল ছাড়িয়ে পৃথিবীর অনেক ওপরে নিয়ে এসেছে। লেকটাকে কি আর দেখতে পাচ্ছেন? এখান থেকে আপনার বলটা ছুঁড়লেও লেকে পড়বে না। বলটা আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে আসছে না?

পুরন্দরের মুখটা হাঁ হয়ে গেল। এই সুন্দর চেহারার মেয়েটার মাথায় এতসব বুদ্ধি। বায়ুমণ্ডলের বাইরে তাঁর অ্যালয়টা অকেজো!

অসীমা বলটা পুরন্দরের হাত থেকে নিয়ে ফেলে দিল সকেটে। তারপর বললো, ওটা মহাশূন্যেই থাক। কোনোদিন জলের ছোঁয়া পাবে না। পৃথিবীর জল যেমন আছে তেমন থাকুক!

সকল অধ্যায়

১. ছোটমামার ব্যাপারটা
২. কেন দেখা দিল না
৩. হীরে কি গাছে ফলে
৪. ঘোড়ার ডাক্তার
৫. হীরে উধাও রহস্য
৬. জলের তলার রাজপুরী
৭. মাসতুতো ভাই
৮. রাত্তির বেলা, একা একা
৯. তেপান্তর
১০. নীল মানুষের মন খারাপ
১১. অমলের পাখি
১২. ভয়ের পুকুর
১৩. চার নম্বর ডাকাত
১৪. আয়না নয়
১৫. রাজপুত্তুরের অসুখ
১৬. কাঞ্চনের দুঃখ
১৭. রাজকুমার
১৮. সুবর্ণরেখার তীরে
১৯. একদম রূপকথা
২০. বিশ্বমামার ম্যাজিক
২১. ভালোবাসা
২২. সুশীল মোটেই সুবোধ বালক নয়
২৩. রবির কুকুর
২৪. ইংরিজির স্যার
২৫. নীল মানুষের পরাজয়
২৬. নিউইয়র্কের সাদা ভল্লুক
২৭. বেণী লস্করের মুন্ডু
২৮. মাঝরাতে অতিথি
২৯. রণজয়ের শহর অভিযান
৩০. কাকাবাবু বনাম মূর্তিচোর
৩১. ছোড়দির বড়দি
৩২. আজব লড়াই
৩৩. নীলমানুষ ও ছোট্ট বন্ধু
৩৪. মেঘচোর
৩৫. হাতিচোর
৩৬. বন্দিনী
৩৭. পৃথা ও চন্দ্র দেবতা
৩৮. বিশুর কাণ্ড
৩৯. ছবি পাহাড়
৪০. কিউই
৪১. মহিষাসুর
৪২. শালিক ও ছোটকাকা
৪৩. ছুটি
৪৪. মহাকালের লিখন
৪৫. তৃতীয় চক্ষু
৪৬. পার্বতীপুরের রাজকুমার
৪৭. পঞ্চম শক্তি
৪৮. জোড়া সাপ
৪৯. সাতজনের তিনজন
৫০. আবার নীল মানুষ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন