সুবর্ণরেখার তীরে

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সকালেবেলা ঘুম ভাঙার পরই মনে হলো, আঃ কী সুন্দর এই জীবন!

জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে, যেন ঠিক গলানো সোনা। বাতাসে একটু একটু শীত। আকাশ একেবারে ঝকঝকে নীল। জানালা দিয়েই দেখা যায়, বাগানে ফুটে আছে পাঁচ রকম রঙের গোলাপ ফুল।

একটা চাদর জড়িয়ে বাইরে এসে দেখি, বিশ্বমামা আর বিলুদা চা খাচ্ছে। আমার আগেই ওরা উঠে পড়েছে? আমার আফসোস হলো। আমার চেয়ে ওরা বেশিক্ষণ দেখতে পাবে সকালটা। এমন সুন্দর সকালে ঘুমোবার কোনো মানে হয়?

আমি বিশ্বমামাকে বললুম, আমায় কেন ডেনে দাওনি?

বিশ্বমামা বললেন, তোকে তিনবার ডেকেছি। তুই শুধু উঁ উঁ শব্দ করে এপাশ ওপাশ করেছিস।

বিলুদা বললো, বাছা কুম্ভকর্ণ!

বিশ্বমামা বললেন, এক্ষুনি তৈরি হয়ে নে, নীলু। আমরা নদীর ধারে বেড়াতে যাবো। তারপর সেখান থেকে ধারাগিরি পাহাড়ে। সারাদিন ফিরবো না।

ঘাটশিলা জায়গাটায় সুবর্ণরেখা নদীর ধারটাই আমার বেশি ভালো লাগে। সাত বছর আগে, তখন আমার বয়েসও ছিল সাত বছর, বাবা—মায়ের সঙ্গে একবার বেড়াতে এসেছিলাম এখানে। সেবারে আমি নদীর ধারে বালি নিয়ে খেলা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম একসময়। বাবা—মা খেয়াল করেননি, বাড়ি চলে এসেছিলেন, তারপর সন্ধেবেলা সবাই মিলে কী খোঁজাখুঁজি! আমি স্বপ্ন দেখছিলাম, সুবর্ণরেখা নদীতে ভাসতে ভাসতে আমি স্বর্গের মতন একটা জায়গায় চলে এসেছি, সেখানে কী সুন্দর গন্ধ!

সেই সাত বছর বয়েসের কত কথা ভুলে গেছি, কিন্তু সেই নদীর ধারে ঘুমিয়ে পড়া আর স্বপ্নটার কথা ঠিক মনে আছে।

একটু বাদে আমরা বেরিয়ে পড়লুম তিনজনে।

বিশ্বমামা অন্য দিন যে—কোনো রাস্তায় যেতে যেতে গাছ—পালা, পশু—পাখি, পাথর সম্বন্ধে কত রকম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা শোনান। আজ তাঁর ওদিকে মন নেই। আজ গুন গুন করে গান গাইছেন আপন মনে।

এই নদীর ধারে অনেকে পিকনিক করতে আসে। কিন্তু আজ এখন মানুষজন বিশেষ নেই। পাতলা পাতলা বাতাস আর হালকা রোদের একটা খেলা চলছে। দূরের ছোট ছোট পাহাড়—মনে হয় যেন আকাশের গায়ে পেন্সিলে আঁকা। এক ঝাঁক সাদা বক উড়ে গেল নদীর এপার থেকে ওপারে।

একজন বুড়ো মতন লোক কোমর পর্যন্ত জলে নেমে একটা গামছা দিয়ে জল আর বালি তুলে ছাঁকছে। আমরা যে পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, তা সে লক্ষও করছে না।

বিলুদা বললো, লোকটা মাছ ধরছে নাকি?

বিশ্বমামা বললেন, না। ওই লোকটা সোনা খুঁজছে।

বিলুদা বললো, জলের মধ্যে নেমে সোনা খুঁজছে? লোকটা পাগল নাকি?

বিশ্বমামা বললেন, পাগল কেন হবে? এই নদীর বালিতে সত্যিই তো সোনা পাওয়া যায়। সেই জন্যই তো নদীর নাম সুবর্ণরেখা।

বিলুদা তবু অবিশ্বাসী মুখ করে বললো, যাঃ, তাহলে তো কত লোকই সোনা খুঁজতে আসতো। সব বালি শেষ হয়ে যেত এতদিনে!

বিশ্বমামা বললেন, এক সময় অনেক লোকই আসতো এখানে সোনা খুঁজতে। আমি ছেলেবেলায় দেখেছি। সোনা সত্যি পাওয়া যায়, কিন্তু সারাদিন ধরে বালি ছেঁকে ছেঁকে হয়তো পাওয়া গেল একটা ছোট্ট দানা, মাসের পর মাস লেগে থাকলে হয়তো হবে পাঁচ রতি কিংবা দশ রতি, তাতে পরিশ্রম পোষায় না। সেই জন্য অনেকে হাল ছেড়ে দেয়। যারা খুব ভাগ্যবান হয়, তারা অনেক সময় বড় টুকরোও পেয়ে যায়। এই তো কাছেই সোনাপেট বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে একটা লোক বড় এক টুকরো সোনা—মেশানো পাথর, যাকে নাগেট বলে, সেরকম একটা পেয়ে বড়লোক হয়ে গিয়েছিল।

বিলুদা এবার চোখ বড় বড় করে বললো, সত্যি? তা হলে চলো না আমরা সোনাপেট যাই!

বিশ্বামামা জিজ্ঞেস করলেন, তোর কাছে বড় একটা ছুরি দেখেছিলাম সেটা সঙ্গে এনেছিস?

বিলুদা বললো, না, আনিনি তো। দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আসবো?

বিশ্বমামা এবার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, নীলু, তুই জানিস ‘বোকার সোনা’ কাকে বলে?

আমি বোকার মতন বললুম, ‘বোকার সোনা’? সে আবার কী?

একটা বড় পাথরের চাঁইয়ের ওপর বসে বিশ্বমামা বললেন, তোরাও বোস এখানে। তোদের একটা গল্প বলি। তোরা চার্লি চ্যাপলিনের ‘গোল্ড রাশ’ সিনেমাটা দেখেছিস?

আমি বললুম, হ্যাঁ, দেখেছি। সেই যে চার্লি চ্যাপলিন খিদের চোটে জুতো খেয়ে ফেলেছিলেন!

বিশ্বমামা বললেন, হ্যাঁ, তোদের সেই গোল্ড রাশেরই একটা গল্প শোনাবো। আমেরিকা মহাদেশটা তো নতুন, ইওরোপ থেকে সাহেবরা আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে যখন সেখানে পৌঁছোয়, তখন তাদের ধারণাই ছিল না দেশটা কত বড়। পুবদিক থেকে তারা পশ্চিম দিকে আস্তে আস্তে এগোয়। তখন পশ্চিম দিকের নাম দিয়েছিল তারা ওয়াইলড ওয়েস্ট!

বিলুদা বললো, হ্যাঁ, পাহাড়, মরুভূমি, হিংস্র রেড ইন্ডিয়ান। ওখানকার গল্প নিয়ে যে—সব ফিল্ম হয়েছে, সেগুলিই তো ওয়েস্টার্ন মুভি। দারুণ মারামারি।

বিশ্বমামা বললেন, ওয়েস্টার্ন ছবিতে তো কাউবয় আর গ্যাংস্টাররা গোলগুলি চালায়। আমার গল্পটা তার চেয়ে কিছু আগের। তখন অনেক লোকের ধারণা হয়েছিল, আমেরিকার ওই পশ্চিম দিকের মরুভূমিতে, নদীগুলোর ধারে সোনা ছড়িয়ে আছে। যে আগে গিয়ে কুড়িয়ে নিতে পারবে, সে—ই বড়লোক হয়ে যাবে। কত লোক যে এই জন্য প্রাণ দিয়েছে তার ঠিক নেই। একে বলে মরীচিকার পেছনে ছোটা। খেতে পায়নি, মরুভূমির মধ্যে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে, রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে খুনোখুনি করেছে।

বিলুদা জিজ্ঞেস করলো, কেউ কি সোনা পেয়ে বড়লোক হয়েছিল?

বিশ্বমামা বললেন, গুজব ছড়িয়ে ছিল যে কেউ কেউ পেয়েছে, কিন্তু তাদের দেখা যায়নি।… এবার শোন দুই বন্ধুর কথা। একজনের নাম বব, আর একজনের নাম নিক। একেবারে প্রাণের বন্ধু যাকে বলে। দু’জনেরই দারুণ স্বাস্থ্য আর দারুণ সাহস। ওরা যাত্রা শুরু করেছিল শিকাগো শহর থেকে। দু’জনের দুটো ঘোড়া আর রিভলভার, দুটো থলিতে সামান্য কিছু জিনিসপত্র। ওরা কোনো বড় দলের সঙ্গে ইচ্ছে করেই ভিড়ে যায়নি। বব আর নিক ঠিক করেছিল, ওরা অ্যারিজোনার মরুভূমিতে গিয়ে কিছুদিন থাকবে। বেশি জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে তো লাভ নেই, শুধু একটা জায়গায় ভালো করে দেখার পর যা হয় হবে। অ্যারিজোনার ওই মরুভূমিটা বড় সুন্দর!

বিলুদা জিজ্ঞেস করলো, তুমি দেখেছো? তুমি গিয়েছিলে?

বিশ্বমামা বললেন, হ্যাঁ, টুসন নামে একটা শহর আছে, তার খুব কাছেই ওই মরুভূমির শুরু। টুসন শহরে একবার একটা বক্তৃতা দিতে গিয়ে আমি পুরো মরুভূমিটা ঘুরে দেখেছি, রাত্তিরেও ছিলাম। তখনই তো বব আর নিকের গল্পটা শুনি।

বিলুদা জিজ্ঞেস করলো, সব মরুভূমিই তো এক রকম হয়। ওটা বেশি সুন্দর কেন?

বিশ্বমামা বললেন, মরুভূমি মানে সবাই ভাবে কোনো গাছপালা নেই, শুধু সমুদ্রের মতন ধুধু করছে বালি। অ্যারিজোনার মরুভূমি সে রকম নয়। অনেক গাছ আছে, ঠিক গাছ নয়। ক্যাকটাস। আমরা যেগুলোকে ফনিমনসা গাছ বলি। কিন্তু অতবড় ক্যাকটাস আমাদের দেশে হয় না, দোতলা—তিনতলা বাড়ির সমানও আছে। ওখানকার বালির রং একেবারে সোনালি। মাঝে মাঝে ছোট ছোট পাহাড়।

বব আর নিক সে রকম একটা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিল। প্রত্যেক দিন তারা মেপে মেপে ঠিক দু’বিঘের মতন জমি তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখে। মাঝে মাঝে ওদের মধ্যে একজন ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়ে দূরের একটা গ্রাম থেকে খাবার কিনে আনে, দু’একটা খরগোশ শিকার করে।

এই রকম ভাবে কেটে গেল মাসের পর মাস। ওরা ধৈর্য না হারিয়ে একটু একটু করে এগোয়। এর মধ্যে বিপদও ঘটলো কয়েকবার। ওই মরুভূমিতে এক রকম বিষাক্ত সাপ আছে, সেগুলোকে বলে র‌্যাটল স্নেক। সে সাপগুলো যখন উত্তেজিত হয়, তখন লেজের দিকে খটখট শব্দ হয়। একদিন বব—এর একেবারে সামনে পড়ে গেল ওই রকম একটা সাপ। বব তখন হাঁটু গেড়ে বসে বালি ঘেঁটে ঘেঁটে দেখছে। রিভলভারটা বার করতে গেলেই যদি সাপটা কামড়ায়, এই ভয়ে হাত নাড়তে পারছে না। নিক রয়েছে তার উল্টো দিকে, সাপটার পেছনে। কিন্তু সে গুলি চালালে ববের গায়েও লাগবে। বেশি চিন্তা করারও সময় নেই। নিক ঝাঁপিয়ে পড়লো সাপটার ওপর, দু’হাতে তার মুখটা চেপে ধরলো। একটু এদিক ওদিক হলেই সাপটা তাকে কামড়াতো।

আর একবার তিনটে ডাকাত এসে ওদের ওপর হানা দিয়েছিল। সেবারেও ববকে বাঁচাতে গিয়ে নিক আহত হয়। বব অবশ্য বাকি দুটো ডাকাতকে তাড়া করে গিয়ে মেরে আসে।

বিলুদা বললো, বুঝেছি, এ গল্পের শেষে কী হবে। ওরা দু’জনে খুব বন্ধু ছিল তো? তারপর একদিন…

বিশ্বমামা বললেন, না, তুই জানিস না।

বিলুদা বললো, ঠিক আছে, তুমি শেষ করো। তারপর দেখবো মেলে কি না।

বিশ্বমামা বললেন, সাত মাস পেরিয়ে গেল, রোদে পুড়ে, জলে ভিজে ওদের চেহারা অদ্ভুত হয়ে গেছে। সারা মুখ দাড়িতে ভর্তি, তবু ওদের জেদ যে সোনা না নিয়ে ফিরবে না। তারপর একদিন সেই ব্যাপারটা ঘটলো।

বিলুদা বললো, ওরা সোনা খুঁজে পেল!

বিশ্বমামা বললেন, ডাকাতদের উপদ্রবে ওরা প্রায়ই জায়গা পাল্টায়। যারা সোনা খুঁজতে আসে, তাদের সব কিছু কেড়ে নেবার জন্য একদল ডাকাতও ঘুরে বেড়াতো ওই মরুভূমিতে। একদিন সকালে, আগের রাতে খুব ঝড়—বৃষ্টি হয়ে গেছে, ওরা দুজনে হাঁটছে। ওদের খাবার ফুরিয়ে গেছে। আগের রাতে কিছুই খাওয়া হয়নি, ওরা ঠিক করলো দুজনেই একসঙ্গে শহরে যাবে। অনেকদিন বাদে কোনো সরাইখানায় গিয়ে ভালো করে খাবে।

হঠাৎ বব থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে অদ্ভুত গলায় ডাকলো, নিক!

নিকও তার বন্ধুর দৃষ্টি অনুসরণ করে দারুণ চমকে গেল। একটা ক্যাকটাস গাছের নিচে এক তাল সোনা। রোদ্দুর পড়ে চকচক করছে। ঠিক যেন ভোরবেলাকার সূর্য। ক্রিকেট খেলার বলের চেয়েও অনেকটা বড় সেই সোনার মণ্ডটার সাইজ। অতখানি সোনা পেলে একজন—দু’জন মানুষের সারা জীবন দারুণ আরামে কেটে যেতে পারে, আর কিছুই করতে হবে না।

দুই বন্ধু থমকে দাঁড়িয়ে আছে। এতদিনের পরিশ্রমের পর এত কাছে এতবড় একটা সোনার মণ্ড দেখেও ওরা যেন এগোতে পারছে না। বব বলে উঠলো, আমি আগে দেখেছি। নিক সঙ্গে সঙ্গে একটা ছুরি বার করে ববের পেটে ঢুকিয়ে এক টান দিল। বব আর কোনো শব্দও করতে পারলো না, মরে গেল সেই মুহূর্তে।

বিলুদা বললো, আমি ঠিক ধরেছিলুম। ঠিক বুঝেছিলাম। যেই সোনা খুঁজে পাবে, অমনি এক বন্ধু আর এক বন্ধুকে মারবে!

বিশ্বমামা গম্ভীরভাবে বললেন, গল্প তো এখনো শেষ হয়নি। বোকারাম, শুরু করার একটু পরেই যারা শুনছে তারা যদি বুঝে যায় যে শেষে কী হবে, সেটা গল্প হয় না। একটু অন্যরকম বলেই তো সেটা গল্প! গল্পের মাঝখানে কখনো বাধা দিতে নেই।

আমি বললুম, তারপর কী হলো বিশ্বমামা?

বিশ্বমামা বললেন, যে নিক তার বন্ধুকে বারবার বাঁচিয়েছে, সোনা দেখা মাত্রই সে সেই প্রাণের বন্ধুকে মেরে ফেললো। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়লো সেই সোনার মণ্ডটার ওপর। সেটা ঝুরঝুরিয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল!

বিলুদা বললো, সেটা সোনা নয়?

বিশ্বমামা বললেন, অ্যারিজোনার মরুভূমিতে কখনো কখনো ওরকম দেখা যায়। বিশেষত ঝড়—বৃষ্টির পর। ঝড়ে ওখানকার সোনার মতন বালি ক্যাকটাসের আঠায় দলা পাকাতে থাকে, পাকিয় পাকিয় গোল বলের মতন হয়ে যায়, তার ওপর রোদ পড়লে অবিকল সোনার মতন দেখায়। ওখানে লোকে ওর নাম দিয়েছে ফুলস গোল্ড, বোকার সোনা! নিক তারপর পাগল হয়ে গেল! বদ্ধ উন্মাদ হয়ে সে সেই মরুভূমিতে চিৎকার করে বেড়াতো—বব, ফিরে আয়! বব, ফিরে আয়!

উঠে দাঁড়িয়ে আবার হাঁটতে হাঁটতে বিশ্বমামা বললেন, সোনা জিনিসটা খুব খারাপ। মানুষের মধ্যে এমন লোভ জাগিয়ে দেয়!

বিলুদা বললো, তুমি কী যে গল্প শোনালে বিশ্বমামা! আমরা যদি এখানে হঠাৎ একতাল সোনা সত্যি সত্যি দেখতে পাই, তাহলে কি আমরা মারামারি করবো নাকি? তুমি আমার নিজের মামা, আর নীলু আমার নিজের ছোট ভাই!

বিশ্বমামা বললেন, মানুষের কাছে অনেক সময় নিজের আত্মীয়ের থেকেও বন্ধু বড় হয়। বন্ধুর জন্য মানুষ প্রাণ দিতে পারে। আবার সেই বন্ধুকেই যখন কেউ মারে, তখন সে কি তার কোনো আত্মীয়কে মারতে পারে না?

আমি এতক্ষণ বাদে বললুম, থাক, ওসব কথা আর বলতে হবে না। এমন সুন্দর সকালবেলাটায় মারামারির কথা শুনতে ভালো লাগে না।

বিশ্বমামা বললেন, ঠিক বলেছিস। সোনা—টোনার কথা বাদ দে। সুবর্ণরেখা কী সুন্দর নাম। বিলু, এই রকম আরও কতকগুলো সুন্দর নদীর নাম বলতে পারবি?

বিলুদা বললো, হ্যাঁ, কৃষ্ণা, কাবেরী, কপোতাক্ষ, ইছামতী, বিপাশা, চন্দ্রভাগা, নর্মদা।

বিশ্বমামা বললেন, নর্মদা নদীতে বাঁধ দেওয়া নিয়ে এখন আন্দোলন চলছে। নর্মদা নামটার মানে জানিস?

বিলুদা বললো, সব নামের কি মানে থাকে?

বিশ্বমামা বললেন, বাঃ, মানে থাকবে না? নর্মদা মানে গভীর নীল জল। গল্প আছে যে একবার ব্রহ্মা অমরকণ্টক পাহাড়ে বিশ্রাম নেবার সময় ঘুমোচ্ছিলেন। কী একটা স্বপ্ন দেখে তাঁর চোখ থেকে খসে পড়ল দু’ফোঁটা জল। পাহাড়ের দু’পাশ দিয়ে সেই চোখের জলের ফোঁটা গড়িয়ে গিয়ে নদী হয়ে গেল, দুটো নদী। একটার নাম শোন, অন্যটার নাম নর্মদা।

বিলুদা বললো, ব্রহ্মার এক ফোঁটা চোখের জলই যদি নদীর মতন, তা হলে ব্রহ্মার মুন্ডুটা কত বড়?

এইসব নানা গল্প করতে করতে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি। হঠাৎ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে বিশ্বমামা আমার আর বিলুদার হাত চেপে ধরে বললেন, দাঁড়া, এক পা নড়বি না।

আমি ভয় পেয়ে বললুম, কী, সাপ নাকি?

বিলুদা বললো, সোনা! ওই তো!

খানিকটা দূরে বালিতে এক টুকরো পাথর। সোনার মতনই চকচক করছে। পাথরটার ওপরের অংশটাই দেখা যাচ্ছে, বালির মধ্যে রয়েছে আরও খানিকটা। এ রকম রঙের পাথর তো আমরা আগে কখনো দেখিনি।

বিশ্বমামা বললেন, ওটা যদি সোনা হয়, তা হলে ওটা কে পাবে, আগে ঠিক হয়ে যাক।

বিলুদা বললো, আমরা ভাগ করে নেবো।

বিশ্বমামা বললেন, কী ভাবে ভাগ হবে?

বিলুদা বললো, তিন জনে সমান সমান।

বিশ্বমামা বললেন, সমান সমান? বাঃ!

বিলুদা বললো, না, মানে, তুমি বয়সে বড়, তুমি বেশি পাবে। তুমি অর্ধেক আর বাকিটা আমরা দু’জনে।

বিশ্বমামা বললেন, ঠিক তো?

বিলুদা বললো, সোনাটার দাম ছ’ভাগ ভাগ করা হবে। তুমি নেবে তিন ভাগ, আমি দু’ভাগ, আর নীলু সবচেয়ে ছোট, ও পাবে এক ভাগ!

হো হো করে হেসে উঠে বিশ্বমামা বললেন, এর মধ্যেই তিনরকম ভাগ হয়ে গেল। তোর কাছে ছুরি থাকলে নিশ্চয়ই আরেক রকম ভাগের কথা বলতিস?

তারপর হাসি মুছে ফেলে বিকট মুখভঙ্গি করে বিশ্বমামা বললেন, যে আগে দেখে, সে—ই পায়। তোরা কিচ্ছু পাবি না। তোদের কাছে ছুরিটুরি নেই আমি জানি। আমাকে বাধা দেবার চেষ্টা করলে দুই থাবড়া মারবো। এখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক।

বিশ্বমামা ছুটে গিয়ে পাথরটা টেনে তুললেন। তারপর ভালো করে না দেখেই সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন নদীর জলে!

বিলুদা আঁতকে উঠে বললো, এ কী, তুমি ফেলে দিলে?

বিশ্বমামা বললেন, বেশ করেছি। আমার জিনিস, আমি যা খুশি করবো। এখন বাড়ি চল, খিদে পেয়েছে।

বিলুদা বললো, ওঃ ওটা সোনা ছিল না। যা চমকে দিয়েছিল; ওটা কী ছিল বলো না?

বিশ্বমামা ওর কথার উত্তর দিলেন না।

হাঁটতে হাঁটতে আপন মনে বললেন, ঘাসের ডগায় একটি শিশিরবিন্দু। আলো পড়লে হীরের কুচির মতন ঝকঝক করে। ভোরবেলা গাছের পাতায় প্রথম সূর্যের আলো ঠিক সোনার মতন দেখায়। আসল হীরে বা সোনার চেয়ে কী তা কম সুন্দর।

সকল অধ্যায়

১. ছোটমামার ব্যাপারটা
২. কেন দেখা দিল না
৩. হীরে কি গাছে ফলে
৪. ঘোড়ার ডাক্তার
৫. হীরে উধাও রহস্য
৬. জলের তলার রাজপুরী
৭. মাসতুতো ভাই
৮. রাত্তির বেলা, একা একা
৯. তেপান্তর
১০. নীল মানুষের মন খারাপ
১১. অমলের পাখি
১২. ভয়ের পুকুর
১৩. চার নম্বর ডাকাত
১৪. আয়না নয়
১৫. রাজপুত্তুরের অসুখ
১৬. কাঞ্চনের দুঃখ
১৭. রাজকুমার
১৮. সুবর্ণরেখার তীরে
১৯. একদম রূপকথা
২০. বিশ্বমামার ম্যাজিক
২১. ভালোবাসা
২২. সুশীল মোটেই সুবোধ বালক নয়
২৩. রবির কুকুর
২৪. ইংরিজির স্যার
২৫. নীল মানুষের পরাজয়
২৬. নিউইয়র্কের সাদা ভল্লুক
২৭. বেণী লস্করের মুন্ডু
২৮. মাঝরাতে অতিথি
২৯. রণজয়ের শহর অভিযান
৩০. কাকাবাবু বনাম মূর্তিচোর
৩১. ছোড়দির বড়দি
৩২. আজব লড়াই
৩৩. নীলমানুষ ও ছোট্ট বন্ধু
৩৪. মেঘচোর
৩৫. হাতিচোর
৩৬. বন্দিনী
৩৭. পৃথা ও চন্দ্র দেবতা
৩৮. বিশুর কাণ্ড
৩৯. ছবি পাহাড়
৪০. কিউই
৪১. মহিষাসুর
৪২. শালিক ও ছোটকাকা
৪৩. ছুটি
৪৪. মহাকালের লিখন
৪৫. তৃতীয় চক্ষু
৪৬. পার্বতীপুরের রাজকুমার
৪৭. পঞ্চম শক্তি
৪৮. জোড়া সাপ
৪৯. সাতজনের তিনজন
৫০. আবার নীল মানুষ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন