চার নম্বর ডাকাত

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

দুপুরের ট্রেনে অনেকেই ঝিমোয়। কেউ খবরের কাগজ পড়তে পড়তে ঘুমোয়। কেউ জানলায় মাথা রেখে ঘুমোয়। কারুর মাথা ঘুমে ঢলে পাশের লোকের কাঁধে গিয়ে পড়ে।

বেলা এখন সোওয়া তিনটে। ট্রেনটা আপন মনে ছুটছে।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো একটা লোক, তার মুখে রুমাল বাঁধা। শুধু চোখ দুটি ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। তার হাতে একটা রিভলভার। সে কামরার চারদিকে একবার চেয়ে নিয়ে বললো, সবাই শোনে! কেউ নিজের জায়গা থেকে নড়বে না। কেউ ওঠার চেষ্টা করলে গুলি চালাবো। যার কাছে যা গয়না, টাকা—পয়সা আছে, দিয়ে দাও। কেউ কিছু লুকোবে না।

যারা একটু একটু ঘুমোচ্ছিল, তারা চমকে ভয় পেয়ে গেল। যারা গভীর ঘুমে রয়েছে তারা কিছু শুনতেই পেল না!

এবার কামরাটার অন্য দু’দিক থেকে উঠে দাঁড়ালো দুটি ছেলে। তারাও এতক্ষণ ঘুমের ভান করে মুখ গুঁজে ছিল। এখন দেখা গেল, তাদের মুখেও রুমাল বাঁধা। দু’জনের হাতেই লম্বা ছুরি।

সেই ছুরিওয়ালাদের একজন একটি ঘুমন্ত লোককে ধাক্কা দিয়ে বললে, এই, ওঠ। টাকা—পয়সা কী আছে বার কর।

লোকটি চোখ মেলেই চেঁচিয়ে উঠলো, ডাকাত! ডাকাত!

ছুরিওয়ালাটি তার মুখে মারলো এক ঘুঁষি।

এবারে কামরার মধ্যে চ্যাঁচামেচি, কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেল। কেউ কেউ ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বলতে লাগলো, হে ভগবান, এ কী হলো! মেরে ফেলবে, ডাকাতরা মেরে ফেলবে!

রিভলভারধারী ডাকাতটি ধমক দিয়ে বললো, কেউ গোলমাল করবে না, চুপ! যার যা আছে সব দিয়ে দিলে কেউ প্রাণে মরবে না।

একজন মহিলা আগেই তাঁর গলা থেকে হার খুলে দিলেন।

ছুরিওয়ালা একজন রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞেস করলো, এটা সোনার?

মহিলাটি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, তা তো জানি না বাবা!

ছুরিওয়ালা ঠোঁট বেঁকিয়ে বললো, নিজের গলার হার পরেছেন, জানেন না সেটা সোনার কিনা! দেখি, ব্যাগের মধ্যে কত টাকা আছে?

রিভলভারধারী ঘুরে ঘুরে পাহারা দিতে লাগলো। আর ছুরিওয়ালা দু’জন লোকদের কাছ থেকে টাকা—পয়সা আর গয়না—টয়না নিয়ে ভরতে লাগলো একটা থলিতে।

একজন বুড়ো লোক ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠে বললেন, আমার মেয়ের বিয়ের জন্য গয়না গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমার মেয়ের বিয়ে হবে না। প্রভিডেন্ট ফান্ডের সব টাকা আজই তুলে এনেছি, আমায় ছেড়ে দাও!

ডাকাতরা তাকেও দয়া করলো না, জোর করে কেড়ে নিল সব।

এত গোলমাল, কান্নাকাটির মধ্যেও একজন লোক অঘোরে ঘুমোচ্ছে। জানালার কাছে হেলান দিয়ে আছে মাথা, কোলের ওপর একটা ইংরেজি ডিটেকটিভ বই খোলা। লোকটির বয়েস হবে চুয়াল্লিশ—পঁয়তাল্লিশ, প্যান্ট আর নীল হাওয়াই শার্ট—পরা।

একজন ছুরিওয়ালা তার কাছে এসে বললো, এটা এখনো ভূতের মতন ঘুমোচ্ছে!

হাঁটু দিয়ে একটা ধাক্কা মেরে বললো, এই গাধা, ওঠ! কী আছে, বার কর।

ঘুমন্ত লোকটি স্প্রিংয়ের মতন লাফিয়ে উঠে বিরাট জোরে একটা ঘুঁষি কষালো সেই ডাকাতটির মুখে। এত জোর ঘুঁষি সে জীবনে খায়নি। দেয়ালে তার মাথা ঠুকে গেল, তারপর মেঝেতে পড়ে গিয়েই অজ্ঞান!

নীল শার্ট—পরা লোকটি সঙ্গে সঙ্গে তার ছুরিটা তুলে নিয়ে বললো, আপনারা কেউ ভয় পাবেন না, ওই রিভলভারটা খেলনা রিভলভার। ও কিচ্ছু করতে পারবে না।

রিভলভারধারী হিংস্র মুখ করে বললো, খেলনা? দেখবি, দেখবি, তোকে শেষ করে দেবো?

এই বলতে বলতে সে দরজার দিকে সরে গেল, তারপর এক লাফ মারলো চলন্ত ট্রেন থেকে।

বাকি রইলো একজন ছুরিওয়ালা। সে বেশ ভ্যাকাচ্যাকা খেয়ে গেছে। এক হাতে উঁচু করে আছে ছুরিটা।

নীল জামা—পরা লোকটি তার দিকে এগোতে এগোতে বললো, লড়বি আমার সঙ্গে? আয়, লড়বি আয়। আমার নাম মানিক ঘোষ, আমার সঙ্গে লড়তে পারিস তো বুঝবো তোর হিম্মৎ।

মানিক ঘোষের স্বাস্থ্য ভালো। সেই তুলনায় ছুরিওয়ালা ডাকাতটা রোগা—প্যাঁকলা। তার হাত কাঁপছে।

সে লড়াই করার কোনো চেষ্টাই করলো না। অন্য দরজার দিকে ছুটে গিয়ে পড়ি—মরি করে দিল এক লাফ!

রেললাইনটা এখানে বেশ উঁচু। জানলা দিয়ে দেখা গেল সেই ডাকাতটা এবড়ো—খেবড়ো পাথরের উপর দিয়ে গড়াচ্ছে। হাত—পা কিছু একটা ভাঙবে নিশ্চয়ই।

নীল শার্ট পরা লোকটা বললো, অন্য ছেলেটাকে ধরে রাখুন, ওকে পালাতে দেবেন না। ধরুন, ধরুন!

কামরার যে—সব লোক এতক্ষণ ভয়ে শুকনো কাঠ হয়ে ছিল, তাদেরই মধ্যে তিন—চার জন এখন ঝাঁপিয়ে পড়লো সেই লোকটার ওপর।

তাকে এমন চড়—চাপড় মারতে লাগলো যে তাতেই তার জ্ঞান ফিরে এলো।

একটু আগে ছিল চ্যাঁচামেচি, কান্নাকাটি। এখন অন্যরকম শোরগোল শুরু হয়ে গেল। ডাকাতদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া গেল এত সহজে? কেউ যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। টাকা—পয়সা—গয়নার থলে দুটোও ওরা ফেলে গেছে!

নীল শার্ট—পরা মানিক ঘোষ নামের লোকটি যেন সিনেমার নায়ক। তাকে ঘিরে ধরলো সবাই। যে—বুড়ো ভদ্রলোক মেয়ের বিয়ের গয়নার কথা বলেছিলেন, তিনি মানিক ঘোষের গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, বাবা, তুমি ভগবান! তুমি আমাকে বাঁচালে, আমার মেয়েকে বাঁচালে!

মানিক ঘোষ লজ্জা পেয়ে বললে, এ কী বলছেন! আমি ভগবান হতে যাবো কেন? আমি সাধারণ মানুষ!

অন্য একজন বললো, আপনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের বাঁচালেন। যদি আগেই আপনাকে ছুরি মেরে দিত!

আর একজন জিজ্ঞেস করলো, দাদা, আপনি কী করে বুঝলেন যে ওটা খেলনা রিভলভার ছিল?

মানিক ঘোষ বললো, দেখলেই তো বোঝা যায়। আপনারাও তো ছেলেমেয়েদের জন্য খেলনা বন্দুক—পিস্তল কিনে দেন, সেগুলো ভালো করে দেখেন না?

বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, দেখে বোঝা খুব শক্ত। বাইচান্স যদি আসল হতো?

মানিক ঘোষ বললো, তাহলে আর কী হতো, বড়জোর গুলি চালাতো আমার দিকে। গুলি চালালেই যে ঠিক লাগাতে পারতো, তারও কোনো মানে নেই। এর আগে একবার আমেদপুর বাজার থেকে ফিরছি সন্ধেবেলা, এক ব্যাটা আমার দিকে গুলি চালালো। হাতে একদম টিপ নেই। আমি এখানে, গুলিটা চলে গেল দু’হাত দূর দিয়ে!

একজন জিজ্ঞেস করলো, আগেও একবার গুলি চালিয়েছিল আপনার দিকে? দাদা, আপনি কি পুলিশ নাকি?

মানিক ঘোষ বললো, না, না, পুলিশ হতে যাবো কোন দুঃখে? আমি ডিমের ব্যবসা করি।

লোকটি বললো, না, অত জোরে ঘুঁষি মারলেন তো, তাই জিজ্ঞেস করছি!

মানিক ঘোষ বললো, পাড়ার ক্লাবে কিছুদিন বক্সিং শিখেছি। ডিমের ব্যবসা করলে কি বক্সিং শেখা যায় না?

বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, গুলিগোলার শব্দ শুনলেই তো প্রাণ উড়ে যায়!

মানিক ঘোষ বললো, আজকাল যা দিনকাল পড়েছে, গুলিগোলার শব্দ তো শুনতেই হবে। অত ভয় পেলে কি চলে দাদু!

তিনজন লোক ধরা—পড়া ডাকাতটিকে মাটিতে শুইয়ে তার বুকের ওপর পা দিয়ে চেপে রেখেছে।

সে একবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই কয়েকজন এগিয়ে এসে তাকে চড়—ঘুঁষি মারতে লাগলো।

মানিক ঘোষ বললো, দাঁড়ান, দাঁড়ান, অত মারবেন না। বাঙালিরা আগে কিছু করতে পারে না। চোর ধরা পড়লেই তারপর তাকে মারতে সবাই খুব ওস্তাদ। এ ছেলেটাকে নিয়ে এখন কী করা যায়?

তিন—চারজন একসঙ্গে বললো, সামনের স্টেশানে ট্রেন থামলে ওকে পুলিশের হতে তুলে দিতে হবে। পুলিশ ওকে ধরে খুব করে ঠ্যাঙালেই ওর দলের সন্ধান বলে দেবে।

অন্য একজন বললো, পুলিশ আজকাল কিছুই করে না। ঘুষ খেয়ে ছেড়ে দেবে!

আর একজন বললো, আজকাল যখন—তখন ডাকাতি! আর পারা যায় না। আমাদেরই উচিত ওকে শাস্তি দেওয়া।

মানিক ঘোষ জিজ্ঞেস করলো, কী শাস্তি দেবেন?

একজন বললো, মারতে মারতে মেরে ফেলুন না। একজন ডাকাত তো অন্তত কমবে।

মানিক ঘোষ বললো, কে মারবে, আমি? তারপর আমি যে খুনের দায়ে ধরা পড়বো!

সেই লোকটি বললো, তাহলে আমরা সবাই মিলে মারবো! কারুর নামে দোষ পড়বে না। ওকে খুন করাই উচিত।

মানিক ঘোষ বললো, ওরে বাবা, একেবারে খুন! আপনারা সবাই তাই চান?

অনেক লোক একসঙ্গে হ্যাঁ বলে উঠলো। দু’—তিনজন অবশ্য বললো, না, না, পুলিশে দেওয়াই ভালো। কিন্তু তাদের কথায় কেউ কান দিল না।

ডাকাতটা ডুকরে কেঁদে উঠে বললো, না, না আমায় খুন করবেন না। আপনাদের পায়ে পড়ছি। আর কোনোদিন এমন করবো না। আমি ভদ্দরলোকের ছেলে!

মানিক ঘোষ বললো, তবে ওর বিচার হোক আগে। ওকে ছেড়ে দিন। সবাই ঘিরে থাকলে ও পালাতে পারবে না!

ছেলেটা কামরার দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসলো! সবাই নিজের নিজের জায়গা ছেড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো চারপাশে। শুরু হলো বিচারসভা।

মানিক ঘোষ জিজ্ঞেস করলো, এই ভদ্দরলোকের ছেলে, তোর নাম কী?

ডাকাতটি বললো, জয় মুখার্জি।

মানিক ঘোষ অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললো, এ কী সত্যি কথা বলছে? এর এই নাম হতে পারে?

অনেকে মিলে একসঙ্গে বলে উঠলো, বানিয়েছে, বানিয়েছে! মুখার্জি না ছাই!

একজন বললো, কোনো মুখার্জি বাড়ির ছেলে এই কাজ করতে পারে না।

ডাকাতটি আর্তগলায় বলে উঠলো, মা কালীর দিব্যি বলছি, বিশ্বাস করুন। আমার নাম জয় মুখার্জি। আমার বাবার নাম রামনাথ মুখার্জি।

বাড়ি কোথায় তোর?

সোদপুর।

শিয়ালদা লাইনের ছেলে হাওড়া লাইনে ডাকাতি করতে এসেছিস? কবে থেকে এই কাজ শুরু করেছিস?

এই প্রথম!

সবাই বলে এই প্রথম!

আমি কলেজে পড়তাম! সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত পড়েছি।

কলেজে—পড়া ডাকাত, অ্যাঁ। কলেজে—পড়া ভদ্রলোকের ছেলে হয়ে তুই এই কাজ শুরু করলি কেন?

বাবার খুব অসুখ। দাদা অন্য জায়গায় থাকে, কিছু সাহায্য করে না। মা সব সময় কাঁদে। বাবার চিকিৎসার পয়সাও নেই, তাই একজন বললো, এ কাজে—

যে বললো, সেও কলেজে—পড়া?

হ্যাঁ।

মানিক ঘোষ মুখ ফিরিয়ে অন্য যাত্রীদের জিজ্ঞেস করলো, আপনাদের কী মনে হয়, সত্যি কথা বলছে?

কেউ এক কথায় ঠিক উত্তর দিল না। নানা জনের নানা মত। হতেও পারে কলেজে—পড়া। ছেলেটা স স করে কথা বলছে না।

মানিক ঘোষ বললো, কয়েকটা কলেজে—পড়া ছেলে একটা খেলনা পিস্তল আর দুটো সামান্য ছুরি জোগাড় করে ভাবলো, ডাকাতি করবে। ডাকাতি করা এত সোজা? খুব সহজে টাকা রোজগার করা যায়। এত সোজা হয়ে গেছে, কারণ আমরা সবাই ভীতু! তাই না?

আবার সে ডাকাতটিকে জিজ্ঞেস করলো, যখন এ কাজে এলি, তখন ভাবিসনি যে ধরা পড়লে কী হবে? খবরের কাগজে পড়িসনি যে গ্রামের দিকে ডাকাতরা ধরা পড়লে লোকে তাদের আর পুলিশে দেয় না, নিজেরাই মেরে ফেলে!

ছেলেটি চুপ করে রইলো।

মানিক ঘোষ আবার বললো, মনে কর, তুই এই কামরার একজন যাত্রী, সঙ্গে তোর বাবা রয়েছে, এই বুড়ো ভদ্রলোকের মতন। তোর বাবা মেয়ের বিয়ের জন্য গয়না কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রভিডেন্ট ফান্ডের সব টাকা তুলে নিয়ে সঙ্গে রেখেছেন। এমন সময় ডাকাত উঠলো। সব কেড়ে নিল। তারপর ডাকাতরা হঠাৎ ধরা পড়ে গেল। তখন যাত্রী হিসেবে তোর কী মনে হতো? তুই ডাকাতদের কী শাস্তি দিতে চাইতিস?

ছেলেটি এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। জামার হাতা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললো, আপনারা আমাকে মেরেই ফেলুন। হ্যাঁ, মেরে ফেলুন। আমার বাবা জানতে পারলে লজ্জায়—দুঃখে আত্মহত্যা করবেন। আমার মা… তার চেয়ে আমার মরে যাওয়াই ভালো!

মানিক ঘোষ বললো, এতক্ষণ ও সত্যি কথা বলেছে কিনা জানি না, কিন্তু এবার সত্যি বলেছে। ও যখন নিজেই মরতে চাইছে, তখন ওর আত্মসম্মান জ্ঞান আছে। তার মানে এটাই ওর প্রথমবার। তাহলে ওকে ছেড়ে দেওয়াই উচিত!

কাছাকাছি লোকেরা কপালে ভুরু তুলে বললো, বলেন কী দাদা? ওকে ছেড়ে দেবো, কিছুতেই না।

মানিক ঘোষ বললো, ধরা পড়ে ওর শিক্ষা হয়ে গেছে। ভদ্দরলোকের ছেলে, আর এ পথে আসবে না!

লোকেরা বলল, কিচ্ছু বিশ্বাস নেই, কিচ্ছু বিশ্বাস নেই। আবার ঠিক এ লাইন ধরবে। একটা অন্তত ডাকাতকে মেরে আমরা হাতের সুখ করে নিই!

মানিক ঘোষ বললো, ঠিক আছে, মারুন তাহলে। আপনাদের ইচ্ছে হয় তো মারুন। আমি ওসবের মধ্যে নেই।

বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি অনেকক্ষণ থেকেই গুনগুন করে কী যেন বলছিলেন, কেউ পাত্তা দেয়নি। এবার তিনি গলা চড়িয়ে বললেন, আমাদের জিনিসপত্তরগুলো কী হবে? ফেরত পাবো না? এইবার দিয়ে দাও না ভাই!

থলে দুটো একজন ভারিক্কি চেহারার লোক চেপে ধরে আছে। সে বললো, কী করে বোঝা যাবে কোন জিনিসটা কার? আর কার কত টাকা ছিল?

একজন টাক—মাথা লোক বললো, আমার তিনশো পঞ্চাশ টাকা ছিল।

তার পাশের লোকটি বললো, সে কি মশাই, আমি যে দেখলুম, আপনার মোটে তিনখানা পঞ্চাশ টাকার নোট ছিল?

আবার শুরু হয়ে গেল হইচই।

একজন মহিলা মানিক ঘোষের কাছে এসে কাকুতি—মিনতি করে বললেন, বাবা, তুমি এই ভার নাও। তুমি আমাদের বাঁচিয়েছো, তোমার কথা সবাই মানবে!

বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ ভাই, তুমিই বিচার করে যার যার জিনিস দিয়ে দাও।

মানিক ঘোষ থলি—দুটো হাতে নিয়ে খুলে দেখলো।

আপন মনে বললো, টাকা—পয়সা আর গয়নাগাঁটি মন্দ পড়েনি দেখছি। এগুলো তাহলে আমার হতে তুলে দিচ্ছেন!

উঠে দাঁড়িয়ে সে হঠাৎ ছুরিটা বাগিয়ে বাজখাঁই গলায় বললো, খবরদার! কেউ আমার কাছে আসবে না। এলেই গলা কেটে দেবো। আমাকে চেনো না তোমরা। মানিক ঘোষের নাম শোনোনি? এ লাইনে বিখ্যাত ডাকাত মানিক ঘোষের নাম কে না জানে!

এক হাতে থলি—দুটো ধরে, অন্য হাতে ছুরি—দুটো তুলে সে এক—পা এক—পা করে সরে যেতে লাগলো দরজার দিকে।

সবাই স্তম্ভিত। কেউ টুঁ শব্দ করছে না।

মানিক ঘোষ বললো, রক্ষকই ভক্ষক, তাই না? চিনতে পারোনি আমায়। তোমরা ওই পুঁচকে ডাকাতটাকে মেরে হাতের সুখ করতে চাও তো করো। আমি এগুলো নিয়ে চললুম।

ট্রেনের গতি কমে এসেছে। কাছেই স্টেশান। এখান থেকে অনায়াসে লাফিয়ে নেমে পড়া যায়।

দরজার কাছে এসে মানিক ঘোষ বললো, কী আমাকে বাধা দেবার সাহস হলো না তো কারুর? সে মুরোদ নেই! আমি ডাকাত ধরে দিলুম, তারপর তোমরা তাকে মারার জন্য ব্যস্ত। মারো তাহলে? আমি এগুলো নিয়ে চললুম।

গলা ফাটিয়ে সে হা—হা করে হেসে উঠলো।

সকল অধ্যায়

১. ছোটমামার ব্যাপারটা
২. কেন দেখা দিল না
৩. হীরে কি গাছে ফলে
৪. ঘোড়ার ডাক্তার
৫. হীরে উধাও রহস্য
৬. জলের তলার রাজপুরী
৭. মাসতুতো ভাই
৮. রাত্তির বেলা, একা একা
৯. তেপান্তর
১০. নীল মানুষের মন খারাপ
১১. অমলের পাখি
১২. ভয়ের পুকুর
১৩. চার নম্বর ডাকাত
১৪. আয়না নয়
১৫. রাজপুত্তুরের অসুখ
১৬. কাঞ্চনের দুঃখ
১৭. রাজকুমার
১৮. সুবর্ণরেখার তীরে
১৯. একদম রূপকথা
২০. বিশ্বমামার ম্যাজিক
২১. ভালোবাসা
২২. সুশীল মোটেই সুবোধ বালক নয়
২৩. রবির কুকুর
২৪. ইংরিজির স্যার
২৫. নীল মানুষের পরাজয়
২৬. নিউইয়র্কের সাদা ভল্লুক
২৭. বেণী লস্করের মুন্ডু
২৮. মাঝরাতে অতিথি
২৯. রণজয়ের শহর অভিযান
৩০. কাকাবাবু বনাম মূর্তিচোর
৩১. ছোড়দির বড়দি
৩২. আজব লড়াই
৩৩. নীলমানুষ ও ছোট্ট বন্ধু
৩৪. মেঘচোর
৩৫. হাতিচোর
৩৬. বন্দিনী
৩৭. পৃথা ও চন্দ্র দেবতা
৩৮. বিশুর কাণ্ড
৩৯. ছবি পাহাড়
৪০. কিউই
৪১. মহিষাসুর
৪২. শালিক ও ছোটকাকা
৪৩. ছুটি
৪৪. মহাকালের লিখন
৪৫. তৃতীয় চক্ষু
৪৬. পার্বতীপুরের রাজকুমার
৪৭. পঞ্চম শক্তি
৪৮. জোড়া সাপ
৪৯. সাতজনের তিনজন
৫০. আবার নীল মানুষ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন