মাসতুতো ভাই

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সাত বছর বয়সে শিবু হঠাৎ দুটো নতুন জিনিস জানতে পারলো। হনলুলুতে তার এক মাসি, মেসো আর মাসতুতো ভাই থাকতো, তারা কয়েকদিন আগে কলকাতায় এসেছে। শিবু জানতোই না, তার কোনো মাসতুতো ভাই আছে, আর হনলুলু নামের কোনো জায়গার নামও সে আগে শোনেনি।

একই দিনে দুটো জিনিস জেনে ফেলা দারুণ ব্যাপার। হঠাৎ এরকম এক—একটা নতুন জিনিস জানা হয়ে যায়। যেমন, মাত্র দু’দিন আগেই সে জানতে পেরেছে যে, জিরাফ কক্ষনো ডাকে না, মুখ দিয়ে কোনো শব্দই করতে পারে না! ব্যাপারটা জেনে সে একেবারে আনন্দের চোটে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। কি অদ্ভুত কাণ্ড? বাঘ, সিংহ, শেয়াল, ঘোড়া, গাধা সবাই ডাকতে পারে আর জিরাফরা পারে না। সব জিরাফই বোবা! এই কথাটা কেউ তাকে আগে বলেনি। মুড়ি খাবার ঠোঙায় একটা জিরাফের ছবি দেখে সে তার নিচে লেখা কথাগুলো বানান করে পড়তে গিয়েই তো সব জেনে ফেললো! তাদের পাশের বাড়ির একটা ছেলে বোবা। সে অবশ্য মুখ দিয়ে শব্দ করতে পারে কিন্তু কথা বলতে পারে না। একটু পরে জিরাফদের জন্য দুঃখও হয়েছিল তার।

হনলুলুতে যে শিবুর মাসিমা থাকেন, তাও সে কখনো শোনেনি আগে। শিবু যখন জন্মায়নি, তারও অনেক দিন আগে ওই মাসিমা জাহাজে চেপে অন্য দেশে চলে গিয়েছিলেন। তারপর তাঁর কথা বোধহয় সবাই ভুলেই গিয়েছিল! হনলুলু আবার কি অদ্ভুত নাম! এরকম কোনো জায়গার নাম হয় নাকি? হনলুলু কথাটা বার বার বলতে বলতে শিবু হাসতে লাগলো।

মা বললেন, পাগলের মতন হাসছিস কেন একা কো? বোকা ছেলে নাকি?

শিবু তবু সারা বাড়িতে দৌড়ে দৌড়ে হনলুলু বলে চ্যাঁচাতে লাগলো। এক একটা নাম একেবারে মাথায় গেঁথে যায়। সারাদিন সে একবারও ওই নামটা ভুলতে পারল না।

পরের দিন রবিবার, বাবা আর মায়ের সঙ্গে শিবু গেল তার মাসির বাড়ি বেড়াতে। মাসিরা বাড়ি ভাড়া করেছেন সেই যোধপুর পার্কে। উল্টোডাঙা থেকে শিবুরা উঠলো নয় নম্বর বাসে। তারপর বাস চলছে তো চলছেই। এতদূরে শিবু কখনো বেড়াতে যায়নি। তারপর এক সময় তো বাস থেকে নামলো। চওড়া রাস্তা, তার দু’পাশে সুন্দর সুন্দর বাড়ি। বাড়িগুলোর কত রকম রঙ। শিবুদের পাড়ায় প্রায় সব বাড়িই এক রঙ।

শিবুর মেসোমশাই বিরাট লম্বা—চওড়া জোয়ান। ঠিক ডাকাত সর্দারের মতন চেহারা। গায়ে একটা টকটকে লাল রঙের জামা। উনি এক সময় জাহাজের খালাসি ছিলেন, তারপর আমেরিকায় খাবারের দোকান করেছিলেন। এখন অনেক টাকা নিয়ে ফিরেছেন, কলকাতায় কিসের যেন ব্যবসা করবেন। এসব কথা শিবু বাসে আসতে আসতে মা—বাবার মুখে শুনেছে।

মেসোমশাই মা—বাবাকে চিনতে পারলেন না। দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কোথা থেকে আসছেন?

বাবা একটু ফ্যাকাসে ধরনের হাসলেন। তারপর বললেন, কি ব্রাদার, চিনতে পারছো না? আমি তোমার বড় ভায়রা হই! আমার নাম ব্রজেন।

মেসোমশাই এবার একটু ভুরু কুঁচকে বললেন, ভায়রা, মানে? ও, ব্রাদার—ইন—ল? হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে! আপনি ব্রজেনদা! অনেক রোগা হয়ে গেছেন…

বাবা বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আর এই যে ইনি তোমার ওয়াইফের বড় বোন। মা এমনিই লাজুক স্বভাবের। আড়ষ্ট হয়ে আছেন। শিবু ওয়াইফ কথাটার মানে জানে। ওয়াইফ মানে বউ। বাবার বউমা। মেসোমশাইয়ের ওয়াইফ মাসিমা।

মেসোমশাই বললেন, ও, আসুন আসুন, ভেতরে আসুন। চিনতেই পারিনি। কতকাল পরে দেখা!

ওরা বসবার ঘরে আসবার পর মেসোমশাই কাকে যেন লোটি লোটি বলে ডাকলেন। কে যেন ভেতর থেকে উত্তর দিল, ইয়েস কাম ইন। তারপর চটি ফটফট করে একজন মেমসাহেব এসে ঢুকলেন ঘরে। গায়ের রঙ তত ফর্সা না হলেও মেম—সাহেবদের মতন ছোটো ছোটো চুল আর গাউন পরা।

তিনি ঘরে এসে মাকে দেখেই বলনে, ওমা, ছোড়দি! জামাইবাবু! ইস ছোড়দি, তোরা দু’জনেই কি রোগা হয়ে গেছিস রে!

ইনিই শিবুর মাসিমা। শিবুর একটু ভয় ভয় করতে লাগলো! মেম—সাহেবদের মতন গাউন পরা কারুকে দেখলেই তার এরকম ভয় হয়। তাদের পাড়ার একটা কে জি ইস্কুলে (শিবু অবশ্য সেখানে পড়ে না) এরকম একজন মাস্টারনী আছেন। খুব রাগী।

মাসির নাম আগে ছিল লতিকা। এখন হয়ে গেছে লোটি। মা কিন্তু লতিকা বলেই ডাকছেন। গাউন পরলেও মাসি মোটেই রাগী নন। একসঙ্গে অনেক কথা বলতে শুরু করলেন। কতসব পুরনো কথা। মায়ের ইঙ্গিত পেয়ে শিবু মাসিকে প্রণাম করতেই শিবুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ইস দিদি, তোর কত বড় ছেলে হয়ে গেছে, আর আমি তাকে চোখেই দেখিনি।

মা বললেন, তোর ছেলে কোথায়? তোর ছেলেকে তো আমি দেখিনি। শিবুও খুব উৎসাহ করে এসেছে ভাইয়ের সঙ্গে খেলা করবে বলে।

মাসি বললেন, হ্যাঁ, আমার ছেলেকে ডাকছি! আসবে এক্ষুনি। দাঁড়া, আমি তোদের জন্য—

মা বাধা দিয়ে বললেন, না না, আমাদের জন্য তোকে ব্যস্ত হতে হবে না। আমি কি পর যে আমাকে খাতির—যত্ন করবি।

মাসি বললেন, শিবুর জন্য একটু কেক নিয়ে আসি। এত কেক আর প্যাসট্রি সঙ্গে এনেছি, খাবার লোক নেই। আর যা গরম এ দেশে!

মাসি উঠে গেলেন। মেসোমশাই আগেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন কি যেন একটা কাজে। মা, বাবা আর শিবু চুপ করে বসে রইলো। ঘর ভর্তি কত সব সুন্দর সুন্দর জিনিস। কত খেলনা। ক্যামেরা, আরও কত রকম যন্ত্রপাতি। সব এখনো সাজানো হয়নি, অগোছালো হয়ে পড়ে আছে।

মেসোমশাই কি রকম লাল টকটকে জামা পরেছিলেন আর মাসিমা সোনালি রঙের গাউন। আর তার বাবা পরে আছেন খাকি প্যান্ট আর সাদা শার্ট—ওই পোশাক পরে বাবা রোজ কারখানায় যান। আজ বাবা সাদা ধুতি পরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চটি জুতোটা ছিঁড়ে গেছে বলে ধুতি পরা হলো না। ধুতির সঙ্গে তো কেউ আর বুট জুতো পরে না। মা পরে আছেন সাধারণ একটা শাড়ি, একটু ময়লা। শিবুর হাফ প্যান্টে একটা বোতাম নেই, তাই সব সময় খুব কায়দা করে পা বেঁকিয়ে বসতে হচ্ছে।

শিবুর মামা একই কারখানায় কাজ করেন বাবার সঙ্গে। সেই মামাই খবর দিয়েছিলেন, মাসিরা আসছেন কলকাতায়, টেলিগ্রাম করেছেন। মামা কারখানা থেকে সাত দিন ছুটি নিয়ে বাড়ি ভাড়াটাড়ার ব্যবস্থা করে রেখেছেন। শিবু ভেবেছিল মামাকেও দেখতে পাবে এখানে।

একজন ঝি প্লেট ভর্তি কেক নিয়ে এলো। তারপর এলেন মাসি, তাঁর সঙ্গে শিবুরই বয়েসি একটি ছেলে। ইংরেজী গল্পের বইতে ছেলেদের যে রকম ছবি আঁকা থাকে, ওকেও ঠিক সেই রকম দেখতে। একটা নীল রঙের ফুল প্যান্ট পরে আছে, আর একটা তুলো তুলো মতন হলুদ গেঞ্জি, মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল।

মাসি বললেন, রণি, এরা তোমার আংকল আর আন্টি হন, প্রণাম করো।

ছেলেটা একটু বেঁকে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মা তাড়াতাড়ি বললেন, থাক থাক, প্রণাম করতে হবে না! বাঃ, কি সুন্দর ছেলে! এর কি নাম বললি লতিকা।

মাসি হেসে ফেলে বললেন, আগে ওর নাম রেখেছিলাম রঞ্জিত। কিন্তু ওখানকার কোনো লোকই ওই নাম উচ্চারণ করতে পারে না। ওর স্কুলের বন্ধুরা বলতো রণ কিংবা রণি। সেই থেকে ওই নামই হয়ে গেছে।

মা আঁচলের গিঁট খুলে একটা রুপোর টাকা বার করে সেটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এই নাও রণি, তুমি কিছু কিনে—টিনে খেয়ো—

মাসি বললেন, একি, এসব আবার কি—

মা লজ্জা—লজ্জা মুখ করে বললেন, আহা, তোর ছেলেকে তো কখনো কিছু দিইনি—কিই বা দেবো—

রণি টাকাটা হাতে নিয়ে কৌতূহলের সঙ্গে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলো। মাসি বললেন, রণি, এই যে শিবু তোমার ভাই হয়, এর সঙ্গে খেলা করো না—

রণি শিবুর দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত গলায় বললো, হ্যালো—ও—

একটু বাদেই শিবু বুঝতে পারলো, রণি একটাও বাংলা কথা বলতে পারে না। সে একেবারে নিরশ হয়ে পড়লো। সে ভেবেছিল, সে একটা ভাই পাবে। কিন্তু ওর সঙ্গে ইংরেজীতে কথা বলবে কি করে?

মা বললে, লতিকা, তুই ছেলেকে বাংলা শেখাসনি?

মাসি বললেন, ও সব বাংলা বুঝতে পারে। তুই যা বলবি ঠিক শুনবে। কিন্তু বলতে পারে না। বলে না তো কখনো তা হলে ও এখানে ইস্কুলে—টিস্কুলে পড়বে কি করে?

কেন, এখানেও তো এমন ইস্কুল আছে শুনেছি, যেখানে বাংলা না শিখলেও চলে। ইংরেজী তো ও ভালই জানে।

মা চুপ করে গেলেন। তিনি অতশত খবর রাখেন না। শিবু তার এই মাসতুতো ভাইয়ের দিকে দারুণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এটাও কি অদ্ভুত জিনিস। বাংলা বুঝতে পারে কিন্তু বলতে পারে না। এরকমও থাকে কেউ। সে আজ আর একটা নতুন জিনিস শিখলো। জিরাফের থেকে কম আশ্চর্য জিনিস নয়।

রণি কারুর সঙ্গে কোনো কথা না বলে বিরাট একটা খেলনা রেলগাড়ি নিয়ে বসে গেল মেঝেতে। শিবুকে সে ডাকলো না। শিবুও কাছে গেল না।

মাসি শুরু করলেন আমেরিকার গল্প। ওরা শুধু হনলুলুতে নয়, শিকাগো আর ফিলাডেলফিয়াতেও ছিলেন এক সময়। মাসি বললেন, ওঃ, কি বড়লোকের দেশ! যখন যা চাইবে তাই পাবে। নিজের হাতে বাসন মাজতে পর্যন্ত হয় না। যন্ত্রের মধ্যে থালা বাসন ফেলে দিলেই ঝকঝকে মাজা হয়ে বেরিয়ে আসে।

মা চোখ বড় বড় করে শুনছেন। এক—একবার জিজ্ঞেস করছেন, হ্যাঁরে, সত্যিই ওদের একশো তলা বাড়ি হয়?

মাসি আরো উৎসাহে সে কথা বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ বাবা বললেন, অন্য দেশের লোকেরা যত বেশি বড়লোক হচ্ছে আমরা ততই গরিব হয়ে যাচ্ছি।

মাসি বললেন, মোটেই তা না। আমাদের দেশের লোক কাজ করে না, কাজ দিলেও করতে চায় না, তাই এত গরিব।

বাবা বললেন, আমি সকাল আটটায় কারখানায় যাই, সন্ধে সাতটার পর ফিরি। জীবনে আর কোনো সাধ—আহ্লাদ নেই। আর কত বেশি কাজ করবো বলো!

মাসি বললেন, এই দেখুন না, আমরা যেই দমদম এয়ার পোর্টে নামলাম, অমনি একগাদা ভিখিরি এসে ছেঁকে ধরলো। ভিক্ষে না করে এরা কাজ করতে পারে না?

বাবা এবার হেসে ফেলে বললেন, লতিকা, তুমি এই দশ বছর ও—দেশে থেকেই খাঁটি মেম—সাহেব বনে গেছ দেখছি। তা তোমরা অত আরামের দেশ ছেড়ে এখানে ফিরে এলে কেন?

মাসি বললেন, কি জানি, ওর কি ব্যবসা—ট্যাবসার ব্যাপার আছে। তা ছাড়া আজকাল নাকি কেউই আর নিজের দেশ ছাড়া অন্য দেশে কিছু সুবিধে করতে পারবে না।

মা বললেন, এলি তো, দেখবি অসুবিধে। যখন—তখন আলো নেই, জল নেই, খাবার নেই—

মাসি বললেন, এর মধ্যেই টের পাচ্ছি।

রণি তার খেলনা ট্রেনে দম দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। সেটা ঝক ঝক করতে করতে এগিয়ে হঠাৎ শিবুর পায়ে একটা ধাক্কা মারলো। শিবু চমকে পা তুলে নিল সোফার ওপরে। রণি হেসে উঠলো। সেই সঙ্গে ইংরেজীতে কত কি যে বললো, তার এক বর্ণও বুঝতে পারলো না শিবু। নিজের মাসতুতো ভাইয়ের কথা বুঝতে না পারলে কি যে মন খারাপ হয়ে যায়! তার মনে পড়ে, ওদের পাশের বাড়ির বোবা ছেলেটির কথা। তার কথাও শিবু বুঝতে পারে না।

মেসোমশাই এই সময় আবার এ ঘরে এলেন। একটুক্ষণ বসে কথা বলতে লাগলেন মা আর বাবার সঙ্গে। শিবুর সঙ্গে তিনি একটি কথাও বললেন না।

মাসি এক সময় বললেন, রণি, তোমার ভাইকে নিয়ে খেলতে যাও না! তোমার ঘরে যাও!

রণি শিবুর দিকে এক আঙুলে ইশারা করে বললো, কাম, কাম ওভার হিয়ার—

শিবুর যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু অন্যরা সবাই ওকে যাও, যাও না, বলতে লাগলেন। তাই শিবুকে যেতেই হলো।

ঘর থেকে বাইরে আসার পর রণি তাকে তড়বড় করে কি সব বললো ইংরেজীতে। শিবু বুঝতে পারলো না যদিও, কিন্তু সেও যে একটু ইংরেজী জানে তার প্রমাণ দেবার জন্য বললো, মাই নেম ইজ শিবশঙ্কর রায়—

রণি তাই শুনে শিবুর পেটে মারলো এক ঘুষি। ব্যথা পাওয়ার চেয়েও শিবু বেশি অবাক হয়ে গেল। হঠাৎ ওকে মারছে কেন? ইচ্ছে করলে শিবুও উল্টে একখানা মারতে পারে। তাদের পাড়ার নিমাই, তপন, বাবলু তার সঙ্গে মারামারিতে পারে না। কিন্তু বাইরে থেকে নতুন এসেছে বলেই শিবু তার মাসতুতো ভাইকে কিছু বললো না। ছেলেটা যেন কি রকম পাগলা—পাগলা। ইংরেজীতে যারা কথা বলে তারা বুঝি এইরকম হয়!

রণি শিবুর মায়ের দেওয়া রুপোর টাকাটা চাকার মতন গড়িয়ে দিল মাটিতে। সেটা অনেক দূর চলে গেল। দৌড়ে কুড়িয়ে নিয়ে রণি আবার গড়িয়ে দিল খুব জোরে।

শিবু ভাবলো, টাকাটা যদি হারিয়ে যায়? তার মা কোনোদিন তাকে আস্ত একটা টাকা দেয়নি। মাঝে মাঝে সে শুনতে পায় আট আনা, একটাকা বেশি খরচ করার জন্য বাবা আর মায়ের মধ্যে ঝগড়া হয়। মা কি তার থেকেও রণিকে বেশি ভালোবাসে যে এক টাকা দিয়ে দিলেন।

রণি টাকাটা নিয়ে খেলা করতে করতে বেশ মজা পেয়ে গেছে। একবার সে সেটা ছুঁড়ে দিল শিবুর দিকে। শিবু সেটা ধরে বসে রইলো। রণি দৌড়ে এসে শিবুর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে গড়িয়ে দিল অন্যদিকে।

কয়েকবার ছোঁড়াছুঁড়ি করতেই টাকাটা একবার গড়িয়ে গেল উঠোনের দিকে। সেখানে একটা নর্দমা আছে।

শিবু চেঁচিয়ে উঠল, পড়ে যাবে, পড়ে যাবে!

রণি হি—হি করে হাসছে।

টাকাটা নর্দমার মধ্যে ঢুকে গেছে। এখনো হয়তো আঙুল দিয়ে টেনে আনা যায়। শিবু টাকাটা তুলে আনতে যাচ্ছিল। এমন সময় মাসিমা সেখানে এসে পড়লেন।

তিনি বললেন, ওখানে কি করছ, শিবু?

শিবু বললো, রণি টাকাটা নর্দমায় ফেলে দিয়েছে। আমি তুলে আনছি!

মাসিমা তাড়াতাড়ি বললেন, এই এই, না না, হাত দিও না। ছেড়ে দাও। চলে এসো—

শিবু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ফিরে এলো। মাসিমা তার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, নোংরার মধ্যে কক্ষনো হাত দেবে না, বুঝলে। তাতে অসুখ করে। ভালো ছেলেরা নোংরায় হাত দেয় না। একটা টাকা গেছে যাক।

সেদিন বাড়ি ফিরতে বেশ দুপুর হয়ে গেল। বাড়ি ফেরার পথে বাবা—মাকে বললেন, ওদের সঙ্গে আমাদের আর মিলবে না, বুঝলে। তোমার বোন সাহেবদের দেশে এতদিন থেকে একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছে।

মা চুপ করে রইলেন।

বাড়ি ফিরে শিবু এক সময় মাকে চুপিচুপি বললে, জানো জানো মা, তুমি রণিকে যে টাকাটা দিয়েছিলে সেটা ও নর্দমায় ফেলে দিয়েছে।

মা একটু চমকে উঠে বললেন, কি বললি?

শিবু বললো, হ্যাঁ, আমি দেখেছি। রণি খেলতে খেলতে টাকাটা নর্দমায় ফেলে দিল, আর তোলেনি। মাসিমা তুলতে বারণ করলেন।

মা একটুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। একটা বড় নিশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, যাক গে! তুই এ কথাটা তোর বাবাকে বলিস না। মনে থাকবে তো? হঠাৎ বোকার মত বলে ফেলিস না যেন!

সেদিন শিবু আরও দুটো জিনিস শিখে গেল। যারা ইংরেজীতে কথা বলে, তারা টাকা—পয়সা নিয়ে খেলে। এক টাকা হারিয়ে ফেললেও তাদের কেউ বকে না। আর মা অনেক কথা বাবার কাছেও গোপন করে যান। মা যা যা জানেন, বাবা তার সব জানেন না।

সকল অধ্যায়

১. ছোটমামার ব্যাপারটা
২. কেন দেখা দিল না
৩. হীরে কি গাছে ফলে
৪. ঘোড়ার ডাক্তার
৫. হীরে উধাও রহস্য
৬. জলের তলার রাজপুরী
৭. মাসতুতো ভাই
৮. রাত্তির বেলা, একা একা
৯. তেপান্তর
১০. নীল মানুষের মন খারাপ
১১. অমলের পাখি
১২. ভয়ের পুকুর
১৩. চার নম্বর ডাকাত
১৪. আয়না নয়
১৫. রাজপুত্তুরের অসুখ
১৬. কাঞ্চনের দুঃখ
১৭. রাজকুমার
১৮. সুবর্ণরেখার তীরে
১৯. একদম রূপকথা
২০. বিশ্বমামার ম্যাজিক
২১. ভালোবাসা
২২. সুশীল মোটেই সুবোধ বালক নয়
২৩. রবির কুকুর
২৪. ইংরিজির স্যার
২৫. নীল মানুষের পরাজয়
২৬. নিউইয়র্কের সাদা ভল্লুক
২৭. বেণী লস্করের মুন্ডু
২৮. মাঝরাতে অতিথি
২৯. রণজয়ের শহর অভিযান
৩০. কাকাবাবু বনাম মূর্তিচোর
৩১. ছোড়দির বড়দি
৩২. আজব লড়াই
৩৩. নীলমানুষ ও ছোট্ট বন্ধু
৩৪. মেঘচোর
৩৫. হাতিচোর
৩৬. বন্দিনী
৩৭. পৃথা ও চন্দ্র দেবতা
৩৮. বিশুর কাণ্ড
৩৯. ছবি পাহাড়
৪০. কিউই
৪১. মহিষাসুর
৪২. শালিক ও ছোটকাকা
৪৩. ছুটি
৪৪. মহাকালের লিখন
৪৫. তৃতীয় চক্ষু
৪৬. পার্বতীপুরের রাজকুমার
৪৭. পঞ্চম শক্তি
৪৮. জোড়া সাপ
৪৯. সাতজনের তিনজন
৫০. আবার নীল মানুষ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন