বিশ্বমামা ও নকল ফুল

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বিশ্বমামা ও নকল ফুল

ঘরে ঢুকেই বিশ্বমামা বললেন, কীসের একটা সুন্দর গন্ধ পাচ্ছি। ছোটমাসি বললেন, সে কি তুই ফুলের গন্ধ চিনিস না? আমেরিকায় গিয়ে কি ফুলের গন্ধও ভুলে গেলি?

ঘরের এক পাশে একটা নিচু টেবিলের ওপর একটা ফুলদানিতে একগুচ্ছ ফুল রাখা আছে। সাদ, আর গোলাপি রং মেশা। ফুলদানিটার গায়েও সুন্দর ছবি আঁকা।

বিশ্বমামা ভুরু কুঁচকে বললেন, ফুলের এত তীব্র গন্ধ? তবে যে অনেকে বলে, আজকাল ফুলের গন্ধ খুব কমে গেছে। গোলাপ ফুলে গন্ধই থাকে না।

আমার দিকে ফিরে বিশ্বমামা জিগ্যেস করলেন, এগুলো কী ফুল রে নীলু?

এই রে, আমি বিপদে পড়ে গেলুম। আমি তো অত ফুল চিনি না। গোলাপ, গাঁদা আর জবা চিনতে পারি বড়জোর। ঘেটু’ বলে একটা ফুলের কথা গল্পের বইতে পড়েছি। কিন্তু সেটা কী রকম দেখতে, তা আমি জানি না।

আমার মুখের অবস্থা দেখেই বিশ্বমামা বুঝে গেলেন।

এবার আমার দাদার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, বিলু, তুই বলতে পারবি?

দাদা আমার থেকে অনেক চালাক।

সে বললে, ওগুলো কী ফুল নয়, তা আমি বলতে পারি। সূর্যমুখী নয়, রজনীগন্ধা নয়, চাপা ফুল নয়, কুমড়ো ফুল নয়।

ছোটমাসি বললেন, ধ্যাৎ! কুমড়ো ফুল কেউ ফুলদানিতে রাখে নাকি?

দাদা বললে, রাখলেই হয়। কুমড়ো ফুল বুঝি ফুল নয়?

ছোটমাসি বললেন, কুমড়ো ফুল ভাজা করে খায়। আজই খাওয়ার টেবিলে পাবি।

বিশ্বমামা বললেন, বাঃ, কুমড়ো ফুল ভাজা আমার খুব ফেভারিট। বিদেশে আজকাল এঁচোর আর পটল পর্যন্ত পাওয়া যায়। কিন্তু কুমড়ো ফুল কোত্থাও দেখিনি।

বিশ্বমামা তো সারা বিশ্ব টহল দিয়ে বেড়ান। অনেক দেশে তাঁকে বক্তৃতা দিতে হয়। প্রায়ই থাকেন না কলকাতায়। মাঝে-মাঝে যখন আসেন, তখন অনেক আত্মীয়দের বাড়িতে তাকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো হয়। ওঁর দুই ভাগ্নে হিসেবে নেমন্তন্ন জুটে যায় আমাদেরও।

আজ ছোটমাসির বাড়িতে নেমন্তন্ন।

সব চেনাশুনো বাড়ির মধ্যে ছোটমাসির বাড়ির নেমন্তন্নই সবচেয়ে বিখ্যাত।

পাঁচ রকমের মাছ আর তিন রকমের মাংস তো থাকবেই।

ছোটমাসি বললেন, আর কেউ এত সহজে গন্ধ পায় না, বিশ্ব ঠিক গন্ধ পাবেই। ছোটবেলা থেকেই ও এরকম। কত বড় নাক।

বিশ্বমামা নিজের লম্বা নাকটার ওপর হাত বুলিয়ে বললেন, আমি এক কিলোমিটার দূর থেকেও যে-কোনও জিনিসের গন্ধ পাই। এই গন্ধটা চেনা-চেনা লাগছে, কিন্তু এই ফুল আগে দেখিনি।

ফুলদানির পাশের সোফায় বসে পড়ে বিশ্বমামা ফুলের তোড়াটা ভালো করে দেখতে লাগলেন।

ছোটমেসো মুখের সামনে মেলে ধরে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। এবার কাগজটা সরিয়ে মুচকি হেসে বললেন, ওটা বিদেশি ফুল। বিশ্ব, তুমি তো অষ্ট্রেলিয়া ঘুরে এসেছ, সেখানে দেখোনি?

বিশ্বমামা বললেন, কোনও দেশে গেলেই কি সেখানকার সব ফুল দেখা যায়? অনেক জায়গায় ফুল দেখার সময়ই পাই না। এ ফুল এখানে কোথায় ফোটে? বেশ টাটকা দেখছি, এখনও শিশির লেগে আছে।

ছোটমেসো বললেন, হর্টিকালচার বাগানে ফোটে। আমাদের বাড়ির ছাদের টবেও ফোটে।

ছোটমাসি বললেন, মানিকতলায় একটা কারখানাতেও হয়।

বিশ্বমামা বললেন, কারখানায়? ভেতরে বাগান আছে বুঝি?

ছোটোমেসো হো-হো করে হেসে উঠলেন।

ছোটমাসিও হাসতে-হাসতে বললেন, আজ বিশ্বকে খুব ঠকানো গেছে। তুই বুঝতেই পারলি না, বিশ্ব, ওগুলো তো নকল ফুল।

আমি আর বিলুদা একসঙ্গে বলে উঠলুম, অ্যাঁ!

সত্যিই বোঝবার উপায় নেই। পরীক্ষা করার জন্য আমি একটা পাপড়ি নোখ দিয়ে চেপে ধরলুম। আসল ফুল হলে নোখের ধারে পাপড়িটা ছিঁড়ে যেত, এর কিছুই হল না।

জলের ফোঁটাগুলো পর্যন্ত নকল।

বিশ্বমামা তবু দমে না গিয়ে বললেন, ছোড়দি, তোমার এরকম অধঃপতন হয়েছে। তুমি নকল ফুল দিয়ে ঘর সাজাচ্ছ? ছি ছি!

ছোটমাসি বললেন, কেন, নকল ফুলের দোষ কী হল? আজকাল এমন চমৎকার ভাবে বানায়, আসল আর নকলের তফাৎ একটুও বোঝা যায় না।

তুই ও তো বুঝতে পারিসনি।

ছোটমেসো বললেন, ঘরের মধ্যে খানিকটা ফুল থাকলে ঘরটা বেশ উজ্জ্বল দেখায়। রোজ-রোজ আর টাটকা ফুল কোথায় পাচ্ছি বলো।

ছোটমাসি বললেন, টাটকা ফুল শুকিয়ে যায়, ফেলে দিতে হয়। ফুলদানির জল পালটাতে হয়, অনেক ঝামেলা। এ ফুলের তো জলও লাগে না। দেখতেও খুব সুন্দর।

আমি জিগ্যেস করলুম, নকল ফুলের তো গন্ধ থাকে না। এই ফুলে গন্ধ এল কী করে?

ছোটমাসি বললেন, আমার পারফিউমের শিশি থেকে রোজ দু-এক ছিটে দিয়ে দিই। সেই গন্ধই থাকে অনেকক্ষণ।

বিশ্বমামা বললেন, সেইজন্যই গন্ধটা চেনা-চেনা লাগছিল। শ্যানেল ফাঁইভ পারফিউম, তাই না?

ছোটমাসি বললেন আগে তো ধরতে পারিসনি!

কথা ঘোরাবার জন্য বিশ্বমামা বললেন, ছোটবেলায় আমরা বলতুম সেন্ট, এখন বলি পারফিউম। যেমন, আগে যাকে বলা হত, স্পোর্টস গেঞ্জি, এখন তাকেই বলি টি শার্ট।

খাওয়ার টেবিলে বিশ্বমামাকে খুব মন-মরা মনে হল।

বিশ্বমামাই সব জায়গায়, নানান জায়গায় কথা বলে সবাইকে জব্দ করে রাখেন, আজ নিজেই প্রথম জব্দ হয়ে গেছেন, তাই সেটা মেনে নিতে পারছেন না।

টেবিলে কত রকম খাবার, তবু বিশ্বমামা চুপচাপ। খাচ্ছেনও ফেলে ছড়িয়ে। ছোটমেসো তাকে কয়েকবার খুঁচিয়ে চাঙ্গা করার চেষ্টা করলেন। তাতেও কোনও ফল হল না। খাবার ঘরেও একটা ফুলদানিতে নকল ফুল।

এর দুদিন পর আমরা বিশ্বমামার সঙ্গে বেড়াতে গেলুম মধ্যপ্রদেশে।

আমাদের বেড়ানো, বিশ্বমামার কিছুটা কাজও আছে।

মধ্যপ্রদেশে বস্তার জেলার জঙ্গল বিখ্যাত। এখানে ছোট-ছোট পাহাড় আর জঙ্গলই বেশি।

আমরা উঠলুম একটা ডাকবাংলোতে। তার খুব কাছ থেকেই জঙ্গলের শুরু।

এই জঙ্গলে বাঘ আছে। ডাকবাংলোর চৌকিদার বলল, পরশুদিনই একজন কাঠুরেকে বাঘে মেরেছে। আর কয়েকজনের চোখের সামনেই বাঘটা সেই লোকটাকে ঘাড় কামড়ে নিয়ে চলে গেল।

আর আছে ভালুক। সেগুলো বাঘের চেয়েও কম হিংস্র নয়। ভালুক নাকি দিনের বেলাতেও দেখতে পাওয়া যায়। জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে আসে বাইরে। লোকজনদের পরোয়া করে না।

এই জঙ্গলে আমাদের তিনদিন ঘুরে-ঘুরে খুঁজতে হবে একটা গাছের পাতা।

বিশ্বমামা জিগ্যেস করলেন, কী রে, ভয় পাবি না তো?

বিলু বলল, ভয় না পেতেও পারি। কিন্তু বন্দুক-টক না নিয়ে খালি হাতে জঙ্গলে গিয়ে বাঘের কামড়ে মরার কি খুব দরকার আছে?

বিশ্বমামা বললেন, একেবারে খালি হাতে তো নয়। আমার কাছে একটা রিভলবার আছে। সেটা তোর কাছে রাখবি।

রিভলভার! আমরা সিনেমায় দেখেছি, বাঘ শিকার করার জন্য বড়-বড় বন্দুক কিংবা রাইফেল লাগে! ছোট্ট একটা রিভলভার দিয়ে কি বাঘ মারা যায়?

বিশ্বমামা বললেন, মারতে হবে কেন? আমি কোনও জানোয়ার মারা পছন্দ করি না। মাঝে-মাঝে এমনিই এক-একটা গুলি ছুঁড়বি। এ রিভলভারটায় খুব জোর শব্দ হয়। সেই শব্দ শুনলে বাঘ বা ভালুক আর কাছে আসবে না। এই শব্দ শুনলেই ওরা ভয় পায়।

পরদিন বেরুনো হল সকালবেলা।

কোন গাছের পাতা খুঁজতে হবে?

বিশ্বমামা বললেন, তোরা কখনো চা গাছ দেখেছিস?

আমি বললুম, হ্যাঁ, অনেকবার। দার্জিলিং গেলেই দু-দিকে চা বাগান দেখা যায়। একবার কুচবিহার যেতে গিয়েও অনেক চা-বাগান দেখেছি।

বিশ্বমামা বললেন, তবে তো ভালোই। আমরা তিনজনেই জঙ্গলে গিয়ে চা-গাছ খুঁজব। দেখতে পেলে পাতা ছিঁড়তে হবে।

বিনু বলল চা গাছ? আমরা যে ভূগোল বইতে পড়েছি, ইন্ডিয়াতে শুধু বাংলা, অসম আর ত্রিপুরাতেই চা হয়। অন্য কোথাও হয় না।

বিশ্বমামা বললেন, তা ঠিকই পড়েছিস। বই-টইগুলো লেখা হয়ে যাওয়ার পরেও তো অনেক নতুন কিছু জানা যায়। কিছুদিন হল জানা গেছে যে মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলেও কিছু চা-গাছ দেখা গেছে। সেগুলো বুনো চা-গাছ। সে গাছের পাতার নমুনা নিয়ে গিয়ে আমাদের বিসার্চ করে দেখতে হবে। যদি ভালো জাতের চা-গাছ হয়, তাহলে এখানেও চা-বাগান বসানো যাবে।

শুরু হল আমাদের অভিযান।

রিভলভারটা বিশ্বমামা বিলুর হাতে দিয়েছেন, কারণ সে আমার চেয়ে বয়সে বড়। আমার হাতে শুধু একটা গাছের ডালভাঙা লাঠি। বিশ্বমামাও, হাতে ওইরকম একটা লাঠি রেখেছেন, কারণ বাঘ ভালুক ছাড়াও যদি সামনে একটা সাপ চলে আসে, সেটাকে ভয় দেখাতে হবে তো?

প্রথমে জঙ্গলটা বেশ পাতলা। দু-একটা লম্বা গাছ আর কিছু ঝোঁপঝাড়। জন্তু জানোয়ার কিছু নেই।

আমরা প্রথম দেখলুম দুটো খরগোশ। ছাই-ছাই গায়ের রং আর লাল রঙের চোখ।

আমি উত্তেজিত ভাবে বললুম, ওই দ্যাখো, ওই দ্যাখো।

বিশ্বমামা ফিরে তাকিয়ে বললেন, কী? কোথায়?

আমি বললুম, খরগোশ।

বিশ্বমামা বেশ চটে গিয়ে বললেন, খরগোশ কি একটা দেখার জিনিস? এসেছি চা-গাছ খুঁজতে আর তুই দেখছিস খরগোশ। আগে কখনো খরগোশ দেখিসনি?

আমি বললুম, খাঁচায় দেখেছি। জঙ্গলে দেখিনি।

বিশ্বমামা বললেন, নে। এবার শুধু চা দ্যাখ।

চা-গাছ তো খুব লম্বা হয় না। ঝোঁপেরই মতন। এখানকার কোনও ঝোঁপই চা গাছের মতন নয়।

একটু পরে জঙ্গল বেশ ঘন হয়ে এল। অনেক বড়-বড় গাছ।

হঠাৎ একটা জায়গায় হুড়মুড় শব্দ হতেই ভয়ে বুক কেঁপে উঠল। বাঘ না ভালুক?

তা নয়, এক দঙ্গল বাঁদর। ছোট, বড়, মাঝারি।

এবারেও আমি চেঁচিয়ে কিছু বলে ফেলতে যাচ্ছিলুম। সামলে নিলুম কোনওরকমে।

বাঁদর আগে থেকেই দেখেছি ঠিকই, কিন্তু এই বাঁদরগুলো তো জঙ্গলের প্রাণী।

বাঁদরগুলো সব গাছ থেকে নেমে আমাদের সামনে-সামনে যাচ্ছে। মাঝে-মাঝে ফিরে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। একটা বেশ বড় বাঁদর এমন ভেংচি কাটছে আমার দিকে, তা দেখলেও ভয় লাগে।

বিলু বলল, বিশ্বমামা, একবার শূন্যে গুলি ছুঁড়ব নাকি। তাহলে ওরা সামনে থেকে সরে যাবে।

বিশ্বমামা বললেন, খবরদার না। গুলির আওয়াজে ওরা ভয় পায় না, বরং তেড়ে আসতে পারে। জানিস তো বাঁদররাই আমাদের পূর্বপুরুষ। ওদের অশ্রদ্ধা করতে নেই।

আমি জিগ্যেস করলুম, ওই বাঁদরটা শুধু-শুধু আমার দিকে ভেংচি কাটছে কেন?

বিশ্বমামা বললেন, ওই গোদা বাঁদরটা বোধহয় নিজেকে ভাবছে আমাদের জ্যাঠামশাই! বুঝে গেছে যে তুই অতি দুরন্ত ছেলে, তাই তোকে বকুনি দিচ্ছে।

যদিও নিজের জ্যাঠামশাই বকুনি দিলেও তার মুখের ওপর কিছু বলা যায় না। কিন্তু এই বাঁদরটা তো আর সত্যি-সত্যি আমার নিজের জ্যাঠা নয়, তাই আমিও একবার ওর দিকে ভেংচি কেটে দিলুম।

একটু পরে বাঁদরগুলো হুপ-হুঁপ করতে করতে অন্য দিকে চলে গেল।

সেদিন অনেক খোঁজাখুঁজি করেও চা-গাছ দেখতে পাওয়া গেল না।

দ্বিতীয় দিনেও কিছু হল না।

শেষ চেষ্টা করার জন্য তৃতীয় দিন আবার এলুম জঙ্গলে।

সে রাত্তিরেই আমাদের ফিরে আসতে হবে। ট্রেনের টিকিট কাটা আছে।

এক ঘণ্টার মধ্যেই বিশ্বমামা আবিষ্কার করে ফেললেন একটা চা গাছ।

মস্ত বড় একটা ঝোঁপের মধ্যে অন্যান্য গাছ আর লতা-পাতা, তার ঠিক মাঝখানের গাছটাই চা-গাছ। এমনিতে বোঝায় উপায় নেই। বিশ্বমামা ঠিক চিনেছেন।

সে গাছের একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে হাতে কচলে প্রথমে নিজের নাকের কাছে নিয়ে গেলেন। তারপর আমাদের দিকে হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, দ্যাখ তো চায়ের গন্ধ পাস কি না।

সত্যি পাতাটায় একটু-একটু চায়ের গন্ধ।

এরপর কাছাকাছি আরও কয়েকটা গাছ পাওয়া গেল।

বিশ্বমামা তাঁর কাঁধের ঝোলা ব্যাগে অনেকগুলো পাতা ছিঁড়ে ভরে নিলেন। বললেন, আর বেশি দরকার নেই। এতেই কাজ হয়ে যাবে।

এবার ফিরলেই হয়।

ফেরার পথে ভারি সুন্দর একটা ব্যাপার হল।

আমরা খানিকটা হেঁটে আসতেই একটা বড় গাছের আড়ালে দেখতে পেলুম একটা ময়ূর। পুরো পেখম মেলে আছে। ঠিক ছবির মতন।

বিশ্বমামা বললেন, ইস, কেন যে ক্যামেরা আনিনি। এরকম পেখম মেলা ময়ুর আর জীবনে কবার দেখা যায়।

ময়ুর মানুষ দেখে মোটেই লজ্জা পায় না, ভয়ও পায় না। সে সরে গেল না, এ অবস্থায় এক পা এক পা ফেলে হাঁটতে লাগল।

সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিশ্বমামা হঠাৎ বললেন, আরে। কথাটা তাহলে সত্যি?

আমি বললুম, কী কথা?

বিশ্বমামা বললেন, সবাই বলে, আকাশে মেঘ করলে ময়ূর এরকম পেখম তুলে নাচে। এখন আকাশে মেঘ আছে? দ্যাখ না, পরিষ্কার নীল আকাশ। আরও একটা কারণে ময়ুর নাচে, যখন অপ্সরা ফুল ফোটে। এ ফুল মাত্র একবার ফোটে দু-বছরে।

আঙুল দিয়ে বিশ্বমামা দেখালেন, ওই দ্যাখ।

একটা বড় গাছের গা থেকে বেরিয়েছে আর একটা ছোট গাছ, যাকে বলে পরগাছা। সেই পরগাছায় ফুটে আছে একটি মাত্র ফুল। লম্বা উঁটির ওপর গোল মতন ফুল, মাঝখানটা নীল আর পাশের দিকে সাদা। খুব সুন্দর দেখতে।

বিশ্বমামা বললেন, এর গন্ধও খুব ভালো। কিন্তু ময়ূরটা না সরে গেলে ফুলের গন্ধ পাওয়া যাবে না। ময়ূরের গায়েও তো গন্ধ থাকে।

বিলু বলল, অঙ্গরা ফুল, কখনো নাম শুনিনি।

বিশ্বমামা বললেন, ইংরেজিতে বলে হেভেস্ মেইডেন। আমি বাংলায় নাম দিয়েছি অপ্সরা ফুল। এ ফুল আমাদের নদীর ধারে খুব দেখা যায়।

ময়ুরটা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সরবার নাম নেই। ও কি ফুলটা পাহারা দিচ্ছে?

বিশ্বমামা বললেন, ফুলটা ছোড়দির জন্য নিয়ে যাব ভাবছি। এ ফুল অনেকদিন টাটকা থাকে।

আমি একটু এগিয়ে যেতেই বিশ্বমামা আমার হাত ধরে টেনে বললেন, দাঁড়া, দাঁড়া কাছে যাস না। ময়ুর দেখতে এত সুন্দর হলে কী হবে, খুব হিংস্রও হয়। ধরতে গেলে চোখ খুলে নিতে পারে।

বিলুকে বললেন, রিভলভার দিয়ে একবার আওয়াজ কর তো?

সেই শব্দ শুনেই ময়ূরটা পেখম গুটিয়ে ক্যাঁ-ক্যাঁ শব্দ করে ছুটে পালাবে।

বিশ্বমামা খুব সাবধানে উঁটিশুদ্ধ ফুলটা তুলে আনলেন।

সত্যিই বেশ সুন্দর, মিষ্টি গন্ধ আছে ফুলটার।

বিশ্বমামা বললেন, যাক, এখানে এসে আমার কাজও হল, আর ছোড়দির জন্য একটা উপহারও পাওয়া গেল।

পরদিন সকালে কলকাতায় ফেরার পরও দেখা গেল, ফুলটা একইরকম টাটকা আছে।

বিশ্বমামা ছোটমাসিকে ফোন করে বললেন দুপুর বেলা যাব তোমার বাড়ি, ভালো-ভালো জিনিস রান্না করো, গন্দা চিংড়ির মালাইকারী যেন থাকে, আর রাবড়ি। তোমার জন্য একটা দারুণ জিনিস এনেছি।

ছোটমাসি তখনি জিগ্যেস করলেন, কী এনেছিস রে? কী? কী?

বিশ্বমামা বললেন, এখন বলব না। দেখতেই তো পাবে।

দুপুরবেলা সদলবলে হাজির হলুম ছোটমাসির বাড়িতে।

ছোটমাসি ফুলটা পেয়ে খুবই খুশি। বারবার বলতে লাগলেন, বাঃ কী সুন্দর, কী সুন্দর। এমন ফুল কখনো দেখিনি।

বিশ্বমামা বললেন, পাড়া-প্রতিবেশীদেরও ডেকে দেখাতে পারো, এ ফুল মাসের পর মাস ফুটবে না। তবে, বাড়িতে এই একটা ফুল রাখলে আর অন্য ফুল মানায় না। ওইসব নকল ফুল-টুলগুলো ফেলে দিতে হবে।

ছোটমেসো বললেন, আরে তা কেন? বেশি ফুল রাখলেই ঘরের শোভা বাড়ে। এটাও থাক, অন্যগুলোও থাক, লোকে বুঝতেই পারবে না, কোনটা আসল, কোনটা নকল।

বিশ্বমামা বললেন, এই অপ্সরা ফুল নিরিবিলিতে থাকতে ভালোবাসে। আশে-পাশে অন্য ফুল ফোটে না। একবার যা একটা ব্যাপার আমি দেখেছি…।

বিশ্বমামা বললেন, থাক, এখন বলব না। পরে তোমরা নিজেরাই দেখতে পাবে।

অঙ্গরা ফুলটাকে রাখা হল নকল ফুলের তোড়াটার পাশেই।

তারপর অনেকক্ষণ গল্পের পর ডাক এল খেতে বসার।

আজ বিশ্বমামার খাওয়ার কী উৎসাহ। খেয়ে ফেললেন চারখানা বড়-বড় চিংড়ি। চাটনি আর রাবড়ি খাওয়ার পরেও বললেন, আর একটা চিংড়ি দাও তো!

খাওয়া শেষ হলেও বিশ্বমামা গল্প জুড়ে দিলেন। পৃথিবীর কোন দেশে কেমন চিংড়ি পাওয়া যায়। নিকোবর দ্বীপে নাকি এমন চিংড়ি দেখেছেন, তার নাম টাইগার প্রান। ওপরের খোসাটা বাঘের মতনই হলুদ কালো ডোরা কাটা আর এক-একটা দেড় হাত লম্বা।

গল্প শুনতে-শুনতে আমরা হাত ধুতে ভুলে গেলুম। আমাদের হাতে এঁটো শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেল।

এক সময় ছোটমাসি বললেন, এবার সবাই উঠে পড়ো। বসবার ঘরে গিয়ে বাকি গল্প হবে।

হাতটাত ধুয়ে আমরা সবাই এসে বসলুম বসবার ঘরে।

বিশ্বমামা বললেন, ছোড়দি, মশলা নেই। খুব খাওয়া হয়ে গেছে আজ।

মশলা আনতে গিয়ে ছোটমাসি হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলে উঠলেন, এ কী? এ কী অদ্ভুত কাণ্ড!

সত্যিই অদ্ভুত কাণ্ড।

অপ্সরা ফুলটা যেন হাসিতে ঝলমল করছে। আর তার পাশের নকুল ফুলের তোড়াটা শুকিয়ে গেছে, খসে পড়েছে অনেকগুলো পাপড়ি!

বিশ্বমামা বললেন, এটাই তো তখন বলতে যাচ্ছিলুম। আমাজন নদীর ধারে একবার দেখেছিলুম এই কাণ্ড। এ রকম একটা অপ্সরা ফুল ফুটে আছে, আর আশেপাশের অন্য সব ফুলের পাপড়ি ঝরে যাচ্ছে। এ ফুল অন্য ফুলদের সহ্য করতে পারে না।

আমাদের চোখের সামনেই নকল ফুলের সব পাপড়ি খসে পড়ে গেল।

ছোটমেসো দারুণ অবাক হয়ে বললেন, নকল ফুলেরও পাঁপড়ি খসে পড়ে? এরকম কখনো শুনিনি!

বিশ্বমামা বললেন, তা হলেই বুঝুন, আসল আর নকলের তফাত।

ছোটমেসো বললেন, কী করে এটা হল, সত্যি করে বলো তো, বিশ্ব!

বিশ্বমামা বললেন, ম্যাজিক, ম্যাজিক!

সকল অধ্যায়

১. তিন নম্বর চোখ (উপন্যাস)
২. আকাশ দস্যু (উপন্যাস)
৩. অন্ধকারে সবুজ আলো (উপন্যাস)
৪. মহাকালের লিখন
৫. ইচ্ছাশক্তি
৬. বিশ্বমামা ও নকল ফুল
৭. বিশ্বমামার ভূত ধরা
৮. বিশ্বমামার খুদে বন্ধু
৯. বিশ্বমামা ও গলদা চিংড়ি
১০. বিশ্বমামা ও বেড়াল-ভূত
১১. বিশ্বমামার গোয়েন্দাগিরি
১২. বিশ্বমামার চোর ধরা
১৩. বিশ্বমামা ও অহি-নকুল
১৪. বিশ্বমামার রহস্য
১৫. বিশ্বমামার ম্যাজিক
১৬. ম্যাজিশিয়ান বিশ্বমামা
১৭. বিশ্বমামার হায় হায়
১৮. নীল রঙের মানুষ
১৯. নীল মানুষের কাহিনি
২০. নীল মানুষের সংসার
২১. নীল মানুষের মন খারাপ
২২. নীল মানুষের খেলা
২৩. নীল মানুষের পরাজয়
২৪. নীল মানুষের বন্ধু
২৫. নীল মানুষ ও ছোট্ট বন্ধু
২৬. সেই একলা নীল মানুষ
২৭. ভূতের দেশে নীল মানুষ
২৮. দেওয়ালের সেই ছবি
২৯. রণজয়ের শহর-অভিযান
৩০. আজব লড়াই
৩১. খেলার সঙ্গী
৩২. নতুন পুকুরের জাগ্রত দৈত্য
৩৩. রণজয় আর অলৌকিক শিশুরা
৩৪. পঞ্চমশক্তি
৩৫. অদৃশ্য পাখি
৩৬. সেই অদ্ভুত লোকটা
৩৭. হীরে কি গাছে ফলে?
৩৮. রাত্তিরবেলা একা একা
৩৯. মেঘচোর
৪০. সাধুবাবার হাত
৪১. লাল জঙ্গল
৪২. রাক্ষুসে পাথর

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন