বিশ্বমামার গোয়েন্দাগিরি

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বিশ্বমামার গোয়েন্দাগিরি

সকাল বেলা খবরের কাগজ পড়তে-পড়তে বিশ্বমামা একটা বিরাট হুংকার দিয়ে বললেন। হুঁ! আবার বুজরুকি!

আমি আর বিলুদা ঘরের মেঝেতে বসে সাপলুডো খেলছিলুম। আমার ঘুটিটা একেবারে আটানব্বইয়ের ঘরে এসে একটা বিরাট সাপের মুখে পড়ে গেল।

বিলুদা মুখ ফিরিয়ে জিগ্যেস করল, কী হয়েছে বিশ্বমামা? বিশ্বমামা লম্বা নাকের ডগায় একটা আঙুল ছুঁইয়ে বললেন, আমাদের এখানে বৃষ্টির নাম গন্ধ নেই। ঝাড়গ্রামে এক সন্ন্যাসী নাকি যজ্ঞ করে, মন্ত্র পড়ে পরপর দুদিন বৃষ্টি নামিয়েছে। ছিটে ফোঁটা নয়, দারুণ বৃষ্টি।

বিলুদা কাগজটা নিয়ে জোরে-জোরে পড়তে লাগল। ঝাড়গ্রামের কাছে বিনপুর নামে একটা জায়গায় এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসী মেঘদমন যজ্ঞ করেছে। যজ্ঞ শুরু করার আগেই সে সবাইকে বলে দিয়েছিল যে এক ঘণ্টার মধ্যে সে বৃষ্টি নামিয়ে দেবে। অনেক লোক সেখানে জড়ো হয়ে আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিল। সত্যি-সত্যি হঠাৎ ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। সবাইকে ভিজিয়ে দিল। এরকম দুদিন ঘটেছে। বিলুদা বললে, নিজস্ব সংবাদদাতা এ খবর পাঠিয়েছে। তা হলে কি এটা মিথ্যে হতে পারে?

বিশ্বমামা হেসে বললেন, খবরের কাগজের সব খবর বুঝি সত্যি হয়? ‘খবর’ কথাটা কীভাবে তৈরি হয়েছে জানিস? খারাপের খ, বদ লোকের ব, আর রং চড়ানোর র। দেখবি খবরের কাগজের প্রথম পাতায় একটা ভালো খবর থাকে না, সব খারাপ খবর। কোথায় ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে বহু লোক মারা গেছে, কোথায় ডাকাতি হয়েছে, কোথায় দলাদলিতে সরকার ভেঙে যাচ্ছে। এই সবই বড়-বড় করে লেখা হয়। ভালো খবর কিছু থাকে? ভালো লোকদের চেয়ে বদ লোকরাই বেশি পাত্তা পায়। যে যত বেশি টাকা চুরি করে, তার নাম তত বড়-বড় অক্ষরে ছাপা হয়। আর রং চড়ানো, কোথাও সামান্য কিছু একটা ঘটলেও খবরের কাগজের লোকেরা অনেক রং চড়িয়ে, বাড়িয়ে-বাড়িয়ে লেখে।

বিলুদা বলল, কিন্তু বিশ্বমামা, তোমার সম্পর্কেও তো মাঝে-মাঝে খবরের কাগজে লেখা হয়। তোমার আবিষ্কারের খবর। সেটা তো খারাপ খবর না, তুমি বদ লোক নও, রংও চড়ায় না। তাহলে?

বিশ্বমামা বললেন, তা কি প্রথম পাতায় ছাপে? ভেতরের দিকে ছোট-ছোট অক্ষরে, যাতে লোকের চোখে না পড়ে। তাও সাংবাদিকদের যা অভ্যেস একটু-আধটু রং না চড়িয়ে পারে না। একবার একটা কাগজে লিখে দিল, আমি নাকি সাড়ে ছফুট লম্বা। আমি মোটে ছ ফুট এক ইঞ্চি, কতখানি বাড়িয়ে দিল দেখলি?

আর লুডো খেলা হবে না বুঝতে পেরে আমি জিগ্যেস করলুম, বিশ্বমামা মানুষ ইচ্ছে করলে বুঝি বৃষ্টি নামাতে পারে না? তবে যে শুনেছিলুম, আকবরের সভায় যে মস্তবড় গায়ক ছিলেন তানসেন, তিনি নাকি মেঘমল্লার গান গেয়ে বৃষ্টি নামিয়ে দিয়েছিলেন?

বিশ্বমামা বললেন, মানুষ বৃষ্টি নামাতে পারবে না কেন? আমিও পারি। তবে গান গেয়ে কিংবা মন্ত্র পড়ে বৃষ্টি নামানো যায় না। কারণ মেঘের কান নেই। মেঘ শুনবে কী করে? তানসেন আসলে এত ভালো গান গেয়েছিলেন তা শুনে অনেক লোক কেঁদে ফেলেছিল। সেই চোখের জলের বৃষ্টি নেমে ছিল।

বিলুদা বলল, তুমি বৃষ্টি নামাতে পারো?

বিশ্বমামা অবহেলার সঙ্গে বলল, পারবো না কেন? এটা এমন কিছু শক্ত কাজ নয়।

আমি বিশ্বমামার কাছে গিয়ে বললুম, একটু দেখাও না। এইখানে একবার বৃষ্টি নামিয়ে দেখাও! কতদিন বৃষ্টি হয়নি।

বিশ্বমামা বললেন, জানলা দিয়ে দেখো তো, আকাশে মেঘ আছে কি না?

আমরা দুই ভাই ছুটে গেলুম জানলার কাছে। কোথাও মেঘের চিহ্ন নেই, আকাশ একেবারে খটখটে।

বিশ্বমামা ভুরু নাচিয়ে বললেন, তাহলে তো হবে না। মেঘ থাকলে আগে আগে বৃষ্টি নামানো যায় যদিও তাতে অনেক ব্যবস্থা লাগে কিন্তু মেঘ না থাকলে বৃষ্টি নামানো মানুষের পক্ষে অসাধ্য। মানুষ একেবারে মেঘ তৈরি করতে পারার ক্ষমতা অর্জন করেনি।

বিলুদা বললেন, এখানে না থাকলেও ঝাড়গ্রামে হয়তো মেঘ করেছে। তাই সাধুটি বৃষ্টি নামাতে পেরেছেন।

বিশ্বমামা বললেন, ঝাড়গ্রামে মেঘ হতে পারে। হঠাৎ বৃষ্টিও নামতে পারে। কিন্তু তাতে সাধুটির কোনও কেরামতি থাকতে পারে না। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে জানিস, ঝড়ে কাক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে। তার মানে জানিস? একটা তালগাছের তলায় একটা কাক বসে ছিল, একজন ফকির তার শিষ্যদের বললেন, আমি মন্ত্র পড়ে ওই কাকটাকে মেরে ফেলতে পারি। ফকির তো মন্ত্র আউড়িয়েই চলেছে, এমন সময় হঠাৎ ঝড় উঠল, আর তালগাছ থেকে খসে পড়ল একটা পাকা তাল। পড়বি তো পড়, সেটা ঠিক পড়ল কাকেরই মাথায়। তাতে কাক বেচারি মারা গেল। ফকির বললেন, দেখলে আমার কেরামতি। আসলে কিন্তু ঝড় না উঠলে তালও তখন পড়ত না, কাকটাও মরত না। একেই বলে কাকতালীয়।

আমি জিগ্যেস করলুম, ঠিক ওই সময়েই ঝড় উঠল কেন?

বিশ্বমামা বললেন, সেদিন হঠাৎ ঝড় উঠেছিল বলেই তো গল্পটা দাঁড়িয়েছে। ওই ফকিরকে যদি বলা যায়, আর একবার মন্ত্র পড়ে ঝড় তোলো তো? সে পারবে? পারবে না। কিছুতেই পারবে না।

বিলুদা বলল, কিন্তু এখানে যে লিখেছে, সাধু যজ্ঞ করে পরপর দুবার বৃষ্টি নামিয়েছে।

বিশ্বমামা বললেন, হুঃ! তা বটে। হারে, তোদের ছোটকাকার দেশের নাম কী রে?

বিশ্বমামা হঠাৎ আচমকা এমন এক একটা কথা বলে, যার কোনও কারণই বোঝা যায় না। এই সময় হঠাৎ ছোটকাকার দেশের প্রসঙ্গ আসে কী করে?

বিলুদা বললেন, ছোটকাকার দেশে তো ভল্টদা। বিশ্বমামা ধমক দিয়ে বললেন, ভালো নাম কী? ভণ্ডুদা বললে কেউ চিনবে?

আমি মাথা চুলকোতে লাগলুম। তাই তো ভন্টুদার ভালো নামটা কী যেন? মনে পড়ল না।

বিলুদা বললেন, প দিয়ে নাম। প্রফুল্ল, প্রশান্ত? না, না, প্রাণগোপাল, না, প্রমথেশ তাও না।

বিশ্বমামা বললেন, প দিয়ে হাজারটা নাম হয়। তোর মায়ের কাছ থেকে জেনে আয়–

তক্ষুনি আমার মনে পড়ে গেল। ভন্টুদার ভালো নাম প্রিয়দর্শী, প্রিয়দর্শী মুখার্জি।

বিশ্বমামা বললেন, ভন্টু এখন ঝাড়গ্রামের এস ডি ও, তাকে ফোন করলেই তো আসল ঘটনা জানা যাবে?

বিশ্বমামা টেলিফোনের কাকে গিয়ে বললেন, একবারেই লাইনে পাওয়া গেল। খোদ ভল্টদার সঙ্গেই কথাবার্তা শুরু হল। খানিকক্ষণ কথা বলার পর বিশ্বমামা চেঁচিয়ে উঠলেন, এক গাঁট্টা মারব। তোর কানটা মূলে দেব। তুইও মন্ত্র-তন্ত্রে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিস।

ফোনটা রেখে দিয়ে বিশ্বমামা বললেন, ভন্টু নিজের চোখে বৃষ্টি পড়তে দেখেছে। চল তো, ঝাড়গ্রামে গিয়ে ব্যাপারটা তদন্ত করে আসি। যদি মন্ত্র পড়ে বৃষ্টি নামাতে পারে তাহলে আমার বিজ্ঞান পড়া ব্যর্থ হয়ে যাবে।

আমরা লাফিয়ে উঠলুম। আর কিছু না হোক ঝাড়গ্রামে বেড়াতে যাওয়া হবে তো। ভারি সুন্দর জায়গা। কাছাকাছি জঙ্গল আছে, পাহাড় আছে।

বিশ্বমামার পুরোনো গাড়ি, মাঝে-মাঝে রাস্তায় থেমে যায়, তখন আমাদের ঠেলতে হয়। এবারে সেরকম কিছু হল না, মাঝপথে একটা ধাবায় থেমে চমৎকার গরম-গরম রুটি-মাংস খাওয়া হল।

আমাদের ভণ্ডুদা ঝাড়গ্রামের এস ডি ও সাহেব। সবাই তাকে খুব খাতির করে। যে-কোনও লোককে জিগ্যেস করলে তার বাংলো দেখিয়ে দেয়। বিলুদা আমায় বললে, সাবধান নীলু, এখানে লোকজনের সামনে ভণ্ডুদা বলে ডাকবি না, বলবি প্রিয়দা, কিংবা ছোড়দা।

সে-বাংলোয় পৌঁছে বিলুদা নিজেই আগে ভদা বলে ডেকে বসল। বিশ্বমামা একগাদা লোকের সামনে বললেন, এই যে ভন্টু খবর না দিয়েই চলে এলুম তোর এখানে।

ভন্টুদা অবশ্য আমাদের দেখে খুব খুশি। মস্ত বড় বাংলো থাকবার জায়গার কোনও অসুবিধে নেই।

সন্ধেবেলা বাংলোর বারান্দায় বসে চা খেতে-খেতে শোনা গেল আসল কাহিনি।

সন্তোষ মিত্র নামে এক ভদ্রলোক জার্মানিতে থাকতেন। বছর চারেক আগে এখান থেকে খানিকটা দূরে বিনপুরে অনেকখানি জমি কিনে বসবাস করছেন। একটা ছোট্ট সুন্দর বাড়িও বানিয়েছেন, ফলের বাগান আছে, তাতে লাগিয়েছেন অনেক রকম ফলের গাছ। লোকটির ব্যবহার ভালো, বিনপুরের লোকেরা তাকে পছন্দ করে।

গত বছর এখানে ভালো বৃষ্টি হয়নি। এ বছরও এখনও বৃষ্টির দেখা নেই। সেই জন্য সন্তোষ মিত্র একজন সাধুকে দিয়ে যজ্ঞ করিয়েছেন। এই সাধু অন্য সময়ে থাকেন হিমালয়ে, তার অনেক রকম অলৌকিক ক্ষমতা আছে। যজ্ঞের সময় তিনি মন্ত্র পড়ে সত্যি-সত্যি বৃষ্টি নামিয়েছেন। একবার নয়, দুবার, একবার হলে বলা যেত কাকতালীয়। প্রথমদিন অনেকেই ব্যপারটা জানত না। বৃষ্টি নামার পর দলে-দলে তোক ছুটে গেল যজ্ঞ দেখার জন্য। দ্বিতীয় দিন সাধু যজ্ঞে বসার আগে সবাইকে বলে দিলেন, কেউ টু শব্দ করবে না। সবাইকে চুপ করে থাকতে হবে। এক ঘণ্টার মধ্যে আমি বৃষ্টি নামিয়ে দেব।

বিশ্বমামা ভল্টদাকে জিগ্যেস করলেন, তুই ছিলি সেখানে, তুই দেখেছিস?

ভন্টুদা বললেন, হাঁ দেখেছি। নিজের চোখে দেখেছি। অবিশ্বাস করলে কী করে?

বিশ্বমামা বললেন কী দেখলি, ভালো করে বল।

ভন্টুদা বললেন, যজ্ঞের কাছেই আমাকে একটা চেয়ার পেতে বসিয়ে দিল। দাউ দাউ করে যজ্ঞের আগুন জ্বলছে। তার দুদিকে বসে আছে সন্তোষ মিত্র আর সেই সাধু। সাধুটি আগুনে ঘি ছিটোচ্ছেন আর মন্ত্র পড়ছেন। মাঝে-মাঝে আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন। হঠাৎ এক ফোঁটা দুটো করে জল পড়তে লাগল সেই আগুনে। তারপরই একেবারে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। আমাদের দৌড়ে যেতে হল বাড়ির মধ্যে।

বিশ্বমামা প্রবল জোরে মাথা নেড়ে বললেন, হতে পারে না। হতে পারে না। আসলে মেঘ ছিল আগে থেকে।

ভন্টুদা বললেন, তা ছিল।

বাইরে একটা জিপ গাড়ি থামল এই সময়ে। তার থেকে নেমে এলেন একজন অচেনা লোক।

ভন্টুদা বললেন, ওই তো এখানকার পুলিশ সাহেব এসে গেছেন। এঁকে জিগ্যেস করেন। কিন্তু বিশ্বমামা, প্লিজ, ওঁর সামনে আমাকে ভন্টু বলে ডেকো না।

পুলিশ সাহেবের নাম দিগবিজয় সরকার। আলাপ পরিচয় হল। তারপর বিশ্বমামা জিগ্যেস করলেন, হ্যাঁ মশাই, আপনিও সাধুকে বৃষ্টি নামানো দেখেছেন?

সরকার সাহেব বললেন, হ্যাঁ দেখলুম তো। আরও অন্তত পাঁচশো তোক দেখেছে। এর মধ্যে জাল-জোচ্চুরি কিছু নেই। সাধু মন্ত্র পড়ল আর বৃষ্টি নামল!

বিশ্বমামা আবার জোর দিয়ে বললেন, এ হতে পারে না।

সরকার সাহেব বললেন, আমিও মন্তর-টন্তর কখনও বিশ্বাস করিনি। কিন্তু সাধুটি সত্যি তাক লাগিয়ে দিয়েছে। আরও আশ্চর্য কথা কী জানেন, সন্তোষ মিত্রের বাড়ি-বাগান নিয়ে পঁচিশ বিঘে জমি। বৃষ্টি পড়েছে শুধু এ-পঁচিশ বিঘের মধ্যে। অন্য সব জায়গা শুকনো খটখটে।

ভন্টুদা বললেন, উনি খরচ-পত্র করে যজ্ঞের ব্যবস্থা করেছেন, তাই শুধু নিজের জমিতেই বৃষ্টি নামিয়েছেন।

বিশ্বমামা পুলিশ সাহেবকে বললেন, সে কী? অ্যারেস্ট করা উচিত ছিল।

পুলিশ সাহেব অবাক হয়ে বললেন, সে কী? অ্যারেস্ট করব কী অপরাধে? নিজের জমিতে বসে কেউ যদি পুজো বা যজ্ঞ করে, সেটা তো দোষের কিছু না।

বিশ্বমামা বললেন, ভন্টু ইয়ে থুড়ি, প্রিয়দর্শী। আমরা একবার বিনপুরে ওই বাড়িটা গিয়ে দেখতে পারি?

ভন্টুদা বললেন, হ্যাঁ, আমি নিয়ে যেতে পারি। সেই সাধু এখনও রয়েছেন তার সঙ্গেও কথা বলতে পারো। বোধহয় আরও বৃষ্টির জন্য আর একবার যজ্ঞ করবে।

বিশ্বমামা বললেন, ঠিক আছে। আমার অন্য পরিচয় দিবি না। শুধু বলবি, তোর আত্মীয়। এমনিই বেড়াতে এসেছি।

ভন্টুদা বললেন, ঠিক আছে, আজ তো রাত হয়ে গেছে, কাল সকালে যাওয়া যাবে।

বিশ্বমামা বললেন, সন্তোষ মিত্র জার্মানি ফেরত অথচ সাধুকে দিয়ে যজ্ঞ করায়।

সরকার সাহেব বললেন, আজকাল বিদেশে অনেক সাহেব-মেমও এসবে বিশ্বাস করে। সত্যি মন্ত্রের জোর আছে বটে।

বিশ্বমামা এরপর কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন। অন্য সময় বিশ্বমামা কত মজার গল্প বলেন। এখন আর তাতে মন নেই। ভণ্ডুদা আর পুলিশ সাহেব, এরা তো মিথ্যে কথা বলবেন না। একজন সাধু মন্ত্র পড়ে বৃষ্টি নামিয়েছে, এরা নিজের চোখে দেখেছে, তা শুনে বিশ্বমামা কি ঘাবড়ে গেলেন? মন্ত্রের কাছে বিজ্ঞানও হার মানল?

আমরা অন্য গল্প করতে লাগলুম, বিশ্বমামা চুপ।

পরিষ্কার আকাশ। অনেক তারা ফুটে আছে, বাইরের আকাশে তারাগুলোকে বেশি উজ্জ্বল মনে হয়। একটা প্লেন উড়ে গেল, কী সুন্দর দেখাল সেটাকে।

বিশ্বমামা এক সময় জিগ্যেস করলেন, মাঝে-মাঝে প্লেনের শব্দ শুনছি। এখান দিয়ে এত প্লেন যায় কোথায়?

ভন্টুদা বললেন, কাছেই তো কলাইকুণ্ডা। যেখানে আমাদের এয়ার ফোর্সের একটা বেস আছে। সেখান থেকে প্লেন ওড়ে, এই শব্দ শোনা আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে।

সরকার সাহেব বললেন, আমার বাংলোর পাশেই ট্রেন লাইন। মাঝরাত্রে ট্রেনের শব্দ শুনে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমার এখনও অভ্যেস হয়নি।

একসময় খাবারের ডাক পড়ল, দারুণ ব্যবস্থা করেছেন ভন্টুদা, প্রথমে ভাতের সঙ্গে দুরকম মাছ, তারপর গরম-গরম লুচির সঙ্গে মাংস। তিনরকম মিষ্টি।

বিশ্বমামা এত খাদ্যরসিক, আজ কিছুই প্রায় খেলেন না। মিষ্টিগুলো ছুঁলেন না পর্যন্ত। বিশ্বমামার এরকম মুখ আমি কখনও দেখিনি।

পরদিন সকালে ব্রেক ফাস্ট খেয়ে আমরা রওনা দিলুম বিনপুরের দিকে।

বেশি দূর নয়, বড় রাস্তা থেকে খানিকটা ভেতরে ঢুকে সন্তোষ মিত্রের বাড়ি। চারদিকে শুকনো-শুকনো ভাব, এই বাড়ির বাগানে গাছগুলো বৃষ্টির জল খেয়ে বেশ তরতাজা। ফলের গাছগুলো বেশি বড় নয়, কিন্তু এর মধ্যেই অনেক গাছে ফল ধরেছে। কয়েকটা কলাগাছে কল্লা ফলে আছে।

সন্তোষ মিত্র একজন মাঝবয়েসি অমায়িক ভদ্রলোক। ভন্টুদার সঙ্গে এসেছে বলে আমাদেরও খাতির করলেন খুব। বাড়ির সামনে মস্ত বড় বারান্দা, তাতে অনেক চেয়ার পাতা।

একটু দূরে একটা ঝাকড়া গাছের তলায় বাঘের চামড়ার আসনে বসে আছেন এক সন্ন্যাসী। মাথায় জটা, মুখ ভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি-গোঁফ। তিনি সিগারেট খাচ্ছেন, আর একটা খবরের কাগজ পড়ছেন। কোনও গেরুয়া পরা সন্ন্যাসীকে সিগারেট টানতে আমি আগে দেখিনি। শুনেছিলাম সন্ন্যাসীরা গাঁজা খায়।

বারান্দায় বসে গল্প করতে করতে সন্তোষ মিত্র জোর করে আমাদের ডল ডিমের ওমলেট খাওয়ালেন। বিশ্বমামা নিজেরটা কিছুতেই খেতে চাইলেন না পরে বিলুদা টপ করে প্লেটটা নিজের কাছে নিয়ে নিলেন।

আমি চুপি-চুপি বিলুদাকে বললুম, আমাদের বিশ্বমামাও বৃষ্টি নামাতে পারেন বলেছিলেন। এই সাধুর সঙ্গে বিশ্বমামার একটা কমপিটিশন হলে ভালো হয় না?

বিলুদা বললেন, চুপ। বিশ্বমামা রেগে আছে। এখন কিছু বলতে যাসনি।

বিশ্বমামা সন্তোষ মিত্রকে জিগ্যেস করলেন, এই সাধুজিকে আপনি পেলেন কোথায়?

সন্তোষ মিত্র বললেন, গত বছর আমি হরিদ্বারে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে আলাপ। কথায় কথায় বলেছিলাম, ঝাড়গ্রামের কাছে অনেক টাকা খরচ করে মস্ত বাগান করেছি। কিন্তু জলের অভাবে সব শুকিয়ে যাচ্ছে। পরপর দুবছর ভালো বৃষ্টি হয়নি। এদিককার পুকুরও শুকিয়ে যায়, কুয়োতে জল থাকে না। তা শুনে সাধুজি বললেন, এ আবার সমস্যা নাকি? আমি ইচ্ছে করলেই বৃষ্টি নামিয়ে দিতে পারি। তাই ওকে নেমন্তন্ন করে নিয়ে এসেছি।

বিশ্বমামা জিগ্যেস করলেন, উনি কি সাহারা মরুভূমিতেও বৃষ্টি নামাতে পারেন?

সন্তোষ মিত্র তাতে খানিকটা অখুশি হয়ে বললেন, জেনে আমার দরকার কী? আমার বাগানে জল পেলেই হল।

বিশ্বমামা বললেন, তা ঠিক। আপনার বাগানটি চমৎকার হয়েছে। আশেপাশে এমন সুন্দর ফলের বাগান কারুর নেই।

এরপর বিশ্বমামা উঠে গেলেন সাধুটির কাছে।

আমরাও সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে সেখানে দাঁড়ালাম।

বিশ্বমামা বললেন, নমস্কার সাধুজী। আপনার অলৌকিক ক্ষমতা অনেক শুনেছি।

সাধু হাত তুলে আশীর্বাদ জানালেন।

বিশ্বমামা আমাদের বললেন, প্রণাম কর, প্রণাম কর। অভিনেতা। ভালো অভিনেতাও তো একজন গুণী।

সাধু এবার কটমট করে তাকালেন বিশ্বমামার দিকে। কড়া গলায় বললেন, তুমি বুঝি বিশ্বাস করো না? হাজার খানেক লোক আমার মন্ত্রশক্তি দেখেছে। তোমরা আজকালকার ছেলে, দুপাতা ইংরেজি পড়েই সবজান্তা হয়ে গেছ। ঠাকুর-ফাকুর মানো, ধর্ম মানো না! সেই জন্যই তো দেশটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। যত্ত সব অকালকুষ্মাণ্ড!

গালাগালি খেয়েও কিন্তু বিশ্বমামা চটলেন না। হাসিমুখে বললেন, রাগ করছেন কেন? সকলকেই কিছু না কিছু অভিনয় করতে হয়, আমিও করি। আচ্ছা সাধুজি, আপনি আকাশে উড়তে পারেন?

সাধু বললেন, কী?

বিশ্বমামা আবার বললেন, আপনার তো অলৌকিক ক্ষমতা আছে, আপনি আকাশে উড়তে পারেন? এখানে বসে মন্ত্র পড়লে তো মেঘেরা শুনতে পাবে না। কখন বৃষ্টি নামাতে হবে তা মেঘেরা বুঝবে কী করে?

সাধু বললেন, আমার আকাশে ওড়ার দরকার হয় না। এখানে বসে মন্ত্র পড়লেই কাজ হয়। পরশু দিনই আবার যজ্ঞ করব তখন দেখতে পাবে।

বিশ্বমামা বললেন, তাহলে এখানে আরও দুদিন থেকে যেতে হয় দেখছি। সাধুজী, আমার সামনে আপনি যদি মন্ত্র পড়ে বৃষ্টি নামাতে পারেন, তাহলে আমি আমার একটা কান কেটে ফেলব।

সাধু বললেন, তাহলে ধরে নাও, তোমার একটা কান কাটা গেছে। আজ আবার মেঘ জমছে। বৃষ্টি আমি নামাবই।

এই সময় বাড়ির মধ্য থেকে একজন লোক বেরিয়ে এল। সাদাপ্যান্ট আর সাদা শার্ট পরা। হাতে একটা নীল বর্ডার দেওয়া সাদাটুপি।

কথা থামিয়ে বিশ্বমামা কৌতূহলী হয়ে সেই লোকটির দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর তার দিকে এগিয়ে বললেন, নমস্কার, আপনার সঙ্গে আমার আলাপ হয়নি।

সন্তোষ মিত্র বললেন, এ আমার মাসতুতো ভাই সুবোধ।

বিশ্বমামা সুবোধকে জিগ্যেস করলেন, আপনি এই বাড়িতে?

সুবোধের বদলে সন্তোষ মিত্রই আবার বললেন, না, মাঝে-মাঝে আসে। ও তো এয়ার ফোর্সের অফিসার। কলাইকুণ্ডার ফাঁইটার প্লেন চালায়।

বিশ্বমামা বললেন, আমারও দেখেই পাইলট মনে হয়েছিল। সুবোধ বাবু, এখন তো যুদ্ধ চলছে না, তবু আপনাকে মাঝে-মাঝেই আকাশে প্লেন ওড়াতে হয়?

সুবোধ বললেন, তা তো হয়ই। ট্রায়াল দিতে হয়। আপনাকে তো চিনলাম না?

উত্তর না দিয়ে বিশ্বমামা হো-হো হেসে উঠলেন, হাসি তো নয় অট্টহাস্য যাকে বলে।

সন্তোষ, সুবোধ দুজনেই সেই হাসি শুনে হকচকিয়ে গেলেন। ভল্টদাও এগিয়ে এল কাছে।

বিশ্বমামা হাসি থামিয়ে সুবোধের কাঁধে একটা চাপড় মেরে বললেন, ও সাধুটাধুর কম্ম নয়। আপনিই বৃষ্টি নামাবার আসল ওস্তাদ। সলিড কার্বন-ডাই-অক্সাইড না সিলভার আয়োডাইড?

সুবোধও এবার মৃদু হেসে বলল, আপনি ধরে ফেলেছেন দেখছি।

বিশ্বমামা বললেন, আমি প্রথম থেকেই ভাবছি, আকাশের ওড়ার ব্যবস্থা না থাকলে তো বৃষ্টি নামানো সম্ভব নয়। এইতো একজন জলজ্যান্ত পাইলট পাওয়া গেছে।

তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ব্যাপারটা বুঝলি? মেঘ মানে কী। খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণা, তাই তো? সেই জলকণাগুলো জমাট বেঁধে বড়-বড় ফোঁটা হয়ে বৃষ্টির মতন পড়ে। বাতাসে আর্দ্রতা বেশি না হলে বৃষ্টি নামে না। কেউ যদি প্লেনে করে উড়ে গিয়ে সলিড কার্বন-ডাই-অক্সাইড কিংবা সিলভার আয়োডাইড মেঘে ছড়িয়ে দিতে পারে, তা হলেই জলকণাগুলো দানা বেঁধে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে। সুবোধবাবু কলাইকুণ্ডা থেকে উড়ে এসে এখানকার আকাশের মেঘে সেই জিনিস ছড়িয়ে দেন।

ভন্টুদা তবু অবিশ্বাসের স্বরে বললেন, তাহলে, তাহলে সাধুর দরকার কী? সাধু মন্ত্র পড়লেন…

বিশ্বমামা বললেন, শুধু-শুধু এই একটা বাগানে মাঝে-মাঝে বৃষ্টি হবে। অন্য কোথাও হবে না। তাতে লোকের সন্দেহ হবে। সেই জন্যই একজনকে সাধু সাজিয়ে ভড়ং দেখানো দরকার। এখান দিয়ে একটা প্লেন উড়ে গেছে, তা কেউ লক্ষ করেনি। কী সুবোধবাবু, ঠিক বলছি?

সুবোধ এখনো হাসছে।

বিশ্বমামা বললেন, আপনি হাসছেন বটে। কিন্তু ওই সাধুর বদলে আপনাকেই পুলিশের অ্যারেস্ট করা উচিত।

সুবোধ বললেন, কেন কেন কী অভিযোগে?

বিশ্বমামা বললেন, চুরি!

সুবোধ বললেন, চুরি? তার মানে? আমি কার কী চুরি করেছি। সিলভার আয়োডাইড আমি কিনি নিজের পয়সায়। আকাশের মেঘ কারুর সম্পত্তি নয়।

বিশ্বমামা বললেন, অবশ্যই মেঘ কারুর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। এই মেঘ থেকে স্বাভাবিক বৃষ্টি হলে আশেপাশে সবার জমিতে বৃষ্টি পড়ত। আপনি শুধু এই বাগানে বৃষ্টি ফেলে অন্যদের বঞ্চিত করছেন। বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই সন্তোষবাবুর বাগানে বৃষ্টি পড়ার ফলে তার গাছগুলো বেশি বাড়ছে।

সন্তোষবাবু বললেন, আমি জানতাম না এটা একটা অপরাধ। আমি ভেবেছিলাম, এটা একটা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা।

বিশ্বমামা বললেন, ইচ্ছে মতন কেউ-কেউ তার জমিতে আলাদা ভাবে বৃষ্টি ফেলিয়ে নিলে কিছুদিন পর সারাদেশে মারামারি শুরু হয়ে যাবে। সেই জন্যই ওই পরীক্ষা এখন বন্ধ।

সুবোধের দিকে ফিরে বললেন, আপনি এয়ার ফোর্সের পাইলট। এয়ার ফোর্সের প্লেন এরকম ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করাটাও অপরাধ নয়? জানাজানি হলে আপনার চাকরি যাবে। অবশ্য সেটা জানাবার দায়িত্ব আমার নয়।

এখানে কী কথাবার্তা হচ্ছে সাধুজী তা শুনতে পাচ্ছে না। তিনি হঠাৎ গম্ভীরভাবে একটা মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন।

বিশ্বমামা সেদিকে তাকিয়ে বললেন, বলেছিলাম না ভালো অভিনেতা। ওই সাধুও বোধহয় এই সন্তোষবাবুর এক মাসতুতো ভাই।

বিলুদা বললেন, গোঁফ দাড়িগুলো আসল না নকল টান মেরে দেখব।

ভন্টুদা বললেন, না, না, না, দরকার নেই, দরকার নেই।

সকল অধ্যায়

১. তিন নম্বর চোখ (উপন্যাস)
২. আকাশ দস্যু (উপন্যাস)
৩. অন্ধকারে সবুজ আলো (উপন্যাস)
৪. মহাকালের লিখন
৫. ইচ্ছাশক্তি
৬. বিশ্বমামা ও নকল ফুল
৭. বিশ্বমামার ভূত ধরা
৮. বিশ্বমামার খুদে বন্ধু
৯. বিশ্বমামা ও গলদা চিংড়ি
১০. বিশ্বমামা ও বেড়াল-ভূত
১১. বিশ্বমামার গোয়েন্দাগিরি
১২. বিশ্বমামার চোর ধরা
১৩. বিশ্বমামা ও অহি-নকুল
১৪. বিশ্বমামার রহস্য
১৫. বিশ্বমামার ম্যাজিক
১৬. ম্যাজিশিয়ান বিশ্বমামা
১৭. বিশ্বমামার হায় হায়
১৮. নীল রঙের মানুষ
১৯. নীল মানুষের কাহিনি
২০. নীল মানুষের সংসার
২১. নীল মানুষের মন খারাপ
২২. নীল মানুষের খেলা
২৩. নীল মানুষের পরাজয়
২৪. নীল মানুষের বন্ধু
২৫. নীল মানুষ ও ছোট্ট বন্ধু
২৬. সেই একলা নীল মানুষ
২৭. ভূতের দেশে নীল মানুষ
২৮. দেওয়ালের সেই ছবি
২৯. রণজয়ের শহর-অভিযান
৩০. আজব লড়াই
৩১. খেলার সঙ্গী
৩২. নতুন পুকুরের জাগ্রত দৈত্য
৩৩. রণজয় আর অলৌকিক শিশুরা
৩৪. পঞ্চমশক্তি
৩৫. অদৃশ্য পাখি
৩৬. সেই অদ্ভুত লোকটা
৩৭. হীরে কি গাছে ফলে?
৩৮. রাত্তিরবেলা একা একা
৩৯. মেঘচোর
৪০. সাধুবাবার হাত
৪১. লাল জঙ্গল
৪২. রাক্ষুসে পাথর

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন