মুসলমান মহিলা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কোনো তুরস্কবাসিনী ইংরাজরমণী মুসলমান নারীদিগের একান্ত দুরবস্থার যে বর্ণনা করিয়াছেন তাহা বিশেষ প্রমাণ না পাইলে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা উচিত জ্ঞান করি না। কিন্তু অসূর্যস্পশ্য জেনানার সুখ-দুঃখ সত্য-মিথ্যা কে প্রমাণ করিবে? তবে, আমাদের নিজের অন্তঃপুরের সহিত তুলনা করিয়া কতকটা বুঝা যায়।

লেখিকা গল্প করিতেছেন, তিনি দুইটি মুসলমান অন্তঃপুরচারিণীর সহিত গল্প করিতেছেন এমন সময়ে হঠাৎ দেখিলেন তাহাদের মধ্যে একজন তক্তার নীচে আর-একজন সিন্ধুকের তলায় তাড়াতাড়ি প্রবেশ করিয়া লুকাইয়া পড়িল। ব্যাপারটা আর কিছুই নয় তাহাদের দেবর দ্বারের নিকট উপস্থিত হইয়াছিল। আমাদের দেশে ভ্রাতৃবধূর দৃষ্টিপথে ভাসুরের অভ্যুদয় হইলে কতকটা এই মতোই বিপর্যয় ব্যাপার উপস্থিত হয়। নব্য মুসলমানেরা এইরূপ সতর্ক অবরোধ সম্বন্ধে বলিয়া থাকেন– “বহুমূল্য জহরৎ কি কেহ রাস্তার ধারে ফেলিয়া রাখে? তাহাকে এমন সাবধানে ঢাকিয়া রাখা আবশ্যক যে, সূর্যালোকেও তাহার জ্যোতিকে ম্লান না করিতে পারে।’ আমাদের দেশেও যাঁহারা বাক্যবিন্যাসবিশারদ তাঁহারা এইরূপ বড়ো বড়ো কথা বলিয়া থাকেন। তাঁহারা শাস্ত্রের শ্লোক ও কবিত্বের ছটার দ্বারা প্রমাণ করেন যে, যাহাকে তোমরা মনুষ্যত্বের প্রতি অত্যাচার বল তাহা প্রকৃতপক্ষে দেবত্বের প্রতি সম্মান। কিন্তু কথায় চিঁড়া ভিজে না। যে হতভাগিনী মনুষ্যসুলভ ক্ষুধা লইয়া বসিয়া আছে তাহাকে কেবলই শাস্ত্রীয় স্তুতি দিয়া মাঝে মাঝ পার্থিব দধি না দিলে তাহার বরাদ্দ একমুষ্টি শুষ্ক চিঁড়া গলা দিয়া নাবা নিতান্ত দুঃসাধ্য হইয়া পড়ে।

লেখিকা একটি অতিশয় রোমহর্ষণ ঘটনার উল্লেখ করিয়াছেন। জেনাবের যখন দশ বৎসর বয়স তখন তাহার বাপ তাহাকে হীরা জহরতে জড়িত করিয়া পুত্তলিবেশে আপনার চেয়ে বয়সে ও ধনে সম্ভ্রমে বড়ো একটি বৃদ্ধ স্বামীর হস্তে সমর্পণ করিলেন। একবার স্বামীগৃহে পদার্পণ করিলে বাপ-মায়ের সহিত সাক্ষাৎ বহু সাধনায় ঘটে, বিশেষত যখন তাঁহারা কুলে মানে স্বামীর অপেক্ষা ছোটো। জেনাব দুই ছেলের মা হইল তথাপি বাপের সহিত একবার দেখা হইল না। নানা উপদ্রবে পাগলের মতো হইয়া একদিন সে দাসীর ছদ্মবেশে পলাইয়া পিতার চরণে গিয়া উপস্থিত হইল। কাঁদিয়া বলিল, “বাবা আমাকে মারিয়া ফেলো কিন্তু শ্বশুরবাড়ি পাঠাইয়ো না।’ ইহার পর তাহার প্রাণসংশয় পীড়া উপস্থিত হইল। তাহার অবস্থা ও আকৃতি দেখিয়া বাপের মনে বড়ো আঘাত লাগিল। বাপ জামাতাকে বলিয়া পাঠাইলেন, “কন্যার প্রাপ্য হিসাবে এক পয়সা চাহি না বরঞ্চ তুমি যদি কিছু চাও তো দিতে প্রস্তুত আছি তুমি তোমার স্ত্রীকে মুসলমান বিধি অনুসারে পরিত্যাগ করো।’ সে কহিল, “এত বড়ো কথা! আমার অন্তঃপুরে হস্তক্ষেপ! মশাল্লা! এত সহজে যদি সে নিষ্কৃতি পায় তবে যে আমার দাড়িকে সকলে উপহাস করিবে!’

তাহার রকম-সকম দেখিয়া দূতেরা বাপকে আসিয়া কহিল, “যে রকম গতিক দেখিতেছি তোমার মেয়েকে একবার হাতে পাইলেই বিষম বিপদ ঘটাইবে।’ বাপ বহুযত্নে কন্যাকে লুকাইয়া রাখিলেন।

বলিতে হৃৎকম্প হয় পাষণ্ড স্বামী নিজের অপোগণ্ড বালক দুটিকে ঘাড় মটকাইয়া বধ করিয়া তাহাদরে সদ্যমৃত দেহ স্ত্রীর নিকট উপহারস্বরূপ পাঠাইয়া দিল।

মা কেবল একবার আর্তস্বরে চিৎকার করিয়া আর মাথা তুলিল না, দু-চারি দিনেই দুঃখের জীবন শেষ করিল।

এইরূপ অমানুষিক ঘটনা জাতীয় চরিত্রসূচক দৃষ্টান্তরূপে উল্লেখ করা লেখিকার পক্ষে ন্যায়সংগত হইয়াছে বলিতে পারি না কিন্তু ইহা নিশ্চয় যে, একীকরণের মাহাত্ম্য সম্বন্ধে যিনিই যত বড়ো বড়ো কথা বলুন, মানুষের প্রতি মানুষের অধিকারের একটা সীমা আছে; পৃথিবীর প্রাচ্য প্রদেশের স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অধিকার সেই সীমা এতদূর অতিক্রম করিয়াছে যে, আধ্যাত্মিকতার দোহাই দিয়া কতকগুলা আগ্‌ড়ম্‌ বাগ্‌ড়ম্‌ বকিয়া আমাদিগকে কেবল কথার ছলে লজ্জা নিবারণ করিতে হইতেছে।

সকল অধ্যায়

১. মণিপুরের বর্ণনা
২. আমেরিকার সমাজচিত্র
৩. পৌরাণিক মহাপ্লাবন
৪. মুসলমান মহিলা
৫. প্রাচ্য সভ্যতার প্রাচীনত্ব
৬. ক্ষিপ্ত রমণীসম্প্রদায়
৭. সীমান্ত প্রদেশ ও আশ্রিতরাজ্য
৮. ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ
৯. স্ত্রী-মজুর
১০. প্রাচীন-পুঁথি উদ্ধার
১১. ক্যাথলিক সোশ্যালিজ্‌ম্‌
১২. আমেরিকানের রক্তপিপাসা
১৩. সুখ দুঃখ
১৪. সোশ্যালিজ্‌ম্‌
১৫. প্রাচীন শূন্যবাদ
১৬. পরিবারাশ্রম
১৭. মানুষসৃষ্টি
১৮. জিব্রল্টার বর্জন
১৯. পলিটিক্স্‌
২০. কন্‌গ্রেসে বিদ্রোহ
২১. ভারত কৌন্সিলের স্বাধীনতা
২২. পুলিস রেগুলেশন বিল
২৩. ভারতবর্ষীয় প্রকৃতি
২৪. ধর্মপ্রচার
২৫. ইণ্ডিয়ান রিলিফ সোসাইটি
২৬. উদ্দেশ্য সংক্ষেপ ও কর্তব্য বিস্তার
২৭. হিন্দু ও মুসলমান
২৮. কন্‌গ্রেসে বিদ্রোহ
২৯. রাষ্ট্রীয় ব্যাপার
৩০. ফেরোজ শা মেটা
৩১. বেয়াদব
৩২. কথামালার একটি গল্প
৩৩. চাবুক-পরিপাক
৩৪. জাতীয় আদর্শ
৩৫. অপূর্ব দেশহিতৈষিতা
৩৬. কুকুরের প্রতি মুগুর
৩৭. ইংলন্ডে ও ভারতবর্ষে সমকালীন সিবিল সর্বিস পরীক্ষা
৩৮. মতের আশ্চর্য ঐক্য
৩৯. ইংরাজি ভাষা শিক্ষা
৪০. জাতীয় সাহিত্য
৪১. ভ্রম স্বীকার
৪২. চিত্রল অধিকার
৪৩. ইংরাজের লোকপ্রিয়তা
৪৪. ইংরাজের স্বদোষ-বাৎসল্য
৪৫. ইংরাজের লোকলজ্জা
৪৬. প্রাচী ও প্রতীচী
৪৭. নূতন সংস্করণ
৪৮. জাতিভেদ
৪৯. বিবাহে পণগ্রহণ
৫০. ইংরাজের কাপুরুষতা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন