বিবাহে পণগ্রহণ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পুরুষ যখন কোনো বিশেষ কন্যাকে বিবাহ করে অবশ্যই তাহার কোনো বিশেষ কারণ থাকে। হয়, তাহাকে ভালোবাসে, নয়, তাহার কুলশীল রূপগুণ অথবা অর্থের আকর্ষণে বদ্ধ হয়। আমাদের দেশে বিবাহযোগ্যা কন্যার বয়স অল্প, এবং তাহার সহিত বিবাহযোগ্য পুরুষের পরিচয় থাকে না সুতরাং বিবাহের পূর্বে ভালোবাসার কোনো সম্বন্ধ থাকিতে পারে না। কন্যার কী কী গুণ আছে এবং কালক্রমে কী কী গুণ ফুটিয়া বাহির হইবার সম্ভাবনা, তাহা কেবল কন্যাকর্তারা এবং অন্তর্যামীই জানেন। রূপ জিনিসটা দুর্লভ এবং বাল্য-সৌন্দর্য যুবকের চিত্তে অনতিক্রমণীয় মোহসঞ্চার করে না। আজকালকার ছেলেদের কাছে কুলগৌরবের বিশেষ কোনো মর্যাদা নাই। তবে একজন বুদ্ধিমান জীব কী দেখিয়া আমৃত্যু কালের জন্য সংসারভার মাথায় তুলিয়া লইবে? সে কি পঞ্জিকার বিশেষ একটা দিনস্থির করিয়া প্রাতঃকালে উঠিয়া যে-কোনো কন্যাকে সম্মুখে দেখিবে তাহাকেই বিবাহ করিবে? সে কি কন্যাদায়গ্রস্তের কন্যাভার মোচনের জন্যই সংসারে আগমন করিয়াছিল?

মনুর বিধানের ফলে আমাদের দেশে একটি বিবাহযোগ্য পুরুষকে যখন কন্যার পিতা দশজনে আসিয়া আক্রমণ করে, তখন তাহাকে কোনো একাট বিশেষ সদ্‌বিবেচনার নিয়ম অবলম্বন করিয়া কন্যা নির্বাচন করিতে হইবে– যদি তাহা না করে তবে সে গর্দভ, এবং দশটি কন্যাদায়িকেরই তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া যাওয়া কর্তব্য। কলেজ হইতে বাহির হইবামাত্র অথবা বাহির হইবার পূর্বেই তাহাকে বিবাহের ফাঁদে ফেলিবার জন্য টানাটানি চলিতে থাকে। তখন তাহার সম্মুখে তরঙ্গসংকুল অকূল সংসার, এবং সেই সংকটসমুদ্রে পার হইবার উপায় অর্থতরণী। তুমি নিজের স্কন্ধ হইতে একটি ভার লইয়া আর-একটি বুদ্ধিবৃত্তিবিশিষ্ট জীবের স্কন্ধে চাপাইয়া তাহাকে ওই অকূল সমুদ্রের মধ্যে ফেলিয়া দিতে চাও; সে সহজেই বলিতে পারে, আগে নৌকার সন্ধান দাও তাহার পরে তোমার বোঝাটি লইয়া আমি এই পারাবারে অবতীর্ণ হইতে পারি নতুবা ওটিকে কাঁধে করিয়া আমি সন্তরণ করিতে পারিব না– আজকালকার দিনে নিজের ভার সংবরণ করাই দুঃসাধ্য।

এই প্রস্তাবের জন্য ছেলেটিকে নিন্দা করা যায় না। অথচ যে সম্বন্ধ চিরজীবনের নিকটতম সম্বন্ধ আরম্ভকালেই সে সম্বন্ধকে ইতর দোকানদারির দ্বারা কলুষিত করিয়া তুলিতে আত্মসম্মানজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেরই ধিক্কার অনুভব করা স্বাভাবিক। কিন্তু পৃথিবীতে সকল সম্বন্ধের মূলেই হয় প্রীতি, নয় স্বার্থ। যেখানে প্রীতিসম্বন্ধের পথ নাই সেখানে স্বার্থ সম্বন্ধ ব্যতীত কী আশা করিতে পারি!

অতএব, দোষ দিতে হইলে সমাজবিধানকেই দোষ দিতে হয়, যে ব্যক্তি পণ লইয়া বিবাহ করে তাহাকে নহে। একটু সবুর করো, যুবকটিকে নিজের চেষ্টায় ও উপার্জনে স্বাধীন হইতে দাও, তাহার পরে সে যখন নিজের হৃদয়ের অনুসরণ করিয়া বিবাহ করিতে প্রবৃত্ত হইবে তখন যদি টাকার জন্য হাত বাড়াইয়া বসে তবে তাহাকে নির্লজ্জ অভদ্র অর্থলোলুপ অযোগ্য বলিয়া তিরস্কার করিতে পারো। যতক্ষণ তাহার পক্ষে কোনো বিশেষ আকর্ষণ নাই এবং তোমার পক্ষে স্বার্থ, ততক্ষণ স্বার্থের বিনিময়েই স্বার্থ সাধন করিয়া লইতে হইবে ইহাই সংসারের নিয়ম। এ নিয়মকে কোনো আইন অথবা আবদারের দ্বারা পরাহত করা সম্ভব নহে।

সকল অধ্যায়

১. মণিপুরের বর্ণনা
২. আমেরিকার সমাজচিত্র
৩. পৌরাণিক মহাপ্লাবন
৪. মুসলমান মহিলা
৫. প্রাচ্য সভ্যতার প্রাচীনত্ব
৬. ক্ষিপ্ত রমণীসম্প্রদায়
৭. সীমান্ত প্রদেশ ও আশ্রিতরাজ্য
৮. ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ
৯. স্ত্রী-মজুর
১০. প্রাচীন-পুঁথি উদ্ধার
১১. ক্যাথলিক সোশ্যালিজ্‌ম্‌
১২. আমেরিকানের রক্তপিপাসা
১৩. সুখ দুঃখ
১৪. সোশ্যালিজ্‌ম্‌
১৫. প্রাচীন শূন্যবাদ
১৬. পরিবারাশ্রম
১৭. মানুষসৃষ্টি
১৮. জিব্রল্টার বর্জন
১৯. পলিটিক্স্‌
২০. কন্‌গ্রেসে বিদ্রোহ
২১. ভারত কৌন্সিলের স্বাধীনতা
২২. পুলিস রেগুলেশন বিল
২৩. ভারতবর্ষীয় প্রকৃতি
২৪. ধর্মপ্রচার
২৫. ইণ্ডিয়ান রিলিফ সোসাইটি
২৬. উদ্দেশ্য সংক্ষেপ ও কর্তব্য বিস্তার
২৭. হিন্দু ও মুসলমান
২৮. কন্‌গ্রেসে বিদ্রোহ
২৯. রাষ্ট্রীয় ব্যাপার
৩০. ফেরোজ শা মেটা
৩১. বেয়াদব
৩২. কথামালার একটি গল্প
৩৩. চাবুক-পরিপাক
৩৪. জাতীয় আদর্শ
৩৫. অপূর্ব দেশহিতৈষিতা
৩৬. কুকুরের প্রতি মুগুর
৩৭. ইংলন্ডে ও ভারতবর্ষে সমকালীন সিবিল সর্বিস পরীক্ষা
৩৮. মতের আশ্চর্য ঐক্য
৩৯. ইংরাজি ভাষা শিক্ষা
৪০. জাতীয় সাহিত্য
৪১. ভ্রম স্বীকার
৪২. চিত্রল অধিকার
৪৩. ইংরাজের লোকপ্রিয়তা
৪৪. ইংরাজের স্বদোষ-বাৎসল্য
৪৫. ইংরাজের লোকলজ্জা
৪৬. প্রাচী ও প্রতীচী
৪৭. নূতন সংস্করণ
৪৮. জাতিভেদ
৪৯. বিবাহে পণগ্রহণ
৫০. ইংরাজের কাপুরুষতা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন