সুখ দুঃখ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যাহারা রীতিমতো বাঁচিতে চাহে, মুমূর্ষুভাবে কালযাপন করিতে চাহে না, তাহারা দুঃখ দিয়াও সুখ কেনে। হ্যফ্‌ডিং বলেন ভালোবাসা ইহার একটি দৃষ্টান্তস্থল। ভালোবাসাকে সুখ বলিবে না দুঃখ বলিবে? গ্যেটে তাঁহার কোনো নাটকের নায়িকাকে বলাইয়াছেন যে, ভালোবাসায়

কভু স্বর্গে তোলে, কভু হানে মৃত্যুবাণ।

অতএব সহজেই মনে হইতে পারে এ ল্যাঠায় আবশ্যক কী? কিন্তু এখনও গানটা শেষ হয় নাই। সুখ দুঃখ সমস্ত হিসাব করিয়া শেষ কথাটা এইরূপ বলা হইয়াছে–

সেই শুধু সুখী, ভালোবাসে যার প্রাণ।

ইহার মর্ম কথাটা এই যে, ভালোবাসায় হৃদয় মন যে একটা গতি প্রাপ্ত হয় তাহাতেই এমন একটা গভীর এবং উদার পরিতৃপ্তি আছে যে, প্রবল বেগে সুখ-দুঃখের মধ্যে আন্দোলিত হইয়াও মোটের উপর সুখের ভাবই থাকিয়া যায়, এমন-কি, এই আন্দোলনে সুখ বল প্রাপ্ত হয়।

এই সুখের সহিত দুইটি মানসিক কারণ লিপ্ত আছে। প্রথমত, দুঃখ যে পর্যন্ত একটা বিশেষ সীমা না লঙ্ঘন করে সে পর্যন্ত সুখের পশ্চাতে থাকিয়া সুখকে প্রস্ফুটিত করিয়া তোলে। এই কারণে, যাহারা সুখের গাঢ়তাকে প্রার্থনীয় জ্ঞান করে তাহারা অবিমিশ্র সামান্য সুখের অপেক্ষা দুঃখমিশ্রিত গভীর সুখের জন্য অধিকতর সচেষ্ট। দ্বিতীয়ত, দুঃখেরই একটা বিশেষ আকর্ষণ আছে। কারণ, দুঃখের দ্বারা হৃদয়ের মধ্যে যে একটা প্রবল বেগ, সমস্ত প্রকৃতির একটা একাগ্র পরিচালনা উপস্থিত হয় তাহাতেই একটা বিশেষ পরিতৃপ্তি আছে। ক্ষমতার চালনামাত্রই নিতান্ত অপরিমিত না হইলে একটা আনন্দ দান করে। বিখ্যাত দার্শনিক ওগুস্ত্‌ কোঁৎ তাঁহার প্রণয়িনীর মৃত্যুর পরে এই বলিয়া শোক প্রকাশ করিয়াছিলেন, “আমি মরিবার পূর্বে মনুষ্যপ্রকৃতির সর্বোচ্চ মনোভাব যে অনুভব করিতে পরিয়াছি সে কেবল তোমরাই প্রসাদে। এই মনোভাবের সঙ্গে সঙ্গে যত কিছু কঠিনতম যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছি সেইসঙ্গে এ কথা সর্বদাই মনে উদয় হইয়াছে যে, হৃদয়কে পরিপূর্ণ করাই সুখের একমাত্র উপায়, তা সে যদি দুঃখ দিয়া তীব্রতম যন্ত্রণা দিয়া হয় সেও স্বীকার।’– আমরা যদি দুঃখ হইতে সম্পূর্ণ অব্যাহতি পাইতে চাই তবে কিছুতেই ভালোবাসিতে পারি না। কিন্তু ভালোবাসাই যদি সর্বোচ্চ সুখ হয় তবে দুঃখের ভয়ে কে তাহাকে ত্যাগ করিবে! কর্মানুষ্ঠানের প্রবলতা ও জীবনের পরিপূর্ণতার সঙ্গে সঙ্গে বিস্তর ব্যয়, মুহুর্মুহু ঘাত-প্রতিঘাত এবং অবিশ্রাম আন্দোলন আছেই। কিন্তু জীবনের সর্বোচ্চ সম্পদগুলি বিনামূল্যে কে প্রত্যাশা করে!

মনস্তত্ত্ববিৎ পণ্ডিতের কথা উপরে প্রকাশিত হইল এখন কবি চণ্ডীদাসের দুটি কথা উদ্ধৃত করিয়া শেষ করি। রাধিকা যখন অসহ্য বেদনায় বলিতেছেন–

“বিধি যদি শুনিত, মরণ হইত,
ঘুচিত সকল দুখ’

তখন–

চণ্ডীদাস কয় “এমতি হইলে
পিরীতির কিবা সুখ!’

দুঃখই যদি গেল তবে সুখ কিসের!

সাধনা, চৈত্র, ১২৯৮

সকল অধ্যায়

১. মণিপুরের বর্ণনা
২. আমেরিকার সমাজচিত্র
৩. পৌরাণিক মহাপ্লাবন
৪. মুসলমান মহিলা
৫. প্রাচ্য সভ্যতার প্রাচীনত্ব
৬. ক্ষিপ্ত রমণীসম্প্রদায়
৭. সীমান্ত প্রদেশ ও আশ্রিতরাজ্য
৮. ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ
৯. স্ত্রী-মজুর
১০. প্রাচীন-পুঁথি উদ্ধার
১১. ক্যাথলিক সোশ্যালিজ্‌ম্‌
১২. আমেরিকানের রক্তপিপাসা
১৩. সুখ দুঃখ
১৪. সোশ্যালিজ্‌ম্‌
১৫. প্রাচীন শূন্যবাদ
১৬. পরিবারাশ্রম
১৭. মানুষসৃষ্টি
১৮. জিব্রল্টার বর্জন
১৯. পলিটিক্স্‌
২০. কন্‌গ্রেসে বিদ্রোহ
২১. ভারত কৌন্সিলের স্বাধীনতা
২২. পুলিস রেগুলেশন বিল
২৩. ভারতবর্ষীয় প্রকৃতি
২৪. ধর্মপ্রচার
২৫. ইণ্ডিয়ান রিলিফ সোসাইটি
২৬. উদ্দেশ্য সংক্ষেপ ও কর্তব্য বিস্তার
২৭. হিন্দু ও মুসলমান
২৮. কন্‌গ্রেসে বিদ্রোহ
২৯. রাষ্ট্রীয় ব্যাপার
৩০. ফেরোজ শা মেটা
৩১. বেয়াদব
৩২. কথামালার একটি গল্প
৩৩. চাবুক-পরিপাক
৩৪. জাতীয় আদর্শ
৩৫. অপূর্ব দেশহিতৈষিতা
৩৬. কুকুরের প্রতি মুগুর
৩৭. ইংলন্ডে ও ভারতবর্ষে সমকালীন সিবিল সর্বিস পরীক্ষা
৩৮. মতের আশ্চর্য ঐক্য
৩৯. ইংরাজি ভাষা শিক্ষা
৪০. জাতীয় সাহিত্য
৪১. ভ্রম স্বীকার
৪২. চিত্রল অধিকার
৪৩. ইংরাজের লোকপ্রিয়তা
৪৪. ইংরাজের স্বদোষ-বাৎসল্য
৪৫. ইংরাজের লোকলজ্জা
৪৬. প্রাচী ও প্রতীচী
৪৭. নূতন সংস্করণ
৪৮. জাতিভেদ
৪৯. বিবাহে পণগ্রহণ
৫০. ইংরাজের কাপুরুষতা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন