প্রাচীন শূন্যবাদ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মায়ার হস্ত এড়াইবার উদ্দেশ্যে কীরূপ তর্কের মায়াপাশ বিস্তার করিতে হয় তাহার একটি দৃষ্টান্ত পাঠকদের কৌতূহলজনক বোধ হইতে পারে।

গ্রন্থখানির নাম মধ্যমকবৃত্তি। ইহা “বিনয় সূত্র’ নামক কোনো এক প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থের প্রাচীন ভাষ্য। ভাষ্যকারের নাম চন্দ্রকীর্তি আচার্য।

ইনি একজন শূন্যবাদী। কিছুই যে নাই ইহা প্রমাণ করাই ইঁহার উদ্দেশ্য। কী করিয়া প্রমাণ করিতেছেন দেখা যাউক।

প্রথমে প্রতিপক্ষ বলিলেন– দর্শন শ্রবণ ঘ্রাণ রসন স্পর্শন এবং মন এই ছয় ইন্দ্রিয়ের দ্বারা দ্রষ্টব্য প্রভৃতি বিষয় আমাদের গোচর হইয়া থাকে।

টীকাকার বলিতেছেন, দর্শন যে একটা স্বাভাবিক শক্তি উপরি-উক্ত বচনে এই কথা মানিয়া লওয়া হইল। কিন্তু তাহা হইতে পারে না। দর্শনশক্তি যে আছে এ কথা কে বলিল?

কারণ,

স্বমাত্মানং হি তত্ত্বমেব ন পশ্যতি।
ন পশ্যতি যদাত্মানং কথং দ্রক্ষ্যতি তৎ পরান্‌।

অর্থাৎ চক্ষু আপনার তত্ত্ব আপনি দেখিতে পায় না, অতএব যে আপনাকে দেখিতে পায় না সে অন্যকে কী করিয়া দেখিবে?

প্রমাণ হইয়া গেল চক্ষু দেখিতে পায় না। “তস্মান্নাস্তি দর্শনং।’

কিন্তু প্রতিবাদী বলিতে পারেন–

“যদ্যপি স্বাত্মানং দর্শনং ন পশ্যতি, তথাপি অগ্নিবৎ পরান্‌ দ্রক্ষ্যতি। তথাহি অগ্নি পরাত্মানমেব দহতি ন স্বাত্মানং এবং দর্শনং পরানেব দ্রক্ষ্যতি ন স্বাত্মানং ইতি।

অর্থাৎ অগ্নি যেমন পরকে দহন করে কিন্তু আপনি দগ্ধ হয় না, তেমনি চক্ষু অন্যকে দেখে নিজেকে দেখিতে পায় না– ইহা অসম্ভব নহে।

উত্তরদাতা বলেন– এতদপ্যযুক্তং। ইহাও যুক্তিসিদ্ধ নহে।

কারণ,

ন পর্যাপ্তোহগ্নিদৃষ্টান্তো দর্শনস্য প্রসিদ্ধয়ে।
সদর্শনঃ স প্রত্যুক্তো গম্যমানগতাগতৈঃ।

অর্থাৎ অগ্নিদৃষ্টান্ত দর্শন প্রমাণের পক্ষে পর্যাপ্ত নহে। কারণ, গম্যমানগতাগতের দ্বারা দহনশক্তি এবং দর্শনশক্তি উভয়ই অপ্রমাণ হইতেছে।

“গম্যমানগতাগত’ বলিতে কী বুঝায় সেটা একটু মনোযোগ করিয়া বুঝা আবশ্যক।

“গতং ন গম্যতে নাগতং ন গম্যমানং এবং অগ্নিনাপি দগ্ধং ন দহ্যতে নাদগ্ধং দহ্যতে ইত্যাদিনা সমং বাচ্যং। যথা চ ন গতং নাগতং ন গম্যমানং এবং ন দৃষ্টং দৃশ্যতে তাবদ্‌দৃষ্টং নৈব দৃশ্যতে। দৃষ্টাদৃষ্টবিনির্মুক্তং দৃশ্যমানং ন দৃশ্যতে।’

অর্থাৎ যাহা গত তাহা যাইতে পারে না, যাহা অগত তাহাও যাইতে পারে না এবং যাহা গতও নহে অগতও নহে কেবলমাত্র গম্যমান, তাহারই বা যাওয়া হইল কই? তেমনি, যাহা দগ্ধ তাহার দহন হয় না, যাহা অদগ্ধ তাহারও দহন হয় না, যাহা দহ্যমান তাহারই বা দাহ হইল কই? পুনশ্চ যাহা দৃষ্ট তাহা আর দেখা হয় না, যাহা অদৃষ্ট তাহাও দেখা হয় না, যাহা দৃষ্টও নহে অদৃষ্টও নহে কেবল দৃশ্যমান তাহাও দেখা হইতে পারে না। ভাবটা এই, যাহা হইয়া গেছে তারা তো চুকিয়াই গেছে, যাহা হয় নাই তাহার কথা ছাড়িয়াই দাও, যাহা হইতেছে মাত্র তাহাকে হইল এমন কথা কেহ বলিতে পারে না।

“এবং দর্শনং পশ্যতে তাবদিত্যাদিনা অগ্নিদৃষ্টান্তেন সহ গম্যমানগতাগতৈর্যস্মাৎ সমং দূষণং অতোহগ্নিবদ্দর্শনসিদ্ধিরিতি ন যুজ্যতে।’

তবেই তো এক “গম্যমানগতাগতে’র দ্বারা চক্ষুই বল অগ্নিই বল সমস্ত অসিদ্ধ হইয়া গেল। সিদ্ধ হইল কী?

“ততশ্চ সিদ্ধমেতৎ স্বাত্মবদ্দর্শনং পরানপি ন পশ্যতীতি।’

অর্থাৎ চক্ষু আপনাকে দেখিতে পায় না তেমনি পরকেও দেখিতে পায় না।

সাধনা, অগ্রহায়ণ, ১২৯৯

সকল অধ্যায়

১. মণিপুরের বর্ণনা
২. আমেরিকার সমাজচিত্র
৩. পৌরাণিক মহাপ্লাবন
৪. মুসলমান মহিলা
৫. প্রাচ্য সভ্যতার প্রাচীনত্ব
৬. ক্ষিপ্ত রমণীসম্প্রদায়
৭. সীমান্ত প্রদেশ ও আশ্রিতরাজ্য
৮. ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ
৯. স্ত্রী-মজুর
১০. প্রাচীন-পুঁথি উদ্ধার
১১. ক্যাথলিক সোশ্যালিজ্‌ম্‌
১২. আমেরিকানের রক্তপিপাসা
১৩. সুখ দুঃখ
১৪. সোশ্যালিজ্‌ম্‌
১৫. প্রাচীন শূন্যবাদ
১৬. পরিবারাশ্রম
১৭. মানুষসৃষ্টি
১৮. জিব্রল্টার বর্জন
১৯. পলিটিক্স্‌
২০. কন্‌গ্রেসে বিদ্রোহ
২১. ভারত কৌন্সিলের স্বাধীনতা
২২. পুলিস রেগুলেশন বিল
২৩. ভারতবর্ষীয় প্রকৃতি
২৪. ধর্মপ্রচার
২৫. ইণ্ডিয়ান রিলিফ সোসাইটি
২৬. উদ্দেশ্য সংক্ষেপ ও কর্তব্য বিস্তার
২৭. হিন্দু ও মুসলমান
২৮. কন্‌গ্রেসে বিদ্রোহ
২৯. রাষ্ট্রীয় ব্যাপার
৩০. ফেরোজ শা মেটা
৩১. বেয়াদব
৩২. কথামালার একটি গল্প
৩৩. চাবুক-পরিপাক
৩৪. জাতীয় আদর্শ
৩৫. অপূর্ব দেশহিতৈষিতা
৩৬. কুকুরের প্রতি মুগুর
৩৭. ইংলন্ডে ও ভারতবর্ষে সমকালীন সিবিল সর্বিস পরীক্ষা
৩৮. মতের আশ্চর্য ঐক্য
৩৯. ইংরাজি ভাষা শিক্ষা
৪০. জাতীয় সাহিত্য
৪১. ভ্রম স্বীকার
৪২. চিত্রল অধিকার
৪৩. ইংরাজের লোকপ্রিয়তা
৪৪. ইংরাজের স্বদোষ-বাৎসল্য
৪৫. ইংরাজের লোকলজ্জা
৪৬. প্রাচী ও প্রতীচী
৪৭. নূতন সংস্করণ
৪৮. জাতিভেদ
৪৯. বিবাহে পণগ্রহণ
৫০. ইংরাজের কাপুরুষতা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন