হারানো সেই দিনের কথা – আইজাক আসিমভ

রণেন ঘোষ

হারানো সেই দিনের কথা – আইজাক আসিমভ

সেই রাতেই মার্গী ঘটনাটা ডায়েরিতে লিখে ফেলল। মে ১৭,২১৫৫ চিহ্নিত পাতায় সে লিখল– আজকে টমি এক সত্যিকারের বই পেয়েছে।

বইটি খুবই পুরোনো। মাগীর দাদু একদিন কথাচ্ছলে বলেছিলেন যে, উনি যখন খুবই ছোট তখন ওঁর দাদু বলেছিলেন, এমন একদিন ছিল যখন প্রতিটি গল্পই কাগজে ছাপা হত।

বইটা নেড়েচেড়ে পাতা উলটে সে দেখল পাতাগুলো একেবারে হলদেটে মুড়মুড়ে হয়ে গেছে। বই পড়তে বেশ মজা লাগে। কালো অক্ষরগুলো কেমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আবার থাকে… সরে সরে যায় না। এরা তো জানে স্ক্রিনে অক্ষরগুলো ক্রমশ সরে যায়– নতুন অক্ষরে সেই স্থান পূরণ হয়। প্রথম থেকে আবার বইয়ের পাতা খুলল– আশ্চর্য! অক্ষরগুলো এখনও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। কখনও সরে যায়নি।

টমি বলে ওঠে, দেখ দেখ… নষ্টের কোনও শেষ নেই। একবার পড়া হয়ে গেলেই তো বইটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়। অথচ টেলিভিশন স্ক্রিনে লক্ষ লক্ষ বই থাকে। বই ফেলে দেবার কোনও সুযোগই নেই।

–আমিও তাই ভাবছি। বলল মার্গী। ওর বয়স এগারো। সমসংখ্যায় টমির মতোই বই পড়েছে টেলিস্ক্রিনে। টমির বয়স এখন তেরো বছর।

-–কোথায় পেলি রে?

–বাড়িতে। বই থেকে মুখ না তুলে বলল টমি। বই-এর পাতায় চোখদুটো যেন আঠা দিয়ে আটকে গেছে।

–কীসের গল্প?

–স্কুলের।

মার্গীর চোখে মুখে অবজ্ঞার ছাপ।

-–স্কুল? স্কুল নিয়ে আবার লেখার কী আছে? স্কুল একদম বাজে পচা। স্কুলকে বরাবর। ঘৃণা করে মার্গী। এখন আরও বেশি করে বিতৃষ্ণা জন্মাল। যন্ত্র মাস্টারমশাই ভূগোল নিয়ে একের পর এক টেস্ট করে চলে আর মার্গীও ক্রমান্বয়ে ফল খারাপ করে চলেছে। এই না দেখে মা একদিন ওর চুলের ঝুঁটি ধরে নেড়ে দিয়েছিল, তাতেও হয়নি… তাকে সটান কাউন্টি ইনস্পেক্টারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল।

কাউন্টি ইনস্পেকটারকে ছোটখাটো গোলগাল দেখতে। মুখখানা রক্তবর্ণ। সামনে বাক্স ভরতি নানান মিটার আর তার যন্ত্রপাতি। তিনি এক গাল হেসে মার্গীর দিকে একটা আপেল এগিয়ে দিয়ে শিক্ষককে আলাদা করে সরিয়ে দিয়েছিলেন। মার্গীর মনে হয়েছিল যাক বাঁচা গেল… মাস্টারকে আর সারানো যাবে না। কিন্তু একঘণ্টার মধ্যে তার ভুল ভাঙল। মাস্টারকে আবার যথাস্থানে দেখা গেল। বড় কালো… বড় স্ক্রিনটা কী বিশ্রী। ওই স্ক্রিনের ওপরেই পড়ার বিষয়গুলো ফুটে উঠছে… পরক্ষণেই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছে। না, এই পর্যন্ত তবুও সহ্য করা যায়, কিন্তু যখন স্ক্রিনে শূন্য খুপরি ভেসে ওঠে আর সেই খুপরিগুলোতে বোতাম টিপে সঠিক উত্তর বসাতে হয় সেই সময়টার মতো বাজে বোধহয় আর কিছু হয় না। এমনি করেই হোমওয়ার্ক আর টেস্ট পেপারের সমাধান করে ওরা। ছয় বছর বয়সের সময়েই এইসব শিখেছিল মার্গী।

…কেমন করে পাঞ্চ কোডে উত্তর দিতে হয়। উত্তর ভুল হলে ভুল সংশোধনের কোনও উপায় নেই… তারই ওপরে যন্ত্রশিক্ষক নম্বর দিতে শুরু করে।

কাজ শেষ করে মার্গীর মাথায় হাত দিয়ে আদর করলেন ইন্সপেক্টার। তারপর মা-কে ডেকে বললেন, এতে মার্গীর কোনও দোষ নেই। আসলে ভূগোলের অংশটা সামান্য দ্রুত হয়ে গেছিল। যন্ত্র তো! চলতে চলতে এমন হয়ে যায় সময়ে সময়ে। যাক আমি সব ঠিক করে দিয়েছি। দশ বছরের সময়সীমায় বেঁধে দিয়েছি। তা ছাড়া আপনার মেয়ের সব বিষয়ের ফলাফল দেখলাম, খারাপ তো কিছু নয়… বরং বেশ ভালো। কথার শেষে মার্গীকে আবার আদর করলেন ইনস্পেকটার।

মার্গী ভীষণভাবে হতাশ হয়ে পড়ল। সে ভেবেছিল যন্ত্রশিক্ষককে বোধহয় একেবারেই সরিয়ে নেবে। টমির বেলায় কিন্তু হয়েছিল… পুরো একমাস যন্ত্রশিক্ষককে রেখে দিয়েছিলেন ইনস্পেকটার। কারণ ইতিহাসের অংশটা একেবারেই কালো হয়ে গেছিল।

স্কুল সম্বন্ধে বিরূপ অভিজ্ঞতার কারণেই মার্গী বলে উঠল– হ্যাঁরে!

স্কুল সম্বন্ধে এত লেখার কী আছে? লেখেই বা কেন?

বিজ্ঞের মতো বড় বড় চোখ করে ওর দিকে তাকাল টমি। তোর মাথায় কিছু নেই বুঝলি। এ কি আমাদের স্কুল? একেবারে অন্য রকম স্কুল, বুঝলি হাঁদা-গঙ্গারাম। একেবারে আদ্যিকালের স্কুল… শয়ে শয়ে তখন এরকম স্কুল ছিল… তাও আজ থেকে হাজার বছর আগে! টমির কথা বলার ধরনই আলাদা… কথা শুনে মনে হয় টমিই বোধহয় পুরোনো স্কুল দেখেছিল… একেবারে চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা আছে।

মার্গী বেশ দমে গেল। ভালো ভালো… সব তুমি জানো! আমি না হয় কিছু জানি না… আদ্যিকালের স্কুলে কী ছিল, জেনেও কাজ নেই আমার। একে তো স্কুল, ও আবার কোন মান্ধাতা যুগের!

রাগের মাথায় কথাগুলো বললেও টমির ঘাড়ের ফাঁক দিয়ে সেও বইয়ের পাতার ওপরে চোখ বোলাল। একটু পরে বলল, আচ্ছা তখনও মাস্টার ছিল?

থাকবে না আবার! তবে সে যন্ত্রমাস্টার নয়, মানুষ-মাস্টার।

মানুষ? মানুষ আবার মাস্টার হবে কেমন করে?

কেন? ছেলেমেয়েদের পড়া বলে দিত… হোমওয়ার্ক দিত… প্রশ্ন করত… পরীক্ষা নিত!

না না মানুষ কি কখনও যন্ত্রের মতো সব জানতে পারে?

নিশ্চয়। মানুষই তো পারত! একবার ভেবে দেখ তো, বাবা-মা তো যন্ত্রমাস্টারের মতোই সব জানে।

তুমি বললেই হবে। মানুষ কখনওই মাস্টারের মতো জানতে পারে না।

একটু থমকে গেল টমি। বলল, হ্যাঁ– হয়তো বেশি জানে না কিন্তু সমান সমান জানে নিশ্চয়ই।

নাঃ,–টমির সঙ্গে মার্গী এই বিষয় নিয়ে বেশি তর্ক করতে চায় না। তবুও বলল তুমি যা-ই বলো না কেন… একটা অচেনা মানুষ আমার বাড়িতে মাস্টার হয়ে থাকবে এটা আমি ভাবতেই পারছি না। বাড়িতে বসে আবার আমাকে পড়াবে… কী বিশ্রী!

টমি এবার হো হো করে হেসে উঠল। কী যে বলিস তুই? মাস্টাররা তখন ছাত্রদের বাড়িতে থাকত না–একটা আলাদা বাড়িতে থাকত… ছেলেমেয়েরা সবাই সেই বাড়িতে যেত।

–এরা সকলে একই বিষয় পড়ত?

–নিশ্চয়ই। তবে সকলেই যদি একই বয়সের হত।

–তবে যে আমার মা বলে, ছেলেমেয়েদের মন বুঝে মাস্টারকে সেইভাবে প্রোগ্রাম করতে হয়… তার ফলে ভিন্ন ভিন্ন ছেলেমেয়ে ভিন্ন-ভিন্নভাবে পড়াশোনা করে। মানে প্রত্যেকে আলাদা আলাদা লেখাপড়া শেখে।

–হ্যাঁ, ঠিক এই রকম ছিল। অবশ্য এখনকার মতো ঠিক এমনভাবে হত না। বেশ তো, এত কথায় কাজ নেই। তোমার ভালো না লাগলে তুমি পড়বে না।

–না, সে কথা আমি বলিনি টমি। আমার ভালো লাগা না-লাগার কথা নয়। কথার মোড় ঘোরাতে চাইল মার্গী। সেই সব মজার স্কুল সম্বন্ধে আরও কিছু জানতে চায় সে… আর সেইজন্যই বইটা পড়া ওর একান্তই দরকার।

…বইটার বোধহয় অর্ধেকও পড়া হয়নি এমন সময়ে মায়ের ডাক শোনা গেল।

–মার্গী… সময় হয়ে গেছে… স্কুলে যাও!

মার্গী বই থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, “যাচ্ছি মা… একটু পরে।

–না… এক্ষুনি যাও। টমি… তোমারও তো স্কুলে যাবার সময় হয়ে গেছে। মার্গী এবার টমিকে বলল– স্কুলের পরে তোমার সঙ্গে বইটা পড়ে ফেলব। কেমন?

-–ঠিক আছে! বিরস মুখে বলল টমি। আপন মনে শিস দিতে দিতে চলে গেল টমি। পুরোনো সেই বইটা নিয়ে যেতে ভুলল না।

মার্গী স্কুল ঘরে ঢুকে গেল। ঠিক ওর শোবার ঘরের পাশেই ওর স্কুল ঘর। সচল যন্ত্রমাস্টার ওর জন্যে অপেক্ষা করছিল। শনি, রবিবার বাদে সপ্তাহের সব দিনই একই সময়ে যন্ত্রমাস্টার অপেক্ষা করে। ওর মা বলেন যে, ছেলেমেয়েদের সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করা উচিত… নির্দিষ্ট সময়ে পড়লে তাড়াতাড়ি শেখা যায়… নিয়মনিষ্ঠ হওয়া যায়।

স্ক্রিন উজ্জ্বল হয়ে উঠল… যান্ত্রিক কণ্ঠ বলে উঠল– আজ পাটিগণিতের ভগ্নাংশের যোগবিয়োগ শেখাব। তোমার আগের দিনের হোমওয়ার্কটা স্লটের মধ্যে ঢুকিয়ে দাও।

দীর্ঘনিঃশ্বাস চেপে মার্গী যন্ত্রমাস্টারের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করল। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল আদ্যিকালের সেই পুরোনো স্কুলগুলোর কথা… যে স্কুলে দাদুর দাদুরা পড়াশোনা করেছে… তখন ওরা মার্গীর মতো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। আশপাশের পাড়ার সব ছেলেমেয়ে স্কুলে একসঙ্গে পড়তে আসত। কতই না গল্প হাসি মজা হত… স্কুলপ্রাঙ্গণ জুড়ে হইচই দৌড়োদৌড়ি। স্কুলের ঘরে একসঙ্গে বসার মজাই আলাদা… এখনকার মতো শূন্য ঘরে একা বসতে হত না… একসময়ে পড়া শেষ হত… দিনের শেষে বই বগলে নিয়ে সকলে একসঙ্গে বাড়ি ফিরত… একই বিষয় পড়ার জন্যে সকলেই সকলকে সাহায্য করতে পারত… এখনকার মতো স্ক্রিনের সামনে বসে পড়া পড়তে হত না… হোমওয়ার্ক নিয়ে আলোচনা করত… বুঝতে না পারলে কেউ না কেউ বুঝিয়ে দিত। একসঙ্গে পড়ার মজাই আলাদা…

আরও বড় কথা হল মাস্টাররা সবাই মানুষ…

যন্ত্রমাস্টার ঘন ঘন স্ক্রিনে ক্লাস করছে– আমরা যখন এর সঙ্গে যোগ করি…

মার্গীর চোখ স্ক্রিনের ওপরে থাকলেও মন চলে গেছে সেই পুরোনো দিনে… ওঃ, কত বন্ধু থাকত… সবাই সবাইকে ভালোবাসত… বন্ধু হত… কী যে সব মজার দিন ছিল সে সব! একবার যদি সেই সব দিন ফিরে পাওয়া যেত।

সকল অধ্যায়

১. রাখে হরি মারে কে – আইজাক আসিমভ
২. ভবিষ্যৎ – ডব্লিউ হিল্টন ইয়ং
৩. মানুষ এক ভিন্ন জীব – এলান ব্লচ
৪. গণিতজ্ঞ – আর্থার ফেল্ডম্যান
৫. ব্যাবসা – ম্যাক রেনল্ড
৬. চিড়িয়াখানা – এডোয়ার্ড ডি. হচ
৭. ডক্টর – হেনরি সেলসার
৮. অভিজ্ঞ – রবার্ট টি, কুরোসাকা
৯. আবিষ্কার – জর্জ আর আর. মার্টিন
১০. দেশপ্রেমিক – অ্যামব্রোস বিয়ার্স
১১. বাছাই – হেনরি সেলসার
১২. বিষের পেয়ালা – লি. কিলাও
১৩. শিকারিরা – ওয়াল্ট সেন্ডন
১৪. ক্রিকেট বল – অ্যাভ্রো ম্যানহাটান
১৫. অ্যাপয়েন্টমেন্ট – এরিক ফ্র্যাঙ্ক রাসল
১৬. রমণী – রবার্ট শেকলে
১৭. পুনরুজ্জীবন – ডান্নি প্লাচটা
১৮. অস্ত্র – ফ্রেডরিক ব্রাউন
১৯. বিজ্ঞানী – জিরাল্ড অ্যাটকিন্স
২০. ব্যবসায়ী – হেনরি সেলসার
২১. জেদি – স্টিফেন গোল্ডিন
২২. ওঁ – মার্টিন গার্ডনার
২৩. কে ভালো – রে রাসেল
২৪. চুলকানি দিয়ে শুরু – রবার্ট শেকলে
২৫. নিয়ম – বেন বোভা
২৬. প্রাগৈতিহাসিক এক ভোরের গল্প – জন, পি. ম্যাকনাইট
২৭. কিউব রহস্য – নেলসন বন্ড
২৮. অমনোনীত – কে. ডব্লিউ. ম্যাকান
২৯. এমন যদি হত – র‍্যালফ মিলনে ফারলে
৩০. হারানো সেই দিনের কথা – আইজাক আসিমভ
৩১. উত্তর – ফ্রেডরিক ব্রাউন
৩২. মানুষ ক্রীতদাস হবে – সিদ্ধার্থ নারলেকার
৩৩. প্রহরী – লরেন্স এস. জ্যানিফার
৩৪. একটি মর্মান্তিক মৃত্যু – সমরজিৎ কর
৩৫. আমি কে – অমিতানন্দ দাস
৩৬. এস্প – এইচ. জি. ওয়েলস
৩৭. নেপথ্যে – আর্থার সি. ক্লার্ক
৩৮. কিন্ডারগার্টেন – জেমস-ই-গান
৩৯. অমৃত – আর্থার সি. ক্লার্ক
৪০. পলাতক তুফান – জগদীশচন্দ্র বসু
৪১. টেলিপ্যাথদের জন্য সায়েন্স ফিকশন – ই. মাইকেল ব্লেক

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন