রণেন ঘোষ
বিষের পেয়ালা – লি কিলাও
চন্দন্নার উত্তর মেরুপ্রদেশে ইরাস্কো শাটল ভেঙে পড়ায় প্রচুর ক্ষতি হয়। অসংখ্য চ প্রাণহানি ঘটে। এর ঠিক দু’দিনের মাথায় দুর্ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। খুবই দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি হয়। বিচারের রায়ে বলা হল– শিল্পে গুপ্তচরবৃত্তিতে নিযুক্ত কারস মেরিভাল ব্যানটিং ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্ঘটনা ঘটানোয় বহুসংখ্যক লোক হতাহত হয়। বিচারে ব্যানটিং অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ায় জীবিত থাকার অধিকার হারিয়েছে। সে চন্দন্না সমাজে বসবাসের অযোগ্য বলে বিবেচিত হল। অতএব তিরিশ দিন ব্যানটিং নির্জন কারাগারে বন্দীজীবন কাটাবে এবং এই তিরিশ দিনের মধ্যে ব্যানটিংকে স্বেচ্ছায় প্রাণত্যাগ করতে হবে এবং জীবনের সবরকম লক্ষণ বিলুপ্ত হওয়ার পরই অপরাধীকে মৃত বলে ঘোষণা করে নশ্বর দেহের যথাযোগ্য সঙ্কার করা হবে।
তার মানে আমি নিজেকে হত্যা করব? আত্মহত্যা করব? চন্দন্নার আইনজীবীকে প্রশ্ন করলেন ব্যানটিং।
অন্যথায় আপনি নিজেকে অর্গান ব্যাঙ্কে দান করে দিতে পারেন। অবশ্য আপনার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কোনও প্রয়োজন আমাদের সমাজে নেই, তবুও আপনার উদার মনোভাবে অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হবে। সব আইনজীবীদেরই এমনই সব কাটা কাটা ভাষা মনে মনে ভাবলেন ব্যানটিং।
আমি যদি বিষ পান করতে অস্বীকার করি? তখন কি জোর করে আমাকে গেলানো হবে?
ব্যানটিং-এর কথায় আইনজীবী শিউরে উঠলেন।
কিছু মনে করবেন না আপনার এই দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু আপনার সুস্থ মনোভাবের পরিচয় দেয় না। আর মনে রাখবেন যে, চন্দন্না রীতিমতো এক সভ্য গৃহ। আপনার শারীরিক অনিষ্ট করার জন্যে কেউই আপনার দেহ স্পর্শ করবে নয়া।
দরজা জানলায় ঘন আচ্ছাদন ছাড়া এই নির্জন সেল যেন রীতিমতো এক কামরা হোটেলের সুট। যেমন আরামদায়ক তেমনি নয়নমনোহর কারুকার্য করা। সময় কাটানোর জন্যে বেশ বড় লাইব্রেরি ছাড়াও রয়েছে মনোরঞ্জনের নানান আধুনিক সাজ-সরঞ্জাম। তার ওপরে খাদ্যসামগ্রীর কোনও তুলনা হয় না। শুধু একটাই বিসদৃশ ব্যবস্থা মনকে উদ্বিগ্ন করে তোলে… ঘরের একপাশে পবিত্র বেদীর মতো টেবিলের ওপরে সুদৃশ্য এক কাপে টলটলে পীতাভ তরল পানীয়।
একসময়ে আইনজীবী সেল থেকে বেরিয়ে গেলেন। উঃ কী সব কথা… নিজে নিজে দেহত্যাগ করো… কে করছে দেহত্যাগ… বেশ মজা করে খাব আর শান্তিতে ঘুমোব। মনে মনে এমন সব ভাবছেন ব্যানটিং। আপিলে নিশ্চয় কিছু না কিছু হবে।
কিন্তু আপিল খারিজ হয়ে গেল। ইতিমধ্যে রায় দানের তিরিশ দিনের মধ্যে আজ শেষ দিন। মনে মনে ব্যানটিং সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। কিন্তু শেষের দিনটা যথারীতি আগের দিনের মতোই শুরু হল। না… গুপ্তপথে কেউ বিষাক্ত গ্যাস ছাড়ল নয়া অথবা জোর করে গলার মধ্যে বিষও ঢেলে দিল। খাদ্যসামগ্রীর কোনওরকম পরিবর্তন-ও নজরে পড়ল না। সন্ধের সময়ে দিন পার করে দেবার খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠলেন ব্যানটিং। কেন জানি না মনে হল বিপদ কেটে গেছে। মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাপভরতি পানীয়টা দূর করে দেওয়ালের গায়ে ছুঁড়ে মারলেন তিনি… কাপটা ভেঙে খান খান হয়ে গেল। মসৃণ দেওয়াল বেয়ে নামল বিষের ধারা।
আরও কিছুক্ষণ কেটে গেল। কিন্তু রাতের আহার আসতে দেরি হচ্ছে কেন? এর অনেক আগেই তো খাবার চলে আসে! পরপর আলোর সুইচ টিপলেন ব্যানটিং। আশ্চর্য! কোনও আলো জ্বলল না।
হঠাৎ দারুণ আতঙ্কে সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল। হৃৎপিণ্ডটা কেউ যেন টিপে ধরল। দৌড়ে গিয়ে জলের কল খুললেন। কয়েক ফোঁটা জল টপ টপ করে পড়ে বন্ধ হয়ে গেল।
পাগলের মতো দরজার দিকে ছুটে গেলেন। মুহূর্মুহূ দরজায় করাঘাত করে চিৎকার করে উঠলেন– কে কোথায় আছেন… শুনুন… আমি আমার আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করতে চাই… দরজাটা খুলুন একবার।
কেউ সাড়া দিল না। কেউ এল না। বন্ধ দরজা বন্ধই রইল। বিচারকের রায়ের কথাগুলো আবার যেন শুনতে পেলেন ব্যানটিং। জীবনের সব লক্ষণ মুছে গেলে মৃত ঘোষণা করা হবে এবং যথাযোগ্য সকার হবে। অন্ধকারের মধ্যে চুরমার হয়ে যাওয়া কাপটাই এখন যেন একান্ত বন্ধু বলে মনে হল তার। দেওয়ালে শুকিয়ে যাওয়া বিয়ের দিকে সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে রইলেন তিনি। ব্যানটিং-এর কণ্ঠ চিরে এক মর্মভেদী হাহাকার বেরিয়ে এল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন