নিন্দুকের প্রতি নিবেদন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

হউক ধন্য তোমার যশ, লেখনী ধন্য হোক, তোমার প্রতিভা উজ্জ্বল হয়ে জাগাক সপ্তলোক। যদি পথে তব দাঁড়াইয়া থাকি আমি ছেড়ে দিব ঠাঁই— কেন হীন ঘৃণা, ক্ষুদ্র এ দ্বেষ, বিদ্রূপ কেন ভাই? আমার এ লেখা কারো ভালো লাগে তাহা কি আমার দোষ? কেহ কবি বলে ( কেহ বা বলে না )— কেন তাহে তব রোষ? কত প্রাণপণ,দগ্ধ হৃদয়, বিনিদ্র বিভাবরী, জান কি, বন্ধু, উঠেছিল গীত কত ব্যথা ভেদ করি? রাঙা ফুল হয়ে উঠিছে ফুটিয়া হৃদয়শোণিতপাত, অশ্রু ঝলিছে শিশিরের মতো পোহাইয়ে দুখরাত। উঠিতেছে কত কণ্টকলতা, ফুলে পল্লবে ঢাকে— গভীর গোপন বেদনা-মাঝারে শিকড় আঁকড়ি থাকে। জীবনে যে সাধ হয়েছে বিফল সে সাধ ফুটিছে গানে— মরীচিকা রচি মিছে সে তৃপ্তি, তৃষ্ণা কাঁদিছে প্রাণে। এনেছি তুলিয়া পথের প্রান্তে মর্মকুসুম মম— আসিছে পান্থ, যেতেছে লইয়া স্মরণচিহ্নসম। কোনো ফুল যাবে দু দিনে ঝরিয়া, কোনো ফুল বেঁচে রবে— কোনো ছোটো ফুল আজিকার কথা কালিকার কানে কবে। তুমি কেন, ভাই, বিমুখ এমন— নয়নে কঠোর হাসি। দূর হতে যেন ফুঁষিছ সবেগে উপেক্ষা রাশি রাশি— কঠিন বচন ঝরিছে অধরে উপহাস হলাহলে, লেখনীর মুখে করিতে দগ্ধ ঘৃণার অনল জ্বলে। ভালোবেসে যাহা ফুটেছে পরানে, সবার লাগিবে ভালো, যে জ্যোতি হরিছে আমার আঁধার সবারে দিবে সে আলো— অন্তরমাঝে সবাই সমান, বাহিরে প্রভেদ ভবে, একের বেদনা করুণাপ্রবাহে সান্ত্বনা দিবে সবে। এই মনে করে ভালোবেসে আমি দিয়েছিনু উপহার— ভালো নাহি লাগে ফেলে যাবে চলে, কিসের ভাবনা তার! তোমার দেবার যদি কিছু থাকে তুমিও দাও-না এনে। প্রেম দিলে সবে নিকটে আসিবে তোমারে আপন জেনে। কিন্তু জানিয়ো আলোক কখনো থাকে না তো ছায়া বিনা, ঘৃণার টানেও কেহ বা আসিবে, তুমি করিয়ো না ঘৃণা! এতই কোমল মানবের মন এমনি পরের বশ, নিষ্ঠুর বাণে সে প্রাণ ব্যথিতে কিছুই নাহিক যশ। তীক্ষ্ম হাসিতে বাহিরে শোণিত, বচনে অশ্রু উঠে, নয়নকোণের চাহনি-ছুরিতে মর্মতন্তু টুটে। সান্ত্বনা দেওয়া নহে তো সহজ, দিতে হয় সারা প্রাণ, মানবমনের অনল নিভাতে আপনারে বলিদান। ঘৃণা জ্বলে মরে আপনার বিষে, রহে না সে চিরদিন— অমর হইতে চাহ যদি, জেনো প্রেম সে মরণহীন। তুমিও রবে না, আমিও রবনা, দু দিনের দেখা ভবে— প্রাণ খুলে প্রেম দিতে পারো যদি তাহা চিরদিন রবে। দুর্বল মোরা, কত ভুল করি, অপূর্ণ সব কাজ। নেহারি আপন ক্ষুদ্র ক্ষমতা আপনি যে পাই লাজ। তা বলে যা পারি তাও করিব না? নিষ্ফল হব ভবে? প্রেমফুল ফোটে, ছোটো হল বলে দিব না কি তাহা সবে? হয়তো এ ফুল সুন্দর নয়, ধরেছি সবার আগে— চলিতে চলিতে আঁখির পলকে ভুলে কারো ভালো লাগে। যদি ভুল হয় ক’দিনের ভুল! দু’ দিনে ভাঙিবে তবে। তোমার এমন শাণিত বচন সেই কি অমর হবে? 

সকল অধ্যায়

১. ভুলে
২. ভুল-ভাঙা
৩. বিরহানন্দ
৪. ক্ষণিক মিলন
৫. শূণ্য হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা
৬. আত্মসমর্পণ
৭. নিষ্ফল কামনা
৮. সংশয়ের আবেগ
৯. বিচ্ছেদের শান্তি
১০. তবু
১১. একাল ও সেকাল
১২. আকাঙ্ক্ষা
১৩. নিষ্ঠুর সৃষ্টি
১৪. প্রকৃতির প্রতি
১৫. মরণস্বপ্ন
১৬. কুহুধ্বনি
১৭. পত্র
১৮. সিন্ধুতরঙ্গ
১৯. শ্রাবণের পত্র
২০. নিষ্ফল প্রয়াস
২১. হৃদয়ের ধন
২২. প্রকাশবেদনা
২৩. নিভৃত আশ্রম
২৪. নারীর উক্তি
২৫. পুরুষের উক্তি
২৬. শূন্য গৃহে
২৭. জীবনমধ্যাহ্ণ
২৮. শ্রান্তি
২৯. বিচ্ছেদ
৩০. মানসিক অভিসার
৩১. পত্রের প্রত্যাশা
৩২. বধূ
৩৩. ব্যক্ত প্রেম
৩৪. গুপ্ত প্রেম
৩৫. অপেক্ষা
৩৬. দুরন্ত আশা
৩৭. দেশের উন্নতি
৩৮. বঙ্গবীর
৩৯. সুরদাসের প্রার্থনা
৪০. নিন্দুকের প্রতি নিবেদন
৪১. কবির প্রতি নিবেদন
৪২. পরিত্যক্ত
৪৩. ধর্মপ্রচার
৪৪. নববঙ্গদম্পতির প্রেমালাপ
৪৫. মায়া
৪৬. বর্ষার দিনে
৪৭. মেঘের খেলা
৪৮. ধ্যান
৪৯. পূর্বকালে
৫০. অনন্ত প্রেম
৫১. আশঙ্কা
৫২. ভালো করে বলে যাও
৫৩. মেঘদূত
৫৪. অহল্যার প্রতি
৫৫. গোধূলি
৫৬. উচ্ছৃঙ্খল
৫৭. আগন্তুক
৫৮. বিদায়
৫৯. সন্ধ্যায়
৬০. শেষ উপহার
৬১. মৌন ভাষা
৬২. আমার সুখ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন