কলকাতার গলিতে – প্রেমেন্দ্র মিত্র

বারিদবরণ ঘোষ

বিশ্বনাথ পাড়াগাঁয়ের ছেলে৷ ঘুটঘুটে অন্ধকারে দুপুররাত্রে বাঁশবনের ভেতর দিয়ে সে তিন ক্রোশ অনায়াসে বেড়িয়ে আসতে পারে৷ অমাবস্যায় গ্রামের সীমানার শ্মশান থেকে মড়া পোড়ানো কাঠ সে কতবার বাজি ধরে নিয়ে এসেছে৷ কিন্তু ভয় তার শুধু কলকাতা শহরকে৷

যেখানে দু’পা এগুতে হলে মানুষের গায়ে ধাক্কা লাগে, ইলেকট্রিক আর গ্যাস লাইটের কল্যাণে যেখানে দিন কি রাত চেনবার জো নেই বল্লেই হয়, সেইখানেই একরাতে সে যা বিপদে পড়েছিল৷

বিশ্বনাথ বলে—‘‘না, কলকাতা শহরে সন্ধ্যার পর বেরুনো নিরাপদ না৷’’

আমরা হেসে উঠলে বলে, ‘‘না হে না, চৌরঙ্গী, সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ-এর কথা বলছি না৷ কলকাতাটা আগাগোড়া চৌরঙ্গী নয়৷ শোন তাহলে—

‘‘সেবার গাঁয়ের লাইব্রেরির জন্যে বই কিনতে কলকাতা গিয়েছিলাম৷ ভেবেছিলাম একদিন থেকেই বইপত্র সব কিনে রাত্রের ট্রেনে বাড়ি চলে আসব৷ কিন্তু কলকাতায় গেলে নতুন বায়স্কোপ থিয়েটার না দেখে কেমন করে ফেরা যায়৷ প্রথম দিনটা তাতেই কেটে গেল৷ দ্বিতীয় দিনে কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে বই-টই সব কিনে ফেল্লাম৷ সঙ্গে বিছানাপত্রের বা তোরঙ্গ-বাক্সের ঝঞ্ঝাট ছিল না৷ শুধু একটি সুটকেস, তাতে বইগুলো ভরে একেবারে সোজা শিয়ালদা স্টেশনে গিয়ে উঠলেই হত৷

কিন্তু হঠাৎ কি খেয়াল হল, ভাবলাম একবার অবিনাশের সঙ্গে দেখা করে যাই৷

অবিনাশ আমাদের গ্রামের ছেলে৷ স্কুলে আমার সঙ্গেই পড়াশুনা করেছে৷ কলেজেও কয়েক বছর আমরা এক সঙ্গে পড়েছিলাম৷ অবিনাশ বেশিদিন অবশ্য কলেজে থাকেনি৷ অত্যন্ত খেয়ালী ছেলে—কোনো কাজে বেশিদিন লেগে থাকবার মতো ধৈর্য তার ছিল না৷ ছেলেবেলা থেকেই কেমন যেন তার উড়ুউড়ু ভাব৷ বাড়ি থেকে যে কতবার সে ছেলেবেলায় পালিয়ে গেছে তার ঠিকঠিকানা নেই৷ বড় হয়েও তার সে স্বভাব কাটেনি৷ কথা নেই, বার্তা নেই—হঠাৎ একদিন হয়তো আমরা শুনলাম অবিনাশ হেঁটে সেতুবন্ধ যাবার জন্যে বেরিয়ে পড়েছে৷ তারপর হয়তো দু’মাস তার দেখা নেই৷ আমরা কোনোরকমে প্রক্সি দিয়ে হয়তো সেবার তার কলেজের খাতায় কামাই-এর সংখ্যা কমিয়ে রাখলাম, কিন্তু এমন করে কতদিন রাখা যায়? বছরের শেষে একজামিনেশনের সময়ে দেখা গেল অবিনাশ আমাদের প্রক্সি দেওয়া সত্ত্বেও কলেজে এত কম দিন এসেছে যে তার পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি পাওয়া অসম্ভব৷ আমরা দুঃখিত হলাম৷ ছেলেটা এত আমুদে আর মিশুক ছিল যে আমরা সবাই তাকে ভালোবাসতাম৷ কিন্তু অবিনাশের যেন স্ফূর্তিই হল৷ বল্লে, ‘‘তবে আর কি? ভাই, বর্মাটা একবার ঘুরে আসি৷’’

তারপর অবিনাশের আর দেখা নেই৷ আমাদের চেয়ে তার ধাতই ছিল আলাদা৷

পৃথিবীটা যে মস্ত বড় এই আনন্দেই তার মন ভরপুর হয়ে থাকত৷ পৃথিবীর এই বিশালতাকে দেশে দেশে নতুন পথে ঘুরে ঘুরে উপভোগ করে তার আশা আর মিটতে চাইত না৷ যেসব দেশ সে এখনো দেখেনি তার আকর্ষণের কথা সে মাঝে মাঝে এমন তন্ময় হয়ে বলত যে আমাদেরও কখনো কখনো মোহ ধরে যেত—কেমন যেন মনে হত এই ছোট্ট শহরের ছোট্ট জানা কটি রাস্তায় দুবেলা যাওয়া-আসায় জীবনের কোনো সার্থকতাই নেই,—পথ যেখানে অফুরন্ত, আকাশের যেখানে কূল-কিনারা নেই, এমন জায়গায় বড় করে বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে না পারলে যেন বাঁচাই বৃথা৷

কিন্তু আমাদের এ ক্ষণিক মোহ অবশ্য খানিক বাদেই কেটে যেত, কিন্তু অবিনাশের এই মোহই ছিল সব৷

মাস-তিনেক আগে আমার গ্রামের ঠিকানায় এই অবিনাশের একটা চিঠি পেয়েছিলাম বহুদিন বাদে৷ একটা গলির ঠিকানা দিয়ে লিখেছিল যে, অনেক জায়গা ঘুরে ফিরে সে কলকাতায় এই ঠিকানায় আপাতত আছে৷ আমি এসে তার সঙ্গে যেন দেখা করি৷ এতদিন বাদে তাকে সেই ঠিকানায় পাওয়া হয়তো যাবে না জেনেও একবার যেতে ইচ্ছে হল৷

বাড়ির নম্বরটা ভুলে গিয়েছিলাম কিন্তু গলিটা মনে ছিল৷ ভাবলাম কলেজ স্ট্রিট থেকে বেশি দূর হবে না৷ ট্রেনেরও এখন দেরি আছে৷ একবার দেখা করেই যাই, যদি তাকে পাওয়া যায়৷

একটু খোঁজাখুঁজির পর একটা গলিরাস্তায় ঢুকে একজনাকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, আর একটু গেলেই অবিনাশ যে গলিতে থাকে তা পাওয়া যাবে৷

রাত তখন বেশি নয়৷ বড়জোর আটটা হবে৷ কিন্তু গলি দিয়ে খানিক দূর হেঁটেই একটু আশ্চর্য হয়ে গেলাম৷ গলিই হোক আর যাই হোক, কলকাতার পথ তো বটে৷ অথচ এই আটটা রাত্রে সেখানে একটি জনপ্রাণী নেই৷

ভেবেছিলাম খানিকদূর গিয়ে আবার কাউকে পথ জিজ্ঞাসা করব৷ কিন্তু লোক কোথায়? তা ছাড়া গলিটাও ফুরোতে চায় না৷

একবার সন্দেহ হল, হয়তো ভুলপথে এসেছি৷ কিন্তু যে লোকটা আমায় খবর দিয়েছে, আমায় ভুল পথ দেখিয়ে তার লাভ কি? নির্জন রাস্তায় চুরি-ডাকাতি? কিন্তু আমার কাছে কি এমন লাখ পঞ্চাশ টাকা আছে যে চোরদের ষড়যন্ত্র করতে হবে? আমার সাজপোশাক দেখে বড়লোক বলে ভুল করবার কোনো সম্ভাবনা নেই৷ তবে?

আরো খানিকটা এমনি করে এগিয়ে গেলাম৷ পথ তেমনি নির্জন, বাতিগুলোও কি এ পথের মিটমিটে হতে হয়! একে গ্যাস-পোস্টগুলো অত্যন্ত দূরে দূরে, তার ওপর কি কারণে জানি না আলো তাদের এত ক্ষীণ যে রাস্তা আলো হওয়া দূরের কথা, সেগুলো যে জ্বলছে এইটুকু বুঝতে কষ্ট হয়৷

খাস কলকাতার ভেতর এমন রাস্তা আছে কে জানত৷ দুপাশের বাড়িগুলো যেন মান্ধাতার আমলের তৈরি৷ কোনোরকমে হাড়-বেরুনো ইট-কাঠের জীর্ণ দেওয়ালগুলো দাঁড়িয়ে আছে৷ না আছে কোনো বাড়িতে একটা আলো, না জন-মানুষের একটু শব্দ৷ সে রাস্তার পাশে সারের পর সার পোড়ো বাড়ির মতো সব খাঁ-খাঁ করছে৷

ক্রমশ মনে হল একটা কেমন যেন ভ্যাপসা গন্ধ নাকে আসছে৷ বহুদিন আলো-বাতাস যেখানে ঢোকেনি, মানুষের বাস যেখানে বহুদিন ধরে নেই, এমনি ঘরে ঢুকলে যেমন গন্ধ পাওয়া যায়, গলিটায় ঠিক সেই রকম একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম৷

লোকটা বলেছিল, কিছু দূর গেলেই ডাইনে গলি পাওয়া যাবে৷ কিন্তু জনমানুষহীন জীর্ণ বাড়ির সারের ভেতর ডাইনে-বাঁয়ে কোথাও কোনো পথ নেই৷

সামনের পথও খানিক দূর গিয়ে দেখলাম বন্ধ৷ যে পথে ঢুকেছি, গলিটার ওই একটি মাত্রই তাহলে বেরুবার রাস্তা! আশ্চর্য ব্যাপার, লোকটা মিছিমিছি আমায় ভুল পথ দেখাল কেন?

সেখান থেকে ফিরলাম৷ গলিটা যেন আরো অন্ধকার মনে হচ্ছিল৷ এতক্ষণ যে গ্যাসগুলো মিটমিট করে জ্বলছিল, তারই কটা একেবারে নিভে গেছে দেখলাম৷ মনে হল, এ গলি থেকে বেরুতে পারলে বাঁচি৷ ভীতু আমি নই, কিন্তু কলকাতা শহরের ভেতর এমন অভাবনীয় ব্যাপার দেখে গা-টা কেমন ছমছম করছিল৷

সবে তো প্রথম রাত৷ কলকাতা শহরের সমস্ত রাস্তা এখন লোকজনে গাড়িঘোড়ায় মানুষের শব্দে গমগম করছে৷ অথচ এই পথটা কেমন করে এখন নির্জন নিস্তব্ধ হয়ে গেল! মনে হল, আমি যেন বহুকালের প্রাচীন একটা শহরে এসে পড়েছি৷ সে শহরের লোকজন বহুকাল আগে বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে৷ কত বছর যে মানুষের পা সে শহরে পড়েনি, কেউ যেন জানে না৷ আমিই যেন প্রথম সে শহরের নিস্তব্ধতা ভাঙলাম৷ খটখট খট—আমার নিজের পায়ের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ কোথাও নেই৷ সে শব্দ অদ্ভুত ভাবে নির্জন অন্ধকার বাড়িগুলোর দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল৷ আমার চোখের ওপরই কটা রাস্তার বাতি দপদপ করে নিভে গেল৷ ভ্যাপসা গন্ধটা ক্রমশ যেন বেড়ে গিয়ে অসহ্য মনে হচ্ছিল৷ না, এ গলি থেকে যত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়তে পারি ততই মঙ্গল৷ কাজ নেই আর অবিনাশের খোঁজ করে৷ পরে একদিন আবার আসলেই হবে৷

খানিকদূর গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ এদিকেও গলির পথ যে বন্ধ৷ কিন্তু তা কেমন করে হতে পারে? আমি একটা পথে যে গলিতে ঢুকেছি, এ বিষয়ে তো কোনো সন্দেহ নেই৷ এ গলি দিয়ে এগুবার সময়ে আশ-পাশে কোনো পথই দেখতে পাইনি৷ তা হলে গলির দু’মুখ বন্ধ কেমন করে হয়?

ভাবলাম, হয়তো আরো একটা পথ ছিল৷ যাবার সময় আমার দৃষ্টি কোনোরকমে এড়িয়ে গেছে, এখন আসবার সময় ভুল করে সেইটিতেই ঢুকে পড়েছি৷ সেইটেরই মুখ এখানে বন্ধ৷ কিন্তু এরকম ভুলই বা হবে কেমন করে? আমি অন্যমনস্ক হয়ে তো ছিলাম না৷ আগাগোড়াই তো সজাগ হয়ে চলেছি৷ রাস্তায় লোক না থাক, একটা বাড়িতে যদি একটা আলো দেখা যেত! না হয় ডেকেই জিজ্ঞাসা করতাম!

যাই হোক, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কোনো লাভ নেই জেনে আমি আবার ফিরলাম৷ গলি থেকে বেরুতে হবেই৷ আবার সেই নির্জন অন্ধকার গলি দিয়ে শুধু নিজের পায়ের শব্দ শুনতে শুনতে এগিয়ে চললাম৷ গলিটা যেন ক্রমশ দীর্ঘই হয়ে চলেছে৷ আমার অজান্তেই কে যেন ইতিমধ্যে সেটা বাড়িয়ে আরো লম্বা করে দিয়েছে৷

এবারও যখন দেখলাম গলির মুখ বন্ধ, তখন সত্যই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল৷ একে আমরা পাড়া-গাঁয়ের লোক৷ ফাঁকা আকাশ ফাঁকা মাঠের মধ্যে মানুষ হয়েছি৷ শহরে এলে অমনিই আমাদের হাঁপ ধরে৷ তার উপর এই ভ্যাপসা গন্ধভরা অন্ধকার গলি—চারিদিক থেকে সে যেন আমাকে জেলখানার মতো বন্দী করে ফেলবার ষড়যন্ত্র করেছে৷ ওপরে চেয়ে যে একটু আকাশ দেখতে পাব তারও জো নেই৷ এমন একটা ধোঁয়াটে কুয়াশায় বাতাস আচ্ছন্ন হয়ে আছে, তার ভেতর দিয়ে একটা তারাও দেখা যায় না৷

যত এই অদ্ভুত ব্যাপার ভাবছিলাম, মাথাটা ততই গুলিয়ে আসছিল৷ কি করব কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না৷ স্যুটকেসটা বইয়ের ভাবে বেশ ভারীই ছিল৷ সেটা বয়ে বেশ ক্লান্তই নিজেকে মনে হচ্ছিল৷ এমনি করে আর খানিকক্ষণ ঘুরতে হলে ক্লান্তিতেই তো বসে পড়তে হবে৷

হঠাৎ বুকটা ধড়াস করে উঠল৷ দূরে একটা মিটমিটে বাতির তলায় একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে না? তাড়াতাড়ি সেই দিকে এগিয়ে গেলাম—এই তো আমাদের অবিনাশ! এতক্ষণের ভয়-ভাবনা নিমেষে ভুলে গেলাম৷

আনন্দে চিৎকার করে তার নাম ধরে ডাকতেই সে চমকে তাকাল৷ বল্লাম, ‘‘কী আশ্চর্য, তোর খোঁজ করতেই এই এক ঘণ্টা এই গলির ভেতর ঘুরে হয়রান হচ্ছি যে! বাবা, কি অদ্ভুত গলিতে থাকিস তুই! ঢুকে আর বেরুনো যায় না!’’

অবিনাশ একটু হেসে বল্লে, ‘‘এসেছিস তাহলে ঠিক!’’

বল্লাম, ‘‘এসেছি আর কই, তোর দেখা না পেলে এই গলির ভেতর তোর বাড়ি কি খুঁজে বার করতে পারতাম!’’

সেকথার কোনো উত্তর না দিয়ে অবিনাশ বল্লে, ‘‘আমায় তা হলে তোর মনে আছে ভাই!’’

‘‘মনে থাকবে না কেন রে?’’

‘‘না ভাই, মনে থাকে না৷ অথচ মানুষ যেটুকু মনে করে রাখে তার ভেতরই আমরা বেঁচে থাকি৷’’

আমি হেসে বল্লাম—‘‘ছিলি তো ভূপর্যটক, আবার দার্শনিক হলি কবে থেকে? যাক, এখন তোর বাড়ি চল দেখি৷ তোর সব গল্প শুনতে চাই৷’’

অবিনাশ কেমন যেন একটু নিরুৎসাহ হয়ে বল্লে, ‘‘আমার বাড়ি! আচ্ছা চল৷ আমার চিঠি পেয়েছিলি?’’

‘‘হ্যাঁ, সে তো তিন মাসে আগে!’’

‘‘তোর জন্যে কতদিন অপেক্ষা করেছিলাম৷ তারপর আবার বেরিয়ে পড়েছিলাম৷’’

‘‘আবার! তা হলে ফিরলি কবে?’’

অন্যমনস্কভাবে অবিনাশ বল্লে—‘‘এই আজ৷’’

‘‘এই আজ? এবারে গেছলি কোথায়?’’

‘‘বলছি চল৷’’

সেই নির্জন গলি দিয়েই তখন আমরা এগিয়ে চলেছি৷ কিন্তু আর তখন আগের কথা কিছুমাত্র মনে ছিল না৷

অবিনাশ বলতে লাগল—‘‘এবারে ভাই গেছলাম বহুদূর৷ খিদিরপুরের ডকে বেড়াতে বেড়াতে একদিন সুন্দর একটি জাহাজ দেখলাম৷ সুন্দর বলতে নতুন মনে করিসনি যেন৷ জাহাজটা অনেক পুরানো৷ নোনাজল লেগে লেগে তার গায়ের রং চটে গেছে৷ মাস্তুলগুলো বহুদিনের পুরানো৷ চিমনিগুলো ধোঁয়ায় কালো হয়ে গেছে৷ আগাগোড়া জাহাজটা দেখলেই মনে হয়, বহুকাল ধরে পৃথিবীর কত সমুদ্রে সে যেন পাড়ি দিয়ে ঝুনো হয়ে গেছে৷ তার চেহারাতেই কেমন একটা ভবঘুরে রুক্ষুরুক্ষু ভাব৷ সেইটিই তার সৌন্দর্য৷ তার ওপর শুনলাম যে এখান থেকে মাল নিয়ে যাবে যবদ্বীপে—তখন আর লোভ সামলাতে পারলাম না৷

যবদ্বীপ! নারকেল আর তালগাছের সার তার তীর পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে সমুদ্রকে অভ্যর্থনা করতে৷ বাতাস আর জঙ্গলের মসলাগাছের গন্ধ৷ তার উপর গভীর বনের মাঝে তার বোরাবুদর৷

একেবারে মেতে উঠলাম, যেমন করেই হোক যেতেই হবে জাহাজে৷ জাহাজের ভাড়া দেবার মতো পয়সা নেই৷ অনেক কষ্টে জাহাজের হেড-খালাসীকে খোঁজ করে, তার সঙ্গে ভাব করে তাকে কিছু ঘুষ দিয়ে লুকিয়ে যাবার বন্দোবস্ত করলাম৷ জাহাজের একধারে বিপদের সময় ব্যবহার করবার জন্যে ছোট তেরপল-ঢাকা বোট টাঙ্গানো থাকে৷ ঠিক হল তারই একটির ভেতর আমি থাকব৷ কেউ তাহলে টের পাবে না৷ খালাসী কোন এক সময়ে লুকিয়ে এসে আমায় খাবার দিয়ে যাবে৷

গভীর রাতে জাহাজে চড়ে সেই বোটের ভিতরে গিয়ে হেড-খালাসীর নির্দেশমতো লুকিয়ে রইলাম৷ ভোর হবার আগে জাহাজ ছেড়ে দিল৷

তারপর কদিন কি অদ্ভুত ভাবেই না কাটিয়েছি৷ সারাদিন তার ভেতর লুকিয়ে থাকি, তেরপল একটু ফাঁক করে আকাশ দেখি আর জাহাজের শব্দ শুনি৷ গভীর রাতে যখন সব নির্জন হয়ে যায়, জাহাজের খোলে কখন ইঞ্জিনিয়ার আর ফায়ারম্যান আর ওপরে হাল ঘোরাবার হুইলে একজন নাবিক ছাড়া আর কেউ থাকে না, তখন একবার করে বেরিয়ে নির্জন ডেকের একটি কোণে রেলিঙ ধরে দাঁড়াই৷

এমনি করে কদিন বাদে জাভায় এসে পৌঁছোলাম৷ আগে ঠিক ছিল, সবাই নেমে গেলে কোন এক সময় হেড-খালাসী আমার নামার ব্যবস্থা করে দেবে৷ কিন্তু বন্দরে জাহাজ ভেড়াবার আগের রাত্রে সে এসে আমায় জানিয়ে গেল যে তা হবার উপায় নেই৷ এখানে মাল নামানো হলেই জাহাজটাকে সটান ড্রাই ডকে রং করবার জন্যে পাঠানো হবে ঠিক আছে, সুতরাং সেভাবে নামা যাবে না৷

তাহলে উপায়? খালাসী বল্লে, উপায় আছে৷ সবাই যখন জাহাজ ভেড়াবার সময়ে সেই কাজে ব্যস্ত থাকবে তখন যদি আমি জাহাজ থেকে জলে পড়ে একটুখানি সাঁতরে যেতে পারি তাহলেই হয়৷ তাতেই রাজি হলাম!

জাহাজ জেটিতে লাগবার আয়োজন চলছে, এমন সময় সন্তর্পণে আমি বোটের ঢাকনি সরিয়ে নেমে পড়লাম৷ পুঁটলিটা আমার পিঠে বাঁধাই ছিল৷ রেলিঙের ধারে গিয়ে জেটির উল্টোদিকে ঝাঁপ দিতে আর কতক্ষণ৷ কেউ দেখতেও পেল না৷

ঝাঁপ দিয়ে পড়লাম ঠিক, কিন্তু সেই মুহূর্তে জাহাজটা জেটিতে ভেড়বার জন্যে পাশে সরতে আরম্ভ করল৷ জাহাজের বিশাল প্যাডেলের ঘায়ে জল তোলপাড় হয়ে উঠল, কি ভীষণ তার টান! প্রাণপণেও আর সে টান ছাড়িয়ে আসতে পারলাম না, সেই ঘূর্ণ্যমান ভয়ঙ্কর প্যাডেলে ধাক্কা খেয়ে তলার দিকে তলিয়ে গেলাম৷’’

আমি শিউরে উঠে বল্লাম—‘‘তারপর?’’

‘‘তারপর সেই প্যাডেলের ঘা! কি ভয়ঙ্কর লেগেছে দেখবি?’’

সামনে একটা গ্যাসের বাতি তখনো জ্বলছিল৷ অবিনাশ তার জামা তুলে দেখালে৷

একি! জামার নিচে যে কিছুই নেই—একেবারে ফাঁকা, শূন্য! ভালো করে আবার চেয়ে দেখলাম—দেহ নেই, কিছু নেই ওধারে গ্যাসপোস্টটা সে জামার তলা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে৷ উপরের দিকে চাইলাম, সেখানে অবিনাশের মাথা নেই—শূন্য শূন্য সব শূন্য৷

অস্ফুট চিৎকার করে সুটকেস হাতে আমি দৌড়াতে শুরু করলাম, কিন্তু কোথায় যাব? যেদিকে যাই, নির্জন গলির মুখ বন্ধ৷ চিৎকার করে একটা পোড়োবাড়ির দরজায় ঘা দিলাম৷ তার ভেতরে দরজা-জানালাগুলো পর্যন্ত সে আঘাতের প্রতিধ্বনিতে ঝনঝন করে উঠল৷ কিন্তু কারুর সাড়া নেই৷ অন্ধকার৷ গলি মনে হল আমার চারিধারে সঙ্কীর্ণ হয়ে আসছে৷ অসহ্য তার ভ্যাপসা গন্ধ৷ তারপরে আমার আর মনে নেই৷

যখন জ্ঞান হল তখন দেখি কে একজন আমায় বলছে,—‘‘উৎরিয়ে বাবু, ইয়ে শিয়ালদা স্টেশন হ্যায়৷’’

শিয়ালদা স্টেশন! অবাক হয়ে দেখি, আমি আমার সুটকেস সমেত একটা রিকশ’য় বসে আছি৷ সামনে শিয়ালদা স্টেশন৷

নেমে পড়ে তার ভাড়া চুকিয়ে দিলাম৷ কিন্তু কখন কেমন করে যে আমি রিকশ’য় উঠেছি, কিছুই মনে করতে পারলাম না৷

হ্যাঁ, তারপর খোঁজ নিয়ে জেনেছি—অবিনাশ দু’মাস আগে জাভার বন্দরে অমনি করে মারা গেছল৷

সকল অধ্যায়

১. পূজার ভূত – ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
২. মণিহারা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৩. একটি ভৌতিক কাহিনী – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
৪. সর্বনাশিনী – পাঁচকড়ি দে
৫. উৎপীড়িতের প্রতিহিংসা – দীনেন্দ্রকুমার রায়
৬. মহেশের মহাযাত্রা – পরশুরাম
৭. নরক এক্সপ্রেস – সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়
৮. মায়া – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
৯. ‘‘ক্লাইম্যাক্স’’ – বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়
১০. অক্ষয়বটোপাখ্যানম – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
১১. ভয় ও ভূত – সুকুমার সেন
১২. ভেরনল – মণীন্দ্রলাল বসু
১৩. কে? – হেমেন্দ্রকুমার রায়
১৪. অশরীরিণী – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
১৫. ‘‘—সাথে সাথে ঘুরবে’’ – প্রমথনাথ বিশী
১৬. নমস্কার – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৭. চাচা কাহিনী – সৈয়দ মুজতবা আলী
১৮. কলকাতার গলিতে – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৯. অবর্তমান – বনফুল
২০. দুই বন্ধু – বুদ্ধদেব বসু
২১. রক্তের ফোঁটা – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
২২. ডাক্তারের সাহস – প্রবোধকুমার সান্যাল
২৩. হলুদপোড়া – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪. লাল চুল – মনোজ বসু
২৫. চেতলার কাছে – লীলা মজুমদার
২৬. একরাত্রির অতিথি – গজেন্দ্রকুমার মিত্র
২৭. নিজে বুঝে নিন – আশাপূর্ণা দেবী
২৮. রাত তখন এগারোটা – বিমল মিত্র
২৯. কুয়াশা – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
৩০. মরণের পরে – সুমথনাথ ঘোষ
৩১. টাইপরাইটার – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
৩২. ভুতুড়ে কাণ্ড – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
৩৩. সত্যি ভূতের গল্প – বিমল কর
৩৪. ভুলো ভূত – মহাশ্বেতা দেবী
৩৫. একদিন রাত্রে – শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৬. ছক্কা মিয়ার টমটম – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
৩৭. বৃত্তের বাইরে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৮. বড়পিসিমা – সমরেশ মজুমদার
৩৯. স্বপ্নের মতো – নবনীতা দেবসেন
৪০. গগনের মাছ – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৪১. তেত্রিশ নম্বর ঘর – দিব্যেন্দু পালিত
৪২. বামরার রহস্য – বুদ্ধদেব গুহ
৪৩. ভূত ও রিপোর্টার – তারাপদ রায়
৪৪. সপ্তর্ষি আর হারানো বিকেল – তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৫. ভূতের কথা – যমদত্ত
৪৬. সংসর্গ – সর্বাণী মুখোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন