ভুলো ভূত – মহাশ্বেতা দেবী

বারিদবরণ ঘোষ

তপনবাবু জীবনে কিছু ভোলেননি৷ ওঁর জন্ম ১৯১২ সালে৷ এ গল্প যখন লেখা হচ্ছে, তখন তিনি সত্তর পেরিয়েছেন৷ কিন্তু ক্লাস ফাইভে পড়ার সময়ে কোন বইয়ের কোন পাতায় কোন কবিতা পড়েছিলেন সব বলে দিতে পারেন৷

সারা জীবনে উনি একবারও ছাতা ট্রামে রেখে নেমে পড়েননি, বাজার থেকে কি কি আনতে হবে তা ভোলেননি৷ এসব খুবই ভালো গুণ তাতে সন্দেহ নেই৷ কিন্তু সবাই তাঁকে যথেষ্ট ভয় করে৷

কেননা কেউ কিছু ভুলে গেলে তপনবাবু বেজায় চটে যান৷ ভুলে যাওয়াটা ওঁর মতে সবচেয়ে বড় দোষ৷ এ হেন তপনবাবু বড় বিপদে পড়লেন৷ ওঁর নাতি বাবুয়ার বয়স এগারো৷ সে আবার বেজায়রকম ভুলো৷ এই নিয়ে যথেষ্ট বকাবকি করে একশো আটবার বাবুয়াকে দিয়ে ‘‘হে রাম, আর ভুলব না’’ বলিয়ে উনি যেই নিজের ঘরে ঢুকেছেন, সেই আলো নিভল৷

যা হোক, রাতটা চাঁদনী ছিল৷ ঘরে বেশ স্বচ্ছ একটা আলোও আসছিল৷ হঠাৎ তপনবাবু দেখলেন, ওঁর ঘরে চেয়ারের ওপর একটা মাথা ভেসে আছে, এবং মাথাটি কাঁদছে৷ যথেষ্ট ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে৷

—এর মানে কি?

তপনবাবু যথেষ্ট অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন৷ লোডশেডিং হোক বা না হোক এখন উনি বজ্রাসন করবেন, জল খাবেন, তারপর শোবেন৷ রুটিনে বাগড়া পড়লে ওঁর মেজাজ ঠিক থাকে না৷

—আমার ঘরে একটা মুণ্ডু কেন?

—স্যার, আমি বড় বিপদে পড়েছি৷

—তুমি কে হে?

—আজ্ঞে আমি এখন ভূত৷

—আহাহা! কান জুড়িয়ে গেল৷

—আমি ভূত, স্যার!

—বলি ধড়টা কোথায়?

—মনে করতে পারছি না৷

—তার মানে?

—স্যার, একটু শুনবেন?

—বলো৷ শুনে ধন্য হই৷

—আমি…মানে…আমার মাথা তো কাটা গিয়েছিল কিনা৷ মানে ডাকাতরা আমার মাথা কেটে ফেলেছিল৷

—কেমন করে?

—আমি জঙ্গল দিয়ে যাচ্ছিলাম তো…

—কেন? জঙ্গল ছাড়া যাবার পথ ছিল না?

—ছিল৷ তবুও…

—বেশ! মাথা কেটেছিল, বুঝলাম৷

—সেই থেকে যখনি মানুষকে…মানে আপনাদের ভয় দেখাতে যাই, ধড়ের একটু উপরে মাথাটা…ভাসতে থাকে৷

—আজই বা এমন মূর্তিতে এলে কেন বাপু?

—সেই তো বলতে চাইছি স্যার৷ আজ আমি ধড়টা ভুলে চলে এসেছি৷

—কি বললে?

—অত ধমকে কথা বলবেন না স্যার৷ আমার ভীষণ ভয় করে৷

—ভয় করে! লজ্জা করে না?

—লজ্জা?

—আবার জিগ্যেস করছ? মানুষের মধ্যে রাতদিন দেখছি ভুলো স্বভাব! অপদার্থ সব! ভূতের মধ্যেও সেই স্বভাব? ধড়টা ভুলে চলে এসেছ?

—হ্যাঁ স্যার৷

—তার মানে, যখন জ্যান্ত ছিলে তখনো এমনি ভুলোই ছিলে? নিশ্চয় তাই হবে৷

—হ্যাঁ স্যার!

মুণ্ডুটি গভীর অনুশোচনায় কাঁদতে থাকে৷ সে এক দৃশ্যই বটে৷ কাঁদতে কাঁদতে সে বলে, কিছু মনে করতে পারছি না স্যার৷ কোথায় রেখে এলাম ধড়টা? আসলে আজ যে আমার মানুষকে ভয় দেখাবার কথা, তাই ভুলে গিয়েছিলাম৷

—বটে!

এতক্ষণে তপনবাবুর গভীর কৌতূহল হল৷ বলতে কি, এই প্রথম তাঁর মনে হল যে ভূতদের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না৷ সন্ধেবেলা লেকে হাঁটতে যান৷ তাঁর কয়েকজন বন্ধুও আছেন৷ তাঁদের এ সব কথা বললে তাঁরা অবাক হয়ে যাবেন৷

—ভয় দেখাবার কি দিনক্ষণ থাকে নাকি?

গভীর দুঃখে মুণ্ডুটি বলতে লাগল, মানুষকে ভয় দেখাতে আসা তো নিয়ম স্যার৷ তা আমি মানুষদের বেজায় ভয় পাই তো৷ বারতিনেক ভয় দেখাবার চেষ্টা করে ছেড়ে দিয়েছিলাম৷ সেদিন তা নিয়ে খুব গণ্ডগোল৷

—ছেড়ে দিয়েছিলে কেন?

—মানুষ আজকাল ভালো নেই স্যার৷ ভয় পাবে কি, তারাই উলটে ভয় দেখায়৷ এই দেখুন না, কত দেখেশুনে ঢুকেছিলাম একটা এঁদোপড়া বাড়িতে৷ সেখানে দেখি তিনটে ভয়ানক চেহারার ছোকরা বসে তাড়া তাড়া নোট ভাগ করছে৷ আমি তো কথাবার্তায় বুঝলাম যে ওরা ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে এখন নোট ভাগ করছে৷ আমাকে দেখে তারা ছোরা নাচিয়ে বলে কি, ব্যাঙ্ক ডাকাতি করব আমরা আর তুমি বেটা ভূত সেজে তাতে বখরা বসাতে এসেছ? কত বললাম যে আমি ভূত৷ আমি টাকা চাই না, আমি ভয় দেখাতে চাই৷

—ওরা শুনল না?

—না, না৷ এমন খেঁকাল যে আমি পালিয়ে বাঁচলাম৷ তারপর দেখুন ক’দিন বাদে পুলিশ অফিসারের ঘরে গিয়েছিলাম৷ যথেষ্ট বন্ধুভাবেই বললাম, ব্যাঙ্ক ডাকাতরা কিন্তু অমুক জায়গায় আছে৷

—সে কি বলল?

—আমলই দিল না৷ সে কি জঘন্য ভাষায় ‘ফোটো ফোটো’ বলে চেঁচাতে থাকল৷ বলল, ধড়ে মাথা বসানো নেই, কোন আক্কেলে থানায় ঢুকেছ? নাম কি? নিবাস কোথায়? ঠিকানা কি? ব্যাঙ্ক ডাকাতদের ঠিকানা তুমি কোথায় পেলে?

—তখন?

—তখন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলাম৷ আচ্ছা, ‘ফোটো’ বলছিল কেন? আমি কি ফুল যে ফুটব?

—ওটা এখনকার বুলি৷ ওর মানে সরে পড়, চলে যাও৷

—দু-বার দু-বার এ রকম হল যখন, তখন আমি বেজায় মুষড়ে পড়লাম৷ কিন্তু আমাদের ইউনিয়ানে এখন সব চ্যাংড়া ভূত৷

—ইউনিয়ানও করা হয়?

—করাকরির কি আছে স্যার? ভূত হলেন যখন, তখন আপনি এ ইউনিয়ানের লোক৷

—একটা ইউনিয়ান, না অনেক?

—একটাই৷ চ্যাংড়াগুলো অসম্ভব গোলমাল করে৷ তারা বলল, তুমি ভয় দেখাতে যাবে না, মজা পেয়েছ? যত বলি, ওরে, মানুষ আজকাল ভয় পায় না৷ কে কার কথা শোনে!

—তারপর কোথায় গেলে?

—আপনার বাড়ির উলটো দিকে৷ ওই তেতলা বাড়িতে৷ সে এক দজ্জাল মেয়েমানুষ বটে৷ ভয় পাওয়া দূরস্থান, সে বঁটি নিয়ে আমায় তাড়া করল৷

—ওখানে গিয়েছিলে কেন বাপু? বোসবাবুর গিন্নি নামকরা দজ্জাল৷

—তারপর আমি একেবারে বেঁকে বসেছিলাম৷ আর আমি ভয় দেখাতে যাব না৷ মানুষ এখন খুব খারাপ হয়ে গেছে৷ ছোট ছেলেরাও ভূত দেখলে ভয় পায় না৷ কিন্তু আজ শুনলাম, ভয় দেখাতে না বেরোলে আমাকে একঘরে করা হবে৷

—তাতে কি?

—ভূত হয়ে ভূতের সমাজে থাকতে পাব না, এটা তো খুবই অপমানজনক৷ নাকি বলুন? ওরা সব বলেও দিল, অমুক জায়গায় যাও, এই ঠিকানায়৷ সেখানে যাবার পথেই ধড়টা ফেলে গেলাম, না সেখানে গিয়ে তবে ফেলে এলাম, কিছু মনে করতে পারছি না৷ সব ভুলে গেছি৷

—সেখানে গিয়েছিলে?

—মনে হচ্ছে, গিয়েছিলাম৷

—সে কোথায়?

—মনে নেই স্যার৷

—তা আমার মনে হয়, তোমার এখন ফুটে যাওয়াই ভালো৷ তোমার সমস্যা খুবই জটিল৷ কিন্তু এ সমস্যার বিষয়ে আমার কিছুই করার নেই৷

—স্যার, আমি কি ধড় ছাড়া ফিরতে পারি! শুধু মুণ্ডুকে কোনো ভূত সম্মান করবে কি?

—এ তো ভারি জ্বালা হল৷

—রাস্তাটার নামটা যদি মনে পড়ত!

—তোমরা কি নাম ঠিকানা নিয়ে ভয় দেখাতে বেরোও?

—হ্যাঁ স্যার৷ আগে যার যা ইচ্ছে হত তাই করত৷ এখন খুব কড়াকড়ি৷ প্রত্যেকদিন প্রত্যেককে কোথায় যাবে, কার বাড়ি যাবে—সব জেনে বেরোতে হয়৷ এ তো মানুষের কাণ্ড নয়, স্যার, যে যা ইচ্ছে তাই করবে৷ আমরা খুব ডিসিপ্লিনে থাকি৷

—কি রকম ডিসিপ্লিন?

—সব তো বলা যাবে না স্যার৷ তবে কিছু কিছু বলতে পারি৷ আমরা, যারা ভূত, তারা বাঁধাধরা এলাকায় ঘুরব৷ যেমন আমি কলকাতা থেকে ক্যানিং-এর মধ্যে থাকব৷ আবার যারা ধরুন শাঁকচুন্নি, বা পেতনি, বা মেছো ভূত, তারা থাকবে গ্রামে৷

—এ সব নিয়ম কেউ ভাঙে না?

—কে ভাঙবে তা বলুন? পুঁচকে ভূতরা রাত দশটা বাজলেই ফিরে যাবে, এও একটা নিয়ম৷ মানুষদেরকে এত কথা বোঝানো মুশকিল৷

—তোমার এই ভুল সারানোর দাওয়াই ভূতের রাজ্যে নেই?

—না স্যার৷

—কোন রাস্তা তাও মনে নেই?

—না স্যার৷

—তোমার ভুল সারাবার দাওয়াই আমি জানি৷

—একটু দেবেন?

—দেবার দাওয়াই নয়, বলতে হবে৷

—কি?

—দাওয়াই অব্যর্থ, তবে তোমার পক্ষে…যাক, একশো আটবার হেঁকে বলো দেখি— রাম!

—কি বললেন! মুণ্ডটি আর্তনাদ করে ওঠে৷

—বলো ‘রাম’!

—হ্যাঁ হ্যাঁ, রামময় রোডই বটে…গলার শব্দ তীক্ষ্ন হয় এবং মুণ্ডুটি মিলিয়ে যেতে থাকে৷

—রামময় রোডে যাবে তাই ভুলে গিয়েছিলে?

তপনবাবু যথেষ্ট হেঁকে বলেন৷ মুণ্ডুটি কি যেন বলে, তা বোঝা যায় না৷

এবং আলো জ্বলে ওঠে৷ তপনবাবু ভালো করে দেখে নেন ঘরটা৷ নাঃ, কোথাও কিছু নেই৷ এবার বজ্রাসন করে জল খেয়ে শুয়ে পড়া যাক৷

কাল সকলকে গল্পটা বলতে হবে৷ নাতিকে আর ধমকধামক দেবেন না তপনবাবু৷ ভুলে যাওয়াটা, বোঝা যাচ্ছে একটা গুরুতর ব্যাধি৷ রীতিমতো গুরুতর৷

সকল অধ্যায়

১. পূজার ভূত – ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
২. মণিহারা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৩. একটি ভৌতিক কাহিনী – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
৪. সর্বনাশিনী – পাঁচকড়ি দে
৫. উৎপীড়িতের প্রতিহিংসা – দীনেন্দ্রকুমার রায়
৬. মহেশের মহাযাত্রা – পরশুরাম
৭. নরক এক্সপ্রেস – সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়
৮. মায়া – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
৯. ‘‘ক্লাইম্যাক্স’’ – বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়
১০. অক্ষয়বটোপাখ্যানম – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
১১. ভয় ও ভূত – সুকুমার সেন
১২. ভেরনল – মণীন্দ্রলাল বসু
১৩. কে? – হেমেন্দ্রকুমার রায়
১৪. অশরীরিণী – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
১৫. ‘‘—সাথে সাথে ঘুরবে’’ – প্রমথনাথ বিশী
১৬. নমস্কার – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৭. চাচা কাহিনী – সৈয়দ মুজতবা আলী
১৮. কলকাতার গলিতে – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৯. অবর্তমান – বনফুল
২০. দুই বন্ধু – বুদ্ধদেব বসু
২১. রক্তের ফোঁটা – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
২২. ডাক্তারের সাহস – প্রবোধকুমার সান্যাল
২৩. হলুদপোড়া – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪. লাল চুল – মনোজ বসু
২৫. চেতলার কাছে – লীলা মজুমদার
২৬. একরাত্রির অতিথি – গজেন্দ্রকুমার মিত্র
২৭. নিজে বুঝে নিন – আশাপূর্ণা দেবী
২৮. রাত তখন এগারোটা – বিমল মিত্র
২৯. কুয়াশা – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
৩০. মরণের পরে – সুমথনাথ ঘোষ
৩১. টাইপরাইটার – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
৩২. ভুতুড়ে কাণ্ড – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
৩৩. সত্যি ভূতের গল্প – বিমল কর
৩৪. ভুলো ভূত – মহাশ্বেতা দেবী
৩৫. একদিন রাত্রে – শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৬. ছক্কা মিয়ার টমটম – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
৩৭. বৃত্তের বাইরে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৮. বড়পিসিমা – সমরেশ মজুমদার
৩৯. স্বপ্নের মতো – নবনীতা দেবসেন
৪০. গগনের মাছ – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৪১. তেত্রিশ নম্বর ঘর – দিব্যেন্দু পালিত
৪২. বামরার রহস্য – বুদ্ধদেব গুহ
৪৩. ভূত ও রিপোর্টার – তারাপদ রায়
৪৪. সপ্তর্ষি আর হারানো বিকেল – তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৫. ভূতের কথা – যমদত্ত
৪৬. সংসর্গ – সর্বাণী মুখোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন