ভূত ও রিপোর্টার – তারাপদ রায়

বারিদবরণ ঘোষ

ভূত ও রিপোর্টার – তারাপদ রায়

এই গল্পের নাম পাঠ করে অনুগ্রহ করে কেউ আমাকে ভূতবিদ্বেষী ভাববেন না৷

ভূতবিদ্বেষী হতে গেলে যে পরিমাণ সাহস, যে রকম মোটা বুকের পাটা লাগে তা আমার নেই, কস্নিনকালেও ছিল না৷

তবু প্রশ্ন থেকে যায়৷ ভূতের সঙ্গে যদি আমার শত্রুতা নাই থাকবে, আমি যদি ভূতবিদ্বেষী নাই হই তাহলে ভূতের মতো একটি প্রাচীন জীবকে আমি কেন এমন বিপদে ফেলব, আমি কেন ভূতকে রিপোর্টারের মুখে ঠেলে দেব৷

সত্যি কথাটা হল আমি ভূতকে রিপোর্টার সাহেবের মুখে ঠেলে দিইনি৷ রিপোর্টার সাহেবই তাকে আবিষ্কার করেছিলেন৷

সম্পাদক মহোদয় রিপোর্টার সাহেবকে পাঠিয়েছিলেন খরা কবলিত অঞ্চলে, সেই দুর্দশাগ্রস্ত অঞ্চলের একটা বাস্তবানুগ প্রতিবেদনের জন্যে৷

কিন্তু রিপোর্টার সাহেব যথাস্থানে যথাসময়ে পৌঁছাতে পারেননি৷ তার আগেই প্রবল বৃষ্টি নামে এবং একটি স্থানীয় নদীতে ঢল ওঠে, পুরো এলাকা জলে ডুবে বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে৷ খরার প্রতিবেদন করতে এসে বন্যার প্রতিবেদন করা সম্পাদক মহোদয়ের মনঃপুত হবে কিনা এই চিন্তা করে সদর অফিসে রিপোর্টার ফোন করতে গেলেন৷ কিন্তু এই বন্যায় ফোন অচল, টেলিগ্রামও তাই৷

অকুস্থলের রেল স্টেশনে প্লাটফর্মের পাশে একটা পোড়ো ঘরে জলবন্দী হয়ে রইলেন রিপোর্টার সাহেব৷

যথাসময়ে এ জায়গায় পৌঁছাতে পারলে রিপোর্টার সাহেবের এত নিগ্রহ হত না৷

কিন্তু এখানে আসতে পথে চারদিন দেরি হয়ে গেছে৷ সেটা অবশ্য রিপোর্টার সাহেবের দোষ নয়৷

পথে এক জায়গায় আফ্রিকার সোমালিয়ায় গণধর্ষণের প্রতিবাদে রেল অবরোধ হয়েছিল৷ দেড় দিন রেলপথ আটকিয়ে রাখে অবরোধকারীরা৷ অবশেষে জংশন স্টেশন থেকে রেলের বড় সাহেব এসে করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন এবং প্রতিশ্রুতি দেন ভবিষ্যতে যাতে এরকম আর না হয় সেটা তিনি দেখবেন৷ তখন রেল লাইন অবরোধ ওঠে৷ কিন্তু ইতিমধ্যে অবস্থা বেগতিক দেখে রেলের ড্রাইভার, ফায়ারম্যান এবং গার্ড—সবাই পলায়ন করেছেন, তাঁদের খুঁজে পেতে আনতে আরো দেড় দিন৷ অবশেষে রেলগাড়ি চালু করতে আরো একদিন৷ সবসুদ্ধ চারদিন দেরি হয়ে গেছে৷

এরই মধ্যে দ্বিতীয় দিন থেকে অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে৷ সেটাও অবশ্য অবরোধ উঠে যাওয়ার একটা কারণ, চতুর্থ দিনের শেষে জলে ভাসতে ভাসতে রেলগাড়ি এসে যখন খরা অঞ্চলে, জেলাসদরে পৌঁছেছে তখন সরকার সেটাকে বন্যাগ্রস্ত অঞ্চল বলে ঘোষণা করেছেন৷

এত কথা অবশ্য ভূতের গল্পে আসা উচিত নয়৷ কিন্তু গল্পটা ছোট ও পুরনো৷ তাই পটভূমিকা রচনা করবার জন্যে ভনিতা একটু দীর্ঘ করতে হল৷

ফোন বিকল৷ টেলিগ্রামের খুঁটি জলে উপড়িয়ে পড়ে আছে৷ ট্রেন আসছে না৷ রিলিফের নৌকো এখনো এসে পৌঁছয়নি৷

প্লাটফর্মের একপ্রান্তে পোড়ো ঘরে রিপোর্টার সাহেব আশ্রয় নিয়েছেন৷ সাধারণত রেল প্লাটফর্ম জলে ডোবে না৷ কিন্তু স্টেশন মাস্টার সাহেব বলেছেন দুবছর আগেও নাকি ডুবেছিল, বিশেষ করে খরার পরে বন্যা হলে সে নাকি খুব মারাত্মক৷

প্লাটফর্মের পোড়ো ঘরের ভেতরটা একটা লোক লাগিয়ে সাফসুফ করিয়ে নিয়েছিলেন রিপোর্টার সাহেব৷ কিন্তু প্রথম রাতেই ফ্যাসাদে পড়লেন৷

চারদিনের ক্লান্তির পরে মেঝের ওপরে চাদর বিছিয়ে মাথায় পোর্টফোলিয়ো ব্যাগটা দিয়ে সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন৷ ঘণ্টা কয়েক পরে কী একটা খশখস শব্দে ঘুম ভাঙল তাঁর৷ ঘুম চোখেই টের পেলেন ঘরের মধ্যে কী যেন একটা ঘুরছে৷

চোখে অন্ধকারটা সয়ে যাওয়ার পর রিপোর্টার সাহেব দেখতে পেলেন ভাঙা ঘরের বেড়া ঘেঁষে ঘেঁষে জীর্ণ শীর্ণ কী একটা ছায়ার মতো ঘুরছে৷

একবার গলাখাঁকারি দিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে?’

ছায়ামূর্তি পালটা জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কে?’

বেশ ন্যাকান্যাকা খোনা খোনা গলা৷ রিপোর্টার সাহেব সে গলা শুনে বুঝতে পারলেন তাঁর ঘরে ভূত ঢুকেছে৷ তিনি জানতে চাইলেন, ‘তুমি কি ভূত?’

ভূত বলল ‘হ্যাঁ৷ আমি এই ঘরে থাকছি৷ তুমি আমার ঘরে ঢুকেছ কেন?’

রিপোর্টার সাহেবের খেয়াল হল কেউ কেউ তাঁকে এ ঘরে থাকতে মানা করেছিল, বোধহয় এই কারণেই৷ কিন্তু এ নিয়ে এখন চিন্তা করে লাভ নেই৷ বরং ভূতের একটা ইন্টারভিউ যদি এই সুযোগে নেওয়া যায়৷ ভূতের মতো মানুষদের ইন্টারভিউ তো সারা জীবন ধরে নিচ্ছেন কিন্তু সাক্ষাৎ জ্যান্ত ভূতের সাক্ষাৎকার, সংবাদপত্র জগতে হইহই পড়ে যাবে, সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটা ল্যান্ডমার্ক তৈরি হবে৷

রিপোর্টার ভূতকে আত্মপরিচয় দিয়ে বললেন, ‘শোনো আমি একজন রিপোর্টার৷ তোমার ইন্টারভিউ নিতে চাই৷’

রিপোর্টার এবং ইন্টারভিউ—এই শব্দ দুটো শুনে ভূত থরথর করে কাঁপতে লাগল, হাত জোড় করে বলল, ‘আমি এই ঘর ছেড়ে দিচ্ছি৷ আপনি আপনার মতো থাকুন৷ আমাকে নিয়ে কিছু লিখতে যাবেন না৷’

রিপোর্টার বললেন, ‘এ তো ভয়ের কিছু নেই৷ তোমার নামও জানি না৷ তোমার ছবিও তোলা যাবে না৷ কেউ বুঝতেই পারবে না যে আমি তোমারই সঙ্গে কথা বলেছি৷ কাগজে লিখে দেব নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক ভূত৷

এরপরেও ভূত ইতস্তত করছে দেখে রিপোর্টার বললেন, ‘অবশ্য রিপোর্টের মধ্যে বার কয়েক ‘বিশ্বস্ত সূত্রে’ ব্যবহার করেও নামধাম গোপন করতে পারি৷

ভূত কী বুঝল কে জানে৷ সে বলল, ‘আপনাদের পাল্লায় পড়লে কারো পরিত্রাণ নেই, তা আমি জানি৷ যাক, যা কপালে আছে হবে৷ কী জানতে চান বলুন৷’

রিপোর্টার ততক্ষণে পোর্টফোলিয়ো ব্যাগ খুলে ডট কলম, নোটবই সব বার করেছেন৷ একটা সিগারেট ধরিয়ে এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্রথমে বলো, তুমি কী করে ভূত হলে?’

এর উত্তরে ভূত একটা আশ্চর্য কথা বলল৷ সে জানাল, ‘আমি বোধহয় ভুল করে ভূত হয়েছি৷’

সিগারেটের ছাই ঝেড়ে রিপোর্টার সাহেব বললেন, ‘ভুল করে ভূত? সে আবার কী?’

ভূত বলল, ‘সে বড় দুঃখের কথা৷ বউয়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে, সংসারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে আত্মহত্যা করার জন্যে চারদিন আগে এই স্টেশন থেকে এক কিলোমিটার দূরে নির্জন মাঠের পাশে রেললাইনে গলা দিয়ে শুয়েছিলাম৷’

রিপোর্টার বললেন, ‘কিন্তু চার দিন আগে তো রেল লাইন অবরোধ চলছিল৷’

ভূত বলল, ‘তা আমি জানব কী করে? একদিন, দুদিন, তিনদিন চলে গেল, রেল এল না৷ কিন্তু এল সাংঘাতিক বৃষ্টি৷ জলের তোড়ে আর খিদের চোটে আমি মারা পড়লাম৷ কিন্তু এভাবে মারা পড়লে তো আর ভূত হয় না৷ আনন্যাচারাল ডেথ বা অপমৃত্যু না হলে তো ভূত হওয়া যায় না৷ আমার মতো সাধারণ মৃত্যু, অনাহারে, না খেয়ে মৃত্যু তো এদেশে সবসময়ে হচ্ছে৷ সে সব ক্ষেত্রে কি ভূত হয়?’

এই ভৌতিক প্রশ্ন শুনে রিপোর্টারের মনে একটা অন্যরকম সন্দেহ দেখা দিল৷ কারণ ভাঙা ঘরের ফাটা বেড়ার মধ্য দিয়ে চাঁদের আলো তখন ঘরের মধ্যে এসে পড়েছে এবং রিপোর্টার দেখতে পেয়েছেন যে, ভূতের ছায়া পড়েছে জ্যোৎস্নায়, যেটা অসম্ভব৷ রিপোর্টার ভূতকে বললেন, ‘তুমি কি সত্যি ভূত? তোমার হাত দিয়ে আমাকে একটু ছোঁও দেখি৷’

ভূত বলল, ‘এত দূর থেকে হাত দিয়ে আমি আপনাকে ছোঁব কী করে?’

রিপোর্টার বললেন, ‘তাহলে তো তুমি ভূত নও৷ ভূতেরা যে যতদূর ইচ্ছে হাত লম্বা করতে পারে৷’

ভূত এবার খুব চিন্তা করল, তারপর বলল, ‘তা হতে পারে৷ আমি বোধহয় এখনো ভূত হইনি৷ বোধহয় এখনো মারাও যাইনি৷ বৃষ্টির সময় রেললাইন থেকে উঠে এখানে চলে আসি৷ চারদিন পেটে অন্ন নেই৷ ভাবলাম মরে ভূত হয়ে গেছি৷’

রিপোর্টার সাহেব তাঁর পোর্টফোলিয়ো ব্যাগ খুলে দুদিনের সঞ্চয় পাঁচশো গ্রাম চিঁড়ে আর একটু গুড়ের একটা ঠোঙা বার করে ভূতকে খেতে দিলেন৷

খাওয়াদাওয়ার পরে বহু কথা হল দু’জনের মধ্যে৷

দু’দিন পরে কলকাতায় ফিরে রিপোর্টার সাহেব তাঁর প্রতিবেদন পেশ করলেন৷

‘বন্যাকবলিত অঞ্চলের ভুখা মানুষের আত্মকাহিনী৷’

ওরকম মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন বহুকাল কোনোও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি৷

সকল অধ্যায়

১. পূজার ভূত – ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
২. মণিহারা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৩. একটি ভৌতিক কাহিনী – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
৪. সর্বনাশিনী – পাঁচকড়ি দে
৫. উৎপীড়িতের প্রতিহিংসা – দীনেন্দ্রকুমার রায়
৬. মহেশের মহাযাত্রা – পরশুরাম
৭. নরক এক্সপ্রেস – সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়
৮. মায়া – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
৯. ‘‘ক্লাইম্যাক্স’’ – বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়
১০. অক্ষয়বটোপাখ্যানম – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
১১. ভয় ও ভূত – সুকুমার সেন
১২. ভেরনল – মণীন্দ্রলাল বসু
১৩. কে? – হেমেন্দ্রকুমার রায়
১৪. অশরীরিণী – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
১৫. ‘‘—সাথে সাথে ঘুরবে’’ – প্রমথনাথ বিশী
১৬. নমস্কার – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৭. চাচা কাহিনী – সৈয়দ মুজতবা আলী
১৮. কলকাতার গলিতে – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৯. অবর্তমান – বনফুল
২০. দুই বন্ধু – বুদ্ধদেব বসু
২১. রক্তের ফোঁটা – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
২২. ডাক্তারের সাহস – প্রবোধকুমার সান্যাল
২৩. হলুদপোড়া – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪. লাল চুল – মনোজ বসু
২৫. চেতলার কাছে – লীলা মজুমদার
২৬. একরাত্রির অতিথি – গজেন্দ্রকুমার মিত্র
২৭. নিজে বুঝে নিন – আশাপূর্ণা দেবী
২৮. রাত তখন এগারোটা – বিমল মিত্র
২৯. কুয়াশা – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
৩০. মরণের পরে – সুমথনাথ ঘোষ
৩১. টাইপরাইটার – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
৩২. ভুতুড়ে কাণ্ড – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
৩৩. সত্যি ভূতের গল্প – বিমল কর
৩৪. ভুলো ভূত – মহাশ্বেতা দেবী
৩৫. একদিন রাত্রে – শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৬. ছক্কা মিয়ার টমটম – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
৩৭. বৃত্তের বাইরে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৮. বড়পিসিমা – সমরেশ মজুমদার
৩৯. স্বপ্নের মতো – নবনীতা দেবসেন
৪০. গগনের মাছ – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৪১. তেত্রিশ নম্বর ঘর – দিব্যেন্দু পালিত
৪২. বামরার রহস্য – বুদ্ধদেব গুহ
৪৩. ভূত ও রিপোর্টার – তারাপদ রায়
৪৪. সপ্তর্ষি আর হারানো বিকেল – তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৫. ভূতের কথা – যমদত্ত
৪৬. সংসর্গ – সর্বাণী মুখোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন