অবরোধ বাসিনী – ৩৩

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

[ ৩৩ ]

প্রায় ১৮ বৎসর হইল, কলিকাতায় একটী দেড় বৎসর বয়স্কা শিশুর জ্বর হইয়াছিল। তাঁহাদের অবরোধ অতি কঠোর,-তাই ততটুকু মেয়েকেও কোন হি-ডাক্তার দেখিতে পাইবেন না, সুতরাং শি-ডাক্তার আসিয়াছেন। বাড়ী ভরা যে স্ত্রীলোকেরা আছেন, তাঁহাদের একমাত্র “শরাফত” ব্যতীত আর কোন গুন নাই। তাঁহারা লেডী ডাক্তার মিস গুপ্তকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। মিস গুপ্ত দেখিয়া শুনিয়া রোগী মেয়েকে গরম জলে স্নান করাইতে চাহিলেন।

শি-ডাক্তার মিস গুপ্ত চাহেন গরম জল,-বিবিরা একে অপরের মুখ! তিনি চাহেন ঠাণ্ডা জল,-বিবিরা বলেন, “বাপরে ঠাণ্ডা জলে স্নান করালে মেয়ের জ্বর বেড়ে যাবে!” ফল কথা, বেচারী মিস গুপ্ত সে দিন কিছুতেই তাঁহাদিগকে নিজের বক্তব্য বুঝাইতে পারিলেন না। তিনি বাহিরে আসিয়া কর্ত্তার নায়েব সাহেবকে সমস্ত বলিয়া বিদায় হইবার সময় বলিলেন, তিনি এ বাড়ীতে আর আসিবেন না। নায়েব সাহেব অনেক অনুনয় বিনয় করিয়া তাঁহাকে ১৬ ফী গছাইয়া দিয়া পর দিন আবার আসিতে বলিলেন।

পরদিন আবার শি-ডাক্তার মিস গুপ্তকে লইয়া বাড়ীর গিন্নীদের গণ্ডগোল আরম্ভ হইল। বে-গতিক দেখিয়া নায়েব সাহেব তাঁহার পরিচিতা জনৈকা মহিলাকে আনিয়া মিস গুপ্তের নিকট পাঠাইয়া দিলেন। বীণাপাণি (নায়েব সাহেবের প্রেরিত সেই বাঙ্গালী মহিলা) আসিয়া দেখেন, লেডী ডাক্তার রাগিয়া ভূত হইয়া আছেন। আর সমবেত বিবিরা দাঁড়াইয়া ভয়ে থর থর কাঁপিতেছেন,-তাঁহাদের মুখে ধান দিলে খই ফোটে! শেষে মিস গুপ্ত গর্জ্জন করিয়া বলিলেন, “ময়ঁ তামাসা দেখনে নেহী আয়ী হোঁ!”

বীণাপাণি চুপিচুপি বিবিদের জিজ্ঞাসা করিলেন যে, ব্যাপার কি? তাঁহারা বলিলেন, “বুঝিতে পারি না,-তিনি তোয়ালে চাহেন, টব চাহেন, কিন্তু আমরা যাহা দিই, তাহাই দূরে ছুঁড়িয়া ফেলেন।”

পরে তিনি মিস গুপ্তকে তাঁহার বিরুদ্ধে বিরক্তির কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি হাতের ঘড়ী দেখিয়া বলিলেন, “দেখুন দেখি! আধ ঘণ্টার উপর হয়ে এ’ল, এখন পর্যøন্ত মেয়েকে স্নান করাবার জন্য কোন জিনিষ পেলুম না।” বীণা সভয়ে বলিলেন, “উহারা যে জিনিষ দেন, তাই নাকি আপনি পসন্দ করেন না?”

মিস গুপ্ত বলিলেন, “কি করে পসন্দ করব বলুন দেখি? আমি চাই একটা বাথ-টাব তাতে বসিয়ে শিশুকে স্নান করাব, ওঁরা দেন আমাকে এতটুকু একটা একসেরা ডেকচি-কাজেই আমি ছুঁড়ে ফেলেছি! আপনিই বলুন ত ঐটুকু ডেকচির ভিতর আমি শিশুকে বসাই কি করে? আমি চাই নরম পুরাতন কাপড়, শিশুর গা মুছে দেবার জন্যে, ওঁরা দেন আমাকে নূতন খসখসে তোয়ালে, – কাজেই আমি ছুড়ে ফেলে দিয়েছি! আমাকে ঐশ্বর্য্য দেখান যে নূতন তোয়ালে আছে! এঁরা মনে করেন যে এঁরা পীর-তাই Everybody should worship them!”

শেষে বীণা সমস্ত জিনিষ যোগাড় করিয়া দিয়া শিশুকে স্নান করাইতে মিস গুপ্তের সাহায্য করিলেন। তখন রাগ পড়িয়া গিয়া তাঁহার মুখে হাসি ফুটিল; বিবিরাও নিশ্বাস ছাড়িয়া বাঁচিলেন।

সকল অধ্যায়

১. অবরোধ বাসিনী – ০১
২. অবরোধ বাসিনী – ০২
৩. অবরোধ বাসিনী – ০৩
৪. অবরোধ বাসিনী – ০৪
৫. অবরোধ বাসিনী – ০৫
৬. অবরোধ বাসিনী – ০৬
৭. অবরোধ বাসিনী – ০৭
৮. অবরোধ বাসিনী – ০৮
৯. অবরোধ বাসিনী – ০৯
১০. অবরোধ বাসিনী – ১০
১১. অবরোধ বাসিনী – ১১
১২. অবরোধ বাসিনী – ১২
১৩. অবরোধ বাসিনী – ১৩
১৪. অবরোধ বাসিনী – ১৪
১৫. অবরোধ বাসিনী – ১৫
১৬. অবরোধ বাসিনী – ১৬
১৭. অবরোধ বাসিনী – ১৭
১৮. অবরোধ বাসিনী – ১৮
১৯. অবরোধ বাসিনী – ১৯
২০. অবরোধ বাসিনী – ২০
২১. অবরোধ বাসিনী – ২১
২২. অবরোধ বাসিনী – ২২
২৩. অবরোধ বাসিনী – ২৩
২৪. অবরোধ বাসিনী – ২৪
২৫. অবরোধ বাসিনী – ২৫
২৬. অবরোধ বাসিনী – ২৬
২৭. অবরোধ বাসিনী – ২৭
২৮. অবরোধ বাসিনী – ২৮
২৯. অবরোধ বাসিনী – ২৯
৩০. অবরোধ বাসিনী – ৩০
৩১. অবরোধ বাসিনী – ৩১
৩২. অবরোধ বাসিনী – ৩২
৩৩. অবরোধ বাসিনী – ৩৩
৩৪. অবরোধ বাসিনী – ৩৪
৩৫. অবরোধ বাসিনী – ৩৫
৩৬. অবরোধ বাসিনী – ৩৬
৩৭. অবরোধ বাসিনী – ৩৭
৩৮. অবরোধ বাসিনী – ৩৮
৩৯. অবরোধ বাসিনী – ৩৯
৪০. অবরোধ বাসিনী – ৪০
৪১. অবরোধ বাসিনী – ৪১
৪২. অবরোধ বাসিনী – ৪২
৪৩. অবরোধ বাসিনী – ৪৩
৪৪. অবরোধ বাসিনী – ৪৪
৪৫. অবরোধ বাসিনী – ৪৫
৪৬. অবরোধ বাসিনী – ৪৬
৪৭. অবরোধ বাসিনী – ৪৭

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন