কাজী নজরুল ইসলাম
যৌবনজলতরঙ্গ
এই যৌবনজলতরঙ্গ রোধিবি কি দিয়া বালির বাঁধ?
 কে রোধিবি এই জোয়ারের টান গগনে যখন উঠেছে চাঁদ?
 যে সিন্ধু-জলে ডাকিয়াছে বান – তাহারই তরে এ চন্দ্রোদয়,
 বাঁধ বেঁধে থির আছে নালা ডোবা, চাঁদের উদয় তাদের নয়!
 যে বান ডেকেছে প্রাণ-দরিয়ায়, মাঠে-ঘাটে-বাটে নেচেছে ঢল,
 জীর্ণ শাখায় বসিয়া শকুনি শাপ দিক তারে অনর্গল।
 সারস মরাল ছুটে আয় তোরা! ভাসিল কুলায় যে-বন্যায়
 সেই তরঙ্গ ঝাঁপায়ে দোল রে সর্বনাশের নীল দোলায়!
খর স্রোতজলে কাদা-গোলা বলে গ্রীবা নাড়ে তীরে জরদ্গব,
 গলিত শবের ভাগাড়ের ওরা, ওরা মৃত্যুর করে স্তব।
 ওরাই বাহন জরা-মৃত্যুর, দেখিয়া ওদের হিংস্র চোখ –
 রে ভোরের পাখি! জীবন-প্রভাতে গাহিবি না নব পুণ্য-শ্লোক?
 ওরা নিষেধের প্রহরী পুলিশ, বিধাতার নয় – ওরা বিধির!
 ওরাই কাফের, মানুষের ওরা তিলে তিলে শুষে প্রাণ-রুধির!
বল তোরা নবজীবনের ঢল! হোক ঘোলা – তবু এই সলিল
 চির-যৌবন দিয়াছে ধরারে, গেরুয়া মাটিরে করেছে নীল!
 নিজেদের চারধারে বাঁধ বেঁধে মৃত্যু-বীজাণু যারা জিয়ায়,
 তারা কি চিনিবে – মহাসিন্ধুর উদ্দেশে ছোটে স্রোত কোথায়!
 স্থাণু গতিহীন পড়ে আছে তারা আপনারে লয়ে বাঁধিয়া চোখ
 কোটরের জীব, উহাদের তরে নহে উদীচীর উষা-আলোক।
আলোক হেরিয়া কোটরে থাকিয়া চ্যাঁচায় প্যাঁচারা, ওরা চ্যাঁচাক।
 মোরা গাব গান, ওদেরে মারিতে আজও বেঁচে আছে দেদার কাক!
 জীবনে যাদের ঘনাল সন্ধ্যা, আজ প্রভাতের শুনে আজান
 বিছানায় শুয়ে যদি পাড়ে গালি, দিক গালি – তোরা দিসনে কান।
 উহাদের তরে হতেছে কালের গোরস্থানে রে গোর খোদাই,
 মোদের প্রাণের রাঙা জলসাতে জরা-জীর্ণের দাওত নাই।
জিঞ্জির-পায়ে দাঁড়ে বসে টিয়া চানা খায়, গায় শিখানো বোল,
 আকাশের পাখি! ঊর্ধ্বে উঠিয়া কণ্ঠে নতুন লহরি তোল!
 তোরা ঊর্ধ্বের – অমৃত-লোকের, ছুড়ুক নীচেরা ধুলাবালি,
 চাঁদেরে মলিন করিতে পারে না কেরোসিনি ডিবেকালি ঢালি!
 বন্য-বরাহ পঙ্ক ছিটাক, পাঁকের ঊর্ধ্বে তোরা কমল,
 ওরা দিক কাদা, তোরা দে সুবাস, তোরা ফুল – ওরা পশুর দল!
তোদের শুভ্র গায়ে হানে ওরা আপন গায়ের গলিজ পাঁক,
 যার যা দেবার সে দেয় তাহাই, স্বর্গের শিশু সহিয়া থাক!
 শাখা ভরে আনে ফুল-ফল, সেথা নীড় রচি গাহে পাখিরা গান,
 নীচের মানুষ তাই ছোঁড়ে ঢিল, তরুর নহে সে অসম্মান।
 কুসুমের শাখা ভাঙে বাঁদরের উৎপাতে, হায়, দেখিয়া তাই –
 বাঁদর খুশিতে করে লাফালাফি, মানুষ আমরা লজ্জা পাই!
 মাথার ঘায়েতে পাগল উহারা, নিসনে তরুণ ওদের দোষ!
 কাল হবে বার জানাজা যাহার, সে-বুড়োর পরে বৃথা এ রোষ!
যে-তরবারির পুণ্যে আবার সত্যেরে তোরা দানিবি তখ্ত্,
 ছুঁচো মেরে তার খোয়াসনে মান, পুরায়ে এসেছে ওদের ওক্ত্ !
 যে বন কাটিয়া বসাবি নগর তাহার শাখার দুটো আঁচড়
 লাগে যদি গায়, সয়ে যা না ভাই, আছে তো কুঠার হাতের পর!
যুগে যুগে ধরা করেছে শাসন গর্বদ্ধত যে যৌবন –
 মানেনি কখনও, আজও মানিবে না বৃদ্ধত্বের এই শাসন।
 আমরা সৃজিব নতুন জগৎ, আমরা গাহিব নতুন গান,
 সম্ভ্রমে-নত এই ধরা নেবে অঞ্জলি পাতি মোদের দান।
 যুগে যুগে জরা বৃদ্ধত্বেরে দিয়াছি কবর মোরা তরুণ –
 ওরা দিক গালি, মোরা হাসি খালি বলিব ‘ইন্না…. রাজেউন!’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন