সম্মিলন (সেথায় কপোত-বধূ লতার আড়ালে)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সেথায় কপোত-বধূ লতার আড়ালে
দিবানিশি গাহে শুধু প্রেমের বিলাপ।
নবীন চাঁদের করে একটি হরিণী
আমাদের গৃহদ্বারে আরামে ঘুমায়।
তার শান্ত নিদ্রাকালে নিশ্বাস পতনে
প্রহর গণিতে পারি স্তব্ধ রজনীর।
সুখের আবাসে সেই কাটাব জীবন,
দুজনে উঠিব মোরা, দুজনে বসিব,
নীল আকাশের নীচে ভ্রমিব দুজনে,
বেড়াইব মাঠে মাঠে উঠিব পর্বতে
সুনীল আকাশ যেথা পড়েছে নামিয়া।
অথবা দাঁড়াব মোরা সমুদ্রের তটে,
উপলমণ্ডিত সেই স্নিগ্ধ উপকূল
তরঙ্গের চুম্বনেতে উচ্ছ্বাসে মাতিয়া
থর থর কাঁপে আর জ্বল’ জ্বল’ জ্বলে!
যত সুখ আছে সেথা আমাদের হবে,
আমরা দুজনে সেথা হব দুজনের,
অবশেষে বিজন সে দ্বীপের মাঝারে
ভালোবাসা, বেঁচে থাকা, এক হ’য়ে যাবে।
মধ্যাহ্নে যাইব মোরা পর্বতগুহায়,
সে প্রাচীন শৈল-গুহা স্নেহের আদরে
অবসান রজনীর মৃদু জোছনারে
রেখেছে পাষাণ কোলে ঘুম পাড়াইয়া।
প্রচ্ছন্ন আঁধারে সেথা ঘুম আসি ধীরে
হয়তো হরিবে তোর নয়নের আভা।
সে ঘুম অলস প্রেমে শিশিরের মতো।
সে ঘুম নিভায়ে রাখে চুম্বন-অনল
আবার নূতন করি জ্বালাবার তরে।
অথবা বিরলে সেথা কথা কব মোরা,
কহিতে কহিতে কথা, হৃদয়ের ভাব
এমন মধুর স্বরে গাহিয়া উঠিবে
আর আমাদের মুখে কথা ফুটিবে না।
মনের সে ভাবগুলি কথায় মরিয়া
আমাদের চোখে চোখে বাঁচিয়া উঠিবে!
চোখের সে কথাগুলি বাক্যহীন মনে
ঢালিবে অজস্র স্রোতে নীরব সংগীত,
মিলিবেক চৌদিকের নীরবতা সনে।
মিশিবেক আমাদের নিশ্বাসে নিশ্বাসে।
আমাদের দুই হৃদি নাচিতে থাকিবে,
শোণিত বহিবে বেগে দোঁহার শিরায়।
মোদের অধর দুটি কথা ভুলি গিয়া
ক’বে শুধু উচ্ছ্বসিত চুম্বনের ভাষা।
দুজনে দুজন আর রব না আমরা,
এক হয়ে যাব মোরা দুইটি শরীরে।
দুইটি শরীর? আহা তাও কেন হল?
যেমন দুইটি উল্কা জ্বলন্ত শরীর,
ক্রমশ দেহের শিখা করিয়া বিস্তার
স্পর্শ করে, মিশে যায়, এক দেহ ধরে,
চিরকাল জ্বলে তবু ভস্ম নাহি হয়,
দুজনেরে গ্রাস করি দোঁহে বেঁচে থাকে;
মোদের যমক-হৃদে একই বাসনা,
দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে বাড়িয়া বাড়িয়া,
তেমনি মিলিয়া যাবে অনন্ত মিলন।
এক আশা রবে শুধু দুইটি ইচ্ছার
এই ইচ্ছা রবে শুধু দুইটি হৃদয়ে,
একই জীবন আর একই মরণ,
একই স্বরগ আর একই নরক,
এক অমরতা কিংবা একই নির্বাণ,
হায় হায় এ কী হল এ কী হল মোর!
আমার হৃদয় চায় উধাও উড়িয়া
প্রেমের সুদূর রাজ্যে করিতে ভ্রমণ,
কিন্তু গুরুভার এই মরতের ভাষা
চরণে বেঁধেছে তার লোহার শৃঙ্খল।
নামি বুঝি, পড়ি বুঝি, মরি বুঝি মরি।

Shelley

সকল অধ্যায়

১. বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ১ (মধুর সূর্যের আলো, আকাশ বিমল)
২. বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ২ (সারাদিন গিয়েছিনু বনে)
৩. বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৩ (আমায় রেখো না ধরে আর)
৪. বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৪ (প্রভাতে একটি দীর্ঘশ্বাস)
৫. বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৫ (গোলাপ হাসিয়া বলে, আগে বৃষ্টি যাক চলে)
৬. বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৬ (হাসির সময় বড়ো নেই)
৭. বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৭ (বেঁচেছিল, হেসে হেসে)
৮. বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৮ (নিদাথের শেষ গোলাপ কুসুম)
৯. বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৯ (ওই আদরের নামে ডেকো সখা মোরে)
১০. বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ১০ (কেমনে কী হল পারি নে বলিতে)
১১. বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ১১ (রবির কিরণ হতে আড়াল করিয়া রেখে)
১২. বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ১২ (দেখিনু যে এক আশার স্বপন)
১৩. বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ১৩ (নহে নহে এ মনে মরণ)
১৪. সম্মিলন (সেথায় কপোত-বধূ লতার আড়ালে)
১৫. তারা ও আঁখি (কাল সন্ধ্যাকালে ধীরে সন্ধ্যার বাতাস)
১৬. সূর্য ও ফুল (মহীয়সী মহিমার আগ্নেয় কুসুম)
১৭. বিসর্জন (যে তোরে বাসেরে ভালো, তারে ভালোবেসে বাছা)
১৮. কবি (ওই যেতেছেন কবি কাননের পথ দিয়া)
১৯. কোনো জাপানি কবিতার ইংরাজি অনুবাদ হইতে (বাতাসে অশথপাতা পড়িছে খসিয়া)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন