বাংলাসাহিত্যের প্রতি অবজ্ঞা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যাঁহারা অনেক ইংরাজি কেতাব পড়িয়াছেন তাঁহারা অনেকেই আধুনিক বাংলা লেখা ও লেখকদের প্রতি কৃপাকটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া থাকেন। এইরূপ অবজ্ঞা প্রকাশ করিয়া তাঁহারা অনেকটা আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। বোধ করি ইতরসাধারণ হইতে আপনাকে স্বতন্ত্র করিয়া লইয়া অভিমানে তাঁহারা আপাদমস্তক কণ্টকিত হইয়া উঠেন। একটা কথা ভুলিয়া যান যে, পৃথিবীতে বড়ো হওয়া শক্ত, কিন্তু আপনাকে বড়ো মনে করা সকলের চেয়ে সহজ। সমযোগ্য লোককে দূরে পরিহার করিয়া অনেকে স্বকপোলকল্পিত মহত্ত্বলাভ করে, কিন্তু প্রার্থনা করি এরূপ অজ্ঞানকৃত প্রহসন-অভিনয় হইতে আমাদের অন্তর্যামী আমাদিগকে সতত বিরত করুন।

বহুকাল হইতে বহুতর সামাজিক প্লাবনের সাহায্যে স্তর পড়িয়া ইংরাজি সাহিত্য উচ্চতা কঠিনতা এবং একটা নির্দিষ্ট আকার প্রাপ্ত হইয়াছে। আমাদের বাংলা সাহিত্যে সম্প্রতি পলি পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে। ইহার কোথাও জলা, কোথাও বালি, কোথাও মাটি। সুতরাং ইহার বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে যে যাহা ইচ্ছা বলিতে পারে, কাহারো প্রতিবাদ করিবার সাধ্য নাই। ইহার ইতিহাস নাই, আবহমান-কাল-প্রচলিত প্রবাহ নাই, বহুকালসঞ্চিত রত্নভাণ্ডার নাই, ইহার বিক্ষিপ্ত অংশগুলিকে এখনো এক সমালোচনার নিয়মে বাঁধিবার সময় হয় নাই। সুতরাং ইংরাজি সমালোচনা গ্রন্থ হইতে মুখগহ্বর পূর্ণ করিয়া লইয়া যখন কোনো প্রবল প্রতিপক্ষ ইহার প্রতি মুহুর্‌মুহু ফুৎকার প্রয়োগ করিতে থাকেন তখন বঙ্গসাহিত্যের ক্ষীণ আশার আলোকটুকু একান্ত কম্পিত ও নির্বাপিতপ্রায় হইয়া আসে। কিন্তু তথাপি বলা যাইতে পারে, ফুৎকার যতই প্রবল হউক শীর্ণ দীপশিখা তাহা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।

বর্তমান বাংলালেখকেরা বঙ্গসাহিত্যের প্রথম ভিত্তি-নির্মাণে প্রবৃত্ত আছেন। সুতরাং যাঁহারা ইংরাজি গ্রন্থস্তূপশিখরের উপর চড়িয়া নিম্নে দৃষ্টিপাত করেন তাঁহারা ইহাদিগকে ছোটো বলিয়া মনে করিতে পারেন। ইঁহারা মাটির উপরে দাঁড়াইয়া খাটিয়া মরিতেছেন, তাঁহারা উচ্চচূড়ায় বসিয়া কেবল হাওয়া খাইতেছেন; এরূপ স্থলে উভয়ের মধ্যে সমকক্ষতার ভাব রক্ষা করা দুরূহ হইয়া পড়ে।

এই দুই দলের মধ্যে যদি প্রকৃত উচ্চনীচতা থাকে তবে আর কোনো কথাই নাই। কিন্তু তাহার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। যাঁহারা শুদ্ধমাত্র পরের চিন্তালব্ধ ধন সঞ্চয় করিয়া জীবনযাপন করেন তাঁহারা জানেন না নিজে কোনো বিষয় আনুপূর্বিক চিন্তা করা এবং সেই চিন্তা ভাষায় ব্যক্ত করা কী কঠিন। অনেক বড়ো বড়ো কথা পরের মুখ হইতে পরিপক্ব ফলের মতো অতি সহজে পাড়িয়া লওয়া যায়, কিন্তু অতি ছোটো কথাটিও নিজে ভাবিয়া গড়িয়া তোলা বিষম ব্যাপার। যে ব্যক্তি কেবলমাত্র পাঠ করিয়া শিখিয়াছে, সঞ্চয় করা ছাড়া বিদ্যাকে আর কোনোপ্রকার ব্যবহারে লাগায় নাই, সে নিজে ঠিক জানে না সে কতটা জানে এবং কতটা জানে না।

যে শ্রেণীর সমালোচকের কথা বলিতেছি তাঁহারা যখন বাংলা পড়েন তখন মনে মনে বাংলাকে ইংরাজিতে অনুবাদ করিয়া লন, সুতরাং সমালোচ্য গ্রন্থের প্রতি তাঁহাদের শ্রদ্ধা থাকিতে পারে না। বাংলাভাষার প্রাণের মধ্যে তাঁহারা প্রবেশ করেন নাই, প্রবেশ করিবার অবসর পান নাই। মাতৃভূমি হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া লইলে সকল সাহিত্যই ম্লান নির্জীব ভাব ধারণ করে, তখন তাহার প্রতি সমালোচনার প্রয়োগ করা কেবল “মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ দেওয়া মাত্র।

যাঁহারা বাংলা লেখেন তাঁহারাই বাংলা ভাষার বাস্তবিক চর্চা করেন; অগত্যাই তাঁহাদিগকে বাংলাচর্চা করিতে হয়। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁহাদের অনুরাগ শ্রদ্ধা অবশ্যই আছে। বঙ্গভাষা রাজভাষা নহে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা নহে, সম্মানলাভের ভাষা নহে, অর্থোপার্জনের ভাষা নহে, কেবলমাত্র মাতৃভাষা। যাঁহাদের হৃদয়ে ইহার প্রতি একান্ত অনুরাগ ও অটল ভরসা আছে তাঁহাদেরই ভাষা। যাঁহারা উপেক্ষাভরে দূরে থাকেন তাঁহারা বাংলা ভাষার প্রকৃত পরিচয় লাভ করিতে কোনো সুযোগই পান নাই। তাঁহারা তর্জমা করিয়া বাংলার বিচার করেন। অতএব সভয়ে নিবেদন করিতেছি এরূপস্থলে তাঁহাদের মতের অধিক মূল্য নাই।

সকল অধ্যায়

১. সাহিত্যের তাৎপর্য
২. সাহিত্যের সামগ্রী
৩. সাহিত্যের বিচারক
৪. বিশ্বসাহিত্য
৫. সৌন্দর্য ও সাহিত্য
৬. সাহিত্যসৃষ্টি
৭. বাংলা জাতীয় সাহিত্য
৮. বঙ্গভাষা ও সাহিত্য
৯. ঐতিহাসিক উপন্যাস
১০. কবিজীবনী
১১. কাব্য
১২. বাংলা সাহিত্যের প্রতি অবজ্ঞা
১৩. পত্রালাপ
১৪. বঙ্গভাষা
১৫. সাহিত্যসম্মিলন
১৬. সাহিত্যপরিষৎ
১৭. ভুবনমোহিনীপ্রতিভা, অবসরসরোজিনী ও দুঃখসঙ্গিনী
১৮. মেঘনাদবধ কাব্য
১৯. স্যাক্‌সন জাতি ও অ্যাংলো স্যাক্‌সন সাহিত্য
২০. বিয়াত্রিচে, দান্তে ও তাঁহার কাব্য
২১. পিত্রার্কা ও লরা
২২. গেটে ও তাঁহার প্রণয়িনীগণ
২৩. নর্ম্যান জাতি ও অ্যাংলো-নর্ম্যান সাহিত্য
২৪. চ্যাটার্টন– বালক-কবি
২৫. বাঙালি কবি নয়
২৬. বাঙালি কবি নয় কেন?
২৭. দেশজ প্রাচীন কবি ও আধুনিক কবি
২৮. কাব্য : স্পষ্ট এবং অষ্টপষ্ট
২৯. সাহিত্যের উদ্দেশ্য
৩০. সাহিত্য ও সভ্যতা
৩১. আলস্য ও সাহিত্য
৩২. কবিতার উপাদান রহস্য
৩৩. সৌন্দর্য
৩৪. Dialogue/Literature
৩৫. সাহিত্য
৩৬. বাংলায় লেখা
৩৭. অপরিচিত ভাষা ও অপরিচিত সংগীত
৩৮. সৌন্দর্য সম্বন্ধে গুটিকতক ভাব
৩৯. বাংলাসাহিত্যের প্রতি অবজ্ঞা
৪০. কাব্য
৪১. একটি পত্র
৪২. বাংলা-লেখক
৪৩. সাহিত্য-পাঠকদের প্রতি
৪৪. রবীন্দ্রবাবুর পত্র
৪৫. সাহিত্যের গৌরব
৪৬. মেয়েলি ব্রত
৪৭. সাহিত্যের সৌন্দর্য

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন