নির্মলেন্দু গুণ
আমার বড় ভাই ভারতের নাগরিক। পশ্চিমবাংলার শিল্পনগরী দুর্গাপুরে তিনি চাকরী করেন। ১৯৭১ সালে আমরা তাঁর কাছেই গিয়ে উঠেছিলাম। ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হয়ে যাবার পর জয়-বাংলার শরণার্থীরা সবাই যখন দল বেঁধে ফিরতে শুরু করে, তখন আমরাও দেশে ফিরে আসার জন্য মানসিকভাবে তৈরি হই। আমার বড় ভাই আমাদের দেশে ফিরে যাবার ব্যাপারটিকে আরও কিছুদিনের জন্য স্থগিত রাখার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, এখনই দেশে ফিরে যাওয়াটা ঠিক হবে না। কিছুদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা দরকার। আগে তো শেখ মুজিবর মুক্তি পাক। [আমি ১৯৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি রমনা রেসকোর্সের জনসভায় উপস্থিত ছিলাম—যেদিন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পটভূমিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া শেখ মুজিবকে পাঁচ লক্ষাধিক জনতার সামনে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। তখন থেকেই আমি শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু বলতাম কিন্তু আমার বাবা এবং আমার বড় ভাই বঙ্গবন্ধুকে সাধারণত মুজিবরই বলতেন। কখনও কখনও বলতেন শেখ মুজিবর।] মুজিবর দেশে ফিরুক। দেশটি তো এখনও নেতাশূন্য। দেশের মানুষ তোদের ঐ তাজউদ্দিন আর নজরুল ইসলামকে বেশিদিন মানবে না। মুজিবরের না ফিরা পর্যন্ত বাংলাদেশের অবস্থা স্বাভাবিক হবে না। মারামারি হানাহানি লেগে থাকবে। বলা যায় না, অচিরেই আবার হয়তো জয় বাংলা ছেড়ে তোদের পালাতেও হতে পারে।
আমরা যদিও দেশে ফেরার জন্য খুবই ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলাম, দেশের জন্য আমাদের মন যদিও খুবই চঞ্চল হয়ে উঠেছিল, তথাপি আমার বড় ভাইয়ের অনুমোদন না পাওয়ার কারণেই আমাদের দেশে ফেরা বিলম্বিত হতে থাকে। নিজ পরিবার থেকে দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থাকার পর মুক্তিযুদ্ধের কারণে পারিবারিকভাবে মিলিত হতে পারার ব্যাপারটি আমার বড় ভাইয়ের মনে একটা নতুন আবেগের সৃষ্টি করেছিল। কোনো সন্দেহ নেই যে, দুর্গাপুরে আমাদের খাওয়া-থাকার ব্যবস্থা করতে গিয়ে তাঁকে বেশ কষ্ট করতে হচ্ছিল। তাই দ্রুত আমাদের শরণার্থীদশার অবসান হোক, এটি তিনি হয়তো আমাদের চাইতেও বেশি করেই চাইতেন। কিন্তু যখন সত্যি-সত্যি চোখের পলকে আমাদের দেশটি স্বাধীন হয়ে গেলো এবং আমরা আমাদের সাতপুরুষের ভিটা-বাড়িতে ফিরে আসার জন্য অস্থির হয়ে উঠলাম তখন আমার বড় ভাইয়ের মনে হয়তো আমাদেরকে আরও কিছুদিনের জন্য নিজের কাছে ধরে রাখার গোপন ইচ্ছাও কাজ করে থাকবে। হয়তো সেজন্যই তিনি আমাদের সামনে ভবিষ্যতের বাংলাদেশের একটি ভয়াবহ চিত্র সবসময়ই তুলে ধরছিলেন। মুজিবর ফিরে আসার পরও সাম্প্রদায়িকতা থেকে দেশটি মুক্ত হতে পারবে, তা তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। আর মুজিবর যদি না ফিরেন, তবে তো কথাই নেই।
কিন্তু নতুন বছরে, জানুয়ারির ১০ তারিখে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে লন্ডন-দিল্লী হয়ে বঙ্গবন্ধু যখন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মাটিতে পা রাখেন, তখনই আমার বড় ভাইয়ের অনুমোদনক্রমে আমাদের পরিবার বাংলাদেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু যদি মুক্তি না পেতেন; যদি তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরতে না পারতেন, -আমরা কি তাহলে ভারতেই থেকে যেতাম? আমার কথা ঠিক বলতে পারি না, তবে মনে হয় আমার পরিবারটি হয়তো থেকেই যেতো। অন্তত আমার বড় ভাই সেরকমটিই চাইতেন। দেশে ফেরার ব্যাপারে আমার বাবাও কিছুটা দ্বিধার মধ্যে ছিলেন। কবিতা লেখার কারণে, কবিতা লিখে দেশের মানুষের ভালোমন্দের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ার কারণে ব্যক্তিগতভাবে দেশের প্রতি আমার মনে যতটা দুর্বলতার সৃষ্টি হয়েছিল; আমার পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে তা ছিল না। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকাতে এবং স্বাধীনতা লাভের অল্পদিনের ব্যবধানে পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসাতে, অন্যদের কথা জানি না, আমাদের পরিবারটি খুবই লাভবান হয়। ১৯৭১ সালে হিন্দুদের মধ্যে যারা শরণার্থী হয়েছিলেন, তাদের বেশ কিছু ভারতে থেকে যান। দশই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে না এলে আমাদেরও হয়তো ভারতেই স্থান হতো। ঢাকার টানে কিছুদিনের জন্য দেশে ফিরে এলেও, পরিবারের আপনজনদের টানে আমাকেও হয়তো এক-পর্যায়ে ভারতেই চলে যেতে হতো। চলে যেতে যে হয়নি, তাকে আমি আমার সৌভাগ্য বলেই মানি।
বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর স্থির হয়, আমরা দুই পর্যায়ে ভারত ত্যাগ করবো। আমি দেশে ফিরে এসে দেশের অবস্থা জানিয়ে দুর্গাপুরে চিঠি লিখব, তারপর আমার পরিবার দেশে ফেরার ব্যাপারটি চূড়ান্ত করবে। তার আগে নয়। ঐরূপ পারিবারিক সিদ্ধান্তের জটিলতার কারণেই বহু প্রত্যাশিত মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আমি বিজয় দেখিনি
আমি যুদ্ধজয়ের একমাস পর, পরবর্তী বছরের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা ফিরি। ঢাকা ফিরে এসে আমি উঠেছিলাম মগবাজারের মুক্তিযোদ্ধা হেলালের বাসায়। হেলালের সঙ্গে নাট্যকার মামুনুর রশীদের মাধ্যমে আমার পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়েছিল ১৯৬৭ সালের দিকে। আমরা মগবাজারের ক্যাফে তাজ-এ অনেকদিন একসঙ্গে আড্ডা দিয়েছি। পরে একাত্তরে হেলাল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় এবং কলকাতায় আবার কিছুদিন আমাদের একসঙ্গে থাকার সুযোগ হয়। দীর্ঘদিন পরবাসে কাটিয়ে আমার প্রিয় নগরীতে ফিরে এসে আমার নিরাপত্তার কথা ভেবে যখন আমি মনে মনে একজন বিশ্বস্ত বন্ধুর সন্ধান করছিলাম, তখন আমার কেন জানি হেলালের কথাই মনে পড়লো। হেলালের বাসায় দু’দিন থাকার পর আমি সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে গিয়ে উঠি। সেখানে থাকার জন্য ছাত্রনেতা আসম আবদুর রব এবং হলের ভিপি জিনাত আলী আমাকে ঐ হলের একটি রুম ছেড়ে দিয়েছিলেন।
কয়েকদিন ঢাকায় কাটিয়ে আমি আমার গ্রামের বাড়িতে যাই। আমার গ্রামের এবং এলাকার মানুষ অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে আমাকে গ্রহণ করে। আমাদের ফেলে যাওয়া বাড়িঘরও মোটামুটি বাসযোগ্যরূপেই পাওয়া যায়। পাকসেনাদের আগমন সংবাদের প্রচারিত শংকার ভিতরে, স্থানীয় আত্মসম্মানবঞ্চিত লোভী-মুসলমানদের মধ্যে যারা আমাদের বাড়িঘর লুটপাট করেছিল, তারা এসে রাতের অন্ধকারে আমার সঙ্গে দেখা করে এবং কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। তারা খুবই কাতরকণ্ঠে জানায়, আমি যদি তাদের না রক্ষা করি তাহলে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা তাদের মেরে ফেলবে। এখন তো বটেই, যৌবনেও আমি ছিলাম খুবই নরম মনের মানুষ। আমি তাদের ক্ষমা করে দিই। ফলে ওদের সঙ্গে অচিরেই আমার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি তখন ‘বাংলাদেশ বাসযোগ্য’ বলে দুর্গাপুরে রিপোর্ট পাঠাই। আমার কাছ থেকে ইতিবাচক রিপোর্ট পেয়ে আমার পরিবারের অন্য সদস্যরাও শরণার্থী জীবনের ইতি ঘটিয়ে, দেশে ফিরে এসে নতুন করে বসতি স্থাপন করে।
বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বাংলার মাটি থেকে অভাবিত দ্রুততার সঙ্গে প্রত্যাহার করতে রাজি হলে, আমার বাবা একটু ভড়কে যান। শুধু বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগই তো বিবেচ্য নয়; মুসলিম লীগার, আলবদর-রাজাকার এবং অতিবিপ্লবী চৈনিক-পরিবৃত বাংলাদেশের মাটিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতির বিষয়টিও আমাদের দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্তটিকে প্রভাবিত করেছিল। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বাংলার মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য সরিয়ে নেবার সংবাদে আমার বাবা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েন। ভারতীয় সেনাদের সহায়তা ছাড়া আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা দেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে বলে আমার বাবা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি মনে করতেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আরও কিছুদিন বাংলাদেশে রাখা দরকার। আমি ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ভারতীয় সৈন্যদের বিদায়ী অনুষ্ঠানটি দেখেছিলাম এবং ভিড় ঠেলে ইষ্টার্ন কমান্ডের জিওসি লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সঙ্গে করমর্দন করেছিলাম। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন সদস্যকে কৃতজ্ঞতা ও সম্মান জানানোর বাসনা আমার মাধ্যমে পূর্ণ হওয়ার সংবাদে আমার বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন
আমার এক পিসতুতো ভাই পি. সি. সোম ছিলেন ভারতীয় বিমান বাহিনীর পাইলট। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মিত্রবাহিনীর হয়ে গভর্নর হাউস এবং ঢাকা সেনানিবাসে পরিচালিত বিমান হামলায় তিনি অংশ নিয়েছিলেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে আমার আরও একজন কাকা ছিলেন। আমার বাবার আপন মামাত ভাই। তাঁর নাম কর্নেল বি. সি. দত্ত। ১৯৭১ সালে শিলিগুড়ি ক্যান্টনমেন্টে তিনি কর্মরত ছিলেন। তিনিও মিত্রবাহিনীর হয়ে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন। আমি নিজে অস্ত্রহাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিইনি, আমার সেরকম সাহস ছিল না; কিন্তু আমার ঐ দু’জন নিকট-আত্মীয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বলে আমি মনে মনে কিছুটা স্বস্তিবোধ করতাম। ভাবতাম, আমার বাবা ও তাঁর পরিবারের অনিচ্ছার মধ্যে যেমন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল,—বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি আমাদের কাছে সেরকম নয়; এই দেশটি, আমার ও আমার পরিবারের সদস্যদের প্রবল ইচ্ছার মধ্যে; ত্যাগ, কষ্ট ও স্বপ্নের মধ্যে জন্ম নিয়েছে। খুব সরাসরি না হলেও, ভারতের মাধ্যমে আমার নিকটজনরাও এসে ঘটনাচক্রে যুক্ত হয়েছেন এই দেশ-জন্মের প্রক্রিয়ায়। সুতরাং এই দেশটির ওপর আমার অধিকার প্রশ্নাতীতভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অতঃপর এই দেশে আমার থাকা না-থাকার ব্যাপারটি বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা না-থাকার ওপর নির্ভর করে না। পৃথিবীর মানচিত্রে এই দেশটি যদি টিকে থাকে, তার শাসক যারাই হোক না কেন, আমি তাতে থাকবো। এ আমার অধিকার। শ্রী অন্নদাশংকরের ভাষায় বলা যায়—’যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান…’ ততদিন। বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্যতম রাষ্ট্রনীতি হিসেবে ঘোষণা করে এই ভূখণ্ডে বসবাসকারী (তা বাঙালি বা বাংলাদেশী যাই বলি না কেন) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐ ন্যায়নিষ্ঠ বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার পর, আমার মধ্যে যে তীব্র ভীতি, প্রচণ্ড ঘৃণাবোধ ও উৎকণ্ঠামিশ্রিত আবেগের সৃষ্টি হয়েছিল; —তার অন্তরালের মনস্তাত্বিক পটভূমি উপরে কিছুটা বর্ণিত হলো। বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে আমার মনে পড়ে যায় আমার বড় ভাইয়ের কথা। আমি ভাবতে বসি, তবে কি আবার আমাকে ভারতে চলে যেতে হবে? দেশটা কী আবার পাকিস্তানে পরিণত হবে? ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ভিতরে ফুটে ওঠা অভাবিত নির্মমতার দিকটির কথা ভেবে আমি খুবই বিচলিত ও অসহায় বোধ করি। আমার মনে প্রশ্ন জাগে, হত্যাকারীদের মনে ঘৃণার এই যে জোর—তারা কোথা থেকে তা পেলো? প্রতিহিংসাপরায়ণতার এই যে উচ্চমাত্রা—তা কী কেবলই মুহূর্তের মতিভ্রম? আমার বিশ্বাস হয় না। বিপুল সংখ্যক মুসলমানের বাসভূমি হলেও, এক শ্রেণীর মুসলমানের কাছে চিরশত্রুরূপে গণ্য হিন্দুস্থানের সহায়তার ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানকে ভেঙে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গঠন করার অপরাধই ঐরূপ দুর্মর ঘৃণার জাতক ছিল বলে আমার মনে হয়।
মনে পড়ে, আমার ঐ সময়ের অসহায়ত্ববোধের সঙ্গে এক ধরণের অপরাধবোধও এসে যুক্ত হয়েছিল। ঐ অপরাধবোধটা ছিল, কবি আল মাহমুদের সম্পাদনায় প্রকাশিত গণকণ্ঠ পত্রিকায় কিছুদিন কাজ করার কারণে। আমি সরল বিশ্বাসে আমার প্রতিষ্ঠানবিরোধী চরিত্রের কারণে যে কাগজটিতে যোগ দিয়েছিলাম— পরবর্তীকালে ঐ কাগজটি জাসদের মুখপত্রে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন করার ক্ষেত্রে ঐ পত্রিকাটি যে ভূমিকা রেখেছিল, আমিও সেখানে দাবার ঘুটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিলাম। সেকথা ভেবে আমার অনুশোচনা হয়। আমি নিজেকে অপরাধী বলে ভাবতে থাকি। বিশ্বাসঘাতক এই নগরীটিকে আমার আর বাসযোগ্য বলে মনে হয় না। আমি স্থির করি, এই নগরীতে আর নয়। আমি অনির্দিষ্টকালের জন্য গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাই।
কিছুদিনের মধ্যেই কাদের সিদ্দিকী ভারতে পালিয়ে গিয়ে কাদের বাহিনী গঠন করে। গ্রামে যাবার কিছুদিনের মধ্যেই কাদের বাহিনী গঠনের সংবাদ আমার কানে আসে। আমাদের এলাকার বিশেষ করে হিন্দু ছেলেরা বিপুল সংখ্যায় ঐ কাদের বাহিনীতে যোগ দিতে থাকে। রক্ষীবাহিনীর একজন লীডার কলমাকান্দার সুকুমার সরকারও কাদের বাহিনীতে যোগ দেয়। মেঘালয় সীমান্ত দিয়ে দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, বারহাট্টা এবং মোহনগঞ্জে এসে কাদের বাহিনীর সদস্যরা থানা ও হাট-বাজারে হামলা চালাতে শুরু করে। কিন্তু ঐসব হামলার জোর এবং ভবিষ্যৎ ছিল খুবই অনিশ্চিত। কেননা ঐরূপ কাজে সিদ্ধি লাভ করার জন্য যেরকম বিপুল সংখ্যায় দেশত্যাগের দরকার ছিল এবং সাহায্যকারী দেশটির যেরূপ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থাকা প্রয়োজন ছিল-ভারতের তৎকালীন সরকারের তা ছিল না। ফলে, ঐসব সম্ভাবনাহীন আক্রমণ দারোগা-পুলিশ অপহরণ এবং থানার অস্ত্র লুট করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। মাঝখান থেকে যাদের বাড়ি ঘর আশ্রয় নিয়ে ঐসব হামলা চালানো হচ্ছিল, কাদের বাহিনীর সদস্যদের চলে যাবার পর তারা খুবই বিপদের মধ্যে পড়ে যায়। আমার একজন মামা, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা ডাক্তার মতিলাল চৌধুরী (মোহনগঞ্জ থানার খলাপাড়া গ্রামে) কাদের বাহিনীর সদস্যদের আশ্রয় দানের অপরাধে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং তাঁর পরিবারটি পুলিশি নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয়। পরে মামলায় আমার মামা মতিলাল চৌধুরী এবং উনার এক ভাতিজা তুষারকে প্রায় বছর দশেক জেল খাটতে হয়েছিল।
মানসিক ভারসাম্য হারানো অবস্থায় আমি ঢাকা ত্যাগ করে গ্রামে ফিরে গিয়েছিলাম, গ্রামের নির্জনতা ও রাজনীতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে শান্তি ও স্বস্তি ফিরে পাবার আশায়। কাদের বাহিনীর থানা আক্রমণ ও আক্রমণের সঙ্গে আমার মামার জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার সংবাদ শুনে আমি কিছুটা উন্মাদের মতোই আমার পরিবারের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে দিনাতিপাত করতে থাকি 1 ইতোমধ্যে ঢাকা থেকে আমার তরুণ কবি-বন্ধু গোলাম সাবদার সিদ্দিকী হঠাৎ একদিন আমার গ্রামে হাজির হয়। ওর আগমনে আমার মানসিক শান্তি বিঘ্নিত হয়। ওর অতিবিপ্লবী নকশালমার্কা কথাবার্তা আমার খুবই অপছন্দ ছিলো। ফলে তাকে আমি বেশিদিন আমার বাড়িতে থাকতে দিই না।
আমি গ্রামে ফিরে গিয়েই শুনতে পেয়েছিলাম, আমাদের গ্রামের মুসলেমউদ্দিন নামে একজন সরকারি কর্মচারী, মেজর ডালিমের কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু হত্যার সংবাদটি রেডিওতে প্রচারিত হতে শুনে আনন্দে এমনই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন নি। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের বড় সড়ক ধরে তিনি খালি গায়ে, মাথায় গামছা বেঁধে দৌড়াতে শুরু করেন এবং চিৎকার করে বলতে থাকেন— ‘ভাইসব, আর চিন্তা নাই, ‘হিন্দুর বাপ’ শেখ মুজিবুর শেষ। আপনেরা সব বাইরইয়া আসেন।’ ঐ চিত্রকল্পটি কল্পনায় অনুভব করে আমার হাসিও পায় আবার রাগে দুঃখে, অক্ষম-যাতনায় মনে কষ্টও পাই। (এখানে মুসলেমউদ্দিন নামটি খুবই লক্ষণীয়। এমন মিল কী করে যে হলো!)
মুসলেমউদ্দিনের ‘হিন্দুর বাপ’ কথাটা আমার খুবই মনে লাগে। আমি ভাবি, শেখ মুজিব কি ছিলেন শুধুই হিন্দুদের বাবা? মুসলমানদের কেউ নন তিনি? অথচ হিন্দুদের জন্য সত্যিকার অর্থে তেমন কিছুই তো তিনি করে যাননি। তিনি না একাত্তরে, পাক বাহিনীর ভেঙে ফেলা রমনা কালীমন্দিরটি পুনঃনির্মাণ করেছেন, না তিনি ১৯৬৫-র পাক-ভারত যুদ্ধের পটভূমিতে ঘোষিত শত্রুসম্পত্তি আইনটি রদ করেছেন। না তিনি বৈষম্যমূলক সরকারি নীতির কারণে, চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া হিন্দুদের বিশেষ কোনো সুবিধা দিয়ে মুসলমানদের পাশাপাশি এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন। তাহলে? শেখ মুজিব ‘হিন্দুদের বাপ’ হবেন কেন? কথাটা তো মোটেও সত্য নয়। তবুও তো বলা হলো। কেন বলা হলো? আমি ভাবতে বসি।
যদিও এইরকমের একটি অসৎ-প্রশ্নের কোনো সদুত্তর হয় না, তবু অনুমান করতে পারি সম্ভাব্য কারণ। তিনি কারও কারও কাছে হিন্দুদের বাপ বলে প্রতিভাত হয়েছেন :
১. হিন্দুস্তানের সহায়তায় পাকিস্তান ভাঙার জন্য।
২. বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্য।
৩. রবীন্দ্রনাথের প্রতি প্রীতির কারণে।
৪. ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ গ্রহণের জন্য।
মুসলেমউদ্দিনের মাথায় গামছা-বাঁধা দৌড়ের ঘটনাটি শোনার পর আমার কৃতজ্ঞ কবিচিত্ত এই সিদ্ধান্তে উপণীত হয় যে, শেখ মুজিবকে নিয়ে আমি কবিতা লিখবো। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও তাঁর কথা আমি প্রচার করবো। সংখ্যালঘুর সমানাধিকারকে নিশ্চিত করার জন্য যিনি জীবন দান করে গেছেন, একজন সংখ্যালঘুর সন্তান হিসেবেই এ আমার পবিত্র কর্তব্য। তাঁর হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পরে কয়েকটি প্রতীকী কবিতা আমি রচনা করেছিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম আর প্রতীকী কবিতা নয়, এবার সরাসরি লিখবো।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন