জলঙ্গীর অন্ধকারে – ১

হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

গাড়ির গতি একটু কমিয়ে মল্লার বলল, ‘ডান দিকের গাছের মাথার দিকে দেখ৷ কত বড় বড় বাদুড় ঝুলছে!’

মল্লারের কথা শুনে চূর্ণী আর সোহম গাড়ির ভিতর থেকে সেই বিরাট গাছটার দিকে তাকাতেই দেখতে পেল গাছের মাথার দিকের ডালগুলো থেকে সার সার বাদুড় ঝুলছে! চূর্ণী সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘কলকাতা চিড়িয়াখানাতে একটা গাছে বাদুড় ঝোলে আমি দেখেছি৷ কিন্তু এত বড় বড় বাদুড় আমি কোনওদিন দেখিনি৷ যেন কেউ বড় বড় কালো ছাতা টাঙিয়ে রেখেছে গাছটার মাথায়!’

চূর্ণীর কথা শুনে সোহম বলল, ‘এমনও হতে পারে এই বাদুড়গুলো ভ্যাম্পায়ার৷ রাত নামলেই ওরা নীচে নেমে আসে শিকারের খোঁজে৷ রক্তপানের লোভে৷ কেউ কেউ হয়তো মানুষ বা অন্য প্রাণীর রূপও ধরে৷ তারপর খিদে মিটিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগে আবার নিরীহ প্রাণীর মতো গাছে গিয়ে বসে৷ রক্তচোষা বা ভ্যাম্পায়ার বলেই ওদের এমন বিরাট বিরাট চেহারা৷’

সোহম কথাটা মজা করে বললেও চূর্ণী মৃদু আতঙ্কিত স্বরে তাকে বলল, ‘দেখ সোহম, তোকে কতদিন না বলেছি ওসব কথা নিয়ে আমার সঙ্গে মজা করবি না৷ রাতে একলা ঘরে থাকি৷ তখন আমার এসব কথা মনে পড়ে, ভয় লাগে৷ রাতে লাইট জ্বালিয়ে শুতে হয়, ঘুম আসে না৷’

গাড়ির গতি আবার বাড়িয়ে দিয়ে মল্লার তাদের দু’জনের কথার মাঝে ফুট কেটে বলল, ‘আর তিন মাস পর যখন তোদের বিয়ে হবে তখন তো আর চূর্ণীকে একলা থাকতে হবে না৷ তখন তোরা দু’জন জমিয়ে ভূত-ভ্যাম্পায়ারের গল্প করতে পারবি৷’

একথা শুনে চূর্ণী রাগ প্রকাশ করে মল্লারকে বলল, ‘যাক, তোকে আর এ ব্যাপারে তাল দিতে হবে না৷ কৃষ্ণনগর পেরিয়ে এলাম তা প্রায় দু’ঘণ্টা হল! যাচ্ছি তো যাচ্ছি! রাস্তায় একজন লোকও দেখছি না৷ তমসাময় শাস্ত্রীর আশ্রমটা আর কতদূর?’

গাড়ির ড্যাশ বোর্ডে রাখা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে নিয়ে মল্লার জবাব দিল! ‘প্রায় চলে এসেছি৷ গুগল ম্যাপ বলছে ‘নবজীবন আশ্রম’ অর্থাৎ তমসাময়ের আশ্রম আর মাত্র তিন কিলোমিটার৷ তাছাড়া গাছের ফাঁক দিয়ে ওই যে কিছু দূরে নদীটাও দেখা যাচ্ছে৷ ওটাই নিশ্চয়ই জলঙ্গী নদী৷ তমসাময় বলেছেন তাঁর অনাথ আশ্রমটা একেবারে নাকি জলঙ্গীর গায়েই৷’

শীতের বিকেল৷ বেলা সাড়ে চারটে বাজতে না বাজতেই আলো বেশ নরম হয়ে এসেছে৷ কাঁচা রাস্তার বাঁ-পাশে গাছপালা, বড় বড় ঝোপ জঙ্গলের আড়াল থেকে মাঝে মাঝেই উঁকি দিচ্ছে নদীটা৷ বিকেলের আলোতে চিকচিক করছে নদীর জল৷ সেদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে সোহম বলল, ‘লোকটার নামটা কিন্তু বেশ অদ্ভুত—তমসাময়! তমসা মানে তো অন্ধকার৷ অর্থাৎ লোকটার নাম, অন্ধকারময়, ঘোর অন্ধকার! আমি তমসাহরণ, শুনেছি, মেয়েদের নাম তমসা হয় শুনেছি কিন্তু কোনও ছেলের নাম তমসাময় শুনিনি৷ যদিও আমার বাংলাভাষার জ্ঞান খুব কম৷ সুযোগ পেলে একবার ভদ্রলোককে তাঁর নামের অর্থ জিগ্যেস করব৷’

মল্লার বলল, ‘ওনার নাম যাই হোক না কেন, যদি দেখি লোকটা সৎ, সত্যিই অনাথ বাচ্চাদের জন্য কাজ করছেন তবে টাকাটা দিয়ে যাব৷ চেকবই তো আমরা সঙ্গেই এনেছি৷’

চূর্ণী বলল, ‘ঠিক বলেছিস৷ বেশ কয়েকটা আশ্রম তো এর আগে দেখলাম আমরা৷ অধিকাংশই তো অনাথ আশ্রমের নামে ব্যবসা ফেঁদেছে অথবা ঠগবাজ! এ আশ্রমটা যদি তেমন না হয়, সত্যিই অনাথ শিশুদের জন্য কাজ করে তবে এদেরকেই টাকাটা দিয়ে যাব৷ এরপর তো বিয়ের জোগাড় যন্তরের কাজ শুরু করতে হবে৷ তার ওপর আবার অফিসের কাজের চাপ আছে৷ এরপর আর এ কাজের জন্য সময় বের করা মুশকিল হয়ে যাবে৷

মল্লার বলল, ‘শুনছি, আমার নাকি নর্থ বেঙ্গলে বদলির অর্ডার আসতে পারে৷ তখন আমারও বেশ কয়েক মাস অফিস বাদ দিয়ে অন্য কাজ করা চাপের হয়ে যাবে৷’—এ কথা বলে সে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল গাড়ি৷ আর তার সঙ্গে সঙ্গে নদীটাও যেন তাদের আরও কাছে এগিয়ে আসতে লাগল৷

মল্লার, সোহম ও চূর্ণী তিন বন্ধু৷ বছর পাঁচেক আগে সোশ্যাল মিডিয়া অর্থাৎ ফেসবুকে প্রথম যোগাযোগ হয় এই দুই তরুণ আর তরুণীর৷ ক্রমে ক্রমে তাদের ব্যক্তিগত স্তরে আলাপ ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে৷ আর কদিন পর তো সোহম আর চূর্ণী এ বন্ধুত্বের গণ্ডি অতিক্রম করে সামাজিকভাবে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সারা জীবনের জন্য আবদ্ধ হতে চলেছে৷

ফেসবুকে পরিচয় হলেও তাদের তিনজনের এই গাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার পিছনে বিশেষ একটা কারণ আছে৷ তা হল, শৈশবে তাদের প্রত্যেকরই জীবন কেটেছ পিতৃ-মাতৃহীন বা অনাথ পরিচয়ে৷

মল্লারের বাবা-মা তার শৈশবেই মারা যান৷ তারপর এক দুঃসম্পর্কীয় আত্মীয়র কাছে বেড়ে ওঠে মল্লার৷

সোহম বছর পাঁচেক বয়সে গঙ্গাসাগর মেলাতে কোনও গ্রাম থেকে এসে হারিয়ে গিয়েছিল৷ তার বাবা-মায়ের কোনও সন্ধান না মেলায় সোমহের শেষ পর্যন্ত স্থান হয় এক অনাথালয়ে৷

চূর্ণীরও তাদের মতনই ব্যাপার৷ শৈশবে সে পিতা-মাতাকে হারায়৷ সম্ভবত কন্যাসন্তান বলেই আত্মীয়পরিজন তার দায় নিতে চায়নি৷ মিশনারি অনাথাশ্রমে তার স্থান হয়৷

এই পিতৃ-মাতৃহীন অনাথ পরিচয়ই তাদের তিনজনের মধ্যে গাঢ় বন্ধুত্বের মূল ভিত্তি৷ কারণ, তাদের শৈশব কৈশোরের যন্ত্রণার কথা তারা নিজেরা যেমনভাবে বুঝতে পারে তা বাইরের লোকরা কিছুটা বুঝলেও সম্পূর্ণভাবে ঠিক উপলব্ধি করতে পারে না৷ এছাড়া আরও একটা ব্যাপারে তাদের অদ্ভুত মিল আছে৷ অনেকক্ষেত্রেই এইসব অনাথরা যেমন সমাজের গোলোকধাঁধায় বা অন্ধকার ভবিষ্যতে নিজেদেরকে হারিয়ে ফেলে, এদের তিনজনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তেমন হয়নি৷ শৈশব-কৈশোরের সব দুঃখ যন্ত্রণা কষ্টকে অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত যুবক বয়সেই তারা জীবন যুদ্ধে জয় লাভ করেছে বলা যায়৷ তিনজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি অতিক্রম করেছে, সফলভাবে প্রবেশ করেছে কর্মক্ষেত্রে৷

মল্লার চাকরি করে একটা সরকারি ব্যাঙ্কে৷ সোহম আর চূর্ণী দু’জনেই আলাদা আলাদা দুটো মাল্টিন্যাশনাল সংস্থায় বেশ উচ্চপদে কর্মরত৷ আজ আর তারা কোনও অনাথ আশ্রম বা অন্য লোকের আশ্রয়ে থাকে না৷ আজ তাদের প্রত্যেকেরই নিজের ঠিকানা আছে৷ সবথেকে বড় কথা আজ প্রত্যেকেই নিজের পরিচয়ে পরিচিত, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সমাজে৷ তবে পিতা-মাতাহীন শৈশব, কৈশোরের যন্ত্রণার কথা তারা আজ হাজার আনন্দের মধ্যেও ভোলেনি৷ অনাথ বাচ্চাদের কথা শুনলেই নিজেদের ফেলে আসা দিনের কথা ভেবে অসহায় শিশুদের প্রতি অন্তরের টান অনুভব করে তারা৷ আর তাই তাদের জন্য কিছু করতে তিনজনই গত তিন বছর ধরে নিজেদের টাকা জমিয়ে একটা ফান্ড গড়ে তুলেছে৷ সে টাকাটা বর্তমানে বেশ মোটা অঙ্কে এসে ঠেকেছে৷ পাঁচ লাখ টাকা!

সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ টাকাটা কোনও সম্বলহীন অনাথ আশ্রমে দান করবে৷ এমন আশ্রম, যারা সরকারি বা বড় প্রতিষ্ঠানের সাহায্য পায় না অথচ অনাথ শিশুদের জন্য সত্যিই কাজ করার চেষ্টা করে চলেছে৷ এই মর্মে কয়েক মাস আগে তারা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল৷ সেই বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে সাহায্যের আর্জি জানিয়ে বেশ কিছু আবেদনপত্র এসেছিল তাদের কাছে৷ সেই সব আবেদনের যথার্থতা যাচাই করার জন্য মাসখানেক ধরে সময় সুযোগ বুঝে বেশ কয়েকটি আশ্রম ইতিপূর্বে ঘুরে বেড়িয়েছে৷ কিন্তু সে সব আশ্রমের কাউকেই তাদের কষ্টার্জিত অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে উপযুক্ত বলে মনে হয়নি৷ কোনও আশ্রম দেখে মনে হয়েছে সেটা আসলে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান৷ অনাথ শিশুদের সামনে রেখে মুনাফা লোটার জন্য আশ্রম খোলা হয়েছে৷ কোনও আশ্রম সম্পর্কে খবর নিয়ে জানা গেছে তারা নানা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রভূত অর্থ সাহায্য পায়৷ আর একবার এক অনাথ শিশুদের আশ্রমে গিয়ে তো সকলে শেষ পর্যন্ত হতভম্ব হয়ে গেছিল৷

গ্রাম লাগোয়া একটা মফস্‌সল শহরে পুরনো দিনের একটা বিরাট বাড়িতে ছিল সেই আশ্রম৷ এক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের নামে নতুন গড়ে তোলা হয়েছে৷ নতুন আশ্রম, তাই টাকার দরকার৷ এমনই দাবি করা হয়েছিল৷ আবেদন সাড়া দিয়ে মল্লাররা আশ্রম পরিদর্শনের জন্য সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল৷ তাদের সামনে হাজির করা হল সাত-আট জন দশ-বারো বছর বয়সি ছেলেকে৷ প্রত্যেকেরই শরীর-স্বাস্থ্য বেশ সুন্দর, পোশাক-আশাক বেশ পরিপাটি, প্রত্যেকেরই হাসিখুশি মুখ৷ তাদের দেখে মল্লার-সোহম-চূর্ণী, তিনজনেরই মনে হয়েছিল আশ্রম কর্তৃপক্ষ তাদের বেশ যত্নে রাখেন৷ নতুন আশ্রম হলেও তার পরিবেশ পরিস্থিতিও বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন৷ এসব দেখে তারা মোটামুটি এক প্রকার সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেছিল যে ওই আশ্রমকেই টাকাটা দেবে৷ কিন্তু এতগুলো টাকার ব্যাপার বলে কথা৷ তাই তারা আশ্রমের ব্যাপারটা শেষ একবার ভালো করে পরখ করে নেবে বলে ঠিক করেছিল। নিজেরা খাবার ও থাকার টাকা দিয়ে দু’দিন সেখানে থেকে যাবে৷ আশ্রম কর্তৃপক্ষ প্রথমে ওদের থাকতে দিতে ইতস্তত করলেও শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছিল টাকা হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে৷ হয়তো ভেবেছিল শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা তারা সামলে নেবে৷

সে আশ্রমে প্রথম দিনে তাদের তিনজনের চোখে কোনও অসঙ্গতি ধরা পড়েনি৷ কিন্তু দ্বিতীয় দিন সকাল থেকেই বাচ্চা ছেলেগুলোর মধ্যে কেমন যেন অস্থির ভাব দেখতে পেল৷ দ্বিতীয় দিন আশ্রম কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকবার বলার চেষ্টা করল টাকাটা তাদের দিয়ে দিলে ভালো হয়৷ কারণ, স্থানীয় ব্যাঙ্ক নাকি মেরামতির কারণে পরদিন থেকে বেশ কিছু দিনের জন্য বন্ধ থাকবে, তাই চেকটা আগে দিলে তারা ওদিন ব্যাঙ্কে জমা দিতে পারে৷ ওদের কথা শুনে কেমন যেন একটা সন্দেহ জেগেছিল মল্লারদের মনে, আর সেটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল পরদিন সকালে৷ সেদিন রাতে কয়েকজন বাচ্চার কান্নার শব্দ কানে এসেছিল৷ আর রাত কাটতেই সেখানে এসে হাজির হয়েছিল বেশ কয়েকজন লোক৷ তাদের থেকে মল্লাররা জানতে পারে যারা তাদেরকে আশ্রম কর্তৃপক্ষ বলে পরিচয় দিয়েছিল তারা সেই বাড়িটা কয়েক দিনের জন্য ভাড়া নিয়েছিল স্থানীয় একজনের কাছ থেকে৷

বাড়িটা কোনও অনাথ আশ্রম নয়৷ আর সেই বাচ্চাগুলোও কেউ অনাথ শিশু নয়৷ অনাথ শিশু সাজিয়ে আনা হয়েছিল স্থানীয় গ্রাম থেকে ওদের বাপ-মাকে কিছু টাকা দিয়ে৷ এক রাতের জন্য৷ কিন্তু দু’রাত কেটে যাওয়াতে সকালবেলায় বাচ্চাদের নিতে এসেছে তাদের বাবারা৷ পুরো ব্যাপারটাই আসলে জালিয়াতি করে পয়সা হাতানোর মতলব ছিল৷ সেই ঠগবাজরা অবশ্য ধরা পড়ার আশঙ্কায় ভোরের আলো ফোটার আগেই চম্পট দিয়েছিল৷ অনাথ আশ্রম দেখতে গিয়ে এমন বিচিত্র অভিজ্ঞতাও হয়েছিল মল্লারদের৷

তবে যে আশ্রমগুলোকে অর্থ সাহায্য করার জন্য ইতিপূর্বে মল্লার-সোহম-চূর্ণীরা গিয়েছিল, সে আশ্রমগুলো সবই ছিল, কলকাতা বা কলকাতা থেকে ঘণ্টা দু-তিন সময়ের দূরত্বে৷ কিন্তু এত দূরে আশ্রম দেখতে কোনও দিন তারা যায়নি৷ এ জায়গার দূরত্ব কলকাতা থেকে অনেকটা৷ নদীয়া জেলার উত্তরে একদম শেষ প্রান্তে মুর্শিদাবাদ জেলার লাগোয়া অঞ্চল৷ দু’ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছে গাড়ি নিয়ে এখানে পৌঁছতে৷ সেই বাদুড়ঝোলা গাছটা অতিক্রম করার মিনিট পনেরো পর সত্যিই অনেকটা কাছে চলে এল নদীটা৷ তারপর চোখে পড়ল উঁচু দরমার বেড়া দিয়ে ঘেরা একটা জমি৷ তার ভিতরে খড়ের ছাদওয়ালা বেশ কিছু ঘর আর গাছপালা দেখা যাচ্ছে৷ তা দেখে মল্লার বলল, ‘আমরা পৌঁছে গেছি এবার৷’

সেই বেড়ার গা বেয়ে গাড়ি নিয়ে একটু এগতেই ভিতরে ঢোকার প্রবেশপথ চোখে পড়ল৷ মুলি বাঁশের বেড়ার তৈরি বেশ বড় একাট দরজা৷ তার পাশেই একটা বাঁশে আটকানো একটা টিনের সাইন বোর্ড৷ হলুদ রঙের সাইন বোর্ডে কালো রঙে লেখা ‘নবজীবন আশ্রম’৷ প্রবেশ পথের সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ির হর্ন বাজাতে লাগল মল্লার৷

বেশ কয়েকবার হর্ন বাজানোর পর দরজার ঝাপ ভিতর থেকে খুলে গেল৷ ঝাপের আড়াল থেকে বাইরে বেরিয়ে মল্লারদের গাড়িটার দিকে এগিয়ে এল একটা বাচ্চা ছেলে৷ কিন্তু সে গাড়ির সামনে আসতে মল্লাররা বুঝতে পারল যে সে আসলে একজন খর্বাকৃতি লোক৷ চলতি কথায় তাকে বামন বলে৷ লোকটার দাড়ি গোঁফ কামানো বা নেই বলে প্রথম দর্শনে তাকে বাচ্চা ছেলে বলে মনে হয়েছিল৷ মল্লার লোকটার উদ্দেশে বলল, ‘আমরা কলকাতা থেকে আসছি৷’

লোকটা যেন অবগত ছিল মল্লারদের আসার ব্যাপারে৷ গাড়ির ভিতরটা সে এক ঝলক উঁকি দিয়ে দেখে নিয়ে বলল, ‘আসুন বাবুরা, ভিতরে আসুন৷’

লোকটা এরপর বাঁশের বেড়াটা গাড়ি নিয়ে যাওয়ার মতো ফাঁক করে দিল৷ মল্লাররা গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করল আশ্রমের ভিতর৷ তারপর বামন লোকটাকে অনুসরণ করে ধীর গতিতে এগতে লাগল৷ ভিতরে ঢুকেই তারা বুঝতে পারল নদীর প্রায় কোল ঘেঁষে অন্তত চার-পাঁচ বিঘা জমি নিয়ে গড়ে উঠেছে আশ্রমটা৷ আয়তাকার জমিটার মাঝে একাট ফাঁকা জায়গা৷ তার কেন্দ্রস্থলে টিনের ছাউনি দেওয়া বাঁশের বেড়ার একটা বেশ বড় বাড়ি বা ঘর৷ আর তাকে কেন্দ্র করে ফাঁকা জমিটার চারপাশে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ঘর৷ মাটির উঠান, দেওয়াল বাঁশের তৈরি৷ মাথায় খড়ের চাল৷ আশ্রমের মধ্যে বেশ কিছু ছোট-বড় গাছও দাঁড়িয়ে আছে৷ কয়েক জায়গাতে বেড়ার গা ঘেঁষে শাক, কপি ইত্যাদি শীতের সব্জিরও চাষ করা হয়েছে৷ গাড়ির ভিতর থেকেই বাইরে তাকিয়ে তারা বুঝতে পারল আশ্রম কথাটা মনে পড়লেই মনের মধ্যে যেমন ভাবনা ভেসে ওঠে, এ জায়গাটা ঠিক তেমনই৷ এ জাগাটা তাদের দেখা আগের আশ্রমগুলোর মতো আলো বাতাসহীন কংক্রিটের কাঠামো নয়৷

লোকটার পিছন পিছন গাড়িটা এগিয়ে নিয়ে আশ্রমের কেন্দ্রস্থলে টিনের বাড়িটার সামনে এল মল্লাররা৷ বামন লোকটা এবার হাতের ইশারাতে বাড়িটার এক পাশে একটা ফাঁকা জায়গাতে গাড়িটা রাখতে বলল৷ তার কথা মতো সেখানে গাড়ি থামিয়ে তারা তিনজন নেমে পড়ল গাড়ি থেকে৷ তারপর লোকটাকে অনুসরণ করে এগলো টিনের ছাউনিওয়ালা বাড়িটার দিকে৷ সেদিকে এগতে এগতে চূর্ণী আঙুল তুলে একটা দিকে দেখিয়ে বলল, ‘ওই দেখ—৷’ তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকাল মল্লার আর সোহম৷ সেদিকে বেড়ার সীমানা ঘেঁষে অনেকটা ব্যারাকের মতো দেখতে একটা লম্বাটে ধরনের ঘর বা বাড়ি৷ আশ্রমের অন্য আরও বাড়িগুলোলের মতো সে বাড়ির দেওয়ালও বাঁশের তৈরি, মাথায় খড়ের ছাদ৷ সামনে মাটির দাওয়া বা ঘরে প্রবেশ করার জন্য উঁচু বারান্দা৷ আর সেই দাওয়াতে সার বেঁধে পা ঝুলিয়ে বসে আছে যারা তাদের কারও গায়ে হাফ হাতা সোয়েটার বা সস্তা দামের চাদর জড়ানো৷ খালি পা৷ শেষ বিকেলের আলো এসে পড়েছে তাদের মুখে৷ সেই আলোতে কেমন যেন মায়াময় দেখাচ্ছে সেই মুখগুলো৷ মল্লারদের দিকে দূর থেকে উৎসুকভাবে তাকিয়ে আছে তারা৷ মল্লাররা তাদের দেখে অনুমান করল, ছেলেগুলো আশ্রমিক অনাথ বাচ্চার দল৷

অধ্যায় ১ / ১৪

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন