০১. আজ পয়লা আষাঢ়

শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)

আজ পয়লা আষাঢ়। কলকাতার চিৎপুর রোড ও সি আই টি রোডের মোড়ে একটা বিবর্ণ হতশ্রী ল্যাম্পপোস্টের খুব কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে সোমনাথ। পুরো নাম—সোমনাথ ব্যানার্জি।

রিকশা, ঠেলাগাড়ি, বাস, লরি, ট্যাক্সি এবং টেম্পোর ভিড়ে চিৎপুর রোডে ট্র্যাফিকের গোলমেলে জট পাকিয়েছে। এরই মধ্যে একটা পুরনো ট্রামের বৃদ্ধ ড্রাইভার লালবাজার থেকে বেরিয়ে বাগবাজার যাবার উৎকণ্ঠায় টং টং করে ঘণ্টা বাজাচ্ছে। সোমনাথের মনে হলো প্রাগৈতিহাসিক যুগের এক জরাগ্রস্ত বিশাল গিরগিটি নিজের নিরাপদ আশ্রয় থেকে বিতাড়িত হয়ে কেমনভাবে কলকাতার এই জন-অরণ্যে পড়ে কাতর আর্তনাদ করছে।

আকারে বৃহৎ হওয়া সত্ত্বেও উদ্বাস্তু গিরগিটির জন্যে সোমনাথের একটু মায়া লাগছে। পৃথিবীতে এতো রাজপথ থাকতে কোন ভাগ্যদোষে বেচারা কলকাতার এই রবীন্দ্র সরণিতে এসে পড়লো? কয়েক বছর আগে হলেও সোমনাথ এই জ্যামজমাট জটিল পরিস্থিতি থেকে কবিতার উপাদান সংগ্রহ করে নিতো। পকেটের ছোট্ট নোট বইয়ে এই মহরতের মানসিকতা নোট করতো, তারপর রাত্রে কবিতা লিখতে বসতো। হয়তো নাম দিতে জন-অরণ্যে প্রাগৈতিহাসিক গিরগিটি। নতুন-লেখা কবিতাটা পরের দিনই তপতীকে পড়াতো। কিন্তু এসব কথা এখন ভেবে লাভ কী? সোমনাথের জীবন থেকে কবিতা বিদায় নিয়েছে।

টেরিটি বাজারের কাছে সোমনাথ ব্যানার্জি কী জন্যে দাঁড়িয়ে আছে? সে কোথায় যাবে? কেন? এই মুহূর্তে কোনো পরিচিত জন এইসব প্রশ্ন করলে সোমনাথ বেশ বিব্রত হয়ে পড়বে। অন্য যে-কোনোদিন হলে, মিথ্যা কিছু বলে দেওয়া যেতো। কিন্তু সোমনাথের পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়—আজ ১লা আষাঢ়। আষাঢ়ের এই প্রথম দিবসকে কবেকার কোন কবি নির্বাসিত এক যক্ষের বিরহবেদনায় স্মরণীয় করে তুলেছে। ২রা, ৩রা, ৫ই, ১৩ই, ১৫ই—আষাঢ়ের যে-কোনোদিনই তো মহাকবি কালিদাস বিরহী মর্মব্যথা উদ্‌ঘাটন করতে পারতেন—তাহলে এই ১লা তারিখটা সোমনাথ একান্তভাবে নিজের কাছে পেতো।

১লা আষাঢ় সোমনাথের জন্মদিন। চব্বিশ বছর আগে এমনই একদিনে সোমনাথ যে-হাসপাতালে ভূমিঠ হয়েছিল তার নাম সিলভার জুবিলী মাতৃসদন। পঞ্চম জর্জের রাজত্বের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে মহামান্য সম্রাটের অনুগত ভারতীয় প্রজাবৃন্দ নিজেদের উৎসাহে চাঁদা তুলে সেই হাসপাতাল তৈরি করেছিল। সিলভার জুবিলী হাসপাতালের বেবির নিজেরই সিলভার জুবিলী হতে চললো—সোমনাথ মনে মনে হাসলো।

চিৎপুর রোডের চলমান জনস্রোতের দিকে তাকিয়ে মায়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে সোমনাথের। মা বলতেন, জন্মদিনে ভালো হবার চেষ্টা করতে হয়। কাউকে হিংসে করতে নেই, কারুর ক্ষতি করতে নেই এবং মিথ্যে কথা বলা বারণ। ১লা আষাঢ়ের এই জটিল অপরাহ্নে রবীন্দ্র সরণিতে দাঁড়িয়ে সোমনাথ তাই মিথ্যে কথা বলতে পারবে না। কেউ প্রশ্ন করলে সোমনাথকে স্বীকার করতেই হবে, সে চলেছে মেয়েমানুষের সন্ধানে।

চমকে উঠছেন? বিব্রত বোধ করছেন? ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না? ভাবছেন, শুনতে ভুল করলেন? না, ঠিক শুনেছেন? ভদ্র, সভ্য, সুশিক্ষিত তরুণ সোমনাথ ব্যানার্জি চলেছে মেয়েমানুষের সন্ধানে এই শহরে যাদের কেউ বলে বেশ্যা, কেউ-বা কলগার্ল।

সোমনাথের বাবার নাম কয়েক বছর আগে একবার খবরের কাগজে বেরিয়েছিল। কাগজের কাটিংটা সোমনাথ নিজেই কেটে রেখেছিল, তারপর কমলা বউদি পারিবারিক অ্যালবামে আঠা দিয়ে এঁটে রেখেছেন। দ্বৈপায়ন ব্যানার্জি নিঃস্বার্থ দেশসেবার জন্যে সরকারী প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। সেই অবসরপ্রাপ্ত সরকারী গেজেটেড অফিসার দ্বৈপায়ন ব্যানার্জির ছেলে সোমনাথ ব্যানার্জি রাস্তায় অপেক্ষা করছে—এখনই সে নারীর সন্ধানে বেরুবে।

কালের অবহেলায় মলিন রবীন্দ্র সরণির দিকে আবার তাকালো সোমনাথ। এই গলিত-নখদন্ত জরদগব চিৎপুর রোডকে নামান্তরিত করে চিরসন্দরের কবির নামের সঙ্গে জড়িয়ে দেবার কুৎসিত বুদ্ধিটা কার মাথায় এলো? কলকাতার নাগরিকরাও কেমন? কেউ কোনো প্রতিবাদ করলো না? বড়বাজারের আবর্জনায় মহাত্মা গান্ধীকে এবং চিৎপুরের পূতিগন্ধময় অন্ধকূপে রবীন্দ্রনাথকে নির্বাসিত করেও এরা কেমন আত্মতুষ্টি অনুভব করছেন।

উত্তেজনায় সোমনাথের দুটো কান ঈষৎ গরম হয়ে উঠছে। মিস্টার নটবর মিত্র এখনই এসে পড়বেন। মেয়েমানুষের ব্যাপারে নটবর মিত্র অনেক খবরাখবর রাখেন। কিন্তু কোথায় নটবর? তিনি কেন এতো দেরি করছেন?

বিব্রত সোমনাথ মুখ তুলে একবার আকাশের দিকে তাকালো। কোথাও এক টুকরো মেঘের ইঙ্গিত নেই। যদি আকাশে অনেক কালো মেঘ থাকতো; যদি বলা যেতে ‘আসন্ন আষাঢ় ঐ ঘনায় গগনে’—তাহলে বেশ হতো। বাধবন্ধনহীন বর্ষার প্রবল ধারায় সোমনাথ যদি নিজের অতীতকে সম্পর্ণ মুছে ফেলতে পারতো তাহলে মন্দ হতো না।

কিন্তু অতীতকে ভোলা তো দূরের কথা, সোমনাথের অনেক কিছু, মনে আসছে। অতীত ও বর্তমান মিলেমিশে একাকার হয়ে সোমনাথের মানস-আকাশকে বর্ষার মেঘের মতো ছেয়ে ফেলেছে। সোমনাথ পথেই দাঁড়িয়ে থাকুক। চলুন আমরা ততক্ষণ ওর অতীত সম্পর্কে খোঁজখবর করি—ওর পারিবারিক জীবনের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় হোক আমাদের।

অধ্যায় ১ / ৩৩

সকল অধ্যায়

১. ০১. আজ পয়লা আষাঢ়
২. ০২. যোধপর পার্কে জলের ট্যাঙ্কের কাছে
৩. ০৩. চা খেয়ে সোমনাথ চুপচাপ বসেছিল
৪. ০৪. বাবার বন্ধু সুধন্যবাবু
৫. ০৫. আজকাল বাবাকে দেখলে কমলার কষ্ট হয়
৬. ০৬. দুপরের ক্লান্ত ঘড়িটা
৭. ০৭. মেঘ কাটতে শুরু করেছে
৮. ০৮. সুকুমার সেদিন চলে গিয়েছিল
৯. ০৯. অফিসের এক বন্ধুকে
১০. ১০. সোমনাথ মনস্থির করে ফেলেছে
১১. ১১. বউদি চলে যাবার একটু পরে
১২. ১২. হাতে অ্যাটাচি কেস নিয়ে
১৩. ১৩. মল্লিকবাবু ছাপানো প্যাডগুলো দিয়ে গেলেন
১৪. ১৪. পাশের ঘরের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ
১৫. ১৫. তপতী বাহাত্তর নম্বর ঘরে হাজির হলো
১৬. ১৬. মিস্টার মাওজীর সঙ্গে সোমনাথের দেখা
১৭. ১৭. সোমনাথের ভাগ্যটা নিতান্তই পোড়া
১৮. ১৮. কমলা বউদি একবারও প্রশ্ন করলেন না
১৯. ১৯. গলার টাইটা কয়েক ইঞ্চি ঢিলে করে
২০. ২০. সোমনাথকে ডেকে পাঠালেন নটবর মিত্তির
২১. ২১. জন্মদিনটা আনন্দের কেন
২২. ২২. যোধপুর পার্ক বাস স্ট্যান্ডের কাছে
২৩. ২৩. সোমনাথ পাথরের মতো বসে রইলো
২৪. ২৪. বাহাত্তর নম্বর ঘরে এগারো নম্বর সীটে
২৫. ২৫. গোয়েঙ্কার প্রত্যাশিত ফোন এসেছে
২৬. ২৬. ইউরোপীয়ান অ্যাসাইলাম লেনের কাছে
২৭. ২৭. মিসেস গাঙ্গুলী
২৮. ২৮. উড স্ট্রীটে এলেন নটবর মিত্র
২৯. ২৯. মিসেস বিশ্বাসের ফ্ল্যাটের কাছে
৩০. ৩০. গোয়েঙ্কাজীর ঘরে
৩১. ৩১. দেড় ঘণ্টা
৩২. ৩২. মাতালের মতো টলছে সোমনাথ ব্যানার্জি
৩৩. ৩৩. জন-অরণ্যের নেপথ্য কাহিনী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন