০৯. অফিসের এক বন্ধুকে

শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)

মেজদা অফিসের এক বন্ধুকে সস্ত্রীক বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছে। জুনিয়রমোস্ট অ্যাকাউনটেন্ট কাজলের তুলনায় এই ভদ্রলোক অনেক বড় চাকরি করেন। কিন্তু কাজলের সঙ্গে ইনি মেলামেশা করেন। একবার বাড়িতে নেমন্তন্ন না করলে ভালো দেখাচ্ছিল না।

বুলবুলের বিশেষ অনুরোধে সোমনাথকে গড়িয়াহাটা থেকে বাজার করে আনতে হয়েছে।

হাতে কোনো কাজ-কর্ম নেই, তবও আজকাল বাজারে যেতে প্রবৃত্তি হয় না সোমনাথের। অরবিন্দর সঙ্গে ওইখানে দেখা হয়ে যেতে পারে। এবং দেখা হলেই জিজ্ঞাসা করবে, ফরেনে যাবার ব্যবস্থা কতদরে এগুলো। বাজারে যাবার আগে বুলবুল বলেছিল, “তোমার মেজদাকে বাজারে পাঠিয়ে লাভ নেই। হয়তো পচা মাছ এনে হাজির করবেন।”

দুর থেকে কমলা বউদি হাসতে-হাসতে বললেন, “দাঁড়াও, কাজলকে ডাকছি।”

বুলবুল ঘাড় উঁচু করে বললো, “ভয় করি নাকি? যা সত্যি, তাই বলবো। অফিসে ঠাণ্ডা ঘরে বসে হিসেব করা আর জিনিস বুঝে-শনে সংসার করা এক জিনিস নয়।”

মেজদার কানে দই বউয়ের কথাবার্তা এমনিতেই পৌঁছে গেলো। মাথার চুল মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বউদিকে অভিজিৎ জিজ্ঞেস করলো, “কী বলছো?”

বউদি রসিকতার সুযোগ ছাড়লেন না। বললেন, “আমাকে কেন? নিজের বউকেই জিজ্ঞেস করো।”

বউকে কিছুই জিজ্ঞেস করলো না মেজদা। বললো, “নিজে বাজারে বেরোলেই পারো।”

“কী কথাবার্তার ধরন! দেখলেন তো দিদি।” বুলবুল স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলো কমলা বউদির কাছে!

সোমনাথের এইসব রস-রসিকতা ভালো লাগছে না। সে নিজের ঘরের ভিতর চকে বসে রইলো।

এখান থেকেও ওদের সমস্ত কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। কমলা বউদি কাজলকে বললেন, “কেন তুমি বুলবুল বেচারার পিছনে লাগছো?”

বুলবুল সাহস পেয়ে গেলো। বরকে সোজা জানিয়ে দিলো, “ইচ্ছে হলে বাজার করতে পারি। কিন্তু অগ্নিসাক্ষী রেখে মন্তর পড়ে খাওয়ানো-পুরানোর দায়িত্ব নিয়েছিলে কেন?”

স্বামী-স্ত্রীর এই খুনসুটি অন্য সময় মন্দ লাগে না সোমনাথের। বুলবুলের মধ্যে সখীভাবটা প্রবল, আর কমলা বউদির মধ্যে মাতৃভাব। কমলা বউদি দু-একবার সোমনাথকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, “বুলবুলও বউদি, ওকে বউদি বলবে।” ওই জিনিসটা পারবে না সোমনাথ! ভূতপর্ক কলেজ-বান্ধবীকে রাতারাতি বউদি করে নিতে পারবে না। বুলবুলও একই পথ ধরেছে। সোমনাথকে ঠাকুরপো বলে না, কলেজের নাম ধরেই ডাকে।

কমলা বউদি বলেছিলেন, “নিদেনপক্ষে সোমদা বোলো।”

বুলবুল তাতেও রাজী হয়নি—“আমার থেকে বয়সে তত বড় নয়। সুতরাং হোয়াই দাদা?”

কমলা বউদির গলা শোনা গেলো। “বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাত্রে ঝগড়া কোরো বুলা। এখন খোকনকে ছেড়ে দাও।”

সোমনাথের ঘরে ঢুকে বুলবুল বললো, “ভাই সোম, রক্ষে করো।”

সোমনাথ নিজেই এবার হাল্কা হবার চেষ্টা করলো। বললো, “দাদার হাত থেকে কী করে রক্ষে করবো? জেনেশুনেই তো বিয়ের মন্ত্র পড়েছিলে?”

দেওরের দিকে তির্যক দৃষ্টি দিলো বুলবুল। তারপর শাড়ির আঁচলে ভিজে হাতদুটো মছলো। বললো, “তুমিও আমার পিছনে লাগছে সোম? অফিসের যে-লোকটা খেতে আসবে সে বেজায় খুতখুতে। বউটা তেমনি নাক উঁচু। যদি আপ্যায়নের দোষ হয় অফিসে কথা উঠবে। আর তোমার দাদা আমাকে আস্ত রাখবে না।”

সোমনাথ কপট গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললো, “বাজারে আস্তর চেয়ে কাটার দাম বেশি।”

বুলবুল ছাড়লো না। আঁচলটা কোমরে জড়াতে জড়াতে বললো, “এর প্রতিশোধ একদিন আমিও নেবো, সোম। তোমারও বিয়ে হবে এবং বউকে আমাদের খপরে পড়তে হবে।”

রসিকতায় খুশী হতে পারলো না সোমনাথ। এ-বাড়ির বেকার সোমনাথের বিয়ের কথা তোলা যে ব্যঙ্গ তা মোক্ষদা ঝিও জানে।

বুলবুল বললো, “ইলিশ এবং ভেটকি দু রকমই মাছ নিও, সোম। ওরা আবার আমাদের চিংড়ি মাছও খাইয়েছিল। আমি কিন্তু টেক্কা দেবার চেষ্টা করবো না।”

বাজার ঠিকমতো করেছিল সোমনাথ। কিন্তু বাড়িতে অতিথি আসবে শুনলেই সে অস্বস্তি বোধ করে। অতিথির সঙ্গে পরিচয়ের পর্বটা সোমনাথ মোটেই পছন্দ করে না। দুপুরবেলা হলে সোমনাথ কোথাও চলে যেতো-ন্যাশনাল লাইব্রেরির দরজা তো বেকারদের জন্যেও খোলা রয়েছে। কিন্তু অতিথি আসছেন রাত্রিবেলাতে।

অতিথি পরিচয়ের আধুনিক বাংলা কায়দটিা সোমনাথের কাছে মোটেই শোভন মনে হয় না। নমস্কার, ইনি অভিজিৎ ব্যানার্জির ভাই, বললেই পর্বটা চুকে যাবে না। একটা অলিখিত প্রশ্ন বিরাট হয়ে দেখা দেবে। ‘ভাই তো বুঝলাম, কিন্তু ইনি কী করেন?’ কলকাতার তথাকথিত ভদ্রসমাজে এ-প্ৰশ্ন এড়িয়ে যাবার কোনো উপায় নেই।

 

অতিথিরা সন্ধ্যা সাড়ে-সাতটার সময় এলেন। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস এম কে নন্দীকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে বলল এক্সট্রা স্পেশাল সাজ করে সময় গণছিল। এই সাজের পিছনে বুলবুলের অনেক চিন্তা আছে। মেজদার সঙ্গে জল্পনা-কল্পনা হয়েছে। বুলবুলকে দেখে কমলা বউদি মন্তব্য করলেন, “এতো ভেবে-চিন্তে শেষ পর্যন্ত এই সাধারণ কাজ হলো?”

বুলবুল উত্তর দিলো, “আর বলেন কেন, দিদি। এইটাই নাকি এখনকার চালু স্টাইল। নিজের বাড়ি তো—খুব ব্রাইট কোনো শাড়ি পরলে এবং লাউড মেক-আপ থাকলে ভাববে ইনি নিজেই বাইরে নেমন্তন্ন রাখতে যাচ্ছেন। তাই মেক-আপ খুব টোন-ডাউন করতে হবে এবং শাড়িটা যেন সাধারণ মনে হয়। কিন্তু শাড়ির দামটা যে মোটেই সাধারণ নয় তা যেন অভ্যাগতরা বুঝতে পারেন। ভাবটা এমন, এতোক্ষণ রান্নাঘরেই ছিলাম, আপনারা এসেছেন শুনে আলতোভাবে মুখের ঘামটা মছে দুত চলে এসেছি। অতিথি আপ্যায়নের সময় কী নিজের সাজ-গোজের কথা খেয়াল থাকে?”

সোমনাথের হাসি আসছিল। অফিসার হয়েও তাহলে শান্তি নেই কত রকমের অভিনয় করতে হয়। বুলবুল অবশ্য পারবে—ওর এইসব ব্যাপারে বেশ ন্যাক আছে।

মিস্টার-মিসেস নন্দীকে গেটেই কাজল ও বলল অভ্যর্থনা করলো। এ-বাড়ির রীতি অনুযায়ী অতিথি দম্পতিকে একবার ওপরে বাবার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। বাবার সঙ্গে দু-একটা কথার পর মিস্টার-মিসেস নন্দী নিচে নেমে এলেন।

মুখে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে বলল বললো, “আমার ভাশরের সঙ্গে আপনার আলাপ হলো না। উনি এখন ট্যুরে  রয়েছেন।”

মেজদা বললো, “বউদিকে ডাকো।” কমলা বউদিকে ধরে আনবার জন্যে বুলবুল বেরিয়ে যেতেই মিস্টার নন্দীকে মেজদা বললো, “দাদা ব্রিটিশ বিস্কুট কোম্পানিতে আছেন। কয়েক সপ্তাহের জন্যে বোম্বাই গিয়েছেন। ওদের কোম্পানির নাম পাল্টাচ্ছে—ইন্ডিয়ান বিস্কুট হচ্ছে।”

মিস্টার নন্দী বললেন, “হতেই হবে। সমস্ত জিনিসই আমাদের ক্রমশ দিশী করে ফেলতে হবে, মিস্টার ব্যানার্জি।”

“রাখো তোমার স্বদেশী মন্তর,” মিসেস নন্দী স্বামীকে বকুনি লাগালেন। “তোমাদের আপিসের সব সায়েবগলে চলে গিয়ে যখন হরিয়ানী বসবে তখন মজা বুঝতে পারবে।”

মিস্টার নন্দী যে বউয়ের বকুনিতে অভ্যস্ত তা বোঝা গেলো। বেশ শান্তভাবে ইন্ডিয়া কিং সিগারেট ধরিয়ে বউকে তিনি বললেন, “হরিয়ানা এবং স্বদেশীয়ানা যে একই জিনিস তা এখন অনেকেই হাড়ে-হাড়ে বুঝছে। কিন্তু মিন, সায়েবদের চলে যেতে বলছে কে? শুধু খোলস পাল্টাতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।”

মিসেস নন্দী বললেন, “কোম্পানির পার্টিতে যেতে আমার মোটেই ভালো লাগে না। কিন্তু বাধ্য হয়ে প্রেজেন্ট থাকতে হয়।”

“কী করবেন বলনে। যে-পজোর যে-মন্ত্র, সুদর্শনা ও সুসজ্জিতা মিসেস নন্দীকে সান্ত্বনা দিলো অভিজিৎ।

মিসেস নন্দী বললেন, “সেদিনের ককটেল পার্টিতেও স্বদেশীর কথা উঠেছিল। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস চোপরা তিনমাস ফরেন বেড়িয়ে এসে ভীষণ স্বদেশী হয়ে উঠেছেন। বললেন, মেয়েদের কসমেটিকস এবং ছেলেদের স্কচ, হইকি ছাড়া আর সব জিনিস স্বদেশী হয়ে গেলে তাঁদের কোনো আপত্তি নেই।”

বুলবুল সেদিন পাটিতে উপস্থিত ছিল। পার্টির শেষের দিকে বেশ কয়েক পেগ ফরেন হইস্কি পান করে মিসেস চোপরা আরও উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। বুলবুলের কোমরে হাত রেখে পঞ্চাশ বছরের যুবতী মিসেস চোপরা বলেছিলেন, “দেশের মঙ্গলের জন্যে ইমপোর্টেড কসমেটিকস আনা কয়েক বছর বন্ধ হলে তাঁর আপত্তি নেই।”

বুলবুলের কথা শুনে হা-হা করে হেসে উঠলেন মিস্টার নন্দী। “মিসেস ব্যানার্জি আপনি সত্যিই খুব সরল প্রকৃতির মানুষ। আপনি মিসেস চোপরার কথা বিশ্বাস করলেন? উনি বলবেন না কেন? এবার ফরেন থেকে ফেরবার সময় মহিলা যা কসমেটিকস এনেছেন তাতে ওঁর সমস্ত জীবন সুখে কেটে যাবে।”

“ও মা!” মিসেস নন্দী স্কুলের কিশোর বালিকার মতো বিস্ময় প্রকাশ করলেন।

মিস্টার নন্দী বললেন, “এসব ভিতরের খবর। বিশ্বাস না-হলে, ট্রাভেল ডিপার্টমেন্টের অ্যারো মুখার্জিকে জিজ্ঞেস করবেন। কাস্টমসের নাকের সামনে দিয়ে বিনা-ডিউটিতে ওই মাল ছাড়িয়ে আনতে বেচারার ব্লডি-প্রেসার বেড়ে গিয়েছে। উপায়ও নেই—রিজিওন্যাল ম্যানেজারের বউ। লিপস্টিকের ওপর ডিউটি ধরলে অ্যারো মুখার্জির চাকরি থাকবে না।”

“ওমা? তুমি তখন বললে না কেন চুপি চুপি।” মিসেস নন্দী আবার বালিকা-বিস্ময় প্রকাশ করলেন।

“কেন মিসেস নন্দী? সি-বি-আইকে খবর পাঠাতেন নাকি?” অভিজিৎ রসিকতা করলো।

“কিছুই করতাম না। শুধু মহিলাকে নেশার ঘোরে ভুলিয়ে-ভালিয়ে দু-একটা লিপস্টিক হাতিয়ে নিতাম,” মিসেস নন্দী আপসোস করলেন।

মিস্টার নন্দী সন্দেহ প্রকাশ করে বললেন, “সে-মুরোদ তোমাদের নেই। মিসেস চোপরার কালচারে মানুষ হলে চক্ষুলজ্জা থাকতো না, তখন হেসে কেদে কিংবা স্রেফ অঙ্গভঙ্গী দেখিয়ে ঠিক ম্যানেজ করে আনতে। ওরা যেমন নির্লজ্জভাবে বড়কর্তাদের জন্যে তেল পাম্প করে, তেমনি নির্দয়ভাবে নিচু থেকে তেলের সাপ্লাই প্রত্যাশা করে।”

একতলা ঘরে ঘরে দেখতে দেখতে চারজনের মধ্যে কথা হচ্ছে। নিজের ঘরে বসেই সোমনাথ এসব স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।

ঘুরতে ঘুরতে ওরা যে এবার সোমনাথের ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছে তা সোমনাথ বুঝতে পারলো। দরজাটা অর্ধেক খোলা ছিল। অভিজিৎ একটা আলতো টোকা মারলো। সোমনাথ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো।

“উঠবেন না, উঠবেন না, বসুন।” হাঁ-হাঁ করে উঠলেন মিস্টার নন্দী।

মেজদা বললো, “আমার ইয়ংগেস্ট ভাই সোমনাথ।” তারপর সোমনাথকে বললো, “খোকন, আমাদের অফিসের ট্রেনিং অ্যান্ড টাফ ম্যানেজার মিস্টার নন্দী।”

সোমনাথ সম্পর্কে শূন্যস্থান পূরণের জন্যে মিসেস নন্দী স্বভাবসিদ্ধ কৌতূহলী দৃষ্টিতে বুলবুলের দিকে তাকালেন। বুলবুলের বুঝতে বাকি রইলো না, মিসেস নন্দী কী জানতে চাইছেন। বুলবুলের বেশ অস্বস্তি লাগছে।

অভিজিৎও অস্বস্তি বোধ করছে। কিন্তু সে কায়দা করে উত্তর দিলো, “সামনে ওর নানা পরীক্ষা রয়েছে। বাড়ির ছোট ছেলে তো, আমরা তাই একটু বেশি করে ভাবছি।”

“ঠিক করছেন মশায়,” উৎসাহিত হয়ে উঠলেন মিস্টার নন্দী। মার্চেন্ট ফার্মে অফিসার পোস্টে ঢুকিয়ে ওর জীবনটা বরবাদ করে দেবেন না। তার থেকে আই-এ-এস-টেস অনেক ভালো।”

কান লাল হয়ে উঠেছিল সোমনাথের। অপমান ও উত্তেজনার মাথায় সে হয়তো কিছু, বলেই ফেলতো। কিন্তু মিস্টার নন্দী বাঁচিয়ে দিলেন। বুলবুলকে বললেন, “ওঁর পড়াশোনায় ডিসটাব করে লাভ নেই। চলুন আমরা অন্য কোথাও যাই।”

সোমনাথের মখটা যে কালো হয়ে উঠছে, তা দাদা ছাড়া কেউ লক্ষ্য করলো না।

কমলা বউদি ভিতরে খাবারের ব্যবস্থা করছেন। আর বাইরের ঘরে ওঁরা চারজন এসে বসলেন। ওঁদের সব কথাবার্তা সোমনাথ এখান থেকে শুনতে পাচ্ছে।

মিস্টার নন্দী অভিযোগ করলেন, “জিনিসপত্তরের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে আর চলছে না, মিস্টার ব্যানার্জি। আপনারা অ্যাকাউনটেন্টরা দেশের যে কী হাল করলেন।”

“আমরা কী করলাম? দেশের ভার তো অ্যাকাউনটেন্টদের হাতে দেওয়া হয়নি, তাহলে—ইন্ডিয়ার এই অবস্থা হতো না!” অভিজিৎ হাসতে-হাসতে উত্তর দিলো।

“পার্সোনেল অফিসারদের হাতেও দেশটা নেই। থাকলে, অন্তত স্কুলে কলেজে, পথে-ঘাটে, কল-কারখানায়, অফিসে-আদালতে ডিসিপ্লিনটা বজায় রাখা যেতো।” দুঃখ করলেন মিস্টার নন্দী।

“তাহলে দেশটা রয়েছে কার হাতে?” একটু অবাক হয়েই প্রশ্ন করলেন মিসেস নন্দী।

“মা জননীদের হাতে!” রসিকতা করলেন মিস্টার নন্দী। “সঙ্গে তালিম দিচ্ছেন কয়েকজন ব্রীফলেস উকিল এবং টেকসট-বুক পড়া প্রফেসর। ম্যানেজমেন্টের ‘ম’ জানেন

এরা।”

এবার তুলনামূলক সমালোচনা আরম্ভ করলেন মিসেস নন্দী। “পার্সোনেল অফিসারদের থেকে আপনারা অনেক ভালো আছেন, মিস্টার ব্যানার্জি।”

“এতো দুঃখ করছেন কেন, মিসেস নন্দী?” বুলবুল জিজ্ঞেস করলো।

“অনেক কারণে ভাই। বাড়িতে পর্যন্ত শান্তি নেই। লোকে যেমনি শুনলো পার্সোনেল অফিসার, অমনি চাকরির তদ্বির শুরু হয়ে গেলো।”

মিস্টার নন্দীও সায় দিলেন। “বন্ধুর বাড়ি, বিয়ে বাড়ি, এমনকি বাজার-হাটেও যাবার উপায় নেই। চেনা-অচেনা হাজার-হাজার চাকরির জন্যে খাই-খাই করছে। চাকরি কি মশাই আমি তৈরি করি?”

মিসেস নন্দী বললেন, “আগে ওঁর ঠাণ্ডা মাথা ছিল, লোকের সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলতেন—এখন চাকরির নাম শুনলে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন।”

“ধৈর্য থাকে না, মিস্টার ব্যানার্জি,” এম কে নন্দীকে বলতে শোনা গেলো।

“মেয়ের বিয়ে এবং ছেলের চাকরির জন্যে বাঙালীরা তো চিরকালই ধরাধরি করে এসেছে, মিস্টার নন্দী,” বুলবুল হঠাৎ বলে ফেললো। পরে বুলবুলের মনে হলো কথাটা মিস্টার নন্দীর মনঃপুত নাও হতে পারে।

“বাঙালী ছেলেদের চাকরি!” আঁতকে উঠলেন মিস্টার নন্দী। তারপর বললেন, “কিছু যদি মনে না করেন, তাহলে সত্যি কথাই বলি। বাংলার শিক্ষিত বেকাররা বিধাতার এক অপূর্ব সৃষ্টি। এরা স্কুল-কলেজে দলে দলে কিছু, মানে-বই মুখস্থ করেছে—কিন্তু এক লাইন ইংরিজি স্বাধীনভাবে লিখতে শেখেনি। বারো-চোদ্দ বছর ধরে প্রতিদিন স্কুলে এবং কলেজে গিয়ে এরা এবং এদের মাস্টারমশায়রা যে কী করেছেন ভগবান জানেন! পৃথিবীর কোনো খোঁজই এরা রাখে না। এরা জানে না মোটর গাড়ি কীভাবে চলে; কোন সময়ে ধান হয়, সিপিয়া রংয়ের সঙ্গে লাল রংয়ের কী তফাত। এরা কলমের থেকে ভারী কোনো জিনিস তিন-পরষের মধ্যে তোলেনি। এরা রাঁধতে জানে না, খাবার খেয়ে নিজেদের থালাবাসন ধতে পারে না, মায় নিজেদের জামা-কাপড়ও কাচতে পারে না। অন্য লোকে ঝাঁটা না ধরলে এদের ঘরদোর পরিষ্কার হবে না। দৈহিক পরিশ্রম কাকে বলে এরা জানে না। এরা কোনো হাতের কাজ শেখেনি, ম্যানার জানে না, কোনো অভিজ্ঞতা নেই এদের। এরা শুধু আনএমপ্লয়েড নয়, আমাদের প্রফেশনে বলে আন-এমপ্লয়েবল। এদের চাকরি দিয়ে কোনো লাভ নেই।”

এ-ঘরে বসে সোমনাথ ভাবছে, মেজদা কিছু মতামত দিচ্ছে না এই যথেষ্ট।

মিস্টার নন্দী বোধহয় একটা সিগারেট ধরালেন। কারণ দেশলাই জ্বালানোর শব্দ হলো। তাঁর গলা আবার শোনা গেলো। এই ধরনের লক্ষ লক্ষ অদ্ভুত জীব আমাদের এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জগুলোতে নাম লিখিয়ে চাকরির আশায় বাড়িতে কিংবা পাড়ার রকে বসে আছে। হাজার পঞ্চাশেক স্কুল-কলেজ আরও কয়েক লাখ একই ধরনের জীবকে প্রতিবছর চাকরীর বাজারে উগরে দিচ্ছে। অথচ এই সব অভাগাদের জন্যে দেশের কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। এরা সমাজের কোন কাজে লাগবে বলতে পারেন? স্কুল-কলেজে এমন ধরনের অপদার্থ বাবু আমরা কেন তৈরি করছি পৃথিবীর কেউ জানে না।”

“আমাদের সমাজই তো এদের এইভাবে তৈরি করছে, মিস্টার নন্দী,” অভিজিৎ গভীর দুঃখের সঙ্গে মৃদু প্রতিবাদ করলো।

মিস্টার নন্দী বোধহয় সিগারেটে টান দিলেন। তারপর বললেন, “ইনটারভিউতে বসে এইসব বেঙ্গলী ছেলেদের তো দেখছি আমি। চোখ ফেটে জল আসে। উগ্রপন্থীরা যে বলতো স্কুল-কলেজ বোমা মেরে বন্ধ করে দাও, তার মধ্যে কিছু লজিক ছিল মিসেস ব্যানার্জি। কারণ স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের এইসব ছেলেদের স্বয়ং ভগবানও এই সমাজে প্রোভাইড করতে পারবেন না।”

“দোষটা তো এই ছেলেদের নয়।” অভিজিতের গলা শোনা গেলো।

“সেইটাই তো আরো দঃখের। এরা জানে না, এদের কি সর্বনাশের পথে ঠেলে দেওয়া রয়েছে। যে-হারে নতুন চাকরি হচ্ছে তাতে ইতিমধ্যেই যারা এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের লিস্টে নাম লিখিয়েছে তাদের ব্যবস্থা করতে আশি-পঁচাশি বছর লেগে যাবে। অর্থাৎ, এখন যদি মাইশ-তেইশ বছর বয়স হয়, চাকরির চিঠি আসবে একশ’ দুই বছর বয়সে।”

মিস্টার নন্দী বললেন, “শতখানেক সরকারী চাকরির জন্যে লাখদশেক অ্যাপ্লিকেশন পড়তে পারে এমন খবর পৃথিবীর কেউ কোথাও কোনোদিন শুনেছে? সবচেয়ে দুঃখের এখা, গভরমেন্টও এদের কাছে বেমালুম মিথ্যা কথা বলছে। ওরে বাবা, মুরোদ থাক-না-থাক এত সত্যবাদী হও। ইয়ংমেনদের কাছে স্বীকার করো, এ-সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা কোনো সকারের নেই। তাহলে ছেলেগুলোর অন্তত চৈতন্যোদয় হয়, নিজের ব্যবস্থা নিজেরা করে ফেলতে পারে।”

“নিজের ব্যবস্থা আর কী করবে, মিস্টার নন্দী?” অভিজিৎ দঃখের সঙ্গে বললো।

“যাদের কেউ নেই, তাদের করতেই হয়,” মিস্টার নন্দী উত্তর দিলেন। “আপনি কলকাতার চীনেদের দেখুন। তিন-চারশ’ বছর ধরে তো ওরা কলকাতায় রয়েছে। ওদের ছেলেপুলেরাও তো লেখাপড়া শিখছে। কিন্তু কখনও এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে কোনো চীনেকে দেখেছেন? ওদের যে চাকরির দরকার নেই এমন নয়। কিন্তু ওরা জানে, এই সমাজে কেউ ওদের দেখবে না, কেউ ওদের সাহায্য করবে না, নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হবে। তাই নীরবে সেই অবস্থার জন্যে ছেলেদের ওরা তৈরি করেছে। এবং খুব দুঃখে কষ্টে নেই ওর।”

মিসেস নন্দী একটু বিরক্ত হলেন। “আমরা তো আর চীনে নই—সুতরাং বারবার চীনের কীর্তন গেয়ে কী লাভ?”।

হেসে ফেললেন মিস্টার নন্দী। “গিন্নির ধারণা আমি প্রো-চাইনীজ।”

“আমরাও প্রো-চাইনীজ—বিশেষ করে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে!” অভিজিৎ মন্তব্য করলো।

একবার হাসির হল্লোড় উঠলো। মিস্টার নন্দী বললেন, “সুইডেনের প্রফেসর জোরগেনসেন এসেছিলেন কিছুদিন আগে। জগদ্বিখ্যাত পণ্ডিত। এই চাকরি-বাকরির ব্যাপারে নানা দেশে অনেক, গবেষণা করেছেন। আমার সঙ্গে এক ডিনারে আধঘণ্টার জন্যে দেখা হয়ে গেলো। তিনি বললেন, অর্থনীতি এবং রাজনীতির অনেক প্রাথমিক আইনই তোমাদের এই বেঙ্গলে খাটে না। অন্য দেশে বেকার বললেই একটা ভয়াবহ ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। একটা রক্ষ মেজাজের সর্বনাশা চেহারার লোক—যার কোনো সামাজিক দায়দায়িত্ব নেই, যে প্রচণ্ড রেগে আছে। ইংলন্ডের কিছু-কিছু প্রি-ওয়ার উপন্যাসে এদের পরিচয় পাবে। লোকটা বোমার মতন কারণ সে অনাহারে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তার আশ্রয় নেই, জামা-কাপড় নেই। যে-কোনো মুহূর্তে সে ফেটে পড়তে পারে।”

একটু থামলেন মিস্টার নন্দী। তারপর আরম্ভ করলেন, “প্রফেসর জোরগেনসেন বললেন, তোমাদের এই বেঙ্গলে এসে কিন্তু তাজ্জব বনে গেলাম। রাস্তায় রাস্তায় পাড়ায় পাড়ায় এমন কি এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়েও বেকার সমস্যার বাহ্যিক ভয়াবহতা দেখলাম না। অথচ তোমাদের এখানে যত বেকার আছে তার এক-দশমাংশ কর্মহীন অন্য যে-কোনো সভ্য দেশকে লণ্ডভণ্ড করে দিতো। তোমাদের বেকাররা অস্বাভাবিক শাত। আর বেকারি ভাতা না থাকলেও তোমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি এদের সর্বনাশ করে দিচ্ছে। অনেকেরই যেন-তেন উপায়ে খাওয়া জরুটে যাচ্ছে। তোমাদের পারিবারিক জীবন এই বোমাগুলোকে ফিউজ করে দিচ্ছে—এরা ফেটে পড়তে পারছে না। নতুন জীবনের অ্যাডভেঞ্চারেও নামতে পারছে না এরা। তাই সমস্যা সমাধানে কোনো তাড়া নেইনাউ অর নেভার, একথা কারও মুখে শোনা যাচ্ছে না।”

মিস্টার নন্দী থামলেন না। বললেন, “জানেন মিস্টার ব্যানার্জি, প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করলে বলতাম—বেকারি অনেকটা ম্যালেরিয়া এবং কালাজ্বরের মতো। এখনই মৃত্যুভয় নেই, কিন্তু আস্তে আস্তে জীবনের প্রদীপ শুকিয়ে আসছে। পৃথিবীর সর্বত্র মানুষ যুগে যুগে যৌবনকে জয়টীকা পরিয়েছে। ক্যাপিটালিস্ট বলুন, সোসালিস্ট বলুন, কম্যুনিস্ট বলুন, সবদেশে যৌবনের জয়জয়কার। আর আমাদের এই পোড়া বাংলায় যুবকদের কি অপমান। লাখ লাখ নিরপরাধ শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের যৌবন কেমন বিষময় হয়ে উঠেছে দেখুন। ওরা যদি বলতো, সমাধান আজই চাই। আজ সমাধান না হলে, কাল সকালেই যা হয় করবো—তাহলে হয়তো দেশের ভাগ্য পাল্টে যেতো।”

মিস্টার নন্দীর কথাগুলো শুনতে শুনতেই সোমনাথের রক্তে আগুন ধরে যাচ্ছিল। একবার মনে হলো, তাকে শোনাবার জন্যেই যেন গোপন ষড়যন্ত্র করে নন্দীকে আজ এ-বাড়িতে আনা হয়েছে।

কিন্তু এ-সমস্ত কথা যে সোমনাথের কানে যাচ্ছে তা মেজদা এবং বুলবুল কল্পনাও করতে পারেনি। সোমনাথের ঘরে কে বুলবুল একবার বলতে এলো, “সোম, তুমিও এসো। সবাই একসঙ্গে খেয়ে নেওয়া যাবে।”

সোমনাথ রাজী হলো না। বললো, “আজকে খাওয়াটা বাদ দেবো ভাবছি। পেটের অবস্থা খারাপ।”

বুলবুল চলে গেলো। খবর পেয়ে কমলা বউদি এলেন। “কখন পেট খারাপ করলো? আগে বলেনি তো।”

সোমনাথ বললো, “এমন কিছু নয়, আপনি অতিথিদের দেখুন।

কমলা বউদি বললেন, “ফ্রিজে রই মাছ রয়েছে—একটু পাতলা ঝোলের ব্যবস্থা করে ফেলি?”

“পাগল হয়েছেন,” সোমনাথ আপত্তি করলো। “একদিন শাসন করলেই ঠিক হয়ে যাবে। পেটকে অনেকদিন আস্কারা দিয়ে এই অবস্থা হয়েছে।”

সকল অধ্যায়

১. ০১. আজ পয়লা আষাঢ়
২. ০২. যোধপর পার্কে জলের ট্যাঙ্কের কাছে
৩. ০৩. চা খেয়ে সোমনাথ চুপচাপ বসেছিল
৪. ০৪. বাবার বন্ধু সুধন্যবাবু
৫. ০৫. আজকাল বাবাকে দেখলে কমলার কষ্ট হয়
৬. ০৬. দুপরের ক্লান্ত ঘড়িটা
৭. ০৭. মেঘ কাটতে শুরু করেছে
৮. ০৮. সুকুমার সেদিন চলে গিয়েছিল
৯. ০৯. অফিসের এক বন্ধুকে
১০. ১০. সোমনাথ মনস্থির করে ফেলেছে
১১. ১১. বউদি চলে যাবার একটু পরে
১২. ১২. হাতে অ্যাটাচি কেস নিয়ে
১৩. ১৩. মল্লিকবাবু ছাপানো প্যাডগুলো দিয়ে গেলেন
১৪. ১৪. পাশের ঘরের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ
১৫. ১৫. তপতী বাহাত্তর নম্বর ঘরে হাজির হলো
১৬. ১৬. মিস্টার মাওজীর সঙ্গে সোমনাথের দেখা
১৭. ১৭. সোমনাথের ভাগ্যটা নিতান্তই পোড়া
১৮. ১৮. কমলা বউদি একবারও প্রশ্ন করলেন না
১৯. ১৯. গলার টাইটা কয়েক ইঞ্চি ঢিলে করে
২০. ২০. সোমনাথকে ডেকে পাঠালেন নটবর মিত্তির
২১. ২১. জন্মদিনটা আনন্দের কেন
২২. ২২. যোধপুর পার্ক বাস স্ট্যান্ডের কাছে
২৩. ২৩. সোমনাথ পাথরের মতো বসে রইলো
২৪. ২৪. বাহাত্তর নম্বর ঘরে এগারো নম্বর সীটে
২৫. ২৫. গোয়েঙ্কার প্রত্যাশিত ফোন এসেছে
২৬. ২৬. ইউরোপীয়ান অ্যাসাইলাম লেনের কাছে
২৭. ২৭. মিসেস গাঙ্গুলী
২৮. ২৮. উড স্ট্রীটে এলেন নটবর মিত্র
২৯. ২৯. মিসেস বিশ্বাসের ফ্ল্যাটের কাছে
৩০. ৩০. গোয়েঙ্কাজীর ঘরে
৩১. ৩১. দেড় ঘণ্টা
৩২. ৩২. মাতালের মতো টলছে সোমনাথ ব্যানার্জি
৩৩. ৩৩. জন-অরণ্যের নেপথ্য কাহিনী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন