বনবিড়াল – বিমল কর

বিমল কর

বনবিড়াল

এক

ভূগোল বইয়ে পাওয়া যাবে কিনা জানি না, টাইম টেবল ঘাঁটলে নিশ্চয় পাওয়া যাবে। জায়গাটা নাম বারকুহি। কাকাবাবুরা বলতেন বারকুই। ওটা মধ্যপ্রদেশে। দু-দিক দিয়েই যাওয়া যায়—জব্বলপুর ইটারসি হয়ে গাড়ি পালটা-পালটি করে; আবার নাগপুর ছিন্দওয়াড়া পারাসিয়া হয়ে। নাগপুর দিয়ে গেলে একটু কম নাকাল হতে হয়।

আমার মেজকাকা জগদীশচন্দ্র থাকতেন বারকুহিতে। চাকরি করতেন কোলিয়ারিতে। আমরা থাকতাম হাওড়া সাঁতরাগাছিতে। কাকা থাকেন একপ্রান্তে, আমরা অন্য প্রান্তে। দেড়-দু বছর অন্তর কাকা টানা দেড়-দু মাসের ছুটি নিয়ে এলে যা দেখা-সাক্ষাৎ হতো, হয়তো ভালো-মন্দর খবর দেওয়া-নেওয়া চলত চিঠিতে।

মেজকাকার একটু অভিমান ছিল, অনেকবার বলা-কওয়া সত্ত্বেও আমরা তাঁর কাছে যাই না। সেবার কাকার হুট করে এক অসুখ করল। খবর পেয়ে আমরা ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। বাবা ছটফট করতে লাগলেন। তিনিই যাবেন ভাবছিলেন বারকুহি, এমন সময় কাকিমার কাছ থেকে চিঠি এল, কাকা ভালো হয়ে উঠেছেন। আমরা নিশ্চিন্ত হলাম। বাবার মন খুঁতখুঁত করছিল। আমাকে তাই বললেন, “তুই একবার ঘুরে আয়। তোর তো এখন গরমের ছুটি।”

আমার ছুটি চলছিল। স্কুলের চাকরির ওইটুকুই আরাম।

কাকাকে চিঠি লেখা হল আমি বারকুহি যাচ্ছি। নাগপুর হয়ে।

জবাবে কাকা লিখলেন, আমি কবে কোন ট্রেনে যাচ্ছি জানতে পারলে তিনি ছিন্দওয়াড়ায় লোক পাঠাবেন আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে।

কাকার খানিকটা বাড়াবাড়ি। একা আমি যেতে পারতাম।

আমার যাবার দিনক্ষণ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হল কাকাকে। তারপর যথাদিন যাত্রা। তখন ধারণাই করতে পারিনি আমার কপালে কী লেখা আছে।

গ্রীষ্মকালে ট্রেনে করে যাওয়া মানে ভাজা-ভাজা হওয়া। তখন গরমটাও চলছিল একনাগাড়ে। প্রায় দেড় দিনের মাথায় ধুঁকতে ধুঁকতে ছিন্দওয়াড়া পৌঁছলাম। সেখানে কাকাবাবুর পাঠানো ভদ্রলোক আমায় ঠিক খুঁজে বার করে নিলেন।

ভদ্রলোকের নাম শ্যাম গুপ্ত। চেহারা দেখলে মনে হবে অ-বাঙালি। মাথায় লম্বা, গায়ের রঙ কালো, হাড়-হাড় গড়ন, দাঁতগুলো ঝকঝকে। উনি বাঙালি। চলনে বলনে খানিকটা হিন্দুস্থানি ভাব এসেছে বোঝা যায়। শ্যামবাবু বললেন তাঁরা দু-পুরুষ নাগপুরের বাসিন্দা। বাড়ি আছে। শ্যামবাবু অবশ্য বারকুহিতেই আছেন। তিনি সার্ভেয়ার। কোলিয়ারিতেই কাজ করেন।

আমরা যখন পারাসিয়ার গাড়িতে উঠলাম তখন সন্ধে। হাতে যথেষ্ট সময় ছিল বলে ওয়েটিং রুমে স্নান সেরে একটু ভদ্রস্থ হয়ে নিলাম। খাওয়া-দাওয়া সারা হয়েছিল। ভেবেছিলাম, গাড়িতে উঠে টানা ঘুম দেব।

ছোট লাইনের গাড়ি। সামনা-সামনি দুই বেঞ্চিতে আমরা গা এলিয়ে বসেছি। কামরায় ভিড় নেই। হই-হট্টগোলও হচ্ছে না। যে যার নিজের মতন বসে আছে কিংবা কথা বলছে। সঙ্গীর অভাব বোধ হয় থাকে না এ-সব গাড়িতে। কামরার বাতিগুলো টিমটিমে। জানলা দিয়ে চমৎকার বাতাস আসছিল।

শ্যামবাবু গল্পে মানুষ। অনর্গল কথা বলে চলেছেন। আমার হাই উঠছিল।

নানা রকম কথার পর শ্যামবাবু হঠাৎ বললেন, “জঙ্গলে বেড়াতে ভালো লাগে?” কিছু না ভেবেই বললাম, “হ্যাঁ, লাগবে না কেন!”

“তো ব্যাস। আমি জঙ্গলে বেড়াতে নিয়ে যাব। এম. পি.-র আধাই হল জাঙ্গল। পাঁচমারাই হিলস-এর নাম শুনেছেন? মহাদেও পাহাড়?”

“কাকার কাছে পাঁচমারির নাম শুনেছি।”

 “পাঁচমারাই ফেমাস। ব্রিটিশদের টাইমে লাটসাহেবরা পাঁচমারাইর হাওয়া লাগাত গায়ে।”

আমি হেসে বললাম, “আমি লাটসাহেব নই শ্যামবাবু।”

শ্যামবাবু হেসে ফেললেন। পরে বললেন, “আপনাকে আমি ঝুমুরিয়ার জঙ্গল দেখাতে নিয়ে যাব।”

“খুব বড় জঙ্গল?”

“না, না, ‘মাথা নাড়লেন শ্যামবাবু, “জাঙ্গল বড় নয়। মাগর জাঙ্গলে আপনি এক জানোয়ার দেখবেন। পিকিউলিয়ার অ্যানিমল।”

শ্যামবাবুর কথায় মাঝে-মাঝে দু-একটা হিন্দি শব্দ মিশে যায়, আগেই লক্ষ্য করেছি। জঙ্গলকে তিনি “জাঙ্গল’-এর মতন করে উচ্চারণ করেন। অভ্যেস। এতে মজা পাবার কিছু নেই।

কিন্তু পিকিউলিয়ার অ্যানিমল শুনে সামান্য কৌতূহল হল। বললাম, “কোন জানোয়ার?”

“নাম জানি না। বাঘ না, ভল্লু না। আজব জানোয়ার। দেহাতের লোকেরা বলে রাক্ষস।”

“রাক্ষস?”

“জি। দেখলে আপনার ভয় লেগে যাবে। বারো-চোদ্দো ফুট লম্বা। চার-সাড়ে-চার হাইট। হাণ্ডির মতন মুখ। ভেরি ফেরোশাস।”

“কিন্তু জানোয়ারটি কী?”

“আমি জানি না। কেউ জানে না। নাগপুরে টাইমস পেপারে লিখেছিল, মনস্টার। ঝুট লেখেনি।”

আমি অবাক হচ্ছিলাম। মনস্টার আবার কী! বড়সড় জন্তু হলেই মনস্টার হবে। বললাম, “আপনি দেখেছেন?”

“একবার দেখেছি। ভয় লেগেছিল। জানোয়ারটাকে না দেখলে আপনি বুঝতে পারবেন না।”

বললাম, “তা হলে একবার যেতেই হয়!” বলে হাসলাম।

দুই

কাকা কাকিমা টুনি আমার জন্যে হাঁ করে বসেছিল। বাড়িতে পৌঁছতেই হই-হই লেগে গেল। টুনি বলল, “তুমি তা হলে পৌঁছতে পারলে! বাবার কত চিন্তা! সত্যি ছোড়দা, চব্বিশ বছর বয়সেও কচি খোকা থেকে গেলে।”

কাকাকে দেখলাম একেবারে স্বাভাবিক প্রায়। সামান্য দুর্বলতা ছাড়া অন্য কোনও উপসর্গ নেই। আমার কাকিমার স্বভাবে একটা মজার জিনিস ছিল। আনন্দ-আহ্লাদ হলে প্রথম দফায় একচোটে কেঁদে নিতেন, তারপর কাকিমার খুশির গলা বেরুত। কাকিমার কান্না আমরা কানে তুললাম না। কান্নাকাটির পালা চুকে গেলে কাকিমা বললেন, “তোকে এখন কিছু করতে হবে না। দু-চার দিন জিরিয়ে নে। খা, দা, ঘুমো। বেড়িয়ে বেড়াবারও সময় পড়ে আছে।”

 কাকা বললেন, “ক’দিন রেস্ট নে, বেটা।”

হাওড়ার ছেলে আমি। সাঁতরাগাছি বাড়ি আমার। এঁদো পুকুর-বাদাড়, কাঁচা রাস্তা, নালা-নর্দমা দেখে-দেখে চোখ মোটামুটি সয়ে গিয়েছে। কাকাবাবুর কাছে এসে মনে হল, পাহাড়ি এলাকায় বেড়াতে এসেছি। সত্যি সেই রকম। চারদিকে তাকালে মনে হয়, পাহাড়ি ঢল নেমে চতুর্দিকে ছড়িয়ে গিয়েছে অজস্র গাছপালা, দূরে তাকালেই জঙ্গল আর জঙ্গল। এরই মধ্যে কাকাবাবুদের কয়লাখনি। ছোট-ছোট। মানুষজনও কম। ঘরবাড়ি সামান্যই। কয়লা বোঝাই হয় ট্রাকে। পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তা দিয়ে ট্রাকগুলো যখন চলে যায় দেখতে বেশ লাগে। বারকুহি স্টেশনটা যেন খেলনা স্টেশন।

কাকাবাবুর বাংলো বাড়ি ছোট ধরনের। মাথায় খাপরা। তলায় সিলিং, কাঠের। ইলেকট্রিক আছে। বাংলোর বারান্দায় বসে দিব্যি দু-চার ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়। গরমটা বোঝা যায় দুপুরের দিকে। রাত্রে বরং ঠাণ্ডা লাগে।

বারান্দায় গজল্লা—মানে আড্ডা চলছে, মেজকাকাও রয়েছেন, তখন আমি রাক্ষসের কথা তুললাম। বললাম, “শ্যামবাবু আমাকে রাক্ষস দেখাতে বনে-জঙ্গলে নিয়ে যাবেন।” কাকিমা সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, “খবরদার যাবি না, দেখাবার আর জিনিস পেল না শ্যাম।”

টুনি বলল, “ব্যস, হয়ে গেল ছেড়দা!” বলে হাসল।

আমি বললাম, “ব্যপারটা কী! আমি শ্যামবাবুর কথা থেকে কিছুই বুঝিনি। শুধু বুঝতে পারলাম, একটা বড় ধরনের জন্তু।”

টুনি বলল, “জন্তু শুধু নয়। এখানকার লোকজন বলে, অপদেবতা। তিনি নাকি যখন-তখন চেহারা পালটে নেন। ছিলেন বাঘ, হয়ে গেলেন খরগোশ।” রগড় করে হাসতে লাগল টুনি।

কাকিমা টুনিকে ধমক দিয়ে বললেন, “এতে হাসির কী আছে! ভূত প্রেত চেহারা পাল্টাতেই পারে।”

আমি মেজকাকার দিকে তাকালাম।

মেজকাকা সিগারেট পাকাচ্ছিলেন। বললেন, “শ্যাম খুব-একটা মিথ্যে বলেনি। জানোয়ারটা একরকম রাক্ষসই।”

“তুমি দেখেছ?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

মাথা নাড়লেন কাকা। “না, তেমনভাবে দেখিনি। একবার দেখতে গিয়েছিলাম। দুদিন বসেও দেখা পেলাম না। এমনই কপাল ফেরার পথেই দু-পলকের জন্যে দেখলাম।”

“কেন? দু’দিন বসেও দেখতে পেলে না কেন? কী হল।”

হাতের পাকানো সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে কাকা বললেন, “মানুষের মতন বনজঙ্গলের পশুপাখিরও একটা নিয়ম আছে, বাধ্য না হলে নিজের জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও বড়-একটা যায় না। তবে কখনও-কখনও শিকারের লোভে বা পথ ভুলে বেজায়গাতে ও চলে যায়। এই জানোয়ারটার সবই উল্টো। এই দিকে রয়েছে, কাল হয়তো গিয়ে দেখলে অন্য জায়গায় পালিয়েছে।”

টুনি বলল, “শ্যামদার পাল্লায় পড়ে তোমার যাওয়াই সার হবে ছোড়দা।”

আমি মেজকাকাকে জিজ্ঞেস করলাম, “জানোয়ারটা কী ধরনের?”

“কোন ধরনই নেই। চারপেয়ে একটা জন্তু, এইমাত্র। তবে বাঘ সিংহ নয়। ভাল্লুকও না। কেউ বলে হায়না ক্লাসের। ওটা যে কী জন্তু ভগবানই জানেন। তবে একটা বড়সড় হাতির মতন। নবাবি চালে অবশ্য চলে না। অতবড় চেহারা নিয়ে ও তাড়াতাড়ি চলা-ফেরা করতে পারে।”

“তা কেমন করে সম্ভব? বড় চেহারা, মানে ওজন বেশি।”

“তবু পারে। বুনো হাতির দৌড় দেখেছিস?”

কাকিমা বললেন, “রাক্ষস দেখে তোর কী হবে। শ্যাম এক পাগল, তুই সেই পাগলের কথায় নেচে উঠলি!”

আমার কৌতুহল হচ্ছিল। আমি কাকাকে বললাম, “তা এ-রকম এক জানোয়ার এদিকে রয়েছে—কেউ খোঁজ করে না জানোয়ারটা কী?”

“করবে না কেন! করেছে! কত রথী মহারথী এসেছে। জু থেকেও লোক এসেছে, ধরতে পারেনি। ভীষণ চালাক। বোধ হয় বুঝতে পারে মানুষজন তাকে খুঁজছে। সঙ্গে সঙ্গে পালায়।”

“কত বছর ধরে এই করছে?”

“লোকে সব জিনিসই বাড়িয়ে বলে। আমার মনে হচ্ছে, বছর চার-পাঁচ আগে একটা গুজব রটতে শুরু করে। তখন যারা দেখেছে তারা অবশ্য বলে, জানোয়ারটাকে এত বড় দেখেনি। আমাদের এক ম্যানেজার, সতীশ কাওলা বছর-দুই আগে জন্তুটাকে দেখেছে। তার ভার্সান হল, ফুট-পাঁচেক লম্বা, মুখটা বড়। হাইট বড় জোর তিন–সাড়ে তিন ফুট। গায়ের রঙ ভালো বুঝতে পারেনি। ধোঁয়াটে মনে হয়েছিল। কাওলা যথেষ্ট সাহসী। কিন্তু সে জন্তুটাকে দেখে গাড়ি থামাবার সাহস করেনি। পালিয়ে এসেছিল। ও তো বলে, জানোয়ারটার চোখ দেখলে বুক কেঁপে ওঠে।”

আমি মনে-মনে শ্যামবাবুর কথার সঙ্গে কাকার কথা মিলিয়ে নিচ্ছিলাম। শ্যামবাবু খানিকটা বাড়িয়ে বলেছেন। “এই ক’বছরে কি জানোয়ারটার হাতে কেউ মারা গেছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“দু-একজন গিয়েছে। একজন সেপটিক হয়ে। তার হাতে কামড়ে ধরেছিল। আর-একজনের মুখে থাবা মেরেছিল। নাকমুখ দিয়ে রক্ত পড়তে-পড়তে মারা গেল।” টুনি ঠাট্টা করে বলল, “ছোড়দা, তোমার বাবা রাক্ষস দেখে দরকার নেই। শুনছ তো কাণ্ড।”

মেজকাকা বললেন, “একটা মজা কি জানিস। বনজঙ্গলের কাছাকাছি গ্রামে যদি বা হানা দেয়— তেমন কোনও ক্ষতি করে না গেরস্থর। ছাগল, মুরগি মেরে মুখে করে যে নিয়ে পালাবে তাও পালায় না। মাংস-খাওয়া জানোয়ার নয়। গোলমাল শুনলে পালায়, আগুন দেখলে কাছে ঘেঁষে না। এসব দিক দিয়ে ভদ্র। তবে ওই বললাম, সামনে গিয়ে পড়লেই বিপদ।”

কাকিমা বললেন, “সামনেও যেতে হবে না, বিপদও বাধাতে হবে না।”

কাজকর্ম ছিল কাকিমার, সামান্য পরে উঠে গেলেন। কাকাও বেশিক্ষণ বসে থাকলেন না। আমি আর টুনি বসে থাকলাম।

একসময় টুনি বলল, “চুপ করে গেলে যে! ভাবছ কী?”

“শ্যামবাবুর কথা। ভদ্রলোক সেই যে কাল আমায় পৌঁছে দিয়ে চলে গেলেন আর কোনও পাত্তা নেই।”

টুনি হাসল। বলল, “শ্যামদা ওই রকমই। এই তোমায় পৌঁছে দিয়ে গেল, আবার দ্যাখোগে গিয়ে অন্য কোনও কাজ জুটিয়ে হয়তো দাতলা গিয়ে বসে আছে।”

“মজার লোক।”

“পাগল! শ্যামদাকে কোনও ব্যাপারে নাচালে আর তোমার রক্ষে নেই। তুমি কি সত্যি বলেছ রাক্ষস দেখতে যাবে?”

“সত্যি-মিথ্যে আবার কী রে! উনি বললেন, জঙ্গলে বেড়াতে নিয়ে যাবেন, আমিও বললাম যাব। উনি রাক্ষস দেখানোর কথা তুললেন, আমি বললাম – দেখব।”

“তাহলে তো হয়েই গিয়েছে।”

“কী?”

“শ্যামদা তোমাকে ঠিক জঙ্গলে টেনে নিয়ে যাবে।”

“যান যদি যাব।”

“যাও, তবে এ তোমার সাঁতরাগাছি নয় ছোড়দা, আর ওই যে জানোয়ারটার কথা শুনলে ওটি কিন্তু সাংঘাতিক। চালাকি মারতে যেও না।”

এমন সময় খানিকটা তফাতে মোটর বাইকের শব্দ শোনা গেল। আলোও পড়ছিল রাস্তায়।

টুনি বলল, “ওই শ্যামদা আসছে।”

“মোটর বাইকে?”

“মোটর বাইক শ্যামদার নয়। সঙ্গে নিশ্চয় সরকারদা আছে। শ্যামদার বন্ধু । পাওয়ার হাউসের ইঞ্জিনিয়র। একসঙ্গে চারটে ডিমের ওমলেট খায়। সরকারদাও এক ছোট রাক্ষস।”

মোটর বাইক বাংলো-বাড়ির গেটের সামনে এসে থামল।

তিন

শ্যমবাবুকে আলাপ করিয়ে দিতে হল না, নিজেই আলাপ করে নিলেন সরকার। ডান হাত খেলোয়াড়দের মতন বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “আমার নাম পি. সরকার। পি. ফর প্রফুল্ল। ডাকনাম পল্টু। পাওয়ার হাউসে মিস্ত্রিগিরি করি। শ্যামদার মুখে শুনলাম আপনি সাঁতরাগাছির। আমি স্যার শিবপুরের। আমরা তা হলে হলাম ভাই-ভাই। আসুন, হাত মেলান।”

হাত মেলাতে গিয়ে বুঝলাম, একবারে লোহা। সরকারের চেহারা ছিপছিপে, মুখে বাহারি গোঁফ, লম্বা জুলফি। মাথার চুল কোঁকড়ানো।পরিচয় শেষ হলে সরকার বসলেন। বসে টুনির সঙ্গে খুনসুটি শুরু করলেন। “তুই আছিস কেন, যা যা, কিছু ফুড নিয়ে আয়। ভদ্রলোক বাড়িতে এল, তুই বসে-বসে আড্ডা মারছিস।”

টুনিও কম গেল না, জবাব দিল মজা করে। হাসাহাসি চলল একটু, তারপর টুনি উঠে গেল।

সরকার বললেন, “এখানে কোনও সোশ্যাল লাইফ নেই। চুপচাপ পড়ে থাকা। ভালো লাগে না, মশাই। শ্যামদা না থাকলে মরে যেতাম। আর এই কাকাবাবু। কিন্তু আমার পাওয়ার হাউস যেখানে, সেখান থেকে রোজ এখানে আসা যায় না।” বলেই একটু থেমে কী ভেবে আবার বললেন, “কাকাবাবু আমাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত সামলে উঠলেন, আমরাও নিশ্চিন্ত হলাম।”

গল্পগুজব হচ্ছিল। শ্যামবাবু আমায় বললেন, “পল্টুর সঙ্গে আমার কথা হয়ে গিয়েছে, রাজুবাবু। পল্টু একটা ব্যবস্থা করেছে।”

সরকার বললেন, “জঙ্গলে বেড়ানো তো! হ্যাঁ, শ্যামদা আমায় বলছে।”

আমি বললাম, “শ্যামবাবু আমায় জঙ্গলের এক অদ্ভুত জীব দেখাবেন বলেছেন!” “শুনেছি! তবে জীবটা দেখতে হলে দেরি করা চলবে না।”

“কেন?”

“জীবটা এখন ঝরুয়ার জঙ্গলে আছে। কখন আবার অন্য জঙ্গলে চলে যাবে বলা যায় না।”

“আপনারা কেমন করে বোঝেন ওই জানোয়ারটা কোথায় আছে?”

“কেমন করে আর বুঝব। গুজব শুনি। দেহাতের লোকদের মুখে খবর পাই।” “আপনি দেখেছেন জানোয়ারটাকে?”

“হ্যাঁ! দুবার! আমার কপাল ভালো।’

“কেমন দেখতে? শ্যামবাবু বলছিলেন, মনস্টার!”

সরকার বললেন, “জানোয়ারের জাত জানি না। চতুষ্পদ জীব। আর যদি গা-গতরের কথা বলেন মশাই, আমি বলব, আর একটা কিং কং। দেখেছেন কিং কং সিনেমায়?”

“দেখেছি।”

“তা হলে বুঝে নাও!” বলেই সরকার জিভ কাটলেন। “স্যরি, তুমি বলে ফেললাম!” আমি হেসে বললাম, “বলেছেন তো কী হয়েছে। আপনারা দুজনেই আমার চেয়ে বয়সে বড়। আপনির চেয়ে তুমি বললেই শুনতে ভালো লাগে।’

সরকার খুশি হলেন। “ঠিক বলেছ। অত ভদ্রতা ভালো লাগে না।….তা যা বলছিলাম, কিং কং। হ্যাঁ, চেহারার গড়নের দিক থেকে নয় ভাই, বিকটত্বের দিক দিয়ে—ওই টাইপ। দেখলে বুক কাঁপে।”

শ্যামবাবু বললেন, “এরকম জানোয়ার দেখা যায় না!

আমি বললাম, “কিন্তু হুট করে দেখতে যাওয়া কি নিরাপদ?”

সরকার তাঁর ঝাঁকড়া চুল আঙুলে ঘাঁটতে লাগলেন। বললেন, “একটা ব্যাপার আছে। জন্তুটা দেখতে যতই ভয়ংকর হোক ও কিন্তু মানুষজনকে অ্যাটাক করে না। দু-একবার গোলমাল করেছে ঠিকই তবে সেটা দোষ বলা যায় না।”

শ্যামবাবু বললেন, “দেহাতের গাঁ-গ্রামের লোক ওকে হামেশাই দেখে। ওর যদি বাঘ-সিংহের স্বভাব হতো, গাঁয়ের লোক কি সেফ থাকতে পারত?”

আমার কৌতুহল বাড়ছিল। বললাম, “আমরা কবে যাব?”

“পরশু-তরশু–” সরকার বললেন।

“একটা জীপ পাওয়া যাবে,” শ্যামবাবু বললেন, “পল্টু ব্যবস্থা করেছে।”

সরকার বললেন, “আমাদের এক বন্ধু আছে। ভরমা। ফরেস্ট অফিসার। ওকে খবর দিয়েছি। ভরমাকে প্রায়ই জঙ্গল ইনসপেকশানে যেতে হয়। ও শিঘ্রি ওদিকে যাবে। বলেছি, আমাদের ঝরুয়ার জঙ্গলে পৌঁছে দিতে। ওখানে ফরেস্ট বাংলো আছে। বীট বাংলো।”

আমি বললাম, “ঠিক আছে। কিন্তু কাকিমা তো ভয়ে মরছেন।”

“কাকিমার কথা ছাড়ো। আমরা ম্যানেজ করে দেব।”

এমন সময় টুনি এল। খাবার নিয়ে এসেছে।

সরকার হাত বাড়িয়ে ওমলেট প্লেট নিতে-নিতে বললেন, “টুনি যাবি নাকি রে?” “কোথায়?”

“রাক্ষস দেখতে?”

“না। আমার অত শখ নেই। ছোড়দা বুঝি যাচ্ছে?”

“যাচ্ছে বইকি!”

“যাক, তারপর ঠেলা বুঝবে।”

“ভয় দেখাবি না, টুনি,” সরকার বললেন, “আমি বন্দুক চালাতে পারি। অবশ্য আমার বন্দুক নেই। থাকলেও পারতাম না, ওই জঙ্গলে বন্দুক চালাবার নিয়ম নেই।” সরকার হাসতে লাগলেন।

চার

একে নতুন জায়গা, তায় জঙ্গল। আমার পক্ষে কিছুই হদিস করা সম্ভব নয়। এইটুকু মাত্র বুঝতে পারছিলাম, বন-জঙ্গলের সঙ্গে আমাদের যেন লুকোচুরি খেলা চলছে। ঝোপজঙ্গল গাছপালার ঠাসাঠাসি ছাড়িয়ে খানিকটা ফাঁকায় এসে যখনই হাঁফ ছাড়ছি, ভাবছি এবার বুঝি শেষ হল জঙ্গলের সীমানা। দেখতে দেখতে আবার একটা জঙ্গল সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। অনেকক্ষণ এই খেলা চলতে লাগল। ব্যাপারটায় অবশ্য অবাক হবার কিছু ছিল না। পাহাড়ি অঞ্চল, জঙ্গল চারপাশেই। কোথাও হালকা, কোথাও বা বড় বড় গাছপালার চেয়ে ছোট-ছোট ঝোপই বেশি।

গাছপালা আমি চিনি না। শ্যামবাবু মাঝে-মাঝে চিনিয়ে দিচ্ছিলেন। সেগুন, শাল, মহুয়া। মেজকাকার মুখে শুনেছি সেগুন-শালের দেশ হল এম.পি। সেগুনের ছড়াছড়ি এখানে। এছাড়া হরেক রকম গাছ রয়েছে, নিম-কাঁঠাল গাছও বাদ যায়নি।

আমাদের জীপ ছেড়েছিল দুপুরের পর। শেষ-বিকেলে আমাদের পৌঁছে যাবার কথা। রাস্তা তো মাত্র মাইল চল্লিশ। তবু এ-সব জায়গায় মাইল গুনে সময়ের হিসেব করা হয় না। পাহাড়ি রাস্তা, তার মানে কোথাও গাড়ি যাবার মতন পথ থাকলেও অনেক জায়গায় নেই। খুশি মতন পথ করে নিতে হয় সেখানে।

আমার একটুও খারাপ লাগছিল না। গরমকাল, বেরোবার সময় রোদও ছিল মাথার ওপর, ঘাম হচ্ছিল। জঙ্গলে ঢুকে পড়ার পর ছাঁয়া বাড়তে লাগল, গাছপালার ঠাণ্ডা গায়ে লাগছিল। কোনও কষ্ট হচ্ছিল না।

জঙ্গল এলাকা হলেও লোকজন প্রথম দিকে ভালোই চোখে পড়ছিল। ছোট-ছোট কয়লাখাদ, কাজকর্মও চলছে, কুলি ধাওড়া, ট্রাক, মোষের গাড়ি। ধীরে ধীরে এ-সব মিলিয়ে গেল। তারপর দেখা দিল একেবারে খুদে গ্রাম। দু-পাঁচ ঘর, কুঁড়ে ঘর। মাথার ওপর খোলার চাল। অল্পসল্প ক্ষেতি। শুনলাম, ওগুলো কাঠুরেদের গ্রাম। এদিকে বিড়ির পাতা তোলারও চল রয়েছে।

যাবার রাস্তায় এ-পাশ ও-পাশ যদিও নদী পড়ল না, তবুও কোথাও-কোথাও নালার খাল দেখলাম। বর্ষায় নাকি ভরা থাকে পাহাড় থেকে নেমে আসা জলে।

আমাদের জীপ চালাচ্ছিলেন ভরমাসাহেব। গাড়ি তাঁরই। ভরমাসাহেব ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোক। সরকারবাবু আর শ্যামবাবুর বন্ধুর মতন। অবশ্য ভরমাসাহেব মানুষটি একটু বয়স্ক। বছর পঁয়তাল্লিশ। গড়াপেটা চেহারা। আর জঙ্গলে রোদে জলে ঘুরে ঘুরে রঙ হয়েছে লালচে। ভদ্রলোকের মাথার বারো আনাই নেড়া, মানুষটি সদালাপী। ভালো।

ভরমাসাহেবের পরনের পোশাকও মজাদার! খাকি রঙের হাফপ্যান্ট পরেছেন তিনি। গায়ে স্পোর্টস গেঞ্জি। চোখে গগলস।ভরমাসহেবের মুখ থেকেই জানতে পারলাম, আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের একটা বাংলো আছে। ওই বাংলোতে জনা-দুয়েক লোক গিয়ে বসে আছে ক’দিন ধরে। তারাও বোধ হয় জানোয়ার দেখতে গিয়েছে। এরকম মাঝে মাঝে হয়।পথের আধাআধির বেশি এসে ভরমাসাহেব জীপ থেকে নেমে গেলেন। সামনেই এক অফিস, ঠিক যেন ছোট পোস্ট অফিস। তার গা-লাগোয়া এক ছোট বাংলোবাড়ি। শুনলাম, ওটা ফরেস্ট অফিসেরই কিসের দপ্তর; ভরমাসাহেবের কাজ আছে ওখানে। তিনি কাজ সেরে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবেন পরশু বিকেল পর্যন্ত।

ভরমাসাহেব জীপ থেকে লাফ মেরে নেমে পড়তেই চাপরাসি ছুটে এল। নিজের ব্যাগটা নিতে বললেন চাপরাসিকে। তারপর সরকার আর শ্যামদাকে বললেন, “সামালকে যানা, সরকার। ডোন্ট টেক রিস্কস। পরশো লোট আনা। ইউ উইল গেট মিস হিয়ার। ওকে।”

হাত নেড়ে বিদায় দিলেন ভরমাসোহেব ।

সরকারবাবু জীপের স্টিয়ারিঙ ধরলেন।

শ্যামবাবু বললেন, “এখান থেকে কাছে। অ্যাবাউট টেন মাইলস।”

“গরমকালে রাস্তা ভালো থাকে।” সরকার বললেন, “বর্ষাকালেই ভয়। ঘণ্টা-খানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাব।”

জলতেষ্টা পাচ্ছিল। ফ্লাক্স তুলে মুখে দিলাম।

আমাদের সঙ্গে কিছু জিনিসপত্র ছিল। ছোট বিছানা, চাল, ডাল, ডিম, নুন, চা-চিনি-দুধ। সামান্য সবজি। আর পেট্রল। বড় ক্যানে বেশ খানিকটা পেট্রল।

গল্প করতে-করতে আরও খানিকটা রাস্তা এগিয়ে গেলাম।

সরকার হঠাৎ বললেন, “যে দুজন লোক গিয়ে বসে আছে তারা কারা, শ্যামদা?” শ্যামবাবুর জানার কথা নয়! “হবে কেউ!”

“সরকারি লোক নয় তো?”

“কেন?”

সরকার আর কিছু বললেন না।

তখনও বিকেল রয়েছে। রোদ মরে আসছিল। ছোট একটা গ্রাম যেন চোখে পড়ল তফাতে। পাহাড়তলির গ্রামের মতন। সুন্দর দেখাচ্ছিল।

হঠাৎ শ্যামবাবু আমায় নাড়া দিয়ে বললেন, “ওই যে—ওই—নজর আসছে?” শ্যামবাবু হাতের নির্দেশ মতন চোখ ঘোরাতে লাগলেন। পাতলা জঙ্গল ছাড়া আমার কিছু নজরে পড়ছিল না। তারপর পড়ল।

দূর থেকে মনে হল, চমৎকার জায়গা। চারদিকে জঙ্গল, তারই মধ্যে অনেকখানি জায়গা মাঠের মতন। ওরই একপাশে বাংলো বাড়িটা।

মাথার ওপর দিয়ে পাখির দল তখনই বোধ হয় ফিরতে শুরু করেছে।

পাঁচ

বাংলো-বাড়িটা আহামরি গোছের নয়, তবে ব্যবস্থা সবই রয়েছে। দুটো ঘর। সামনে পেছনে বারান্দা। পেছনে বারান্দার গা-লাগিয়ে ছোট-ছোট দুই পায়রা খোপ, রান্নাঘর আর স্নানের ব্যবস্থা। খানিকটা তফাতে চৌকিদারের আস্তানা। কুয়ো রয়েছে বাঁধানো। কিছু গাছপালা নিজের খেয়ালে বেড়ে উঠেছে চারদিকে। বাংলো-বাড়ির চৌহদ্দি কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। বাড়িটার গাঁথনি ইটের হলেও মাথার ছাদ খাপরার।

চৌকিদারকে বোধ হয় খবর দেওয়া ছিল, একটা ঘর খুলে দিল আমাদের। জিনিসপত্র সবাই মিলে নামিয়ে নিলাম আমরা।

হাতমুখ ধুয়ে বারান্দায় বসে আমরা বিশ্রাম নিচ্ছি, চৌকিদার চা তৈরি করছে রান্নাঘরে—সূর্য ডুবু-ডুবু হয়ে আলো বেশ ময়লা হয়ে এসেছে—এমন সময় দূরে কাকে দেখা গেলে।

চৌকিদার আমাদের আগেই বলেছিল, আর একজন এখানে আছে। আগে শুনেছিলাম দু’জন অতিথির থাকার কথা। এখন দেখছি, একজন আছে।

সরকারের চোখে পড়েছিল, বললেন, “ওই আসছে, শ্যামদা।”

“দেখছি,” শ্যামবাবু বললেন।

আমরা তাকিয়ে থাকলাম। সামনের মাঠ ভেঙে ধীর-ধীরে যে মানুষটি এগিয়ে আসছিলেন, মনে হল তিনি বয়স্ক। জীপগাড়িটা, তাঁর নজরে পড়েছিল প্রথমে। বোধ হয় থমকে দাঁড়িয়ে গাড়িটা তিনি দেখলেন, তারপর এগিয়ে আসতে লাগলেন।

অপেক্ষা করছিলাম আমরা।

ভদ্রলোক বাংলোর ভেতর এলেন। পরিষ্কারভাবে তাঁকে দেখলাম। প্রবীণ মানুষ। মাথার চুল অর্থেক সাদা, গোলমুখ, পরনে আলখাল্লার মতন প্যান্ট, গায়ে বুশ শার্ট, হাতে ছড়ি, গলায় বায়নাকুলার ঝুলছে। চোখে ওঁর চশমা ছিল।

উনি আমাদের লক্ষ্য করতে-করতে বারান্দার সামনে এলেন, তারপর বললেন, “হ্যালো!”

ওঁর চোখে বিস্ময়। গলার স্বরে সৌজন্য।

সরকার উঠে দাঁড়ালেন।

সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, “ফরেস্ট অফিসার?”

মাথা নাড়লেন সরকার। না, তিনি ফরেস্ট অফিসার নন। আমাদের সাধারণ পরিচয় দিলেন সরকার।

ভদ্রলোক বললেন, “আই অ্যাম পি. পি. ৷”

জীবনে এমন অদ্ভুত নাম শুনিনি। পি. পি. আবার কী? আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম।

পি. পি. বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা, হাসি-হাসি মুখ করে বললেন।

“প্রভাকর প্যাটেল।”

আমরা হেসে ফেললাম।

চা এনেছিল চৌকিদার। সরকার চায়ের কাপ নিয়ে পি. পি-র দিকে এগিয়ে দিলেন। “বসুন স্যার।”

বসার ব্যবস্থা সামান্যই ছিল। দুটো নড়বড়ে চেয়ার আর একটা টুলে আমরা তিনজন বসেছিলাম। সরকার নিজের চেয়ার ছেড়ে দিলেন।

পি. পি বললেন, “আমার ঘরে চেয়ার আছে। চৌকিদার ঘর খুলে চেয়ার বার করে আনুক।”

চৌকিদার কাছে ছিল না। চা নিয়ে আবার ফিরবে।

সাধারণ কথা হচ্ছিল। সরকার বললেন, আপনার সঙ্গে আর একজন ছিল, তিনি কোথায়? চলে গিয়েছেন?”

পি. পি. বললেন, “মনজুল। হ্যাঁ, ওকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছি। মনজুল ফোটোগ্রাফার। আমি ওকে সঙ্গে এনেছিলাম। ওর কাজ হয়েছে।”

“আপনি কি কোনও কাজে এসেছিলেন এখানে?” সরকার জিজ্ঞেস করলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে পি. পি. বললেন, “অবশ্যই। তবে কাজটাকে শখের কাজ বলতে পারেন। আমি কোনও সরকারি কাজে আসিনি।”

চৌকিদার দ্বিতীয় দফার চা নিয়ে এল। পি. পি. পকেট থেকে চাবি বার করে দিলেন তাকে। চেয়ার বার করতে বললেন ঘর থেকে।

“আপনি ওই জানোয়ারটাকে দেখতে এসেছেন?” শ্যামবাবু জিজ্ঞেস করলেন। পি. পি. শ্যামবাবুর দিকে তাকালেন। দু-মুহূর্ত পরে বললেন, “রাইট। আপনারা?” “আমরাও।”

চৌকিদার ঘর খুলে দুটো চেয়ার বার করে আনল। সবগুলো চেয়ারেরই সমান অবস্থা।

সরকার বসলেন। বললেন, “আমরা দুজন জানোয়ারটাকে এক আধবার দেখেছি, কিন্তু ও–” বলে আমার দিকে আঙুল দেখালেন, “এখানে নতুন। বেড়াতে এসেছে। ওকে নিয়ে এসেছি দেখাতে।”

পি. পি. কোনও জবাব দিলেন না।

“জানোয়ারটা আছে, না পালিয়েছে?” শ্যামবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

“আছে।”

“আপনি নিজে দেখেছেন, স্যার?”

“দুবার দেখেছি। কাল দেখতে পাইনি! আজও তার দেখা পাব কিনা জানি না। দিনের বেলায় তাকে দেখা যায় না। তবু কোথাও যদি লুকিয়ে থাকে, তাই খানিকটা তল্লাশ করছিলাম।”

সূর্য ডুবে গিয়েছে। আলোও চলে গেল। অন্ধকার হয়ে আসছিল। বাতাস দিচ্ছে চমৎকার।

চা শেষ করে পি. পি. বুশ শার্টের পকেট থেকে পাইপ আর তামাক বার করলেন। মানুষটিকে ধীরস্থির মনে হচ্ছিল। কথাও বলেন নরম গলায়।

সরকার বললেন, “আপনি তখন একবার বলছিলেন শখের কাজ! কাজটা কী মিস্টার পি. পি.?”

পি.পি. বললেন, “শখ ছাড়া আর কী! আমার একটা কৌতূহল মেটাতে এসেছিলাম। আগেও এসেছি। ঠিক এই জায়গায় নয়, কাছাকাছি।”

পি.পি.-র কথাবর্তা ধাঁধার মতন লাগছিল। হঠাৎ আমার নজরে পড়ল, অন্ধকার জমে কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে আসার পর-পরই আলো ফুটছে আবার। চাঁদের আলো। খেয়াল হল, গত ক’দিনই জ্যোৎস্না দেখেছি। কোন তিথি জানি না, তবে পূর্ণিমার খুব কাছাকাছি হবে। যত সন্ধে হবে, রাত বাড়বে, জ্যোৎস্না আরও ছড়িয়ে পড়বে।

শ্যামবাবু বললেন, “আপনি তো জানোয়ারটাকে দেখতে এসেছেন বলছিলেন!” মাথা নাড়লেন পি. পি.। পাইপে দাঁত চেপে বললেন, “সব কথা বলতে হলে অনেক বলতে হয়। সংক্ষেপে বলি।” ধোঁয়া গলায় নিয়ে কয়েক মুহূর্ত বসে থাকলেন পি.পি.। পাইপ সরিয়ে নিলেন মুখ থেকে। বললেন, “নাগপুর টাইমস-এ মাত্র ক’দিন আগে একটা খবর বেরিয়েছে। পড়েছেন আপনারা? আমি নাগপুরের লোক নই। আমার ভাই নাগপুরে থাকে। ডাক্তার। ভাইয়ের কাছে এসেছিলাম পারিবারিক কাজে। খবরটা আমার চোখে পড়ে। আপনাদের হয়তো মনে থাকার কথা নয়, এই খবর গত ক’বছর ধরে বারকয়েকই বেরিয়েছে। লোকাল নিউজ-পেপারেই বেশি। দু-এক বার বোম্বাইয়ের পেপারে আমি দেখেছি।” বলে পি.পি. একটু থেমে আবার একটু পাইপ টেনে নিলেন। পরে বললেন, “দু-বছর আগে একজন জুলজিস্ট এই বিচিত্র জানোয়ারটি সম্পর্কে একটা লেখা লেখেন। পপুলার ইংরেজি উইকলিতে। আমার সেটা নজরে পড়ে। তখন থেকেই বলতে পারেন, আমি এই ব্যাপারে নাক গলাচ্ছি।”

শ্যামবাবু বললেন, “নাগপুর টাইমস কাগজের খবর আমরাও দেখেছি।”

“চোখে পড়ার মতনই ঘটনা।…আমি এবার নাগপুরে ছিলাম বলে কাগজের অফিসে গিয়েছিলাম। অনেক পুরানো ফাইল দেখেছি। আমার সঙ্গে যে-ছেলেটি এসেছিল সে কাগজের ফোটোগ্রাফার। কাজ সেরে সে চলে গিয়েছে। আমি যাইনি। আরও দু-এক দিন থাকার ইচ্ছে।”

“আপনি এদিকে আগেও এসেছেন বলছিলেন। কেন?” সরকার জানতে চাইলেন।

“এই একই উদ্দেশ্য নিয়ে।”

“জানোয়ারটা দেখতে?”

“হ্যাঁ।”

“এখানেই এসেছিলেন?”

“ঠিক এই স্পটে নয়, কাছাকাছি।”

সরকার বললেন, “আমরা শুনেছি জানোয়ারটা সব সময় এক জায়গায় থাকে না।”

“সে-রকমই মনে হয়। তবে এই জঙ্গল ছোট নয়। আপনারা লক্ষ্য করলে বুঝবেন, ঝরুয়ার জঙ্গলের আশেপাশে চার-পাঁচ মাইল এলাকার মধ্যেই জানোয়ারটাকে বারবার দেখা গিয়েছে। ধরে নিতে পারেন এই এলাকাটাই তার ঘোরাফেরার জায়গা। মানুষের মতন জীবজন্তুর একটা আস্তানা থাকে। বলতে পারেন ওদের নিজেদের মহল্লা ।”

শ্যামবাবু বললেন, “জানোয়ারটা তো আপনি দেখেছেন! আপনার কী মনে হয়?”

“অদ্ভুত জীব। ওর কোনও জাত নেই, মানে ও যে কোন ক্লাসের বলা যায় না। মোস্ট পিকিউলিয়ার, অ্যাবনরমাল। মনস্টার।”

মাথা নাড়লেন পি.পি.। বললেন, “কাগজে ওকে মনস্টার বলে রেফার করে। রাক্ষস! দানব। তাই না?”

“হ্যাঁ, স্যার”, সরকার বললেন, “আপনি কী বলেন?”

পাইপ নামিয়ে মাথার চুল ঘাঁটতে ঘাঁটতে পি.পি. বললেন, “আমি কী বলব! মনস্টার বলতে আপত্তি কোথায়? জানোয়ারটার চেহারা থেকে মনস্টারই মনে হয়।”

সরকার আবার বললেন, “তবু আপনার মতামতটা শুনতে ইচ্ছে করছে। আপনি ওটাকে স্টাডি করছেন বলছিলেন।”

পি.পি. সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, “আমার যা মনে হয়, আমি তা লিখে রাখছি। আপনারা শুনতে চান, কাল আপনাদের শোনাব। আজ থাক। বাঃ। চমৎকার জ্যোৎস্না ফুটে উঠেছে। বিউটিফুল। আমি এই বাংলোর বারান্দায় বসে যখন তাকিয়ে থাকি মিস্টার সরকার, তখন ভাবি, ভগবান যে বিরাট জগৎ সৃষ্টি করলেন, তার এক কণাও জানতে পারলাম না। কে বা জেনেছে।”

“স্যার?… আপনি কি ফিলোজফার?”

“না না, একেবারেই নয়।”

“তবে আপনি কি ? ”

“আমি?… আমার পেশা ছিল বিচিত্র। আমি আর্মির লোক। এনজিনিয়ারিং সার্ভিসের লোক। তবে আমার কাজ ছিল খানিকটা গোপনীয়। কোথাও কোনও মিলিটারি ক্যাম্প বা ধরুন কোনও কিছু বসাবার দরকার হল। আগে আমরা জায়গাটাকে দেখতে আসতাম।

সুবিধা-অসুবিধে, সেফটি বিচার করতাম। কী ভাবে কী করা যেতে পারে তার রিপোর্ট দিতাম। এর বেশি কিছু করার দায়িত্ব আমাদের ছিল না। ভালো কথা, পাঁচমারিতে একটা মিলিটারি বেস…” পি. পি. কথা শেষ করার আগেই শ্যাম গুপ্ত কী বললেন। হাতের আঙুল দিয়ে দেখালেন দূরে।

আমি কিছু দেখতে পেলাম না।

“কী?” সরকার জিজ্ঞেস করল।

“ওই যে—দূরে।”

আমরা সবাই দাঁড়ালাম। আমার নজরে পড়ছিল না।

পি. পি. বললেন, “যদি এসে থাকে আসুক। আপনারা গোলমাল চেঁচামেচি করবেন না। আগুন জ্বালাবেন না।”

আমরা বাংলো বাড়ির ফটকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

শ্যামবাবু যা দেখেছিলেন আমার চোখে তা স্পষ্ট হল না। অনেক দূরে, যেখানে গাছপালা ঝোপঝাড় জ্যোৎস্নায় কালো ছায়ার মতন জমে আছে, সেখানে একটা কিছু ঘোরাফেরা করছিল বোঝা যায়। কিন্তু তার কোনও আকৃতি বোঝা যায় না। এমনকী পি.পি.-র বায়নাকুলার এই সময় কোনো কাজে এল না।

আমরা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম, যদি জানোয়ারটা কাছাকাছি আসে। এল না। সামান্য এগিয়েও গেলাম সকলে, দুরের সেই ছায়া দূরেই থাকল, তারপর কোথায় মিলিয়ে গেল।

পি.পি. বললেন, “না, আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই।”

“আসবে না?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“এখন নয়। জন্তু-জানোয়ারদের সিক্সথ সেন্স থাকে। ওরা বোকা নয়।” “তা হলে আর দেখতে পাব না?”

“পেতেও পারি, নাও পারি। ওর মর্জি।”

আফশোষ হবারই কথা। আমার খারাপ লাগছিল। জন্তুটাকে দেখতে পাব না? সরকার বললেন, “কাছাকাছি যখন আছে তখন নিশ্চয় একবার দেখা দেবে।” শ্যামবাবু বললেন, “আমারও তাই মনে হয়। আজ হোক, কাল হোক ও আসবে।” পি.পি. ফিরতে লাগলেন।আমরাও ফিরছিলাম।

পি.পি আমায় বললেন, “আপনি নিরাশ হবেন না।” বলে সান্ত্বনা দেবার মতন করে হাসলেন।

কিছু বললাম না।

সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। পি.পি. এবার ঘরে ঢুকবেন। আমরাও একটু গা হাত পা ছড়িয়ে নেব। তারপর গল্প-টল্প হবে। রাত হলে খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়ব।

শ্যামবাবু চৌকিদারকে ডাকাডাকি করতে লাগলেন, রান্নার জিনিসপত্র দিতে হবে।

সরকার আমায় বললেন, “কী খবর রাজুবাবু, কেমন লাগছে জঙ্গল?”

“ভালো।”

“এখন ভালো। যত রাত বাড়বে ততই বুকের মধ্যে কেমন ! ”

আমি কোনও কথা বললাম না।

পি.পি. নিজের ঘরে চলে গিয়েছেন। বাতি জ্বেলেছেন ঘরে। মোমবাতি।

শ্যামবাবু চৌকিদারকে নিয়ে ব্যস্ত। সরকারবাবু ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।

আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। চাঁদের আলো আরও পরিষ্কার হয়ে উঠেছে! সামনের ফাঁকা জায়গাটুকু ধবধব করছিল। দূরে জোনাকি উড়ছে। ঝিঁঝি ডাকছিল। হাওয়া দিচ্ছিল দমকে দমকে। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম দূরের অরণ্য এবং এই জ্যোৎস্না।

ছয়

গায়ে নাড়া লাগতেই ঘুম ভেঙে গেল।

চাপা গলায় সরকার বললেন, “এসেছে। শব্দ কোরো না। উঠে পড়।” ঘরের জানলা মাত্র দুটি। গরমের জন্যে খোলা ছিল। বাতাস আসছিল। মশারির মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলাম।শ্যামবাবু আগেই উঠেছেন।

“কই?” আমি ফিসফিস করে বললাম।

“জানলার কাছে এসে দাঁড়াও। একেবারে শব্দ করো না!” উত্তেজনায় বুকের মধ্যে ধকধক করে উঠল। জানলার কাছে এসে দাঁড়ালাম। সরকার আমায় সরিয়ে জানলার পাশে দাঁড় করিয়ে দিলেন।

তাকিয়ে থাকলাম। কোথাও কিছু নেই। জানলা দিয়ে বাংলোর ফেন্সিং। কয়েকটা ঝোপ চোখে পড়ছিল। বাইরে আমাদের জীপ রাখা রয়েছে।

কিছু চোখে না পড়ায় অধৈর্য হয়ে উঠেছিলাম। “কই?”

“আছে।”

আর ঠিক তখনই চোখে পড়ল, সেই অদ্ভুত জীবটি কোন অদৃশ্য জায়গা থেকে যেন হঠাৎ কখন বেরিয়ে এসেছে। এমন বিশাল প্রাণী আমি জীবনে দেখিনি। চিড়িয়াখানাতে হাতি দেখেছি। তুলনা করা যায়—আবার যায় না। বিশালত্বে হাতির মতন, তবে অতটা উঁচু নয়। লম্বায় পনেরো ফুটের বেশি হতে পারে। বোঝা মুশকিল। সারা গায়ে লোম। রঙ বোঝা যাচ্ছে না। বিরাট মুখ। আচমকা দেখলে বাঘ মনে হতে পারে।

শ্যামবাবু আমার পেছনে। ফিসফিস করে বললেন, “চোখ দেখেছ?”

চোখ যে সব সময় দেখতে পাচ্ছিলাম তা নয়। যতটুকু দেখছিলাম, মনে হচ্ছিল, এমন জ্বলন্ত, হিংস্র চোখ দানবেরই হতে পারে।

জানোয়ারটা তার বিশাল চেহারা নিয়ে জীপগাড়ির কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করছিল। একবার পুরো গাড়িটা পাক খেল। তাকাল বাংলো-বাড়ির দিকে। ঘাড় ঘোরাল। আবার অন্য দিকে সরে গেল। খুব অবাক লাগছিল আমার, পশুমাত্রই শব্দ করে, যে যার মতন। এর গলায় কোনও শব্দ নেই। যেন বোবা জানোয়ার। বোধ হয় খুব চালাক। সতর্ক।

“জীপগাড়িটার সামনে ঘোরাঘুরি করছে কেন?” শ্যামবাবু বললেন।

“বুঝতে পারছি না। বোধ হয় কোন জন্তু-জানোয়ার ভাবছে।” সরকার জবাব দিলেন। “পি. পি. কি জেগেছেন?”

“জানি না। …রাজুবাবু, ভয় করছে নাকি?”

ভয় করছিল। এমন এক দানব দেখলে ভয় না করার কারণ নেই। ভরসা এই যে, আমরা ঘরের মধ্যে আছি। তবে জানোয়ারটা যা যাতে এই ঘরদোরও তার কাছে তেমন বাঁধা না-ও হতে পারে।

চোখের সামনেই ছিল, হঠাৎ দেখি জানোয়ারটা আর নেই। অদৃশ্য। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে না। কোথায় গেল?

সরকার সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন না, পরে পাল্টা প্রশ্ন করলেন “আপনাদের কী মনে হয়?”

আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। আবার আসবে।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও কিছু দেখা গেল না। মনে হল, জন্তুটা চলে গিয়েছে।

আমি বললাম, “দরজা খুলে দেখলে হয় না?”

সরকার বললেন, “সেফটি ফার্স্ট। আর খানিকটা দেখা যাক।”

জানলার কাছে ঠায় দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে পা ধরে গেল। একই ভাবে তাকিয়ে আছি।

আর কিছু আমার চোখে পড়ছে না।

সরকার এবার নিঃশব্দে দরজার ছিটকিনি আর হুড়কো খুললেন।

পাল্লা খোলার সময়েও কোনও শব্দ করলেন না। মুখ বাড়ালেন।

আমরা তিনজনেই ঘরের বাইরে এলাম। পি. পি.-র ঘরের দরজা বন্ধ। তিনি কিছু বুঝতে পারেননি। ঘুমিয়ে আছেন।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমরা। চারদিকে নিঃসাড়। মাঠ জঙ্গল গাছপালা সব যেন ঘুমে অচৈতন্য। বাতাসের শব্দ ছাড়া কিছু শোনা যায় না। জ্যোৎস্নায় মাখামাখি হয়ে আছে চতুর্দিক।

না, ওই অদ্ভুত জন্তুটা আর নেই। নিঃশব্দে এসেছিল, চলেও গিয়েছে। হয়তো দেখে গেল, মানুষজন কেমন জমছে বাংলো-বাড়িতে।আমরা ধীরে-ধীরে বারান্দার নীচে নামলাম। তাকালাম চার পাশ। তারপর খুব সাবধানে ফেন্সিং পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম।

চাঁদের আলোয় সবই চোখে পড়ছিল। কোথাও কিছু নেই। চলেই গিয়েছে জানোয়ারটা।

সরকার সাহস করে জীপ পর্যন্ত এগিয়ে গেলেন। শ্যামবাবু কয়েক পা ডান দিকে সরে গিয়ে কিছু লক্ষ্য করার চেষ্টা করছিলেন। আমি ফটকের ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে।

আচমকা আমার মনে হল, পেছনে যেন কেমন শব্দ হল। চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি, সেই ভয়ঙ্কর জানোয়ার। একেবারে সিঁড়ির কাছটায়। সর্বাঙ্গ হিম হয়ে গেল। নড়াচড়া করার সাধ্য হল না। সেই মুহূর্তে এমনই যেন যে, আমি কী দেখছি, দুঃস্বপ্ন না সত্যিই এক দানব, বুঝে উঠতে পারলাম না। তফাত থেকে সামান্য আগে যে বিচিত্র জীবটিকে দেখেছিলাম—এ যেন তার চেয়েও ভয়ঙ্কর। চেহারায় শুধু বিশাল নয়, তার মধ্যে যে হিংস্রতা রয়েছে তাও ভীষণ। পালাবার ক্ষমতা আমার ছিল না। হাত-পা অসাড়। কাঁপছিলাম। বুক যেন আর শ্বাস নিতেও পারছে না।

মানুষ ভয়ের মুহূর্তে কী করে সে নিজেই জানে না। আমি চিৎকার করে উঠলাম। আর্তনাদ। তারপর যে কী হল বোঝা গেল না, সরকারবাবু শ্যামবাবু ছুটে এলেন কি এলেন না, কিছু বললেন কি বললেন না—আমার খেয়াল নেই, শুধু শব্দ শুনলাম। গুলির শব্দ।এরপর যা ঘটল তা সত্যিই দুঃস্বপ্ন। আমরা কে কাকে টেনে ঠেলে সরিয়ে বারান্দা দিয়ে ঘরে এসেছি জানি না। বোধ হয় পি. পি. আমাদের যেমন-যেমন করতে বলেছিলেন, আমরা করছিলাম।

বাইরে একটা তাণ্ডব চলল কিছুক্ষণ। জীপগাড়িটার মাথার ক্যম্বিস ছিঁড়ে-খুঁড়ে, বসার গদিগুলো ফালা ফালা করে, গাড়িটাকে একপাশে হেলিয়ে সেই চোট খাওয়া জন্তু চলে গেল জঙ্গলে। তার গলায় শব্দ কিন্তু না বাঘের, না সিংহের, বরং বেড়ালের মতন।

পরের দিন বেলায় চা খাবার সময় পি. পি. বললেন, “আমার যা লেখার আমি লিখেছি। এগুলো ছাপাব। লোকে বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। আপনারা তার খসড়া পড়তে পারেন। কিন্তু তার আগে সংক্ষেপে ব্যাপারটা বলে নিই।”

আমরা তিনজনই ঝোড়ো কাকের মতন বসে ছিলাম। পি. পি. কাল আমাদের বাঁচিয়েছেন।

পি. পি. পাইপ ধরিয়ে বললেন, “আমি আপনাদের আগেই বলেছি, মিলিটারি সার্ভিসের লোক আমি। আমাদের কাজ ছিল সার্ভে করার। প্রায় বছর-ছয় আগে আমরা এখানে ক্যাম্প করেছিলাম সার্ভে করার মতলব নিয়ে। তখন একদিন একটা বুনো বিড়াল—জাঙ্গল ক্যাট—আমাদের ক্যাম্পের সামনে এসে হাজির। একেবারে বাচ্চা। বেড়ালটার মজা ছিল, তাকে ডেজার্ট ক্যাট আর জংলি ক্যাটের মাঝামাঝি বলা যায়। তা এখানে মরুভূমি কই? জাঙ্গল ক্যাট বলেই আমি তাকে পুষেছিলাম। মানে ক্যাম্পে সে থাকত, আমরা যা খেতে দিতাম খেত। একদিন বিল্লিটাকে কিসে যেন কামড়াল। কী কামড়েছিল বলতে পারব না। গলার কাছে কামড় দেয়। আমাদের মনে হয়েছিল বিষাক্ত কোনও কিছু কামড়েছে। সঙ্গে যে ওষুধপত্র ছিল—যা হাতে পেয়েছি ওকে দিয়েছি। আর যখন ক্যাম্প গুটিয়ে চলে আসি তখন বাড়তি কিছু ওষুধ, ভেরি কমন মেডিসিন, দু-একটা অবশ্য কমন নয়—ফেলে দিই। ফাঁকা মাঠে। এই বিল্লি সেগুলো হজম করে দেয়। আমরা তখন হেসে মরেছিলাম। এই ঘটনার মাস চার-পাঁচ পরে আবার একবার সুপিরিয়ার অফিসারদের সঙ্গে আমায় একই জায়গায় ক্যাম্প করে থাকতে হয়েছিল। তখন আমি অবাক হয়ে দেখি, সেই জাঙ্গল বিল্লিটা একটা অ্যাবনরমাল শেপ নিচ্ছে। কেন হচ্ছে—বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম তখন বাচ্ছা ছিল, এখন বড় হয়েছে বলে অন্য রকম দেখাচ্ছে। যাই হোক পরে আমার সন্দেহ হয়, এমন কিছু ঘটে গেছে ওই বিল্লিটার, যাতে ওর শরীরের মধ্যে কোনও মস্ত পরিবর্তন হচ্ছে। এটা কেন হবে? কামড় খাবার পর আমরা ওকে যে ওষুধপত্র দিয়েছিলাম আর পরে যেসব ফেলে দেওয়া ওষুধ খেয়েছে তার জন্যে নাকি? এর কোনও সদুত্তর আমি পাইনি। তবে আমি যতবার এসেছি—ওকে ওয়াচ করার চেষ্টা করছি। এবার আরও ভালো করে দেখতে এসেছিলাম। দুঃখের কথা, ওকে গুলি করতে হল। ও মরবে না কি বেঁচে থাকবে বলতে পারি না। তবে একটা ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ, ওই জানোয়ারটা সাধারণ জাঙ্গল ক্যাট। কিন্তু প্রকৃতির খেয়ালে–কোনও ভেতরের রহস্যে জংলি বেড়ালটা মনস্টার হয়ে উঠল। এর কারণ ওই একটাই হতে পারে—বেড়ালটার ভেতরে-ভেতরে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। গ্ল্যাণ্ডের ব্যাপার বলেই আমার ধারণা। দেখা যাক, অন্যে কী বলে। মানুষের বেলাতেও তো এই বেয়াড়া ব্যাপার ঘটে।” পি. পি. তাঁর কথা শেষ করে নতুন করে চা ঢালতে লাগলেন কাপে।

অধ্যায় ১ / ১০

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন