পাখিঘর – বিমল কর

বিমল কর

পাখিঘর

এক

দোকানে পা দিতেই প্রিয়গোপাল বলল, “একটা লোককে দেখলি? এইমাত্র বেরিয়ে গেল?”

প্রিয়গোপালের কথার ধরনই ওই রকম। কোন কথা কেন বলছে বোঝাই যায় না ৷ “কোন লোক? শয়ে শয়ে লোক যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে।”

“আরে এই মাত্তর, জাস্ট নাউ যে লোকটা, মানে ভদ্রলোক, বেরিয়ে গেলেন ! দেখিসনি? লম্বা, কালো, কোঁকড়ানো চুল মাথায়, হাতে ব্যাণ্ডেজ! বাঁ না ডান? ডান ! না, বাঁ হাতেই।”

প্রিয়গোপালের মুখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে আমি বললাম, “না, আমি কাউকে দেখিনি। হয়েছে কী?”

“তুই একটু খেয়াল করে দেখলি না? চোখ বন্ধ করে রাস্তা চলিস?” প্রিয়গোপাল এমনভাবে বলল কথাগুলো, যেন আমি লম্বা কালো ভদ্রলোকটিকে না দেখায় দারুণ কিছু হারিয়েছি। প্রিয়গোপালেরও বোধহয় অনুশোচনা হচ্ছে।

কলকাতার রাস্তাঘাটে কেউ চোখ বুজে চলে না। দু’চার জন ম্যাজিশিয়ান আছে যারা চোখে পট্টি বেঁধে মোটরবাইক চালিয়ে কেরামতি দেখিয়েছে। আমি সে-দলের নই। চোখ খুলেই আমি পথ চলি, নিতান্তই প্রাণের দায়ে। তা বলে রাস্তাঘাটের প্রত্যেকটি পথ-চলতি মানুষকে নজর করব, সে-অভ্যেস আমার নয়।

প্রিয়গোপালের কথার কোনও মানেই হয় না। এখন একেবারে ভরা সন্ধে। হ্যারিসন রোড গমগম করছে। বিশেষ করে এই জায়গাটা। কলেজ স্ট্রিটের জংশনের কাছে যত ভিড়, তত হট্টগোল। ট্রাম, বাস, রিকশা, ট্যাক্সি, ঠেলা, মফস্বলের দোকানিদের গাঁঠরি হাতে নিয়ে দৌড়ঝাঁপ—এত সবের মধ্যে কে কাকে নজর করে। কোনও রকমে ফুটপাথ ধরে এগুতে পারলেই যথেষ্ট।

প্রিয়গোপালের লম্বা লোকটি সম্পর্কে আমি কোনও আগ্রহ না দেখিয়ে বললাম, “চা খাওয়া। ডালহাউসি থেকে হাঁটছি।”

“দাঁড়া, গদাই আসুক। ও কলেজ স্ট্রিট মার্কেটে গিয়েছে—বাবার জন্যে ফল আনতে।”

প্রিয়গোপালদের এই দোকানটাকে ঠিক দোকান মনে হয় না, মনে হয় বইয়ের গুদোম। চার-পাঁচটা বড়-বড় সেকেলে বইয়ের আলমারি, ছোট বুক-র‍্যাকও গোটা দুই, তাছাড়া হাফবেঞ্চি, টুল—যেখানেই দ্যাখো বই আর বই। নতুন বই নয়, পুরনো, ময়লা, সোঁদা-গন্ধ-ধরা বই। আসলে প্রিয়গোপালদের ব্যবসাটাই হল পুরনো বইয়ের। এখানে নাটক, নভেল, গল্প—এ-সব সাধারণ কেতাব পাওয়া যায় না। বাংলা বইও নয়। দু’একটা হয়তো পাওয়া যেতে পারে খুঁজলে, তবে সেটা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। এই দোকান-ঘরে যেখানে যত বই—তাদের বয়েস কম করে একশো, বেশি হলে দেড়শো-দু’শো হবে। সেকেলে সাহেবসুবোর বই; বিদেশী ছাপা। ইতিহাস, রাজকাহিনি, হিমালয়-ভ্রমণ, জন্তু-জানোয়ার, জঙ্গল, আইন, পুরনো গেজেট—এই ধরনের যত বই।

ব্যবসাটা একসময় শুরু করেছিলেন প্রিয়গোপালের ঠাকুরদা। উনিশশো এক সালে। সাইনবোর্ড দেখলেই সেটা বোঝা যায়। তাঁর আমলে নাকি জমকালো ভাবেই চলত ব্যবসা। রাজারাজড়ার আমল তখন। লাইব্রেরি সাজাবার জন্যে অর্ডার আসত বইয়ের। ঠাকুরদার পর দোকান দেখতেন প্রিয়গোপালের বাবা। তিনিও মোটামুটি পঁচিশ-তিরিশ বছর টাকাপয়সার মুখ দেখেছেন। তার পরই ব্যবসা পড়ে গেল। এখন মাসে দু’চার হাজার টাকাও বিক্রি হয় কি হয় না। তবে এই পড়তি ব্যবসাতেও মাঝেসাঝে হুশ করে পাঁচ-সাত হাজার টাকার অর্ডার চলে আসে। বাইরে থেকে। আসলে এ-সব বই সাধারণ খরিদ্দারে কেনে না। বিলেতে কিসের এক ক্যাটালগ তৈরি হয়, সেই ক্যাটালগ দেখে বই কেনাবেচা চলে। বড় বড় লাইব্রেরিই এ-সব বইয়ের খদ্দের।

প্রিয়গোপাল নিজে মোটেই বইয়ের ব্যবসায় আসতে চায়নি। তার কোনও আগ্রহ ছিল না। কিন্তু প্রিয়গোপালের বাবা, দ্বিজেন কাকাবাবু, হার্টের অসুখ বাধিয়ে এমন এক অবস্থা করলেন যে, বেচারির দোকানে না এসে উপায় থাকল না।

আজ মাস ছয়েক হল সে দোকানে বসছে। বসছে এই মাত্র, সে কিছু জানে না, বোঝে না। বরং তার চেয়ে বেশি বোঝে তারকদা। বাবার আমলের কর্মচারী।

প্রিয়গোপাল তার চেয়ার থেকে উঠে একবার দোকানের দোরগাড়ায় গিয়ে দাঁড়াল। মুখ বাড়িয়ে বাইরেটা দেখল অল্পক্ষণ, তারপর ফিরে এসে বলল, “দ্যাখ, কোনও মুখ একবার দেখলে সেটা আমি সহজে ভুলি না। তুই জানিস এ-ব্যাপারে আমি মাস্টার। ঠিক কি না, বল?”

কথাটা স্বীকার করতে আমার বাধল না। এক-একজন মানুষের এক-এক ব্যাপারে আশ্চর্য ক্ষমতা থাকে। কারও গন্ধের নাক প্রখর, কারও চোখ অত্যন্ত তীক্ষ্ণ, কেউ পাতার পর পাতা মুখস্থ করতে পারে, কেউ বা এক-আধবার কোনও গান শুনলে অবিকল সুরটা তার গলায় ধরতে পারে। আমাদের প্রিয়গোপালের ক্ষমতা রয়েছে মুখ মনে রাখার। সে একবার কাউকে দেখলে সহজে ভোলে না। কবে স্কুলে কলেজে আমাদের সঙ্গে পড়ত, এতদিনে তার মুখের চেহারাই পালটে গিয়েছে, আমরা তো চিনতেই পারব না, প্রিয়গোপাল কিন্তু ঠিক চিনে ফেলবে। “আরে তুই হরিশ না?”

হরিশ বলে যাকে চিনল প্রিয়গোপাল, সে ঠিক হরিশ নয়, মানে তার নাম হরিশ নয়, তবে সে স্কুলে আমাদের সহপাঠী ছিল। নাম তার ত্রিদিব। প্রিয়গোপালেরও গোলমাল ছিল এইখানে। মুখ তার মনে থাকবে, কিন্তু নামটা মনে রাখতে পারবে না ।

এক-এক সময় প্রিয়গোপাল আমাদের যত অবাক করেছে, ততটাই আবার লজ্জায় ফেলেছে। মেট্রো সিনেমা থেকে বেরিয়ে আসছি, বেঁটে মতন একটি ছেলেকে সে ধরে ফেলল, “কী ব্যাপার? সিনেমায়? তার পর কী খবর সত্যেনবাবু?” সত্যেনবাবু কিন্তু খুশি হল না। “আমার নাম সত্যেন নয়, আপনি অন্য কাউকে খুঁজছেন।” প্রিয়গোপাল হার মানল না। “সে কী মশাই, দিঘায় সেই হোটেলে খাবার সময় আপনার গলায় মাছের কাঁটা আটকে সাঙ্ঘাতিক অবস্থা হল! আমার স্পষ্ট মনে আছে।” ছেলেটি গলায় কাঁটা আটকাবার কথা স্বীকার করল। বলল, তার নাম গজেন।

আসলে নামের গোলমাল করলেও মুখের গোলমাল প্রিয়গোপাল বড় একটা করত না। তার ঠিক মনে থাকত। সে নিজেই বলত, নামটা ভাই আমার ঠিক মনে থাকে না, ভুল হয়ে যায়।

আমরা বলতাম, “নামটা তাহলে বলিস কেন? না বললেই পারিস।”

“মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়,” প্রিয়গোপাল হেসে ফেলত।

গদাই ফিরে এল। হাতে ফলের ঠোঙা। রোগাপাতলা মানুষ গদাই, চোখে এক তাপ্পিমারা চশমা। নিজের হাতেই বোধহয় মেরামতি করে-করে চশমাটার অমন দশা করেছে। গলায় কণ্ঠি। পানের ছোপে দাঁতগুলোর খয়েরি রঙ ধরেছে।

গদাই ফলের ঠোঙা আর খুচরো টাকাপয়সা প্রিয়গোপালের দিকে এগিয়ে দিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগে প্রিয়গোপাল বলল, “ও-সব রেখে দাও। আগে চা খাওয়াও আমাদের।” ফলের ঠোঙা আড়ালে রেখে দিয়ে গদাই চায়ের পাত্র বার করল। চলে গেল চা আনতে।

“আয়,” প্রিয়গোপাল ডাকল।

দোকানের একপাশে বেঁটে মতন পার্টিশান খানিকটা। পার্টিশানের ওপাশে টেবিল-চেয়ার, টাইপ মেশিন, টেলিফোন, পুরনো ওয়াল ক্লক সাজিয়ে বসে থাকে প্রিয়গোপাল। বসে-বসে থ্রিলার আর ডিটেকটিভ পড়ে। কীই বা তার কাজ!

পার্টিশানের ওপার থেকে পুরো দোকানটার ওপরই চোখ রাখা যায়, কাজেই তারকদা বা গদাই দোকানে না থাকলেও কোনও অসুবিধে হয় না।

প্রিয়গোপাল তার চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, “লোকটাকে, মানে ভদ্রলোককে তুই দেখলে বুঝতে পারতিস। দি সেম ফেস দি সেম ম্যান।”

আমি বসলাম। “কোন ফেস? কোন ম্যান?”

“গত পরশু, না পরশু নয়, তরশু, সোমবার। তুই, আমি আর যোগেন দোকানে বসে গেঁজাচ্ছি, এক ভদ্রলোক এলেন, মনে আছে? লম্বা, কালো, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, চোখে হাফচশমা? মনে পড়ে?”

মনে করবার চেষ্টা করতেই ভদ্রলোকের চেহারাটা চোখের সামনে মোটামুটি ভেসে উঠল। “হ্যাঁ। মনে পড়েছে।”

“সেই ভদ্রলোক একটা বইয়ের খোঁজে এসেছিলেন। বই আমাদের দোকানে ছিল না। মানে ক্যাটালগে ছিল না। আমরা ক্যাটালগে বই না পেয়ে ভদ্রলোককে বললাম, “ও-বই নেই। তোর মনে পড়ছে?’

“তোরা কথা বলছিলি, আমরা অত খেয়াল করে শুনিনি। তুইই ওদিকে তারকদার বড় টেবিলের কাছে গিয়ে কথা বলছিলি।”

“বলছিলাম। কিন্তু ভদ্রলোক চলে যাবার পর ফিরে এসে তোদের কী বললাম মনে নেই? বললাম, ভদ্রলোক আমাদের পুরনো ক্যাটালগ পকেট থেকে বার করে দেখালেন, বইটার নাম রয়েছে। তারকদা বলল, হয় বইটা বিক্রি হয়ে গেছে, না হয় আমাদের নতুন ক্যাটালগ ছাপার সময় ভুল করে বাদ পড়ে গিয়েছে। খুঁজে দেখে বলতে হবে।”

“বইটার নাম কী রে? কিসের বই?”

‘এনসেন্ট ম্যান’। আদিম ব্যাপার সব। আমি জানি না। আঠারো শো আটানব্বই সালের বই। পুরনো ক্যাটালগে তাই লেখা আছে। প্রিয়গোপাল তার টেবিলের ওপর পড়ে থাকা নস্যির ডিবে তুলে নিল। নস্যির নেশা তার। নস্যি টেনে টেনে নাকের গর্ত বোধহয় আধখানা বুজিয়ে ফেলেছে।

“এ-দেশে ছাপা?”

“না বিদেশে ছাপা, লেখকও বিদেশী। এ-দেশে ছাপা হলেই কি পাওয়া যেত? এইটটিন নাইনটি এইট-এর বই, একশো বছর হতে চলল প্রায়,” প্রিয়গোপাল বলল. “বইয়ের ঠিকুজি থাক। আসল কথাটা শোন। ভদ্রলোককে আমরা বললাম, পরে খোঁজ করতে, আমরা খুঁজে দেখব। এটা তোর সোমবারের ঘটনা। আর আজ বৃহস্পতিবার। আজ যে ভদ্রলোক এসেছিলেন, তিনিও ওই একই বইয়ের খোঁজ করতে এসেছিলেন। দি সেম বুক।”

একই বই দুজনে খোঁজ করতে পারে, এর মধ্যে অবাক হবার কী আছে? আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। বললাম, “তাতে কী?”

“তাতে এই যে, সোমবারের ভদ্রলোক আর আজকের ভদ্রলোক একই রকম দেখতে। অবিকল এক। কিন্তু আমি যখন বললাম, উনি দু’দিন আগেও বইটার খোঁজে এসেছিলেন, বইটা আমাদের কাছে নেই বলছিলাম, তখন, ভাই, আমার কথা শুনে ভদ্রলোক বললেন, না, তিনি আসেননি। আমি যতবার বলি—তিনি এসেছিলেন, তিনি ততবার মাথা নাড়েন। শেষে বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে কী বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন।”

আমি অবাক হয়ে প্রিয়গোপালের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। “তুই ঠিক বলছিস?” “এক্কবারে ঠিক। তারকদা থাকলে তারকদাও বলত। আমি একলা দোকানে ছিলাম। এই তো খানিক আগে ভদ্রলোক এসেছিলেন। তুই দোকানে ঢুকছিস আর ভদ্রলোক বেরিয়ে যাচ্ছেন। নিজে যদি চোখে দেখতিস, তোরও মনে হত।”

“যমজ? আমাদের কমলের মতন ?”

“জানি না। কোনও তফাত আমার চোখে পড়ল না। একমাত্র পোশাকটা আলাদা। সোমবারের ভদ্রলোক ধুতি-পাঞ্জাবি পরে এসেছিলেন, আর আজকের ভদ্রলোকের ছিল প্যান্ট-শার্ট।”

“আজকের ভদ্রলোকের হাতে ব্যাণ্ডেজ ছিল।”

“হ্যাঁ। তা সেটা তো হতেই পারে। এর মধ্যে চোট পেয়েছেন হয়তো।”

গদাই চা নিয়ে এসেছিল। এক কোণে গিয়ে ধোয়ামোছা কাপে চা ঢালতে লাগল। প্রিয়গোপাল বলল, “আমার আর-একটা সন্দেহ হচ্ছে।”

“কী?”

“বাবার অসুখের সময়, বাবা যখন হাসপাতালে, আমরা দু’বেলা ছোটাছুটি করছি, তখন এই ভদ্রলোককে আমি দেখেছি। একই ওয়ার্ডে কি না বলতে পারব না। তবে দেখেছি। একদিন ভদ্রলোক মেডিক্যাল কলেজের গেটের সামনে ট্যাক্সিচাপা পড়তে যাচ্ছিলেন। কপালজোরে বেঁচে গেলেন।”

গদাই চা এনে আমাদের দিল।

চায়ে চুমুক দিয়ে রীতিমতন আরাম লাগল। গদাই নিজে দোকানে দাঁড়িয়ে থেকে দারুণ চা করিয়ে আনে। তার বাহাদুরি আছে।

চা খেতে-খেতে আমি বললাম, “তোর কথাই ধরা গেল। একই রকমের দেখতে দুই ভদ্রলোক তোর দোকানে একই বই খুঁজতে এসেছিলেন। এতে ক্ষতি কী হয়েছে? এমন হতেই পারে।”

প্রিয়গোপাল চায়ের কাপ তুলে চুমুক দিতে যাচ্ছিল, হাত সামান্য নামিয়ে নিয়ে বলল, “ক্ষতির কথা আমি বলছি না, আমি বলছি, ভদ্রলোক অকারণে মিথ্যে বলবেন কেন! সোমবার যিনি দোকানে এসে একটা বই খোঁজ করে গেলেন, বৃহস্পতিবার তিনি এসে বলবেন, না, আমি আসিনি। অদ্ভুত!”

“আমি কিচ্ছু অদ্ভুত দেখছি না,” আমি বললাম। মনে হল, নিতান্ত জোর করে বলছি কথাটা, ভেতরে-ভেতরে আমারও কেমন গোলমাল লাগছিল। বলছিস, একই লোক। কিন্তু প্রিয়, একই রকম দেখতে দুটো লোক তো হামেশাই দেখা যায়। আমাদের কমল আর সুবল, বাণী আর দেবু…। এই দুই ভদ্রলোক আলাদাও হতে পারেন।”

“লোক আলাদা, কিন্তু একই বইয়ের খোঁজে এসেছেন?” প্রিয় ঠাট্টা করে বলল, “তুই কী বলছিস, শংকর?”

“বাঃ! এটা এমনকী অদ্ভুত কথা। আমি দোকানে গিয়ে একটা বই চাইলাম, তারপর তুই গিয়ে সেটা চাইতে পারিস না?”

“পারি, কিন্তু বইটা কী তা তো দেখতে হবে। এ তোমার রমরমা বই নয়, কলেজের টেক্সটবই নয়। পুরনো বই, প্রায় একশো বছরের পুরনো। রেয়ার বই ওভাবে দল বেঁধে কিনতে লোক আসে না, ভাই। রেয়ার বই কেনার খদ্দেরও রেয়ার। বুঝলে?”

“বুঝলাম। কিন্তু ধরে নে এটা কাকতালীয় ব্যাপার! দু’জনেই এসে গেছে।”

“না,” মাথা নাড়ল প্রিয়গোপাল, “আমাদের বই ওল্ড অ্যাণ্ড রেয়ার বুকস ক্যাটালগ না খুঁজলে চোখে পড়বে না। দ্বিতীয়ত আমাদের নতুন ক্যাটালগে বইটার নাম নেই । পুরনোতে আছে। পুরনোটা বছর দুই আগের ছাপা। তোর কথা যদি মানতে হয়, তবে বলতে হবে, একই রকম দেখতে আলাদা দুই ভদ্রলোক, আমাদের পুরনো ক্যাটালগ দেখে একই বই কেনার জন্যে বেছে নিয়েছিলেন। মাইণ্ড দ্যাট–পুরনো ক্যাটালগ না দেখলে বইটার কথা জানার উপায় নেই।…তারপর দু’বছর পরে দুজনেই একই সঙ্গে, মোটামুটি একই সময়ে দু’তিন দিন আগে-পরে বইটা কিনতে আমাদের দোকানে এসেছিলেন! না ভাই, এত কাকতালীয় ব্যাপার মানতে আমি রাজি নই।”

প্রিয়গোপাল এমনভাবে কথাগুলো বলল, যেন এই ঘটনার মধ্যে সে একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে। আমার অবশ্য তেমন কিছু লাগছিল না, তবে মনে হচ্ছিল, কেমন যেন ব্যাপারটা অস্বাভাবিক।

ঠাট্টা করে আমি বললাম, “তুই রাতদিন থ্রিলার আর ডিটেকটিভ বই পড়িস বলে তোর ওই রকম মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামানোর মতন অত কিছু নেই।” প্রিয়গোপাল মাথা নাড়তে লাগল। চা খাওয়া শেষ করে প্রিয়গোপাল বলল, “আজ বাড়ি গিয়ে বাবাকে আর একবার জিজ্ঞেস করব।”

আমি তকিয়ে থাকলাম। কী জিজ্ঞেস করবে প্রিয় কাকাবাবুকে ?

প্রিয়গোপাল নিজেই বলল, “সেদিন বাবাকে একবার বইটার কথা বলেছিলাম। বাবা বলল, আমার ঠিক মনে পড়ছে না। তারককে খোঁজ করতে বলো। হয়তো বিক্রি হয়ে গিয়েছে। আমাদের অর্ডার-বুকটা দ্যাখো।”

“দেখেছিলি?”

“আমি দেখিনি। তারকদা যদি দেখে থাকে!”

“তারকদা কোথায় গিয়েছে?”

“তারকদা নিজের একটা কাজে গিয়েছে। ঘণ্টাখানেক হতে চলল। তারকদার কে এসেছে দেশ থেকে, তার সঙ্গে দেখা করে জিনিসপত্র কী পাঠাবে।”

“আজ যখন ভদ্রলোক এলেন, তখন তারকদা ছিল না?”

“বলছি তো তারকদা ঘণ্টাখানেক হল নেই। আরে তারকদা থাকলে হাতেনাতে ব্যাপারটা ধরা পড়ে যেত। আগের ভদ্রলোককে দেখেছে তারকদা, এঁকেও দেখত।”

আমি আর কিছু বললাম না।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে প্রিয়গোপাল বলল, “কাল আমি নিজে অর্ডার বুকটা দেখব।” “দেখে কী বুঝবি?”

“বইটা কবে বিক্রি হয়েছে, কাকে বিক্রি করা হয়েছে। অর্ডার ছাড়া আমাদের বই বিক্রি হয় না। খাতা দেখলেই বুঝতে পারব। তার আগে বাবাকে আজ আর-একবার জিজ্ঞেস করে নেব।”

দুই

শনিবার দিন প্রিয়গোপালদের দোকান বন্ধ হয় দুটো নাগাদ। দোকান বন্ধ হলেও আড্ডা বন্ধ হয় না। আমরা দু’তিনজন বন্ধু বিকেলের মধ্যেই তার দোকানে গিয়ে হাজির হই। গল্পগুজব আড্ডা চলে, কখনও দোকানে তালা লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ি আমরা, কফি হাউস বা চায়ের দোকানে গিয়ে বসি, মাঝে মাঝে সোমনাথের কলেজ রো’র বাড়িতে গিয়ে তাস খেলতে বসি।

অফিস সেরে—প্রিয়গোপালের দোকানে গিয়ে দেখি, সে একা, তখনও কেউ এসে পৌঁছয়নি।

প্রিয়গোপাল কিসের একটা চিঠি টাইপ করছিল। সে টাইপ জানে না, মানে টাইপিস্ট নয়, তবে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে টাইপ করতে পারে।

টাইপ মেশিন থেকে চোখ তুলে প্রিয়গোপাল বলল, “বোস। দু’মিনিট। একটা লাইন বাকি আছে।”

আমি বসলাম। দোকানে কেউ নেই। না তারকদা, না গদাই। ওদের থাকার কথাও নয়। শনিবার দুটো-তিনটে নাগাদ ওদের ছেড়ে দেয় প্রিয়গোপাল।

প্রিয়গোপাল টাইপ করতে লাগল। আমি দরজার দিকে তাকিয়ে বসে থাকলাম। ফাল্গুন মাস, রোদ আর গরম দুই-ই চড়ে উঠছে। বাইরে এখনও রোদের বেশ তেজ। বিকেল চারটে হতে চলল প্রায়।

হঠাৎ আমার পরশু দিনের ঘটনা মনে পড়ল। মুখ ফিরিয়ে প্রিয়গোপালের দিকে তাকালাম। “সেই কেসটার কী হল রে? সেই লম্বা ভদ্রলোকের?”

প্রিয়গোপাল বোধহয় শেষ লাইনটা টাইপ করছিল। প্রথমে কথার জবাব দিল না। সামান্য মাথা নাড়ল। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম।

টাইপ শেষ করে প্রিয়গোপাল বলল, “খানিকটা ট্রেস করা গেছে।”

“মানে?”

“বইটা আমাদের দোকানে এসেছিল বছর চারেক আগে। জাস্টিস এ বি রায় তাঁর লাইব্রেরির কিছু বই যখন বেচে দেন, তখন আমরা তাঁর কাছ থেকে ছ’সাতটা বই কিনেছিলাম। তার মধ্যে দুটো ছিল আইনের বই, দুটো ছিল স্পিরিচুয়ালিজমের বই তার মধ্যে একটা বই ছাপা হয়েছিল উনিশশো তেইশ সালে। বিলেতে ছাপা, বইটার নাম ‘ডেথ অ্যাণ্ড ইটস মিস্ট্রি’। আর এই বইটা, যেটা নিয়ে খোঁজ চলছে সেই বইটার নাম ‘এনসেন্ট ম্যান’। ওয়াল্টার স্মিথ বলে এক সাহেবের লেখা। ছবি আছে। এইটটিন নাইনটি এইটে ছাপা হয়েছিল আমেরিকায়।”

প্রিয়গোপাল টাইপকরা কাগজটা মেশিন থেকে খুলে নিল। খুলে নিয়ে একবার পড়ে নিচ্ছিল।

“তুই জানলি কেমন করে?” আমি বললাম। ঠাট্টা করেই বললাম, কেননা প্রিয় এই দোকানের বইপত্রের ব্যাপারে একেবারে গবেট। সে যে কেমন করে এত খোঁজ খবর নিল কে জানে। কাকাবাবু বোধ হয় বলে দিয়েছেন।

প্রিয়গোপাল মেশিনের ডালা বন্ধ করে টেবিলের কাছে ফিরে এল। চেয়ার টেনে বসতে-বসতে বলল, “করেসপনডেন্স ফাইল আর পারচেজ বুক থেকে।”

“তুই এ-সব দেখলি? জানিস তুই?”

“বাবা বলে দিল।” টাইপ করা কাগজটা রেখে প্রিয়গোপাল নস্যির ডিবে তুলে নিল। “আমাদের বইয়ের ব্যবসা আর এমনি বইয়ের ব্যবসা একই রকম নয়, ভাই। আমরা যেমন পুরনো রেয়ার বইয়ের খোঁজ রাখি, সে-রকম যারা এ-সব বই বিক্রি করতে চায় তারাও আমাদের খোঁজ রাখে।” নস্যি নাকে গুঁজে জোর এক টান মারল প্রিয়। নেশাটা তার মগজে ভালো করে পৌঁছে যাবার পর, সামান্য ছলছলে চোখ করে সে আবার বলল, “জাস্টিস এ বি রায়ের কাছ থেকে আমরা বইটা কিনেছিলাম। চিঠি-চাপাটি রয়েছে ফাইলে। সত্যি বলতে কী, আমরা একটা দাঁও মেরেছিলাম তখন, মানে টাকার দিকে থেকে। ওই একটা বইয়ের দাম হাজার খানেকের মতন হতে পারত। মাত্র চারশো টাকায় কিনেছিলাম।”

“একটা বইয়ের দাম এক হাজার?”

“কিছুই নয়। একটা বইয়ের দাম দু’হাজারও হতে পারে। কত পুরনো, কত মূল্যবান আর ক’টা বই বাজারে আছে, তার ওপরই সব নির্ভর করে।”

বোধ হয় হাজার টাকার কথা শুনে আমার সিগারেট খেতে ইচ্ছে করল। পকেট থেকে প্যাকেট বার করতে করতে বললাম, “এই জাস্টিস ভদ্রলোক কোনদিকে থাকেন ?” “কলকাতায় নয়। উনি পাটনা হাইকোর্টের জজ ছিলেন। পরে রিটায়ার করে ওঁদের পাটনার বাড়িতেই ছিলেন।”

“তুই জানলি কেমন করে?”

“বাবার কাছে শুনলাম। তাছাড়া তখন যে চিঠিপত্র চালাচালি হয়েছিল তাতে পাটনার ঠিকানাই রয়েছে।”

আমি আর কিছু বললাম না। বাইরের দিকেই চোখ রেখে বসে থাকলাম। হ্যারিসন রোড দিয়ে ট্রাম বাস ট্যাক্সি রিকশা সবই যাচ্ছে। তবে আজ শনিবারের বিকেলে এদিকে ভিড়ভাট্টা খানিকটা কম মনে হচ্ছিল। যোগেন, সুকুমার, এরা কেন আসছে না এখনও?

প্রিয়গোপাল নিজেই বলল, “একটা অদ্ভুত ব্যাপার কী জানিস! বইটা আমরা কিনেছি তার রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু বইটা আমরা বেচেছি তার কোনও রেকর্ড নেই।”

আমি প্রিয়গোপালের দিকে ঘাড় ঘোরালাম। “তার মানে ?”

“তার মানে,” প্রিয়গোপাল বলল, “আমাদের দোকান থেকে বইটা যে বিক্রি হয়েছে, তার কোনও প্রমাণ নেই। আমরা বই কেনার সময় যেমন খুঁটিনাটি রেকর্ড রাখি, বই বেচার সময়ও যাকে বেচে দিই তার পুরো ঠিকুজি টুকে রাখি। এটা আমাদের নিয়ম।”

“কেন?”

“অনেক সময় চিঠিপত্রে এনকোয়ারি আসে। বড়-বড় জায়গা থেকে, বিখ্যাত মানুষদের কাছ থেকে। যদি আমাদের দোকানের বেচে-দেওয়া বই হয়, আমরা জানিয়ে দিই অমুক জায়গায় বইটি বিক্রি করা হয়েছে, আপনি খোঁজ করতে পারেন।”

“সিস্টেমটা ভালো।”

“এ শুধু আমাদের সিস্টেম নয়, আমাদের মতন কারবার যারা করে, তাদেরও এই সিস্টেম।” বলে প্রিয়গোপাল হঠাৎ একটু হাসল। “বাবার কাছে শুনেছি, যে-বই আমরা বিক্রি করেছি, সেই বই আমাদের হাতে ফিরেও এসেছে দু’পাঁচ বছর পরে। আবার আমরা বেচেছি। তবে এ-রকম ঘটনা খুব কম, দু’চারটে।”

প্রিয়োগোপালের কথা শেষ হবার পর পরই যোগেন আর সুকুমার দোকানে ঢুকল। একই সঙ্গে এসেছে ওরা।

দোকানে ঢুকেই যোগেন বলল, “কী রে শংকর, কতক্ষণ?’ “খানিকক্ষণ আগে, তোরা এত দেরি করলি?”

সুকুমার বলল, “সারকুলার রোডে আটকে গিয়েছিলাম। কী জ্যাম রে!”

সুকুমার কাজ করে সায়েন্স কলেজে। তার বাড়িও কলেজের কাছাকাছি, বিদ্যসাগর স্ট্রিটে। যোগেনদের পৈতৃক ব্যবসা। রঙের কারবার। শিয়ালদার কাছাকাছি তাদের কারখানা।

যোগেন প্রিয়গোপালকে বলল, “তোর সেই ভদ্রলোক আর এসেছিলেন?” মাথা নড়ল প্রিয়গোপাল। আসেননি।

আমার দিকে তাকাল যোগেন, “শুনেছিস তুই! পরশু তুই এসেছিলি। আমি কাল এসে শুনলাম।”

সুকুমার বলল, ঠাট্টা করে, “প্রিয়, তুই আমাকে ভাড়া নে, আমি তোর মিস্ট্রি সলভ করে দেব।”

“তুইও শুনেছিস?” আমি জিজ্ঞেস করলাম সুকুমারকে।

“যোগেনের কাছে শুনলাম,” সুকুমার বলল, “প্রিয় ভুল দেখেছে।”

প্রিয়গোপাল চটে গেল। “বাজে বকিস না, প্রিয় কখনও ভুল দেখে না। আমি ঠিক দেখেছি। বলে সে টাইপ করা চিঠিটা তুলে আমাদের দিকে এগিয়ে দিল। “পড়ে দ্যাখ, ঠিক হয়েছে কিনা!’

যোগেন চিঠিটা নিল প্রথমে। পড়ল। পড়ে আমার দিকে এগিয়ে দিল।

চিঠিটা পড়তে গিয়ে দেখি, জজসাহেব এ বি রায়কে চিঠিটা লেখা হয়েছে। পাটনার ঠিকানাতেই।

চিঠিটা পড়লাম। প্রিয়গোপাল ছোট করে যে চিঠিটা লিখেছে, তার মর্মার্থ হল আমরা অমুক সালে অমুক মাসে আপনার লাইব্রেরি থেকে যে কয়েকটি বই কিনি, তার মধ্যে অমুক বইটি ছিল। বইটি আমাদের পুরনো ক্যাটালগে তালিকাভুক্ত ছিল। নতুন ক্যাটালগে নেই। সম্প্রতি দুই ভদ্রলোক বইটি খোঁজ করতে আসায় আমরা দোকানের খাতা-পত্র দেখতে গিয়ে লক্ষ করলাম, বইটি আমরা কোনও ক্রেতাকে বিক্রি করিনি। অথচ বইটি আমাদের স্টকেও নেই। কোথাও কোনওরকম ভুলচুক ঘটেছে আমাদের। আপনি কি এ-বিষয়ে আমাদের কোনও ভাবে সাহায্য করতে পারেন? বইটির দ্বিতীয় কোনও কপি থাকলে আমরা তা কিনতে আগ্রহী।

চিঠির মধ্যে প্রিয়গোপাল লিখেছে দুই ভদ্রলোক, লেখেনি একই রকমের দেখতে দুই ভদ্রলোক।

চিঠিটা আমি সুকুমারের দিকে এগিয়ে দিলাম। সে চিঠি পড়তে লাগল। আমি প্রিয়গোপালকে বললাম, “তুই এই চিঠি লিখলি কেন? জবাবের আশা করে?”

প্রিয়গোপাল বলল, “হ্যাঁ। দেখা যাক না।”

যোগেনও সন্দেহ করছিল। বলল, “রায়মশাই চার-পাঁচ বছর আগে বই বেচেছেন। এতদিনে তাঁর মনে আছে কি না কে জানে। তোর মতন তিনি তো বইয়ের দোকান করে বসে নেই!”

“একটা চিঠিতে কী যায় আসে রে?” প্রিয়গোপাল বলল, “হয় জবাব দেবেন, না হয় দেবেন না। তবে জজসাহেব ছিলেন তো, ফর্মালিটি মানতে পারেন।”

সুকুমারের চিঠি পড়া শেষ হয়েছিল। সে বলল, “পুরো নাম জানিস নাকি জজসাহেবের?”

“অবনীভূষণ রায়। তাঁর চিঠির তলায় নাম সই ছিল।”

সুকুমার তার থুতনির কাছে দাড়ি চুলকোতে লাগল। সে ছাগলের মতন দাড়ি রাখে খানিকটা। দাড়ি চুলকোতে-চুলকোতে বলল, “প্রিয়, আমার মাসিমার মেয়ে বুড়িদি পাটনায় থাকে। বিয়ের পর থেকে পাটনায়। দিদির কাছে আমার একবার যাবার কথা। রেবার বিয়ের সম্বন্ধ করেছে। মা যেতে বলছে। অবশ্য দু’চার দিনের মধ্যে আমি যাচ্ছি না। বুড়িদিকে একটা চিঠি লিখব নাকি? ফর ইনফরমেশান।”

প্রিয়গোপাল সে-কথার জবাব দিল না। হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিল সুকুমারের কাছ থেকে।

আমি খানিকটা মজার গলায় বললাম, “তুই যখন চিঠিই লিখলি প্রিয়, তখন ওটাও লিখলে পারতিস, একই রকমের দেখতে দুই ভদ্রলোক তোর দোকানে বইটার জন্যে হানা দিচ্ছেন।”

মাথা নাড়ল প্রিয়গোপাল। “না, লিখলাম না। দেখি না এই চিঠির জবাব আসে কিনা।” বলে হাতের ভাঁজ করা চিঠি খামে ভরতে লাগল। তারপর হঠাৎ বলল, “তোমরা যে যা বলো ভাই, আমি বলছি, এর মধ্যে কোনও ব্যাপার আছে। আমদের দোকানে এইভাবে বই কিনতে খদ্দের আসে না।”

সুকুমার মজার গলায় বলল, “কিছু টাকা ছাড়, আমি পাটনায় গিয়ে তোকে সব ইনফরমেশান এনে দিচ্ছি।”

প্রিয়গোপাল বলল, “দেব। দাঁড়া, আগে দেখি চিঠির জবাব আসে কি না!”

যোগেন কিছু ভাবছিল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “দ্যাখ শংকর, সেদিন যখন তুই আর আমি বসে কথা বলছি, প্রিয় উঠে গিয়েছে ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে, তখন আমি তোকে কী বলেছিলাম?”

যোগেন কী বলেছিল আমার মনে পড়ল না। “কী বলেছিলি?”

“বলেছিলাম, ভদ্রলোকটিকে রইসের মতন দেখাচ্ছে। ধুতিটা কেমন করে যেন পরেছিলেন। বাঙালি ভদ্রলোক, যারা ধুতি পরে, তারা ও-ভাবে পরে না। কাছাটা ভাই ননবেঙ্গলি মার্কা। পাঞ্জাবির বুকের কাছে কাজ করা ছিল।”

“হাতে মার্বেল সাইজের আংটি।” আমি খোঁচা মেরে বললাম।

“হ্যাঁ, আংটি ছিল হাতে। চোখে হাফচশমা। চশমার কাচ নীলচে মতন। ঠিক কিনা, প্রিয়?”

প্রিয়গোপাল মাথা দোলাল। যোগেন ঠিকই বলেছে।

আমি বললাম, “এ-সব কথা থেকে তুই কী প্রমাণ করতে চাইছিস?”

“না, প্রমাণ আর কী করব। পাটনা শুনে মনে হল, ভদ্রলোক বোধহয় বাইরে থেকেই এসেছিলেন। বিহারি-বাঙালি…।”

সুকুমার চেঁচিয়ে উঠল, “দারুণ রে যোগেন, দারুণ! তুই আর-এক ব্যোমকেশ। …কী তোর চোখ।”

আমরা হেসে উঠলাম একসঙ্গে। যোগেনও হেসে ফেলল।

প্রিয়গোপাল যেন আচমকা কোনও ঝিলিক দেখতে পেল। বলল, “তাই তো রে! তোরা হাসছিস; আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, যোগেন একটা বড় পয়েন্ট খুঁজে পেয়েছে। আমার আগে খেয়াল হয়নি, এখন কিন্তু মনে হচ্ছে, ভদ্রলোক যখন কথা বলছিলেন, বাংলা ইংরিজি মিলিয়ে, তখন তাঁর বাংলা কথার মধ্যে হিন্দি টান চলে আসছিল। যেমন একবার বললেন, চুঁড়ছি’। আমরা ভাই ছুঁড়ছি’ বলি না, খুঁজছি বলি।”

যোগেন যেন উৎসাহ পেয়ে গেলে। “তবে! …আমার সন্দেহ হচ্ছে, ভদ্রলোক কলকাতার নন। মানে এ-দিকে বরাবর থাকার লোকই নন। বাইরে থেকে এসেছেন। …তুই কি ভদ্রলোকের নামটাম জানতে চেয়েছিলি প্রিয়?”

“না,” প্রিয়গোপাল মাথা নাড়ল। “একজন কাস্টমার। আমি নাম জানতে চাইব কেন? বই নিয়েই কথা হচ্ছিল।”

আমি বললাম, “তোরা তা হলে বলতে চাইছিস পাটনার জজসাহেবের সঙ্গে এই ভদ্রলোকের একটা লিংক আছে?”

সুকুমার হাত তুলে বলল, “দাঁড়া, আমার একটা কোশ্চেন আছে। প্রথম ভদ্রলোকের সঙ্গে দ্বিতীয় ভদ্রলোকের কতটা মিল, প্রিয়?”

“কতটা মিল মানে? একই রকম দেখতে।”

“চোখমুখ একরকম। গায়ের রঙ?”

“একই।”

“কথা বলার ধরন?”

প্রিয়গোপাল এবার ধাঁধায় পড়ল। ভাবল সামান্য। বলল, “দ্বিতীয় ভদ্রলোকর ব্যাপারটা অত খেয়াল করতে পারছি না। উনি ইংরিজিই বেশি বলছিলেন। কথাও কম বলেছেন। বাংলা যা বলেছেন, আমাদের মতনই।”

সুকুমার বলল, “যাচ্চলে! তা হলে এ তো অন্য লোক। আগের ভদ্রলোক নয়।” প্রিয়গোপাল মাথা নাড়তে লাগল। “একই লোক।”

“একই লোক—তবু দুজনের অভিনয় করছে? তোর ডিটেকটিভ বইয়ে যেমন দেখা যায়?”

প্রিয়গোপাল কোনও জবাব দিল না।

হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল, প্রিয়গোপাল সেদিন বলেছিল, ঠিক এইরকম একজনকে সে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দেখেছিল। আমি বললাম, “হ্যাঁ রে প্রিয়, তুই তো বলছিলি, এই রকম, অবিকল এই রকম চেহারার এক ভদ্রলোককে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গেটে ট্যাক্সি চাপা পড়তে যাচ্ছিল দেখেছিলি। তা হলে সেই তিন নম্বরটা কে? এই দু’জনের একজন, না সে আলাদা—তিন নম্বর?”

প্রিয়গোপাল কোনও জবাব দিতে পারল না।

তিন

কয়েকটা দিন আর বাড়ি থেকে বেরোতে পারিনি। সিঁড়ি থেকে পা হড়কে পড়ে গিয়ে ডান পায়ের গোড়ালি এমন মচকে গেল যে, দাঁড়াবার পর্যন্ত উপায় থাকল না। গোড়ালির কাছটায় ফুলে টাটিয়ে বিশ্রী অবস্থা।

সেদিন সন্ধেবেলায় প্রিয়গোপাল আর যোগেন এল বাড়িতে। পায়ের অবস্থা দেখে বলল, “এখনও ক্রেপ ব্যাণ্ডেজ বেঁধে রেখেছিস?”

“উপায় কী! ব্যাথা রয়েছে। তবে আগের চেয়ে কমেছে আনেকটা।”

দু’পাঁচটা অন্য কথার পর প্রিয়গোপাল বলল, “আমার অবস্থা খুব কাহিল হয়ে উঠেছে রে! এই ক’দিনে কত কাণ্ড ঘটে গেল, তুই জানিস না।”

আমি প্রিয়গোপালের মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকে দেখলাম। বললাম, “পাটনা থেকে জজসাহেবের চিঠি পেয়েছিস?”

“পেয়েছি,” প্রিয়গোপাল বলল, “জজসাহেব গত বছর মারা গিয়েছেন।” “মারা গিয়েছেন! সে কী! তা হলে তোর চিঠির জবাবা দিল কে?”

যোগেন এতক্ষণ বেশি কথা বলেনি, এবার বলল, “সেটাও মিস্ট্রি। বাড়ির কেউ জবাব দিয়েছে, তবে সে কে, তা লেখেনি।”

“তুই চিঠি দেখেছিস?” আমি যোগেনের দিকে তাকালাম। যোগেন মাথা হেলাল।

সে দেখেছে।

প্রিয়গোপাল বলল, “চিঠি পড়ে মনে হল, জজসাহেবের বাড়িতে কোনও পুরনো কর্মচারী আছে। ম্যানেজার বা সরকার ক্লাসের। সেই ভদ্রলোকই জবাব দিয়েছে। লিখেছে, জজসাহেব গত বছর মারা গিয়েছেন। তাঁর লাইব্রেরি আর বই সম্পর্কে বাড়ির লোক কোনও খোঁজখবর রাখে না। কাজেই তারা কিছু বলতে পারছে না ৷ ”

আমি বললাম, “তা হলে তো ব্যাপারটা দি এণ্ড হয়ে গেল রে, প্রিয়।”

যোগেন বলল, “দি এণ্ড হল কোথায়; সবে শুরু হল। শোন না প্রিয়র মুখে। থ্রিলিং ব্যাপার হচ্ছে পর পর।”

আমি প্রিয়গোপালের মুখের দিকে তাকালাম।

প্রিয়গোপাল একটু চুপ করে থেকে বলল, “এই তোর পরশু দিন সন্ধের দিকে দোকান বন্ধ করে উঠব উঠব করছি, একটা ফোন এল। ফোন তুলে হ্যালো বলতেই যাঁর গলা শুনলাম, মনে হল সেই ভদ্রলোক। গলাটা যে চিনতে পেরেছিলাম তা নয় ভাই, তবে কথা বলার ধরন, হিন্দি টান মেশানো বাংলা শুনেই সন্দেহ হল সেই প্রথম ভদ্রলোক, যিনি দোকানে প্রথম বইটার খোঁজে এসেছিলেন। তা সন্দেহ ভুল হয়নি। ভদ্রলোক নিজেই বললেন, বইয়ের খোঁজে দোকানে এসেছিলেন, আমরা বলেছিলাম বইটা নেই, তবে খোঁজখবর করে দেখব যদি ভুল করে কোথাও মিশে গিয়ে থাকে। বইটা আমরা পেয়েছি কিনা জানতে চাইলেন।”

আমি তেমন অবাক হলাম না। এমনটা হতেই পারে। ভদ্রলোক খোঁজ করতেই পারেন বইটা সম্পর্কে। “তুই কী বললি?”

“যা সত্যি কথা তাই বললাম,” প্রিয়গোপাল বলল, “বললাম, ওপর-ওপর খোঁজ করেছি, বই পাইনি। বইটা নেই। বিক্রি হয়ে গিয়েছে।…”

“তুই তো মিথ্যে কথা বললি,” আমি বললাম।

“না, মানে মিথ্যে ঠিক বলিনি। খাতায় পত্রে বিক্রি দেখতে পাইনি ঠিকই, তবে বইটা থাকলে ক্যাটালগে নামটা থাকত। আমি অবশ্য সেটা আর বললাম না। উনি তো জানেনই। নতুন ক্যাটালগ দেখানো হয়েছে ওঁকে।”

“ভদ্রলোক কী বললেন ?”

“যা বললেন তাতে আমি থ’ মেরে গেলাম। বললেন, বইটা বিক্রি হয়নি। হতে পারে না। বইটা কোথাও আছে। তোকে বলব কী শংকর, এমনভাবে বললেন যেন আমায় হুকুম করছেন। হুকুমের গলায় বললেন, পনেরো দিন সময় দিচ্ছেন আমাদের, বইটা খুঁজে বার করতে হবে। যদি না করি, পরিণাম খারাপ হবে।”

আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। “তোকে থ্রেট করলেন?”

“হ্যাঁ। থ্রেট”

“তুই কী বললি?”

“আমি তখন রেগে কী যেন বলতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ মাথায় এক বুদ্ধি এসে গেল। কেন এল, জানি না। এক্কেবারে হঠাৎ প্ল্যানটা এসে গেল। আমি বললাম, মশাই, আসল ব্যাপারটা কী? আপনি বইটা খোঁজ করে যাবার দু’দিন পরে আরেক ভদ্রলোক, অবিকল আপনার মতন দেখতে, ওই একই বই খোঁজ করতে এসেছিলেন। তিনি একটা মোটা দরও দিয়ে গিয়েছেন।” বলে প্রিয়গোপাল আমার মুখের দিকে এমন চোখ করে তাকাল, যেন বলতে চাইল, পাল্টা কেমন দিয়েছি বল

যোগেন একটা মজার ভঙ্গি করে বলল, “ভদ্রলোককে চুপসে দিয়েছে প্রিয়। দারুণ দিয়েছে।”

আমি বললাম, “ভালোই দিয়েছিস। কিন্তু দ্বিতীয় ভদ্রলোক কি তোকে দর দিয়েছিলেন?”

“মোটেই নয়। সেরেফ ধাপ্পা। আমি বাজাতে চাইছিলাম। তারপর কী হল শোন না! আমার কথা শুনে ভদ্রলোকের মুখে আর কথা নেই। চুপ। শেষে কড়া গলায় বললেন, তিনি আমার দোকানে আর আসেননি। যে গিয়েছিল সে অন্য লোক, হ্যাঁ—তাঁর মতনই দেখতে অবিকল। তার নাম হীরালাল। ‘বাইসাইকেল’ নামে সে বিখ্যাত। সাঙ্ঘাতিক লোক।”

“বাইসাইকেল?” আমি অবাক।

যোগেন ঠাট্টার গলায় বলল, “বিখ্যাতদের একটা করে দু’নম্বরি নাম থাকে না, সেইরকম আর কি। উনি বাইসাইকেল, আর ইনি বোধহয় ট্রাইসাইকেল।”

যোগেনের কথায় না হেসে পারলাম না।

প্রিয়গোপাল বলল, “তারপর যা হল শোন আমার এক চালে ভদ্রলোক কাত হয়ে গিয়ে বললেন, বাইসাইকেলের দর কত? আমি ফট করে বললাম, চার হাজার।”

“চার হাজার! যাঃ!”

“বাই গড বললাম। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক বললেন, তাঁর দর পাঁচ হাজার থাকল। ….আমি বললাম, ভেবে দেখব। বইটা যদি পাই। তিনি তাঁর নাম-ঠিকানা দিতে পারেন। তাঁকে জানাব।”

“দিলেন নাম-ঠিকানা ? ”

“দিলেন। তবে নামও বললেন না, ঘরবাড়ির ঠিকানাও দিলেন না। শুধু একটা ফোন নাম্বার দিলেন। বললেন, ওই নাম্বারে রিং করে খবরটা দিয়ে দিলেই হবে।”

যোগেন টিপ্পনি কেটে বলল, “পার্টি খুব সেয়ানা।”

চা এসেছিল। চা আর ডালপুরি। মা পাঠিয়েছে। পল্টু আমাদের সামনে খাবার আর চা রেখে চলে গেল।

যোগেন খাদ্যরসিক। সঙ্গে-সঙ্গে প্লেট উঠিয়ে নিল। বলল, “মাসিমার সঙ্গে আমার টেলিপ্যাথি হয়েছিল। শংকর, তুই দুটো খাস না, একটা আমাকে দিয়ে দে। তোর পায়ে ব্যথা, বেশি খেতে নেই।”

ডালপুরিতে আমার রুচি ছিল না তখন। দিয়ে দিলাম। প্রিয়গোপালকে বললাম, “ব্যাপারটা তো সত্যিই বড় গোলমেলে রে!”

“শুধু গোলমেলে নয়, মিস্টিরিয়াস,” প্রিয়গোপাল বলল, “পরশু ফোনে এইসব কথা হল তো! আজ দোকানে গিয়ে দেখি একটা চিঠি।”

“কার চিঠি?”

“মনে হচ্ছে হীরালাল ওরফে বাইসাইকেলের। টাইপ-করা চিঠি ভাই। মাত্র দুটি লাইন লেখা। ‘বিল্লি থেকে সাবধান। বিপদে পড়বেন।”

“বাংলা টাইপ?”

“না, ইংরিজিতে। বিল্লি কথাটা ক্যাপিটাল হরফে লেখা ছিল। বিওয়ার অব ডগস যেমন ঝোলানো থাকে কোনও-কোনও বাড়ির ফটকে, প্রায় সেই রকম ব্যাপার আর কি!”

“চিঠির নীচে নাম সই নেই?”

“না।”

“তা হলে? কে তোকে বলল ওটা হীরালালের?”

“আমি সন্দেহ করছি।”

যোগেন একমনে খাচ্ছিল। আমি চায়ে চুমুক দিলাম। প্রিয়গোপালও খেতে শুরু করেছিল।

আমরা তিনজনেই খানিকক্ষণ চুপচাপ থাকলাম। শেষে যোগেন বলল, “সুকুমারকে তুই লাগিয়ে দে প্রিয়, পাটনা থেকে একটা খবর যোগাড় করুক। এই বাইসাইকেল লোকটাই বা কে? আর বিল্লিই বা কে? আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে, জজসাহেবের সঙ্গে এদের কোনও সম্পর্ক রয়েছে।”

যোগেন কথাটা না বললেও বুঝতে পারলাম প্রিয়গোপাল আগে থেকেই ওই একই সন্দেহ করছে। আমারও এমন সন্দেহ হচ্ছিল, বইটার সঙ্গে অনেক রহস্য জড়িয়ে রয়েছে।

আমি প্রিয়গোপালকে দেখছিলাম। প্রিয়কে দেখলে মনে হবে, কোনও স্কুল-কলেজের ছেলেমানুষ মাস্টার। খানিকটা নাদুস-নুদুস চেহারা, গোল ছাঁদের মুখ, মাথার চুল ছোট-ছোট, সিঁথি করে চুল আঁচড়ায়। খুবই নিরীহ দেখতে। কিন্তু আমরা জানি, বাইরে যত নিরীহ বোকা-বোকা দেখায় প্রিয়কে, অতটা নিরীহ সে নয়। চটে গেলে মারামারি করতেও তার আটকায় না। ভয় জিনিসটা তার নেই এমন বলব না, তবে চট করে ভয়ে কুঁকড়ে যাবার ছেলে সে নয়।

প্রিয়গোপাল চা শেষ করে নস্যির ডিবে বার করতে লাগল। বলল, “বাবাকে আমি সব কথা বলিনি। বললে, নার্ভাস হয়ে যাবে। হার্টের রোগী। তবে বাবাকে আমি বইটার কথা ক’বারই জিজ্ঞেস করেছি।” বলে প্রিয়গোপাল সামান্য চুপ করে থাকল, নস্যি নিল নাক ভরতি করে, নাক মুছল রুমালে। পরে বলল, বাবা বলছে, “বইটা দোকানে ছিল। নিজের হাতে তেমন করে নেড়েচেড়ে বইটা দেখেনি। তবে বাবার যতটা মনে পড়ছে, বইটা খুব মোটা নয়, মাঝারি মোটা, চওড়া সাইজের দেখতে, অনেক ছবি ছিল, আর বাঁধাই ছিল খুব ভালো।”

“জজসাহেবের নাম ছিল না?” আমি সাধারণভাবে বললাম। “জিজ্ঞেস করিনি থাকতে পারে। নাও পারে।” “কাকাবাবুর মনে নেই বইটা বিক্রি হয়েছিল কি না?”

“না, বাবার মনে নেই। তবে বাবার মনে আছে, বিহার ইউিনিভার্সিটি থেকে একবার একজন এসেছিলেন। তিনি বইটা নেব কি নেব না করে শেষ পর্যন্ত নেননি।

“এটা কবেকার কথা?”

“বছর খানেক কি দেড়েক আগেকার কথা।…তা ভাই, এখানেও ধোঁকা খাচ্ছি। এক-দেড় বছর আগেও যদি বইটা দোকানে থেকে থাকে, তা হলে নতুন ক্যাটালগে থাকল না কেন?”

“তোরা ক’বছর অন্তর ক্যাটালগ ছাপিস?”

“নিয়ম বছরে একবার করে। সবসময় হয় না। পুরো ক্যাটালগও ছাপি না। নতুন বইগুলো আলাদা ছেপে পুরনোর সঙ্গে স্টিচ করে দিই। আর বিক্রি হয়ে যাওয়া বইগুলো বাদ দিয়ে দিই। সেই পাতাগুলো ছেপে নিতে হয় আলাদা করে। খরচ কমাবার চেষ্টা আর কি।”

“তা তোদের এবারকার নতুন ক্যাটালগ কবে ছাপা?”

“ধর, গত বছর।”

“প্রথম ভদ্রলোক তোকে যে ক্যাটালগ দেখিয়েছিলেন, সেটা দু’বছর আগে ছাপা বলেছিলি। তাই না?”

“হ্যাঁ। আর পরের ক্যটালগ গত বছর। দু’চার মাস এদিক-ওদিক হতে পারে। এই এক বছরের মধ্যে বইটা গেল কোথায়? যদি বিক্রি হয়ে গিয়ে থাকত, খাতায় পাচ্ছি না কেন?”

যোগেন হঠাৎ বলল, “প্রিয়, জজবাবুও একবছর আগে মারা গিয়েছেন। তা হলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে কী?”

যোগেনের কথায় আমার যেন চমক লাগল। সত্যি তো, জজবাবু যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন কেউ বইটার খোঁজ করেনি নাকি? তিনি মারা যাবার পর থেকেই কি বইটার খোঁজ শুরু হয়েছে? কেন? কী আছে ‘এনসেন্ট ম্যান’ বইটায়?

খানিক চুপ করে থেকে আমি বললাম, “প্রিয়, এখন আমার মনে হচ্ছে, বইটার মধ্যে কোনও রহস্য আছে। জটিল রহস্য। তুই ভালো করে খোঁজ করে দ্যাখ, জজবাবু কবে কখন কোথায় মারা গিয়েছেন? যদি এমন হয়, যোগেন যা যা বলল, জজবাবু মারা যাবার পর বইটা নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়েছে, তবে বুঝতে হবে শুধু বই নয়, বাইরেও গভীর রহস্য রয়েছে। …তুই সুকুমারকে পাটনায় পাঠিয়ে দে। নিজে যেতে পারবি না। তোর গিয়ে কাজ নেই।”

চার

দিন আট-দশ পরের কথা। পা সেরে গিয়েছিল আমার। অফিস যাওয়া শুরু করেছি। সেদিন সন্ধের মুখে প্রিয়গোপালের দোকানে ঢুকতেই দেখি সুকুমার আর যোগেন বসে আছে। প্রিয়গোপাল নেই।

“কী রে সুকুমার? ফিরলি কবে?”

সুকুমার পাটনায় গিয়েছিল। তা দিন পাঁচ-ছয় আগে। প্রিয়গোপাল যে তাকে তাগাদা দিয়ে পাঠিয়েছিল, তা নয়। সুকুমার নিজেই যাব যাব করছিল। ছোট বোনের বিয়ের সম্বন্ধ করেছে তার বুড়িদি। যেতেই হতো। এই ছুতোয় ঘুরে এল। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হল আর কি!

সুকুমার বলল, “কাল ফিরেছি। আমরা তোর জন্যেই বসে আছি।”

“প্রিয় কোথায়?”

“তারকদার খোঁজে গিয়েছে। এক্ষুনি আসবে।”

“কোনও খবর পাওয়া গেল না তারকদার?”

যোগেন মাথা নাড়ল।

দিন দুই আমার প্রিয়গোপালের দোকানে আসা হয়নি। শেষ যেদিন এসেছিলাম, শুনেছি—তারকদা হুট করে বাড়ি চলে গিয়েছে। বউবাজারে মলঙ্গা লেনে একটা বাসা ভাড়া করে তারকদারা জনাচারেক থাকে। তারকদার বাড়ি বদ্যিনাথধামে। বছরে এক-আধবার বাড়ি যায়। পুজোর ছুটিতে একটানা দিন পনেরো কাটিয়ে আসে। অন্য সময় নিতান্ত দরকার পড়লে দু’চার দিনের জন্যে যায় বাড়িতে। অবশ্য তেমন দরকার কমই পড়ে।

তারকদা ক’দিন আগে হুট করে বদ্যিনাথধামে চলে গিয়েছে। কেন গিয়েছে বলে যায়নি। শুধু লোক মারফত খবর পাঠিয়েছে, জরুরি দরকারে বাড়িতে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করবে।

সুকুমারের পাশে বসতে-বসতে আমি বললাম, “তোর পাটনার খবর কী?” সুকুমার কান চুলকোচ্ছিল। বলল, “অনেক খবর।” বলে আবার কান চুলকোতে লাগল।

যোগেন বলল, “ব্যাপার গুরুতর, বুঝলি রে শংকর! আমাদের একজন শার্লক হোমস দরকার।”

সুকুমারের কান চুলকোনো আমার ভালো লাগছিল না। বললাম, “কান পরে খোঁচাবি, কাজের কথা বল।”

মাথা হেলাল সুকুমার। “বলছি।” কান চুলকোনো থামিয়ে এবার আমার দিকে তাকাল। বলল, “শর্টে বলব, না লংয়ে ?”

“তোর যাতে খুশি বল! ইয়ার্কি ছাড়।”

সুকুমার মুচকি হাসল। তারপর বলল, “রিটায়ার্ড জজসাহেব এ বি রায়—লোকে যাকে টেকো জজ বলে, তাঁর পুরো হিস্ট্রি আমি নিয়ে এসেছি।”

“টেকো জজ ? মানে ?”

“পুরো মাথাটাই টাকে ভরতি ছিল; ঘাড়ের কাছে আর কানের কাছে পাঁচ-সাতটা সাদা চুল,” সুকুমার বলল। “টেকো জজসাহেবের তিন পুরুষের ইতিহাস শুনবি?”

বিরক্ত হয়ে বললাম, “তিন পুরুষের কাসুন্দি ঘাঁটতে হবে না, এক পুরুষের কথাই বল।”

“বেশ তাই বলছি, পরে কিন্তু আফসোস করবি। …শুধু এ বি রায় মশাইয়ের কথা বলতে হলে বলব, ভদ্রলোক পাটনা শহরের একজন নামকরা লোক ছিলেন। বাঁকিপুরের দিকে থাকতেন। যে-বাড়িতে থাকতেন সেটা ওঁর বাপ-ঠাকুরদার বাড়ি। বাড়িটা বিশাল। যাকে তোরা বলিস প্রাসাদতুল্য, তাই। পুরনো বাড়ি, বাইরে থেকে দেখলে ভাঙাচোরা দুর্গ বলে মনে হবে, কিন্তু ভেতরে ঢুকলে অতটা মনে হবে না। ভেতরের দিকের মহল আধখানা ফাঁকা, বাকি আধখানায় লোকজন বসবাস করে। এই বাকি আধখানা মোটামুটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সাজানো-গোছানো, পুরনো আসবাবপত্রে ভরতি।”

সুকুমার এমন ভাব করে বলছিল যেন রুপকথার গল্প বলছে। আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, “তোকে ভূমিকা করতে হবে না। সোজাসুজি যা বলার বল আমি বুঝতে পারছি জজসাহেবের বাড়িটা রাজপ্রাসাদের মতন। তারপর কী তাই বল”

“বাড়ি যা—তার আট দশগুণ হল বাড়ির চৌহদ্দি। তার মধ্যে বাগানই হল বিঘে দুই-তিন। আম, জাম, লিচুগাছ থেকে শুরু করে সবজিবাগান, ফল-ফুল সব পাবি।”

“তুই নিজের চোখে দেখেছিস?”

“ইয়েস স্যার, দেখে এসেছি। দিদির দেওর নিয়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হল বাগানের দিকে এক চিড়িয়াখানা। না না, জন্তু-জানোয়ারের চিড়িয়াখানা নয়, সেরেফ চিড়িয়াখানা। কোথাও গোল করে, কোথাও চৌকো করে তারের জাল দিয়ে ঘেরা ঘর, তার মধ্যে কতরকম পাখি। পাখিঘরগুলো রিয়েলি দেখার মতন।”

“তারপর?”

“তারপর আর কি। বাড়ি আর বাগান আর পাখিঘর বাদ দিয়ে যে জায়গাটা পড়ে রয়েছে, সেটা জঙ্গল বলতে পারিস। গাছপালা আর আগাছায় ভরতি।”

“জজসাহেব কবে মারা গেছেন ? ”

“গত বছর মার্চ মাসে।”

“অসুখ করেছিল?”

“না,” মাথা নাড়ল সুকুমার, “অসুখ করে নয়, ইচ্ছামৃত্যু।”

“ইচ্ছামৃত্যু! মানে, আত্মহত্যা বলছিস?”

“না রে শার্লক হোমস, আত্মহত্যা নয়। তবে আত্মহত্যার মতন বলতে পারিস।” বিরক্ত হয়ে বললাম, “তুই বড় চ্যাংড়ামো করছিস, সুকু। সিরিয়াস ব্যাপারে চ্যাংড়ামি ভালো লাগে না।”

সুকুমার মুচকি হাসল। তারপর মুখে গম্ভীর ভাব করে বলল, “তাহলে সত্যি কথাটা শোন। জজসাহেবের হালফিল শখ হয়েছিল, মাটি কেটে গর্ত করে তার মধ্যে সমাধিস্থ হয়ে বসে থাকবেন। সমাধি হবার বায়না ধরে তিনি আজ এখানে কাল সেখানে গর্ত করে বসে থাকতে গিয়ে একদিন মাটি চাপা পড়ে সমাধিস্থ হয়ে গেলেন। ব্যস, সাধনায় সিদ্ধিলাভ ঘটল।”

কী বাজে ফাজলামি করছে সুকুমার! মাটি চাপা পড়ে সমাধিস্থ ! চটে গিয়ে বললাম, “তুই আমাকে গোরুর গাছে ওঠার গল্প শোনাচ্ছিস?”

“একেবারেই নয়। যা বলছি সব সত্যি।”

যোগেন এতক্ষণ একমনে ঝালমুড়ি চিবোচ্ছিল। হাতে ঠোঙা। তার মুড়ি খাওয়া শেষ হয়েছে। ঠোঙাটা দলা পাকাতে পাকাতে বলল, “তুই শুনে যা শংকর। রোমাঞ্চ সিরিজের গল্প রে।” বলতে বলতে যোগেন উঠল। জল খেতে গেল ওপাশে। গদাই দোকানেই রয়েছে।

আমি বললাম, “প্রিয়র সঙ্গে দেখা হয়েছে তোর? বলেছিস সব?”

সুকুমার ঘাড় হেলাল। “বলেছি।”

“তা হলে বল, জজসাহেবের ইচ্ছামৃত্যুর পর কী হল?”

“তারপর—মানে জজবাবু মারা যাবার পর ও-বাড়িতে একটা গণ্ডগোল লেগে গেল। লোকে বলে, বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে গোলমাল। জজসাহেবের ছেলে আর তাঁর দুই ভাইপোর মধ্যে।”

“কেমন ভাইপো?”

“বড় ভাইয়ের ছেলে। এক ভাইপো ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা করে, আরেক ভাইপো ফার্মিং—মানে চাষবাস, ডেয়ারি নিয়ে পড়ে আছে। প্রথম জনের নাম রাজাবাবু, রাজালাল। আর দ্বিতীয়জনের নাম হীরাবাবু—মানে হীরালাল।”

হঠাৎ আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “যমজ ?”

“ঠিক ধরেছিস। যমজ। অবিকল এক রকম দেখতে।”

“একজনের নাম কি ‘বাইসাইকেল’? মানে লোকে তাকে—”

‘একজাক্টলি। প্রিয় তোকে বলেছে?”

“বলেছে।”

প্রিয়গোপাল ফিরে এল দোকানে। মুখ দেখেই মনে হল বিরক্ত। কপালে গলায়

ঘাম জমে ভিজে উঠেছে।

যোগেন বলল, “খোঁজ পেলি তারকদার?”

“না।” প্রিয়গোপাল জল চাইল গদাইয়ের কাছে। নিজের চেয়ারে এসে বসল। পকেট থেকে রুমার বার করে মুখ মুছতে-মুছতে বলল, “কেউ কিছু বলতে পারল না। শুধু বলল, দরকারি কাজে বদ্যিনাথধাম চলে গিয়েছে। কী দরকারি কাজ কেউ জানে না।”

গদাই জল এনে দিল।

জল খেয়ে প্রিয়গোপাল আমার দিকে তাকাল। “কখন এলি? শুনেছিস সব? সুকু অনেক খবর নিয়ে এসেছে।”

“শুনছি। …তোর দুই মক্কেলকে তো চেনা গেল। রাজালাল, হীরালাল। একজনের দু’নম্বরি নাম ‘বিল্লি’, আরেক জনের ‘বাইসাইকেল’। তাই না?”

“হ্যাঁ। জজসাহেবের দুই ভাইপো।”

সুকুমার বলল, “আমি যা শুনলাম, দু’জনেরই বেশ নামডাক আছে পাটনা শহরে। দু’জনেই পাকা লোক। ফেমাস। তবে রাজালাল পয়লা নম্বর ধড়িবাজ। টাকা-পয়সাও যথেষ্ট করেছে। হীরালাল ধূর্ত হলেও ভদ্রলোক। সে গয়া-পাটনা লাইনে বিশাল জায়গা নিয়ে ফার্মিং করে। পাটনার কাছাকাছি।”

যোগেন সিগারেট বার করল। আমরা হাত বাড়ালাম। প্রিয়গোপাল নস্যিখোর, তবে এক-আধটা সিগারেট সে খায়।

গদাইকে চা আনতে বলা হল।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর যোগেন বলল, “ব্যাপারটা তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে? মানে, প্রবলেমটা কী, কোথায়?”

সঙ্গে-সঙ্গে কথার জবাব দেওয়া গেল না। শেষে প্রিয়গোপাল বলল, “প্রবলেম একটা পুরনো বই নিয়ে। ওই বইয়ে এমন কিছু ছিল যা আজ বিশেষ দরকারি হয়ে পড়েছে। রাজালাল আর হীরালাল, দু’জনেই খুঁজে বেড়াচ্ছে বইটা। তার জন্যে টাকা খরচ করতে কারও আপত্তি নেই। অন্তত রাজালালের। এমনকী, শাসাতেও সে পিছপা নয়।”

“কী থাকতে পারে বইটায়?”

“কেমন করে বলব? চোখে তো দেখিনি। কেমন তার চেহারা তাও জানি না। বাবা বইটা সম্পর্কে ভালো করে কিছু মনে করতে পারল না। বইটা মোটা, ছবি আছে অজস্র, এইটুকু যা মনে করতে পারে। আর বলছিল, বাঁধাই খুব ভালো ছিল। সেকালের বই।”

“তারকদা বলতে পারছে না? সে তো বই নাড়াচাড়া করে।”

“না, তারকদাও পারছে না। বাবা না পারলে তারকদা কেমন করে পারবে। দোকানে কাজ করতে-করতে তারকদা যা শিখেছে। তা বলে বইয়ের মেরিট, কী রয়েছে বইয়ে, এসব কেমন করে বলবে।”

ভেবেচিন্তে যোগেন বলল, “আমরা সবাই মিলে একদিন দোকানের বই নামিয়ে ধুলো ঝেড়ে দেখি না, বইটা পাই কি না! বিক্রি যদি না হয়ে গিয়ে থাকে, নিশ্চয় পাব।”

প্রিয়গোপাল মাথা নাড়ল। “পাবি না। আমি মোটামুটি সব দেখেছি।”

“মোটামুটিতে চলবে না প্রিয়, গোরুখোঁজা করে খুঁজতে হবে। তাতেও যদি না পাই, তবে বুঝতে হবে বইটা দোকান থেকে হয় হারিয়েছে, না হয় চুরি গিয়েছে। এছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। বিক্রি হয়নি যখন, তখন বই কি পাখা মেলে উড়ে যাবে?”

কথাটা ঠিকই। বইটা দোকান থেকে উড়ে যেতে পারে না।

প্রিয়গোপাল বলল, “বেশ, তা হলে একদিন সবাই মিলে লেগে পড়। কিন্তু দেরি করলে চলবে না। রাজালাল ওরফে “বিল্লি’ আমায় পনেরো দিন সময় দিয়েছিল। তার মধ্যে দশ-বারোদিন কেটে গেল।”

আমি বললাম, “তোকে আর ফোন করেনি ? ”

“না।”

সুকুমার বলল, “রাজালালকে ধাপ্পা মেরে দোকানে ডাক না। তারপর বাবাজিকে ধরা যাবে।”

“তাতে লাভ? একটা লোক বইয়ের খোঁজ করছে বলে তাকে ধরে তুই কী করতে পারিস? ওটা কাজের কথা নয়।” বলে একটু চুপ করে থেকে প্রিয় আবার বলল, “তার চেয়ে ভালো হয়, যদি রাজালালের একটা হদিস করতে পারি। লুকিয়ে।”

“আর হীরালালের?”

“তাকেও ট্রেস করতে হবে। দু’জনেই বোধহয় এখন কলকাতায় আছে। নয়তো দোকানে আসত না, ফোন করত না, বেনামা চিঠি দিত না।”

আমি সুকুমারকে বললাম, “তুই পাটনা থেকে খবর অনেক এনেছিস। ওই দু’জনকে দেখেছিস পার্টনার বাড়িতে?”

“না।” মাথা নাড়ল সুকুমার।

হঠাৎ আমার কী মনে হল, বললাম, “জজবাবুর ক’ ছেলে?”

“এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ে এলাহাবাদে থাকে। ছেলে পাটনাতেই থাকে, পাটনা সেক্রেটারিয়েটে অফিসার।”

“নাম?”

“জীবনলাল। শুনলাম, মানুষ খারাপ নয়।”

যোগেন মাথার চুল ঘাঁটতে-ঘাঁটতে বলল, “না, এভাবে বসে থাকার কোনও মানে হয় না। এবার লেগে পড়া দরকার। রহস্য ঘনীভূত হয়ে গেছে।” বলে হাসল। তামাশা করাটা তার স্বভাব। “এখন আমাদের হাতে দুটো কাজ। এক, দোকান সাফ করে বইটা খোঁজা, আর দুই, রাজালালের পাত্তা লাগানো।”

“কেমন করে লাগাবি?”

“ফোন নম্বর দিয়েছে। ওটা হয়তো ওর নিজের নম্বর নয়। তবু ওই নম্বর ধরে রাজাবাবুকে ট্রেস করতে হবে। টেলিফোন অফিসে আমার চেনা লোক আছে।”

আমার যেন মনে হল, অন্যভাবেও খোঁজ করার চেষ্টা করা যেতে পারে। রাজালাল যখন ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা করে, তখন নিশ্চয় কলকাতায় তার অফিস আছে, নাহয় কোনও ট্রান্সপোর্ট কম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ আছে। আমি বললাম, “টেলিফোন গাইড দেখে ট্রান্সপোর্ট কম্পানিগুলোর নাম-ঠিকানা ফোন-নাম্বার খুঁজে বার কর তো। দেখা যাক রাজালালের হদিস পাওয়া যায় কি না।”

প্রিয়গোপাল বলল, “তোর মাথা খারাপ হয়েছে। কলকাতায় কয়েকশো ট্রান্সপোর্ট কম্পানি, ওর মধ্যে খোঁজা কি চাট্টিখানি কথা! তা ছাড়া রাজালাল যে ট্রান্সপোর্ট কম্পানির ফোন-নাম্বার দেবে, তোকে কে বলেছে?”

আমি বললাম, “দেখতে দোষ কিসের? ঠিক আছে, আমি খুঁজব। …কাল তোরা দোকান নিয়ে পড়। আমি টেলিফোন গাইড নিয়ে পড়ব।”

যোগেন রাজি হয়ে গেল। সুকুমারের অসুবিধে ছিল সামান্য, সে বলল, তার আসতে দুপুর হবে।

গদাই চা নিয়ে দোকানে ফিরল।

পাঁচ

বরাতজোর বলে একটা কথা আছে। হয় আমার, না হয় প্রিয়গোপালের। বরাত ভালো। টেলিফোন গাইডের ওই গন্ধমাদন ঘাঁটতে ঘাঁটতে রাজালালের দেওয়া নম্বরটা পেয়ে গেলাম। আমি যা অনুমান করেছিলাম—তাই। ট্রান্সপোর্ট কম্পানির নম্বরগুলোই হাতড়াচ্ছিলাম। হাতড়াতে হাতড়াতে বি. বি. রোড ট্রান্সপোর্ট কম্পানির নামের পাশে রাজালালের দেওয়া ফোন-নম্বরটা পাওয়া গেল। সঙ্গে-সঙ্গে লাফ মেরে চেঁচিয়ে উঠে বললাম, “প্রিয়, পেয়েছি। মিল গিয়া। রাজাবাবুর পাত্তা পেয়ে গিয়েছি।”

প্রিয়গোপালরা তিনজনে মিলে বই ঘাঁটছিল। তাদের বই ঘাঁটা শুরু হয়েছে দুপুর থেকে। এখন প্রায় সন্ধে হতে চলল। আমাকেও কম করে ঘণ্টা দেড়-দুই টেলিফোনের গোবদা বইটা হাতড়াতে হয়েছে। চোখ টনটন করছিল।

আমার চিৎকারে প্রিয়গোপালরা বই ঘাঁটা থামিয়ে আমাকে দেখতে লাগল। আমি বললাম, “এদিকে আয়। দ্যাখ তুই যে ফোন-নাম্বার দিয়েছিস, মানে রাজালালের দেওয়া ফোন নাম্বার, সেটা হল বি. বি. রোড ট্রান্সপোর্ট কম্পানির।”

বই ঘাঁটা ফেলে রেখে প্রিয়গোপাল এগিয়ে এল। “পেয়েছিস?”

“এই দ্যাখ”

দেখল প্রিয়গোপাল। বলল, “আরে, এ তো চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনুর ঠিকানা। দাঁড়া, দাঁড়া, আমি মনে করতে পারছি যেন। হ্যাঁ, ওদিকে, তোর ওই ফায়ার ব্রিগেডের কাছে—এপাশে ওপাশে কয়েকটা ট্রান্সপোর্ট কম্পানির অফিস আছে।”

“তা হলে একবার ফোন করা যাক”

“আমি?” প্রিয়গোপাল যেন থমমত খেয়ে গেল। বুঝে উঠতে পারল না, তার ফোন করা উচিত হবে কি না!

সুকুমার আর যোগেনও ততক্ষণে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

আমি কী ভেবে বললাম, “যোগেন, তুই এখানে একটা ফোন কর। বি. বি. ট্রান্সপোর্ট কম্পানি। এমনভাবে ফোনটা করবি যেন তুই ব্যবসার কথা বলছিস। মাল পাঠাবার ব্যাপারে কথা বলতে চাস। বুঝলি?”

“তা বুঝলাম। কিন্তু কাকে ফোন করব? কোন ধরনের মাল পাঠাবার কথা বলব?” “রঙ। তোর যা লাইন।”

“ও. কে.। কাকে করব?”

“কম্পানিতেই করবি। কবে দু’চার কথা বলার পর কায়দা করে রাজাবাবুর কথা তুলবি। এমনভাবে তুলবি, যেন সন্দেহ না করে। তারপর ঘুরিয়ে রাজালালের ঠিকানাটা জেনে নিবি। কলকাতার ঠিকানা। মগজে গেল?”

মাথা হেলাল যোগেন। বুঝেছে। “নে, তা হলে ফোন তোল।”

“প্রিয় ফোন করলে ভালো হতো না? আমি তো রাজালালের গলা চিনতে পারব না।”

“তোকে রাজালালের গলা চিনতে হবে না। আর, আমিও চাই না ও ফোন করুক। বাইচান্স রাজালাল যদি সেখানে থাকে, ফোনটা ধরে, প্রিয়র গলা চিনতে পেরে যায়, সব বরবাদ হয়ে যাবে। একেবারে থার্ড পার্টি হয়ে তুই ফোন করবি।”

যোগেন একবার আমাদের দিকে তাকিয়ে হাতটা ঝাড়নে মুছে নিল। বই ঘাঁটার সময় ওদের হাতে ঝাড়ন ছিল।

সুকুমার বলল, “জয় মা কালী। নে যোগেন, লেগে যা।”

যোগেন ফোন তুলল। ডায়াল করল। লাইন পেল না। একবার, দু বার, তিন বার। চার বারের বার নম্বর পাওয়া গেল।

আমরা ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

“হ্যালো বি. বি. রোড ট্রান্সপোর্ট …! হাঁ-হাঁ-হাঁ- জি!” বলে আড়চোখে আমাদের দিকে তাকাল, ইশারায় বোঝাল, ও-পাশে কোনও অবাঙালি ফোন ধরেছে।

যোগেন কথা বলতে লাগল। আমরা কান খাড়া করে শুনতে লাগলাম। গলার স্বরটাকে যতটা পারে ভারিক্কি আর ব্যবসাদারের মতন করে কথা বলছিল ও। হাজার হোক রক্তে ওর ব্যবসা রয়েছে, ব্যবসায়িক কথাবার্তা বলতে না-পারবে কেন? তবে হিন্দি বুলি ঠিক বলতে পারছিল না, আর যা বলছিল তা দোকানপত্রে আচার চলে।

“হাঁ জি, পেইন্টস টোটাল মালুম সাত ড্রাম … সেভেন ড্রামস … ফিফটি কে. জি. ড্রামস। শ’সোয়া শ’লিটার লিকুইড পেইন্টসভি হ্যায়। কাল মর্নিংমে তো নেহি হোগা।” রং পাঠাবার কথা বলতে বলতে ঝপ করে যোগেন রাজালালের কথা তুলল। আফটার টু… দো বাজে জরুর।” এমনভাবে তুলল যেন ব্যবসাপত্রের ব্যাপারেই কথা বলছে। “রাজাবাবুকে সাথ থোড়া কুছ কাম থা। ভেরি আর্জেন্ট। অ্যাড্রেস তো থা … মাগর …ছুঁড়নে পড়ে গা। আপ থোড়া মেহেরবানি…।” যোগেন কথা শেষ করল না। চুপ করে গলে। তারপর তার মুখ যেন দপকরে জ্বলে উঠল। “হাঁ, হাঁ, নাউ আই রিমেমবার … ইয়েস, এগারা নাম্বার, সার্কাস অ্যাভিনু। এগারা? একাইশ টুয়েন্টি ওয়ান? জি! আচ্ছা ঠিক হায়। থ্যাংক ইউ! … টুমরো উইদিন টুটুমরো উইদিন টু … হাঁ জি, হাঁ ক্যালকাটা টু পাটনা নমস্তে …।”

যোগেন ফোন নামিয়ে রাখতেই আমরা চেঁচিয়ে উঠলাম। যোগেন নাচতে লাগল। বলল, “আরেব্বাস, গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল ভাই। তবে যে ফোন ধরেছিল, সে বোধহয় ছেলে ছোকরা হবে। গলা শুনে তাই মনে হল। যাকগে, রাজালালের পাত্তা পাওয়া গেল।”

প্রিয়গোপাল বলল, “শংকর, তোর আন্দাজে ছোঁড়া ঢিল দারুণ লেগে গেছে রে! ….কিন্তু বইটা তো পাচ্ছি না।”

সুকুমার বলল, “আর একটু বাকি আছে কাজ, হয়ে যাক। গদাই, চায়ের ব্যবস্থা করো। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।”

ওরা আবার বইয়ের গাদা ঘাঁটতে ওপাশে চলে গেল।

সাড়ে সাতটা বেজে গেল। এবার দোকান বন্ধ করার পালা।

গদাই আর প্রিয়গোপাল দোকান বন্ধ করল।

আমরা চার বন্ধু রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। চারজনেরই বাড়ি কাছাকাছি পাড়ায়। আমার হল বিডন স্ট্রিট। সুকুমার থাকে বিদ্যাসাগর স্ট্রিটে। যোগেন আর প্রিয়গোপাল গড়পারে।

চারজনে হাঁটতে হাঁটতে আমহার্স্ট স্ট্রিটের মুখে এসে দাঁড়ালাম। আজ চমৎকার বাতাস দিয়েছে। দক্ষিণের হাওয়া। রাস্তাতেও ভিড় কমেছে।

হাঁটতে-হাঁটতে প্রিয়গোপাল বলল, “রাজালালের ঠিকানা না-হয় পাওয়া গেল!

তারপর?”

তারপর কী তা অবশ্য আমার জানা ছিল না।

সুকুমার বলল, “সটান হাজির হলেই হয় লোকটার কাছে।”

“হাজির হব ওর কাছে! বলছিস কী?”

যোগেন বলল, “আমার মনে হয় রাজাবাবু যে-পাড়ায় থাকে, সেই পাড়ায় একবার খোঁজ লাগনো দরকার। লোকটা কতদিন ওই বাড়িতে আছে, কার বাড়ি, কে কে থাকে বাড়িটায়, রাজাবাবু কী করেন ওখানে বসে, মানে ডিটেল ইনফরমেশান জেনে নেওয়া দরকার।”

আমি বললাম, “ওটা আমাদের বেপাড়া। খোঁজখবর নেওয়া মুশকিল।”

“চেষ্টা করতে হবে,” যোগেন বলল, “আমাদের এত বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়—সামান্য একটা খোঁজ নিতে পারব না?”

সুকুমার বলল, “পারতে পারতে রাত কাবার হবে। তার চেয়ে থানায় গিয়ে একটা ডায়েরি লিখিয়ে দে।”

প্রিয়গোপাল বলল, “তুই কী বাজে বকছিস, সুকু! থানায় গিয়ে ডায়েরি লেখাব? কিসের জন্য? কেন? রাজাবাবু আমাকে শাসাচ্ছে, এটা কি ডায়েরিতে লেখাবার কথা হল? প্রমাণ কী যে শাসাচ্ছে?”

“তুই তো বলেছিস, শাসিয়েছে।”

“বলেছি। কিন্তু সেটা প্রমাণ করা যাবে না। একটা বইয়ের জন্যে কেউ যদি জোর তাগাদা দেয়, বা ধমকায়, সেটাকে তুই শাসানো বলে থানায় গিয়ে চালাতে পারিস না।”

কথাটা ঠিক। থানায় গিয়ে ডায়েরি করা চলে না এই তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে। তা হলে? কী করা যায় আলোচনা করতে করতে আমরা কেশব সেন স্ট্রিটের মুখ পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম।

আচমকা আমার মনে হল, সার্কাস অ্যাভিনুতে না হলেও কাছাকাছি জায়গায় আমার মামাতো ভাই অজয়ের স্টুডিও। ছবি তোলার স্টুডিও। অজু ভালো ফোটোগ্রাফার। বছর দুয়েক হল দোকানটা করেছে। অজুর কাছে গিয়ে বললে সে একটা খোঁজখবর যোগাড় করে দিতে পারে।

“প্রিয়, মাথায় একটা মতলব এসেছে,” আমি বললাম, “আমার মামাতো ভাইয়ের ফোটো স্টুডিও আছে ওই পাড়ার কাছাকাছি। রাজালালের খবরটা আমিই যোগাড় করার চেষ্টা করব।”

“তুই করবি?”

“হ্যাঁ। চেষ্টা করে দেখি।”

“কর তা হলে। তবে সিক্রেটলি করবি। ওরা সুবিধের লোক বলে মনে হচ্ছে না। ধরা পড়ার মতন কিছু করিস না। মানে, রাজাবাবু যেন জানতে না পারে, আমরা তার খোঁজখবর করে বেড়াচ্ছি।”

সুকুমার বলল, “একটার পাত্তা তো পাওয়া গেল, আরেকটার পাত্তা কেমন করে পাওয়া যায়? হীরালালের অ্যাড্রেস কী? সেও তো কলকাতায় আছে।”

যোগেন সুকুমারকে ধমক মেরে বলল, “দাঁড়া! এক বাবুকেই ঠিকমতন ধরতে পারছি না তো হীরাবাবু! হবে, পরে হবে। টিকি ধরতে পারলে মাথাও আসবে।”

আমরা হেসে উঠলাম।

সুকিয়া স্ট্রিটের আগেই সুকুমাররা দাঁড়িয়ে পড়ল। তারা যাবে ডান দিকে। “চলি রে?… কাল দেখা হবে।”

আমি বললাম, “কাল আমি আসছি না। রাজালালের খোঁজে যাব। পরশু দিন দেখা হবে।”

ছয়

আমি বরাবরই ঘুমকাতুরে। রাত্রে বিছানায় শুয়ে আধ ঘণ্টাও জেগে থাকতে পারি না। কিন্তু কোনও কারণে যদি ঘুম চটে যায়, তা হলেই আমার মাঝরাতের আগে আর চোখের পাতা বুজোতে পারব না।

ঠিক ওই ব্যাপারটাই হল। রাত্রে বিছানায় শুয়ে রাজালালের কথাই মনে পড়ে গেল। কাল আমার অজু, মানে আমার মামাতো ভাই অজয়ের কাছে যাবার কথা। রাজালাল সম্পর্কে খোঁজখবর করতে হবে। কালকেই যে বিশেষ কিছু জানতে পারব তা মনে হয় না। অজুকে সময় দিতে হবে খোঁজ করার জন্যে।

রাজালাল, হীরালাল, ফোন, চিঠি, বই…এ-সব ভাবতে ভাবতে মাথাটা কেমন গরম হয়ে উঠল। না, রাগে গরম নয়, পাঁচ কথা ভাবতে ভাবতে যেমন ভাবনাগুলো ফেনিয়ে ওঠে, সেই রকম হল। ঘুমও পালাল। কিছুতেই আর মাথা ঠাণ্ডা করতে পারলাম না।

পারলাম না যখন, তখন অকারণ আর চেষ্টাও করলাম না। তার চেয়ে পুরো ব্যাপারটাকে এবার গুছিয়ে, ছোট করে ভাববার চেষ্টা করতে লাগলাম।

আসল ব্যাপারটা কী? একটা বই শ’খানেক বছরের পুরনো বই। বইটা কি এমন যে, তার বিষয়-গুরুত্বের জন্যে রাজালাল আর হীরালাল ঝাঁপিয়ে পড়েছে? মনে হয় না। রাজালাল করে ট্রান্সপোর্ট-এর ব্যবসা, হীরালাল করে ফার্মিং, চাষবাস। এদের পেশা থেকে মনে হয় না—তারা পণ্ডিত বা গবেষক। বইটার সম্পর্কে এই দুই ভাইয়ের সমান উৎসাহ কেন? কেন তারা খুঁজে বেড়াচ্ছে বইটা?

শার্লক হোমস না হয়েও বলা যায়, বইটার মধ্যে এমন কিছু আছে যা রীতিমতন গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কী থাকতে পারে? কী থাকতে পারে, সেটা আপাতত বোঝা যাচ্ছে না, অনুমান করাও যাচ্ছে না। কাজেই কী আছে বইটায়, সেটা পরে বিবেচ্য। এখন দেখা যাক, বইটা কোথা থেকে এল? কেন এল?

বইটা এসেছে পাটনার এক রিটায়ার্ড জজসাহেবের কাছ থেকে। এই জজসাহেব রাজালাল আর হীরালালের কাকা। অর্থাৎ এখন যারা বইটা খোঁজ করছে, আর ক’বছর আগে যিনি বইটা বেচেছেন তাঁরা একই পরিবারের লোক। একই বাড়ি থেকে বইটা এসেছে।

বইটা যদি এতই জরুরি, গুরুত্বপূর্ণ, বহুমূল্য হয়ে থাকে তাহলে জজসাহেব কেন বইটা বেচে দিতে চেয়েছেন? তিনি কি গুরুত্বটা জানতেন না? ধরে নেওয়া যাক, জানতেন না। কিন্তু প্রয়োজন নেই, এমন কত বই জজসাহেব বেচেছেন? প্রিয়গোপাল বলেছে, গোটা পাঁচেক বই তারা কিনেছিল। মানে তাদের দোকানে এসেছিল। জজসাহেবের লাইব্রেরিতে কি বিক্রি করার মতন পাঁচ দশটা বই ছিল? হতেই পারে না। হয়তো অন্য কোনও দোকানেও কিছু বেচে দিয়েছেন। তবে জজবাবু আর যে কটা, চার কি পাঁচটা বই বিক্রি করছেন প্রিয়দের—সেই বইগুলোর জন্যে তো রাজালালরা দোকানে আসছে না? তাহলে?

আর এটাও বড় আশ্চর্যের কথা, জজসাহেব বই বিক্রি করেছেন বছর চার-পাঁচেক আগে। তিনি মারা গিয়েছেন গত বছর। জজসাহেব বেঁচে থাকতে, বা তিনি মারা যাবার পর পর কেন রাজালালরা বইটার খোঁজ করতে আসেনি?

আবার মজা দ্যাখো, যে-বই নিয়ে এত খোঁজাখুজি, চার পাঁচ হাজার টাকা দর উঠে যাওয়া সেই বইটাই দোকানে নেই। বিক্রিও হয়নি। বইটা তা হলে গেল কোথায়?

কে হাতাল?

দোকান থেকে বই হাতাবার লোক কে হতে পারে? কাকাবাবু নয়, প্রিয় নয়। অন্য যারা থাকল, তারা হল তারকদা আর গদাই। তারকদা পুরনো, বিশ্বস্ত লোক দোকানের। গদাই বেচারি বাংলা হরফ ছাড়া কিছু জানে না। এদের মধ্যে সন্দেহ যদি করতেই হয়, তারদকাকে করতে হয়।

হঠাৎ, একেবারেই আচমকা আমার মনে হল, সত্যি তো তারকদা এই সময় হুশ করে উধাও হল কেন? কেন কিছু জানিয়ে গেল না কাকাবাবুকে বা প্রিয়কে? কেন? কেন? তবে কি ওই বইটা পাচার করার ব্যাপারে তারকদার হাত আছে?

কথাটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রিয়গোপালকে বললে সে বিশ্বাস করবে না। কাকাবাবুও করবেন না। তারকদা এতই বিশ্বস্ত এবং কাজের লোক যে, তাকে সন্দেহ করা যায় না। কাকাবাবুর অসুখের সময় থেকে তারকদাই তো দোকান চালাচ্ছে। প্রিয়গোপাল কী বোঝে, কতটুকুই বা বোঝে!

তবু, কথাটা একবার প্রিয়গোপালের কাছে তোলা দরকার।

কতটা রাত হয়েছে বুঝতে পারছিলাম না; অবসাদ লাগছিল। বড় বড় হাই উঠতে লাগল। ঘুম পাচ্ছে। ঠিক এই সময় আচমকা এক দৃশ্য আমার চোখের তলায় ভেসে উঠল। দেখলাম, বুড়োমতন একটা লোক—মাটি খুঁড়ছে। এ-পাশে ও-পাশে বাগান। বুড়ো মানুষটা মাটি খুঁড়ে তার মধ্যে নেমে গেল। ব্যস, তারপরই মাটি চাপা পড়ে গেল।

ভয়ে প্রায় চমকে উঠেছিলাম। চোখ মেলে তাকালাম। ঘরভরা অন্ধকার; খোলা জানলা দিয়েও কোনওরকম আলো আসছে না। একেবারে নিস্তব্ধ সব। বাড়ি, গলি কোথাও কোনও শব্দ নেই।

ওই বুড়ো মানুষটি যে জজসাহেব অবনীভূষণ রায়, তা বুঝতে আমার কষ্ট হল না। অবনীভূষণকে আমি দেখিনি, আমরা কেউ দেখিনি। না দেখলেও কল্পনায় এক অবনীভূষণ এসে গিয়েছিলেন। তাঁকেই দেখলাম।

আশ্চর্য কাণ্ড! সুকুমার বলেছে, জজসাহেবের নাকি মাটি খুঁড়ে সেই গর্তের মধ্যে বসে সাধনা করার খেয়াল চেপেছিল মাথায়। তিনি এক-এক জায়গায় মাটি খুঁড়তে ন আর তার মধ্যে ধ্যনস্থ হয়ে বসতেন। একদিন মাটি চাপা পড়ে মারা গেলেন।

সুকুমার বলেছে, ইচ্ছামৃত্যু। ঠাট্টা করে বলেছে। ইচ্ছামৃত্যু বলে কিছু নেই। পুরাকালে হয়তো ছিল। একালে নেই। তবে আত্মহত্যা আছে।

আত্মহত্যা কথাটা মাথায় আসতেই আমি ভয়ে যেন কেমন এক শব্দ করে উঠলাম। জজসাহেব কি আত্মহত্যা করেছিলেন? কিন্তু ও-ভাবে কেউ আত্মহত্যা করে বলে শুনিনি। আত্মহত্যা করতে হলে লোকে বিষ খায়, গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়ে, নদীতে গিয়ে ঝাঁপ মারে। এ-ভাবে কেউ আত্মহত্যা করে না।

জজসাহেবের মারা যাবার মধ্যে কী রহস্য আছে কে জানে !

পরের দিন অজয়ের স্টুডিওতে যেতেই সে আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলল, “আরে শংকরদা, এসো এসো। কী ব্যাপার গো তোমার? পথ ভুলে এসে পড়েছ?”

আমি হাসলাম। অজুর স্টুডিও আগে দেখেছি। মোটামুটি চেহারা ছিল, এখন ভালোমতনই সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে। আলো, কাচের দরজা, বড়-বড় ফোটো, শো-কেস, চার দিকেই একটা ঝকঝকে ভাব।

“তোর সঙ্গে একটা জরুরি দরকার আছে,” আমি বললাম।

অজু কিসের একটা বিল করছিল, হাত-কয়েক তফাতে ছোকরা-বয়েসী একজন দাঁড়িয়ে। দোকানের একপাশে কয়েকটা হালকা চেয়ার। দুটি মেয়ে বসে রয়েছে। দিদি আর বোন বলেই মনে হয়।

অজু বলল, “এক মিনিট…।” বলে বিল লেখা শেষ করল। করে পাশের ছেলেটিকে বলল, “একুশ টাকা ষাট পয়সা।…প্রিন্টগুলো গুছিয়ে দিয়ে দিস। চলো শংকরদা।”

দোকানের মধ্যেই আর-এক চিলতে আলাদা ঘর। সব দিক আড়াল করা। “বোসো,” অজু বলল, “বাড়ির খবর কী? সেদিন পিসি এসেছিল শুনলাম। মেজদার বিয়ের কথা হচ্ছে।”

“হ্যাঁ। তবে দেরি আছে। বর্ষার আগে নয়।…শোন, আমি একটা অন্য কাজে এসেছি। খুব জরুরি কাজ।”

“বলো।”

“এই এরিয়ার কাছাকাছি এক ভদ্রলোক সম্পর্কে আমার কিছু ইনফরমেশান দরকার।” “এই এরিয়া? কী নাম, কত নম্বর বাড়ি।”

রাস্তার নাম, বাড়ির নম্বর, রাজালালের নাম বললাম।

অজু বলল, “সার্কাস অ্যাভিনু হল তোমার ওদিকটায়। একটা বড় গ্যারাজ আছে দেখেছ? পাশে ব্যাংক। তার পাশ দিয়ে রাস্তা…।”

“আমি ওদিকে যাইনি কখনও। তুই খবর করে দিতে পারিস?”

“আরে, এটা একটা কাজ?…দাঁড়াও…আমার সোলজারকে ডাকি।”

চেয়ার ছেড়ে উঠে পার্টিশানের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল অজু। দরজা ফাঁক করে ডাকল, “শ্যমা… শোন”

আবার চেয়ারে এসে বসল অজু। “শ্যামাদাস; আমার সোলজার। দারুণ ছেলে। ওকে দেখলে কিছু বুঝবে না, শংকরদা। শ্যামা এদিককার পাড়ার মস্তানদের কাছে পপুলার।”

“মস্তান নাকি?”

“না। তবে ভাবসাব রাখে। বোঝোই তো, দোকানে একজন জবরদস্ত লোক না রাখলে এখানে বসা যাবে না।”

শ্যামাদাস এল। অজুর সোলজার। ছেলেটি মাথায় লম্বা, রঙ কালো, শক্ত গড়নের চেহারা।

“শ্যামা, আমার দাদা শংকরদা। পেন্নাম কর।”

আমি বাধা দেবার আগেই শ্যামাদাস পায়ে হাত ঠেকিয়ে দিল।

“শ্যামা,” অজু বলল, “সার্কাস অ্যাভিনু তোর এরিয়া?”

শ্যামাদাস যেন লজ্জা পেল। একবার আমার দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, “না।” “সার্কস অ্যাভিনুর একটা বাড়ির নম্বর দিলে বাড়ির লোকের খবর বার করতে পারবি?”

শ্যামাদাস এমন মুখ করে হাসল, যেন এটা কোনও কাজই নয়।

“শংকরদা, ওকে বাড়ির নম্বর, নামধাম দিয়ে দাও। তোমার কোনও চিন্তা নেই, খবর পেয়ে যাবে।”

আমি রাজালালের বাড়ির নম্বর দিলাম; মানুষটা কেমন দেখতে তাও আভাসে বলে দিলাম। অবশ্য রাজালালকে আমি একবারই দেখেছি, প্রিয়গোপালের দোকানে।

“অজু, ব্যাপারটা কিন্তু গোপন রাখতে হবে। মানে রাজালালের খোঁজখবর হচ্ছে যেন জানতে না পারে।”

“শ্যামা, শুনলি?”

“পারবে না জানতে।”

“কবে খবর পাব?”

‘একটা দিন হাতে থাক। পরশু দিন। ”

“বেশ। আমি পরশু আসব।”

শ্যামাদাস ঘর ছেড়ে চলে গেল।

 অজু বলল, “কী ব্যাপার শংকরদা, তুমি পুলিশে চাকরি নিয়েছ?”

“না রে, থানা-পুলিশে আমার অ্যালার্জি আছে। এ একটা অন্য কেস।” “ডিফিকাল্ট কেস হলে আমায় বলো। লোকাল থানার ছোটবাবু দত্ত আমার বন্ধু। দত্তর ফোটোগ্রাফির শখ। মাঝে-মাঝে দোকানে এসে আড্ডা জমায়।”

খবরটা শুনে যেন ভরসা বাড়ল। তেমন কোনও বিপদে পড়লে পুলিশের শরণাপন্ন হতেই হবে। তবে এখন তার সময় নয়।

আরও খানিকটা বসে আমি উঠে পড়লাম।

রাস্তায় এসে মনে হল, রাজালালের বাড়ি তো তেমন দূর বলে মনে হচ্ছে না, মিনিট দশেকের পথ। বাড়িটা তফাত থেকে একবার দেখে গেলে মন্দ হয় না। আমার ভয়-ডরের কিছু নেই, আমি প্রিয়গোপাল নই, বাড়িটার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালেও কেউ আমায় সন্দেহ করতে আসছে না। হ্যাঁ, রাজালাল আমাকে প্রিয়দের দোকানে দেখেছে। কিন্তু সরাসরি নয়। প্রিয় উঠে গিয়ে কথা বলছিল তফাতে, আমি তার টেবিলের কাছে বসে যোগেনের সঙ্গে গল্প করছিািলম। এমনও হতে পারে, রাজালাল আমায় লক্ষ করেনি।

হাঁটতে হাঁটতে খানিকটা এগিয়ে গেলাম। পাড়াটায় হই-হল্লা নেই। বেশির ভাগ বাড়িই বড় বড়। খুব পুরনো নয়। ফ্ল্যাটবাড়িই বেশি বলে মনে হল। রাস্তাটাও চওড়া। রাস্তার পাশে গাছপালাও নষ্ট হয়নি। দোকানপত্র কম। একটা নার্সিং হোম রয়েছে

তে-মাথার কাছে।

আরও খানিকটা হেঁটে আসতেই গ্যারাজ আর ব্যাংকের সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। ফুটপাথ বদলে নিয়ে সামান্য এগুতেই রাজালালের বাড়ির নম্বর পেয়ে গেলাম।

বাড়িটা অন্যরকম। সামনে ফটক। ফটকের পর খানিকটা জমি। দু চারটে সুপুরি আর ঝাউগাছ। তারপর সিঁড়ি। সিঁড়ি উঠে বারান্দায়।

বাড়িটার গড়ন যেন থিয়েটারের স্টেজের মতন। আধাআধি গোল ধরনের বাড়ি। বাইরে প্লাস্টার নেই। ইটের ওপর প্লাস্টার ধরানো হয়নি। তবে রং রয়েছে, ইট-রং। বাড়িটা দোতলা। নীচে একটা পুরনো বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। লোকজন তেমন চোখে পড়ল না। দু’একজনকে যেটুকু চোখে পড়ল, মনে হল, তারা দারোয়ান, গাড়ির ড্রাইভার বা কাজের লোক।

অনর্থক দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। বাড়িটা চিনে নেওয়া গেল, আপাতত এই যথেষ্ট।

ফেরার সময় পকেটে হাত দিয়ে দেখি সিগারেটের প্যাকেট অজুর স্টুডিওতে ফেলে এসেছি।

কাছাকাছি একটা দোকান অবশ্য আছে, ছোটখাটো চায়ের দোকান। তার পাশে একটা লোক ফেরিঅলার মতন বসে বসে পান সিগারেট বিক্রি করে।

সিগারেট কিনতে লোকটার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই রাস্তার আলো নিভে গেল। লোডশেডিং। অন্ধকার তখনও জমাট বাধেনি। ফাল্গুন মাসের শেষ। ছায়া ঘন হয়ে এসেছে।

সিগারেট কিনে দেশলাই জ্বালছি চোখে পড়ল, রাজালালের গাড়ি বাড়ি থেকে বের করে রাস্তায় এনে দাঁড় করানো রয়েছে। তার মানে রাজালাল কোথাও যাচ্ছ।

দাঁড়িয়ে থাকলাম। নিজের চোখেই একবার দেখে যাই। বাড়িটা যে রাজালালের, সে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে, এটা চোখে দেখলে আর কোনও সন্দেহ থাকবে না । খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরেও দেখি গাড়িটা যেমন ছিল সেই ভাবেই রাস্তায় রাখা রয়েছে। রাজালালের কোনও পাত্তা নেই।

পানের দোকান থেকে সরে গিয়ে আবার একবার দাঁড়ালাম। গাড়িটা যেমনকে তেমন অবস্থায় দাঁড়িয়ে।

ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসছিল। ভাবছিলাম আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই,

রাজালালকে দেখা যাবে না।

কয়েক পা মাত্র এগিয়েছি, হেডলাইটের আলো পড়ল রাস্তায়। মুখ ফিরিয়ে দেখি রাজালালের গাড়ি রাস্তার বাঁ দিক থেকে ডান দিকে পাক মারছে। তারপর হুশ করে বেরিয়ে গেল।

সাত

অফিস থেকে প্রিয়গোপালকে ফোন করলাম। গতকাল তার কাছে গিয়েছিলাম। আজ আর যাওয়া হবে না।

দোকানেই ছিল প্রিয়। বলল, “বল”

“শোন, আমি অজুর স্টুডিও হয়ে ফিরব। তোর কাছে যেতে পারছি না। তোরা আমার বাড়ি চলে আয় দোকান বন্ধ করে। সন্ধের পর আয়। রাজালালের খবর পাবি।” প্রিয়গোপাল ঠাণ্ডা গলায় বলল, “তার আগে আমি একটা খবর দিই। রাজালাল নিজেই ফোন করেছিল।…তার বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছে।”

আমি কেমন থতমত খেয়ে গেলাম। প্রিয় কি তামাশা করছে? তার ঠাট্টার জবাবে আমিও ঠাট্টা করে বললাম, “তোকে একলা?”

“সবান্ধবে।…শোনো ভাই, আমরা ওর কাছে শিশু। তুমি যাও ডালে-ডালে, ও যায় পাতায়-পাতায়।”

“মানে?” এবার আমি চমকে উঠলাম।

“মানে—ট্রান্সপোর্ট কম্পানিতে ফোন করে রাজাবাবুর ঠিকানা জানতে চাওয়ায় সব ক্যাচ হয়ে গেছে!” প্রিয়গোপাল বলল।

আমি এতটা ভাবিনি। তবে হলেও যে হতে পারে, তা না-ভাবার কারণ ছিল না। বললাম, “জেনেছে তো বয়ে গেছে। ও জেনেছে বলে আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকব!…যাক গে, তোরা আমার বাড়ি আয় সন্ধের পর। তখন কথা হবে।”

বাড়ি ফিরতে-ফিরতে আমার সন্ধে হল। খানিকটা পরে প্রিয়গোপালরাও হাজির। ঘরে ঢুকে যোগেন বলল, “শংকর, শুনেছিস তো, রাজালাল আমাদের ডিনারে ডেকেছে। তোকে স্পেশ্যালি…।”

আমি হাসলাম। অবশ্য মরা হাসি।

সুকুমার বলল, “দারুণ ধুরন্ধর ভাই, রাজালাল। চার দিকে আঁটঘাট বেঁধে রেখেছে।” আমি প্রিয়গোপালকে জিজ্ঞেস করলাম, “রাজালাল তোকে কখন ফোন করেছিল?” “কাল।…তুই আর সুকু চলে যাবার পর,” প্রিয়গোপাল বলল। “লোকটা এমন ভাবে কথা বলছিল যেন মজা পেয়েছে। বলল, আমরা নাকি ছেলেমানুষি করছি। বাচপান না টাচপন কী-একটা বলল, ভাই।”

আমার কেমন রাগ হয়ে গেল। বললাম, “যা খুশি বলুক। রাজালালের হুমকিতে আমি ডরাই না। আমিও তার অনেক কিছু জেনেছি।”

যোগেনরা আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।

আমি বললাম, “বেশি বাড়াবাড়ি করলে রাজাবাবুর বাড়িতে পুলিশ ঢুকিয়ে দেব। ও অন্য জায়গায় তড়পাক, আমাদের কাছে নয়।”

প্রিয়গোপাল বলল, “তুই তোর কথা বল! কী জানতে পারলি রাজালাল সম্পর্কে?” রাজালাল সম্পর্কে খোঁজখবর করে যা জানা গিয়েছিল বললাম।

সার্কাস অ্যাভিনুর বাড়িটা রাজালালের কলকাতার বাড়ি। ভাড়া বাড়ি। বছর তিনেক হল বাড়িটা ভাড়া নিয়ে রেখে দিয়েছে। বাড়িতে রাজালালের লোকজন থাকে, মানে ঠাকুর, চাকর, দারোয়ান, ড্রাইভার…আর সরকার গোছের একজন বাবু। এরা কেউ কলকাতার লোক নয়, বাইরে থেকে আনা হয়েছে। পাড়ার মধ্যে বড় একটা মেলামেশা এরা কেউ করে না। মানে, সবাই যেন একটা নিষেধ মেনে চলে।

“আর রাজালাল…,” আমি বলালম, “লোকটা গোড়ার দিকে মাঝেসাঝে কলকাতায় আসত। এখন ঘন-ঘন আসে। মাসে একবার করে তো বটেই। পাড়ার লোকজন ওর কাছ ঘেঁষতে পায় না। লোকটা দাম্ভিক। তবে ধনী মানুষ, পাড়ার যে-কোনও ব্যাপারে সরকার-বাবু মারফতে মোটা চাঁদা দিয়ে পাড়ার লোককেও খুশি করে রেখেছে।”

“বুদ্ধিমান লোক।” সুকুমার বলল।

“হ্যাঁ, বুদ্ধিমান, খুবই বুদ্ধিমান। তবে পাড়ার খবর থেকে দেখা যায়, রাজাবাবুর বাড়িতে একটা গুপ্ত ব্যাপার চলে। রাজালাল যখনই কলকাতায় থাকে, তখন তার বাড়িতে দু’তিনজন অদ্ভুত ধরনের মানুষ আসে। একজন শুনলাম, জটাওয়ালা এক সাধুবাবা। সাধুবাবাকে গাড়ি করে আনতে হয়। আর আসে বেঁটে বোতল-সাইজের একটা লোক। বামন গোছের। অবাঙালি চেহারা। গলায় সোনার চেন। সে আসে তার নিজের গাড়িতে। গাড়ি থেকে নামার সময় তার হাতে একটা ব্রিফকেস থাকে।” যোগেন ঠাট্টা করে বলল, “একদিকে সাধুবাবা, অন্যদিকে বামনবাবা! কম্বিনেশান ভালো।”

“আরও আছে…’ আমি বললাম, “তালগাছের মতন লম্বা এক অ্যাংলোসাহেবও আসে। সে আসে মোটরবাইক করে। তাকে দেখলেই পাড়াসুদ্ধু কুকুর চেল্লাতে শুরু করে। চার নম্বর যে আসে, তার নাম হাতকাটা বাদশা, সে শুনলাম টপগুণ্ডা। এখন রিটায়ার করেছে। তবে দল আছে তার।”

সুকুমার সব শুনে বলল, “রাজালালের পার্শ্বচরদের কথা শোনা গেল, কিন্তু এই লোকগুলো রাজাবাবুর সঙ্গে মিলেমিশে করে কী!”

“সেটা কেউ জানে না।”

“স্মাগলার নাকি রাজালাল?” প্রিয়গোপাল বলল।

“কী, তা আমরা জানি না। হলেও হতে পারে। লোকটা যে সোজা রাস্তায় হাঁটে না, এটা পরিষ্কার।”

কিছুক্ষণ আর কথাবার্তা হল না। যে যার মতন করে ভাবছিল। চা এসেছিল। আমরা চায়ের কাপ তুলে নিয়ে চুমুক দিলাম।

প্রিয়গোপাল বলল, “সবই বুঝলাম, কিন্তু এখন আমাদের কী কর্তব্য?”

“কর্তব্য একটাই…’ আমি বললাম, “রাজালালকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া যে-বইটা সে খুঁজছে, সেটা তাকে দেওয়া যাচ্ছে না।”

“বলেছি তো! শুনছে কোথায়?”

“না শুনলে করার কিছু নেই। তারা যা খুশি করতে পারে। তবে পাটনা থেকে কলকাতায় এসে চালাকি করতে গেলে সে বিপদে পড়বে।”

প্রিয়গোপাল কোনও কথা বলল না।

হঠাৎ আমার তারকদার কথা মনে পড়ে গেল। “তারকদা ফিরেছে?”

“চিঠি দিয়েছে। লিখেছে, মায়ের বাড়াবাড়ি অসুখ শুনে চলে গিয়েছিল।”

বলব কি বলব না করে শেষে আমি বললাম, “প্রিয়, একটা কথা বলব? কিছু মনে করবি না?”

প্রিয়গোপাল নস্যি নিতে-নিতে বলল, “বল?”

ইতস্তত করে বললাম, “একটা ব্যাপার আমাদের করতে হবে। তারকদার সামনে এই ব্যাপার নিয়ে আর কোনও আলোচনা নয়।”

অবাক হয়ে প্রিয়গোপাল আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। “মানে?”

“তারকদার ওপর চোখ রাখা দরকার।”

প্রিয়গোপালের মুখে আর কথা ফুটছিল না। শেষে বলল, “কী বলছিস তুই?

তারকদাকে সন্দেহ করতে হবে?”

“সন্দেহ না করি, তফাতে রাখতে হবে।”

“কেন?”

“কয়েকটা কারণে,” আমি বললাম। “বইটার কথাই ধরা যাক প্রথমে। যে-বই বিক্রি হয়নি, সেই বই দোকানেই থাকার কথা। তারকদাই বইপত্রের খোঁজ রাখে। বইটা যে দোকান থেকে সে সরায়নি, তার প্রমাণ কী?”

প্রিয়গোপাল অসন্তুষ্ট হল। “এ তুই কী বলছিস, শংকর? তারকদার মতন বিশ্বাসী লোক তুই পাবি কোথায়? বাবার ডান হাত ছিল তারকদা। এখন যে দোকানটা চলছে—এও তারকদার জন্যে। আমি কিছুই জানি না দোকানের।”

আমি কী বলব, বুঝতে পারছিলাম না।

হঠাৎ যোগেন বলল, “শংকর, আমি তোর সঙ্গে একমত। একটা জিনিস আমার খারাপ লেগেছে। তারকদার এই আচমকা ডুব দেবার কারণ কী?”

“মায়ের অসুখ!” প্রিয়গোপাল বিরক্ত হয়ে বলল।

“হোক মায়ের অসুখ, তা বলে সে একবার তোদের বাড়িতে গিয়ে কথাটা বলে যেতে পারল না? স্রেফ না বলে-কয়ে ডুব? তুমি যতই যা বলো ভাই, ব্যাপারটা খারাপ!”

প্রিয়গোপাল চুপ করে থাকল।

যোগেন আর সুকুমার নিজেরা তারকদা সম্পর্কে কয়েকটা কথাবার্তা বলাবলি করছিল। তাদেরও একটা জিনিস নজরে পড়েছে। হালে তারকদার ব্যবহার চলাফেরা কেমন যেন খাপছাড়া হয়ে উঠেছে। দোকানে সব সময় থাকে না, মাঝে-মাঝেই দোকান ছেড়ে চলে যায়, প্রিয়গোপালদের কথাবার্তা মন দিয়ে শোনে। সোজা কথা, তারকদা আজকাল যেন খানিকটা তফাতে থাকর চেষ্টা করছে।

প্রিয়গোপাল কোনও কথা বলছিল না। বোধ হয় কথাগুলো তার ভালো লাগছিল না। আমি বললাম, “আমার মনে হয় তারকদাকে একটু নজরে রাখা দরকার। আর তার সামনে রাজলালদের নিয়ে কোনও আলোচনা না করাই ভালো।”

প্রিয়গোপাল মাথা হেলাল।

খানিকক্ষণ আর কথা হল না। যোগেন সিগারেটের প্যাকেট বার করে আমাদের বিলি করল।

সিগারেট ধরানো হয়ে গেলে সুকুমার বলল, “এখন তাহলে কী করা হবে? হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব?”

কী করা যায় আমরা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সকলেই চুপচাপ।

শেষে যোগেন বলল, “রাজালালকে হাতছাড়া করলে আমাদের চলবে না। ওকে যেমন করেই হোক ধরে রাখতে হবে।”

“কেমন করে?” সুকুমার বলল।

“মিথ্যে কথা বলে। ধাপ্পা মেরে। আমার তো মনে হয়, রাজালালকে বলতে হবে বইটার খোঁজ মোটামুটি পাওয়া গেছে। কয়েক দিন সময় লাগবে…।”

“বিশ্বাস করবে রাজালাল?” আমি বললাম।

“না করলে আমাদের কিছু করার নেই। সে নিজেই বলছে, বইটা দোকানে রয়েছে। প্রিয়কে পনরো দিন সময় দিয়েছে বইটা উদ্ধার করে তার হাতে তুলে দেবার জন্যে। এখন যদি সে বিশ্বাস না করে প্রিয়র কথা, না করবে।…আমি বলছি, রাজালাল পুরোপুরি অবিশ্বাস করবে না। একটা চান্স নিতে হবে।”

আট

রাজালালকে কেমন করে বঁড়শি গেঁথে দোকানে হাজির করানো যায়, এই নিয়ে গবেষণা করতে করতে আরও একটা দিন কেটে গেল। রাজালাল ধুরন্ধর, চতুর, বুদ্ধিমান। সে প্রিয়গোপালের মুখের কথায় বিশ্বাস করবে, বইটা পাওয়া গিয়েছে শুনে লাফিয়ে উঠবে—এমন মনে করার কারণ নেই। হয়তো প্রমাণ চাইবে, হয়তো বলবে তার বাড়ি গিয়ে বই পৌঁছে দিতে হবে। আরও কত কী বলতে পারে কে জানে!

শেষে প্রিয়গোপাল বলল, “হীরালালকে দাঁড় করিয়ে দিলে কেমন হয়? মানে, যদি রাজালালকে বলা যায়, হীরালাল বইটার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, প্রায়ই ফোন করছে, আর দর বাড়িয়ে চলছে, তাহলে রাজালাল কি খানিকটা মরিয়া হয়ে উঠবে না?”

আমাদের মনে হল, হীরালালকে একবার দাঁড় করানো যেতে পারে। তবে, ধাপ্পাটা টিকবে কি না বলা মুশকিল। রাজালাল কি অত কাঁচা? আবার এটাও ঠিক, রাজালাল হীরালালের ব্যাপারে সতর্ক। তার ভয়, পাছে হীরালাল বইটা হাতে পেয়ে যায়!

অথচ হীরালাল মানুষটা অদ্ভুত। সে একদিন মাত্র দোকানে এসেছিল, আর একটাই চিঠি লিখেছিল বেনামা। এ-ছাড়া তার কোনও মাথা ঘামানো নেই। কোথায় থাকে সে, কী তার ঠিকানা, প্রিয়গোপালরা জানে না। রাজালালকে মোটামুটি আন্দাজ করা যায় এখন, হীরালালকে যায় না।

তবু মনে হল, প্রিয়গোপাল যা বলছে, এ-ছাড়া পথ নেই।

পরের দিন খানিকটা সন্ধে করেই রাজালালকে ফোন করা গেল। সার্কাস অ্যাভিনুর বাড়িতে ফোন ছিল। খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না।

ফোন করেছিল প্রিয়গোপাল।

ফোন তুলে ও-পাশে সাড়া পেতে-না-পেতেই লাইন কেটে গেল। আবার একবার ডায়াল করল প্রিয়গোপাল।

এবার সে লাইন পেল। লাইন পেল, কিন্তু খানিকটা ঘাবড়ে যাবার জন্যেই বোধ হয় তার কাশি এসে গেল। কাশির দমক সামলে গলা পরিষ্কার করতে করতে প্রিয়গোপাল রাজালালের খোঁজ করল। তার গলার স্বর ভাঙা-ভাঙা, জড়ানো কাশিক দমকে গলা যেন আটকে আছে তখনও।

ওপারে বোধহয় অন্য কেউ ফোন ধরেছিল। প্রিয়গোপাল রাজালালের খোঁজ করল। হঠাৎ দেখি, প্রিয়গোপালের মুখ কেমন ছাইয়ের মতন সাদা হয়ে গেল। ভীষণ চমকে উঠেছে। চোখ দুটো গোল্লা হয়ে গিয়েছে। রিসিভার-ধরা হাতটা কাঁপছিল। গলা দিয়ে আর স্বর ফুটছিল না।

ওপাশে বোধহয় লাইন কেটে গেল। কয়েক মুহূর্ত ফোন কানের কাছে ধরে রাখল প্রিয়গোপাল, তারপর নামিয়ে রাখল।ততক্ষণে প্রিয়গোপালের কপালে গালে ঘাম জমে উঠেছে। ভূত দেখার মতন কাঠ হয়ে বসে আছে।

আমরা ওর দিকে বোবার মতন তাকিয়ে থাকলাম। সুকুমার বলল, “কী হল রে?” প্রিয়গোপাল নিজেকে সামলাচ্ছিল। শেষে ঢোঁক গিলে বলল, “তারকদা।” আমরা চমকে উঠলাম। “তারকদা? কী বলছিস?”

“তারকদার গলা। স্পষ্ট তারকদার গলা। তারকদা ফোন ধরেছিল।” অবাক হবারও সীমা আছে। আমরা চুপ। কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। যোগেন বলল, “রাজালালের বাড়িতে তারকদা? তুই ঠিক বলছিস?” “তারকদার গলা চিনতে ভুল হবে আমার?”

“কী বলল?”

“রাজাবাবু বাড়ি নেই।”

আমরা পরস্পরের দিকে তাকালাম। যেন বোঝবার চেষ্টা করছিলাম, এটা কেমন

করে হল?

সুকুমার বলল, “তারকদার বদ্যিনাথধামে যাওয়াটা তা হলে মিথ্যে কথা? মায়ের অসুখটাও মিথ্যে? তুই না বললি চিঠি পেয়েছিস তারকদার?”

মাথা নাড়ল প্রিয়গোপাল। “পেয়েছি।…আমি বিশ্বাস করতে পারছি না…তারকদা এমন কাজ করতে পারে।”

চিঠিটা কই? বাড়িতে, না, দোকানে?” আমি জিজ্ঞেস করলুম।

“দোকানের ঠিকানায় এসেছিল,” প্রিয়গোপাল বলল, “টেবিলেই পড়ে আছে।”

‘দেখি, বার কর।”

প্রিয়গোপাল টেবিলের একপাশে গুছিয়ে রাখা চিঠিগুলো থেকে তারকদার পোস্টকার্ডটা বার করে এগিয়ে দিল।

চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়লাম। তারপর ডাকঘরের ছাপ খোঁজ করতে গিয়ে দেখি, চিঠিটায় বড়বাজার পোস্টঅফিসের ছাপ মারা আছে। তার মানে চিঠিটা বড়বাজারের কোনও জায়গা থেকে পোস্ট করা হয়েছে। অন্য ছাপটা এই এলাকার।

“তুই এটা দেখিসনি?” আমি আঙুল দিয়ে ডাকঘরের ছাপটা দেখাতে দেখাতে বললাম, “বড়বাজার পোস্ট অফিসের ছাপ।”

এমন সময় ফোন বেজে উঠল।

প্রিয়গোপাল এমনই মনমরা, হতাশ, ক্ষুব্ধ হয়ে বসে ছিল যে, ফোন তুলতে হাত বাড়াল না। চোখের ইশারায় আমাদের ফোন ধরতে বলল।

ফোনটা আমিই তুলে নিলাম। “হ্যালো?”

ওপাশে খুব চাপা গলায় যে সাড়া দিল সে যেন আমায় চমকে দিল। তারকদা। “গোপাল নেই?” তারকদা প্রিয়কে গোপাল বলে ডাকে।

“আছে। সে কেমন…’

“বুঝেছি। শোনো, বেশি কথা বলার উপায় নেই। আমাকে এরা ধরে এনে গুম করে রেখেছে। তুমি গোপালকে বলো, জুবিলি হোটেলে হীরাবাবুকে ফোন করতে। তোমরা নিজেরাও যেতে পারো। হীরাবাবু ছাড়া উপায় নেই। দেরি করো না। অনেক কথা আছে। বলার সময় নেই। হীরাবাবু, জুবিলি হোটেল।”

ফোন কেটে গেল।

আমি যেন আমার মধ্যে নেই আর। অদ্ভুত লাগছিল। মনে হচ্ছিল, কানে যা শুনেছি, দেখেছি, সবই মিথ্যে। দুঃস্বপ্ন।

“কী হল রে? কে?”

“তারকদা। বলছে, তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছে রাজালাল, গুম করে রেখেছে।” বলে আমি তারকদার কথাগুলো প্রিয়গোপালদের বললাম।

কথাগুলো মন দিয়ে শুনল প্রিয়গোপালরা।

যোগেন বলল, “হীরালাল! কী করবে হীরালাল?”

“জানি না। তারকদা বলল।”

“তারকদার কথায় বিশ্বাস কিসের? আবার যদি ফাঁসিয়ে দেয়?

বিশ্বাসঘাতক!”

আমি বললাম, “যে-ভাবে বলল, তাতে মনে হল, কোনও একটা ব্যপার আছে। হীরালাল ছাড়া উপায় নেই।”

আমরা বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কী করব? হীরালালকে বিশ্বাস কী? তাকেও আমরা চিনি না, জানি না। সেও তো সুবিধের লোক নয়। এক করতে অন্য কিছু হয়ে যেতে পারে।

শেষে প্রিয়গোপালই কেমন বেপরোয়া হয়ে বলল, “ঠিক আছে, শেষ পর্যন্ত দেখা যাক। কোনও মানুষকেই বিশ্বাস নেই। তবু দেখা যাক, হীরালাল কী বলে। সুকু হোটেল দ্যাখ জুবিলি হোটেল, ফোন কর হীরালালকে।”

সুকুমার ফোন গাইড বার করে হোটেলের নম্বর বার করতে লাগল।

যোগেন সিগারেটের প্যাকেট বার করে। “এ তো এক থ্রিলার হয়ে গেল ভাই। একটা বই নিয়ে এত কাণ্ড!”

আমরা সিগারেট ধরালাম।

ফোন নাম্বার টুকে দিল সুকুমার।

প্রিয়গোপাল নিজেই ফোন করল।

সামান্য পরে পাওয়া গেল হীরালালকে। বোধহয় তাকে ঘর থেকে ডেকে আনতে হয়েছে।

প্রিয়গোপাল কথা বলল। “আমি বইয়ের দোকান থেকে কথা বলছি। ও. আর. বুক কম্পানি থেকে। আপনি একদিন আমাদের দোকানে এসেছিলেন। ব্যাপারটা আপনাকে বলি। তারকদা…” প্রিয়গোপাল ছোট করে তারকদার কথা বলল।

কী কথা হল আমরা সব বুঝলাম না। শেষে ফোন রেখে প্রিয়গোপাল বলল, “হীরাবাবু কাল সন্ধের পর হোটেলে যেতে বলেছে।”

নয়

হীরালালের হোটেল খুঁজতে আমাদের অসুবিধে হল না। এক দিকে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, অন্য দিকে মিশন রো, তার মুখেই হীরালালের হোটেল। বাইরে থেকে চট করে বুঝতে অসুবিধে হয়। হোটেলের নীচের তলায় এক এয়ার ট্রাভেল এজেন্সির অফিস। তার পাশ দিয়ে হোটেলের সিঁড়ি।

হোটেলের মুখে এসে যোগেন আর সুকুমার আলাদা হয়ে গেল। আমরা ঠিক করেছিলাম, চারজনে একসঙ্গে হোটেলে ঢুকব না। দল মিলে হীরালালের কাছে যাওয়া ভালো দেখায় না। হীরালালও বিরক্ত হতে পারে। তা ছাড়া, যার কাছে যাওয়া হচ্ছে, সেই মানুষটা যে মতলববাজ নয়, তাই বা কে বলতে পারে! বরং সুকুমারের মুখ থেকে যা শোনা গিয়েছে, তাতে রাজালাল আর হীরালালের মধ্যে কতটুকু তফাত কে বলতে পারে!

যোগেন বলেছিল, “সাবধানের মার নেই। তোরা হোটেলে ঢুকবি, আমরা বাইরে থাকব। ওয়াচ করব।”

প্রিয়গোপাল আর আমি হোটেলের অফিস-ঘরে গিয়ে হীরালালের খোঁজ করতে বেঁটেখাটো এক ভদ্রলোক তেতলায় সাত নম্বর ঘরে যেতে বললেন।

সিঁড়ি বেয়ে আমরা তেতলায় উঠে এলাম। আসবার সময় লক্ষ করলাম, হোটেলটার বাইরের চাকচিক্য কম। ঝলমলে ভাব নেই কোথাও। কিন্তু ভেতরে ঢুকলে কেমন এক শান্ত ছিমছাম পরিবেশ চোখে পড়ে। লোকজন যারা আসা-যাওয়া করছিল তারা কেউই সাহেবসুবো নয়, এদেশী মানুষজন।

তেতলায় সাত নম্বর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে প্রিয়গোপাল আমার মুখের দিকে তাকাল। অস্বস্তি আর ভয়-ভয় লাগছিল তার। ইশারায় আমি তাকে দরজায় টোকা দিতে বললুম।

প্রিয়গোপাল দরজায় টোকা দিল।

কমুহূর্ত পরে দরজা খুলে যে লোকটি মুখ বাড়ালেন, তিনি যে হীরালাল বুঝতে অসুবিধে হল না।

হীরালালকে আমি চোখে দেখিনি। রাজালালকে একদিন হাত কয়েক তফাত থেকে দেখেছি। তবু মনে হল, অবিকল এক চেহারা।

প্রিয়গোপাল অভ্যেসবশে নিজের পরিচয় দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই হীরালাল বললেন, “আসুন। আপনারই অপেক্ষা করছিলাম। উনি?” বলে আমাকে দেখালেন চোখের ইশারায়।

“আমার বন্ধু। শংকর। ওকে নিয়ে এলাম।”

“আসুন, ভেতরে আসুন।”

আমরা ভেতরে ঢুকলাম, দরজা বন্ধ করলেন হীরালাল। “বসুন।”

হোটেলের এই জায়গাটা বসার ঘরের মতন করে সাজানো। হাত কয়েক জায়গা, কিন্তু তার মধ্যেই গুছিয়ে সোফা, ছোট মতন লেখার টেবিল, বাহারি ল্যাম্প রাখা রয়েছে। একটা পাহাড়-পর্বতের ছবিও টাঙানো। ডান দিকের সরু দরজা দিয়ে শোবার ঘর দেখা যাচ্ছিল।

“বসুন, আরাম করে বসুন,” হীরালাল বললেন, হয়তো গলার স্বরে সামান্য কৌতুক ছিল।

আমরা বসলাম।

হীরালালকে ভালো করে লক্ষ করতে গিয়ে আমার মনে হল, ওঁর লম্বা কালো ছিপছিপে চেহারার মধ্যে আভিজাত্যের ছাপ রয়েছে। বয়েস যে খুব বেশি তা নয়, চল্লিশের মতন। মাজা-ঘষা স্বাস্থ্য।

“তারপর? দাঁড়ান, আমার নেশার খোরাকটা নিয়ে আসি আগে।”

হীরালাল শোবার ঘরের দিকে চলে গেলেন।

প্রিয়গোপাল ফিসফিস করে বলল, “এক্কেবারে এক চেহারা। কোনও তফাত

নেই।…হাতের ব্যাণ্ডেজটা দেখছি না আজ।”

হীরালাল ফিরে এলেন। হাতে পাইপ। “চা খাবেন তো? চা না কফি?”

“না না, আমাদের কিছু লাগবে না।”

“তাই কি হয়! আমার ঘরে এসেছেন, কফি খান।” বলে হীরালাল দরজার কাছে চলে গেলেন। দরজা খুলে মুখ বাড়িয়ে কাকে যেন ডাকলেন। বললেন কিছু তারপর দরজা বন্ধ করে আবার আমাদের কাছে এসে সোফায় বসলেন। বসে একবার প্রিয়গোপালের দিকে তাকিয়ে একটু যেন হাসলেন। “আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় আগেই হয়েছে। দোকানে।…বলুন, আমি কী করতে পারি।”

প্রিয়গোপাল বিব্রত বোধ করল। হীরালাল সম্পর্কে আমাদের ধারণার সঙ্গে এই মানুষটির মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভদ্র, রুচিবান, অভিজাত। এই ভদ্রলোকের নাম “বাইসাইকেল’ হয় কেমন করে?

“তারকদা আমাকে, মানে—আমাদের আপনার সঙ্গে কথা বলতে বলেছে,” প্রিয়গোপাল বলল, “কাল ফোনে আমি আপনাকে সব বলেছি।”

হীরালাল কথা বললেন না। লাইটার জ্বালিয়ে পাইপ ধরাতে লাগলেন। আমি তাঁকে দেখছিলাম। পরনে পায়জামা, গায়ে নকশা-করা পাঞ্জাবি, পায়ে হালকা চটি। মানুষটি ফিটফাট ধরনের।

পাইপ ধরিয়ে হীরালাল বললেন, “তারকবাবুর কথা শুনলাম। ব্যবস্থা হবে একটা।” “কী ব্যবস্থা করবেন ? ”

“দেখা যাক কী করা যায়!” হীরালাল প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়ে অন্য কথা তুললেন। “দেখুন, আপনারা যখন আমার কাছে এসেছেন, তখন লুকোচুরি খেলা খেলবার দরকার নেই। যা বলার স্পষ্ট করে বলুন। স্পষ্ট কথায় কাজ হবে, লুকোলে হবে না।”

প্রিয়গোপাল আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, “আমরা আর কী লুকোতে চাইব! আপনি যা জানেন…’

“আমি যা জানি তার বাইরেও কিছু জানার আছে,” হীরালাল বললেন, পাইপ টানলেন বার দুই। শেষে আচমকা বললেন, “বইটা তা হলে নেই?”

প্রিয়গোপাল ঘাবড়ে গেল। এমনভাবে আচমকা বইয়ের কথা উঠবে, সে ভাবতে পারেনি। নিজেকে সামলে নিল প্রিয়। বলল, বইটা আমাদের কাছে নেই।”

হীরালাল সরাসরি প্রিয়গোপালের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর বললেন, “বইটার ইতিহাস আমি জানি। আপনি কতটা জানেন? কী জানেন?”

প্রিয়গোপাল বলল, “বছর চার-পাঁচ আগে জাস্টিস এ. বি. রায়ের কাছ থেকে বইটা আমরা কিনেছিলাম। ঠিকঠাক বলতে গেলে ওঁর লাইব্রেরি থেকে আমরা কয়েকটা পুরনো বই কিনি। তার মধ্যে ‘এনসেন্ট ম্যান’ বইটা ছিল। তখন বইটার দাম ছিল…মানে আমরা দর দিয়েছিলাম চারশো টাকা।

“বইটা এর পর কার হাতে যায় ? ”

“জানি না। বইটা বিক্রি করা হয়নি। দোকানের খাতা-পত্রেও কোথাও বিক্রির

রেকর্ড নেই। অথচ বইটা দোকানে নেই ।”

হীরালাল মাথা নাড়লেন। বললেন, “বইটা কেন নেই?”

“বুঝতে পারছি না।”

“বোঝার চেষ্টা করলে বুঝতে পারতেন।…বইটা আপনাদের দোকান থেকে কে নিয়ে গিয়েছে?”

“জানি না।”

“আপনার বাবা কী বলেন?”

প্রিয়গোপাল খানিকটা অবাক হল। একবার আমার দিকে তাকাল। চোখ ফিরিয়ে নিল সঙ্গে-সঙ্গে। “আমার বাবাকে আপনি জানেন?”

হীরালাল যেন চোরা-হাসি হাসলেন। বললেন, “না। তবে এটা জানি যে, আপনার বাবাই ব্যবসাপত্র দেখতেন আগে। আপনি নতুন।”

আমরা স্পষ্টই বুঝতে পারলাম, প্রিয়গোপালদের বইয়ের দোকান সম্পর্কে অনেক খোঁজখবরই রাখেন হীরালাল।

প্রিয়গোপাল বলল, “বাবা ভালো করে কিছুই মনে করতে পারছেন না। তিনি নিজেও অবাক হয়েছেন।”

হীরালাল সোজাসুজি প্রিয়গোপালের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। যেন দেখতে চাইছিলেন প্রিয় সত্যি কথা বলছে না মিথ্যে কথা! হঠাৎ কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, “তারকবাবু আপনাদের দোকানে কাজ করছেন অনেক দিন ধরে। তাঁর সম্পর্কে আপনারা কী জানেন?”

এই প্রশ্নের কী জাবাব দেবে প্রিয়গোপাল? থমমত খেয়ে গেল। শেষে বলল, “তারকদা আমাদের পুরনো লোক। বিশ্বাসী।” বলে একটু থামল প্রিয়গোপাল; তারপর আগোছালো ভাবে বলল, “তবে কিছুদিন ধরে তার ব্যবহার খাপছাড়া হয়ে গিয়েছিল। আগে এটা আমাদের চোখে পড়েনি। বুঝতে পারিনি। আর এখন তো দেখছি…” কথাটা শেষ করল না প্রিয়গোপাল।

হীরালাল বললেন, “এখন আপনাদের কী মনে হচ্ছে তারকবাবুকে? আপনার বাবাকে হালের খবর বলেছেন?”

মাথা নাড়ল প্রিয়গোপাল। “বলিনি এখনও। সবেই তো কাল জানলাম। তারকদাকে রাজাবাবুরা ধরে নিয়ে গিয়ে গুম করে রেখেছে। বাবাকে বলতে ভয় করে। হার্টের রোগী। খবরটা শুনলে হয়তো ঘাবড়ে যাবেন। শরীর খারাপ হবে।”

দরজায় টোকা পড়ল। হীরালাল উঠলেন।

দরজা খুলতেই হোটেলের এক জাঁদরেল চেহারার লোক দু’হাতে দুই ট্রে নিয়ে ঘরে এল। যেন নৈবেদ্য বয়ে এনেছে। তার ট্রে বয়ে আনার কসরত, একটা ট্রে কেমন কায়দা করে ছোট লেখার-টেবিলে নামিয়ে লাখল প্রথমে, তারপর হাতটা খালি করে নিয়ে ট্রেগুলো আমাদের সামনে গুছিয়ে দিল—আমি এইসব দেখতে দেখতে অন্য কথা ভাবছিলাম। তারকদার সঙ্গে হীরালালের যোগাযোগ কত দিনের?

দরজা আবার বন্ধ হল। গুঁফো জাঁদরেল লোকটা চলে গিয়েছে।

হীরালাল কফিপট থেকে আমাদের কাপে কফি দুধ ঢেলে দিতে লাগলেন। অন্য ট্রে’র ওপর দুটো প্লেটে স্ন্যাকস সাজানো।

“রাজা যেদিন আপনাদের দোকানে যায়, সেদিন ওই সময়ে তারকবাবু দোকানে ছিলেন। মনে আছে আপনার?” হীরালাল বললেন।

“হ্যাঁ।”

“আমি যেদিন যাই, তারকবাবু ছিলেন না। মনে পড়ে?”

“হ্যাঁ, মনে আছে।”

“কেন ছিলেন না?” হীরালাল হাতের ইশারায় স্ন্যাকস তুলতে বললেন আমাদের। হঠাৎ আমার কেন যেন মনে হল, ব্যাপারটা বোধ হয় আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। ফট করে আমি বললাম, “আপনি যাবেন তারকদা জানত।”

হীরালাল আমার দিকে তকালেন। মুচকি হাসলেন। “একজ্যাক্টলি। প্রি-অ্যারেঞ্জড ছিল। কিন্তু কেন?”

“প্রিয়কে কনফিউজ করে দেবার জন্যে?” আমি বললাম।

“খানিকটা ঠিক, সবটা নয়। …নিন, কফি খান, চিনি আপনারা মিশিয়ে নিন,” বলে হীরালাল নিজের কফি তুলে নিলেন। “তারকবাবুকে পরীক্ষা করছিলাম।” আবার সেই মুচকি হাসি।

“মানে?” প্রিয়গোপাল বলল, “বুঝতে পারছি না…”।

“মানে…তারকবাবু আমার ইনফরমারের কাজ করছিলেন। তবে ইনফরমাররা অনেক সময় দু’তরফের পয়সা খায়। রাজার পয়সাও তিনি খাচ্ছেন কি না, তার প্রমাণ কী? দোকানে গিয়ে আমি বুঝলাম, তারকবাবু রাজার পয়সা খাচ্ছেন না।” হীরালাল কফিতে চুমুক দিলেন। অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বললেন, “আমি কলকাতায় ছিলাম না। নিজের জায়গায় ছিলাম। তারকবাবু খবর দেবার পর আমি কলকাতায় আসি। আমাদের মধ্যে খবর দেওয়া-নেওয়ার একটা ব্যবস্থা আছে। এ-বেলার খবর ও-বেলা আমি পেয়ে যেতে পারি।”

আমরা কফি তুলে নিয়েছিলাম। হীরালাল মানুষটি তো দেখছি অতি বিচক্ষণ, চতুর, বুদ্ধিমান !

“আপনি বোধহয় জানেন না, আমি কলকাতায় এসেছি জানতে পারার পরই রাজা আপনার দোকানে ফোন করেছিল। আপনাকে শাসানোর চেষ্টা করেছিল। ঠিক কি না?”

“হ্যাঁ, উনি ফোন করে আমায় শাসিয়েছিলেন।”

“আমি জানি। তারকবাবুর কাছ থেকে আমি সব খবর পেতাম। আমার টাইপ-করা চিঠিও আপনি যাতে পান, সে-ব্যবস্থা করা হয়েছিল।” হীরালাল কৌতুক করেই বললেন।

আমি বললাম, “আপনি বাইসাইকেল কেন? আর রাজাবাবুই বা বিল্লি কেন?” হীরালাল এবার সামান্য জোরে হেসে উঠলেন। বললেন, “এ আমাদের ছেলেবেলার খ্যাতি। শুনেছি, সারা দিনে ঘুমোবার সময় বাদে সাইকেল ছাড়া আমাকে দেখা যেত না। সাইকেল আমার অবসেশান ছিল। খুব নাম-ডাকও হয়েছিল সাইকেল রেসে। বাইসাইকেল নামটা পাড়ার লোকজন বন্ধুবান্ধবদেরই দেওয়া।”

“আর বিল্লি?”

“বিল্লি–মানে বেড়াল। ওটাও বাইরের লোকের দেওয়া,” বলে হীরালাল কফির পেয়ালা নামিয়ে আবার পাইপ ধরাতে লাগলেন। “বেড়াল দু’জাতের হয়। এক জাতের বেড়াল ঘরের বেড়াল। ডোমেস্টিক। আর এক জাতের বেড়াল হল জাঙ্গল ক্যাট, বনবিড়াল।” হীরালালের চোখে যেন কোনও ইঙ্গিত ছিল। চুপ করে গেলেন।

আমার সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছিল। প্যাকেট বার করলাম। প্রিয়গোপাল বলল, “রাজাবাবু আপনার ভাই। আপনারা যমজ ?”

“হ্যাঁ। ও আগে, আমি পরে। শুনেছি আধ ঘণ্টার তফাত।” “জজসাহেব আপনাদের…”

“কাকা ছিলেন। আমাদের বাবা মারা গিয়েছেন, আমরা যখন ছোট, পনেরো ষোলো বয়স। মা মারা গিয়েছেন বছর দশ-বারো আগে। কাকাই আমাদের অভিভাবক ছিলেন।”

হঠাৎ জজসাহেবের ইচ্ছামৃত্যুর কথা আমার মনে পড়ল। মাটি খুঁড়ে তার মধ্যে বসে সমাধিস্থ হবার খেয়াল চেপেছিল তাঁর। মাটি চাপা পড়ে মারা যান। এক মুখ ধোঁয়া গিলে আমি বললাম, “শুনেছি উনি অদ্ভুতভাবে মারা যান?”

হীরালাল আমার দিকে তাকিয়ে কিছু লক্ষ করলেন, তারপর ব্যঙ্গ করেই বললেন, “অপনারা অনেক কিছু শুনেছেন। খবর করেছেন। আমি আগেই আপনাদের বলেছি, আপনারা কে কী করেছেন না করেছেন, তার খবর আমি রাখি। তারকবাবুর কাছ থেকেই রেখেছি।”

আমি কেমন বিব্রত বোধ করলাম। হীরালাল অসন্তুষ্ট হয়েছেন। ভাবছেন, আমরা লুকোচুরি খেলার চেষ্টা করছি।

প্রিয়গোপাল অবস্থাটা সামলে নেবার জন্য বলল, “আপনি কিছু মনে করবেন না। আমাদের এক বন্ধু পাটনায় গিয়েছিল, তার বাড়ির কাজে। সে আমাদের কয়েকটা খবর এনে দেয়। আসলে আমরা এই ব্যাপারটায় এমন পাজলড হয়ে গিয়েছি…। আমাদের কোনও দেষ নেই।”

হীরালাল দাঁতে পাইপ চেপে ছোট-ছোট ধোঁয়া ছাড়লেন কিছুক্ষণ, শেষে বললেন, “আপনারা কে কী করেন, কোথায় থাকেন, দোকানে কবে কবে আসছেন, কী আলোচনা করেন সব আমি জানি। পাটনায় আপনাদের যে বন্ধুটি গিয়েছিলেন, তাঁর নাম সুকুমার। আমি জানি।” বলে আমার দিকে তাকালেন, “তবু ন্যাকা সাজতে হয় কখনও-কখনও, যেমন আপনাকে দেখে সাজলাম। আপনার কি ধারণা আমি আপনাকে বুঝতে পারিনি?”

আমরা চুপ করে থাকলাম। প্রিয় আমার দিকে তাকাল, আমি তার দিকে। কোথায় যে অপরাধ ঘটল বুঝতে পারছিলাম না। হয়তো কথাটা অন্যভাবে বলা উচিত ছিল।

প্রিয়গোপাল যেন হাসবার চেষ্টা করল। বলল, “আপনি কিছু মনে করবেন না। …আসলে জজবাবু সম্পর্কে যা শুনেছি সেটা বিশ্বাস করা মুশকিল। আমরা শুনেছি তিনি মারা যাবার আগে সাধনা-টাধনা করতে শুরু করেছিলেন। তাঁর খেয়াল চেপেছিল…মাটি খুঁড়ে তার মধ্যে বসে সাধনা করবেন… মানে ওই রকম আর কি!”

হীরালাল কোনও জবাব দিলেন না।

আমরাও বোকার মতন চুপ করে বসে থাকলাম।

অনেক পরে হীরালাল বললেন, “আপনারা ছেলেমানুষ, অনেক কিছুই জানেন না। মাটি খুঁড়ে তার মধ্যে বসে থাকা শক্ত ব্যাপার নয়। শক্ত ব্যাপার…আপনি মাটির মধ্যে থাকলেন, অথচ আপনার মাথার ওপর মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হল, তবু আপনি এক-দেড় ঘণ্টা মাটির তলায় নিশ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকলেন! এ এক ধরনের যোগ। এ-রকম খেলা দেখানোও হয়, ম্যাজিশিয়ানরা দেখান। তবে সব ম্যাজিশিয়ান যোগী নয়। সেখানে ছল-চাতুরি থাকে। যোগীদের থাকে না। তাঁরা পারেন। সবাই নয়, দু’পাঁচজন। আমি একজনেকে দেখেছি। আমার কাকা অবশ্য যোগী ছিলেন না।”

আমরা কোনও কথা বললাম না। যোগী দেখিনি তো কী বলব!

হীরালাল নিজেই বললেন, “কাকা মাটি খুঁড়ে বসে সাধনা করতেন না। লোকের কাছে সেরকম বলা হত। তিনি মাটি খুঁড়তেন অন্য কারণে। মাটির তলায় আমাদের পূর্বপুরুষের এক গুপ্তধন লুকনো আছে। কোথায় যে আছে, আমরা জানি না। তবে আছে।”

আমাদের পায়ের তলায় যেন মাটি সরে গেল। অবাক, বিমূঢ় হয়ে বসে থাকলাম। নিশ্বাসও বোধহয় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গুপ্তধন? হীরালাল কি তামাশা করছেন?

হীরালালের মুখ দেখে মনে হল না তিনি তামাশা করছেন।

প্রিয়গোপাল ঢোঁক গিলে বলল, “সত্যি আছে?”

“শুনেছি রয়েছে।”

“কোথায় আছে আপনারা কেউ জানেন না?”

“না। …জানার একটাই পথ ছিল…”

“কী পথ?”

‘ওই বই। যেটা কাকা বাড়ি থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন।”

আমরা আবার চমকে গেলাম। বুঝতে পারলাম না, আদিম মানবজাতি সংক্রান্ত একটা বইয়ের মধ্যে গুপ্তধন উদ্ধারের কোনও সাংকেতিক নির্দেশ কি কথা থাকতে পারে!

হীরালাল বললেন, “আমার কাকা হাইকোর্টের জজ ছিলেন। আইন না-মেনে চলা তাঁর স্বভাবে ছিল না। কিন্তু যে-সম্পত্তি আর ঐশ্বর্য তাঁর পূর্বপুরুষের, সেই ঐশ্বর্যের বেলায় তিনি নীতি বা আইন মানতে চাননি। তিনি ভেবেছিলেন, তিনি একলা, আর তাঁর ছেলে সেই ঐশ্বর্য ভোগ করতে পারবেন। এখানেই তাঁর ভুল হয়েছিল। আগুন জ্বালালে তার ধোঁয়া লুকনো যায় না। বলবেন, কেন, ইলেকট্রিক হিটার জ্বালালে তো ধোঁয়া চোখে পড়ার কথা নয়। ঠিকই। তবে কি জানেন, কাকা কাঠকুটো জড়ো করেই আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করেছিলেন। কাজেই ধোঁয়া প্রথমে চোখে পড়েছিল রাজার। তারপর পড়ে আমার।”

আমি বললাম, “পুরনো একটা বইয়ের মধ্যে গুপ্তধন উদ্ধারের কথা কেমন করে লেখা থাকতে পারে।”

“কেমন করে থাকতে পারে সে-কথা এখন বলা যাবে না। সময় নেই। আমি এবার উঠব। আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে। আপনারা আর-একদিন আসুন। পরশু…হ্যাঁ… পরশু দিন আসতে পারেন। আমি থাকব।”

“তারকদা?” প্রিয়গোপাল বলল।

“সে-ভাবনা আমার।” হীরালাল উঠে পড়লেন।

হোটেলের বাইরে এসে দাঁড়ালাম আমরা। দু’জনের কারও মুখে কথা নেই। হয়তো এখনও আমাদের চমকের ঘোর কাটেনি। যা শুনেছি, তা যেন মেনে নিতে, বিশ্বাস করতে মন চাইছিল না। আবার সবটা মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিতেও পারছিলাম না। আগাগোড়াই আমাদের সন্দেহ হচ্ছিল, বইটার মাধ্যে এমন কিছু আছে যা সাধারণ নয়, সামান্য নয়। কিন্তু কে ভেবেছিল, একটা বইয়ের পাতায় গুপ্তধনের হদিস থাকবে। আশ্চর্য!

সুকুমারের গলা শুনে চমকে উঠলাম। “কী রে, এতক্ষণ কী করছিলি তোরা? আমরা ভাবলাম, হীরালাল তোদেরও বুঝি গুম করে দিল।”

প্রিয়গোপাল নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “ব্যাপারটা যা হল—তার চেয়ে গুম হয়ে যাওয়া সহজ ছিল।”

“কী হল?” যোগেন বলল।

“চল বলছি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অত কথা বলা যায় না।”

“তা হলে এসপ্লানেডের দিকে চল। চায়ের দোকানে বসে শুনব। তারপর গুমটি থেকে ট্রাম ধারব।”

আমরা চার বন্ধু বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট ধরে হাঁটতে লাগলাম। সন্ধে পার হয়ে গিয়েছে কখন। রাস্তায় ভিড় নেই এদিকটায়। ট্রাম যাচ্ছে চিৎপুরের দিকে। সিনেমা হাউসের কাছে নাইট শোয়ের টিকিট বিক্রি চলছে।

প্রিয়গোপাল হোটেলে ঢোকার পর থেকে যা যা ঘটেছে বলতে শুরু করল।

দশ

হীরালালের কথামতন যথাদিনে তাঁর হোটেলে পৌঁছে দেখি তিনি স্নান সেরে বসে আছেন। হাতে লেমনেডের গ্লাস। পাইপ। স্নানের পর হীরালালকে তাজা দেখাচ্ছিল।

হীরালাল বললেন, “তারকবাবুর খবর পেলেন?’

“না,” প্রিয়গোপাল মাথা নাড়ল। আমার দিকে তাকাল একবার, চোখ ফিরিয়ে নিল হীরালালের দিকে। বলল, “শংকরের ভাইয়ের বন্ধুর সঙ্গে লোকাল থানার অফিসারের জানাশোনা আছে। ও-দিক দিয়ে চেষ্টা করলে তারকদাকে বের করে আনা যায়। অপনি বলছিলেন ব্যবস্থা হবে, তাই…’

হীরালাল মোটেই ব্যস্ত হলেন না। তারকদার গুম হওয়াকে তিনি প্রথম থেকেই পাত্তা দিচ্ছেন না কেন কে জানে! বললেন, “ছাড়া পেয়ে যাবার কথা। দেখি, রাজা আসুক…”

এমন সহজ গলায় হীরালাল বললেন কথাটা যে, আমরা প্রথমে ভালো করে বুঝতেই পারিনি। পরে খেয়াল হল উনি রাজালালের কথা বললেন, “রাজা আসুক….।” আসুক মানে? কোথায়? কার কাছে?

প্রিয়গোপাল আর আমি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। প্রিয় বলল, “এখানে আসবেন ?”

লেমনেড খেতে খেতে হীরালাল বললেন, “হ্যাঁ। আসার কথা। মনে হয়, আসবে। আপনারা থাকতে থাকতেই।” একটু যেন হাসি-হাসি মুখ করলেন উনি। আবার বললেন, “আমার পক্ষে আর কলকাতায় বসে থাকা পোষাচ্ছে না। নিজের কাজকর্মের বড় ক্ষতি হচ্ছে। আমরা চাষা-ভুষো মানুষ। মাটি না ঘাঁটলে ঘুমোতে পারি না।” বলেই উঠে পড়লেন। পাশের ঘর থেকে আমাদের জন্যে দু’গ্লাস লেমনেড ঢেলে নিয়ে ফিরে এলেন আবার। “নিন, গলা ভেজান। যা গরম।”

আমি বলতে যাচ্ছিলাম, রাজালালের আসার হেতু কী? সামলে নিয়ে বললাম, “আপনি ফার্মিং নিয়ে থাকেন শুনেছি?”

“ঠিকই শুনেছেন। পুনপুনের কাছে আমার খেতখামার, চাষবাস, ডেয়ারি। পুনপুন পাটনা থেকে দূর নয়। গয়া লাইনে।” লেমনেড শেষ হল হীরালালের। নিজেই বললেন, “আমি মশাই চাষা লোক। ধান, গম, যব নিয়ে আমার দিন কাটে। একসময় এগ্রিকালচারের একটা ডিগ্রি জুটিয়েছিলাম, দেখলাম হাতেকলমে না নামলে হয় না।” হীরালাল সহজভাবে হেসে উঠলেন। পাইপে তামাক ঠাসতে ঠাসতে নিজের মনেই মাথা নাড়লেন।

আমরা তাঁর হাসি আর পাইপ ধরানো দেখছিলাম।

পাইপ ধরানো হয়ে গেলে হীরালাল বললেন, “আমাদের বংশের পুরনো খোঁজখবর কিছু রাখেন নাকি?”

মাথা নাড়ল প্রিয়গোপাল। বলল, “না। শুনেছি পাটনায় আপনাদের বিশাল বাড়ি, প্যালেসের মতন; বিরাট বাগান, পাখির খাঁচা…”

“খাঁচা নয়, ঘর। পাখিঘর, হীরালাল শুধরে দিলেন। বারকয়েক পাইপ টানলেন। তারপর বললেন, “আমাদের ইতিহাসটা একটু বলি। শুনে রাখলে বুঝতে পারবেন একটা বই নিয়ে এত গোলমাল কেন পাকানো হল।”

আমরা তাকিয়ে থাকলাম।

হীরালাল সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, “গোড়ার কথাগুলো বেশি করে আর বলার দরকার নেই। ছোট করে বলি। …আমাদের এক পূর্বপুরুষ… ঠাকুরদার বাবার বাবা…মুসলমান রাজাদের আমলের শেষের দিকে খানিক ধনসম্পত্তি করেন। ঠাকুরদার বাবা…মানে আমার প্রপিতামহ মুঙ্গের থেকে চলে আসেন পাটনায়। মুঙ্গেরের চেয়ে পাটনার দিকেই তাঁর বেশি নজর ছিল। বেশ একটা জমিদারিও ফেঁদে বসেন। আগেকার দিনে জমিদাররা রাজা-গজা হয়ে যেত সহজেই। প্রপিতামহকে শুনেছি লোকে মান্য করে রাজাসাহেব বলত। ধনদৌলত, বাগান, বাড়ি—এসব খানিকটা তাঁর কীর্তি। তারপর হাল ধরেন আমার ঠাকুরদা।”

হীরালাল এমন সহজ, হালকা, সকৌতুক গলায় কথাগুলো বলছিলেন যে, মনে হচ্ছিল তিনি সত্যিই কোনও গল্প বলছেন।

আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে নিলাম।

হীরালাল বললেন, “আমার ঠাকুরদা থেকে বংশের ইতিহাসের নতুন চ্যাপ্টার শুরু। ঠাকুরদা ছিলেন রেলের জরিপদার। তাঁর জরিপ-কাজের খ্যাতি ছিল। ওদিকে, তখন রেললাইন বাড়াবার, নতুন করে লাইন পাতার কাজ চলছে। ঠাকুরদাকে জঙ্গলে তাঁবু খাটিয়ে বসে জরিপের কাজকর্ম করতে হতো। মানুষটি ভালো শিকারি ছিলেন। বাঘ-ভালুকের সঙ্গে থাকতে হলে বন্দুক ছাড়া গতি নেই। ঠাকুরদার বন্দুকের নিশানা ছিল পাকা। হাতে বন্দুক, মনে সাহস, আর গায়ে বল থাকলে মানুষ ধরাকে সরা জ্ঞান করে। আমার ঠাকুরদাও তাই করতেন।”

“বেপরোয়া ছিলেন? তাই না?” প্রিয়গোপাল বলল।

“বেপরোয়া, দুঃসাহসী, জেদি। শুনেছি রোখ চাপলে তাঁকে আটকানো যেত না। তাঁর এই রোগের জন্যেই তিনি একদিন এক গুপ্তধন পেয়ে যান।”

গুপ্তধন? আমরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকালাম। হীরালাল আগের দিনও বলেছেন কথাটা।

“আমি আগেই বলেছি, জরিপের কাজকর্মের জন্যে জঙ্গলে তাঁবু খাটিয়ে থাকতে হতো ঠাকুরদা আর তাঁর সঙ্গীদের। রোজই একঘেয়ে কাজ কত আর করা যায়। মাঝে-মাঝে শিকারে বেরুতেন ঠাকুরদা। ঘোরাফেরা করতেন আশেপাশে। একদিন তিনি তাঁর সাধের বন্দুক আর পেয়ারের এক পোর্টারকে সঙ্গী করে বেড়াতে বেরোন। ঘুরতে ঘুরতে ঠাকুরদা ভাঙাচোরা, গাছপালায় ঢাকা এক মন্দিরের কাছে গিয়ে পড়েন। কবেকার পুরনো মন্দির এক, না আছে তার মাথা, না বোঝা যায় কোনদেবতার মন্দির। আগাছা আর জঙ্গলে সব ভরা। এইখানে ঠাকুরদার সঙ্গী পোর্টারকে সাপে কামড়াল। ও-সব পাহাড়ি জায়গার সাপ বড় বিষাক্ত। যাকে কামড়ায় তাকে দু’ঘণ্টাও টিকিয়ে রাখা যায় না। ঠাকুরদার পোর্টারকেও বাঁচানো যায়নি। কিন্তু সেই যে রোখ চেপে গেল ঠাকুরদার, তাঁর পোর্টারকে যে-সাপ কামড়েছে তাকে আর তার বংশকে তিনি নির্মূল করবেন, এই রোখ আর গেল না।”

হীরালাল আবার একটু থামলেন। পাইপের ছাই পরিষ্কার করলেন। বললেন, “রাজা জনমেজয় সর্পযজ্ঞ করেছিলেন মহাভারতে আছে। আমার ঠাকুরদাও সর্পনিধনে লেগে গেলেন। ভাঙা জঙ্গলভরা মন্দিরের আশপাশ তন্নতন্ন করে সাপ খোঁজেন। গর্ত দেখতে পেলেই খোঁচান, বন্দুকের নল চালিয়ে দেন। দু’একটা সাপ মারাও গেল। তাতেও ঠাকুরদার শান্তি নেই। সেই শয়তান সাপটা গেল কোথায়? তার চেহারা নাকি চিনে রেখেছিলেন ঠাকুরদা। শেষে একদিন একটা ভারী পাথর চাপা ফাটল দেখা গেল। আর যায় কোথা, লাইন পাতার সময় পাথর ফাটাবার জন্যে ডিনামাইট স্টিক কাজে লাগানো হত। ঠাকুরদা সেই স্টিক দিয়ে ফাটলটা ফাটিয়ে দিলেন।”

কয়েক মুহূর্ত চুপ। তারপর আমাদের দিকে হাসি-হাসি চোখে তাকিয়ে হীরালাল বললেন, “পাথর-চাপা কপাল বলে একটা কথা আছে। এখানে তার উলটো হল। পাথরের তলায় পাওয়া গেল, মরা সাপ…আর একটা হাতখানেক লম্বা বাক্স। তার মধ্যে চামড়ার থলিতে ভরা দামি দামি পাথর, জুয়েলস মানে হিরে, মুক্তো, চুনি, পান্না—বহুমূল্য পাথর। তার দাম কত হবে কে জানে! বিশ পঁচিশ তিরিশ লাখ হতে পারে। বেশিও পারে।”

আমরা যেন রূপকথার গল্প শুনছিলাম।

হীরালাল নিজেই বললেন, “সেই সব পাথর অন্যদের চোখের আড়ালে সরিয়ে রেখে দিলেন ঠাকুরদা। শেষে যখন পাটনায় ফেরার সময় হল, নিজের পেট-পট্টিতে ধনরত্ন লুকিয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন তিনি। কাউকে কিছু বললেন না।”

“আপনারা কেমন করে জানলেন?” আমি বললাম।

“কোনও মানুষই সব কিছু লুকিয়ে রাখতে পারে না। ঠাকুরদাও পারেননি। আর নিয়তি বলে একটা কথা আছে। অদৃষ্টের এমনই পরিহাস, ঠাকুরদার বড় ছেলে…আমার জ্যাঠামশাই, মাত্র সতেরো-আঠারো বছর বয়েসে আমাদের পাটনার বাড়িতেই সাপের কামড়ে মারা গেলেন। ঠাকুরদার তখন পুত্রশোকে পাগলের মতন অবস্থা। তাঁর ধারণা হল, কোন যক্ষের ধন তিনি চুরি করে নিয়ে এসেছেন, এ হল তারই অভিশাপ। ঠাকুমাকে সমস্ত কথা বলে…অত দামি দামি পাথর…সব মাটির তলায় পুঁতে ফেললেন।

ভাবলেন, বাকি বংশধররা বেঁচে যাবে অভিশাপের হাত থেকে।”

“ঠাকুমার কাছে থেকেই আপনারা গুপ্তধনের কথা শোনেন?”

“ঠাকুমা মারা যাবার আগে ঠাকুরদা মারা যান। ঠাকুমা মারা যাবার সময় পাথরের কথাগুলো বলেছিল। কেউ বিশ্বাস করত না, ভাবত ঠাকুমার পাগলামি। ঠাকুমা মারা যাবার অনেক পরে, আমার বাবও তখন বেঁচে নেই, আমাদের পুরনো ঠাকুরঘরের এক ভাঙা সিন্দুকের মধ্যে একটা ছেঁড়াখোঁড়া খাতা পাওয়া যায়। ঠাকুরদার হাতে লেখা খাতা। তাতে নানান কথা ছিল। তবে ওরই মধ্যে ঠাকুরদা তাঁর গুপ্তধন-প্রাপ্তির কথা লিখে রেখেছিলেন। এটা আমরা সবাই দেখেছি। সে-খাতা এখনও পাটনার বাড়িতে আছে। তবে গুপ্তধন পাবার কথা থাকলেও তা কোথায় লুকিয়ে রেখে গিয়েছেন তার কথা ঠাকুরদা সেখানে লেখেননি।”

প্রিয়গোপাল বোকার মতন বলল, “আপনারা সেই লেখা কথায় বিশ্বাস করে…’ “না, না। আবার বলছি, মানুষ সব কথা লুকোতে পারে না। ঠাকুরদা শেষ পর্যন্ত আর-এক জায়গায় তাঁর রেখে যাওয়া গুপ্তধনের কথা লিখে যান। ঠিক যে লিখে গিয়েছিলেন তা নয়, একটা আভাস দিয়ে গিয়েছিলেন। একটা বইয়ের বিশেষ একটা ছবি দেখে আর তার আশপাশের ঠার দেখে বুঝতে বলেছিলেন।”

প্রিয়গোপাল বলল, “সাঙ্কেতিক কিছু?”

“হ্যাঁ। একটা ছবি আর কিছু কথা—ঠারে লেখা। ঠার মানে ইঙ্গিত। সঙ্কেত। কোড ল্যাংগুয়েজ। আমাদের দেশে ঠারে কথা বলা বা কিছু বোঝানোর চল ছিল প্রাচীন কাল থেকে। নানা ঠারের নানা নাম কদম্বঠার, ফুলঠার, নিদঠার। গোপনীয় বিষয় ঠারে লেখা হত। ঠাকুরদা যে ছবিটার কথা বলেছিলেন সেটা ছিল “এনসেন্ট ম্যান’ বইয়ের একত্রিশ নম্বর ছবি। ছবির কাছাকাছি পাতায় ছিল ঠার।”

“ছবির পাতায়?”

“না, না। অত কাঁচা কাজ তিনি করেননি। আগে ছবিটার কথা বলি। ছবিটা অন্য কোনও জীবজন্তুর নয়, মানুষের ছবি। তবে যেমন চেহারা দেখি মানুষের, সেরকম নয়। ওটা ছিল কেভ-পেন্টিং বা গুহাচিত্র। লতাপাতা ফুল দিয়ে নকশা করা মানুষের চেহারা। লম্বা-লম্বা পা’গুলো লতার মতন করে আঁকা, নুয়ে পড়া ফুলের ডালের মতন হাত দুটি ঝুলছে। মুখ আঁকা রয়েছে মস্ত এক সূর্যমুখী ফুলের মতন। বুকের কাছটায় আঙুর ফলের মতো ছোট ছোট ফল। আর ছবির চার কোণে চারটি ছোট ছোট উড়ন্ত পাখি। ভারী সুন্দর দেখতে।”

“দেখেছেন আপনি ছবি?”

“দেখেছি বই কী। তা এই ছবির গা-লাগানো পাতা আর পরের পাতায় ছিল ঠারে লেখা কথা। বইটা ইংরিজি। তার হরফ রোমান এক-একটা কথার তলায় হাল্কা করে দাগ দেওয়া ছিল কালির। যেমন ধরুন HUNTING কথাটার তলায় দাগ মারা। এই কথাটার ভেতর থেকে একটা বর্ণ নিতে হবে। কোনটা নেবেন?”

আমরা তাকিয়ে থাকলাম।

হীরালাল বললেন, “নেবেন “T” মানে ট। মানে, বিজোড় শব্দে “মাঝ”…মানে মাঝের বর্ণ। আর জোড় শব্দের শেষ বর্ণ যেমন BIRD হলে নিতে হবে ‘D’ মানে ‘ড’।

“একে কোন ঠার বলে?”

“জানি না। অনেক মাথা ঘামিয়ে এই ঠার আমি ধরতে পেরেছিলাম। বাংলা বা হিন্দিতে হলে বুঝতে সুবিধে হতো। রোমান হরফকে বাংলায় এনে ঠার বোঝা কি সহজ কর্ম! যাকগে, উদ্ধার করে দেখেছি ঠাকুরদা এক ধাঁধা রেখে গেছেন। ধাঁধাটা হল এই রকম-

“ষড় পক্ষী ষড় ঘরে

রাধাশ্যাম নাম ধরে।

চারি পক্ষী চারি দিকে

আগে পিছে যাই লিখে।

পুষ্পপত্র কত শত

নেত্র তিন চিত্রমতো ।

ঊর্ধ অধঃ রেখা ধরো

দুই পদ যোগ করো।

উত্তরে পর্বত থাকে, দক্ষিণে পবন ।

যদি পাও পেতে পারো কলস রতন।।”

হীরালাল তাঁর ঠারের ছড়া শেষ করে হাসলেন।

আমার মাথায় কিছু ঢুকল না। প্রিয়গোপালও বোকার মতন তাকিয়ে থাকল। আমি বললাম, “এ যে হিং টিং ছট!”

হীরালাল হাসলেন। বললেন, “তা ঠিক। এই হিং টিং ছট থেকেই অর্থটা আমি উদ্ধার করলাম।”

নাম।”

“কী অর্থ?”

“আমাদের বাড়ির বাগান ঘিরে ছ’টা পাখিঘর আছে। রাধাশ্যাম আমার ঠাকুরদার সুকুমারের কথা মনে পড়ল। পাখিঘরের কথা সে বলেছিল।

হীরালাল বললেন, “ছ’টা পাখিঘরকে বলা হয়েছে যড়, পক্ষী। ঠাকুরদার তৈরি পাখিঘরগুলোকেই বোঝানো হয়েছে এখানে। তারপর বলা হয়েছে একত্রিশ নম্বর ছবির কথা…যার চার কোণে চারটে ছোট পাখির ছবি। ঠার লেখা আছে : আগে পিছে। ছবিতে লতাপাতার শেষ নেই। তার মধ্যে ফুলের মতন করে আঁকা মুখের ছবিতে কপালে আর দুই চোখের কাছে রয়েছে তিনটি টানা-টানা পাতা। ত্রিনেত্র। ছবির তিন চোখের মাঝামাঝি জায়গা থেকে নীচে রেখা টানতে হবে। দুই পায়ের মাঝখানটা রেখা দিয়ে যোগ করলে…ওপর থেকে টেনে আনা রেখা যেখানে যোগ হবে সেখানে, মানে নীচে, ছবিতে যা দক্ষিণ, সেখানে মাটি খুঁড়লে গুপ্তধন পাওয়া যাবে। তার সহজ মানে আমাদের বাগানের পাখিঘরগুলোর দক্ষিণে, নীচের দিকে ঠাকুরদার সেই গুপ্তধন লুকনো আছে। ঠিক জায়গাটা বাছতে হলে ছবির দেখাদেখি একটা জ্যামিতির নকশা কষে মাটি খুঁড়তে হবে।”

প্রিয়গোপাল বলল, “আপনি মাটি খুঁড়েছিলেন?”

“না”, হীরালাল মাথা নাড়ালেন। “গুপ্তধনের দরকার আমার নেই। কিন্তু তার আগে একটা কথা আপনারা জানতে চাইলেন না। আমি বলি। আমাদের পাটনার বাড়ির লাইব্রেরি নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। কেউ বড় যত্ন করত না। একবার বিরাট এক আগুনও লেগে গিয়েছিল। কাকা একদিন বইপত্র বেচে দিতে বললেন। যারা বইপত্র নাড়াচাড়া করে—তাদের কাজে আসবে বলে আমরা একটা লিস্ট তৈরি করলাম। নানা জায়গায়, বইয়ের দোকানে চিঠি দিলাম। দিল্লিতে, এলাহাবাদে, মাদ্রাজে, কিছু বই গেল। কলকাতায় এল প্রিয়বাবুদের বইয়ের দোকানে। আর এমনই কপাল আমাদের, বই যখন পাঠানো হবে, হঠাৎ কাকার হাতে ঠাকুরদার লেখা একটা চিরকুট এসে পড়ল। তাতে কী লেখা ছিল তখন আমি জানতাম না। কাকা আচমকা এসে “এনসেন্ট ম্যান বইটা দেখতে চাইলেন। নিয়েও গেলেন হাতে করে, তারপর ওই একত্রিশ নম্বর ছবিটা কেটে নিয়ে ফেরত দিয়ে গেলেন। আমরা জানতেও পারলাম না। বইটা বিক্রি হয়ে আপনাদের দোকানে চলে এল।”

“বছর চারেক আগে?”

“হ্যাঁ। ওই রকম হবে। এরপর কাকা সেই ছবি নিজের কাছে লুকিয়ে রেখে নানান চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু তিনি মস্ত ভুল করেছিলেন। ছবিটা ছিঁড়ে নিলেও বুঝতে পারেননি যে, বইয়ের পাতা থেকে “ঠার” উদ্ধার করতে না পারলে হাজার মাটি খুঁড়লেও গুপ্তধন পাওয়া যাবে না।”

“আপনারা কখন থেকে কাকাকে সন্দেহ করতে লাগলেন ?”

“তা বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। লাইব্রেরি-ঘরে বসে কাকা নানান আঁকজোক করতেন। তারপর মাটি খুঁড়তে শুরু করলেন। বাড়িতে বলতেন, সমাধিযোগের অভ্যেস করছেন। একদিন অসাবধানে ঠাকুরদার লেখা চিরকুট আর বইয়ের ছবি লাইব্রেরি ঘরে রেখে তিনি কোথাও উঠে গিয়েছিলেন। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে সেগুলো দেখি।”

“কী লেখা ছিল চিরকুটে?”

“সামান্য কয়েকটা কথা। যদি কেউ কোনও দিন পূর্বপুরুষের রাখা অভিশপ্ত গুপ্তধনের হদিশ করতে চায়, অমুক বইয়ের অমুক ছবিটি দেখলে আর ঠার বুঝলে তা উদ্ধার করতে পারবে; তবে না করাই ভালো।” হীরালাল থামলেন সামান্য। আবার বললেন, “কাকা ছবিটাকেই আসল জিনিস মনে করেছিলেন, ঠার তাঁর মাথায় ঢোকেনি। চোখও হয়তো এড়িয়ে গিয়েছিল। বা হতে পারে…দাগ দেওয়া শব্দগুলো তিনি কোথাও টুকে নিয়েছিলেন। তবে অর্থ বুঝতে পারেননি।”

“আপনি পাটনার বাড়িতে থাকতেন না। এত সব ঘটনা আপনি জানলেন—দেখলেন কেমন করে?”

হীরালাল হেসে ফেললেন। “আমার মা বেঁচে ছিলেন। পাটনার বাড়িতেই থাকেন। পুনপুন থেকে হপ্তায় দু’একবার করে আমি পাটনার বাড়িতে আসতাম। এখনও আসি। আমার নিজের কোনও সংসার নেই। রাজার আছে। সকলেই পাটনায় থাকে।”

এগারো

দরজায় শব্দ হল। আমরা তাকালাম। শব্দটা যেন ধাক্কা মারার মতন। হীরালাল আমাদের দিকে তাকালেন। “রাজা! আপনারা বসুন। কোনও ভয় নেই।”

উঠে গিয়ে দরজা খুললেন হীরালাল।

হ্যাঁ, রাজালাল। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। চোখে হাফচশমা। সেই চেহারা। হাতে বিরাট এক আংটি। রাজালালের পেছনে-পেছনে যে এল, তাকে দেখে আমরা চমকে উঠলাম। তারকদা।

রাজালাল আমাদের দেখতে পাবেন আশা করেননি। বিরক্তভাবে দেখলেন কয়েক পলক। কেমন এক শব্দ করলেন। বোধহয় অসন্তুষ্ট হয়েছেন। আমাদের আর গ্রাহ্য করলেন না।

“কই, আমার জিনিস?” রাজালাল বললেন, হীরালালকে।

“পাবে।”

“পাবে নয়, দাও। হাতে হাতে। তোমার জিনিস ফেরত পাচ্ছ, আমার জিনিস আমাকে দাও।” বলে চোখের ইশারায় তারকদাকে দেখালেন। মানে তারকদা হল হীরালালের জিনিস।

হীরালাল শোবার ঘরে চলে এলেন ।

রাজালাল ঘরের মধ্যে এমনভাবে পায়চারি করতে লাগলেন যেন আমরা নেই।

ফিরে এলেন হীরালাল। হাতে একটা বই। “এই নাও। দেখে নাও।”

রাজালাল বইটা নিলেন। দেখলেন। পাতা ওল্টালেন। খুঁজলেন কিছু। “ছবিটা নেই?” “থাকার কথা নয়।”

“ঠিক আছে।…চলি।”

রাজালাল চলে যাচ্ছিলেন, হীরালাল বললেন, “শোনো, তোমায় একটা কথা বলি।

তুমি চেষ্টা করে দেখতে পারো, তবে তোমার লাভ হবে না।”

“কেন?”

“সত্যি কথা শুনবে? তা হলে বলি। তুমি বাড়িতে মা, বাবা, কাকা, কাকিমা সকলের কাছে বিহার ভূমিকম্পের কথা শুনেছ। উনিশ শো চৌত্রিশের ভূমিকম্প। গোটা উত্তর বিহার তছনছ হয়ে গিয়েছিল। পাটনা বাদ যায়নি। আমাদের ঘরবাড়ি, বাগান ও অনেক জায়গায় ফেটেফুটে চৌচির হয়ে গিয়েছিল। ঠাকুরদার সময় তৈরি পাখিঘরের কী অবস্থা হয়েছিল, হয়তো গল্প শুনেছ। বাবা সেগুলো আবার নতুন করে তৈরি করান।”

“তাতে কী হয়েছে?”

‘কী হয়েছে তুমি বুঝতে পারবে না। মাটির তলায় যেখানে যা ছিল তা কোথায়, কোন ফাটলের মধ্যে তলিয়ে গিয়েছে, কোনদিকে সরে গেছে, কেউ বলতে পারবে না। তুমি যা খুঁজতে চাইছ, খুঁজে পাবে বলে আমার মনে হয় না।”

“কেন?”

“অঙ্ক মিলবে না।”

“দেখা যাবে।”

“আর-একটা কথা তোমাকে বলি, রাজা। মা তোমার জন্যে সারাটা জীবন অশান্তি ভোগ করল। বউদি কান্নাকাটি করে। তুমি কলকাতায় চোরাই পাথরের কারবার ফেঁদেছ। তোমাকে আমি সবাধান করে দিলাম।”

“লেকচার দিও না। নিজের চরকায় তেল দাও।…চলি।”

রাজালাল চলে গেলেন।

হীরালাল চুপ। যেন ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছেন।

তারকদা কিছু বলল। হীরালালের ঘোর কাটল। আমাদের দিকে তাকালেন হীরালাল। বিষণ্ণ হাসি হাসলেন। “আপনাদের তারকদাকে ফিরে পেলেন? বড় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, না?…তারকবাবুর সঙ্গে আমার বছর দুই-আড়াইয়ের বেশি যোগাযোগ। উনি আমায় সাহায্য না করলে ওই বই আমার হাতে আসত না। আমিও কিছু ধরতে পারতাম না। তারকবাবু আমার সহায় হয়েছিলেন বলেই যতটুকু পারার পেরেছি। উনি আমার বন্ধু। ভাড়াটে লোক নন।” বলে হীরালাল তারকদার হাত চেপে ধরলেন।

সবাই চুপচাপ। হঠাৎ আমি বললাম, “রাজাবাবু কি গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারবেন না?”

“সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। ভূমিকম্প সেই গুপ্তধনকে কোন পাতালে নিয়ে গিয়েছে কে জানে।” হীরালাল আর-কিছু বললেন না।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন