বিমল কর
মানুষকে চমকে দিতে বনবিহারীর জুড়ি নেই। বনবিহারী আমাদের বন্ধু। সে পেশায় আরকিটেক্ট। মানে নকশা করে ঘরবাড়ির। গণেশ অ্যাভিনুতে তাদের একটা ফার্মও আছে, তবে বনবিহারী মাসের মধ্যে ক’দিন যে অফিসে গিয়ে বসে বলতে পারব না। বড়লোকের ছেলে, তিন পুরুষ ধরে টাকার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বলে পেটের চিন্তা নেই। নিজের শখ আর নেশা নিয়ে তার ব্যস্ততা বেশি। বনবিহারী ফটো তোলায় ওস্তাদ, দু-চার বার প্রাইজও পেয়েছে—এখান ওখান থেকে; সে ড্রয়িংরুম ম্যাজিশিয়ান—মানে ছোট খাট আড্ডায় আসরে মজার মজার ম্যাজিক দেখাতে পারে; মাছ ধরার প্রচণ্ড নেশা তার। তবে আমরা তার প্রতিভা দেখেছি গল্প বলায়। এমনটি আর দেখা যায় না। এমন এমন গল্প বলবে যে চমকে যেতে হয়। তার গল্প বলার দোষ অনেক, গল্পের চেয়ে লেজুড় বেশি, এমন তরতরিয়ে গল্পের গরুকে গাছে উঠিয়ে দেয় যে—কিছুই আর বিশ্বাসযোগ্য হয় না, তবু সব মিলিয়ে মিশিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা চমক সে দিতে পারে।
এই বনবিহারী সেদিন আমাদের আড্ডায় এল মুখে পাইপ গুঁজে। মাথায় দেখি নেপালী টুপি, বাঁ হাতে ক্রেপ ব্যাণ্ডেজ বাঁধা।বনবিহারী মাস খানেক অদৃশ্য হয়েছিল। কলকাতার বাইরে যাবার কথা বলেছিল, কোথায় তা বলেনি।
বনবিহারীকে দেখে আমরা যখন সবাই এক সঙ্গে কী হয়েছে কী হয়েছে করছি, তখন বনবিহারী মাথার টুপি খুলে দেখাল তিন তিনটে জায়গায় চুল নেই বললেই চলে। মানে জখমের ব্যাপার কিছু হয়েছিল। এখন আবার খোঁচা খোঁচা চুল গজাচ্ছে।
“তোর হয়েছিল কী?’
বনবিহারী বলল, “বলছি। তার আগে চা খাওয়া। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।”
নিখিল গিয়ে চায়ের কথা বলে এল বাড়ির মধ্যে।
“তোর হাতে কী হয়েছে?” ফণী জিজ্ঞেস করল।
“হাত মাথা—সব একই ব্যাপার। অ্যায়সা অ্যাকসিডেন্টে পড়েছিলাম ভাই, জীবনটাই চলে যেত। কী করে যে বেঁচে গেলাম—আজও বুঝতে পারি না।”
“অ্যাকসিডেন্ট?”
“হ্যাঁ। সাঙ্ঘাতিক অ্যাকসিডেন্ট। দাঁড়া বলছি,” পাইপের পোড়া ছাই পরিষ্কার করতে করতে বনবিহারী বলল, “একটু দাঁড়া গলাটা ভিজিয়ে নিতে দে।”
চা এল খানিকটা পরে। যে যার মতন চায়ের কাপ তুলে নিলাম। আমরা পাঁচ জন বনবিহারী, নিখিল, ফণী, যতীন আর আমি।
চা খেতে খেতে বনবিহারী বলল, “তোদের তো বলে গেলাম ক’দিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছি কলকাতার। আমার যাবার কথা ছিল ওয়ালটেয়ার। ছোট পিসেমশাই একটা পুরানো বাড়ি কিনবেন; বলেছিলেন সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বাড়িটা দেখাবেন। তা কিসের এক ফ্যাচাংয়ে পিসেমশাইয়ের ওয়ালটেয়ার যাওয়া হল না, তার বদলে আমার এক ভগ্নিপতি, মাসতুতো বোনের স্বামী, পল্লব আমায় ধরল, বলল—চলুন—নাগাল্যাণ্ডে ঘুরে আসবেন। হপ্তা খানেকের ব্যাপার।
“পল্লব এমন একটা বিদঘুটে কাজ করে যার মাথামুণ্ডু আমি বুঝি না। তার কাজের বারো আনাই মিলিটারি সিক্রেটের মতন ব্যাপার। যেন যা কিছু হবে সবই গোপনে বাকি চার আনা থেকে যা জানতে পারলাম—তাতে মনে হল পল্লবকে একটা বাজে কাজেই পাঠানো হয়েছে।
“এই কাজটা কী তা বলার আগে সামান্য ভূমিকা দরকার। ভূমিকা হিসেবে এই মাত্র বলতে পারি, আজকের দুনিয়ায় অনেক আজগুবি কাণ্ড ঘটছে। কারা ঘটাচ্ছে সে প্রশ্ন তুলে লাভ নেই। যাদের টাকা আছে রাশি রাশি তাদের আর যাদের মাথায় গ্রহান্তরের বুদ্ধিমান জীব সম্পর্কে একটা বিশ্বাস জন্মে গেছে ওরা না করছে এমন কিছু নেই। সোজা কথা, টাকাওয়ালা এবং মাথাওয়ালা কিছু লোকের একটা ক্লাব আছে, যার নাম এখানে বলা যাবে না। এই সংস্থা কিন্তু আন্তর্জাতিক। দেদার টাকা। খয়রাতির টাকাতেই ধনী। হেড অফিস—মানে সদর দপ্তর সুইজারল্যাণ্ডে। এই ক্লাবের কাজ হল—আমাদের এই জগতের বাইরে থেকে ভেসে আসা সাঙ্কেতিক শব্দকে ধরবার চেষ্টা করা এবং তার অর্থ উদ্ধার করা। কথা হল, কেউ যদি মনে করে—আমাদের জগতে এমন শব্দ নিয়মিত আসছে তবেই না সে চৌকিদারি করতে লোক বসাবে। ওরা তা মনে করে। পল্লব এই ক্লাবের একজন কর্মচারী। ভারতের পূর্বাঞ্চলে তার কাজ। কাজকর্মের হুকুমটা আসে দেরাদুনের কাছাকাছি তাদের ভারতীয় দপ্তর থেকে। পল্লব একজন রেডিও কমিউনিকেশন এক্সপার্ট। চাকরিটা একরকম নতুনই।
“আমরা যে নাগাল্যাণ্ডের এক সর্বনেশে এলাকায় গিয়ে পড়লাম তার কারণটা হল ওই—সঙ্কেতিক যোগাযোগ উদ্ধারের আশায়। পল্লবদের সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছিল, অমুক জায়গায় অমুক তারিখ থেকে অমুক তারিখ পর্যন্ত কোনও সাঙ্কেতিক শব্দ শোনা যেতে পারে। পল্লব যেন হাজির থাকে সেখানে।
“পল্লব আমায় টেনে নিয়ে গেল কেন আমি জানি না। আমার মনে হয়, একা একা জঙ্গলের মধ্যে পড়ে থাকতে আর পোকার কামড় খেতে তার ভালো লাগবে না বলেই সঙ্গী হিসাবে সে আমায় ধরে নিয়ে গেল। তা ছাড়া দাবা। পল্লব দাবা খেলায় পাকা আমারও ও ব্যাপারে নেশা আছে। দাবা খেলে সময় কাটানোর মতলবও পল্লবের ছিল।
“আমরা যে জায়গায় ছিলাম তার নাম বলা নিষেধ। ধরো জায়গাটার নাম আকলা। পাহাড়ের এক বিশাল ঢাল নেমেছে পূব দিকে তারই গা ধরে ঘন বনজঙ্গল, পাহাড়ী এক নদী। ওই নির্জনে, থাকার ব্যবস্থা কিন্তু ভালোই। একটা ডাকবাংলো ধরনের বাড়ি, কাঠের। বাড়ির আধখানা থাকা, টাকার জন্যে, বাকিটা অফিস। ওখানে যারা ছিল তাদের মধ্যে একজোড়া চাপরাশি কাম-ড্রাইভারের কথা বলতে হয়। জিপ ছিল একটা। আর ছিল ছোকরা নেপালী এক রেডিও এনজিনিয়ার। সে সাধারণ কাজকর্ম বেশ চালাতে পারত। ডাকবাংলো থেকে গজ পঞ্চাশ দূরে ছিল এক টাওয়ার, রেডিও কমিউনিকেশনের জন্যে।
“আমরা ওই জায়গায় পৌঁছেছিলাম এক বুধবার। বুধবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত দিব্বি কেটেছে। মানে ভাত, মুরগির ঝোল, আলুর দম, সেঁকা রুটি, জেলি এই সব খেয়ে। কফি আর চা খেয়েছি ঘণ্টায় ঘণ্টায়। জিপে চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি বলব না—কারণ ওই জিনিসটি করার উপায় ছিল না। পল্লবকে অনবরত নজর রাখতে হচ্ছিল কোনও সাড়াশব্দ এসে পৌঁছোয় কী না!
“তোমরা হয়তো বলবে, সাড়াশব্দ পাওয়া যেতে পারে এই খবরটা কে দেয়? আগেই বলেছি খবরটা মূল অফিস থেকে বিভিন্ন এলাকায় ঘাঁটি অফিসে যায়, সেখান থেকে আসে জোনাল অফিসে। যেমন পল্লবের কাছে খবর এসেছিল দেরাদুনের অফিস মারফত।
“আমার কাছে সমস্ত ব্যাপারটাই, টাকার শ্রাদ্ধ বলে মনে হচ্ছিল। নিতান্ত পাগলামী। কোথাও কিছু নেই কোথাকার এক আকলার অফিসের রেডিও ঘরে অন্য জগতের খবর এসে পৌঁছবে! সঙ্কেতিক শব্দে। গ্রহান্তরের কেউ আছে কি না—তারই যখন ঠিক নেই তখন শব্দটা পাঠাবে কে? কেনই বা পাঠাবে!
“আমাদের সাত দিন থাকার কথা। বুধ থেকে শুক্রবার দিব্বি কাটিয়ে শনিবার বিকেলের দিকে বসে বসে চা খাচ্ছি, হঠাৎ নেপালী ছোকরা পল্লবকে ডাকল, স্যার—শীঘ্রী আসুন।
“ডাক পেয়ে পল্লব চলে গেল রেডিও ঘরে। আমি বসে থাকলাম। চা শেষ হল, দু-দুটো কড়া সিগারেট শেষ হল—পল্লব আর আসে না। তোমাদের বলতে ভুলে গিয়েছি—ওদের রেডিও ঘরে আমার যাওয়া বারণ ছিল। জোর করলে যেতে পারতুম, কিন্তু আমার জোর করতে ইচ্ছে করেনি।
“এক ঘণ্টারও পরে পল্লব ফিরে এল। বলল, একটা গোলমালে পড়ে গেলাম বনবিহারীদা। একটা শব্দ তো ধরা যাচ্ছে, যাকে বলে বিপ বিপ শব্দ। বড় ছোট ছোট বড় আবার বড়। এই শব্দটা কিসের তা তো বুঝতে পারছি না।
“আমি বললাম, কোনও প্লেনের হবে।”
“পল্লব মাথা নড়ল, না।”
“ঘণ্টা খানেক পরে আবার উঠল পল্লব। আমি ঘরে চলে গেলাম।”
“সন্ধে হয়ে গেল। রাত হল। পল্লব আর আসে না। প্রায় ঘণ্টা তিনেক পরে পল্লব এল। এসে বলল, বনবিহারীদা—আমি কিছু বুঝতে পারছি না। সেই শব্দটা আরও স্পষ্ট আরও জোরে হয়েছে। পাক্কা পনেরো মিনিট অন্তর আট মিনিট করে সিগন্যাল দিচ্ছে। শর্ট লং আর মানছে না। কিন্তু কে দিচ্ছে তা তো ধরতে পারছি না।
“পল্লব এক মগ কফি, এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আবার চলে গেল অফিসে। আমি একা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়—পল্লব আর আসে না। আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়া গেল তো! আমারই বা একা একা ভালো লাগবে কেন !
“পল্লব ফিরে এল বেশ রাত করে। বলল, বনবিহারীদা—কোনও একটা ব্যাপার হয়েছে। কী হয়েছে আমি বলতে পারব না, তবে সেই সিগন্যালিং আরও তাড়াতাড়ি হচ্ছে। পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর। মনে হচ্ছে যেন, কোনও অপারেটর জরুরী কিছু বলার চেষ্টা করছে। বিপদে পড়ল নাকি তাই বা কে জানে! তাছাড়া বিপদে পড়ার মতন জিনিসটাই বা কী? কোনও ফ্লায়িং অবজেক্ট, না, এ শব্দ অন্য কিছুর! যাইহোক, তুমি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ো, আমার কপালে রাত জাগা রয়েছে। হয় শব্দটা থামা পর্যন্ত আমায় অপেক্ষা করতে হবে, না হয়—ওর যতক্ষণ পি বিপ আমারও ততক্ষণ রেকর্ডিং চলবে।”
“আমি বললাম, ওই একই শব্দ রেকর্ড করে কী হবে?” পল্লব বলল, “তা জানি না। আমরা রেকর্ডিংয়ের টেপ সদর দপ্তরে জমা দিই। সেখানে ওরা এর অর্থ পরীক্ষা করে। একবার এক ফ্লায়িং অবজেক্টের সিগন্যাল ধরা পড়েছিল। আমি অবশ্য শুনেছি।”
“পল্লব চলে গেল তার দপ্তরে। সেই নেপালী ছোকরাটি তখন থেকে ঠায় বসে আছে অফিসে। আমি খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে পড়লাম।”
“তোমরা বিশ্বাস করবে না ভাই, এরপর সেই অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটল। তখন কত রাত তা আমি জানি না—অঘোর ঘুমে তখন, আচমকা ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙে মনে হল যেন এক অন্ধকার গুহায় মধ্যে পড়ে আছি। চোখ চেয়েও কোনও কিছু বুঝতে পারছি না, দেখতে পারছি না। অন্ধ হলে হয়তো সেই রকমই দেখায় সব। কোনও শব্দও পাচ্ছিলাম না।
“ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি, বা কিছু একটা ঘটে গেছে ভেবে যেন বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলাম। তারপর যখন ধীরে ধীরে নিজের চেতনাকে ফিরে পেলাম, মনে হল—আমি বিছানায় শুয়ে নেই, মাটিতে পড়ে আছি, কোথাও কোনও আলো জ্বলছে না, শব্দ নেই। হুঁশ হবার সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলাম। এরকম তো হবার কথা নয়। ডাকবাংলোর বাইরে বাতি জ্বলে। সাধারণ বাতি। রেডিও ঘরের জন্যে ওদের ব্যাটারি আর কী যেন সব আছে। এমন নিকষ কালো অন্ধকার তো হবার কথা নয়।
“সঙ্গে আমার টর্চ ছিল। কিন্তু ওই অন্ধকারে কোথা থেকে টর্চ খুঁজে নেব? কোথায় আমার বিছানা? পড়ে আছি মাটিতে। পল্লবের কী হাল? কী হল নেপালী ছেলেটির? দুই চৌকিদারের?
“অন্ধকার হাতড়ে হাতড়েও না খুঁজে পাই নিজের খাট, না দরজা। অন্ধের মতন হাতড়ে বেড়াচ্ছি—হঠাৎ শুনি অদ্ভুত এক শব্দ—বিপ বিপ বিপ বিপ। কোনও শব্দই নিজের কানে না শনলে তা অনুভব করা যায় না, বিশেষ শব্দটা যখন অপরিচিত। তোমরা ইংরিজী সিনেমায়—এইধরনের একটা শব্দ শুনেছ হয়তো। কিন্তু আমি যে শব্দের কথা বলছি তার কাছাকাছি কোনও শব্দ আমি অন্তত জীবনে শুনিনি। অদ্ভুত এক শব্দ—বিপ বিপ বিপ বিপ বিপ একটানা। কোথাও ছেদ নেই। বিরতি নেই। মনে হল শব্দটা খানিকটা তফাত থেকে আসছে।
“আমি অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছিলাম। এই শব্দটা এতক্ষণ কোথায় ছিল? শুনতে পাইনি কেন? নাকি যে সময়টুকুতে আমার হুঁশ ছিল না সেই সময়টুকু আমি নিজেই শুনতে পাইনি।
“হঠাৎ দেখি শব্দটা থেমে গেল। একেবারে আচমকা। কেন থামল বুঝলাম না। পল্লবদের জন্যে আমার তখন ভীষণ ভয় হচ্ছে। কোথায় তারা?
“কোনও রকমে হাতড়ে হাতড়ে, গুঁতো খেতে খেতে ঘরের বাইরে এলাম। সেই নিকষ কালো অন্ধকার, আকাশের তারার আলোও যেন মেঘের আড়াল পড়ে আছে, ঝোড়ো বাতাস দিচ্ছিল, শন শন বাতাসের শব্দের সঙ্গে কেমন এক ভয়ও যেন ভেসে আসছে চতুর্দিক থেকে।
আমি চিৎকার করে পল্লবের নাম ধরে ডাকলুম, ডাকলুম নেপালী ছেলেটিকে, চৌকিদারদের। কোনও সাড়া শব্দ নেই। আতঙ্কে উদ্বেগে পাগল হয়ে গলা ফাটিয়ে ডাকতে লাগলাম ওদের। না, কোনও সাড়া নেই।
“ঠিক এই সময় হঠাৎ আবার সেই শব্দ—বিপ বিপ বিপ বিপ এবার আর অত ধীরে নয়। জোরে। শব্দটা একই রকম, তবে তার জোর বাড়ছে। মনে হল, আগে যা তফাতে ছিল এখন তা কাছে এসে গেছে অনেকটা।
“কোনও শব্দ—তা যেমনই হোক, যদি একই নাগাড়ে একই ভাবে তোমার কানের কাছে বাজে কেমন হয় শুনেছ কখনও? আমিও আগে শুনিনি। গান বলো, বাজনা বলো, বৃষ্টির শব্দ বলো, রেল গাড়ির শব্দ বলো—সব শব্দেরই উঁচু নিচু পরদা আছে, কখনও জোরে কখনও ধীরে হয়, ছন্দে ভাঙচুর আছে ওঠা-নামার খেলা আছে। কিন্তু একই ভাবে, সমানে একই ধরনের কোনও শব্দ বাজতে থাকলে যে কী ভয়ংকর লাগে তোমরা বুঝবে না। একদিন পরীক্ষা করে দেখো। পাগল হয়ে যাবে।
“আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। শব্দটা আর থামছে না, থামছে না। সেই একই ভাবে বিপ বিপ বিপ বিপ। আর প্রতি মুহূর্তে তার জোর বাড়ছে।
“কী হয়েছে তা হলে? রেডিও ঘরের দরজা জানলা কী ভেঙে গেছে, না খোলা ? পল্লবরা কী অজ্ঞান হয়ে আছে? নয়তো এই শব্দ কেমন করে আসবে!
“আমি কিছুই না বুঝে, ঠাওর করতে না পেরে—শুধু শব্দটার দিকে কান রেখে অন্ধকারে এগিয়ে চললাম পা পা করে।
“যেতে যেতে মনে হল শব্দটাই আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমি যেন অদ্ভুত এক নেশার আকর্ষণে ওই শব্দের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। শব্দটা ক্রমশ জোর হচ্ছিল। কিন্তু তার সুর বা ছন্দ পাল্টাছিল না। বিপ বিপ বিপ “শেষ পর্যন্ত আমি এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম যেখান থেকে আর পিছিয়ে আসা যায় না, এগিয়ে যাওয়াও নয়। সেই জগতটা শুধু ওই শব্দের। একই রকম শব্দের। আর কী প্রচণ্ডভাবে সেই শব্দ আমার কানের ওপর বাজতে লাগল, আমাকে পাগল, বেহুঁশ করে তুলল—তোমাদের বলতে পারব না।
“হ্যাঁ, আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম।
“যখন জ্ঞান ফিরল তখন সকাল।
“আমরা সকলেই বেঁচে, তবে জখম হয়েছি কম বেশি। আমার মাথার তিন চারটে জায়গায় কাচ বা কাঠ লেগে কেটে গেছে। রক্তপাত হয়েছে প্রচুর। পল্লবের ডান হাত ভেঙেছে, নেপালী ছেলেটির পা জখম। চৌকিদারদের চোট জখম কম।
“হয়েছিল কি?
“সোয়া দুটো নাগাদ এক ভুমিকম্প হয়। ভূমিকম্পই বলতে হবে–কেননা তামাম জায়গাটা দুলতে শুরু করে, কাঠের বাড়ির দরজা জানলা ভেঙে পড়ে। পল্লবেরা তখনই চোট পায়। তারা রেডিও ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দরজা-টরজা ভেঙে পড়ে। ওরা চোট পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। আর শব্দটাও তখন বেশ জোর হয়ে উঠেছিল।
“সকালে পল্লব আর নেপালী ছেলেটি মিলে যেটুকু দেখল বুঝল—তাতে মনে হল, রেডিও ঘরের যন্ত্রপাতি সব ভেঙে চুরে নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু ওই বিপ বিপ শব্দটাই তখনও বেজে চলেছে। তবে তার সেই শব্দ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। মনে হচ্ছিল যেন—মিলিয়ে আসছে।”
বনবিহারী থামল। পাইপে তামাক ঠাসল। ধরাল ধীরে সুস্থে। তারপর বলল, “এই শব্দটাকে কী মনে হয় তোমাদের?”
আমরা চুপ করে থাকলাম।
যতীন বলল, “ভুতুড়ে।”
“হতে পারে,” বনবিহারী বলল, “তবে আমার মনে হয়, এটা কোনও বাইরের ব্যাপার নয়, মানে কোনও গ্রহান্তরের জীব এ-শব্দ পাঠাচ্ছে না। কেন পাঠাচ্ছে না—তার যুক্তি হল—মানুষ তার জ্ঞানবুদ্ধি অভ্যেস মতন এক ধরনের সাঙ্কেতিক শব্দ কমিউনিকেশানের জন্যে—মানে খবরাখবর দেওয়া নেওয়ার জন্যে ঠিক করে নিয়েছে। তার মূল ধরনটা এক। অন্য গ্রহের জীব আমাদের শব্দ নকল করবে কেন! তারা তাদের মতন শব্দই পাঠাবে। সেটা কেমন হবে আমরা জানি না। হয়তো মেঘের ডাকের মতন, হয়তো নাচার শব্দের মতন, হয়ত বৃষ্টির মতন। আমরা জানি না। কাজেই ওই শব্দটা এই জগতের। তবে হ্যাঁ, যেভাবে শব্দটা সেদিন ব্যবহার করা হয়েছে তাতে আমার মনে হয়, ওটি ভাই শব্দভেদী বাণ।”
“শব্দভেদী বাণ?”
“রামায়ণ পড়নি! রাজা দশরথ অন্ধমুনির ছেলেকে ভুল করে মেরেছিল, ভেবেছিল হরিণ জল খাচ্ছে।”
“তার সঙ্গে এর সম্পর্ক কী?”
“সম্পর্ক সরাসরি কিছু নেই। তুলনাটাও ঠিক নয়। তবু আমি বলব, আজকাল পৃথিবীতে মানুষ মারার যে মহড়া চলছে লুকিয়ে লুকিয়ে, নানা রকম গোপন ও ভয়াবহ অস্ত্র আবিষ্কার হচ্ছে। কাগজে প্রায়ই দেখো, এই অস্ত্রটি তার অন্যতম। শব্দ দিয়ে মানুষ মারার ফন্দি।…আমার মনে হয় পল্লবদের ক্লাব সন্দেহ করেছিল কেউ এ-রকম কিছু একটা করতে পারে। নজর রাখতে বলেছিল। দুঃখের বিষয় নজর রাখতে গিয়ে আমরাই ঘায়েল হয়ে গেলাম।”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন