যশিড়ির বড়মামা – বিমল কর

বিমল কর

যশিড়ির বড়মামা

এক

যশিডি থেকে কালুদা সরাসরি দু’দুটো চিঠি নিয়ে হাজির। সাতসকালেই। একটা চিঠি আমার নামে, ঝন্টু। অন্য চিঠিটা মায়ের নামে, নুটু। আমাকে চিঠি লিখেছে বড়মামা। মায়ের চিঠি এসেছে মামির কাছ থেকে। অত সকালে কালুদাকে দেখে আমরা একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলাম। সকালের ট্রেনে হাওড়া স্টেশনে নেমে যেভাবে রাতজাগা বাসি চোখমুখ আর খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে কালুদা আমাদের লেকটাউনের বাড়িতে এসে হাজির হল, তাতে ঘাবড়ে যাবারই কথা ।

মা ভয় পেয়ে বলল, “কী হয়েছে কালু?”

কালুদা বলল, “ভয়ের কিছু নেই পিসিমা, চিঠি নিয়ে এসেছি।”

কালুদা বড়মামার কাছেই থাকে। বছর দশ-বারোর বেশি বই কম নয়। বড়মামার যোগ্য সাকরেদ। আমার বড়মামার নাম, মহাদেব দত্ত। মামির নাম, মহাদেবী। বাপের বাড়ি থেকে দেবী নাম নিয়েই এসেছিল মামি। শ্বশুরবাড়িতে একসময় দেবীর আগে মহা যোগ হয়ে গেল। হবারই কথা। মামা-মামি দুইই সমান। দাঁড়িপাল্লায় চাপলে, মানে ওজনে চাপালে কেউ কারুর থেকে কম নয়, স্বভাবেও সমান সমান। আত্মীয়রা বলত, যেমন দেবা, তেমনি দেবী।

বড়মামার চিঠি পড়ে আমি হাসব না কাঁদব; বিছানায় গড়াব না মটিতে লুটোব; পেট ব্যথার ওষুধ খাব না মাথা ঘোরার—কিছুই ঠিক করতে পারলুম না। শেষমেশে হাসতে হাসতে বিষম খেয়ে মরে যাচ্ছিলুম আর কী।

মা এসে বলল, “এত হাসছিস কেন? মরবি।”

আমি বললুম, “মামা পাগল হয়ে গছে। টোটাল ম্যাড।”

মায়ের হাতে ছিল মামির চিঠি। মা দেখিয়ে বলল, “বউদি কাশী চলে যাচ্ছে। লিখেছে, সংসারে আর থাকবে না। ঘেন্না ধরে গেছে।”

“তা ধরতে পারে। মামির আর দোষ কোথায়? মামা যশিড়ির বাড়িতে পাগল পোষার ব্যবস্থা করছে। মামা কী লিখেছে, শুনবে?” বলে আমি মামার চিঠিটা পড়তে লাগলাম।

“ঝন্টু মহারাজ, এই পত্রে আমার আশীর্বাদসহ তোমায় কয়েকটি প্রয়োজনীয় কর্মের দায়িত্বভার ন্যস্ত করিতেছি। আমার যশিডির বাড়িটার পূর্বদিকে যে আউট হাউসটি আছে, সেই বাড়িটিতে আমি একটি পাগল-পালন নিবাস খুলিব। অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া (চিন্তা করিয়া) আমি এই কাজটি করিতে যাইতেছি। এ-জগতে যথার্থ পাগল পাওয়া ভার। উন্মাদ, ক্ষেপা, বাতিকগ্রস্ত, সেয়ানা—প্রভৃতি পাগল বিস্তর। ঈশ্বরের জগতে বাঁদরের সংখ্যা অনেক, সর্বত্রই তাহারা বিচরণ করিতেছে। হায় রে দু-দশটি যথার্থ পাগল নাই। আমার এই সাধু সংকল্পে তুমি আমার সহায় হইবে, এই ভরসা করি। নিচের বিজ্ঞাপনটি কলিকাতার বড় দুটি কাগজে আজই দিয়া আসিবে। যাহাতে আগামী রবিবার অবশ্যই প্রকাশ পায়। তোমায় টাকা পাঠাইলাম। বিজ্ঞাপন প্রকাশ পাইলেই পাঁচ কপি করিয়া কাগজ কিনিয়া এখানে চলিয়া আসিবে। অন্যথা না হয়। ইন্টারভিউয়ের সময় তোমাকে আমার প্রয়োজন। আশীর্বাদ জানিবে। ইতি তোমার বড়মামা।”

মা চিঠি পড়া শুনতে শুনতে বলল, “বড়দার মাথাটা একেবারেই গেছে।” বিজ্ঞাপনটা শোনো।…“যথার্থ পাগল চাই। বয়স পঁচিশ হইতে পঁতাল্লিশের মধ্যে হইলেই চলিবে। জাতিধর্মের বিচার নাই। মহিলা পাগলের আপাতত কোনও ব্যবস্থা নাই। নির্বাচিত পাগলদের থাকা খাওয়া ধুতি জামা ফ্রি। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার পর মাত্র দশজন পাগলকে নির্বাচন করা হইবে। যথা শীঘ্র পাল্টে আবেদন করিতে হইবে। বিলম্বে হতাশ হইবার সম্ভাবনা। ঠিকানা শ্রীযুক্ত মহাদেব দত্ত। মহাদেব ভবন। যশিডি। বিহার।

মা ততক্ষণে গালে হাত দিয়ে মুখ হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলতে পারছিল না। শেষে কোনও রকমে বলল, “বউদির কপাল। সারাটা জীবন জ্বলেপুড়ে মরল।

এরপর বউদি যদি কাশী চলে যায়—তার দোষ কী।”

“যাবে না। দাঁড়াও না আমি যাচ্ছি। মামিকে ম্যানেজ করে ফেলব!”

“তুই যাবি?”

“যাব না। বড়মামার হুকুম।’

“তুই যাবি কেমন করে? অফিস?”

“ছুটি নেব। শীতের ছুটি। বেড়িয়ে আসি ক’দিন!”

“তুইও পাগল!”

“নরানাং মাতুলক্রম…।” বলে আমি হাসতে লাগলুম।

দুই

চেনাশোনা আর বন্ধুবান্ধব না থাকলে কোনও কাগজেই বোধ হয় আমি ওই অদ্ভুত বিজ্ঞাপন বার করতে পারতাম না। টাকা দিয়েও নয়। তা কাগজওয়ালাদের হাসিঠাট্টা হজম করে বিজ্ঞাপনটা বার করা গেল। কৃতিত্ব স্বপনেরই।

ডিসেম্বর মাস চলছে। কলকাতার গায়েও শীত ধরেছে সবে। বছর শেষের ছুটি নিয়ে নিলাম অফিস থেকে। তারপর যশিডির গাড়ি ধরলাম।

যশিডি কলকাতা নয়। পৌষ পড়ার মুখে শীত পড়ে গিয়েছিল। আমিও বেশ তৈরি হয়ে এসেছিলুম। গরম জামাকাপড় তো ছিলই, মায় মাফলার, মাংকি ক্যাপও নিতে ভুলিনি।

যশিডিতে আমার মামার বাড়িটিকে ভূতের বাড়ি বললেও বলা যায়। পাঁচিল ঘেরা মস্ত সীমানা। যদিও পাঁচিলের অনেক জায়গা ভেঙে পড়েছে। পুরনো হয়েছে তার চেহারা, শ্যাওলা ধরেছে, কালো হয়েছে, ফাটলের গায়ে গায়ে লতাপাতা। মামা সদ্যসদ্য পাঁচিল সারানোর কাজে মিস্ত্রিমজুর লাগিয়েছে দেখলাম। গাছে গাছে চারিদিক ভরা।

ইউক্যালিপটাস, দেবদারু, আম, জাম, নিম—কী নয়। ফুলবাগান নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, আবার নতুন করে বাগান তৈরি হচ্ছে। দক্ষিণের দিকে এই বাংলো বাড়ি। বড়ই। পেছনে কুয়ো। পুবে একটা ব্যারাক গোছের বাড়ি। তা ছোট নয় তেমন, ঘর বারান্দা রয়েছে। এই বাড়ির কাজেও সবে মিস্ত্রিমজুর খাটতে শুরু করেছে দেখলুম। মামা ওখানেই পাগল-পালন নিবাস বা আশ্রম খুলবে। আমার বড়মামা ছিল পুলিস-দারোগা। জীবনে একটাও চোর-ছ্যাঁচড় ধরেনি। ডাকাতও নয়। থানায় যাদের ধরে আনা হত মামা তাদের “জিলাবি”, “বুদিয়াকা লাড্ডু”, “নিমকিন” খাওয়াত। ফলে মামা যখন যেখানে রাজত্ব করেছে, চোর ছ্যাঁচড়া খুব শান্তি-স্বস্তিতে ছিল। বড় চুরি করত না। লজ্জা পেত। হোলিতে মামাকে মিষ্টি-মাস্টার ভেট দিয়ে যেত খুশি হয়ে।

এ হেন মামার কিন্তু বেশ নাম হয়েছিল। সবাই ডাকত মহাদেব দাগাজি বলে। দাগাজি মানে দারোগাজি। চাকরিতে দশ ঘাটের জল খেয়ে বড়মামা যখন রিটায়ার করল, তখন যশিডির এই পুরনো বাড়িটাই কিনে ফেলল। বাড়িটা এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সাহেবের। সাহেব ছিল না, মেমসাহেব জলের দরে বাড়ি জমি বাগান সব বেচে দিয়ে চলে গেল কানপুর। বড়মামা তার জনা চারেক পুষ্যি নিয়ে জাঁকিয়ে বসল বাড়িটাতে। দাদুর রেখে যাওয়া টাকা-পয়সা আর মামার গচ্ছিত মিলে ভালোই জমেছিল ব্যাংকে। মামা-মামির কোনও সন্তান নেই। আছে কালুদা, রামভরত, গোপিয়া আর করুণাদি।

বাড়িতে ঢুকেই মামা কয়েকটা কাজ সেরে নিয়েছিল। ‘লিলি লজ’ নাম পাল্টে বাড়ির নাম করেছিল ‘মহাদেব ভবন’ বসার ঘরে মস্ত মস্ত ছবি টাঙ্গিয়েছিল শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধ, যিশুর, ছিল রামকৃষ্ণদেবের ছবি, বিবেকানন্দর। আর আমার দাদুর। দিদিমার।শোবার ঘরেরও পাল্টে ছিল কিছু কিছু। মামির রান্নাঘর হয়েছিল এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। পাখি, কুকুর, বেড়াল—মামার না ছিল কি! মামার আদরের কুকুরকে মামা ডাকত, ‘গোল্ডি’ বলে। মানে, ওরে আমার সোনা। কুকুরটা ষোলো আনা নেড়ি খালি খেত, আর ঘুমিয়ে থাকত। কাউকে কামড়াত না। ঘরে ব্যাঙ ঢুকলে সে-বেটা ভয়ে লেজ গুটিয়ে পালাত। আমি বছরে বার দুই তিন মামার কাছে আসতাম। মামা যে আমাকে ভালোবাসে। মামিও।

তিন

বাড়ি আসতে-না-আসতেই মামা বলল, “এসেছিস! বাঁচালি !”

“তোমার বিজ্ঞাপন বেরিয়ে গেছে।”

“জানি। অল রেডি তিনটে চিঠি এসে গিয়েছে। আরও আসবে। তবে বুঝলি ঝন্টু, ওই যথা শীঘ্র কথাটা বদলে দিলেই হতো। ওই আরও সাতটা দিন গ্রেস দিয়ে একটা তারিখ থাকা দরকার ছিল। লোকে দেখবে, তবে না দরখাস্ত করবে।”

“লোকে নয় মামা, পাগলে দেখবে—তবে না—”

“ইয়েস ইয়েস। তা তুই দশ-পনেরোটা দিন থেকে যা।” “দেখি !”

“দেখি কিরে! এতবড় কাজ! তুই না থাকলে চলে?” “মামির খবর কী?”

‘দেখে আয়! বাক্স গোছাচ্ছিল! কাশী যাবে!” আমি বললুম— “যাবে যাও কাশী, আই ডোন্ট কেয়ার, বাজার আমি চিনি।” মামি না থাকলে মামার চলে না।

তবে হ্যাঁ, মামা বাঁশি বাজাতে জানে। আড় বাঁশি। অনেকে তাই মামাকে বাঁশি দারোগাও বলত আড়ালে।

মামার কাছ থেকে মামির কাছে গিয়ে দেখলুম, তুলসিপাতা গোলমরিচ আদার রস দিয়ে মামি এক ঘটি চা করছে। বলল, “তোর গলা পেয়েছি। নুটু কেমন আছে? তোর বাবা? বাড়ির আর কী খবর?”

খবরাখবর দিয়ে বললুম, “তুমি কাশী যাচ্ছ? মা আমাকে পাঠাল। বলল, তোর মামি কাশী যাচ্ছে। তুই সঙ্গে যা। কাশীতে এখন ভীষণ প্লেগ লেগেছে। কখন কী হয়?”

মামি আঁতকে উঠে বলল, “প্লেগ! কই শুনিনি তো!”

“শুনবে কোথা থেকে! ওদিককার কাগজ কি এদিকে আসে! তারপর গভর্নমেন্ট রয়েছে না, প্যানিক ছাড়িয়ে যাবে বলে সব চেপে দিচ্ছে।”

“ও! তা প্লেগে মরা ভালো, তবু পাগলের হাতে মরা ভালো না।” মামির কথায় হাসতে হাসতে দম বন্ধ হয়ে যায় আর কি !

মামি বলল, “যা, এই লোটা আর গ্লাসটা তোর মামাকে দিয়ে আয়। ঠাণ্ডা লাগিয়েছে বুড়ো। গলায় ইঞ্জিনের ভোঁ বাজছে। বসে বসে খাক।…আর তুই হাতমুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে আয়। চা-টা খেয়ে নে।”

মামি আর মামা দুজনেই আকারে সমান। প্রায় গোলাকার। মামি বেশি গোল। খানিকটা বেঁটে। মামির গায়ের রং এই বয়সেও কী ফরসা। চোখমুখ যেন মা দুর্গার ছাঁদের মতন। মাথার চুলও সব সাদা ।

মামার রং মামির চেয়ে কম ফরসা। মাথায় মামা মাঝারি। চোখমুখ নিরীহ ভালো মানুষের মতন। মাথায় চুল বেশি নেই। মাঝখানে টেরি। মস্ত একটা গোঁফ রাখে মামা। দারোগা গোঁফ রাখে মামা। দারোগা গোঁফ। এখনও মামা খাকি হাফ প্যান্ট, কলার তোলা গেঞ্জি, নরম চপ্পল পরে প্রায়ই বসে থাকে বাড়িতে। বাইরে ফুল প্যান্ট। পাজামাও পরে মামা।

চায়ের লোটা গ্লাস নিয়ে এসে মামাকে দিলাম। বললাম, “কই, মামি তো কাশী যাচ্ছে না!”

মামা বলল, “বললাম তো তোকে। মুরোদ আমার জানা আছে বুড়ির।”

চার

সাতদিনের মাথায় হিসেব করে দেখলুম, একশো পঁয়ত্রিশটা চিঠি এসেছে।

আজকাল ডাকঘর মানে গুমঘর। বারো আনাই গুম হয়ে যায়। উত্তরপাড়া থেকে কলকাতা চিঠি আসতে—যদি একান্তই আসে—পাক্কা একুশ দিন। বউবাজার থেকে শ্যামবাজার পাঁচ দিন। তা আন্দাজ করে দেখলে মনে হয়, নয় নয় করেও অন্তত শ’চারেক চিঠি ছাড়া হয়েছিল মামার ঠিকানায়। পেয়েছি মাত্র একশো পঁয়ত্রিশ।

মামা বলল, “নট ব্যাড দেড়শো হলেই ইন্টারভিউ শুরু করব।”

বললাম, “মামা, আমার ছুটি ফুরিয়ে যাবে। আর মাত্র ছ’সাত দিন হাতে আছে।”

“ছুটি বাড়িয়ে নে। আরও সাতটা দিন। ভাগ্নে, সৎ কাজে ভাগ্নেরাই মামাদের সহায় হয়। ইন্টারভিউয়ের চিঠি ছাড়া শুরু কর। জাস্ট সাতদিন পরে থেকে ইন্টারভিউ নেব। দিনে পনেরো কুড়ি। যারা আসবে তারা রাহা খরচ পাবে। পঞ্চাশ টাকার বেশি নয়। আর এখানে ইন্টারভিউ দিতে আসবে সকালবেলায়, দুপুরের খাওয়া পাবে—রুটি, ডাল, কুমড়োর ছক্কা, গুড়। ব্যস–আর কিছু নয়। সে চিঠি ছাড়তে শুরু কর আজ থেকেই।” অত চিঠি লিখবে কে? মামা বলল, কার্বন কপি কর, শুধু নাম ঠিকানাটা পাল্টে দিবি। বুঝলি? যথেষ্ট বুঝলাম।

ওদিকে আউট হাউস অনেকটাই সারানো হয়ে গেছে। পাগলরা থাকবে তো! ঘরের ভেতর চুনকাম চলছিল। গোটা দশেক দড়ির খাটিয়া এসে হাজির হয়েছে। বিছানাপত্র কম্বলের ব্যবস্থা হচ্ছে।

মামি সবসময় ফুঁসছে। বলছে, “ওই ঘরে কেউ থাকুক না থাকুক—আসল পাগলকে আমি তালা বন্ধ করে রেখে দেব। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিল আমায়! বাবা গো, তুমি একবার দেখে যাও— কী হাল হয়েছে আমার।” মামা আছে নিজের মতন। আউট হাউসের কাজ দেখছে, দেওঘর থেকে সতরঞ্জি আর কম্বল কিনে আনাচ্ছে পাগলদের বিছানার জন্যে, ওদিককার কুয়োতলা পরিষ্কার করিয়ে ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়েছে একগাদা !

এরই ফাঁকে ফাঁকে মামা আমার সঙ্গে পরামর্শ করে নিচ্ছে, ইন্টারভিউটা কীভাবে নেওয়া যায়? লিখিত প্রশ্নের উত্তর তো সবাই দিতে পারবে না—কারণ লেখাপড়াই হয়তো জানে না তারা। তখন লিখিত প্রশ্নের পঞ্চাশ নম্বর কীভাবে অ্যাডজাস্ট করা যাবে! মৌখিক প্রশ্ন নিয়ে অবশ্য সমস্যা নেই।

মামা বলল, “ঝন্টু, যারা লেখাপড়া জানে না তাদের প্রতি আমাদের মানবিক কর্তব্য আছে। নয় কী?’

সাধু বাংলা, সাধু প্রস্তাব। বললাম, “তা আছে।”

মামা বলল, “তাহলে ওদের মণ্ডল কমিশনের অ্যাডভানটেজ দিতে হবে! ঠিক কিনা!”

হাসতে গিয়ে আমার পাজামার কোমরের দড়ি ছিঁড়ে গেল!

পাঁচ

দশ দিনের মাথায়, মানে আমি যশিডি আসার সতের দিনের মাথায় শুরু হল ইন্টারভিউ। মামা বাংলো বাড়ির বারান্দায় টেবিল খাতা কাগজ কলম রুল, ফিতে হান্টার, বেঁটে দূরবীন মানে বাইনাকুলার, কিছু কলা, ভিজে ছোলা—আরও কত কী নিয়ে বসে আছে।

পাশের চেয়ারে আমি।

আউট হাউসের দিকে জনা কয়েক পরীক্ষার্থী পাগল।

মামা ঘড়ি দেখল! বেলা ন’টা।

কালুদা সামনে দাঁড়িয়ে।

মামা বলল, “ঝন্টু, আরম্ভ করা যাক।”

“হ্যাঁ, শুরু হোক।”

মামা কালুদাকে বলল, “যাও নিবারণ গুইকে ডাক।”

নিবারণ গুঁই এল।

তালপাতার সেপাই। পরনে পাজামা, গায়ে ছেঁড়া জামা, তার ওপর এক বেখাপ্পা সোয়েটার, একটা খদ্দরের চাদর কোমরের কাছে বাঁধা।

মামা শুরু করল।

“নাম কী হে তোমার?”

“নিবারণ গুঁই!”

“বাবার নাম!”

‘পতিতচরণ গুই।”

“দেশ বাড়ি কোথায়?”

“জেলা গোড়া, বাঁকুড়া…।” “কী কর তুমি?”

“আজ্ঞে, কিছু করি না।”

“লেখাপড়া জান ? ”

“না আজ্ঞা।”

“তুমি যে ঠিকঠাক পাগল তার প্রমাণ কী?”

“এত জানা কথা সাহেব! আমার বাপ পাগল ছিল বটে, ঠাকুরদাও পাগল ছিল। আমরা পাগলের বংশ। মায়ের দিক থেকেও তিন পুরুষ।’

“…তোমার বনেদিআনা আছে। ভালো কথা। এবার বাপু এই বারান্দায় হাঁট তো।” নিবারণ হাঁটতে লাগল। মামা টেবিল থেকে বাইনাকুলার তুলে নিয়ে তাকে দেখতে লাগল। হাঁটা শেষ হল। মামা হঠাৎ দুটো কলা নিয়ে এগিয়ে দিল।

“আচ্ছা!…এই কলাজোড়া খাও তো হে!” নিবারণ সামনে এসে কলা নিল। নিয়ে পিছিয়ে গিয়ে খোসা ছাড়াতে লাগল ।

“খাব আজ্ঞা?”

“বললাম তো, খাও!”

কলা খেয়ে নিবারণ হাতের মুঠোয় খোসা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

মামা হঠাৎ কালুদাকে ডাকল। ডেকে হান্টারটা এগিয়ে দিল। বলল, “ওর পিঠে দশ ঘা লাগা। জোরে জোরে।” নিবারণ আঁতকে উঠল। “আজ্ঞা মশায়, চাবুক খাব?

কেন? কী অপরাধ করলাম?”

মামা বলল, “বেটা, কলা খেয়ে খোসা হাতে নিয়ে তুমি দাঁড়িয়ে আছ, তুমি পাগল! আমায় ঠকাতে এসেছ! আমি খাঁটি পাগল চিনি না! তোমার হাঁটা দেখে বুঝেছি—তুমি ছিঁচকে চোর। পা টিপে টিপে হাঁট। তুমি পাগল নও। কোন পাগল কলার খোসা হাতে দাঁড়িয়ে থাকে হে।…যাও, বেরিয়ে যাও। জোচ্চোর কোথাকার।…ঝন্টু, ওর রাহা খরচ বিশ টাকা দিয়ে দাও। গেট আউট। কালু, ওর ডালরুটি ওকে দিয়ে দেবে, বেলা বারোটায়। যাও তুমি! হতভাগা!”

নিবারণ চলে গেল। তারপর এল নীলমণি সাহানা। মামা বলল, “লেখাপড়া জান?”

“অল্পস্বল্প। আট ক্লাস।”

“এই নাও কাগজ পেন্সিল।”

নীলমণি কাগজ নিল।

“নাও লেখ। কণ্টক রণ্টন লুণ্ঠন অবগুণ্ঠন…।”

নীলমণি লিখল।

“দাও দেখি।”

মামা কাগজ নিয়ে দেখল।

বলল, “তুমি কিসের নেশা কর হে নীলুবাবু? গাঁজা, না গুলি।”

“করি না ঠাকুর। কালেভদ্রে খাই।”

“গাঁজা?”

নীলমণি মাথা নিচু করল।

মামা বলল, “নীলবাবা, তুমি বেশ পণ্ডিত। বানান যা লিখেছ! পাগল তো নও বাবা তুমি। বুদ্ধি ধর। তা তুমি ফক্স মানে জান?”

“ফ-কস” “হ্যাঁ, ফক্স!”

“শুনেছি বাবা…”

“শুনেছ বটে, এবার জেনে যাও। তুমি একটি স্লাই ফক্স। মাগনায় খাওয়া-পরার লোভে পাগল সাজতে এসেছ!…তোমার তো সাহস কম নয়। আমি বত্রিশ বছর পুলিসে ছিলাম। মহাদেব দারোগা। আমায় ফাঁকি দেবে। কালু, বেটাকে দশ ঘা দে ! জোরে জোরে।”

নীলমণি লাফ মেরে দু পা সরে গেল ।

“আমি কিছু বুঝতে লারছি বাবা!”

মামা বলল, “লারবে বটে! চাবুক খাও—তারপর বুঝবে। তুমি রাস্কেল বানান লেখার নাম করে আমায় তেল মেরেছ। লিখেছ কী হে! বাবা আপনি ভগবান। বেটা আমি ভগবান। ভগবান গাছে ফলে! কালু, মার বেটাকে—দশ চাবুক, গায়ের ছাল তুলে দে…।”

নীলমণি লাফ মেরে বারান্দার নিচে। তারপর দে দৌড়।

ছয়

মামার ইন্টারভিউ চলতেই লাগল। পাঁচ সাতজন করে আসে ওরা। নানা জাতের পাগল-ছাগল, ছিটেল, ধূর্ত ধান্ধাবাজরা। আজকালকার দিনে যশিডির মতন জায়গায় মাগনায় থাকা-খাওয়া—আসবে না কেন! মামা তাদের হরেক কায়দায় পরীক্ষা করে। কাউকে ওঠবোস করায় পঞ্চাশবার, কাউকে বলে নাচতে, কাউকে বলে ডিগবাজি খাও তিরিশবার, কাউকে দশ ঘটি জল ঢকঢক করে খেয়ে হামাগুড়ি দিতে বলে।

এইসব দেখে-শুনে আমি বললাম, “মামা তুমি যে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় করে ফেললে। এত পাগল আসছে, তোমার পছন্দ হচ্ছে না?”

মামা হাতের কাগজ দেখিয়ে বলল, “কেমন করে হবে বল এরা কেউ একশোর মধ্যে তিরিশ নম্বরও পাচ্ছে না। পাস মার্ক বলে একটা কথা আছে তো!”

“গ্রেস দাও। আমাদের টাইমে গ্রেস ছাড়া কিছু হয় না।”

“তাই দেব।…আর দুটো দিন দেখি।”

শেষ পর্যন্ত এল বংশী মণ্ডল।

দেখার মতন চেহারা। আবির্ভাবও চোখ চেয়ে দেখতে হয়। মানুষটা ঢেঙা, রং কুচকুচে কালো, টকটকে লাল চোখ, একগাল খোঁচা খোঁচা দাড়ি। পরনে তাপ্পিমারা জিনসের প্যান্ট, গায়ের ছেঁড়াফাটা জামার চারদিকে নানা ছাপছোপ। একটা হাত-কাটা বেয়াড়া কোট গায়ে। মাথায় জকি ক্যাপের মতন এক টুপি। লোকটার দু কাঁধে দুই বিচিত্র জিনিস ঝুলছে। এক কাঁধে দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা মোটরগাড়ির প্যাঁক-প্যাঁক হর্ন, আর অন্য কাঁধে এক হাঁড়ি ঝুলছে। বোধহয় অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি। কিন্তু এত চিট-কালো যে বোঝাই যায় না ওটা কিসের। হাঁড়ির মুখ ঢাকা। পাশে কয়েকটা ফুটো।

মামার কাছে এসেই বংশী স্যালুট করার ভঙ্গিতে মাথায় হাত ঠেকিয়ে বলল, “গুড ইভনিং স্যার!” বলার আগে অবশ্য মাথার জকি-টুপিটা খুলে নিয়েছিল। আহা সে কী চুল! সজারুর কাঁটা বললেও চলে। বংশীর কথা শুনে আমি থ। সকাল বেলায় গুড ইভনিং!

মামা গম্ভীর হয়ে বলল, “গুড ইভনিং!”

“নেম”

“বনশি মনডিয়াল।”

“মণ্ডল!”

“ইয়েস স্যার।”

“বাবার নাম?”

“আয়েসা মনডিয়াল।”

“আয়েসা! সে তো মেয়েদের নাম।”

“ওয়ান মিনিট স্যার।” বলে লোকটা তার কাঁধ থেকে হাঁড়ি আর হর্ন নামিয়ে রাখল। রেখেই এক ডিগবাজি। তারপর দু’হাত মাটিতে রেখে মাথা নিচু পা উঁচু করে থাকল সামান্যক্ষণ। আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে মাটি থেকে পাঁচানো প্যাঁক প্যাঁক হর্ন তুলে নিয়ে কানে রেখে বাজাল বার কয়েক।

আমি একেবারে হাঁ।

বংশী এবার হাসল। বলল, “বাবার নাম ফকিল মনডিয়াল।”

মামা যেন একটু থমকে গিয়েছিল। বলল, “তুমি ওটা কী করলে? খেলা দেখাচ্ছ!” “নো স্যার। আমার মাথার ঘিলু সাইড চেঞ্জ করে।”

“সে কী হে”

“হ্যাঁ স্যার।…ওয়ানস আপন এ টাইম–আমার এই মাথায় একটা ডাব পড়েছিল। ফ্রম এ গ্রেটহাইট। বাড়ির বাগানে স্যার আমি একেবারে অজ্ঞান। থ্রি ডেজ। তখন থেকেই মাথার ঘিলু সরে গেছে। ঘিলুটাকে জায়গায় আনতে হলে ওটা করি।

মামা বড় বড় চোখ করে আমায় দেখল।

“ঘিলু প্লেসিং। ঝন্টু, টেকনিক্যালি পারফেক্ট, কী বলিস! প্রথমে প্লেসিং, তারপর হর্ন মেরে অ্যাডজাস্টমেন্ট!” বলেই মামা বংশীর দিকে তাকাল। “তুমি কী করতে হে?”

“মালি স্যার। চার্চে মালিগিরি।”

“ক্রিশ্চান?”

“ইয়েস স্যার।”

“লেখাপড়া জান?”

“ভেরি লিটল!”

“বাংলা ইংরেজি…!”

“এক যে ছিল মা তার ছয়টি ছাঁ—জানি স্যার! রাট ক্যাটানি।”

মামা বেশ খুশি হয়ে উঠছিল। বলল, “তুমি কী কী জান?”

“গার্ডেন করতে জানি স্যার। কাগজের পাখি ফুল করতে পারি। দুধ-আণ্ডা করতে জানি।”

“দুধ-আণ্ডা কি হে?”

“ডিম ফেটিয়ে দুধ আর চিনি মিশিয়ে মামলেট করতে হয় স্যার। খেতে ভালো।” “তুমি নিজে কী খাও?”

“যা পাই খাই। মাংস খাই না।”

“কেন?”

“ঘিলু গরম হয়ে যায়।”

“আচ্ছা!…..তা তুমি আর কী কী পার?

“কমসম সবই পারি স্যার।”

“তোমার হাঁড়িতে কি আছে হে?”

“দেখবেন?”

“কী আছে বল তো আগে?”

“সেভেন নেংটিস সাত ভাই চম্পা…”

“সাত ভাই…”

“আমার পোষা সাতটা নেংটি ইঁদুর স্যার। দেখবেন? দেখুন না। হাঁড়ির মুখ তুলে মাটিতে নামিয়ে দিচ্ছি। ইঁদুরগুলো কোথাও যাবে না। আমার পাশে বসে থাকবে।”

বলতে বলতে বংশী মাটিতে বসে তার হাঁড়ির মুখের ওপর থেকে ঢাকা সরিয়ে একটা একটা করে ইঁদুর বার করে আশেপাশে রাখতে লাগল। ইঁদুরগুলো সত্যিই নেংটি, ছোট ছোট। তারা একটু নড়ল না। আশ্চর্য!

মামা হঠাৎ বলল, “ওগুলো তো মাটির হে! আসল ইঁদুর কই ! ”

বংশী নিজের মনেই ইঁদুরগুলো নানাভাবে রাখছিল আর বলছিল, “না স্যার। এগুলো আসল। আপনি বুঝতে পারছেন না। সকালবেলায় এদের একটু আফিংয়ের ঝিম থাকে। মুড়িগুঁড়োর সঙ্গে আফিংয়ের জল মিশিয়ে দিই কিনা। এখন এরা ঘুমোচ্ছে। রাত্তিরে দেখবেন জেগে গেছে। ঘরময় লেজ তুলে খেলে বেড়াচ্ছে। দিনে এরা ঘুমোয়।” বলতে বলতে বংশী একটা একটা করে ইঁদুর তুলে নিয়ে আবার হাঁড়িতে রেখে দিল।

মামা বললেন, “বংশী, তুমি যথার্থ পাগল। খুব আনন্দ পেলাম। তুমি এখানে থাকবে। তোমাকে নিয়েই শুরু করব।” বলে আমার দিকে তাকালেন। “ঝন্টু, এই হল আসল। ওর কোনও নকল নেই। ইঁদুরের মতো জীবকে র‍্যাটকিলার না খাইয়ে খাওয়ায়। আহা প্রাণে কত মায়া! এত এতদিনে মনের মতন পাগলা পেয়েছি।”

মাসখানেক পরে বড়মামার চিঠি পেলাম কলকাতায়।

“ঝন্টু, গত রবিবার বংশী আমাদের ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে। যাইবার সময় আমার দুটি প্যান্ট, একজোড়া কেডস, ঘড়ি, ট্রানজিস্টার, রেডিয়ো, ক্যামেরা ও কিছু চুরুট লইয়া গিয়াছে। তোমার মামির বিশেষ কিছু নেয় নাই। গরম শাল ও পঞ্চাশটি টাকা মাত্র। বংশী চলিয়া যাওয়ায় আমার বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগিতেছে। এমন একটি মানুষ আবার কবে দেখিতে পাইব জানি না ।”

চিঠি পড়ে বড়মামার জন্যে আমারও বড় দুঃখ হচ্ছিল।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন