সাদাত হোসাইন
আজিজ মাস্টার ঢাকায় যাচ্ছেন। তিনি দবির খাঁ মেমোরিয়াল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি ঢাকায় যাচ্ছেন। কিন্তু সেই উদ্দেশ্যের কথা কেউ জানে না। দীর্ঘ বাসযাত্রায় তার খানিক ঝিমুনির মতো এসেছে। ঝিমুনিতে তিনি একটা স্বপ্নও দেখে ফেলেছেন। স্বপ্নে তাঁর মৃত বাবা দবির খাঁ তাঁকে বলছেন, ‘তুই ঢাকায় যাচ্ছিস কেন ?’
‘স্কুল বাঁচাতে।’
‘স্কুলের কি পরাণ আছে নি যে মরণ-বাঁচন থাকবো ?’
‘জি আব্বা আছে।’
‘ঢাকায় গেলে স্কুল বাঁচবে ?’
‘চেষ্টা করতে দোষ কী!’
‘চেষ্টা করতে দোষ নাই। কিন্তু অযথা চেষ্টায় সময় নষ্ট।’
‘কোনো চেষ্টাই অযথা না আব্বা।’
‘অবশ্যই অযথা। এই যে বাসে করে ঢাকায় যাচ্ছিস, এখন এই বাস যদি রাস্তার মাঝখানে বন্ধ হয়ে যায়, আর তুই একা যদি সেই বাস ঠেলে ঠেলে ঢাকায় নেওয়ার চেষ্টা করিস, তাহলে সেই চেষ্টা অযথা হবে না ?’
আজিজ মাস্টার জবাব দিলেন না। স্বপ্নে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন দবির খাঁ মেমোরিয়াল হাই স্কুলের মাঠে। টাকাপয়সার অভাবে স্কুল প্রায় বন্ধ হতে চললেও মাঠভর্তি ছেলেপুলে। আজিজ মাস্টার তাদের ফুটবল কিনে দিয়েছেন। বিকেল হতেই তারা ফুটবল নিয়ে মাঠে নেমে যায়। চিৎকার চেঁচামেচি করে। এই দৃশ্য দেখতেও আজিজ মাস্টারের ভালো লাগে। স্কুলের বেড়া কোনোরকমে টিকে থাকলেও মাথার উপরের টিনের চালগুলো এখানে ওখানে ফুটো হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলেই ঝরঝর করে পানি পড়ে। ‘দবির খাঁ মেমোরিয়াল হাই স্কুল’ লেখা সাইনবোর্ডখানার রঙও এখানে সেখানে উঠে গেছে। দবির খাঁ হয়ে গেছে ‘দাবর খা’। এই এলাকায় দাবর শব্দের অর্থ ধাওয়া। ফলে আঞ্চলিকভাবে স্কুলের নাম হয়ে গেছে এখন ‘ধাওয়া খা’। এই নিয়ে আড়ালে আবডালে লোকজন হাসাহাসি করে। আজিজ মাস্টার বুঝেও না-বোঝার ভান করেন। তিনি চাইলেই নতুন ঝা-চকচকে একখানা সাইনবোর্ড লাগাতে পারেন। কিন্তু যেই স্কুলে ক্লাস হয় না, শিক্ষক-শিক্ষার্থী আসে না, টাকার অভাবে স্কুলের টিনের চাল বেয়ে জল ঝরে, সেই স্কুলে চকচকে সাইনবোর্ড মানায় না। তিনি সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আমি শেষ চেষ্টা করে দেখতে চাই আব্বা।’
দবির খাঁ বললেন, ‘সব চেষ্টাই চেষ্টা না। কিছু কিছু চেষ্টা আছে, যেগুলো অযথা সময় নষ্ট। শ্রম আর মেধার অপচয়। বন্ধ বাসের মতো তোর ওই স্কুলও বন্ধ। স্কুলের ইঞ্জিন নষ্ট। তুই একা একা চেষ্টা করছিস সেই বাস কাঁধে ঠেলে চালাতে। কিন্তু এই কাজ একা সম্ভব না। এর আগেও তো কতবার স্কুলের কাজে ঢাকায় গিয়েছিস। কত নেতাফেতা ধরেছিস। কাজ হয়েছে ? হয় নি। বরং মাঝখান থেকে ঢাকায় যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া বাবদ পকেটের টাকা খরচ হয়েছে। হয় নি ?’
‘জি হয়েছে।’
‘তাহলে ?’
‘এবার কাজ হবে।’
‘কীভাবে হবে ?’
‘এবার স্কুল এমপিওভুক্তির দাবিতে আমি অনশন করব। আমরণ অনশন। যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ সাড়াশব্দ না করবে, দাবি মেনে না নেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত অনশন ভাঙব না।’
‘যদি তোর অনশন ভাঙাতে কেউ না আসে ? তখন কী করবি ?’
আজিজ মাস্টার এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন না।
দবির খাঁ বললেন, ‘তাহলে কি তখন সত্যি সত্যিই অনশন করে না খেয়ে মারা যাবি ?’
‘মারা যাব কেন ? কেউ না কেউ আসবেই। একজন বৃদ্ধ মানুষ, পেশায় স্কুলশিক্ষক, তিনি ঘোষণা দিয়ে দিনের পর দিন না খেয়ে প্রকাশ্যে মারা যাবেন, আর এই নিয়ে কেউ কিছু বলবে না ? এমন হবে ? কখনোই হবে না। কেউ না কেউ অবশ্যই আসবে। দেখবেন এই নিয়ে চারদিকে একটা হইচই পড়ে যাবে। পেপার পত্রিকায় খবর ছাপা হবে। টেলিভিশন সাংবাদিকেরা চলে যাবে। আর আপনি তো জানেন না, আজকাল ফেসবুক নামে মারাত্মক এক জিনিস এসেছে। আলাদিনের দৈত্যের মতো তার ব্যাপার-স্যাপার। তার পক্ষে সবই সম্ভব। এই খবর যদি একবার ফেসবুকে ছড়িয়ে যায়, দেখবেন চারদিকে মানুষের ভেতর একটা হই হই কান্ড, রই রই ব্যাপার ঘটে যাবে।
‘এইটা কি গ্রামগঞ্জের যাত্রাপালার মতো কোনো ঘটনা নাকি ?’
‘যাত্রাপালা হবে কেন আব্বা ?’
‘না, আমাদের সময় গ্রামগঞ্জে যাত্রাপালা হইতো। রহিম-রূপবান, গহর বাদশা-বানেছা পরী, সোহরাব-রুস্তম—এইসব। তখন দেখতাম চারিদিকে রিকশা ভ্যানে করে মাইকিং করতো, হই হই কান্ড, রই রই ব্যাপার। তোর কথা শুনেও তো সেই অবস্থা মনে হয়। যেন যাত্রাপালার স্ক্রিপ্ট রিহার্সেল করে নিয়া যাচ্ছিস। যাওয়া মাত্র হই হই কাণ্ড রই রই ব্যাপার ঘটে যাবে।’
‘আপনার তো কখনোই আমার উপর কোনো ভরসা ছিল না। সব সময় ভাবেন আমার বুদ্ধি কম। আমি একরোখা, জেদি। কিন্তু এইবার দেইখেন আব্বা।’
দবির খাঁ চিন্তিত গলায় বললেন, ‘কী জানি! আচ্ছা, একটা সত্যি কথা বল তো ?’
‘কী কথা ?’
‘তুই কি শুধু স্কুলের দাবি নিয়েই যাচ্ছিস ? নাকি ভিতরে ভিতরে তোর অন্য কোনো মতলবও আছে ?’
‘অন্য কী মতলব ?’
দবির খাঁ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তোরে তো আমি চিনি। আর চিনি বলেই এত দুশ্চিন্তা। একবার কোনো কিছু মাথায় ঢুকলে তো আর সেই জিনিস তোর মাথা থেকে বের হবে না! কাজের হোক আর অকাজের হোক, সেটার পিছন তুই ছাড়বি না।’
আজিজ মাস্টার জবাব দিলেন না। দবির খাঁ-ই আবার বললেন, ‘এক কাজ করলে কেমন হয় ?’
‘কী কাজ ?’
‘তুই নুরুল মোল্লার নামে স্কুলটা দিয়ে দে।’
‘নুরুল মোল্লার নামে!’ আজিজ মাস্টার যারপরনাই বিরক্ত হলেন। কিন্তু বাবার সামনে তা পুরোপুরি প্রকাশ করলেন না।
দবির খাঁ বললেন, ‘হ্যাঁ, নুরুল মোল্লার নামে। তুই বুদ্ধিমান মানুষ হলে এতদিনে তাই করতি।’
এবার বিরক্ত হলেন আজিজ মাস্টার। তিনি খানিকটা বিরক্তিমাখা গলাতেই বললেন, ‘আমি যে বোকা, এইটা তো নতুন কথা না আব্বা। সেই এতটুকুন বয়স থেকেই আপনি আমাকে এই কথা বলে আসছেন। নতুন করে আর বলার কী হলো!’
‘সত্য কথা বেশি বেশি বলতে হয়। মিথ্যা কথা বলতে হয় কম। শোন গাধা, নুরুল মোল্লা এলাকার চেয়ারম্যান। স্কুলের সভাপতিও সে। সামনে এমপি ইলেকশনেও দাঁড়ানোর সম্ভাবনা আছে। তখন কী করবি ?’
‘কী করব ?’ অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বললেন আজিজ মাস্টার।
‘সে এমপি হয়ে গেলে তখন কিন্তু বিপদ আরও বাড়বে। তখন ইহজনমে আর তোর স্কুল এমপিওভুক্ত করতে পারবি না। তারচেয়ে এক কাজ কর, গোয়ার্তুমি ছেড়ে ভালোয় ভালোয় তার নামে স্কুলটা দিয়ে দে। দেখবি তার নামে স্কুলের নাম হলেই স্কুল এমপিওভুক্ত করার জন্য সে উঠে পড়ে লাগবে!’
আজিজ মাস্টার বললেন, ‘এতদিন এত কষ্ট করার পর, তার সঙ্গে এত যুদ্ধ করার পর, এখন তার ইচ্ছাই মেনে নিব ?’
‘গাধা না হলে আরও আগেই মেনে নিতি। জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে যুদ্ধ করে কখনো কাউকে জিততে দেখেছিস ?’
দবির খাঁর কথা সত্য। এই কথা দবির খাঁ যেমন জানেন, তেমনি আজিজ মাস্টারও জানেন। কিন্তু বিষয়টা তাঁর মেনে নিতে ইচ্ছে করে না। এই স্কুলের জন্য তাঁরা বাপ-ছেলে কী করেন নি! সম্ভাব্য সবকিছুই করেছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় নি। তারপরও নিজেদের এতদিনকার সব স্বপ্ন, শ্রম, সামর্থ্য নিংড়ে দেওয়ার পর এখন এখানে এসে এভাবে হার মানতে ইচ্ছে হয় না। আজিজ মাস্টার বাবাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই তিনি দেখলেন মাঠ থেকে জোরালো শটে ফুটবলটা সরাসরি তার কপাল লক্ষ্য করে ছুটে আসছে। তিনি শেষ মুহূর্তে চেষ্টা করেছিলেন সরে আসতে। কিন্তু পারলেন না। বলটা তাঁর কপালে আঘাত করল।
প্রবল ঝাঁকিতে আজিজ মাস্টারের ঘুম ভেঙে গেল। বিকট শব্দে বাসের ব্রেক কষেছে ড্রাইভার। আজিজ মাস্টারের মাথা ঠুঁকে গেছে সামনের সিটের সঙ্গে। পেছন থেকে ড্রাইভারের উদ্দেশে গাল বকল কাঁচা ঘুম ভাঙা যাত্রীরা।
আজিজ মাস্টার অবশ্য কিছু বললেন না। তিনি চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর কোলে একখানা ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর ভাঁজ করা একখানা ব্যানার। সেই ব্যানারে কী লেখা আছে কে জানে! তিনি তা কাউকেই দেখান নি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন