সাদাত হোসাইন
শেষের আগে
স্থান : ঢাকা প্রেসক্লাব।
সময় : বিকেল সাড়ে পাঁচটা।
এই সময়ে প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় অফিসছুট ক্লান্ত মানুষের সারি থাকে। আজও রয়েছে। তবে আজকের ভিড়টা আর আট-দশ দিনের ভিড়ের মতো নয়। প্রেসক্লাবের সামনে লোকজন জমে গিয়ে বড়সড় একটা জটলা লেগে গেছে। সেই জটলার ভিড় ক্রমশই বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে ভিড় চলে এসেছে রাস্তা অবধি। অফিসফেরত বাসযাত্রীদের বাসগুলো ধীরে ধীরে আটকে পড়তে শুরু করেছে সেই ভিড়ে। ক্রমশই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে রাস্তার জ্যাম। কৌত‚হলী মানুষ তাদের জরুরি কাজ ফেলে রেখে ভিড়ের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু ভিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে সামনের উঁচু মাথাগুলোর জন্য তারা আসল ঘটনার কিছুই দেখতে পারছে না। ফলে কেউ কেউ উঠে গেছে ওভার ব্রিজের ওপরে। দু-একজন তরতর করে রেইনট্রি গাছের ডাল বেয়ে উঠে গেছে ওপরে। আশপাশের বাসা, অফিসের ছাদেও উৎসুক মানুষের ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু ঘটনা কী ?
ঘটনা হলো ভিড়ের মাঝখানে দাঁড়ানো শীর্ণকায় শরীরের মানুষটা। মানুষটার নাম আজিজ মাস্টার। আজিজ মাস্টার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দাঁড়িয়ে আছেন প্রেসক্লাবের সামনে। তার বাঁ হাতে ধরা একখানা মশাল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি সেই মশাল থেকে গায়ে আগুন ধরাবেন। কিন্তু একটু দেরি করছেন। কারণ তাঁর গলায় একখানা ছোট ব্যাকবোর্ড ঝোলানো। সেই ব্যাকবোর্ডে চক ঘষে স্পষ্ট বড় বড় অক্ষরে লেখা,
‘আমি কোহিনুরের বাবা। কোহিনুর আমার মেয়ে।
আমি তার ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চাই।’
নিচে ধর্ষকের নাম-পরিচয়সহ বিস্তারিত লেখা।
এই ঘটনার কথা আসাদ এখনো জানে না। সে ভোরে আজিজ মাস্টারকে বাসে তুলে দিয়ে বাসায় ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু আজিজ মাস্টার শেষ অবধি বাড়ি ফিরে যান নি। আসাদ তাকে বাসে রেখে ফিরে চলে যেতেই তাঁর হঠাৎ কী যে হলো! কিছুদূর যেতেই তিনি কন্ডাক্টরকে বললেন, ‘বাস থামান।’
‘বাস থামাব কেন ?’
‘কারণ আমার বাথরুম চেপেছে।’
‘বাথরুম বাসা থেকে করে আসতে পারেন নি ? দশ মিনিট হয় নাই বাস ছাড়ছে, এর মধ্যেই আপনার বাথরুম চাপছে। পুরা পথ কী করবেন ?’
‘সেইটা পুরা পথেই দেখতে পাবেন।’ বলেই তিনি বাস থেকে নামলেন। তারপর পকেট থেকে একটা এক শ’ টাকার নোট বের করে কন্ডাক্টরকে ধরিয়ে দিলেন। কন্ডাক্টর বলল, ‘ঘটনা কী ? টাকা দিয়ে আমি কী করব ?’
‘তেমন কিছু না। শুধু বাসের লকার থেকে আমার ব্যাকবোর্ডটা একটু বের করে দিবেন।’
‘মানে কী ? আপনে কি ব্যাকবোর্ড নিয়ে বাথরুম করতে যাবেন নাকি ?’
আজিজ মাস্টার বিগলিত ভঙ্গিতে হাসলেন, ‘নাহ। ব্যাকবোর্ড নিয়ে বাথরুমে যাব না। আমি ঢাকাতেই থাকব। জরুরি কাজ পড়ে গেছে। আজ বাড়ি যাওয়া যাবে না। আপনি ভাই দয়া করে আমার ব্যাকবোর্ডটা একটু নামিয়ে দেন।’
কন্ডাক্টর রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে আজিজ মাস্টারের দিকে তাকিয়ে রইল। তবে শেষ পর্যন্ত সে তার ব্যাকবোর্ড নামিয়েও দিল। আজিজ মাস্টার সেই চলন্ত বাস থামিয়ে রাস্তার মাঝখানে নেমে পড়লেন। আসলে তার মাথায় তখনো কিলবিল করছিল আসাদের সেই কথাটা। কথাটা তিনি কোনোভাবেই তাঁর মাথা থেকে তাড়াতে পারছিলেন না। বাসে ওঠার পরপরই হঠাৎ তাঁর মনে হলো, এভাবে তিনি বাড়ি ফিরে যেতে পারবেন না। এমনকি এভাবে ফিরে গেলে তিনি মরেও শান্তি পাবেন না। বাকি জীবনও বেঁচে থাকবেন প্রবল অশান্তি নিয়ে। স্বস্তিতে ঘুমাতে পারবেন না আর কখনো। যে-কোনো উপায়েই হোক, এই ঘটনার প্রতিবাদ তিনি করবেনই। এই ঘটনার বিচার তিনি চাইবেনই।
আজিজ মাস্টার সিএনজি ভাড়া করে সোজা চলে এসেছেন প্রেসক্লাবের সামনে। এক টিন কেরোসিন কিনে গায়ে মেখেছেন। একটা মশাল জ্বালিয়ে ধরে রেখেছেন এক হাতে। তবে তিনি গায়ে আগুন লাগানোর সাহস সঞ্চয় করতে পারেন নি। আসাদের মতো তাঁরও ধারণা, শেষ মুহূর্তে এসে আশেপাশে জড়ো হওয়া জনগণ তাঁকে নিবৃত্ত করবে। কিন্তু তাঁর এই প্রতিবাদ, তাঁর এই চেষ্টা ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে।
আজিজ মাস্টার প্রথম দিকে লোকজনের উপস্থিতি, আগ্রহ দেখে খুবই খুশি হয়েছিলেন। মাত্র কদিন আগেই তিনি প্রেসক্লাবের দেয়াল ঘেঁষে যে বসে ছিলেন, কেউ তা গ্রাহ্যই করেনি। অথচ আজ, মাত্র কয়েক ঘণ্টায়ই এভাবে মানুষ জড়ো হয়ে যাবে তা তিনি ভাবেন নি। আসাদ ছেলেটার বুদ্ধি ভালো। সবচেয়ে ভালো হতো আসাদ ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে এলে। সে কবিতার ভাষায় কিছু প্ল্যাকার্ড নিয়ে এলে আরও ভালো হতো। সমস্যা হচ্ছে এই মুহূর্তে তার পক্ষে আসাদকে খবর দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ তার কাছে মোবাইল ফোন নেই। আসাদের ফোন নম্বরও নেই।
যদিও আজিজ মাস্টারের চারদিকে অসংখ্য মোবাইল ফোন। তাঁর চারপাশে চক্রাকারে যে বিশাল জন জমায়েত, তাদের প্রায় সবার হাতেই একটা করে মোবাইল ফোন। কারও কারও হাতে একাধিক ফোনও রয়েছে। তারা সমানে আজিজ মাস্টারের ছবি তুলছে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এই দৃশ্য দেখে আজিজ মাস্টার কিঞ্চিৎ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। অনেকটা ঘাবড়েও গেছেন। তাঁর কেন যেন মনে হচ্ছে, প্রতিবাদের বার্তা পাওয়ার চেয়ে মানুষের মধ্যে তামাশা দেখার একটা প্রবল আগ্রহ কাজ করছে।
যদিও তার প্রাথমিক উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। চারপাশে একটা হইহই রব উঠে গেছে। শতশত মানুষ এসে জড়ো হয়েছে। আরও মানুষ আসছে। তাদের প্রায় সবার হাতেই মোবাইল ফোন, ক্যামেরা। এই মোবাইল ফোন, ক্যামেরার কারণে অবশ্য আজিজ মাস্টারের লাভও হয়েছে। অনেকেই ফেসবুকে আজিজ মাস্টারের ছবি-ভিডিও পোস্ট করছেন।
তবে আজিজ মাস্টারের কেন যেন মনে হচ্ছে উপস্থিত মোবাইল ফোন হাতে জনতা প্রবল আগ্রহ ও উত্তেজনা নিয়ে ঘটনা ঘটার অপেক্ষা করছে। প্রতিবাদের চেয়েও তারা যেন আজিজ মাস্টারের জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনা দেখতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বিষয়টা নিয়ে আজিজ মাস্টারের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। যদিও তাদের এমন আগ্রহ দেখে প্রচুর সাংবাদিকও জড়ো হয়েছেন। তাঁরাও ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত। টিভি সাংবাদিকদের অবশ্য আসতে একটু দেরি হচ্ছে। তারা আজিজ মাস্টারের এই অভিনব প্রতিবাদ সরাসরি সম্প্রচার করবে। সাংবাদিকেরা বিষয়টা খানিকটা হলেও গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। এটি একটা আশার ব্যাপার।
তবে চারপাশের মানুষের পরিস্থিতি, উত্তেজনা, প্রতিক্রিয়া দেখে আজিজ মাস্টার ক্রমশই ভীত হয়ে পড়েছেন।
এত এত মানুষের জমায়েত দেখে প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, তাঁর এই প্রতিবাদ এমপি-মন্ত্রী অবধি পৌঁছে যাবে। তাঁরা তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে ছুটে আসবেন। কিংবা সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী কাউকে পাঠাবেন। ভাগ্য ভালো হলে প্রধানমন্ত্রীও তাঁর দাবির স্বপক্ষে বিবৃতি দিয়ে ফেলতে পারেন। অসংখ্য মানুষের উপস্থিতি, তার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা এবং এত এত সাংবাদিকের উপস্থিতি দেখে এ বিষয়ে তিনি মোটামুটি নিশ্চিতই ছিলেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তাঁর হিসেবে বড় ধরনের গড়মিল ছিল। কেউ তো আসেই নি, বরং উপস্থিত সকলেই যেন অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে, কখন আজিজ মাস্টার তাঁর গায়ে আগুন ধরাবেন!
আজিজ মাস্টারের পেছনে কতকগুলো চ্যাংড়া ছেলেপুলে দাঁড়ানো। তাদের হাতে মোবাইল ফোন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে তারা উশখুশ করছিল। এবার পেছন থেকে তাদের একজন বলেই ফেলল, ‘কী হইলো স্যার ? দেরি করতেছেন কেন ?’
আজিজ মাস্টার তার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। ওই ছেলে কিসের দেরির কথা বলছে ? তাঁর গায়ে আগুন ধরানোর ? তার মানে তারা তাঁর জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করছে ? কী ভয়ঙ্কর! কী ভয়ঙ্কর!
অন্য একটা ছেলে পেছন থেকে বলল, ‘আমার ইন্টারনেটের ডাটা কিন্তু শেষ হয়ে যাবে চাচা মিয়া, আর কতক্ষণ এমনে ফেসবুকে লাইভ ধইরা থাকবো ? ঘটনা ঘটাইলে তাড়াতাড়ি ঘটান। আপনি ঘটনা শুরু করলেই দেখবেন লাইভের ভিউয়ার সংখ্যা সাইসাই করে বাড়তে থাকবে। ধরাইলে এখনই ধরান। দিনের আলো থাকতে থাকতে। একটু পর কিন্তু অন্ধকার নেমে যাবে।’
আজিজ মাস্টারের চিন্তা করার শক্তি যেন লোপ পেয়ে যাচ্ছে। মানুষ যে বিষয়টাকে এভাবে ভাবতে পারে, এটা তার চিন্তার ত্রিসীমানায়ও ছিল না। এই মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটের বিষয়টা সম্পর্কে তিনি অল্পবিস্তর শুনেছিলেন। কিন্তু তাও খুব ভালোভাবে না। তবে এই ডাটার বিষয়টি তিনি একদমই কিছু বোঝেন না। ফেসবুকের কথা কিছু কিছু তিনি শুনেছেন। তাঁর ছোট মেয়েটা বায়না ধরেছিল মোবাইল ফোনের। তাও আবার ইন্টারনেটওয়ালা মোবাইল ফোন। আজিজ মাস্টার কিনে দিবেন দিবেন করেও আর দিতে পারেন নি। দিবেন কী করে ? বাপদাদার ভিটেবাড়ি যা ছিল, তার সব বিক্রি করে তো ওই স্কুলখানাই তিনি করেছেন। বছরের পর বছর সেই স্কুল চালাতে গিয়ে তার দিশেহারা অবস্থা।
দিশেহারা অবস্থা এই মুহূর্তেও। মানুষজন ক্রমেই যেন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। টিভি ক্যামেরাও চলে এসেছে। তারা আজিজ মাস্টারের এই অভিনব প্রতিবাদ লাইভ সম্প্রচারের উদ্দেশ্যে যন্ত্রপাতিও নিয়ে এসেছে। আরও টিভি চ্যানেল আসছে। আজিজ মাস্টার তার বাঁ দিকে একটা ছোটখাটো জটলা দেখতে পেলেন। কিছু তরুণ শিক্ষার্থী সেখানে জড়ো হয়েছে। তাদের মধ্য থেকে ঝাঁকড়া চুলের বাবড়ি দোলানো, পাঞ্জাবি পরা এক ছাত্র উঁচু এক স্তম্ভের উপর উঠে গেল। তারপর গলার রগ শক্ত করে, উঁচু গলায় বক্তৃতা দেওয়া শুরু করল। আজিজ মাস্টার অবশ্য তাদের বক্তৃতার কারণ বুঝলেন না। তবে মনে মনে খানিক শঙ্কিত বোধ করলেন তিনি। যদি কোনো কারণে তাঁর প্রতিবাদের বিষয়টি থেকে মানুষের দৃষ্টি সরে যায়! যদিও তেমন কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। বরং মনে হলো তাদের কারণেই আরও অনেক বেশি মানুষ আজিজ মাস্টারকে কেন্দ্র করে জটলা বাড়িয়ে চলেছে।
আজিজ মাস্টারের শরীর খারাপ লাগছে। এতক্ষণ প্রচন্ড রোদ ছিল। আর এখন ভিড়ের কারণে ঘামে, গরমে তাঁর নাভিশ্বাস অবস্থা। মনে হচ্ছে, যে-কোনো সময় তিনি মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে যাবেন। তা ছাড়া হাতের মশালটিও এভাবে এতক্ষণ উঁচু করে ধরে রাখতে তাঁর কষ্ট হচ্ছে। একটু উল্টোপাল্টা কিছু হলেই ভয়াবহ বিপদ ঘটে যেতে পরে।
আজিজ মাস্টার এখন সত্যি সত্যিই ভয় পাচ্ছেন। আর যাই হোক, জীবন্ত আগুনে দগ্ধ হয়ে মরার মতো সাহস তাঁর নেই। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে না, কেউ তাঁকে নিবৃত্ত করতে আসবে। বরং সকলেই যেন সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষা করছে। কখন আজিজ মাস্টার তাঁর গায়ে আগুন ধরিয়ে দিবেন। দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে আগুন। সেই আগুনে পুড়তে থাকবে একটি জীবন্ত মানুষ। আর অপেক্ষমাণ এই শত শত মানুষ তাঁর গায়ে আগুন লাগানোর সেই দৃশ্য ক্যামেরায়, মোবাইল ফোনে ধারণ করবে। তারপর ফেসবুক, ইউটিউব, টেলিভিশনে ছড়িয়ে দিবে। অজস্র মানুষ সেই ঘটনায় কমেন্টস, লাইক, শেয়ার করবে। কী ভয়ঙ্কর!
আজিজ মাস্টারের শরীর বেয়ে দরদর করে ঘাম ছুটছে। তিনি খুব করে চাইছেন, কোনো এক অলৌকিক উপায়ে হলেও কবি আসাদ যদি এখানে ছুটে আসত! তাহলে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা সে করে ফেলতে পারত। কিন্তু এই তুমুল ভিড়ের মধ্যে কোথাও আসাদকে দেখতে পেলেন না তিনি। পেছন থেকে এক সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি ঠিক ক’টা নাগাদ গায়ে আগুন লাগানোর পরিকল্পনা করেছেন ?’
আজিজ মাস্টার ঘুরে সাংবাদিকের দিকে তাকালেন। সাংবাদিক তাঁর মুখের কাছে মাইক্রোফোন এগিয়ে দিলেন। তাঁর পেছনে একজন ক্যামেরা ধরে আছেন। আজিজ মাস্টার তাঁর কথার উত্তর দিচ্ছেন না দেখে সাংবাদিকটি আবারও প্রশ্ন করলেন, ‘এখনো কি সংশ্লিষ্ট কেউ আপনার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেন নি ?’
আজিজ মাস্টার এই প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারলেন না। পেছন থেকে এক সাংবাদিক বললেন, ‘আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার উপায় কী ? কোনো ফোন নম্বর আছে আপনার সঙ্গে যে ফোন নম্বরে কেউ আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে ? থাকলে ফোন নম্বরটি দিন, আমরা সেটি টিভি স্ক্রলে দেখানোর ব্যবস্থা করতে পারি। তাতে যদি সংশ্লিষ্ট কেউ আপনাকে ফোন করেন। কিংবা কেউ কোনো প্রশ্ন করতে চান আপনাকে ?’
আজিজ মাস্টার বুঝতে পারছেন না তিনি কী করবেন। এর মধ্যে অবশ্য আরও একজন সাংবাদিক এগিয়ে এলেন। তিনি আজিজ মাস্টারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, ধরুন যদি এমন হয় যে আপনার দাবি মেনে নিতে কেউই এগিয়ে এল না, তখন আপনি কী করবেন ? আপনি কি তখন সত্যি সত্যিই গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করবেন ?’
আজিজ মাস্টারের শরীর খুবই খারাপ লাগছে। চারধারে মানুষের ভিড় আরও বাড়ছে। তাঁর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তিনি বুঝতে পারছেন না কী করবেন। এই সময়ে একজন তাঁর প্রায় মুখের সঙ্গে মাইক্রোফোন চেপে ধরে বললেন, ‘যদি আপনি গায়ে আগুন ধরিয়ে সত্যি সত্যিই আত্মহত্যা করেন, তবে সেটি ঠিক কখন মানে কটা নাগাদ হতে পারে ? আপনি কি সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কোনো সুনির্দিষ্ট টাইমলাইন বেঁধে দিয়েছেন ?’
আজিজ মাস্টার এই প্রশ্নেরও কোনো জবাব দিলেন না। তাঁর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। এক গ্লাস পানি পেলে ভালো হতো। কিন্তু যে মানুষ গায়ে আগুন লাগিয়ে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করার হুমকি দিয়েছে, সেই মানুষটি এই অবস্থায় কারও কাছে তেষ্টা নিবারণের জন্য জল চাইতে পারে না। সেটি ভালোও দেখায় না।
সাংবাদিকটি আবারও জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিচ্ছেন না। আচ্ছা, কিছু মনে করবেন না, আপনাকে একটা প্রশ্ন করি, আপনি কি সত্যি সত্যিই গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করবেন ? নাকি এটি কেবলই একটা আইওয়াশ ?’
আজিজ মাস্টার কারও কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিচ্ছেন না। তিনি চোখে ঝাপসা দেখছেন। তাঁর মাথা টলমল করছে। যেন যে-কোনো মুহূর্তে তিনি ঢলে পড়বেন মাটিতে। তাঁর কাছে কোনো জবাব না পেয়ে এক সাংবাদিক আবার রিপোর্টিংয়ে ফিরে গেলেন। তিনি তাঁর টেলিভিশনের দর্শকদের উদ্দেশে আবেগঘন কণ্ঠে বলতে লাগলেন, ‘প্রিয় দর্শক, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, একজন স্কুলশিক্ষক কতটা মহান, কতটা সৎ, কতটা বিবেকবান হলে তাঁর ছাত্রীর ধর্ষণের প্রতিবাদে এমন তীব্রভাবে সোচ্চার হতে পারেন। নিজেকে সেই ছাত্রীর বাবা হিসেবে দাবি করতে পারেন। এমন একনিষ্ঠ, আদর্শবান হতে পারেন। এ দেশের ঘরে ঘরে যদি তাঁর মতো শিক্ষক, তাঁর মতো মানুষ থাকত তবে এই দেশ বদলে যেত। হতে পারত এক আদর্শ রাষ্ট্র। কিন্তু আফসোস, এমন সোনার মানুষ এ দেশে নেই। আপনাদের জানাতে চাই যে তিনি এমনকি শুধু মানুষকে দেখানোর জন্যই যে এমন প্রতিবাদ করছেন, তা কিন্তু নয়। বরং সত্যি সত্যিই তিনি এই প্রতিবাদ করছেন। তাঁর এই নির্বিকার, নির্বাক প্রতিক্রিয়াতেই সেটা স্পষ্ট। তিনি আমাদের মতো কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী। এ যেন আমাদের প্রচলিত সমাজব্যবস্থার মুখে এক তীব্র চপেটাঘাত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে সংশ্লিষ্ট মহলের কাউকেই এখনো এখানে দেখা যাচ্ছে না। কেউই এখনো তাঁর সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগই করে নি। মিডিয়ার মাধ্যমেও না। এভাবেই আমাদের…।’
আজিজ মাস্টার আর শুনতে পেলেন না সাংবাদিকটি কী বলছেন! তবে তিনি বুঝতে পারছেন তার চারপাশের মানুষগুলো আর ধৈর্য রাখতে পারছে না। তারা ক্রমেই আরও অস্থির হয়ে উঠছে। যেন মজার, আকর্ষণীয় কোনো দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় তারা তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে এতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এই সবকিছুই অর্থহীন। আজিজ মাস্টার আসলে কিছুই করবেন না। বরং সবাইকে দাঁড় করিয়ে রেখে তিনি নিজেই এক ধরনের মজা লুটছেন। শেষ পর্যন্ত গায়ে আগুন তিনি ধরাবেন না। ফলে শুধু শুধু এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।
লম্বা লেন্সের ক্যামেরা হাতে এক লোক দূর থেকে আজিজ মাস্টারকে ডাকলো, ‘স্যার, স্যার।’
আজিজ মাস্টার বুঝলেন না কোনদিক থেকে কে তাকে ডাকছে। তবুও তিনি শব্দ লক্ষ করে ফিরে তাকালেন না। লোকটা আবারও চিৎকার করে বলল, ‘স্যার। এইদিকে স্যার। এই যে, আপনের ডানে, একটু তাকান স্যার। জি, স্যার। একটু মুখটা শক্ত করে হাতটা উঁচু করেন স্যার, জি স্যার। মানে স্যার আঙুল তুলে বক্তৃতা দেওয়ার ভঙ্গি করবেন স্যার। একবার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে। একবার তর্জনী উঁচিয়ে স্যার। খুব সুন্দর একটা ছবি হবে স্যার।’
আজিজ মাস্টার কিছুই বুঝলেন না। তিনি কিছু করলেনও না। তবে ছেলেটা একের পর এক ক্যামেরার শাটার টিপতে লাগল। আজিজ মাস্টার দেখলেন অসংখ্য মানুষ একের পর এক মোবাইল ফোনে তাঁর ছবি তুলছে। অনেকে ধীরে ধীরে তাঁর একদম কাছেও চলে এসেছে। তারা আজিজ মাস্টারের সঙ্গেও ছবি তোলার চেষ্টা করছে। আজিজ মাস্টার না বুঝলেও তিনি অসংখ্য মানুষের সেলফিতে স্থান পেয়ে যেতে থাকলেন। একটি মেয়ে তাঁর গা ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়ে লম্বা সেলফি স্টিক বের করে সেলফি তুলতে লাগল। কিন্তু সে তার সেলফিতে মোটেই সন্তুষ্ট হচ্ছিল না। বরং ডানে বাঁয়ে মাথা, মুখ, ঠোঁট কাত কিংবা আঁকাবাঁকা করেও সে তার কাক্সিক্ষত ছবিটি কোনোভাবে না পেয়ে অবশেষে আজিজ মাস্টারকে ডাকল সে। বলল, ‘আংকেল, একটু এদিকে তাকাবেন প্লিজ ?’
আজিজ মাস্টার হতভম্ভ চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটা এতক্ষণে সম্ভবত বুঝতে পারল যে এখানে এই মুহূর্তে এমন আবদার করাটা তার ঠিক হয় নি। তা ছাড়া সে সময়ও নিয়ে ফেলেছে অনেক। ফলে তার চারপাশের লোকজনও তার ওপর বিরক্ত হয়ে উঠছিল। মেয়েটা তড়িঘড়ি করে দূরে সরে গেল। তবে এরপরই শুরু হলো সেলফি তোলার হিড়িক। আজিজ মাস্টার অবশ্য জানেন না কী ঘটছে। তার খুব অসুস্থ লাগতে লাগল। মাথা ঘোরাচ্ছে। তিনি ভিড় থেকে খানিক দূরে সরে যেতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না। কেউই তাঁকে সামান্য জায়গাও দিচ্ছিল না।
আজিজ মাস্টার সবার মাঝখানে আচমকা হড়বড় করে বমি করে ফেললেন। তাঁর পাশের লোকটা ছিটকে দূরে সরে গেল। কিন্তু আজিজ মাস্টার আর তাল সামলাতে পারলেন না। তাঁর মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। তিনি দুপা এলোমেলো সামনে বাড়ালেন। তারপর ধপাস করে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, তাঁর হাতের মশালটা ছিটকে এসে পড়ল তার শরীরে। আর মুহূর্তেই কমে এল চারপাশের ভিড়। মোবাইল হাতের সেলফি-শিকারিরা ছুটে সরে গেল দূরে। টেলিভিশন সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যানরা নিরাপদ দূরত্বে সরে গেল। কারণ ততক্ষণে দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে আগুন। আজিজ মাস্টারের তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তাঁর গায়ে সত্যি সত্যিই আগুন লেগে গেছে! প্রথমে কিছুক্ষণ তিনি তেমন কিছুই বুঝতে পারলেন না। তারপর হঠাৎই তীব্র চিৎকার করতে চাইলেন তিনি, ‘বাঁচান, আমাকে বাঁচান।’ কিন্তু সেই চিৎকার করে সাহায্য চাইতে গিয়েও আবার থমকে গেলেন আজিজ মাস্টার। শত শত মানুষ তাঁর চারপাশে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁদের সকলের হাতেই মোবাইল ফোন, স্থির ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা। তারা প্রবল আগ্রহ আর একাগ্রতার সঙ্গে আজিজ মাস্টারের ছবি তুলছে। এমন দৃশ্য এর আগে কখনো কোথাও তারা দেখে নি। তাদের চোখের সামনে জীবন্ত একজন মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে। এমন দৃশ্য হয়তো আর কখনো কোথাও তারা দেখতেও পাবে না। ফলে এই বিরল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে রাখা উচিত, এই অভূতপূর্ব স্মৃতি সংরক্ষণ করে রাখা উচিত। তাই তারা একের পর এক নানা অ্যাঙ্গেলে, নানা কম্পোজিশনে ছবি তুলে রাখতে লাগল। ভিডিও করে রাখতে লাগল।
একজন জীবন্ত মানুষের অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনা টেলিভিশনে লাইভ সম্প্রচারিত হচ্ছে। কেউ কেউ অবশ্য তাদের ব্রডকাস্ট পলিসি মেনে পোড়ার এই দৃশ্য ঝাপসা করে দিয়ে প্রচার করছে। তবে স্পষ্টভাবেই লাইভ হচ্ছে ফেসবুক ইউটিউবেও। অসংখ্য মানুষ দেখছে একজন প্রতিবাদী স্কুলশিক্ষক তাঁর ছাত্রীর ধর্ষণের প্রতিবাদে সত্যি সত্যি গায়ে আগুন জ্বালিয়ে আত্মহত্যা করছেন। তারা সেই ভিডিও ছবির নিচে তাদের তীব্র প্রতিক্রিয়া, আবেগঘন মতামত জানাচ্ছেন। লাইক শেয়ার করছেন। মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে।
আজিজ মাস্টার তাকিয়ে আছেন, তাঁর চোখের সামনের দৃশ্য ক্রমশই ঝাপসা হয়ে উঠছে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, খানিক আগেও যে তীব্র যন্ত্রণা তিনি পেতে শুরু করেছিলেন, সেই যন্ত্রণা এখন আর তিনি অনুভব করছেন না। এক ধরনের ঘোরের মতো হচ্ছে তাঁর। যেন কোনোকিছুই ঠিকঠাক উপলব্ধি করতে পারছেন না তিনি।
আজিজ মাস্টারের হঠাৎ মনে হলো, এই ঘটনা বাস্তবে ঘটছে না, এই ঘটনা ঘটছে তাঁর স্বপ্নে। তিনি প্রায়ই অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন দেখার অসুখ তাঁর আছে। তাঁর বাবা দবির খাঁকে তিনি প্রায়ই স্বপ্নে দেখেন। তাঁর সঙ্গে নানা কথাবার্তাও তাঁর হয়। কিন্তু এই মুহূর্তে দবির খাঁকে কোথাও দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। আজিজ মাস্টারের হঠাৎ খুব দবির খাঁকে দেখতে ইচ্ছে করতে লাগল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তাঁর মুখটা তিনি মনে করতে পারলেন না। তবে দবির খাঁর মতো কাউকেই যেন আচমকা দেখতে পেলেন আজিজ মাস্টার। হ্যাঁ, ওই যে, ওই যে তাঁর বাবা দবির খাঁ। তিনি দবির খাঁকে দেখতে পাচ্ছেন। দবির খাঁ লাঠি হাতে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছেন। বাবাকে দেখে আজিজ মাস্টারের খুব ভয় লাগতে লাগল। তিনি নিশ্চিত এই অবস্থায়ও তাঁর বাবা তাঁকে বকাঝকা করবেন। বলবেন, ‘কিরে বেকুব, শেষ পর্যন্ত অন্যের মেয়ের জন্য নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিলি! নিজের মেয়েদের কথা একবারও ভাবলি না ?’
আজিজ মাস্টার তাঁর বাবা দবির খাঁকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু পারলেন না। তার আগেই পুরো পৃথিবী তাঁর কাছে অন্ধকার হয়ে গেল। নিঃশব্দ হয়ে গেল। মিলিয়ে গেল তাঁর চারপাশের তুমুল কোলাহল। অসংখ্য মানুষের মুখ ও মুখোশ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন