সাদাত হোসাইন
পরদিন বেলা করে ঘুম ভাঙল দুজনেরই। আজিজ মাস্টার ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়েছিলেন বলে আর ওঠার তাড়া ছিল না। তবে ঘুম থেকেই উঠেই কেমন যেন অস্থির হয়ে পড়লেন তিনি। আসাদ বলল, ‘এখন কী করবেন ?’
‘কেরোসিন ঢেলে গায়ে আগুন ধরাব।’
‘কেরোসিন ঢেলে গায়ে আগুন ধরাব মানে ?’
‘এটা ছাড়া তো আসলেই আর কোনো উপায় নেই। এ ক’দিন আমি এই একটা বিষয়ই ভাবছি। আপনার এই বুদ্ধি ছাড়া আর কোনো বুদ্ধি আমার মাথায় আসে নাই।’
আসাদ হতাশ ভঙ্গিতে হাসল, ‘এই বুদ্ধিও কাজে লাগবে না।’
‘কেন ? কাজে লাগবে না কেন ?’
‘আগেভাগে ঘোষণা দিয়ে আগুন লাগাতে গেলে পুলিশ প্রেসক্লাবের সামনে আপনাকে দাঁড়াতেই দিবে না। ধরে জেলে ঢুকিয়ে দিবে।’
‘কিন্তু সেদিন যে বলেছিলেন ?’
আসাদ হাসল, ‘এমনি এমনি বলেছিলাম। সব কথা কি আর সব সময় আমরা সিরিয়াসলি বলি ?’
‘তা বলি না। কিন্তু আমি এখন কী করব তাহলে ? ওটা ছাড়া তো আর কোনো উপায় দেখি না আমি।’
আসাদ আঁতকে ওঠা গলায় বলল, ‘আপনি কি সত্যি সত্যিই গায়ে আগুন জ্বালিয়ে মরতে চান নাকি ?’
‘মরব কেন ?’
‘তাহলে কী করবেন ? কেরোসিন ঢেলে গায়ে আগুন লাগিয়েও বেঁচে থাকার কোনো টেকনিক জানেন নাকি আপনি ?’
‘নাহ। তা কেন ? কিন্তু আপনিই না বললেন, জাস্ট আগুন লাগানোর ভান করব। কিন্তু লাগাব না। আসলে অত মানুষের ভিড়ে সেটা সম্ভবও না। পাবলিক তো আর তাদের চোখের সামনে ওভাবে কাউকে গায়ে আগুন লাগিয়ে মরতে দিবে না, তাই না ? তারা কেউ না কেউ থামাবেই। আমাদের উদ্দেশ্য শুধু প্রতিবাদটা মানুষের কাছে পৌঁছেই দেওয়া।’
‘কিন্তু আপনি তো প্রথমেই ভুল করছেন। আপনার উচিত ছিল প্রথম থেকেই ব্যাগের ভেতরে রাখা ওই ব্যানার টানিয়ে আমরণ অনশনে বসে যাওয়া। তাহলে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ হতো সহজে। আপনি সেটি না করে কী এক ব্যাকবোর্ডে স্কুলের এমপিওভুক্তির দাবি জানিয়ে অনশনে বসে গেলেন। বিষয়টা হাস্যকর হয়ে গেল না ?’
আজিজ মাস্টার খানিক চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমি আসলে ভয় পাচ্ছিলাম, প্রথমেই যদি কোহিনুরের এই বিষয়টা নিয়ে বসে যাই, আর তা যদি নুরুল মোল্লা কোনোভাবে জেনে যায়, তাহলে কিছু একটা সে করবেই। এইজন্যই স্কুলেরটা দিয়ে প্রথমে এখানকার হাবভাবটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম।’
‘তো হাবভাব কী বুঝলেন ?’
আজিজ মাস্টার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘এই সাধারণ, নির্বিরোধী বিষয় নিয়েই পুলিশ যা করল, আর ওই বিষয় নিয়ে কিছু করলে তো ভয়াবহ অবস্থা হবে।’
‘কথা সত্য। এই দেশে কোনো এক অদ্ভুত কারণে হয় ধর্ষণকারীরা শক্তিশালী হয়ে যায়, অথবা শক্তিশালীমাত্রই ধর্ষণকারী হয়।’
আজিজ মাস্টার আর কোনো কথা বললেন না। তিনি চুপচাপ বসে রইলেন। আসাদ বলল, ‘একটা কথা বলি স্যার ?’
‘জি বলেন’।
‘যা হয়েছে তার চেয়ে খারাপ আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু আপনার তো নিজের ঘরসংসারও আছে, আছে না ?’
‘জি আছে।’
‘তাহলে একবার ভাবেন তো আপনার কারণে তারা এখন কত বড় বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ?’
আজিজ মাস্টার কথা বললেন না। আসাদ বলল, ‘যদি আপনার এই প্রতিবাদের কারণে আপনার মেয়েদের কোনো সমস্যা হয় ? ঘরে এখনো দুটো মেয়ে আপনার। তখন ? তখন বাবা হয়ে সেটা মেনে নিতে পারবেন ?’
আজিজ মাস্টার এবারও জবাব দিলেন না। আসাদ বলল, ‘যে অন্যের মেয়ের ওপর ঘটা এমন ঘটনাই মেনে নিতে পারে না, সে নিজের মেয়ের ওপর এমন ঘটনা ঘটলে কী করবে ?’
দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে আজিজ মাস্টার কথা বললেন, ‘কী করব তাহলে ?’
‘আপনি বরং বাড়ি চলে যান। দেখেন স্কুলটার কোনোভাবে এমপিও করাতে পারেন কি না!’
‘স্কুলের মেয়েদের যদি নিরাপত্তাই দিতে না পারি, তাহলে আর স্কুল রেখে লাভ কী ?’
আসাদ চট করে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারল না। তবে সে আজিজ মাস্টারের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আাপনি ভালো মানুষ। আমি আপনার যন্ত্রণাটা বুঝি স্যার। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কোহিনুর তো আপনার নিজের মেয়ে না ? তাই না ?’
আজিজ মাস্টার এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। আসাদ আবারও প্রশ্নটা করল, ‘সে আপনার নিজের মেয়ে ?’
আজিজ মাস্টার বললেন, ‘নাহ।’
‘তাহলে যাদের মেয়ে, তাদের উচিত ছিল না বিষয়টা নিয়ে অনেক বেশি সোচ্চার হওয়া ?’
‘জি, ছিল।’
‘তাহলে তারা যদি না হয়, আপনার এত দায় কিসের ? অন্যের মেয়ের জন্য চিন্তার আগে কি নিজের মেয়েদের জন্য চিন্তা করা উচিত না ?’
আজিজ মাস্টার এই প্রশ্নেরও উত্তর দিলেন না। চুপ করে বসে রইলেন। তবে তার চোখের সামনে তখন সত্যি সত্যিই তার মেয়েদের চেহারা ভেসে উঠেছে। বাড়িতে নিশ্চয়ই সবাই খুব দুশ্চিন্তা করছে। বাবার জন্য অপেক্ষায় আছে তারা। আচ্ছা, ওরা কি তার খোঁজে অস্থির হয়ে আছে ? নিশ্চয়ই আছে। কে জানে, হয়তো চারদিকে তার খোঁজে লোকজনও পাঠিয়েছে। আবার ঢাকা শহরেও পৌঁছে যায় নি তো তারা ? কিন্তু ঢাকা শহরে পৌঁছালে কোথায় খুঁজবে তাকে ? এমন না যে তিনি ফোন ব্যবহার করেন আর সেই ফোনে তারা বাবাকে খুঁজে পাবে! তাহলে ? হঠাৎ মেয়েদের জন্য বুকের ভেতরটা কেমন শূন্য হয়ে গেল আজিজ মাস্টারের। কেমন আঁকুপাঁকু করতে লাগল।
আজিজ মাস্টার চুপচাপ বসে রইলেন। বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন তিনি। কিন্তু কোহিনুরের কথা মনে পড়তেই সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ওই গ্রামটাতে ফিরে গেলেই কোহিনুর তাঁর সামনে এসে দাঁড়াবে। তখন তাকে কী জবাব দিবেন তিনি ? স্কুলে ক্লাস টেনের যে বেঞ্চিটাতে রোজ এসে বসত কোহিনুর, সেই বেঞ্চিটা চোখের সামনে রেখে কী করে পড়াবেন তিনি ? যে পথ ধরে মেয়েটা রোজ হেঁটে যেত, সেই পথ ধরে কী করে হাঁটবেন তিনি ?
আচ্ছা, সত্যি সত্যিই কি কোহিনুরের ঘটনার কোনো বিচার হবে না ? কোনো বিহিত হবে না ? কিচ্ছু করতে পারবেন না তিনি ? অন্তত একটু প্রতিবাদও না ? এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না আজিজ মাস্টার। ভাবতেই বুকের ভেতরটা কী এক অক্ষম আক্রোশে ফুঁসে ফুঁসে উঠছে। জানেন, কিছুই করার নেই তার। তারপরও ডুবে যাওয়া মানুষ যেমন খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায়, তেমন করেই তিনি আসাদকে বললেন, ‘আপনি কি কিছু করতে পারেন না আসাদ সাহেব ? আপনি তো লেখেন। কবিতা, গল্প। লিখেও তো কত কিছু হয়! কত প্রতিবাদ, কত দাবি আদায়। হয় না ?’
আসাদ ম্লান হাসল, ‘এই দেশে হয় না। এখানে লিখে, গান গেয়ে, মানববন্ধন করে প্রতিবাদ করলে মানুষ ভাবে প্রতিবাদের শক্তি নেই বলে এগুলো করা হচ্ছে। কিংবা যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা হচ্ছে সেটা গুরুতর কোনো অন্যায় নয়। এগুলো লোকদেখানো। আর নীতিনির্ধারক বা শাসকেরাও এগুলোকে গুরুত্বহীন ভাবেন। ফলে এগুলো করে কিছু হবে না।’
‘আসলেই হবে না ?’
‘কোনো একদিন হয়তো হবে। এখন তো হয় না। দেখেন নি, সাগর রুনি হত্যার ঘটনায় কত লেখালেখি হলো, কত মানববন্ধন হলো, কই তাতে কিছু হলো ? আজ কত বছর ? হলো না তো কিছুই! তনু ধর্ষণ-হত্যার ঘটনা জানেন ? জানেন নিশ্চয়ই। এমন আর কত শত ঘটনা যে রয়েছে। কই ? কিছুই তো হয় নি! এই যে কত লেখালেখি, কত মানববন্ধন, প্রতিবাদ হলো কিন্তু কিছু হলো না তো!’
‘তাহলে ?’
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না আসাদ। সে চুপ করে রইল। চুপ করে রইলেন আজিজ মাস্টারও। সারা দিন আর কোনো কথা বললেন না তিনি। তবে বিকেল নাগাদ বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন আজিজ মাস্টার। তাঁর এখন সত্যি সত্যিই নিজের মেয়েদের জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে। অস্থির লাগছে।
পরদিন ভোরে তাঁকে বাড়ি যাওয়ার গাড়িতে তুলে দিল আসাদ। তবে পুরোটা সময় সে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। এই অদ্ভুত মানুষটাকে সে কোনোদিন ভুলবে না। এই মানুষটার সঙ্গে এই জীবনে আর কখনো দেখা হবে কি না আসাদ জানে না, তবে সে এটা জানে, এই মানুষটা হুটহাট তার গল্প, কবিতা, ভাবনায় বিচরণ করে যাবেন। সে হঠাৎ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, মাঝেমধ্যেই আজিজ মাস্টারের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে সে মানুষটার সঙ্গে দেখা করে আসবে। আর ফেরার সময় নিয়ে আসবে অদ্ভুত এক শক্তি।
আজিজ মাস্টারকে বিদায় দেওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে তিনি হঠাৎ আসাদের হাত চেপে ধরলেন। তারপর বললেন, ‘একটা কথা।’
‘কী কথা ?’
‘আপনি যে বললেন কোহিনুর আমার মেয়ে না। এইজন্য আমার বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত, তাই না ?’
আসাদ এই প্রশ্নের কী উত্তর দিবে সে জানে না। তারপরও সে বলল, ‘ঠিক তা না। আমি আসলে বলতে চেয়েছি, আপনার যদি কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে তারা কী করবে ?’
‘কী করবে ?’
‘আপনিই জানেন, তারা কী করবে!’
‘হ্যাঁ জানি। তারা কান্নাকাটি করবে। পিতৃহারা হয়ে কষ্ট পাবে। কিন্তু আসাদ সাহেব…।’
‘জি বলুন ?’
‘তাদের কারও কিছু হলে আমি কী করব ?’
‘কিছু হলে মানে ?’
‘ধরুন, যদি কোহিনুরের মতো কিছু হয়ে যায় ?’
‘এমন কিছু হবে না। আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না।’
‘কিন্তু যদি হয়ে যায় ? কোহিনুরের বাবা-মাও কি কখনো ভেবেছিলেন যে তাঁদের মেয়ের এমন কিছু হয়ে যেতে পারে ?’
‘উঁহু, ভাবেন নাই।’
‘তাহলে ?’
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না আসাদ। চুপ করে রইল। আজিজ মাস্টার নিজেই বললেন, ‘আল্লাহ না করুক, ধরেন আমার মেয়েদের ক্ষেত্রেও যদি এমন খারাপ কিছু ঘটে যায়, তখন কিন্তু অন্য সব বাবাও এটাই ভাববে যে তাদের ঘরে তাদের মেয়েরা তো ভালো আছে, নিরাপদে আছে। তাই না ? তারা কেন আমার মেয়ের বিচারের দাবিতে এগিয়ে আসবে ? আমার মেয়ের জন্য রাস্তায় নেমে তারা কেন নিজেদের বিপদ ডেকে আনবে ? তখন তাদের সন্তানরাও তো তাদের জন্য দুশ্চিন্তা করবে, তাই না ? তাদের কিছু হয়ে গেলে তাদের ছেলেমেয়েরাও তো তাদের জন্য কাঁদবে, পিতৃহারা হবে। তখন এইসব ভেবে তারাও আমার মতো এভাবে বাড়ি ফিরে গিয়ে নিজের স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে নিরাপদে থাকবে। আমাকে দেখেও না-দেখার ভান করবে। কিন্তু আমি একা তখন কী করব ? আমি তো বাবা, তাই না ?’
আসাদ এই প্রশ্নের জবাব দিল না। আজিজ মাস্টার হঠাৎ হাসলেন, ‘ওহ, আমি বারবার শুধু ভুলে যাই, আমি তো শুধু আমার মেয়েদের বাবা। আমি তো অন্য মেয়েদের বাবা নই। আমি তো কোহিনুরেরও বাবা নই। তাই না আসাদ সাহেব ?’
আসাদ এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল আজিজ মাস্টারের দিকে। লোকটাকে কেমন উদ্ভ্রান্ত লাগছে। কেমন অচেনা অন্যরকম লাগছে। তবে এই অচেনা অন্যরকম মানুষটা তার ভাবনার জগতটাকেও এলোমেলো করে দিচ্ছে। যদি এমন অচেনা মানুষে এই দেশটা পরিপূর্ণ হয়ে যেত, তবে এই দেশটাও কি অচেনা হয়ে যেত ? যেই অচেনাটা চেনার চেয়ে ভালো ? অন্য এক আলোঝলমলে মানুষের দেশ!
আসাদ ঘরে ফিরল তার কিছুক্ষণ পরেই। তার ঘরের মেঝেতে আজিজ মাস্টারের রেখে যাওয়া হলুদ ব্যানারখানা পড়ে আছে। কোহিনুরের হত্যার বিচার চেয়ে এই ব্যানারখানা তিনি বানিয়েছিলেন। কিন্তু কোথাও এটা প্রদর্শনের সুযোগ তাঁর হয় নি। আর কোনোদিন হবেও না। হয়তো এ কারণেই ব্যানারখানা ফেলে রেখে গিয়েছেন আজিজ মাস্টার। কে জানে, এই ব্যানারের সঙ্গে সঙ্গে হয়তো তিনি ফেলে রেখে গেছেন তাঁর যাবতীয় ক্ষোভ, ক্রোধ আর প্রতিবাদের শক্তিও। তাহলে যে শক্তিমান মানুষটা এই শহরে পা রেখেছিলেন অসম্ভব প্রতিবাদের এক স্বপ্ন নিয়ে, সেই মানুষটাই ফিরে যাচ্ছেন স্বপ্নহীন, শক্তিহীন, নিঃস্ব, ন্যুব্জ এক মানুষ হয়ে! আসাদ ব্যানারের ভাঁজটা খুলল।
ভেতরে স্পষ্ট বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘কোহিনুর ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চাই।’
প্রতিবাদমুখর এই শব্দগুলো পেছনে ফেলে রেখে শূন্যবুকে ফিরে গেছেন আজিজ মাস্টার। এক পরাজিত, বিধ্বস্ত, নিঃসঙ্গ একা মানুষ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন