মরণোত্তম – ২

সাদাত হোসাইন

আজিজ মাস্টার বসে আছেন প্রেসক্লাবের বাইরে। মূল গেট থেকে খানিক দূরে প্রেসক্লাবের দেয়াল ঘেঁষে ফুটপাতে মাদুর বিছিয়ে বসেছেন তিনি। তাঁর আশপাশে কিছু লোক জড়ো হয়েছে। এদের বেশির ভাগেরই ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, এরা বড়সড় কোনো মজা দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। আজিজ মাস্টার অবশ্য বুঝছেন না, এখানে মজা পাওয়ার মতো কী আছে! বিষয়টি এমন না যে তিনি এখানে কোনো হাস্যরসাত্মক কর্মকান্ড করছেন। স্ট্রিট ম্যাজিশিয়ানদের মতো রাস্তার পাশে কোনো ম্যাজিকও দেখাচ্ছেন না। এমনকি ক্যানভাসারদের মতো আদিরসাত্মক কথাবার্তা বলে কোনো গোপন রোগের ওষুধও বিক্রি করছেন না। তিনি অনশন করছেন। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, তাঁর পেছনে একখানা ছোট ব্যাকবোর্ড। ব্যাকবোর্ডে লেখা ‘ঐতিহ্যবাহী দবির খাঁ মেমোরিয়াল হাই স্কুলের এমপিওভুক্তির দাবিতে আমরণ অনশন। অনশনে—প্রধান শিক্ষক আজিজুর রহমান।’

এখানে হাসি-তামাশার মতো কোনো ব্যাপার নেই। একজন স্কুলশিক্ষক তাঁর স্কুলের এমপিওভুক্তির দাবিতে আমরণ অনশন করছেন, এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে! কিন্তু জড়ো হওয়া লোকজনের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তারা কোনো সার্কাস দেখতে এসেছে। সার্কাসে দারুণ মজার মজার ঘটনা ঘটছে। আরও মজার ঘটনা ঘটার অপেক্ষায় তারা অর্ধবৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছে। আজিজ মাস্টার অবশ্য কোনো কথা বললেন না। তিনি তাঁর পিঠের নিচের ব্যাগখানা খানিক উপরে তুলে দেয়ালে হেলান দিয়ে আরাম করে বসলেন। তাঁর মাথা ঠেকে আছে পেছনের ব্যাকবোর্ডে। এই ব্যাকবোর্ড তিনি তাঁর স্কুলঘর থেকে বাসের লকারে করে বয়ে এনেছেন।

ভিড় থেকে খানিক দূরে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে চশমা। মাথায় লম্বা চুল। মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। সে অন্যদের মতো উশখুশ করছে না বা ভিড়ের মধ্যেও ঢুকছে না। খানিকটা দূরে একা দাঁড়িয়ে আছে। এত এত মানুষের ভিড়েও ছেলেটা আলাদা করেই দৃষ্টি কাড়ল আজিজ মাস্টারের। বার কয়েক চোখাচোখিও হলো। যতবারই চোখাচোখি হয়েছে, ছেলেটা বিব্রত ভঙ্গিতে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ঢাকা শহরে উটকো লোকজনের অভাব নেই। বিষয়টা আজিজ মাস্টার জানেন। আর জানেন বলেই ছেলেটার এমন তীক্ষ্ণ ও গোপন চোখে তাকিয়ে থাকার বিষয়টা তাঁকে একধরনের অস্বস্তি দিচ্ছে। আড়াল থেকে নজর রাখাদের সব সময়ই গোপন উদ্দেশ্য থাকে। সরাসরিদের থাকে না। ছেলেটা ওভাবে আড়াল থেকে তাঁর দিকে তাকিয়ে না থেকে অন্যদের মতো তাঁর সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকলে তিনি চিন্তিত হতেন না। কিন্তু এখন চিন্তা লাগছে।

ছেলেটা অবশ্য আর বেশিক্ষণ আড়ালে থাকল না। হঠাৎ কী মনে করে সে সোজা আজিজ মাস্টারের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আজিজ মাস্টার এবার খানিক অবাকই হলেন। ছেলেটা ধীর পায়ে সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর বলল, ‘স্যার কি একাই এসেছেন ? নাকি সঙ্গে কেউ আছে ?’

আজিজ মাস্টার বুঝতে পারছেন না, এই প্রশ্নের উত্তরে তার কিছু বলা উচিত কি না! তিনি কিছুটা ভয়ও পাচ্ছেন, আবার আগ্রহও জাগছে। আগ্রহ জাগার কারণ ঢাকায় তিনি এসেছেন একা। এখানে তাঁর চেনা-পরিচিত কেউ নেই। জানাশোনা কেউ নেই। শহরের হাবভাব বোঝে এমন একজন কেউ সঙ্গে থাকলে খুব ভালো হতো। সমস্যা হচ্ছে, শহরভর্তি চোর-বাটপাড়। এর মধ্যে তিনি কাকে বিশ্বাস করবেন আর কাকে করবেন না—এই সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি ছেলেটার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া থেকে বিরত রইলেন।

ছেলেটা অবশ্য নাছোড়বান্দা। সে বলল, ‘আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন স্যার ?’

আজিজ মাস্টার মিনমিন করে বললেন, ‘ভয় পাব কেন ? আপনি কি চোর না ডাকাত ? আর চোর-ডাকাত হলেও লাভ নেই। আমার কাছে মূল্যবান কিছু নেই।’

ছেলেটা হাসল, ‘আমি চোরও না, ডাকাতও না। মানুষও মোটামুটি ভালো। তবে একটু পাগলা কিসিমের। তাতে অবশ্য আপনার অসুবিধা হবে না। আপনার পাশে একটু বসি স্যার ?’

আজিজ মাস্টার এবারও জবাব দিলেন না। তবে ছেলেটা যে তাঁর জবাবের অপেক্ষা করল তাও না। সে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আজিজ মাস্টারের পাশে বসে পড়ল। তারপর আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরাল। আজিজ মাস্টার যুগপৎ অবাক এবং আশাহত হলেন। মনে মনে ছেলেটাকে তিনি ভালো ভাবতে চাইছিলেন। ভাবতে চাইছিলেন, ছেলেটা তাঁকে কোনো না কোনোভাবে সাহায্য করবে। কিন্তু তাঁর মতো একজন বয়োঃবৃদ্ধ স্কুলশিক্ষকের সামনে এই বয়সের একটা ছেলে এভাবে সিগারেট ধরাবে এটি তিনি আশা করেন নি। ছেলেটি অবশ্য আজিজ মাস্টারকে আরও অবাক করে দিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটি তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিল। তারপর বলল, ‘চলবে নাকি স্যার ?’

আজিজ মাস্টার হতভম্ব গলায় বললেন, ‘কী!’

ছেলেটা একইরকম হাসি হাসি মুখে বলল, ‘না মানে স্যার, এই মুহূর্তে এর চাইতে ভালো ব্রান্ড খাওয়ার পয়সা নাই। যখন পয়সা থাকে তখন ভালো জিনিসই খাই। এই ধরেন বেনসন অ্যান্ড হেজেস, মার্লবোরো। আর যখন পয়সা থাকে না তখন বিড়িও খাই।’

আজিজ মাস্টার রীতিমতো বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। রাগে তাঁর শরীর কাঁপছে। এই বয়সি একটা ছেলে তাঁর সামনে বসে সিগারেট খাচ্ছে, মুখ ভর্তি করে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়ছে। আবার এমন আজেবাজে ধরনের কথা বলছে। বিষয়টা তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। ছেলেটা আজিজ মাস্টারের অবস্থা দেখে বিনয়ী ভঙ্গিতে বলল, ‘এই ব্র্যান্ড তেমন দামি না হলেও সিগারেটটা খেয়ে কিন্তু খুব মজা স্যার। টেস্ট করে দেখতে পারেন।’

আজিজ মাস্টার কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। প্রচন্ড রাগে তাঁর শরীর কাঁপছে। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হচ্ছে, সেই রাগ তিনি প্রকাশ করতে পারছেন না। ফলে তা প্রচন্ড হতাশায় পরিণত হচ্ছে। অবদমিত প্রবল রাগ থেকে তৈরি এই হতাশাটা ভয়ঙ্কর।

ছেলেটা গলগল করে মুখভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘অনশন কি একাই করতেছেন ?’

আজিজ মাস্টার এবারও কথা বললেন না। তবে সে আজিজ মাস্টারের কথা বলার অপেক্ষায়ও থাকল না। নিজে নিজেই আবার বলল, ‘অনশন করলে সঙ্গে লোকজন থাকতে হয়। একা একা অনশন হয় না।’

আজিজ মাস্টার এবার ক্ষীপ্ত গলায় বললেন, ‘কে আপনি ? আপনার পরিচয় কী ?’

ছেলেটা তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে একইরকম নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘অনশন করতে হলে টিভি ক্যামেরা, পেপার পত্রিকার সাথে ভালো যোগাযোগ আছে, এমন লোকজন লাগে। আছে আপনার এমন লোকজন ?’

আজিজ মাস্টার কিছু বলবেন না বলবেন না করেও শেষ অবধি সন্দিগ্ধ ভঙ্গিতে মৃদুকণ্ঠে বললেন, ‘না।’

ছেলেটা খে খে করে হাসল। যেন এর চেয়ে হাস্যকর কথা আর সে শোনে নি। হাতের সিগারেটটা নিভিয়ে ফুটপাতে ছুড়ে দিতে দিতে সে বলল, ‘তাহলে তো হবে না স্যার।’

আজিজ মাস্টার কথা না বললেও চোখ তুলে তাকালেন। ছেলেটা বলল, ‘ওইরকম কিছু লোকজন থাকলে তারা খবর দিয়ে সাংবাদিক-টাংবাদিক নিয়ে আসবে। সাংবাদিক ছাড়া এইসব অনশন টনশন করে কোনো লাভ নাই। আপনিই বলেন, সাংবাদিকরা যদি কোনো খবর না করে, তাহলে সেই অনশনের কথা কেউ কোনদিন জানবে ?’

ছেলেটার সঙ্গে কোনোভাবেই কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না আজিজ মাস্টারের। কিন্তু তারপরও তিনি যেন কিছুটা আগ্রহী হয়ে উঠলেন। মৃদুকণ্ঠে বললেন, ‘না, জানবে না।’

ছেলেটা আবারও হাসল, ‘হে হে হে। এই তো লাইনে আসছেন। এখন তাহলে কী করতে হবে ?’

‘কী করতে হবে ?’ আজিজ মাস্টার অসহায় ভঙ্গিতে প্রশ্নের ছলে দ্বিরুক্তি করলেন।

‘সাংবাদিকদের খবর দিতে হবে। চা-বিস্কুট খাওয়াতে হবে। যাওয়ার সময় হাতের ফাঁকে সামান্য টাকাপয়সাও গুঁজে দিতে হবে। এইটারে আবার ঘুষ ভাইবেন না স্যার। এইটা হলো তাদের আসা-যাওয়ার খরচ। ভাড়া বা নিজেদের গাড়ির তেলের খরচ। নিজেদের গাঁটের পয়সা খরচ করে তারা আপনার সংবাদ কভার করতে কেন আসবে বলেন ? সবকিছুরই তো একটা সিস্টেম আছে, আছে না ?’

আজিজ মাস্টার জবাব দিলেন না। তিনি তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। বিশাল রেইনট্রি গাছের ফাঁক দিয়ে শরতের পরিষ্কার স্বচ্ছ আকাশ দেখা যাচ্ছে। আকাশে চক্রাকারে চিল উড়ছে। ঢাকা শহরে এই সময়ে এভাবে চিল উড়তে দেখবেন, তিনি ভাবেন নি।

ছেলেটা খানিক কাছে এসে বলল, ‘শোনেন স্যার, এসব না হলে কিন্তু এই অনশন-টনশন করে কোনো লাভ নাই।’

আজিজ মাস্টার ছেলেটার দিকে তাকালেন না। তবে আড়চোখে তিনি তার উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা করছেন। ছেলেটার কথাবার্তা শুনে তিনি মোটামুটি নিশ্চিত যে এই ছেলে ধান্দাবাজ টাইপের কেউ। এসব হাবিজাবি বলে সে তাঁর কাছ থেকে টাকা মেরে দেওয়ার ধান্দা করছে। কিন্তু আজিজ মাস্টার এসব বোঝেন। তাঁকে বোকা বানানো এত সহজ না।

ছেলেটা বলল, ‘আর যদি এই পরিকল্পনা নিয়ে এসে থাকেন যে স্রেফ লোক দেখানোর জন্য অনশনের অভিনয় করছেন, তাহলেও কিন্তু লোকজন লাগবে। কারণ আপনি তো আর না মরা পর্যন্ত অনশন করবেন না। করবেন ? করবেন না। তাহলে ? তাহলে অনেক চেষ্টাচরিত্র করে, আপনারে বুঝিয়ে সুঝিয়ে, জোরজবরদস্তি করেও তো আপনার অনশন ভাঙানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তাই না ?’

আজিজ মাস্টার এবারও জবাব দিলেন না। তিনি চুপচাপ ছেলেটার কথা বোঝার চেষ্টা করছেন। ছেলেটা বলল, ‘যেহেতু আপনি মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত অনশন করবেন না, মানে আমরণ অনশন করবেন না, সেহেতু আপনার কিন্তু কিছু লোক লাগবে। বিশেষ করে নিজের কাছের আপনা লোকজনই লাগবে।’

আজিজ মাস্টার এবার সরাসরি ছেলেটার চোখে তাকালেন। ছেলেটা মৃদু হেসে চোখ টিপে বলল, ‘এরা জোর করে আপনার অনশন ভাঙানোর অভিনয় করবে। এই ধরেন আপনি একদম অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে যাওয়ার অভিনয় করবেন। তখন আপনার জন্য হাসপাতাল থেকে ডাক্তার নিয়ে আসার জন্য লোক লাগবে। মিছেমিছি স্যালাইন লাগানোর জন্য লোক লাগবে। তারপর শেষ মুহূর্তে এসে জোরজবরদস্তি করে জুস-টুস খাইয়ে তারা আপনার অনশন ভাঙাবে। বুঝলেন ?’

আজিজ মাস্টার তাকিয়েই আছেন। উদ্দেশ্য যা-ই হোক, ছেলেটাকে এখন তার ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। তিনি কৌতূহলী ভঙ্গিতে তাকালেন। ছেলেটা বলল, ‘আর যদি সত্যি সত্যিই আমরণ অনশনে যেতে চান, মানে দাবিদাওয়া আদায় না হওয়া পর্যন্ত সত্যি সত্যিই অনশন করতে চান, তাহলে কিন্তু সত্যি সত্যি না খেয়ে মরতে হবে।’

‘কেন ?’ আজিজ মাস্টার এবার আর জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারলেন না। ‘একটা মানুষ দাবি আদায় না হলে অনশন করে মারা যাবে, তবুও কেউ তার কাছে আসবে না ? তার দাবিদাওয়া শুনতে চাইবে না ?’

ছেলেটা আরও একটা সিগারেটে ধরাতে ধরাতে বলল, ‘নাহ।’

‘কেন ?’

‘কারণ এইসব অনশন টনশনে কারও কিছু যায়-আসে না।’

‘যায়-আসে না কেন ?’

‘কারণ এই দেশে মানুষ বেশি। হা হা হা। ছোটবেলায় রচনা পড়েন নাই ? পপ্যুলেশন প্রবলেম ইন বাংলাদেশ ? বাংলাদেশ ইজ আ ওভার পপ্যুলেটেড কান্ট্রি…।’

‘ইজ অ্যান। ওভারের আগে অ্যান হবে। অ্যান ওভার পপ্যুলেটেড কান্ট্রি।’ আজিজ মাস্টার গম্ভীর মুখে বললেন।

ছেলেটা হাসল, ‘জি স্যার, জি স্যার। এইসব আর্টিকেল ফার্টিকেল ছোটবেলায় পড়েছি। তবে ভুল বললেও ঘটনা কিন্তু সত্য। এটা কিন্তু স্যার বুঝতে হবে। না বুঝলে বিপদ।’

আজিজ মাস্টার এই পরিস্থিতিতে ছেলেটার এমন অসংলগ্ন কথাবার্তা, প্রগলভতায় বিরক্ত। খানিকটা বিভ্রান্তও বটে। তবে তিনি সেটা প্রকাশ করলেন না। দ্বিধামিশ্রিত চোখে তাকিয়েই রইলেন। ছেলেটা বলল, ‘শোনেন স্যার, এই দেশে মন্ত্রী মিনিস্টার বা তাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ কেউ মরলে সেইটা একটা ঘটনা। কিন্তু আপনার আমার মতো আমজনতা রোজ কয়েক শ মরলেও তাতে কারও কিছু যায় আসে না। প্রতিদিন সারা দেশে রোড এ্যাকসিডেন্টে কত মানুষ মারা যায়, সেই হিসাব করছেন কোনোদিন ?’

আজিজ মাস্টার ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়লেন। ছেলেটা বলল, ‘বুঝলেন তো ? এই যে রোজ কত কত মানুষ রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়, আপনি তার খবরও জানেন না। আপনার তাতে কিছু যায় আসে না। তাহলে আপনি মরলে কার কী যাবে আসবে ? আপনি কোন হরিদাশ পাল যে আপনি মরলে লোকজন হই হই করে ছুটে আসবে ? আলাপ আলোচনা করবে! বলেন ?’

ছেলেটার কথা বলার ভঙ্গি খুব একটা সুবিধার না। একটা প্রচ্ছন্ন বেয়াদবির ব্যাপার আছে। তবে তার কথাগুলো কিন্তু মিথ্যে না। আজিজ মাস্টার তার প্রশ্নের জবাব না দিলেও মনে মনে বিষয়টা ভেবে দেখতে লাগলেন। আগে কখনো এভাবে ভাবেন নি তিনি। ছেলেটা বলল, ‘এই দেশে রোজ কত শত মানুষ মরে, তাতে কার কী যায় আসে ? শোনেন, যেই দেশে যেটার অভাব নেই, সেই দেশে সেটার গুরুত্বও নাই। এই দেশে সব জিনিসেরই অভাব। শুধু একটা জিনিসেরই অভাব নাই। সেইটা হলো মানুষ। যেহেতু মানুষের অভাব নাই, সেহেতু মানুষের দামও নাই, কোনো গুরুত্বও নাই। বুঝলেন ? হিসেব পরিষ্কার ?’

আজিজ মাস্টার ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর কাছে এখন ছেলেটাকে খুবই কৌতূহলোদ্দীপক মনে হচ্ছে। ছেলেটা বলল, ‘কি, আছে এই দেশে মানুষের অভাব ? এইখানে আপনার অনশন ভাঙাতে কেউই আসবে না। আপনি মরলে কারও কিছু আসে যায় না। রাস্তার মানুষেরও না। এমনকি আপনি রাস্তার পাশে মরে পড়ে থাকলেও দু-এক দিন লোকে ভাববে ফুটপাতে ছিন্নমূল কোনো মানুষ ঘুমাচ্ছে। কারণ, এই দেশে হাজার হাজার মানুষ আছে, তারা ছিন্নমূল, গৃহহীন। এরা রাস্তায়, ফুটপাতে, ট্রেন স্টেশনে ঘুমায়। তারা ভাববে আপনিও তাদের একজন। তবে হ্যাঁ, পচে গন্ধ ছড়ালে অবশ্য ভিন্ন কথা। তখন লোকজন একটু হইচই করবে। তার মানে বুঝলেন তো ?’

‘কী ?’

‘আপনাকে শুধু মরলেই হবে না। লোকজনের নজরে পড়তে হলে পচে গন্ধও ছড়াতে হবে। হা হা হা।’

ছেলেটা হাসছে। আজিজ মাস্টার কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। ছেলেটা হাসি থামিয়ে বলল, ‘অযথা আপনাকে নিয়ে কেউই ঝামেলায় জড়াতে চাইবে না। লোকজন ভাববে এখানে এসে আবার কী না কী ঝামেলায় পড়বে। দরকার কী ? এমনকি এই যে এখন যারা আপনার চারপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে, এরাও না। বরং ধরেন নিজের গায়ে যদি আগুন টাগুন লাগিয়ে মারা যেতে পারেন, তখন সেইটা একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা হইতে পারে।’

‘মানে ? গায়ে আগুন লাগিয়ে মৃত্যু ইন্টারেস্টিং ঘটনা ?’ আজিজ মাস্টার হতাশ এবং ব্যথিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

‘অবশ্যই ইন্টারেস্টিং ঘটনা। এই দেশে মৃত্যু কোনো ঘটনা না। তবে ক্যামেরার সামনে যদি জীবন্ত কোনো মানুষ গায়ে আগুন লাগিয়ে মরে, তবে সেটা অবশ্যই ইন্টারেস্টিং ঘটনা। তখন এরা বরং চোখে মুখে আনন্দ নিয়ে আপনার মৃত্যুদৃশ্য দেখবে। কেউ কেউ ছবি তুলবে, ভিডিও করবে। কেউ কেউ সেই দৃশ্য ফেসবুকে লাইভ ভিডিও দিবে। এই দিক দিয়ে অবশ্য আপনি তখন ভাগ্যবান হবেন, লাইভ ভিডিও ডেথ হবে আপনার। সেই ভিডিও ভাইরাল হবে। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ লাইক, কমেন্ট, শেয়ার। বুঝলেন ?’

আজিজ মাস্টার ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়ালেন। তিনি বোঝেন নি। ছেলেটা বলল, ‘থাক, আপনার আর বুঝতে হবে না। তবে সমস্যা হচ্ছে, আপনি নিজের কোনো লোকজন নিয়ে আসেন নাই যে তারা এসে অনুনয় বিনয় করে, জোরজবরদস্তি করে আপনার অনশন ভাঙাবে।’

আজিজ মাস্টার থমথমে চোখে তাকিয়ে আছেন। ছেলেটা বলল, ‘আর আপনার দাবিদাওয়া কেউ মানতে আসবে না। এইটা সিওর। তবে সত্যি সত্যিই যদি অনশন করে মরে যান, তখন হয়তো কিছু সাংবাদিক খোঁজখবর নিতে আসবে। ভাগ্য ভালো হলে পত্রিকার কোনায় টোনায় দু-একটা সংবাদ টংবাদও হতে পারে। সান্ত্বনা বলতে এটুকুই। আমার মতো দু-একজন টুটকা ফাটকা কবি তখন আপনাকে নিয়ে কবিতা টবিতাও লিখে ফেলতে পারে। বিদ্রোহী কবিতা।’

আজিজ মাস্টার এতক্ষণে ভালো করে ছেলেটার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। এতক্ষণে তার মনে হলো ছেলেটা কবি-লেখক গোছেরই কিছু একটা হবে। তার কাঁধের শান্তিনিকেতনি ঝোলার ভেতর থেকে কাগজ-কলমও উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু কবি লেখকেরা কি আসলেই এমন হয় ? তাদের একপলক দেখেই বোঝা যায় তারা কবি-লেখক ? আজিজ মাস্টার অবশ্য শুনেছেন, আজকাল শহুরে কবি-লেখকরা আর আগের মতো এমন বেশভূষায় ঘুরে বেড়ান না। তারা এখন জিন্স, টি শার্ট, কোট-টাই পরেও হরদম ঘুরে বেড়ায়।

ছেলেটা আজিজ মাস্টারের মুখের কাছে মুখ এনে প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘এই দেশে অনশন, মানব বন্ধন করে কোনো লাভ হয়েছে কোনোদিন ? কোনো দাবিদাওয়া আদায় হয়েছে ? হয় নাই। কারণ, ওগুলো এই দেশের জিনিস না। ওগুলা হলো শিক্ষিত, উন্নত দেশের জিনিস। এই দেশের দাবি আদায়ের জিনিস হলো জ্বালাওপোড়াও, ভাঙচুর, হরতাল-অবরোধ। কথায় আছে না, যেমন ওল, তেমন বাঘা তেঁতুল ? এটাই আসল কথা। এইসব মানব বন্ধন-ফন্দন এই দেশে চলে না। মানুষ ভাবে মশকরা হচ্ছে। তারা বিষয়টাতে বিনোদন পায়, আনন্দ পায়; কিন্তু আন্দোলনটা আর পায় না। আমাদের দেশের শাসকশ্রেণি হলো লোহা। আর লোহা গলাতে লাগে আগুন। পানিতে লোহা গলে না, গলে আগুনে। যেই জিনিসের যেই নিয়ম।’

আজিজ মাস্টার এতক্ষণে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার পরিচিত কোনো সাংবাদিক আছে ?’

‘দু-চারজন আছে। তাবে তাদের দিয়ে কোনো কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না।’

‘কেন ?’

‘কারণ তারা হচ্ছে অনলাইন পত্রিকার সাংবাদিক। ঢাকা শহরে এখন যে পরিমাণ কাক, সেই পরিমাণ অনলাইন পত্রিকা। এদের বেশির ভাগেরই কোনো সাংবাদিক থাকে না। নিজেই সম্পাদক, নিজেই সাংবাদিক। এরা বড় বড় পত্রিকার নিউজ কপি করে হুবহু ছাপায়। ফলে এদের নিজেদের নিউজ কেউ পড়ে না। না পড়ার অবশ্য কারণও আছে। এদের নিজস্ব নিউজ মানেই যৌন সুড়সুড়ি মার্কা খবর। মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর বা উত্তেজক হেডলাইন। হেডলাইনের পাশে লেখা থাকে ভিডিওসহ।’

‘আজকাল কি পত্রিকায়ও ভিডিও দেখা যায় ?’

‘আরও অনেক কিছুই দেখা যায়, সেসব আপনি বুঝবেন না। এবার আসল কথায় আসেন।’

‘জি।’ আজিজ মাস্টার যেন হালে কিছুটা পানি ফিরে পাচ্ছেন। তাঁর ধারণা, এই ছেলে তাঁকে বুদ্ধি পরামর্শ কিছু দিলেও দিতে পারে। নিজের বোধ বুদ্ধি নিয়ে খুব একটা আত্মবিশ্বাসী নন তিনি। আগে তা যাও ছিলেন, এখন দিন যত যাচ্ছে, নিজের প্রতি আস্থা তত কমছে আজিজ মাস্টারের। চারপাশের মানুষ, পৃথিবী কেমন পাল্টে যাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও এর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না তিনি।

প্রেসক্লাবের সামনে এসে এই অনশন করার বুদ্ধিও তাঁর নিজের না। এই বুদ্ধি আরও বছরখানে আগে তাঁকে দিয়েছিল তাঁর স্কুলের অবৈতনিক বাংলা শিক্ষক রফিকুল ইসলাম। রফিকুল পড়াশোনা করেছে ঢাকার তিতুমির কলেজে, বাংলায়। তার জীবনের ‘এইম ইন লাইফ’ বলতে যা বোঝায়, তা হলো গ্রামের কোনো স্কুলে গিয়ে শিক্ষকতা করা। কোমলমতি ছেলেমেয়েদের সে তার শিক্ষায়-আদর্শে গড়ে তুলতে চেয়েছিল। কিন্তু তার সেই ইচ্ছে পূরণ হলো না।

মাস্টার্স পাশ করার পরও কোনো ভালো স্কুল-কলেজে সে চাকরিবাকরি জোটাতে পারল না। আজকাল স্কুল-কলেজে চাকরি পেতে হলে সার্টিফিকেট ছাড়াও আরও নানান কিছু লাগে। কিন্তু সেসব কিছুই তার নেই।

রফিকুলের সঙ্গে আজিজ মাস্টারের পরিচয়ের ঘটনা খুবই অদ্ভুত। আজিজ মাস্টার ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। আবহাওয়া খারাপ। আরিচা ফেরিঘাট থেকে ফেরিতে উঠতেই শুরু হলো তুমুল ঝড়-বৃষ্টি। একই ফেরিতে ফিরছিল রফিকুলও। তার বাড়ি খুলনায়। কিছুক্ষণের মধ্যে ঝোড়ো হাওয়া থেমে গেলেও বৃষ্টি আর থামল না। আজিজ মাস্টারের হাতে ছাতা। তিনি ছাতা মাথায় ফেরির রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালেন। বিস্তৃত নদীর জলে ঝরে পড়ছে বৃষ্টির অজস্র ফোঁটা। ক্রমশই ধূসর হয়ে উঠছে দূরের দৃশ্য। ঠিক এই মুহূর্তে ছেলেটাকে চোখে পড়ল তার। রেলিংয়ের শেষপ্রান্তে একা দাঁড়িয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বৃষ্টিতে ভিজছে রফিকুল। তার পরনে ইস্ত্রি করা আকাশি রঙের শার্ট, কালো প্যান্ট। কাঁধে ব্যাগ। কিন্তু কোনোদিকে কোনো খেয়াল নেই তার। সে আনমনে নদীর দিকে তাকিয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। তবে তার তাকানোর ভঙ্গি দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, আসলে কিছুই দেখছে না সে। কেবল শূন্যচোখে তাকিয়েই আছে।

আজিজ মাস্টার ভারি অবাক হলেন। তিনি খানিক ইতস্তত করে ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেলেন। কথাও বললেন। রফিকুল তখন মানিকগঞ্জে এক স্কুলে ইন্টারভিউ দিয়ে বাড়ি ফিরছে। ইন্টারভিউর ফলাফল সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার চাকরি হয় নি। রফিকুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এবার আর সে বাড়ি ফিরে যাবে না। আজিজ মাস্টার সব শুনে বললেন, ‘তাহলে কোথায় যাবে তুমি ?’

রফিকুল উদাস গলায় বলল, ‘জানি না।’

‘জানি না মানে ? এত দারুণ একটা ভাবনা নিয়ে তুমি এখন কিছুই করবে না ? তোমার বয়সী আর কোনো ছেলেমেয়ে এই চিন্তা করবে ?’

‘করবে না ?’

‘মনে তো হয় না। এমন আর কাউকে তো দেখি নাই।’

‘তার মানে আমার ভাবনাটা আসলে দারুণ না। আমার ভাবনা বরং অচল ভাবনা।’

‘অচল কেন হবে ?’

‘অচল না হলে তো আরও অনেকের মধ্যেই এই ভাবনা দেখতেন।’

আজিজ মাস্টার রফিকুলের অভিমান ও হতাশার জায়গাটা বুঝতে পারছেন। কিন্তু নিজের তেমন কিছু করারও নেই। তারপরও তিনি বললেন, ‘শোনো বাবা। তোমার ভাবনা অবশ্যই দারুণ। সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশে এই ভাবনা প্রচলিত ভাবনা না। সবাই আগে টাকাপয়সার ভাবনাটা ভাবে। এই কারণে কেউ এমন করে ভাবতে পারে না। সবার তো আর এই সাহসটা থাকে না। তোমার আছে। তুমি সাহসী ছেলে।’

রফিকুল হতাশ ভঙ্গিতে হাসল, ‘পেটে ভাত না থাকলে সাহস দেখিয়ে লাভ কী ? সাহস দেখাতে হলে আগে পেটে ভাত থাকতে হয়।’

রফিকুলের কথা সত্য। আজিজ মাস্টারের খুব ইচ্ছে হচ্ছে ছেলেটাকে তার স্কুলের জন্য নিয়ে যেতে। কিন্তু তার সেই সামর্থ্য নেই। এই ছেলেকে তিনি কোনো টাকাপয়সা দিতে পারবেন না। তার ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না। তবে তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাটা তিনি করতে পারবেন। দবির খাঁ মেমোরিয়াল হাই স্কুলে এই মুহূর্তে ভয়াবহ শিক্ষক-সংকট। বিনা বেতনে কে-ই বা আর কাজ করতে চায় ? এই অবস্থায় রফিকুলের মতো কাউকে পেলে মন্দ হয় না। কিন্তু শুধু থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে কি সে রাজি হবে ?

অনেক দ্বিধা আর সঙ্কোচ নিয়েই প্রস্তাবটা দিলেন আজিজ মাস্টার। তিনি বললেন, ‘তুমি যদি কিছু না মনে করো, তাহলে তোমাকে একটা প্রস্তাব দিতে পারি বাবা।’

রফিকুল খানিক তাকিয়ে থেকে বলল, ‘কিছু মনে করার মতো অবস্থা আমার নাই। আপনি যা ইচ্ছা তা-ই বলতে পারেন। চাইলে ধাক্কা দিয়ে আমাকে পানিতেও ফেলে দিতে পারেন। বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাও যদি তাতে কমে।’

আজিজ মাস্টার সস্নেহে বললেন, ‘এসব কী বলছো তুমি! এত হতাশ হলে চলে ?’

রফিকুল জবাব দিল না। আজিজ মাস্টার বললেন, ‘আমার একটা স্কুল আছে। হাই স্কুল। সেই স্কুল এখনো এমপিওভুক্ত হয় নি। তুমি চাইলে আমার সেই স্কুলে আপাতত জয়েন করতে পারো। তবে সমস্যা হচ্ছে, আমি আপাতত তোমাকে বেতন টেতন কিছু দিতে পারব না। কিন্তু তোমার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আমি করব।’

রফিকুলের কথাটা বিশ্বাস হলো না। এ যেন মিরাকলের মতো ব্যাপার। এমন মনভাঙা হতাশার দিনে, এই চলন্ত ফেরিতে এমন একটা প্রস্তাব আসতে পারে এটা সে স্বপ্নেও ভাবে নি। রফিকুল নিশ্চিত হওয়ার জন্য বলল, ‘আমি আপনার কথা বুঝি নি।’

আজিজ মাস্টার বললেন, ‘স্কুল এমপিওভুক্ত হওয়ামাত্রই তুমি তোমার যোগ্যতা অনুযায়ী বেতনভাতা সব পেতে শুরু করবে। কিন্তু আপাতত আমি তোমাকে টাকাপয়সা কিছু দিতে পারব না। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাটা শুধু করতে পারব। তবে তোমাকে নিচের ক্লাসের কিছু টিউশন ফিউশন জোগাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করব। যাতে তোমার হাতখরচটা অন্তত সেখান থেকে আসে।’

এই মুহূর্তে এরচেয়ে ভালো সুযোগ আর রফিকুলের হাতে নেই। সে এককথায় রাজি হয়ে গেল। সেদিনই রফিকুলকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন আজিজ মাস্টার। রফিকুল দবির খাঁ মেমোরিয়াল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক হিসেবে বিনা বেতনে চাকুরি পেয়ে গেল। তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেল আজিজ মাস্টারের বাড়িতেই।

আজিজ মাস্টারের তিন মেয়ে। ছেলে নেই। বড় মেয়ে ঝুমুর বিয়ে দিয়েছেন। মেজ মেয়ে রুমু এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। ছোট মেয়ে কুমু পড়ে ক্লাস টেন-এ। এই বাড়িতে রফিকুলের বয়সী ছেলে রাখা আর খাল কেটে কুমির আনার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু আজিজ মাস্টার তারপরও রাখলেন। রাখার অন্য কারণও অবশ্য আছে। ফেরি থেকেই রফিকুলের সঙ্গে তার কথাবার্তা বেশ জমে উঠল। রফিকুল স্বল্পভাষী হলেও সে কথা বলে খুব গুছিয়ে, হিসাব-নিকাশ করে। স্কুলের বর্তমান অবস্থা বিষয়ে তার সঙ্গে নানান আলাপ-আলোচনাও হলো। রফিকুলের আগ্রহ দেখে আজিজ মাস্টারের ভালো লেগে গেল। এই ছেলেটা সঙ্গে থাকলে স্কুলবিষয়ক নানান শলাপরামর্শ তিনি করতে পারবেন। তার কেন যেন মনে হতে লাগল যে রফিকুল আলমের কারণেই তিনি তাঁর স্কুলের একটা গতি করে ফেলতে পারবেন। এটা তাঁর মধ্যে একধরনের দৈব বিশ্বাসের মতো কাজ করা শুরু করল। এছাড়া আর কোনো সঙ্গত কারণ নেই। কে জানে কাকে দিয়ে কখন কোন উপকার হয়ে যায়!

সেই রফিকুলের পরামর্শেই তিনি ঢাকায় এসেছেন। তবে রফিকুল তাঁকে এই পরামর্শ দিয়েছিল আরও বছরখানেক আগে। সে হঠাৎ একদিন পুরোনো এক খবরের কাগজ হাতে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল। তারপর হড়বড় করে বলতে লাগল, ‘দেখেছেন স্যার বিষয়টা ?’

আজিজ মাস্টার চশমাটা মুছতে মুছতে বললেন, ‘কী বিষয় ?’

‘বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকেরা তাদের স্কুল সরকারি করার দাবিতে অনশনে বসছে।’

আজিজ মাস্টার যতটা আগ্রহ নিয়ে বিষয়টা দেখতে চাইছিলেন ততটা অনাগ্রহ নিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, ‘এইসব অনশন ফনশনে কিছু হয় না।’

‘হয় হয় স্যার। এগুলাতেই হয়। এই অনশনে প্রথমে কাজ না হলেও এই যে পেপার পত্রিকায় এল, এর একটা ইমপ্যাক্ট আছে। এগুলো অনেকের চোখে পড়বে। এটা নিয়ে কথা হবে। ধরেন একজন শিক্ষক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গেল। বা আরও খারাপ কিছু ঘটে গেল। তখন কিন্তু আর সরকারের পক্ষে বিষয়টা গুরুত্ব না দিয়ে পারা যাবে না।’

‘হুম।’ আজিজ মাস্টার খুব একটা আগ্রহী হতে পারলেন না। রফিকুল বলল, ‘তারপর ধরেন কেউ একজন এসে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি ট্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের অনশন ভাঙাল। তারপর কী হবে জানেন ?’

‘কিছুই হবে না। ওই প্রতিশ্রুতিই সম্বল।’

‘এটা যেমন ঠিক, তেমনি এর উল্টোদিকও আছে।’

‘উল্টোদিক কী ?’

‘এরপর শিক্ষকেরা দাবি আদায়ের জন্য রাজপথে নামবে। রাস্তা ব্যারিকেড দিবে। তখন পুলিশ বাধা দিবে। সরকারি দলের চ্যালাচামুণ্ডা ঝামেলা পাকাবে। তারপর কী হবে ? টিয়ারশেল, লাঠিচার্জ। তখন এটা একটা ন্যাশনাল ইস্যু হয়ে যাবে। আর তখন দেখবেন ঘটনা সিরিয়াস আকার ধারণ করেছে। সরকারের তখন আর দাবি না মেনে উপায় থাকবে না।’

‘হুম। কী জানি!’ হতাশ গলায় বললেন আজিজ মাস্টার। ‘আমার এখন আর কোনো কিছুতেই বিশ্বাস হয় না।’

‘কোনো কিছুতে ঠিকঠাক লেগে থাকলে সেটা হয়ই স্যার। পার্থক্য শুধু আগে আর পরে।’

‘লেগে তো আমিও কম থাকি নি বাবা। কই কিছুই তো হলো না।’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন আজিজ মাস্টার।

‘ঠিকঠাক লেগে থাকলে এতদিনে হয়ে যেত স্যার।’

আজিজ মাস্টার চট করে রেগে গেলেন, ‘তুমি বলছো আমি ঠিকঠাক লেগে থাকি নি ? তোমার কী ধারণা, এই স্কুলের প্রতি আমার মায়া মহব্বত কম ? আমি চাই না এই স্কুল এমপিওভুক্ত হোক ?’

রফিকুল সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘না না। আমি তা বলি নি স্যার। আমি বলেছি যে অনেক উপায় আছে, যেটা অনুসরণ করা গেলে হয়তো কিছু একটা হয়েই যেত।’

আজিজ মাস্টার রাগান্বিত স্বরেই বললেন, ‘কী উপায় শুনি ?’

রফিকুল অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই বলার সাহস পেল না। একটু সময় নিয়ে পুরো বিষয়টা গুছিয়ে নিল সে। তারপর বলল, ‘যদি একটা কাজ করা যায় স্যার, তাহলে একটা উপায় হয়েও যেতে পারে।’

‘কী কাজ ?’

‘ধরেন স্যার আমরা স্কুলের সব ছেলেমেয়ে নিয়ে গিয়ে ছাত্র-শিক্ষক সবাই একটা অনশনে বসলাম। ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। সেখানে সাংবাদিক, টিভি ক্যামেরা সব সময়ই থাকে। এটা নিয়ে স্যার তখন একটা শোরগোল পড়ে যাবে। ছোট ছোট বাচ্চারা অনশনে বসলে বিষয়টা সবার দৃষ্টিগোচর হবে। আলোচনায় চলে আসবে। তখন দেখবেন একটা না একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে।’

‘তো দেশে যত স্কুল আছে এমপিওভুক্ত হয় নি, সব স্কুলের ছাত্র শিক্ষকেরা এমন করলে তাদের স্কুলের সমস্যারও সমাধান হয়ে যাবে ?’

আজিজ মাস্টারের এই কথায় রফিকুল গুটিয়ে গেল। আজিজ মাস্টার বললেন, ‘বিষয়টা যদি এতই সহজ হতো তাহলে এই যে এত এত প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক এত এত দিন ধরে এত এত আন্দোলন করত না।’

রফিকুল আরও কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু আজিজ মাস্টারের মেজাজ দেখে সে আর কিছু বলল না। আজিজ মাস্টারও তার নানান যুক্তি বিবেচনায় তখন বিষয়টাতে তেমন গুরুত্ব দেন নি। রফিকুলের বুদ্ধিও তাঁর পছন্দ হয় নি। ছেলেমানুষী মনে হয়েছে। তা ছাড়া, তিনি নিজে তো জানেন, অনশনটা স্রেফ হুমকি, লোকদেখানো। না খেয়ে তো আর সত্যি সত্যিই কেউ মরে যায় না। তিনিও যাবেন না। মাঝখান থেকে অনশনের অভিনয় করে কিছু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করবেন কেবল। কিন্তু স্কুল নিয়ে এটা করতে তার মন ভেতর থেকে সায় দিচ্ছিল না। তা ছাড়া শেষ পর্যন্ত যদি তার এই অনশন নিয়ে কেউ কোনো আগ্রহ না দেখায়, তখন ? তখন কী হবে ?

তখন তো বিষয়টি রীতিমতো হাস্যকর হয়ে যাবে। প্রথমত, এই এলাকা থেকে এত ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকায় যাওয়া তার পক্ষে নানা কারণেই সম্ভব না। নুরুল চেয়ারম্যান এই ঘটনা শুনলেই কোনো একটা ফন্দি আঁটবেন নিশ্চিত। তিনি এমন কিছুও করে ফেলতে পারেন, যাতে আজিজ মাস্টার বড় কোনো বিপদে পড়ে যান। তা ছাড়া গ্রামের বাবা-মায়েরাও এতে রাজি হবেন না। দ্বিতীয়ত, দেখা গেল তিনি একা একাই অনশন করতে চলে গেলেন। অনশনে বসেও গেলেন। কিন্তু তারপর যদি কেউ সেটাকে কোনো গুরুত্বই না দেয়! তার দাবি যদি আদায় না হয়, তখন তো আর তিনি সত্যি সত্যিই না খেয়ে মারা যাবেন না! তখন কী করবেন তিনি ? নিজে নিজে বেহায়ার মতো অনশন ভেঙে বাড়ি চলে আসবেন ?

এরপর বহু সময় চলে গেছে। বিষয়টা একভাবে ভুলেই গিয়েছিল রফিকুল। এ নিয়ে আজিজ মাস্টারের সামনে কোনো কথা বলার আর সাহস হয় নি তার। কিন্তু দিন দুই আগে রফিকুলকে ডেকে আজিজ মাস্টার নিজেই বললেন, ‘মাস্টার সাব, আমি ঢাকা যাব।’

‘হঠাৎ ঢাকা কেন যাবেন স্যার ?’

‘তুমি না বলছিলা, প্রেসক্লাবের সামনে গিয়ে অনশন করতে!’

রফিকুল অবাক গলায় বলল, ‘সে তো বহু আগে স্যার! কিন্তু তখন তো আইডিয়া আপনার পছন্দ হয় নাই!’

‘তখন হয় নাই বলে যে আর কখনো হতে পারবে না, এমন তো কোনো কথা নাই। আছে ?’ আজিজ মাস্টার বিরক্ত গলায় বললেন।

‘জি-না।’

‘তাহলে তর্ক বন্ধ করে, কীভাবে কী করব, সেই বিষয়ে ধারণা দাও।’

রফিকুল খানিক ধারণা দিলেও পুরো বিষয়টি নিয়েই সে এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ ভুগতে লাগল। ফলে সে চাইছিল, সে নিজেও আজিজ মাস্টারের সঙ্গে ঢাকায় আসতে। কিন্তু আজিজ মাস্টার তাতে রাজি হলেন না। মাস কয়েক আগে এলাকায় এক অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার পর থেকেই চারদিকে একটা থমথমে অবস্থা। এই সময়ে বাড়িতে একটা পুরুষমানুষ থাকা দরকার। তাঁর স্ত্রী রিজিয়া বেগমও অবশ্য আজিজ মাস্টারকে একা ছাড়তে চান নি। কিন্তু আজিজ মাস্টার কারও কথাই শোনেন নি। তিনি গ্রামের কাউকে কিছু না বুঝতে দিয়ে গতকাল ভোরেই চুপিচুপি ঢাকা চলে এসেছেন। কিন্তু এখানে এসে এখন মনে হচ্ছে, এভাবে ঝোঁকের মাথায় একা একা চলে আসা তাঁর ঠিক হয় নি। কোনোকিছুরই আগামাথা তিনি বুঝতে পারছেন না। সঙ্গে জানাশোনা কেউ থাকলে আসলেই ভালো হতো।

ঝোঁকের মাথায় একা একা ঢাকায় এসেছেন তিনি। এখন এখানে এই ফুটপাতে বসে আছেন। কিন্তু কী করবেন না করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। কাঁধে ঝোলাওয়ালা কবি কবি চেহারার ছেলেটা তাঁর পাশে বসে আছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে ছেলেটাকে বিশ্বাস করা যায়। আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে ছেলেটা ধুরন্ধর প্রকৃতির। একে বিশ্বাস করা আর নিজের পায়ে নিজের কুড়াল মারা সমান কথা। ছেলেটা আবার বলল, ‘কী ব্যাপার স্যার ? আপনি তো কিছুই বলছেন না ? এরকম ধ্যানমগ্ন হয়ে সারস পাখির মতো বসে থাকলে চলবে ? আপনার প্ল্যান-পরিকল্পনা কী সেটা বলেন ?’

আজিজ মাস্টার হঠাৎ সংবিত ফিরে পাওয়া গলায় বললেন, ‘কোনো প্ল্যান-পরিকল্পনা তো নেই।’

‘প্ল্যান-পরিকল্পনা ছাড়া কেউ অনশন করতে বসে ?’

‘তা তো জানি না। এর আগে তো কখনো অনশন করি নাই আমি।’

‘এটা অবশ্য ঠিক কথা। তবে স্যার, আপনি সত্যি করে একটা কথা বলবেন ?’

‘কী কথা বলব ?’

‘আপনার আসল উদ্দেশ্য কী ?’

‘আসল উদ্দেশ্য কী মানে ?’

‘না মানে, অনশন করার নাটকটা কেন করছেন ?’

‘নাটক করছি ?’ আজিজ মাস্টার রীতিমতো অপমানিত বোধ করলেন।

‘নয়তো কী ? স্কুল এমপিওভুক্তির দাবিতে এভাবে একা একা কেউ কোনোদিন অনশন করেছে ? আর করলেও এভাবে কি দাবি আদায় হয় ?’

‘হয় না ?’

‘ধরেন হলো। তো এভাবে যদি দাবি আদায় হতে থাকে, তাহলে তো যে-কেউ যখন-তখন, যে-কোনো দাবিতে এভাবে রাস্তাঘাটে বসে অনশন করা শুরু করে দিবে। তখন ? দেখা গেল কেউ একজন একটা স্কুল খুলেই এসে অনশন করা শুরু করা দিল—তার স্কুল এমপিওভুক্ত করতে হবে। তখন কি সরকারের পক্ষ থেকে সেই দাবি পূরণ সম্ভব হবে ? অনশন করে সব শিক্ষকেরা মরে গেলেও তো সম্ভব হবে না।’

আজিজ মাস্টার খানিক চুপ করে রইলেন। এই কথা তিনি নিজেও ভালোভাবে জানেন। কিন্তু তার আসল উদ্দেশ্যটা তিনি কাউকে খুলে বলতে পারছেন না। সেটা এখনই সম্ভব নয়। আগে বুঝতে হবে ছেলেটা কেমন। যদি ভালো মনে হয়, তাহলে তিনি তার আসল উদ্দেশ্যটা ছেলেটাকে খুলে বলবেন। আজিজ মাস্টার বিড়বিড় করে বললেন, ‘তা হবে না। কিন্তু আমার দাবির পক্ষে তো যুক্তি আছে।’

‘সবার দাবির পক্ষেই যুক্তি থাকে স্যার। যে লোক চুরি করে, তারও তার চুরির পক্ষে যুক্তি থাকে। যে লোক খুন করে, তারও তার খুনের পক্ষে যুক্তি থাকে। কিন্তু যুক্তি থাকা মানেই সেটা সঠিক বা গ্রহণযোগ্য না।’

কথাটা খুব পছন্দ হলো আজিজ মাস্টারের। ছেলেটার ভাবভঙ্গি, পোশাক-আশাক দেখে মনে মনে যতটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য তিনি করেছিলেন, এখন তা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। আজিজ মাস্টার বললেন, ‘আমার স্কুল এমপিওভুক্ত না হওয়ার পেছনে অন্য কারণও আছে। গুরুতর কারণ। সেটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। রাজনৈতিক। একবার তো সবকিছু একদম ফাইনাল হয়েই গিয়েছিল, কিন্তু এই কারণেই শেষ মুহূর্তে হলো না।’

‘হবে কীভাবে বলেন ? আপনার নিজের ইচ্ছাই তো শক্ত না।’

‘ইচ্ছা শক্ত না মানে ?’ আজিজ মাস্টার খুবই অবাক হলেন।

‘মানে যেই দাবির কথা মানুষ চক দিয়ে ব্যাকবোর্ডে লেখে, সেই দাবি তো পূরণ হওয়ার কথা না।’

আজিজ মাস্টার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে তাকালেন। দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থেকেও তিনি সমস্যাটা ধরতে পারলেন না। কোথাও কি কোনো ভুল হয়েছে ? বানান বা বাক্যে ?

ছেলেটা বলল, ‘ব্যাকবোর্ডে মানুষ কী লেখে জানেন ?’

‘কী ?’

‘যা মুছে ফেলতে হবে তা। মানে এরপর সেখানে অন্য কিছুও লিখতে হবে। এখন বলেন, আপনার আসল উদ্দেশ্য কী ?’

আজিজ মাস্টার সঙ্গে সঙ্গেই কথা বললেন না। তবে ছেলেটার চোখের দিকে তিনি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। এতক্ষণে তিনি লক্ষ করলেন ছেলেটার চোখজোড়া ঝকঝকে। বুদ্ধিদীপ্ত। তিনি উল্টো প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার নাম কী ?’

‘আসাদ।’

‘কী করেন ?’

‘কবিতা লিখি।’

‘তার মানে কবি ?’

‘বলতেও পারেন। আবার নাও বলতে পারেন।’

‘মানে ?’

‘মানে লোকে অকবিও বলে।’

‘অকবি আবার কী জিনিস ?’

‘যে কবিতা লেখার চেষ্টা করে, কিন্তু হয় না বা লিখতে পারে না, সে হলো অকবি।’

‘আপনার কবিতা হয় না ?’

‘মাঝে মাঝে মনে হয়—হয়। আবার মাঝে মাঝে মনে হয়—হয় না।’

‘তাহলে তো আপনার মাঝে মাঝে কবি, আর মাঝে মাঝে অকবি হওয়ার কথা ছিল।’

‘আমারও তাই-ই মনে হয়। কিন্তু আমার সমসাময়িক আর সব কবির ধারণা আমার কবিতা কিছুই হয় না। সব গার্বেজ।’

‘তাদের সম্পর্কে আপনার কী ধারণা ?’

‘তাদের সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।’

‘কেন ?’

‘কারণ তাদের লেখা আমি পড়ি না।’

‘পড়েন না কেন ?’

‘পড়ার যোগ্য মনে করি না।’

‘কেন যোগ্য মনে করেন না ? না পড়লে যোগ্য-অযোগ্য বুঝবেন কী করে ? আগে তো পড়তে হবে। তারপর না ভাবতে পারবেন।’

‘তাদের নিয়ে আমি ভাবতেও চাই না। ভাবিও না।’

‘ভাবেন না কেন ?’

‘সময় নষ্ট। কারণ এরা লেখার চেয়ে সারাক্ষণ অন্য কবি-লেখকদের সমালোচনা করা, খিস্তি-খেউড় নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে।’

‘কিন্তু আপনি না ভাবলে লিখবেন কী করে ?’

‘তাদের নিয়ে ভাবি না মানে যে আমি কিছু নিয়েই ভাবি না, তা তো নয়!’

‘আচ্ছা, তাহলে আপনি কাদের নিয়ে ভাবেন ?’

‘আমি ভাবি নিজেকে নিয়ে। নিজেকে ঠিকভাবে চিনতে পারলেই সবাইকে চেনা যায়। লালন সাঁইয়ের গান আছে না—একবার আপনারে চিনতে পারলে রে যাবে অচেনারে চেনা।’

‘এখন কী লিখছেন ?’

‘এখন কিছুই লিখছি না।’

‘কেন ?’

‘লিখতে পারছি না।’

‘লিখতে পারছেন না কেন।’

‘তা তো জানি না। তবে অনেক দিন ধরে অনেক চেষ্টা করেও কিছু লিখতে পারছি না। কবিতা আসছে না।’

আজিজ মাস্টারের হঠাৎ মনে হলো তিনি অযথা কথাবার্তা বলছেন। এসব কথাবার্তার সঙ্গে তাঁর অনশনের কোনো সম্পর্ক নেই। শিক্ষকদের এই এক সমস্যা, তারা কারণে অকারণে শুধু কথা বলতে চায়। কোথায় তাঁর এখন নিজের কাজের কথা বলা উচিত, তা না করে তিনি এসব কী হাবিজাবি নিয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করছেন! আজিজ মাস্টার এবার কাজের কথায় এলেন, ‘আমার কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন ?’

‘ঝেড়ে কাশা উচিত।’

‘ঝেড়ে কাশা উচিত মানে ?’

‘ঝেড়ে কাশা উচিত মানে, আসল ঘটনা কী সেটা খুলে বলা উচিত।’

‘আপনার ধারণা আমি এই অনশন নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করছি ? মিথ্যে কথা বলছি ?’

‘উঁহু, তা মনে হচ্ছে না।’

‘তাহলে কী মনে হচ্ছে ?’

‘মনে হচ্ছে, আপনার অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু সেই উদ্দেশ্যের কথা আপনি প্রথমেই কাউকে বলতে চাইছেন না।’

এবার আজিজ মাস্টার সত্যি সত্যি বিরক্ত হলেন। তিনি বললেন, ‘আপনার কেন এমন মনে হচ্ছে ?’

‘শোনেন স্যার, আমার প্রধান শখ মানুষ দেখা। রাতদিন আমি এই মানুষ দেখার জন্য ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াই। আমার ধারণা ছিল, এইভাবে মানুষ দেখলে আমি কবিতা লিখতে পারব। অনেক দিন পেরেছিও। কিন্তু হঠাৎ বেশ কিছুদিন হলো কিছুই লিখতে পারছি না। বুঝতে পারছি না, আমার কি তাহলে মানুষ দেখা শেষ হয়ে গেল নাকি ?’

‘মানুষ দেখা আবার শেষ হয় ?’

‘সেটাই কথা। সমস্যাটা কী বুঝতে পারছি না।’

‘অন্য সব দেখা, সব পড়া একদিন শেষ হয়ে যেতে পারে; কিন্তু মানুষ দেখা বা পড়া কখনো শেষ হবে না। কারণ মানুষ হলো অফুরন্ত গল্পের উৎস।’

‘বাহ, দারুণ বলেছেন স্যার। তবে একটা কথা কী জানেন ? কবিতা লিখতে না পারলেও, এই দিনের পর দিন রাস্তাঘাটে ঘুরে ঘুরে মানুষ দেখতে দেখতে একটা লাভ আমার হয়েছে।’

‘কী লাভ ?’

‘আমি এখন অল্পবিস্তর মানুষ চিনতে পারি। কিছুক্ষণ কারও দিকে তাকিয়ে থাকলেই তার হাবভাবে তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটা ধারণা হয়ে যায়। আমি দীর্ঘ সময় রাস্তার ওই পাশে বসে বসে আপনাকে দেখছিলাম। দেখে আপনার সম্পর্কে খুব কৌতূহল তৈরি হলো। এইজন্যই আসা। আপনি আবার স্যার ভাববেন না যে আমার বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য আছে। আসলে আপনাকে আমার যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং মানুষ মনে হয়েছে। মনে হয়েছে আপাতদৃষ্টিতে দেখতে সাদাসিধে হলেও, আপনি মানুষটা সাদাসিধে না।’

‘আমি তাহলে কেমন মানুষ ?’

‘আমার ধারণা আপনি খুব জেদি একজন মানুষ। আর এই জেদ আপনাকে সাদাসিধে মানুষ থেকে মুহূর্তেই ভয়ংকর মানুষ বানিয়ে ফেলতে পারে।’

আজিজ মাস্টার কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। তাঁর প্রায় ষাট বছরের এই জীবনে এই প্রথম কেউ তাঁকে ভয়ংকর মানুষ বলল। তিনি নিজে খুব ভালো করেই জানেন, তিনি মোটেই ভয়ংকর কোনো মানুষ নন। বরং খুবই সাদাসিধে, নিরীহ গোছের গোবেচারা, নির্ঝঞ্জাট ধরনের মানুষ তিনি। কারও কোনো সাতে-পাঁচে তিনি নেই। কোনো ঝামেলা পছন্দ করেন না। কিন্তু এই ছেলের কথা শুনে তার এখন মনে হচ্ছে, যদি সত্যি সত্যিই এই সহজ সাধারণ চেহারার আড়ালে ভয়ংকর কোনো মানুষ হতে পারতেন তিনি! বিষয়টা তাহলে মন্দ হতো না। বরং ভালোই হতো। হঠাৎ হঠাৎ নানান তুঘলকি কাজকর্ম করে লোকজনকে চমকে দেওয়া যেত। আজিজ মাস্টার আবিষ্কার করলেন, নিজেকে ভয়ংকর মানুষ ভাবতে তাঁর ভালো লাগছে। বিষয়টা ভেবে মনে মনে ভারি অবাক হলেন তিনি। খানিকটা ভয়ও পেলেন।

আসাদ বলল, ‘এখন ঘটনা কী খুলে বলেন। এখানে কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারবেন না। রাতে ঘুমাবেন বা আশপাশে কোথাও বাথরুম করতে যাবেন, এসে দেখবেন আপনার বিছানা-বালিশ নেই। ব্যাগ নেই। ব্যাকবোর্ডও নেই।’

‘কেন ?’

‘কারণ এটা ঢাকা শহর। তবে সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হচ্ছে, ফুটপাতে নানান ধরনের হকারদের ব্যবসা থাকে। আনারস থেকে তরমুজ, আমড়া, জাম্বুরা, শরবত, বাদাম, ছোলা মুড়ি থেকে গেঞ্জি, কসমেটিকস পর্যন্ত এরা এই ফুটপাতে বসেই বিক্রি করে। এতেই তাদের সংসার চলে। সুতরাং এরা কিন্তু বেশিদিন আপনাকে সহ্য করবে না। তাদের ব্যবসায় আপনি ব্যাঘাত ঘটাচ্ছেন। আপনি না উঠলে আপনাকেসহই তারা হাপিশ করে দিবে।’

আজিজ মাস্টার এবার খানিক ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি বিচলিত গলায় বললেন, ‘আমার দাবি আদায় না হোক, আমি অন্তত চাই আমার কথাগুলো, দাবিদাওয়াগুলো লোকজনের কাছে পৌঁছাক। কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি পর্যন্ত যাক। কেউ একজন এসে আমার সঙ্গে কথা বলুক। আমার কথা শুনুক।’

‘আপনার এই স্কুলের কথা শুনে লোকজনের লাভ কী ?’

আজিজ মাস্টার এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। তবে আসাদের কথা সত্য, তার স্কুলের কথা শুনে আসলেই কারও কোনো লাভ নেই।

আসাদ বলল, ‘আর সাধারণ মানুষ শুনলে তো আপনারও কোনো লাভ নেই। আছে ?’

‘উঁহু।’

‘তার মানে আপনার কথা শুনতে হবে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের। প্রভাবশালী লোকজনের। এমপি মন্ত্রীদের। কিন্তু আপনার কথা শোনার সময় তাঁদের নেই। তাঁরা অনেক ব্যস্ত মানুষ। তাঁদের নানান গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম, মিটিং সিটিং, সভা সেমিনার থাকে। তাঁরা কেন আপনার এই তুচ্ছ বিষয়ে সময় নষ্ট করবে ?’

‘একটা স্কুলের অস্তিত্বের প্রশ্ন তুচ্ছ বিষয় ?’

‘অবশ্যই তুচ্ছ বিষয়।’

‘তাহলে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কী ?’

‘এই ধরেন কোনো অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতা দেওয়া। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যাওয়া। টিভি সিনেমার নায়ক নায়িকা, গায়ক গায়িকাদের গানের অনুষ্ঠানে যাওয়া। বিয়ে-বৌভাতের অনুষ্ঠানে যাওয়া। বা ধরেন আলু কিংবা মুলা চাষ বিষয়ে উচ্চতর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আহরণের জন্য পরিবার পরিজন নিয়ে রাষ্ট্রীয় খরচে বিদেশ সফর করা। এছাড়াও আছে টেলিভিশন টক শোতে বকবক করা। এমন বহু বিষয় আছে।’

‘কিন্তু আমাকে যে একজন বলেছিল, প্রেসক্লাবের সামনে যে-কোনো দাবিতে অনশন করলে সাংবাদিকেরা সংবাদ করে। তখন বিষয়টার একটা গুরুত্ব তৈরি হয়। মন্ত্রী মিনিস্টাররা পর্যন্ত তখন বিষয়টাকে গুরুত্ব দেয় ?’

আসাদ বিরক্ত গলায় বলল, ‘এতক্ষণ কী বললাম আপনাকে! এই যে তখন থেকে বকবক করছি, কী জন্য ?’

আজিজ মাস্টার কথা বললেন না। আসাদ বিরক্তি নিয়েই বলল, ‘আরে চাচা, সেজন্যও তো আপনার কিছু চেনা-পরিচিত সাংবাদিক লাগবে। কিছু লোকজন লাগবে। যারা এইসব অ্যারেঞ্জ করে দিবে। আপনার আশেপাশে বসার জন্যও দু-একজন লোক লাগবে। দাবিদাওয়া সংবলিত একটা ব্যানার হলে ভালো হতো। কিন্তু আপনি নিয়ে আসছেন ব্যাকবোর্ড। এটা কিছু হলো ? সঙ্গে একটা হ্যান্ড মাইক থাকলেও না হয় কিছু একটা করা যেত! আপনার সাথের লোকরা অন্তত কিছুক্ষণ পরপর মাইকে আপনার দাবিদাওয়া ঘোষণা দিতে পারত। সেই দাবিদাওয়া পূরণ না হলে আপনি কী করবেন সেগুলোও খানিক পরপর বলতে পারত। সবচেয়ে ভালো হতো, মাইকে যদি বলা যায়, আগামী তিন দিনের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে আপনি গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করবেন!’

‘কী বলছেন আপনি! গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যা করব মানে ?’ আজিজ মাস্টার রীতিমতো আঁতকে উঠলেন।

‘ঠিকই বলছি। এ ছাড়া কারও টনক নড়বে না, বুঝলেন ? এই দেশে সবকিছু দরকার কড়া, কঠিন। এই দেশে কড়া ছাড়া দরজার কড়াও নড়ে না। আপনি যদি একটা কাজ করতে পারেন, কেবল তাহলেই কিছুটা হলেও আপনার আলোচনায় আসার সুযোগ আছে। আপনার দাবিদাওয়া নিয়ে একটা শোরগোল ওঠার সুযোগ আছে। এছাড়া কোনো চান্স নাই।’

‘কী কাজ ?’

‘আপনার দাবি আদায় না হলে একটা হুমকি দিয়ে রাখবেন।’

‘দাবি আদায়ের জন্য হুমকি ?’

‘হুম।’

‘কী হুমকি ?’ দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বললেন আজিজ মাস্টার।

‘কোনো একটা নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার ঘোষণা দিবেন। দেখবেন, এই খবর মুহূর্তে চারদিকে ছড়িয়ে যাবে। সবখানে একটা শোরগোল লেগে যাবে।’

‘কী বলছেন আপনি ?’

‘ঠিকই বলছি। এই কাজ করলে দেখবেন লোকজন আগ্রহ নিয়ে আপনার দিকে তাকাবে। বহু লোক জড়ো হয়ে যাবে। ফেসবুক টেসবুকে আসবে। তখন পেপার-পত্রিকাও আগ্রহ দেখাবে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই স্যার।’

আজিজ মাস্টারের এবার আসাদকে পাগল মনে হতে লাগল। এর ভাবভঙ্গি, কথাবার্তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। এই খুব ভালো, গভীর কথা বলছে; আবার পরক্ষণে খুবই এলোমেলো, অসংলগ্ন, হাস্যকর কথাবার্তা বলছে। তিনি হতাশ গলায় বললেন, ‘আপনি একটা কাজ করবেন আমার জন্য ?’

‘কী কাজ ?’

‘এই যে ভিড় করে আসা লোকগুলোকে একটু সরাবেন ?’

‘কেন ?’

‘এদের দেখেই আমার মাথা ধরে যাচ্ছে।’

‘এদের দেখে মাথা ধরলে তো হবে না স্যার। বরং এরাই আপনার সত্যিকারের সম্পদ। যত ভিড়, তত বীর।’

‘মানে ?’

‘মানে যত লোক জমবে, তত আপনার প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষিত হবে। আপনার গুরুত্ব বাড়বে। বুঝলেন ?’

‘হুম বুঝলাম।’ আজিজ মাস্টার আর কথা বললেন না। তাঁর সত্যি সত্যিই মাথা ধরেছে। তবে আসাদ একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছে। এইসব জিনিসপত্র রেখে তিনি আশপাশে কোথাও বাথরুম করতেও যেতে পারবেন না। ফিরে এসে যে আর কিছুই পাওয়া যাবে না, সে বিষয়ে তিনি এখন মোটামুটি নিশ্চিত। সন্ধ্যা পর্যন্ত আজিজ মাস্টার দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলেন। ততক্ষণে ভিড় মোটামুটি কমে এসেছে। আসাদও চলে গেছে। সামনে জনা চারেক পুলিশ দেখে একফাঁকে তিনি উঠে গিয়ে বাথরুম সেরে এলেন। পুলিশের সামনে নিশ্চয়ই কেউ কিছু সরাতে সাহস করবে না। বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখলেন, কেউ কিছু সরায়ও নি। তবে সেই জনাচারেক পুলিশ খানিক দূরে দাঁড়িয়ে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করে কথা বলছে তারা। আজিজ মাস্টারের হঠাৎ কেন যেন মনে হলো, এই পুলিশগুলো তাঁকে নিয়েই কথা বলছে। তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু একমাত্র তিনিই। এ বিষয়ে আজিজ মাস্টার হঠাৎ নিশ্চিত হয়ে গেলেন। যদিও কারণটা তিনি বুঝতে পারছেন না।

নুরুল মোল্লা কি তাহলে কোনোভাবে এই ঢাকা পর্যন্ত তার প্রভাব খাটিয়ে লোকজন পাঠিয়ে দিয়েছে! এই ভয়টাই তিনি এতদিন করছিলেন। আর এ কারণেই চুপচাপ কাউকে কিছু না জানিয়ে একা একা ঢাকা চলে এসেছিলেন তিনি।

দুজন পুলিশ সদস্য হঠাৎ তার দিকে এগিয়ে এল। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে একজনের নাম তিনি পড়তে পারলেন—সাগর।

সাগর অবশ্য কোনো ভদ্রতার ধার ধরল না। সে সরাসরি বলল, ‘চাচা মিয়া, এইখানে কী করেন ?’

আজিজ মাস্টার মিনমিন করে বললেন, ‘কী করি তা তো দেখতেই পাচ্ছেন।’

‘নাহ, দেখতে পাচ্ছি না। আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।’

আজিজ মাস্টার ঘটনা খুলে বললেন। সাগর বলল, ‘এইসব বাইল চাইল ছাড়েন। অযথা ঝামেলা করবেন না। এমনিতেই নানান জ্বালা-যন্ত্রণায় আছি। আর যন্ত্রণা করবেন না। যান, বাসায় যান।’

‘ঢাকায় তো আমার বাসা নাই।’

‘বাসা না থাকলে থাকেন। ফুটপাতে ঘুমান। এতে আমাদের কোনো সমস্যা নাই। আপনি একা না, আপনার মতো আরও অসংখ্য মানুষই ফুটপাতে ঘুমায়। কিন্তু সেইটা শুধু রাতের বেলা। তখন ফুটপাত ফাঁকা থাকে। লোকজনের চলাচলতি নাই। ভিড়ভাট্টা নাই। কিন্তু চাচা মিয়া, খবরদার দিনের বেলা কিন্তু ফুটপাত আটকাই রাখবেন না।’

‘জি আচ্ছা।’

‘আর ওই সাইনবোর্ড টাইনবোর্ড যেন আর না দেখি।’

‘কিন্তু বাবা…।’

তিনি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই তার সঙ্গের গোঁফওয়ালা পুলিশটা বলল, ‘এমনিতেই নানান ঝামেলায় আছি বুড়া মিয়া। এর মধ্যে উটকো ঝামেলা কিন্তু ভালো লাগে না। এইসব আউলফাউল নাটক-মাটক বাদ দিয়া, গাট্টি-বোচকা গুছ কইরা সকালের মইধ্যে জায়গা ছাড়বেন। না হইলে কিন্তু পিটাইয়া পাছার ছাল লাল কইরা ফেলবো!’

আজিজ মাস্টার হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলেন। তিনি তার কানকে এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না। তিনি চিন্তাও করতে পারছেন না পৃথিবীতে এই ভাষায় কখনো কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারে! তিনি ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় জগতের সকল অবিশ্বাস চোখে নিয়ে পুলিশের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। পুলিশ অফিসার অবশ্য এসব থোড়াই কেয়ার করল। সে খক করে একদলা থুথু ফেলল। থুথুটা পড়ল আজিজ মাস্টারের বিছানার উপরে। আজিজ মাস্টার একবার থুথুর দিকে তাকালেন, একবার পুলিশের লোকটার দিকে। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, সত্যি সত্যিই এই ঘটনা ঘটছে। ঘন জমাট থুথুর দিকে তাকিয়ে ঘেন্নায় তাঁর প্রায় বমি পেয়ে যাচ্ছিল। তিনি কোনোমতে নিজেকে সামলালেন। ফ্যালফ্যাল করে পুলিশ দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না। তার মনে হলো তার বাক্শক্তি লোপ পেয়েছে। তিনি আর কখনোই কথা বলতে পারবেন না। সেই সারা রাত আর একফোঁটাও ঘুমাতে পারলেন না আজিজ মাস্টার। কেবল ব্যাগটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরে একটা ঘোরের মধ্যে রাত কাটিয়ে দিলেন।

পরদিন ভোরে অবশ্য পুলিশ দুজনকে আর কোথাও দেখতে পেলেন না তিনি। তবে আসাদ এল আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই। সে খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘আমার আইডিয়া কি আপনার পছন্দ হয়েছে ?’

‘কোন আইডিয়া ?’

‘গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেওয়ার ঘোষণার আইডিয়া।’

‘কী যে বলেন আসাদ সাব! আমি কি সত্যি সত্যিই মরব নাকি ?’

‘সত্যি সত্যি মরবেন না ?’

‘আমি ভীতু মানুষ। অত সাহস আমার নাই।’

‘তাইলে তো আরও বিপদ।’

‘আরও কী বিপদ ?’

‘আরও বিপদ হলো, ওইটার ঘোষণা না দিলে সত্যি সত্যিই মরবেন। আর ওইটার ঘোষণা দিলে সত্যি সত্যি মরবেন না। বরং ওইটাতে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না।’

‘কী রকম ?’

‘কী রকম ? শোনেন, আপনি আগেভাগে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার ঘোষণা দিবেন। কোথায়, কখন আগুন দিবেন এইসবও ঘোষণায় জানিয়ে দিলেন। এতে করে দেখবেন সেই জায়গায় ঠিক ঠিক টাইমে লোকজন জমে গেছে। বিরাট ভিড়ভাট্টা লেগে গেছে। তখন অত মানুষের সামনে কি আর আপনি সত্যি সত্যিই গায়ে আগুন দিয়ে পুড়ে মরতে পারবেন ?’

‘পারব না ?’

‘উঁহু, পারবেন না। সেটা সম্ভব না।’

‘কেন ?’

‘কারণ তার আগেই দেখবেন সবাই আপনাকে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। অতগুলা মানুষের সামনে একটা মানুষ গায়ে আগুন দিয়ে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে আর কেউ তাকে রক্ষা করতে আসবে না—এমন তো আর হবে না, তাই না ? কেউ না কেউ ঠিকই আপনাকে নিবৃত্ত করবে। নিরস্ত করবে। কথা বোঝা গেছে ?’

‘জি বোঝা গেছে।’

‘কিন্তু এই ঘটনায় একটা ম্যাজিক ঘটে যাবে।’

‘কী ম্যাজিক ?’

‘ধরেন ভাগ্য যদি সহায় হয়, তাহলে দেখবেন আপনার এই গায়ে আগুন ধরিয়ে জ্যান্ত পুড়ে মরার প্রতিবাদের কথা শুনে মানুষজনের কাছে আপনি হিরো হয়ে গেলেন। আর যদি সত্যি সত্যিই প্রেসক্লাবের সামনে কেরোসিন আর আগুন নিয়ে দাঁড়িয়ে যান, দেখবেন কেল্লাফতে।’

‘কেল্লাফতে কী ?’

‘কেল্লাফতে হলো দুর্গ জয় করা। কিন্তু এইখানে তার অন্য মানে। দেখবেন আপনার এই প্রতিবাদ দেখে সবাই আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে। আপনার দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করবে। এমনকি লোকজন আপনাকে কাঁধে করে মিছিল-টিছিলও করে ফেলতে পারে। আপনার একার দাবি তখন শত সহস্র মানুষের সোচ্চার দাবিতে পরিণত হয়ে যেতে পারে!’

শেষের দিকে এসে আসাদের গলা ভারী হয়ে এল। যেন কোনো বিশাল জনসমাবেশে সে বক্তৃতা করছে এমনভাবে কথা বলতে লাগল সে। আজিজ মাস্টার অবশ্য তার কথা শুনলেন কি না বোঝা গেল না। তিনি ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘একটা কাজ করবেন আসাদ সাব ?’

‘কী কাজ ?’

‘আপনি একটু বসবেন এইখানে ? আমি একটু বাথরুম টাথরুম সেরে আসতাম।’

আসাদ হাসল, ‘আমাকে বিশ্বাস করলেন তাহলে ?’

আজিজ মাস্টার উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ‘না করে আর উপায় কী ?’

তিনি বাথরুম সেরে ফিরে এসে বললেন, ‘আমার আরেকটা উপকার করতে হবে।’

‘কী উপকার ?’

‘আপনি একটু বসবেন, আমি একটু ঘুমাব। সারা রাত একফোঁটাও ঘুম হয় নি আমার। শরীর খারাপ লাগছে। দেখা গেল দাবি আদায়ের আগেই টুক করে মরে গেলাম।’

 আসাদ বলল, ‘সেটা বরং ভালো স্যার।’

‘ভালো কীভাবে ?’

‘এই দেশে বেঁচে থাকলে যাকে নিয়ে হইচই হয় না, মরে গেলে তার চেয়ে বেশি হইচই হয়। মোটামুটি লঙ্কাকান্ড ঘটে যায়। সত্যি সত্যি মরে গেলে দেখবেন আপনার দাবিদাওয়া নিয়ে একটা হইচই লেগে গেছে। এখানে বাঁচার চেয়ে মরাই উত্তম। এই নিয়ে আমি এক কবিতা লিখেছি। কবিতার নাম দিয়েছি “মরণোত্তম”। মানে মরণই উত্তম। শুনবেন সেই কবিতা ?’

‘নাহ। এখন কবিতা শোনার মতো অবস্থা আমার নাই। পরে শুনব।’

আসাদ আরও কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু আজিজ মাস্টার তার কথা কিছুই শুনতে পেলেন না। বরং তার আগেই তিনি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তিনি স্বপ্নও দেখে ফেললেন। দেখলেন তার বাবা দবির খাঁ বলছেন, ‘তুই শেষ পর্যন্ত গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করলি ?’

আজিজ মাস্টার বললেন, ‘আত্মহত্যা কেন বলছেন আব্বা ? এটা হলো প্রতিবাদ।’

‘কিসের প্রতিবাদ ?’

‘দাবি আদায় না হওয়ার প্রতিবাদ। ন্যায়বিচার না পাওয়ার প্রতিবাদ।’

‘এখন কি ন্যায়বিচার পাবি ?’

‘মনে হয় পাব।’

‘কেন মনে হলো পাবি ?’

‘আরে আপনি দেখেন নি ? যখন অনশন করতে বসলাম ফুটপাতে, কেউ ফিরেও তাকাল না। কোনো গুরুত্বই দিল না। বরং পুলিশ এসে পিটিয়ে উঠিয়ে দিল। পত্রিকার সাংবাদিক তো দূরের কথা, একটা পথচারীও এক মিনিটের জন্য আমার দাবিদাওয়া সম্পর্কে জানতে চাইল না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেন তামাশা দেখছিল। আমি এই বয়সের বুড়ো একটা মানুষ, কিসের দাবিতে অনশন করছি, কী দাবিদাওয়া, কেউ কিচ্ছু জানতে পর্যন্ত চাইল না! কিন্তু যেই গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে জ্যান্ত পুড়ে মারা গেলাম, অমনি দেখেন আমার লাশ কাঁধে নিয়ে মিছিল পর্যন্ত হয়ে গেল।’

দবির খাঁ ধমকের গলায় বললেন, ‘আহাম্মক জানি কোথাকার! তুই আর মানুষ হলি না, অন্যের জন্য আজকাল কেউ আর নিজের জীবন দেয় ? যার যার তার তার। তোর এত অন্যের জন্য দরদ কিসের ?’

আজিজ মাস্টার কাচুমাচু গলায় বললেন, ‘অন্যের জন্য কী ? এই স্কুল কি অন্যের ?’

দবির খাঁ এবার আরও জোরে ধমক দিলেন, ‘আমি তোর বাপ, না তুই আমার বাপ ? তুই এইখানে কেন আসছিস আমি জানি না বুঝেছিস ? তোর স্কুল তো একটা ছুঁতা, তুই আসছিস অন্য কারণে। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো তোর স্বভাব। এইজন্যই এই জীবনে তোর কিছু হলো না। আরেকজনের জন্য তোর এত দরদ কিসের, হ্যাঁ ? আগে নিজেরটা ভাব। এই যে এখন গায়ে আগুন দিয়ে মারা গেলি, এখন তোর পরিবারের কী হবে ? তাদের কে দেখবে ? নিজের ভালোমন্দ আগে ভাবতে শেখ রে গর্দভ।’

আজিজ মাস্টার মিনমিন করে বললেন, ‘যার যার তার তার ভাবি বলেই তো আমরা এখন আর কেউ কারও না আব্বা। কারও বিপদে আপদে পাশে গিয়ে দাঁড়াই না। অন্য কারও উপরে ঘটা কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করি না। ভাবি, আমি নিজে তো নিরাপদ আছি। আমার ঘর, আমার সন্তান, আমার পরিবার নিরাপদ আছে। আমি কেন অন্যের বিরুদ্ধে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে যাব ? কিন্তু বাবা, এতে করে অন্যায়কারী আরও সাহস পায়। একসময় সে আমার ঘরে, আমার পরিবারেও ঢুকে পড়ে। তখন আমার মতোই অন্যরাও চুপ করে থাকে। আমার জন্য প্রতিবাদ করতেও আর কেউ আসে না।’

দবির খাঁ হাসলেন, ‘তুই তো দেখি ছাত্র পড়াতে পড়াতে বাপের কাছেও মাস্টারি শুরু করেছিস। এইসব লেকচার ছাড়। বাপের চেয়ে বেশি বুঝলে সমস্যা। এইটা খুব খারাপ অভ্যাস। খুব খারাপ।’

আজিজ মাস্টার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই তার ঘুম ভেঙে গেল। তিনি পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালেন। বিশাল রেইনট্রি গাছটার মাথার উপরে উঠে গেছে সূর্য। তার পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে আসাদও। তিনি আসাদকে ডাকতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন তাঁর পিঠের কাছটায় তীব্র একটা ব্যথা। দীর্ঘ সময়ের গভীর ঘুমের কারণে তিনি এতক্ষণ বুঝতে পারেন নি। তাঁর সামনে কয়েকজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। রাতের সেই পুলিশ অফিসার সাগরও তাদের মধ্যে আছে। তার হাতে লাঠি। প্রথমবারের আঘাতটা ঘুমের কারণে তেমন টের না পেলেও দ্বিতীয়বারের আঘাতটা টের পেলেন আজিজ মাস্টার। সাগর তার কাঁধ বরাবর আঘাতটা করল।

আজিজ মাস্টারের মনে হলো তাঁর কাঁধ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। একজন বৃদ্ধ স্কুলশিক্ষককে এভাবে কেউ কখনো আঘাত করতে পারে, তা তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেন নি। রাজ্যের বিস্ময়, হতাশা, অপমান নিয়ে তিনি অসহায়ের মতন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। তবে অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, তাঁর কাঁধের ব্যথাটা আর তিনি টের পাচ্ছেন না। বুকের ভেতর কেবল কেমন একটা চিনচিনে তীব্র ব্যথা জেগে উঠছে। সেই ব্যথা ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে পড়ছে তাঁর সারা শরীরজুড়ে। বুকের বাঁ পাশটা যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। যেন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার।

পুলিশ অফিসার এবার বিশ্রী ভাষায় গাল বকল তাঁকে। তারপর কুৎসিত ভঙ্গিতে বলল, ‘অনশন মারাও না ? অনশন ? এরপর কী করবা ? মিছিল, মিটিং, হরতাল ? অ্যাঁ ? ঘটনা কী, ঘটনা খুইলা ক…।’

আবারও অশ্রাব্য ভাষায় গাল বকল পুলিশ অফিসার। আজিজ মাস্টার সবই শুনছেন, কিন্তু কিছুই বলতে পারছেন না তিনি। তার কেবল মনে হচ্ছে এসব কিছুই বাস্তবে ঘটছে না। তাঁর অসুস্থ, ক্লান্ত মনের কল্পনা সবই। পুলিশ অফিসার আবার খেঁকিয়ে উঠল, ‘আসল উদ্দেশ্য কী তোর, বল ? বল, বল। আসল ঘটনা বল।’

আজিজ মাস্টার বলার চেষ্টা করলেন—ঘটনা কিছুই না। কিন্তু তাঁর গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। পুলিশ অফিসারই আবার বলল, ‘তোর বিষয়ে আমাদের কাছে খবর আছে।’

‘খবর ? কী খবর ?’ আজিজ মাস্টার অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

‘তুই বিরোধীদলের লোক। তুই একটা বড় এজেন্ডা নিয়ে এইখানে আসছোস। তোর সেই এজেন্ডা কী বল ?’

কী বলবেন আজিজ মাস্টার ? তিনি হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলেন। অন্য পুলিশটা বলল, ‘বিরোধীদল এই এলাকায় নাশকতার চেষ্টা করবে, তাই না ? তুই তাদের পক্ষ হয়ে আগাম খোঁজখবর নিতে আসছিস, তাই তো ? নাকি তোর আলাদা কোনো উদ্দেশ্য আছে ? কী উদ্দেশ্য তোর ক ? এক্ষণ ক। নো হাংকি পাংকি।’

আজিজ মাস্টার পুলিশের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছেন না। তিনি একইভাবে তাকিয়ে আছেন। অন্য পুলিশ সদস্যটি জোরে লাথি বসাল তার পাশেই শুয়ে থাকা আসাদের কোমরে। আসাদ ধড়ফড় করে উঠে বসল। সে কিছু বলার আগেই পুলিশটি বলল, ‘কাইল দেখলাম একজন, আজই দুইজন ? এরপর কয়জন ? তিন, চাইর, পাঁচ ? তারপর দলবল নিয়া আসবি ? ঘটনা কী ? ঘটনা বল ? উদ্দেশ্য কী তোদের ? কোন দল করস ? নাকি আবার জঙ্গি ফঙ্গি ? এইসব ভং ধইরা শেষে আসল ঘটনা ঘটাইবি ?’

ঘটনা বেশিদূর গড়ানোর আগেই আসাদ সামলে নিল। পুলিশের হাতে পায়ে ধরে, চা-নাস্তার জন্য পকেটে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে কোনোমতে আজিজ মাস্টারকে নিয়ে ভাগল সে। কিন্তু আজিজ মাস্টার বিষয়টা নিতে পারলেন না। এই অপমান তিনি তাঁর বাকি জীবনে আর কখনো ভুলতে পারবেন বলে মনে হয় না। মানসিকভাবে বড় ধরনের আঘাতে তাঁর চিন্তা-ভাবনা সব এলোমেলো হয়ে গেছে। এত বড় আঘাত তিনি আর কখনো পেয়েছেন বলে মনে হয় না।

আসাদ থাকে খুপরি মতন এক ঘরে। পুরোনো এক বাড়ির ছাদে চিলেকোঠার মতো এক ঘর, সেই ঘরে থাকে সে। আজিজ মাস্টারকে এনে সেখানেই ওঠাল সে। কিন্তু রাত থেকেই আজিজ মাস্টারের ভয়াবহ জ্বর শুরু হলো। সেই জ্বরে কিংবা দুপুরের ঘটনার প্রভাবে, যে কারণেই হোক, এলোমেলো প্রলাপ বকতে থাকলেন আজিজ মাস্টার। ঘুমের মধ্যেই ছটফট করতে থাকলেন সারা রাত। আসাদও ঘুমাতে পারল না। রাত জেগে সে আজিজ মাস্টারের মাথায় পানি ঢালল। জলপট্টি দিল। আরও নানান সেবা শুশ্রুষা করল। শেষরাতে কাছের মসজিদ থেকে ফজরের আজানের শব্দ শোনা গেল। খানিক তন্দ্রার মতো লেগে এসেছিল আসাদের। আজানের শব্দে আচমকা তন্দ্রা ভেঙে জেগে উঠল সে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে ঘুমের ঘোরে বলা আজিজ মাস্টারের এলোমেলো কথাগুলো কানে এল তার। যদিও সেই কথাগুলোর বেশির ভাগই অস্পষ্ট। জড়ানো গলায় হড়বড় করে একের পর এক কীসব বলে যেতে লাগলেন আজিজ মাস্টার। তার একটাও বুঝতে পারল না আসাদ। একটা শব্দ থেকে আরেকটা শব্দ আলাদা করতে পারল না সে। তবে আজিজ মাস্টারের বলা কথা থেকে একটা কথা সে স্পষ্টই বুঝতে পারল। তিনি বারবার একটি নামই উচ্চারণ করছেন। সেই নামটা তার মাথায় গেঁথে গেল। আজিজ মাস্টার পাগলের মতো বারবার বলতে লাগলেন, ‘কোহিনুর, ও কোহিনুর। কোহিনুর রে। ও কোহিনুর। মা রে…।’

আজিজ মাস্টার একনাগাড়ে কোহিনুর কোহিনুর বলে চিৎকার করছেন। আর ঘুমের মধ্যেই কাঁদতে থাকলেন তিনি। সেই কান্না স্বাভাবিক কোনো মানুষের কান্না না। সে বোবা এক প্রাণীর জান্তব চিৎকার। সেই রাতেই ভোরের আলো ফোটার আগে আগে আসাদ হঠাৎ আবিষ্কার করল, তার সন্দেহই ঠিক। আজিজ মাস্টার আসলে দবির খাঁ মেমোরিয়াল হাই স্কুলের এমপিওভুক্তির দাবি নিয়ে ঢাকায় আসেন নি। তিনি এসেছেন অন্য দাবি নিয়ে। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সেই দাবির কথা তিনি বলতে ভয় পাচ্ছেন। তবে ভেতরে ভেতরে বিষয়টা তাঁকে ক্রমাগত প্রচন্ড আহত করে চলেছে। তীব্র যন্ত্রণা দিচ্ছে। বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে না পেরে অব্যক্ত যন্ত্রণায় তিনি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন