প্রথম অধ্যায় : উমাইয়া রাজবংশের বৈশিষ্ট্য

সৈয়দ মাহমুদুল হাসান

প্রথম অধ্যায় – উমাইয়া রাজবংশের বৈশিষ্ট্য

৬৬১ খ্রিস্টাব্দে মুয়াবিয়া সিরিয়ায় যে উমাইয়া বংশ প্রতিষ্ঠা করেন তা ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। আমীর আলী বলেন, “উমাইয়া বংশের ক্ষমতা লাভের ফলে কেবল শাসক বংশেরই পরিবর্তন হয় নি, বরং শাসননীতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটে এবং এটি সাম্রাজ্যের ভাগ্য ও জাতির ক্রমবিকাশের উপর প্রভূত প্রভাব বিস্তার করবার মত অনেক নতুন উপাদানের জন্ম দেয়।”

রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা : উমাইয়া খিলাফতের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, এটি প্রজাতন্ত্র ও গণতন্ত্রের পরিবর্তে মুসলিম বিশ্বে সর্বপ্রথম একটি বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র (Hereditary monarchy) প্রবর্তন করে। রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মুয়াবিয়া গণতন্ত্রের অনুশাসনগুলোর কণ্ঠরোধ করেন। মহানবী এবং খোলাফায়ে রাশেদূনের সময়ে ঐশীতন্ত্র (Theocracy) ও প্রজাতন্ত্র ছিল। তাঁরা ইসলামের মৌলিক আদর্শ, নীতি ও অনুশাসনগুলো বজায় রেখে শাশ্বত (অবিনশ্বর- ধর্মের প্রতি মুসলমানদের অনুরাগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। উমাইয়া খিলাফতে মুসলমানগণ বিভিন্ন অমুসলিম রাজ্য ও ধর্মীয় ভাবধারার সংস্পর্শে এসে নিজেদের ধর্মীয় চেতনা ও স্বাতন্ত্র্যবোধ হারিয়ে ফেলে।

উমাইয়া রাজবংশ প্রতিষ্ঠার ফলে মজলিস-উস-শূরা কর্তৃক খলিফা নির্বাচনের পদ্ধতি বিলুপ্ত হয়। খলিফা নির্বাচনে মজলিস-উস-শূরার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল; কারণ, এটি ছিল একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অন্তরায়। সর্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত না হলেও গণতান্ত্রিক আদর্শে পুষ্ট মজলিসের একটি নির্বাচকমণ্ডলী দ্বারা খলিফা নির্বাচিত হত এবং রাষ্ট্রের কার্যকলাপ শূরার পরামর্শক্রমে সম্পন্ন করা হত। কিন্তু মুয়াবিয়া খলিফা হয়ে মজলিস-উস-শূরার বিলোপ সাধন করেন। খলিফা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন; রাজ্য পরিচালনায় জনসাধারণের অংশগ্রহণ অথবা সমালোচনা করবার অধিকার রহিত হয়।

হিট্টি বলেন, “দ্বিতীয় খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা উমাইয়া বংশের পার্থিব সদস্য মুয়াবিয়া তাঁর পুত্র ইয়াজিদকে মনোনীত করে একটি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেন। বংশানুক্রমিক নীতি খলিফার উত্তরাধিকারী নিয়োগে প্রচলিত হল এবং এটি পরবর্তীকালে কখনও বর্জন করা হয় নি।” ইসলামের ইতিহাসে উমাইয়া খিলাফত সৰ্বপ্ৰথম রাজবংশ। বংশানুক্রমিক রাজবংশ সম্পর্কে মূইর বলেন, “মুয়াবিয়ার দামেস্কের সিংহাসনে উপবেশন খিলাফতের সমাপ্তি এবং রাজতন্ত্রের সুচনা করে।”

বায়তুল মাল : খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে বায়তুল মাল বা কোষাগার সম্পূর্ণরূপে জনগণের সম্পত্তি ছিল; এটি খলিফাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। এটি হতে জনসাধারণকে ভাতা প্রদান করা হত, রাষ্ট্রীয় ও সামরিক খাতে রাষ্ট্রের পর উদ্বৃত্ত অর্থ জনহিতকর কাজে ব্যয় করা হত এবং মজলিস-উস-শূরা কর্তৃক নির্বাচিত মাসোহারা খলিফা তা হতে পেতেন। উমাইয়া বংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজতন্ত্রপন্থী মুয়াবিয়া সর্বপ্রথম বায়তুল মালকে পারিবারিক সম্পত্তিতে রূপান্তরিত করেন। ওমর ইবন-আবদুল আজীজ ব্যতীত অপর উমাইয়া খলিফাগণ একে ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করে নিজেদের বিলাস- বাসনে এর সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করতেন।

ধর্মীয় মর্যাদা লোপ : রাজতন্ত্র উদ্ভবের পূর্বে হযরত মুহাম্মদ (স) ও তাঁর প্রথম চারজন খলিফা ধর্মীয় ও পার্থিব ক্ষমতার (Religious and Secular powers) অধিকারী ছিলেন। হযরত ওমর (রা) সর্বপ্রথম খলিফা ছাড়া ‘আমির-উল-মুমেনীন’ উপাধি ধারণ করেন। এর ফলে ইসলামের ধর্মীয় ও পার্থিব ক্ষমতা তাঁর মধ্যে সন্নিবেশিত হয়। কিন্তু উমাইয়া বংশ প্রতিষ্ঠার পর দ্বিতীয় ওমর ব্যতীত সকল খলিফাই পার্থিব ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন মাত্র। অধর্মাচরনের ফলে তাঁদের উপর জনগণের আস্থা লোপ পায়।

উমাইয়া বংশ প্রতিষ্ঠার ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে মদিনার প্রাধান্য বিলুপ্ত হয়ে দামেস্ক নব প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় রাজধানীতে পরিণত হয়। আরনল্ডের মতে, “মদিনায় ইসলামের ধর্ম, আইন এবং রাজনীতি সংক্রান্ত বিধি-ব্যবস্থা প্রচলিত হয় কিন্তু আরবের বাইরে ইসলাম বিস্তৃত হলে এ সমস্ত বিধি-ব্যবস্থার ব্যবহারিক প্রয়োগ শুরু হয়।” জোসেফ হেল বলেন, “এর পর থেকে মদিনা ইসলামের জ্ঞান, সাধনা এবং আধ্যাত্মিক জ্যোতি কেন্দ্রের মর্যাদা হারালে এবং মদীনার সূর্য অস্তমিত হলে রাসূলের প্রকৃত ইসলামও অস্তমিত হলো।”

খোলাফায়ে রাশেদূনকে ‘Patriarchal’ যুগ বলা হয়ে থাকে; কারণ, খলিফাগণ সর্বপ্রকার বিলাস-বাসন ত্যাগ করে সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। আরনল্ডের ভাষায়, “রাসূলের মৌলিক ঐতিহ্যে প্রভাবিত মক্কা ও মদিনার ধার্মিক গোষ্ঠী অনুভব করেন যে, মহানবী ও তাঁর সাহাবীদের ধর্মপ্রবণতা ও অকৃত্রিম সরলতার সংরক্ষণের পরিবর্তে মুয়াবিয়া খিলাফতকে আড়ম্বর ও ভোগ-বিলাস দ্বারা চিহ্নিত একটি পার্থিব সার্বভৌম রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেন।” একই কথার প্রতিধ্বনি করেন ভনক্রেমার, “খলিফাদের দরবারে বিলাসিতা অবাধ গতিতে চলত-এটি প্রথম খলিফাদের সারল্যের পরিপন্থী ছিল।” প্রথম খলিফাগণ জনগণের দুর্দশা লাগবের জন্য রাত্রে ছদ্মবেশে শহর পরিভ্রমণ করতেন। অপরদিকে উমাইয়া রাজন্যবর্গ বিরাট অট্টালিকার আমোদ-প্রমোদ করে রাত্রি অতিবাহিত করতেন। মুয়াবিয়া সর্বপ্রথম দ্বাররক্ষী নিযুক্ত করেন। খলিফার নিরাপত্তার জন্য মসজিদে মকসুরাও নির্মিত হয়। মদ্যপান, জুয়াখেলা, ঘোড়দৌড়, ব্যভিচার উমাইয়া সমাজকে কলুসিত করে। আরনল্ড সত্যই বলেন, “৬৬১ খ্রিস্টাব্দে দামেস্কে মুয়াবিয়া সাম্রাজ্যের রাজধানী প্রতিষ্ঠিত করলে আরবে প্রাচীন পৌত্তলিক ভাবধারার পুনর্জাগরণ হয়।” ধর্মের নামে অধর্ম, সততার পরিবর্তে অসাধুতা, নিরপেক্ষতার পরিবর্তে স্বজনপ্রীতি প্রভৃতি খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে ছিল না। মুয়াবিয়ার উপাধি ছিল, “আরবদের সীজার” (“Caesar of the Arabs”)। রাজকীয় দরবার মজলিস-উস-শূরার স্থান দখল করে, উপদেষ্টার পরিবর্তে বিভিন্ন রাজকীয় কর্মচারী নিযুক্ত করা হয়। দ্বাররক্ষী, দাস-দাসী রাজপরিবারের মর্যাদা বৃদ্ধি করে। হিট্টি বলেন, “মুয়াবিয়া মিম্বারে বসে খুৎবা পাঠ করতেন এবং তাঁর দরবারের আকর্ষণ ছিল সিংহাসন। মুয়াবিয়ার রাজত্বে আরব জাতির প্রাধান্য অনারব জাতির তুলনায় সর্বাধক ছিল।” এ কারণেই ঐতিহাসিক ওয়েলহাউসেন উমাইয়া খিলাফতকে আরবদের দ্বারা গঠিত এবং আরবদের সুবিধার্থে প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্র বলে অভিহিত করেন। আরনল্ড বলেন, “ইসলামী ভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসীদের নীতিগত ঐক্যের পরিবর্তে আমরা দেখতে পাই যে, বিজিত জাতির উপর আরবগণ একটি প্রভাবশালী আভিজাত্যের শাসন কায়েম করেছে।”

হযরত ওসমানের খিলাফতে কুরাইশ বংশের দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্র বানু হাশেম ও বানু উমাইয়াদের মধ্যে পুরাতন বিরোধ ও কোন্দল পুনরুজ্জীবিত হতে থাকে এবং উমাইয়া রাজত্বে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। শিয়া ও খারিজি সম্প্রদায়ের আবির্ভাবে উমাইয়া বংশের ভিত্তি প্রকম্পিত হয়। মুয়াবিয়া নিজ স্বার্থে হেজাজী আরব বা মুদারীয় এবং দক্ষিণ ইয়েমেনী আরব বা হিমারীয়দের মধ্যে গোষ্ঠী কলহের ইন্ধন জোগান। এই কলহ ও বিদ্বেষ উমাইয়া খিলাফতের জন্য আত্মঘাতী ছিল এবং পরিশেষে একে দুর্বল ও পতনে সহায়তা করে।

সকল অধ্যায়

১. প্রথম অধ্যায় : আরব ভূখণ্ডের ইতিহাসের উৎসসমূহ
২. দ্বিতীয় অধ্যায় : প্রাক-ইসলামী যুগ : রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
৩. তৃতীয় অধ্যায় : প্রাচীন আরব ভূখণ্ডের ভৌগোলিক ও গোত্রীয় প্রথার বিবরণ
৪. চতুর্থ অধ্যায় : আরব জাতি : বায়দা ও বাকিয়া
৫. পঞ্চম অধ্যায় : ‘অজ্ঞতার যুগে’ আরব দেশ
৬. প্রথম অধ্যায় : হযরত মুহাম্মদের (স) আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট
৭. দ্বিতীয় অধ্যায় : হযরত মুহাম্মদের (স) প্রথম জীবন ও নবুওয়াত
৮. তৃতীয় অধ্যায় : প্রাথমিক প্রত্যাদেশ
৯. চতুর্থ অধ্যায় : ধর্মপ্রচারে বিরোধিতা
১০. পঞ্চম অধ্যায় : সম্প্রসারিত দিগন্ত
১১. প্রথম অধ্যায় : কুরাইশদের প্ররোচনা ও হিজরত
১২. দ্বিতীয় অধ্যায় : মক্কাবাসীদের প্রতিরোধের ব্যর্থতা ও ইসলামের বিজয়
১৩. তৃতীয় অধ্যায় : মক্কাবাসীদের ওপর মহাবিজয়
১৪. চতুর্থ অধ্যায় : হযরত মুহাম্মদের (স) সাংগঠনিক ক্ষমতা
১৫. পঞ্চম অধ্যায় : হযরত মুহাম্মদের (স) সাথে ইহুদীদের সম্পর্ক
১৬. ষষ্ঠ অধ্যায় : ইসলামী রাষ্ট্রের : রূপরেখা মদিনা সনদ
১৭. সপ্তম অধ্যায় : হযরত মুহাম্মদের (স) শেষ জীবন (৬২৮-৬৩২ খ্রি.)
১৮. প্রথম অধ্যায় : হযরত আবু বকর (রা) (৬৩২-৬৩৪ খ্রি.)
১৯. দ্বিতীয় অধ্যায় : হযরত ওমর ফারুক (রা) (৬৩৪-৬৪৪ খ্রি.)
২০. তৃতীয় অধ্যায় : হযরত ওসমান যুন্নুরাইন (রা) (৬৪৪-৬৫৬ খ্রি.)
২১. চতুর্থ অধ্যায় : হযরত আলী আসাদুল্লাহ (রা) (৬৫৬-৬৬১ খ্রি.)
২২. পঞ্চম অধ্যায় : খিলাফত আমলের প্রশাসনিক ব্যবস্থা
২৩. প্রথম অধ্যায় : উমাইয়া রাজবংশের বৈশিষ্ট্য
২৪. দ্বিতীয় অধ্যায় : মুয়াবিয়া (৬৬১-৬৮০ খ্রি.)
২৫. তৃতীয় অধ্যায় : প্রথম ইয়াজিদ ও দ্বিতীয় মুয়াবিয়া (৬৮০-৬৮৪ খ্রি.)
২৬. চতুর্থ অধ্যায় : প্রথম মারওয়ান ও আবদুল মালিক (৬৮৪-৭০৫ খ্রি.)
২৭. পঞ্চম অধ্যায় : প্রথম ওয়ালিদ (৭০৫ – ৭১৫ খ্রি.)
২৮. ষষ্ঠ অধ্যায় : সুলায়মান এবং দ্বিতীয় ওমর (৭১৫-৭২০ খ্রি.)
২৯. সপ্তম অধ্যায় : পরবর্তী উমাইয়া খলিফাগণ (৭২৪-৭৫০ খ্রি.)
৩০. অষ্টম অধ্যায় : উমাইয়াদের পতন
৩১. নবম অধ্যায় : উমাইয়া খিলাফতের শাসনব্যবস্থা, সমাজ ও সভ্যতা
৩২. প্রথম অধ্যায় : আবুল আব্বাস (৭৫০-৭৫৪ খ্রি.) ও আল-মনসুর (৭৫৪-৭৭৫ খ্রি.)
৩৩. দ্বিতীয় অধ্যায় : আল-মাহদী, আন-হাদী, হারুন আর-রশীদ
৩৪. তৃতীয় অধ্যায় : আল-আমীন (৮০৯-৮১৩ খ্রি.)
৩৫. চতুর্থ অধ্যায় : আল-মামুন (৮১৩-৮৩৩ খ্রি.)
৩৬. পঞ্চম অধ্যায় : আব্বাসীয় খিলাফতের শেষার্ধ (৮৩৩-১২৫৮ খ্রি.)
৩৭. ষষ্ঠ অধ্যায় : বুয়াইয়া (৯৪৫-১০৫৫ খ্রি.) এবং সেলজুক বংশ (১০৫৫-১১৯৪ খ্রি.)
৩৮. সপ্তম অধ্যায় : আব্বাসীয় খিলাফতের অবনতি ও পতন
৩৯. অষ্টম অধ্যায় : আব্বাসীয় যুগের শাসনব্যবস্থা, সমাজ ও সভ্যতা
৪০. পরিশিষ্ট-১ : The 100: A Ranking of the most influential Persons in History: by Michael H. Hart Muhammad (sm) এবং বাংলা তর্জমা
৪১. পরিশিষ্ট-২ : হযরত মুহাম্মদ (স) প্রসঙ্গে বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতামত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন