চতুর্থ অধ্যায় : আরব জাতি : বায়দা ও বাকিয়া

সৈয়দ মাহমুদুল হাসান

আরব জাতি : ‘বায়দা’ ও ‘বাকিয়া’

আরব উপদ্বীপের আদিম অধিবাসীদের সঠিক ঐতিহাসিক তথ্য নিরূপণ করা সম্ভব হয় নি। স্বকীয়তা এবং স্বাতন্ত্রবোধে উদ্দীপ্ত আরব জাতি প্রধানত দুভাগে বিভক্ত। যথা— (১) অধুনালুপ্ত ‘বায়দা’ (Baidah) এবং (২) ‘বাকিয়া’ (Baqiyah)। কুরআন শরীফে বর্ণিত প্রখ্যাত প্রাচীন বশ ‘আদ’ (Ad) এবং ‘সামুদ’ (Thamud) এবং ‘তাসম’ (Tasm) ও ‘জাদীস’ (Jadis) প্রভৃতি প্রাচীন আরব গোত্র প্রথম শ্রেণী অর্থাৎ ‘বায়দা’ভুক্ত ছিল। যে সমস্ত জাতিগুলোর অবলুপ্ত হয়েছে তাদের ‘বায়দা’ বলা হয়। অধুনালুপ্ত আরব গোত্রীগুলোর উত্তরাধিকারী হিসেবে ‘বাকিয়া’ গোত্রের আবির্ভাব ঘটে। অবিশ্বাসী উৎপীড়ক মিথ্যাচারী এবং সত্যপ্রত্যাখানকারী যে সমস্ত গোত্রের পথভ্রষ্ট লোকেরা তাদের নিকট প্রেরিত নবীর হেদায়েত না শুনে পাপাচার, ভণ্ডামী ও জঘন্য কার্যকলাপে নিয়োজিত ছিল তাদের বর্ণনা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন সূরায় পাওয়া যাবে।

১। আ’দ সম্প্রদায়

আরব ভূখণ্ডের অতি প্রাচীন ও সমৃদ্ধশালী অবলুপ্ত জাতি ও জনপদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আ’দ এবং তাদের উত্তরাধিকারী সামূদ জাতি। তাদের সমৃদ্ধি, বৈভব এবং অতুলনীয় সম্পদ ও ঐশ্বর্য সম্বন্ধে আল-কুর’আনের অসংখ্য সূরায় বর্ণিত আছে এবং এ কথাও বলা হয়েছে যে, তাদের পাপাচার, অবিশ্বাস, অনাচার ও বিপদগামিতার জন্য তাদের সমূলে ধ্বংস করা হয়েছে।

অবলুপ্ত আ’দ এবং সা’মুদ জাতির অভ্যুত্থান কোথায় হয়েছিল তা সঠিকভাবে বলা না গেলেও ঐতিহাসিক তথ্যাবলি, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি ও পবিত্র কুর’আন শরীফের ভাষ্যকারদের বিবরণী থেকে জানা যায় যে, আ’দ নামের এক প্রাচীন জাতি দক্ষিণ আরবে একটি সমৃদ্ধশালী সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। ঐতিহাসিকেরা বলেন যে, তাদের বিশাল সাম্রাজ্য আরব উপসাগরের উত্তরমুখী ওমান থেকে পশ্চিম দিকে দক্ষিণাঞ্চলে হাজরমাউত ও ইয়েমেন অর্থাৎ লোহিত সাগরের বেলাভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সূরা আল-আহকাফের (৪৬) ২১ নম্বর আয়াতে এই অঞ্চলকে সুবিস্তৃত বালুকণা দ্বারা ঘেরা একটি উঁচু উপত্যকা ( Wind – curved Sandhill) বা ভূখণ্ড বলা হয়েছে। এখন বালুকাময় উপত্যকা হলেও কোন এক সময় এই অঞ্চলটি ছিল খুব সুজলা-সুফলা, শস্য- শ্যামলা; এখানে কৃষিকাজের সুবিধার্থে সেচ ব্যবস্থা ছিল; বহু খাল খনন করা হয়, যার ফলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। কৃষিকাজের অগ্রগতির সাথে সাথে ধনসম্পদ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এ অঞ্চলে একটি উন্নতমানের সংস্কৃতি ও সভ্যতা গড়ে উঠে। যদিও ভৌগোলিক অবস্থান সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায় না, তবুও হাজরামাউতে ‘কবর’ নামে পরিচিত নবী হৃদের সমাধি থেকে ধারণা করা হয় যে, এখানে আ’দ জাতির বসবাস ছিল। উল্লেখ্য যে, মহান আল্লাহতায়ালা পাপাচারে লিপ্ত অবিশ্বাসী পৌত্তলিকদের মধ্যে তাওহীদ প্রচারের জন্য তাদের গোত্রের হূদ নামক এক নবীকে নির্দেশ দেন। হাজরামাউতে অবস্থিত ‘মুকাল্লা’র নব্বই মাইল উত্তরে নবী হূদের সমাধি ছিল। আবুল আলা মওদুদী যথার্থই বলেন যে, দক্ষিণ আরবের ‘রব-ই-খালী’ (Empty Quarters ) নামের মরুভূমিতে আল-আহকাফ অবস্থিত, যা আরব উপদ্বীপের মানচিত্রে এখনও দেখা যায়। এখানেই আ’দ নামে একটি সমৃদ্ধ জাতির অভ্যুদয় হয় এবং পূর্বে ওমান থেকে পশ্চিমে ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

আ’দ সম্প্রদায়ের জাতিগত বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয়, যে আ’দ সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরিত নবী হূদ (আ) আ’দ বংশোদ্ভূত ছিলেন, যা সূরা আল-আলাফের (৭) ৬৫ নম্বর আয়াতে বর্ণিত রয়েছে। আ’দ সম্প্রদায়ের নামকরণ হয় তাদের বংশ প্রতিষ্ঠাতা আ’দ থেকে, যাকে নবী নূহের (আ) বংশধর বলে ধারণা করা হয়। আল্লামা ইউসুফ আলী-র মতে, আ’দ ছিলেন নবী নূহের (আ) পুত্র শেম, শেমের পুত্র আরাম, আরামের পুত্র আউসের সন্তান অর্থাৎ নবী নূহের (আ) চতুর্থ পিঁড়িতে তার অবস্থান ছিল।

মহান আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে বিভিন্ন পথভ্রষ্ট জাতিকে হেদায়েতের জন্য নবী- পয়গম্বর পাঠিয়েছেন। আ’দ সম্প্রদায়ের পৌত্তলিকতা যখন চরমে পৌঁছল তখন তাদের বংশ থেকে হূদ (আ) নামে একজনকে আল্লাহতায়ালা নবী হিসেবে তৌহিদ প্রচারের জন্য পাঠান। হৃদকে সর্বপ্রথম আরবীয় নবী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বাইবেলে বর্ণিত ইবারকে (Eber), যিনি হিব্রু ভাষায় ইবরিম (Ibrim) নামে পরিচিত ছিলেন, সম্ভবত আ’দ সম্প্রদায়ের নবী হূদ (আ) বলে ধারণা করা হয়।

প্রাক-ইসলামী যুগে উত্তর আরব ভূখণ্ডে আ’দ নামে কোন জাতির উল্লেখ পাওয়া যায় না। দক্ষিণ আরবে যে সমস্ত প্রাক-ইসলামী রাজ্য সমৃদ্ধি লাভ করেছিল তা হচ্ছে মিনইয়ান ও সাবা। দক্ষিণ আরবের অবলুপ্ত জাতি হিসেবে আ’দ এবং সা’মূদের উল্লেখ পাওয়া যায় এবং অবলূপ্ত আরব জাতিদের সাধারণ কথায় আরবে বায়দা (extinct) বলা হয়। প্রাক-ইসলামী যুগের কাব্যে অবলুপ্ত আ’দ জাতির উল্লেখ পাওয়া যায়। আরব বংশবৃত্তান্ত রচয়িতাগণ (Geneologists) মনে করেন যে, আরব জাতির মধ্যে সর্বপ্রাচীন হচ্ছে আ’দ সম্প্রদায়। কথিত আছে যে, কোন এক সময়ে আ’দ অঞ্চলে বসবাসকারী বনু বুহাব বিন সায়ান গোত্রের এক সদস্য মহানবী হযরত মুহাম্মদের (স) সাথে দেখা করতে আসেন। তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে অবলূপ্ত আ’দ সম্প্রদায়ের সম্বন্ধে অনেক তথ্য পরিবেশন করেন। এ সম্বা কিংবদন্তি বংশপরম্পরায় প্রচারিত হয়ে এসেছে। আ’দ যে সর্বপ্রাচীন জাতি, তা মওদুদীর মতে, তাদের আদ্য অক্ষর আ’দ অর্থাৎ প্রাচীন থেকেই প্রমাণিত হয়। আ’দ থেকে ‘আদিয়াত’ নামে আর একটি শব্দের উৎপত্তি হয়েছে, যার অর্থ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।

ঐতিহাসিকগণ ‘আদিয়াতের’ অন্য যে অর্থ করেছেন তা হচ্ছে ‘আদি আল-আরদ’। অর্থাৎ প্রাচীন ভূমি বা অনুর্বর অঞ্চল। সম্ভবত ‘রব-আল-খালী’তে আল-আহকাফ অঞ্চল বালুকাপূর্ণ থাকায় এ নামের উৎপত্তি হয়েছে। বর্তমানে এখানে কোন জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই; কোন জনপদের ধ্বংসাবশেষও পাওয়া যায়নি।

সমৃদ্ধশালী আ’দ সম্প্রদায় ঐশ্বর্যের স্বর্ণশিখরে উপনীত হয়েছিল, যা সূরা আল- ফাজরের (৮৯) ৬ থেকে ৮ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন যে, আ’দ বংশীয় লোকেরা সুউচ্চ অসংখ্য স্তম্ভবিশিষ্ট প্রাসাদের অধিকারী ছিল, যার সমতুল্য কোন দেশে নির্মিত হয়নি। সূরা আল-ফজরে আ’দ বংশের ‘ইরাম গোত্রের’ উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে ধারণা করা হয় যে, ‘ইরাম’ নামে একটি তিলোত্তমা নগরী ছিল, যা সুউচ্চ অট্টালিকা ও অন্যান্য স্থাপত্যকীর্তির দ্বারা সুশোভিত ছিল। মুহাম্মদ আসাদ মনে করেন যে, কিংবদন্তির গৌরবমণ্ডিত ‘ইরাম’ নগরী বর্তমানে আল- আহকাফের বালুকারাজির মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়েছে।

সূরা আদ-শু’আরার (২৬) ১২৮ থেকে ১২৯ আয়াতে আ’দ জাতির স্থাপত্যকীর্তির কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। পাপাচার ও অবিশ্বাসে নিমগ্ন আ’দ জাতির প্রতি সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলা হয়েছে যে, “তোমরা ত দম্ভভরে অযথা প্রত্যেকটি উচ্চস্থানে স্তম্ভ নির্মাণ করছ এবং দুর্গও নির্মাণ করছ- এ কথা মনে করে যে, সেগুলো চিরস্থায়ী হবে।

ধূ ধূ মরু অঞ্চল আল-আহকাফে আ’দ জাতির কোন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়নি, অথচ যে অঞ্চলে আ’দ জাতি সংস্কৃতি ও সভ্যতা গড়ে তুলেছিল তা ইসলামী যুগে “সুখী আরব ভূখণ্ড” (Happy Arabia বা Arabia Felix) নামে পরিচিত ছিল। আ’দ জাতি ও তাদের সমৃদ্ধ নগরী এমনভাবে বিধ্বস্ত হয় যে, তার কোন চিহ্নই অবশিষ্ট নেই। অবশ্য কতিপয় প্রত্নতাত্ত্বিক দক্ষিণ আরব থেকে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রী, শিলালিপি, ভাস্কর্যের নিদর্শন, মৃৎপাত্রের অংশবিশেষ আবিষ্কার করেন। বলাই বাহুল্য যে, এ সমস্ত প্রত্নসম্পদ সাবাইনদের যুগের (খ্রিঃ পূঃ ৯৫০-১১৫) বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

যাহোক, জেমস, আর. ওয়েলস্টেড নামক একজন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর অফিসার ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ আরবের নাকাব আল-হাজর নামক স্থানে একটি অতি প্রাচীন শিলালিপি আবিষ্কার করেন। এই শিলালিপিটিতে আ’দ জাতির উল্লেখ আছে এবং বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে, এই শিলালিপিটি আদ সম্প্রদায়ের সমৃদ্ধির যুগের একজন কারিগর খোদাই করেছেন। এই শিলালিপির পাঠোদ্ধার করে আ’দ জাতির বৈভব ও প্রাচুর্যের কথা জানা যায়। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ এর খোদাইকাল খ্রিস্টপূর্ব অষ্টাদশ শতাব্দী বলে মনে করেন। এতে বলা হয়েছে :

“আমরা বহু যুগ ধরে এই দুর্গে গৌরবের সাথে বসবাস করছি। আমাদের কোন অভাব নেই; আমাদের খালগুলোতে সব সময় (কৃষিকাজের সুবিধার্থে) পানি থাকে। আমাদের শাসকদের রাজা বলা হয় এবং তারা পাপ কাজে লিপ্ত থাকেন না (?)। তিনি সুশাসক এবং দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করে থাকেন। তিনি হ্রদের প্রবর্তিত আইন (শারিয়া আল-হৃদ’) দ্বারা শাসন করেন (?)। তার আইনসংহিতা একটি গ্রন্থে সন্নিবেশিত রয়েছে। আমরা অলৌকিক ঘটনা এবং পুনর্জীবনে বিশ্বাস করি।”

অতুলনীয় বৈভব, বিলাসবহুল জীবন, প্রাসাদোত্তম অট্টালিকায় বসবাসের দম্ভ ও ঔদ্ধত্য, প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্য আ’দ জাতিকে পথভ্রষ্ট করে পাপ-পঙ্কিল জীবনে বসবাসে প্রলোভিত করে। তারা একেশ্বরবাদের স্থলে পৌত্তলিকতায় নিমগ্ন হয় এবং বিভন্ন ধরনের অনাচার, পাপাচার, মিথ্যাচার, ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ করতে থাকে। তাদের পাপের মাত্রা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে, তাদেরকে হুঁশিয়ার করার জন্য বহুবার বহু সূরা অবতীর্ণ হয় এবং বারংবার তাদের পাপের ফল বা পরিণতি সম্বন্ধে সাবধান করা হয়। সূরাগুলো হল- সূরা ‘আল-আনআম’ (৬), ‘আল-আরাফ’ (৭), ‘হ্রদ (১১), আল হিজর’ (১৫), ‘আল-হাজ্জ্ব’ (২২), ‘আল-ফুরকান’ (২৫), ‘আস-শুআরা’ (২৬), ‘আল-নামল’ (২৭), ‘আল-আনকাবুত’ (২৯), ‘সা’দ (৩৮), ‘হা-মিম’ (৪১), ‘আল-আহকাফ’ (৪৬), ‘আল- যারিয়াত’ (৫১), ‘আল-কামার’ (৫৪), ‘আল-বুরুজ’ (৮৮), ‘আল-ফাজর’ (৮৯), ‘আস্-সামস’ (১)।

মহান আল্লাহতায়ালা বিপথগামী, পাপাচারে লিপ্ত আ’দ জাতির হেদায়েতের জন্য তাদের মধ্য থেকে হৃদকে (আ) নবী হিসেবে পাঠালেন। সূরা আল-আরাফের (৭) ৬৫ নম্বর আয়াতে বর্ণিত আছে যে, ‘(মহান আল্লাহতায়ালা বলেন) আ’দ জাতির নিকট তাদের ভাই হৃদকে পাঠিয়েছিলাম। সে তাদের বলেছিল, “হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। তোমরা কি সাবধান হবে না।” নবী হূদ (আ) তার স্বজাতি আ’দকে অংশীদারিত্ব ও কুফরী পরিত্যাগ করে এক আল্লাহতায়ালার ইবাদত করার জন্য বারংবার অনুনয়-বিনয় করতে থাকেন। তিনি আরও বলেন যে, তোমাদের পাপকর্মের জন্য তোমরা অণুতপ্ত হয়ে মহান করুণাময় আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। কিন্তু বিধর্মী পৌত্তলিক আ’দ গোষ্ঠী নবী হৃদের (আ) বাণীতে কর্ণপাত করেনি। নবী হূদ (আ) ও তার আ’দ সম্প্রদায়ের সাথে যে কথোপকথন হয়েছিল তা নিচে দেওয়া হল।

হূদ (আ) : “হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর এবং বর তিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ্ নেই।”

আ’দ সম্প্রদায়ের প্রধান : “আমরা দেখছি যে, তুমি একজন নেহায়েৎ নির্বোধ ব্যক্তি। শুধু তাই না আমরা তোমাকে মিথ্যাবাদী মনে করি।”

হূদ (আ) : “হে আমার সম্প্রদায়, আমি মোটেই নির্বোধ নই, আমি বিশ্বজগতের প্রতিপালকের রাসূল। আমি কেবল আল্লাহর বাণী তোমাদের কাছে পৌছাচ্ছি। এর পরিবর্তে আমি কোন পুরস্কার আশা করি না। যদি কোন পুরস্কার থাকে তাহলে তা আসবে মহান আল্লাহর নিকট থেকে। “

আ’দ সম্প্রদায়ের প্রধান : “হে হূদ। তুমি আমাদের কাছে কোন স্পষ্ট প্রমাণ দিতে পারনি। তোমার কথায় আমরা আমাদের দেব-দেবী পরিত্যাগ করতে পারি না, কারণ আমরা তাদের বিশ্বাস করি ও উপাসনা করি

হ্রদ (আ) : “তোমরা যদি আল্লাহর পথে না যাও এবং আমার বাণী উপেক্ষা কর তাহলে তোমাদের জন্য তোমাদের প্রতিপালক মহাশাস্তি, অভিশাপ ও ক্রোধ নির্ধারিত করে রেখেছেন। সেটাই হবে আমার বাণীর সত্যতার প্রমাণ।”

আ’দ সম্প্রদায়ের প্রধান : “নিশ্চয় আমাদের (পৌত্তলিক) মধ্যে কেহ তোমাকে অশুভ দ্বারা আবিষ্ট করেছে।”

হূদ (আ) : “আমি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি যে, আমাকে কেহ প্ররোচিত করেনি। আমি আদিষ্ট হয়ে আল্লাহর রাসূল হিসাবে তোমাদের কাছে তৌহিদের বাণী নিয়ে এসেছি। আল্লাহর সাথে অন্যকে যারা শরীক করে আমি তাদের থেকে দূরে থাকি।”

আ’দ সম্প্রদায়ের প্রধান : “হে হৃদ। তুমি কি আমাদের গোত্রভুক্ত হয়েও আমাদের পূর্বপুরুষের দেব-দেবীর উপাসনা থেকে দূরে রাখতে চাও। তুমিও তাহলে মিথ্যাবাদী ও প্রতারক হিসেবে পরিচিত লাভ করবে।”

নবী হূদ (আ)-এর বাণী প্রত্যাখ্যান করে আ’দ জাতি মহান আল্লাহ্তায়ালার প্রতি অবিশ্বাস আনে, যার পরিণতি হয় ভয়াবহ। সূরা হূদ নাজেল হয়েছে তাদের কুফরীর ফলশ্রুতিতে! আ’দ জাতি মহান আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহ ও কৃপা ভুলে গিয়ে হয়ে উঠে স্বৈরাচারী, দাম্ভিক, উচ্ছৃঙ্খল ও উদ্ধৃত স্বভাবের। এ কারণে পৃথিবীতে তারা অভিশপ্ত জাতিতে পরিণত হয় এবং রোজ কিয়ামতেও তাদের কুফরীর জন্য অভিশপ্ত হয়ে শাস্তি পাবে। তাদের কুকর্ম, পাপাচার ও অবিশ্বাসের জন্য মহান আল্লাহতায়ালা তাদের সমূলে উৎপাটিত করেন। পবিত্র কুর’আন শরীফে সূরা শূ’- আরার ১২৩ থেকে ১৪০ আয়াতে বলা হয়েছে যে, “মহান আল্লাহতায়ালা আ’দ সম্প্রদায়কে প্রাচুর্য দিয়েছিলেন দুগ্ধবতী পশু (আনআম), প্রস্রবণ, ফলের বাগান, সন্তান-সনতুতি, এতদসত্ত্বেও তারা তাদের প্রতিপালকের নির্দেশ মানেনি এবং তার প্রেক্ষিতে নবীকে অপমানিত অপদস্থ করেছে, বিদ্রূপ তামাশা করেছে, যার পরিণতি ছিল ধ্বংস।”

মহান আল্লাহতায়ালা কিভাবে বিপদগামী আ’দ সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছিলেন তা সূরা আল-আনকাবুতের (২৯) ৪০ নম্বর আয়াতে স্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। যারা তৌহিদ প্রত্যাখ্যান করে পৌত্তলিকতায় লিপ্ত ছিল তাদের প্রত্যেককে “প্রস্তরসহ প্রচণ্ড ঝড় (শিলাবৃষ্টি), প্রচণ্ড জলস্রোত (মহা প্লাবন), ভুমিকম্প, যার ফলে তারা ভূগর্ভে প্রোথিত হয়েছিল”, শাস্তি প্রদানের উল্লেখ পাওয়া যায়। সূরা সাদের (৩৮) ১৩ থেকে ১৪ আয়াতে, যেখানে বলা হয়েছে যে নূহ, আ’দ, সা’মূদ, লূত ও শোয়েবের সম্প্রদায় খুবই শক্তিশালী ছিল এবং তাদের বিশাল বাহিনী ছিল কিন্তু মহা প্রতিপালক আল্লাহতায়ালার নির্দেশ অমান্য করে কুফরী করায় তাদের ধ্বংস করা হয়। আ’দ সম্প্রদায় যখন প্রচণ্ড খরার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল এবং তাদের দুঃখ-দুর্দশা বেড় যেতে থাকল তখন আকাশে মেঘ দেখে মনে করেছিল যে তাদের অনাবৃষ্টির দিন কেটে গেছে এবং আবার বৃষ্টিপাতের জন্য তাদের দেশ সুজলা-সুফলা হয়ে উঠবে। কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালার তরফ থেকে তাদের উপর ঝড়-ঝঞ্ঝা, শিলাবৃষ্টি পতিত হয় এবং নবী হৃদ তাদের বললেন যে, “ঝড় মর্মন্তুদ শাস্তি বহনকারী, এটি এমন বৃষ্টি যা তাদেরকে মুহূর্তে ধ্বংস করে দিবে।” (৪৭ : ২৪-২৬)

মহাপ্রলয়, ধ্বংসকারী ঝঞ্ঝা, উষ্ণবায়ু তাড়িত প্রবল বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় (winnowing wind) যে কি প্রচণ্ড ধ্বংসলীলা সম্পন্ন করেছিল মহান আল্লাহতায়ালা তা একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে আ’দ সম্প্রদায়ের উপর আরোপ করেন। সূরা আল-হাক্কা (৬৯)-এর ৬ থেকে ৮ আয়াতে বলা হয়েছে যে, “যে প্রচণ্ড ঝঞ্ঝা তাদের ধ্বংস করে দিয়েছিল তা সাত দিন ও সাত রাত বিরামহীনভাবে চলতে থাকবে ফলে আ’দ সম্প্রদায়ের লোকেরা এমনভাবে মৃত্যুবরণ করে যেন তারা সারশূন্য মধ্যভাগে বিক্ষিপ্ত চিরা খেজুরের কাণ্ডের মত মাটিতে লুটিয়ে আছে এবং তাদের কারও কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।” তাদের পাপাচার এমন পর্যায়ে পড়ল যে, তারা অবলুপ্ত জাতিতে (আরব আল-বায়দা)-তে পরিণত হয়।

২। ‘ইরাম’

পবিত্র কুর’আন শরীফের কয়েকটি সূরায় আরবদেশের কতিপয় অবলুপ্ত জাতি ও জনপদের উল্লেখ রয়েছে। এ সমস্ত ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদ ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘ইরাম’ শহর এবং এর অধিবাসিবৃন্দ।

সূরা আল-ফাজরের (৮৯) ৬ থেকে ১৩ পর্যন্ত আয়াতে ইরামের অধিবাসীদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে, তারা সুরমা, নয়নাভিরাম ও সুউচ্চ অট্টালিকায় বসবাস করত। তাদের স্থাপত্যকীর্তি ছিল অতুলনীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ‘ইরামের’ প্রাচীন কীর্তির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়নি; তবে ধারণা করা হয় যে, সম্ভবত ইরাম ছিল দক্ষিণ আরবের আ’দ জাতির একটি প্রাচীন রাজধানী। এটি সুউচ্চ স্তম্ভরাজি দ্বারা নির্মিত গগনভেদী বিশাল অট্টালিকার জন্য বিখ্যাত ছিল। বিশালাকার উঁচু স্তম্ভরাজিগুলো বিরাটাকার দৈত্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কোন কোন ভাষ্যকার বিরাটাকার স্তম্ভরাজিকে বিশালদেহী ‘ইরামের’ অধিবাসীদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে প্রতীয়মান হবে যে, প্রায় সকল প্রাচীন জাতিই সুউচ্চ প্রাসাদ, মন্দির বা সমাধিসৌধ নির্মাণ করে অমরকীর্তি রেখে যাওয়ার চেষ্টা করে, যেমন ফেরাউনী মিসরের পিরামিড ও মন্দির, ব্যাবিলনের ব্যাবেল টাওয়ার, অ্যাকামেনীয়দের পার্সিপোলিসের প্রাসাদ।

‘ইরামের’ অধিবাসীদের ‘জাত-আত-ইমাদ’ বলা হয়েছে। আল্লামা ইউসুফ আলীর মতে, ইরামের অধিবাসিগণ সুউচ্চ স্তম্ভের মত দীর্ঘ ছিল; এজন্য তাদের নাম হয়েছে “ইরাম’। কিন্তু ইবন খালদুন বলেন, ‘ইমাদ’ শব্দের অর্থ ‘তাঁবুর খুঁটি’ (tent poles)। বেদুঈন আরবগণ মরুভূমিতে খুব উঁচু খুঁটির সাহায্যে তাঁবু খাটাত এবং এখনও খাটায়। ‘ইরামের’ অট্টালিকাসমূহ তাঁবুর খুঁটির মত শক্ত ও দীর্ঘদণ্ডের মত পাথরের সুউচ্চ স্তম্ভরাজির সাহায্যে নির্মিত হয়।

পি. কে. হিট্টির মতে, ইরাম নগরী রোমীয় আমলের নির্মিত নাবাতীয় শহর পেত্রা (Petra)। কিন্তু তার মতবাদ সঠিক নয় কারণ পবিত্র কুর’আন শরীফে উল্লিখিত আল- হিজরের অধিবাসীদের সাথে পেত্রার জনগোষ্ঠীর কোন সাদৃশ্য নেই। এ প্রসঙ্গে মার্মাতিউক পিকথাল তার “The Meaning of the Glorious Quran“-এ সটিকভাবে বলেছিল যে, দক্ষিণ আরব বা ইয়েমেন ‘ইরাম’ নামে একটি প্রাচীন শহর ছিল। পেত্রা, যাকে “রক্তগোলাপ শহর” (Red-rose city) বলা হয়, উত্তর আরবে অবস্থিত, যা এখনও দর্শকদের প্রচণ্ডভাবে আকর্ষণ করে।

‘ইরামের’ অধিবাসিগণ পাপাচারে লিপ্ত ছিল; পৌত্তলিকতার ব্যাপক প্রসার ঘটে এ সময়ে এবং জনগোষ্ঠী ন্যায়, সদাচার ও একেশ্বরবাদের স্থলে শেরেকিতে নিমগ্ন ছিল। তাদের বারংবার সাবধান করা সত্ত্বেও তারা সৎপথে পরিচালিত হয়নি। বরঞ্চ অনাচার, অবিশ্বাস, কুসংস্কার ও পাপাচার চরম সীমায় পৌঁছে। এ কারণে আ’দ, সামুদ, সদুম ও গোমারো জাতির মত ইরামের অধিবাসীদের আল্লাহতায়ালা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভূমিকম্প, শিলাবর্ষণ দ্বারা ধ্বংস করে দেন। বর্তমানে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, “যেহেতু ইরামের অধিবাসিগণ, যারা ফেরাউন, আদ ও সা’মূদের অধিবাসীদের মত সীমালঙ্ঘন করেছিল এবং অনাচার, অশান্তি, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল, সেহেতু শাস্তিস্বরূপ তাদের ধ্বংস করে দেই।”

৩। সা’মুদ সম্প্রদায়

আ’দ জাতির মত সা’মূদ জাতিও প্রাচীন আরব ভূখণ্ডের একটি অবলুপ্ত সম্প্রদায়, যা পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, সামূদ জাতির কথা পবিত্র কুর’আন শরীফে আ’দ জাতি প্রসঙ্গে প্রায়ই বলা হয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, সামূদ জাতি, যাদের “দ্বিতীয় আ’দ” বলা হয়ে থাকে, আ’দ সম্প্রদায়ের উত্তরসূরী ছিল। সমৃদ্ধশালী ও ঐশ্বর্যমণ্ডিত আ’দ জাতি সগৌরবে বহুদিন দক্ষিণ আরবে রাজত্ব করে এবং তাদের অবিশ্বাস, পাপাচার ও কুসংস্কারের মাত্রা যখন ছাড়িয়ে যায় তখন মহান আল্লাহতায়ালা তাদের ধ্বংস করে দেন। তাদের উত্তরাধিকারী হিসেবে সা’মূদ জাতি পুনরায় আ’দ জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উপর নির্ভর করে একটি বিশাল ও সমৃদ্ধশালী রাজ্য গঠন করে। তাদের বিত্ত ও বৈভব ছিল অতুলনীয়।

অবলুপ্ত সা’মূদ জাতি সম্বন্ধে পবিত্র কুর’আন শরীফ, অ্যাসিরীয় ও গ্রিক ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্র থেকে জানা যায় যে, তারা পাথরের পাহাড় কেটে গুহা তৈরী করে বসবাস করত (Rock dwellers)। তাদের রাজ্য বা জনপদ কোথায় ছিল তা সঠিকভাবে জানা যায় না। যাহোক, নবী করীম হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর সময়ের একটি ঘটনা। আরব ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করে যে, হিজরীর নবম এবং ইংরেজি ৬৩০ সনে এক বিশাল বাহিনী নিয়ে বায়জানটাইন বাহিনীর আগ্রাসণ বন্ধ করার জন্য সিরিয়ার অভিমুখে নবী করীম যাত্রা করেন। মদিনা থেকে প্রায় ৪০০ মাইল উত্তরে তাবুক নামক স্থানে রাসূলে খোদা তাঁবু ফেলেন। অভিযানকালে তিনি ও তাঁর বাহিনী একটি প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান, যা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, অতিক্রম করেন। তাঁরা এ স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে অনেক পাথরখণ্ড এবং পাথরের পাহাড়ে খোদাইকৃত অসংখ্য গুহা দেখতে পান। ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকগণ এই ধ্বংসস্তূপ, যা বর্তমানে জনমানব শূন্য পেত্রা বলে চিহ্নিত করেছেন। রক্ত গোলাপ নগরী (Red-rose city) পেত্রা সামূদ জাতির প্রধান নগরী ছিল। বর্তমানের পেত্রা নগরীর প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে; কারণ হিট্টির মতে, খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রোমীয় শাসনামলে এ শহর সমৃদ্ধশালী নগরীতে পরিণত হয়। কিন্তু আ’দ জাতির উত্তরাধিকারী সামূদ এ অঞ্চলে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে। তাছাড়া পেত্রাকে নাবাতীয়দের রাজধানী বলা হয়েছে এবং সামূদ জাতি নাবাতীয়দের পূর্বে আবির্ভূত হয়। প্রমাণস্বরূপ বলা যায় যে, প্রতাপশালী দ্বিতীয় সারগণের খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর (৭১৫) একটি শিলালিপিতে সা’মূদ জাতির উল্লেখ রয়েছে। এমন কি গ্রিক ক্ল্যাসিক্যাল ঐতিহাসিকগণও সামূদকে “Thamudari” নামে অভিহিত করেন।

আ’দ জাতির মত সা’মূদ জাতিও যে খুবই সমৃদ্ধশালী ছিল তার প্রমাণ রয়েছে পবিত্র কুর’আন শরীফের বিভিন্ন সুরায়; যদিও তাদের কুকর্ম, পাপাচার, অবিশ্বাস, শঠতা, হঠকারিতা, মিথ্যাচার, কুসংস্কারের জন্য আ’দ জাতির মত সামূদ সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা হয়। আ’দ জাতির নবী ছিলেন হ্রদ এবং মহান আল্লাহতায়ালা হেদায়েতের জন্য নবী সালেহ (আ)-কে সামূদ জাতির নিকট পাঠান। নবী লূত (আ) যেমন স্বগোত্রীয় ছিলেন, তেমনি সালেহও সা’মূদ বংশোদ্ভূত ছিলেন। এতদসত্ত্বেও এ দুই সম্প্রদায় তাদের স্বগোত্রীয় ভ্রাতৃসম নবীদের সাবধান বাণীকে কোন মুল্য দেয়নি, যার ফলে তাদেরকে দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে।

পবিত্র কুর’আন শরীফের বেশ কযেকটি সুরায় সামূদ জাতি সম্বন্ধে বলা হয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য আল-আরাফ, হ্রদ, ফুরকান, শুআরা, নামাল, যারিয়াত, কামর, বুরুজ, ফাজর।

মুহাম্মদ আসাদ সূরা আল-আরাফের (৭) ৭৪ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন যে, “উত্তর হিজাজের আল-হিজর অঞ্চলে সামূদ জাতি যে বিস্তীর্ণ পাথরে কাটা গুহার বাসস্থান ও সমাধি তৈরি করেছিল তার উল্লেখ বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া যায় এবং এ সমস্ত পাথরে খোদিত জীবজন্তুর ভাস্কর্য ও শিলালিপি দেখে প্রমানিত হয় যে সা’মূদ জাতি একটি উন্নতমানের রাজনৈতিক আধিপত্য ও সভ্যতা গড়ে তোলে।” এ সময় অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং রুচিসম্পন্ন শিল্পকলার নিদর্শন যে অঞ্চলে পাওয়া যায় তা আরবি ভাষায় ‘মা’দাইন সালেহ’ অর্থাৎ ‘নবী সালেহের শহর’ হিসেবে বিবেচিত। সাধারণ কথায় এটিকে আল-হিজর বা পাথরে-কাটা একটি নগরী বলা হয়ে থাকে। কয়েক হাজার একর জুড়ে এই বিস্তীর্ণ এলাকায় সভ্যতার গৌরবময় যুগে পাঁচ লক্ষ লোক বসবাস করত। সূরা হিজরের (১৫ ) ৮০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে যে, “হিজরবাসীগণ রাসূলদের প্রতি (সালেহ) মিথ্যা আরোপ করেছিল এবং আল্লাহর নির্দেশ উপেক্ষা করায় তাদের ধ্বংস করা হয়।” আল-হিজর দ্বারা সা’দদের রাজ্যকে বুঝান হয়েছে এবং এ অঞ্চলটি সুরা আল-ফাজরের (৮৯) ৯ নম্বর আয়াতে ওয়াদী (উপত্যকা) আল-কুরা নামেও অভিহিত হয়েছে। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে যখন প্রথম ওহী নাজেল হয় রাসূলে করীমের নিকট তখন কাফেলা মা’দাইন সালেহ পার হয়ে সিরিয়া থেকে মদিনায় যাতায়াত করত। আরব ভূখণ্ডের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত সামূদ জাতিদের রাজ্য তৎকালীন সময়ে অত্যন্ত শক্তিশালী ও প্রগতিশীল ছিল। এ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে হিজাজ রেলপথ চলে গিয়েছে।

আ’দ জাতির মত সামূদ জাতি আরব বংশোদ্ভূত ছিল এবং তারাও তাদের পূর্বসূরীদের মত বাইদা বা অবলুপ্ত জাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আ’দ জাতির একটি ক্ষুদ্র শাখা বা “দ্বিতীয় আ’দ” নামে পরিচিত সা’দদের কথা প্রাচীন আরব কবিতায় উল্লেখ আছে। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, দ্বিতীয় সারগণ খ্রিস্টপূর্ব ৭১৫ অব্দের একটি আসিরীয় শিলালিপিতে সা’মূদের কথা উৎকীর্ণ রয়েছে। এছাড়া গ্রিক হেলেনিস্টিক যুগে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক টলেমী সা’মূদের “Thamudaes Thamudari” বলে উল্লেখ করেছেন। মহান আল্লাহতায়ালা সা’মূদদের নিকট তাদের স্বগোত্রীয় নবী সালেহকে পাঠান এবং পৌত্তলিকতার ভয়াবহ পরিণতির জন্য সালেহ (আ) তাঁর সম্প্রদায়কে সাবধান করেছেন। নবী সালেহের বংশ লতিকা এরূপ :

নূহ (আ)

শেম (আ)

অরিব (আ)

সামূদ (আ)

হায়দার (আ)

উবহিদ (আ)

সালেহ (আ)

খ্রিস্টপূর্ব ৭১৫ অব্দে উৎকীর্ণ অ্যাসিরীয় শিলালিপিতে সা’মূদদের কথা উল্লেখ থাকায় এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর পূর্বে সা’মূদ জাতি তাদের ক্ষমতা, প্রভাব, ঐশ্বর্য ও অতুলনীয় বৈভবের চরম শিখরে উঠে। পবিত্র কুর’আন শরীফে নাবাতীয়দের সম্বন্ধে কিছু বলা হয়নি এবং এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে বর্তমানের পেত্রা নগরী, যা খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে গৌরবের স্বর্ণশিখরে পৌঁছায়, তা ছিল পাথরে খোদাই একটি নগরী এবং প্রাচীন সামূদদের সাথে এর পার্থক্য এই যে সা’মূদগণ নাবাতীয়দের পূর্বসূরি। পি. কে. হিট্টি যথার্থই বলেন যে, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে পেত্রা অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী নগরী ছিল এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩১২ অব্দে শক্তিশালী নাবাতীয়গণ রোমীয় অভিযান প্রতিহত করতে সমর্থ হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৮৫ অব্দে নাবাতীয় রাজা আল-হারিস সিরিয়ার দামেস্ক পর্যন্ত আধিপত্য বিস্তার করেন। কিন্তু সামূদগণ রোমীয় সাম্রাজ্যের প্রভাবাধীন থাকেন এবং ১০৫ খ্রিস্টাব্দে রোমীয় সম্রাট ট্রোজান পেত্রা দখল করলে নাবাতীয় সাম্রাজ্যের পতন হয়। বলাই বাহুল্য যে, রোমীয় স্থাপত্যের প্রভাবে পেত্রায় পাথরে কাটা অট্টালিকা ও মন্দির নির্মিত হয়।

সামূদ জাতির স্থাপত্যকলা উন্নতমানের ছিল। ইউসুফ আলীর ভাষায়, “তাদের (সা’মূদ জাতি) সভ্যতায় প্রাচীন মিসরীয়, গ্রিক ও রোমীয় সভ্যতার প্রভাব দেখা যায়।” তিনি আরও বলেন যে, তারা প্রকাণ্ড পাথরের পাহাড় কেটে মন্দির, সমাধি ও অট্টালিকা নির্মাণ করে এবং দেবী আল-লাত-এর উপাসনা করে। মার্মাডিউক পিকথাল বলেন যে, “পাথরে খোদাই এ সামূদ জাতি অসাধারণ নৈপূণ্য অর্জন করেন।” তিনি সা’মূদীয় স্থাপত্য ভাস্কর্যের সাথে প্রাচীন ভারতীয় ইলোরা ও অজন্তার শিল্পকলার তুলনা করেন। পিকথাল আরও বলেন যে, স্থাপত্য ও বাস্তুকলাবিদ্যায় সামূদীয় সম্প্রদায় অসামান্য খ্যাতি অর্জন করে। পবিত্র কুর’আন শরীফের সূরা আল-আরাফের ৭৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে যে, আ’দ জাতির পর মহান আল্লাহতায়ালা সামূদ জাতিকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন এবং তাঁর করুণা ও দয়ায় তিনি তাদের পৃথিবীতে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, তারা সমতলভূমিতে প্রাসাদ ও পাহাড় কেটে বাসগৃহ নির্মাণ করছে। সা’মূদ জাতি অত্যন্ত প্রাচুর্যের সাথে বসবাস করে, তাদের কোন কিছুরই অভাব ছিল না। প্রচুর শস্যভাণ্ডার ছিল, ফলমূল সমৃদ্ধ বাগান ছিল। খেজুর বাগানের প্রাচুর্য ছিল, প্রস্রবণ কৃষি উৎপাদনে সহায়ক ছিল; তারা দক্ষ কারিগর, শিল্পী, স্থপতি ও ভাস্কর ছিল। সা’মূদ জাতি এতই সমৃদ্ধিশালী ছিল; যে তারা মহান আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করে দাম্ভিকভরে পৌত্তলিকতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। এ কারণে তাদের গোত্র থেকে সালেহকে নবী হিসেবে পাঠান হয়। সামূদদের অধ্যুষিত আল-হিজর অঞ্চলের কথা ইবনে বতুতা চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে সিরিয়া থেকে মক্কায় আসার পথে উল্লেখ করেন। তাঁর ভাষায়, “লাল রঙের পাহাড় কেটে তৈরি সা’মূদদের ইমারতসমূহ আমি দেখতে পাই। এখানের চিত্রকর্ম এতই উজ্জ্বল ও প্রানবন্ত ছিল যে, তা দেখে মনে হয় যেন অতি সম্প্রতি এগুলো অঙ্কিত হয়েছে। এখনও এখানে মানুষের কঙ্কাল পাওয়া যায়।’

সম্পদশালী ও অতুলনীয় বৈভবের মালিক সামূদ জাতি বিলাসপ্রিয় জীবন, পাপপঙ্কিল ও অনাচারে কলুষিত ছিল। তারা একেশ্বরবাদের স্থলে পৌত্তলিকতার প্রতি মোহগ্রস্ত ছিল। এ কারণে মহান আল্লাহতায়ালা সামূদ সম্প্রদায়ভুক্ত নবী সালেহকে পাঠিয়ে তাদের সৎপথে চলার ও এক আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহ্বান জানান। নবী সালেহ এবং সা’মূদ সম্প্রদায়ের নেতার সাথে নিম্নরূপ কথোপকথন হয়েছিল :

সালেহ (আ) : “হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। তোমাদের কাছে আল্লাহ বিশেষ ও স্পষ্ট নিদর্শন পাঠিয়েছেন। আল্লাহর উষ্ট্রী তোমাদের জন্য একটি নিদর্শনস্বরূপ। এই উষ্ট্রীর কোন ক্ষতি করবে না, তাকে সহজে জমিতে চলতে দিবে, কোন প্রকার বাধাবিঘ্ন সৃষ্টি করবে না তাদের খাবার গ্রহণের সময়। যদি তোমরা তা কর তবে তোমরা মহাশাস্তি ভোগ করবে।”

সা’মূদ সম্প্রদায়ের নেতা : দম্ভভরে উদ্ধত স্বভাবের সা’মূদ সম্প্রদায়ের নেতা দুর্বল বিশ্বাসীদের জিজ্ঞাসা করে যে, “তোমরা কি জান যে সালেহ আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত হয়েছে?” জবাবে বিশ্বাসীগণ বলে যে, “তার প্রতি যে ঐশীবাণী প্রেরিত হয়েছে তাতে আমরা বিশ্বাস করি।” তখন দাম্ভিক সা’মূদ সম্প্রদায়ের লোকেরা বলল যে, “বিশ্বাসীগণ যাকে ইবাদত করে আমরা তাকে প্রত্যাখ্যান করি।’

সালেহ (আ) : “মনে রেখ যে, মহান আল্লাহতায়ালা তোমাদেরকে (মানুষ জাতি) মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং এই মাটিতে তোমাদের ফিরে যেতে হবে। সুতরাং সেই মহান এক আল্লাহর, যার কোন অংশীদার নেই, ইবাদত কর।

সা’মূদ সম্প্রদায়ের প্রধান : “হে সালেহ। তুমি আমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত এবং তুমি আমাদের আশা ভরসা ছিলে। তা হলে তুমি কি করে তোমার পূর্বপুরুষদের ধর্ম পৌত্তলিকতা ছেড়ে অন্য পূর্ব প্রচার করছ? তুমি যে একেশ্বরবাদ প্রচার করছ তাতে আমাদের ঘোর সন্দেহ রয়েছে এবং আমাদের মনে হচ্ছে যে, তুমি আমাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছ।

সালেহ (আ) : “হে আমার সম্প্রদায়; আমি মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশে তাঁর মহানবাণী প্রচার করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং তিনি একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন পাঠিয়েছেন তোমাদের সৎ পথে চলা এবং তৌহিদে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য। আমি যদি আমার দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত হই এবং অবাধ্য হই তাহলে আল্লাহও আমাকে শাস্তি দিবেন। সুতরাং তোমরা আমার সম্প্রদায়ভুক্ত হয়েও অবাধ্য হয়ে আমার ক্ষতিসাধন করছ।”

সা’মুদ সম্প্রদায়ের প্রধান : “হে সালেহ। তুমি একজন মিথ্যাবাদী, আমাদের বিপথগামী করার চেষ্টা করছ। তোমার সতর্কবাণীতে আমাদের কোন আস্থা নেই। তুমি কি করে বিশ্বাস করলে যে আমরা আমাদের সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তির কথার আমাদের পূর্বপুরুষদের ধর্ম পৌত্তলকতা ত্যাগ করব। তাহলে ত আমরা বিপথগামী এবং উন্মাদ হিসাবে পরিচিত হব। হে সালেহ, নিশ্চয় তুমি দাম্ভিক, প্রতারণাকারী এবং মিথ্যাবাদী।

সালেহ (আ) : “হে আমার সম্প্রদায়। তোমরা বিপথগামী হবে না, তা হলে মহান আল্লাহ কঠোর শাস্তি দিবেন। আমি বিনা পুরস্কারে তোমাদের নিকট আল্লাহর বাণী পৌছিয়েছি শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।”

সা’মূদ সম্প্রদায়ের প্রধান : “হে সালেহ! তুমি তোমার যে নিদর্শনের কথা বলে আমাদের ভয় দেখাচ্ছ সেই নিদর্শন উষ্ট্রীকে আমাদের সামনে আন।’

অতঃপর উগ্র স্বভাবের সামূদ জাতির লোকেরা মহান আল্লাহর ইবাদত থেকে বিরত থেকে কুফরী করতে থাকে। তখন মহান প্রতিপালক নিদর্শনস্বরূপ একটি উষ্ট্রীকে পাঠালেন এবং বললেন যে তার যেন কোন ক্ষতি না হয়। সামূদ জাতির ঔদ্ধত্য ও সীমাহীন অবিশ্বাস পরীক্ষার জন্য একটি উষ্ট্রী পাঠান হয়। কিন্তু সামূদ জাতির অসদাচরণ, দম্ভ ও উগ্র মনোভাব প্রকাশ পায় যখন আল্লাহর এই নিদর্শনকে তারা হত্যা করে। আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক নবীর কাছে মোজেজা পাঠিয়েছেন এবং নবী সালেহের জন্য মোজেজা বা আলৌকিক ঘটনা ছিল এই উষ্ট্রীর আগমন। সূরা আল-কামারের (চন্দ্র) (৫৪) ২৩ থেকে ৩১ আয়াতে উষ্ট্রীর কাহিনী বর্ণিত রয়েছে।

কোন একটি বিশেষ দিনে অবিশ্বাসী সামূদ সম্প্রদায়ের লোকেরা একটি পাহাড়ের উপত্যকায় সমবেত হয়ে একটি দশ মাস গর্ভবতী উষ্ট্রীকে পাহাড়ের মধ্য থেকে আসতে বলে। নবী সালেহ (আ) প্রতিশ্রুতি মোতাবেক মহান আল্লাহতায়ালার নিকট মোজেজা পাঠাবার জন্য আকুল আবেদন করেন। বহু সময় পার হয়ে যাওয়ার পর যখন বিপদগামী সা’মূদ সম্প্রদায়ের লোকদের ধৈয্যচ্যুতি ঘটার উপক্রম হল তখন আকস্মিকভাবে উঁচু পাহাড়ের একধারে একটি উষ্ট্রীকে দেখা গেল। উষ্ট্রীটি গর্ভবতী হলেও খুব উঁচু ও সুন্দর ছিল, যা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নবী সালেহ তখন তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, “মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রতিশ্রুতি রেখেছেন, পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখ এবং যেহেতু তোমাদের আশা পূরণ করা হয়েছে সেহেতু তোমরা মূর্তিপূজা ছেড়ে দিয়ে এক আল্লাহের ইবাদত কর।” দুটি পাহাড়ের মাঝখানে উষ্ট্রীর আগমনে সমতলে দণ্ডায়মান সামূদ জাতির লোকেরা বিস্মিত ও স্তম্ভিত হয়ে পড়ল। সূরা আল- আরাফ এবং সূরা আল-হিজরে উষ্ট্রীর আগমনকে অলৌকিক ঘটনা (miracle) বলে অভিহিত করা হয়েছে। কোন কোন সূত্রে বলা হয়েছে যে, উষ্ট্রী তার শাবককে নিয়ে পাহাড় থেকে সমতলের চারণভূমিতে খাবারের সন্ধানে আসে।

সূরা আল-কামারের (৫৪) ২৩ থেকে ৩১ নম্বর আয়াতসমূহে আল্লাহতায়ালার মোজেজাস্বরূপ উষ্ট্রীর আগমন ও পরবর্তী ঘটনাবলি বর্ণিত হয়েছে, “সামূদ সম্প্রদায় সতর্ককারীদেরকে (নবী সালেহ) মিথ্যাবাদী বলেছিল। তারা বলেছিল যে আমাদেরকে আমাদেরই গোত্রের একজনের আনুগত্য স্বীকার করতে হবে? (যদি না করি) তাহলে কি আমরা বিপথগামী এবং উম্মাদরূপে গণ্য হব? আমাদের মধ্যে কেবল তার (সালেহ) কাছেই কি প্রত্যাদেশ (ওহী) এসেছে, যে শুধু মিথ্যাবাদীই নই, দাম্ভিকও।” আল্লাহতায়ালা বলেন, “আমি তাদের পরীক্ষার জন্য একটি (গর্ভবতী) উষ্ট্রী পাঠিয়েছি তাদের আচরণ ও ধৈর্য পরীক্ষার জন্য। তাদেরকে (সা’মূদবাসী) জানিয়ে দাও (সালেহের উদ্দেশ্যে) যে তাদের জন্য পালাক্রমে পানি খাবার সময় নির্ধারিত হয়েছে। তারা (পাগুরা) সময়মত পালাক্রমে পানি পান করার জন্য উপস্থিত হবে এবং এর কোন রকম ব্যতিক্রম হবে না। এরপর তারা (সা’মূদ সম্প্রদায়) তাদের এক সঙ্গীকে উক্ত উষ্ট্রীটিকে হত্যার জন্য নির্দেশ দিল এবং সে তাকে হত্যা করল।” তার নাম ছিল কুদার বিন ছালেফ।

পাহাড়-পর্বতসঙ্কুল অঞ্চলে চারণভূমিতে পানি থাকায় সামূদ জাতির উট ও মেষপালকেরা পাহাড় থেকে প্রবাহিত ঝর্ণার পানিতে তাদের পশুদের পানি পান করাত। সা’মূদ সম্প্রদায় যখন মোজেজা দাবি করল তখন মহান আল্লাহ দশ মাস অন্তঃস্বত্ত্বা একটি উষ্ট্রীকে দুই পাহাড়ের মধ্যভাগে আবির্ভূত করলেন। সুউচ্চ পাহাড়ের মধ্যভাগে আকস্মিকভাবে উষ্ট্রীর আবির্ভাবে সা’মূদ সম্প্রদায় হতবাক হয়ে পড়ে এবং তারা তাদের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারেনি। উষ্ট্রীটি একটি শাবক প্রসব করে এবং তারা দু’জনে পাহাড় থেকে ঝর্ণার পানি খাবার জন্য সমতলে নেমে আসে। কোন কোন ভাষ্যকার বলেন যে, উষ্ট্রী যখন ঝর্ণার সমস্ত পানি পান করে ফেলত তখন অন্য কোন উট বা উষ্ট্রী তার কাছে আসতে পারত না। অপর কয়েকজন ভাষ্যকার বলেন যে, আল্লাহতায়ালার মোজেজাস্বরূপ প্রেরিত এই উষ্ট্রীর এত প্রচুর পরিমাণ দুধ হত যে একটি সম্প্রদায়ের লোকদের জন্য যথেষ্ট হত। যখন এই বিশেষ উষ্ট্রীটি সমতলে ঘুমিয়ে থাকত অন্য কোন জীবজন্তু তার কাছে আসত না।

আল্লাহতায়ালা কর্তৃক প্রেরিত এই বিশেষ উষ্ট্রীকে লক্ষ্য করে নবী সালেহের (আ) সম্প্রদায়ের অনেকে পৌত্তলিকতা ছেড়ে দিয়ে একেশ্বরবাদী হয় এবং মহান আল্লাহর করুণা ও আশীর্বাদে বিশ্বাস স্থাপন করে। কিন্তু অধিকাংশ সা’মূদীয় অধিবাসী তাদের পূর্বপুরুষদের মূর্তিপূজায় নিয়োজিত থাকে। নবী সালেহের (আ) ধর্মপ্রচারের কিঞ্চিৎ সাফল্য দেখে জিঘাংসাপরায়ণ সামূদ জাতির অধিকাংশ সদস্য নবী সালেহের (আ) যিনি তাঁদের গোত্রভুক্ত ছিলেন, প্রতি তাদের আক্রোশ ও প্রতিহিংসা ঐ বিশেষ উষ্ট্রীর প্রতি প্রদর্শন করতে থাকে। গোত্র প্রধানগণ লক্ষ্য করে যে, উষ্ট্রীটি যতক্ষণ ঝর্ণার কাছে থাকে ততক্ষণ তাদের পালের উট ও মেষ পানি পান করতে পারে না। কিন্তু পূর্বে সূরা কামারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে ঝর্ণার পানি উষ্ট্রী এবং সা’দ গোত্রের পশু পালাক্রমে পান করবে এরূপ বিধান মহান আল্লাহ দিয়েছেন। কিন্তু কুচক্রী, লোভী ও ষড়যন্ত্রকারী সামূদ গোত্র প্রধানগণ ঝর্ণার সম্পূর্ণ পানি ভোগের জন্য উষ্ট্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। শুধু তাই নয় প্রভাবশালী গোত্র প্রধানগণ সাধারণ গোত্রীয় সদস্যদের পানি সরবরাহ বন্ধ করার চক্রান্ত করে। এর ফলে সামাজিক অনাচার ও অবিচারের সম্ভাবনা দেখা দেয়। নবী সালেহ (আ) সা’মূদ গোষ্ঠীর এহেন অবিচারের ভয়াবহ পরিণামের কথা বারবার বলেও তাদের ক্ষান্ত করতে পারেননি। নবী সালেহের (আ) সব সময় আশংকা ছিল যে পথভ্রষ্ট ও কুচক্রী সামূদ সম্প্রদায়ের লোকেরা আল্লাহর আশীর্বাদ ও নিদর্শনস্বরূপ এই উষ্ট্রীকে হত্যা করবে। সা’মূদ গোত্রীয় প্রধানগণ নবী সালেহের (আ) কাছে অভিযোগ করতে থাকে যে বিরাটাকার উষ্ট্রী ঝর্ণার পানি খেয়ে ফেলে, যার ফলে তাদের পানি সঙ্কটই দেখা দিচ্ছে না, বরঞ্চ কৃষিকাজ ব্যাহত হচ্ছে। এমতাবস্থায় তারা এই বিশেষ উষ্ট্রীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুর’আন শরীফে উল্লেখ আছে [সূরা হূদ ১১ : আয়াত ৬৪-৬৫]।

নবী সালেহ (আ) বলেন, “হে আমার সম্প্রদায়। আল্লাহর এই উষ্ট্রী তোমাদের জন্য একটি নিদর্শন। একে আল্লাহর জমিতে চরে খেতে দাও। একে কোন ক্লেশ দিও না। যদি তাকে কষ্ট দাও বা তার অনিষ্ট কর তবে তোমাদেরকে ভয়ানক শাস্তি প্রদান করা হবে।” নবী সালেহের (আ) উপদেশ বা সাবধানবাণীর তোয়াক্কা না করে সা’মূদ গোত্রীয় প্রধানগণ আল্লাহতায়ালার নিদর্শনস্বরূপ উষ্ট্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। আল্লাহর নিদর্শনস্বরূপ এই উষ্ট্রীকে বদ করার জন্য কারও সাহস হল না কারণ তাদের ভয় ছিল যে, এর ফলে তাদের উপর অভিসম্পাত বর্ষিত হবে। তখন কুচক্রীদল গোত্রের চরিত্রহীন মহিলাদের সাহায্য নিল। কোন কোন ভ্রষ্টানারী যুবকদের প্ররোচিত করতে লাগল তাদের সঙ্গদানের বিনিময়ে। সাদুক বিনতি মাহইয়া নামে এক ধনাঢ্য ও অভিজাত পরিবারের মহিলা ঘোষণা করল যে, যদি কোন যুবক উষ্ট্রীকে বদ করতে পারে তাহলে সে তার সঙ্গ লাভ করবে। মাসূরা ইবনে মহারাজ নামের এক যুবক উষ্ট্রীকে ধরে একটি খুঁটিতে বেঁধে রাখার দায়িত্ব গ্রহণ করল। আসিয়া নামে একজন কুচক্রী বৃদ্ধা কুদার ইবন সালিফ নামে এক যুবকের সাথে তার কন্যার সঙ্গদানের জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হল এই শর্তে যে, সে উষ্ট্রীকে হত্যা করবে। মাসূরা ও কুদারসহ সর্বমোট নয়জন যুবক উষ্ট্রী হত্যায় অংশগ্রহণ করে। পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা আন-নামলের (২৭) ৪৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “আর সেই শহরে ছিল এমন নয় ব্যক্তি যারা দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করত এবং শাস্তি প্রতিষ্ঠা করত না।”

এই নয়জন কুচক্রী পাহাড়ের কাছে গিয়ে গভীরভাবে উষ্ট্রীর গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকে। উঁচু পাহাড় থেকে উষ্ট্রী ধীরে ধীরে সমতলে ঝর্ণার দিকে যেতে থাকলে যুবকেরা অধীরীভাবে অপেক্ষা করতে থাকে। ঝর্ণার কাছে আসলে মাসূরা একটি তীর নিক্ষেপ করে উষ্ট্রীর পা জখম করে। আহত হয়ে উষ্ট্রীটি দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করলে ক্রমাগত তীর নিক্ষেপ করায় সে ধরাশায়ী হয়। এমন সময় অন্য একজন তার তরবারি দিয়ে উষ্ট্রীর অপর পায়ে আঘাত করলে সে মাটিতে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে এবং এই সুযোগে কুদার তরবারির আঘাতে তার গলা দ্বিখণ্ডিত করে। হত্যা করে যুবকবৃন্দ মহাআনন্দে শহরে প্রবেশ করলে তাদেরকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তাদের আপ্যায়ন করা হয় এবং তাদের উদ্দেশ্য করে কাব্য রচিত হয়। তারা নবী সালেহকে (আ) ব্যঙ্গ করে বলে যে, তিনি ত উষ্ট্রীকে বাঁচাতে পারলেন না। এর জবাবে পবিত্ৰ কুরআনে উল্লেখ আছে (১১ : ৬৫), “কিন্তু তারা তাকে (উষ্ট্রী) বধ করল। অতঃপর সে (নবী সালেহ) বলেন, তোমরা তোমাদের ঘরে তিন দিন জীবন উপভোগ কর। এটি এমন একটি প্রতিশ্রুতি যা মিথ্যা হবার নয়।

সা’মূদ গোত্রপতিগণ নবী সালেহকে (আ) জিজ্ঞাসা করল, “মাত্র তিন দিন কেন? শাস্তি দিতে হলে এখনই তা দিয়ে প্রমাণ করা হউক।” নবী সালেহ (আ) তাঁর সম্প্রদায়কে হেদায়েতের শেষ চেষ্টা করে বললেন, “হে আমার সম্প্রদায়, এখনও সময় রয়েছে। তোমরা পথভ্রষ্ট না হয়ে সৎপথে, বিশ্বাসের পথে আস। তোমরা তোমাদের পাপাচার ও কুকর্মের জন্য আল্লাহতায়ালার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি মহান ও ক্ষমাশীল। তোমাদের অনুশোচনা তিনি মেনে নিয়ে তোমাদের ক্ষমা করবেন।” (২৭ : ৪৬) এর জবাবে সা’মূদ সম্প্রদায়ের নেতারা বলল, “তোমাকে এবং তোমার সাথে যারা আছে তাদেরকে আমরা অমঙ্গলের কারণ মনে করি।” নবী সালেহ (আ) তখন বললেন, ‘তোমাদের ভালমন্দ আল্লাহতায়ালার এখতিয়ারভুক্ত; বস্তুত তোমরা এমন এক সম্প্রদায়ভুক্ত যাদেরকে (আ’দ ও লূতের সম্প্রদায়েরমত) পরীক্ষা করা হচ্ছে।”

পবিত্র কুরআন শরীফে বর্ণিত উষ্ট্রী হত্যার ঘটনা হাদিসেও পাওয়া যায়। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবন খাত্তাবের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, নবী করিম (স) ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে তাবুকে অভিযানকালে আল-হিজর বা পর্বতসঙ্কুল অঞ্চল দিয়ে অতিক্রম করেন। সূরা হিজরে (১৫) হিজরবাসীদের সম্বন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে। এই হিজর’ই ছিল সম্ভবত সা’মূদ জাতির বাসস্থান। মদিনা থেকে রওয়ানা হয়ে সেনাবাহিনীসহ রাসূলে করিম (স) উত্তরে তাবুকের কাছাকাছি আসার সময় তাঁর সাহাবী ও সেনাবাহিনীকে সাবধান করে দেন এই বলে যে, তারা যেন সামূদদের ধ্বংসস্তূপের দিকে না তাকায় এবং মহানবী একথা বলেও সাবধান করেন যে, তারা যেন সামূদদের মত পাপ কাজে নিমগ্ন না হয়। যে পাহাড়ের মাঝ থেকে মহান আল্লাহতায়ালা মোজেজা হিসাবে উষ্ট্রীকে প্রেরণ করেন সেখানে মুসলিম বাহিনী উপস্থিত হল। শাবকসহ উষ্ট্রী যে পাহাড়ি অঞ্চল থেকে সমতলে আসে তা ‘ফাজ’ (Faij) এবং ‘নাক্ত’ (Naqut) নামে পরিচিত। এখানে নবী করিম (স) তাঁর সমস্ত সাহাবী এবং সেনাবাহিনীকে একত্রিত হতে বললেন এবং তাদের উদ্দেশ্যে বললেন যে, আল্লাহতায়ালা পাপিষ্ঠদের এভাবেই শাস্তি দেন; তারা পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। সমবেত লোকদের কয়েকজন যে ঝর্ণা থেকে সা’মূদ জাতি পানি সংগ্রহ করত এবং যেখানে তারা উষ্ট্রীকে হত্যা করেছিল সেখান থেকে পানি আনার চেষ্টা করলে নবী করিম (স) তাদের ঐ ঝর্ণার পানি খেতে নিষেধ করেন এবং ঐ পানি দিয়ে রুটির জন্য মণ্ড তৈরি করতে নিষেধ করেন। এই নিষেধাজ্ঞার মূল কারণ এই যে, এই ঝর্ণার পানি পাপাচারে লিপ্ত বিধর্মী সামূদ জাতির লোকেরা ব্যবহার করে দূষিত করেছিল। নবী করিম (স) তাদের নবী সালেহের (আ) ব্যবহৃত কুয়া বা ঝর্ণা থেকে পানি আনতে বলেন কারণ আল্লাহর আশীর্বাদ ও নিদর্শনস্বরূপ উষ্ট্রী ঐ ঝর্ণার পানি খেয়েছিল। যে অঞ্চলের কথা বলা হয়েছে সে অঞ্চলটি ওয়াদি আর-কুরা নামে পরিচিত। দক্ষিণ আরব থেকে উত্তরে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত শমলা-সড়কের (Spice route) পাশে সামূদ সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল।

আরবদেশের প্রাচীন জাতি ও জনপদ যেমন সুসমৃদ্ধ ছিল ঠিক তেমনি একইভাবে সেগুলো বিধ্বস্ত হয়েছে। আদ ও লূত জাতির মত সামূদ জাতিও বিলুপ্ত হয়েছে এবং এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, সা’মূদ জাতি আ’দ জাতির উত্তরাধিকারী ছিল। এ কারণে সা’মূদ সম্প্রদায়কে দ্বিতীয় আ’দ জাতি বলা হয়ে থাকে। সা’মূদ জাতি যখন তার নবী সালেহের (আ) আবেদনে সাড়া দিল না এবং বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় অনাচার, অনৈতিক ও সামাজিক পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে তখন তাদের উপর আল্লাহতায়ালার অভিশাপ বর্ষিত হয়। বিধর্মী ও পাপিষ্ঠ জাতিদের ধ্বংস করা হয় এ ধরনের সাবধানবাণী দিয়ে, যাতে ভবিষ্যতে অপর কোন সম্প্রদায় পৌত্তলিকতা ও অসামাজিক কাজে জড়িয়ে না পড়ে। সামূদ সম্প্রদায় প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “এবং যখন আমার (আল্লাহর) নির্দেশ আসল তখন আমি সালেহ ও তার সঙ্গে যারা বিশ্বাস করেছিল তাদেরকে আমার অনুগ্রহে রক্ষা করলাম, তাদেরকে (রোজ কিয়ামতের) সেই দিনের লাঞ্ছনা থেকে রক্ষা করলাম। তোমার প্রতিপালক তো শক্তিশালী ও পরাক্রমশালী।” আ’দ জাতি ও লূত সম্প্রদায়ের মত সা’মূদ জাতিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দ্বারা ধ্বংস করা হয়। সূরা হূদের (১১) ৬৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “অতঃপর যারা সীমালঙ্ঘন করেছিল তাদের মহানাদ বা ভূমিকম্প আঘাত করে। এর ফলে তারা নিজ নিজ গৃহে নতজানু অবস্থায় বিধ্বস্ত হয়। তাদের এমনভাবে ধ্বংস করা হয় যে, যেন তারা সেখানে বসবাস করেনি।” সূরা কামারের (৫৪) আয়াত ৩০-৩১-এ বর্ণিত আছে, “কি কঠিন ছিল আমার (আল্লাহর) শাস্তি ও সতর্কবাণী। আমি তাদেরকে আঘাত হেনেছিলাম এক প্রচণ্ড ভূমিকম্প দিয়ে; এর ফলে তারা ছাগল-ভেড়ার খোঁয়াড় প্রস্তুতকারীর বহু দ্বিখণ্ডিত বিক্ষিপ্ত শুষ্ক শাখা পল্লবের মত হয়ে গেল।” সূরা শামসের (৯১) ১১ থেকে ১৪ নম্বর আয়াতে সা’মূদ সম্প্রদায়ের শেষ পরিণতির বিবরণ দেওয়া হয়েছে : “সা’মূদেরা অবাধ্যতাবশত তাদের নবীর (সালেহ) প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছিল। তাদের মধ্যে যে সর্বাধিক হতভাগ্য সে যখন তৎপর হয়ে উঠল, তখন নবী তাদেরকে বলল, আল্লাহর উষ্ট্রী ও তাকে (শাবক) পানি পান করার জন্য যত্নশীল হও। কিন্তু তারা (সা’মূদ জাতি) তার প্রতি মিথ্যা আরোপ করল এবং তাকে (উষ্ট্রী) কেটে ফেলল। তাদের পাপের জন্য তাদের প্রতিপালক তাদের সমূলে ধ্বংস করে একাকার করে দিলেন।” অনুরূপভাবে সূরা হাক্কার (৬৯) ৫ নম্বর আয়াতে সামূদ জাতির ধ্বংসের কথা উল্লেখ আছে, “সা’মূদ সম্প্রদায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে এক প্রলয়ঙ্কর বিপর্যয়ে।” সা’মূদ জাতির ধ্বংসের কথা সূরা যারিয়াতের (৫১) ৪৩ থেকে ৪৬ আয়াতে বর্ণিত আছে, “আরও নিদর্শন রয়েছে সা’মূদের বৃত্তান্তে যখন তাদের বলা হয় ভোগ কর স্বল্পকালের জন্য; কিন্তু তারা তাদের প্রতিপালকের আদেশ অমান্য করল। ফলে তাদের প্রতি বজ্রাঘাত হল এবং অসহায় অবস্থায় তারা তা পরখ করল।”

৪. আর-রাসের অধিবাসীবৃন্দ

কখনো কখনো এককভাবে আবার কখনো কখনো অন্য এক জাতি বা গোষ্ঠী প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন শরীফে আর-রাসের অধিবাসীদের কথা বলা হয়েছে। সূরা ফুরকান (২৫) ও সুরা কা’ফে পাপাচারে লিপ্ত, বিপথগামী ও অবিশ্বাসী অধিবাসীদের ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে। এ কথা বলা হয়েছে যে, নূহের সম্প্রদায় আ’দ ও সামূদ এবং আর-রাসের অধিবাসীবৃন্দের মত সত্যপ্রত্যাখ্যানকারী রাসের জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণরূপে শাস্তিমূলকভাবে ধ্বংস করা হয়েছে।

আ’দ ও সামূদ জাতির মত আর-রাসের জনপদ ও জাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। এ কারণে তাদের ভৌগোলিক অবস্থান সম্বন্ধে সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে ধারণা করা যায় যে, আ’দ ও সা’মূদ জাতির মত আর-রাস সম্প্রদায় আরব ভূখণ্ডের মরু অঞ্চলে বসবাস করত। পবিত্র কুরআন শরীফের অনুবাদকারী মুহাম্মদ আসাদ বলেন যে, মধ্য আরবের একটি প্রদেশে আর-রাস নামে একটি শহর রয়েছে। যদিও তা দেখে প্রাচীন আর-রাসের অধিবাসীদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। মুহাম্মদ আসাদের মতে, এতে বর্তমানে তেল আর-রাস অর্থাৎ রাস নামক পাহাড়, যা মধ্য-আরবের কাসিম অঞ্চলে অবস্থিত। এটি নেজদ প্রদেশের মধ্যভাগে এবং উনাইয়া শহর থেকে পঁয়ত্রিশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। এই শহরটিকে আরব উপদ্বীপের মধ্যস্থল ধরা হয়ে থাকে। এটি মক্কা এবং উত্তরে বসরার (ইরাক) সমদূরত্বে অবস্থিত।

জেরেমী সারফী এবং কনর বলেন যে, নাবলুসের উপরে গেরেজিন টাওয়ারের উত্তরের অংশের কথা এন্তোনীয় পিয়াসের (১৩৯-১৬১ খ্রিস্টাব্দ) রোমীয় কবির কবিতায় উল্লেখ আছে। সেখানে ফ্লভিয়া নিউপোলিস নামক স্থানে প্রাপ্ত একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, এখানে একটি সুউচ্চ মন্দির নির্মিত হয়েছিল। বিশেষজ্ঞগণ এই শহরটিকে আর-রাসের অধিবাসীদের প্রধান শহর বলে চিহ্নিত করেছেন।

গবেষকদের মধ্যে আর-রাসের অধিবাসীদের বংশ-পরিচয় সম্বন্ধে মতৈক্য নেই এবং তারা বিভিন্ন তথ্য পরিবেশন করে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেন। আর-রাসের জনগোষ্ঠী সম্বন্ধে পবিত্র কুরআন শরীফ ছাড়া, কোন ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্র থেকে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। এমনকি আর-রাস শব্দটির প্রকৃত অর্থ কি তাও সঠিকভাবে জানা যায় না। প্রখ্যাত দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক আল-রাজী আর-রাসের বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী তথ্য উল্লেখ করেন এবং অধিকাংশই কাল্পনিক ও ভিত্তিহীন বলে বাতিল করেন। ইউসুফ আলীও আর-রাসের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে ‘আর-রাস’ শব্দের অর্থ একটি বহু প্রাচীন কূপ অথবা ‘কানাত’ বা ভূমির বা মরুভূমির নিচে প্রবাহিত এক ধরনের ঝর্ণাধারা। অপর একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, কবরস্থান। খুব সম্ভবত আর-রাস একটি স্থান অথবা শহরের নাম। ইউসুফ আলী মনে করেন যে, সূরা আল-ফুরকানে (২৫) আ’দ ও সা’মূদ সম্প্রদায়ের সাথে আর-রাসের উল্লেখ থাকায় ধারণা করা হয় যে, এ তিনটি জাতি বা অধিবাসী সমসাময়িক ছিল। মনে করা হয়ে থাকে যে, আরব মরু অঞ্চলে আ’দ এবং সামূদ জাতিদের অভ্যুদয়ের মধ্যবর্তীকালে আর-রাস গোত্রের উদ্ভব হয় এবং তারা একটি প্রগতিশীল সমাজ ও সংস্কৃতি গড়ে তোলে, অবশ্য নূহ (আ)-এর আবির্ভাবের অনেক পরে। মার্মাডিউক পিকথাল বলেন যে, আর-রাস ইয়ামামা প্রদেশের একটি সমৃদ্ধিশালী শহর ছিল, যা বহুপূর্বে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আর-রাসের অধিবাসীদের বংশ লতিকা পাওয়া যায় না, তবে ধারণা করা হয় যে আরব বেদুঈন গোত্রের কোন উপ- গোত্র (clan) থেকে তাদের উদ্ভব হয়। তারা কত দিন রাজত্ব করে বা তাদের পৃথিবীতে কত দিন অবস্থিতি ছিল তার কোন সঠিক তথ্য জানা যায় না।

আবু বকর মুহম্মদ ইবন আল-হাসান বলেন যে, আর-রাসের অধিবাসিগণ অত্যন্ত ধনাঢ্য ছিল এবং তারা একজন সুশাসক ও জনহিতৈষী রাজা দ্বারা শাসিত ছিল। তাদের কোন অভাব ছিল না এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাদের বেশ অবদান রয়েছে। এই মহান ও সুযোগ্য শাসকের নাম জানা যায়নি। বিপথগামী ও পৌত্তলিক আর-রাসের অধিবাসীবৃন্দ পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তারা আল্লাহতায়ালার নির্দিষ্ট পথ পরিহার করে শয়তানের প্ররোচনায় নানা ধরনের কুকর্ম করতে থাকে। একদিন শয়তান ইবলিস তাদের কাছে উপস্থিত হয়ে বলে, “আমি এখনও মরিনি, আমি কিছুদিনের জন্য অনুপস্থিত ছিলাম তোমাদের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য।” একথা শুনে আর-রাসের অধিবাসীবৃন্দ খুবই খুশি হয় একথা মনে করে যে তাদের কোন অনিষ্ট হলে শয়তান তাদের রক্ষা করবে। শয়তান ইবলিস তাদেরকে তার (শয়তান) এবং অধিবাসীদের মধ্যে একটি পর্দা তৈরি করতে বলল এবং আরও বলল যে তার কোনদিন মৃত্যু হবে না (কুরআন শরীফে উল্লেখ আছে যে আল্লাহতায়ালা রোজ কিয়ামত পর্যন্ত শয়তান ইবলিসকে জীবন দান করেছেন)। শয়তানের কথা বিশ্বাস করে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহতায়ালার বন্দেগী ছেড়ে আর-রাসের অধিবাসীবৃন্দ শয়তানের উপাসনা বা আরাধনায় ব্যস্ত থাকল।

পথভ্রষ্ট আর-রাসের অধিবাসীবৃন্দ যখন শয়তানকে অধিক প্রাধান্য দিল তখন মহান আল্লাহতায়ালা তাদের হেদায়েতের জন্য একজন নবী পাঠালেন। তাঁর নাম হুজলা ইবন সাফওয়ান। তিনি আর-রাসের অধিবাসীদের শয়তানের প্রবঞ্চনা, প্রতারণা, প্ররোচনা ও ও কুপরামর্শ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন। হুজলা আল্লাহতায়ালার পথে তাদেরকে জীবনযাত্রা পরিচালনার জন্য আকুল আহ্বান জানান। কিন্তু কুচক্রী ও বৈরীভাবাপন্ন আর-রাসের অধিবাসীবৃন্দ নবী হুজলার পরামর্শ অগ্রাহ্য করে ইবলিসের উপাসনায় নিয়োজিত থাকল। শুধু তাই নয় হিংস্রপরায়ণ আর-রাসবাসী তাদের নিকট প্রেরিত নবীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তার মৃতদেহ একটি কুয়ায় ফেলে দেয়।

আর-রাসের অধিবাসীদের হিংস্রতা ও নৃশংসতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে তারা মহান সৃষ্টিকর্তা, প্রতিপালক, সর্বজ্ঞ এবং অন্তর্যামী আল্লাহতায়ালার অস্তিত্বই অস্বীকার করতে থাকে। এ কারণে আল্লাহতায়ালা তাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন ভূমিকম্প, শিলাবৃষ্টি, ঝড় দ্বারা সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দেন। পাপাচারে লিপ্ত আর-রাসের অধিবাসীদের শহর, ঘর-বাড়ি, অতুলনীয় অট্টালিকা বিধ্বস্ত হয় এবং তারা পৃথিবীর বুক থেকে এমনভাবে অবলুপ্ত হয় যে তাদের কোন নিদর্শনই আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

৫. লূত (আ)-এর সম্প্রদায় (সদুম ও গোমোরো)

পৃথিবীর অবলুপ্ত জাতিদের অন্যতম হচ্ছে নবী লূত (আ) (Lut)-এর সম্প্রদায়। তাদের মত অভিশপ্ত ও ধিকৃত সম্প্রদায় সম্ভবত দ্বিতীয়টি ছিল না। তারা একদিকে যেমন ছিল সমৃদ্ধশালী, অপরদিকে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জাতি, কারণ তারা ঘৃণ্য ও অস্বাভাবিক যৌনাচারে লিপ্ত ছিল, যা পবিত্র কুরআন শরীফে উল্লিখিত রয়েছে। তাদের পাপাচার তাদের উপর অভিসম্পাত ডেকে আনে এবং তারা প্রলয়ঙ্করী ঝড়, ভূমিকম্প, শিলাবর্ষণ প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আল্লাহতায়ালা লূতকে (আ) তাঁর সম্প্রদায়ের নবী হিসাবে প্রেরণ করেন এবং লূত (আ)-এর সম্প্রদায় প্যালেস্টাইনের পশ্চিমে Dead Sea-এর দক্ষিণাঞ্চলে বসবাস করত। যে প্রধান দুটি নগরীতে তারা বসতি স্থাপন করে, যার কোন চিহ্নই অবশিষ্ট নেই, তা হচ্ছে সদুম ও গোমোরো (Sodom and Gomorrah)। বাইবেলে সদুম ও গোমোরো সম্বন্ধে উল্লেখ রয়েছে। পবিত্র কুরআনে সদুম ও গোমোরোর উল্লেখ পাওয়া যায় না। এই দু’শহরের ঘৃণিত পথভ্রষ্ট পাপাচারে লিপ্ত অধিবাসীদের লূত (আ)-এর সম্প্রদায় হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

লূত (আ)-এর সম্প্রদায় যে Dead Sea-এর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বসবাস করত তার অপর নাম বাহর-ই-লূত। বাহর-ই-লূত-এর অর্থ লূত-এর সাগর। বর্তমান ইসরাইল এবং জর্দানের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত Dead Sea লবণাক্ত এবং এখানকার পানি এত ভারী ও লবণাক্ত যে কোন মানুষই এই সাগরে ডুবে না, ভেসে থাকে। এছাড়া এ স্থানটি ভূ-পৃষ্ঠের সর্বনিম্নস্তরে অবস্থিত সমুদ্র স্তর থেকে ১৩০০ ফুট নিচে। সদুম ও গোমোরো দুটি পাশাপাশি শহর (twin cittes) ছিল এবং Dead Sea-এর দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত ছিল, যা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। তুলনামূলকভাবে গোমোরো অপেক্ষা সদুম অধিকতর সমৃদ্ধিশালী নগরী ছিল এবং Dead Sea-এর খুব নিকটবর্তী শহর ছিল। ধারণা করা হয় যে, এ দুটি শহর Dead Sea-এর তলদেশে বিধ্বস্ত হয়েছে। লূত (আ)- এর সম্প্রদায়কে কাউম-ই-লূত বলা হয় এবং এই রাজ্যের রাজধানী ছিল সদুম। বর্তমানে ইসরাইলী রাষ্ট্রের অন্তর্গত লূত (আ)-এর রাজ্য ছিল খুব বড় এবং এই রাজ্যের মোট পাঁচটি শহরের মধ্যে প্রধান ছিল সদুম ও গোমোরো। পবিত্র কুরআন শরীফে শহরগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়নি তবে তালমুদ (ইহুদী) সূত্র থেকে জানা যায় যে, সে যুগে আ’দমা, জেবোইম ও জোয়ার বা বেলা নামে আরও তিনটি নগরী ছিল। এ পাঁচটি শহরের অবস্থান ছিল Dead Sea-এর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে, যা ‘আল-লিসান’ নামে পরিচিত ছিল। ‘আল-লিসান’ অর্থ উপদ্বীপ। ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিকদের মতে লূত (আ)-এর রাজ্য জর্দান নদীর অববাহিকা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার জাম্বেসী নদীর সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে সদুম ও গোমোরো ছিল খুবই স্বাস্থ্যকর ও আকর্ষণীয় শহর। Dead Sea-এর দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে লবণের পাহাড়ের মধ্যে (rock salt) অনেকগুলো মনুষ্যাকৃতি পিলার দেখা যাবে। এ সমস্ত পাথরের গঠন বা formation পশ্চিম উপকূলের দক্ষিণাংশে দেখা যায়। এখানে বিশালাকার লবণ পাহাড় অবস্থিত, যার নাম ‘জবল উসদুম’। লক্ষণীয় যে, উসদুম থেকেই সদুম শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। কোন কোন অতি উৎসাহী প্রত্নতাত্ত্বিকগণ মনুষ্যাকৃতি এই লবণের পিলারকে লূত (আ)-এর স্ত্রী বলে চিহ্নিত করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আল্লাহতায়ালার নিষেধ অমান্য করে সদুম গোমোরো থেকে দ্রুত প্রত্যাবর্তনের সময় লূত (আ)-এর স্ত্রী পিছন ফিরে তাকাবার জন্য তিনি একটি লবণ পাথরের মূর্তিতে পরিণত হন।

লূত (আ)-এর রাজ্য নামে অভিহিত Dead Sea-এর বিশাল দক্ষিণাঞ্চলে যে পাঁচটি শহরের নাম পাওয়া যায় তা কত প্রাচীন সে কথা সঠিকভাবে বলা যায় না। এর মূল কারণ এই যে অভিশপ্ত এ সমস্ত নগরীর কোন ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়নি যেহেতু Dead Sea-তে এ সমস্ত নিমজ্জিত হয়েছে অথবা প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে সমস্ত অধিবাসীসহ শহরগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। কোন প্রকার প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালিত হয়নি এবং প্রত্নকীর্তি কার্বন ১৪-ডেটিং (কেমিক্যাল পরীক্ষা) করা সম্ভব হয়নি। এতদসত্ত্বেও বিশেষজ্ঞগণ এ সমস্ত শহরগুলোর সময়কাল ব্রোঞ্জ যুগের মধ্যভাগ (আনুমানিক ২০০০-১৫০০ খ্রিস্টপূর্ব) নির্ধারিত করেছেন। যদিও Dead Sea-এর পানি এমন লবণাক্ত যাতে কোন উদ্ভিজ্জ জন্মায় না, ব্রোঞ্জযুগে মিঠা পানি প্রবাহিত হয়ে Dead Sea-তে পড়ত। এর ফলে আজকের শুষ্ক ও পাহাড়ি অঞ্চল তখন সুজলা-সুফলা, শস্য- শ্যামলা ছিল। জমির উর্বরতার দিকে লক্ষ্য রেখে নবী লূত (আ) এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন, যা জবল উসদুম নামে পরিচিত ছিল। এর অর্থ লবণাক্ত সাগর। এখানে প্রচুর পরিমাণে লবণ উৎপাদিত হত। নবী লূত (আ)-এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন, কারণ এ সময় তিনি এই এলাকায় মেষ চারণ করতেন এবং এখানে মানুষ ও পশুর জন্য প্রচুর পরিমাণ মিঠা পানি পাওয়া যেত।

সদুম ও গোমোরোর ভৌগোলিক অবস্থান সম্বন্ধে কোন কোন ঐতিহাসিক ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁরা বলেন যে, Dead Sea-এর উত্তরাঞ্চল ‘বাব আ’দ-দর-এ দুটি শহর অবস্থিত ছিল। কিন্তু এ অঞ্চলে ব্যাপক প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করে যে প্রত্নসম্পদ পাওয়া গিয়েছে তা পরীক্ষা করে জানা যায় যে, এগুলো ব্রোঞ্জযুগের আদি পর্বের (খ্রি. পৃ. ৩৩০০-১০০০)। কিন্তু ‘বাহর-ই-লূত’ অঞ্চলটি ব্রোঞ্জযুগের মধ্যবর্তীকালে সমৃদ্ধি লাভ করে। সুতরাং ‘বাব-আ’দ-দর’ এর সাথে ‘বাহর-ই-লূতের’ কোন সম্পর্ক নেই। সুতরাং এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, লূত (আ)-এর রাজ্যের পাঁচটি সমৃদ্ধশালী নগরী Dead Sea-এর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ছিল।

পবিত্র কুরআন শরীফে লূত-এর সম্প্রদায়ের সীমাহীন পাপাচার এবং অভিশপ্ত সম ও গোমোরো নগরী ধ্বংসের উল্লেখ আছে বিভিন্ন সুরায়। এ সমস্ত কুরআন সূত্রের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আল-আরাফ (৭), হূদ (১১), আল হিজর (১৫), আল-আনবিয়া (২১), আল-হজ্ব (২২), আশ-শুয়ারা (২৬), আল-নামল (২৭), আল-আনকাবুত (২৯), আস-সাফাত (৩৭), সা’দ (৩৮), আল-কামার (৫৪), আত্-তাহরিম (৬৬)।

আ’দ সম্প্রদায়ের নিকট যেমন লূত, সামূদ সম্প্রদায়ের নিকট যেমন সালেহ (আ), মিডিয়ানবাসীদের নিকট যেমন শোয়াইবকে পাঠানো হয়, আল্লাহতায়ালার একত্ববাদ প্রচারের জন্য তেমনি ঘৃণিত, অভিশপ্ত, পাপাচারে লিপ্ত লূত (আ)-এর সম্প্রদায়ের হেদায়েতের জন্য নবী লূতকে (আ) পাঠানো হয়। লূত (আ)-এর বংশ পরিচয় সম্বন্ধে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায়। তিনি হযরত ইব্রাহিমের (আ) ভ্রাতুষ্পুত্র ছিলেন এবং তিনি তার চাচার কাছে দীক্ষা লাভ করেন। হযরত ইব্রাহিম (আ) নব্য-ব্যাবিলনীয় বা ক্যালদানীয়দের রাজধানী উর-এ বসবাস করতেন। উর ইরাকের একটি প্রাচীন ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরী। লূত (আ)-তার চাচার কাছে ধর্মপ্রচারে দীক্ষা লাভ করেন তার সাহচর্যে এসে। হযরত ইব্রাহিম (আ) যখন উর ছেড়ে ধর্ম প্রচারের জন্য ফেরাউন শাসিত মিসরে যান তখন লূত তার সাথে ছিলেন। কোন এক পর্যায়ে মিসরে লূত ফেরাউনদের হাতে বন্দী হলে হযরত ইব্রাহিমের (আ) চেষ্টায় মুক্তি লাভ করেন। মিসর থেকে মেসোপটেমিয়ায় প্রত্যাবর্তন করার পর আল্লাহতায়ালা হযরত ইব্রাহিমের (আ) ভ্রাতুষ্পুত্র লূতকে (আ) তার সম্প্রদায়ের নবী হিসাবে পাঠান ‘বাহর-ই-লূতে’। নবী লূত চাচার আশীর্বাদ নিয়ে সদুম ও গোমোরোর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।

নবী লূত (আ) তাঁর সম্প্রদায়ে একেশ্বরবাদের বাণী প্রচার করতে থাকেন। তিনি হৃদ ও সালেহের মত স্বগোত্রীয় নবী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁর ধর্মপ্রচারে কর্ণপাত না করে নানা প্রকার অনাচার, পাপাচার, অসামাজিক ও নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। এ জঘন্য কুকর্মের জন্য লূত (আ)-এর সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা হয় তা হচ্ছে সমকামিতা; এছাড়া তারা ছিল লোভী, পরস্ব অপহরণকারী, ধোঁকাবাজ, অত্যাচারী, লুঠতরাজকারী। পূর্বোল্লিখিত সুরাসমূহে লূত সম্প্রদায়ের অস্বাভাবিক যৌনাচারের কথা বারংবার বলা হয়েছে। সূরা আরাফের (৭) ৮৪ থেকে ৯৪ আয়াতে বর্ণিত আছে যে, মহান, পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা লূতকে তার সম্প্রদায়ের নিকট পাঠান তাদের সৎ ও সরল পথে চলার আহ্বান জানাবার জন্য। লূত (আ) তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, “তোমরা এমন কুকর্ম করছ যা তোমাদের পূর্বে বিশ্বে কেউ করেনি। তোমরা কাম-তৃপ্তির জন্য নারী ছেড়ে পুরুষের নিকট যাও। তোমরা তো সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়।” অনুরূপভাবে সূরা লূতের (১১) ৭৭ থেকে ৮৩ আয়াতে বলা হয়েছে, “এবং যখন আমার (আল্লাহর) প্রেরিত ফেরেশতাগণ লুতের নিকট আসল তখন তাদের আগমনে সে (লূত) বিষণ্ন হল এবং নিজেকে তাদের রক্ষায় অসমর্থ মনে করল এবং বলল, এটি মহাসঙ্কট একটি নিদারুণ দিন।” এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, লূত-এর সম্প্রদায়কে পরীক্ষা করার জন্য মহান আল্লাহতায়ালা লূত-এর কাছে দুজন ফেরেশতা পাঠান। কিন্তু সমকামী লূত-এর সম্প্রদায়ের সম্ভাব্য হামলার কথা চিন্তা করে নবী লূত (আ) বিষণ্ন ও চিহ্নিত হয়ে পড়েন এবং তাদের রক্ষা করার মত তার সমর্থতা সম্বন্ধে সন্দিহান হন; কারণ লূত জানেন যে, তার পাপিষ্ঠ সম্প্রদায়ের লোকেরা জিঘাংসাপরায়ণ ও লম্পট।

যখন আল্লাহতায়ালার প্রেরিত দু’জন ফেরেশতা নবী লূতের (আ) কাছে আসল তখন সংবাদ পেয়ে লূতের সম্প্রদায় লূত (আ)-এর বাড়িতে ছুটে গেল, যেখানে ফেরেশতারা আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং বিশ্রাম করছিলেন। পবিত্র কুরআনের (১১ : ৭৮) বলা হয়েছে, “তার (লূত-এর) সম্প্রদায় তার নিকট উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে ছুটে আসল এবং পূর্ব থেকেই তারা কুকর্মে (সমকামিতায়) লিপ্ত ছিল।” সে (লূত) বলল, “হে আমার সম্প্রদায়, এরা আমার কন্যা (দু’জন) তোমাদের জন্য এরা পবিত্র। (প্রয়োজনে তোমরা বিবাহ করে এদের সঙ্গসুখ লাভ কর, যা হবে খুবই স্বাভাবিক ও সামাজিক) সুতরাং আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার অতিথিদের প্রতি অন্যায় আচরণ করে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন কর না। তোমাদের মধ্যে কি কোন ভাল মানুষ নেই?” (১১ : ৭৭-৭৮)।

প্রত্যুত্তরে লূত (আ)-এর সম্প্রদায় বলল, “তুমি তো জান, তোমার কন্যাদেরকে আমাদের প্রয়োজন নেই, আমরা কি চাই তা ত তুমি জানই।” এ ধরনের দাম্ভিক ও অশোভন আচরণে লূত (আ) তাঁর সম্প্রদায়ের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন এবং বলেন, “তোমাদের উপর যদি আমার শক্তি থাকত অথবা যদি আমি কোন শক্তিশালী দলের আশ্রয় নিতে পারতাম (তাহলে এ ধরনের কুকর্ম আমাকে প্রত্যক্ষ করতে হত না)।” ( ১১ : ৭৯-৮০ )

আল্লাহতায়ালার প্রেরিত ফেরেশতাগণ লূত (আ)-এর সম্প্রদায়ের নিকট ‘বাহর-ই- লূতে’ যাবার আগে হযরত ইব্রাহিমের (আ), যিনি লূতের (আ) চাচা, নিকট আগমন করে। হযরত ইব্রাহিম (আ) তাদের আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা জবাবে বলল, “আমাদেরকে এক অপরাধী সম্প্রদায়ের (লূত-এর সম্প্রদায়) বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হয়েছে।” ফেরেশতারা আরও জানাল যে, “লূতের পরিবারবর্গের বিরুদ্ধে নয়, আমরা অবশ্যই এদের সকলকে রক্ষা করব, কিন্তু লূতের স্ত্রীকে নয়, আমরা জেনেছি যে যারা ধ্বংস হবে সে অবশ্যই তাদের অন্তর্ভুক্ত।” (১৫ : ৫৭-৬০)

নবী লূতের (আ) কাছে যখন দু’জন ফেরেশতা আসল তখন তিনি তাদের চিনতে পারেননি এবং তাদের আগন্তুক মনে করে বলেন, “তোমরা তো অপরিচিত লোক।” জবাবে ফিরিশতারা তাদের পরিচয় দিয়ে বলেন যে, আল্লাহাতয়ালা তাদেরকে পাঠিয়েছেন পাপিষ্ঠ লূত-এর সম্প্রদায়ের জীবনপ্রণালী পরীক্ষার জন্য এবং আল্লাহর নিদর্শন হিসেবে তারা সাবধানবাণী নিয়ে এসেছেন। ফেরেশতারা বলল, “না, আমরা আগন্তুক বা অপরিচিত লোক নয়, বরং আল্লাহতায়ালা কর্তৃক প্রেরিত ফেরেশতা এবং তাঁর কাছ থেকে আপনার লূত (আ) কাছে সংবাদ নিয়ে এসেছি। তারা বলল, “তারা (লূত-এর সম্প্রদায়) যে শাস্তি সম্পর্কে সন্দিগ্ধ ছিল আমরা তোমার নিকট তাই নিয়ে এসেছি। আমরা তোমার নিকট সত্য সংবাদ নিয়ে এসেছি এবং আমরা সত্যবাদী।” (১৮ : ৬১-৬৪)

লূত-এর সম্প্রদায় সদুম ও গোমোরো শহরে বাস করত এবং দু’জন সুন্দর যুবা পুরুষের (ফেরেশতা) আগমন সংবাদে তারা লূতের বাড়িতে কামার্ত হয়ে ছুটে আসল। সূরা হিজরের (১৫) ৬৭ থেকে ৭২ আয়াতে ফেরেশতাদের প্রতি পাপিষ্ঠ লূত-এর সম্প্রদায়ের দুর্ব্যবহারের কথা পুনর্বার উল্লেখ করা হয়েছে; “নগরবাসীগণ উল্লসিত হয়ে উপস্থিত হলে লূত বললেন যে, “তাঁরা আমার সম্মানিত অতিথি। সুতরাং তোমরা আমাকে বে-ইজ্জত কর না। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর ও আমাকে হেয় প্রতিপন্ন কর না।” জবাবে তার সম্প্রদায়ের লোকেরা বলল, “আমরা কি দুনিয়ার লোককে আশ্রয় দিতে তোমাকে নিষেধ করিনি?” লূত বললেন, “একান্তই যদি তোমরা কিছু করতে চাও তবে আমার আমার কন্যাগণ রয়েছে।” আল্লাহতায়ালা এ মুহূর্তে বললেন, “তোমার জীবনের শপথ। তারা উম্মত্ত, উম্মাদ ও কর্তব্যবিমূঢ় হয়েছে।” (১৫ : ৬৭-৭২) এ কারণেই তাদের উপর অভিশাপ নেমে আসে।

সূরা শু’আরার (২৬) ১৬০ থেকে ১৭৫ আয়াতে লূতের (আ) সম্প্রদায়ের সীমাহীন লাম্পট্য ও কলুষিত যৌনাচার সম্বন্ধে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে। নৃত স্বীয় সম্প্রদায়ের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তার গোত্রীয় লোকেরা তাকে মিথ্যাবাদী বলে অভিহিত করে এবং তার প্রচারিত তাওহীদবাদের বাণীর প্রতি ভ্রূক্ষেপও করেনি। এ সমস্ত আয়াতের মর্মবাণী হচ্ছে যে, লূত তার সম্প্রদায়কে বললেন, “তোমরা কি সাবধান হবে না, আমি তোমাদের জন্য একজন বিশ্বস্ত রাসূল এবং তোমরা আমাকে মিথ্যাবাদী বললেও আমি আল্লাহতায়ালার বাণী প্রচার করব এবং এর প্রতিদানে তোমাদের কাছ থেকে আমি কিছুই চাই না, কারণ আমার প্রভু ও প্রতিপালক আমার জন্য পুরস্কার নির্ধারিত করে রেখেছেন।” এরপর নবী লূত (আ) তার বিপথগামী ও সমকামিতায় নিমগ্ন সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে বললেন, “মানুষের মধ্যে তোমরা তো কেবল পুরুষের মাঝে উপগত হও এবং তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য যে স্ত্রীগণকে সৃষ্টি করেছেন তাদেরকে তোমরা বর্জন করছ। তোমরা নিশ্চিতভাবে সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়।”

লূত (আ)-এর সম্প্রদায় এমনভাবে পাপে নিমগ্ন ছিল যে তারা ধৃষ্টতা ও লাম্পট্যের চরম শিখরে পৌছল। তারা লূত (আ)-এর উদ্দেশ্যে বলল, “হে লূত। তুমি যদি নিবৃত্ত না হও, তবে অবশ্যই তুমি নির্বাসিত হবে।” এর জবাবে লূত (আ) বললেন, “আমি তোমাদের এই কাজকে ঘৃনা করি এবং এর পরিণতি তোমরা ভোগ করবে।” অন্য এক সূরায় (আল-নাম্‌ল ২৭, ৫৪-৫৮) নবী লূত (আ) তার সম্প্রদায়ের পাপাচারে লিপ্ত লোকদের বলছেন, “তোমরা জেনেশুনে কেন পাপ ও অশ্লীল (সমকামিতা) কাজে জড়িত রয়েছে। তোমরা কি এতই অজ্ঞ জাতি যে প্রকৃতির বিধান লঙ্ঘন করে স্বাভাবিক যৌনজীবন যাপন না করে সমকামিতায় লিপ্ত থাকবে?” প্রত্যুত্তরে লূত (আ)-এর সম্প্রদায় বলল যে, লূত (আ) ও তার পরিবারকে সমাজচ্যুত করবে এবং তাদের জনপদ সদুম ও গোমোরো থেকে বহিষ্কার করবে। তারা লূতকে (আ) ভণ্ড ও মিথ্যাবাদীও আখ্যা দেয় এবং বলে যে, লোকদের দেখানোর জন্য লূত (আ) পবিত্র এবং আল্লাহতায়ালার রাসূল দাবী করছে। নবী লূতের (আ) কথা পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে সূরা কামারে (৫৪) ৩৩ থেকে ৩৯ আয়াতে। এখানে পাপিষ্ঠ লূত (আ)-এর সম্প্রদায়ের প্রতি কত ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তা বর্ণনা করা হয়েছে। এক পর্যায়ে বলা হয়েছে যে যখন লালসাগ্রস্ত ও পাপাচারে নিমগ্ন লূত (আ)-এর সম্প্রদায় নবীর বাড়িতে দু’জন সুপুরুষের উপর হামলা করতে উদ্যত হল তখন মহান আল্লাহতায়ালা তাদের অস্বাভাবিক যৌনাচারকে বন্ধ করার জন্য তাদেরকে অন্ধ করে দেন। ৩৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : “তারা (লূত-এর গোষ্ঠী) লূতের নিকট থেকে তার অতিথিদেরকে দাবী করলে আমি (আল্লাহতায়ালা) তাদের দৃষ্টিশক্তি লোপ করে দিলাম এবং বললাম, “আমার শাস্তি আস্বাদন এবং আমার সতর্কবাণীর বিরুদ্ধাচরণের পরিণাম ভোগ কর’।”

মহান আল্লাহতায়ালা প্রথম মানব সন্তান সৃষ্টি করেন এক টুকরো মাটি থেকে এবং তাকে নাম দেন আ’দম, যিনি মানবজাতির পিতা। আ’দমের নিঃসঙ্গতার জন্য করুণাময় আল্লাহ আ’দমের ডান পাঁজর থেকে বিবি হাওয়াকে সৃষ্টি করলেন এবং তাদের সন্তান- সন্ততি হাবিল ও কাবিল থেকে পৃথিবীতে মানুষের জন্ম হয় স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হবার পর। নারী ও পুরুষের স্বাভাবিক মিলনের মাধ্যমেই পৃথিবীর জনগোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন যে, “স্ত্রী পুরুষদের জন্য ভূমিস্বরূপ এবং

ক্ষ যেভাবে চাইবে সে ভূমি কর্ষণ করতে পারে।” শুধু একথাও নয় সূরা নিসায় বিবাহ বন্ধনের কতকগুলো নিয়ম বেঁধে দেওয়া হেেছ, বিশেষ করে কার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে এবং কার সাথে যাবে না। এই বৈবাহিক বন্ধনের কোন প্রকার ব্যতিক্রম মহান আল্লাহতায়ালার দৃষ্টিতে মহাপাপ এবং এই মহাপাপের পরিণতিও ভয়স্কর এবং পাপীদের অসহনীয় শাস্তি ভোগ করতে হবে। এই নারী-পুরুষের স্বাভাবিক ও সহজাত যৌন আকর্ষণের ব্যতিক্রম করেছিল সদুম ও গোমোরোর অধিবাসীবৃন্দ। তারা শুধুমাত্র সমকামীই ছিল না, লম্পট-পরস্ব অপহরণকারী হিসাবে তারা ধিকৃত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, সদুম শহরের নাম থেকে ‘Sodomy’ শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে, যার অর্থ ফ্রয়েডের মতে, সমকামিতা। এই অস্বাভাবিক পাপাচার লূত (আ)-এর সম্প্রদায়কে আল্লাহতায়ালা পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয় এবং আদ, সা’মূদ, মিডিয়ানদের মত তারাও অবলুপ্ত জাতিতে পরিণত হল।

পবিত্র কুরআন ও বাইবেলে নবী লূত-এর সম্প্রদায়কে অনাচার সম্বন্ধে বর্ণিত আছে। লূত (আ)-এর সম্প্রদায়ের নৈতিক অবক্ষয় এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে, তারা সকল প্রকার অসামাজিক, অশ্লীল ও নৈতিকতা বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। তাদের কুকর্মের অনেক বিবরণ পাওয়া যায়। একবার এক আগন্তুক বিদেশী ব্যবসায়ী সদুম নগরীতে আসে। পথে রাত হয়ে যাওয়ায় সে একটি গাছতলায় আশ্রয় নেয় এবং যেহেতু তার কাছে পর্যাপ্ত আহার ছিল সেহেতু সে কোন নাগরিকের আতিথ্য গ্রহণ করেনি। পাপের নগরী সদুমের একজন অধিবাসী একজন সুঠাম সুপুরুষকে দেখে কামার্ত হয়ে তাকে তার ঘরে রাতে আশ্রয় গ্রহণ করার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। বাধ্য হয়ে আগন্তুক-ব্যবসায়ী সদুমের অধিবাসীর গৃহে গিয়ে রাত্রিযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। গভীর রাতে আগন্তুক ঘুমিয়ে পড়লে বাড়ির মালিক তার গাধাটি চুরি করে এবং সেই সাথে লাগামটিও, যাতে সে পালিয়ে যেতে না পারে। এর কিছুক্ষণ পর ঐ ব্যক্তি আগন্তুকের ধন-সম্পত্তি ও মালামাল অপহরণ করে। সকালে ঘুম ভেঙে গেলে আগন্তুক তার গাধা ও মালামাল দেখতে না পেয়ে হতবাক হয়ে পড়ে এবং গৃহস্বামীকে তার গাধা ও মালসামানের কথা জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু গৃহস্বামীসহ নগরবাসীদের কেউ তার অভিযোগে কান দিল না, বরং তাকে অবিশ্বাস করল। তার এহেন নিঃস্বতা ও দুরবস্থায় কারও দয়া হল না। উপরন্তু, সদুমবাসী আগন্তুক ব্যবসায়ীকে নগর থেকে বহিস্কার করে দিল। নিঃস্ব ও রিক্ত অবস্থায় আগন্তুক শহর ছেড়ে চলে গেল। লুটপাট, রাহাজানি, পরস্বাপহরণ প্রসঙ্গে সূরা আল-আনকাবুতের (২৯) ২৯ নম্বর আয়াতে বর্ণিত রয়েছে “তোমরা কি পুরুষে উপগত হচ্ছ না? তোমরা তো রাহাজানি করে থাক এবং নিজেদের মজলিসে প্রকাশ্যে ঘৃণ্যকাজ করে থাক।” এর উত্তরে লূত-এর সম্প্রদায় বলল, “আমাদের উপর আল্লাহর শাস্তি আন যদি তুমি সত্যবাদী হও।” একথা শুনে লূত বললেন, “হে মহান আল্লাহ আমার প্রতিপালক, বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য কর।”

লূত (আ)-এর সম্প্রদায় ছিল খুবই সম্পদশালী এবং তারা এত লোভী ও অনাসৃষ্টিকারী ছিল যে তাদের পর্যাপ্ত ধন-সম্পদের অতিরিক্ত বিলাস-বাসনের জন্য রাজপথে বা কাফেলায় লূটতরাজ করত। এ ধরনের রাহাজানির কথা সূলা আল আন- কাবুতে উল্লেখ করা হয়েছে। লুটতরাজ করার পর লূষ্ঠিত ধন-সম্পদ এমনভাবে ভাগ করে নিত তারা যাতে অপহরণকারী সহজে ধরা না পড়ে। সম্পদের অধিকারী বা ভুক্তভোগী ব্যক্তি তা নিয়ে কোন প্রকার অভিযোগ করলে সদুমের লুণ্ঠনকারীরা বলত আমার কাছে খুব সামান্য সম্পদ রয়েছে। এভাবে ভাগ-ভাটোয়ারা করার ফলে লুণ্ঠিত মালামালের কোন হদিস পাওয়া যেত না। শুধুমাত্র লূটতরাজই নয় ধোঁকাবাজী ও চক্রান্ত করে সদুমের অধিবাসীবৃন্দ পথচারী, পর্যটক কাফেলার লোকদের আপ্যায়নের জন্য শহরে নিয়ে গিয়ে সর্বস্ব লুট করে নিত। একবার একজন কার্পেট ব্যবসায়ী মশলা পথ (Spice route) দিয়ে কাফেলাই যাচ্ছিল কিন্তু পথ ভুলে সদুম নগরীতে প্রবেশ করে রাত্রিযাপনের জন্য আশ্রয় চায়। এক কুচক্রী সদুমবাসী তাকে আশ্রয় দেয়। রাত্রে ঘুমন্ত অবস্থায় কার্পেট ব্যবসায়ী যে কার্পেটের উপর শয়ন করে সেটি চুরি হয়ে যায়। ব্যবসায়ী সদুম নগরীর গোত্র প্রধানের কাছে নালিশ করে কিন্তু তারা বলতে থাকে যে ব্যবসায়ী সত্য কথা বলছে না, বরঞ্চ স্বপ্নেই দেখেছে যে তার একটি কার্পেট ছিল। অগত্যা কার্পেট ব্যবসায়ী তার কার্পেটের মায়া ত্যাগ করে চলে গেল। উপরন্তু, সদুমবাসী মিথ্যা অভিযোগের শাস্তিস্বরূপ ব্যবসায়ীকে তিনটি রৌপ্য মুদ্রা জরিমানা দিতে বাধ্য করে।

সদুম ও গোমোরোর অধিবাসীদের অনাচার, অবিচার ও পাপাচার চরম সীমায় পৌঁছায়। সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তাদের মধ্যে সৎ‍ ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি দেখা যায়নি। এমন একটি জঘন্য নিকৃষ্ট ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়।

যদি কোন আক্রমণকারীর হামলায় কোন অন্তঃস্বত্ত্বা মহিলার গর্ভপাত হয় তাহলে বিচারক এরূপ শাস্তি দিত যে উক্ত মহিলা আক্রমণকারীর সঙ্গে ততদিন বসবাস করবে যতদিন না মহিলাটি পুনরায় অন্তঃস্বত্ত্বা হয়। এভাবে মৃত শিশুর জন্য অভিযোগকারিণীকে শাস্তি প্রদান করা হত।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে, একবার হযরত ইব্রাহিমের (আ) স্ত্রী সারাহ ইব্রাহিমের ভ্রাতুষ্পুত্র লূত (আ)-এর খোঁজ-খবরের জন্য বাহর-ই-লূতে অর্থাৎ সদুম ও গোমোরোতে একজন ভৃত্যকে পাঠান। ভৃত্য যখন সদুম নগরীতে প্রবেশ করল তখন সে একজন সদুমবাসীকে বিনা কারণে একজন আগন্তুককে উৎপীড়ন করতে দেখল এবং স্বাভাবিকভাবে এই অত্যাচারের প্রতিবাদ করল। এর ফলে অত্যাচারী সদুমবাসী ইব্রাহিমের ভৃত্যের উপর চড়াও হয়ে মারতে থাকে এমনভাবে যে সে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পায়। সদুমবাসী ছিল হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর, জালিম ও দাম্ভিক। সদুম ও গোমোরোসহ সকল শহরে ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ ছিল। হঠাৎ অন্য শহর থেকে একজন ভিক্ষুক সদুম নগরীতে এসে ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করে এবং ক্ষুধার্ত থাকায় খাবার চায়। কিন্তু সদুমবাসীরা এমন নিষ্ঠুর ছিল যে তারা ভিক্ষুককে ভিক্ষা বা আহার দিল না। ভিক্ষুকটি হাঁটতে হাঁটতে নবী লূত (আ)-এর বাড়ির কাছে আসলে লূত (আ)-এর কন্যা দয়াপরবশ হয়ে গোপনে ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেন। ভিক্ষা প্রদানের সময় সদুম নগরীর তিনজন যুবক তা প্রত্যক্ষ করে এবং গোত্রপতির নিকট ঘটনাটি জানিয়ে দেয়। এমতাবস্থায় লূত (আ)- এর কন্যাকে অভিযুক্ত করা হয় এবং তার শাস্তির বিধান করা হয়। লূত (আ)-এর কন্যাকে দান-খয়রাতের জন্য কি শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা যায় না। একটি মতবাদ অনুযায়ী তাকে ভিক্ষা দান থেকে বিরত থাকার জন্য সাবধান করে দেওয়া হয় এবং বলা হয় যে, যদি সে পুনরায় ভিক্ষা দেয় তাহলে তাকে শহর থেকে বহিষ্কার করা হবে। অপর একটি মতবাদ অনুযায়ী, যা বিশেষ করে ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লেখ আছে, লূত (আ)-এর কন্যা ভিক্ষুককে রুটি প্রদানের সময় ধরা পড়লে তাকে একটি বড় ধরনের রুটির মধ্যে পূরে তার উপর মধু মাখিয়ে দড়ি দিয়ে কোন বাড়ির আঙ্গিনায় ঝুলিয়ে রাখা হয়। এমতাবস্থায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে অথবা মৌমাছির দংশনে লূত (আ)-এর কন্যার মৃত্যু হয়। উল্লেখ আছে যে, এরূপ বীভৎস মৃত্যুর যন্ত্রণায় মেয়েটি যখন চিৎকার করছিল তখনই আল্লাহতায়ালা পাপ পঙ্কিলে নিমজ্জিত সদুম ও গোমোরোসহ মোট পাঁচটি বাহর-ই-লূত-এর জনপদ ধ্বংস করেন।

সদুম ও গোমোরোর অধিবাসীদের মাত্রাধিক লোভ ও লালসা তাদের অধঃপতনকে ত্বরান্বিত করে। তারা তাদের ধন-সম্পদ, সোনা-রূপা খুব যত্নসহকারে এবং গোপনীয়ভাবে সংরক্ষণ করত। স্বর্ণ যাতে চুরি না হয় সে জন্য তা সোনালী রঙের শস্যদানা গমে সোনালী প্রলেপ দিয়ে রাখত। তারা এমন পাপিষ্ঠ ছিল যে মৃতদেহের আবরণ বা কাফন খুলে নিয়ে মৃতদেহকে উলঙ্গ অবস্থায় সমাহিত করত। বিবেকবর্জিত কাজে অর্থলিপ্সা তাদের জীবনকে কলুষিত করে। তারা আগন্তুক পথচারী বিদেশী পর্যটক বা ব্যবসায়ীকে শহরের অভ্যন্তরে ডেকে নিয়ে তার সর্বস্ব লুট করত, যা পূর্বে বলা হয়েছে। কখনো কখনো প্রতারণা করে তারা আগন্তুককে ঘরে নিয়ে আসত স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য। যদি আগন্তুক বিশালদেহী হত এবং শয়নের চৌকী ছোট হত তাহলে তারা আগন্তুকের পা দুটো কেটে চৌকীর সাইজে করে দিত। যদি আগন্তুক কদাকার হত এবং চৌকী খুব বড় হত তাহলে তারা আগন্তুকের পা দুটো টেনে লম্বা করে দিত। এ সমস্ত ঘটনা কতটুকু সত্য তা সটিকভাবে বলা যায় না। যাহোক, এ সমস্ত ঘটনা দ্বারা এটিই প্রমানিত হয় যে, সদুম ও গোমোরো বা লূত (আ)-এর সম্প্রদায় ছিল অভিশপ্ত ও ধিকৃত। দয়াদাক্ষিণ্য বলে তাদের মধ্যে কিছুই ছিল না। কোন দুঃস্থ ব্যক্তি যদি সাহায্যের জন্য আসত তাহলে তারা তার নামে একটি সোনা বা রূপার পিণ্ড বরাদ্দ করত বাহ্যিকভাবে দেখাবার জন্য যে তারা দয়াশীল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা ছিল কুচক্রী ও নিষ্ঠুর। দুঃস্থ ব্যক্তিকে কোন প্রকার পানীয় বা আহার দেওয়া হত না, যার ফলে সে ‘অনাহারে মারা যেত। মারা গেলে মৃত ব্যক্তির নামে বরাদ্দকৃত সোনা বা রূপার দানা তারা নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যেত। এ ধরনের নৈতিক অবক্ষয় অপর কোন জাতির মধ্যে লক্ষ্য করা যায়নি।

মহান আল্লাহতায়ালা অবিশ্বাসী, সীমালঙ্ঘনকারী, উৎপীড়ক ও পাপাচারে লিপ্ত জাতিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়েছেন, যার জন্য আ’দ, সামূদ, মিডিয়ান এবং লূত (আ)-এর সম্প্রদায়ের কোন চিহ্ন আজ অবশিষ্ট নেই। তারা অভিশপ্ত ও অবলুপ্ত জাতি।। নবী লূত (আ) শত প্রচেষ্টা, আকুল আহ্বান ও ধর্মীয় প্রচারণা দ্বারা পাপিষ্ঠ সদুম ও গোমোরোর অধিবাসীদের আল্লাহতায়ালার পথে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের চোখ থাকতেও তারা অন্ধ, কান থাকতেও বধির, হৃদয় থাকতেও পাষাণ, বিবেক থাকতেও তারা বিবেকবর্জিত, লালসাগ্রস্ত, অস্বাভাবিক যৌনাচারে লিপ্ত, অভিশপ্ত জাতি। লূত (আ)-এর সম্প্রদায়কে ধ্বংস করার পয়গাম নিয়ে দুই ফেরেশতা প্রথমে হযরত ইব্রাহিমের (আ) সঙ্গে পরামর্শ করেন। পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা আন-কাবুতের (২৯) ৩১ থেকে ৩২ পর্যন্ত আয়াতে বলা হয়েছে : “যখন আমার (আল্লাহ) প্রেরিত ফেরেশতাগণ সুসংবাদসহ ইব্রাহিমের কাছে আসল তখন তারা বলল, ‘আমরা এই জনপদবাসীদেরকে ধ্বংস করব কারণ এর অধিবাসীরা সীমালঙ্ঘনকারী।’ একথা শুনে ইব্রাহিম (আ) বললেন, “এই জনপদে তো লূত রয়েছে, তারা (ফেরেশতাগণ) বলল, ‘সেখানে কারা আছে তা আমরা ভাল জানি; আমরা তো লূতকে ও তার পরিজনবর্গকে রক্ষা করবই; তবে তাঁর স্ত্রী ব্যতীত, সে তো ধ্বংসপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত।” এরপর ফেরেশতা দুজন সুপুরুষের বেশে লূত-এর নগরী সদুমে প্রবেশ করল এবং লূতকে যখন আসন্ন ধ্বংসের কথা জানাল তখন লূত (আ) খুব বিষণ্ন ও চিহ্নিত হয়ে পড়লেন। তিনি মনে করলেন যে, এই ধ্বংসলীলায় তিনি তার পরিবার-পরিজনসহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। কিন্তু ফেরেশতাগণ তাঁকে বলল, “ভয় কর না, দুঃখ কর না, আমরা তোমাকে ও তোমার পরিজনবর্গকে রক্ষা করব, তবে তোমার স্ত্রী ব্যতীত। কারণ (তার কুফরীর জন্য) সে ধ্বংসপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত।”

সূরা হূদের (১১ : ৮১ থেকে ৮৩) আয়াতে লূত-এর সম্প্রদায়ের বিপর্যয় এবং লূত ও তার পরিবার-পরিজনের রক্ষার কথা পুনরায় বলা হয়েছে; “তারা (ফেরেশতাগণ) বলল, ‘হে লূত। আমরা তোমার প্রতিপালক কর্তৃক প্রেরিত ফেরেশতা (কিন্তু যুবাপুরুষের বেশ ধারণ করে তোমার ঘৃণা ও পাপীষ্ঠ সম্প্রদায়ের পাপাচার পরীক্ষা করতে এসেছি) তারা (তোমার সম্প্রদায়) কখনই তোমার কাছে পৌঁছতে পারবে না। সুতরাং তুমি রাতের কোন এক সময় তোমার পরিবারবর্গসহ বের হয়ে পড়বে এবং তোমাদের মধ্যে কেউ পিছনে ফিরে তাকাবে না (ধ্বংসলীলা দেখার জন্য)। তাদের [লূত (আ)-এর সম্প্রদায়] যা ঘটবে তারও (লূত-এর বিধর্মী স্ত্রী) তাই ঘটবে। প্রভাত তাদের জন্য নির্ধারিত সময়। প্রভাত কি নিকটবর্তী নয়।” (১১ : ৮১)। সূরা হিজরের (১৫) ৫৮ থেকে ৬০ আয়াতে মোটামুটি একইভাবে ধ্বংসের সংকেত দেওয়া হয়েছে : “সে (ইব্রাহিম) বলল, “হে ফেরেশতাগণ! তোমাদের আর বিশেষ কি কাজ আছে?’ তারা (ফেরেশতাগণ) বলল, ‘আমাদেরকে এক অপরাধী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হয়েছে, লূতের পরিবারের বিরুদ্ধে নয়, আমরা অবশ্যই এদের সকলকে রক্ষা করব, শুধুমাত্র লূত-এর স্ত্রী ছাড়া কারণ আমরা জেনেছি যে, যারা ধ্বংস হবে সে (লূত-এর স্ত্রী) অবশ্যই তাদের অন্তর্ভুক্ত।” এভাবে মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর ফেরেশতার মাধ্যমে লূত-এর বিপদগামী স্ত্রী ছাড়া লূত এবং তাঁর পরিবার পরিজনকে রক্ষার জন্য রাতের শেষ প্রহরে অভিশপ্ত সদুম নগরী ত্যাগ করে তাদের নির্দেশিত পথে চলে যেতে বলেন এবং একথাও বলা হয় যে যদি কেউ পিছনে ফিরে তাকায় তাহলে সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।

প্রত্যাদেশ পাওয়ার পর নবী লূত (আ), তাঁর স্ত্রী, পরিবার পরিজনসহ রাতের অন্ধকারে, অভিশপ্ত সদুম নগরী থেকে রওয়ানা হলেন। তারা শহরের উপকণ্ঠে পৌছলেন এবং তারা আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক পিছনে ফিরে তাকাননি। তখন প্রায় প্রত্যুষ হতে চলেছে এবং সূরা হিজরের (১৫) ৬৬ আয়াতের বর্ণনা অনুযায়ী, “আমি (আল্লাহ) লূতকে জানিয়ে দিলাম যে, প্রত্যুষে তাদের (পাপিষ্ঠ লূত-এর সম্প্রদায়) সমূলে ধ্বংস করা হবে।” নগরপ্রান্তে ঊষা সমাগত হতেই ধ্বংসলীলা শুরু হয়ে যায় এবং আল্লাহতায়ালার গজব তাদের উপর ভয়ঙ্করভাবে পড়তে থাকবে। কিন্তু চলার পথে লূত (আ)-এর স্ত্রী কৌতূহল বশে ধ্বংসলীলা দেখার জন্য পিছনে ফিরে তাকাবার সাথে সাথে তিনি ধ্বংসপ্রাপ্ত হন। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি সাথে সাথে লবণের পাথরের পিলারে (মনুষ্যাকৃতি) (rock salt pillar) পরিণত হন। বাইবেলে বর্ণিত হলেও পবিত্র কুরআন শরীফে এ ধরনের মনুষ্যাকৃতি পিলারের উল্লেখ নেই। Dictionary of Bible and Religion-এর (P. 627) উল্লেখ আছে, “It is just a myth. In fact Lot’s wife in her pillar of salt remains forever petrified in the reeling of legend.” “লূত-এর স্ত্রীর নারীরূপে পাথরের পিলারে পরিণত হবার ঘটনা সম্পূর্ণরূপে অলীক ও রূপকথা।” রূপক অর্থে মনে করা হয় যে, “এ ধরনের লবণের পাথরের পিলারে বা স্তম্ভে লূতের স্ত্রী চিরকালের জন্য রূপকথার গল্প হিসাবে চিরবন্ধী হয়ে রয়েছেন।” প্রকৃতপক্ষে লূত (আ)-এর স্ত্রী বিধর্মী ছিলেন এবং এক আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না। উপরন্তু, তিনি লূত-এর পাপিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সদস্য হিসাবে অবাধ্য, উচ্ছৃঙ্খল ও কুচক্রী ছিলেন। কথিত আছে যে, যুবাপুরুষের বেশে দু’জন ফেরেশতা, নবী লূত (আ)-এর গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করলে লূত-এর কন্যাদ্বয় তাদের আপ্যায়ন করেন। কিন্তু লূত (আ)-এর স্ত্রী তার স্বগোত্রীয় লোকদের, যারা সমকামী হিসাবে ধিকৃত, যুবপুরুষদের আসার সংবাদ দেন। যাহোক, আল্লাহতায়ালার নির্দেশে নবী নূহের (আ) স্ত্রীর মত লূত (আ)-এর স্ত্রীও ধ্বংসপ্রাপ্ত হন।

সূরা আত-তাহরীমে (৬৬) ১০ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে, “আল্লাহ সত্যপ্রত্যাখানকারীদের জন্য নূহ ও লূতের স্ত্রীর দৃষ্টান্ত উপস্থিত করছেন। তারা ছিল আমার দুই সৎকর্মপরায়ণ দাসের অধীন। কিন্তু তারা তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, ফলে নূহ ও লূত তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারল না এবং তাদেরকে বলা হল, জাহান্নামে প্রবেশকারীদের সাথে তোমরাও সেখানে প্রবেশ কর।”

পৃথিবীর ইতিহাসে রোমীয় যুগের শেষার্ধে ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতে সুসমৃদ্ধ পাম্পে ও হারকুলানিয়াম শহর দু’টি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় চোখের নিমেষে এবং এমনভাবে ধ্বংসযজ্ঞ হয় যে নগরবাসী পালাবার সময় পর্যন্ত পায়নি। বর্তমানে খনন করে এ দু’টি নগরীর ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া বহু নর-নারী ও শিশুর মূর্তি বা কঙ্কাল পাওয়া গেছে, যা লাভায় জমাট বেঁধে মমী হয়ে রয়েছে। এছাড়া নগরবাসী যে যেমন অবস্থায় ছিল কেউ ঘুমন্ত অবস্থায়, কোনটি মা শিশুকে স্তন্যপান অবস্থায়। ভিসুভিয়াসের উত্তপ্ত গলিত লাভায় মৃত্যুবরণ করে এ সমস্ত মৃতদেহ যেন মমী হয়ে রয়েছে। এ ধরনের অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিকম্প, শিলাবৃষ্টি, প্রবল বর্ষণ, মহানাদ প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়েছে বহু অভিশপ্ত জনপদ, যা অবলুপ্ত। মহান আল্লাহতায়ালা দৃষ্টান্তস্বরূপ পাপীদের উপর এরূপ লানৎ বর্ষিত করেন যাতে তারা কুফরীর পথ পরিহার করে সত্য, ন্যায় ও একেশ্বরবাদের পথে চলতে পারে। লূত (আ)-এর সম্প্রদায়ের ধ্বংস ছিল তাৎক্ষণিক এবং সমূলে বিনাশ (instant)। বিভিন্ন সূরায় সদুম ও গোমোরোর ধ্বংসের কথা উল্লেখ আছে। সূরা ‘আ’রাফের (৭) ৮৪ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে, “তাদের উপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলাম; সুতরাং অপরাধীদের পরিণাম কি হয়েছিল তা লক্ষ্য কর।” সূরা হূদের (১১) ৮২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “অতঃপর যখন আমার আদেশ আসল তখন আমি নগরগুলোকে (সুদম, গোমোরো) উল্টিয়ে দিলাম এবং তাদের উপর ক্রমাগত বর্ষণ করলাম কংকর।

প্রথম সূরায় ঝড়-ঝাপটা প্রবল বর্ষণের কথা বলা হলেও দ্বিতীয় সূরায় ভূমিকম্প ও শিলাবৃষ্টির উল্লেখ করা হয়েছে। ‘সিজ্জিল’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ প্রচণ্ড শক্ত, বরফের শিলা (brimstone)। সূরা আস-শু’আরার (২৬) ১৭৩ আয়াতে বলা হয়েছে, “তাদের উপর শাস্তিমূলক বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলাম, যাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল তাদের জন্য এই বৃষ্টি ছিল কত নিকৃষ্ট।” সূরা কামারের (৫৪) ৩৪ নম্বর আয়াতেও বর্ষণের কথা বলা হয়েছে, “আমি তাদের উপর প্রস্তরবহনকারী প্রচণ্ড ঝটিকা প্রেরণ করেছিলাম, কিন্তু লূত পরিবারের উপর নয়, তাদের আমি উদ্ধার করেছিলাম শেষ রাত্রে (লূত-এর স্ত্রী ছাড়া)। প্রত্যুষে বিরামহীন শাস্তি তাদের আঘাত করল।” (৫৩ : ৩৪, ৩৮)

সম্ভবত সদুম ও গোমোরোর মত অপর কোন প্রাচীন অবলূপ্ত স্থান প্রত্নতাত্ত্বিক, ভূতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিকদের অধিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। পবিত্র কুরআন, বাইবেল (ওল্ড টেস্টামেন্ট) ছাড়াও বিভিন্ন গ্রন্থে, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণালব্ধ সূত্র থেকে সদুম ও গোমোরো ধ্বংসলীলা জানা যায়। এ দুটি অভিশপ্ত ও বিলুপ্ত জমজ বা twin শহরের ন্যায় এত অল্প সময়ে এবং ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগে অন্য কোন শহর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়নি। বাইবেলের সূত্রে জানা যায় যে, জোয়ার ছাড়া লূত (আ)-এর সম্প্রদায়ের পাঁচটি পাপ- নগরী (sin city) সাতদিন এবং সাতরাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত ও ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। অবশ্য পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে যে, পাপিষ্ঠ সদুম ও গোমোরোর অধিবাসীগণকে তিনটি দিন তাদের বুদ্ধি বিবেচনা দ্বারা নিজেদের যাচাই করার সময় দেওয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে যদি তারা পাপের পথ ত্যাগ না করে এবং অবিশ্বাসীই থেকে যায় এবং ঘৃণ্য যৌনাচার থেকে বিরত না হয় তাহলে তাদের উপর আল্লাহতায়ালার অভিসম্পাত বর্ষিত হবে। সদুম ও গোমোরোর মত সুসমৃদ্ধ নগরী এত দ্রুত ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় যে, বিশেষজ্ঞগণ ও পুরাতাত্ত্বিকগণ এ নিয়ে গবেষণা করেন এবং প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালিত করেন। লূত (আ)-এর সম্প্রদায় সদুম ও গোমারোর এমন সুসমৃদ্ধ ও সুষমামণ্ডিত নগরীতে বসবাস করত, যা সুমেরীয় যুগের উর অথবা নিপ্পুর এবং ব্যাবিলনীয় যুগের ব্যাবিলনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। যীশু খ্রিস্টের সমসাময়িক (২০০ বছর পূর্বে) ঐতিহাসিক জোসেফাস মনে করেন যে, Dead Sea-এর দক্ষিণে সদুম, গোমোরো, আ’দমা, জেবোইম এবং বেলা (বা জোয়ার)-এর ধ্বংসস্তূপ অনুসন্ধান করলে পাওয়া যাবে। পরবর্তীকালের ঐতিহাসকিদের ধারণা যে ভৌগোলিক ও ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের ফলে ভূমিকম্প, প্রবল শিলাবৃষ্টি, তুফান প্রভৃতি কারণে এ সমস্ত শহর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে এবং Dead Sea-এর মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছে। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে পল ল্যাপ এই অঞ্চলে খনন করে একটি বিরাট শহরের ভিত্তি আবিষ্কার করেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে ওয়াটার রাস্ত এবং থমাস শুয়ার নামে দু’জন মার্কিন প্রত্নতাত্ত্বিক Dead Sea-এর দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে খনন পরিচালনা করে চারটি জনপদের সন্ধান পান। এ সময় প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান আরবি নামে অভিহিত যথা, নূমেরা (গোমোরো), আসসাফী, ফাইরে এবং খানাযিব।

বাব-ই-দহর এবং নূমেরায় খনন কাজ পরিচালনা করে রাস্ত এবং শুয়ার সিদ্ধান্তে আসেন যে, এ দু’টি অঞ্চলই ছিল প্রাচীন সদুম ও গোমোরো। যদিও বর্তমানে এ অঞ্চল লবণাক্ত এবং ফসল উৎপাদনের অনুপযুক্ত কিন্তু ধারণা করা হয় যে, খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে এ অঞ্চল ছিল খুবই উর্বর এবং কৃষিকাজের উপযোগী। বর্তমানে জেরুজালেমের ইসরাইলী জাদুঘরের Rothchild Miscellany Collection – এ পঞ্চদশ শতাব্দীর একটি মিনিয়েচার রয়েছে। এই ছবি দেখে প্রতীয়মান হয় যে, প্রাচীর বেষ্টিত বিশাল ও প্রসিদ্ধ সদুম নগরী সুউচ্চ অট্টালিকা ও মন্দির দ্বারা শোভিত ছিল। আকস্মিকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত এই সমস্ত নগরগুলোর কোন চিহ্ন নেই। এতদসত্ত্বেও সূরা আল-হিজরের (১৫) ৭৩ থেকে ৭৭ আয়াতে বলা হয়েছে, “অতঃপর সূর্যোদয়ের সাথে সাথে মহানাদ তাদের আঘাত করল এবং আমি (আল্লাহ) নগরগুলোকে উল্টিয়ে দিলাম ( turned upside down) এবং তাদের উপর কংকর বর্ষন করলাম। অবশ্যই এতে পর্যবেক্ষণ শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। যে পথে লোক চলাচল করে তার পাশে তাদের ধ্বংসস্তূপ এখনও বিদ্যমান। অবশ্যই এতে বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।”

ভূতাত্ত্বিকগণ Dead Sea বা মৃত সাগরের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে জরিপ পরিচালনা করে সিদ্ধান্তে আসেন যে সাদুম ও গোমোরোর ধ্বংসের মূলে ছিল আগ্নেয়গিরি থেকে উৎক্ষিপ্ত গলিত লাভা, এর সাথে প্রচণ্ড ভূমিকম্প, শিলাবৃষ্টি, প্রলয়ঙ্করী ঝড় (winnowing wind), যা নিমেষে সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। সদুম ও গোমোরোর ধ্বংসলীলার সাথে প্লেটো কর্তৃক বর্ণিত গ্রিসের উপকূলে আটলান্টিস দ্বীপের ধ্বংসযজ্ঞের তুলনা করা যায়। সদুম ও গোমোরোর ধ্বংসের অনেক পরে (খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে) এই নগরী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১৪৫০ অব্দে সুসমৃদ্ধ আটলান্টিস নগরী ভূমিকম্পে সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হয়। সমুদ্রের তলদেশে অনুসন্ধান করে বিধ্বস্ত নগরীর ইমারতসমূহের ভগ্নপ্রাপ্ত অসংখ্য পাথরের খণ্ড পাওয়া গিয়েছে।

৬. মাদিয়ান সম্প্রদায়

আ’দ, সামূদ এবং আর-রাস সম্প্রদায়ের মত প্রাচীন আরবের অন্যতম অবলুপ্ত জাতি হচ্ছে মাদিয়ান। সমৃদ্ধিশালী আ’দ এবং সামূদ সম্প্রদায়ের ধ্বংসের অব্যবহিত পরে আরব ভূ-খণ্ডের উত্তরে সিরিয়া-প্যালেস্টাইন অঞ্চলে মাদিয়ান সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হয়। পবিত্র কুরআন শরীফ এবং বাইবেলে মাদিয়ানদের উত্থান ও পতনের উল্লেখ আছে। বিপদগামী মাদিয়ানদের হেদায়েতের জন্য মহান আল্লাহতায়ালা নবী শোয়েবকে পাঠান, ঠিক যেমনভাবে আদ সম্প্রদায়ের নিকট নবী হূদ (আ) এবং সামূদ সম্প্রদায়ের (আ) নিকট নবী সালেহকে (আ) প্রেরণ করা হয়। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাতে মাদিয়ানদের ইসমাইলী, মতান্তরে ইসরাইলী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যার উল্লেখ ওল্ড টেস্টামেন্টে পাওয়া যায়। মাদিয়ানগণ যাযাবর জাতি ছিল এবং সম্ভবত তারা আকাবা উপসাগরের পূর্বাঞ্চলে বসবাস করত। মাদিয়ানদের প্রধান জীবিকা ছিল যাযাবর জাতির মত যত্রতত্র ভ্রমণ করা, কাফেলার সাহায্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করা এবং কখনো কখনো লুঠতরাজ করা। মাদিয়ান সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয় সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ত্রয়োদশ শতাব্দীতে।

ঐতিহাসিকদের মতে, মাদিয়ান সম্প্রদায় মোয়াব এবং এডম-এর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে একটি বিশাল এলাকায় বসবাস করত। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে তাদের নির্মিত সমৃদ্ধিশালী একটি শহরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এই শহরটির নাম তিমনাহ্। এখানে প্রাচীন মিশরীয় মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে এবং পাথরের একটি মন্দির কোন এক সময়ে এখানে নির্মিত হয়। আবুল আ’লা আল-মওদুদীর মতে, মাদিয়ানদের রাজ্য হিজাজের উত্তর-পশ্চিম এবং লোহিত সাগর ও আকাবা উপসাগরের দক্ষিণে অবস্থিত ছিল। ধারণা করা হয় যে, তাদের রাজ্যের সীমানা সাইনাই উপদ্বীপের উত্তর সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মাদিয়ান সম্প্রদায় খুবই বিত্তশালী ছিল এবং এর মূল কারণ ছিল এই যে, ইয়েমেন থেকে মক্কা ও ইয়ারবু হয়ে সিরিয়া পর্যন্ত লোহিত সাগরের উপকূল দিয়ে যে বানিজ্যপথ (কাফেলা) ছিল তার সঙ্গমস্থলে মাদিয়ানদের শহরগুলো অবস্থিত ছিল। এ কারণে আরব ব্যবসায়িগণ মাদিয়ান সম্প্রদায় সম্বন্ধে অবগত ছিল এবং দক্ষিণ আরব থেকে উত্তরে সিরিয়া পর্যন্ত যে ‘মশলা পথ’ (Spice route) ছিল তার মধ্যে মাদিয়ানদের প্রাচীন কীর্তির ধ্বংসাবশেষ কাফেলায় গমনকারী আরব ব্যবসায়িগণ লক্ষ্য করেন। মাদিয়ানদের সম্বন্ধে গ্রিক, রোমীয় ও আরব সূত্র থেকে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া গিয়েছে।

মাদিয়ান সম্প্রদায়ের সঠিক বংশ-পরিচয় জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয় যে, তারা আরব বেদুঈনদের মত যাযাবর জাতি ছিল, অর্থাৎ কোন একটি বিশেষ স্থানে তারা দীর্ঘদিন বসবাস করত না। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে, মাদিয়ানগণ কেতুরার মাধ্যমে নবী ইব্রাহিমের (আ) বংশধর ছিলেন। কেতুবা সম্ভবত ছিলেন নবী ইব্রাহিমের (আ) তৃতীয় স্ত্রী। কেতুবার গর্ভে মাদিয়ান নামে একটি পুত্রসন্তান জন্ম হয় এবং তার নামানুসারে এ সম্প্রদায়ের নাম হয় মাদিয়ান এবং তাদের প্রতিষ্ঠিত রাজ্যও মাদিয়ান নামে পরিচিতি লাভ করে।

মাদিয়ান সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায় পবিত্র কুরআন শরীফের বিভিন্ন সুরায় যেমন- আল-আরাফ (৭), আত-তাওবা (৯), হ্রদ (১১), আল-হিজর (১৫), তাহা (২০), আল-হাজ্জ (২২), আস-শুয়ারা (২৬), আল-কাসাস (২৮), আল-আন-কাবুত (২৯), সা’দ (৩৮)।

মাদিয়ান সম্প্রদায়ের প্রাচুর্য ও বৈভব এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে, তা অকল্পনীয়। এর ফলে তারা ক্রমশ হয়ে উঠে দাম্ভিক, পথভ্রষ্ট, বিবেকহীন এবং তারা মূর্তিপূজা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক এবং নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপ করতে থাকে। মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআন শরীফের বিভিন্ন সূরায় তাদেরকে তাদের কুকর্ম ও পাপাচার থেকে বিরত থাকার জন্য আদেশ করেন এবং তাদের হেদায়েতের অর্থাৎ সৎ পথে চলার জন্য তাদের মধ্য থেকে একজন নবী প্রেরণ করেন, যিনি শোয়াইব (আ) নামে পরিচিত ছিলেন। মাদিয়ান সম্প্রদায়ের ধ্বংসের মূলে যে সম্প্রসারণ উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে বিশেষভাবে তাদের ধৃষ্টতা, অসাধুতা, নৈতিকতাবিরোধী কার্যকলাপ, পাপাচার, অনাচার ও অংশীবাদী বিশ্বাস প্রধান। মুনাফাখোরী মনোবৃত্তির ফলে অসাধুতা প্রাধান্য পায় এবং এজন্য পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে; “মাপ ও ওজন ঠিক দিবে”, “বিক্রতাকে তার প্রাপ্য বস্তু থেকে বঞ্চিত করবে না।” এ ধরনের অসাধুতার ফলে সাধারণ লোক প্রতারিত হয় ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এ ধরনের দুর্নীতি ও অসামাজিক কার্যকলাপ জনগণের মধ্যে সন্তোষের সৃষ্টি করে ও বিশৃঙ্খলার সূত্রপাত করে। পবিত্র কুরআন শরীফে মাদিয়ান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার, অবিশ্বাস, লুঠতরাজের প্রবণতার অভিযোগ আনা হয়েছে। অর্থলোভ ও অসাধুতা মাদিয়ান সম্প্রদায়কে আল্লাহর নির্দেশিত পথ থেকে দূরে রেখেছিল এবং একেশ্বরবাদের স্থলে অংশীবাদী বিশ্বাসে প্ররোচিত করেছিল। তাদের সীমাহীন ঔদ্ধত্য এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে, তারা তাদের গোত্র থেকে প্রেরিত নবী শোয়াইবকে মিথ্যাবাদী বলে আখ্যায়িত করে। অসৎপথে অর্জিত অর্থ দিয়ে মাদিয়ানবাসী যে প্রাসাদ ও দেবালয় নির্মাণ করে তাও ছিল তাদের শঠতার প্রতীক। প্রতারণা ও প্রবঞ্চনা করে তারা যে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছিল, তাও ছিল অবৈধ। মাদিয়ান সম্প্রদায়ের পাপাচার এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে, আল্লাহতায়ালা সূরা আল-হিজরে (১৫) তাদের ‘আসহাব আল-আইকাত’ বা আইকাত সম্প্রদায় বা সীমালঙ্ঘনকারী বা পাপাচারে লিপ্ত সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

সীমাহীন অনাচার, দূর্নীতি, অসাধুতা এবং অবিশ্বাসে মাদিয়ান সম্প্রদায় যখন দিন কাটাচ্ছিল তখন মহান আল্লাহতায়ালা তাদের সম্প্রদায়ের একজন সদস্যকে নবী হিসাবে তাদের কাছে পাঠান তাদের পথ নির্দেশের জন্য। শোয়াইব (আ)-কে মাদিয়ানবাসীদের একজন ভাই হিসাবে বলা হয়েছে। ইউসুফ আলী যথার্থই বলেন যে, তিনি হযরত ইব্রাহিমের (আ) চতুর্থ বংশধর ছিলেন এবং তিনি হযরত মুসার (আ) শ্বশুর ছিলেন। ওল্ড টেস্টামেন্টে শোয়াইবকে Jethro বলা হয়েছে। আল্লাহতায়ালার প্রেরিত পুরুষ হিসেবে শোয়াইব (আ) তাঁর স্বগোত্রীয় সম্প্রদায়ের নিকট আল্লাহতায়ালার বাণী প্রচার করতে শুরু করেন।

শোয়াইব (আ) তাদের বলেন, “হে আমার সম্প্রদায়। তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ্ নেই। তোমাদের প্রতিপালক আমার মাধ্যমে তোমাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ পাঠিয়েছেন। তোমরা কখনই ওজনে কম দিও না এবং মাপ সঠিক দিবে। ক্রেতাদের তাদের হক পূরণ করবে এবং তাদের প্রাপ্য বস্তু দিতে কুণ্ঠা করবে না। পৃথিবীতে সুখ-শান্তি বিরাজ করছে। সুতরাং তোমরা তোমাদের অনৈতিক ও অসামাজিক কাজ দ্বারা পৃথিবীতে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা আনবে না। তোমরা যদি পৌত্তলিকতা ছেড়ে এক আল্লাহতায়ালার ইবাদত কর, তাহলে তোমাদের জন্য তা হবে কল্যাণকর।” (৭:৮৫)

শুধু এ কথা বলেই নবী শোয়াইব (আ) ক্ষান্ত হলেন না। তিনি আরও বললেন যে, “তোমরা (স্বগোত্রীয় লোকেরা) বিশ্বাসীদের ভয় দেখানোর জন্য পথে ওত পেতে থাকবে না; বিশ্বাসীদের আল্লাহতায়ালার ইবাদত বন্দেগীতে বাধা দিবে না এবং তাদের অযথা দোষত্রুটি ধরার চেষ্টা করে উত্তাক্ত করবে না।” এরপর নবী শোয়াইব (আ) বললেন,

“আল্লাহতায়ালার অশেষ কৃপায় তারা অল্পসংখ্যক জনগোষ্ঠী থেকে বিশাল রাজ্যের অধিবাসী হয়েছে এবং সুসমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত হয়েছে। তারা যেন অকৃতজ্ঞ ও ঔদ্ধতা স্বভাবের না হয়।” (৭:৮৫-৮৬)

নবী শোয়াইবের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে মাদিয়ানবাসী নবীকে মিথ্যাবাদী বলে আখ্যায়িত করে এবং তাদের গোত্রপ্রধান বলল, “হে শোয়াইব! তোমার সালাত কি এরূপ কোন নির্দেশ দেয় যে, আমাদের পূর্বপুরুষগণ যার ইবাদত করত তা বর্জন করতে হবে এবং আমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ আমাদের খুশিমত ব্যয় করতে পারব না।” দাম্ভিক মাদিয়ান প্রধানগণ আরও বলে, “হে শোয়াইব। একদিন তোমাদের আমাদের পূর্বপুরুষের ধর্মে ফিরে আসতে হবে। যদি না আস তাহরে তোমাকে তোমার স্বধর্মাবলম্বীসহ আমাদের সমাজ থেকে বিতাড়িত করা হবে ও তোমরা সমাজচ্যুত হবে। (১১ : ৮৪–৮৭)

প্রত্যুত্তরে শোয়াইব (আ) তাঁর গোত্রপ্রধানদের উদ্দেশ্যে বললেন, “যদি আমি আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত পথ ছেড়ে পুনরায় তোমাদের (পৌত্তলিকতার) ধর্মে ফিরে যাই তা হবে ঘোর অন্যায় এবং মহান আল্লাহর বিধানের পরিপন্থী; তাছাড়া একেশ্বরবাদীগণ আল্লাহতায়ালার বিনা অনুমোদনে পুনরায় পূর্বপুরুদের ধর্মীয় বিশ্বাসে ফিরে যেতে পারে না। আমরা আল্লাহতায়ালার আজ্ঞাবহ এবং আমরা যা কিছুই করি আল্লাহ সবই জানেন, কারণ তিনি সর্বজ্ঞানী। তাছাড়া আমরা আমাদের প্রতিপালক আল্লাহতায়ালার উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল।” বিধর্মী মাদিয়ানবাসী শোয়াইবকে সদাচারী ও সহিষ্ণু হিসাবে আখ্যায়িত করে এবং তার দৃঢ় সংকল্প ও আত্মপ্রত্যয়ে বিস্মিত হয়ে গোত্রপ্রধানগণ তাদের সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে বলল, “তোমরা (অবিশ্বাসীগণ) যদি শোয়াইবকে অনুসরণ কর এবং তাঁর কথা বিশ্বাস কর তাহলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

অবিশ্বাসী পথভ্রষ্ট স্বগোত্রীয় মাদিয়ানদের অনঢ় মনোভাব লক্ষ্য করে নবী শোয়াইব (আ) বললেন, “আমি নিজের জন্য বা নিজের কৃতিত্ব লাভের জন্য তোমাদের হেদায়েত করছি না; বরঞ্চ আল্লাহতায়ালার তরফ থেকে বারংবার সাবধান করছি এ কথা বলে যে, তোমরা তোমাদের পাপাচার ও অবিশ্বাস পরিহার করে আল্লাহর ইবাদত কর। মহান আল্লাহ আমাদের সুন্দর, পরিচ্ছন্ন ও উৎকৃষ্ট জীবনের সকল উপকরণ দিয়েছেন। তাহলে কিভাবে আমি আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব থেকে বিরত থাকব। আমি তোমাদেরকে যে কুকর্ম ও অধর্মীয় কার্যকলাপ করতে নিষেধ করছি তা থেকে আমি নিজেকেও অনেক দূরে রাখি। আমি মহান আল্লাহর আজ্ঞাবাহী নবী এবং তোমাদের জীবনের সংস্কার সাধনের জন্য তিনি আমাকে তোমাদের কাছে পাঠিয়েছেন।”

এ কথা বলেই নবী শোয়াইব (আ) ক্ষান্ত হলেন না; বরঞ্চ আরও বললেন যে, “যদি আমার সাবধানবাণী তোমরা না মান তাহলে তোমরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে ঠিক যেভাবে মহান আল্লাহতায়ালা অবিশ্বাসী নূহের সম্প্রদায়, হূদ ও সা’মূদ সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেন। এছাড়া লূত-এর সম্প্রদায়ও (যারা সদুম ও গোমোরোর অধিবাসী) তাদের কুফরীর জন্য পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এখনও সময় আছে, তোমরা অনুশোচনা কর, আল্লাহতায়ালার নিকট ক্ষমা চাও তোমাদের গুনাহের জন্য এবং আমার প্রতিপালক, যিনি মহান, দয়ালু ও প্রেমময় তোমাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা করবেন”। (১১ : ৮৯)

এত কিছু বলার পরও মাদিয়ান সম্প্রদায়ের লোকদের বোধোদয় হল না এবং তাদের গোত্র প্রধানেরা বলল, “হে শোয়াইব। তুমি যা বল তার অনেক কথা আমরা বুঝি না এবং আমরা তো আমাদের মধ্যে তোমাকেই দুর্বল দেখছি। তোমার আত্মীয়- স্বজন না থাকলে আমরা তোমাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলতাম কারণ তুমি আমাদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী নও।” এর জবাবে নবী শোয়াইব (আ) বলেন, “হে আমার সম্প্রদায়। তোমরা কি মনে কর যে আল্লাহতায়ালার চেয়ে আমার আত্মীয়-স্বজন অধিক শক্তিশালী? তোমরা তোমার প্রতিপালককে সম্পূর্ণরূপে অবজ্ঞা করছ, যার পরিণতি মোটেই ভাল হবে না।” (১১ : ৯০-৯২)। হতাশাগ্রস্ত হয়ে নবী শোয়াইব (আ) তাঁর বিপথগামী অবিশ্বাসী সম্প্রদায়কে আল্লাহর লানৎ থেকে বাঁচাবার শেষ চেষ্টা করার জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জনান এ কথা বলে, “হে আমার সম্প্রদায়। তোমরা যেমন করছ তেমন করতে থাক এবং আমিও আমার কাজ (মিশন) করে যাচ্ছি। খুব শীঘ্র তোমরা তোমাদের কর্মফল জানতে পারবে এবং তোমাদের কুকর্ম ও অধর্মের জন্য তোমরা লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি ভোগ করবে। তখন তোমরা বুঝতে পারবে কে মিথ্যাবাদী। তোমরা এবং আমিও সেই অন্তিম দিনের অপেক্ষায় আছি।” (১১ : ৯৩)

আ’দ, সা’মূদ, লূতের সম্প্রদায়ের মত সীমালঙ্ঘনকারী মাদিয়ানবাসীদের ধ্বংস করা হয়। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, “যখন আমার নির্দেশ আসল তখন আমি শোয়াইব ও তার সঙ্গে যারা বিশ্বাস করেছিল তাদেরকে আমার অনুগ্রহে রক্ষা করলাম, অতঃপর যারা সীমালঙ্ঘন করেছিল মহানাদ, ভূমিকম্প, মহাপ্রলয় তাদেরকে আঘাত করল ফলে তারা নিজ নিজ গৃহে নতজানু অবস্থায় শেষ হয়ে গেল।” (১১ : ৯৪) মাদিয়ানদের এমনভাবে ধ্বংস করা হয় যে, তাদের প্রাসাদোত্তম অট্টালিকা, নয়ানাভিরাম বসতবাড়ি, পরিচ্ছন্ন নগরী, সুজলা ও শস্য-শ্যামলা শস্যক্ষেত, পানি সরারাহকারী কুয়া বা কানাত সবকিছুই চোখের নিমেষে বিধ্বস্ত হয়। মাদিয়ান সম্প্রদায় পৃথিবীর অন্যতম অবলুপ্ত জাতি যাদের এমনভাবে ধ্বংস করা হয় যেন তারা কখনও সেখানে (তাদের অঞ্চলে) বসবাস করেনি। সূরা হূদের ৯৫ নম্বর আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, “জেনে রাখ! ধ্বংসই ছিল মাদিয়ানবাসীদের পরিণাম যেমনভাবে ধ্বংস হয়েছিল সামূদ সম্প্রদায়।”

৭. সেবিয়ান সম্প্রদায়

পবিত্র কুরআন শরীফে বহু অবলূপ্ত জাতি, গোত্র, গোষ্ঠী, অধিবাসী, নগর ও জনপদের উল্লেখ রয়েছে। মুসলিম ধর্মগ্রন্থে দুটি ধরনের গোষ্ঠীর কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে; একদল যারা মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত পথ থেকে বিচ্যুত, বিভ্রান্ত, পথভ্রষ্ট, পাপাচারে লিপ্ত অবিশ্বাসীদের দল, যাদের মধ্যে সা’মূদ, ইরাম ও আর-রাসের অধিবাসী, সদুম ও গোমোরোর জনগোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত; অন্য দল হচ্ছে আহল-ই কিতাব, ইসলামপন্থী, ইহুদী, খ্রিস্টান এবং সেবিয়ান নামে একটি ক্ষুদ্র খ্রিস্টান সম্প্রদায়। পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা বাকারার (২) ৬২ নম্বর আয়াতে সেবিয়ানদের উল্লেখ করা হয়েছে, “যারা বিশ্বাস করে যারা ইহুদি হয়েছে এবং খ্রিস্টান এবং সাবিয়ান যারা আল্লাহ এবং রোজ কিয়ামতে বিশ্বাস করে এবং যারা সৎকাজ করে, মহান আল্লাহ তাদের আশ্বস্ত করে বলছেন, তাদের ভয় বা অনুতাপ করার কোন কারণ নেই এবং তাদের নিরাকার একেশ্বরবাদী বিশ্বাস এবং সৎকাজ ও সদাচারের জন্য তারা পুরস্কৃত হবে।”

পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা আল-মায়িদার (৫) ৭৩ নম্বর আয়াতে সেবিয়ানদের উল্লেখ করা হলেও সূরা হজ্জের (২২) ১৭ নম্বর আয়াতে তাদের নাম বলা হয়নি। মহান আল্লাহতায়ালা ত্রি-ত্ত্ববাদী অর্থাৎ তিন ঈশ্বরে (Trinity) (নাউজুবিল্লাহ) বিশ্বাসী, যথা- মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ (God the Father), তথাকথিত আল্লাহর পুত্র যীশুখ্রিস্ট (God the Son) এবং মহান আল্লাহর বার্তাবাহক ফেরেশতা জিব্রাইল যাকে God the Holy Ghost’ বলা হয়েছে, বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করে এক আল্লাহ (লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহু, অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত অপর কোন ইলাহ্ নেই) বিশ্বাস স্থাপনের নির্দেশ দেন। তিনি সাবধান করে দিয়েছেন এ কথা বলে যে, যে সত্য প্রত্যাখ্যান করবে এবং অংশীবাদী হবে রোজ কিয়ামতে তাদের কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে।

ভৌগোলিক অবস্থান ও বংশ পরিচয়

সেবিয়ান গোষ্ঠী সম্বন্ধে মতবিরোধ থাকলেও আধুনিককালে গবেষকগণ মন্তব্য করেছেন যে, এই গোত্র বা গোষ্ঠী হিব্রু ও খ্রিস্টান ধর্মের সারমর্ম গ্রহণ করে একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, যা Nasoraie d’ Yahya অথবা খ্রিস্টান সাধু সেন্ট জনের অনুসারীবৃন্দ Nasoreans। বর্তমানে যে খ্রিস্টানদের Nazareans বলা হয় তা সম্ভবত পূর্বে Nasoreans-এর অপভ্রংশ। তারা Mandeans নামেও পরিচিত ছিল এবং তাদের মধ্যে Baptism বা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষার পূর্বে পবিত্র জর্দান বা উরদান নদীতে স্নান করার প্রথা প্রচলিত করে। তাদের বিশেষ ধর্মগ্রন্থের নাম ছিল Ginza এবং একটি আরামায়েক ভাষার একটি শাখা মানডাই-এ লিপিবদ্ধ করা হয়। ধারণা করা হয় যে, এই জনগোষ্ঠী ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসী (Theists) ছিল এবং খুবই শান্তিপ্রিয় ছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, খ্রিস্টের জন্মের প্রথম শতাব্দীতে তারা আরব ভূ-খণ্ডের উত্তরে ব্যাবিলনে বসবাস করত। সম্ভবত সেবিয়ানদের আদি বাস ছিল প্যালেস্টাইন এবং জর্দান নদীর পানি তাদের কাছে খুবই পবিত্র ছিল। সেবিয়ানদের সাথে নাবাতীয় এবং পালমেরীয় নামে উত্তর আরবের দুটি সমৃদ্ধ জাতির সাদৃশ্য ছিল।

মুহম্মদ আসাদ বলেন, “The Sabians seem to have been a monotheistic religious group intermediate between Judaism and Christianity.” (“ইহুদী ও খ্রিস্টানদের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত সেবিয়ানগণ একশ্বরবাদী ছিল।”) সেবিয়ান শব্দটি সম্ভবত সেবা (Sebha) থেকে গ্রহণ করা হয়েছে, যার “অর্থ স্নান করা।”

সেবিয়ানদের বংশপরিচয় সঠিকভাবে জানা যায় না। পবিত্র কুরআন শরীফে উল্লিখিত সেবিয়ানগণ বর্তমানে ইরাকের দক্ষিনাঞ্চলে বসবাসকারী সেবিয়ান বা মাদিয়ান গোষ্ঠী কিনা তা সঠিকভাবে বলা যায় না। আল্লামা ইউসুফ আলী এবং মুহাম্মদ আসাদ, যারা কুরআনের বিশিষ্ট ভাষ্যকার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন, বলেন যে, বর্তমানের সেবিয়ানদের সাথে কুরআনে বর্ণিত সেবিয়ানদের কোন সম্পর্ক নেই, যদিও ইরাকের একেশ্বরবাদী এই গোষ্ঠী সম্ভবত প্রাচীনতম সেবিয়ানদের নাম গ্রহণ করে। অন্যদিকে পি. কে. হিট্টি তার History of the Arabs (পৃষ্ঠা ৩৫৭-৫৮) গ্রন্থে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, “পবিত্র কুরআন শরীফের তিন স্থানে উল্লিখিত সেবিয়ানদের বংশধর ইসলামের আবির্ভাবের পরেও বসবাস করে এবং ইহুদী, খ্রিস্টানদের মত তারাও ‘জিম্মি বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসাবে পরিগণিত হয়। তাদের রক্ষনাবেক্ষণরে দায়িত্ব মুসলিম রাষ্ট্রের; তাদের সামরিক বাহিনীতে যোগাদন করতে হত না এবং মুসলিম রাষ্ট্রকে তাদের জিজিয়া নামে একটি কর দিতে হত। মুসলমানদের সাথে তাদের সুসম্পর্ক ছিল এবং নবী করিম (সা) তাদেরকে একেশ্বরবাদী হিসাবে মনে করতেন।”

পি. কে. হিট্টি বলেন যে, “সেবিয়ান গোষ্ঠী এখনও ইরাকের বসরা অঞ্চলে নদীর পাড়ে বসবাস করে এজন্য যে, স্নান করে পবিত্র হওয়া তাদের ধর্মের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।” ফিহিরিস্ত (১৯৫১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ) বলেন যে, তাদের ‘মুগতাশিলা’ বলা হত এ জন্য যে, তারা সব সময় স্নান করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পাক থাকত। সম্ভবত এখনও প্রায় ৫,০০০ সেবিয়ান দক্ষিণ ইরাকের জলাভূমিতে বসবাস করে।

সেবিয়ানদের সাথে আরব ভূ-খণ্ডের অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর পার্থক্য এই যে, সাবিয়ানগণ অন্যান্য জাতির মত যেমন আ’দ, সামূদ, আর রাসের অধিবাসী, সদুম ও গোমোরো বিলুপ্ত হয়নি। দ্বিতীয়ত, মহান আল্লাহতায়ালা তাদের উপর শাস্তি আরোপ করেন নি; বরং বলা হয়েছে যে, যারা এক আল্লাহর বিশ্বাসী তাদের জন্য পরকালে পুরস্কার রয়েছে। তাদের ভয়-ভীতি ও আশঙ্কার কোন কারণ নেই। আবার পবিত্র কুরআন শরীফে একথা বলা হয়েছে যে, যারা অংশীবাদী, এক আল্লাহর বিশ্বাস করে না বা বলে না যে, এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ্ নেই (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাদের জন্য রোজ কিয়ামতে কঠোর শাস্তি রয়েছে।

৮. সাবাইন গোষ্ঠী (রাণী বিলকিস)

প্রাচীন আরব রাজাসমূহের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছিল সাবাইন বা সাবাবাসী, যারা দক্ষিণ-পশ্চিম আরবে বসবাস করত। তারা সেমিটিক জাতিভুক্ত ছিল এবং তারাই আরব উপদ্বীপে সভ্যতার উন্মেষ ঘটায়। গ্রিক সাহিত্যিক থিওফ্রাসটাস সাবাবাসীদের কথা উল্লেখ করেন। বৃষ্টিধারায় ধৌত ও সামুদ্রিক বাণিজ্যের অনুকূল সাবাইন রাজ্যের প্রতিষ্ঠার কথা প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে আবিষ্কৃত শিলালিপির পাঠোদ্বার থেকে জানা যায়। ফিনিশীয়দের মতে, সাবাবাসী সামুদ্রিক বাণিজ্যে অসীম কৃতিত্ব প্রদর্শন করে এবং খ্রিস্টের জন্মের প্রায় এক হাজার বছর পূর্ব থেকে তারা দক্ষিণের সমুদ্রের উপর একাধিপত্য বিস্তার করে। স্থলপথে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার করার জন্য ইয়েমেন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত মক্কা, পেত্রা, মিশর, সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়ার সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী কাফেলার রাস্তা (Caravan route) নির্মাণ করা হয়। হাজরামাউত ও ইয়েমেন অঞ্চলই প্রধানত সাবাইন রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, এ অঞ্চলে যে সুগন্ধি দ্রব্য (Aroma) ব্যবহৃত হত তা সাবাইন রাজ্য থেকে সংগৃহীত হত। মা’রিব ছিল এ রাজ্যের রাজধানী। মিনাই ও সাবাইন ছিল তাদের ভাষা এবং তাদের বর্ণমালা ছিল সিনিয়াটিক।

>

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত সাবাইনদের রাজত্বকাল খ্রিস্টপূর্ব ৯৫০ থেকে ১১৫ অব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সাবাইনদের রাজত্বকালকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমত খ্রিস্টপূর্ব ৯৫০ থেকে ৬৫০ পর্যন্ত সময়কালকে মুকাররবদের, যারা পরোহিত রাজা ছিলেন, যুগ বলা হয়ে থাকে। প্রাচীন নগরী সিরওয়াহ ছিল প্রথম সাবাইন রাজ্যের রাজধানী, বর্তমানে এর নাম খারিবাহ। মা’রিব ছিল প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র এবং তিনটি বাণিজ্যপথের সঙ্গমস্থলে এটি অবস্থিত ছিল। কৃষি উৎপাদনের প্রতীক মা’রিব বাঁধ তৎকালীন যুগে ছিল বিস্ময়। প্রকৌশলীদের নৈপুণ্যের পরিচায়ক মা’রিব বাঁধ শুধু একটি অপূর্ব কীর্তিই ছিল না বরং কৃষিকাজের সুব্যবস্থা ও নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রার প্রতীক ছিল এটি। দ্বিতীয় সাবাইন যুগ শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ থেকে। এ যুগের নৃপতিদের মালকস্ববা উপাধি গ্রহণে মনে হয় যে, তারা পৌরহিত্যের কার্যকলাপ থেকে নিজেদের নিবৃত্ত রাখত। দক্ষিণ আরবের রাজবংশের মধ্যে দ্বিতীয় সাবাইনগণ সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধিশালী ছিল। স্থাপত্যকলা, ভাস্কর্য ও শিলালিপি প্রভৃতি দক্ষিণ আরব সভ্যতার স্বাক্ষর বহন করে রয়েছে। খ্রিস্টপূর্বাব্দ ১১৫ অব্দে সাবাইন রাজ্যের পতন হয়। বাইবেল এবং পবিত্র কুরআন শরীফে সাবাইন রাজ্যের রাণী সেবা (Sheba) অথবা বিলকিসের উল্লেখ আছে। উল্লেখ্য যে, ইসরাইলদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নবী হযরত সোলায়মান (আ) ছিলেন হযরত দাউদের (আ) পুত্র। এর সাথে দক্ষিণ-পশ্চিম আরবের সুসমৃদ্ধ সাবাইন রাজ্যের বিদুষী রাণী বিলকিসের সাক্ষাৎ হয় এবং পরবর্তী পর্যায়ে রাণী বিলকিস পৌত্তলিকতা ত্যাগ করে একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী হন এবং হযরত সোলায়মানের (আ) সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

পবিত্র কুরআনের সূরা আন-নামলের (২৭) ২০ থেকে ৪৪ আয়াত ও সূরা সাবার (৩৪) ১৫ থেকে ২১ আয়াতে হযরত সোলায়মান (আ) ও রাণী বিলকিস প্রসঙ্গে বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়েছে। সূরা আল-নামলে বলা হয়েছে যে, হযরত সোলায়মানকে (আ) মহান আল্লাহতায়ালা দিব্যজ্ঞান দিয়েছিলেন এবং জিন ও পাখীদের উপর হযরত সোলায়মানের (আ) অসাধারণ কর্তৃত্ব ছিল। উদ্ধৃতি দেওয়া হল, “আমি (আল্লাহতায়ালা) অবশ্যই দাউদ ও সোলায়মানকে জ্ঞানদান করেছিলাম এবং তারা বলেছিল, ‘প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদেরকে তার বহু বিশ্বাসী দাসের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলেন।’ সোলায়মান (আ), যিনি দাউদের (আ) পুত্র ও উত্তরাধিকারী ছিলেন, বলেন যে, ‘হে মানুষ। আমাকে বিহঙ্গকূলের ভাষা বুঝবার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এবং আমাকে সবই দেওয়া হয়েছে যা ছিল মহান আল্লাহতায়ালার সুস্পষ্ট অনুগ্রহ।’ এরপর হযরত সোলায়মানের (আ) কাছে জিন, মানুষ ও বিহঙ্গকূলকে (পাখি) উপস্থিত করা হল এবং তাদেরকে এক একটি বাহিনীর দায়িত্ব দিয়ে এক একটি দুর্গে অবস্থান করতে বলা হয়।”

হযরত সোলায়মানকে (আ) মহান আল্লাহতায়ালা পাখিদের উপর অসামান্য কর্তৃত্ব দেন এবং পাখিকুল তার আজ্ঞাবহ ছিল। এ সমস্ত পাখি সোলায়মানের (আ) বিশ্বস্ত অনুচর ছিল; তারা বাতাসে ডানা মেলে সমস্ত পৃথিবীতে বিচরণ করত এবং সর্বপ্রকার কার্যকলাপ (মনুষ্য, পশু-পক্ষীদের কৃতকর্ম) লক্ষ্য করত এবং তা হযরত সোলায়মানের (আ) নিকট বর্ণনা কর েসমস্ত পাখিদের মধ্যে একটির নাম ছিল ‘হুদহুদ’ (Hoopoe)। ইউসুফ আলী বলেন যে, “হুদহুদ ছিল নানা বর্ণের পালকে সমৃদ্ধ অতি সুন্দর ও হালকা একটি পাখি, যে আকাশে দ্রুত উড়তে পারত। তার মাথায় হলুদ রঙের মুকুটের মত ঝুঁটি ছিল। এজন্য ‘হুদহুদ’ পাখির রাজকীয় সম্মান ছিল এবং হযরত সোলায়মানের (আ) খুবই প্রিয় ছিল।” হযরত সোলায়মানের (আ) কাছাকাছি থাকত এই ‘হুদহুদ’ পাখি; কিন্তু একদিন তাকে দেখতে না পেয়ে তিনি খুব বিরক্ত হলেন। সূরা আন-নাম্‌লের ২০ থেকে ২১ আয়াতে বর্ণিত আছে; “সোলায়মান বিহঙ্গদলকে পর্যবেক্ষণ করল এবং বলল, হুদহুদকে দেখছি না কেন? সে কি অনুপস্থিত? সে যদি উপযুক্ত কারণ না দেখায় তা হলে আমি [হযরত সোলায়মান (আ)] অবশ্যই তাকে কঠিন শাস্তি দিব অথবা তাকে হত্যা করব।”

‘হুদহুদ’ পাখি তার প্রভু হযরত সোলায়মানের (আ) বিচলিত হওয়ার সংবাদে তাঁর সামনে উপস্থিত হল। ‘হুদহুদ’ পাখি তার প্রভুকে বলল, “আপনি যা অবগত নন আমি তা অবগত হয়েছি এবং ‘সাবা’ থেকে সুনিশ্চিত সংবাদ নিয়ে এসেছি।” (২৭ : ২২) সোলায়মান (আ) ‘হুদহুদ’ পাখিকে অজ্ঞাত সংবাদের কথা জিজ্ঞাসা করলেন। ‘হুদহুদ’ পাখি জবাবে বলল, “আমি এক নারীকে তাদের (সাবাহ বা সাবাবাসী) উপর রাজত্ব করতে দেখেছি। তাকে (রাণী বিলকিস), পবিত্র কুরআনের ভাষায়, এবং বাইবেলের মতে, সব কিছু দেওয়া হয়েছে এবং তার একটি বিরাট সিংহাসন আছে।” (২৭ : ২৩) রাণী বিলকিস প্রসঙ্গে ইউসুফ আলী বলেন যে, “দক্ষিণ আরবের গৌরবমণ্ডিত ও সুসমৃদ্ধ সাবা রাজ্যের রাণী ছিলেন বিলকিস। তিনি কেবল সাবা রাজ্যের অধিপতিই ছিলেন না, পার্শ্ববর্তী আবিসিনিয়া (আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে অবস্থিত যেখানে নবী করীমের সময়ে মুসলমানগণ প্রথম হিজরত করে আশ্রয় গ্রহণ করেন) দখল করেন। খ্রিস্টপূর্ব দশম অথবা একাদশ শতাব্দীতে দক্ষিণ আরব অঞ্চল থেকে আবিসিনিয়ায় অভিযান করা হয় এবং আবিসিনিয়ার অধিবাসীরা হাবাসা গোত্রভুক্ত ছিল। খুব সম্ভবত দক্ষিণ আরবের ইয়েমেন থেকে আরবগণ আবিসিনিয়ায় গমন করে সেখানে বসতি স্থাপন করে।” সুতরাং সাবার রাণী বিলকিস শুধু দক্ষিণ আরবেই সুপরিচিত ছিলেন না, তার আধিপত্য আবিসিনিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বর্তমানে আবিসিনিয়া ইথিওপিয়া নামে পরিচিত।

,

আবিসিনিয়ার ইতিহাসে রাণী বিলকিসের নাম উল্লিখিত হয়েছে। “The Book of the Glory of Kings” নামে ইথিওপীয় ভাষায় লিখিত ইংরেজিতে অনূদিত গ্রন্থে রাণী সেবা বা বিলকিসের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, রাণী সেবার পুত্র প্রথম মেনয়িলেক (Menyelek-1) আবিসিনিয় রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ভাষাগত দিক থেকেও আরবের সাবেয়ী ও হিমিয়ারী ভাষার সাথে ইথিওপীয় ভাষার সাদৃশ্য দেখা যায়। এ থেকে বিশেষজ্ঞগণ ধারণা করেন যে, দক্ষিণ আরবের ভাষা আবিসিনীয় ভাষায় প্রভাব বিস্তার করেছে।

সূরা নামলের ২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে যে, সাবাবাসীদের অফুরন্ত প্রাচুর্য, বৈভব ও সমৃদ্ধি ছিল। এর মূল কারণ দুটি : মা’রিব বাঁধের ফলে কৃষিকার্যের ব্যাপক প্রসারতা এবং মশলা সড়কের (Spice route) মাধ্যমে দক্ষিণ আরবের সুগন্ধি দ্রব্য (frankinscene, myrr, henna) উৎপাদনকারী ইয়েমেনের সাথে উত্তরের সিরিয়ার জেরুজালেম পর্যন্ত কাফেলায় ব্যবসা-বাণিজ্য। মা’রিব একটি সুসমৃদ্ধশালী নগরী ছিল এবং সা’বা রাজ্যের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। রাণী বিলকিস এরূপ একটি সম্পদশালী ও শক্তিশালী রাজ্যের শাসক ছিলেন, যার কথা ‘হুদহুদ’ পাখি হযরত সোলায়মানকে (আ) জানায়। রাণী বিলকিসের সিংহাসনের কথা বলা হয়েছে এবং এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, হযরত সোলায়মানের (আ) মত প্রতাপশালী শাসকের সমসাময়িক আরব ভূখণ্ডের আর একজন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্যের অধিপতি ছিলেন রাণী বিলকিস, যার বিশাল প্রাসাদ ছিল, সভাসদ ছিল, সেনাবাহিনী ছিল।

বিস্তারিত বিবরণ দিতে গিয়ে ‘হুদহুদ’ পাখি হযরত সোলায়মানকে (আ) বলল, “আমি তাঁকে (রাণী বিলকিস) এবং তাঁর সম্প্রদায়কে দেখলাম যে, তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সিজদা করছে। শয়তানের প্ররোচনায় তাদের কার্যাবলি তাদের কাছে শোভনীয় মনে করছে এবং সে (শয়তান) তাদের সৎপথ থেকে নিবৃত্ত করছে। তার ফলে তারা সৎপথ না পেয়ে বিপথগামী হয়েছে।” (২৭ : ২৩) হুদহুদ’ পাখি আরও বলে,

(২৭:২৩) “সে (শয়তান) নিবৃত্ত করেছে এজন্য যে তারা (সাবাবাসী) আল্লাহকে সিজদা না করে, যে মহান আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সমস্ত লুক্কায়িত বস্তুকে প্রকাশ করেছেন। তিনি (মহান আল্লাহ) তোমরা যা গোপন কর বা ব্যক্ত কর তার সব কিছুই জানেন।” (২৭:২৫ )

উপরিউক্ত আয়াত দুটিতে সাবাইনদের গ্রহ নক্ষত্র উপাসনার (astral belief) কথা বলা হয়েছে। উইলিয়াম মূইর বলেন, “অনন্তকাল থেকে মক্কা এবং সমগ্র উপদ্বীপ আধ্যাত্মিক অসারতায় নিমজ্জিত ছিল- সমগ্র অধিবাসী কুসংস্কার, বর্বরতা ও পাপাচারে ডুবে ছিল- তাদের ধর্ম ছিল ঘৃণ্য পৌত্তলিকতা এবং বিশ্বাস ছিল সর্বশক্তিমান আল্লাহর পরিবর্তে অদৃশ্য একটি শক্তির কুহেলিকাপূর্ণ ভীতি। উন্মুক্ত মরুপ্রান্তরে বসবাসকারী আরব বেদুঈনগণ সৌরজগতের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়। দক্ষিণ আরবের স্বাধীন রাজ্যগুলোতে সূর্য ও চন্দ্র দেবতার পূজা প্রচলিত ছিল এবং সম্ভবত বেদুইনগণও অনুরূপ সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহ ও উপগ্রহের পূজা করত।” হিময়ারী ও সাবাইন গোষ্ঠী সৌরজগতের উপাসনা করত ‘হুদহুদ’ পাখি স্বচক্ষে সাবাইনদের সূর্যের উপাসনা প্রত্যক্ষ করে। হযরত সোলায়মানের (আ) বিশেষ বার্তাবাহক পাখি ‘হুদহুদ’ যে ফেরেশতার সমতুল্য ছিল, সৌরজগতের প্রতি সাবাইনদের সিজদা দিয়ে আরাধনা করছে দেখতে পাই এবং বলে যে একমাত্র প্রতিপালক ও সৃষ্টিকর্তা আল্লাহই সিজদার উপযুক্ত এবং তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। ‘হুদহুদ’ পাখি বলছে যে, “তিনি (মহান আল্লাহ) মহান আরশের অধিপতি।” (২৭ : ২৬) এখানে আরশের বা আল্লাহতায়ালার মহিমামণ্ডিত সিংহাসনের কথা বলা হয়েছে, বা রাজা-বাদশাহের সিংহাসনের, যা পার্থিব, তুলনায় পবিত্র, মহান ও অবিনশ্বর।

‘হুদহুদ’ পাখির পরিবেশিত সংবাদে হযরত সোলায়মান (আ) বললেন, “আমি দেখব তুমি কি সত্য বলছ না তুমি একজন মিথ্যাবাদী।” (২৭ : ২৭) হযরত সোলায়মান তাঁর প্রিয় ‘হুদহুদ’ পাখিকে বিশ্বাস করতেন এবং সে তাঁর প্রভুকে কখনই মিথ্যা সংবাদ দেয়নি। এতদসত্ত্বেও, ‘হুদহুদের’ সংবাদের সত্যতা বিচারের জন্য হযরত সোলায়মান (আ) তার মাধ্যমে একটি চিঠি রাণী বিলকিসের কাছে পাঠালেন; একই সূরার ২৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “তুমি (হুদহুদ) আমার এই চিঠি নিয়ে রাণী বিলকিসের কাছে যাও এবং চিঠিটি তাকে দাও। অতঃপর তুমি, তাদের কাছ থেকে সরে পড়বে এবং দেখবে তারা কি উত্তর দেয়।” (২৭ : ২৮) চিঠিটি যখন মহান বাদশাহ সোলায়মানের (আ), যিনি ইহুদী সম্প্রদায়ের জন্য জেরুজালেমে একটি মন্দির নির্মাণ করেন এবং তৌহিদ প্রচার করেন আল্লাহতায়ালার হুকুমে, কাছ থেকে সাবাইনদের প্রতাপশালী ও সম্পদশালী রাণী বিলকিসের নিকট পৌঁছল তখন তিনি দরবারে বসেছিলেন। চিঠিটি পাওয়ার পর বিলকিস বললেন, “হে পরিষদবর্গ। আমাকে এক সম্মানিত পত্র দেওয়া হয়েছে।” এটি সোলায়মানের কাছ থেকে এসেছে এবং এতে বলাহয়েছে যে, দয়াময় পরম দয়ালু আল্লাহর নামে অহমিকা বশে আমাকে (সোলায়মান) অমান্য করো না; এবং আনুগত্য স্বীকার করে আমার নিকট উপস্থিত হও।” (২৭ : ২৯-৩১)

হযরত সোলায়মানের (আ) চিঠির মর্মবাণী জেনে রাণী বিলকিস তার সভাসদদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। বিলকিস বলল, “হে পারিষদবর্গ। আমার এই সমস্যায় তোমাদের অভিমত দাও। আমি যা সিদ্ধান্ত করি তা তো তোমাদের উপস্থিতিতেই করি।” (২৭ : ৩২) রাণী বিলকিসের কথা শুনে সভাসদবর্গ নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করতে লাগল কারণ, ইসরাইলী রাষ্ট্রের মহাপরাক্রমশালী বাদশাহ সোলায়মান (আ) সাবাইন রাজ্যের রাণী বিলকিসকে তার সাথে দেখা করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। এর মধ্যে উভয় রাজ্যের মান-সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি জড়িত। রাণী বিলকিসের কথার জবাবে পারিষদবর্গ বলল, “আমরা তো শক্তিশালী ও কঠোর (সুনিপুণ) যোদ্ধা; তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের একমাত্র ক্ষমতা আপনারই (রাণী বিলকিস); কি আদেশ করবেন তা ভেবে-চিন্তে দেখুন।” (২৭ : ৩৩) রাণী বিলকিস বাদশাহ সোলায়মানের (আ) চিঠি পেয়ে অপমান বোধ করেন নি বরং মর্যাদা ও সম্মানের সাথে ‘হুদহুদ’ পাখি প্রদত্ত চিঠি পেয়ে বিষয়টি পর্যালোচনা করেন। এটি এমন যুগের কথা যখন সৈন্যবলে বলীয়ান হয়ে এক দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী রাজা পার্শ্ববর্তী কোন দুর্বল রাজ্যের উপর আক্রমণ পরিচালনা করে রাজ্য বিস্তার করেন। হযরত সোলায়মান (আ) আরব ভূ-খণ্ডের উত্তরে সিরিয়ায় রাজত্ব করছিলেন এবং দক্ষিণাঞ্চলে আরব উপদ্বীপের দক্ষিণে ইয়েমেনের সাবাইনদের রাজ্য। রাণী বিলকিস মহান সোলায়মানের (আ), যাকে বলা হয় মহাজ্ঞানী সোলায়মান (Solomon the Wise), চিঠি পেয়ে সম্মানিত বোধ করেন এবং তার সাথে সাক্ষাতের আগ্রহ দেখান। ইউসুফ আলী বলেন যে, আমন্ত্রণ পথ গ্রহণে রাণী বিলকিসের একেশ্বরবাদের প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ পায় এবং পরবর্তী পর্যায়ে রাণী বিলকিস একেশ্বরবাদী হন। ইউসুফ আলী আরও বলেন যে, চিঠি প্রাপ্তির ফলে রাণী বিলকিসের মানসিক ও আধ্যাত্মিক পরিবর্তন (mental and spiritual transformation) ঘটে। তিনি বলেন, “In Bilqis we have a picture of womanhood, gentle, prudent and able to tame wilder passions of her subjects.” e “বিলকিসের মধ্যে এমন এক নারীত্বের নিদর্শন পাওয়া যায় যা শান্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত এবং যা প্রজাদের দুর্দমনীয় প্রবৃত্তি নিরসনের জন্য যথেষ্ট।”

পাশাপাশি দুটি শক্তিশালী ও বিশাল সাম্রাজ্যের অবস্থান রাজনৈতিক দিক থেকে মোটেই সুখকর নয়। কারণ এতে আক্রমণাত্মক সামরিক অভিযান পরিচালনা করে আগ্রাসন নীতি জাহির করা হয়। কিন্তু হযরত সোলায়মান (আ) এবং রাণী বিলকিসের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ হয়নি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, “সে (রাণী) বিলকিস) বলল, রাজা- বাদশারা যখন কোন জনপদে প্রবেশ করে, তখন তারা সেটা বিধ্বস্ত করেছেন এবং সেখানকার মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অপদস্থ করে, এরাও এরূপ করবে।” (২৭ : ৩৪) রাণী বিলকিসের কোন মতিভ্রম হয়নি। তিনি হযরত সোলায়মানের (আ) মনোভাব জানার জন্য তার দরবারে একটি কূটনৈতিক মিশন পাঠান। একই সুরার ৩৫ থেকে ৩৬ আয়াতে দূত পাঠানোর কথা বলা হয়েছে : “আমি (রাণী বিলকিস) তার নিকট উপঢৌকন পাঠাচ্ছি, দেখি দূতেরা কি উত্তর আনে।” দূত সোলায়মানের (আ) নিকট আসলে সোলায়মান (আ) বললেন, “তোমরা কি আমাকে ধন-সম্পদ দিয়ে সাহায্য করতে চাও? আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন তা তোমাদের যা দিয়েছেন তা থেকে শ্ৰেষ্ঠ, অথচ তোমরা তোমাদের উপঢৌকন নিয়ে উৎফুল্ল বোধ করছ।”

কাফেলার অসংখ্য উটের পিঠে নানা ধরনের মূল্যবান উপটোকন নিয়ে রাণী বিলকেসের দূত যখন মা’রিব থেকে জেরুজালেমে পৌঁছল তখন নগরবাসী হতবাক হয়ে গেল। এই মশলা সড়কে যুগ যুগ ধরে দক্ষিণ আরব থেকে উত্তরে সিরিয়ার ধনরত্ন, সুগন্ধি দ্রব্য, (যা এক সময় মিশরের মমিতে ব্যবহৃত হয়েছে) আনা হত। কাফেলা যখন জেরুজালেমের উপকণ্ঠে পৌঁছল তখন বাদশাহ সোলায়মানের (আ) নিকট রাণী বিলকিসের পাঠানো মহামূল্যবান উপহার ও উপঢৌকনের সংবাদ আসল; তিনি সেগুলো তার সামনে রাখার নির্দেশ দেন এবং প্রচুর ধনসম্পদ দেখে তার ধারণা হল যে সম্ভবত রাণী বিলকিস তার সাথে সন্ধি করতে চান। কিন্তু বাদশাহ সোলায়মান (আ) উপঢৌকনে সন্তুষ্ট হতে পারে নি, কারণ তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল রাণী বিলকিসের ধর্মীয় মতবাদ জানা অর্থাৎ তিনি কি একেশ্বরবাদী, না সৌরজগতের উপাসনাকারী। এছাড়া হযরত সোলায়মান (আ) পরীক্ষা করতে চান যে সেবিয়ানগণ রাজনৈতিকভাবে কতটুকু শক্তিশালী। এজন্য তিনি বললেন, “তাদের (সেবিয়ান গোষ্ঠী) নিকট তোমরা ফিরে যাও, আমি অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে এক সেনাবাহিনী নিয়ে আসব, যার মোকাবিলা করার শক্তি তাদের নেই। আমি (হযরত সোলায়মান) অবশ্যই তাদেরকে সেখান থেকে বহিষ্কৃত করব লাঞ্ছিতভাবে এবং তখন তারা অবনমিত হবে।” (২৭ : ৩৭)

ইসরাইলী রাষ্ট্রের সাথে সাবাইন রাজ্যের যখন এ ধরনের রাজনৈতিক সঙ্কট উপস্থিত হয় তখন রাণী বিলকিস সংঘর্ষের স্থলে সমঝোতার পথ বেছে নেন। এ কারণে তিনি মা’রিব থেকে জেরুজালেমে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। হযরত সোলায়মান (আ) রাণী বিলকিসের আগমনের সংবাদে পারিষদবর্গের উদ্দেশ্যে বললেন, “হে আমার পরিষদবর্গ। সে (রাণী বিলকিস) আত্মসমর্পণ করে আমার কাছে আসার পূর্বে কে তাঁর সিংহাসন আমাকে এনে দিবে?” একথা শুনে ‘ইফরিত’ নামে এক শক্তিশালী জিন সিংহাসন এনে দিবার প্রতিশ্রুতি করে। একই সূরার ৩৯ নম্বর আয়াতে বর্ণিত আছে : এক শক্তিশালী জিন (ইফরিত) বলল, “আপনি আপনার স্থান থেকে উঠার আগেই আমি তা এনে দেব এবং এ ব্যাপারে আমি ক্ষমতাবান, বিশ্বস্ত। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, হযরত সোলায়মান (আ) রাণী বিলকিসের সিংহাসন মা’রিব থেকে জেরুজালেমে নিয়ে আসার জন্য তাঁর জিনদের আদেশ দেন। জিনদের উপর তাঁর অসামান্য কর্তৃত্ব ছিল এবং তারা তাঁর আজ্ঞাবহ দাস। সিংহাসন ক্ষমতা, প্রভাব ও প্রতিপত্তির প্রতীক এবং রাণী বিলকিসের সিংহাসন আনার অর্থ এই যে, রাণী হযরত সোলায়মানের (আ) নিকট বশ্যতা স্বীকার করবেন, কোন প্রকার সংঘাতের মধ্যে যাবেন না এবং উভয়ের সাক্ষাৎ হবে খুবই সহজ ও স্বাভাবিক।

রাণী বিলকিসের সিংহাসন আনা রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথমত, হযরত সোলায়মান (আ) তাঁর জিনদের পরীক্ষা করতে চান যে তারা তাঁর আদেশ চোখের পলকে পালন করে কিনা। বাস্তবিকপক্ষে ‘ইফরিত’ চোখের নিমেষে রাণী বিলকিসের সিংহাসনটি নিয়ে এসে বাদশাহ সোলায়মান (আ) দরবারে স্থাপন করল। দ্বিতীয়ত, সিংহাসন আনার জন্য হযরত সোলায়মান (আ) আল্লাহতায়ালা কর্তৃক প্রদত্ত অলৌকিক ক্ষমতার কথা উল্লেখ করে প্রতিপালক ও সৃষ্টিকর্তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন। তৃতীয়ত, সিংহাসনটি এনে এবং তাকে কিছুটা পরিবর্তন করে হযরত সোলায়মান (আ) পরীক্ষা করতে চান যে, রাণী জেরুজালেমে তাঁর দরবারে রক্ষিত তাঁর (রাণী) সিংহাসনটি চিনতে পারবেন কিনা। সূরা আন-নামলের ৪০ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে, “কিতাবের জ্ঞান যার ছিল সে (জিন) বলল, আপনি চোখের পলক ফেলবার পূর্বেই আমি তা আপনাকে এনে দেব।” হযরত সোলায়মান (আ) যখন তার সামনে (সিংহাসনটি) রক্ষিত দেখলেন তখন সে বলল, “এটি আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করতে পারেন, আমি কৃতজ্ঞ, না অকৃতজ্ঞ। যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে তা করে নিজের কল্যাণের জন্য এবং যে অকৃতজ্ঞ, সে জেনে রাখুক যে সাবাইন আমার প্রতিপালক অভাবমুক্ত, মহানুভব।” মহান আল্লাহতায়ালা হযরত সোলায়মান (আ) কে কতকগুলো অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী করেছিলেন।

মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর অপার করুণায় হযরত সোলায়মানকে (আ) বাতাস, জিন, বিহঙ্গ ও মানুষের উপর অপরিসীম কর্তৃত্ব দিয়েছেন। সূরা আন-নামলের ১৬ আয়াতে বলা হয়েছে, “সোলায়মান ছিল দাউদের উত্তরাধিকারী (পুত্র) এবং সে বলেছিল, হে মানুষ! আমাকে বিহঙ্গকুলের (পাখির) ভাষা বুঝবার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল এবং আমাকে সবই দেওয়া হয়েছে; এটি অবশ্য একটি সুস্পষ্ট অনুগ্রহ।” অনুরূপভাবে জিনদের প্রতি তাঁর যে কর্তৃত্ব ছিল তার প্রমাণ, দক্ষিণ আরবের সাবাইন রাজ্যের রাজধানী থেকে সোলায়মানের (আ) রাজধানী জেরুজালেমে সিংহাসন আনয়ন। ৪১ আয়াতে বলা হয়েছে, “সোলায়মান (আ) বলল, তার সিংহাসনের আকৃতি বদলিয়ে দাও এবং দেখি সে (রাণী বিলকিস) সঠিকভাবে চিনতে পারছে, না কি সে বিভ্রান্ত।” রাণী বিলকিস তার পরিষদবর্গ, সৈন্য সামন্ত, ধন-দৌলত নিয়ে কাফেলায় মশলা সড়ক ধরে উত্তর দিকে যাত্রা করলেন। বহুদিন পর দীর্ঘ রাস্তা অতিক্রম করে জেরুজালেমে উপকণ্ঠে এসে উপস্থিত হলেন। দীর্ঘ ২০০০ মাইল পথ ধূ ধূ মরুভূমির মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে রাণী বিলকিস হযরত সোলায়মানের (আ) রাজধানীতে পৌঁছলে তাকে জাঁকজমকের সাথে অভ্যর্থনা জানানো হয়। সোলায়মানের (আ) বিশাল বাহিনী তাঁকে সম্মানিত করে। বাদশাহের দরবারে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলে প্রাসাদের সামনে রাখা একটি সিংহাসনের দিকে তাঁর নজর পড়ে। প্রাসাদের ফটকে বাদশাহ সোলায়মান (আ) রাণী বিলকিসকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন এবং রাণী বিলকিসকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, সামনে রাখা সিংহাসনটি কি তাঁর? এ প্রসঙ্গে ৪২ নম্বর আয়াতে বর্ণিত আছে, কিলকিস যখন পৌছল তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, “তোমার সিংহাসন কি এরূপ?” সে বলল, ‘এটি তো ঐরূপই। আমরা ইতিপূর্বেই সমস্ত অবগত হয়েছি এবং আত্মসমর্পণও করেছি।”

রাণী বিলকিস প্রাসাদের ফটকের সন্নিকটে রাখা সিংহাসনটি দেখে হতভম্ব হয়ে যান। প্রথমে তিনি চিনতে না পেরে সঠিক জবাব দিতে ইতস্তত করেন, কারণ এটি প্রকৃতপক্ষে তাঁর সিংহাসন হলেও কোথায় যেন বৈসাদৃশ্য মনে হচ্ছিল। হযরত সোলায়মানের (আ) নির্দেশে রাণী বিলকিসের সিংহাসনটির কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়। এর মূল কারণ হযরত সোলায়মান (আ) রাণী বিলকিসের বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা করতে চান। বহুক্ষণ পরখ করার পর রাণী চিন্তা করলেন তার দরবারের সিংহাসনটি কিভাবে জেরুজালেমে বাদশাহ সোলায়মানের (আ) দরবারে আসল। এটি আল্লাহর কুদরত এবং তাঁর ইচ্ছায় চোখের নিমেষে ‘ইফরিত’ জিন মহাশূন্য দিয়ে দক্ষিণ আরব থেকে প্যালেস্টাইনের সিরিয়ায় এটি নিয়ে আসে। যাহোক, রাণী বিলকিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন এ কথা বলে যে, এটি তাঁর সিংহাসনের মত হুবহু একই এবং সম্ভবত এটিই তাঁর সিংহাসন, যাতে তিনি দরবারে বসতেন। শয়তানের ধোঁকায় রাণী বিভ্রান্ত হয়েছিলেন এবং শয়তানের প্ররোচনায় তিনি এবং তাঁর সম্প্রদায় এক আল্লাহর ইবাদতের পরিবর্তে সৌর পূজায় নিয়োজিত। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “আল্লাহর পরিবর্তে সে যার (সূর্য, নক্ষত্র) পূজা করত তাই তাকে সত্য থেকে নিবৃত্ত করেছিল, সে ছিল সত্য প্রত্যাখ্যানকারী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।” (২৭ : ৪৩) ইউসুফ আলী বলেন যে, বিলকিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিজেকে ধন্য মনে করলেন; যদিও তার সিংহাসনটি কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছিল তবুও তার অর্ন্তদৃষ্টি ও বুদ্ধিমত্তার ফলে রাণী বিলকিস তার সিংহাসনটি শেষ পর্যন্ত চিনতে পারলেন। ঘটনাটি একটি রূপক মাত্র। এখানে সিংহাসনটি চিনতে পারার সাথে সত্যকে জানার এক সম্পর্ক রয়েছে। কারণ কুফরী এবং ঈমান পরস্পরবিরোধী। হযরত সোলায়মানের (আ) প্রচারিত একেশ্বরবাদী মতবাদ পরবর্তীকালে রাণী বিলকিস গ্রহণ করেন এবং তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

রাণী বিলকিস দরবার কক্ষে প্রবেশ করার পূর্ব মুহূর্তে আর একটি পরীক্ষার সম্মুখীন হন। সূরা আন-নামলের ৪৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : “তাকে বলা হল এ প্রাসাদে প্রবেশ কর। যখন সে তার প্রতি (মেঝে) দৃষ্টিপাত করল তখন তাঁর মনে হল এটি একটি স্বচ্ছ জলাশয় এবং সে তার কাপড় টেনে হাঁটু পর্যন্ত তুলে ধরল।” সোলায়মান বললেন, “এটি তো স্বচ্ছ স্ফটিকের তৈরি প্রাসাদ।” বিলকিস তখন বললেন, “হে আমার প্রতিপালক, আমি ত নিজের প্রতি জুলুম করেছিলাম, আমি সোলায়মানের সাথে বিশ্বজগতের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করছি।”

হযরত সোলায়মানের (আ) রাজপ্রাসাদের সামনে একটি স্বচ্ছ জলাশয়ের কথা বলা হয়েছে। এই স্বচ্ছ জলাশয় সম্পর্কে বিভিন্ন ভাষ্যকার বিভিন্ন মত পোষণ করেন। স্বচ্ছ জলাশয় কথাটি স্পষ্ট নয়; কারণ জলাশয় কিভাবে স্বচ্ছ হবে— চৌবাচ্চা, জলাধার, জলাশয়, পুকুর প্রভৃতিতে পানি থাকা স্বাভাবিক কিন্তু প্রাসাদের সামনে এমন একটি খোলামেলা জলাশয় থাকাও অস্বাভাবিক। এজন্য কেউ কেউ মনে করেন যে, এই জলাশয়টি স্বচ্ছ কাচ দিয়ে ঢাকা ছিল। ইউসুফ আলী বলেন যে, “দরবার কক্ষের মেজে (floor) পালিশ করা স্বচ্ছ কাচ দিয়ে ঢাকা ছিল, যা পানির মত ঝলমল করত।”

মোহাম্মদ আসাদের মতে, “এটি ছিল একটি বিশাল জলাশয় (fathomless expanse of water) যার উপরিভাগ কাচ দিয়ে ঢাকা ছিল; তা না হলে এর উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া অসম্ভব ছিল।” পিকথাল এবং মালেকও জলাশয়ের কথা বলেছেন। যাহোক, পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে যে, রাণী বিলকিস দরবারের সম্মুখের মার্বেল চত্বর পার হয়ে যাবার সময় তিনি তাঁর পরনের কাপড় হাঁটু পর্যন্ত তোলেন, যাতে তা ভিজে না যায়। হযরত সোলায়মান (আ) রাণী বিলকিসের জ্ঞান-বুদ্ধি ও দূরদর্শিতা পরীক্ষার জন্য তাঁর দরবারের সামনে একটি চৌবাচ্চা নির্মাণ করে স্বচ্ছ কাচ দিয়ে তা এমনভাবে ডেকে দেন, যাতে বুঝা না যায়। প্রথম পরীক্ষায় সিংহাসন চিনতে পেরে উত্তীর্ণ হলেও দ্বিতীয় পরীক্ষায় রাণী বিলকিস মারাত্মক ভুল করে বসেন। তাঁর কাপড় হাঁটু পর্যন্ত তুলে পা, পায়ের পাতা ও গোড়ালি উন্মোচিত করে ফেলেন, যা যে-কোন নারীর পক্ষে তো বটেই, কোন রাণীর পক্ষে অশোভন ঘটনা। মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছায় এ ঘটনা ঘটেছিল এবং এতে তাঁর প্রচ্ছন্ন নিদের্শনা ছিল। রূপক অর্থে এ ঘটনাটিও ভাষ্যকারদের মতে আধ্যাত্মিকতা ও জড়বাদিতার মধ্যে একটি পার্থক্য দেখানো হয়েছে। হযরত সোলায়মান (আ) রাণী বিলকিসকে যখন বললেন, “এটি তো স্বচ্ছ স্ফটিক-নির্মিত প্রাসাদ” (transparent marble of crystal)। তখন রাণী বিলকিস লজ্জা পেয়ে উপরে উঠানো কাপড় নামিয়ে দিলেন। এতে প্রতীয়মান হয় যে, মহাজ্ঞানী সোলায়মান (আ) রাণী বিলকিসের তুলনায় অনেক গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও জ্ঞানবুদ্ধির অধিকারী ছিলেন। দ্বিতীয়ত, এ ঘটনার মাধ্যমে মহান আল্লাহতায়ালা রাণী বিলকিস ও তাঁর সৌরজগতের উপাসনাকারী সম্প্রদায়কে এভাবে শিক্ষা দেন যাতে তারা যেন কুফরী না করে এবং একেশ্বরবাদী হয়ে আল্লাহ্র ইবাদত করে। মহাজ্ঞানী সোলায়মানের (আ) দরবারে উপস্থিত হয়ে রাণী বিলকিস উপলব্ধি করেন যে, তিনি আল্লাহতায়ালার প্রেরিত পুরুষ, যিনি একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেছেন। রাণী আরও বুঝতে পারেন যে, হযরত সোলায়মান (আ) শুধুমাত্র একটি বিশাল রাজ্যের অধিপতিই নন, বরং মানুষ, জিন, বিহঙ্গের উপর তাঁর রয়েছে অসামান্য কর্তৃত্ব। জেরুজালেমে আসার পর রাণী বিলকিসের বোধোদয় হল এবং সৌরজগতের উপাসনার অসারতা সম্বন্ধে তিনি সজাগ হন। তিনি বুঝতে পারেন যে, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র সমস্ত কিছুই আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি এবং তারা এতকাল সৃষ্টিকর্তার ইবাদত না করে তাঁর সৃষ্ট পদার্থের উপাসনা করছেন। এভাবে রাণী বিলকিস ও তার সম্প্রদায় এক আল্লাহর ইবাদতে রত হলেন।

হযরত সোলায়মান (আ) এবং রাণী বিলকিসের ঘটনাবলি সাবাইনদের রাজত্বকালের গোড়ার দিকে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব এক সহস্রাব্দে সংঘটিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এ সময় রাজাদের বা শাসকদের উপাধি ছিল ‘মুকাররিবস্ববা’। খ্রিস্টপূর্ব ৬৫০ অব্দে দ্বিতীয় পর্যায়ে সাবাইনদের রাজত্ব শুরু এবং এ যুগের শাসকগণ ‘মূলত্ববা’ নামে পরিচিত হয়। রাণী বিলকিস প্রথম যুগের একজন পরাক্রমশালী শাসনকর্তা ছিলেন, যার সময়ে দক্ষিণ আরবের ইয়েমেনে সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। প্রত্নতাত্ত্বিক খনননের ফলে মা’রিবসহ অসংখ্য ধ্বংসস্তূপ আবিষ্কৃত হয়েছে, যা কালের স্বাক্ষর বহন করে রয়েছে।

রাণী বিলকিস ও তাঁর সম্প্রদায় একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী হলেও দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৬৫০ অব্দের পর সাবাইনগণ মুকাররিবস্ববাদের উত্তরাধিকারী হিসেবে ‘মূলস্ববাগণ’ রাজত্ব করতে থাকে। এ সময়ে পুনরায় নানা ধরনের অনাচার, অত্যাচার, অবিশ্বাস, পাপাচার সমাজ ও ধর্মীয় জীবনকে কলুষিত করে। এর ফল তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং এই ধ্বংসযজ্ঞে প্রধান ভূমিকা পালন করে প্রখ্যাত মা’রিবের বাঁধের ভাঙ্গন (bursting of the dam )।

পবিত্র কুরআন শরীফের ৩৪ নম্বর সূরা সাবায় সাবাইন বা সাবাবাসীদের সম্বন্ধে বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়েছে। ধ্বংসের পূর্বে সাবাইনদের রাজ্য ছিল খুবই ঐশ্বর্যশালী এবং কৃষিকাজ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণে তারা একটি শক্তিশালী ও সুসমৃদ্ধ রাজ্য গঠন করে। তাদের বাগান ফল-মূল, তরি-তরকারিতে ভরে থাকত। শহরের মধ্য দিয়ে খাল প্রবাহিত হত এবং মারিব বাঁধের পানি জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। ফলে সাবাইনদের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য ছিল। দক্ষিণ আরব বিশেষ করে ইয়েমেন ছিল সুগন্ধি দ্রব্য উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র এবং frankinscene, myrr-এর মত দুষ্প্রাপ্য সুগন্ধি প্রাচীন মিশর ও ব্যাবিলনীয় রাজ্যে রপ্তানি করা হত। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা ইয়েমেনকে বলা হত Arabia Felix বা ‘সুখী আরব অঞ্চল’। কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায় উগ্ৰ স্বভাবের, দাম্ভিক ও অবিশ্বাসী সাবাইনগণ নানা রকম কুফরীতে নিয়োজিত হয় এবং এর জন্য তাদের উপর আল্লাহতায়ালার গজব বর্ষিত হয়। তারা পরকালে বিশ্বাস করত না এবং পার্থিব সুখের প্রতি মোহগ্রস্ত ছিল।

সূরা সাবায় (৩৪) ১৫ থেকে ২১ আয়াতে সাবাইনদের ধ্বংস প্রসঙ্গে বলা হয়েছে : “সাবাবাসীর জন্য তাদের বাসভূমি ছিল এক নিদর্শন; দুটি উদ্যান-একটি ডান দিকে অপর একটি বাম দিকে। তাদের বলা হয়েছিল, তোমরা তোমাদের প্রতিপালক প্রদত্ত জীবিকা ভোগ কর এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। এই স্থান উত্তম এবং তোমাদের প্রতিপালক ক্ষমাশীল।” সাবাইনগণ রাণী বিলকিসের আমলে এক আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করলেও পরবর্তীকালে তারা নানা প্রকার অবৈধ, অসামাজিক ও নীতিবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে উচ্চশ্রেণী ও নিম্নশ্রেণীতে বিভক্ত হলে তাদের মধ্যে অনৈক্য দেখা দেয়। হালাল খাদ্য ছেড়ে তারা হারাম ভক্ষণ করতে থাকে এবং পরস্ব অপহরণ করে। শয়তানের প্ররোচনায় কুকর্ম করতে থাকে। তারা জড়বাদী ও বস্তুবাদী হয়ে পড়ে। আল্লাহতায়ালা প্রদত্ত প্রাচুর্যে তারা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠে এবং প্রতিপালক সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। ফলে অন্যান্য অভিশপ্ত জাতি ও জনপদের মত তাদের ধ্বংস হয়ে পড়ে অনিবার্য।

মারিব বাঁধ ভেঙ্গে বন্যার পানি সাবাইনদের শহরগুলো নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এ প্রসঙ্গে একই সূরার (৩৪) ১৬ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে : “পরে তারা আমার (আল্লাহ) আদেশ অমান্য করল, এর ফলে আমি তাদের উপর বাঁধ ভাঙ্গা বন্যা প্রবাহিত করলাম এবং তাদের উদ্যান দুটি এমনভাবে পরিবর্তন করে দিলাম, যাতে উৎপন্ন হয় বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউগাছ এবং কিছু কুলগাছ।” পবিত্র কুরআন শরীফে মা’রিব বাঁধ-এর নাম উল্লিখিত না হলেও বাঁধ ভাঙ্গার যে ঘটনা ঘটেছিল প্রাক-ইসলামী যুগে আরবদেশে তা নিঃসন্দেহে প্রখ্যাত এবং স্থাপত্য কৌশলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এই মা’রিব বাঁধকে কেন্দ্র করে। ১৬ নম্বর আয়াতে ‘আরিম’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যা দ্বারা বাঁধকে ইঙ্গিত করে। সাবাইন রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বর্তমানে নাকাব আল-হাজার নামক স্থানে মা’রিব বাঁধ নির্মিত হয়। মা’রিবের ধ্বংসাবশেষ এখনও দেখা যাবে। এই প্রাচীন কীর্তি সর্বপ্রথম ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি পর্যটক আরল্ড আবিষ্কার করেন এবং সেই সাথে প্রায় ষাটটি দক্ষিণ আরবের শিলালিপি উদ্ধার করেন। পরবর্তীকালে এডওয়ার্ড গ্লাসার (১৮৮২-৯৪) এবং ডাব্লিউ. বি. হারিস মা’রিব বাঁধে খনন কাজ ও অনুসন্ধান পরিচালনা করেন। ফ্রাঙ্ক. পি. অলব্রাইট রাণী বিলকিসের রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের সন্ধান পান এবং খননকাজ পরিচালনা করে ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য উল্লেখ করেন তার রিপোর্টে। এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটির পরিমাপ ছিল আয়াতাকার, উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিমে ৫৮০ মাইল লম্বা এবং উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্বে ৪০০ মাইল। এই অঞ্চলটিকে প্রাক- ইসলামী যুগের সর্ববৃহৎ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এর প্রায় ১০ মাইল জুড়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে ধ্বংসস্তূপ, মৃৎপাত্রের টুকরো, শিলালিপি। বর্তমানে এই স্থানের দর্শনীয় বস্তু হচ্ছে মা’রিব বাঁধ এবং আওয়াম মন্দির বা হারাম বিলকিস। আওয়াম মন্দিরটি ইলুমকা দেবতার নামে উৎসর্গিকৃত। এই মন্দিরের পাশে একটি সমাধিও আবিষ্কৃত হয়েছে।

মা’রিব বাঁধটি মাটি দিয়ে নির্মিত হয় এবং এই মাটির প্রাচীরকে মজবুত করার জন্য পাথর ব্যবহার করা হয়। বাঁধটি দুই মাইল লম্বা এবং ১২০ ফুট উঁচু ছিল। বাঁধটি মজবুত করার জন্য মাঝেমাঝে গোলাকার বুরুজ ব্যবহৃত হয়েছে। যে সমাধির ধ্বংসস্তূপ পাওয়া গিয়েছে তা কার সমাধি সঠিকভাবে বলা যায় না। মা’রিব বাঁধ কখন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তা সঠিকভাবে বলা যায় না। বর্তমানে ইয়েমেনের রাজধানী সানার ৬০ মাইল পূর্বে অবস্থিত মা’রিব দ্বিতীয় সাবাইন রাজ্যের মুলবার রাজধানী ছিল। মা’রিব সমুদ্রতট থেকে ৬৯০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। আরবি ঐতিহাসিক হামদানী তাঁর ‘ইকলিলে’ বলেন যে, মা’রিবে তিনটি দুর্গ নির্মিত হয়। কিন্তু সা’দ বলেন যে, মা’রিব বাঁধ খুবই আকর্ষণীয় ও অত্যাশ্চর্য। পি. কে. হিট্টি মা’রিব বাঁধ নির্মাণকে একটি উল্লেখযোগ্য প্রকৌশলী কৃতিত্ব ( remarkable engineering feat ) বলেছেন। ইয়েমেন তথা সাবাইন রাজ্যের সমৃদ্ধির মূল কারণ মারিব বাঁধের জলসেচ ব্যবস্থা। এটিতে অনেকগুলো পানি নিষ্কাশনের ফটক (sluice) ছিল এবং সমগ্র অঞ্চলে পানি সরবরাহ করা হলে কৃষি উৎপাদন মাত্রাধিকভাবে বৃদ্ধি পায়। এছাড়া ছিল মশলা রপ্তানির ব্যবসা। মা’রিব বাঁধ কবে নির্মিত হয়েছিল, কে নির্মাণ করেন এবং কখন এটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হল তা সঠিকভাবে বলা যায় না, কারণ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এসব ক্ষেত্রে মতবিরোধ রয়েছে। কোন কোন শিলালিপিতে বাঁধের নির্মাতা হিসাবে ইথি-আমারা বাইন’ এবং তার পিতার নাম উল্লেখ আছে; কিন্তু হামদানী, আল-মা’সূদী, ইসফাহানী ও ইয়াকূতের মতে নির্মাতা ছিলেন লুকমান ইবন আদ। কিংবদন্তিতে লুকমান খুবই পরিচিত ব্যক্তিত্ব।

মা’রিব বাঁধ ছিল দক্ষিণ আরবের সমৃদ্ধির প্রতীক এবং এর ভাঙ্গন এই সমৃদ্ধিকে ধূলিসাৎ করে দেয়। মা’রিব বাঁধের ভাঙ্গনকে কেন্দ্র করে অনেক কবিতা রচিত হয়েছে এবং ইসলামী সাহিত্যে এর একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। আল-ইসফাহানী মা’রিব বাঁধ সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ দেন। তাঁর মতে, ইসলামের আবির্ভাবের চারশ বছর পূর্বে মা’রিব বাঁধ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় অর্থাৎ ২১০ খ্রিস্টাব্দে। ইউসুফ আলী মনে করেন যে, ১২০ খ্রিস্টাব্দে মা’রিব বাঁধ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অপরদিকে অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ বলেন যে, দক্ষিণ আরবের খ্রিস্টান আবিসিনীয় রাজা আবরাহার ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার কা’বা শরীফ ধ্বংসের জন্য হস্তী বাহিনী নিয়ে অভিযান করে। সে সময়ে মা’রিব বাঁধ অক্ষত ছিল। অবশ্য বহুবার সংস্কার করার পর এটিকে ব্যবহার করা হয়। আবরাহার (খ্রিঃ ৫৪২-৪৩ ) সময়ের একটি শিলালিপিতে মা’রিব বাঁধের সংস্কারের উল্লেখ আছে। তাহলে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে মা’রিব বাঁধ ব্যবহারযোগ্য ছিল বলে মনে হয়। কোন কোন ঐতিহাসকি মা’রিব বাঁধ ভাঙ্গার তারিখ ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সমস্যা হল যে, দ্বিতীয় সাবাইন রাজ্যের পরিসমাপ্তি ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ১৫ অব্দে এবং পাপাচার ও শয়তানের প্ররোচনায় কুফরীতে লিপ্ত সাবাইনদের মা’রিব বাঁধ আল্লাহতায়ালা প্রবল জলস্রোত ও প্লাবন দ্বারা এ রাজ্য ধ্বংস করেন। ধারণা করা হয় যে, পাহাড়ের ঝর্ণা থেকে প্রবল বেগে পানি বাঁধে এস জমতে থাকে এবং এই প্রচণ্ড জলস্রোতের চাপে মজবুত করে নির্মিত বাঁধে ফাটল ধরে কয়েকটি স্থানে। এর ফল বন্যার পানিতে মা’রিবসহ বিশাল জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। প্লাবনের মাত্রা এতই ভয়ঙ্কর ও মারাত্মক ছিল যে সমস্ত কৃষি উপযোগী জমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায় এবং জমি অনুর্বর হয়ে পড়ে। এ কারণে ১৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : “তাদের উদ্যান দুটি পরিবর্তন করে দেওয়া হল এমনভাবে যে তাদের জমিতে (সুস্বাদু ফল-মূলের পরিবর্তে) বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউ গাছ এবং কিছু কুলগাছ উৎপন্ন হতে থাকে।” ধারণা করা হয় যে খ্রিস্টপূর্ব ১১৫ শতাব্দীতে সাবাইন রাজ্যের পতন হয় এবং তাদের উত্তরাধিকারী হিসাবে হিমারীয়গণ দক্ষিণ আরবে শাসন করতে থাকে (খ্রিঃ পূঃ ১১৫ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দ)। মা’রিব বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবনের সৃষ্টি হলেও ধারণা করা হয় যে, পরবর্তী পর্যায়ে কয়েকবার মা’রিব বাঁধ পুনঃনির্মিত হয় এবং এই পুনঃনির্মাণ আবরাহার শাসনকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল, যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে এটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

মা’রিব বাঁধের ভাঙ্গন ছিল পাপিষ্ঠ ও দুরাত্মা সাবাইন গোষ্ঠীর প্রতি শাস্তিস্বরূপ। একই সূরার ১৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “আমি (আল্লাহ) তাদেরকে এই শাস্তি দিয়েছিলাম (যেহেতু) তারা সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিল। আমি কৃতঘ্ন ব্যতীত অন্য কাউকে শাস্তি দিই না।” মহান আল্লাহতায়ালা করুণার বশবর্তী হয়ে সুস্বাদু ফল বিশিষ্ট বৃক্ষ, উর্বর জমি, নিরাপদ সড়ক ও বাণিজ্যপথ সৃষ্টি করে সাবাইনদের সমৃদ্ধি, প্রাচুর্য, বৈভব, ঐশ্বর্যের পথ সুগম করেছিলেন। কিন্তু লোভী, পরস্ব অপহরণকারী, ঈর্ষাপরায়ণ, আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর সাবাইনবাসী ন্যায় ও সত্যের পথ ত্যাগ করে এবং একেশ্ববাদের স্থলে পুনরায় সেওলপূজা, মূর্তিপূজায় আত্মনিয়োগ করে। মহান আল্লাহতায়ালা তাদের নিয়ামতস্বরূপ সুস্বাদু ফলের বাগান ও উর্বর জমিই দেননি বরঞ্চ জনপদ সৃষ্টি করেছেন ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণের জন্য। সূরা সাবার ১৮ নম্বর আয়াতে বর্ণিত আছে, “তাদের এই যে সব জনপদের প্রতি আমি (আল্লাহ) অনুগ্রহ করেছিলাম সেগুলোর অন্তর্বর্তী স্থানে দৃশ্যমান বহু জনপদ স্থাপন করেছিলাম এবং ঐ সমস্ত জনপদে ভ্রমণকালে বিশ্রামের জন্য নির্দিষ্ট ব্যবধানে স্থান (সরাইখানা) নির্ধারিত করেছিলাম এবং তাদেরকে বলেছিলাম, তোমরা এসব জনপদে নিরাপদে দিবারাত্র ভ্রমণ কর।” ইউসুফ আলী এই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন যে, দক্ষিণ আরবের ইয়েমেন বা মা’রিব থেকে উত্তরে সিরিয়া প্যালেস্টাইনের জেরুজালেম পর্যন্ত বিস্তৃত মশলা সড়কে (Spice route) নিরাপদে কাফেলা যাতায়াত করত। এই মহাসড়ক পরবর্তী পর্যায়ে পশ্চিম দিকে ফেরাউনদের মিশরের নীল নদ পর্যন্ত এবং পূর্ব দিকে মেসোপটেমীয় ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের ফোরাত ও দজরা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। এই মহাসড়কের মাঝে মাঝে বিশ্রামের জন্য সরাইখানা নির্মিত হয় এবং এরূপ স্থান নির্ধারণের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কাফেলাগুলোকে প্রকাশ্য রাজপথে রাহাজানি থেকে রক্ষা করা। কিন্তু স্বার্থান্বেষী সাবাইনগণ এর কোন গুরুত্ব বা মর্যাদা দেয়নি, বরং তাদের অর্থলোভ এমন প্রচণ্ড আকারে প্রকাশ পায় যে, তারা দুর-দূরাঞ্চলে বিশ্রামের স্থান নির্মাণের জন্য আবেদন করে, যাতে তারা একচেটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে। এ প্রসঙ্গে ১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : “কিন্তু তারা বলল, হে আমাদের প্রতিপালক। আমাদের সফরের মঞ্জিলের ব্যবধান বর্ধিত কর। এভাবে তারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল (লোভ ও স্বার্থপরতার জন্য)। ফলে আমি তাদেরকে কাহিনীর বিষয়বস্তুতে (legend) পরিণত করলাম এবং তাদের ছিন্নভিন্ন করে দিলাম। এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য নিদর্শন রয়েছে।”

আল্লাহতায়ালা সাবাইনদের লোভ-লালসা, ঘৃণা স্বার্থপরতা ও নৈতিকতাবিরোধী কার্যকলাপের জন্য তাদেরকে ছিন্নভিন্ন করে দেন। এ কথার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভাষ্যকার ইউসুফ আলী বলেন যে, আস্তে আস্তে জমির পানি শুকিয়ে গিয়ে অনুর্বরতার সৃষ্টি হয়। মিষ্টি পানির অভাবে সুস্বাদু ফল-মূল উৎপাদন ব্যাহত হয়। ভৌগোলিক পরিবেশ পরিবর্তিত হলে অনাবৃষ্টি শুরু হয় ও আবহাওয়া শুষ্ক হতে থাকে। বৃক্ষাদি কেটে ফেলার জন্য কোন বাগান উদ্যান থাকল না; বৃক্ষ না থাকায় ঝড়-ঝাপটা ক্রমাগত হতে থাকে। আধ্যাত্মিকতার স্থলে সাবাইনগণ বস্তুবাদকে প্রাধান্য দিতে থাকে। পার্থিব সুখ- স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তারা মারাত্মকভাবে অর্থলোভী হয়ে পড়ে এবং ব্যবসায় একচেটিয়া আধিপত্য বজায়ের জন্য সফরের মঞ্জিলের ব্যবধানের কথা বলে। শয়তানের (ইবলিস) প্ররোচনায় তারা এক আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে অর্থের দেবতাকে (god of mammon ) পূজা করতে থাকে। এ কারণে আল্লাহতায়ালা তাদের ‘কৃতঘ্ন’ বলেছেন। শুধু তাই নয় আল্লাহতায়ালা তাদের জনপদগুলো বিলুপ্ত করে দিয়েছেন, যার ফলে তারা ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে গিয়ে জাতি হিসাবে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। ইউসুফ আলী যথার্থই বলেন, “They gradually passed out of history” অর্থাৎ “তারা ক্রমে ক্রমে ইতিহাসের পাতা থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।” তার পরিবর্তে তারা শুধুমাত্র একটি নামে পরিণত হয়েছে, যাদের প্রাচীন ঐতিহ্য সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।

সাবাইনদের বিপথগামিতার মূলে প্রধান প্ররোচনা আসে ইবলিসের কাছ থেকে। প্রতারক, প্রবঞ্চক, অভিশপ্ত ইবলিস সবসময় মানুষের সুকুমার গুণাবলিকে স্তব্ধ করে দিয়ে অসত্য, মিথ্যাচার, অনাচার, পাপাচার প্রভৃতি কাজে প্রলোভিত করে। সাবাইনদের ক্ষেত্রে এর কোন ব্যতিক্রম দেখা যায় নি। এ কারণে মহান আল্লাহতায়ালা সূরা সাবার (২০) ২১০ নম্বর আয়াতে বলেন, “তাদের সম্বন্ধে ইবলিসের প্রত্যাশা সফল হল; ফলে তাদের মধ্যে একটি বিশ্বাসী দল ব্যতীত সকলেই তার (শয়তানের) অনুসরণ করল তাদের উপর শয়তানের কোন আধিপত্য ছিল না। কারা পরলোকে বিশ্বাসী এবং কারা তাতে সন্দিহান তা প্রকাশ করে দেওয়াই ছিল আমার (আল্লাহ) উদ্দেশ্য। তোমার প্রতিপালক সব বিষয়ের তত্ত্বাবধায়ক।”

সকল অধ্যায়

১. প্রথম অধ্যায় : আরব ভূখণ্ডের ইতিহাসের উৎসসমূহ
২. দ্বিতীয় অধ্যায় : প্রাক-ইসলামী যুগ : রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
৩. তৃতীয় অধ্যায় : প্রাচীন আরব ভূখণ্ডের ভৌগোলিক ও গোত্রীয় প্রথার বিবরণ
৪. চতুর্থ অধ্যায় : আরব জাতি : বায়দা ও বাকিয়া
৫. পঞ্চম অধ্যায় : ‘অজ্ঞতার যুগে’ আরব দেশ
৬. প্রথম অধ্যায় : হযরত মুহাম্মদের (স) আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট
৭. দ্বিতীয় অধ্যায় : হযরত মুহাম্মদের (স) প্রথম জীবন ও নবুওয়াত
৮. তৃতীয় অধ্যায় : প্রাথমিক প্রত্যাদেশ
৯. চতুর্থ অধ্যায় : ধর্মপ্রচারে বিরোধিতা
১০. পঞ্চম অধ্যায় : সম্প্রসারিত দিগন্ত
১১. প্রথম অধ্যায় : কুরাইশদের প্ররোচনা ও হিজরত
১২. দ্বিতীয় অধ্যায় : মক্কাবাসীদের প্রতিরোধের ব্যর্থতা ও ইসলামের বিজয়
১৩. তৃতীয় অধ্যায় : মক্কাবাসীদের ওপর মহাবিজয়
১৪. চতুর্থ অধ্যায় : হযরত মুহাম্মদের (স) সাংগঠনিক ক্ষমতা
১৫. পঞ্চম অধ্যায় : হযরত মুহাম্মদের (স) সাথে ইহুদীদের সম্পর্ক
১৬. ষষ্ঠ অধ্যায় : ইসলামী রাষ্ট্রের : রূপরেখা মদিনা সনদ
১৭. সপ্তম অধ্যায় : হযরত মুহাম্মদের (স) শেষ জীবন (৬২৮-৬৩২ খ্রি.)
১৮. প্রথম অধ্যায় : হযরত আবু বকর (রা) (৬৩২-৬৩৪ খ্রি.)
১৯. দ্বিতীয় অধ্যায় : হযরত ওমর ফারুক (রা) (৬৩৪-৬৪৪ খ্রি.)
২০. তৃতীয় অধ্যায় : হযরত ওসমান যুন্নুরাইন (রা) (৬৪৪-৬৫৬ খ্রি.)
২১. চতুর্থ অধ্যায় : হযরত আলী আসাদুল্লাহ (রা) (৬৫৬-৬৬১ খ্রি.)
২২. পঞ্চম অধ্যায় : খিলাফত আমলের প্রশাসনিক ব্যবস্থা
২৩. প্রথম অধ্যায় : উমাইয়া রাজবংশের বৈশিষ্ট্য
২৪. দ্বিতীয় অধ্যায় : মুয়াবিয়া (৬৬১-৬৮০ খ্রি.)
২৫. তৃতীয় অধ্যায় : প্রথম ইয়াজিদ ও দ্বিতীয় মুয়াবিয়া (৬৮০-৬৮৪ খ্রি.)
২৬. চতুর্থ অধ্যায় : প্রথম মারওয়ান ও আবদুল মালিক (৬৮৪-৭০৫ খ্রি.)
২৭. পঞ্চম অধ্যায় : প্রথম ওয়ালিদ (৭০৫ – ৭১৫ খ্রি.)
২৮. ষষ্ঠ অধ্যায় : সুলায়মান এবং দ্বিতীয় ওমর (৭১৫-৭২০ খ্রি.)
২৯. সপ্তম অধ্যায় : পরবর্তী উমাইয়া খলিফাগণ (৭২৪-৭৫০ খ্রি.)
৩০. অষ্টম অধ্যায় : উমাইয়াদের পতন
৩১. নবম অধ্যায় : উমাইয়া খিলাফতের শাসনব্যবস্থা, সমাজ ও সভ্যতা
৩২. প্রথম অধ্যায় : আবুল আব্বাস (৭৫০-৭৫৪ খ্রি.) ও আল-মনসুর (৭৫৪-৭৭৫ খ্রি.)
৩৩. দ্বিতীয় অধ্যায় : আল-মাহদী, আন-হাদী, হারুন আর-রশীদ
৩৪. তৃতীয় অধ্যায় : আল-আমীন (৮০৯-৮১৩ খ্রি.)
৩৫. চতুর্থ অধ্যায় : আল-মামুন (৮১৩-৮৩৩ খ্রি.)
৩৬. পঞ্চম অধ্যায় : আব্বাসীয় খিলাফতের শেষার্ধ (৮৩৩-১২৫৮ খ্রি.)
৩৭. ষষ্ঠ অধ্যায় : বুয়াইয়া (৯৪৫-১০৫৫ খ্রি.) এবং সেলজুক বংশ (১০৫৫-১১৯৪ খ্রি.)
৩৮. সপ্তম অধ্যায় : আব্বাসীয় খিলাফতের অবনতি ও পতন
৩৯. অষ্টম অধ্যায় : আব্বাসীয় যুগের শাসনব্যবস্থা, সমাজ ও সভ্যতা
৪০. পরিশিষ্ট-১ : The 100: A Ranking of the most influential Persons in History: by Michael H. Hart Muhammad (sm) এবং বাংলা তর্জমা
৪১. পরিশিষ্ট-২ : হযরত মুহাম্মদ (স) প্রসঙ্গে বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতামত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন