সপ্তম অধ্যায় : আব্বাসীয় খিলাফতের অবনতি ও পতন

সৈয়দ মাহমুদুল হাসান

সপ্তম অধ্যায় – আব্বাসীয় খিলাফতের অবনতি ও পতন 

৭৫০ খ্রিস্টাব্দে আবুল আব্বাস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আব্বাসীয় খিলাফত ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে দুরাত্মা হালাকু খান কর্তৃক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। দুর্ধর্ষ ও বর্বর তাতার আক্রমণে সুদীৰ্ঘ পাঁচশত বছরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের আকস্মিক পরিসমাপ্তি ঘটে। আব্বাসীয় বংশের এহেন অধঃপতন এবং বিলুপ্তির মূলে বিবিধ কারণ রয়েছে। 

(ক) ইবন খালদুনের নীতিকথা : প্রত্যেক ব্যক্তি ও জাতির জীবনে যে তিনটি অপরিহার্য স্তর রয়েছে তা হল উত্থান, ক্রমবিকাশ ও উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহণ এবং অধঃপতন ও বিলুপ্তি। ইবন-খালদূনের মতে, সাধারণত কোন রাজবংশ এক শতাব্দীর অধিক স্থায়ী হয় না। উমাইয়া বংশের ক্ষেত্রে এটি যেমন প্রযোজ্য তেমনি আব্বাসীয় বংশের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। পাঁচশত বছর ব্যাপী আব্বাসীয় খিলাফত বজায় থাকলেও প্রকৃতপক্ষে এর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ হতে ৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের আল-মুতাওয়াক্কিলের রাজত্ব (৮৪৭-৮৬১) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ৮৪৭ হতে ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আব্বাসীয় খলিফাগণ প্রকৃত ক্ষমতা এবং প্রভুত্ব হারিয়ে আমীর ও উজিরদের ক্রীড়নকরূপে সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিলেন। সুতরাং ঐতিহাসিক পটভূমিতে বিচার করলে দেখা যাবে যে, আব্বাসীয়দের অধঃপতন একশত বছর পরেই অর্থাৎ আল-মুতাওয়াক্কিলের খিলাফত হতে শুরু হয়। হিট্টি যথার্থই বলেন যে, “আল- মুতাওয়াক্কিল অধঃপতনের যুগের প্রথম খলিফা।” 

(খ) উত্তরাধিকারীদের অযোগ্যতা : আব্বাসীয় খিলাফতের অধঃপতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল উত্তরাধিকারীদের অযোগ্যতা, দুর্বলতা, অকর্মণ্যতা এবং বিলাসপ্রিয়তা। সর্বমোট ৩৭ জন খলিফার মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যতীত প্রায় সমস্ত খলিফা শাসনকার্যে সুনাম অর্জন করতে পারেন নি। আল-থালাবী (Al-Thalabi ) বলেন, “আল-মনসুর আব্বাসীয় খিলাফতের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করেন, আল-মামুন তা পরিপূর্ণ করেন এবং আল-মুতাজিদ যবনিকাপাত করেন।” আব্বাসীয় খলিফাদের মধ্যে কেবল মনসুর, মাহদী, হারুন এবং মামুন তাঁদের কার্যস্পৃহা, বিচক্ষণতা, রণনৈপুণ্য, বিদ্যোৎসাহিতা ও দূরদর্শিতার দ্বারা অশেষ কীর্তি রেখেছেন। আল-মুতাজিদের (৮৯২-৯০২ খ্রি.) পর অভ্যন্তরীণ অরাজকতা, কুচক্রী এবং স্বার্থন্বেষী মন্ত্রীদের ষড়যন্ত্রের ফলে পরবর্তী উত্তরাধিকারিগণ ভোগ-বিলাসে নিমগ্ন থেকে রাজকার্যে অবহেলা করতেন। 

(গ) সাম্রাজ্যের বিশালতা : উমাইয়া শাসনকে ‘আরব রাজত্ব’ এবং আব্বাসীয় খিলাফতকে ‘ইসলামী সাম্রাজ্য’ বলে বার্নার্ড লুইস অভিমত প্রকাশ করেন। এর কারণ আব্বাসীয় খলিফাদের আমলে ইসলাম আরবদের সম্পত্তির পরিবর্তে সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে তৎকালীন বিশ্বে সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যের পত্তন করতে সক্ষম হয়। সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের মধ্যে ইসলামের ব্যাপকতা নিহিত ছিল এবং আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের পতনের মূলে ছিল বিশাল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠার অক্ষমতা। আব্বাসীয় সাম্রাজ্য আটলান্টিক মহাসাগর হতে সিন্ধুনদ এবং কাস্পিয়ান সাগর হতে নীলনদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। রাস্তাঘাটের অভাবে দ্রুত যানবাহন ব্যবস্থা তখনকার দিনে অসম্ভব ছিল। প্রদেশের সংবাদ রাজধানী বাগদাদে সময়মত পৌঁছত না এবং সময়মত খলিফা বিদ্রোহ দমনের জন্য দূর-দূরাঞ্চলে অভিযান প্রেরণ করতে পারতেন না। উচ্চাভিলাসী প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণও স্বাধীনভাবে রাজকার্য পরিচালনা করতেন। খলিফার পক্ষে এই বিশাল সাম্রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা কায়েম করা ও দুঃসাধ্য ছিল। 

(ঘ) স্বাধীন রাষ্ট্রের উৎপত্তি : কেন্দ্রীয় শাসন-ব্যবস্থার সুষ্ঠু প্রবর্তনের অভাব, সাম্রাজ্যের বিশালতা, উপযুক্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব, প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের উচ্চাভিলাস এবং রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপ আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সহায়ক ছিল। আব্বাসীয় যুগের প্রথম দিকেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু হয় এবং খলিফা হারুনের রাজত্বকালে উত্তর আফ্রিকার শাসনকর্তা ইব্রাহিম ইবন- আগলাব ৮০০ খ্রিস্টাব্দ হতে স্বাধীন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। মামুনের আমলে তাহিরী বংশ স্বাধীনভাবে খোরাসানে রাজত্ব করতে থাকে। এ ছাড়া পরবর্তীকালে সমগ্র আব্বাসীয় সাম্রাজ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম হয়- ইদ্রিসীয়, সাফ্ফারী, সামানী, বুয়াইয়া, সেলজুক, গজনভী, ফাতেমীয় প্রভৃতি। যোগাযোগ ব্যবস্থা, সুসংগঠিত সৈন্যবাহিনী এবং বিশ্বস্ত কর্মচারীর অভাবে খলিফাদের পক্ষে এ সমস্ত স্বাধীন রাজ্য জয় করে সাম্রাজ্যভুক্ত করা সম্ভবপর হয় নি। সাম্রাজ্যেল ঐক্য ও সংহতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা দুরূহ ছিল। আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের দুরবস্থা প্রসঙ্গে হিট্টি বলেন, “রোগী ইতিপূর্বেই মৃত্যুশয্যায় শায়িত ছিল, তা টের পেয়ে সিঁদেল চোর দরজা ভেঙ্গে অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং রাজকীয় সম্পত্তি হতে স্ব স্ব অংশ কেড়ে লয়।” 

(ঙ) সামরিক বিভাগের অবহেলা : উমাইয়া যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সামরিক বিজয় আর আব্বাসীয় খিলাফতের বৈশিষ্ট্য ছিল কৃষ্টি ও সভ্যতার বিকাশ। পারসিক সামরিক শক্তির সহায়তায় আব্বাসীয়গণ ক্ষমতা লাভ করে সত্য কিন্তু আব্বাসীয় সৈন্যবাহিনীতে বিভিন্ন জাতি, গোত্র এবং ধর্ম মতাবলম্বীদের সমাবেশ থাকায় এর ক্ষমতা এবং রণকৌশল বহুলাংশে লাঘব হয়। সিরিয়া, মিসর, আফ্রিকা, ইরাক, পারস্য ও ট্রান্স- অক্সিয়ানার বহু নব-দীক্ষিত মুসলমান আব্বাসীয় বাহিনীতে যোগদান করে। উপরন্তু, জাতি বা গোত্রের ভিত্তিতে সৈন্যবাহিনী গঠন করায় সৈন্যবাহিনীর শক্তি হ্রাস পায়। আল- মনসুর মিসরীয়, মুদারীয় এবং খোরাসানী নামে তিনটি জাতিভিত্তিক সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। মুতাসিম সর্বপ্রথম মধ্য এশিয়ার দুর্ধর্ষ তুর্কীদের নিয়ে একটি অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন বাহিনী গঠন করেন। সৈন্যদলের দ্বন্দ্ব এবং ঈর্ষাপরায়ণতা সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে দুর্বল করে ফেলে। খলিফাদের অবহেলা ও উদাসীনতার ফলে সৈন্যদের শৌর্য-বীর্য এবং সামরিক শক্তির এতদূর অবনতি ঘটে যে, তারা বহিঃশত্রু এবং বিদ্রোহীদের আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়। নিয়মিত বেতন হতে বঞ্চিত হয়ে তুর্কী সৈন্যদল খলিফা আল- মু’তাজকে হত্যা করে। আল-মুকতাদীরের রাজত্বে আব্বাসীয় সেনাবাহিনীর পক্ষে খ্রিস্টানদের সাথে ধর্ম-যুদ্ধে (ক্রুসেড) তুর্কী সুলতানদের সাহায্য করা সম্ভবপর হয় নি। সর্বশেষ খলিফা মুসতাসিম সৈন্য-বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করেন (Disbanded)। হালাকু খান বাগদাদ নগরী ধূলিসাৎ করবার জন্য তীব্র আক্রমণ করলে প্রাচ্যের সুরম্য নগরীকে রক্ষা করবার মত খলিফার কোন সুসংগঠিত সেনাবাহিনী ছিল না। 

(চ) সুষ্ঠু মনোনয়ন নীতির অভাব : আব্বাসীয় খিলাফতের অধঃপতনের অপর একটি বিশেষ কারণ হল সিংহাসনে উত্তরাধিকারকে কেন্দ্র করে রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিরোধ, স্বার্থান্বেষী কোন্দাল, ষড়যন্ত্র ও রক্তপাত। এর মূলে ছিল সুষ্ঠু মনোনয়ন নীতির অভাব। রাজ্যের সংহতি এবং স্থিতিশীলতার অন্তরায় এই মনোনয়ন নীতির ফলে খলিফার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, পিতৃব্যের মধ্যে আত্মকলহ, ষড়যন্ত্র এবং গুপ্তহত্যা অপ্রতিহতভাবে চলতে থাকে। বলা বাহুল্য যে, হারুনের অদূরদর্শিতার ফলে আমীন এবং মামুনের মধ্যে ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। আল-মুনতাসির দরবারী ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা ও ঈর্ষাবশে পিতা আল-মুতাওয়াক্কিলকে গুপ্তহত্যা করে আব্বাসীয় শাসনের শেষভাগে এক মারাত্মক পরিস্থিতির সূচনা করেন। 

(চ) জাতিগত কোন্দল : উমাইয়া খিলাফতে গোষ্ঠী কোন্দল দেখা দিলেও আব্বাসীয় যুগে এটি চরম আকার ধারণ করে। আরব মুসলমান, অনারব মুসলমান ও নব-দীক্ষিত মুসলমান প্রভৃতি জনশ্রেণীর মধ্যে জাতি-বিভেদ ও গোত্ৰকলহ দেখা দেওয়ায় মুসলিম সাম্রাজ্যের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ে। হিমারীয় ও মুদারীয়, পারস্য, তুর্কী, সেমিটিক, বার্বারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আব্বাসীয় খিলাফতকে দুর্বল এবং শক্তিহীন করে। আমীনের পরাজয়ে মামুনের বিজয় প্রকৃত অর্থে ছিল আরবদের উপর পারস্যবাসীর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার সূচনা। এর পূর্বে হারুনের সময়ে বার্মেকী বংশ রাজতন্ত্রকে পারসিকীকরণ করবার প্রয়াস পায়। পারস্যবাসী আরবদের ঘৃণা করত এবং আরবগণও পারস্যবাসীসহ সকল অনারবদের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করত। বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত মুসলমানদের একসূত্রে গ্রথিত করবার কোন নীতি এবং প্রেরণা তাঁদের ছিল না। ইরানি, পারস্যবাসী, তুরানি তুর্কিগণ অথবা হেমেটিক বার্বারগণ কেহই সেমিটিক আরবদের সঙ্গে একই গ্রন্থিতে আবদ্ধ হতে পারে নি। 

(জ) শ্রেণীগত বিভেদ : বিভিন্ন ধর্মমতাবলম্বী মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং অনৈসলামিক কার্যকলাপ আব্বাসীয় খিলাফতে ধর্মীয় অরাজকতার সূচনা করে। উমাইয়া রাষ্ট্রীয় প্রধান খলিফার মর্যাদা লাভ করেন; কিন্তু আব্বাসীয়গণ সুন্নী মতাবলম্বী হিসেবে বিশ্বাসীগণের নেতা (Amir-ul-Muminin) উপাধি গ্রহণ করেন সত্য কিন্তু জাগতিক এবং ধর্মীয় উভয় ক্ষেত্রে তাঁদের অপ্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং অসামান্য প্রভুত্ব পরিলক্ষিত হয় নি আব্বাসীয় যুগে বিভিন্ন মতাবলম্বী সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়- শিয়া, সুন্নী, দাইলামী, কারামাতি, মুতাজিলা, ইসমাইলী গুপ্তঘাতক দল (Assasins), আশায়ারী, জিন্দিক, সর্বেশ্বরবাদী (Pantheism), বাতিনী, ফাতেমীয় প্রভৃতি। প্রাচীন ঐতিহ্যে গঠিত ইরানী বংশ-সম্ভূত পারস্যবাসী আর কোনদিই সেমিটিক বংশের আরবদের প্রভুত্বকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে নি। পারস্যবাসী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও তাদের অগ্নি-উপাসনার স্পৃহা প্রশমিত হয় নি। আল-মনসুরের রাজত্বে মাজুস (Magian) নেতা সানবাদ এবং রাওয়ান্দিয়া (যারা খলিফাকে আল্লাহ্র অবতার মনে করত) খোরাসানে বিদ্রোহ করে। হারুনের খিলাফতে রাজকার্য পারস্যের শিয়া সম্প্রদায়বুক্ত বার্মেকিগণ কুক্ষিগত করে এবং আমীনের উজির ফজল-বিন-রাবীর সাথে মামুনের উজির ফজল-বিন-সহলের দ্বন্দ্ব বস্তুত সুন্নী এবং শিয়াদের দ্বন্দ্ব বলে মনে করা হয়। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য মনসুর শিয়া নেতৃবৃন্দকে অবমাননা ও হত্যা করেন; কিন্তু তা উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষভাবকে গভীর হতে গভীরতর করে। শুধু শিয়া ইমাম জাফর-আস-সাদিককে নয়, বরং হানাফী ও মালিকী মতবাদের জনক ইমাম আবু হানিফা এবং ইমাম মালিককে নির্যাতন করা হয়। খলিফাদের এহেন ধর্মীয় নীতি জনসাধারণকে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। বার্মেকীদের ধ্বংস খলিফা হারুনের প্রগাঢ় সুন্নী প্রবণতার ফলশ্রুতি বলে মনে করা হয়। তিনি শিয়া মতবাদকে প্রাধান্য দেন নি এবং আবু ইউসুফের নেতৃত্বে হানাফী ধর্মমত সুসংগঠিত করার প্রয়াস পান। শিয়া প্রবণতা সত্ত্বেও মামুনের রাজত্বে আলী-ইবন-রাজী অস্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। গোঁড়া ইসলামী মতবাদ (Orthodox Islam)-এর পরিবর্তে মামুন মুতাজিল মতবাদকে ৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দান করেন এবং এর বিরোধিতা করায় হাম্বলী মতবাদের জনক আহম্মদ ইবন-হাম্বলকে কারারুদ্ধ করতে দ্বিধাবোধ করেন নি। আল-মুতাসিমও তাঁকে নির্যাতন করেন। ৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে আল-মুতাওয়াক্কিলের রাজত্বে মুতাজিলদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আল-গাজ্জালী মুতাজিলা মতবাদের পরিবর্তে আশায়ারী মতবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। এ ছাড়া জিন্দিক, গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়, কারামাতি সম্প্রদায় প্রভৃতি সাম্রাজ্যের ঐক্য ও সংহতিকে তাদের ভ্রান্ত এবং অনৈসলামিক প্রচারণা দ্বারা বিঘ্নিত করে। দুর্বল আব্বাসীয় খলিফাদের অকর্মণ্যতা ও অযোগ্যতার সুযোগে শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত দাইলামী বুয়াইয়া আমীরগণ কেবল স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেন নি; বরং সুন্নী খলিফার ধর্মীয় ও পার্থিব মর্যাদাকে বহুলাংশে ক্ষুণ্ণ করেন। সুন্নী সেলজুকদের আবির্ভাবে এই শিয়া প্রাধান্য বিলুপ্ত হয়। ধর্মীয় ক্ষেত্রে আব্বাসীয় খিলাফতের সময়ের মত অপর কোন সময়ে এরূপ নৈরাশ্যজনক অরাজকতা পরিলক্ষিত হয় নি। 

(ঝ) আরব-অনারব বিবাহ : আব্বাসীয় বংশের অধঃপতনের অন্যতম কারণ পরবর্তী খলিফাদের বিলাস-বাসন এবং অনৈসলামিক কার্যকলাপ। পারস্য প্রভাবে আব্বাসীয় খিলাফতে নানারূপ আচার-অনুষ্ঠান প্রবর্তিত হয়। মদ্যপান, হারেমের ভোগ- বিলাসিতা, ক্রীতদাসী, নপুংসক রক্ষী-বাহিনী, উপপত্নী, বিদেশিনীর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন প্রভৃতি আব্বাসীয় বংশের সমাজ জীবনকে কলুষিত করে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মহিলাদের বিবাহ করায় খলিফাগণ তাঁদের রক্তের আভিজাত্য হারাতে থাকেন এবং ক্রমশ দুর্বল, ইন্দ্রিয়পরায়ণ এবং মাত্রাধিক ভোগ-বিলাসী হয়ে পড়েন। মনসুরের মাতা ছিলেন একজন বার্বার ক্রীতদাসী, মামুনের মাতা একজন পারস্যবাসী, আল-ওয়াসিক এবং আল-মুহতাদীর গ্রীক, আল-মনতাসিরের গ্রীকো-আবিসিনিয়ান, আল-মুসতাইন স্লাভ, আল-মুসতাদি আর্মেনীয় মাতার সন্তান ছিলেন। সম্ভবত আব্বাসীয় খিলাফতের মধ্যে একমাত্র আল-আমীনের পিতা ও মাতা উভয় দিক হতে অকৃত্রিম আরবি রক্তের অধিকারী ছিলেন। খলিফা হারুনের উপ-পত্নীদের কথা আরব্যোপন্যাসের এবং ইসলামের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে। নৃত্য, সঙ্গীত, মদ্যপান আব্বাসীয় খলিফাদের তিনটি প্রধান আকর্ষণ ছিল। আল-আমীনকে ‘ব্যালে নৃতের জনক’ বলা হয় এবং তিনি এতে অংশগ্রহণ করতেন। তিনি সঙ্গীতজ্ঞ ইব্রাহিম ইবন-আল-মাহদীকে আবু নুওয়াসের রচনা আবৃতির জন্য তিন লক্ষ দিনার দেন। উবাইদা আল-তুনবুরিয়া আল-মুতাসিমের রাজত্বে গায়িকা এবং সুন্দরী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। 

(ঞ) নৈতিক অধঃপতন : আল-মনসুর, হারুন এবং মুহতাদী ব্যতীত প্রায় সকল আব্বাসীয় খলিফা মদ্যপান করতেন। মদ্যপানাসক্ত উৎসব প্রবর্তন করা হয়। উপপত্নী গ্রহণের প্রথা আব্বাসীয়গণ প্রবর্তন করে। প্রাদেশিক শাসনকর্তা, সেনাপতি, নৃপতিগণকে নর্তকী এবং উপপত্নী উপহার দিত। বায়জানটাইনদের বিরুদ্ধে অভিযানকালে হারুন হেলেন নাম্মী একজন খ্রিস্টান মহিলাকে বাগদাদে আনয়ন করেন এবং তাঁর উদ্দেশ্যে একটি কবিতা রচনা করেন। অনাচার ও অশালীন কার্যকলাপে খলিফাদের রাজোচিত গুণাবলিসমূহ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং তাদের পতনকে ত্বরান্বিত করে। 

(ট) অর্থনৈতিক সংকট : অর্থনৈতিক সংকটই মূলত আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের প্রধান কারণ। ভোগ-বিলাসে নিমগ্ন খলিফা, আমীর ও উজিরগণ জনসাধারণের মঙ্গলকে উপেক্ষা করে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য জনসাধারণের উপর মাত্রাধিক কর “গিয়ে দেন। করভারে জর্জরিত কৃষকগণ কৃষিকার্য ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এতে কৃষি এবং শিল্পোন্নয়ণ ব্যাহত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। অনাবৃষ্টি, মহামারী, দুর্ভিক্ষ মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের জনসংখ্যাকে হ্রাস করে। এটি একদিকে জনসাধারণের দুর্দশা এবং অর্থনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করে; অপরদিকে খলিফাদের অজস্র আর্থিক অপচয় রাজকোষকে প্রায় শূন্য করে। ফলে, পরবর্তী খলিফাগণ সৈন্যদের নিয়মিত বেতন দিতে অসমর্থ হলে তাদের হত্যা করা হয়। সৌখিন খলিফা আল-আমীন নৌবিহারের জন্য পাঁচটি সিংহ, হস্তী, ঈগল, সর্প এবং অশ্বাকৃতি বজরা নির্মাণ করেন। প্রতিটি বজরার নির্মাণ খরচ পড়ে ৩০ লক্ষ দিরহাম। অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেলে সাম্রাজ্যের অধঃতপন অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। 

(ঠ) তুর্কী বাহিনীর দৌরাত্ম্য : মুতাসিম কর্তৃক গঠিত তুর্কী সৈন্যবাহিনী পরবর্তী আব্বাসীয় খলিফাদের ক্রীড়নকে পরিণত করে। ক্ষমতালোভী এই বর্বরবাহিনী ইচ্ছামত খলিফাদের সিংহাসনচ্যুত করত এবং স্বার্থসিদ্ধির অনুকূলে রাজদরবারের যে-কোন সদস্যকে খিলাফত প্রদান করত। হিট্টি বলেন, “আল-মামুনের প্রশান্তির শহর অরাজকতার শহরে পরিণত হল।” মুতাসিমের এই বাহিনী গঠন ছিল অদূরদর্শিতার পরিচায়ক; কারণ এদের অত্যাচারে বাগদাদের জনসাধারণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। খলিফা সংঘর্ষ এড়াবার জন্য বাগদাদ হতে ৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী সামররাতে স্থানান্তরিত করতে বাধ্য হন। তাদের সীমাহীন দৌরাত্ম্যে আরব ও পারস্যবাসীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে। তুর্কী ক্রীতদাসীর সন্তান হয়ে মুতাসিম আরব এবং পারস্যবাসীদের উপরে তুর্কীদের প্রধান্য প্রতিষ্ঠা করেন। সামাররা ৫৬ বছর (৮৩৬-৯২) আব্বাসীয় খিলাফতের রাজধানী ছিল এবং এখানে তুর্কী সেনাবাহিনী ও উজিরের ‘ছায়াতলে’ শক্তিহীন আটজন খলিফা রাজত্ব করেন। দুর্ধর্ষ এবং বর্বর এই তুর্কী সেনাবাহিনীর দোর্দণ্ড প্রতাপে খলিফাগণ ভীত ও শঙ্কিত থাকতেন। এ কারণে তুর্কী বাহিনীর অত্যাচার হতে নিষ্কৃতি পাবার জন্য খলিফা মুতা’দ ৮৯২ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী পুনরায় বাগদাদে স্থানান্তর করেন। 

(ড) আমীর উল-উমরাহদের ঔদ্ধত্য : তুর্কী সেনাধ্যক্ষদের স্থলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং অযোগ্য খলিফাগণ একাদিক্রমে আমীর-উল-উমরাহদের দ্বারা পরিচালিত হতে থাকেন। আল-মুকতাদিরের রাজত্বে (৯০৭-৩২ খ্রি.) কমপক্ষে ১০ জন উজিরের উত্থান-পতন হয়। উপরন্তু রাজমাতা কখনও কখনও রাজকার্যে হস্তক্ষেপ করতেন। মুকতাদির তাঁর নপুংসক দেহরক্ষী নেতা মুনীসকে ‘আমীর উল-উমরা’ নামক একটি নবপ্রবর্তিত উপাধিতে ভূষিত করেন। পরবর্তীকালে মুকতাদীর সৈন্যবাহিনী কর্তৃক নিহত হন এবং তাঁর বৈমাত্রেয় ভ্রাতা আল-কাহির সিংহাসন লাভ করেন। তিনি মাত্র এক বছরকাল রাজত্ব করেন। আল-কাহিরকে তাঁর উজির অন্ধ করে সিংহাসনচ্যুত করেন এবং শেষ জীবনে তাঁকে বাগদাদের রাজপথে ভিক্ষাবৃত্তি করতে দেখা যায়। তাঁর দুজন উত্তরাধিকারী আল-মুত্তাকী (৯৪০-৯৪৪ খ্রি.) এবং আল-মুসতাকফীকেও (৯৪৪-৯৪৬ খ্রি.) নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আর-রাজির (৯৩৪-৯৪০ খ্রি.) রাজত্বে আমীর উল উমরাহগণ ঔদ্ধত্যের সীমা অতিক্রম করে খুৎবার খলিফার নামের সঙ্গে তাদের নাম পাঠের ব্যবস্থা করেন। হিট্টি বলেন, “জেনারেলিসম্, আমীর-উল-উমরাহ মুসলিম রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসকরূপে প্রতিষ্ঠিত হলেন।” 

(চ) প্রতিদ্বন্দ্বী খিলাফত : আব্বাসীয় সার্বভৌমত্বে আঘাতস্বরূপ বাগদাদ ব্যতীত কায়রো এবং মাহদিয়ায় আরও দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। ফাতেমী বংশের ওবায়দুল্লাহ আল-মাহদী কর্তৃক উত্তর আফ্রিকায় (৯০৯ খ্রি.) এবং তৃতীয় আব্দুর রহমান কর্তৃক কর্ডোভায় (৯২৯ খ্রি.) খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে মুসলমানদের নিকট আব্বাসীয় খলিফাদের মর্যাদা এবং প্রাধান্য হ্রাস পায়। 

(ণ) বুয়াইয়া প্রভুত্ব : তুর্কীদের দৌরাত্ম্য হতে রক্ষা পাবার জন্য মুসতাকফী (৯৪৪-৯৪৬ খ্রি.) শিয়া বুয়াইয়াদের বাগদাদে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু খলিফাকে তাদের কর্তৃত্বাধীনে শাসনকার্য চালাতে হয়। সুন্নী তুর্কীর পরিবর্তে শিয়া দাইলামী বুয়াইয়াদের প্রভাবাধীনে এসে আব্বাসীয় খলিফাগণ দুর্বল ও অসহায় হয়ে পড়েন। মুইজ-উদ- দৌলাহ খলিফার নামের সাথে খুৎবায় নিজের নাম পাঠ, মুদ্রায় নিজের নাম অঙ্কিত করেন এবং সুলতান উপাধি ধারণ করেন। শিয়া প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য ১০ই মরহরমকে শোক দিবসে পরিণত করা হয়। খলিফা তাদের আশ্রিত এবং বেতনভোগী ছিলেন। অপর এক বুয়াইয়া আমীর আজদু-উদ-দৌলাহ ‘শাহানশাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন। বুয়াইয়াদের প্রভুত্ব হতে অব্যাহতি লাভের জন্য আল-কায়েস তুঘ্রীল বেগকে সাদরে বাগদাদে আমন্ত্রণ জানান। আমীরদের ক্ষমতা-লিপ্সা, আত্মকলহ, নির্যাতনমূলক পদ্ধতি, গোত্র ও ধর্মীয় ঈর্ষাপরায়ণতা প্রভৃতি ছিল আব্বাসীয়দের পতনের অন্যতম কারণ। 

(ত) অমুসলমানদের অসন্তোষ : অমুসলমানগণ বিশেষ করে মাজুস, ইহুদী, খ্রিস্টান প্রভৃতি সম্প্রদায় আব্বাসীয় খলিফাদের ধর্মীয় নীতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে উল্লেখযোগ্য যে, এই অমুসলমান সম্প্রদায় রাজকার্যে নিয়োজিত ছিল এবং তারা কৃষিকার্যও করত এবং বিভিন্ন ধরনের কর, খারাজ ও জিজিয়া প্রদান করত। কিন্তু আব্বাসীয়দের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা তাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। খলিফা হারুন ৮০৭ খ্রিস্টাব্দে সীমান্ত অঞ্চলে নির্মিত গীর্জাগুলো ধ্বংস করবার আদেশ দেন এবং তাদের একটি বিশেষ ধরনের পোশাক পরিধানে বাধ্য করেন। খলিফা মুতাওয়াক্কিলের রাজত্বেও অমুসলমানদের প্রতি অসহিষ্ণু নীতি কার্যকর করা হয়। কিন্তু একথাও সত্য যে, নবম শতাব্দীর শেষার্ধে খ্রিস্টানগণ উজিরের পদমর্যাদা লাভ করেন। আল-মু’তাদীর-এর উজির ছিল খ্রিস্টান। ইহুদিগণ টাকশালে কর্মরত ছিল এবং খ্রিস্টানগণ চিকিৎসক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। মনির সম্প্রদায় (Manicheans) খলিফাদের দ্বারা নির্যাতিত হয় কারণ তারা ইসলামের বিরোধিতা করে। ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে খলিফা মাহদী বাগদাদে মানিকীয়দের শূলবিদ্ধ করেন। আল-হাদী এবং হারুন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। প্রজাদের অসন্তোষ ও অসহযোগিতা আব্বাসীয়দের পক্ষে অভিশাপ ছিল। 

(থ) বহিঃশত্রুর আক্রমণ ও ক্রসেড : মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে বায়জানটাইনদের বৈরী মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। যুবরাজ হারুন বায়জানটাইনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন এবং পরবর্তীকালে মুসলিম সাম্রাজের শক্তি এবং সার্বভৌমত্ব খর্বের জন্য তারা সর্বদা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। হারুনের মহানুভবতা এবং অদূরদর্শিতার জন্য বায়জানটাইনগণ বহুবার সন্ধি চুক্তি ভঙ্গ করে। অভ্যন্তরীণ গোলযোগ দমনে ব্যস্ত থাকায় বায়জানটাইনগণ ঘন ঘন আব্বাসীয় সাম্রাজ্য আক্রমণ করে জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতি করতে থাকে। সেলজুকদের আবির্ভাবে তাদের প্রতিপত্তি খর্ব হলেও তাদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে আব্বাসীয় শক্তি দ্রুত ক্ষীণ হতে থাকে। 

(দ) হালাকু খানের বাগদাদ আক্রমণ ও লুণ্ঠন ও আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের সর্বশেষ এবং প্রধান কারণ ছিল ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিস খানের পৌত্র হালাকু খানের বাগদাদ আক্রমণ এবং লুণ্ঠন। মোঙ্গল নেতা হালাকু খান ১২৫৩ খ্রিস্টাব্দে একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে পারস্য অভিযান করে গুপ্তঘাতকদের সুরক্ষিত আলামুত দুর্গ আক্রমণ করেন। এই অভিযানে তিনি তৎকালীন সর্বশেষ খলিফা আল-মুসতাসিমের (১২৪২-৫৮ খ্রি.) নিকট সাহায্য কামনা করে একটি পত্র প্রেরণ করেন। উদ্ধত প্রকৃতির খলিফা হালাকুর আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। হালাকু ক্রুদ্ধ এবং অপমানিত হয়ে গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়কে (Assasins) সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে মেসোপটেমিয়া অভিমুখ যাত্রা করেন। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বাগদাদের উপকণ্ঠে উপস্থিত হয়ে খলিফা মুস্তাসিমকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। অতঃপর চল্লিশ দিন বাগদাদ নগরী অবরোধ করে বৃহৎ প্রস্তরখণ্ড (Catapult) এবং জ্বলন্ত অগ্নির (Naptha) সাহায্যে প্রাচ্যের সুরম্য নগরী বাগদাদের প্রাচীর বিধ্বস্ত করেন। ভীত ও সন্ত্রস্ত সর্বশেষ খলিফা মুসতাসিম নিষ্ঠুর হালাকু খানের নিকট আত্মসমর্পণ করে প্রাণভিক্ষা চান। খলিফা এবং তাঁর পরিবারের সকলকে হত্যা করা হয়। উল্লেখযোগ্য যে, হালাকু খান খলিফাকে রাসূলে করীমের বংশধর মনে করে অস্ত্রাঘাতে নিহত করতে ইতস্তত করেন এবং একটি কার্পেটে তাঁকে জড়িয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করেন। হালাকুর খ্রিস্টান পত্নী ডকুজ (Doquz) এবং শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত উপদেষ্টা নাসির উদ্দীন তুসীর পরামর্শ অনুযায়ী খ্রিস্টান এবং শিয়া সম্প্রদায়ের লোক ব্যতীত প্রায় ১৬ লক্ষ লোককে মাত্র ছয় সপ্তাহে হত্যা করা হয়। হালাকুর রক্তলোলুপতা এবং জিঘাংসা মনোবৃত্তির ফলে শিশু, বৃদ্ধ, নারীও এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। কথিত আছে যে, তিন দিন ধরে নগরীর রাজপথগুলোতে রক্তস্রোত প্রবাহিত হয় এবং ইউফ্রেটিসের পানি রক্ত-রঞ্চিত হয়ে যায়। তার ধ্বংসলীলার হাত হতে মসজিদ, মাদ্রাসা, সমাধি, গ্রন্থাগার, হাসপাতাল, জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোও রক্ষা পায় নি। 

ফলাফল : গিলমান বলেন, “এরূপে শত-সহস্র নিহতদের প্রকট গননভেদী আর্তনাদ এবং বিজয়োন্মত্ত বর্বর মোঙ্গলদের প্রকট উন্মাদনায় যে বাগদাদ পাঁচশত বছর ধরে শিল্প, বিজ্ঞান এবং সাহিত্যের গৌরবোজ্জ্বল কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল তা চিরতরে বিলুপ্ত হল।” 

আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের সঙ্গে সঙ্গে সুন্নী ইসলাম যে অসুবিধার সম্মুখীন হয় তা পুনরুদ্ধার করা আর কখনই সম্ভবপর হয় নি। সুন্নী ধর্মীয় আধিপত্য ব্যতীত রাষ্ট্রীয় প্রভুত্বও ক্ষুণ্ণ হল। অনেকের মতে, মুসতানসিরের শিয়া নির্যাতন এরূপ চরম আকার ধারণ করে যে, শিয়া মন্ত্রী মুহম্মদ বিন আল-কামী ঈর্ষান্বিত হয়ে হালাকু খানকে বাগদাদ আক্রমণের আমন্ত্রণ জানান। আবুদল লতীফের মতে, “মোঙ্গলদের প্রলয়ঙ্করী ও রক্তপিপাসু অভিযান এরূপ একটি দুর্যোগ যা অপরাপর দুর্যোগকে ম্লান করে দিয়েছে।” আব্বাসীয় খিলাফতের অধঃপতনের সুন্নী-মুসলিম সমাজ ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় প্রতীক হারিয়ে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে। ইবন আসীরের মতে, “তাতারদের আক্রমণ সাধারণভাবে সমগ্র বিশ্বের উপর বিশেষভাবে মুসলমানদের উপর আপাতত ভয়াবহ দৈব- দুর্বিপাকগুলোর অন্যতম। পরবর্তী যুগে এরূপ দুর্ঘটনা সংঘটিত হয় নি।” বার্নার্ড লুইস বলেন, “কয়েকটি দিক হতে একে যতটুকু আঘাত বলে মনে করা হয় ঠিকততটা ছিল না। খলিফাগণ বহু দিন পূর্বেই প্রকৃত ক্ষমতা হারান। সুলতানগণ রাজধানীতে ও প্রদেশসমূহে প্রকৃত ক্ষমতাধিকারী ছিলেন; তারা (সুলতানগণ) খলিফাদের ধর্মীয় সুযোগ-সুবিধাগুলো পর্যন্ত অন্যায়ভাবে ভোগ করতে থাকেন। মুদ্রায় নামাঙ্কন, খুৎবায় নাম পাঠ প্রভৃতি ক্ষেত্রে মোঙ্গলগণ একটি মৃত প্রতিষ্ঠানেরই (খিলাফত) প্রতীককে ধ্বংস করে।” এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, বর্বর হালাকুর নিধনযজ্ঞ এবং ধ্বংসলীলা সত্ত্বেও নিজামিয়া এবং মুসতানসারিয়া মাদ্রাসা রক্ষা পায়। ১৩৪৩ খ্রিস্টাব্দে তৈমুরলঙ্গের বাগদাদ আক্রমণের দুই বছর পর এই দুটি প্রতিষ্ঠান সংযুক্ত করা হয় এবং ১৩২৭ খ্রিস্টাব্দে ইবনে বতুতা এটি পর্যবেক্ষণ করেন। যাহোক, মোঙ্গল আক্রমণে বাগদাদের সমৃদ্ধি বিলুপ্ত হয়, সুন্নী ইসলামের পরিবর্তে মোঙ্গল ইলখানদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। আমীর আলী বলেন, “শিক্ষার আগার, সভ্যতার ক্ষেত্র এবং সারাসিন জগতের প্রতীক ও কেন্দ্ৰভূমি বাগদাদ চিরতরে ধ্বংসপ্রাপ্ত হল।” 

সকল অধ্যায়

১. প্রথম অধ্যায় : আরব ভূখণ্ডের ইতিহাসের উৎসসমূহ
২. দ্বিতীয় অধ্যায় : প্রাক-ইসলামী যুগ : রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
৩. তৃতীয় অধ্যায় : প্রাচীন আরব ভূখণ্ডের ভৌগোলিক ও গোত্রীয় প্রথার বিবরণ
৪. চতুর্থ অধ্যায় : আরব জাতি : বায়দা ও বাকিয়া
৫. পঞ্চম অধ্যায় : ‘অজ্ঞতার যুগে’ আরব দেশ
৬. প্রথম অধ্যায় : হযরত মুহাম্মদের (স) আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট
৭. দ্বিতীয় অধ্যায় : হযরত মুহাম্মদের (স) প্রথম জীবন ও নবুওয়াত
৮. তৃতীয় অধ্যায় : প্রাথমিক প্রত্যাদেশ
৯. চতুর্থ অধ্যায় : ধর্মপ্রচারে বিরোধিতা
১০. পঞ্চম অধ্যায় : সম্প্রসারিত দিগন্ত
১১. প্রথম অধ্যায় : কুরাইশদের প্ররোচনা ও হিজরত
১২. দ্বিতীয় অধ্যায় : মক্কাবাসীদের প্রতিরোধের ব্যর্থতা ও ইসলামের বিজয়
১৩. তৃতীয় অধ্যায় : মক্কাবাসীদের ওপর মহাবিজয়
১৪. চতুর্থ অধ্যায় : হযরত মুহাম্মদের (স) সাংগঠনিক ক্ষমতা
১৫. পঞ্চম অধ্যায় : হযরত মুহাম্মদের (স) সাথে ইহুদীদের সম্পর্ক
১৬. ষষ্ঠ অধ্যায় : ইসলামী রাষ্ট্রের : রূপরেখা মদিনা সনদ
১৭. সপ্তম অধ্যায় : হযরত মুহাম্মদের (স) শেষ জীবন (৬২৮-৬৩২ খ্রি.)
১৮. প্রথম অধ্যায় : হযরত আবু বকর (রা) (৬৩২-৬৩৪ খ্রি.)
১৯. দ্বিতীয় অধ্যায় : হযরত ওমর ফারুক (রা) (৬৩৪-৬৪৪ খ্রি.)
২০. তৃতীয় অধ্যায় : হযরত ওসমান যুন্নুরাইন (রা) (৬৪৪-৬৫৬ খ্রি.)
২১. চতুর্থ অধ্যায় : হযরত আলী আসাদুল্লাহ (রা) (৬৫৬-৬৬১ খ্রি.)
২২. পঞ্চম অধ্যায় : খিলাফত আমলের প্রশাসনিক ব্যবস্থা
২৩. প্রথম অধ্যায় : উমাইয়া রাজবংশের বৈশিষ্ট্য
২৪. দ্বিতীয় অধ্যায় : মুয়াবিয়া (৬৬১-৬৮০ খ্রি.)
২৫. তৃতীয় অধ্যায় : প্রথম ইয়াজিদ ও দ্বিতীয় মুয়াবিয়া (৬৮০-৬৮৪ খ্রি.)
২৬. চতুর্থ অধ্যায় : প্রথম মারওয়ান ও আবদুল মালিক (৬৮৪-৭০৫ খ্রি.)
২৭. পঞ্চম অধ্যায় : প্রথম ওয়ালিদ (৭০৫ – ৭১৫ খ্রি.)
২৮. ষষ্ঠ অধ্যায় : সুলায়মান এবং দ্বিতীয় ওমর (৭১৫-৭২০ খ্রি.)
২৯. সপ্তম অধ্যায় : পরবর্তী উমাইয়া খলিফাগণ (৭২৪-৭৫০ খ্রি.)
৩০. অষ্টম অধ্যায় : উমাইয়াদের পতন
৩১. নবম অধ্যায় : উমাইয়া খিলাফতের শাসনব্যবস্থা, সমাজ ও সভ্যতা
৩২. প্রথম অধ্যায় : আবুল আব্বাস (৭৫০-৭৫৪ খ্রি.) ও আল-মনসুর (৭৫৪-৭৭৫ খ্রি.)
৩৩. দ্বিতীয় অধ্যায় : আল-মাহদী, আন-হাদী, হারুন আর-রশীদ
৩৪. তৃতীয় অধ্যায় : আল-আমীন (৮০৯-৮১৩ খ্রি.)
৩৫. চতুর্থ অধ্যায় : আল-মামুন (৮১৩-৮৩৩ খ্রি.)
৩৬. পঞ্চম অধ্যায় : আব্বাসীয় খিলাফতের শেষার্ধ (৮৩৩-১২৫৮ খ্রি.)
৩৭. ষষ্ঠ অধ্যায় : বুয়াইয়া (৯৪৫-১০৫৫ খ্রি.) এবং সেলজুক বংশ (১০৫৫-১১৯৪ খ্রি.)
৩৮. সপ্তম অধ্যায় : আব্বাসীয় খিলাফতের অবনতি ও পতন
৩৯. অষ্টম অধ্যায় : আব্বাসীয় যুগের শাসনব্যবস্থা, সমাজ ও সভ্যতা
৪০. পরিশিষ্ট-১ : The 100: A Ranking of the most influential Persons in History: by Michael H. Hart Muhammad (sm) এবং বাংলা তর্জমা
৪১. পরিশিষ্ট-২ : হযরত মুহাম্মদ (স) প্রসঙ্গে বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতামত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন