আমেরিকান গডস – ৮

নিল গেইম্যান

অধ্যায় আট 

আমাকে বলল ও, মৃতদের আত্মা আছে। কিন্তু যখন জানতে চাইলাম,
কী করে তা সম্ভব-আমি তো ভেবেছিলাম তারাই আত্মা! 
আমার ধ্যান ভাঙ্গল সে। বলল, সন্দেহ হয় না তোমার? 
মৃতরা কেন লুকিয়ে রাখা কথা? 
বলো আমায়, মৃতরা কেন লুকিয়ে রাখে কথা? 

–রবার্ট ফ্রস্ট, টু উইচেস 

.

ক্রিসমাসের আগের সপ্তাহটায় যেকোনো ফিউনারেল পার্লারের ব্যাবসাই মন্দা যায়, রাতের খাবার খেতে খেতে জানল শ্যাডো। ছোটো একটা রেস্তোরাঁয় খেতে এসেছে ওরা, আইবিস অ্যান্ড জ্যাকেলের ব্যাবসাস্থল থেকে দুই ব্লক দূরে জায়গাটা। পেট ভরে খেল শ্যাডো, তবে মি. আইবিস কফি-কেক নাড়াচাড়া করল কেবল। ‘মৃত্যু-পথযাত্রীরা শেষ আরেকটা ক্রিসমাস ভালোবাসার লোকজনের সাথে কাটানোর জন্য দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করে। অথবা নববর্ষের জন্য।’ 

ফিউনারেল পার্লারটা একেবারে ছোটো, পারিবারিকভাবে চালানো হচ্ছে অনেকদিন হলো। প্রকৃতপক্ষে আশপাশের এলাকাগুলোতে সত্যিকার অর্থে এমন স্বাধীন ফিউনারেল পার্লারের সংখ্যা অতি অল্প, অন্তত মি. আইবিসের সেটাই দাবি। ‘মানুষ কেন যেন সারা দেশজুড়ে আছে, এমন সব ব্র্যান্ডের প্রতি একটু বেশি আকৃষ্ট হয়। ব্যাখ্যা করার ভঙ্গিতে বলল লোকটা। শ্যাডোর মনে পড়ে গেল এক কলেজ প্রফেসরের কথা…তিনি ব্যায়ামাগারে আসতেন প্রায়ই, স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারতেন না। তবে তর্কে জুড়ি ছিল না তার। পরিচিত হবার কয়েক মিনিটের মাঝেই শ্যাডো বুঝতে পেরেছিল, ফিউনারেল পার্লারের এই ডিরেক্টরের সাথে কথোপকথনে যেকারও অংশগ্রহণ হতে হবে অতি সীমিত—কেবল শোনা। 

‘কারণটাও পরিষ্কার, কীসের পেছনে পয়সা ঢালা হচ্ছে, সেটা মানুষ খরচ করার আগেই জানতে চায়। এজন্যই ম্যাকডোনাল্ড’স, ওয়াল মার্ট, এফডব্লিউ উলওয়র্থ আছে সারা দেশজুড়ে। যেখানে যাও না কেন, আশপাশে তাদেরকে পাবেই! 

‘তবে ফিউনারেল হোমের ব্যাবসা পদ্ধতি আলাদা। সবাই চায়, প্রিয়জনের শেষ যত্নটা দক্ষ কেউ নিক। হারাবার কষ্ট সবাইকেই পীড়া দেয়, তাই এমনসব সময়ে মানুষ চায় তাদের পছন্দের মানুষটা আলাদা মনোযোগ পাক। বড়ো বড়ো কোম্পানিদের মতো যেন পণ্য হিসেবে দেখা না হয় মরদেহটাকে। সমস্যা হলো, যেকোনো ব্যাবসায়-মৃত্যুও একধরনের ব্যাবসাই-পয়সা কামানো সম্ভব হয় একবারে অনেক পরিমাণে কিনে, দক্ষতার সাথে সেটা পরিচালনা করে। শুনতে ভালো না লাগলেও, কথাটা সত্যি। কিন্তু ওই যে, আলাদা মনোযোগের কথা বললাম! যে লোক জীবিত থাকা অবস্থায় মানুষটাকে দেখে সম্মান জানাত, সেই লোকটার হাতেই ভালোবাসার লোকটার মরদেহ তুলে দিতে চায় তারা।’ 

মি. আইবিস বাদামি একটা হ্যাট পরে আছে, সেই সাথে বাদামি ব্লেজারও। ছোটো, সোনার রিমের চশমা নাকের ওপরে বসে আছে। প্রথমে মি. আইবিসকে খাটো বলে মনে হয়েছিল তার, কিন্তু পাশে দাঁড়াবার পর বুঝতে পারল-লোকটা প্রায় ছয় ফুটের চাইতে বেশি লম্বা! 

‘তাই বড়ো বড়ো কোম্পানিগুলো যখন আমাদের মতো ছোটো কোম্পানিগুলোকে কিনে নেয়, তখন নাম বদলায় শুধু। ডিরেক্টররা কিন্তু রয়েই যায়। যাই হোক, ব্যক্তিগত কারণেই আমরা এখনও আমাদের পার্লারটা বিক্রি করিনি। আমাদের এখানে সবকিছু নিজ হাতে করা হয়। সত্যি বলতে কী, আমরাই এই দেশে সেরা! তবে এ কথা আমরা দুজন বাদে আর কেউ জানে না। পার্লারে কিন্তু মরদেহ জ্বালানো হয় না। নিজস্ব ক্রিমেটোরিয়াম বানালে অনেক টাকা কামাতে পারতাম বটে, কিন্তু সেকাজে তো আর আমদের স্বকীয়তা থাকত না। আমার পার্টনার তাই প্রায়শই বলেন-স্রষ্টা যে যোগ্যতা বা দক্ষতা দিয়েছেন, সেটাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো দরকার। তোমার কী মনে হয়?’ 

‘ঠিকই তো।’ উত্তর দিল শ্যাডো। 

‘প্রভু আমার পার্টনারকে মৃতদের ওপর ক্ষমতা দিয়েছেন, আর আমাকে দিয়েছেন শব্দের উপর। জানো, এই শব্দ ব্যাপারটা না বড়ো অদ্ভুত। আমি গল্পের বই লিখি। ছাপাবার ইচ্ছা নেই, নিজের আনন্দেই বলতে পারো। অনেকটা জীবনী- 

‘মূলক,’ থেমে গেল মি. আইবিস। যতক্ষণে শ্যাডো ধরতে পারল যে ওকে পড়তে চাইবার সুযোগ করে দেবার জন্য এই বিরতি, ততক্ষণে আবার মুখ খুলেছে লোকটা। ‘যাই হোক, আমাদের ব্যাবসার বয়স প্রায় দুইশ বছর হলো। আর এই দুইশ বছরে একজন আইবিস আর একজন জ্যাকেল সবসময় ওই ফিউনারেল হোমের কর্তৃত্বে ছিল। অবশ্য এর আগে ছিলাম মুর্দাফরাশ, তারও আগে লাশের সদ্গতি করা মানুষ!’ 

‘তার আগে?’ 

‘আসলে,’ কিছুটা গর্বের হাসি দেখা গেল মি. আইবিসের ঠোঁটে। ‘আমাদের ইতিহাস অনেক পুরনো। তবে গৃহযুদ্ধের আগে আমরা ঠিক জাঁকিয়ে বসতে পারিনি। যুদ্ধের সময় কালো মানুষদের মুর্দাফরাশ হিসেবে কাজ করতে শুরু করি। তবে আমাদেরকে কেউ নিগ্রো ভাবেনি হয়তো বিদেশি ভেবেছে, অথবা অদ্ভুত…তবে নিগ্রো না। আর যুদ্ধ শেষে এমন একটা সময় এলো, যখন আমাদেরকে একসময় যে বিদেশি ভাবা হতো, তাই ভুলে বসল সবাই। অবশ্য আমার পার্টনারের ত্বক আমার চাইতেও কালো বলে, নতুন এই পরিচয়ে পরিচিত হতে খুব একটা কষ্ট হয়নি। মানুষ যখন নিগ্রোদেরকে আফ্রিকান-আমেরিকান বলে, তখন অবাক লাগে। আমরা কিন্তু নিজেদেরকে নীল নদের মানুষ ভাবতেই বেশি পছন্দ করি।’ 

‘তোমরা তাহলে মিশরিয়?’ 

‘হ্যাঁ…আবার না। মিশরিয় বলতে আমি বুঝি যারা এখন ওখানে বাস করছে, তাদেরকে। আমাদের কবর আর প্রাসাদের উপর দাঁড়িয়ে আছে তাদের শহর। ওরা কি আমার মতো দেখতে?’ 

শ্রাগ করল শ্যাডো। এমন অনেক কালো মানুষের সাথে ওর পরিচয় আছে, যারা মি. আইবিসের মতো দেখতে। আবার এমন সাদা মানুষকেও চেনে, যাদের ত্বক রোদে পুড়ে লোকটার মতো হয়ে গেছে। 

‘কফি-কেক কেমন লাগল?’ কাপে কফি ঢালতে ঢালতে জানতে চাইল ওয়েট্রেস। 

‘আমার খাওয়া সবচেয়ে সেরা,’ বলল মি. আইবিস। ‘তোমার মাকে আমার শুভেচ্ছা জানিয়ো।’ 

‘অবশ্যই।’ বলে বিদায় নিলো মেয়েটা। 

‘ফিউনারেল পার্লার যারা চালায়, তারা সাধারণত লোকজনকে তাদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে প্রশ্ন করে না। মানুষ ধরে নেয়, সে ব্যাবসার খোঁজ করছে।’ দুঃখিত শোনাল কণ্ঠটাকে। ‘চলো দেখি, তোমার ঘর গোছান শেষ কি না।’ 

রাতের বাতাসে নাক থেকে বেরোন মাত্র বাষ্পের জন্ম দিচ্ছে। দোকানের জানালায় দেখা যাচ্ছে ক্রিসমাসের আলোকসজ্জা। ‘আমার জন্য ঝামেলা সহ্য করছ, ধন্যবাদ।’ বলল শ্যাডো। 

‘তোমার চাকরিদাতা কৃতজ্ঞতাপাশে আমরা আবদ্ধ। আর ঘরের কথা কী বলব, কতগুলো যে অব্যবহারে ধুলোয়-ধূসরিত হয়ে যাচ্ছে তা স্রষ্টা জানেন। আগে অবশ্য অনেকেই থাকত বিশাল ওই বাড়িটাতে। এখন আমরা মাত্র তিনজন আছি। অসুবিধা হবে না।’ 

‘কয়দিন থাকতে হবে আমাকে, ধারণা আছে?’ 

মাথা নাড়ল মি. আইবিস। ‘তা বলেনি। তবে তুমি এখানে এসেছ বলে আমরা আনন্দিত। খুব বেশি নাক উঁচু না হলে…আর মৃতদেরকে সম্মান জানাতে পারলে কাজেরও অভাব হবে না। 

‘তোমরা কায়রোতে এলে কেন?’ জানতে চাইল শ্যাডো। ‘নামের টানে?’ 

‘নাহ। আসলে আমাদের কারণেই এই এলাকার এমন নামকরণ। অতীতে জায়গাটা ছিল আমাদেরই একটা ব্যাবসাকেন্দ্ৰ।’ 

‘ফ্রন্টিয়ারের দিনগুলোতে?’ 

‘তা বলতে পারো।’ বলল মি. আইবিস। ‘শুভ সন্ধ্যা, মিস সিমন্স! ক্রিসমাসটা আনন্দে কাটুক! আমাকে আনয়নকারীরা এখানে পা রেখেছে তারও আগে, মিসিসিপি হয়ে।’ 

থমকে দাঁড়াল শ্যাডো, একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জানতে চাইল, ‘তুমি বলতে চাইছ, পাঁচ হাজার বছর আগে মিশরিয়রা এখানে ব্যাবসা করতে এসেছিল?’ 

কিছুই বলল না মি. আইবিস, তবে হাসল একটু। ‘তিন হাজার পাঁচশ ত্ৰিশ বছর আগে।’ 

‘ঠিক আছে,’ বলল শ্যাডো। ‘মেনে নিলাম। পণ্য কী ছিল?’ 

‘তেমন কিছু না,’ উত্তর দিল মি. আইবিস। ‘পশুর চামড়া, খাবার, তামা। খাজনার চাইতে বাজনা বেশি পড়ে গেছিল। তবে এখানে থেকে আমাদের উপাসনা করার সময় পেয়েছিল তারা, কয়েকজন মারাও গেছিল। আশপাশেই কোথাও তাদের কবর পাওয়া যাবে। তাই ওরা চলে গেলেও, আমরা রয়ে গেলাম।’ আচমকা ফুটপাতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা! দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে বলল, ‘এই দেশটা দশ হাজার বছর ধরে বিশাল বড়ো এক স্টেশন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কলোম্বাসের গল্প জানো না?’ 

‘কলোম্বাসের আবার কোন গল্প?’ 

‘কলোম্বাস তাই করেছে, যা হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ করে আসছিল। আমেরিকায় আসার মাঝে এমন বিশেষ কিছু নেই। মাঝে মাঝে সেই গল্প লিখি আমি।’ হাঁটতে শুরু করেছে ওরা আবার। 

‘সত্যি গল্প?’ 

‘অনেকাংশেই সত্যি। চাইলে দুয়েকটা পড়তে পারো। যার চোখ আছে, সে অবশ্য সত্যগুলো দেখতে পাবে। ব্যক্তিগতভাবে, সায়েন্টিফিক আমেরিকান-এর একজন গ্রাহক হিসেবে বলছি কথাটা, পেশাদার নৃ-তত্ত্ববিদদের প্রতি আমার মায়াই হয়। এই দেশে কোন একটা খুলি পেলেই তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে! আর যখন প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন খুঁড়ে বের করে, তখনকার কথা তো বলাই বাহুল্য। মাথা চুলকে চুলকে তারা বলে-এ তো অসম্ভব! আইনু, মানে জাপানের প্রাচীন সভ্যতার মানুষদের কথাই ধরো। একটা খুলি পাওয়া গেল, আর সবাই অসম্ভব অসম্ভব বলে চিৎকার করতে শুরু করল! অথচ নয় হাজার বছর আগেই তারা আমেরিকায় পা রেখেছে। এর দুই হাজার বছর পর পলিনেশনিয়ানরা যে ক্যালিফোর্নিয়ায় পা রেখেছিল, তার প্রমাণও আছে কিন্তু! বিজ্ঞানীদের মাথাব্যথা কার সাথে কার সম্পর্ক, সেটা বের করা নিয়ে-অথচ সত্যিটা তারা যেন দেখেও দেখে না হোপিদের বানানো টানেল আবিষ্কার করলে যে ওদের অবস্থা কী হবে, তা ভেবে ভয়ই পাচ্ছি! 

‘আইরিশরা আমেরিকায় পা রেখেছিল কি না জানতে চাইছ? অবশ্যই রেখেছিল। যেমন রেখেছিল ভাইকিং আর ওয়েলশের অধিবাসীরাও! আফ্রিকানরা দক্ষিণ আমেরিকার সাথে ব্যাবসা করত। চাইনিজরা কয়েকবার এসেছিল ওরিগনে, ওর অবশ্য এলাকাটাকে ফু সাঙ বলে ডাকত। বারোশ বছর আগে বাস্করা নিউফাউন্ডল্যান্ডের তীরে মাছ ধরতে আসত। জানি তুমি বলবে: মি. আইবিস, এই লোকরা তো আদিম! ওদের না রেডিয়ো ছিল আর না জেট প্লেন।’ 

কিছু বলল না শ্যাডো, ওর কিছু বলার ইচ্ছাও ছিল না। কিন্তু বুঝতে পারল, মি. আইবিস চাইছে সে কিছু বলুক। তাই মুখ খুলল, ‘কথাটা বললে ভুল হবে?’ 

‘বর্তমান দুনিয়ার একটা ভুল ধারণা হলো, কলোম্বাসের আগে মানুষ দূরপাল্লার যাত্রা করতে অক্ষম ছিল। অথচ নিউ জিল্যান্ড, তাহিতি আর প্যাসিফিক আইল্যান্ডের অগণিত দ্বীপের লোকরা এমন দক্ষ ছিল যা কলোম্বাসকেও লজ্জায় ফেলে দেবে! আফ্রিকা এত সম্পদশালী হলো কী করে? ব্যাবসার মাধ্যমে। তবে হ্যাঁ, ওরা ব্যাবসা করত ভারত আর চীনের সাথে। আমার দেশের মানুষ, মানে নীলের লোকরা, বুঝতে পেরেছিলাম: ধৈর্য আর সুপেয় পানি থাকলে নলখাগড়ার নৌকা নিয়েই বিশ্ব ঘুরে আসা সম্ভব। এখানে আগে কেউ আসেনি দুটো কারণে: দূরত্ব আর ব্যাবসা করার মতো জিনিসের অভাব।’ 

কথা বলতে বলতে একটা বড়ো দালানের সামনে এসে পৌঁছাল ওরা, সদর দরজা দিয়ে ঢুকে সোজা চলে গেল দালানের পেছনে। সামনে বড়ো দুটো দরজা পড়লে, মি. আইবিস চাবি ব্যবহার করে খুলে ফেলল ওটা। একটা বড়ো, শীতল কক্ষে প্রবেশ করল ওরা, ঘরের ভেতর এরইমাঝে দুজন মানুষ আছে। তাদের একজন বেশ লম্বা আর কালো ত্বকের লোক, হাতে বড়ো ধাতব স্কালপেল। অন্য জন এক তরুণী; লাশ হয়ে পড়ে আছে একটা লম্বা, পোর্সেলিনের টেবিলে। 

মরদেহের পাশের দেয়ালে মৃত মেয়েটার অনেকগুলো ছবি পিন দিয়ে লাগানো। একটায় হাসছে সে, হাই-স্কুলের থাকার সময়কার ছবি। আরেকটায় সে দাঁড়িয়ে আছে তিন বান্ধবীর সাথে, পরনে স্কুল-নাচের পোশাক। কালো চুল মাথার ওপরে বেণি করা, মুখে উষ্ণ হাসি। 

তবে পোর্সেলিনে শোয়া দেহটা ঠান্ডা, চুল খোলা। শুকনো রক্তে মাখা-মাখা হয়ে আছে! ‘আমার পার্টনারের সাথে পরিচিত হও। ইনি মিস্টার জ্যাকুয়েল।’ বলল আইবিস। 

‘আমাদের আগেই দেখা হয়েছে,’ বলল জ্যাকুয়েল। ‘হাত মেলাতে পারছি না বলে দুঃখিত।’ 

মৃত মেয়েটার দিকে তাকাল শ্যাডো। ‘কী হয়েছে ওর?’ 

‘প্রেমিক বাছতে ভুল করেছে।’ উত্তর দিল জ্যাকুয়েল। 

‘সবসময় ভুলটা মারাত্মক হয় না বটে,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল মি. আইবিস। ‘তবে এবার হয়েছে। লোকটা মাতাল ছিল, হাতে ছিল একটা ছুরি। মেয়েটা তাকে জানিয়েছিল, সম্ভবত সে গর্ভবতী হয়ে পড়েছে। সন্তানটাকে নিজের বলে মানতে চায়নি তার প্রেমিক 

‘মোট…’ গুণতে শুরু করল মি. জ্যাকুয়েল। ‘পাঁচ বার ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল তাকে। তিনটা বুকের সামনের দিকে। প্রথমটা বাঁ স্তনের ভেতরের দিকে, চতুর্থ আর পঞ্চম পাঁজরের হাড়ের মাঝখানে—দুই সেন্টিমিটার গভীর। দ্বিতীয় আর তৃতীয়টা বাঁ স্তনের মাঝ বরাবর, তিন সেন্টিমিটার হবে গভীরতা। বাঁ বুকের ওপরের দিকে দুই সেন্টিমিটার গভীর আরেকটা আঘাত আছে, দ্বিতীয় পাঁজরের হাড়ের ঠিক নিচে। বাঁ হাতের ওপরে রয়েছে আরেকটা পাঁচ সেন্টিমিটার লম্বা আর ছয় সেন্টিমিটার গভীর একটা ক্ষত। বুকের সবগুলো আঘাতই মারাত্মক। খালি চোখে দেখা যায়, এমন আঘাত আর নেই।’ ক্লিক করে আওয়াজ হলো একটা। শ্যাডো বুঝতে পারল, এতক্ষণ পা দিয়ে রেকর্ডারের বোতাম চেপে রেখেছিল মি. জ্যাকুয়েল; কেননা মৃতদেহের টেবিলের ওপরে দড়ি দিয়ে একটা মাইক্রোফোন ঝুলছে! 

‘তুমি করোনারের দায়িত্বও পালন করো?’ জানতে চাইল শ্যাডো। 

‘আমাদের এদিকে করোনারের পদ আছে, কর্মকর্তা নেই।’ বলল আইবিস। ‘জ্যাকুয়েলের কাজ হলো লাশকে লাথি মারা। যদি ওটা উত্তরে লাথি না হাঁকায়, তাহলে ডেথ সার্টিফিকেটে সই করে দেয়। জ্যাকের পদবি হলো প্রোসেকটর। কাউন্টি মেডিকেল এক্সামিনারের হয়ে কাজ করে সে, ময়নাতদন্ত সারে আর পরীক্ষার জন্য টিস্যুর স্যাম্পল রাখে।’ 

আইবিসকে পাত্তা দিল না জ্যাকুয়েল। বড়ো আরেকটা স্কালপেল নিয়ে মহিলার দেহ কাটতে শুরু করল সে, ভি আকৃতির একটা ক্ষত তৈরি করল যেটা এক হলো বুকের হাড়ের শেষের দিকে। এরপর সোজা নিজের দিকে কাটতে শুরু করল-বুক থেকে তলপেটের হাড় পর্যন্ত। এরপর একটা ভারী, ক্রোম-নির্মিত ড্রিল হাতে নিয়ে বুকের হাড়ের দুপাশের পাঁজরের হাড় কাটতে শুরু করল। 

মেয়েদের পার্স যেভাবে খট করে খুলে যায়, সেভাবেই যেন খুলে গেল লাশটা।

আচমকা একটা হালকা, কিন্তু বাজে গন্ধ নাকে পেল শ্যাডো। ‘আমি তো ভেবেছিলাম লাশ পচার গন্ধ আরও বাজে হবে।’ 

‘লাশটা একদম তাজা,’ বলল জ্যাকুয়েল। ‘পেটের নাড়ি-ভুঁড়িও ফুটো হয়নি। তাই বিষ্ঠার গন্ধও বেরোয়নি।’ 

অন্য দিকে তাকাল শ্যাডো, ঘেন্নায় না। কেন জানি মেয়েটাকে একটু একাকীত্ব দেবার ইচ্ছা হলো ওর। 

পেটের নাড়িগুলো বেঁধে ফেলল জ্যাকুয়েল, টিপে টুপে দেখল কোথাও ছিদ্র আছে কি না। মাইক্রোফোনে ‘স্বাভাবিক’ বলে ফেলে দিল মেঝেয় রাখা একটা বালতিতে। এরপর লাশটার বুকের ভেতর থেকে সব রক্ত শুষে নিলো একটা ভ্যাকিয়ুম ক্লিনার দিয়ে, পরিমাণ মেপে নিয়ে মন দিল ভেতরের অঙ্গগুলোর দিকে। ‘পেরিকার্ডিয়ামে তিনটা ক্ষতচিহ্ন আছে। জমাট বাঁধা আর তরল রক্তে ভরতি। 

মেয়েটার হৃৎপিণ্ডটার ওপরের অংশ ধরল জ্যাকুয়েল, এরপর সেটা কেটে নিয়ে উলটো করে দেখল। ‘মায়োকার্ডিয়ামে দুইটি ক্ষত। একটা ডান দিকে এক দশমিক পাঁচ সেন্টিমিটার, অন্যটা বাঁ দিকে এক দশমিক আট সেন্টিমিটার।’ 

এবার ফুসফুসের দিকে মন দিল লোকটা। বাঁ দিকের ফুসফুসে ছুরি ঢুকেছিল, ওটা চুপসে আছে। দুই ফুসফুস আর হৃৎপিণ্ডের ওজন নিলো সে, এরপর ছবি তুলল ক্ষতগুলোর। উভয় ফুসফুস থেকেই ছোটো ছোটো একটা করে অংশ কেটে নিয়ে একটা পাত্রে ভরল। 

‘ফরমালডিহাইড,’ ফিস ফিস করে শ্যাডোকে জানাল মি. আইবিস। 

কী কী করছে, তার ধারা-বিবরণী মাইক্রোফোনে বলতে থাকল জ্যাকুয়েল। মেয়েটার যকৃত, পাকস্থলী, প্লীহা, অগ্ন্যাশয়, বৃক্ক, গর্ভাশয় আর ডিম্বাশয় কেটে নিলো একে একে। সবগুলোর ওজন মেপে প্রতিটা থেকে একটু একটু কেটে নিয়ে ফরমালডিহাইডের পাত্রে ভরে রাখল। 

তবে হৃৎপিণ্ড, যকৃত আর দুই বৃক্ক থেকে বাড়তি একটা অংশ কাটল সে। এগুলো চাবাল আস্তে আস্তে। কেন জানি শ্যাডোর খুব স্বাভাবিক মনে হলো ব্যাপারটাকে। মনে হলো যেন লোকটা এভাবে মৃতের প্রতি সম্মান দেখাচ্ছে! 

‘তুমি তাহলে আমাদের সাথে কিছুদিন থাকতে চাও?’ মেয়েটার হৃৎপিণ্ডের টুকরা চিবুতে চিবুতে বলল জ্যাকুয়েল। 

‘যদি তোমাদের আপত্তি না থাকে তো।’ 

‘আমাদের আপত্তি থাকবে কেন!’ বলল আইবিস। ‘মানা করার কোনো কারণই নেই।’ 

‘মৃতের সাথে এক ছাদের নিচে ঘুমাতে আপত্তি না থাকলেই হলো।’ 

লরার স্পর্শ আর ওর ঠান্ডা ঠোঁটের কথা মনে পড়ে গেল শ্যাডোর। ‘নেই। কেবল ওরা আবার বেঁচে না উঠলেই হয়।’ 

অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল জ্যাকুয়েল। ‘আমাদের এখানে মৃতরা…মৃতই থাকে।’ 

‘আমার তো মনে হয়,’ বলল শ্যাডো। মৃতদের প্রাণ ফিরে পেতে বেশি একটা কষ্ট হয় না!’ 

‘আরে না,’ বলল আইবিস। ‘জিন্দালাশদের কথাই ধরো। একটু গুঁড়ো, দুই- একটা মন্ত্র আর হালকা কপাল-ব্যস, জিন্দালাশ বানিয়ে ফেলতে পারবে তুমি। ওগুলো নড়বে-চড়বে, কিন্তু জীবিত হবে না। সত্যি সত্যি মৃতকে পুনরায় জীবিত করার জন্য চাই-ক্ষমতা,’ একটু ইতস্তত করে যোগ করল সে। ‘অবশ্য আমাদের আদি ভূমিতে কাজটা খুব কঠিন ছিল না।’ 

‘চাইলেই তখনও দেহের সাথে কা পাঁচ হাজারের বছরের জন্য বেঁধে দেওয়া যেত,’ বলল জ্যাকুয়েল। ‘কিন্তু সে অনেক আগের কথা।’ যেসব অঙ্গ দেহ থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিল, সেগুলো সম্মানের সাথে আবার জায়গামতো রেখে দিল সে, চামড়ার কাটা দুই প্রান্ত কাছাকাছি এনে সেলাই করতে শুরু করল। মাংসের তালটাকে আবার মেয়ের লাশে পরিণত করতে বেশি সময় নিলো না সে। 

‘বিয়ার দরকার একটা,’ বলে হাত থেকে গ্লাভস খুলে ফেলল জ্যাকুয়েল। পরনের বাদামি ওভারঅলটা ঝুলিয়ে রেখে হাতে তুলে নিলো অঙ্গের অংশ বিশেষ কেটে রাখা পাত্রগুলো। ‘আসছ?’ 

রান্নাঘরে ফিরে এলো ওরা। দেয়ালগুলো বাদামি আর সাদা রং করা, ভেতরটা যেন সেই ১৯২০ সালে সাজানো হয়েছে। একটার সাথে লাগানো রয়েছে একটা বৃহদায়তন কেলভিনেটর। ওটার দরজা খুলে পাত্রগুলো ভেতরে রেখে দিল জ্যাকুয়েল, বের করে আনল তিনটে বাদামি বোতল। এদিকে আইবিস ততক্ষণে তিনটে উঁচু গ্লাস বের করে এনেছে। শ্যাডোকে রান্নাঘরের টেবিলে বসার ইঙ্গিত দিল সে, বিয়ার ঢেলে একটা গ্লাস ওর দিকে আর একটা জ্যাকুয়েলের দিকে এগিয়ে দিল। বিয়ারটা ভালো, একটু তেতো হলেও কড়া। 

‘দারুণ,’ বলল শ্যাডো। 

‘আমরাই বানাই,’ জানাল আইবিস। ‘আগে মেয়েরা এসব কাজ করত। সত্যি বলতে কী, আমাদের চাইতে দক্ষ ছিল তারা। কিন্তু এখন আমরা মাত্র তিনজন বাকি আছি-আমি, জ্যাকুয়েল আর ও।’ ছোট্ট, বাদামি বিড়ালটার দিকে ইঙ্গিত করল সে। ‘শুরুতে আমাদের সাথে আরও অনেকে ছিল। কিন্তু সেট গেল দেশ দেখতে, তা-ও প্রায় দুইশ বছর হতে চলেছে। ১৯০৫ কি ১৯০৬ সালের দিকে স্যান ফ্রান্সিসকো থেকে একটা পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিল, তারপর আর কোনো খবর নেই। আর হোরাসের কথা কী বলব! বেচারা…’ বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে থেমে গেল সে, হতাশা ভরে মাথা নাড়ল। 

‘মাঝে মাঝে দেখি ওকে,’ বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে জানাল জ্যাকুয়েল। ‘লাশ তোলার সময়।’ 

‘আমি কাজ করে খেতে চাই,’ বলল শ্যাডো। ‘তোমাদের উপর বোঝা হতে চাই না।’ 

‘অসুবিধা নেই, করার মতো অনেক কাজ পাবে।’ 

গুটিশুটি পাকিয়ে ঘুমাচ্ছিল বিড়ালটা, চোখ খুলে উঠে দাঁড়াল। শ্যাডোর কাছে এসে মাথা ঘষল বুটের সাথে। বাঁ হাত দিয়ে ওটার কপাল, কানের পেছনটা আর ঘাড় চুলকে দিল ও। আরামে বাঁকা হয়ে গেল বিড়ালটার শরীর, লাফিয়ে ওর কোলে উঠে পড়ল ওটা। সেখানেই আবার গুটিশুটি পাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। হাত দিয়ে আদর করতে লাগল শ্যাডো প্রাণিটাকে, ওর কোলকে দুনিয়ার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা ভেবে ঘুমাচ্ছে ওটা। শ্যাডোর নিজেরও ভালো লাগছে। 

‘তোমরা ঘরটা সিঁড়ির একেবারে মাথায়, বাথরুমের পাশে,’ বলল জ্যাকুয়েল। ‘কাজের সময় তোমাকে যে জামা-কাপড় পরতে হবে তা ক্লজিটেই থাকবে। তবে সবার আগে নিশ্চয়ই একটু পরিষ্কার হয়ে নিতে চাইছ?’ 

আসলেও তাই। ঢালাই লোহার তৈরি বাথটাবে দাঁড়িয়ে গোসল সেরে নিলো ও। এরপর ক্ষুর দিয়ে দাড়ি কামাল। জিনিসটা জ্যাকুয়েলের কাছ থেকে নেয়, প্রচণ্ড তীক্ষ্ণ জিনিসটা সম্ভবত মৃত পুরুষদের দাড়ি শেষবারের মতো কামাবার জন্য ব্যবহার করা হয়। এর আগে ক্ষুর ব্যবহার না করলেও, কোনো দুর্ঘটনা ঘটল না। শেভিং ক্রিম মুছে ফেলে আয়নায় নিজের নগ্ন দেহ দেখল একবার। বুকে আর হাতে নতুন করে আঘাতের চিহ্ন পড়েছে, অথচ পাগলা সুইনির দেওয়া ক্ষতগুলো এখনও শুকায়নি। আয়নার ভেতর দিয়ে শ্যাডোর প্রতিচ্ছবি যেন সন্দেহের চোখে তাকাল ওর দিকে। 

তারপর…একদম আচমকা…যেন অন্য কেউ ওর হাত ধরে আছে…আস্তে আস্তে ক্ষুরটা তুলে নিজের গলায় ঠেকাল শ্যাডো! মুক্তি পাবার এটাও একটা পথ, ভাবল ও। বড়ো সহজ একটা পথ। নিচের তলায় দুজন এমন মানুষ আছে, যারা ওর মৃতদেহের ভালো খেয়াল রাখবে! লরাকে নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না…হতে হবে না কোনো ষড়যন্ত্রের খুঁটি। আর কখনও দুঃস্বপ্নও দেখতে হবে না। শুধু শান্তি আর শান্তি। একটা মাত্র আঘাত, এ কান থেকে ও কান পর্যন্ত… 

… ব্যস। 

গলায় ক্ষুর ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ও, এক বিন্দু রক্ত গড়িয়ে পড়ল চামড়ার ওপর দিয়ে। কখন যে কেটে গেছে, টেরই পায়নি। কত সহজ, কেউ যেন ফিসফিস করে বলছে ওর কানে। একদম টের পাবে না, ব্যথার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিছু বোঝার আগেই কাজ শেষ হয়ে যাবে। 

আচমকা খুলে গেল বাথরুমের দরজা, হাট হয়ে না-মাত্র কয়েক ইঞ্চি। এই অল্প জায়গার ভেতর দিয়েই মাথা ঢোকাল ছোট্ট, বাদামি বিড়ালটা। ‘মরর?’ ওর দিকে তাকিয়ে ডেকে উঠল। 

‘আমি তো ভেবেছিলাম,’ বিড়ালটাকে বলল শ্যাডো। ‘দরজা লাগিয়ে দিয়েছি!’ ধারাল অস্ত্রটা বন্ধ করে, সিঙ্কের পাশে রেখে দিয়ে কাটা স্থানে লাগাল টয়লেট পেপারের একটা টুকরা। তারপর কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে চলে এলো পাশের শোবার ঘরে। এটাও রান্নাঘরের মতো ১৯২০ সালের আদলে সাজানো। একটা ওয়াশস্ট্যান্ড আর পানি রাখার পিচার আছে ভেতরে। ওগুলোর পাশেই আছে ওয়ার্ডোব আর আয়না। বিছানার উপর কে যেন সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে জামা- কাপড়-কালো স্যুট, সাদা শার্ট, কালো টাই, সাদা গেঞ্জি আর জাঙ্গিয়া, কালো মোজা। মেঝেতে রাখা আছে একজোড়া কালো জুতো। 

পোশাক পরে নিলো শ্যাডো, ভালো মানের কাপড় দিয়ে বানানো হয়েছে এগুলো; যদিও একটাও নতুন নয়। কে জানে, কোনো মৃত মানুষের পোশাক পরছে হয়তো! অত-শত না ভেবে সবকিছু পরে নিলো ও। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, হাসছে ওর প্রতিচ্ছায়া। 

এই একটু আগেই নিজের গলা কেটে ফেলতে চাচ্ছিল, বিশ্বাসই হতে চাইছে না শ্যাডোর। ‘হাসছ কেন?’ আয়নার শ্যাডোকে জিজ্ঞেস করল ও। ‘আমার অজানা কোনো রহস্যের সমাধান জানা আছে মনে হচ্ছে?’ বলেই লজ্জা পেল। 

আচমকা ক্যাচ-ক্যাঁচ শব্দে খুলে গেল দরজা। বিড়ালটা বিনা শব্দে প্রবেশ করল ঘরে। ‘এবার যে দরজা লাগিয়েছিলাম,’ প্রাণিটাকে বলল ও। ‘তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’ আগ্রহ নিয়ে ওর দিকে তাকাল বিড়ালটা, হলদে রঙের মণি ওটার। তারপর লাফিয়ে উঠে পড়ল বিছানায়, আরাম করে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সাথে সাথেই। 

দরজা খোলা রেখেই বেরোল শ্যাডো। বিড়ালটা চাইলে বেরিয়ে যেতে পারবে, আবার ঘরটাতেও বাতাস ঢুকবে একটু। ওর ওজনের ভার নিতে না পেরে প্রতিবাদ জানাল যেন কাঠের সিঁড়ি। 

‘আরে!’ বলল জ্যাকুয়েল। ‘দারুণ লাগছে দেখতে। শ্যাডোর মতোই আরেকটা স্যুট পরে আছে সে। ‘ভালো কথা, শববহনকারী গাড়ি চালিয়েছ কখনও?’ 

‘হার্স? না।’ 

‘ব্যাপার না,’ বলল জ্যাকুয়েল। ‘সবকিছুরই একটা শুরু থাকে। ওটা সামনে পার্ক করে রাখা আছে।’ 

.

মারা গেছেন এক বৃদ্ধা, নাম ছিল তার লিলা গুডচাইল্ড। মি. জ্যাকুয়েলের নির্দেশনা মোতাবেক শ্যাডো একটা ভাঁজ করা, অ্যালুমিনিয়ামের গার্নি নিয়ে উঠে গেল ওপরে। ভদ্রমহিলার বিছানার পাশে খুলল সে গার্নিটা, নীলচে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে রাখল লাশের পাশে। লিলি গুডচাইল্ড একটা গোলাপি নাইটগাউন আর একটা পুরু রোব পরে আছেন। লাশটাকে তুলে নিয়ে একটা কম্বলে জড়াল শ্যাডো, একদম হালকা…পাখির মতো দেহ যেন। সবশেষে ব্যাগে ভরে আলতো করে তুলল গার্নিতে। এদিকে জ্যাকুয়েল ভদ্রমহিলার স্বামীর সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। আসলে বলছে কম, শুনছে বেশি। নিজের সন্তান, নাতিপুতির বিরুদ্ধে যত অভিযোগ আছে, সব শোনাচ্ছে ভদ্রলোক জ্যাকুয়েলকে। বলছে, নাতিদের দোষ দেয় না সে। দোষ দেয় ছেলে-মেয়েদের। বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়। 

জ্যাকুয়েলের সহায়তায় গার্নিটাকে সরু সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামিয়ে আনল শ্যাডো। বুড়ো লোকটা এলো সাথে, এখনও কথা বলেই যাচ্ছে। লোকটার পায়ে শোবার ঘরে পরার চপ্পল। গার্নির ভারী, নিচের অংশটা বয়ে রাস্তায় এলো শ্যাডো। এরপর চাকার সাহায্যে ঠেলে নিয়ে গেল হার্সের কাছে। জ্যাকুয়েল পেছনের দরজাটা খুলে ধরলে, ইতস্তত করল শ্যাডো। ‘ভেতরে ঢুকিয়ে দাও, নিচের চাকাগুলো আপনা-আপনি ভাঁজ হয়ে যাবে।’ তা-ই করল শ্যাডো, সুন্দর মতো গার্নিটা এঁটে গেল ভেতরে। কীভাবে গার্নি বেঁধে লাশটাকে সাবধানে রাখতে হয়, তা দেখাল জ্যাকুয়েল। শ্যাডো যখন হার্সটার দরজা বন্ধ করছে, তখন জ্যাকুয়েল মন দিয়ে লিলা গুডচাইল্ডকে বিয়ে করা বুড়োর কথা শোনায় ব্যস্ত। সন্তানদের গাল-মন্দ করছে সে। বলছে, ওরা আসলে শকুনের চাইতে ভালো কিছু নয়। লিলা আর ওর জমানো অল্প যা আছে, সব কেড়ে নেবার জন্য ওঁত পেতে আছে। তবে ওর স্ত্রী যে কোনো নার্সিং হোমে মারা যায়নি, তাতে সে খুশি। আবার তার নিজের ভাগ্যে ওরকম কিছু লেখা আছে ভেবে ভয়ও পাচ্ছে। 

বুড়ো লোকটার সাথে বাড়ি পর্যন্ত হেঁটে এলো ওরা, এমনকী সিঁড়ি বেয়ে তাকে শোবার ঘর পর্যন্ত এগিয়ে দিল। ছোট্ট একটা টিভি আছে এই রুমে, ওটার পাশ দিয়ে যাবার সময় শ্যাডোর যেন মনে হলো, খবর পাঠিকা ওর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপছে! 

‘গুডচাইল্ডদের খুব একটা টাকা-পয়সা নেই,’ হার্সে ফিরে বলল জ্যাকুয়েল। ‘আগামীকাল লোকটা আইবিসের সাথে দেখা করতে আসবে। সবচেয়ে কম খরুচে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াটা পছন্দ করবে স্ত্রীর জন্য। কিন্তু মহিলার বান্ধবীদের চাপে বাধ্য হবে আরও বেশি দামি আরেকটা বেছে নেবার জন্য। কী আর করা বলো, আজকাল কারও হাতেই টাকা-পয়সা বেশি নেই। যাই হোক, আমার তো মনে হয় ভদ্রলোক আর ছয় মাস বাঁচবে না…খুব বেশি হলে এক বছর। 

তুষারপাত হচ্ছে, হেডলাইটের আলোতে অদ্ভুত দেখাচ্ছে ওগুলোকে। ‘কেন, অসুস্থ নাকি?’ জানতে চাইল শ্যাডো। 

‘নাহ, তা না। মেয়েরা সাধারণত তাদের স্বামীর চাইতে বেশি বাঁচে। পুরুষ, বিশেষ করে মি. গুডচাইল্ডের মতো পুরুষ, স্ত্রী মারা গেলে আর বেশিদিন বাঁচে না। আস্তে আস্তে ক্লান্ত হতে শুরু করবে সে, তারপর একদিন হাল ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজবে। ডাক্তার হয়তো বলবে, ক্যান্সারে বা নিউমোনিয়ায় মারা গেছে। আসলে বুড়ো বয়সে মানুষের আর লড়াই করে বাঁচার ইচ্ছা থাকে না। মরণটা হয় সে কারণেই।’ 

‘আচ্ছা, জ্যাকুয়েল—’ 

‘বলো।’ 

‘তুমি কি আত্মায় বিশ্বাসী?’ আসলে এই প্রশ্নটা করার ইচ্ছা ছিল না শ্যাডোর। নিজেও অবাক হয়ে গেছে শব্দগুলো উচ্চারণ করার পর। 

‘নির্ভর করে অনেক কিছুর ওপরে। যখন আমরা ক্ষমতায় ছিলাম, তখন সবকিছু ছিল ছকে বাঁধা। মারা গেলে সবাইকে এক সারিতে দাঁড় করানো হতো। পাপের জন্য জবাবদিহিতা করতে হতো, পুণ্যের জন্য পাওয়া যেত প্ৰশংসা। যদি পাপের ওজন একটা পালকের চাইতে বেশি হতো, তাহলে আত্মাটাকে আমেমেতের সামনে রেখে দিতাম আমরা। গপগপ করে গিলে ফেলত সে ওটাকে।’ 

‘তাহলে নিশ্চয়ই অগণিত আত্মা খেতে পেয়েছে সে!’ 

‘অতো বেশিও না। পালকটা আসলে খুব ভারী ছিল। বিশেষভাবে বানানো হয়েছিল ওটাকে। খুব বড়ো ধরনের পাপী না হলে, ওটার চাইতে বেশি ওজন হতো না আত্মার। ওই গ্যাস স্টেশনের সামনে থামো, কয়েক গ্যালন নিয়ে নিই।’

নির্জন রাস্তা, অবশ্য প্রথম তুষারপাতের সময় রাস্তা খালিই হয়ে যায়। ‘এবারের ক্রিসমাসে সাদার রাজত্ব থাকবে।’ তেল ভরতে ভরতে বলল শ্যাডো। 

‘হ্যাঁ। কুমারী-পুত্রের কপাল বটে।’ 

‘যিশুর কথা বলছ?’ 

‘হ্যাঁ, কপাল নিয়ে জন্মেছে। গুয়ের গর্তে পড়লেও দেখা যাবে, ফুলের সুগন্ধি গায়ে নিয়ে উঠে এসেছে! অথচ ক্রিসমাস আসলে ওর জন্মদিনও না, ওটা ধার করেছে মিথরাসের কাছ থেকে। মিথরাসের সাথে দেখা হয়েছে? লাল ক্যাপ পরে থাকে? ভালো ছেলে।’ 

‘মনে হয় না।’ 

‘অবশ্য আমিও অনেকদিন দেখি না। আর্মিতে নাম লিখিয়েছে, বুঝলে। হয়তো এখন মধ্য প্রাচ্যে আছে। তবে কে জানে, বিস্মৃতও হয়ে যেতে পারে এতদিনে। এরকমটাই হয়। একদিন যার নামে বিশাল বিশাল সব পশু বলি দেওয়া হয়, পরেরদিন তার জন্মদিনটাও কারও মনে থাকে না।’ 

কাজ শেষে আবার রওনা দিল ওরা, মাঝখানে সুযোগ বুঝে একটু গতি তুলতে গিয়ে আরেকটু হলেই গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসেছিল শ্যাডো। তাই এবার ঘণ্টা প্রতি মাত্র দশ মাইল বেগে চালাল। গাড়িটাকেও মনে হলো এই গতিতে সন্তুষ্ট। 

‘যা বলছিলাম,’ বলল জ্যাকুয়েল। ‘যিশুর কপালটা ভালো। এদিকটায় ওর নামও আছে বেশ। কিন্তু আমি এমন একজনকে চিনি, যে ওকে আফগানিস্তানের রাস্তায় হাঁটতে দেখেছে। অথচ কেউ ওকে লিফট দেওয়ার জন্য গাড়িটা পর্যন্ত থামায়নি। আসলে পুরোটাই অবস্থানের ওপরে, নিজ পাড়ায় কুত্তাও সিংহ।’ 

‘আমার ধারণা, একটা ঝড় আসছে।’ বলল শ্যাডো, আসলেই আবহাওয়ার ব্যাপারে বলেছে। 

কিন্তু জ্যাকুয়েল যখন কথা বলল, তখন সে আবহাওয়ার ধারে-কাছে দিয়েও গেল না। ‘আমার আর আইবিসের কথাই ধরো। বছরখানেকের মধ্যে আমাদের ব্যাবসা বন্ধ হয়ে যাবে। মন্দার জন্য বেশ কিছু টাকা আলাদা করা আছে আমাদের। তবে সত্যি বলতে কী, মন্দা চলছে কয়েক বছর ধরেই। আবার প্রতি বছর আগের চাইতেও বেশি খারাপ হচ্ছে অবস্থা। হোরাস তো পুরো পাগল হয়ে গেছে, পুরোটা সময় বাজপাখি হয়েই কাটিয়ে দেয়। মরা প্রাণী খেয়ে বাঁচা-এটা কোনো জীবন হলো। বাস্টকেও তো দেখেছ। আমাদের অবস্থা বাকিদের চাইতে ভালো। এখনও অল্প-স্বল্প বিশ্বাস পাই আমরা। অধিকাংশ তো কিছুই পায় না। পুরোটা অনেকটা ফিউনারেল ব্যাবসার মতো-বড়ো কোম্পানিগুলো একদিন-না- একদিন তোমাকে কিনেই নেবে। তা ব্যাপারটা তোমার মনে ধরুক আর না-ই ধরুক। এর বিরুদ্ধে লড়াই করেও লাভ নেই। যখন একশ…এক হাজার বা দশ হাজার বছর আগে এই দেশে পা রেখেছি, তখনই হেরে গেছি সেই যুদ্ধে। আমাদেরকে নিয়ে আমেরিকার না কোনো মাথাব্যথা আগে ছিল, আর না এখন আছে। তাই হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। ঝড় আসছে।’ 

পেছনের দুই বড়ো দরজার সাথে প্রায় লাগিয়ে হার্সটা থামাল শ্যাডো। আইবিস ওটার দরজা আর সেই সাথে মর্গের দরজাও খুলে দিল। শ্যাডো নেমে পড়ল গার্নিটা নামাবার কাজে। গাড়ি থেকে নামানো মাত্র গার্নিটার নিচের চাকাগুলো নেমে এলো আবার। ওটা ঠেলে টেবিলের কাছে আনতে তাই একদম কষ্ট হলো না। লিলা গুডচাইল্ডকে বহন করা ব্যাগটা তুলে এমনভাবে তাকে ওই ঠান্ডা টেবিলে শুইয়ে দিল শ্যাডো যেন কোন ঘুমন্ত বাচ্চাকে কোলে নিয়েছে! 

‘কোলে না নিলেও হতো, আমার আলাদা বোর্ড আছে।’ বলল জ্যাকুয়েল।

‘সমস্যা নেই,’ বলল শ্যাডো। ‘আমার কষ্ট হয়নি।’ 

শৈশবে বয়সের তুলনায় খাটো ছিল শ্যাডো। ওর ছেলেবেলার একটা মাত্র ছবি পছন্দ হয়েছিল লরার। অগোছালো চুল আর কালো চোখের একটা গম্ভীর বাচ্চাকে দেখা যাচ্ছিল ওতে, কেক আর কুকি ভরতি একটা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। যেহেতু ওতে ছেলেটা বো-টাই আর সুন্দর জামা পরা ছিল, তাই শ্যাডোর ধারণা কোনো দূতাবাসের ক্রিসমাস পার্টির সময় তোলা ছবি ওটা। 

শ্যাডো আর ওর মা কোথাও থিতু হতে পারত না। প্রথমে ইউরোপ জুড়ে, এক দূতাবাস থেকে অন্য দূতাবাসে যেত ওরা। শ্যাডোর মা কাজ করতেন ফরেন সার্ভিসের কমিউনিকেটর হিসেবে, তার দায়িত্ব ছিল বিশ্ব জুড়ে গোপন টেলিগ্রাম পাঠানো আর দূতাবাসে আসা টেলিগ্রামগুলো লিখে রাখা। শ্যাডোর বয়স যখন আট, তখন ইউএসএ ফিরে আসে ওরা। মা ততদিনে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাই একটানা কোনো চাকরি করতে পারতেন না। এক বছর এই শহরে তো অন্য বছর ওই শহরে করে থাকতে হতো তাদের। বাচ্চা শ্যাডো যে কোথাও বন্ধু বানাবে, একটু স্থির হবে—সেই সুযোগ পায়নি। তার ওপর আকারে ছিল ও ছোটো… 

বেড়ে উঠেছেও একেবারে আচমকা। তেরোতম বছরের এক বসন্তের কথা। ওর স্কুলের বাচ্চারা খেপাচ্ছিল বেচারাকে। জানত, লড়াই করতে চাইলে সহজেই পিটিয়ে ছাতু বানাতে পারবে বাচ্চা শ্যাডোকে। সেজন্যই হয়তো খুব উসকানি দিচ্ছিল। সাধারণত এধরনের ঘটনা ঘটলে পালিয়ে ছেলেদের ওয়াশরুমে চলে আসত ও, কাদা আর রক্ত ধুয়ে ফেলত চেহারা থেকে। এরপর এলো গ্রীষ্মের ছুটি। জীবনের তেরোতম বছরের এই ছুটিটাকে ওর আশীর্বাদ বলে মনে হয়। পুরোটা সময় গা বাঁচিয়ে চলছিল, সাঁতার কাটত আর পুলের পাশে বসে লাইব্রেরি থেকে আনা বই পড়ত। ছুটির শুরুতে সাঁতারের কেবল ‘স’ জানত ও। কিন্তু আগস্টের শেষ দিকে দেখা গেল: আরামসে পুলের এপার-ওপার করছে ও, উঁচু ডাইভিং- বোর্ড থেকে লাফিয়ে নামছে পুলে, গায়ের চামড়া হয়ে গেছে তামাটে। সেপ্টেম্বরে যখন স্কুল খুলল তখন অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, এতদিন ধরে ওর ওপরে অত্যাচার করে আসা ছাত্রগুলো আসলে একেবারে নরম আর দুর্বল কয়েকটা পুতুল ছাড়া আর কিছুই না! দুজন অবশ্য তা-ও ঝামেলা করতে এসেছিল, কিন্তু দ্রুতই তাদের ঘরে না শেখা ভদ্রতার পাঠ পড়িয়ে দিল শ্যাডো। 

তবে সমস্যাও হলো, এখন আর চুপচাপ একেবারে পেছনে বসে থাকা ছাত্রের চরিত্রে মানিয়ে নেওয়া গেল না। একটু বেশিই দশাসই হয়ে গেছে ও, নজরে পড়ে সবার। ওই বছরের শেষের দিকে এসে দেখা গেল, শ্যাডো সাঁতার দলের তারকা সাঁতারু; ভার-উত্তোলনকারী দলের সদস্য। কোচের নজরে পড়ে গেল সে, তিনি ওকে ট্রায়াথলনের জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করলেন। শক্তিশালী আর বিশালদেহী পরিচয়ে খুব সহজেই মানিয়ে নিতে পারল ও নিজেকে। এতদিন লাজুক, বইপ্রেমি ছিল-কষ্ট পেতে হতো খুব। আর এখন সে বিশাল এক বোকা মানব-মানুষজন ওর কাছ থেকে বিশেষ কিছু আশা করে না। সোফাটাকে একঘর থেকে অন্যঘরে নিয়ে যেতে পারলেই সবাই খুশি। 

কিন্তু লরা…লরার আগমন পালটে দিল সব কিছু! 

.

রাতের খাবার রান্না করল মি. আইবিস। নিজের ও মি. জ্যাকুয়েলের জন্য রাঁধল ভাত আর সবজি সিদ্ধ। ‘আমি মাংস খাই না,’ জানাল সে। ‘আর জ্যাকুয়েল কাজ করতে করতেই যথেষ্ট পরিমাণ পায়।’ শ্যাডোর জন্য যোগ করা হলো কেএফসি- এর চিকেন আর বিয়ারের একটা বোতল। 

মুরগির পরিমাণ এত বেশি ছিল যে পুরোটা একা খেতে পারল না শ্যাডো, বিড়ালটাকেও দিতে হলো কিছু। তবে তার আগে চামড়া সরিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করতে ভুলল না। 

‘জ্যাকসন নামে এক কয়েদি ছিল জেলে,’ খেতে খেত বলল শ্যাডো। ‘লাইব্রেরিতে কাজ করত। ওর মতে, কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেনের নাম কেএফসি করার কারণ একটাই—এখন আর আসলে মুরগি পরিবেশন করা হয় না। এখন আমরা যেগুলোর মাংস খাই, ওগুলো আসলে জেনেটিক্যালি পরিবর্তিত প্রাণী। তাদের না মাথা আছে আর না মুখ। শুধু পা, বুক আর পাখনা। ওদের খাওয়ানো হয় টিউব দিয়ে। লোকটার মতে, সরকার তাই কোম্পানিকে নামের সাথে ‘চিকেন’ ব্যবহার করতে বাধা দিয়েছে।’ 

ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল আইবিস। ‘তোমার-ও কি তাই মনে হয়?’ 

‘না। তবে আমার আরেক সেলমেট, লো কির ব্যাখ্যাটা মনে ধরেছিল। ওর মতে, ফ্রাইড শব্দটা এখন মানুষের পছন্দ হয় না। ওরা ভাবতে চায়, মুরগি নিজেই নিজেকে রান্না করে তাদের সামনে উপস্থাপন করেছে।’ 

রাতের খাবার শেষ হলে, জ্যাকুয়েল মর্গে চলে গেল। আইবিস গেল তার স্টাডিতে, লেখালেখি করবে। শ্যাডো আরও কিছুক্ষণ বসে রইল রান্নাঘরে, ছোট্ট বিড়ালটাকে মাংস খাওয়াল। যখন মুরগি আর ওর বিয়ার, দুটোই ফুরিয়ে গেল—তখন বাসন-কোসন ধুয়ে সাজিয়ে রেখে চলে এলো শোবার ঘরে। 

এসে দেখে, বিড়ালটা এরইমাঝে ওর বিছানার নিচে ঘুমিয়ে পড়েছে! ওয়াড্রোবের মাঝের ড্রয়ারে কয়েকজোড়া সুতির পায়জামা খুঁজে পেল শ্যাডো। দেখে মনে হয় সত্তর বছরের পুরনো, কিন্তু গন্ধে নতুন। কালো স্যুটের মতোই, সুন্দর ওর শরীরে এঁটে গেল ওটা। 

বিছানার পাশের টেবিলে অনেকগুলো রিডার’স ডাইজেস্ট রাখা আছে। অবশ্য কোনটাই মার্চ ১৯৬০ সালের পরের নয়। জ্যাকসন, জেলের লাইব্রেরিতে কাজ করা পাগলাটে লোকটার এই রিডার’স ডাইজেস্ট নিয়েও একটা তত্ত্ব আছে। সিআইএ নাকি একে তাদের শাখা অফিসের কাভার হিসেবে ব্যবহার করে। দেশ জুড়ে রিডার’স ডাইজেস্টের যত অফিস আছে, সব আসলে সিআইএর শাখা! 

আচমকা মরহুম মি. উডের সেই ঠাট্টার কথা মনে পড়ে গেল শ্যাডোর-কেনেডির হত্যাকাণ্ডে যে সিআইএর হাত ছিল না, তার নিশ্চিয়তা কী? 

জানালাটা অল্প একটু খুলে ধরল শ্যাডো, যেন বাতাস আসতে পারে। আর রাতে যদি চায়, তাহলে বিড়ালটা চলেও যেতে পারে ব্যালকনিতে 

বেডসাইড ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে বিছানায় উঠে পড়ল ও, অল্প কিছুক্ষণ ডাইজেস্ট পড়তেই ঘুমে যেন বন্ধ হয়ে গেল চোখ। নিদ্রা-দেবীর হাতে নিজেকে সঁপে দেবার আগে কেবল বাতিটাই নেভাতে পারল শ্যাডো। 

.

স্বপ্নটা কখন শুরু হলো, কীভাবে শুরু হলো বা কোনটার পর কী দেখল—এসবের কিছুই বলতে পারে না যুবক। মনে করতে গেলে শুধু অন্ধকার কিছু আবছা দৃশ্য দেখতে পায়। মেয়ে ছিল একজন। কোথায় যেন দেখেছিল সে মেয়েটাকে। ব্রিজের উপর দিয়ে হাঁটছে দুজন, ছোটো একটা হ্রদের উপর অবস্থিত ওটা…কোনো এক শহরের ঠিক মাঝখানে। বাতাস বইছে পানির উপর দিয়ে, ছোটো ছোটো ঢেউয়ের জন্ম দিয়ে দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে। 

‘নিচের দিকে মন দাও, আদেশ দিল মেয়েটা। তার পরনে একটা চিতাবাঘের ছোপঅলা স্কার্ট, বাতাসে পতপত করে উড়ছে। স্কার্টের নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে ক্রিমের মতো নরম মাংস। নাকে মেয়েলি সুবাস টের পাচ্ছে শ্যাডো। স্বপ্নে দেখা মেয়েটা যে ওকে বাস্তব জীবনেও উত্তেজিত করে তুলছে, তা বুঝতে পারছে। 

মেয়েটার চেহারার দিকে চাইল সে, কিন্তু অন্ধকারে ঢেকে আছে। মুখ বাড়িয়ে খুঁজতে চাইল তার নরম ঠোঁট, খুঁজেও পেল। ঠোঁটে পেলব ঠোঁটের স্পর্শ আর হাতে নরম স্তনের ছোঁয়া পেয়ে আরও উত্তেজিত হয়ে উঠল যেন শ্যাডো। আস্তে আস্তে সিল্কের মতো মসৃণ পিঠ আর কোমর বেয়ে দুই উরুর ফাঁকে চলে এলো ওর হাত। নরম, ভেজা জায়গাটা যেন আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। 

উত্তেজনার শীৎকার বেরিয়ে আসছে মেয়েটার দুই ঠোঁটের ফাঁক দিয়েও। আচমকা নিজের পুরুষাঙ্গের উপর মেয়েটার হাতের মৃদু চাপ অনুভব করল শ্যাডো, আর সামলাতে না পেরে মেয়েটাকে শুইয়ে চড়ে বসল ওপরে 

আগে কখনও এমন নরম ঠোঁটে চুমু খায়নি শ্যাডো, আসলে কারও ঠোঁট যে এতটা নরম হতে পারে তা জানতই না। তবে মেয়েটার ঠোঁট বেশ কর্কশ, যেন স্যান্ডপেপার। 

–কে তুমি? জানতে চাইল ও। 

উত্তর দিল না মেয়েটা, দেওয়ার চেষ্টাও করল না। উলটো ওকে শুইয়ে দিয়ে নিজে উঠে এলো ওপরে। তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে আঁচড়ে দিল শ্যাডোর দুই পাশ, কিন্তু ব্যথা পেল না যুবক। বরঞ্চ সুখের আবেশে যেন তলিয়ে গেল। মেয়েটা যা-ই করছে, কোনো এক পরশ পাথর সেটাকে পরিণত করছে আনন্দে…আবেশে… 

কী যেন বলতে চাইল শ্যাডো, কিন্তু কথা খুঁজে পাচ্ছে না। অনেক চেষ্টার পর আবারও জানতে চাইল, কে তুমি? 

এবারও উত্তর এলো না। কেবল উজ্জ্বল চোখ দিয়ে চেয়ে রইল মেয়েটা শ্যাডোর দিকে। আলতো করে মুখ নামিয়ে প্রবল অনুরাগের সাথে চুমু খেল, এমনভাবে যে ওই ব্রিজের ওপর…না না, কায়রো ফিউনারেল হোমের বিছানার উপর আরেকটু হলেই রেত:পাত হয়ে যেত শ্যাডোর। কিন্তু না, নিজেকে নিয়ন্ত্ৰণ করার প্রয়াস পেল ও। মেয়েটাকে সাবধান করে দিতে হবে। 

–আমার স্ত্রী, লরা। তোমাকে খুন করবে। 

–না, করবে না। জানাল মেয়েটা। 

মেয়েটার নাম জানার জন্য আকুলি-বিকুলি করছে শ্যাডোর মন, কিন্তু তৃতীয়বারের মতো জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে না। আচমকা আঁকড়ে ধরল ওকে মেয়েটা, বুকের উপর শক্ত হয়ে থাকা স্তন-বৃত্তের স্পর্শ পেল শ্যাডো। ওকে যেন চাপ দিয়ে সর্বোচ্চ সুখ দিতে চাইছে মেয়েটা। এবার আর পারল না সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে। সর্বশক্তিতে প্রবেশ করল মেয়েটার ভেতরে, যত দূর পারে…যতটা জোরে পারে… 

–আটকে রেখো না নিজেকে, ছেড়ে দাও। আমাকে দাও সবটা। 

তিন বছরের জমিয়ে রাখা পৌরুষ তাই একবারে উগড়ে দিল শ্যাডোর দেহ।

–বিশ্রাম নাও এবার। নরম ওই ঠোঁটজোড়া দিয়ে যুবকের পাপড়িতে চুমু খেল মেয়েটা। ছেড়ে দাও নিজেকে। 

আবার ঘুমিয়ে পড়ল শ্যাডো। গভীর…স্বপ্নহীন আর স্বস্তির ঘুম। 

নিদ্রা দেবীর হাতে নিজেকে ছেড়ে দিল শ্যাডো। 

.

পরদিন শ্যাডোর ঘুম ভাঙ্গল অদ্ভুত এক আলোয়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে, ভোর ছয়টা পঁয়তাল্লিশ বাজে। বাইরে এখনও অন্ধকার, তবে ঘরের ভেতর হালকা নীলচে আলো। বিছানা ছেড়ে নামল ও, কিন্তু নগ্ন হয়ে আছে। ঠান্ডা বাতাসে শীত করছে ওর, তাই বন্ধ করে দিল জানালা। 

রাতে তুষার-ঝড় হয়েছে, রাস্তায় জমে থাকা ছয় ইঞ্চি পুরু বরফই তার প্রমাণ। জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া দালানগুলো যেন সাদা কোনো সাজে সেজেছে। রাস্তার কোন চিহ্ন নেই, ওখানে এখন শুধু বরফের খেত! 

একটা চিন্তা খেলে গেল ওর মনে… ঠিক মনে না, মনের কাছ দিয়ে। তবে দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার সেই চিন্তাটুকু। 

আয়নার দিকে তাকাল ও, কেন জানি কিছু একটা ঠিক নেই বলে মনে হচ্ছে। মনোযোগ দিয়ে আয়নার শ্যাডোর দিকে তাকাতেই ধরলে পারল ব্যাপারটা। দেহে এখন কোনো ক্ষত দেখা যাচ্ছে না! আঙুল দিয়ে চাপ দিল আগের ক্ষতগুলোতে, কিন্তু না পাগলা সুইনির উপহার দেওয়া আঘাতগুলো টের পেল…আর না মি. উড ও মি. স্টোনের মারের ব্যথা! তবে হ্যাঁ, পিঠে আঁচড়ের দাগ রয়েছে বটে। 

পুরোটা তাহলে কল্পনা ছিল না। 

ড্রয়ারগুলো খুলল শ্যাডো। ভেতরে পেল পুরনো একজোড়া নীল ডেনিম- লিভাই, একটা শার্ট আর নীল সোয়েটার। মুর্দাফরাশের একটা কোটও আছে। সবগুলো পরে নিলো শ্যাডো, তবে জুতা পরল নিজেরটাই। 

পুরো বাড়ি ঘুমিয়ে আছে। চুপিচুপি নিচে নেমে এলো শ্যাডো। বাইরে বেরিয়ে বরফের মাঝে হাঁটল কিছুক্ষণ। বাড়ির ভেতর থেকে দেখে যতটা পুরু মনে হয়েছিল, ততটা পুরু হয়ে বরফ জমেনি! 

মিনিট পনেরো হাঁটার পর, শ্যাডো একটা ব্রিজের নিচে এসে উপস্থিত হলো। বড়ো একটা সাইনবোর্ড দেখতে পেল ও। এই ব্রিজটাই যে কায়রো শহরটার শেষ সীমা, সেটা লেখা আছে তাতে। ব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে আছে কেউ একজন, এখান থেকে মনে হচ্ছে গার্গল করছে। মুখে সিগারেট, ঠকঠক করে কাঁপছে ঠান্ডায় পরিচিত বলে মনে হলো লোকটাকে। 

এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘শুভ সকাল, মিস্টার সুইনি।’ 

নিশ্চুপে হয়ে আছে পুরো বিশ্ব, এমনকী চারপাশে গাড়ির আওয়াজ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। ‘হেই।’ বলল পাগলা সুইনি, মুখ তুলে তাকাবার চেষ্টাও করল না। মুখে রাখা সিগারেটটা হাতে বানানো। 

‘ব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধ করো,’ বলল শ্যাডো। ‘মানুষজন তোমাকে ট্রল ভাববে।’ 

এতক্ষণে চোখ তুলে তাকাল পাগলা সুইনি। লোকটার ভয়ার্ত চোখের সাদা অংশ পর্যন্ত দেখতে পেল ও। ‘তোমাকেই খুঁজছিলাম,’ বলল সুইনি। ‘আমার সাহায্য দরকার। অনেক বড়ো ঝামেলায় পড়ে গেছি।’ সিগারেটটা মুখ থেকে সরাতে চাইল সে, কিন্তু কাগজের অংশটা নিচের ঠোঁটের সাথে লেগে খুলে গেল পুরোটা। ভেতরের তামাকটুকু ছড়িয়ে পড়ল দাড়ির ওপরে। টি-শার্টের সামনের অংশটুকুও বাদ পড়ল না। হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলাবার চেষ্টা করল পাগলা সুইনি, যেন পোকা তাড়াচ্ছে! 

‘আমার পয়সা-কড়ি প্রায় শেষ, সুইনি।’ বলল শ্যাডো। ‘তবে কী দরকার, তা বলতে পারো। কফি আনব?’ 

মাথা নাড়ল পাগলা সুইনি। পরনের ডেনিম জ্যাকেট থেকে তামাক আর কাগজ বের করে আনল সে, নতুন একটা সিগারেট বানাতে শুরু করল। মুখ নড়তে শুরু করল বেচারার, কিন্তু কোনো আওয়াজ উচ্চারিত হলো না। সিগারেট কাগজের আঠাঅলা অংশটা চেটে দুই আঙুল দিয়ে রোল করল। তারপর বলল, ‘আমি ট্রল নই। বাল, ওইগুলা খুব খারাপ।’ 

‘আমি তা জানি, সুইনি।’ বলল শ্যাডো। ‘তাহলে বলো, কী সাহায্য চাও?’ হাতের তামা জিপ্পোটা জ্বালাল পাগলা সুইনি। ওর সিগারেটের প্রথম ইঞ্চিটা পুড়ে গেল সাথে সাথে। ‘মনে আছে? তোমাকে একটা পয়সা দিয়েছিলাম, মনে আছে?’ 

‘হ্যাঁ,’ বলল শ্যাডো। লরার কবরে ওটা ছুড়ে দেবার কথাও মনে পড়ে গেল ওর। ‘মনে আছে।’ 

‘ভুল পয়সাটা নিয়েছ।’ 

ব্রিজের আড়াল থেকে আচমকা বেরিয়ে এলো একটা গাড়ি, ওটার হেডলাইটের আলোয় ধাঁধিয়ে গেল দুজনের চোখ। যেতে যেতে আচমকা ব্রেক কষল গাড়িটা। জানালা নামিয়ে চালক জানতে চাইল, ‘সব ঠিক আছে তো?’ 

‘একদম ঠিক, অফিসার।’ জানাল শ্যাডো। ‘সকালের হাওয়া খেতে বেরিয়েছি।’ 

‘ঠিক আছে,’ বলল পুলিস অফিসার। তবে তাকে দেখে মনে হলো না যে সে শ্যাডোর কথা বিশ্বাস করেছে। অপেক্ষা করল তাই। ওকে দেখাবার জন্যই একটা হাত সুইনির কাঁধে রাখল শ্যাডো। দুজনে মিলে একটু সামনে এগিয়ে গেল, শহরের বাইরে। জানালা বন্ধ হলো বটে পুলিসের গাড়ির, তবে একচুলও নড়ল না ওটা। 

হাঁটতে থাকল শ্যাডো, হাঁটল পাগল সুইনিও। তবে মাঝে মাঝে হোঁচট খেল বেচারা। 

পুলিসের গাড়িটা এতক্ষণে এগোতে শুরু করল। শহরের বাইরে চলে এসেছে শ্যাডোরা। ওদের বিরক্ত করার আর কেউ নেই। ‘এবার বলো, কী এমন ঝামেলায় পড়েছ?’ 

‘আমাকে যা যা বলেছে, আমি করেছি। যেভাবে বলেছে, সেভাবেই করেছি। কেবল তোমাকে পয়সা দেবার সময় ভুল পয়সাটা দিয়ে ফেলেছি। যেটা দিয়েছি, ওটা রাজাদের জন্য, বুঝেছ? আমার আসলে ওটা বাতাস থেকে তোলারও কথা ছিল না। ওটা পাওয়ার কথা ছিল আমেরিকার রাজার…তোমার আমার মতো চাষার না। এখন ঝামেলায় পড়েছি! শ্যাডো, আমাকে ফিরিয়ে দাও পয়সাটা। যদি দাও, তাহলে আর কখনও আমার এই চেহারা দর্শন করতে হবে না তোমাকে। ঠিক আছে? ব্রানের কসম খেয়ে বলছি।’ 

‘কার কথা শুনে কী করেছ, সুইনি?’ 

‘গ্রিমনিরের, তুমি যাকে ওয়েনসডে নামে চেন। ওর আসল পরিচয় জানা আছে?’ 

‘হ্যাঁ…তা আছে।’ 

আইরিশ লোকটার উন্মাদনাপূর্ণ চোখে এখন ভয়ের ছায়া। ‘খারাপ কিছু করতে বলেনি। নির্দিষ্ট একটা সময়ে নির্দিষ্ট একটা বারে উপস্থিত থেকে তোমার সাথে মারামারি করতে বলেছে। তুমি আসলে কতটা যোগ্য, সেটাই নাকি পরখ করে দেখতে চেয়েছিল।’ 

‘আর কিছু করতে বলেছে?’ 

আবারও কেঁপে উঠল সুইনি। শ্যাডোর মনে হলো, ভয়ের কাঁপুনি ওটা। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারল, ব্যাপারটা তা না। যেভাবে কেঁপে উঠেছে লোকটা, তা কেবল মাদকাসক্ত কেউ মাদকের অভাবেই কাঁপে! সুইনিও তাই, ওর দেহ কিছু একটা চাচ্ছে। হয়তো হেরোইন! সিগারেটের জ্বলন্ত অংশটুকু ফেলে দিল লোকটা, বাকিটুকু ভরে নিলো পকেটে। হাত দুটো ঘষে ঘষে গরম করার প্রয়াস পেল। সুইনির কণ্ঠ এখন আকুতিতে পরিণত হয়েছে। ‘শোনো, আমাকে শুধু পয়সাটা ফিরিয়ে দাও। আরেকটা দেব, দরকার হলে আরও কয়েকশটা!’ 

বেসবল ক্যাপটা মাথা থেকে খুলে নিলো সুইনি। আগের মতো খেলা দেখার ভঙ্গিতে বাতাস থেকে সোনার পয়সা তুলে নিয়ে ভরল ক্যাপটা। সোনা ভরতি ক্যাপ পরক্ষণেই এগিয়ে দিল শ্যাডোর দিকে। ‘সব তোমার। শুধু আমাকে আমার পয়সাটা ফিরিয়ে দাও।’ এগিয়ে দেওয়া টুপিটার ভেতরে উঁকি দিল শ্যাডো, কত টাকার সোনা আছে ওতে-ভাবল একবার। 

‘সোনা খরচ করার জায়গা কোথায়?’ জানতে চাইল শ্যাডো। ‘কোথায় এই সোনাকে নগদে পরিণত করা যাবে?’ 

ওর মনে হলো, আইরিশ লোকটা বুঝি ওকে আঘাত করে বসবে। কিন্তু না, নিজেকে সামলে নিলো পাগলা সুইনি। উলটো চোখ ভরে উঠল পানিতে। মাথায় আবার চড়াল ক্যাপটা, এখন খালি! ‘দিতেই হবে তোমাকে, কাজটা কীভাবে করতে হয় তা তো শিখিয়েই দিয়েছি! দাও না, প্লিজ। ওটা আসলে আমার ছিল না!’ 

‘আমার কাছে পয়সাটা নেই।’ 

বন্ধ হয়ে গেল ম্যাড সুইনির কান্না। তুই…হারামজাদা…’ কী যেন বলতে চাইল সে। কিন্তু মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বেরোল না। 

‘সত্যি কথাটাই বলছি,’ বলল শ্যাডো। ‘দুঃখিত, থাকলে দিয়ে দিতাম।’ 

সুইনির তৈলাক্ত হাতগুলো শ্যাডোর কাঁধ আঁকড়ে ধরল, নীল চোখ রাখল শ্যাডোর চোখে। বেচারার চেহারায় কান্নার দাগ পড়ে গেছে। ‘বাল,’ বলল সে। ওর মুখ থেকে ভেসে আসা তামাক আর হুইস্কির গন্ধ পেল শ্যাডো। ‘তুমি দেখি সত্যি কথাটাই বলছ। স্বেচ্ছায় আরেকজনকে দিয়ে দিয়েছ পয়সাটা!’ 

‘আমি দুঃখিত।’ 

‘দুঃখিত হলেই বা আমার কী লাভ?’ শার্টের হাতায় নাক-চোখ মুছল সুইনি। এমনিতেই কাদা লেগে থাকা চেহারাটা আরও কুৎসিত দেখাল। সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে তার হাতে চাপ দিল শ্যাডো। 

‘এরচেয়ে কখনও জন্ম না নিলেই ভালো হতো।’ বলল পাগলা সুইনি। ‘আচ্ছা, যে লোকটাকে দিয়েছ, সে চাইলে ফেরত দেবে না?’ 

‘এক মেয়েকে দিয়েছি। এখন সে কোথায় আছে, তা-ও জানি না। তবে মনে হয় না দেবে। 

দুঃখের সাথে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুইনি। ‘যখন বয়স কম ছিল, তখন এক মহিলার সাথে তারার আলোয় দেখা হতো। তার দুধ নিয়ে খেলতাম, আর আমার ভাগ্য পড়ে শোনাত সে। বলেছিল, সূর্যাস্তেরও পশ্চিমে হবে আমার ধ্বংস। আর তা-ও হবে এক মৃতা মেয়ের হাতে! হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম সেদিন। মদ খেতে খেতে চুমু বসিয়ে দিয়েছিলাম মহিলার ঠোঁটে। দিন ছিল বটে ওগুলো, তখন সাধু- সন্তরা আমাদের দেশে পা রাখেনি। আর এখন…’ বলতে বলতেই থেমে গেল সে। শ্যাডোকে সাবধান করে দেবার ভঙ্গিতে বলল, ‘তোমার ওকে বিশ্বাস করা উচিত না।’ 

‘কাকে?’ 

‘ওয়েনসডেকে। তোমার ওকে বিশ্বাস করা উচিত না।’ 

‘আমি ওকে বিশ্বাস করি না, ওর হয়ে কাজ করি।’ 

‘মনে আছে খেলাটার কথা?’ 

‘কী?’ শ্যাডোর মনে হচ্ছে, একসাথে যেন আধ-ডজন ভিন্ন ভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলছে ও। লেপ্রিকন লোকটা একেক বার একেক মনস্তত্ত্ব ধারণ করছে! 

‘পয়সা, পয়সার খেলার কথা বলছি।’ দুইটা আঙুল চেহারার সামনে তুলে ধরল সে, ওগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মুখ থেকে বের করে আনল একটা সোনার পয়সা। শ্যাডোর দিকে ওটাকে ছুড়ে দিল সে, ধরার জন্য হাত বাড়াল শ্যাডো। কিন্তু পেল না কিছুই! 

‘মাতাল ছিলাম,’ জানাল শ্যাডো। ‘কিছুই মনে নেই।’ 

রাস্তা দিয়ে টলতে টলতে এগোল সুইনি। সূর্য উঠেছে, দুনিয়া এখন সাদা আর ধূসর। শ্যাডো পিছু নিলো ওর। ব্রিজের কাছাকাছি পৌঁছে এক হাত দিয়ে ওটার দেয়াল আঁকড়ে ধরল সুইনি। ‘কয়েকটা টাকা দিতে পারবে?’ জানতে চাইল সে। ‘খুব বেশি লাগবে না। এখান থেকে বিদায় নেবার মতো হলেই হবে। এই ধরো, বিশ ডলার। আছে?’ 

‘বিশ ডলারে কোথায় যাবার বাস টিকেট পাবে?’ জানতে চাইল শ্যাডো। 

‘এখান থেকে বিদায় নিতে পারব।’ বলল সুইনি। ‘ঝড় আসার আগেই পালাতে চাই। পালাতে চাই এমন এক দুনিয়া থেকে, যেখানে মানুষ আফিমের মাঝে ধর্মকে খুঁজে পায়। পালাতে চাই…’ থেমে গেল আচমকা, নাক মুছল হাত দিয়ে। 

জিন্সের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা বিশ ডলারের নোট বের করে আনল শ্যাডো, এগিয়ে দিল আইরিশ লোকটার দিকে। ‘এই নাও।’ 

নোটটা হাতে নিয়েই দলা-পাকাল সুইনি। এরপর তেলের দাগ পড়া ডেনিম জ্যাকেটের পকেটে ঢোকাল। মাথা নেড়ে বলল, ‘এতেই চলবে।’ 

দেয়ালে হেলান দিয়ে পকেট হাতড়াল সুইনি, একটু আগে গুঁজে রাখা সিগারেটের অংশটুকু বের করে এনে আগুন ধরাল তাতে। ‘তোমাকে একটা কথা বলি,’ এমনভাবে বলল যেন শ্যাডোর সাথে সেদিন প্রথম কথা হচ্ছে! ‘ফাঁসি- কাষ্ঠের দিকে এগোচ্ছ তুমি, গলায় যে দড়ি সেঁটে আছে তা বুঝতেও পারছ না। তোমার দুই কাঁধেই বসে আছে দুটো দাঁড়কাক, চোখগুলো খুবলে খাবার অপেক্ষায়। দুনিয়া থেকে নরক পর্যন্ত বিস্তৃত গাছটার ডালে ঝুলতে হবে তোমাকে।’ থেমে গেল লোকটা। ‘আমি কিছুক্ষণ এখানেই বিশ্রাম নেব।’ বলে বসে পড়ল দেয়াল ঘেঁষে। 

‘তোমার সৌভাগ্য কামনা করছি।’ বলল শ্যাডো। 

‘আমার আবার সৌভাগ্য,’ বলল পাগলা সুইনি। ‘যাক গে, ধন্যবাদ।’ 

বাড়ি ফেরার পথ ধরল শ্যাডো। এখন সকাল আটটা বাজে, কায়রো আস্তে আস্তে জেগে উঠতে শুরু করেছে। ব্রিজের দিকে একবার ফিরে তাকাল ও, সুইনি ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। 

সেই ছিল জীবিত পাগলা সুইনিকে ওর শেষ দেখা।

.

ক্রিসমাসের আগের ছোটো ছোটো শীতের দিনগুলো যেন অন্ধকারের মাঝে এক টুকরা আলো। মৃতদের ঘরটায় সময়টুকু যেন চোখের পলকেই কেটে যায়! 

ডিসেম্বর মাসের তেইশ তারিখে জ্যাকুয়েল আর আইবিস লিলা গুডচাইল্ডের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করল। দলে দলে মহিলারা এসে ভিড় জমাল ফিউনারেল পার্লারে। মৃতকে রাখা হয়েছিল সামনের ঘরে, ফুলে আবৃত হয়ে শুয়ে ছিলেন তিনি। ঘরটার উলটো পাশে রয়েছে খাবার-ভরতি আরেকটা টেবিল। মধ্য- বিকালে দেখা গেল, যাজকের সাথে হাত মেলাতে উপস্থিত হয়েছে আরও অনেকে। পুরো ব্যাপারটা দক্ষতার সাথে সামলাল জ্যাকুয়েল আর আইবিস। পরেরদিন কবর দেওয়া হবে মিসেস লিলাকে। 

হলঘরের ফোনটা বেজে উঠলে, সেদিকে এগিয়ে গেল মি. আইবিস। কথা বলে সে শ্যাডোকে টেনে নিয়ে এলো আরেকদিকে। ‘পুলিস ফোন করেছিল।’ বলল সে। ‘লাশ আনতে যেতে পারবে?’ 

‘অবশ্যই।’ 

‘কারও দৃষ্টি আকর্ষণ কোরো না আবার।’ একটা কাগজে ঠিকানা লিখল সে। একবার ঠিকানাটা পড়ে নিয়ে পকেটে কাগজ ঢুকিয়ে রাখল শ্যাডো। ‘পুলিসের গাড়ি তোমার জন্য অপেক্ষা করবে ওখানেই।’ বলল আইবিস। 

পার্লারের পেছন দিকে গিয়ে হার্সটা বের করে আনল শ্যাডো। আলাদা আলাদা করে মি. জ্যাকুয়েল আর মি. আইবিস, দুজনই ওকে বুঝিয়েছে, হার্সটা যেকোনো কাজে ব্যবহার করাটা ঠিক হবে না। লাশ নিয়ে আসার জন্য ভ্যানটা কাজে লাগাতে হবে। তবে এই মুহূর্তে ওটা গ্যারেজে, নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। ঠিক হতে আরও তিন সপ্তাহ লাগবে, তাই এই সময়ের মাঝে হার্সটা ব্যবহার করলে যেন সাবধানে করে। 

রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে গাড়িটা, বরফ সরিয়ে ফেলা হয়েছে এতক্ষণে। চাইলেই আরও জোরে চালাতে পারে শ্যাডো, কিন্তু তা না করে কমিয়েই রাখল গতি। কেন যেন এই গাড়িটার সাথে দ্রুতগতি মানায় না। আমেরিকার রাস্তা থেকে মৃত্যু বিদায় নিয়েছে, ভাবল শ্যাডো। মৃত্যু এখন হাসপাতাল আর অ্যাম্বুলেন্সে রাজত্ব করে। 

একটা পার্শ্ব রাস্তায় দেখতে পেল ও নীল পুলিস গাড়িটাকে, হার্স ওটার পেছনেই পার্ক করল শ্যাডো। গাড়ির ভেতরে দুই জন অফিসার বসে আছে, ফ্লাস্কে চুমুক দিয়ে পান করছে গরম চা। উষ্ণতা বজায় রাখার জন্য চালু রেখেছে গাড়ির ইঞ্জিন। এগিয়ে গিয়ে ওটার জানালায় নক করল শ্যাডো। 

‘কী?’ 

‘আমি ফিউনারেল হোম থেকে এসেছি।’ জানাল শ্যাডো। 

‘আমরা মেডিকেল এক্সামিনারের জন্য অপেক্ষা করছি।’ 

এই লোকটাই কি আমাকে থামিয়েছিল ব্রিজের নিচে? ভাবল শ্যাডো। দুই পুলিসের একজন বেরিয়ে এলো বাইরে, অন্যজন হুইলের পেছনেই বসে রইল। প্রথম পুলিস, একজন নিগ্রো, ওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলো একটা আস্তাকুঁড়ের পেছনে। পাগলা সুইনি বসে আছে ওটাতে হেলান দিয়ে, কোলে একটা খালি সবুজ বোতল নিয়ে। ওর ক্যাপ, কাঁধ আর চেহারা ঢেকে আছে বরফে। পাতা ফেলাচ্ছে না আইরিশ লোকটা। 

‘মাতাল ভবঘুরে। মরে ভূত,’ বলল পুলিস। 

‘দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।’ 

‘কিছু স্পর্শ করো না।’ পুলিস অফিসার জানাল। ‘মেডিকেল এক্সামিনার যেকোনো সময় চলে আসবে। আমার মনে হয় মাতাল হয়ে এখানেই পড়ে ছিল, বরফে জমে মারা গেছে।’ 

‘দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।’ একমত হয়ে আবারও একই কথা বলল শ্যাডো। 

নিচু হয়ে পাগলা সুইনির হাতে ধরা বোতলটা পরখ করে দেখল ও। কম দামি জেমসন আইরিশ হুইস্কি-কায়রো থেকে পালানোর জন্য বিশ ডলারের টিকিট! ঠিক সেই মুহূর্তে একটা ছোটো, সবুজ নিসান গাড়ি এসে থামল আস্তাকুঁড়ের পাশে। মাঝবয়সি এক ঝাঁটার মতো গোঁফঅলা লোক বেরিয়ে এলো ওটা থেকে। লাশটার গলা স্পর্শ করল লোকটা। 

‘মারা গেছে,’ বলল মেডিকেল এক্সামিনার। ‘পরিচয়পত্র আছে সঙ্গে?’

‘নাহ, অজ্ঞাত,’ জানাল পুলিস। 

শ্যাডোর দিকে তাকাল এক্সামিনার। ‘তুমি জ্যাকুয়েল আর আইবিসের হয়ে কাজ করছ?’ জানতে চাইল সে। 

‘হ্যাঁ।’ 

‘তাহলে জ্যাকুয়েলকে বোলো, এর ডেন্টাল রেকর্ড আর ছবি যেন পরিচিতির জন্য পাঠায়। আর কেবল রক্ত টানলেই হবে, টক্সিকোলজির জন্য। বুঝেছ? না লিখে দেব?’ 

‘লাগবে না।’ জানাল শ্যাডো। ‘মনে থাকবে।’ 

ভ্রু কুঁচকে পকেট থেকে একটা বিজনেস কার্ড বের করল লোকটা। পেছনে কী সব লিখে এগিয়ে দিল শ্যাডোর দিকে। ‘এটা জ্যাকুয়েলকে দিয়ো। সবাইকে ক্রিসমাসের শুভকামনা,’ বলে বিদায় নিলো সে, অফিসার দুজন রেখে দিল সবুজ বোতলটা। 

‘অজ্ঞাতনামা’-র জন্য কাগজে সই করল শ্যাডো, এরপর লাশটাকে গার্নিতে শোয়াবার প্রয়াস পেল। জমে গেছে আইরিশ লোকটার দেহ, বসা থেকে অনেক চেষ্টা করেও শোয়াতে পারল না লাশটা। সেভাবেই হার্সের পেছনে বসিয়ে দিল ওটাকে। এরপর রওনা দিল ফিউনারেল পার্লারের দিকে। 

পথে লাল বাতি পড়লে থামল হার্স। ঠিক সেই সময়ই ও শুনতে পেল একটা কণ্ঠ। ‘একটা দারুণ অনুষ্ঠান চাই আমার। সবকিছু যেন সেরা হয়, সুন্দরী সব মেয়ে এসে কান্নাকাটি করে। আর সাহসী পুরুষেরা আমার গল্প শোনায়।’ 

‘তুমি মৃত, পাগলা সুইনি।’ বলল শ্যাডো। ‘মৃতের আবার চাহিদা কী?’

‘তা ঠিক। হার্সের পেছনে বসে থাকা মৃত লাশটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মাতলামি উধাও হয়েছে কণ্ঠ থেকে। মনে হচ্ছে যেন সেই সুদূর থেকে ভেসে আসছে ওর কণ্ঠ। 

সবুজ বাতি জ্বলে উঠলে আবার এগোতে শুরু করল হার্স। 

‘তবে একটা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করো কিন্তু।’ বলল পাগলা সুইনি। ‘আজরাতেই করো, তেমন দামি কিছু লাগবে না। হাজার হলেও, আমাকে তুমিই খুন করেছ!’ 

‘আমি তোমাকে হত্যা করিনি, ম্যাড সুইনি।’ বলল শ্যাডো। ‘মাতাল হয়ে নিজেকে নিজেই খুন করেছ।’ 

উত্তর এলো না কোনো, বাকি সময়টা নিস্তব্ধতার মাঝেই কেটে গেল। হার্স বাড়ির পেছনে পার্ক করে চলে এলো মর্গে। এমনভাবে পাগল সুইনিকে টেবিলের ওপরে শোয়াল, যেন কোন গোরুর মাংসের টুকরো ছুড়ে দিচ্ছে! 

অজ্ঞাতনামাকে একটা শিট দিয়ে ঢেকে দিল ও, এরপর কাগজপত্রগুলো পাশে রেখে দিয়ে চলে এলো ওপরে। পেছন থেকে ভেসে এলো একটা কণ্ঠ, ‘মদ বা ঠান্ডা কীভাবে লেপ্রিকনকে খুন করে? নাহ, শ্যাডো। তোমার ওই পয়সা আরেকজনকে বিলিয়ে দেওয়াই আমার মৃত্যুর কারণ।’ 

কিছু একটা বলতে চাইছিল শ্যাডো, কিন্তু মৃতের সাথে ঝগড়া চলে না! 

দালানের মুল অংশের দিকে এগিয়ে গেল ও, এখনও কয়েকজন মাঝবয়সি মহিলা অপেক্ষা করছে ওখানে। মি. গুডচাইল্ড, মৃতার স্বামী, মি. আইবিসকে একটা দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরে জানাচ্ছে-সন্তানরা যে আসবে না তা ভালো করেই জানা ছিল তার। ওই যে, বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়! 

সেদিন সন্ধ্যায় শ্যাডো আরেকটা চেয়ার বসালো টেবিলে। প্রত্যেকটা চেয়ারের সামনে রাখল একটা করে গ্লাস, ঠিক মাঝখানে রইল এক বোতল জেমসন গোল্ড। দোকানে এর চাইতে দামি আর কোনো আইরিশ হুইস্কির বোতল পাওয়া যায়নি। রাতের খাবার শেষ হবার পর, প্রতি গ্লাসে অনেকটা করে মদ ঢালল শ্যাডো… 

…ওর, আইবিসের, জ্যাকুয়েলের আর পাগলা সুইনির গ্লাসে। 

‘হয়তো সেলারের একটা গার্নিতে শুয়ে আছে লোকটা,’ বলল শ্যাডো। ‘হয়তো কপালে জুটবে এক গরীব মানুষের কবর। আজ ওকে আমরা স্মরণ করব, অনুষ্ঠান পালন করব।’ 

খালি চেয়ারটা লক্ষ্য করে গ্লাস তুলল শ্যাডো। ‘আমি জীবিত সুইনিকে দেখেছি মাত্র দুইবার।’ বলল সে। ‘প্রথমবার মনে হয়েছিল, লোকটা আসলে বিশ্বমানের হারামজাদা। দ্বিতীয়বার ওকে দেখেছিলাম যখন, তখন বেচারার অবস্থা খুব খারাপ। বলতে গেলে, ওর মৃত্যুর জন্য কেনা বোতলটার দাম আমার পকেট থেকেই এসেছে। নিজেকে দাবি করত ও লেপ্রিকন বলে। শান্তিতে থাকো, পাগলা সুইনি।’ গ্লাসে চুমুক দিল ও, স্বাদটা সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ার সময় দিল। পান করল অন্য দুজনও। 

জ্যাকেটের ভেতরের পকেট থেকে একটা নোটবুক বের করে আনল আইবিস। ওটার একটা নির্দিষ্ট পাতা খুলে পড়ে শোনাল পাগলা সুইনির জীবনের গল্প। 

মি. আইবিসের মতে, পাগলা সুইনির জীবন শুরু হয়েছিল একটা ছোটো আইরিশ বন্যভূমির রক্ষক হিসেবে, তা-ও প্রায় তিন হাজার বছর আগে। পাগলা সুইনির প্রেম কাহিনি, তার শত্রুদের কথা, মিত্রদের গল্প—সব জানাল। প্ৰথম প্ৰথম সম্মান আর উপাসনা পেত সে আয়ারল্যান্ডের অধিবাসীদের কাছ থেকে। ধীরে ধীরে তা পরিণত হলো হাসি-ঠাট্টায়! ব্যানট্রি থেকে নিউ ইয়র্কে আসা এক মেয়ে সাথে করে নিয়ে এসেছিল পাগলা সুইনিকে। 

সেরাতে রান্নাঘরের টেবিলে বসে এসব গল্পের পাশাপাশি আরও অনেক কিছু ওকে শোনাল মি. আইবিস। দেয়ালে পড়া ওর ছায়াটা দেখে সারসের কথা মনে পড়ে গেল শ্যাডোর। দ্বিতীয় গ্লাস শেষ হবার একটু আগে পাগলা সুইনি নিজেই শুরু করে দিল আইবিসের গল্পে নাক গলানো। কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেল, সুইনি হাত নাড়িয়ে আয়ারল্যান্ডে দেবতাদের কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে! চার্চ এসে এই দেবতাদেরকে পরিণত করল ট্রল, ফেয়ারি, মৃত রাজা অথবা সন্তে। মি. জ্যাকুয়েল দাঁতে দাঁত চাপতে শুরু করলে পর, চুপ করল সে। 

‘পয়সার খেলাটার কথা মনে আছে তো?’ শ্যাডোর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে জানতে চাইল সে। 

‘নাহ, নেই।’ 

‘আন্দাজও নেই, কীভাবে করলাম?’ পাগলা সুইনি জানতে চাইল। ওর ঠোঁট বেগুনি হয়ে গেছে, নীল চোখগুলো ঘোলাটে। 

‘হাতের ভেলকি?’ জানতে চাইল শ্যাডো। 

‘না।’ 

‘কোনো ধরনের যন্ত্র? হাতায় লুকিয়ে রেখেছিলে, এমন কিছু?’ 

‘নাহ, তা-ও না। আর কারও হুইস্কি লাগবে?’ 

‘একটা বইতে পড়েছিলাম, কৃত্রিম কিছু থলে বানানো হয়। ওটার রং একদম মানুষের হাতের মতো। তাই ভেতরে থাকা পয়সা ধরা যায় না।’ 

‘মহান সুইনির শেষকৃত্যানুষ্ঠান এটা, যিনি আয়ারল্যান্ড জুড়ে উড়তেন পাখির মতো। অথচ আজ বেচারার জন্য চোখের পানি ফেলছে কেবল একটা পাখি, এক কুকুর আর এক গর্দভ। নাহ, থলে-টলের মামলা নেই।’ 

‘আমার মাথায় তো আর কিছু আসছে না।’ বলল শ্যাডো। ‘হাওয়া থেকে নিশ্চয়ই পয়দা করো না!’ কথাটা বলা মাত্র অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখা গেল সুইনির চেহারায়। ‘কী! হাওয়া থেকে তুলে নাও?’ 

‘ঠিক হাওয়া থেকে না।’ বলল পাগলা সুইনি। ‘তবে সঠিক পথে চিন্তা করতে শুরু করেছ। গুপ্ত ভাণ্ডার থেকে নেই।’ 

‘গুপ্ত ভাণ্ডার।’ বলল শ্যাডো। ‘ওহ, আচ্ছা।’ 

‘ওটাকে কেবল নিজের মনের মধ্যে স্থাপন করে নিতে হবে। তারপর হাত বাড়ালেই পাবে।’ 

শ্যাডোকে পদ্ধতিটা দেখাল ও। 

এবার ধরতে পারল শ্যাডো। 

.

তীব্র মাথাব্যথায় চোখ খুলতে পর্যন্ত কষ্ট হচ্ছে শ্যাডোর, মুখের ভেতরটা মনে হচ্ছে যেন বালি দিয়ে তৈরি। চোখ পিটপিট করে সূর্যের দিকে তাকাল ও। রান্নাঘরের টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। পরনে রাতের পোশাকটাই, কেবল টাইটা খুলেছে। 

সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায় নামল ও, মর্গে এসে অজ্ঞাতনামা লাশটাকে ওখানেই দেখতে পেয়ে ফেলল স্বস্তির নিশ্বাস। ওপরে কার যেন হাঁটা-চলা করার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ওপরে ফিরে এসে দেখে, মি. ওয়েনসডে রান্নাঘরের টেবিলে বসে আছেন। রাতের বেঁচে যাওয়া খাবার খাচ্ছেন তিনি। পরনে একটা ধূসর স্যুট, সাদা শার্ট আর ধূসর টাই। সকালের আলো পড়ে ঝিকঝিক করে উঠছে গাছের আকৃতির টাইপিন। শ্যাডোকে দেখে হাসলেন তিনি। 

‘আহ, শ্যাডো, বাছা আমার। তুমি জেগে আছ দেখে ভালো লাগছে। ভেবেছিলাম ঘুম আর ভাঙবেই না!’ 

‘পাগলা সুইনি মারা গেছে।’ বলল শ্যাডো। 

‘শুনেছি,’ বললেন ওয়েনসডে। দুঃখের খবর। তবে শেষ পর্যন্ত মরতে হবে আমাদের সবাইকে।’ কাল্পনিক একটা দড়ি ধরলেন তিনি, ভান করলেন যেন চোখ বেরিয়ে আসবে সকেট থেকে; জিহ্বা বেরিয়ে এসেছে। ‘নাস্তা খাবে?’ হাতের খাবারটুকু এগিয়ে ধরলেন লোকটি। 

‘নাহ, দরকার নেই। হলের দিকে একনজর তাকাল শ্যাডো। ‘আইবিস আর জ্যাকুয়েলকে দেখেছেন?’ 

‘দেখেছি। ওরা মিসেস লিলা গুডচাইল্ড না কাকে যেন কবর দিতে গেছে। তোমার সাহায্য পেলে খুশি হতো, তবে আমি ওদেরকে জানালাম-আজ লম্বা সময় গাড়ি চালাতে হবে তোমাকে। তাই পারবে না।’ 

‘আমরা বেরোচ্ছি?’ 

‘এক ঘণ্টার মাঝে।’ 

‘ওদেরকে বিদায় জানালে পারলে ভালো হতো।’ 

‘ওসব বিদায়-টিদায় বাজে কথা। আবার দেখা হবে তোমাদের, এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই!’ 

সেই প্রথম রাতের পর, এই প্রথমবারের মতো বাদামি বিড়ালটাকে দেখতে পেল শ্যাডো। বাদামি চোখজোড়া দিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে ওটা। 

বিনা বাক্যব্যয়ে ফিউনারেল পার্লার থেকে বিদায় নিলো শ্যাডো। ঝোপঝাড়গুলো এখনও বরফে ছাওয়া। পথটাও পিচ্ছিল। 

পথ দেখিয়ে রাস্তায় পার্ক করে রাখা একটা সাদা শেভি নোভার কাছে শ্যাডোকে নিয়ে গেলেন ওয়েনসড়ে। সদ্য পরিষ্কার করা হয়েছে গাড়িটাকে, উইসকনসিনের নম্বর প্লেট সরিয়ে লাগানো হয়েছে মিনেসোটার প্লেট। পিছনের সিটটা ওয়েনসডের বাক্স-পেটরা দিয়ে ভরতি। বাড়তি চাবি দিয়ে দরজা খুললেন তিনি। 

‘আমি চালাচ্ছি,’ বললেন ওয়েনসডে। ‘এক ঘণ্টার আগে তুমি কিছুই করতে পারবে বলে মনে হয় না।’ 

উত্তর দিকে এগোল ওরা, মিসিসিপিকে বাঁ দিকে রেখে। 

শ্যাডো বুঝতে পারল, ফিউনারেল পার্লারে খুব অল্প কিছু সময়ের জন্য থাকতে পেরেছে ও। কিন্তু কেন জানি এখনই মনে হচ্ছে, অনেক অনেক দিন আগের কোনো ঘটনা ওটা। 

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন