আমেরিকান গডস – ৫

নিল গেইম্যান

অধ্যায় পাঁচ 

মেয়েটার জীবন যেন এক প্রস্ফুটিত ফুল,
মৃত্যু ছাড়েনি পিছু, করবে নাকো ভুল;
সে নিজ দেহে বন্দী এক প্ৰাণ, 
স্বর্গে বসে মৃত্যু খেলা করে নিয়ে জান। 

–ডব্লিউ. ই. হেনলি: ম্যাডামস লাইফ’স আ পিস ইন ব্লুম 

.

একমাত্র যরিয়া উত্রেনেয়া জেগে ছিল শনিবার সকালে। শ্যাডোদেরকেও বিদায় জানাল শুধু সে-ই। তবে তার আগে ওয়েনসডের কাছ থেকে গুণে গুণে পঁয়তাল্লিশ ডলার নিতে ভুল করল না। সকালের আলোতে পুতুলের মতো লাগছে তাকে, বয়স্ক চেহারাটায় মেকআপ দেওয়ার জন্যই হয়তো! সোনালি চুলগুলো মাথার ওপর বেণি করা। 

মহিলার হাতে চুমু খেলেন ওয়েনসডে। ‘আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ,’ বললেন তিনি। ‘আশা করি তুমি আর তোমার বোনেরা আকাশকে বরাবরের মতো উজ্জ্বল রাখবে। 

‘তুমি লোকটা একদম ভালো না,’ বলল মহিলা। তারপর আচমকা জড়িয়ে ধরল তাকে। ‘সাবধানে থেকো। তোমাকে চিরতরে হারাতে চাই না। কষ্ট পাবো।’ 

‘আমিও পাবো।’ 

শ্যাডোর সাথে হাত মেলাল যরিয়া। ‘যরিয়া পলুনোচনেয়া তোমার খুব প্রশংসা করল।’ 

‘ডিনারের জন্য ধন্যবাদ।’ বলল শ্যাডো। 

এক ভ্রু উঁচু করে ওর দিকে তাকাল উত্রেনেয়া। ‘তোমার ভালো লেগেছে? তাহলে তো আবার আসতেই হবে বেড়াতে।’ 

ওয়েনসডেকে সাথে নিয়ে শ্যাডো নিচে নামল। জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢোকাল সে, রুপালি লিবার্টির চেহারা মুদ্রিত ডলারটা এখনও ঠান্ডা মনে হচ্ছে। এর আগে এমন ভারী আর বড়ো পয়সা দেখেনি ও। 

‘আহ, লেডি লিবার্টি,’ ওকে পয়সা নিয়ে খেলতে দেখে বললেন ওয়েনসডে। ‘দারুণ, তাই না?’ 

উত্তর দিল না শ্যাডো, পকেটে ঢুকিয়ে রাখল পয়সাটাকে। 

‘লেডি লিবার্টি,’ বলেই চলছেন ওয়েনসডে। ‘জানো, আমেরিকাবাসীর পছন্দের আরও অনেক দেবতার মতোই, তিনিও বিদেশি? এই মহিলার জন্ম ফ্রান্সে। তবে আমেরিকানদের মানসিকতার কথা চিন্তা করে ফ্রেঞ্চরা মহিলার বিশাল দুধ দুটো ঢেকে-ঢুকে পাঠিয়েছে।’ সিঁড়ির একেবারে নিচের ধাপে ব্যবহৃত কনডমের প্যাকেট দেখে নাক কুঁচকালেন তিনি। ‘ওটার উপর পা পড়লে যে কেউ পিছল খাবে…এমনকি ঘাড়ও ভেঙে যেতে পারে। বিড়বিড় করে যেন নিজেকেই বললেন তিনি। এরপর দরজা খুলে পা রাখলেন সূর্যালোকে। ‘লিবার্টি হচ্ছে এমন এক মহিলা, যার সাথে শুতে হয় লাশের পাহাড়ের ওপরে।’ 

‘মানে?’ অবাক হয়ে জানতে চাইল শ্যাডো। 

‘এক ফ্রেঞ্চ লোকের মন্তব্য শোনালাম তোমাকে।’ বললেন ওয়েনসডে। ‘ নিউ ইয়র্কের পোতাশ্রয়ে যে মূর্তিটা আছে, তার ক্ষেত্রেও খাটে কথাটা। ওই মহিলা এমন একজন, যে পিঠের নিচে শাস্তির যন্ত্রের স্পর্শ না পেলে শুতেই চায় না! হাতের মশাল যতই উঁচু করে ধরো না কেন প্রিয়, ইঁদুর ঠিক তোমার পোশাকের নিচে আশ্রয় নেয়। তোমার দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে এখনও ঝরে পড়ে রস। দরজা খুলে শ্যাডোকে প্যাসেঞ্জার সিটে বসার ইঙ্গিত দিলেন তিনি। 

‘আমার তো তাকে বেশ সুদর্শনা বলে মনে হয়।’ পয়সাটা চোখের কাছে এনে বলল শ্যাডো। লিবার্টির চেহারা ওকে যরিয়া পলুনোচনেয়ার কথা মনে করিয়ে দিল। 

‘ওটাই তো…’ গাড়ি চালাতে চালাতে বললেন ওয়েনসডে। ‘…পুরুষ মানুষের আজন্ম পাপ। নরম মাংসের পেছনে ছোটে তারা, অথচ ওই মাংস হাড়ের আবরণ ছাড়া আর কিছু না, পোকা-মাকড়ের খাদ্য। মেয়েদের সাথে রাত কাটানো আসলে উষ্ণ খাবারের সাথে গা-ঘষা মাত্র!’ 

ওয়েনসডেকে আগে এত কথা বলতে দেখেনি শ্যাডো। আমার নতুন বস, ভাবল সে, অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর হঠাৎ করেই হড়বড়িয়ে কথা বলা শুরু করে। ‘আপনি আমেরিকান নন?’ 

‘প্রকৃতপক্ষে,’ বললেন ওয়েনসডে। ‘কেউ-ই আমেরিকান নয়। সেটাই তো বলতে চাচ্ছি।’ ঘড়ি দেখলেন তিনি। ‘ব্যাংক বন্ধ হবার এখনও কয়েক ঘণ্টা দেরি আছে। ভালো কথা, চেরনোবোগের ব্যাপারটা বেশ ভালোভাবেই সামলেছ তুমি। আমি অবশ্য ওকে পটাতে পারতাম। কিন্তু এখন যেরকম আগ্রহ নিয়ে সে রাজি হয়েছে, তখন হতো না।’ 

‘আগ্রহের কারণটা ভেবে দেখুন—এসব শেষ হলে ও আমাকে খুন করতে পারবে!’ 

‘তেমনটা না-ও হতে পারে। নিজেই তো বললে, লোকটার বয়স হয়েছে। এক আঘাতে সে কাজ সারতে পারবে না হয়তো। কে জানে, হয়তো তুমি বাকি জীবনটা পঙ্গু হয়ে কাটিতে দেবে।’ 

চোখ তুলে লোকটার দিকে চাইল শ্যাডো। 

একটা ব্যাংকের পার্কিং লটে গাড়ি ঢোকালেন ওয়েনসডে। ‘এই ব্যাংকে ডাকাতি করব আমি। এখনও কয়েক ঘণ্টা খোলা থাকবে এটা। চলো, ভেতরে গিয়ে হ্যালো বলে আসি।’ 

লোকটার ইঙ্গিত পেয়ে, অনিচ্ছাসত্ত্বেও গাড়ি থেকে নামল শ্যাডো। ব্যাংক ডাকাতিটা বোকার মতো একটা কাজ হতে চলছে, আর তাই ক্যামেরায় নিজের চেহারা দেখাতে চায় না। কিন্তু কৌতূহল ওকে টেনে নিয়ে গেল ব্যাংকের ভেতরে। নজর মেঝের দিকে রাখল সে, কিছুক্ষণ পরপর নাক চুলকাচ্ছে। যতটা সম্ভব চেহারা গোপন রাখা আরকি! 

টাকা জমা দেবার ফর্মগুলো কোথায়, ম্যাম?’ এক মহিলা কর্মচারীর কাছে জানতে চাইলেন ওয়েনসডে। 

‘ওই যে, ওখানে।’ 

‘অনেক অনেক ধন্যবাদ। আর যদি রাতে, মানে ব্যাংক বন্ধ হবার পর জমা দিতে চাই, তাহলে কোন ফর্ম ব্যবহার করব?’ 

‘ফর্ম একই।’ ওয়েনসডের দিকে তাকিয়ে হাসল মেয়েটা। টাকা কোথায় জমা দিতে হবে তা জানেন তো? সদর দরজার দিয়ে বের হয়েই বাঁয়ে, দেয়ালের সাথে লাগানো আছে যন্ত্রটা।’ 

‘ধন্যবাদ।’ 

বেশ কয়েকটা ফর্ম তুলে নিলেন ওয়েনসডে। এরপর মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। 

ব্যাংকের পাশের ফুটপাতে একটু দাঁড়ালেন তিনি, দাড়ি চুলকাচ্ছেন। তারপর এটিএম মেশিন আর টাকা জমা দেবার যন্ত্রের পাশে দাঁড়িয়ে ভালো মতো দেখে নিলেন সবকিছু। শ্যাডোকে সাথে নিয়ে এরপর রাস্তা পার হয়ে চলে এলেন সুপারমার্কেটে। ওকে এক কাপ হট চকলেট কিনে দিয়ে নিজে নিলেন চকলেট ফাজ আইসক্রিম। ঢোকার পথেই একটা পে-ফোন রয়েছে, ওটার নিচে নানা ধরনের বিজ্ঞাপন সাঁটা বোর্ড। আরও একবার রাস্তা পার হলেন দুজন। ‘আমাদের দরকার,’ আচমকা বললেন ওয়েনসডে। ‘তুষার। বিরক্তিকর, তীব্র তুষারপাত। এক কাজ করো, মনে মনে তুষারপাত ভাবতে থাকো।’ 

‘হাহ?’ 

‘ওই যে পশ্চিমে, মেঘ দেখতে পাচ্ছ? ওগুলোকে মানসিক শক্তি খাটিয়ে বড়ো আর কালো করে তোল। ভাবো, ধূসর আকাশে আর্কটিক থেকে আসা বাতাস বইছে। ভাবো, তুষার নামছে ওই মেঘগুলো থেকে।’ 

‘তাতে লাভ হবে বলে মনে হয় না।’ 

‘বোকার মতো কথা বলো না। আর কিছু না হলেও, অন্তত তোমার মন তো ব্যস্ত থাকবে। গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বললেন প্রৌঢ়। ‘এবার কিনকোতে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি ভাবনা শুরু করো।’ 

তুষার, মনে মনে ভাবল শ্যাডো। প্যাসেঞ্জার সিটে বসে গরম চকলেট ভরা কাপে চুমুক দিচ্ছে থেকে থেকে। বড়ো বড়ো, পেঁজা তুলার মতো তুষার ঝরছে আকাশ থেকে। ধূসর আকাশে সাদা মেঘ, আলতো স্পর্শ করেই মিলিয়ে যাচ্ছে সেই তুষার। শীতের অনুভব ছড়িয়ে দিয়েই গলে যাচ্ছে। বারো ইঞ্চি পুরু তুষারে পুরো পৃথিবী যেন সেজেছে এক জাদুময়ী সাজে। দেখা যাচ্ছে সবই, কিন্তু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সুন্দর…অসাধারণ সুন্দর… 

ওয়েনসডের কথায় সম্বিত ফিরল ওর। 

‘শুনিনি আপনার কথা।’ বলল শ্যাডো। 

‘বললাম, এসে পরেছি। কোথায় হারিয়ে গেছিলে?’ 

‘তুষারের কথা ভাবছিলাম।’ 

কিনকোতে গিয়ে ব্যাংক থেকে আনা জমা দেওয়ার ফর্ম ফটোকপি করালেন ওয়েনসডে। সেই সাথে খান বিশেক বিজনেস কার্ডও প্রিন্ট করালেন। শ্যাডোর মাথাব্যথা করছিল, কেমন যেন এক অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছে দুই কাঁধের মাঝখানটায়। শোয়া ঠিক হয়নি বোধহয়, ভাবল ও। কে জানে, হয়তো গত রাতে সোফায় ঘুমাবার কারণে এখন মাথাব্যথা হচ্ছে। 

ওয়েনসডে কিন্তু বসে নেই। তিনি কম্পিউটারে কী যেন টাইপ করছেন। কাজ শেষ হলে দোকান কর্মচারীর সহায়তায় কয়েকটা বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা সাইন প্রিন্ট করালেন। 

তুষার, আবার ভাবতে শুরু করল শ্যাডো। আকাশের অনেক ওপরে, নিখুঁত, ধুলোর চাইতেও ছোটো ছোটো স্ফটিক তৈরি হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। এরপর একসাথে অনেকগুলো স্ফটিক জড়ো হয়ে ঝরে পড়ছে পৃথিবীর বুকে। শিকাগোর পুরোটাই সাদাটে চাদরে মোড়া যেন। ইঞ্চি ইঞ্চি করে জমছে… 

‘এই নাও,’ বলে শ্যাডোকে এক কাপ কফি এগিয়ে দিলেন ওয়েনসডে। ‘যথেষ্ট হয়েছে। কি বলো?’ 

‘কী যথেষ্ট হয়েছে?’ 

‘তুষারপাত। শহর যদি অকেজো হয়ে পড়ে, তাহলে আমাদের কাজ হবে কী করে?’ 

আকাশের দিকে তাকাল শ্যাডো, যুদ্ধতরীর মতো ধূসর হয়ে আছে ওটা। তুষারপাত শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই। 

‘আমি করেছি এসব?’ জানতে চাইল শ্যাডো। ‘মানে আমি ভেবে ভেবে তুষার নামিয়েছি?’ 

‘কফিটা শেষ করে ফেল।’ উত্তর দিলেন না ওয়েনসডে। ‘স্বাদ একদম বাজে। কিন্তু মাথাব্যথাটা কমবে।’ একটু থেমে যোগ করলেন তিনি। ভালো কাজ দেখালে। 

বিল পরিশোধ করে সবকিছু বুঝে নিলেন ওয়েনসডে। গাড়ির ট্রাঙ্ক খুলে সেগুলো ভরে নিলেন একটা বড়ো, কালো, ধাতব কেসে। সাধারণত টাকা-পয়সা বহন করা হয় ওসব বাক্সে। শ্যাডোর দিকে একটা বিজনেস কার্ড বাড়িয়ে দিলেন তিনি। 

‘এই,’ বলল শ্যাডো। ‘এ. হ্যাডকটা কে? এ-ওয়ান সিকিউরিটি সার্ভিসের ডিরেক্টর?’ 

‘তুমি।’

‘এ. হ্যাডক?’ 

‘হ্যাঁ।’ 

‘এ এর পুরোটা কী?’ 

‘আলফ্রেডো? আলফোন্স? অগাস্টিন? অ্যামব্রোস? তোমার যেটা ইচ্ছা।’

‘ওহ, বুঝতে পেরেছি।’ 

‘আমি জেমস ও’ গরম্যান।’ বললেন ওয়েনসডে। ‘বন্ধুরা আমাকে জিমি বলে ডাকে। আমার একটা কার্ডও আছে।’ 

গাড়িতে উঠে বসল ওরা দুজন। ওয়েনসডে বললেন, ‘যেভাবে তুষার নামালে, সেভাবে ‘এ. হ্যাডক’-কে নিয়ে চিন্তা করলে আমাদের ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। রাত নামার আগেই বড়োলোক হয়ে যাব!’ 

‘আমি জেলে ফেরত যেতে চাই না।’ 

‘নিশ্চয়তা দিচ্ছি, যেতে হবে না।’ 

‘আগেই বলেছিলাম, কোন বে-আইনি কাজে আমি নেই!’ 

‘তেমন কিছু করতেও হবে না। একটু সাহায্য করবে আমাকে, এই যা। বিশ্বাস করো, তোমার কেশাগ্রও কেউ স্পর্শ করতে পারবে না।’ 

‘তাই নাকি? আপনার বয়স্ক স্লাভিক বন্ধু যেন আমার মাথাকে নিয়ে কী করতে চায়?’ 

‘চেরনোবোগের চোখের অবস্থা ভালো না। আমার তো মনে হয় তোমার মাথায় লাগাতেই পারবে না। এখনও আমাদের হাতে বেশ খানিকটা সময় আছে। শনিবার যে আজ, তাই। যাই হোক, দুপুরের খাবার খেয়ে নিলে কেমন হয়? 

‘খুব ভালো হয়।’ বলল শ্যাডো। ‘খুব ক্ষুধা লেগেছে।’ 

‘আমি একটা জায়গা চিনি।’ বললেন ওয়েনসডে। গুনগুন করতে করতে গাড়ি চালালেন তিনি। গানটা চিনতে পারল না শ্যাডো। আস্তে আস্তে শুরু হলো তুষারপাত, ঠিক যেমনটা ও ভেবেছিল। কেমন যেন গর্ব বোধ করল সে। যদিও মস্তিষ্ক বলছে, এই তুষারপাতের পেছনে ওর কৃতিত্ব নেই…যেমন জানে, ওর পকেটের রুপালি লিবার্টি ডলারটা কস্মিনকালেও চাঁদ ছিল না…তারপরও… 

কুঁড়েঘরের মতো দেখতে একটা দালানের সামনে এসে থামল ওদের গাড়ি। বাইরের লেখা অনুসারে, মাত্র চার ডলার নিরানব্বই সেন্ট দিয়ে বুফে খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। ‘জায়গাটা আমার দারুণ পছন্দ।’ বললেন ওয়েনসডে। 

‘কেন? খাবার ভালো?’ জানতে চাইল শ্যাডো। 

‘খুব একটা না, তবে পরিবেশটা বেশ।’ 

ওয়েনসডের ‘বেশ’ পরিবেশের সাথে পরিচিত হতে বেশি একটা দেরি হলো না শ্যাডোর। ফ্রাইড চিকেন দিয়ে লাঞ্চ শেষ করার পরপরই ও দেখতে পেল, দালানটার পেছনে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া মানুষদের জিনিসপত্র বিক্রি করা হচ্ছে। বুঝতে পারল, এই বেচা-কেনাকে ঘিরেই ওয়েনসডের যত আগ্রহ। 

প্রৌঢ় লোকটা গাড়ি থেকে একটা ছোটো স্যুটকেস নিয়ে এলেন, ওটা নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন ছেলেদের বাথরুমে। শ্যাডো বুঝতে পারল, ইচ্ছা হোক আর না হোক, অতিসত্বর ওয়েনসডের পরিকল্পনা জানতে পারবে ও। তাই লোকটার দিকে নজর না দিয়ে, কী কী বিক্রি হচ্ছে সেদিকে মনোযোগ দিল। অদ্ভুত সব জিনিস জমা হয়েছে এখানে—কেবলমাত্র বিমানে ব্যবহারযোগ্য কফির বাক্স, জিনা আর টিনেজ মিউট্যান্ট নিনজা টার্টেলসের খেলনা, ওয়ারিয়র প্রিন্সেসের পুতুল, গান শোনানো টেডি বিয়ার, প্রক্রিয়াজাত খাবারের টিন, মার্শমেলো, বিল ক্লিনটনের ছবিঅলা হাতঘড়ি ইত্যাদি। 

হাঁটতে হাঁটতে ভাবনার অতলে হারিয়ে গেল শ্যাডো। আচ্ছা, মানুষ কীভাবে চাঁদকে আসমান থেকে ফুল তোলার মতো করে তুলে আনে? কীভাবে সেটা রূপ নেয় একটা রুপালি ডলারের? কী করলে মৃত এক নারী কবর থেকে উঠে আসে? অনেকটা পথ পাড়ি দেয় স্বামীর সাথে গল্প করতে? 

‘দারুণ না জায়গাটা?’ ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলেন ওয়েনসডে। ভেজা হাত রুমাল দিয়ে মুছছেন তিনি। ‘ভেতরে টিস্যু নেই। শ্যাডো টের পেল, ভেতরে থাকা অবস্থায় পোশাক পরিবর্তন করেছেন তিনি। এখন তার পরনে একটা ঘন নীল জ্যাকেট, এক রঙের ট্রাউজার্স, নীল টাই আর নীল সোয়েটার। সোয়েটারের নিচে একটা সাদা শার্ট আর পায়ে কালো জুতো দেখা যাচ্ছে। ব্যাপারটা মুখ ফুটে বললও সে। 

‘কী আর বলব বলো,’ বললেন ওয়েনসডে। ‘কেবল এতটুকু বলি, তোমার নজর খুব কড়া। যাই হোক, এ. তে আর্থার হলে কেমন হয়? নামটা কিন্তু ভালো।’ 

‘একটু বেশিই প্রচলিত নাম।’ 

‘তাহলে ভাবতে থাকো। চলো, শহরে ফেরা যাক। আমাদের ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনা কাজে লাগাবার সময় হয়েছে। তারপর কিছু খরচ-টরচ করতে চাই।’ 

‘টাকার দরকার হলে,’ বলল শ্যাডো। ‘মানুষ সাধারণত তা এটিএম থেকেই নেয়!’ 

‘আমিও তাই করব, তবে একটু ঘুরিয়ে।’ 

সুপারমার্কেটের পার্কিং লটে গাড়ি রাখলেন ওয়েনসডে। গাড়ির ট্রাঙ্ক থেকে তিনি বের করে আনলেন ধাতব কেসটা, একটা ক্লিপবোর্ড আর একজোড়া হ্যান্ডকাফ। কেসটাকে নিজের হাতের সাথে বাঁধলেন তিনি। তুষারপাত হচ্ছে পুরোদমে। হয়তো তাই মাথায় নীল ক্যাপটা চড়ালেন, জ্যাকেটের বুক পকেটে লাগিয়ে নিলেন এ-ওয়ান সিকিউরিটি লেখা একটা কাপড়। ক্যাপটাতেও তাই লেখা। 

প্রস্তুতি শেষ হয়নি তার, ক্লিপবোর্ডের সাথে লাগিয়ে রাখলেন জমা দেওয়ার রশিদগুলো। এরপর সামনের দিকে একটু ঝুঁকে গেলেন তিনি, এখন তাকে দেখতে বয়স্ক আর অবসর-প্রাপ্ত এক পুলিস বলে মনে হচ্ছে। কীভাবে কীভাবে যেন হাল্কা একটু ভুঁড়িও দেখা গেল তার উদরে! 

‘এবার,’ তৈরি হয়ে বললেন তিনি। ‘মার্কেটে চলে যাও। খাবারের দোকানে কিছু কেনাকাটা করে পে-ফোনের পাশে চলে যেয়ো। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, তোমার প্রেমিকার গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। ওর ফোনের অপেক্ষা করছ।’ 

‘আমার প্রেমিকা…সুপার মার্কেটে আমাকে ফোন করবে কেন?’

‘মেয়েদের মন…বোঝা বড়ো দায়!’ 

রং ওঠা গোলাপি একজোড়া মাফলার দিয়ে কান ঢাকলেন ওয়েনসডে। ট্রাঙ্কটা বন্ধ করে জানতে চাইলেন, ‘কেমন দেখাচ্ছে আমায়?’ 

‘হাস্যকর।’ জানাল শ্যাডো। 

‘হাস্যকর?’ 

‘নির্বোধও বলা যায়।’ 

হুম, নির্বোধ আর হাস্যকর। চলবে।’ হাসলেন ওয়েনসডে। মাফলার পরিহিত অবস্থায় হাসি দেখে মনে হলো, লোকটা নির্ভরযোগ্য, মজার আর পছন্দ করার মতো একজন। রাস্তা পার হয়ে তিনি সোজা ব্যাংকের দালানের কাছে চলে গেলেন। নির্দেশ মতো কাজ করল শ্যাডো, একটা চোখ ওয়েনসডের দিকে। 

এটিএমের সামনে একটা বড়ো নষ্ট লেখা কাগজ লাগিয়ে দিলেন ওয়েনসডে রাতের বেলা টাকা জমা দেবার যে স্লটটা আছে, সেটার সামনে লাগালেন একটা লাল রিবন। কিনকোর দোকান থেকে আনা সাইনটা ঝোলালেন এরপর। কৌতূহলী শ্যাডো এত দূর থেকেও লেখাগুলো পরিষ্কার পড়তে পারল- 

গ্রাহক-সেবার মান বৃদ্ধির জন্য, আমরা বর্তমানে কিছু কাজ করছি। এতে গ্রাহকদের সাময়িক সমস্যার জন্য আমরা দুঃখিত। 

এবার ঘুরে রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলেন ওয়েনসডে, তাকে দেখে মনমরা আর শীতার্ত বলে মনে হচ্ছে। 

কমবয়সি এক মহিলা এটিএম ব্যবহার করার জন্য কাছে আসতেই, বাধা দিলেন তিনি। তার মাথা নাড়ানো দেখে শ্যাডো বুঝতে পারল, ওটা যে নষ্ট তা জানাচ্ছেন। গালি দিয়ে উঠল মেয়েটা, তারপর নিজেই লজ্জা পেয়ে ক্ষমা চাইল। দাঁড়াল না আর বেচারি। 

এর কিছুক্ষণ পর, এটিএমের সামনে এসে থামল একটা গাড়ি। ছোটো একটা ধূসর থলে আর একটা চাবি হাতে নিয়ে গাড়ি থেকে নামল এক লোক। ওয়েনসডে ক্ষমা চাইলেন লোকটার কাছে, তারপর এগিয়ে দিলেন ক্লিপবোর্ড। লোকটা তাতে সই করার পর পূরণ করল একটা জমার ফর্ম। ওটা দেখে নিয়ে একটা রশিদ দিলেন ওয়েনসডে, রশিদের কোন অংশ রাখবেন আর কোনটা ফিরিয়ে দেবেন, সেটা নিয়ে বিভ্রান্ত দেখাল তাকে। অবশেষে ধাতব কেসটা খুলে তাতে রেখে দিলেন লোকটার থলে। 

এদিকে লোকটা শীতে কাঁপছে আর বারবার পা ঠুকছে ফুটপাতে। বয়স্ক সিকিউরিটি গার্ডের এই দেরি সহ্য হচ্ছে না যেন তার। রশিদ পাওয়া মাত্র আর দেরি করল না সে, উষ্ণ গাড়িতে উঠে বসে বিদায় নিলো। 

ধাতব কেসটা সাথে নিয়ে রাস্তা পার হলেন ওয়েনসডে। সুপার মার্কেট থেকে এক কাপ কফি কিনে নিয়ে ফিরে গেলেন আবার। শ্যাডোকে অতিক্রম করার সময় মুচকি হেসে বললেন, ‘শুভ সন্ধ্যা, যুবক। ঠান্ডা পড়েছে বেশ, তাই না? 

ব্যাংকের সামনে গিয়ে বসলেন তিনি। শনিবার বিকালে টাকা জমা দিতে আসা নারী-পুরুষদের হাত থেকে ধূসর থলে আর খাম নিতে থাকলেন। বৃদ্ধ, রং-জ্বলা মাফলার পরিহিত সিকিউরিটি গার্ডকে কেউ সন্দেহই করল না। 

টার্কি হান্টিং, পিপল আর প্রচ্ছদে ইয়েতির ছবি দেখে উইকলি ওয়ার্ল্ড নিউজ পত্রিকা কিনল শ্যাডো। ওগুলো ওলটাতে ওলটাতে তাকাল জানালা দিয়ে বাইরে।

‘আমি কোনভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’ মাঝবয়সি এক নিগ্রো জানতে চাইল ওর কাছে। ম্যানেজার হবে হয়তো, ভাবল শ্যাডো। 

‘নাহ, ধন্যবাদ। আমি আসলে একটা ফোন কলের জন্য অপেক্ষা করছি। আমার প্রেমিকার গাড়ি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে রাস্তায়।’ 

‘ব্যাটারির গোলমাল মনে হচ্ছে।’ বলল সাদা গোঁফের ম্যানেজার। ‘মানুষ কেন যে ওগুলো বদলাবার কথা ভুলে যায়! অথচ দাম খুব একটা বেশি না।’ 

‘একদম ঠিক বলেছেন।’ বলল শ্যাডো। 

‘দুশ্চিন্তা করবেন না।’ বলে মার্কেটের ভেতরে চলে গেল ম্যানেজার। 

তুষারপাত হচ্ছে এখনও, এপাশ থেকে ওপাশের কথা শোনা যাচ্ছে না। শ্যাডোর মনে হচ্ছে যেন নির্বাক চলচ্চিত্র দেখছে। এখান থেকে দেখে মনে হয়—বৃদ্ধ সিকিউরিটি গার্ড একটু অদক্ষ হলেও, সাদা মনের। মানুষ হাসি মুখেই তার হাতে তুলে দিচ্ছে টাকা-পয়সা। 

একটু শান্ত হয়ে এসেছে ও, এমন সময় ব্যাংকের সামনে এসে দাঁড়াল পুলিসের গাড়ি। আঁতকে উঠল শ্যাডো। অবশ্য ওয়েনসডের ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি এগিয়ে গিয়ে ক্যাপ ধরে সম্ভাষণ জানালেন। গাড়িটার জানালার কাছে দাঁড়িয়ে কী কী যেন বললেন আর মাথা দোলালেন কিছুক্ষণ। এরপর পকেট হাতড়ে বের করে আনলেন একটা বিজনেস কার্ড আর একটা চিঠি। জানালা দিয়ে ওগুলো এগিয়ে দিয়ে মন দিলেন কফিতে চুমুক দেবার কাজে। 

আচমকা বেজে উঠল টেলিফোন। ওটা তুলে নিয়ে কণ্ঠে বিরক্তি ঢেলে শ্যাডো বলল, ‘এ-ওয়ান সিকিউরিটিজ।’ 

‘আমি কি এ. হ্যাডকের সাথে কথা বলতে পারি?’ রাস্তার ওপাশের গাড়িতে বসে থাকা পুলিস প্রশ্ন করল। 

‘অ্যান্ডি হ্যাডক বলছি।’ 

‘মি. হ্যাডক, আমি একজন পুলিস-সদস্য। আপনার একজন লোক ফার্স্ট ইলিনয় ব্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মার্কেট আর সেকেন্ডের মোড়ে।’ 

‘ওহ, জিমি ও’ গরম্যান নিশ্চয়। কোনো সমস্যা, অফিসার? জিম বাজে আচরণ করেনি তো? নাকি মাতালামি করছে?’ 

‘কোনো সমস্যা নেই, স্যার। আপনার লোকও ঠিক আছে। শুধু নিশ্চিত হতে চাচ্ছিলাম।’ 

‘জিমিকে দয়া করে বলে দিন অফিসার, আরেকবার মদ্যপ অবস্থায় যদি আমার হাতে ধরা পড়ে, তাহলে এবার সোজা বের করে দেব। এ-ওয়ান সিকিউরিটিজে আমরা এসব সহ্য করি না।’ 

‘আমার এসব বলা ঠিক হবে বলে মনে হয় না, স্যার। আপনার লোক ঠিকমতোই কাজ করছে। তবে এরকম একটা জায়গায় মাত্র একজনকে রাখাটা আসলে ঠিক হচ্ছে না, কমপক্ষে দুজন গার্ড দরকার। ঝুঁকির ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হবে।’ 

‘তা তো বটেই। আসলে এই কথাগুলো ফার্স্ট ইলিনয়ের ওই কিপ্টা ব্যাংকারদের কানে তোলা দরকার। আমার লোকদের ঝুঁকির মধ্যে ঢেলে দিচ্ছে বারবার। বুঝলেন অফিসার, এরা সবাই ভালো মানুষ। আপনার মতোই।’ শ্যাডোর মনে হলো, ও যেন আসলেই অ্যান্ডি হ্যাডক! মুখে একটা সিগার পোড়া আছে ওর, সামনে একগাদা কাগজ। ‘আপনার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে, বয়স খুব একটা বেশি না। তা অফিসার…কী যেন নাম বললেন?’ 

‘মেয়ারসন।’ 

‘অফিসার মেয়ারসন। যদি কখনও ছুটির দিনে হালকা কাজ করতে মন চায়, অথবা যদি কখনও চাকরি ছাড়েন, আমাকে ফোন করতে ভুল করবেন না। আমার কার্ডটা তো আছে, তাই না?’ 

‘জি।’ 

‘রেখে দিন,’ বলল অ্যান্ডি হ্যাডক। ‘আপনার মতো মানুষের আমাদের বড্ড দরকার।’ 

কথা শেষে চলে গেল পুলিসের গাড়ি। ওয়েনসডে ফিরে এলেন নিজের জায়গায়। তার হাতে টাকা তুলে দেবার জন্য এরইমাঝে অনেকে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে পড়েছে! 

‘ঠিক আছে তো সব?’ দরজা দিয়ে মাথা বের করে জানতে চাইল ম্যানেজার। ‘আপনার প্রেমিকার কথা জিজ্ঞেস করছি।’ 

‘হ্যাঁ। ব্যাটারিরই সমস্যা,’ জানাল শ্যাডো। ‘এখন অপেক্ষা করতে হবে আমাকে।’ 

‘মেয়েমানুষ!’ হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল ম্যানেজার। ‘আশা করি আপনার এই অপেক্ষার যোগ্য মেয়েটা।’ 

.

শীতের রাত নামতে শুরু করেছে, আস্তে আস্তে গোধূলি রূপ নিচ্ছে রজনীর। রাস্তার বাতি জ্বলে উঠছে এক এক করে। ওয়েনসডে টাকা নিয়ে কুল পাচ্ছেন না। আচমকা, যেন এক অদৃশ্য ইঙ্গিতে, দেয়ালের কাছে চলে গেলেন তিনি। নষ্ট লেখা কাগজটা খুলে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে এগোলেন পার্কিং লটের দিকে। এক মিনিট অপেক্ষা করে পিছু নিলো শ্যাডো। 

গাড়ির পেছনের সিটে বসে ছিলেন ওয়েনসড়ে। ধাতব কেসটা খুলে ভেতরের সবকিছু এরইমধ্যে ঢেলে ফেলেছেন পাশের খালি আসনটায়। 

‘চালাও,’ বললেন তিনি। ‘স্টেট স্ট্রিটের ফার্স্ট ইলিনয় ব্যাংকের অফিসে যাও। 

‘আবার একই নাটক?’ জানতে চাইল শ্যাডো। ‘ঝুঁকিটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না?’ 

‘আরে না, আবার কেন করব!’ বললেন ওয়েনসডে। ‘এবার টাকা জমা দিতে যাচ্ছি।’ 

শ্যাডোর গাড়ি চালানোর সময়টা কাজে লাগালেন ওয়েনসডে। চেক আর ক্রেডিট কার্ডের স্লিপগুলো ফেলে দিয়ে রাখলেন শুধু নগদ টাকা। তা-ও সব না, কয়েকটা খাম তো স্পর্শই করলেন না। কিছু নোট আলাদা রেখে বাকিগুলো আবার ভরে রাখলেন তিনি কেসে। শ্যাডো ব্যাংকের গজ পঞ্চাশেক দূরে গাড়ি থামাল, এখান থেকে ব্যাংকের ক্যামেরা ওদেরকে দেখতে পাবে না। গাড়ি থেকে বেরিয়ে ওয়েনসডে খামগুলো রাতে জমা করার স্লটটায় ঢুকিয়ে দিলেন। এরপর রাতের সেফটা খুলে ভেতরে রাখলেন ধূসর ব্যাগগুলো। 

কাজ শেষে ফিরে এলেন গাড়িতে। ‘আই-৯০-এর দিকে যাও।’ বললেন তিনি। ‘সাইন দেখে দেখে পশ্চিমে, ম্যাডিসনের দিকে এগোবে।’ 

গাড়ি চালাতে শুরু করল শ্যাডো। 

একবার পেছন ফিরে ব্যাংকের দিকে তাকালেন ওয়েনসডে। ‘সবাই বিভ্রান্ত হয়ে যাবে। যাই হোক, যদি একদানে অনেক টাকা কামাতে চাও, তাহলে এই কাজটা করতে হবে রবিবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে। তখন নাইট ক্লাব আর বারের ইনকাম জমা দিতে আসে মানুষ। সাথে দুই একজন মাংসল বাউন্সারও আনে অনেকে। তবে আকারে বড়ো হলেও, বুদ্ধিতে একেবারে খাটো হয় ব্যাটারা। সঠিক ব্যাংক, সঠিক সময় আর সঠিক ক্লাবের টাকা পেলে, একবারে পৌনে এক মিলিয়ন ডলার কামানোও অসম্ভব না।’ 

‘কাজটা যদি এত সহজই হয়,’ বলল শ্যাডো। ‘তাহলে সবাই করছে না কেন?’

‘একেবারে ঝুঁকিমুক্ত পরিকল্পনা বলব না,’ বললেন ওয়েনসডে। ‘বিশেষ করে ভোর সাড়ে-চারটায় বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।’ 

‘কী সমস্যা? পুলিস একটু বেশিই সন্দেহ-প্রবণ থাকে তখন?’ 

‘নাহ, বাউন্সাররা থাকে। মাঝে মাঝে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীনও হতে হয় আরকি।’ 

পঞ্চাশ ডলারের অনেকগুলো নোট একত্র করলেন ওয়েনসডে, এরপর কয়েকটা বিশ ডলারের নোট যোগ করে ওজন আন্দাজ করার চেষ্টা করলেন হাতে নিয়ে। সন্তুষ্ট হয়ে পুরোটা এগিয়ে দিলেন শ্যাডোর দিকে। ‘এই নাও, তোমার প্রথম সপ্তাহের বেতন।’ 

না গুনেই নোটগুলো পকেটে পুরল শ্যাডো। ‘এভাবেই তাহলে আপনি টাকা কামাই করেন?’ 

‘খুব বিপদে পড়লে…আর যখন খুব বড়ো অঙ্কের টাকা খুব দ্রুত প্রয়োজন হয়, তখন। সাধারণত আমি নেই এমন লোকদের কাছ থেকে, যারা তা বুঝতেই পারে না…অভিযোগ করার তো প্রশ্নই ওঠে না। জানো, পরেরবার আমাকে দেখা মাত্র লাইন ধরে দাঁড়িয়ে যায় তারা-টাকা দেবার জন্য!’ 

‘সুইনি বলেছিল, আপনি প্রতারক।’ 

‘ঠিক বলেছে। কিন্তু আমি যেন-তেন প্রতারক নই, শ্যাডো।’ 

.

অন্ধকারের মাঝ দিয়ে হেডলাইটের আলো জ্বেলে এগিয়ে চলছে শ্যাডো। এই উজ্জ্বল হচ্ছে রাস্তা, আবার এই নেমে আসছে অন্ধকার। সম্মোহিত হয়ে পড়ছে যেন যুবক। 

‘বিশ্বের একমাত্র দেশ এটা,’ বললেন ওয়েনসডে। ‘যেটা নিজের পরিচয় নিয়ে এতটা মাথা ঘামায়!’ 

‘বুঝলাম না!’ 

‘অন্য দেশগুলো এমন অস্তিত্বের সংকটে ভোগে না। নরওয়ের হৃৎপিণ্ডের খোঁজে কোনো নরওয়েজিয়ানকে হন্য হয়ে ঘুরতে দেখেছ? অথবা মোজাম্বিকের আত্মার খোঁজে কোনো মোজাম্বিকবাসীকে? ওরা জানে নিজেদের পরিচয়।’ 

‘আর…?’ 

‘আর কিছু না।’ 

‘অনেক দেশ ঘুরেছেন মনে হচ্ছে?’ 

কিছুই বললেন না ওয়েনসডে, শ্যাডো লোকটার দিকে তাকাল। ‘না,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন তিনি। ‘খুব একটা ঘোরা হয়নি।’ 

গ্যাস নেবার জন্য পথে একবার থামতে হলো ওদেরকে, সিকিউরিটি গার্ডের উর্দি পরা অবস্থায় স্টেশনের রেস্টরুমে ঢুকলেন ওয়েনসডে; বের হলেন স্যুট, বাদামি জুতা আর হাঁটু পর্যন্ত লম্বা বাদামি কোট পরে। কোটটা সম্ভবত ইতালিয়ান! 

‘ম্যাডিসনে যাবার পর আমরা কী করব?’ 

‘থামবে না। চোদ্দো নম্বর হাইওয়ে ধরে স্প্রিং গ্রিনে চলে যাবে। হাউজ অন দ্য রক নামের একটা জায়গায় আমরা সবার সাথে দেখা করব। আগে গেছ কখনও?’ 

‘না,’ জানাল শ্যাডো। ‘তবে সাইনবোর্ড দেখেছি বেশ কয়েকবার। 

হাউজ অন দ্য রকের সাইনবোর্ড মনে হয় সারা বিশ্ব জুড়েই ছড়িয়ে আছে। অন্তত ইলিনয়, মিনেসোটা আর উইসকনসিনে তো আছেই, আইওয়াতে থাকলেও শ্যাডো অবাক হবে না। সে নিজেও অনেক জায়গায় দেখেছে ওই সাইন, কিন্তু বাঁকা চিহ্নগুলোর অর্থ ধরতে পারেনি। নামটাও যেন কেমন! রক, মানে পাথরের ওপরে কি বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাউজ, মানে দালানটা? বেশিক্ষণ অবশ্য ব্যাপারটা নিয়ে ভাবল না শ্যাডো। চলতি পথে অবস্থিত নানা দর্শনীয় স্থান দেখায় ওর আগ্রহ নেই 

ম্যাডিসনে এসে ইন্টারস্টেট রাস্তা ছাড়ল ওরা, ক্যাপিটাল বিল্ডিঙের গম্বুজের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এলো। আচমকা নিজেকে শ্যাডো আবিষ্কার করল অপ্রশস্ত, অনেকটা গ্রাম্য রাস্তায়। প্রায় একঘণ্টা ধরে গাড়ি চালিয়ে, ‘কালো মাটি’ টাইপ অদ্ভুত নামের একাধিক শহর অতিক্রম করার পর একটা সরু ড্রাইভওয়েতে এসে নামল ওরা। চারপাশে গাছ দিয়ে ঘেরা পার্কিং লট প্রায় খালি। 

‘খুব দ্রুতই বন্ধ হয়ে যাবে।’ বললেন ওয়েনসডে। 

‘নাম কী এই জায়গার?’ জানতে চাইল শ্যাডো। গাড়ি থেকে নেমে ওরা দুজনেই একটা নিচু, কাঠের দালানের দিকে এগোল 

‘এই হচ্ছে যাকে বলে…চলতি পথে অবস্থিত দর্শনীয় স্থান। আমেরিকার অন্যতম সেরা জায়গা এটা। তাই এক হিসেবে একে তুমি ক্ষমতায় পূর্ণ এলাকাও বলতে পারো।’

‘মানে?’ 

‘সহজ কথা,’ বললেন ওয়েনসডে। ‘অন্যান্য দেশের কথা ধরো। মানুষ নানা স্থানকে পুজো করে এসেছে, তারা জানত ওসব এলাকার বিশেষ ক্ষমতা আছে। কখনও কখনও জায়গাটার বিশেষত্ব এসেছে প্রাকৃতিকভাবে, আবার কখনও কখনও ওটা আসলেই বিশেষ কিছু একটা ছিল। ওসব স্থানে তারা বানাত মন্দির বা ক্যাথেড্রাল, অথবা স্থাপন করত মূর্তি…বুঝতেই পারছ আমি কী বলতে চাইছি!’ 

‘আমেরিকা জুড়ে চার্চের সংখ্যা কিন্তু কম না।’ বলল শ্যাডো। 

‘হুম, প্রতিটা শহরেই আছে। অনেক শহরে তো প্রতিটা ব্লকেই দেখা যায়। আসলে এই ইউএসএতেও মানুষ মাঝে মাঝে ওপাশের ডাক শুনতে পায়। যার ফলশ্রুতিতে জীবনে যায়নি বা দেখেনি, এমন জায়গার প্রতিকৃতি বানায় তারা। কালে সেটাই পরিণত হয়ে দর্শনীয় স্থানে!’ 

‘আপনার তত্ত্বগুলো মাঝে মাঝে বড়ো অদ্ভুত বলে মনে হয়।’ বলল শ্যাডো।

‘তত্ত্ব না বাছা,’ বললেন ওয়েনসডে। ‘এতক্ষণে তো তোমার বুঝে যাওয়া উচিত-আমি আন্দাজে কথা বলি না।’ 

টিকিট বিক্রি হচ্ছে এমন একটা মাত্র বুথ এখনও খোলা আছে। ‘আমরা আধ ঘণ্টা পর টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দেব। পুরোটা ঘুরে দেখতে কমসে কম দুই ঘণ্টা সময় লাগে তো, তাই।’ 

নগদ টাকা দিয়ে টিকিট কিনলেন ওয়েনসডে। 

‘পাথর কই?’ জানতে চাইল শ্যাডো। 

‘দালানের নিচে।’ 

‘তা দালানটা কই?’ 

উত্তর না দিয়ে ওয়েনসডে ওর ঠোঁটে আঙুল রেখে ওকে চুপ করিয়ে দিলেন। কোনো কথা না বলে কিছুক্ষণ সামনে এগোল ওরা। পিয়ানোর বাজনা কানে এলো ওদের; শ্যাডোর মনে হচ্ছে, যেন ১৯৬০ সালের এক ব্যাচেলরের আবাস নকল করে সাজানো হয়েছে। পাথরের কাজ করা, পায়ের নিচে বিছানো কার্পেট আর মাশরুমের মতো দেখতে ল্যাম্প শেডগুলো সেরকমই মনে করাচ্ছে ওকে। 

‘লোকে বলে, এই জায়গাটা বানিয়েছিলেন ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইট-এর দুষ্টু যমজ, ফ্রাঙ্ক লয়েড রং। নিজের কৌতুকে নিজেই হাসলেন তিনি! 

‘কোনো একটা টি-শার্টে লেখাটা পড়েছি আমি।’ বলল শ্যাডো। 

বেশ কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে ওঠা-নামা করার পর, একটা বড়ো ঘরে এসে উপস্থিত হলো ওরা। ঘরটা কাচ দিয়ে বানানো, সামনের দিকটা একটা সুইয়ের মতো সরু হয়ে গেছে। শেষ হয়েছে যেখানে, সেখান থেকে সাদা-কালো গ্রাম্য এলাকা দেখা যায়। অথচ ঘরের অনেকটা অংশ হাওয়ার ওপরে! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পরিবেশটাকে উপভোগ করল শ্যাডো। 

‘এই তাহলে হাউজ অন দ্য রক?’অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ও। 

‘মোটামুটি। এই ঘরের নাম অনন্ত ঘর, অনেক পরে বানানো হয়েছে। তবে আমার বন্ধু, এই দালানের আসল রূপের ঝলকটাও তুমি এখন পর্যন্ত অবলোকন করোনি।’ 

‘আপনার তত্ত্ব মতে,’ বলল শ্যাডো। ‘ডিজনি ওয়ার্ল্ড আমেরিকার সবচেয়ে পবিত্র আর ক্ষমতাশালী জায়গা!’ 

ভ্রু কুঁচকে তাকালেন ওয়েনসডে। ‘ওয়াল্ট ডিজনি ফ্লোরিডার মাঝখানে কয়েকটা কমলার বাগান কিনে একটা টুরিস্ট টাউন বানিয়েছে। ওখানে জাদু কই? তবে আমার ধারণা, আসলে ডিজনিল্যান্ডে কিছু থাকলেও থাকতে পারে। যাই হোক, ফ্লোরিডার কিছু জায়গায় কিন্তু সত্যি সত্যি জাদুর অস্তিত্ব আছে। শুধু চোখ খোলা রাখলেই, দেখতে পাবে…আমার সাথে এসো।’ 

চারপাশে শুধু সুর আর সুর, তবে কেমন যেন ঠিক খাপে খাপ মেলে না…পুরনো বলে মনে হয়। একটা পাঁচ ডলারের নোট বের করে চেঞ্জ মেশিনে ঢোকালেন ওয়েনসডে, বিনিময়ে পেলেন অনেকগুলো তামাটে রঙের পয়সা। শ্যাডোর দিকে একটা ছুড়ে দিলেন তিনি, ছোটো একটা বাচ্চা ওর দিকে তাকিয়ে আছে টের পেয়ে পয়সা হাপিস করার খেলা দেখাল সে। 

ওয়েনসডের পিছু নিয়ে বাইরে চলে এলো শ্যাডো। কিছুক্ষণ একসাথে চলার পর, ‘বিগত দিনের রাস্তা’র সাইনগুলো অনুসরণ করতে লাগল ও। 

‘চল্লিশ বছর আগে, অ্যালেক্স জর্ডান, যার চেহারা তোমার হাতে থাকা পয়সাটায় মুদ্রিত হয়েছে, একটা বাড়ি বানাতে শুরু করলেন। যেখানে বাড়ি বানাচ্ছিলেন, সেখানে ছিল উঁচু পাথরের স্তূপ, এমনকি জায়গাটার মালিকও তিনি ছিলেন না। দালানটা কেন ওঠাচ্ছেন, সেটা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে পারতেন না! যাই হোক, তার এই বাড়ি বানানো দেখার জন্য লোকে ভিড় করতে শুরু করল। কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর তাদের কাছে ছিল না! কেউ কেউ কৌতূহলী ছিল, কেউ কেউ বিভ্রান্ত। অনেকে দুটোর কোনটাই ছিল না। অ্যালেক্স বুদ্ধিমান আমেরিকানের মতো কাজ করলেন-দর্শনার্থীদের কাছ থেকে টাকা রাখতে শুরু করলেন তিনি, অঙ্কটা শুরুতে ছোটোই ছিল। শুরুতে এক নিকেল[৮], অথবা একটা কোয়ার্টার[৮]। দালান বানানো কিন্তু বন্ধ হয়নি। বন্ধ হয়নি লোক আসাও। 

[৮. এক নিজেকে ৫ সেন্ট, এক কোয়ার্টারে ২৫ সেন্ট।]

‘টাকাটা নিয়ে তিনি আরও বড়ো কিছু জিনিস বানালেন। বাড়িটার নিচের জমিতে খাড়া করলেন কিছু গুদাম, ওগুলো ভরলেন মানুষ দেখতে চায় এমন জিনিস দিয়ে। এখন প্রতি বছর লাখ লাখ লোক এখানে আসে। 

‘কেন?’ 

উত্তর না দিয়ে কেবল হাসলেন ওয়েনসডে, বিগত দিনের রাস্তায় আধো আলোতে এগোতে থাকল তারা। দুপাশের ধুলো পড়া দোকানগুলোর জানালা দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে প্রাচীন আমলের চীনে মাটির পুতুল। ওদের মাথার ওপরে অন্ধকার ছাদ, পায়ের নিচে খোয়া বিছানো মেঝে; পেছন থেকে ভেসে আসছে বাজনা। ভাঙা পাপেট আর বড়ো একটা সোনালি মিউজিক বক্সের সামনে দিয়ে হেঁটে গেল ওরা। অতিক্রম করল দাঁতের ডাক্তার আর ওষুধের দোকানও। 

রাস্তার শেষ মাথায় একটা বৃহদায়তন কাচের বাক্স দেখা যাচ্ছে, ভেতরে একটা মেয়ে পুতুল। পরনে জিপসি ভবিষ্যদ্বক্তার পোশাক। 

‘শোনো,’ বাজনার আওয়াজ ছাপিয়ে গেল ওয়েনসডের কণ্ঠ। ‘যেকোনো কাজে নামার আগে, নর্নদের সাথে আলোচনা করে নেওয়া উচিত। তাই এসো, আমরা এই ভবিষ্যদ্বক্তাকে উর্ডবলে ধরে নেই।’ স্লটে একটা তামাটে পয়সা ঢুকিয়ে দিলেন তিনি। সাথে সাথে একটা হাত উঁচু করে ধরল জিপসি, আবার নামিয়ে আনল। সুট থেকে বেরিয়ে এলো এক টুকরা কাগজ। 

ওটা ছিঁড়ে নিয়ে পড়লেন ওয়েনসডে, এরপর ঘোঁত করে দলা পাকালেন কাগজটা, এক মুহূর্ত পর ওটার স্থান হলো তার পকেটে। 

‘আমাকে দেখাবেন না? আমারটা চাইলে দেখতে পারেন।’ বলল শ্যাডো।

‘যার যার ভাগ্য…তার তার।’ শক্ত কণ্ঠে বললেন ওয়েনসডে। ‘তোমারটা দেখার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।’ 

কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে গেল শ্যাডো, স্লটে পয়সা ঢোকানো মাত্ৰ কাগজ বেরিয়ে এলো একটা।

প্রতিটা অন্তের মাঝেই লুকিয়ে আছে নতুন আদি। 
তোমার জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে, এমন কোন নম্বর নেই। 
তোমার শুভ রং মৃত্যু।
আপ্তবাক্য-বাপ কা বেটা, সিপাই কা ঘোড়া। 

মুখ বিকৃত করল শ্যাডো, কাগজটা ভাঁজ করে কোটের ভেতরের পকেটে রেখে দিল। 

আবার এগোতে শুরু করল দুজন। একে একে পার হলো একটা লাল করিডর, ফাঁকা চেয়ার ভরতি ঘর যেখানে ভায়োলিন আর চেলো আপনাআপনি বাজছে (মানে সুটে পয়সা দেবার পর আরকি)। কিছুটা অবাক হয়েই লক্ষ করল শ্যাডো, ওই যন্ত্রগুলোকে বাজাচ্ছে একটা যান্ত্রিক হাত। অথচ একটা তারও স্পর্শ করছে না ওটা! ভাবল, এই বাজনা হয়তো বাতাসের কাজ। আবার আগে থেকে রেকর্ড করাও হতে পারে। 

প্রায় কয়েক মাইল হাঁটার পর, মিকাডো নামে একটা ঘরে এসে উপস্থিত হলো ওরা। ওই ঘরেও বাজছে বাজনা, একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে বেঞ্চের উপর বসে আছে চেরনোবোগ। সুরের তালে তালে নাচছে তার হাতের আঙুলগুলো। 

এগিয়ে গিয়ে লোকটার পাশে বসলেন ওয়েনসডে। শ্যাডো দাঁড়িয়েই রইল। বাঁ হাত বাড়িয়ে প্রথমে ওয়েনসডে আর পরে শ্যাডোর সাথে করমর্দন করল সে। তারপর আবার মন দিল গানে। 

কৃত্রিম যন্ত্রগুলো কেমন যেন অগোছালোভাবে শেষ করল বাজনা। নতুন আরেকটা গান শুরু হতে অবশ্য দেরি হলো না। 

‘তোমাদের ব্যাংক ডাকাতি কেমন গেল?’ জানতে চাইল চেরনোবোগ। ‘অসুবিধা হয়নি তো?’ মিকাডো ছেড়ে যেতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে না। 

‘মাখনের মাঝে গরম ছুরি যেভাবে যায়, তেমন মসৃণভাবেই কাজ সেরেছি।’

‘আমি কসাইখানা থেকে পেনশন পাই।’ বলল চেরনোবোগ। ‘এর বেশি কিছু দরকার নেই।’ 

‘একদিন ওই পেনশন আসাও বন্ধ হয়ে যাবে।’ বললেন ওয়েনসডে। ‘সবকিছুই একদিন-না-একদিন ফুরিয়ে যায়।’ 

আরও অনেকগুলো করিডর, অনেকগুলো বাদ্য যন্ত্র পার হতে হলো ওদেরকে। শ্যাডো বুঝতে পারল, পর্যটকদের যে পথে হেঁটে সব দেখে, সেই পথ না ধরে ওয়েনসডের দেখানো অন্য পথ দিয়ে চলছে ওরা। এখন একটা ঢাল বেয়ে নামছে ওরা, যুবকের মনে হচ্ছে যেন এই পথে আগেও পা রেখেছে। 

আচমকা শ্যাডোর হাত আঁকড়ে ধরল চেরনোবোগ। ‘জলদি, এদিকে এসো।’ বলে ওকে একটা বিশালাকার কাচের বাক্সের কাছে নিয়ে গেল। বাক্সের ভেতরে একটা ত্রি-মাত্রিকভাবে নির্মিত দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। এক ভবঘুরে শুয়ে আছে একটা চার্চের দরজার সামনে অবস্থিত একটা গোরস্তানে। মাতালের স্বপ্ননামটা কাচের সাথে লেখা। সেই সাথে এ-ও লেখা, জিনিসটা ঊনবিংশ শতাব্দীর একটা সুট মেশিন। ইংলিশ ট্রেন স্টেশনে এগুলো বসানো থাকত। এখন এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে যে হাউজ অন দ্য রকের পয়সা নিতে পারে। 

‘পয়সা ঢালো। বলল চেরনোবোগ। 

‘কেন?’ 

‘তোমার দেখতেই হবে।’

স্লটে পয়সা ফেলল শ্যাডো। গোরস্তানে শায়িত মাতাল ঠোঁটের কাছে তুলে ধরল মদের বোতল। সেই সাথে উলটে গেল একটা সমাধিফলক, কবর থেকে উঠে এলো একটা মৃতদেহ। মাথার কাছে দেখা গেল একটা খুলি, দাঁত বের করে হাসছে। আরও একজনকে দেখা গেল, একটা অবয়ব, চার্চের ডান দিকে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে চার্চের বাঁয়ে কিছু একটা এক পলকের জন্য দেখা দিয়েই আবার মিলিয়ে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তে খুলে গেল চার্চের দরজা, বাইরে পা রাখলেন এক যাজক। মরদেহ, অবয়ব সব উধাও হয়ে গেল। বাকি রইল কেবল মাতাল আর যাজক। নাক কুঁচকে মাতালের দিকে তাকালেন তিনি, তারপর পিছিয়ে এসে বন্ধ করে দিলেন দরজা। মাতাল পড়ে রইল মাতালের মতো। 

পুরো দৃশ্যটা নাড়া দেবার মতো। এমন গল্প দেখানো উচিত না, ভাবল শ্যাডো। 

‘কেন দেখালাম, জানো?’ জিজ্ঞেস করল চেরনোবোগ। 

‘না।’ 

‘দুনিয়ার আসল রূপ এটাই। ওখানে, ওই বাক্সে যা দেখলে…পুরো পৃথিবীটাই আসলে সেরকম।’ 

রক্ত-রঙা একটা ঘরের ভেতর দিয়ে ওরা হাঁটছে এখন, ভেতরে পুরনো দিনের বড়ো বড়ো সব অর্গান। তামাটে পাইপগুলো দেখে মনে হচ্ছে, ওগুলো বুঝি মদের কারখানা থেকে খুলে আনা হয়েছে। 

‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’ জানতে চাইল শ্যাডো।

‘ক্যারোসেলের কাছে।’ উত্তর দিল চেরনোবোগ। 

‘ক্যারোসেলে যাবার পথটা এরইমাঝে না হলেও বারো-চোদ্দোবার পার হয়ে এসেছি আমরা।’ 

‘ওয়েনসডে হাঁটে নিজের বেছে নেওয়া পথে, বৃত্তাকারে হাঁটা বলতে পারো। কখনও কখনও দ্রুততম পথটা দীর্ঘতম হয়। 

ব্যথা করতে শুরু করেছে শ্যাডোর পা, কথাটা কেন যেন ওর বিশ্বাস হলো না।

একটা উঁচু ঘর পার হলো ওরা, ঘরটার মাঝখানে বড়ো…কালো একটা তিমির রেপ্লিকা রাখা। ওটার মুখের ভেতর বসে আছে একটা পূর্ণ নৌকার মডেল। সেখান থেকে একটা ট্রাভেল হলে পা রাখল ওরা, ওখানকার গাড়িটা টাইলসে ভরতি। ওটা এখন পরিণত হয়ে রুব গোল্ডবার্গের ডিজাইন অনুসারে বানানো মুরগি- প্রসেসিং যন্ত্রে। সেই সাথে দেয়ালে লাগাচ্ছে বার্মা শেভ কোম্পানির বিজ্ঞাপন। 

জীবন বড়ো কঠিন, 
পদে পদে খেতে হয় হোঁচট আর বাড়ি;
তাই পরিষ্কার রাখো চোয়াল, 
থাকে না যেন দাড়ি। 
বার্মা শেভ। 

আরেকটায় লেখা— 

গাড়ি চালাতে গিয়ে, করেছিল সে ওভারটেক, 
জানত না যে বাঁক আছে ওপাশে; 
তাই এখন শুধু গোরখোদক, 
সঞ্জা দেয় ওকে 
বার্মা শেভ। 

ঢালের নিচে এসে পৌঁছাতে বেশিক্ষণ লাগল না ওদের, সামনেই দেখা গেল একটা আইসক্রিমের দোকান। খোলা আছে তবে দোকানের একমাত্র কর্মচারী মেয়েটার চেহারা কেমন যেন ভাবলেশহীন। তাই চলে গেল পিজ্জেরিয়া- ক্যাফেটেরিয়াতে। খালিই বলা চলে, কেবল এক বয়স্ক কালো চামড়ার লোক বসে আছে। তার পরনে চেকের স্যুট আর হাতে ক্যানারির মতো হলদে গ্লাভস। ছোটোখাটো লোকটা বেশ বয়স্ক, দেখে মনে হয় যেন বয়সের ভারে ন্যুজ্ব হয়ে আছে। বিশাল একটা আইসক্রিম সানডে তার হাতে, অন্য হাতে তেমনই বিশাল এক মগ ভরতি কফি। অ্যাশট্রে জ্বলছে একটা কালো সিগার। 

‘তিন কাপ কফি আনো।’ শ্যাডোকে নির্দেশ দিয়ে রেস্টরুমে চলে গেলেন ওয়েনসডে। 

কফি এনে কাপগুলো চেরনোবোগের কাছে নিয়ে গেল শ্যাডো। লোকটা তখনও ওই বৃদ্ধের সাথে ছিল, সিগারেট টানছিল চুপিচুপি; যেন কোনো তরুণ ভয়ে ভয়ে টানছে। বৃদ্ধের অবশ্য ভ্রুক্ষেপ নেই, আইসক্রিম সানডে নিয়েই ব্যস্ত সে। সিগারটা অ্যাশট্রেতে এমনি এমনি পড়ে জ্বলছে। তবে শ্যাডোকে আসতে দেখে ওটা তুলে নিলো সে। লম্বা একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল, দুটো রিং তৈরি হলো ধোঁয়ায়-একটা বড়ো আর অন্যটা ছোটো। ছোটোটা একটুও স্পর্শ না করে চলে গেল বড়োটার ভেতর দিয়ে। হাসি ফুটে উঠল বৃদ্ধের মুখে, নিজের কাজে সন্তুষ্ট। 

‘শ্যাডো, ইনি হচ্ছেন মি. ন্যান্সি।’ পরিচয় করিয়ে দিল চেরনোবোগ। 

উঠে দাঁড়িয়ে গ্লাভস পরা ডান হাত এগিয়ে দিল বৃদ্ধ। ‘পরিচিত হয়ে প্রীত হলাম,’ চোখ ধাঁধানো হাসি হেসে বলল সে। ‘তুমি কে, তা বুঝতে পারছি। নিশ্চয়ই ওই একচোখা হারামজাদার হয়ে কাজ করছ, তাই না?’ উচ্চারণে হালকা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান টান টের পেল শ্যাডো। 

‘ঠিক ধরেছেন, আমি মিস্টার ওয়েনসডের হয়ে কাজ করি।’ বলল শ্যাডো। ‘বসুন না।’ 

চেরনোবোগ সিগারেট টেনেই যাচ্ছে। 

‘আমার ধারণা,’ হতাশা ভরা কণ্ঠে বলল সে। ‘আমাদের জাতটা সিগারেট পছন্দ করে, কারণ এই জিনিসটা আমাদেরকে অতীত স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। একদা আমাদের জন্য এভাবেই আগুন জ্বালিয়ে কত কী উৎসর্গ করা হতো! ধোঁয়া ওপরে উঠত আর মানুষ ভাবত, আমাদের কাছে সেগুলো ওদের প্রার্থনা পৌঁছে দিচ্ছে।’ 

‘আমি কখনও অমন কিছু পাইনি।’ বলল ন্যান্সি। ‘আমার কপালে জুটত একগাদা ফল, কখনও কখনও রান্না করা খাসির মাংস। পান করার মতো ঠান্ডা পানীয় আর মাঝে মাঝে…কপাল ভালো হলে সুন্দর মেয়ে।’ সাদা দাঁত বের হয়ে গেল হাসিতে। শ্যাডোর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল সে। 

‘আর আজ,’ কণ্ঠে হতাশা চেরনোবোগের। ‘কপালে কিচ্ছু জোটে না।’ 

‘আগের মতো ফল পাই না, সে কথা সত্যি…’ চোখ জ্বলজ্বল করছে মিস্টার ন্যান্সির। ‘…তবে বড়ো বড়ো দুধঅলা মেয়েমানুষের অভাবটা বেশি জ্বালায়। অনেকেই বলে, মেয়েমানুষের পেছনটা আগে দেখে নিতে হয়। তবে আমার মতে, বুক-ই আসল।’ হাসিতে ফেটে পড়ল বৃদ্ধ, তাকে পছন্দ হয়ে গেল শ্যাডোর। 

রেস্টরুম থেকে ফিরে এসেছেন ওয়েনসডে, ন্যান্সির সাথে হাত মেলালেন তিনি। ‘শ্যাডো, কিছু খেতে চাও? পিজ্জা বা স্যান্ডউইচ?’ 

‘ক্ষুধা পায়নি।’ 

‘তোমাকে একটা কথা বলি, শোনো।’ বলল মি. ন্যান্সি। ‘পরবর্তী খাবার সুযোগ কখন আসবে তা কেউ জানে না। তাই যখন কেউ তোমাকে খাওয়াবার প্রস্তাব দেয়, তখন দ্বিতীয়বার না ভেবে খেয়ে নাও। তোমার মতো আর যুবক নই, কিন্তু অভিজ্ঞতা কম না। তাই বলছি, খাওয়া, প্রস্রাব করা আর ঘুমাবার সুযোগ হেলায় হারানো একদম উচিত না। বুঝতে পেরেছ?’ 

‘হ্যাঁ। কিন্তু আমার আসলেই ক্ষুধা লাগেনি।’ 

‘সাইজ তো বেশ ভালোই আছে,’ শ্যাডোর হালকা ধূসর চোখে নিজের মেহগনি রঙা চোখ রাখল ন্যান্সি। ‘তবে বুদ্ধি-শুদ্ধি খুব একটা আছে বলে মনে হচ্ছে না। আমার এক ছেলে আছে, বুঝলে? তোমাকে দেখে ওর কথা মনে পড়ছে। যে কেউ ওকে এক হাটে কিনে দশ হাটে বেচতে পারবে!’ 

‘কিছু মনে না করলে, আপনার কথাটাকে আমি প্রশংসা হিসাবেই নেব।’

‘কোন কথাটা? তোমাকে বোকা বলা?’ 

‘নাহ, আপনার পরিবারের একজনের সাথে তুলনা করাটা।’ 

সিগারের আগুন নিভিয়ে ফেলল মি. ন্যান্সি। তারপর হলদে গ্লাভস থেকে কাল্পনিক ছাই ঝাড়ার কাজে মত্ত হলো। ‘একচোখার পছন্দ খুব একটা খারাপ না দেখছি।’ ওয়েনসডের দিকে তাকাল সে। ‘ভালো কথা, আজ রাতে কজন আসবে, জানো?’ 

‘খবর তো সবাইকেই পাঠালাম।’ বললেন ওয়েনসডে। ‘অনেকেই আসতে পারবে না। আবার অনেকে,’ চেরনোবোগের দিকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি। ‘আসতে চাইবে না। তবে আশা করি কমসে-কম কয়েক ডজন আসবে। খবরটা ছড়াতেও বেশি সময় লাগবে না।’ 

ডিসপ্লেতে রাখা অনেকগুলো বর্মের পাশ দিয়ে এগোল ওরা। কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা দরজা দিয়ে সবাইকে বের করে আনলেন ওয়েনসডে। (‘এত হাঁটাহাঁটি করতে পারব না,’ বলল ন্যান্সি। ‘আমার বয়স কম হয়নি। আর তাছাড়া, আমার বাড়িও উষ্ণ আবহাওয়ার এলাকায়।’) এরপর আরেকটা করিডর, তারপর আরেক দরজা দিয়ে বের হয়ে ওরা উপস্থিত হলো ক্যারোসেল রুমে। 

ক্যালিয়োপি সুর বাজছে—মাঝে মাঝে ভুল হচ্ছে সুর। যে দরজা দিয়ে ওরা ঢুকেছে, তার পাশেই ঝুলছে অনেকগুলো জীর্ণ, ক্যারোসেলে ব্যবহার করার ঘোড়া। কিছু রং-জ্বলা, কিছু ধুলো পড়া। মাথার ওপরে, ছাদ থেকে ঝুলছে কয়েক ডজন পাখাঅলা দেবদূত। দোকানে ব্যবহৃত মেয়ে পুতুল ব্যবহার করা বানানো হয়েছে ওগুলো। প্রাণহীন চোখে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে তারা। 

আর আছে ক্যারোসেলটা। 

সাইনবোর্ডের লেখা অনুসারে, দুনিয়াতে এর চাইতে বড়ো ক্যারোসেল আর নেই। ওটার ওজন, কয় হাজার বাল্ব ব্যবহার করা হয়েছে ইত্যাদির পাশাপাশি সাবধান বাণীও আছে: কেউ যেন ওর পশুগুলোর পিঠে না চড়ে। 

ক্যারোসেলের প্ল্যাটফর্মে বসানো পশুগুলো দেখে অবাক না হয়ে পারল না শ্যাডো। শত শত সচরাচর আকারের পশু দিয়ে সাজানো হয়েছে ক্যারোসেলটা। কী নেই! আসল প্রাণী, কাল্পনিক প্রাণী, দুটোর শঙ্কর-সব আছে। একই রকম দুটো পশু-মূর্তি বসানো হয়নি ওখানে। মৎস্য-কন্যা আছে, আছে সেন্টর আর ইউনিকর্ন; হাতি, বুলডগ, ফিনিক্স, জেব্রা, বাঘ, ম্যান্টিকোর, ব্যাসিলিস, রাজহাঁস…এমনকী সমুদ্র-দানোও আছে! প্রতিটা উজ্জ্বল রঙে রং করা, যেন আসল সবগুলোই। গানের তালে তালে ঘুরছে ক্যারোসেল, একটা শেষ হতেই আরেকটা বেজে উঠল। এক মুহূর্তের জন্যও থামল না ওটা! 

‘কাহিনিটা কী?’ প্রশ্ন করল শ্যাডো। ‘বুঝলাম, এটা দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো, অগণিত প্রাণী আছে এখানে, সবসময় চালু থাকে। কিন্তু কেউ চড়ে না কেন?’ 

‘মানুষের ব্যবহারের জন্য তো বানানো হয়নি এটাকে।’ বললেন ওয়েডসেনডে। ‘বানানো হয়েছে যেন সবাই দেখে মুগ্ধ হয়।’ 

‘ঠিক যেন প্রার্থনার চাকা ঘুরতেই থাকে…ঘুরতেই থাকে। শক্তি সঞ্চয় করে।’ বলল ন্যান্সি। 

‘অন্যদের সাথে আমরা কোথায় দেখা করছি?’ প্রশ্ন শেষ হয়নি শ্যাডোর। ‘আমি তো ভেবেছিলাম, এখানেই দেখা হবে। কিন্তু কেউ তো নেই!’ 

হাসলেন ওয়েনসডে; যে হাসি দেখলে রক্ত জমে যেতে চায়, সেই হাসি। ‘শ্যাডো,’ বললেন তিনি। ‘অনেক বেশি প্রশ্ন করে ফেলছ। তোমাকে তো প্রশ্ন করার জন্য পয়সা দেওয়া হয় না।’ 

‘দুঃখিত।’ 

‘তাহলে চুপ করে আমাদেরকে সাহায্য করায় মন দাও।’ বললেন ওয়েনসডে। হেঁটে গেলেন প্ল্যাটফর্মের এক পাশে, যেখানে ক্যারোসেলের বর্ণনা আর সাবধানবাণী টানানো আছে! 

কিছু একটা বলবে কি না, ভাবল শ্যাডো। কিন্তু তা না করে, চুপচাপ একের- পর-এক সবাইকে তুলে দিল প্ল্যাটফর্মে। ওয়েনসডেকে বেশ ভারী মনে হলো ওর; চেরনোবোগের তেমন সাহায্যের দরকার হলো না, শ্যাডোর কাঁধে হাত রাখল কেবল সে। এদিকে ন্যান্সির ওজন যেন পাখির পালকের সমান। প্ল্যাটফর্মে উঠে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল সবাই, এরপর ছোট্ট করে লাফ দিয়ে ঘূর্ণায়মান ক্যারোসেলের উপর উঠে পড়ল। 

‘দাঁড়িয়ে আছ কেন?’ ধমকে উঠলেন ওয়েনসডে। ‘আসবে না?’ 

শ্যাডো, একটু ইতস্তত করে উঠে পড়ল দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো ক্যারোসেলে। তবে তার আগে একবার পেছনে তাকিয়ে নিতে ভুলল না, হাউজ অন দ্য রকের কোনো কর্মী যদি ওকে নিয়ম ভাঙতে দেখে ফেলে! ক্যারোসেলে ওঠার পর অবাক হয়ে ভাবল ও-ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে যতটা দুশ্চিন্তা করেছে, এখানে নিয়ম ভাঙার ব্যাপার নিয়ে দুশ্চিন্তা তারচেয়ে বেশি! 

তিন বৃদ্ধের সবাই একটা একটা করে পশুর পিঠে চড়ে বসলেন। ওয়েনসডে বেছে নিলেন একটা সোনালি নেকড়ে; চেরনোবোগ একটা সেন্টর আর ন্যান্সি সিংহ। বাজনা বেজে চলছে ওদের চারপাশে, ঘুরছে ক্যারোসেল। 

হাসি ফুটেছে ওয়েনসডের মুখে, ন্যান্সি হাসছে প্রাণখুলে, এমনকী চেরনোবোগকে দেখে মনে হচ্ছে যে সে-ও মজা পাচ্ছে খুব। শ্যাডোর মনে হলো, বিশাল এক ভার যেন ওর কাঁধ থেকে নেমে গেছে। তিন বুড়োই উপভোগ করছে সময়টা। ওদেরকে যদি কেউ ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করেও দেয়, তাতে কী? পৃথিবীর বৃহত্তম ক্যারোসেলে চড়া তো হলো! ওঠা হলো এই সব রাজকীয় দানোদের পিঠে! 

নিজের জন্য একটা পশু বাছায় মন দিল শ্যাডো। প্রথমে পছন্দ করল একটা বুলডগ, এরপর সোনালি হাউদাসহ একটা হাতি। কিন্তু চড়ে বসল ইগলের মাথা আর বাঘের দেহঅলা একটা মূর্তির পিঠে। নীল দানিয়ুবের সুর বাজছে। মাথার উপর জ্বলজ্বল করছে হাজার হাজার বাতি। এক পলকের জন্য যেন আবার বাচ্চা হয়ে গেল শ্যাডো। চুপচাপ, শক্ত করে বসে রইল ইগল মাথা বাঘের পিঠে, কল্পনা করল যেন দুনিয়ায় ঘুরছে ওকে কেন্দ্র করে। 

বাজনা ছাপিয়ে হাসির আওয়াজ ভেসে এলো ওর কানে। এক মুহূর্ত পর বুঝতে পারল, ওটার তারই হাসি। গত ছত্রিশটা ঘণ্টা যেন দূর অতীত…যেন কল্পনা। শুধু এই অল্প সময়ই নয়, বিগত তিনটা বছর যেন কোনো বাচ্চার দুঃস্বপ্ন! যেন এখনও সে বসে আছে স্যান ফ্রান্সিসকোর গোল্ডেন গেট পার্কের ক্যারোসেলে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন ওর মা, গর্বিত চোখে সন্তানের দিকে তাকিয়ে আছেন। শ্যাডো ছোট্ট ছোট্ট হাতে শক্ত করে ধরে আছে আইসক্রিম, গলে গলে পড়ছে ওটা একটু একটু করে। মনে মনে প্রার্থনা করছে, কখনও যেন বন্ধ না হয় এই ক্যারোসেল… থেমে না যায় বাজনা…চলতেই থাকে…চলতেই থাকে। 

আচমকা বন্ধ হয়ে গেল বাতি… 

…আর দেবতাদেরকে দেখতে পেল শ্যাডো। 

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন